Sunday 27 November 2022

অনির ডাইরি (তমলুক ছেড়ে কাঁথির পথে)

 

 

অনির ডাইরি ৯ই নভেম্বর, ২০২২

(পর্ব - ১)

এই তো সেদিন বদলি হয়ে এল শৌভিক। সোহাগী ফোনটা প্রথম করেছিল এষা। বাড়িতে সেদিন একাই ছিল শৌভিক। তুত্তুরীকে নিয়ে হাওড়া গিয়েছিলাম আমি। 


আমাদের এই ছুটকো-ছাটকা ঝটিকা সফর গুলো ভীষণ ভাবে উপভোগ করে শৌভিক। আমরা না থাকা মানেই নাকি অখণ্ড নির্জনতা, অপার শান্তি আর স্বাধীনতা। এই দিনগুলোয় নিজের হাতেই টুকটাক রান্না করে শৌভিক। সেদিনও তেমনি নৈশভোজের জন্য ম্যাগি আর ডিম সিদ্ধ বসাতে গিয়েছিল। এষার উচ্ছ্বাসের ধাক্কায় হাত থেকে ধড়াম করে প্যানটাই পড়ে গিয়েছিল মাটিতে। আর শৌভিক পড়েছিল রীতিমত আকাশ থেকে। 


বিস্মিত শৌভিকের ন্যাতানো প্রতিক্রিয়ায় চটে গিয়েছিল এষা। ‘ধুৎ দাদা, তুমি সত্যিই জানতে না। অর্ডার দেখোনি?’ এষার ফোনের মাঝেই ঝড়ের মত আসতে শুরু করেছিল শুভেচ্ছা বার্তা এবং শুভকামনামূলক ফোন। সমস্ত কিছু থেকে অনেক দূরে, আমি তখন গলা ফাটাচ্ছি বাবার বৈঠকখানায় চাটুজ্জেদের সান্ধ্যকালীন আড্ডায়। জম্পেশ করে মুড়ি মেখেছিল মা, মুড়ি শেষে চা চাপিয়েছি এমন সময় বরের ফোন। 


শৌভিকের প্রথম সম্ভাষণ আজও আমার কানে ভাসছে। ‘ কপাল পুড়েছে’।  খোলসা করে আর বলতে হয়নি। কিছু কিছু ক্ষেত্রে আমার ইনট্যুশন বেশ ধারালো। বেশ কিছুদিন ধরে এমনিই মনে হচ্ছিল, বলছিলামও বার বার,‘তুই বাপু বাঁচবি না। তোর কপালে এসডিও গিরি নাচছে।’ তবে সেটা যে এইভাবে সত্যি হয়ে যাবে তা স্বপ্নেও ভাবিনি। ঐ জন্যই ঠাকুমা বলত, কথা ক্ষণে পড়ে। মুখ খোলার সময় বুঝেশুনে বলতে হয়, কখন কি ঘটে যায়, কিচ্ছু বলা যায় না। 


৯ই জুলাই শুক্রবার জয়েন করতে গেল শৌভিক। একসাথেই বেরোলাম দোঁহে, যে যার আপিসের উদ্দেশ্যে। শৌভিকের ড্রাইভার, সিকিউরিটি উদগ্রীব হয়ে অপেক্ষা করছিল নতুন সাহেবের জন্য। উর্দি পরা, কোমরে বন্দুক গোঁজা নিরাপত্তা রক্ষী তড়িঘড়ি এগিয়ে এসে শৌভিকের হাত থেকে ব্যাগটা নিয়ে নিল। দরজা খুলে ধরল, ভ্যানিলা আইসক্রিম রঙা মস্ত জাইলো গাড়িটার। গাড়িতে যখন উঠে বসল শৌভিক, প্রবল গর্বের সঙ্গে সঙ্গে কেন যে টনটনিয়ে উঠছিল হৃদয় আর এত করকর করছিল দুটো চোখ। এবার তাহলে সত্যিই আলাদা হবার পালা, ভাবলেই ডাক ছেড়ে কাঁদতে ইচ্ছে করছিল। 


মার্চ মাস নাগাদ বিধাননগরে বদলির অর্ডার হয়েছিল আমার। মুভমেন্ট অর্ডার অর্থাৎ কবে কাকে চার্জ দিয়ে যাব সেই সংক্রান্ত অর্ডারের জন্য  দিন গুণছিলাম আমি। সেদিন মনে হল পলকে উল্টোপাল্টা হয়ে গেল চেনা অঙ্কটা। 


মহানগরের সদর দপ্তরে যেদিন সনির্বন্ধ অনরোধের ডালি নিয়ে গিয়ে হাজির হলাম, উর্ধ্বতন কতৃপক্ষ অত্যন্ত সহমর্মিতার সঙ্গেই জানতে চাইল কেন? তুত্তুরীর কি হবে? সোজা জবাব, স্কুল বদল হবে তুত্তুরীর। তারপর? যখন বদলি হয়ে যাবে যে কোন একজন তখন কি করবে? আবার স্কুল পাল্টাবে কি? স্নেহশীল দাদা,দিদি,বন্ধুরা বলল, হঠকারিতা নয়, একটু ভেবে সিদ্ধান্ত নাও। ও আসবে না হয় সপ্তাহান্তে,তোমরাও যাবে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে।


 মুস্কিল হল ব্যাপারটা ভাবতে যতটা সোজা,বাস্তব রূপায়ন ততোটাই জটিল। যাবতীয় ঝঞ্ঝাট- ঝামেলা, ঝড়- বৃষ্টি- তুফান দেখতাম বেছে বেছে সপ্তাহান্তেই এসে হাজির হত। আর ঐ ভাবে প্রতি সপ্তাহে তুত্তুরীর মাসিকে বাড়ি পাঠিয়ে, বাসন মাজার দিদিকে নিষেধ করে সব বন্ধ করে, তাল-ছন্দ মিলিয়ে আমাদের আসা যাওয়াটাও মোটেই সহজ ছিল না। অনেকেই করেন, বেশির ভাগ এমনি অফিসারদের সুগৃহিনীরাই তাই করেন। কিন্তু আমি যে মোটেই অত ভালো গিন্নি নই। অবুঝ হৃদয় যে কথাই শোনে না। পশ্চিম মেদিনীপুর ছেড়ে পুরুলিয়া গিয়েছিল যখন সুকন্যা, কি খিল্লিই না করেছিলাম আমি। বরকে ছেড়ে থাকতে পারে না বলে রীতিমত আওয়াজ দিতাম বেশ কিছুদিন।  অথচ যখন একই পরীক্ষায় বসতে হল আমায়, সু এর থেকেও খারাপ ফল করলাম আমি। একটা লোকের অনুপস্থিতিতে রাতারাতি যে কি বিবর্ণ, বিশ্রী হয়ে গিয়েছিল কল্লোলিনী তিলোত্তমা। 


২৭শে অক্টোবর যখন শেষ পর্যন্ত বদলির অর্ডারটা বেরোল, হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। কোজাগরী লক্ষ্মী পুজোর দিন,মেয়ে আর মেয়ের মাসীকে বগলদাবা করে, এতদিনের সংসার, সাধের গাছপালা ফেলে নির্দয়ের মত চলে এলাম পূব মেদিনীপুর। চারটে দেওয়াল আর একটা ছাতে বাড়ি হয় থোড়াই, বাড়ি বা সংসার গড়তে লাগে প্রিয়জন সাহচর্য। ব্যাপারটা বেশ ন্যাকা শোনালেও আমার মত অপদার্থ অলবড্ডেদের জন্য নির্মম সত্যি।


 নতুন করে গড়ে তুললাম আমরা আমাদের, ' লাল- নীল সংসার'। মহকুমা শাসকের মহা ফাঁকিবাজ ডেজিগনেটেড রাঁধুনীকে হাত ধরে রান্না শেখালাম তুত্তুরীর মাসি আর আমি। কি যে ভয়ানক রান্না করতেন তিনি। সব ডাল, সব তরকারি,সব মাছে যে কি করে একই স্বাদ আর গন্ধ আনতেন ভগবানই জানেন। 


প্রথম প্রথম ফেলে আসা, তালা বন্ধ বাড়িটার জন্য কাঁদত তুত্তুরী। মন খারাপ করত,ফেলে আসা স্কুল আর বন্ধুদের জন্য। ধীরে ধীরে ভালো লেগে গেল নিমতৌড়ির এই নিরালা প্রান্তর। বিরাট বিরাট কাঁচের জানলা, সক্কাল সক্কাল মোটা পর্দার ফাঁক গলে জবরদস্তি ঢুকে আসেন দিনমণি। আর আসে পাখির ঝাঁক। জানলার পর্দা সরালেই ঝাঁক বেঁধে উড়ে যায় মোটকু ধুসর বলের মত ছাতারে পাখিদের গুষ্টি। বারন্দার রেলিংএ, কাপড় শুকাতে দেবার তারে বসে নেচেই যায় মস্ত ল্যাজ ওয়ালা ঘোর কৃষ্ণাঙ্গী, চেরা ন্যাজ ফিঙে সুন্দরীদের দল। বাগানের ঘাসে নাক উঁচিয়ে চরে বেড়ায় ধপধপে সাদা বকের দল। গেটের বাইরের নারকেল গাছে বাসা বাঁধে গোলগোল চোখওয়ালা এক গুরুগম্ভীর প্যাঁচা। বৃষ্টি নামলে ডানা দিয়ে কি সুন্দর মাথা ঢেকে রাখে, দেখে তাজ্জব হয়ে যায় তুত্তুরী।  


বাংলোর সিকিউরিটি ছেলেগুলো কবে যেন কাকু হয়ে যায় তুত্তুরীর। রান্না করা, বাসন মাজা আর বাগানে কাজ করতে আসা দিদিরা হয়ে যায় মাসি।এমনকি তাদের ছেলেমেয়েদের সাথেও গভীর দোস্তি হয়ে যায় তুত্তুরীর। একসাথে হৈচৈ করে সরস্বতী পুজো হয় বাংলোয়। পুঁচকে গুলো সম্মিলিত ভাবে সাজায় মহকুমা শাসকের সরকারি নিবাসটাকে। পাকা হাতে নিপুণ, নিখুঁত আল্পনা দেয় সিকিউরিটি অমিত। অঞ্জলির দেবার সে কি লাইন আর ধুম সেদিন। 


ওদের থেকেই ধার করে সাইকেল চালাতে শেখে তুত্তুরী কিছুটা। অবসরে হরেক রকম গাছ চেনে তুত্তুরী। শাক চেনে। ফুল চেনে। পাখি চেনে কত যে। এছাড়াও সাপ চিনেছে বেশ কয়েকরকম, ব্যাঙ আর পোকার গুষ্টি চিনেছে এই তমলুকে এসেই না। 


       ব্যাঙ আর পোকা নিয়ে কত যে মজার মজার অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছে তুত্তুরী এখানে এসে। সেই যে সেদিন সান্ধ্যভ্রমণে বেরিয়ে ঢিল ভেবে একটা গাব্দা ব্যাঙের গায়ে শট্ মেরেছিলাম আমি, তাতে ব্যাঙটা বেপোট রেগে কটমট করে খানিকক্ষণ নাকি আমার দিকে তাকিয়েছিল। সেই প্রখর দৃষ্টির সামনে ভয়ে নাকি রীতিমত কুঁকড়ে গিয়েছিল তুত্তুরীর মারকুটে জননী। বেশ খানিক্ষণ তাকিয়ে থেকে, প্রবল ঘ্যাম নিয়ে, নাক উঁচু করে  থপথপ্ করতে করতে চলে গিয়েছিল ব্যাঙটা।  আজও সে গল্প করতে গিয়ে হেসে গড়িয়ে পড়ে তুত্তুরী। আর সেই যে সেবার, বাগানের দরজা বন্ধ হচ্ছে না দেখে প্রবল টানাটানি করেছিলাম আমি। ফলে দরজার ফাঁকে আটকে থাকা ব্যাঙটা জিভ বার করে অজ্ঞান হয়ে পড়ে ধড়াম করে। সেই দেখে কাঁদতে কাঁদতে নাকি  বিকট হট্টগোল জুড়ি আমি।  'কেন বাড়িতে চশমা পরি না গোওওও।' 'আমার জন্য ব্যাঙটা বেঘোরে মরে গেল গোওওও।' সেই দেখে শৌভিক কি ভাবে পেটে হাত দিয়ে অট্টহাস্য করতে করতে উল্টে পড়েই যাচ্ছিল,  হুবহু দেখিয়ে দেয় তুত্তুরী। 


দিন যায়, এপ্রিল মাসে নতুন স্কুলে ভর্তি হয় তুত্তুরী। প্রথম দিন কি যে বিকট ভয় বুকে চেপে স্কুলে গিয়েছিল মেয়েটা আমার। সব ভয় অমূলক প্রমাণ করে, কেউ bully করে না তুত্তুরীকে, কেউ উত্যক্ত বা বিরক্ত করে না। বরং খুব ভালো ভাবেই মিশেছিল সবাই। জনৈকা বান্ধবী শুধু দু একবার বলেছিল, ‘ঐ ব্যবসাটার নাম জানিস? ওটা কার জানিস? আমার দাদুর। আমরা কত বড়লোক জানিস? ফরেন ট্যুর করি আমরা। তুই কখনও বিদেশে গেছিস? যাসনি? বেড়াতে তো যাস বাকি? কোথায় যাস? মধ্য প্রদেশ? ওখানে দেখার কি আছে?  এই শীতে সুইজারল্যান্ড যাব আমরা।জানিস স্পেনে গিয়ে আমার বাবা স্প্যানিশ লিকর খেয়েছিল। তোর বাবা মদটদ খায়? খেতে বলবি। ক্ল্যাসি লাগবে।’ বাড়ি ফিরে হাসতে হাসতে বিষম খেয়েছিল তুত্তুরী। আজও বাড়িতে কোন পরিচিত অতিথি এলে, সর্বাগ্রে সেই গল্প শোনায় তুত্তুরী। 


মে মাসে প্রথম প্রাইভেট টিউটর রাখা হল তুত্তুরীর। নতুন ম্যাম এলেন, বেজায় ডিগ্রি ধারী। কিন্তু বয়সে ছুকরি। শৌভিক এবং আমি যগপৎ বলেও দিলাম, এসডিওর বাচ্ছা বলে আলাদা খাতির করার কোন দরকার নেই। প্রয়োজনে এমনকি অপ্রয়োজনেও হাত খুলে প্যাঁ- ইয়ে ঠ্যাঙাবেন। তুত্তুরীকেও বলা হল ম্যাম ব্ল্যাক বেল্ট ,সেটা যে সর্বৈব মিথ্যে বুঝতে তুত্তুরীর লেগেছিল দুটো দিন মাত্র। তারপর এমন দোস্তি হল দুজনের, যে উভয়ের হাহা-হিহি-হোহোর ঠ্যালায় বাংলো ভেঙে পড়ার খাপ। কে যে পড়ায় আর কে যে পড়ে বোঝা দায়। পড়াতে আসার সময় বাড়ি থেকে কুমড়ো ফুল, টাটকা শাক, গাছের পেয়ারা, তালের বড়া নিয়ে আসে দিদিমনি। যোগাড় করে আনেন পিরিয়ডিক টেবিলের ছক।  


বেশ জমিয়ে বসেছিলাম আমরা,  ভুলতেই বসেছিলাম আমরা ভূমিপুত্র বা কন্যা নই, আমরা হলাম পরিযায়ী পাখি। আজ এখানে, কাল না জানে কোথায়। আমাদের শিকড় ছড়াতে নেই। গত পরশু সন্ধ্যেয় যখন পুনরাবর্তিত হল ইতিহাস, ঠিক পৌনে সাতটা নাগাদ এসে হাজির হওয়া অর্ডার কড়া নেড়ে জানাল, বদলি হয়ে গেছে শৌভিক, ক্ষণিকের জন্য যেন বজ্রাহত হলাম আমরা। সেই একই রকম ভাবে আসতে লাগল শুভেচ্ছা বার্তা আর শুভকামনায় মোড়া ফোনগুলো। লাফাতে লাফাতে সোহাগী ফোন করল এষা, 'কি গো, তোমরা তো এবার রোজ দীঘা যাবে?' সেই একই রকম ন্যাতানো জবাব দিলাম আমরা। ঠিক একই রকম যুগপৎ হতাশ এবং ক্রুদ্ধ হল এষা। 


তিনজনেরই কমবেশি মনখারাপ,তবে তারই মধ্যে শ্রীমতী তুত্তুরীর মুখের দিকে তাকাতে পারছিলাম না দোঁহে। ‘আমাদের সত্যিই তমলুক ছেড়ে চলে যেতে হবে বাবা? আমি তো একটা সেশনও শেষ করতে পারলাম না মা? নতুন ব্লেজারটা পরতেও পারলাম না। আমার সাইন্স এক্সিবিশন এর কি হবে মা? স্কুল ম্যাগাজিনে আমার লেখাটা ছাপা হল কি না, সেটাও তো জানতে পারব না বাবা। ইত্যাদি, প্রভৃতি। ’ ভ্যাবাচাকা খেয়ে, বারবার বলেই যাচ্ছিল তুত্তুরী। সান্ত্বনা দেব কি, আমার নিজেরই বিশ্বাসই হচ্ছিল না যে। পাততাড়ি গোটানোর সময় সমাগত।  


 সরকারি চাকরির এই তো বিড়ম্বনা। মাতৃসুলভ কাতরতার সাথে শৌভিককে বলতে গিয়ে বেজায় ঝাড় খেলাম। ‘স্কুল পাল্টালে কিছু খারাপ হয় না। নজির তোর সামনেই আছে।’ সত্যিই তো, শ্বশুরমশাইয়ের চাকরির দৌলতে বহুবার এমন স্কুল পাল্টেছে শৌভিক। আর প্রতিবারেই মিড সেসনে। খারাপ তো কিছু মানুষ হয়নি বাপু। এটাও কিছু হয়েই যাবে নির্ঘাত। ‘আর না হলেই বা কি’ মেয়ের পিঠে হাত রেখে পাশ থেকে বলে শৌভিক, ‘ গরু চরালেই বা কার কি। শ্বশুরটা তো বলেইছে যে দুটো গরু কিনে দেবে। তাই চরাবে।' সবকথায় আমার বেচারী বাপকে না টানলে আমার বরের ঠিক পোষায় না।


ছদ্ম দাম্পত্য কলহে নিমজ্জিত হই আমরা, ঝুটো হাসি ঠাট্টা মশকরায় ডুবে যাই আমরা, মনখারাপী মনের ওপর পরে নিই নকল হাসির মুখোশ। সামলে নিই একে অপরকে। এই তো জীবন কালী দা। 


দেখতে দেখতে এসে পড়ে আজকের সন্ধ্যা। বিদায়বেলায় উপহার পাওয়া রাশি রাশি ফুলের সৌরভে মম করে ওঠে সরকারি নিবাসের চেনা বৈঠকখানা। জমে ওঠে উপহারের স্তুপ। মিষ্টির প্যাকেট। শৌভিক এর মোবাইল ভর্তি হয়ে যায় আবেগে মাখামাখি মেসেজে। সবকিছু যেন নীরবে, অথচ চিৎকার করে বলে, আর মাত্র কিছুটা সময়, তারপরই ছেড়ে যেতে হবে প্রিয় শহরটাকে।


 বিদায় সাধের তাম্রলিপ্ত নগরী, বড় ভালোবেসে ফেলেছিলাম তোমায়। খুব ভালো থেকো প্রিয় নগর আর তার অধিবাসীরা। অনেক অনেক সুখ স্মৃতি নিয়ে পরবর্তী গন্তব্যের দিকে চলেছি আমরা। সকলের জন্য রেখে গেলাম একরাশ শুভেচ্ছা আর শুভকামনা।

(চলবে)

 অনির ডাইরি ১৯ শে নভেম্বর, ২০২২

(পর্ব -২)

বেশ নরম, রেশমি একটা রোদ উঠেছে। বাতাসে হাল্কা হিমেল ভাব। তমলুকের থেকে এদিকে ঠাণ্ডাটা কেন জানি একটু বেশিই লাগে। কাঁথির মহকুমা শাসকের সরকারি নিবাসটা বেশ প্রাচীন। কথায় কথায় এরা বৃটিশ আমলের গল্প শোনায়। মহকুমা শাসকের বাংলো চেম্বারে টাঙানো বিশাল বিশাল দুটি বোর্ড জুড়ে, ১৯৪২ সাল থেকে পদাধিকারী  নানা রথী-মহারথীর নাম। সবার উপরে জ্বলজ্বল করছেন শ্রী এস সেন, আই সিএস। সময়কাল ১৮ই জুন, ১৯৪২ থেকে ২৩শে ডিসেম্বর,১৯৪৩। সত্যি মিথ্যে জানি না, জনশ্রুতি শুনি ইনিই সেই প্রবাদপ্রতিম সুকুমার সেন। স্বাধীন বাংলার প্রথম মুখ্যসচিব। ভারতের প্রথম নির্বাচন সংগঠিত হয় যাঁর তত্ত্বাবধানে। 


 তাঁর উত্তরসূরি শ্রী এম ভট্টাচার্য ছিলেন BCS, বেঙ্গল সিভিল সার্ভিসের অফিসার। বাংলা ভাগ হয়নি যে, পশ্চিমী তকমা লাগেনি আমাদের গায়ে। প্রথম IAS মহকুমা শাসক পায় কাঁথি ১৯৪৮ সালে। আর প্রথম WBCS (Exe) ঐ চেয়ারে বসেন ১৯৬১ সালে।   


চতুর্দিকে বাগান দিয়ে ঘেরা ছিমছাম একতলা বাংলো। বাগান মানে তমলুকের বাংলোর মত শৌখিন বাগান নয়, রীতিমত গা ছমছমে মহীরুহের সমাহার। ছতলা বাড়ির সমান লম্বা ইউক্যালিপটাস, নারকেল গাছ, আম গাছ, জাম গাছ, নিম, লিচু, তেঁতুল, শাল, জামরুল, বেল, কুল, পেয়ারা, সজনে ডাঁটা গাছ কি নেই সেই তালিকায়। এছাড়াও আছে দেবদারু আর ঝাউ গাছের সারি, দুখানা বিশাল কাজু বাদাম গাছ, তেজ পাতার গাছ,কারি পাতার গাছ, লবঙ্গ গাছ এমনকি দুটো শ্বেত চন্দনের গাছও। সামান্য খুঁটে দেখলাম, গন্ধ পেলাম না যদিও। 


এত গাছ থাকার জন্য পাখিদের আনাগোনা লেগেই থাকে। ভোর বেলা জানলা ঠকঠকায় কাঠঠোকরা, জানলার ফাঁক গলে ফুড়ুৎ করে ঢুকে আসে চড়াই দম্পতি। নিম গাছের কোটর থেকে মুখ বাড়ায় ডিমে তা দেওয়া মা টিয়া পাখি। বাগানে পেতে রাখা বেঞ্চে গিয়ে বসলে পায়ে সুড়সুড়ি দেয় হ্যাংলা কাঠবেড়ালির দল। আগের স্যার ম্যাডামরা নাকি বাসি রুটি, মুড়ি, বিস্কুট ইত্যাদি খেতে দিত। সেই লোভেই আমার কাছে এসেছিল, আমি যদিও কিছু না জেনে,  দলবেঁধে  পায়ে কামড়াতে এসেছে ভেবে ব্যাপক চিল্লিয়েছি। ফলশ্রুতিতে আপাতত হাতে বিস্কুট নিয়ে বসে আছি, আমাকে বয়কট করেছে কাঠবিড়ালির দল। তাদের জন্য ছড়ানো বিস্কুট খেয়ে যাচ্ছে একদল মোটু ছাতারে। 


সব মিলিয়ে ঝিম ধরানো পরিবেশ,নির্ভেজাল শান্তির প্রলেপ বুলিয়ে দেয় বিগত দশদিনের উত্তেজিত স্নায়ুর ওপর। বড় উৎকণ্ঠা আর উত্তেজনায় কেটেছে গত কয়েকটা দিন। সাত তারিখ সন্ধ্যেবেলায় যখন বিনা মেঘে বজ্রপাতের মত আছড়ে পড়েছিল অর্ডারটা, সাময়িক ভাবে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েছিলাম আমরা। মানছি বদলির চাকরী, অর্ডার বেরোলে যেতেই হবে, তাও একটু দম ফেলার সময় যদি পাওয়া যেত, বড় উপকার হত আর কি।


 আট তারিখটা গুরুনানকের জন্মদিন ছিল। কি যেন দপ্তরী কাজে মহানগরে আসার কথা শৌভিকের, মায়ের তুলে রাখা পেনশনটা ওর হাত দিয়েই পাঠিয়ে দিলাম। অজুহাত দিলাম সময় বড় কম,সংসার তুলে নিয়ে যেতে হবে, কত যে কাজ বাকি। আসল উদ্দেশ্য ছিল মায়ের একটু মনোবল বাড়ানো। মহানগর ছেড়ে আমাদের তমলুক চলে আসাটাই হজম হয়নি আমার মায়ের। ভুগতে শুরু করেছিল মানসিক অবসাদে। বিগত একবছর ধরে নিয়মিত বাড়ি যাওয়া আসা করে, প্রতিটি উৎসব অনুষ্ঠানে চাটুজ্জে বাড়ি গুলজার করে, কলকাতার মত তমলুকে বসে বাবার ইলেকট্রিক বিল, টাটা স্কাই, ফোন রিচার্জ করে, অনলাইন মাসকাবারি সওদা করে দিয়ে, পুজোর বাজার করে, সময়মত ডাক্তার দেখিয়ে এনে ইত্যাদি প্রভৃতিতে একটু মানসিক জোর পেয়েছিল মা। তাও পুরোপুরি ভয় মুক্তি হয়নি মায়ের, আমার স্কুলের বন্ধুদের পেলে আজও ডুকরে কেঁদে ওঠে, ‘পারলে আসিস। খোঁজখবর রাখিস। ও তো অনেক দূরে চলে গেছে’ ইত্যাদি, প্রভৃতি। আর এখন তো আরও একটু বেশি দূরে সরে যাবার পালা। ফোনের ওপারে মায়ের নীরব কাতর কণ্ঠ সোচ্চারে বলছিল, মোটেই ভালো ভাবে বদলির ব্যাপারটা নিতে পারেনি মা। ভাবছে আর হয়তো বাড়িই যেতে পারব না আমি/আমরা। এমতবস্থায় শৌভিকের পজিটিভ এনার্জি, ভালোবাসা মাখানো মিষ্টি ধমকের বড় দরকার ওদের।


 

নয় তারিখ, বুধবার চার্জ হ্যান্ডওভার করার পর গোছগাছে হাত দিলাম আমি।এই বাংলো এখন নতুন আধিকারিকের। তিনি যত উদারই হন না কেন, অনির্দিষ্ট কালের জন্য তাঁর সরকারি আবাস তো দখল করা যায় না। আর শৌভিকের পক্ষেও তমলুক থেকে কাঁথি নিত্য যাতায়াত করা বেশ চাপের। যত তাড়াতাড়ি পারা যায়, বোঁচকাবুঁচকি নিয়ে রওণা দিতে হবে নতুন বাসায়। শৌভিকের ইচ্ছে ছিল রবিবারের মধ্যেই পুরাণ বাসা ছেড়ে দেওয়া। বাধ সাধল তুত্তুরী। বাংলো ছাড়া মানে তো স্কুলও পরিত্যাগ করা। শিশু দিবসের আগে কিছুতেই পুরাণ স্কুল ছেড়ে যেতে রাজি হল না তুত্তুরী। 


তুত্তুরীর ভাষায়, কলকাতার স্কুলটা ছেড়ে আসতে তেমন দুঃখ হয়নি ওর। কারণ অতিমারির প্রকোপে দুবছর স্কুল বন্ধ ছিল, বন্ধুদের সাথে যোগাযোগের মাধ্যম বলতে ছিল হোয়াটস্অ্যাপ। তাও তো ছিল। শিক্ষককুলের সঙ্গে তো তাও ছিল না। কি যে অনলাইন ক্লাস হত, অর্ধেক দিন শুনতাম স্যারের ডেটা শেষ হয়ে গেছে। ম্যাম বলেছেন তোমরা পড়ে নাও ইত্যাদি প্রভৃতি। তাম্রলিপ্ত পাবলিক স্কুল, মফস্বলের সাদামাটা পুঁচকে স্কুল হতে পারে, কিন্তু আন্তরিকতা ছিল সীমাহীন। এখানে এসে যেমন ভালো বন্ধু পেয়েছিল তুত্তুরী, তার থেকেও ভালো পেয়েছিল শিক্ষক শিক্ষিকাদের। তাদের সাথে কত পরিকল্পনা করেছিল শিশুদিবস উদযাপনের, সে সব ফেলে কিছুতেই যাবে না তু্ত্তুরী।


 শৌভিকের বদলিতে আপাততঃ সবথেকে বেশি কষ্ট পাচ্ছে মেয়েটাই, তার জন্য এইটুকু তো করতেই হবে। নতুন আধিকারিকের কাছে কটা দিন সময় চেয়ে নেয় শৌভিক। দীর্ঘদিনের পরিচিত, ভ্রাতৃপ্রতিম আধিকারিক এক গলা জিভ কেটে বলে,‘কি বলছ দাদা। তোমার যতদিন ইচ্ছে, থাকো না।’ 


বাংলো না ছাড়লেও পলাশকে ছেড়ে দেয় শৌভিক। মহকুমা শাসকের নিজস্ব গাড়ি চালায় পলাশ, এতদিন সকাল সকাল তুত্তুরীকে স্কুলে পৌঁছে দেবার কাজটা স্বেচ্ছায় নিজেই করত পলাশ। ফেরৎ আনার দায়িত্ব ছিল আমার আর উত্তমকুমারের। আমি ব্যস্ত থাকলে মাসি আর উত্তমকুমার যেত।যেদিন আমি আর উত্তমকুমার উভয়েই ব্যস্ত থাকতাম, সেদিন পলাশই আনতে যেত। বকবক করতে করতে গাড়ি চালাত পলাশ, তুত্তুরীকে শহর চেনাত। এতদিন পলাশের আবোলতাবোল বকবকানিতে রেগে যেত তুত্তুরী, বুধবার সন্ধ্যেয় যখন আনুষ্ঠানিক ভাবে পলাশকে ছেড়ে দেওয়া হল, তার জন্যই কেঁদে ভাসাল তুত্তুরী। নতুন আধিকারিক এবং পলাশ উভয়েই বলেছিল, আর তো তিনটে দিন স্কুল যাবে মেয়েটা, এই কটা দিন না হয় পলাশই দিয়ে আসুক। শৌভিক রাজি হয়নি। অধিকার ছাড়তেও তো জানতে হয়। 


আমরা ছাড়তে চাইলেও কমলি ছাড়ে কই। পুরাণ আপিসের লোকজন পলাশ, নবেন্দু আব্দার করে, ‘আমরা গিয়ে সব প্যাকিং করে দেব স্যার।’ ভাগিয়ে দেয় শৌভিক। প্যাকিং করার মত আছেটাই বা কি? কটা তো জামাকাপড় আর বইখাতা। ও আমি দিব্য পেরে যাব। শুধু কটা প্যাকিং বক্স লাগবে। লোকজন স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে এসে দিয়ে যায় কার্ডবোর্ডের বাক্স, নারকেল দড়ি, টেপ। খোঁজ নিয়ে যায় বারবার, আর কিছু লাগবে কি? আর কোন সহায়তা লাগবে কি? লাগবে না বললে অখুশি হয়, দুঃখ পায়,তাও বেশ বুঝতে পারি আমরা। 


শ্বশুরমশাইয়ের চাকরি সূত্রে বীরভূম, মুর্শিদাবাদ, লবণহ্রদ ইত্যাদি মিলিয়ে সাকুল্যে চোদ্দ না পনেরো বার বাড়ি পাল্টেছিল শৌভিকের। বিয়ের আগে থেকে শুনে আসছি সেসব গল্প। শাশুড়ি মায়ের আসুরিক শক্তি আর কর্মতৎপরতার গল্প। শৌভিক বলত, আজও বলে, ‘মা একাই, একটা আর্মি ছিল।’ মুভার্স এণ্ড প্যাকার্স  মার্কা কারো হেল্প লাগত না। যাবতীয় প্যাকিং- আনপ্যাকিং সবকিছু একা হাতেই সামলেছেন উনি। শ্বশুরমশাই বা তাঁর লোকজন বড়জোর বাক্স গুলো গাড়িতে তুলে দিয়েছে বা নামিয়ে নিয়েছে। আর ওণার বাড়ি বদল মানে খাট-বিছানা- আলমারি- বাসনকোসন- টিভি-ফ্রিজ সবকিছু। 


তাঁর সবথেকে অযোগ্য পুত্রবধূ আমি। বিয়ের পর বার চারেক বাড়ি পাল্টেছে বটে, তবে সবকিছুই আগে থেকে সাজানো গোছানো ছিল। মামুলি কিছু জিনিস নিয়ে গেছি, দু একটা ব্যাগে ভরে ফিরে গেছি। এবারে কোথা থেকে যে এত জিনিস জমা হল বুঝতেই পারিনি। তুত্তুরীর মাসিকে নিয়ে চারজনের জামাকাপড়, জুতো, রাশি রাশি গল্পের বই, তুত্তুরীর পড়ার বই, খাতা, পুতুল, শৌভিকের ক্যামেরা, চার্জার, বুড়ো ল্যাপটপ,  ঝুটো গয়নাগাটি, প্রসাধন দ্রব্য, বিভিন্ন সময় উপহার পাওয়া ঘর সাজানোর সামগ্রী সব মিলিয়ে ১৬টা প্যাকিং বক্স উপচে গেল। এর বাইরেও বাড়িতে যতগুলো সুটকেস, হ্যান্ডব্যাগ ছিল, ভর্তি হয়ে গেল সেই কটাও। এরওপর ছিল গত বছরের না বিসর্জন দেওয়া সরস্বতী প্রতিমা, উপহার পাওয়া কাঁচের বাটিতে বসানো লাকি বাম্বু। নিত্য পুজো পাওয়া ঠাকুর, তাঁদের বাসনকোসন। পুজোর মাসে বেশ কটা দিন অনুপস্থিত ছিলাম বলে, মাসকাবারি তেমন ভাবে হয়নি। নভেম্বর মাসে তাই চাল,আটা, তেল, মশলা সবই বেশি বেশি নেওয়া হয়েছিল। সেই সব গুছিয়ে প্যাক করা কি চাট্টিখানি কথা। তারওপর ভাগাভাগির ঝামেলা, কিছু কৌটো মহকুমা শাসকের ছিল। কিছু আমরা বাড়ি থেকে এনেছিলাম। পরবর্তী কালে কফি, জ্যাম, বড় বিস্কুট ইত্যাদি কেনার জন্য কিছু কৌটো জমেছিল। কোনটা সরকারি ডাব্বা, আর কোনটা বেসরকারি তার হিসেব করতে বসে তুত্তুরীর মাসির আর আমার মাথার চুল ছেঁড়ার যোগাড়। শেষ পর্যন্ত একটা ডাব্বা নিয়ে সংশয় আর যায়ই না। উত্তরসূরিকে যেদিন বাংলোয় চা খেতে ডাকল, লজ্জার মাথা খেয়ে বলেই দিলাম আমি, ‘ভাই মনে হচ্ছে তোমার একটা কৌটো আমরা নিয়ে যাচ্ছি। বিস্কুটগুলোকে প্যাকেটে ভরে নিয়ে যেতে গেলে ভেঙে যাবে কি না।’ বেচারা এত অপ্রস্তুত বোধহয় জীবনেও হয়নি। 


একই সংশয় দেখা দিয়েছিল জামাকাপড় ঝোলানোর হ্যাঙার আর কাপড় শুকাতে দেবার ক্লিপ নিয়ে। শেষ পর্যন্ত অবশ্য শৌভিকের হস্তক্ষেপে প্রমাণ হয় ওগুলো সবই মহকুমা শাসকের সম্পত্তি।  


 একটা একটা করে বাক্সবোঝাই হয়, টেপ মারি আমরা, অতঃপর কালো মার্কার পেন দিয়ে লেখা হয় বাক্স নম্বর- আর ছোট করে কি আছে তাতে। তারপর সেই বক্সের একটা বড় তালিকা বানাই আমরা, গুছিয়ে লিখি কোন বক্সে কি ভরেছি। অতঃপর ভাগাভাগি করে দোতলা থেকে একতলায় নামাই তুত্তুরী আর আমি। মাসি দৌড়ে আসে, আহাঃ ও কেন, আমায় ডাকবে তো। সিকিউরিটি ছেলেগুলো দুঃখ পায়,  ঘড়ির কাঁটা কেবল টিক টিক করে জানায় একটু জলদি করো হে, আর তো মাত্র কয়েকটা ঘন্টা। এখনও বাকি কত যে কাজ। 

(চলবে)

অনির ডাইরি, ২৭শে নভেম্বর, ২০২২

(অন্তিম পর্ব)

কয়েকটা মুহূর্তের জন্য হৃদস্পন্দন স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল আমার বরের, যখন ৭ই নভেম্বরের সন্ধ্যেয় জনৈক শুভানুধ্যায়ী দাদা ফোন করে খবর দিয়েছিলেন,‘ তোর জায়গায় অমুকের অর্ডার হয়েছে।’  তমলুকের মহকুমা শাসকের বাংলো চেম্বারের সেদিন চলছিল কোন রুদ্ধদ্বার বৈঠক। উল্টো দিকে বসেছিল শৌভিকের অত্যন্ত স্নেহভাজন দুই অফিসার। দরজার বাইরে সদ্য নেমেছে সন্ধ্যা। অন্যান্য সন্ধ্যা গুলোর মতই খাবার টেবিলে এক কাপ দুধ নিয়ে বসে অনর্থক সময় নষ্ট করা তুত্তুরী বা পড়তে বসার জন্য নিরন্তর তাগাদা দেওয়া আমি, কেউ জানিই না ছোট্ট ঘরটার মধ্যে উল্টেপাল্টে যাচ্ছে সবকিছু। 


শৌভিকের কাঁথির অর্ডারটার গুরুত্ব প্রথমে কিছুক্ষণ উপলব্ধিই করতে পারেনি তুত্তুরী। অতঃপর সারা সন্ধ্যে একটাই কথা বলে গেছে,‘ আবার স্কুল বদলাতে হবে? আমি তো একটা সেশনও শেষ করতে পারলাম না এই স্কুলে।’ মোটামুটি চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে চার্জ দেওয়া-নেওয়া মিটিয়ে ফেলার পর শৌভিকের ইচ্ছে ছিল যত তাড়তাড়ি সম্ভব তাম্রলিপ্ত নগরী পরিত্যাগ করা। এখানেই বেঁকে বসে তুত্তুরী, শিশু দিবসের আগে কিছুতেই প্রিয় স্কুল ছাড়তে রাজি নয় সে। প্রতি মুহূর্তে ভিতরে ভিতরে ক্ষতবিক্ষত  হওয়া সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে শৌভিকের পাষাণ হৃদয়  ও বোধহয় গলে ছিল কিছুটা। 


চারটি অতিরিক্ত দিন স্কুল করার অনুমতি দেওয়া হল তুত্তুরীকে। ৯ইনভেম্বর, বুধবার স্কুলে গিয়ে সবার আগে নিজের প্রিয় বান্ধবী রিমলিকে খবরটা দিল তুত্তুরী। রিমলির সাথে প্রথম দিকে অবশ্য তেমন ভাব ছিল না তুত্তুরীর। তুত্তুরীর ভাষায়,‘ একবার মিউজিক স্যার ক্লাশে এসে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, আগুনের পরশমণি গানটা কারা গাইতে পারবে। আমি আর রিমলি দুজনেই হাত তুলেছিলাম। স্যার দুজনকে একসাথে গাইতে বললেন, গাইলাম, গান শেষ হবার পর ও আমায় ডেকে বলল, ‘আমার পেটের বোতামটা খুলে গেছে, একটু লাগিয়ে দিতে পারবি?’ অবাক লেগেছিল জানো মা, আমি তো ক্লাসে নতুন, পুরাণ বন্ধুদের না বলে আমায় বলল কেন? তারপর খেয়াল করে দেখলাম, ওর পাশে কেউ বসে না। ও এসে একাই একটা বেঞ্চে বসে। দু-তিনদিন পর আমি একদিন ওকে জিজ্ঞাসা করলাম,‘তোর পাশে বসতে পারি?’ ও বলল,‘বস। বস।’ সেই যে আমরা একসাথে বসা শুরু করলাম, শেষ দিন অবধি একসাথেই বসেছি।’ 


গতকালও রিমলির গল্প বলতে বলতে ভেঙে এসেছিল তুত্তুরীর গলা। প্রথম দিকে তুত্তুরী আর রিমলির মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির চেষ্টা করেছিল কেউ, কেউ। রিমলির গাত্রবর্ণ, রিমলির মেদুল চেহারা, রিমলির অতিরিক্ত সিরিয়াস হাবভাব, তরল কথাবার্তায় অনীহা ইত্যাদি তুলে ধরে তুত্তুরীকে কুমন্ত্রণা দিয়েছিল,‘ওর পাশে বসিস না। আমাদের পাশে বসবি আয়।’ আর রিমলিকে বলা হয়েছিল, তুত্তুরী একে তো কলকাতা থেকে গেছে তারওপর বাবার বদলির চাকরি, ওর স্থায়িত্বই বা কদিন, ওর সাথে মেশা মানে সময় অপচয় করা। 


প্রতিটি কুমন্ত্রণা আরো কাছাকাছি  এনেছিল মেয়েদুটোকে। একসাথেই বসত ওরা। ভাগ করে খেত একে অপরের টিফিন। গল্প করত প্রিয় নায়কদের নিয়ে। কবে যেন কুমন্ত্রণা দেওয়া সহপাঠীগুলোও একে একে এসে বসতে শুরু করেছিল ওদের ঘিরে। প্রাথমিক নেতিবাচক মেঘলা আবহাওয়া কেটে গিয়ে উঠেছিল ঝলমলে বন্ধুত্বের রোদ। তুত্তুরীর বিদায় সংবাদ শুনে প্রাথমিক ভাবে সিঁড়িতেই বসে পড়েছিল রিমলি। ‘তুই চলে যাবি? সত্যি চলে যাবি? এত তাড়াতাড়ি?’ 


স্কুল প্রদর্শনীতে জীববিজ্ঞানের কি যেন মডেল বানানোর কথা ছিল দোঁহের। হাত ধরাধরি করে বলে এল বায়োলজি স্যারকে,‘ আমরা আর বানাতে পারব না।’ স্কুল ছুটির পর সিঁড়িতে ক্লাশ টিচারকে পাকড়াও করে জিজ্ঞাসা করে নিল তুত্তুরী,‘স্যার, সামনেই তো ইউনিট টেস্ট, এমন সময় আমায় টিসি দেবেন তো? নাহলে বাবা বলেছে, নতুন স্কুলে আমায় নেবে না।’ প্রিয় ছাত্রীর মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে তিনতলা থেকে নেমেছিলেন মাননীয় শিক্ষক মহাশয়। মনমরা মেয়েটাকে যুগিয়েছিলেন অপরিসীম সাহস। ইংরেজি বলার বাধ্যকতা ছেড়ে মাতৃভাষায় বুঝিয়েছিলেন‘ আরে মন খারাপ করছিস কেন? কাঁথি অনেক বড় শহর। অনেক বড় স্কুল পাবি ওখানে। আর যখন যাবি দেখবি, ঐ স্কুলের প্রিন্সিপাল স্যারের মনটা না পুরো সোনা দিয়ে তৈরি। নিখাদ সোনা। তারপর তো আমরা রইলামই। যেকোন দরকারে তোর পুরাণ স্যার ম্যাডামদের ফোন করবি।’ বুকে হাত দিয়ে বলতে পারি, মহানগরে বড় হওয়া তুত্তুরী, হাওড়ায় বড় হওয়া আমি কোনদিন এত সহৃদয় বার্তা পাইনি কোন শিক্ষক-শিক্ষিকার থেকে। 


পরবর্তী দুদিনের মধ্যে গোটা ক্লাশ জেনেই গেল। যাকে/ যাদের বেশ অপছন্দ করত তুত্তুরী, স্কুল থেকে যাবার আগে যাদের রূঢ় বা বিদ্রুপ মাখানো বিদায় সম্ভাষণ জানাবে ঠিক করেছিল, তারাও খবরটা শুনে এমন আবেগ বিহ্বল হয়ে পড়েছিল, একজন তো তুত্তুরীকে জড়িয়ে ভ্যাক করে কেঁদেই ফেলল। কিছুদিন আগে ঐ মেয়েটিই তুত্তুরীর কাছে জানতে চেয়েছিল, ক্লাসের ফার্স্ট বয়কে কি করে প্রপোজ করতে হয়। জবরদস্ত আইডিয়ার জন্য তুত্তুরী আবার কথাটা জানায় তার দাদুকে। কারণ তুত্তুরীর মতে যাবতীয় উৎকট আইডিয়া দাদুর থেকে ভালো কেউ দিতে পারে না। অব্যর্থ আইডিয়ার জন্য কটা দিন সময় চেয়েছিল দাদু, ভাগ্যে তারই মধ্যে শৌভিকের ট্রান্সফারটা হয়ে গেছে। নাহলে এই দাদু-নাতনীকে নিয়ে যে আমি কি করতাম ঠাকুর!


১৬ই নভেম্বর বুধবার সকালে যখন আমরা সত্যিসত্যিই তমলুক ছেড়ে রওণা দিলাম কাঁথির দিকে, অবিকল শিশুর গলা নকল করে বার বার একই কথা বলে যাচ্ছিল তুত্তুরী,‘ অ্যায়াম ছো ছ্যাড।’ বিষাদের চোটে জ্বরই এসে গেল মেয়েটার। বৃহস্পতিবারই নতুন স্কুলে ভর্তি হবার কথা ছিল,নতুন স্কুলের প্রিন্সিপাল স্যার আগেই জানিয়ে রেখেছিলেন, ঐ স্কুলে এখন ইউনিট টেস্ট শুরু হয়ে গেছে। ফলে কটা দিন লাইব্রেরিতে বসে থাকতে হবে তুত্তুরীকে। 


জ্বর অবশ্য নেমে গেল একদিনেই। পরদিন নতুন স্কুলে ভর্তি হতে গেল তুত্তুরী। প্রিন্সিপ্যাল স্যারের ঘরে বসে ফর্ম ফিলাপ করতে লাগল শৌভিক, আর তুত্তুরীকে নিয়ে গেল ইনচার্জ ম্যাডাম। মাপা হল ওজন, উচ্চতা ইত্যাদি। তারপর দু জন দিদিমণি ধরলেন কিছু প্রশ্নোত্তর। কি যে কাগের ঠ্যাং, বগের ঠ্যাং মার্কা উত্তর দিল তুত্তুরী, ভয়ে তো গলা দিয়ে আওয়াজই বেরোচ্ছিল না। শুধু নাক দিয়ে কি সব যেন ঝরছিল। ম্যামরা বকলেন তো নাই, উল্টে দুহাতে দুটো টফি নিয়ে ফেরৎ এল মেয়েটা। বেশ কিছুক্ষণ খোশ গল্প করলেন বড় স্যার। জানতে চাইলেন, পুরাণ স্কুলের জন্য মন খারাপ কি না? জানালেন মন খারাপ হলেই ওণার কাছে বা ভাইস প্রিন্সিপ্যাল স্যার বা ইনচার্জ ম্যাডামের কাছে গিয়ে মনোবেদনা উজাড় করে দিতে। বললেন,‘আমাদের ছাত্রছাত্রীদের থেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ আমাদের কাছে কেউ নই। নির্দ্বিধায় এসো আমার ঘরে। যত ব্যস্তই থাকি না কেন-’।  


 কিছুটা খুশি খুশি মনে ফিরে এল তুত্তুরী। সঙ্গে নিয়ে এল নতুন বই, খাতা। মাপ দেওয়া হল  নতুন পোশাকের। পুরাণ স্কুলের ব্লেজারটা আর পরতে পারবে না বলে খুব দুঃখ ছিল তুত্তুরীর, নতুন স্কুল থেকে অনুমতি দেওয়া হল, রঙটা যখন খুব কাছাকাছি, তখন ঐটাই পরুক তুত্তুরী। শুধু পুরাণ স্কুলের লোগোটা তুলে দিলেই চলবে। ছাত্রছাত্রীদের খুশিটাই বেশী জরুরী এই স্কুলে।  


নতুন স্কুলে, নতুন স্যার-ম্যাডামদের সাথে ধীরে ধীরে আলাপ হল। দুচারজন সহপাঠীর সাথেও আস্তে আস্তে ভাব হল। ইনচার্জ ম্যাডাম, ভাইস প্রিন্সিপাল, প্রিন্সিপ্যাল স্যার যার সাথেই দেখা হয়, প্রত্যেকে নিয়মিত খোঁজ নেন,‘কি পুরোযা, ভালো আছ তো? নতুন বন্ধু হল? কোন অসুবিধা হলেই আমাদের বলবে কিন্তু।’ শুধু তুত্তুরী নয়, প্রতিটি ছাত্রছাত্রীর সাথেই এমন ভাবেই কথা বলেন ওণারা। খোঁজ নেন সকলের। 


অন্যদের ইউনিট টেস্ট চলতে লাগল রুটিন মেনে, তাই বলে মন খারাপ করে একাকী লাইব্রেরিতে বসতে হল না মেয়েটাকে আমার। সবাই যখন পরীক্ষা দেয়, ক্লাশেই চুপ করে বসে থাকে মেয়েটা। জানলা দিয়ে আকাশ দেখে। মফস্বলের স্কুল,  স্কুলের উল্টো দিকে বিরাট ধান ক্ষেত। পেকে উঠেছে সোনায় ফসল। বড় বড় জানলা গলে হুহু করে ছুটে আসে হাওয়া। বাড়ি ফিরে গল্প শোনায় তুত্তুরী,‘জানো মা, অমুক সাবজেক্টের স্যার/ম্যাডাম আমাকেও প্রশ্নপত্র ধরিয়েই দিয়েছিলেন প্রায়। আমি হাত জোড় করে বললাম, স্যার আমি তো নতুন এসেছি। সিলেবাস জানা নেই।’ বলে একটু দম নেয় মেয়েটা, চোখ দুটো বড় বড় করে অপ্রয়োজনে, তারপর বলে,‘পাশের মেয়েটার পরীক্ষা শেষ হয়ে যাবার পর, বললাম, তোর প্রশ্নপত্রটা একবার দিবি? নিয়ে দেখি, সব চেনা। আমি সব পারতাম মা। সব পারতাম।’ বলতে বলতে চোখের কোণ চিকচিক করে ওঠে তুত্তুরীর।তুত্তুরীর মায়ের হৃদয় যেন এফোঁড়-ওফোঁড়  হয়ে যায় সাময়িক ভাবে। ক্ষণিকের জন্য কাঁথির মহকুমা শাসকের বাংলো চেম্বারে বিরাজ করে অখণ্ড নীরবতা। তারপরেই সামলে নেয় মা, জীবনের ঘাত প্রতিঘাত থেকে কতদিন বাঁচিয়ে রাখবে মেয়েকে, পাখির মাকেও তো একদিন বন্ধ করতে হয় ডানা। জোর করে উড়িয়ে দিতে হয় ছানাগুলোকে। উড়তে না শিখলে বাঁচবে কি করে? লড়তে না শিখলে টিকবে কি করে? আর ইতিহাস তো এটাই শেখায়, ‘যে টিকে গেছে, সেই জিতে গেছে।’

(শেষ)