Wednesday 30 September 2015

অনির ডাইরি ২৯শে সেপ্টেম্বর ২০১৫

জাতীয়তাবাদের ঢল নেমেছে। তেরঙ্গায় মুড়ে গেছে ফেসবুক। হাবাগোবা মহিলা শ্রমিক আমি, ডিজিটাল ইন্ডিয়ার ফান্ডাটাই বুঝি না। সকালে কাগজ দেখার সুযোগ হয় না, খুব একটা ঔৎসুক্য ও নেই, ফলে সমসাময়িক ঘটনাবলী সম্পর্কে একেবারেই অজ্ঞ ।এমনকি তথাকথিত পেজ থ্রী সেলেব দেরও খুব একটা চিনি না। সেদিন এক বন্ধু এক অপরূপার ছবি পাঠাল, রক্তবর্ণ বসনে স্বয়ং ঊর্বশী, কেবল হাতে একটি ত্রিশূল । কোথায় যেন দেখেছি, কোন সিনেমা, কিছুতেই মনে করতে পারলাম না, সাধারণত সর্বসমক্ষে নিজের অজ্ঞতা যাতে না প্রকাশ পায়, সে ব্যাপারে আমি অত্যন্ত যত্নশীল কিন্তু লজ্জার মাথা খেয়ে সেদিন জিজ্ঞাসা করতে বাধ্য হলাম, যে অভিনেত্রীর নামটা যেন কি? পেটে আসছে বটে তবে --- । বন্ধু বেশ কিছু বাছাই অসংস্কৃত শব্দ প্রয়োগ করে জানাল, উনি একজন পুণ্যাত্মা সন্যাসিনী।
যাই হোক, সকাল বেলা ফেসবুক খুলেই চমকে উঠলাম, ব্যাপার কি? হঠাৎ করে সবাই তেরঙা ছবি লাগাচ্ছে কেন? দেশের বাবার জন্মদিন আসতে বিলম্ব আছে, আর দেশের বাবাকে উদোম খিস্তিখেউড় করাটাই তো হেপ এণ্ড হ্যাপেনিং। ওনার সম্পর্কে বিন্দুমাত্র না জেনেও যত বিকৃত ভাষায় ওণার সমালোচনা করতে পারবেন, তত বোদ্ধা হিসাবে আপনার নাম ছড়াবে। মাঝে ঝালনুন হিসাবে নেতাজীর সাথে ওণার একটু তুলনা, আঃ জমে ক্ষীর । আজও কতলোক যে ওণাদের বেচে খাচ্ছে। সেদিন দেখলাম জনৈক গবেষক নানা তথ্য দিয়ে প্রমাণ করেই ছেড়েছেন যে গান্ধীজী ঘোরতর বর্ণবিদ্বেষী ছিলেন।
মোদ্দা কথা হল, বাপুর জন্মদিন নয়, স্বাধীনতা বা প্রজাতন্ত্র দিবস ও নয়। তবে কি হল রে বাবা? প্রোফাইল পিকচার তো আমিও ঘনঘন পাল্টাই। নার্সিসিস্ট হওয়া মোটেই দোষের নয়। পরের খুঁত দেখার থেকে নিজেকে নিখুঁত দেখা ভাল। কিন্তু নতুন ছবি কেউ লাগায়নি, পুরানোটাই তেরঙা হয়ে গেছে। ওপরে লেখা “ডিজিটাল ভারতের সমর্থনে । ” ব্যাপারটা কি? যত বেলা বাড়তে লাগল, তেরঙা ছবির সংখ্যা বাড়তে লাগল। কিছুকাল আগে আমেরিকায় সমকামী বিবাহ আইনসিদ্ধ হওয়াতে বহু লোক এরূপ রামধনু রঙের ছবি লাগিয়েছিল। যে দেশে সম্মান রক্ষার্থে খুনজখম আকছার হয়, যেখানে এখনও গাড়ু নিয়ে লোকে মাঠে ছোটে, সমকামী এবং হিজরার প্রভেদ বোঝাতে চুল ছিড়তে হয়, তারাও আমেরিকান সমকামীদের জয়ের উল্লাসে সাত রঙে রাঙিয়ে ফেলল আননবই। মন্দ কি। যতক্ষণ আপনার পুত্র -কন্যা, ভাই- বোন বিষমকামী থাকছে, হেপ হতে সমস্যা কোথায়। হলে পঞ্চম বেদ তো রইল।
কিন্তু ডিজিটাল ভারতটা কি? খায় না মাখে? বেশ কয়েকজনকে প্রশ্ন করলাম, উত্তর এল না বটে তবে তাদের ছবিগুলি চটপট তেরঙা হয়ে গেল। শেষে আমার এক ভগিনীসম সহকর্মী জানাল যে প্রতিটি গ্রাম কম্পুটর দিয়ে ঢেকে ফেলা হবে। অন্তরজালে মুড়ে যাবে ভারতবর্ষ । দীন ,দরিদ্র , অর্ধউলঙ্গ, পূর্ণ উলঙ্গ ভারতবাসীও আননবই পড়তে পারবে। বাঃ বলতে গিয়েও থমকালাম, পড়বে কি করে? অক্ষরজ্ঞান থাকলে তো? বন্ধু বলল, এসব গাড়ল মার্কা প্রশ্ন করলে তোমাকে আই এস আই এর এজেন্ট বলবে। ঠিক । ঠিক। মুখবন্ধ করে কল্পনা করছি, আমার মামার বাড়ির গ্রাম, সুদূর মুর্শিদাবাদের একটা অখ্যাত গ্রাম, আর অখ্যাত থাকবে না। পাষানী গয়লানী , ইসমাইল মাষ্টার, অশোক মুদি, নারান হাড়ির গৃহপরিচারিকা বউ, খোঁড়া অনাথা সরস্বতী মাসি সবাই ল্যাপটপ নিয়ে ঘুরবে। ট্যাবলেট হাতে বুনো পাড়ার ছেলেগুলো বাগালি করতে যাবে। এমনকি বুনোপাড়ার ঘরে ঘরে যখন ধেনো মদ তৈরি হবে তখনও----- “বড়িয়া হ্যায়”।
‪#‎Anirdiary‬ ‪#‎Aninditasblog‬

Monday 28 September 2015

গোধূলি



ধুলো পুরু আস্তরনে আবৃত আমি,
ছুঁয়েও দেখো না,
গলা জড়াই  কাতর আবদারে, ভালবাসবে একটু?
বিরক্ত তুমি, “কি করে বাসতে হয়”?
সরে আসি নীরব বেদনায়,
জানি প্রেম আছে, শুধু হারিয়ে  গেছে
সেই কবোষ্ণতা ।
আঙুলের  ফাঁক দিয়ে দ্রুত চুঁইয়ে পড়ছে সময়।

Thursday 24 September 2015

মন ভালো নেই

মন ভালো নেই, আমিও না।
কিন্তু কেন? যা চেয়েছি, তাই তো পেয়েছি,
দীর্ঘ ভাবনা-চিন্তা, অনেক হিসাব-নিকাশ কষে, তবেই তো চেয়েছিলাম।
কেমনে আজ বলি, সব ভুল?
জানতাম, তুমি কেমন, আমারই মনের মত,
শত বিনিদ্র যামিনীর স্বপ্ন- কল্পনা ওপর পরতে পরতে জমা রক্ত, মাংস, চামড়া, রোমরাজি।
বড় প্রিয়, বড় আপন, প্রতিটি রোমকূপ,আমারই তো প্রতিচ্ছবি ।
তবে কেন এ বিষাদ, কার তরে মন উদাস? কার প্রতি অবহেলা?

সবই বুঝি অলস মায়া, নিখাদ দুঃখবিলাস।
image courtesy- Google

সহযাত্রী (পর্ব -৪)


সুমি আর কলির দৌলতে দাশনগর থেকে কোলাঘাট যেতে মন্দ লাগত না, কোলাঘাটে ওরা নেমে যাবার পর আবার দুঃসহ একাকীত্ব। মোবাইলে টাওয়ার থাকত না। এফ এমও ধরা যেত না। টাইমস অব ইন্ডিয়া মুখস্ত করতে করতে কোন মতে খড়গপুর পৌঁছত শিলালিপি। ফিরতি ট্রেনে বাড়ি ফিরে যাবার অদম্য ইচ্ছেটাকে কবর দিয়ে, চূড়ান্ত বিরক্তি নিয়ে দুনিয়ার দীর্ঘতম প্লাটফর্ম পার হয়ে, সম্ভবত খাড়াইতম ওভার ব্রিজ টপকে, হাফ মাইল হেঁটে অটো স্ট্যান্ড। স্টেশনের সামনেই রিক্সাস্টান্ড, তবে রিক্সাওয়ালা গুলিকে স্বচ্ছন্দে ডাকাত বলা যায়,  প্রত্যহ ওদের সাথে দরাদরি অথবা বচসা করা শিলালিপির দুঃস্বপ্ন মনে হত। সুতরাং অটো ছাড়া গতি ছিল না। অটোতে অবশ্য মিনিট সাতেকের বেশি লাগত না অফিস পৌছতে।
পোঁছেই বা কি লাভ হত? কোন অজ্ঞাত কারণে, সমস্ত কর্মযজ্ঞ থেকে শিলালিপি ছিল বঞ্চিত। কাজ বলতে এক আধো অন্ধকার ড্যাম্প ধরা, স্যাঁতস্যাঁতে ঘরে সারাদিন গালে হাত দিয়ে বসে থাকা। মাসে একবার একটা রিপোর্ট সই করে কলকাতা নিয়ে যাওয়া ছাড়া এক কথায় শিলালিপি সম্পূর্ণ বেকার। ঘরটিতে তিনটি জানালা, যার মধ্যে দুটি বাইরে থেকে ইট দিয়ে গেঁথে বন্ধ করা। তৃতীয় জানলাটি খোলে বটে, প্রচণ্ড বর্ষা আর তীব্র শীতেও তাকে খুলেই রাখতে হয়, উপায়ন্তর নেই, পাল্লা ভাঙা। চেম্বারে একটা ফোন পর্যন্ত দেওয়া হয়নি, মাঝে মাঝে শিলালিপির মনে হত জগত বিচ্ছিন্ন এক দ্বীপে ওকে নির্বাসন দেওয়া হয়েছে।
বিকাল পৌনে পাঁচটা বাজলে, বন্দী দশা ঘুচত। সারা দিন বসে থাকার ক্লান্তি আর চূড়ান্ত হীনমন্যতা নিয়ে গুটি গুটি বেড়িয়ে পড়ত শিলালিপি। ফেরার মেদিনীপুর লোকালে সহযাত্রী বলতে যারা ছিল, প্রায় সকলেই ডাই ইন হারনেস কেসে চাকরী পাওয়া বিভিন্ন বয়সী রেলের চতুর্থ শ্রেণীর মহিলা কর্মচারী। অতি সাধারণ বেশভূষা, কাঁধে বা হাতে সস্তার ব্যাগ অথবা বাজারের চটের থলে। ট্রেন ছাড়লেই প্রত্যেকের ঝোলা থেকে বের হত, মস্ত এক প্ল্যাস্টিকের প্যাকেট ভর্তি মুড়ি। একটু পড়েই ঝালমুড়ি, চপ আর চা ওয়ালারা উঠত। কেউ চপ কিনে, চটকে মেখে নিত মুড়ির সাথে, কেউ বা মুড়ি ওয়ালাকে পয়সা দিয়ে মাখিয়ে নিত, সাথে গরম চা। প্রাতকালে শিলালিপি যখন ঘুম থেকে ওঠে, তখন ওরা ট্রেন ধরে। দুপুরে রেলের ক্যান্টিনের ভাত আর সকাল বিকাল মুড়ি, বাঁধাধরা রুটিন। পরে একজন শিলালিপিকে জানিয়েছিল, শুধু দুই বেলা মুড়ি আনবার জন্য ওরা নিয়মিত প্ল্যাস্টিকের প্যাকেট কেনে। যাইহোক, আপাত সাদাসিধে মানুষ গুলির সাথে শিলালিপির খুব কমই ভাব বিনিময় হত। ফেরার পথে মন খারাপ করে বসে  থাকা ছাড়া গত্যন্তর নেই।
সেদিনও তার ব্যতিক্রম হয়নি, সবে ট্রেন খড়গপুর প্ল্যাটফর্ম ছাড়িয়েছে, মহিলারা যে যার মুড়ির প্যাকেট বার করবে করবে করছে, হটাৎ তীব্র গোলযোগ। হইচই, চিৎকার, সপাটে চড় মারার শব্দ এবং অবশেষে ভেউভেউ কান্না। কৌতূহলী হলেও সিট ছেড়ে উঠল না শিলালিপি, পার্শ্ববর্তীনী নিত্যযাত্রীরা দৌড়ল। মহিলা কামরায় ঝগড়াঝাঁটি কালেভদ্রে হয় না। নারদের নিত্য বসবাস। তবে মারামারি আজ অবধি দেখার দুর্ভাগ্য হয়নি শিলালিপির। একটু পরেই  মহিলারা যে যার সিটে ফিরল, সাথে এক ক্রন্দনশীলা তরুণী। দেখলেই বোঝা যায়, নির্ঘাত বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী, নতুবা হবু ছাত্রী। সেদিন ট্রেনে বেশ ভিড় ছিল, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তিন জনের জায়গায় চার জন কষ্টেসৃষ্টে বসেছিল। এই নিয়েই ঝগড়া এবং হাতাহাতি। জনৈক ডেইলি পাষণ্ড মহিলা ঐ তরুণীকে সাঁটিয়ে এক চড় কশিয়েছেন। ঘটনাপ্রবাহের আকস্মিকতায় হতভম্ভ হয়ে বেচারি মেয়েটি রণে ভঙ্গ দিয়ে করুণ সুরে কাঁদছিল। “আমাকে আমার মা বাবাই কোনদিন মারেনি। সামান্য একটু সিটের জন্য এভাবে কেউ মারে?” শিলালিপির আশে পাশের সহযাত্রীরা নানা ভাবে সান্ত্বনা দিচ্ছিল। একজন চা কিনে দিল, মেয়েটি তবু ফুঁপিয়েই চলেছে, শিলালিপি, খানিক পরে অবিশ্বাসের সুরে পার্শ্ববর্তিনীকে জিজ্ঞাসা করল, “সত্যই মেরেছে?কে মারল দিদি?”
মহিলা ঠোঁট মুচড়ে বলল, “ঐ দেখছু না, ঐ মেয়েছেলেটা। কেউ মারে বল? আহা কেমন ফোঁপাচ্ছে দেখছনি। ওকে কাঁদতে দেখে, আমার মেয়েটার কথা মনে পড়ছে গো।” বৃদ্ধার অঙ্গুলি অনুসরণ করে শিলালিপি দেখল, দূরে এক ঘোর কৃষ্ণ বর্ণ মহিলা, আহত জন্তুর মত, ওদের দিকে তাকিয়ে আছে। সন্ধ্যার আবছায়া আলোতে কপালে লাল টিপটা জ্বলজ্বল করছে, দেখেই মনে হবে, স্বয়ং মা শিতলা, ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। গা ছমছমিয়ে উঠল শিলালিপির।
দিন কয়েক পরের কথা, সকালের ট্রেনটা সবে মেচেদা ছারিয়েছে,মহিলা কামরা মোটামুটি খালি, ইতস্তত বিক্ষিপ্ত ভাবে, কিছু নিত্যযাত্রী বসে আছে, শিলালিপি যথারীতি টাইমস মুখস্ত করার বৃথা চেষ্টা করছিল, অকস্মাৎ সেদিনের সেই রণচণ্ডী মহিলা এসে ধপ করে ওর পাশে বসল। এই সিটে সাধারণত আট জন বসে, বর্তমানে মাত্র শিলালিপিকে নিয়ে মাত্র জনা তিনেক মহিলা বসে আছেন। ঠেসাঠেসি বা মারামারি হবার সম্ভবনা ক্ষীণ তবু শিলালিপি একটু জানলার দিকে চেপে বসল। মহিলা অবশ্য দিব্যি খোশ মেজাজে উল্টো দিকে বসা নিত্যযাত্রীনীর সাথে গল্প জুড়লেন। না না বিষয়ে কথা হচ্ছে, হাসির ফোয়ারা ছুটছে মাঝে মাঝেই, হঠাৎ মহিলা ওকে কনুই এর খোঁচা মেরে বলল, “ কি বল, ভাই তাই না?”
“অ্যাঁ? তাই কি? শুনিনি সরি।” মারের ভয়ে সরি বলল বটে, মনে মনে বলল, তোমাদের ভ্যাজোর ভ্যাজোর খামোখা শুনতে যাব কেন বাপু।  মহিলা হাসতে হাসতে  বলল, “এই সব রঙ, তোমাদের মানায়, আমাদের বয়সে কি চলে? কি করব ভাই, ছেলের শ্বশুর বাড়ি থেকে পুজোয় দিয়েছে, তাই পরা।” শিলালিপি জবাবে দেঁতো হাসি হাসল। কিছু পরে ট্রেন আরও ফাঁকা হয়ে গেল। উল্টো দিকের নিত্যযাত্রীনীও নেমে গেলেন। খড়গপুর আসতে তখনও এক ঘণ্টা, মা শীতলা বকেই চলেছে, শিলালিপিরও মন্দ লাগছিল না, বেশ গ্রাম্য সরল মনে হল মহিলাকে। এক চপওয়ালা উঠল, প্রায় খালি ঝুড়ি নিয়ে, মা শীতলা তার সাথে দরাদরি করে, ঠাণ্ডা ডিমের চপ কিনল, আলুর চপের দরে। মুড়িও কেনা হল এক ঠোঙা, অতঃপর ওনার উপরোধে শিলালিপিকে খানিক খেতেও হল, মন্দ লাগছিল না, সময়টা বেশ দ্রুত কাটছিল। ট্রেন যখন খড়গপুর ধুকছে, শিলালিপি অবশেষে জিজ্ঞেস করল, “ দিদি আপনার নাম কি?’’
মহিলা লাজুক হেসে বলল, “ঊষাঙ্গিনি। সবাই ঊষাদি বলেই ডাকে। তুই এত দূর থিকে আসিস, আমার নম্বরটা রেখে দে, দরকারে বলিস।” এভাবেই ঊষাঙ্গিনির সাথে, শিলালিপির আলাপ, তবে বন্ধুত্ব দ্রুত জমেনি, জমতে সময় লেগেছে। লিপিলেখার সাথে দেখা হয়েছিল, এরও বেশ কিছুদিন পর, সৌজন্য ঊষাঙ্গিনি। লিপিলেখা ডেইলি পাষণ্ডগিরি শুরু করার দিন দুয়েকের মধ্যেই কি ভাবে যেন, ঊষাঙ্গিনির সাথে আলাপ জমিয়ে ফেলে, শিলালিপি তখন ছুটিতে। ঊষাঙ্গিনি লিপিলেখাকেও নিজের নম্বর দিয়ে একই ভাবে বলেছিলেন, বিপদে আপদে ওনাকে ফোন করতে। ওনার এই আপেক্ষিক উদারতায়, শিলালিপি না গললেও লিপিলেখা গলে যায়। ঊষাঙ্গিনি অচিরেই হয়ে ওঠে লিপিলেখার ঊষা কাকিমা।পরে যদিও শিলালিপি এবং লিপিলেখা আবিষ্কার করে, যে ঊষাঙ্গিনি ওদের নম্বর তো দিয়েছিল, কিন্তু ফোনটা সঙ্গে না এনে প্রায়দিনই বাড়িতেই রেখে আসেন, এই নিয়ে শিলালিপি এবং লিপিলেখার যুগ্ম আক্রমণের সামনে, উনি অসহায় ভাবে শুধু বলেছিলেন, “কি করব বল? নাতির আব্দার কি ফেলা যায়। তাতে কি? তোরা আমার অফিসে ফোন করবি, বড় সাহেবের ঘরে বটে ফোনটা, ও উনি ডেকে দিবেন। ”

(চলবে)

Sunday 20 September 2015

সহযাত্রী পর্ব-৩


অবশেষে ট্রেন এল, লোকাল ট্রেন বেশি ক্ষণ দাঁড়াবে না, ঐ অতি স্বল্প সময়ে মেয়ে ঠিকঠাক ট্রেনে উঠতে পারবে কি না, এই নিয়ে উর্বশী দেবীর বেজায় দুশ্চিন্তা ছিল, মাকে সাময়িক ভাবে ভুল প্রমাণিত করে তড়িঘড়ি মহিলা কামরায় উঠেও পড়ল শিলালিপি। হাওড়া থেকেই মোটামুটি ভর্তি হয়ে এসেছে ট্রেনটা। তবুও কিছু বসার সিট খালি ছিল, দৌড়ে গিয়ে বসতে গিয়ে এক চোট ধাক্কা খেল শিলালিপি, ভাবলেশহীন মুখে এক সুসজ্জিতা রমণী, তৎক্ষণাৎ ঐ সিটের ওপর তাঁর ব্যাগটি রেখে জানানলেন, “জায়গা আছে।” কার জায়গা, কিছু বুঝতে পারল না শিলালিপি, সবাই বসেই আছেন, মহিলাকে প্রশ্ন করার অবকাশ পেল না, কারণ ততক্ষণে তিনি পার্শ্ববর্তী মহিলার সাথে, পুনরায় গল্পে মসগুল হয়ে পড়েছেন। মন খারাপ করে অন্য সিটে বসতে গেলেও পুনরায় একই অভিজ্ঞতা হল। ইতিমধ্যে পরবর্তী স্টেশন এসে গেল, বেশ কিছু সুদর্শনা রমণী, ওর পাশ কাটিয়ে গিয়ে সংরক্ষিত সিটে বসেও পড়লেন, বোকার মত কাঁধে ব্যাগ আর হাতে টিফিনের ঝোলা নিয়ে কিংকর্তব্যবিমুড় হয়ে দাঁড়িয়েই রইল শিলালিপি। কান্না পাচ্ছিল, কোনমতে ঠোঁট কামড়ে উদ্গত কান্না সংবরণ করল, কারণ অজান্তেও অনুভব করছিল, বেশ কয়েক জোড়া চোখ তীব্র দৃষ্টিতে ওকে পর্যবেক্ষণ করছে। কি করা যায়? তবে কি আবার বাড়িতেই ফোন করে জিজ্ঞেস করবে? নাকি জলপাইগুড়িতে সৌরকে ফোন করবে? সে তো মাঝে মাঝে নাকি লোকালে সওয়ারি করত। নাকি অপেক্ষা করবে? এমন সময় হঠাৎ কলাবতী অর্থাৎ রম্ভার ফোন, “কি রে? ট্রেনে উঠতে পেরেছিস?” কোন মতে গলা ঝেড়ে জবাব দিল, শিলালিপি, “হ্যাঁ মাসিমণি।”
“হুঁ। বসতে পেয়েছিস?” চোখ ছলছলিয়ে উঠল শিলালিপির, কিছু বলতে গেলেই কেঁদে ফেলবে, তাই চুপ করে রইল। রম্ভা আবার বললেন, “পাসনি তো? জানতাম। কি বলছে? আসন সংরক্ষিত?” “হ্যাঁ।”
“বুঝেছি। এই জন্যই এদের ডেইলি পাষণ্ড বলে। তাও তো সাউথ ইস্টার্ন অনেক ভাল। শোন এমনি জায়গা পাবি না। দেখ কোথায় তিন জন বসে আছে, সেখানে গিয়ে বল, একটু চেপে বসুন তো। বললেই অভ্যাস বশতঃ ওরা একটু সরে বসবে। একটু কষ্ট করে বসে যা, বাগনানে সব নেমে যাবে। বুঝেছিস?” মাসির প্রতি কৃতজ্ঞতায় শিলালিপির মনটা ভরে উঠল, আপাত কঠিন রম্ভার মনে যে ন্যাদোশ আলু ভাতে মার্কা বোনঝির জন্য কতখানি দরদ আছে, তার পরিচয় অবশ্য এর আগেও ও বহুবার পেয়েছে। রম্ভার উপদেশ অব্যর্থ। কোনমতে কষ্টেসৃষ্টে বসতে পেল শিলালিপি।
গভীর মনোযোগের সাথে সহযাত্রী দের পর্যবেক্ষণ করতে লাগল শিলালিপি, প্রায় সকলেরই পরনে পরিপাটি করে পড়া সুতির শাড়ি,  হাল্কা প্রসাধন, গম্ভীর মুখ, পরিমিত হাসি, এক কথায় ভয়াবহ রকম মার্জিত। মাঝে মাঝে দু একজন অবশ্য সিল্ক বা সস্তার সিন্থেটিক শাড়ি পড়েছেন। ওনাদের বাক্যালাপ অল্পক্ষণ শুনলেই বোঝা যায়, এঁরা সকলেই শিক্ষিকা। বাপরে সবাই শিক্ষিকা আর মাঝে একজন ছাত্রী। মনে মনে প্রমাদ গুনল শিলালিপি।
দিন কয়েক কাটল। মোটামুটি মুখ চেনা হয়ে গেছে, রম্ভা বলেই ছিলেন, যে অচিরেই শিলালিপিকেও ওরা ওদের একজন হিসাবে গণ্য করবে। ততটা না হলেও, আজকাল বসতে গেলে কেউ বলে না যে, সিট রাখা আছে। দীর্ঘ পথ তো আর মুখ বুঝে যাওয়া যায় না, অগত্যা সহযাত্রীদের নিয়ে গবেষণা শুরু করল শিলালিপি, শিক্ষিকাদের মধ্যে দুটি সুস্পষ্ট দল আছে, একদল প্রাক এস এস সি যুগের, অপর দল এস এস এস সি দিয়ে ঢোকা শিক্ষিকাকুল। প্রাক্তনিদের বক্তব্য হল, তাঁরাই প্রকৃত শিক্ষিকা। তাঁরা ভালবেসে পড়ান, নিছক চাকরী করেন না। বিদ্যালয়ের প্রয়োজনে তাঁরা সর্বদাই হেডুর সাথে সহযোগিতা করেন, বিশেষ কাজে ছুটির দিনেও আসতে ওনাদের আপত্তি নেই। বা থাকলেও তা মৃদু। উগ্র সাজগোজ করেননি,শাড়ি পরব না, সালোয়ার দাও বলে বায়নাক্কা করেননি, ইত্যাদি ইত্যাদি। অপর দিকে নবীনাদের বক্তব্য হল, তাঁরা রীতিমত পরীক্ষা দিয়ে উত্তীর্ণ হয়ে চাকরী পেয়েছেন, কোন দাদা দিদি মাসি মেসো ধরে নয়। সুতরাং অকারনে কাউকে খাতির করে চলার প্রশ্নই ওঠে না। প্রাক্তনিরা সকলেই বাড়ির কাছাকাছি স্কুলে পড়ান, তাই তাদের পক্ষে অতিরিক্ত সময় ব্যয় করা কোন সমস্যা নয়, কিন্তু সল্টলেক থেকে কোলাঘাট বা গড়িয়া থেকে পাশকুড়া যাকে দৌড়তে হয়, তাঁর পক্ষে ছুটির দিন স্কুল করা মোটেই আহ্লাদের কথা নয়। শুধু দীর্ঘ পথযাত্রাই নয়, অনেক শিক্ষিকাকেই বাস, ট্রেন, ট্রেকার এমনকি সাইকেলে চড়ে স্কুল যেতে হয়, শাড়ি পড়ে যা প্রায় অসম্ভব। সালোয়ার ও তো জাতীয় পোশাক, যথেষ্ট ভদ্র মার্জিত, শরীর ঢাকা পোশাক। পরলে অসুবিধা কোথায়? তবে ভিতরে ভিতরে সুস্পষ্ট বৈরিতা থাকলেও উপরে কিন্তু সহজ সৌজন্যমূলক সম্পর্ক বজায় ছিল। নবীনারাই অবশ্য ছিল সংখ্যা গরিষ্ট। তবে শিলালিপি কে একা পেলেই দু দলই একে অপরের নামে পরচর্চা শুরু করত। যেমন কলি। সুমি আর কলি সুদূর দক্ষিণ কলকাতার শহরতলী থেকে সুদূর কোলাঘাটে পড়াতে যেত। শিলালিপিরই সমবয়সী। সুমি বেশ স্থুলাকৃতি, নাদুস নুদুস, মিষ্টি মিষ্টি দেখতে, দেখলেই বোঝা যায়, শিলালিপির মতই বাবা মায়ের আবদেরে আলু ভাতে। প্রায় রোজই অপরূপ সুন্দর তথা অত্যন্ত মূল্যবান শাড়ি পড়ে রোজ স্কুলে যেত। ঐ বিশাল বপু বার হাত শাড়িতেও ঢাকা পড়ত না, তাই সুমির মা সর্বত্র যত্ন সহকারে সেফটি পিন লাগাতেন, সেই সেফটি পিন মাঝে মাঝেই খুলে গিয়ে সুমিকে তো ঘায়েল করতই, একবার শিলালিপির হাতেও ফুটে গিয়েছিল। তখনও ওদের সাথে ভাব জমেনি। শুধু মুখ চেনা, তবু সমবয়সী বলে, দেখা হলেই এক গাল হাসি বিনিময় হত। যেদিন সুমি প্রথম ওকে ডেকে নিজেদের পাশে বসালো, শিলালিপি বেশ পুলকিত বোধ করল, যাক এত দিনে হংস মধ্যে হংস যথা হতে পারল। কি কপাল, সেদিনই সুমির মায়ের সযত্নে আঁটা পিন, পট করে খুলে গিয়ে দুজনকেই ঘায়েল করল। সুমি বেচারা লজ্জায় লাল কালো হয়ে অনেক ক্ষমা চাইল। শিলালিপ ক্ষততে হাত বোলাতে বোলাতে শুধু বলল বলল, “ এত সেফটি পিন লাগাও কেন?” লজ্জায় সুমি করুণ মুখে বলল, “কি করি? পেট দেখা যায় যে? মোটা হবার কি কম জ্বালা? তুই তো বুঝিস।”
(চলবে)

সহযাত্রী


অনেক দিন আগের কথা, তখন পশ্চিম বঙ্গে রাজনৈতিক পালাবদল, মুষ্টিমেয় জনগণের দিবাস্বপ্ন মাত্র। রেড জোন আছে বটে, তবে জঙ্গলমহল তখনও লাল হয়নি। মাঝে মাঝেই বিরাপ্পনের নাম শোনা গেলেও, কিষান জীর সাথে বঙ্গবাসী তখনও অপরিচিত। শিলালিপি, লিপিলেখা, ঊষাঙ্গিনি আর নবনী চার ঘনিষ্ট বন্ধু। চার জনেই ডেইলি পাষণ্ড। ১১৩ নং মেদিনীপুর লোকাল এবং ১১৫ নং খড়গপুর লোকালের মহিলা কামরার সব নিত্যযাত্রী এবং সব হকার ওদের চেনে। ওরা একসাথে যায় আবার এক সাথে ফেরে। নবনী এবং উষাঙ্গিনিী এ লাইনে পুরানো পাপী, বহুদিন ধরে যাতায়াত করছে, উষাঙ্গিনির বয়স দেখে যদিও মনে হয় পঞ্চাশ, বাহান্ন এমনকি পঞ্চান্নও হতে পারে, তবে তিনি দাবী করেন তাঁর বয়স নাকি সবে চল্লিশ পেরিয়েছে। কয়েক বৎসর পূর্বেও দোহারা চেহারা ছিল, আজকাল একটু ভারির দিকে। ঘোর কৃষ্ণ বর্ণ। সস্তার কলপ করা চুলে গদগদে করে সিঁদুর পরেন। হাতে শাঁখা, পলা। অধিকাংশ দিনই সিনথেটিক শাড়ি পরেন, কদাচিৎ তাঁত বা সিল্ক। চান করে ভেজা চুল বেঁধে ট্রেনে ওঠেন, উঠেই আগে চুলটা খুলে দেন। চটি খুলে সিটের ওপর বাবু হয়ে বসা ওনার প্রিয়তম অভ্যাস। জোরে জোরে কথা বলেন, কথায় কথায় অট্টহাস্য করেন, মাঝে মাঝে সুর করে গানও গান, অবশ্য চলতি বাংলা সিনেমার গান, না হলে বড় জোর স্বর্গীয় মান্না দে বা সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়ের গান। গান গাইতে গাইতে সিটে বসে এক পাক নেচেও নেন। অবশ্য কামরা খালি থাকলে তবেই। কোন এক কেন্দ্রীয় সরকারি অফিসে চতুর্থ  শ্রেণীর কর্মচারী। উষাঙ্গিনির পুত্র কন্যা উভয়েই বিবাহিত। বড় নাতিটিরই সপ্তম শ্রেণী হল। স্বামীও ঐ একই অফিসে চাকরী করেন। তবে কলকাতায় পোস্টেড। একদিন কথা প্রসঙ্গে বলেই ফেলেছিলেন, স্বামীর কাজে খুশি হয়ে কোন এক বড় সাহেব ঊষাঙ্গিনিকে অনুগ্রহ পূর্বক এই চাকরীটী যোগাড় করে দেন। যাই হোক মহিলা কামরার নিত্যযাত্রীদের কাছে উনি খুব একটা জনপ্রিয় নন। কারণ উনি নাকি অনেকের কাছেই টাকা ধার করে রেখেছেন। হকাররাও ওনাকে দেখলে সরে সরে যায়। তবে টাকার পরিমান ৫০০-১০০০ এর মধ্যেই থাকে। উনি সময় সুযোগমত ৫০-১০০ করে শোধও দেন, তবু শিলালিপি আর লিপিলেখাকে নিরালায় পেলেই অন্যান্য মহিলা যাত্রীরা সাবধান করে দেয়। সব মিলিয়ে মানুষটা মন্দ নন। শহুরে পালিশ বিহীন গ্রাম্য মহিলা।
শিলালিপি আর লিপিলেখা সদ্য সদ্য ডেইলি পাষণ্ডগিরি শুরু করেছে। দুজনেরই দপ্তর খড়্গপুর। ওদের বয়সও কাছাকাছি, সমবয়সীই বলা যায়। দুজনেই গৌরী, বেশ হৃষ্টপুষ্ট। শিলালিপি আসে হাওড়া থেকে আর লিপিলেখা ট্রেনে ওঠে বাগনান থেকে। ট্রেনেই ওদের আলাপ, আলাপ থেকে ঘনিষ্টতা হয়ে বর্তমানে ওরা একে অপরের প্রিয়তম বান্ধবী। শিলালিপির বদলির চাকরী, খড়গপুর ওর প্রথম পোস্টিং। বাবা মায়ের দুলালী, প্রথম দিন বৃদ্ধ বাবা সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিলেন। সমুদ্র নীল জিন্স, সাদা শার্ট আর উঁচু গোড়ালির ফ্যাশন দুরস্ত জুতো পড়ে প্রথম দিন অফিস গিয়েছিল শিলালিপি। বাড়ি থেকে বেড়িয়ে অফিস পৌছতে লেগেছিল পাক্কা চার ঘণ্টা। জুন মাসের তীব্র গরমে তথা পথশ্রমে ক্লান্ত মোমের পুতুলকে দেখে মেদিনিপুরিয়া বড় সাহেবের মনেও দয়া হয়েছিল, তাই সেদিন তড়িঘড়ি ছেড়ে দেন। সাড়ে তিনটের ট্রেন, লোকাল অবশ্যই, ঐ সময় কোন এক্সপ্রেস ট্রেন থাকে না, ধরার জন্য তিনটের সময় অফিস থেকে বেড়িয়ে যথারীতি চার ঘণ্টা পর সন্ধ্যা সাতটার সময় বাড়ি ঢুকে শিলালিপি হাত পা ছড়িয়ে কাঁদতে বসে। সাথে সাথে মাও খানিক কেঁদে নিলেন। সে কি নাটক বাপ রে বাপ। অবশেষে শিলালিপির বাবা প্রবল চিৎকার চেঁচামিচি করে পাড়ার লোকের ঘুম চটকিয়ে নাটকে যবনিকাপাত করেন সেদিনের মত নাটক বন্ধ হলেও পরদিন থেকে নতুন নাটক শুরু করে শিলালিপি। মোবাইলের অ্যালার্ম বেজে বেজে থেমে যায়, মা ডেকে ডেকে ক্লান্ত হয়ে পড়েন, বাবার চিৎকারে পাড়ার তন্দ্রাচ্ছন্ন সারমেয় কূলের আমেজ নষ্ট হয়ে যায়, কিন্তু শিলালিপির ঘুম আর ভাঙে না। অবশেষে যখন নিদ্রাভঙ্গ হয়, তখন বেলা নটা। অতএব ঐ দিন আর অফিস যাওয়া হয় না। তাতেও শিলালিপির কোন অপরাধ বোধ ছিল না, দিব্যি চান করে ভাত খেয়ে, বাতানুকূল যন্ত্র চালিয়ে একটা সুখী সুখী দিবানিদ্রার উদ্যোগ নিচ্ছিল, সব আমেজ নষ্ট করে দিল একটা ফোন। আগের দিনের স্নেহশীল বড় সাহেবের ফোন, আজ অবশ্য গলায় স্নেহ ছাড়ুন, বিন্দুমাত্র মিষ্টতাও ছিল না। হিমশীতল গলায় ধমকালেন, পুনরায় বিনা সংবাদে বা কোন অগুরুতর কারণে অফিস না গেলে, উনি যথোপযুক্ত ব্যবস্থা নেবেন। শিলালিপি অনুভব করল বাস্তবিকই গরিবের কথা বাসী হলে কতটা মিষ্টি হয়, বিগত রাত থেকে নানা ভাবে বাবা এই কথাটাই বোঝাবার নিরলস চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন। জনমানসে রাজ কর্মচারীদের সম্পর্কে যাই ধারণা থাকুক না কেন, সরকারি চাকরীতে আদৌ যেমন খুশি চলা যায় না। ঢুকেছ কি মরেছ। বাবা যথার্থই বলেন, “সরকারি চাকরী হল আদতে চাকরগিরি। আর তোরা হলি জনগণের চাকর বাকর, public servant?”

শিলালিপির স্বর্গীয় মাতামহ রবীন্দ্রনাথের অনুপ্রেরণায় প্রথমা কন্যার নাম রেখেছিলেন উর্বশী। এই নিয়ে মাতামহের সাথে ওনার মাতা ঠাকুরানীর তীব্র বিবাদ হয়, অপ্সরার নামে ভদ্র পরিবারের মেয়ের নাম রাখা সেই প্রাচীনপন্থী মহিলার মতে ছিল নিতান্তই “অলপ্পেয়ে” ব্যাপার স্যাপার। জাই হোক কয়েক বৎসর পর যখন শিলালিপির মাসিমণির জন্ম হল, তখন সেই মহিলা জেদ ধরলেন নাতনির নাম রাখতে হবে রম্ভা। মাতামহ হয়তো অন্য কোন শ্রুতিমধুর নাম কল্পনা করেছিলেন, কিন্তু বৃদ্ধার জেদের সামনে অস্ত্র ত্যাগ করতে বাধ্য হন। যাইহোক রম্ভার জন্মের পর ঠাকুমা খুব অল্পকালই জীবিত ছিলেন, ওনার মৃত্যুর পর যতবার রম্ভার নাম পরিবর্তনের প্রচেষ্টা হয়েছে, প্রতিবার রম্ভা তা ব্যর্থ করতে সক্ষম হয়েছে। বৃদ্ধ পিতামহী মৃত্যুর পূর্বে যেন তাঁর সমস্ত জেদ এবং ব্যক্তিত্ব ঐ ক্ষুদ্রিকাকে দিয়ে গিয়েছিলেন, বিদ্যালয় থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত কেউ রম্ভার নাম নিয়ে ফাজলামি করার সাহস পায়নি। উর্বশী এবং রম্ভা সহোদরা হলেও চরিত্রগত ভাবে সম্পূর্ণ বিপরীত । শিলালিপির মা স্বভাবত বেশ মিষ্ট এবং কোমল, সর্বংসহ প্রকৃতির রমণী। কেন্দ্র সরকারের মাঝারি শ্রেণীর কর্মচারী। রম্ভা ততোধিক দৃঢ়, রূঢ় বলাই বাহুল্য তীব্র ব্যক্তিত্বের অধিকারিণী। কেন্দ্র সরকারের অডিট সংক্রান্ত দপ্তরের বেশ দরের অফিসার। জামাই বাবু অর্থাৎ শিলালিপির বাবার সাথে ওনার ব্যক্তিত্বের সংঘাত নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। উভয়েরই ব্যক্তিত্ব প্রবল। তবে দিদি বা শিলালিপির প্রতি ওনার ভালবাসায় কোন খাদ নেই। শত ব্যস্ততার মধ্যেও দিনান্তে একবার উনি দুরাভাষ মারফৎ খবরাখবর নিয়েই থাকেন। যদিও ওনার সর্বদাই মনে হয়, উর্বশী তাঁর মেয়েকে অতিরিক্ত আদরে একটি “আব্দেরে আলু ভাতে” তৈরি করেছে। সেদিন যখন উনি শুনলেন, শিলালিপি অফিস যায়নি, তীব্র বিরক্তির সাথে উনি জিজ্ঞাসা করলেন, “অফিস যায়নি কেন?”
উর্বশী ভয়ে ভয়ে বললেন, “না, আসলে কাল এত ক্লান্ত হয়ে ফিরেছিল, তাই আজ আর ঘুম থেকে উঠতেই পারেনি।”
“ঘুম থেকে উঠতে পারেনি বলে অফিস যায়নি???”
“ভালো হয়েছে দূরে পোস্টিং হয়েছে, এবার তোর ঐ ন্যাদোশ মেয়েটা মানুষ হবে। ট্রেনে করে যাতায়াত করতে হলে চটপটে হতেই হবে। এ তোমার কলকাতা হাওড়ার বাস নয়, যে পাঁচ মিনিট পর পরই পাওয়া যাবে। কাল ও যদি না যায়, তো বলিস পরশু ঘুম ভাঙানোর দায়িত্ব আমার।”
শিলালিপির বাবা এত ক্ষণ ভালো মানুষ সেজে কাগজ পড়ার ভান করে স্ত্রী এবং শ্যালিকার কথোপকথন শুনছিলেন, বলাই বাহুল্য শ্যালিকাকে উনি খুব একটা পছন্দ করেন না, তবে স্ত্রীর ভয়ে সহ্য করতে বাধ্য হন। আড়ালে আবডালে রম্ভাকে উনি কলাবতী বা কলা বলে সম্বোধন করেন। কাল শিলালিপি অফিস না গেলে পরশু রম্ভা আসবেন, এত বড় গসিপ হজম করা ওনার পক্ষে অস্মভব। উর্বশী দেবী বলার আগেই, উনি কাগজ বগলে দৌড়লেন, শিলালিপির ঘরে, বিছানার ওপর কাগজটা আছড়ে বলে উঠলেন, “হল তো!” কৌতূহলী শিলালিপি বোকা বাক্স থেকে মুখ ঘুরিয়ে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাল, “ আমি অত ডাকলাম, উঠলি না। এবার কলা এসে তোর ঘুম ভাঙাবে। আসছেন তিনি। ”
কলা অর্থাৎ রম্ভাকে বড় ভয় শিলালিপির। শিক্ষা দেবার জন্য রম্ভা করতে পারেন না, এমন কিছুই নেই। নিজের একমাত্র পুত্রকে একবার তিনি নিজের হিশি নুন দিয়ে চাটিয়েছিলেন। বারংবার নিষেধ সত্ত্বেও টুবাই রাতে বিছানা ভেজাত।
অগত্যা বস এবং কলাবতী অর্থাৎ মাসিমণির যুগ্ম আতঙ্কে পরদিন থেকে শুরু হল শিলালিপির ডেইলি পাষণ্ডগিরি। প্রাতঃকালে মায়ের হাতের ডাল ভাত খেয়ে, যত্ন করে গুছিয়ে দেওয়া দুই সেট টিফিন ব্যাগে পুরে, দুর্গা নাম নিয়ে বেড়িয়ে পড়ল শিলালিপি। বাবা সঙ্গে করে নিয়ে গিয়ে বাসে তুলে দিলেন। দাশনগর স্টেশন থেকে ১১৩ নং মেদিনীপুর লোকাল। ট্রেন আসার কথা ৮টা ১১এ। পরের ট্রেনের সময় হয়ে এলেও তেনার দেখা নেই। প্লাটফর্মে কারো যেন কোন তাড়া নেই। যে যার মত, মুঠো ফোন নিয়ে ব্যস্ত। কোন টিকিট পরীক্ষক বা রেল পুলিশের পাত্তা নেই। কাকে জিজ্ঞেস করা যায়? অগত্যা বাবাকেই ফোন লাগাল শিলালিপি, “ট্রেন তো এল না বাবা। কি করি?”
“আসবে আসবে, অপেক্ষা কর। সাউথ ইস্টার্ন রেলের নাম আগে ছিল, বি এন আর। বেঙ্গল নাগপুর রেলয়ে।আর স্থানীয় লোকজন কি বলত জানিস, ‘ বি নেভার রেগুলার’। মাত্র আধ ঘণ্টায় হতাশ হয়ে পড়লে হবে?” কৌতুকের সুরে জবাব দিলেন বাবা।
(চলবে)image courtesy- Google

Thursday 10 September 2015

অপেক্ষা সেই মাহেন্দ্র ক্ষণের



মঙ্গল পাণ্ডে কোথায় তুমি?
সত্যিই কি তুমি তবে এনফিল্ড বুলেটের সুতো দাঁতে কাটতে স্বীকৃত হলে?
মাত্র ১৫৮ টা বছর, এত দুর্বল নুব্জ হয়ে পড়ল তোমার মেরুদণ্ড ?
জানি কামানের গোলায় শতছিন্ন হওনি ,
জানি তুমি আসবে, আসবেই,আসতেই হবে,
অপেক্ষা শুধু সেই মাহেন্দ্র ক্ষণের, ততোদিন না হয় আরো একটু শূলপক্ক হই আমরা।

Wednesday 9 September 2015

অনির ডাইরি ৩রা সেপ্টেম্বর ২০১৫



 নাঃ এবার এটা শেষ করতেই হবে।  অনির ডাইরি আমার মনের খোলা জানালা, দৈনন্দিন একঘেয়েমি যখন অসহনীয় হয়ে ওঠে আমার মধ্যে না লেখা গল্পের চরিত্রগুলো সম্মিলিত ভাবে ক্যাঁচোর ম্যাচোর শুরু করে অথচ লেখার অবকাশ বা উদ্যম পাই না তখন নানা ছোটখাট আপাত সাধারণ ঘটনাবলী নিয়ে দু চার কথায় ডাইরি লিখতে বসি।  বেশিটাই বাড়ি ফেরার পথে চার্টার্ড বাসে আধো অন্ধকারে লেখা।
এদিকে ক্যান্সার রোগাক্রান্তা চম্পু মাসিকে প্রতিশ্রুতি দিয়ে বসে আছি চম্পু আর ফেলুকে নিয়ে “একটি নিটোল প্রেমের গল্প ” লিখব। খানিকটা লিখে আর লেখাটা পছন্দ  হচ্ছে না। সম্পূর্ণ অপরিচিত এক ব্যক্তির চিত্রাঙ্কন  কি এতই সোজা? এদিকে আমার প্রাক্তন সহপাঠী রঞ্জা গত সপ্তাহ থেকে  উত্যক্ত  করছে ওদের বংশ নিয়ে একটি গল্প লিখতে হবে। রঞ্জাকে আজকাল দূরদর্শনে প্রায়শই দেখা যায় নারীর অধিকার এবং নারী স্বাধীনতা বিষয়ক আলোচনা চক্রে। দিল্লীর নামজাদা কলেজের অধ্যাপক এবং প্রবাসী বাঙালি আমলার সাথে সহবাসী। রঞ্জার প্রতি আমার দুর্বলতার প্রধান কারণ ওর বাবাও আমার বাবার মত জেলখাটা  নক্শাল নেতা ছিলেন। ওর বাবার প্রতি প্রতিহিংসা বশতঃ ওর জেঠুকে সত্তরের দশকে কারা যেন কুপিয়ে খুন করেছিল।  লাশ পাওয়া যায়নি।  রঞ্জা বলত ওর জেঠু যে কলেজে পড়াতেন সেখানকার কেয়ারি করা বাগানে কোথাও  পুঁতে রাখা আছে জেঠুর লাশ। শুধু তাই নয় রঞ্জার পিতামহ তাঁর যৌবনে পালিয়ে রেঙ্গুন গিয়েছিলেন  সশস্ত্র বিপ্লবীদের জন্য অস্ত্র আমদানি করতে। রঞ্জার ছোটদাদু নাকা “ইয়ে আজাদি ঝুটা হ্যায় ” আন্দোলন করতে গিয়ে শহীদ হন।  পুরো ঘটনাবহুল ইতিবৃত্ত ।
ওদিকে “কিছুই হারায় না” ও আধখেঁচড়া পড়ে আছে। অমিয়া রহমত আর ফরজানাকে নিয়ে লিখতে গিয়ে, লিখে বসলাম অমিয়ার সহকর্মী দীপক আর তার স্ত্রী মিলির “পরকীয়া”।  বেচারা রহমত মুম্বাই এর পতিতা পল্লী গুলিতে ফরজানাকে খুঁজেই চলেছে।

যাই হোক আবার মাদপুরে ফিরে যাই, এল পি সি নিয়ে খড়্গপুর তথা মাদপুরকে আপাত বিদায় জানিয়ে ফিরে এলাম মহানগরে।  মনে বারংবার অনুরণিত হতে লাগল শৌভিকের দীর্ঘশ্বাসযুক্ত উক্তিগুলি, সত্যই ঐ নিঃসঙ্গতা অবর্ণনীয় । দিন পাঁচেক বাদে অফিস থেকে ফিরছি, বাসে অকথ্য ভিড়। আমার মত দু একজন অফিস ফেরতা হতভাগ্য  বাদে বেশির ভাগই পুজোর বাজার করে ঢাউস ব্যাগ নিয়ে সুখী সুখী দম্পতি, সবৎসা জননী বা মনপসন্দ মার্কেটিং করে ফেরা কলেজ পড়ুয়া মেয়েদের দল।  অতি কষ্টে বসার জায়গা পেলাম, উপবেশনের  পর হঠাৎ মনটা দুখী হয়ে উঠল আমার হতভাগ্য বরের জন্য।  মা আসছে, আনন্দস্রোতে ভাসমান মহানগর ।  একাতীত্ব নিঃসঙ্গতা সাময়িক  ভাবে বিজাতীয়  শব্দ মনে হচ্ছিল। যদিও অবহিত ছিলাম ঐ মুহূর্তে   এস ডিও সাহেবের চেম্বারে মিটিং চলছে তবু একবার দুরাভাষে জ্বালানোই যায়।  বড়জোর ফোন কেটে দেবে। এমন তো কতই হয়।  শৌভিক ফোন ধরে কি যে বলছে কিছুই বুঝতে  পারছিলাম না। সাময়িক  ভাবে অসহ্য লাগছিল মহানগরীর আনন্দ কলতান।  এক কান চেপে ধরে যা অনুধাবন করতে পারলাম শৌভিক যথাসম্ভব  সোচ্চারে কোন ট্রান্সফারের কথা বলছিল।  শুনতে অপারগ অগত্যা ও বলল একটু পরে জানাচ্ছে।  তীব্র উৎকণ্ঠা নিয়ে গুঁতোগুঁতি করে বাস থেকে  নেমে আবার ফোন করাতে শৌভিক বলল,“আমারও ট্রান্সফার হয়ে গেছে।  ”
“কার?” আমি চিৎকার  করে উঠলাম।
“আমার।  ”
“ কোথায় ??”
“জানি না!”
“মানে?”
“মানে আমার উত্তরসুরীর অর্ডার বেড়িয়ে  গেছে।  আমারটা এখনও---”
বোধগম্য হল না।  বদলির কোন প্রার্থনা জানাবার  অবকাশ ও পায়নি।  বদলি অবশ্যই প্রয়োজন । কিন্তু স্পাউস পোস্টিং এর প্রার্থনা ছাড়াই বদলির অর্থ পশ্চিমবঙ্গের ৩৪১টি ব্লকের মধ্যে যে কোন একটিতে হতে পারে।  ততোদিনে প্রায় সমস্ত মহকুমাতেই আমাদের অফিস খুলে গেছে।  কিন্তু সদ্য কলকাতায় ঢোকার পক্ষকালের মধ্যেই যদি আবদার করি স্বামীর কর্মক্ষেত্রের কাছাকাছি আমাকেও বদলি করতে হবে, তাহলে তৎকালীন এ্যাডিশনাল লেবার কমিশনার শ্রী সুবল বিশ্বাসের যতই অমায়িক মিষ্টভাষী  হন বা আমি ওণার স্নেহধন্য হই না কেন, উনি কান ধরে চেম্বার থেকে বার করে দিতেন এ ব্যাপারে আমি নিঃসংশয় ছিলাম। সুতরাং সেই মুহূর্তে দমবন্ধ-করা প্রতীক্ষা ছাড়া করণীয় আর কিছুই ছিল না। দীর্ঘ কুড়ি একুশ দিনের নিদারুণ যাতনা এবং প্রার্থনার পর অবশেষে অর্ডার বের হল। ষষ্ঠীর দিন সন্ধ্যা বেলা জানা গেল পরবর্তী  গন্তব্য মগরাহাট। পরে জানতে পারি জায়গাটার আসল নাম উস্তি।
এই জীবন সম্পর্কে খুব বেশি কিছু লিখতে পারছি না কারণ এই ব্লকের সাথে আমার প্রত্যক্ষ যোগাযোগ কখনই স্থাপিত হয়নি। মেয়ে নিয়ে যে কয়বার গেছি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ডারমন্ড হারবারে থেকেছি। মগরাহাটের চার বছরে অনেক ঘটনা ঘটেছে যেমন সংগ্রামপুরের বিষমদ কাণ্ড।  তবে এই সাম্প্রতিক ঘটনাবলীর সাথে সকলেরই সম্যক পরিচয় আছে তাই চর্বিতচর্বণ আর এই মুহূর্তে করছি না। হয়তো আবার কখনও মনে হলে লিখব। আজ নয়।  শুধু অন্তিম লগ্নে এই বিডিও গিরি থেকে অব্যাহতির কাঙ্ক্ষিত অর্ডার বের হওয়া নিয়ে যে টানাপোড়েন চলছিল, তা আমাদের পাশাপাশি তুত্তরিকেও কতটা প্রভাবিত  করেছিল তা এই মুহূর্তেও বোঝা যায় যখন ও বাবাকে দেখলেই বলে ওঠে,“অর্ডার বেরোবে বাবা। ”


Monday 7 September 2015

অনির ডাইরি ২রা সেপ্টেম্বর ২০১৫



ডাক্তারের পরামর্শে আমাকে আশ্বাসন দেওয়া হল, ক্ষত সারলেই তুত্তুরী সহ আমাকে মাদপুর নিয়ে যাওয়া হবে। এক সপ্তাহ নার্সিং হোমে অতিবাহিত  করে মেয়ে নিয়ে বাড়ি ফিরলাম রবিবার সকালে।  সোমবার  ভোরে বিদায় জানাতে হল শৌভিককে।  এক সপ্তাহব্যাপী  ছুটি উবে গেল কর্পূরের মত। প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য যে তখন ইলেকশনের সামারি রিভিশন চলছে।  কোনমতেই বিডিওর ছুটি পাবার কথা নয়। পেত ও না, যদি না তদানিন্তন মহকুমা শাসক শ্রী অরিন্দম দত্ত নিজ উদ্যোগে না ছাড়তেন। এই নিয়ে কিছু প্রশাসনিক জটিলতার সৃষ্টি হয়, তবে দত্ত সাহেব একাকী তার মোকাবিলা করেন।  আঁচটুকুও লাগতে দেননি শৌভিকের গায়ে। শুধু  তাই নয় আমার দুশ্চিন্তা বৃথা করে উনি প্রতি সপ্তাহান্তেই শৌভিককে ছেড়ে দিতেন, যাতে সদ্যোজাত সন্তানের সাথে অন্তত  কিছুটা সময় অতিবাহিত  করতে পারে।

সাড়ে চার মাসের মাতৃত্বকালীন অবকাশযাপন অন্তে নভেম্বরে যখন মাদপুরে প্রত্যাবর্তন করলাম, মাদপুর বড়ই বিবর্ণ লাগল। চারমাসের তুত্তুরী রয়ে গেল হাওড়ায় আমার মা বাবার সাথে।  সকলের সম্মিলিত আপত্তিতে আর ওকে আনা সম্ভব হল না।  সত্যি তো এত পোকামাকড়,  ব্যাঙ সর্বোপরি ধেড়ে  ইঁদুর।  তাও হয়তো আনতাম কিন্তু সারাদিন লক্ষ্য রাখার মত লোক অনেক খুঁজেও পাওয়া গেল না।
মাদপুরের সেই ন্যাড়া কোয়ার্টর ইতিমধ্যে আমূল পরিবর্তিত।  চতুর্দিকে উচু প্রাকার পরিবেষ্টিত ,  সামনে বিশাল গেট।  গেটে নিওন সাইন “সমষ্টি উন্নয়ন আধিকারিকের নিবাস” তাতে শৌভিকের নাম লেখা। বাদবাকি সবই পূর্বাবৎ। জীবন আবার গড়াতে লাগল নিজ ছন্দে। কিন্তু শতচেষ্টাতেও আর খড়্গপুর বা মাদপুরকে ভাল লাগাতে পারছিলাম না। কানাঘুষো শোনা যেতে লাগল শীঘ্রই ট্রান্সফার হব। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই ভোটের দামামা বেজে উঠল।  সিঙ্গুর, নন্দীগ্রাম থেকে নেতাইগ্রাম হয়ে লালগড় নানাঘটনা তুফান তুলছে বাঙালির চায়ের কাপে।  দেখতে দেখতে এসে পড়ল পরিবর্তনের  ইলেকশন।
এই সময় বেশ কিছুদিেনর জন্য বাবা- মা তুত্তুরীকে নিয়ে মাদপুর ঘুরে যাওয়াতে আমরা কিছুটা অক্সিজেন পেলাম।
মাদপুরবাসের দিনগুলিতে কোন অথিতি এলেই আমরা তাঁদের নিয়ে পাতরা যেতাম।  মনোরম কাঁসাই নদীর বেশ কিছু পুরাতন ভগ্নপ্রায়  টেরাকোটা মন্দির যা স্থানীয় এক মুসলিম ভদ্রলোকের একার প্রচেষ্টায় সংরক্ষিত হয়েছে।  ওনার নাম দুর্ভাগ্যবশত এই মুহূর্তে মনে পড়ছে না।  ইয়াসিন মালিক বা ইয়াসিন পাঠান সম্ভবত । আমার বাবা এবং শ্বশুর মশাই দুজনেই ওনার সাথে আলাপে উৎসাহী ছিলেন।  যদিও সময়াভাবে তা আর হয়ে ওঠেনি।  পাতরার অপর এক বৈশিষ্ট্য ছিল, অধিকাংশ মন্দির বিগ্রহশূন্য ছিল।  কারণ অজ্ঞাত । এছাড়াও আমাদের যুগলের প্রিয় ঘোরার জায়গা ছিল খড়্গপুরের একমাত্র মল, নাম ছিল “পূজা মল। ” একতলায় সদ্য খোলা ক্যাফে কফি ডের আমরা নিয়মিত অতিথি ছিলাম।বাঁধা মেনু  গ্রিলড্ চিকেন স্যান্ডউইচ আর ডেভিলস্ ওন।  সাথে নিভৃত আলাপচারিতা । তিনতলায় ছিল একটি হাবিবস্ শ্যালোন।  কলকাতার তুলনায় অন্তত দেড়গুণ সস্তা ছিল সবকিছু ।  ওদের নিয়মিত খরিদ্দার ছিলাম আমি।  তখনও এত খারাপ অবস্থা ছিল না আমাদের, মাত্র ১০ শতাংশ ডিএ কম পেতাম। একদিন সন্ধ্যা বেলা হাবিবস্ এ আছি, হঠাৎ শৌভিকের ফোন ফিসফিস  করে জিজ্ঞাসা করল, আমার আশেপাশে কোন কালো মোটা লোক ফেসিয়াল করাচ্ছে কি না।  যার মাথায় রিং টাক অথচ চাপদাড়ি।  পাশে চোখে শশার টুকরো আর মুখে প্যাক মেখে গোল গলা গেঞ্জি পরা একটি লোক বসেছিল, ভয় পেয়ে গেলাম,  বর্ণনা অনেকটাই নামি দুষ্কৃতি তথা হাজতবাসকারী রামবাবুর   সাথে মিলে যাচ্ছে। তবে তার মুক্তি আসন্ন জানতাম, তবে কি ছাড়া পেয়েই গেল? পরে শুনলাম উনি জনৈক অবজার্ভার। ওণার বায়নাক্কার ঠেলায় প্রশাসনের নাভিশ্বাস উঠছিল।  তাতে নতুন যোগ হয়েছিল হাবিবস্ এর আতিথ্যগ্রহন।

সেবার শৌভিকের এ্যাসেম্বলী কনস্টিটিউয়েন্সীর অবসার্ভার হয়ে এলেন ডঃ গনি।  কাশ্মীরি  ক্যাডারের আই এ এস।  প্রথম দর্শনে মনে হবে কবির বেদির যমজ ভাই।  কাশ্মীরি  আপেলের মতই গাত্র বর্ণ, নীল চোখ, খড়্গনাসা। নির্মেদ, কবির বেদির থেকেও লম্বা।  এপ্রিল মে মাসের ঐ চাঁদিফাটা গরমে উনি কাহিল হয়ে পড়ছিলেন।  বাধ্য হয়ে জয়েন্ট বিডিও সাহেবের অপেক্ষাকৃত ছোট চেম্বারটিকে বাতানুকূল করার ব্যবস্থা করা হয়। যতদূর মনে পড়ে যন্ত্রটি ধার করা হয়েছিল এবং সম্ভবত জেনারেটরের মাধ্যমে চালানো হত। গনি সাহেবের জন্য স্করপিও গাড়ি বরাদ্দ  করা হয়েছিল।  ঝকঝকে  নতুন গাড়ি।  কিন্তু জনাবের ঐ গাড়ি নাপসন্দ।  ওনার কাম্য ইনোভা।  তৎকালে মফঃস্বলে ইনোভা গাড়ি দুষ্প্রাপ্য ছিল।  অবজার্ভার সাহেবের আবদারে অনেক অন্বেষণের  পর যোগাড় হল ইনোভা গাড়ি। সাহেবের নির্দেশে উনি গাড়িতে সওয়ার হবার অন্তত আধঘন্টা পূর্বে এসি চালিয়ে রাখতে হত। বাঙালি খাবার উনি পূর্বে কখনও চাখেননি।  পোস্ত খেয়ে মোহিত হয়ে গিয়েছিলেন।  ওণাকে খাওয়ানোর দায়ভার অবশ্য শম্ভু নিমাই কে দেওয়া হয়নি। নামি ক্যাটারার সরবরাহ করত।  তবে গনি সাহেব যখন অন্নগ্রহণ করতেন পাশে কাউকে থাকতে হত, প্রতিটি পদ সম্পর্কে সবিস্তারে বর্ণনা করতে হত।  আগে শুক্তো শেষে দই মিষ্টি না বলে দিলে বুঝবেন কি করে। দ্বৈপ্রাহরিক আহার উনি বিডিওকে ছাড়া করতেন না। বেচারা শৌভিক সকালে আমার সাথে ভাত না খেয়ে অফিস গেলে আমি রুষ্ট হতাম, খেয়ে গেলে গনি সাহেব। এতো গেল বায়নাক্কা, তবে কাজের বেলা অসম্ভব খুঁতখুঁতে ছিলেন উনি। বুথ দর্শন থেকে ভোটার টার্ন আউট রিপোর্ট সব কিছু খোদ ‘সক্রুটিনি’ না করলে ওনার শান্তি হত না। প্রসঙ্গত না বলে পারছি না সেবার উপমন্যু চট্টোপাধ্যায়ও অবসার্ভার হয়ে আসেন মেদিনীপুরে।

 ইলেকশন শেষ।  কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন।  গণনার পরের দিন শেষ বাবের মত জ্বালাতন করে  কাশ্মীর ফিরে গেলেন ডঃ গনি।  অপরাহ্নে আমরাও বাড়ি আসার জন্য তৈরি হঠাৎ সব পরিকল্পনা বানচাল করে দিল একটি বাঁদর। ৬ নং জাতীয় সড়কের ধারে বুড়ামালা বলে একটি অঞ্চল আছে।  ঐটি খড়্গপুর ২নং ব্লকের অন্তর্গত ।  প্রতি শীতে ওখানে মহাবীর মেলা বসে। কস্মিনকালে একটি হনুমান রাস্তা পেরোতে গিয়ে ঐ স্থানে গাড়ি চাপা পড়েছিল।  তারপর নানান আধিভৌতিক ঘটনা ঘটতে থাকে, পরিশেষে স্থানীয় অধিবাসীবৃন্দ মৃত হনুমানের উদ্দেশ্যে একটি মন্দির নির্মাণ করেন এবং প্রতি বৎসর মেলা বসাতে শুরু করেন। বিগত শীতে আমরা যুগলে সে মেলা উদ্বোধনও করে এসেছি। ইলেকশনের সময় যে কেন্দ্রীয় বাহিনী এসেছিল তাদের মধ্যে একটি নাগা ব্যাটেলিয়ন ছিল।  যাদের সাময়িক ঠিকানা ছিল বুড়ামালার সন্নিকটে কোন স্কুল । নাগারা আসার পর রাস্তার সারমেয় কূল ক্রমহ্রাসমান হয়ে পড়ে, এই নিয়ে স্থানীয় বাসিন্দারা ক্ষুব্ধ ছিলই।  সমস্যা আরো সঙ্গীন হয় যখন নাগা সৈন্যরা লোভ সংবরণ করতে না পেরে একটি হনুমানকে কাটতে যায়।  দা জাতীয় কোন অস্ত্র দিয়ে কোপ মারা হয়।  মারাত্মক আহত হলেও প্রাণীটি মরেনি।  ঐ রক্তাক্ত অবস্থায় গাছের মগডালে উঠে প্রবল আর্তনাদ করতে থাকে।ঐ ভয়াবহ দৃশ্য দেখে স্থানীয়দের ক্ষোভ বাঁধ ভাঙে, খোদ মহাবীরের পীঠস্থানে হনুমান ভক্ষণের প্রয়াস? ঘোর পাপাচারের বিরুদ্ধে জাতীয় সড়ক অবরোধ করে ধিক্কার জানানো শুরু হয়। ভোট শেষে খবরের আকাল চলছিল, এইরকম চটকদার খবর পেয়ে বেশ কিছু বাঙলা সংবাদ চ্যানেল ও এসে জুটে যায়।  শৌভিককে দৌড়তে হয়।  খবর পেয়ে বনদপ্তরের আধিকারিক গণ আসেন।  হনুমানটিকে পরিচর্যার জন্য নিয়ে যাওয়া হয়।  সেদিন আমাদের বাড়ি ফেরা হয়নি বটে তবে বেশ কিছু আত্মীয় স্বজন দূরাভাষ মারফৎ জানান যে শৌভিককে বোকা বাক্সে দেখাচ্ছে। সত্যি রোদে পুড়ে তামাটে, চোখের নীচে কালি, ক্লান্ত, আধা ঘুমন্ত শৌভিক শেষ কাচা টি শার্টটি পড়ে বাঁধাগৎ আওড়াচ্ছে,  তোতাপাখির মত।
 সেদিন হনুমান হলে পরেরদিন একটি গরুর জন্য আমাদের বাড়ি ফেরা আরো বিলম্বিত  হল। পূর্বরাত্রে ঠিক ছিল পরদিন কফি খেয়েই বেড়িয়ে পড়ব।  প্রাতরাশ বাড়ি ফিরে করা হবে।  সেই মত বের হতে যাব ফোন, প্রাথমিক স্বাস্থ্যকেন্দ্রের খোলা সেপটিক ট্যাঙ্কে একটি গরু পড়ে গেছে। উঠতে পারছে না,তাকে তোলার ব্যবস্থা করতে হবে!!!!

দেখতে দেখতে আবার আমাদের বিবাহ বার্ষিকী এসে গেল।  তৎকালীন উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে অর্ধদিবস ছুটি নেওয়াও দুষ্কর ছিল। অগত্যা ঠিক হল রাত্রি বেলা রোজভ্যালিতে ডিনার করতে যাওয়া হবে। মেদিনীপুর শহরে রোজ ভ্যালির ঐ রেস্টুরেন্টটি ছিল তৎকালীন সবথেকে বিলাসবহুল রেস্তোরাঁ । বাতানুকূল সুসজ্জিত  স্বল্পকালের জন্য মনে হত পার্কস্ট্রীট। অফিস করে সেজে গুজে যুগলে গেছি রোজভ্যালি, কথাপ্রসঙ্গে  শৌভিক জানালো একটি “কেলো” হয়েছে।  জনৈক স্টাফ ছুটি চাইতে এসেছিল, উপলক্ষ্য নবপরিণীতা স্ত্রীর শুভজন্মদিন। আমার বর শুধু আবেদন নাকচ করেই ছাড়েনি, উল্টে খানিক সদুপদেশ দিয়ে শেষে বলেছে,“এই তো আজ আমাদের অ্যানিভার্সারি।  ম্যাডাম ও অফিস গেছেন,  আর আমি ও। ” কথা ছড়াতে সময় লাগেনি।  সাব এ্যাসিস্টান্ট ইঞ্জিনিয়ার অরিজিৎ বাবুর নেতৃত্বে স্টাফেরা আবদার জানান ওণারা কিছু উপহারের মাধ্যমে শুভেচ্ছা  জানাতে ইচ্ছুক । পত্রপাঠ আবেদন নাকচ হবার পরও ওণারা হতোদ্যম হননি। ছুঁতোনাতায় জেনে নিয়েছেন আমরা রাত্রে রোজ ভ্যালি যাব। বিরাট সুসজ্জিত  ডাইনিং রুমের এক কোণে আমরা নিভৃত আলাপচারিতায় মগ্ন হঠাৎ শৌভিক আঁতকে উঠল, “এইরে অরিজিৎ বাবু উঁকি মেরে গেলেন, সদর দরজা দিয়ে। ” কিয়ৎক্ষণ পরেই অরিজিৎ বাবু ঢুকলেন দুটি পুষ্পস্তবক এবং রাংতা মোড়া তিনটি উপহার নিয়ে। সর্বসমক্ষে  আমাদের সোচ্চারে শুভেচ্ছা  জানালেন এবং আমাদের হাতে উপহার তুলে দিলেন।  এমনকি অনুপস্থিত তুত্তুরীকেও ওণারা ভোলেননি। আমরা যৎপরনাস্তি আপ্লুত এবং অভিভূত।  হঠাৎ পাশের টেবলে আহাররত অবাঙালি দম্পতির মধ্যে মৃদু বাকবিতণ্ডা আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করল।  মহিলা অনুযোগের সুরে কিছু বলছিলেন, ভদ্রলোক অসহায় ভাবে ইংরেজিতে জানালেন আজ ওণাদের ও শুভদিন। ওণার স্ত্রী অনুযোগ করছেন কেন ওণাদের কেউ এমন উপহার বা শুভেচ্ছা  জানাল না।  চার জনেই হেসে উঠলাম।

মাস দুই তিনের মধ্যেই বহুকাঙ্খিত এবং বহুবিলম্বিত ট্রান্সফার। চার বছর তিনমাস  পশ্চিম মেদিনীপুরে অতিবাহিত করার পর মহানগর কলকাতা। সদর দপ্তর থেকে তাগাদা এল সত্বর এস। প্রথম গড়ে তোলা সংসার, স্বামী, কোয়ার্টর, ধানক্ষেত, আমগাছ, রেললাইন, পোকামাকড়,  ধেড়ে ইঁদুর সব ফেলে সানন্দে চলে এলাম কলকাতা, মেয়ের কাছে।  চার দিন পর এলপিসি আনতে গিয়ে মন খারাপ হয়ে গেল। সব যেন আরো মলিন, ধুলি ধুসরিত, শৌভিককে এত বিমর্ষ অসহায় কখনও দেখিনি। রাতে খেতে যাওয়া হল রোজ ভ্যালি মেদিনীপুর।  সেই রোজ ভ্যালি কেমন যেন বিবর্ণ। খেয়ে ফিরছি জনশূন্য অন্ধকার রাস্তা দিয়ে বুলেটের মত ছুটছে শৈবাল দার গাড়ি, শৌভিক বিমর্ষ হয়ে বলল,“এই নির্জনতা,  এই একাতীত্ব অসহনীয়।বৃটিশ আমলে পর পর উত্তর পূর্বের তিনজন রেসিডেন্ট কমিশনার আত্মহত্যা করেছিল শুধু এই একাতীত্বের আতঙ্কে। ” আমি চলে যাবার  দুই দিন পরেই প্রথম সাপ ঢুকেছিল কোয়ার্টরে।

 (চলবে ?)

Friday 4 September 2015

অনির ডাইরি ১ লা সেপ্টেম্বর,২০১৫


 আমাদের আড়াই বছর মাদপুর বাসের সবথেকে রোমহর্ষক অংশ অবশ্যই রাত্রি বেলা ভূূল ট্রেনে উঠে আমার কলাইকুন্ডায় পথ হারানো এবং শৌভিক শৈবালদা ডুয়োর উদ্ধার করা।  তবে সেটা “শ্রমিক আমির” অংশ। আগেই বলেছি ♣।

তখন শীতকাল , শৌভিককের এক গ্রাম পঞ্চায়েত থেকে এএলসিকে নিমন্ত্রণ জানানো হল “ পানিশিউলির মেলা”য়। শুধু নিমন্ত্রন পত্র পাঠিয়েই ওণারা ক্ষান্ত হলেন না, উপর্যুপরি অনুরোধ আসতেই থাকল।  এক হোমরাচোমরা নেতা নিজে এসে অনুরোধ  করে গেলেন পদধূলিধন্য করার জন্য। এমনি নয় অবশ্যই, মূল উদ্দেশ্য স্থানীয় অধিবাসীবৃন্দকে আমাদের সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্প গুলি সম্পর্কে সচেতন করা এবং নামনথিভুক্তি।খড়্গপুর ২ এর তৎকালীন নূন্যতম মজুরি পরিদর্শক ছিলেন সমীর সর্দার । সমীর বাবু আর আমাকে একত্রে ডিএলসি শৈবাল দা বলতেন “হাইপার এ্যাক্টিভ টিম”। বিনা অর্থব্যয়ে  তথা বিনাআয়াসে সচেতনতা শিবির তখন চরম কাঙ্ক্ষিত বস্তু । আমরা একপায়ে খাড়া। মেলা যদিও সন্ধ্যা বেলায়, পথ অনেকটা এবং বেশ রিমোট জায়গায় ।  বিকাল চারটে নাগাদ আমরা এএলসি ইন্সপেক্টর মিলে রওনা  দিলাম।  যাবার আগে স্যার বেশ কিছুক্ষণ ধরে জেরা করলেন, বুঝতে পারলাম আমাদের উত্তর ওণার আদৌ মনঃপূত হয়নি। চলে আসছি উনি ডেকে বললেন,“দেখ তোমাদের অভিজ্ঞতা কম।  সব শুনে আমার বেশ চিন্তা হচ্ছে কোন বিপদ আপদ না হয়।  যাবে মনস্থ করেছ যাও,  কাল জানিও কটা রেজিস্ট্রেশন হল। ” আমরা অকুতোভয় বেড়িয়ে  পড়লাম।  শৌভিক সকালে জানিয়েছিল ও যাবে। ফোনে জিজ্ঞাসা করাতে বলল ব্লক থেকে ওকে তুলে নিতে।  শেষ পর্যন্ত যখন আমরা রওনা  দিলাম সূর্য পাটে বসতে চলেছে।  আমাদের গাড়ি ছেড়ে বিডিওর গাড়িতেই আমরা সওয়ার হলাম। কারণ আর কিছুই না ঐ রাস্তা কেবল ড্রাইভার শৈবালদাই চিনতেন।
মরা গোধূলিরআলোয় সে এক রোমহর্ষক সওয়ারি ।  হাইওয়ে থেকে নেমে সরু কাঁচা মাটির রাস্তা, বাঁশ ঝাড়, পুকুরের পাশ  দিয়ে টলটলিয়ে চলল এ্যাম্বাসাডর। মাঝে মাঝে উঁচু রাস্তা থেকে ডাইভ মেরে নীচে নামছে, আবার কখনও হড়কে পড়তে পড়তে উপরে উঠে যাচ্ছে।

মাঝে মাঝে চোখজুড়ানো সূর্যমুখী আর গাঁদার ক্ষেত।  হঠাৎ ঝাঁকুনি খেয়ে থমকে  দাঁড়ালো গাড়ি।  সামনে বাঁশ দিয়ে রাস্তা আটকানো। একদল ফচকে ছেলে দৌড়ে এল একটা বিল বই নিয়ে।  শৈবাল দা সবে হুঙ্কার  দিতে যাবে, শৌভিক ইশারায় নিষেধ করল।  পুচকে গুলো যখন গাড়ির খুব কাছে এসে গেছে, ধড়াম করে দরজা খুলে তীব্র হুঙ্কার  ছুড়ল শৌভিক,“বিডিওর থেকে চাঁদা নিবি?”দুদ্দাড় করে দৌড়ল সবকটা।  “কিসের পুজো রে এই?” বলতে বলতে খানিক ধাওয়া করল বিডিও আর তাঁর ড্রাইভার। ভয় দেখানোই আসল উদ্দেশ্য ।  ফিরে এসে শৈবাল দা বাঁশ খুলে দিয়ে আবার ইঞ্জিন চালু করলেন।  পথে একই নাটকের আরো দুবার পুনরাভিনয় হল। যত মেলাপ্রাঙ্গনের দিকে এগোতে লাগলাম যত্র তত্র ছোট ছোট জটলা চোখে পড়তে লাগল।  আমার চোখে কোন অস্বাভাবিকতা ধরা না পড়লেও শৈবাল দা চাপা গলায় বলে উঠল ,“দেখছেন স্যার এখন থেকেই নেশা করে বসে আছে। ”

অবশেষে যখন  আমরা মেলা প্রাঙ্গণে পৌছলাম তখন সন্ধ্যা নামছে।  মেলা প্রাঙ্গণ শব্দটা একটু বাড়াবাড়ি , একটা মাঝারি সাইজের মাঠ।ইতিউতি হাতে গোনা কয়েকজন ছেলে মেয়ের জটলা ছাড়া কোন কর্তা ব্যক্তি চোখে পড়ল না।  আদৌ কোন স্টল ছিল কি না আজ আর মনে নেই।  একটা অন্ধকার অর্ধনির্মিত মঞ্চ অবশ্য অপেক্ষা করছিল আমাদের জন্য।  সমীর বাবু আর আমি হতভম্ব কিংকর্তব্যবিমূঢ়  হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম।  শৌভিক খানিক এদিক ওদিক পায়চারি করে নিল।  শৈবাল দা অসহিষ্ণু হয়ে বলল, “কাছেই প্রধান সাহেবের বাড়ি। ” অনুমতি পেলে উনি প্রধানকে পাকড়ে  আনতেন, আমার কাছে নম্বর না থাকায় ইশারায় সমীর বাবুকে বললাম সেই নেতামশাইকে ফোন করতে।  ফোনে যা কথা হল, বুঝতে  পারলাম উনি অপেক্ষা করতে বললেন।  শৌভিক অবশ্য আর এক মুহূর্ত নষ্ট করতে রাজি হল না।  আমরাও দেখলাম অন্ধকার ক্রমে ঘন হচ্ছে এমতাবস্থায় অযথা সময় অপচয় করে কোন লাভ নেই।  সর্বোপরি মেলায় উপস্থিত জনগনকে দেখে হতাশা আরো বাড়ছিল।  অসংগঠিত শ্রমিকদের সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্পে যে এরা আদৌ উৎসাহী হবে না, অন্তত সেই মুহূর্তে তো হবেই না তা অনুমান করা কষ্টকর ছিল না। একরাশ হতাশা নিয়ে গাড়িতে উঠলাম, সাথে উৎকণ্ঠা, কাল ডিএলসি শৈবাল দা যখন জানতে পারবেন কি অমৃতবাণী যে শুনতে হবে। কি আর করা যাবে? পথে শৌভিক কুবুদ্ধি দিল ,“ডি এল সি সাহেব বকাবকি করলে বলিস,গোটা পঞ্চাশেক ফর্ম দিয়ে এসেছিস, ওরা ফিল আপ করে টাকা সমেত  ব্লক অফিসে পাঠিয়ে দেবে। ” অগত্যা আমরা ফিরে চললাম, নিকষ অন্ধকারের মধ্যে দিয়ে ফেরাটা রীতিমত রোমহর্ষক ছিল।  অনেক পরে সমীর বাবুকে নামিয়ে যখন আমরা ফিরছি, শৌভিক বলল, “আজকে তোদের নিয়ে আমি বেশ টেনশনে ছিলাম।  জায়গাটা ভাল নয়।  আমার দুই পূর্বসুরীকে ওখানে হেকলড্ হতে হয়েছিল।  তাই একা ছাড়ার সাহস পাইনি। ”
প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য যে দিন দুয়েক বাদে শৈবাল দা যখন জিজ্ঞাসা করলেন,“এই তোমাদের পানিশিউলির মেলা কেমন হল?” আমরা মিথ্যা বলতে পারিনি।  সব শুনে উনি শুধু বলেছিলেন,“ জানতাম। ”

দেখতে দেখতে মাতৃত্বকালীন ছুটি নেবার সময় ঘনিয়ে এল। জুলাই মাস।   প্রাক পরিবর্তন রাজনৈতিক  পরিস্থিতি বেশ উত্তপ্ত হয়ে উঠছে।  ইলেকশন আসতে আর দশ মাস মাত্র।  ওদিকে কিশনজী আর যৌথ বাহিনীর দ্বৈরথ।  খড়্গপুরের এস ডি ও তখন শ্রী অরিন্দম দত্ত। দত্ত সাহেবের ব্যক্তিগত উদ্যোগে মাত্র পাঁচ দিন ছুটি মঞ্জুর  হল শৌভিকের।  আমার বাবার ইচ্ছায় মধ্য হাওড়ার এক সাবেকী নার্সিংহোমে জন্ম হল তুত্তুরীর।  আমাদের বৃহত্তর পরিবারের অনেকেরই পুত্র কন্যা ঐ প্রৌঢ় ডাক্তারবাবুর হাতে হয়েছে।  স্বামী গাইনি, স্ত্রী শিশুরোগ বিশেষজ্ঞ ।  নিজেদের বাড়িতেই নার্সিং হোম।  চিকিৎসা  পদ্ধতি  ও বেশ সাবেকী ।  সাত দিনের আগে ওণারা কাউকে ছাড়েন না।  সেলাই কেটে সপ্তম দিন রেহাই দেন।  রবিবার ভরতি হয়েছিলাম অর্থাৎ পরবর্তী রবিবার সকালের পূর্বে  মুক্তি পাবার সম্ভবনা নেই।  সোম মঙ্গল তো সিডেটিভের ঘোরে কাটালাম কিন্তু বুধবার  সন্ধা থেকে শুরু হল আকুল ক্রন্দন । মনের মধ্যে বারংবার অনুরণিত হচ্ছিল, আর মাত্র কটা দিন, সোমবার ভোরেই ওকে চলে যেতে হবে।  আবার কবে ছুটি মিলবে? আবার কবে দেখা হবে? বারবার তো আর এসডিও সাহেব দাক্ষিণ্য দেখাতে পারবেন না।  শৌভিক সাধ্যমত বোঝাবার আকুল চেষ্টা করতে লাগল।  কান্না আর থামে না। বৃহস্পতিবার কান্নার বেগ বাড়ল বই কমল না।  দীর্ঘ দিনের পরিচিত প্রৌঢ় ডাক্তার দম্পতি প্রায় আত্মীয় সমতুল, প্রথমে সস্নেহে পরে ধমকে বোঝাবার অনেক চেষ্টা করলেন।  বেচারা আমার বৃদ্ধ বাপ বিনা দোষে আমার জন্য বকুনি খেল ডাক্তারের কাছে।  বেশি কিছু তো চাইনি শুধু অনুরোধ করেছিলাম আমাকে মুক্তি দিন।  শনিবার এসে সেলাই কাটিয়ে যাব।  সম্ভবত সবটুকুই ছিল পোস্টন্যাটাল ডিপ্রেসন্। অথবা নয়।  তবে সেদিনের কথা ভাবতে বসলে আজও হৃদয় ব্যথিত হয়। জানি যদিও এরকম  তো কতই হয়-----󾌮󾌮󾌮

(?)

Thursday 3 September 2015

অনির ডাইরি ২৯শে অগস্ট ২০১৫-৩১ শে অগস্ট ২০১৫



আজ অত্যন্ত খুশির দিন  মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রীর কলমের একটি আঁচড়ে  শৌভিকের বিডিও গিরি সমাপ্ত হল  ২০১৩  সাল থেকে শুরু হওয়া অবর্ণনীয় যাতনার আজ অবসান না আমাদের যৌথ সিদ্ধান্ত এই নিয়ে বিন্দুমাত্র  আদিখেত্যা আমরা করব না  তবু মন বারংবার স্মৃতিমেদুর হয়ে উঠছে 
  শ্বশুরমশাই এর কর্কট রোগ ধরা পড়ার পর ওণার সনির্বন্ধ অনুরোধে আইনানুগ বিবাহ চটজলদি সেরে ফেলা হলেও অগ্নিসাক্ষী করে বিয়ে আরো বেশ কিছুদিন পরে  বাবা তখনও জয়েন্ট সেক্রেটারী  আপতকালীন পরিস্থিতিতে প্রবেশনার শৌভিক বদলি হয়ে এল সিউড়ি থেকে আলিপুর আমি তখন এএলসি খড়্গপুর 

সপ্তাহান্তে দেখা হত  বিয়ের পরও ছয় মাস আলাদা আলাদা থাকা শৈবালদা তখন ডিএলসি খড়্গপুর ওণার অনুগ্রহে প্রতি শুক্রবার ২টা ২৫ এর খড়্পুর লোকাল ধরে টা নাগাদ সাঁতরাগাছি  সেখান থেকে হোয়াইট লাইনার ধরে ট্রাফিক জ্যাম না থাকলে সন্ধে  ৭টা নাগাদ এয়ারপোর্ট দুটো দিন কর্পূরের মত উবে যেত  রবিবার দুপুর থেকে শুরু করতাম কান্নাকাটি   সোমবার ভোরে যখন শৌভিক হাওড়াগামী ট্যাক্সিতে তুলে দিত, মনে হত সময় যেন ওখানেই থমকে  রয়ে গেল    আজও মনে আছে সেদিন মেদিনীপুরে চাইল্ড লাইনের কোন অনুষ্ঠান ছিল  অনুষ্ঠান শেষে দেবু সুকন্যার সাথে গাড়িতে ফিরছি শৌভিক ফোন করে জানালো ওর প্রথম পোস্টিং হতে চলেছে লালবাগ  মস্তকে বজ্রাঘাত  তখনও লালবাগে কোন আরএলও (Regional Labour Office ) ছিল না  বহরমপুরের এএলসি লালবাগের দায়িত্বভার সামলাতেন যদি কেঁদেককিয়ে বহরমপুর পাইও তবু একসাথে থাকা অসম্ভব সে যাত্রা শেষ মুহূর্তে জমা দেওয়া বিয়ের নথিপত্র আমাদের খণ্ডিত দাম্পত্যকে জোড়া লাগায়  শৌভিকের প্রথম পোস্টিং বিডিও খড়্গপুর পঞ্চায়েত্ সমিতি

 সবথেকে বেশি খুশি ছিলেন আমার শাশুড়ী মা  আমাদের  লালনীল সংসার হবে শৌভিক যোগ দেবার পর জানা গেল যে প্রাক্তন বিডিও  আপাতত কোয়ার্টার ছাড়তে অপারগ উনি পুরুলিয়া চলে গেলেও ওণার পরিবার এখানেই থাকবে অগত্যা শৌভিককে থাকতে হত বিডিও অফিস সংলগ্ন একটি ছোট্ট  ঘরে  জলচৌকির ওপর চিটচিটে বিছানায় আর আমি যথারীতি  ডেইলি পাষণ্ড   হাওড়া থেকে  খড়্গপুর  ভাবুন কি মর্মান্তিক ব্যাপার, রোজ আমার ট্রেন ওর অফিসের সামনে দিয়ে চলে যেত  তব একঝলক দেখা হত না আমরা ঠিক করলাম খড়্গপুরে বাড়ি ভাড়া নিয়ে থাকব  সেই মত বাড়ি খুজঁতে গিয়ে বৈদ্যুতিক ঝটকা খেলাম  খড়্গপুরের বাড়ি ভাড়া কলকাতার যে কোন সমৃদ্ধশালী এলাকার থেকে  কম তো নয়ই বরং বেশি  সময় কেটে যাচ্ছে হুহু করে  আমাদের এক বৃদ্ধ পিওন পরামর্শ দিল মন্দাকিনী লজে নৈশযাপনের  লিখতে গিয়ে আজ হাসি পেলেও সেই সময় প্রস্তাবটা আমাদের মনঃপূত হয়েছিল  ফোন করে বুক করাতে হত  এক রাতের ভাড়া পঞ্চাশ টাকা মাত্র একটা পুচকে ঘর  ঝুলপরা বাথরুম  একটা ১৪টিভি আর খাট বিছানা  আর কোন আসবাব ছিল কিনা মনে পড়ে না  যে বাচ্চা ছেলেটি  ঘর খুলতে আসত তাকে টাকা দিলে সে নিকটবর্তী কোন দোকান থেকে পরোটা আর ভাঁড় ভর্তি ঝাল আলুরদম এনে দিত  তারপর জগৎ বিচ্ছিন্ন দ্বীপ হয়ে যেত ঘরটা  আমরা ছাড়া আর কাউকে কখনও দেখিনি নিজের বিবাহিত বরের সাথে লজে শিরশিরে  নৈশযাপন অনন্য অভিজ্ঞতা কজনের হয় বলুন?

  লা ডিসেম্বর ২০০৯ আমরা একসাথে থাকতে শুরু করলাম প্রাক্তন  বিডিও সাহেব সময়ের অনেক আগেই কোয়ার্টর খালি করে দেন  একটি ঢাউস ব্যাগ নিয়ে যখন দাশনগর থেকে ট্রেনে উঠলাম বাবার চোখ ছলছল করছিল সেদিন বিকাল বেলা বিডিও অফিসের ড্রাইভার শৈবালদা তাঁর দুধ সাদা অ্যাম্বাসাডর গাড়ি করে আমাকে নিয়ে গেল কোয়ার্টরে নং জাতীয় ধরে বেশ খানিকটা গিয়ে, বাঁ দিকে নয়নমনোহর ইউক্যালিপ্টাসের জঙ্গল পেরিয়ে মাদপুর  গ্রাম  ততক্ষণে  সন্ধ্যা ঘনিয়েছেসভাপতি কাকলি ভুইঞ্যা সাউ অপেক্ষা  করছিলেন যুগলকে একত্রে শুভেচ্ছা জানালেন অতঃপর গৃহপ্রবেশের পালা  ছিমছাম একতলা বাড়ি আম বাগান দিয়ে ঘেরা  পাশেই পুকুর আর ধানক্ষেত একটু দূরেই রেললাইন নিরালা নিস্তব্ধতায় ঘেরা স্বপ্নপুরী
ঈশ্ অরকূট আর নেই  থাকলে  সেই সব মায়াবী দিনগুলির কিছু ছবি পুনরায় শেয়ার করতে পারতাম  সবুজ ধানক্ষেত, টলটলে ডোবা, ঘাড় বেঁকিয়ে  হেঁটে  যাওয়া  উদ্ধত হাঁস আর  ভীতু  ভীতু মুরগির  দল অগুনতি  রঙবেরঙের পাখি আসত  বারমাস কোকিল ডাকত  ভোরবেলা সেই তীক্ষ্ন সুরেলা  গান ঘুম ভাঙিয়েই ছাড়ত  রাতে উত্যক্ত  করত ব্যাঙ আর ঝিঝিপোকাদের সম্মিলিত কোলাহল বেশ শ্লথ গতিতে চলছিল জীবন  অজগ্রামে থেকেও যাবতীয় নাগরিক সুবিধা ভোগ করা  বিরাট একটি মাঠকে ডানদিক থেকে চক্রাকারে ঘিরে ছিল পর্যায়ক্রমে গ্যারেজ, ফুডের গুদাম, বিডিওর করণ, ডোবা যেখানে শৌভিক শখের এনআরএজিএ বিল্ডিংটা আর বানিয়ে আসতে পারেনি, আমাদের কোয়ার্টর, ক্যান্টিন, বিএসএনএলের অফিস আর ব্লক পশুচিকিৎসকের দপ্তর   অফিস চত্বর ফুলগাছ দিয়ে সাজাবার প্রস্তাব দিলেই  স্টাফেরা হাঁহাঁ করে উঠত  ইতিপূর্বে যতবার চেষ্টা করা হয়েছে টিকা নিতে আসা গরুর দল চেটেপুটে সাফ করে দিয়ে গেছে 
সন্ধ্যা নামলেই সব ফাঁকা   অফিসে অফিসে তালা  দূরে গেটের কাছে গ্যারেজের ওপর জয়েন্ট সাহেব থাকতেন  পাশে বড়বাবু আর ইন্সপেক্টর বিসিডব্লু  আর কোণাকুণি ন্যাড়া কোয়ার্টরে আমরা সেই সময় কিশনজীর দাপটে জঙ্গলমহল কাঁপছে  যৌথ বাহিনী সবে ঘুরিয়ে মারতে শুরু করেছে, খবর এল কিশনজী নাকি লুকিয়ে আছে মাদপুরেই থানা বহুদূর প্রায় ১৫ কিমি  তার ওপর থানায় গাড়ির তীব্র অভাব ছিল  পুলিশ আনতে হলে বিডিওকেই গাড়ি পাঠাতে হত আর বিডিও অফিসের নাইট গার্ড? ছিলেন তো  তাঁর নাম ছিল বলাই বাবু  রিটায়ার্ড পঞ্চায়েত্ কর্মী   সন্ধ্যা ঘনালে টর্চ, বালিশ আর বৃদ্ধা স্ত্রীকে নিয়ে আসতেন ডিউটি  দিতে আজো মনে আছে সপ্তাহান্তে বাড়ি ফিরছি, বলাই বাবু গাড়ির জানলা দিয়ে মুণ্ড গলিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন,“ স্যার আপনি কবে ফিরবেন?”
কেন
এজ্ঞে একা থাকতে বড় ভয় করে

একরাতে হঠাৎ  থানা থেকে ফোন এল, গোপন সূত্রের খবর আজ রাতেই বিডিও অফিসে ডাকাত পড়বে  তখন রাত সাড়ে আটটা শৌভিকের কপালে গভীর ভাঁজ  পড়ল  থানা জানালো এই মুহূর্তে যথেষ্ট ফোর্স নেই  রাত এগারোটার আগে কিছু করা সম্ভব নয় একাধিকবার ফোন করার পর বলাই বাবুর সাড়া পাওয়া গেল, সব শুনে তার যা অবস্থা হল তা আর বলছি না  বিরক্ত শৌভিক শুধু বলল,“ তিন তলায় তালাচাবি দিয়ে বসে থাকুন  প্রসঙ্গত সিন্দুক ছিল দোতলায় গা ছমছমে নিস্তব্ধতা   পাল্লা দিয়ে ঝিঁঝির ডাক  খাওয়া দাওয়া মাথায় উঠল  কিছুক্ষণ অন্তর অন্তর শৌভিক বারন্দায় গিয়ে দাঁড়াচ্ছে আর আতঙ্কে আমি অবশ হয়ে যাচ্ছি  লোহার গেটে দাঁড়ালেই প্রথমেই ওকে দেখতে পাবে আর ভাবতে পারছিলাম না  শেষে অনেক ভাবনার পর শৌভিক স্থানীয় এক দোর্দোণ্ডপ্রতাপ রাজনৈতিক নেতাকে ফোন করল  তিনি তৎক্ষণাৎ প্রতিশ্রুতি  দিলেন পার্টির ছেলেদের পাঠাচ্ছেন  “কিচ্ছু চিন্তা করবেন না সার  আমরা আছিআছেন কিনা কিছুই বুঝিনি অবশ্য কাউকেই দেখতে পেলাম না  উৎকণ্ঠার প্রহর আর কাটেই না  শেষে প্রায় মাঝরাতে গাদা বন্দুকধারী  গোটা চার জওয়ান এসে হাজির  স্বস্তির শ্বাস নেবো কি, বলাই বাবু আর নামেও না, গেট খোলে না  বহু ফোন, পুলিশের জীপের হর্ণআমাদের সম্মিলিত চিৎকার , ঘটাং ঘটাং ইত্যাদির পর বলাই বাবুর বউ নেমে এসে গেট খোলে

 সে রাতেই শৌভিককে বললাম, “ বলাইকে কালই দূর করে দেবলাই বাবুর বিরুদ্ধে ক্ষোভ জমছিল বেশ কিছুদিন ধরেই  আমরা না থাকলেই সাধের আম গাছগুলি ফাঁকা হয়ে যেত  অফিস স্টাফেরা একবাক্যে বলাইকে দায়ী করত  ব্লকের যে মাসি আমাদের বাসন মাজতে আসত, তার বক্তব্যানুসারে বলাই তার মেয়েকে বিরক্ত করত এই নিয়ে দিনকয়েক আগেই বলাই বাবুর বউ খুব এক চোট হুজ্জতি করেছিল এসব নিয়ে পঞ্চায়েত্ সমিতিও খাপ্পা ছিল সুতরাং সরিয়ে দেওয়াই যায় শৌভিক দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,“ পারলে এই দণ্ডেই  কিন্তু লোক কই?”
 লোক তো তৈরি  যেদিন আমাদের যুগলে গৃহপ্রবেশ হয়েছিল, সেদিনই তার সাথে আলাপ  শৌভিকই আলাপ করিয়ে দিয়েছিল,“এই যে এরাই আমায় বিগত এক মাস ধরে খাইয়ে পড়িয়ে রেখেছে নিমাইশম্ভু আর ইন্দ্র তিন ভাই, ক্যান্টিন চালায়  নিমাই লম্বা, রোগা, মুখভর্তি না কাটা আধপাকা দাড়িগোঁফ  শম্ভু মেজ  অতটা লম্বা নয়  গাঁট্টাগোট্টা   গোঁফ আছে আর ইন্দ্র নিতান্তই বাচ্ছা ছেলে  ছোট্টোখাট্টো  সর্বদা হাসিখুশি   কিন্তু হাবা যাইহোক আমার বরকে যে কি খাইয়ে রেখেছিল পরদিনই বুঝতে পারলাম  রান্নার  ব্যবস্থা তখনও হয়নি তাই সকালের খাবার ওরাই তিনভাই মিলে নিয়ে এল, লা ওপালার প্লেটে গরম ভাত, বাটিতে ডাল, পোস্তোর বড়া, মাছের ঝাল আর টমেটোর অম্বল

সাথে একটা তরকারি  এটা বিডিও সাহেবের ইসস্পেশাল রান্না  পোস্তোর বড়াটা মুখে দিয়েই ঝটকা খেলাম  “একিরে এতো রসুনের গন্ধ  রসুনের খোলাও আছেশৌভিক মুচকি হেসে বলল, “সবে তো খাওয়া শুরুতরকারিটা মুখে দিয়ে আঁতকে উঠলাম,“এটা কি?” শৌভিক হাসি চেপে বলল,“ কেন? চিনতে পারছিস না?”
অখাদ্য  এটা কি?”
পেঁপে  পোস্তো ঐযে ক্যান্টিনের পাশে যে পেঁপে গাছ আছে, পেঁপের পোস্ত
বাপরে বাপ  কেন যে টিকা নিতে আসা গরুর  পাল পেঁপে  গাছ গুলোকে মুড়িয়ে খেত না কে জানে খেলে আমার পৈশাচিক আনন্দ হত  আর মাছ?দেশি রুই মাছের রিং পিসকে কড়কড়ে করে ভেজে রসুনগন্ধী ঝোলে ফোটানো   এক দুবার খেয়ে আমার মাছে ঘেন্না ধরে গিয়েছিল  সোমবার সকাল ৭টা১০ এর ট্রেন ধরে বেলা ৯টা নাগাদ পৌছতাম  এরপর আর রেঁধে খেয়ে অফিস যাবার অবকাশ থাকত না অগত্যা শম্ভু- নিমাই ভরসা  পইপই করে বলে আসতাম নিরামিষ রান্না করতে, কিন্তু বিডিও সাহেব আর ম্যাডামকে নিরামিষ খাওয়াতে ওদের তীব্র পাপবোধ হত  ফলতঃ দেশি রুই বাঁধা একবার বলে এলাম ডিমের ঝোল করতে এতে রসুন দিলেও সমস্যা  নেই  কত খারাপ আর করবে  খেতে বসে ভির্মি খেলাম  শৌভিকও আমার ওপর ক্ষেপে গেলওকে না জিজ্ঞাসা  করে নির্দেশ দেবার জন্য  কি দেখলাম? এক বাটি লালচে হলুদ ঝোল তাতে ভাসছে একটি ডিম এবং গুটিকয়েক ঝিঙে ক্যান্টিনের পিছনে যে একটি ঝিঙে গাছ হয়েছে আমি খেয়াল করিনি

 যাই হোক এই শম্ভু বেশ কিছুদিন ধরে আমাকে বারবার অনুরোধ করছিল, নাইট গার্ডের পদটির জন্য ব্লকের এফ এবং অমল বাবু ছিলেন শৌভিকের ডান এবং বাঁ হাত দুজনে মিলে এই কুবুদ্ধিটা দিয়েছিলেনম্যাডামকে ধর ম্যাডামকে বললে সার না করবেননিযত বলতাম,“তা তুমিই বল
না আপনি বলেন ভয় করে
সেরাতে সত্যই বললাম  শৌভিক বলল,“জানি কিন্তু পারবে না

মুখে যাই বলুক অচীরেই বলাই বাবুর জায়গায় শম্ভু বহাল হল ঠিক এই সময়ই সপ্তাহখানেক ছুটি নিতে হল দিন দশেক পরে অফিস করে ফিরছি, দেখি আমার আগে আগেই বলাই বাবু তার বউ, টর্চ আর বালিশ নিয়ে ঢুকছেন  শৌভিক ফিরতেই জিজ্ঞাসা  করলাম,“বলাই বাবু আবার কি করতে এলেন?”
নাইটগার্ড ” 
 “শম্ভু?”
চাকরি ছেড়ে দিয়েছে
মানে? কেন?”
 “ বউকে ছেড়ে থাকতে পারছে না  বউও নাকি কান্নাকাটি করছে
ধপ্ করে বসে পড়লাম চেয়ারে খানিকপরে আবার জিজ্ঞাসা  করলাম,“হ্যাঁরে সত্যি বউ ছেড়ে থাকতে পারছে না? নিজের বউ? ” শৌভিকের সেই দমফাটা হাসি আজো মনে পড়ে
পুনশ্চ শম্ভু তখন মধ্যচল্লিশ তো বটেই
মন্দ কাটছিল না মাদপুর বাস সকালে কোকিলের ডাকে ঘুম ভাঙা থেকে  নিশুতি রাতে ঝিঝিপোকার ডাকে ঘুমিয়ে পড়া  মিনিট চার হাঁটলেই রেল লাইন, লাইন পেরোলেই বাজার  টাটকা সবজিদেশী মুরগির ডিম, হরেকরকম শাক একবার শৌভিককে ওর কোন স্টাফ এক ব্যাগ নিজের ক্ষেতের বাদশাভোগ চাল দিয়েছিল সে যে কি দেবভোগ্য বস্তু তা ভাষায় অপ্রকাশ্য   অনভিজ্ঞতা বশতঃ চাল শেষ হয়ে যাওয়ায় চালের ভাত করেছিলাম  গোটা কোয়ার্টর সুরভিত হয়ে উঠেছিল অতি মূল্যবান বাসমতি চালেও কখনত্ত সে সুগন্ধ পাইনি  বাজার করে দিতেন শৈবাল দা  আমাদের শত অনুরোধেও উনি বেশি করে সব্জি বা মাছ আনতেন না  বললে বলতেন ,“ফ্রীজে রাখা মাছ সবজি খাবেননি স্যার ”   দৈবাৎ শৈবাল দা না থাকলে আমাদের ম্যান ফ্রাইডের নাম ছিল জামাই  কস্মিনকালে কোন স্টাফের তুতো  জামাই ছিল হয়তো, জামাই এর একটি জম্পেশ মুসলিম নাম ছিল যা দীর্ঘ আড়াই বছরে আমরা জেনে উঠতে পারিনি ব্লক অফিসের পাঁচিল ঘেষে ছিল জামাই এর ছোট্ট মণিহারি দোকান কিন্তু ব্লক অফিসের  সর্বঘটে জামাই ছিল কাঁঠালীকলা ট্যাঙ্কে জল নেই, পাম্প  চালাবে কে? লোডশেডিং, জেনারেটর চালাবে কে? ট্রাক থেকে  মাল নামাতে লোক ডাকবে কে? মোট কথা জামাইকে ছাড়া ব্লক অফিস কানা শুধু নয় নিতান্তই অক্ষম

কনকনে শীত  মনোরম পুষ্পশোভিত বসন্ত মাদপুর অপরূপা  নাম না জানা রঙ বেরঙের কত যে ফুল ফুঠত  শীতে যাত্রা হত দিন সাতেক আগে থেকে চলত তার ঘোষণা, সাথে তারস্বরে  বাজত বাংলা সমসাময়িক সিনেমার গান  একই গান বারবার লাগাতার সোহম-পায়েল বেশ কয়েকবার ঘুরে গেল, কখনও মাদপুর, কখনত্ত শ্যামচক, কখনত্ত বা বালিচক   সবথেকে বড় হাঙ্গামা হল যে বার বালিচকের ছেলে শ্রীযুক্ত দেবকুমার অধিকারী এলেন মাদপুরে সেবার উদ্যোক্তারা নাছোরবান্দা বিডিও সাহেবকে দেখতে যেতেই হবে যায়নি যদিও চোখের পলকে সপ্তাহ পার হয়ে যেত  শনিবার বিকাল থেকে নিস্তব্ধতা অসহনীয় হয়ে উঠত

মনোরম  মাদপুর রাতারাতি ভোল বদল করল এপ্রিল থেকে  মার্চ মাসেও রাতে হাল্কা  গায়ের চাপা লাগত, হঠাৎ শুরু হল তীব্র দাবদাহ  ভয়াবহ চামড়া জ্বালানো রোদ সাথে মারাত্মক  আদ্রতা  দিন যাও বা ব্যস্ততার মধ্যে কেটে যেত,রাত কাটতেই চাইত না  কোয়ার্টর ছাড়ুন খোদ বিডিও অফিসেই কোন বাতানুকূল যন্ত্র ছিল না  কারণ আর কিছুই না, রেল লাইনের দিকে বিদ্যুত সরবরাহকারী এক অতি দুর্বল ট্রান্সফরমার বারংবার অনুরোধউপরোধ, চিঠি চাপাটি, ধমক, হুমকি সব ব্যর্থ বাতানুকূল যন্ত্র ছাড়ুন, ভোল্টেজের এত ভয়াবহ অবস্থা ছিল

যে  আমরা রীতিমত প্রার্থনা করতাম, যাতে রাতে লোডশেডিং হয়, ইনভার্টররের দৌলতে অন্তত পাখাটা তো জোরে ঘুরবে  শুধু গরম না সাথে দেখা দিল ভয়াবহ পোকামাকড়ের উৎপাত   বিভিন্ন আকৃতি এবং বর্ণের শয়ে শয়ে  পোকা  কেউ আসত ঝাঁক বেঁধে কেউ ছিল একাই একশ  সন্ধ্যাবাতি জ্বললেই ঝাঁকে  ঝাঁকে উড়ে আসত পাশের ধান ক্ষেত থেকে  প্রাণান্তকর গরমেও সব জানলা ঢেকে ফেলা হল হলুদ নাইলনের নেট দিয়ে  বারন্দার দিকের সব দরজা হয় বন্ধ রাখতে হত নতুবা বাতি নিভিয়ে নিকষ আঁধারে খুলতে হত  সব রকম সাবধানতা অবলম্বন করা সত্ত্বেও তারা আসত বিশেষ করে রান্না করার সময় একাকী আমাকে আক্রমন করে তাদের যে কি অপরিসীম  উল্লাস হত তা আজো এক রহস্য

মনে আছে একবার রান্নাঘরে  ঢুকেই উচ্চঃস্বরে কাঁদতে কাঁদতে বেড়িয়ে এসেছি, শৌভিক ইউটিউবে ভিভ রিচার্ডসের খেলা দেখছিলআতঙ্কিত হয়ে দৌড়ে এল  পটল ভাজতে দিয়ে এক পলকের জন্য রান্নাঘর ছেড়ে এসেছি, ওমনি কোথা থেকে একটি মথ ঝাঁপিয়ে  পড়েছে গরম তেলে আত্মহত্যা করতে  গিয়ে দেখি পটল এবং মথ একসাথে পক্ক হচ্ছে!!
 শুধু পোকা কেন এত সুপুষ্ট টিকটিকি অন্য কোথাও খুব বেশি দেখিনি  টিকটিকিগুলির আজব বৈশিষ্ট্য ছিল, ঘরের এমন এক কোণায় গিয়ে দেহত্যাগ  করত, যে আমরা শত অন্বেষণেও হদিশ পেতাম না  শুধু গন্ধে গোটা বাড়ি করত  এছাড়াও ছিল ব্যাঙ  যখন তখন বিনানুমতিতে প্রবেশ করত এবং ব্যাপক লম্পঝম্প জুড়ত  হাওয়াই চপ্পল ফটফটিয়ে ব্যাঙ তাড়াতে শৌভিক বিশেষজ্ঞ  হয়ে উঠেছিল  সাপ অবশ্য প্রথম ঢুকেছিল আমি বদলি হবার পর

তবে নিঃসন্দেহে মাদপুরে ভিআইপি ছিল ধেড়ে ইঁদুর প্রায় ছুঁচোর সমান আকৃতি এবং বিডিও কে বিন্দুমাত্র  ভয় পেত না  শৈবাল দা খুঁজে  খুঁজে বিষ আনত,পরম যত্নে আমার বর কখনত্ত চানাচুর, কখনত্ত বা আটার গুলি দিয়ে তা মেখে টোপ ফেলত  সব চেটেপুটে সাফ করে দিলেও কিছু হত না  ওদের প্রিয় খাদ্য ছিল সাবান সুগন্ধী সাবান কিন্তু   কাপড়কাচা সাবান স্পর্শও করত না  এমনকি সাবান কেস বাদ যেত না মাঝে মাঝে গভীর রাতে খাটের ওপর দিয়ে শর্টকার্ট নিত  আমি কখনও অনুভব করিনি যদিও  শৌভিকের কষ্টকল্পিত হতেও পারে

 দেখতে দেখতে এসে গেল আমাদের প্রথম বিবাহ বার্ষিকী   সপ্তাহের মাঝে তো আর এস ডিও বা ডিএলসি সাহেবের কাছে বেয়াড়া আবদার করা যায় না  অগত্যা অন্যান্য  দিনের মতই যে যার অফিস গেলাম  বন্ধু বান্ধব ,আত্মীয়-স্বজন  ফোনে শুভেচ্ছা  জানালেন ডিএলসি শৈবাল দা ঠাট্টার সুরে লেগপুল করলেন, কোথাও ঘুরতে যায়নি বলে  ঠাঠা রোদে কোথায় বা যেতাম? দুঃখী মনে কাজ করছি হঠাৎ শৌভিকের ফোন,“দূরঃ  জাহান্নামে যাক সব  চল কোথাও ঘুরে আসি রেডি থাক  আসছি
দুপুর তিনটে নাগাদ আমরা রওনা  হলাম ড্রাইভার শৈবাল দাকে বলা হল আজ আমাদের বিশেষ দিন একটা জম্পেশ জায়গায় নিয়ে চল  ধূধূ ফাঁকা রাস্তায় লাগাম ছেড়ে দৌড়ল গাড়ি  লাল মোরাম বিছানো পথ ধরে, ঘন নিরিবিলি ঝাউ আর ইউক্যালিপটাসের জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে, উচ্চাবচ কালভার্ট পেরিয়ে হারিয়ে যাওয়া  নির্বাক নিশ্ছিদ্র   ভালোলাগায় মন যখন কানায় কানায় ভর্তি  হঠাৎ গাড়ি থামিয়ে শৈবাল দা বলল,“যান স্যার খুব ভাল লাগবেতৎকালীন মেদিনীপুরের সবথেকে বড় এবং জনপ্রিয় পার্ক, নাম ঝিলমিল অল্পবয়সীদের প্রিয় রোমান্টিক ডেসটিনেশন তবে আদপেই সেন্ট্রাল পার্ক সুলভ নয়  শৌভিক কিছুতেই নামবে না  বেচারা শৈবাল দা হতভম্ব   এমন সুন্দর পার্ক সাহেবের নাপসন্দ? আর আমি অসভ্যের মত হেসেই যাচ্ছিলাম

(চলি?)