Monday 28 March 2016

বসন্তপূর্ণিমা



আমরা ছয় ‘তারা’, রাখী, সঞ্চিতা, চৈতালি, অস্মিতা, অন্তরা আর আমি অনি। আসলে আমাদের স্কুলের নাম ছিল ‘তারাসুন্দরী বালিকা বিদ্যাভবন”। এককালে হাওড়ার শ্রেষ্ঠতম মেয়েদের স্কুল হিসেবে পরিগণিত হত, আজ যদিও সে গরিমায় ক্ষয় রোগ লেগেছে। যাই হোক, তারাসুন্দরীর প্রাক্তন ছাত্রী হিসাবে আমরা নিজেদের ‘তারা’ বলে পরিচয় দিতে অত্যন্ত শ্লাঘা বোধ করি।
স্কুলে যে  আমরা একে অপরের খুব ঘনিষ্ট ছিলাম তা নয়, স্কুল ছাড়ার পর তো প্রায় কারোর সাথে কোন যোগাযোগই ছিল না। ভয়াবহ জীবন সংগ্রামে ব্যাপ্ত ছিলাম প্রত্যেকেই।নতুন করে যোগাযোগ হয় আবার অর্কুটের মাধ্যমে। পরবর্তী কালে সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিলেন মার্ক জুকারবার্গ। ফেসবুকের দৌলতে আরও কাছাকাছি এলাম আমরা, আর হোয়াটস্ অ্যাপ আসার পর তো যাকে বলে ‘জমে ক্ষীর।”
এ বছর দোল, হোলি আর গুড ফ্রাইডে মিলে বেশ কয়েকদিন ছুটি পাওয়া গেছে। সবথেকে মজার কথা হল এই ছুটিটা যেমন অস্মিতা, সঞ্চিতা আর আমার মত সরকারী লোকজন পেয়েছে, তেমনি রাখী আর চৈতালির মত কর্পোরেট সেক্টরের লোকজনও বঞ্চিত হয়নি। সর্বসম্মত ভাবে ঠিক হল, দোলের দিনটা ‘আমরা’ এক সাথে কাটাব। শুধু আমরা, বর বাচ্ছা নয়। একদিনের জন্য বরেরা বাচ্ছা সামলাবে আর মায়েরা পার্টি করবে। দিনের বেলা চুটিয়ে রঙ খেলা, সাথে ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা বীয়র আর রাতে পূর্ণ চন্দ্রের চাঁদোয়ার নীচে গালিচা পেতে জমজমাট বসন্ত উৎসব। পরিকল্পনা তো দুদ্ধর্ষ, কিন্তু জায়গা কোথায় পাই? সিদ্ধান্ত নিতে নিতে এতটাই দেরি হয়ে গেল যে, এখন আর কাছেপিঠে কোন হোটেল বাঁ রিসোর্ট ফাঁকা নেই। নিরাপত্তার কথাটাও তো ভাবতে হবে। কারো বাড়িতে হলে সবথেকে ভালো হত, কিন্তু আমাদের মধ্য হাওড়ার বাবা মায়েরা এখনও এত উদার হতে পারেননি, যে ছ ছটা ধিঙ্গি মেয়ে আকণ্ঠ বীয়র (পড়ুন মদ) গিলে উদ্দাম নাচন কোঁদন করবে আর রঙ খেলবে তা তারা মেনে নেবেন। বর বাচ্ছা ফেলে বন্ধুদের সাথে দোল খেলা ব্যাপারটাই বেশ দুষ্পাচ্য ওনাদের পক্ষে।
জায়গার অভাবে সমস্ত পরিকল্পনাটাই যখন ভেস্তে যেতে বসেছে, দেবদূতের মত এসে হাজির হল সৃজা। চৈতালির সহকর্মী সৃজাদের একটি পৈত্রিক বাড়ি আছে, আমতাতে। বর্তমানে ফাঁকাই পড়ে থাকে। এক বৃদ্ধ কেয়ারটেকার  দম্পতি ভিন্ন কেউই থাকে না। সেখানে দোল খেলাই যায়। তবে শর্ত হল, সৃজাকেও দলে নিতে হবে।
দোলের দিন ভোর বেলায় রাখীদের বড় গাড়ি করে আমরা বেড়িয়ে পড়লাম, সৃজাদের বাড়িটা ঠিক আমতায় নয়, আমতা থেকে বেশ দূরে একটি ছোট গ্রামে। গ্রামের নামটি ভারি সুন্দর সিরাজবাটি। দূরত্ব হাওড়া শহর থেকে ৩৫ কিমি মত। গ্রামের মূল জনবসতি থেকে বেশ দূরে পাঁচিল দিয়ে ঘেরা সৃজাদের বিশাল পুরানো আমলের বাড়ি। কোন এককালে হলুদ রঙ করা ছিল, এখন ফ্যাকাসে, বেশ বিবর্ণ। জায়গায়  জায়গায় পলেস্তারা খসে পড়েছে। পাঁচিলের গায়ে সবুজ রঙ করা লোহার দরজা, গাড়ির আওয়াজ পেয়ে এক সৌম্যদর্শন বৃদ্ধ দরজা খুলে দাঁড়িয়ে ছিলেন। পরনে নীল লাল চেক লুঙ্গি আর গায়ে সাদা ফতুয়া। সৃজা আলাপ করিয়ে দিল, “ এই হল আমার রিয়াজ চাচা। রিয়াজুল মিয়াঁ, উনি আর সালেহা চাচী মিলেই বাড়িটাকে টিকিয়ে রেখেছেন।” বৃদ্ধ অল্প লজ্জিত হয়ে এগিয়ে এসে মালপত্র নামাতে গেলেন, আমরা হাঁহাঁ করে উঠলাম। আমরা থাকতে এক বয়ঃজ্যেষ্ঠ মোট বইবেন? গাড়িটাকে ছেড়ে দেওয়া হল। কোন সাক্ষী রাখতে আমরা চাই না।
অপরিসর সবুজ রঙের দরজাটি এই বিশাল অট্টালিকার সাথে একেবারেই বেমানান। বোঝাই যায়, পরবর্তী কালে বাস্তুসহ সমগ্র জমিটি পাঁচিল দিয়ে ঘেরা হয়েছে, সম্ভবত জবরদখল ঠ্যাকাতে। দরজা দিয়ে ঢুকেই বিরাট পাকা উঠান। তকতক করছে, কোথাও কোথাও দুষ্টু আগাছা এবং ঘাসের গোছা মাথা তুলে দাঁড়াবার চেষ্টা করছে বটে, তবে তাদের যে নিয়মিত নির্মূল করা হয়, তা বলাইবাহুল্য। উঠোনের এক পাশে পূর্ব মুখী অট্টালিকা, এক কোণে একটি টিউবওয়েল, পাশেই রান্নাঘর এবং সম্ভবত রিয়াজুল মিয়াঁর থাকার ঘর। বাকি চার পাশেই আম, কাঁঠাল, বেল, পেয়ারা, যজ্ঞিডুমুর, নাগকেশর, নারকেল আর সুপারি গাছের বাগান। পশ্চিমদিকে একটা মজা পুকুর আছে। সৃজা বলল খিড়কি পুকুর। আগে বাড়ির মেয়েরা ঐ পুকুর ব্যবহার করত।
উঠোন থেকে দুই ধাপ লম্বা সিঁড়ি দিয়ে উঠে লম্বা দালান। চকচকে লাল মেঝে, কালো পাড়। কোন এক কালে খোলা বারান্দা ছিল, ওপর থেকে জাফরি কাটা সানশেড রোদ আর বৃষ্টির ঝাট থেকে বাঁচাত। পরবর্তী কালে নিরাপত্তার স্বার্থে গ্রিল বসানো হয়েছে।দালানে একটি চৌকি পাতা, চৌকির ওপর মাদুর বিছানো।  কচি সূর্যের কাঁচা সোনা রোদ জাফরি দিয়ে অনুপ্রবেশ করে লাল মেঝেতে চিত্র-বিচিত্র আল্পনা কাটছে। পূর্ব দক্ষিণ খোলা, হুহু করে বাতাস সব লণ্ডভণ্ড করে দিচ্ছে। বেশ গরম থাকা সত্ত্বেও বৈদ্যুতিক পাখা চালানোর প্রয়োজনই বোধ হয় না।
চৈতালি ডিএসএলআর ক্যামেরা বার করে পটাপট ছবি তুলতে লাগল, রাখী, সঞ্চিতা আর আমি ব্যস্ত হয়ে পড়লাম নানা পোজে সেলফি তুলতে। অস্মি গুনগুন করে গান ধরল, “আজি এ বসন্তে...”।অন্তু রঙ, আবির বার করতে লাগল আর সৃজা জলদি বীয়রের বোতল গুলো ফ্রিজে তুলতে নিয়ে গেল। একতলায় একটি ঘরই খোলা, সেখানে একটি সাবেকী ১৬৫ লিটারের লাল রঙের ফ্রিজে কোন মতে বোতল গুলি ঢোকানো হল। এটি সম্ভবত খাবার ঘর। একটি পরিচ্ছন্ন কিন্তু মলিন খাবার টেবিল আর চারটি চেয়ার পাতা। এ বাড়ির আভিজাত্যের তুলনায় নেহাত খেলো।
“আমরা দোতলায় থাকব।” ঘোষণা করল সৃজা। “দোতলার ঘর গুলো খুলে দেওয়া হয়েছে, তোমরা চেঞ্জ করতে চাইলে, করে নিতে পারো। দোতলায় বাথরুম একটা আছে বটে,  তবে সেটা আপৎকালীন। চান বা বড় কাজ করতে হলে নীচে নামতে হবে” বলে সৃজা হেঁহেঁ করে হেসে উঠল। মালপত্র নিয়ে দোতলায় উঠে মন ভরে গেল। একতলার মত এখানেও খোলা ঝুল বারন্দাকে নিরাপত্তার স্বার্থে গ্রিল দিয়ে ঘেরা হয়েছে। মূল জনবসতি থেকে বেশ খানিকটা দূরে হওয়ায়, চকচকে নীল আকাশটা যেন হাতের মুঠোয়। বিশাল বিশাল ঘর গুলি ঝকঝক করছে, সাদা চুনকাম করা দেওয়াল, ঠাণ্ডা লাল মেঝে, প্রতিটি ঘরে সাত ফুট উঁচু তিনটি করে জানলা যেন আলোর ঝর্না । শিফনের মত পাতলা রঙ জ্বলে যাওয়া পর্দা হাওয়ায় পতপত করে উড়ছে। ছত্রীওলা সাবেকী খাটে টানটান করে বিছানা পাতা। দেখলেই গড়িয়ে পড়তে ইচ্ছে করে, রাজ্যের ক্লান্তি যেন ঘুম হয়ে নেমে আসে চোখে।
গরম গরম লুচি, হলুদ ছাড়া আলু চচ্চড়ি আর ঘিয়ের গন্ধ ওঠা হালুয়া নিয়ে এলেন রিয়াজ চাচা সাথে ঘোমটা মাথায়, সাধাসিধে শাড়ি পরা, বেশ ফর্সা এক বয়স্ক মহিলা। সৃজা আলাপ করিয়ে দিল, “সালেহা চাচী। বলেছি না এঁরা আছেন বলেই বাড়িটা আছে। ”ভদ্রমহিলা লাজুক হেসে হাতজোড় করে নমস্কার করলেন।
গরম চা আর জলখাবারের পর খানিক গড়িয়ে নিয়ে শুরু হল, আমাদের রঙ খেলা। হোলি পার্টির থিম ছিল সাদা জামা আর হাফ প্যান্ট।সদর দরজায় খিল দিয়ে দিল সৃজা, যাতে অবাঞ্ছিত কেউ না এসে হাজির হয়। ছয় জোড়া মোবাইল একত্রে গেয়ে উঠল, “ রঙ বরষে......”। উদ্দাম নাচ, বীয়র আর রঙ। ছবি তোলা মাথায় উঠল, কে কার ছবি তোলে? প্রবল হুল্লোড়ের মধ্যে অন্তু শুধু একবার বলে উঠল, “এই রিয়াজ চাচারা কিছু মনে করছে না তো? এই বেলেল্লাপনা দেখে?” সৃজা বলল, “ফোঁৎ”। আমি বললাম, “আর প্রতিবেশীরা?”। সৃজা এক লম্বা চুমুক বীয়র খেয়ে, বাঁ হাতের মধ্যমা উঁচু করে দেখালো। “ইয়েস্” আমরা চেঁচিয়ে উঠলাম। রাখী সৃজার রঙিন গালে চকাস করে একটা চুমু খেয়ে বলল, “দ্যাট্ শুড বি দা স্পিরিট সুইটহার্ট।” সৃজা অর্ধেক সুরে, অর্ধেক হেঁড়ে গলায় গেয়ে উঠল, “ দুনিয়া নে হামকো দিয়া ক্যায়া/ দুনিয়া সে হামনে লিয়া কেয়া? হাম সব কি পরোয়া করে কিঁউ/ সব নে হামারা কিয়া কেয়া?”।


আশ মিটিয়ে, বাঁধন ছিঁড়ে, উদ্দাম দোল খেলে, দুপুর বেলায় দিশী মুরগীর ঝোল ভাত খেয়ে, তোফা দিবানিদ্রা দিয়ে, বিকালে যখন ঘুম ভাঙল, মনটা বেশ খারাপ হয়ে গেল। একদিকে সন্তানদের জন্য এবং অস্বীকার করে লাভ নেই তাদের বাবাদের জন্য দমচাপা কষ্ট অপরদিকে এত সুন্দর দিনটা কেটে যাবার আফসোস। কাল থেকে আবার সেই থোড় বড়ি খাড়া। সন্ধ্যে হতে না হতেই ভোল্টেজ কমতে লাগল। টিমটিমে মন খারাপ করা আলোয় বাড়িটা যেন গাছমছমে পোড়ো ভূতুরে বাড়ি বলে মনে হচ্ছিল।সাথে ঝিঁঝিঁ পোকাদের সম্মিলিত সঙ্গীত যথোচিত আবহ তৈরি করছিল। তাল কাটল দোল পূর্ণিমার পূর্ণচন্দ্র। এমন মোহন জ্যোৎস্না কলকাতায় দুর্লভ।ঝকঝকে কালো আকাশে অসংখ্য হীরের কুঁচির মত তারাদের মাঝখানে প্রকাণ্ড রূপার থালার মত চাঁদ। সন্ধ্যে বেলার থিম ছিল তাঁতের শাড়ি, বড় টিপ, আর মাথায় ফুল। আমি বায়না ধরেছিলাম পলাশ ফুল চাই, যদিও শেষ পর্যন্ত তা আর হয়ে ওঠেনি। তাই ফুলটা সর্বসম্মত ভাবে বাদ দেওয়া হয়। চৈতালি বাদে, বাকি সবাই শাড়ি পরে তৈরি হয়ে দেখি, উঠোনে চৌকি পেতে সান্ধ্য আসরের আয়োজন করে ফেলেছেন চাচা। মাদুরেরে ওপর একটা পুরানো তোশক পেতে গুটি কয়েক তাকিয়াও দিয়ে দিয়েছেন। আয়োজন চমৎকার। কিন্তু চৈতালিই আমাদের মনের কথাটা বলল, “এখানে কেন? বসলে ছাতে বসব।” ছাত শব্দটা সৃজা বা রিয়াজ চাচা দুজনেরই পছন্দ হল না। দুজনেই বললেন, “আবার ছাতে কেন? অনেকদিন কেউ যায় না। পরিষ্কার-টরিষ্কার হয় না। এখানেই ভাল।” সৃজা মৃদু আপত্তির সুরে বলল, “চাচার পক্ষে ছাতে চা নিয়ে যাওয়াটা এই বয়সে...”। চৈতালি থামিয়ে দিয়ে বলল, “ কেন বে? আমরা কি এতটাই অক্ষম, যে চাচা চা নিয়ে যাবে? ছাড় তো। হাঁক পেড়ো চাচা এই মোটি গুলো এসে নিয়ে যাবে। যা গিলেছে মাইরি, সবকটার এক্সসাইজ করা দরকার।”
অবশেষে ছাতে বসা হল। উত্তর পশ্চিম কোণে ছাতেওঠার সিঁড়ির দরজা আর দক্ষিণ-পূর্ব কোণে একটা বন্ধঘর, সম্ভবত ঠাকুরঘর, মাঝে বিশাল ছাত। বেশ পরিষ্কার। কোথা থেকে মিষ্টি ফুলের গন্ধ ভেসে আসছে, ঝাঁক ঝাঁক জোনাকি উড়ছে, আর চাঁদের আলোয় ধুয়ে যাচ্ছে গোটা ছাত। অস্মি গান ধরল, “আজ জ্যোৎস্না রাতে সবাই গেছে বনে...।” অস্মি এর থেকে অনেক ভাল গায়, কিন্তু আজ এই মায়াবী পরিবেশে যে মাদকতা ছড়িয়ে পড়ছিল, তা আগে কখনও শুনিনি। প্রতিটি শব্দ যেন আছড়ে পড়ছিল প্রতিটি রোমকূপে। আমি বাদে একে একে সকলেই গান গাইতে লাগল। আজ বোধহয় কেউ চাইলেও বেসুরে গাওয়া সম্ভব ছিল না। চৈতালি আর সৃজা অসাধারণ কবিতা শোনালো। এবার আমার পালা। গানটা বেসুরে মন্দ গাইনা, কিন্তু আজ এই সুরের মূর্ছনায় কিছুতেই গাইতে পারলাম না। ভয় করছিল আমি গাইলেই এই মায়াজাল কেটে যাবে। কিছুতেই গাইব না, ওরাও ছাড়বে না। নেহাত বসন্তপূর্ণিমার সন্ধ্যা তাই কেউ অসংস্কৃত শব্দ প্রয়োগ করছে, না হলে নির্ঘাত আমার কান দিয়ে রক্ত বার করে দিত।  ইতিমধ্যে রিয়াজ চাচা কখন চা নিয়ে এসেছেন কেউ খেয়াল করিনি, আমাদের বাকবিতণ্ডা শুনে চাচা বললেন, “ তা মণি, তুমি গান না গাও একটা গল্পই শোনাও না।” সবাই সমস্বরে বলে উঠল, “একদম।” সঞ্চিতা আব্দার করল, “ প্লিজ বল অনি। এই চাঁদনী রাতে ভুতের গল্প দারুণ জমবে।” সৃজা আর রিয়াজ চাচা আঁতকে বলল, “এই ভূত নয়! ভূত নয়! খোলা ছাতে ভূত জীন পরির গল্প না বলাই ভাল।” চৈতালি আবার সবাইকে থামিয়ে বলল, “ যা খুশি বল। তবে বস ওরিজিনাল চাই।”
বিরক্ত হয়ে বললাম, “দূর শালা। এভাবে গল্প বানান যায়?” এক ঢোঁক চা খেয়ে সৃজাকে জিজ্ঞেস করলাম, “ সৃজা তোমাদের এই বাড়িটা কতদিনের পুরানো?” “তা দু-আড়াইশ বছর তো হবেই। আমার প্রপিতামহের বাবার বানানো” একবার রিয়াজ চাচার দিকে তাকিয়ে জবাব দিল সৃজা। হঠাৎ মাথায় একটা প্লট এল, রহস্য করে বললাম, “বেশ।আমি গল্প বলতে পারি, কিন্তু মাঝে কেউ বাধা দিতে পারবে না। ছোটো-বড় যার যে বাইরে যাবার আছে, বিঁড়ি ফোঁকার আছে এই বেলা সেরে নাও।” রাখী আর সামলাতে পারল না, “ বল না শালি। কেউ বিরক্ত করব না” বলেই এক গলা জিভ কাটল, রিয়াজ চাচার উপস্থিতিটা খেয়াল করতে পারেনি।
“বেশ। আজ থেকে সোয়াশ বছর আগে এক সম্পন্ন ব্রাহ্মণ ছিলেন, নাম ধরা যাক তারাপদ বাবু। তখন বৃটিশ আমল, চতুর্দিকে পাকা রাস্তা তৈরি হচ্ছে, তারাপদ বাবু সাহেব কোম্পানিকে ঘেঁষ সাপ্লাই করে প্রচুর ধনসম্পদ বানিয়েছিলেন। ভদ্রলোকের তিন পুত্র দুর্গাপদ, দুর্গানাথ আর দুর্গাচরণ। আর তিন কন্যা পদ্মাবতী, হৈমবতী আর শ্রীমতী। পদ্মাবতীর বিয়ে এক বিরাট বড় ঘরে হয়। পদ্মাবতীর শ্বশুর ছিলেন তৎকালীন জাঁদরেল ব্যারিস্টার। তাঁর তিন পুত্রই বাবার দৌলতে নামী সওদাগরী অফিসে চাকরী পায়। বিশাল বাড়ি, বাড়িতে নাকি ৭৫টা ঘর। এমনকি পান সাজার জন্যও একটি আলাদা কাঁচের ঘর ছিল। বাড়িতে গণ্ডা গণ্ডা ঝি চাকর আর আশ্রিত।বাড়ির মেয়ে বউদের গায়ে থানথান সোনার গয়না, তারাপদ বাবুর বদ্ধমূল ধারণা ছিল, যে পদ্মা রাজরানী হয়ে, চিরসুখে জীবন কাটাবে। কিন্তু বাস্তবে দেখা গেল যে, ব্যারিস্টার সাহেবের তিনপুত্রই অকালকুষ্মাণ্ড। সবকটাই রেসুড়ে এবং মদ্যপ। পিতার মৃত্যুর অল্পকালের মধ্যেই কুবেরের ঐশ্বর্য রেস খেলে উড়িয়ে দিল। এমনকি পদ্মার বিয়ের গয়নাগুলিও বাদ গেল না। কর্মক্ষেত্রে চুরিচামারি করার জন্য চাকরী গুলি গেল আর মদ খেয়ে লিভার।অকাল বিধবা হয়ে তরুণী পদ্মাবতী ফিরে এল তিন কন্যা সন্তানের হাত ধরে।  
কুলীন বংশের ওপর তীব্র বিতৃষ্ণা জন্মাল তারাপদ বাবুর। মেজমেয়ে হৈমবতী যখন বিবাহযোগ্যা হল, তিনি ঠিক করলেন, ঢের হয়েছে, এবার কোন মধ্যবিত্ত উচ্চশিক্ষিত উদ্যোগপতির সাথে হৈমর বিয়ে দেবেন, যে অন্তত স্বোপার্জিত অর্থের মুল্য বুঝবে। হৈম ছিল তারাপদ বাবুর সবথেকে আদরের সন্তান। ছোটোখাটো গোলগাল, ছোটো গভীর চোখ, বড়ির মত নাক, দুষ্টুমিষ্টি হাসি, কোমর অবধি কোঁকরা চুল আর দুধে আলতা গায়ের রঙ। বাবা এবং দাদারা আদর করে ডাকতেন গুলবদন বেগম বলে, সংক্ষেপে গুলু। বউদিদিরাও গুলু বলে ডাকত বটে, তবে আড়ালে বলত ‘গুলেবকাওলি’। গুলু অর্থাৎ হৈমর কল্পনাশক্তি ছিল প্রখর, তিলকে তাল করতে জুড়ি মেলা ভার।
এ হেন হৈমর জন্য বর খুঁজতে কোন সমস্যা হল না। সুপাত্র নিজেই এসে ধরা দিল। তৎকালীন ‘জুপিটার’ নামক নামী বীমা কোম্পানির বেশ উঁচু দরের অফিসার। কলকাতা তথা পূর্ব ভারতে বীমা কোম্পানির প্রধান নিয়ন্ত্রা। বাতাসে গুজব যে জুপিটার কোম্পানির মালিক বুড়ো সারাভাই কর্তার বিশেষ স্নেহধন্য। শীঘ্রই এম ডি হতে চলেছেন। আদতে কাশীর প্রবাসী বাঙালি, পিতৃহীন। মাতা শ্রীমতী রাধারানী দেব্যা কাশীতে পৈতৃক বাটিতে একাই থাকেন। পাত্রের নাম শ্রীযুক্ত বাবু ব্যোমকেশ বন্দোপাধ্যায়। বীমা সংক্রান্ত ব্যাপারেই তারাপদ বাবুর সাথে পরিচয়। ব্যোমকেশ যাকে বলে তরুণ তুর্কি। অসাধারণ রুপবান। ৬ ফুট লম্বা, নিয়মিত ব্যায়াম চর্চিত বলিষ্ট চেহারা, গৌর বর্ণ, তীক্ষ্ণ নাসা।” মুহূর্তের জন্য গল্প থামালাম, সবকটা মন্ত্রমুগ্ধের মত বসে আছে, হাতের চা টা জুড়িয়ে গিয়েছিল, এক চুমুকে শেষ করে আবার শুরু করলাম, “ ধরে নে ব্যোমকেশ বাবুকে অনেকটা সেযুগের নায়ক ছিল না প্রদীপ কুমার তাঁর মত দেখতে ছিল। যাই হোক, বাড়ি শুদ্ধু লোক ব্যোমকেশে মজল। বিয়ে পাকা হবার আগে, বুড়ো গিন্নী শুধু বললেন, ‘কি করছ? এভাবে কুলশীল না জেনে বিয়ে হয় নাকি? বলছে কাশীতে বাড়ি! মায়ের নাম রাধারানী! ও নাম তো বেবুশ্যেদের হয় গা।”বুড়ো কর্তা হেসেই উড়িয়ে দিলেন।
ধুমধাম করে ব্যোমকেশ বাবুর সাথে হৈমর বিয়ে হয়ে গেল। সবাই জামাই দেখে মুগ্ধ। ফিসফাস শোনা গেল, হৈমর তুলনায় বড় বেশি সুদর্শন। মাথায়ও অনেকটাই লম্বা। শ্রীমতীর সাথে বেশি ভাল মানাত। তিন বোনের মধ্যে কনিষ্ঠা শ্রীমতীই সবথেকে বেশি রূপবতী।ঝাড়া লম্বা, ছিপছিপে, গমের মত গায়ের রঙ, অনুপম অঙ্গ সৌষ্ঠব, একজোড়া টানাটানা ঢুলুঢুলু চোখ, রেশমের মত কোমর ছাপানো এক রাশ চুল। পাড়া-বেপাড়ার সকল যুবকের স্বপনচারিণী।
হৈম-ব্যোম বিয়ের পর বাপের বাড়ির কাছাকাছি কিছুদিন বাড়ি ভাড়া করে রইল, তারপর নিউআলিপুরে বিরাট বাড়ি কিনে উঠে গেল।ইতিমধ্যে বীমাকোম্পানির চাকরী ছেড়ে নতুন ব্যবসা খুলেছে  ব্যোম। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই হৈম গর্ভবতী হল, কিন্তু সে খবরটা আর তারাপদ বাবুর শোনা গেল না। তাঁর ব্যাঙ্ক হঠাৎ একদিন লাল বাতি জ্বেলে দিল, সেই বাজারে লক্ষাধিক টাকা হারিয়ে বৃদ্ধ আর বাঁচলেন না। সান্নিপাতিক রোগে আচমকা পরলোক গমন করলেন। ঐ পারিবারিক বিপর্যয়ের মধ্যে সদ্যবিধবা গিন্নী আর হৈমকে ছাড়তে রাজি হলেন না। নিউআলিপুরের বাড়িতে হৈমকে কে দেখবে? তাই প্রসব হওয়া অবধি হৈম রয়ে গেল তার বাবার বাড়িতেই।  ব্যোমকেশ প্রায়ই আসেন, বিশাল শেভ্রলে গাড়ি চেপে। মাস দুয়েক কাটতে না কাটতে বিনা মেঘে বজ্রপাতের মত একদিন আবিষ্কৃত হল যে অনুঢ়া শ্রীমতীও গর্ভবতী এবং তা এতদিনে সুস্পষ্ট ভাবে প্রতীয়মান। বিধবা গিন্নী, দাদা-বউদিদিরা উন্মাদপ্রায় হয়ে উঠল, এত বড় কলঙ্ক। অথচ শ্রীমতী নির্বিকার। হবু সন্তানের জনক কে, এ প্রশ্নের জবাব পেতে বিন্দুমাত্র কষ্ট পেতে হল না, তিনি ঐ পরিবারেরই সদস্য। সদম্ভে শ্রীমতী জানাল, তার হবু সন্তানের পিতা শ্রীযুক্ত বাবু ব্যোমকেশ।
হৈমকে প্রথম চোটে কিছুই জানানো হয়নি, কিন্তু যেদিন ব্যোমকেশ এলেন, দরজা বন্ধ করে হৈমর দাদাদের সাথে তাঁর তর্কাতর্কির আওয়াজ হৈমর কানেও পৌঁছল। সে যুগে গর্ভপাত আইন সিদ্ধ ছাড়ুন, চিকিৎসাশাস্ত্র সম্মতও ছিল কি না সন্দেহ। স্থানীয় ধাই শ্রেণীর মহিলারা কিছু জড়িবুটি দিত বটে, তবে তাতে কাজের থেকে অকাজ হত বেশি। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তীব্র রক্তক্ষরণে মারা যেত জননী, আবার কখনও বিকলাঙ্গ শিশুর জন্ম দিত। বাড়ির লোক শ্রীমতীর চিন্তায় অন্নজল ত্যাগ করলেও শ্রীমতী ছিল নির্বিকার। পরিস্থিতির গুরুত্ব বুঝে হৈম নিজেই উদ্যোগী হল। একাকী গিয়ে কুলপুরোহিতের সাথে দেখা করে দিনক্ষণ ঠিক করল, বরের সাথে ছোট বোনের বিয়ের। দাদারা ক্ষুব্ধ হয়ে বলল, “হৈম ক্ষেপেছিস? আত্মীয়-স্বজন, সমাজ? কি জবাব দেব আমরা? কেন মেজ বোন জীবিত থাকা সত্ত্বেও মেজ জামাইএর সাথে ছোট বোনের বিয়ে দিলাম?”  প্রসবের দিন যত এগিয়ে আসছিল, হৈমর শ্বাসকষ্ট তত বাড়ছিল, হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, “ আমাকে তো লোকে এমনি ক্ষেপী বলে দাদা। বোলো মাথার গণ্ডগোল লুকিয়ে বাবা বিয়ে দিয়েছিল, সন্তান গর্ভে আসতে পুরো পাগল হয়ে গেছি। আমাকে আজকাল ঘরে তালাচাবি বন্ধ করে রাখতে হয়। আমি এবার থেকে চিলেকোঠার ঘরে থাকব। তালা দিয়ে রেখ, যাতে কেউনা যেতে পারে।”
বুড়ো কর্তার মৃত্যুর সাথে সাথে সেই প্রাচুর্য  অস্তগামী, সেই অজুহাতে ন্যূনতম আড়ম্বরে শ্রীমতীর সাথে ব্যোমকেশের বিয়ে হয়ে গেল। তবুও বাড়ি ভর্তি লোকজন, সানাই, যজ্ঞ, মন্ত্রোচ্চারণ কিছুই বাদ গেল না। বাদ শুধু হৈম। একাকী চিলেকোঠায় স্বেচ্ছাবন্দিনী। পিতার মৃত্যুর পর দুর্গাপদই বাড়ির কর্তা। গুলু তাঁর বড় আদরের বোন। ঐ অনুষ্ঠানের মধ্যে লুকিয়ে চিলেকোঠায় গিয়ে দেখেন, হৈম শুষ্ক মুখে জানলার গারদ ধরে উদাস চোখে আকাশের দিকে তাকিয়ে আছে। দুর্গাপদর স্বস্নেহ ডাকে করুণ চোখে তাকালো। তারপর বলল, “বড়দা তুমি আমায় একটা প্রতিশ্রুতি দেবে?” “বল না?” গলা যথাসম্ভব স্বাভাবিক রেখে দুর্গাপদ বললেন। “আমি আর ও বাড়ি যাব না দাদা। বাসনমাজা, ঘরমোছা, রান্না করা, বাচ্ছা সামলানো যা বলবে করে দেব, শুধু ও বাড়ি আমায় আর যেতে বল না।ঐ লোকটার সাথে আমি আর থাকতে পারব না।” দাদার আশ্বাস পেয়ে এই প্রথম কাঁদল হৈমবতী। শুধু দুর্গাপদ ছাড়া আর কেউ সাক্ষী রইল না সেই কান্নার।
দুর্গাপদ কথা রেখেছিল। কিছুদিন বাদে হৈমর একটি মেয়ে হয়। খবর পেয়ে ব্যোমকেশ ছুটে এসেছিল, মেয়ের মুখ দেখতে দিলেও হৈমর সাথে দেখা হয়নি। হৈম ওর মুখ দেখতে অস্বীকার করে। দুর্ভাগ্যবশত হৈমর মেয়েটি কয়েক মাসের বেশি বাঁচল না। ভাইপো-ভাইঝি, বোনঝি দের নিয়ে আর সংসারের কাজ করে দিন কেটে যায় হৈমর। কিছুদিন বাদে শ্রীমতীর একটি ছেলে হয়। বংশের প্রথম দৌহিত্র, বুড়ি গিন্নির কাতর আবেদনে শ্রীমতীকে সবৎসা বাপের বাড়িতে নিয়ে আসে দাদারা। ব্যোমকেশ বাবু ও আবার আসা যাওয়া শুরু করেন। ওঁরা এলেই হৈম উঠে যায় চিলেকোঠার ঘরে। যতই না নামুক, না মিশুক, খবর ঠিকই কানে যায়, কখনও পদ্মাবতী, কখনও বা বউদিদিদের আলাপ আলোচনা থেকে বোঝা যায়, হৈমর সাজানো সংসার আজ শ্রীমতীর অধিকারে, তবে হৈমর জন্য পাশেই আর একটি অনুরূপ মহল বানিয়েছেন ব্যোমকেশ বাবু। হৈমর শাড়ি, গয়না কিছুই পায়নি শ্রীমতী। সব সযত্নে তুলে রাখা আছে, হৈমর জন্য বানানো মহলে। দুই স্ত্রী এবং তাদের আগত সন্তানসন্ততিদের জন্য সব সমান ভাগে ভাগ করে রেখেছেন ব্যোমকেশ বাবু।
মা, দিদি সুস্পষ্ট ভাবে, বউদিদিরা ঠারেঠোরে বোঝায়, হৈমর এবার ফিরে যাওয়াই উচিৎ। পুরুষ মানুষের ঐ রকম চারিত্রিক দোষ একটু আধটু থাকেই। ওসব ধর্তব্যের মধ্যে আনতে নেই। তাছাড়া তারাপদ বাবুর আমলের সেই অর্থনৈতিক স্বাচ্ছ্যন্দ্য আর নেই। দাদারা কোন মতে সংসারটা টানছে। তাদের নিজেদেরই অনেক গুলি করে ছেলেমেয়ে, তারওপর পদ্মাবতী আর তার তিন কন্যার দায়ভার। এছাড়া দোল দুর্গোৎসব তো আছেই। ঘটি না ডুবলেও তালপুকুর তো বটেই।হৈমর গয়নাগাটিও কিছু নেই, হাতে-কানে-গলায় অল্প কিছু ঘরোয়া গয়না বাদে সবই ফেলে এসেছে। সহায়সম্বলহীনা নারীর এত গুমোর চলে না। এই প্রতিকূল পরিবেশে হৈমর একমাত্র অবলম্বন হল বড়দা দুর্গাপদ। তাঁর প্রখর ব্যক্তিত্বের জন্য হৈমকে মুখের ওপর কোন কথা কেউ বলতে সাহস পায় না। তবে চাপ ক্রমেই বাড়ছিল।
সেদিন ও ছিল দোলযাত্রা। এক বৎসরের শিশুপুত্রকে নিয়ে শ্রীমতী আর ব্যোমকেশ বাবু নিমন্ত্রিত হয়ে এসেছেন দোল খেলতে। বুড়ো কর্তার আমলে প্রবল ধূমধাম করে দোল খেলা হত, আজ তা অনেকটাই অনুজ্জ্বল। তবুও কালাশৌচ কাটার পর প্রথম দোল বলে কথা, ধার করেও ছেলেরা বেশ বড় করেই আয়োজন করেছেন। বাড়ির বাইরে দোলমঞ্চ। সেখানে পুরুষরা দোল খেলে, আর ঘেরা আঙিনায় মহিলা আর শিশুরা। হৈম যথারীতি চিলেকোঠায় বন্দী। দোল হৈমর বড়ই প্রিয়। তাই চিলেকোঠার ঘর থেকে বেড়িয়ে এসে ঝুঁকে দেখছে, নীচে ভাইপো-ভাইঝি, বোনঝি, বউদিদি আর প্রতিবেশিনী দু একজন রঙ খেলছে। শ্রীমতী ছেলে কোলে বারন্দায় বসে আছে। কখন যে ব্যোমকেশ দুমুঠো আবির নিয়ে ছাতে উঠে এসেছে হৈম খেয়াল করেনি।বুড়ি গিন্নির পূর্ণ প্রশ্রয় ছিল। বউদিদিরাও ভেবেছিল যাক এই রঙের উৎসবে রঙের সাথে সাথে সব মান অভিমান ধুয়ে যাক। শ্রীমতী শুধু মুখ বেঁকিয়েছিল। অল্পক্ষণের মধ্যেই হৈমর তীব্র চিৎকার শোনা গেল। সে আওয়াজ বাইরে না গেলেও বাড়িতে বেশ কিছুক্ষণের জন্য গুমরে গুমরে মরল। আধ ঘণ্টা- পঁয়তাল্লিশ মিনিট বাদে ব্যোমকেশ যখন নামলেন, মুখে গলায় বুকে আঁচড়ের দাগ, হাতে আর গালে কামড়ে রক্ত বেরোচ্ছে। আঁতকে উঠে তীব্র হাউমাউ জুড়ে দিল শ্রীমতী। “খবরদার বলচি,আর যদি কোনদিন গেচ সে রাক্ষুসী মাগির কাচে। তার এত গুমোর। থাক পড়ে বাপের বাড়ি। দাদারা যেদিন নাথি মেরে দূর করে দেবে, ভিক্ষে করে খাবে।”
বাড়ির কোন বিচ্চু ছেলে মারফৎ খবর গেল দুর্গাপদ বাবুর কাছে। হন্তদন্ত হয়ে বাড়ি ঢুকে দেখেন, শ্রীমতী তখনি বড় ছেলেকে নিয়ে চলে যেতে উদ্যত হয়েছে। ব্যাপার বুঝতে খানিক সময় গেল দুর্গাপদ বাবুর। সব শুনে অগ্নিশর্মা হয়ে ব্যোমকেশকে বললেন, “ কোন সাহসে হৈমর কাছে গিয়েছিলে? কার অনুমতিতে?” বুড়ি গিন্নী ঝাঁপিয়ে পড়লেন, “ আমি বলেচি। কেন যাবে না? ওর বিয়ে করা বউ। একশ বার যাবে।” অশান্তি কমল তো নাই উত্তরোত্তর বাড়তে লাগল। কোণঠাসা হয়ে পড়তে লাগলেন দুর্গাপদ। কেউ নেই ওনার পাশে। সবার একমত হৈমকে ফিরে যেতেই হবে। দ্বৈপ্রাহরিক স্নানাহার মাথায় উঠল, ঝগড়া আরও কতটা গড়াত জানি না, আচমকা তীব্র কটু গন্ধে সবাই থতিয়ে গেল, ওপরে তাকিয়ে দেখে ঘন কালো কটু গন্ধী ধোঁয়া চিলেকোঠার জানলা দিয়ে বেড়িয়ে আসছে। সবাই দৌড়ল ছাতে, বন্ধ দরজা ভেঙে দেখা গেল, মুখ বন্ধ করে পুড়ে যাচ্ছে হৈমবতী। তীব্র দহন জ্বালা থেকে বাঁচতে দুহাতে আঁকড়ে ধরেছে পূর্ব দিকের দেওয়াল। দেওয়ালে একজন প্রমাণ সাইজের মানুষের সমান কালো ছাপ, দুহাতের ছাপ গুলি চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বলছে কি অপরিসীম যন্ত্রণা ভোগ করেছে ওদের মালকিন।”
গল্পে বুঁদ হয়ে ছিলাম। চোখের সামনে যেন সিনেমার মত ঘটে যাচ্ছিল ঘটনাবলী। আচমকা সৃজার ভয়ার্ত গলায়“চাচা গো” শুনে চটক ভাঙল। ছোট্ট মেয়ের মত বুড়ো চাচাকে জড়িয়ে ধরেছে সৃজা। চাচাও এক হাতে তাকে আঁকড়ে বলল “ইয়া আল্লা। বারণ করেছিলাম মামণি তোমায়। এবাড়িতে দোল খেল না, ছাতে যেও না। এই বুড়ো মুসলমানটার কোন কথা তুমি শোন?” অস্মি আর অন্তু উঠে গিয়ে আঁকড়ে ধরল সৃজাকে। চাচা আস্তে আস্তে গিয়ে সিঁড়িতে রাখা নিভু নিভু হ্যারিকেনটা বাড়িয়ে, আমাদের পাশ কাটিয়ে গিয়ে দাঁড়ালো সেই বন্ধ ঘরটার সামনে। শিকল খুলে দরজাটা হাট করে খুলে দিল। একটা কাঁপা কাঁপা আঙুল আমার দিকে বাড়িয়ে ইশারায় ডাকল আমায়। প্রচণ্ড ভয় লাগছিল আমার, চৈতালির হাতটা ধরলাম, ও ইশারায় বলল, “চল”। আমি আর চৈতালি  গিয়ে দাঁড়ালাম সেই ঘরটার সামনে, ভিতর থেকে একটা চামসে গন্ধ আসছে, চাচা হ্যারিকেনটা আমায় দিয়ে বলল, “যাও। ঢুকে দেখো। উল্টো দিকের দেওয়ালটা।” অনুজ্জ্বল হ্যারিকেনের আলো আর চৈতালির মোবাইলের টর্চের আলোয় স্পষ্ট দেখলাম, উল্টো দিকের দেওয়ালে ঘন কালো ছোপ। ঠিক যেমন, দেবী দুর্গার পিছনে চালচিত্র থাকে, তেমনি, তবে তার একটু উপরে দুদিকে দুটো পোড়া হাতের ছাপ, পোড়া অস্পষ্ট আঙুলের ছাপে তীব্র বেদনার আকুতি। যেন বৈদ্যুতিক শক খেয়ে ছিটকে বেড়িয়ে এলাম। চৈতালি শুধু বলল, “ অনি? কি ভাবে?”
চাচা মন্ত্রোচ্চারনের সুরে বলল, “একই গল্প। সৃজার বাবার মেজ পিসিমা। নাম ছিল ঊমাশশী। বরের নাম চন্দ্রমৌলী। প্রায় ৭০/৭৫ বছর আগের কথা। বিগত সত্তর বছরে অন্তত বার পাঁচেক চুনকাম করা হয়েছে। দুবার প্লাস্টার ছাড়িয়ে, ট্রিটমেন্ট করে আবার নতুন করে রঙ করানো হয়েছে। কিন্তু বার বার ঐ দাগ ফিরে এসেছে। আহা দোল খেলতে বড় ভালবাসত গো গুলু পিসিমা।”
#AninditasBlog
http:/amianindita.blogspot.in

প্রতীক্ষা-


কি ভাবছ? ভাবছ বুঝি খুব জব্দ করলে?
ভাবছ সেই সাদাকালো নায়িকাদের মত নির্ঘাত গালে হাত দিয়ে বসে আছি,
তোমার প্রতীক্ষায়।
উদাস ভাবে উস্কে দিলাম নিভু নিভু হ্যারিকেন বাতি। 
ধুর! এত ভাবার সময় কই? কত ব্যস্ততা ।
কবেই বা ভেবেছ?
ভালবাসা তো নিছক জোনাকীর আলো, ক্ষণিকের চপলতা । নিছক কাঁধে মাথা রাখা, অবোধগম্য প্রলাপ বকা, অপরিণত মনের ছলনা। 
তারপর কি হল?
তীব্র অভিমান। 
আঃ। তারপর? 
কি জানি? গুলিয়ে গেল সবকিছু । মন জুড়ে শুধুই মনখারাপ। আহা বড় ব্যস্ত সে--। কে জানে হয়তো তারও মন---

২৮.০৩.২০১৬

হারিয়ে যাওয়া

হারিয়ে যাওয়া ছেলেবেলা। 
হারিয়ে যাওয়া সোনা রোদ, খেলার মাঠ,
হারিয়ে যাওয়া যত খেলা, কুমীর ডাঙা, রুমাল চোর। 
হারিয়ে যাওয়া চেনা পথ, হারিয়ে যাওয়া গলির মোড়,
হারিয়ে যাওয়া স্কুল, সাদা শাড়ি লাল পাড়,
হারিয়ে যাওয়া যত শারদীয়া গোগোল, কর্ণেল, কিকিরা। 
হারিয়ে যাওয়া বইখাতা আর বন্ধু,
হারিয়ে যাওয়া লোডশেডিং আর মনকেমন করা অন্ধকার ,
হারিয়ে যাওয়া কালবৈশাখী আর হারিয়ে ফেলা বরষা,
হারিয়ে যাওয়া প্রথম ফুল, প্রথম বসন্ত । 
হারিয়ে গেল সবকিছু , সেই মনখারাপ আর ব্যর্থতা,
জীবন ঘোরে চক্রাকারে,হঠাৎ দেখা পথের বাঁকে,
দাঁড়িয়েছিলি কার তরে তুই?
তোরও বুঝি সব হারালো? সেই সোনা রোদ, লুকোচুরি, কুমীরডাঙা?
কিন্তু কেন আজ মনে হয়, সত্যিই কি সব হারালাম?
নাকি কিছুই হারায় না?
২৮.০৩.২০১৬

জানি দেখা হবে-


যখন পশ্চিম আকাশে ঢলে পড়ে ক্লান্ত চাঁদ,
মোহন চাঁদনীর মৃদু আবেশে হঠাৎ করে চোখ মুদে নিওনের বাতি,
আকাশের বুকে ডানা খুলে উড়ে যায় দুটো নিশাচর,
যখন বাতাস বয়ে আনে সদ্য ঝরা বকুল ফুলের মেঠো সুবাস,
ঘুমন্ত শিশু পরম আশ্লেষে আঁকড়ে ধরে আমার হাত-
অদ্ভুত শিহরণে থিরথির কেঁপে ওঠে চরাচর,
জানি তুমি আসছ।
শুধু আমি জানি দেখা হবে

কিছুটা ব্যক্তিগত


ডং । মেসেজ এল। বুবু দৌড়ে গেল, সৌর’র মেসেজ- মন খুশি খুশি হয়ে উঠল । খুলে দেখে,“ Nape Napier kvetch Krugman pooch jewel calc post psi petty”। এ কি লিখেছে রে বাবা। যা আঁতেল। জ্ঞান বৃদ্ধ একেবারে । নিজের বিদ্যে-বুদ্ধি নিয়ে মাঝেসাঝেই হীনমন্যতায় ভোগে বুবু , বিশেষত সৌরর পাশে। একদিন জিজ্ঞাসা করেছিল,“ উত্তর আসবে না। তুমি আসবেই আমি জানি- কার লেখা?”বুবু পড়েছিল মহাফাঁপরে। গুটি কয়েক রবীন্দ্র সংগীত, এক আধটা নজরুল গীতি অবধি ওর দৌড়। এর বাইরে শুধু “যেতে পারি কিন্তু কেন যাব” আর “ ফুল ফুটুক না ফুটুক আজ বসন্ত” এই দুটো কবিতা কার লেখা জানত। কপাল ঠুকে বলেই দিল “র-বী-ন্দ্র-নাথ ঠাকুর”। কিছুক্ষণ সৌর মৌন হয়ে বসে রইল। তারপর চশমাটা খুলে দু আঙুলে চোখ ঘষল, তারপর ক্লান্ত স্বরে বলল, “ কবির সুমন- যিনি এককালে সুমন চট্টোপাধ্যায় নামে গান গাইতেন?” লজ্জায় বুবু প্রার্থনা করছিল, হে ধরণী দ্বিধা হও। জীবনে প্রথমবার এমন এক পুরুষের সান্নিধ্যে আসতে পেরেছি, যাকে দেখতে সুদর্শনই শুধু নয় মগজে যে ধুসর বর্ণের পদার্থটি আছে, সেটি বাস্তবিকই গ্রে ম্যাটার। অন্যান্য আবাল গুলোর মাথায় যা ছিল সেগুলো দেখতে গ্রে হলেও কি গন্ধ। দুদণ্ডেই বোঝা যায় মগজ ভরা গোময়। ওর স্তব্ধতাকে ভুল বুঝে কিনা জানি না, সৌর হাত পা নেড়ে বুঝিয়েছিল,“সুমন? গানওয়ালা? সেই যে প্রথমত আমি তোমাকে চাই?” লজ্জায় হড়বড় করে বুবু বলে উঠেছিল, “ হ্যাঁ ঐ গানটা শুনেছি। ক্যাসেটটা ছিল। ” বলেই বুঝেছিল ধরিত্রী দ্বিধা না হলেও ও নিজের কবর খুঁড়েই ফেলেছে। সম্পর্ক ছাড়ো নূন্যতম বন্ধুত্ব হওয়াও আর হল না। পরপর দু তিন দিন কেটে গেছে। কেউই ফোন বা মেসেজ করেনি। এমনও নয় যে ওরা রোজ কথা বলত, তবু মাঝেসাঝে বুবু হ্যাংলার মত কথা বলতে ফোন করত। ভদ্রতাবশতই হবে হয়তো সৌর ও করত, করে অবশ্য নিপাট জ্ঞান দিত।
যাই হোক আজ এই মেসেজটার মানে ও কিছুতেই বার করতে পারল না। নানা পারমুটেশন-কম্বিনেশন সকলই ব্যর্থ হল। তবে কি অন্য কোন ভাষা? ধাঁধা? হ্যাঁ নির্ঘাত ধাঁধা । সমাধান করতে হলে সূত্র লাগবে । নিজেকে বোকা, গাধা ইত্যাদি গালি দিতে দিতে বুবু মেসেজ পাঠাল, “কিছুই বুঝলাম না। কি ছাতার মাথা লিখেছো? সূত্রটা কি?”
মেসেজ ডেলিভার হতেই, ফোনের ঘন্টি বেজে উঠল। সৌরর ফোন। কল্পচক্ষে বুবু দেখতে পেল, সৌর একই রকম ভাবে, দুআঙুলে চোখ টিপে একরাশ হতাশা নিয়ে ওকে ফোন করছে। কাঁপা কাঁপা হাত, কাঁপা কাঁপা বুকে ফোন ধরল বুবু, “ হ্যালো?”
ওদিক থেকে সৌরর প্রাণখোলা হাসি শোনা গেল,“ এর কোন মানে নেই। মনের খেয়ালে ফোনের চাবি গুলিতে আঙুল চালাচ্ছিলাম। যা লেখা হল পাঠিয়ে দিলাম। ”
ওঃ। শান্তিতেও যে দীর্ঘশ্বাস পড়ে আজই আবিষ্কার করল বুবু। সৌর থামেনি,“ মাঝে মাঝে আমার পছন্দের লোকেদের আমি ওমনি মেসেজ পাঠাই। ” পছন্দের লোক বলল কি? ঠিক শুনল কি বুবু?

প্রিয়সখা হে

কেমন আছ? নিশ্চয় খুউব ভাল?
কবিতা পড়?আজও? কার জন্য?
আজও কি জৈষ্ঠ্যর খর দুপুরে রৌদ্রস্নান কর? হাঁটতেই থাক প্রায় জনশূন্য রাজপথে?
কে সঙ্গ দেয়? সে? কালো হয়ে যাবার ভয় নেই বুঝি তার?
আর জোছনা রাত? মেঘলা দিন? প্রথম বরষা? শরতের দুপুর? শীতের মোহরকুঞ্জ? চড়কের মেলায়? স্মৃতির পাতায়? ভোরের স্বপ্নে?খোঁজ না বুঝি আমায়?
জানি খোঁজ না। কেউ খোঁজে না। আমিও না। শুধু জানতে বড় ইচ্ছা হয়, জান? আজও কি মনে পড়ে আমায়? আঙুলের খাঁজে বা পুরানো খাতার ভাঁজে, যেখানে লুকিয়ে আছি আমি।
শুকিয়ে আছে কবেকার ফুল---

অনির ডাইরি ২১শে ফেব্রুয়ারি


সুপ্তোত্থিতা, ক্রন্দনরতা কন্যাকে স্কুলে পৌছান যে কি চাপ, তা কেবল ভুক্তোভোগীই বুঝবেন।  প্রত্যহই শব্দ প্রাবল্য ৬৫ডেসিবল অতিক্রম করে যায়। আমাদের ফ্ল্যাটের নীচেই থাকেন এক মালয়ালি আন্টি।  সাধারণত মালয়ালি আন্টি বললেই যা চোখের সামনে ভেসে ওঠে, ইনি আদপেই তা নন অবশ্য। সত্তরোতীর্ণা কালো মেমসাহেব। অক্সিলিয়ামে পড়াতেন। এখনও মিডি ফ্রক পড়ে খটখট করে ঘুরে বেড়ান। ফড়ফড়  করে ইংরাজি বলেন, যার অধিকাংশই আমার বোধগম্যতার বাইরে।  তুত্তুরির চিৎকার  প্রায়শ ওণার প্রভাতী শান্তি বিঘ্ন করে। চটি  ফটফটিয়ে উঠে আসেন ওপরে, শান্তিবিনাশককে বিদেশী ভাষায় আদর করেন, চকলেট দেন, আর আমার কপালে জোটে খটমট ইংরেজী বকুনি।  মাঝে মাঝে আমার সন্দেহ হয়, তুত্তরী বোধহয় মাকে নাস্তানাবুদ করার জন্যই ঐ প্রবল কান্নাকাটির আবহ তৈরি করে।
যাই হোক আন্টির হাত থেকে নিষ্কৃতি পাবার একমাত্র উপায় যা আমি আবিষ্কার করতে পেরেছি, তা হল গল্প বলা।  গল্প শুরু করলেই তুত্তুরী চুপ। রোজ নতুন গল্প কোথা থেকে জোগাড় করি? উপেন্দ্রকিশোর বিগত দুই বছর ধরে আমার ত্রাতা।  কিন্তু ঐ গল্পে আর ভবি ভোলে না। গত সপ্তাহে শুরু করেছি বেতাল পঞ্চবিংশতি। সেই ছোট বেলায় দেখা বিক্রম অউর বেতাল অবলম্বনে। চরিত্রগুলির নাম মনে নেই, পড়ার অবকাশ কোথায় ? হাল্কা মনে আছে, অধিকাংশ গুরুত্বপূর্ণ নারী চরিত্রে দীপিকা চিকলিয়া থাকত।  পরবর্তী  কালে যিনি রামানন্দ সাগরের রামায়নে সীতার চরিত্রচিত্রণ করেন।তাই এখনও অবধি বলা তিনটি গল্পেরই নায়িকার নাম দিয়েছি দীপিকা । তুত্তুরি অবশ্য ক্রমসন্দিহান হয়ে উঠছে, কিন্তু আমি নিরুপায় ।
যাই হোক প্রথম গল্পটি ছিল, এক নবোঢ়া তরুণীর গল্প, সদ্য বিবাহের পর শ্বশুরবাড়ি যাবার সময় পর্যায়ক্রমে তার স্বামী এবং ভ্রাতা দেবী দুর্গার সম্মুখে স্বহস্তে  শিরশ্ছেদ করে  আত্মঘাতী  হয়। অন্তে মা দুর্গার আশির্বাদে মেয়েটি তার স্বামী এবং উভয়কেই বাঁচিয়ে তোলে কিন্তু হড়বড়ানিতে এর ধড়ে ওর মুণ্ডু লাগিয়ে বসে।
রাত্রে ঘুমোনোর  আগে সকালে বলা গল্পটি আবার শোনাতে হয়, শুক্রবার রাতে যখন শোনাচ্ছিলাম, শৌভিক বলল, “ এই লেজেন্ডটি নিয়ে টমাস মানের একটি গল্প আছে,‘ চেঞ্জ অব হেড’ বলে। সেইটা অবলম্বনে গিরিশ কারনাডের একটি  বিখ্যাত  নাটক আছে,‘ হয়বদন’। ”
“ হয়? বদন?”
“ হুঁ।  হয়। হয় মানে ঘোড়া। শঙ্খ ঘোষ বাংলায় অনুবাদ করেছিলেন।  বাবার আছে।  তুই পড়তে চাইলে, খুব খুশি হবে। ”
 বলাই বাহুল্য , শ্বশুর মশাই খুশি হয়ে একটি নয় দু দুটি নাটক পড়তে দিলেন।  পাতলা চটি বই। এক নিশ্বাসে পড়লাম। কোন এক কাল্পনিক  নগরে দুই অভিন্নহৃদয়  বন্ধু থাকত, দেবদত্ত ব্রাহ্মণ পুত্র, গৌর বর্ণ, দোহারা পেলব চেহারা, নামী কবি।  কপিল কামারের ছেলে, বিদ্যাদেবীর সঙ্গে চিরবিবাদ।  কপিল কুস্তিগীর। ভাগ্যবৈগুন্যে দুই বন্ধু  একই নারীর প্রেমে পড়ে। পদ্মিনী নামী শ্রেষ্ঠীতনয়া।  কালক্রমে দেবদত্তের ঘরনী হয়।  কপিল সব মেনে নিয়েও নিজের মুগ্ধতা গোপন করতে পারেনা।  দেবদত্ত অসন্তুষ্ট হয়, কিন্তু পদ্মিনী কপিলের নীরব প্রেম উপেক্ষা করতে পারে না।  এক জটিল ত্রিকোণ তৈরি হয়।
গল্প এগোয়।  মা কালীর কাছে কোন এক কালে করা মানত চরিতার্থ করতে দেবদত্ত আত্মবলি দেয়। অনুসরণ করে কপিলও।  যথারীতি  পদ্মিনী যখন স্ব শিরশ্ছেদ  করতে যায়, মা কালী তাকে নিরত করেন এবং সুযোগ দেন দেবদত্ত এবং কপিলকে পুনরুজ্জীবিত করার। পদ্মিনী কপিলের বলিষ্ঠ দেহে দেবদত্তের মাথা জুড়ে দেয়, সচেতন ভাবে নাকি অবচেতনে তা পদ্মিনী নিজেও বোঝে না।
প্রাণ ফিরে আসার পর, দুজনেই পদ্মিনীকে নিজ স্ত্রী হিসাবে তথা পদ্মিনীর গর্ভজাত পুত্রকে নিজ সন্তান দাবী করে।  পদ্মিনী যদিও নব সুঠাম দেহী দেবদত্তকেই নিজ স্বামী হিসাবে গ্রহণ করে।
দিন যায়, নবদেহে দেবদত্তর সাথে পরমসুখে দিন কাটে পদ্মিনীর।  কিন্তু ধীরে ধীরে নতুন দেহেও পুরাণ দেবদত্ত প্রকট হয়ে উঠতে থাকে।  ছটফটিয়ে উঠতে থাকে পদ্মিনী, কপিলের জন্য।  অবশেষে একদিন শিশু পুত্রকে কোলে নিয়ে কুলত্যাগী হয় পদ্মিনী কপিলের জন্য।  কিন্তু কপিল কোথায় ? সেদিনের পর থেকে কেউ দেখেনি তাকে।
শেষটা বরং উহ্যই থাক।
htttp:amianindita.blogspot.in
#aninditasblog #anirdiary

অনির ডাইরি ২রা মার্চ ২০১৬


ইউটিউবে শর্ট ফিল্ম দেখাটা নেশার মত পেয়ে বসেছে। আড়াই মিনিট থেকে বড় জোর আধ ঘন্টার ব্যাপার। দৈনন্দিন ব্যস্ততার ফাঁকে এটুকু সময় তো নিজেকে দেওয়াই যায়। নানা বিচিত্র গল্প, অধিকাংশই অপেক্ষাকৃত সস্তা ক্যামেরায় তোলা, অপ্রয়োজনীয় সঙ্গীত অর্থাৎ ঝিনচ্যাক গান বা চটুল নৃত্য নেই। বেশির ভাগই অনামী শিল্পি কচিৎ নামী শিল্পিদের একঝলক।  আর হ্যাঁ সেন্সর বোর্ডের রক্তচক্ষু ও সম্ভবত নেই।
অজস্র শর্ট ফিল্মের মধ্যে একটির কথা অনেকদিন ধরেই বলব ভাবছি, নাম সম্ভবত ,“ ওহ মেহরুনী সোয়েটার”।
শৌভিক তখন ব্লক অর্থাৎ উস্তিতে থাকত।  ঐ লিঙ্কটা পাঠিয়েছিল।  দৈর্ঘ্য ছ-সাত মিনিট হবে। গোটা ফিল্ম জুড়ে উর্দু মিশ্রিত হিন্দিতে অদ্ভুত মাদকতা মিশিয়ে একজন ধারাভাষ্য দিয়ে চলে, বিষয় প্রেম। “প্রেম” কোথায়? চূড়ান্ত ব্যস্ততার মধ্যে  ফেসবুক বা হোয়াটস্ অ্যাপে সামান্য বার্তালাপ। রেস্তোরাঁ  বা মাল্টিপ্লেক্সে দেখা, কিয়ৎক্ষণের নিভৃত আলাপচারিতা - ব্যাস আবার ব্যস্ত হয়ে পড়া রোজকার ইঁদুর দৌড়ে। প্রেমের সেই মাধুর্য, সেই রহস্যময়তা, অপার্থিবতা যেন কোথায় হারিয়ে গেছে। এই কনক্রীটের জঞ্জালে ভরা শহরে প্রেম আজ বড়ই যান্ত্রিক, বড়ই বিবর্ণ।
কিন্তু এই সাদাকালো রুক্ষ খরাগ্রস্ত শহরে বক্তা আচমকা একদিন সাচ্চা প্রেম অনুভব করতে পারলেন।  টাটকা গোলাপের মত রক্তিম সুগন্ধী প্রেম। অফিস টাইমের চরম ব্যস্ত রেলস্টেশনে  তিনি দেখতে পেলেন তাঁদের। এক পুরুষ ও এক নারী। রোজ ওঁরা  একই সময়ে স্টেশনে আসেন। পাশাপাশি  দাঁড়িয়ে থাকেন যতক্ষণ  না ট্রেন আসে। ট্রেনেও ওঁরা পাশাপাশি বসেন। ভদ্রলোক খবরের কাগজ খুলে বসেন, আর মহিলা সোয়েটার বুনতে থাকেন। কখনও অল্প ক্লান্ত হয়ে মাথা রাখেন ভদ্রলোকটির কাঁধে। কখনও অনুচ্চ স্বরে দাম্পত্যালাপ করতে থাকেন। নিতান্তই মামুলী থোড়বড়িখাড়া মার্কা কথা সব। নির্দিষ্ট    স্টেশনে দুজনে নামেন, বক্তার অপলক মুগ্ধ দৃষ্টির সামনে হাত ধরাধরি করে মিশে যান ভিড়ের মধ্যে।

বক্তা ওদের নাম দেন মিঃ এবং মিসেস শর্মা। প্রতিনিয়ত ওঁদের দেখার জন্যই উনি ঐ ট্রেনে সওয়ারি করেন।
মাঝে কি হল, কিছুদিন মিঃ এবং মিসেস শর্মা এলেন না।  বক্তা  বিমর্ষ হয়ে পড়লেন, তবে কি ওরা পথ পাল্টালেন? রোজ চরম আশা নিয়ে বক্তা স্টেশনে পৌছন, রোজ ব্যর্থ হন। তবে কি হারিয়েই গেল, রাক্ষুসে শহর হজম করে ফেলল প্রেমকে?
 সপ্তাহ দুই বাদে হঠাৎ একদিন মিঃ শর্মাকে দেখতে পেলেন। আনন্দে মাতোয়ারা হয়ে উঠলেন বক্তা, কিন্তু শ্রীমতী শর্মা কই? দুদিন-চারদিন-এক সপ্তাহ কেটে গেল। মিঃ শর্মা একাই আসেন। ট্রেনে ওঠেন।  কাগজ পড়েন। একাই নির্দিষ্ট স্টেশনে নেমে যান।  মিশে যান ভিড়ে।
সপ্তম দিনে বক্তা আর থাকতে না পেরে মিঃ শর্মা কে জিজ্ঞাসা করেই ফেলে, “ শুনছেন? একটা কথা জিজ্ঞেস করতে পারি?”
মিঃ শর্মা বিরক্তি নিয়ে বললেন “ তুমি সেই না? যে হাঁ করে আমাদের দিকে তাকিয়ে থাকতে?”
বক্তা সলজ্জ ভাবে বলেন,“ আজ্ঞে হ্যাঁ।  আচ্ছা উনি কোথায়? ওণাকে আজকাল দেখি না। ”
মিঃ শর্মা ক্রুদ্ধ হয়ে বললেন,“ দেখ আমি খুব যন্ত্রণার মধ্যে আছি।  দয়া করে জ্বালিও না। ” কিছুক্ষণ ভ্রু কুঁচকে জানলা দিয়ে তাকিয়ে রইলেন, তারপর হড়বড় করে বললেন, “ ভীষণ জেদী ছিল।  ওর ক্যান্সার ধরা পড়েছিল।  ডঃ বলেই দিয়েছিলেন বড়জোর দুমাস। বলতাম আরাম কর, শুনতো কই? বলত যেকটা মুহূর্ত আছে, তা শুধুই আমার সাথে কাটাতে চায়। ঐ অসুস্থতা নিয়ে রোজ আমার সাথে যেত। আমি অফিসে ঢুকে গেলে ফিরে যেত। ”
হঠাৎ ধড়মড়িয়ে উঠে পড়লেন মিঃশর্মা।  ট্রেন স্টেশনে ঢুকছে, মিঃশর্মা নেমে  মিশে যাচ্ছেন জনস্রোতে, আচমকা  বক্তা খেয়াল করলেন মিঃ শর্মার পরণে যে মেরুন সোয়েটারটা রয়েছে সেটা অর্ধসমাপ্ত। একটা হাত বোনা হয়ে ওঠেনি।  সেই মেরুন সোয়েটারটা যেটা মিসেস শর্মা বুনছিলেন।
#anirdiary #aninditasblog
http:amianindita.blogspot.in