#অনিরডাইরি #কাঁথিরকিস্যা
শনিবারের সন্ধ্যা, জোর করে পড়তে বসেছি তুত্তুরী আর আমি। কে যে কাকে পড়াচ্ছে, বোঝা দায় যদিও। শৌভিক এখনও বাড়ি ফেরেনি। তমলুকে মিটিং ছিল। মিটিং এর মাঝে, ঘন্টায় ঘন্টায় তো আর ফোন করে জ্বালাতে পারি না, তাই মহকুমা শাসকের ড্রাইভার নূপুর বাবুকে ফোন করেছিলাম, "স্যার বেরিয়েছেন" কি না জানতে। তিনিও ধরেননি, পরে জানতে পারলাম, ধরবেন কি করে, তিনি তো ফোনটা বাংলোতেই ফেলে গেছেন।
ব্যক্তিগত নিরাপত্তা রক্ষী ছেলেটির নম্বর নেব নেব করেও আর নেওয়া হয়নি। ফলে whatsapp ই ভরসা। অফিশিয়াল নম্বরে আবার, ' বেরিয়েছ ' বা ' ওগো ফেরার সময় এক কিলো চিনি আর আড়াইশো পেঁয়াজ এনো তো' মার্কা বার্তা পাঠালে, খেপে ব্যোম হয়ে যায় শৌভিক। ব্যক্তিগত নম্বরে যে পাঠাব, সেটা আবার দিনে বার চারেকের বেশি দেখেন না তিনি। "বেরোলি? তুই এলে কফি খাবো " মেসেজটা বিগত দুই ঘন্টায় বার দুয়েক করে ফেলেছি। জবাব আসেনি। ভাবছি কি করব, ফোন করব কি না, এমন সময় বাংলোর নিরাপত্তা রক্ষী ভদ্রলোক এসে এক গাল হেসে, বার পাঁচেক মাথা চুলকে আর হাত কচলে বললেন, " ম্যাডাম এক ভদ্রলোক এসেছেন। বলছেন, উনি আগে এখানে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন। স্যারের সাথে কি দরকার-"।
কেজো সুরে জানালাম, স্যার তো নেই। কখন ফিরবে জানিনা। উনি হাত কচলে বললেন, ' আজ্ঞে ম্যাডাম, বলছিলাম- উনি বললেন, উনি আপনার সঙ্গে দুই মিনিট কথা বলতে চান।' কি সাংঘাতিক! এই শনিবার ভর সন্ধ্যায়, কোথাকার কে অজানা লোক, আমার সাথে কথা বলতে বাংলোয় চলে এসেছে? তমলুকে থাকতে এই এক জ্বালা ছিল, রাজ্যের লোক প্রথম প্রথম আমায় এসে ধরত, "আপনি একবার বললেই এসডিও সাহেব করে দিবেন/ ছেড়ে দিবেন।" কিছুতেই বোঝাতে পারতাম না যে, ওভাবে হয় না। সহবাস করলেও, পেশাগত ভাবে দুজন দুটো আলাদা জগতের বাসিন্দা।
আমার অফিসের ব্যাপারে যেমন আমি শৌভিককে নাক গলাতে দিই না। তেমনি ওর অফিসেরও কোন কিছু আমি জানতে চাই না। অফিসটাকে আমরা বাংলোর বাইরেই রাখতে সচ্ছন্দ বোধ করি। তাই বলে কি দপ্তরী কেচ্ছা করি না আমরা? কোন সমস্যা হলে, একে অপরের মতামত চাইনা আমরা? অবশ্যই চাই। কিন্তু ওইটুকুই। বরের কাজে মাতব্বরি করা আমার দুচক্ষের বিষ। ফেসবুকে ডায়েরি লেখা ছাড়া, এমনকি অপরিচিত বা অর্ধপরিচিত লোকজনের কাছে নিজেদের পেশাগত পরিচয় দিতেও স্বচ্ছন্দ বোধ করি না আমি। আমি অনিন্দিতা আর ও শৌভিক এই পরিচয়টুকুই তো যথেষ্ট।
সন্দিগ্ধ স্বরে জানতে চাইলাম, 'আপনি ওনাকে চেনেন?' উনি দুদিকে ঘাড় নাড়লেন। সন্ধ্যেবেলা পাকশালা সামলায় যে ছেলেটি, সেও জানালো, চেনা তো দূর, নামই শোনেনি কোনদিন। তাহলে? বললাম, বলুন স্যার এলে আসতে। না হলে সোমবার অফিস টাইমে স্যারের সাথে যোগাযোগ করতে।
ওরা দুজনে তাই বলতে গেল, আমি ফোন করলাম শৌভিককে। ঘড়িতে রাত পৌনে আটটা, এতক্ষণে যদি মিটিং নাও ভেঙ্গে থাকে একটা ফোনতো করা/ধরাই যায়। ফোন করতেই শৌভিক বললো, " এই বেরোলাম। ফোন করতেই যাচ্ছিলাম।" জানালাম নূতন অতিথির কথা। ব্যাপারটা বেশ ভয়ের যাই বলেন, আমার বরটা তো বিশেষ সুবিধের নয়। বরং বেশ ট্যাড়া। এদিক ওদিক তাকায় না, সোজা ব্যাটে খেলে। শত্রুও বেশ কিছু বানিয়েছে। কারা যেন হুমকি-টুমকি ও দিয়েছে, কত বড় এসডিও হয়েছে দেখে নেবে। সে সব গল্প শৌভিক ফুৎকারে উড়িয়ে দিলেও, আমার অত দুঃসাহস নেই।
ভেবেছিলাম উপহাস করবে বুঝি, শৌভিক হাসল না। ক্লান্ত স্বরে বলল, ' ভদ্রলোক বোধ হয় রিটায়ার্ড আইএএস অফিসার। হলদিয়ার এসডিও ছিলেন বোধহয়। আমার কাছেও এসেছিলেন। খুব গুছিয়ে কিছু বলতে পারছিলেন না, কথাবার্তা বেশ অসংলগ্ন মনে হয়েছিল স্বল্প পরিসরে। ভয় করলে দেখা করতে হবে না।'
অবসরপ্রাপ্ত আমলা মানে তো, আমার শ্বশুরমশাইয়ের বর্তমান আর আমাদের ভবিষ্যৎ। কেমন লাগবে যদি ওনাকে এমনি করে বাংলোর বাইরে থেকে ভাগিয়ে দেয় বর্তমান কোন আমলার গৃহিনী। ফোনটা রেখে বাগানে বেরিয়ে দেখি গেটের কাছে কার সাথে যেন কথা বলছেন সিকিউরিটি। জিজ্ঞাসা করলাম ভদ্রলোক চলে গেছেন নাকি? জবাব দিলেন," না ম্যাডাম। স্যারের হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরটা চাইছেন।" দৌড়ে গেলাম গেটের কাছে, এক বয়স্ক ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে আছেন। পরনে ইস্ত্রি বিহীন ফুলহাতা শার্ট আর প্যান্ট। এক মাথা অবিন্যস্ত কাঁচা পাকা চুল। থতমত খাওয়া হাবভাব।
করজোড়ে নমস্কার জানিয়ে বললাম, " মার্জনা করবেন স্যার। আসলে আমি ঠিক আপনাকে চিনতে পারিনি। এসডিও সাহেব বললেন আপনি আগেও এসেছিলেন। ভিতরে আসুন প্লিজ।"
উনি বললেন, ' আপনি আমার মেয়ের মতন। আমার মেয়েও আপনার বয়সীই হবে বুঝলেন। একটু নম্বরটা যদি-।' বললাম, নম্বর বলছি সেভ করে নিন। উনি নার্ভাস হয়ে সব পকেট হাতড়ে, মোবাইল ফোন খুঁজে না পেয়ে, বললেন, " আমি চোখে তেমন দেখতে পাই না বুঝলেন তো। একটু যদি কাগজে -'।
ভিতরে এনে বসালাম, পাকশালার ছেলেটিকে বললাম, এক কাপ ভালো করে চা করে আনুন তো। সে উল্টে একটা মিষ্টির প্যাকেট এগিয়ে দিয়ে বললে, " স্যার এনেছেন।" কি দরকার ছিল বলতে গিয়েও গিলে ফেললাম। ওই প্রজন্মকে বোঝা আমাদের সাধ্যাতীত। ভদ্রলোক নার্ভাস ভাবে হেসে, হালকা জড়ানো স্বরে বললেন, " আমার সুগার আছে তো, তাই সুগার ফ্রী মিষ্টি এনেছি।"
ডায়েরির পাতা ছিড়ে বড় বড় করে মহকুমা শাসকের নম্বরটা লিখে দিলাম। উনি গুরুত্বহীন ভাবে, ভাঁজ করে, পকেটে পুরে গল্প করতে লাগলেন। বললেন ওনার বয়স ৭৯ বছর। উনি কাঁথির ভূমিপুত্র। সংস্কৃতের ছাত্র। সংস্কৃতে কাব্যতীর্থ। ওনার স্ত্রীও সংস্কৃতে এমএ এবং তিনিও কাব্যতীর্থ। স্ত্রী বিগত সাত বছর ধরে পক্ষাঘাতগ্রস্ত। বিছানাটাই তার ঘরবাড়ি। শোনালেন, " রান্নার লোক আছে। সে মাসে ১০ হাজার টাকা বেতন নেয়। স্ত্রীর দেখাশোনা করার জন্য, আয়া আছে। সে নেয় মাসে ১৫ হাজার। যে জামাকাপড় কাচে, সে নেয় ২০০০ টাকা। এছাড়াও বাজার- মাছ যা লাগে, ফোন করে বললেই দিয়ে যায়।" বললেন, "চোখে তেমন দেখতে পাই না তো, তাই একটা টোটো রেখেছি। তাকে ফোন করে বললে, সেই এদিক ওদিক নিয়ে যায়।"
পক্ষাঘাতের অংশটুকু বাদ দিলে বাকি ওই বয়সী সব দম্পতিদের একই গল্প। জানতে চাইলাম সন্তানাদির কথা। বললেন একটি কন্যা সন্তান। তিনি কোন নামী স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা। জামাতাও পেশায় শিক্ষক। বললেন মেয়ে আগে ওঁদের সাথেই থাকত। বর্তমানে কর্মসূত্রে এই জেলারই অন্য শহরের বাসিন্দা।
এই জেলার জনৈক নামী নেতার নাম করে বললেন, ও আমার সম্বন্ধী। বুঝতে না পেরে প্রশ্ন করলাম, উনি আপনার শ্যালিকাকে বিবাহ করেছেন? ভদ্রলোক হেসে কইলেন, " নানা আমি ওর বোনকে বিয়ে করিছি।"বললেন, " জানেন ও আমার সম্বন্ধী বলে, আমাকে হলদিয়া থেকে সরিয়ে দেয় তৎকালীন সরকার। অফিসে ভাঙচুরও করে অমুক-"। ভাঙচুর যিনি করেছিলেন, তিনি এককালে দুই মেদিনীপুরের ত্রাস ছিলেন। বর্তমানে অবশ্য সবটুকুই অতীত বা ভূত।
ভদ্রলোকের কথাবার্তা বেশ অসংলগ্ন। হুট করে কোথা থেকে কোথায় চলে যাচ্ছেন বোঝা দায়। এই আসানসোলে বিডিওগিরি করছেন, তো এই গেলেন ডায়মন্ড হারবারে। অনেক বড় বড় অফিসারের নাম করলেন, যাদের সঙ্গে উনি এককালে কাজ করেছেন। কাউকেই তেমন চিনতে পারলাম না, একজন ছাড়া। ভদ্রলোক এককালে লেবার কমিশনার ছিলেন। আমরা যখন চাকরিতে ঢুকি, উনি তখন আমাদের দপ্তরের মুখ্য সচীব। একজনকে অন্তত চিনতে পারার সাথে সাথেই, এনার মুখে জ্বলে উঠল হাজার ওয়াটের আলো।
বললেন আসানসোলে থাকতে থাকতেই দুষ্কৃতিদের ছোঁড়া বোমার স্প্লিন্টার লেগে ক্ষতিগ্রস্ত হয় চোখ। "এখন তো আরোই কম দেখি, তোমাকে সরি আপনাকে যেমন একদম ঝাপসা দেখছি। শুধু অবয়বটাই যা, বুঝতে পারছি। অনেক ডাক্তার দেখিয়েছি জানো/জানেন, ঠিক হয়নি। উত্তরোত্তর বিগড়েছে।"
কথা ঘোরাতে প্রশ্ন করলাম হলদিয়ার এসডিও থেকে কোথায় গেলেন? উত্তর দিলেন, " আর বলবেন না। সেই কুচবিহার এডিএম অর্ডার হল। আমি যাইনি। পরিবারকে ফেলে অতদূর যাবার মতন অবস্থা তখন ছিল না। তখন দিল কলকাতায়, কম্পালসারি ওয়েটিং এ। রাইটার্স বিল্ডিংয়ে এমন একটা ঘর দিল, যেখানে একটা পাখা পর্যন্ত ছিল না। এদিকে হাজিরা নিয়ে কি কড়াকড়ি। একটা মেস বাড়িতে থাকতাম আরো বেশ কয়েকজনের সঙ্গে। সে এক অভিজ্ঞতা- "
মেস বাড়ির অভিজ্ঞতার মাঝখানে, ফোন করলো শৌভিক, জানতে চাইলো কি অবস্থা? বললাম চায়ে পে চর্চা করছি আমরা। শৌভিক ভুল বুঝেছিল, উনি আইএএস ছিলেন না বটে, তবে উনি রাজ্য সিভিল সার্ভিসে আমার শ্বশুরমশাইয়ের ব্যাচমেট। ১৯৭৮ এর স্পেশাল ব্যাচ এতটাই বড় ছিল, যে আমার শ্বশুরমশাইয়ের নাম করতে গিয়েও আর করলাম না। এই মুহূর্তে এনার স্মৃতিশক্তি বা মনোযোগ কোনটাই তেমন প্রবল নয়। দু একটি কথা বলতে গিয়ে দেখলাম, ইনি শোনার থেকে শোনানোতে বেশি উৎসাহী। এটাই হয়তো বয়স বাড়ার লক্ষণ। নিজের মধ্যেও এই লক্ষণের পূর্বাভাস পাই আজকাল। সাগ্রহে শুনতে লাগলাম ওনার গল্প।
রাইটার্স থেকে অবশ্য আবার এডিএম হয়ে ফেরত আসেন তমলুক। তখনও অবিভক্ত মেদিনীপুর। ২০০৪ সালে ভদ্রলোক অবসর নিতে নিতে, এসে পৌঁছায় শৌভিক। দেখলাম ভদ্রলোক যাকে না পেয়ে, তার সহধর্মিনীর সাথে দেখা করতে উদগ্রীব ছিলেন, গল্পের ঝোঁকে বিস্মিত হয়েছেন তার সাথে সাক্ষাতের কারণ। এমন কি শৌভিকের সঙ্গে বেশ কিছুক্ষণ গল্প করার পরেও, মনে পড়ল না। ভদ্রলোক এমন ভাবে মাথা চুলকাচ্ছিলেন, মায়া লাগছিল রীতিমত। শৌভিক বলল, " বাড়ি ফিরবেন তো? আমার গাড়িটা তো ফিরছেই, আপনাকে নামিয়ে দিয়ে যাবে।"
ভদ্রলোক উঠে দাঁড়ালেন, একটা নোংরা রুমাল বার করে মুখটা মুছলেন, তারপর লাজুকভাবে এক গাল হেসে বললেন, " বাড়ি না ক্লাবে যাব। বাড়িতে বিড়ি সিগারেট ফুঁকতে দেয় না বউ। অশান্তি করে শুয়ে শুয়েই। তাই ক্লাবে যাই, বিড়ি না ফুঁকলে আবার পেট সাফ হয় না কিনা।" আসি, তাহলে, বলে অনুমতি দিলেন ভদ্রলোক। আমরাও বললাম সাবধানে যাবেন। ভালো থাকবেন। দুটো সিঁড়ি ভেঙে নামতেই যে হারে থরথর করে কাঁপছিলেন ভদ্রলোক, এ বুড়া কিভাবে যে রাতের বেলা একা বাড়ি ফিরবে কে জানে? ফোনটাও তো সঙ্গে করে আনেন নি। ওই ব্যাচের সিভিল সার্ভেন্টদের পেনশন কত, আমাদের থেকে ভালো কেউ জানে না। ভদ্রলোক আবার শ্বশুরমশাইয়ের বছর পাঁচেক আগেই অবসর নিয়েছিলেন। ফলে কি পান সহজেই অনুমেয়। পেনশনারদের তো আর ইনক্রিমেন্ট হয় না, DA টুকুই ভরসা। সে প্রসঙ্গে আর মুখ না খোলাই ভালো। ওষুধ,পথ্য, ডাক্তার, আয়া, বাজারদর কেউ তো আর বয়স দেখে রেয়াত করে না। ফলে কমাতেই হয় জীবনধারণের মান।
সময় কাউকেই রেয়াত করে না, আজ আপনি যতই দোর্দণ্ডপ্রতাপ হোন না কেন, হাতে মুণ্ড কাটুন না কেন, কালকে আপনার গল্পটাও আর পাঁচজনের মতোই হবে। তাও যে কেন ভুলে যাই আমরা, মত্ত হয়ে পড়ি অর্থ, পদ আর শক্তির আস্ফালনে। ভুলে যাই, কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না শেষ কালে। শেষ অঙ্কে সবাই সমান।
No comments:
Post a Comment