#অনিরডাইরি #কাঁথিরকিস্যা
"পাঁউসির কাছে একটা অনাথ আশ্রমে বসন্ত উৎসবের নিমন্ত্রণ আছে, যাবি?"কোন এক রবিবারে সকালে সাগ্রহে জানতে চাইল শৌভিক। দোল কেটেছে বেশ কয়েকদিন হল, জানলার বাইরে উদ্দাম উল্লাসে গান ধরেছে কোকিলের গুষ্টি। গরম কফির কাপটাকে দুই হাতে সোহাগী আলিঙ্গন পূর্বক, সেই কলতানই শুনছিলাম মন দিয়ে।
জবাব দিতে কিঞ্চিৎ বিলম্ব হওয়ায় আবার বলল শৌভিক,"যাবি? পাশেই একটা রিজর্ট আছে 'মনচাষা' বলে, ওটাও ঘুরে নেব আর ফেরার পথে তোদের মন্দারমনি থেকেও ঘুরিয়ে আনব। লাল কাঁকড়া বিচ, যাবি?"
কয়েক বছর আগে হলেও, সপ্তাহান্তের ছুটির দিনে কোথাও যেতে বললে বিকট মুখব্যাদান করতাম আমি। ছুটির দুপুরে ফুল স্পিডে পাখা চালিয়ে, আপাদমস্তক চাদর মুড়ি দিয়ে ঘুমানো ছিল আমার কাছে স্বর্গসুখ। সাধের দিবানিদ্রা ফেলে কোথাও নড়তে রাজি হতাম না তেমন। ইদানিং বয়স বেড়েছে, প্রতিটা মুহূর্তে অনুভব করি, হাতে কমে আসছে সময়। ব্যস্ততাটাকেও ততো খারাপ লাগেনা আজকাল আর।
জলখাবার খেয়ে, আমরা যখন রওনা দিলাম মধ্য গগনে উঠবার তোরজোড় সম্পন্ন করে ফেলেছেন সূর্যদেব। কাঁথি থেকে খুব একটা দূরে নয়, কুড়ি-একুশ কিলোমিটারের মতো হবে। মহকুমা শাসকের ড্রাইভার নূপুর বাবু স্টিয়ারিং ধরলে তো, মিনিট কুড়ি -পঁচিশেই পৌঁছে যাব আমরা। গল্প শোনাতে শোনাতে নিয়ে গেলেন নূপুর বাবু, আগেকার স্যার ম্যাডামরা নাকি প্রায়ই যেতেন, এই আশ্রমে। দূর দূর থেকে বহু লোক আজও আসেন এই আশ্রমটি দেখতে। বেশ অনেকবার বললেন, "খুব ভালো লাগবে ম্যাডাম।"
বাংলায় "অন্ত্যোদয় অনাথ আশ্রম" লেখা বোর্ড টাঙ্গানো গেটের ভেতর দিয়ে যখন ঢুকলাম, একনজরে বুঝতে পারলাম না, এটা অনাথ আশ্রম না কোন রিজর্ট! সর্বত্র পরিচ্ছন্নতা আর যত্নের ছাপ, থোকায় থোকায় ফুটে আছে কেয়ারি করা মরশুমি ফুলের দল। একটা শেডের তলায় দাঁড় করানো আছে, অনেকগুলি ছোট বড় গাড়ি। নূপুর বাবু বললেন, "ওই দেখুন কত মানুষ এসেছে। এনারা প্রচুর অনুদান পান স্যার।"
হলুদ গোল গলা গেঞ্জি আর সাদা সুতির পাজামা পরিহিত এক ভদ্রলোক দৌড়ে এলেন। এক মাথা অবিন্যস্ত কাঁচা পাকা চুল, খালি পা, মুখে এক গাল হাসি। করজোড়ে শৌভিককে অভ্যর্থনা জানিয়ে, সাদরে নিয়ে গেলেন আশ্রমের ভিতরে। বিশাল এলাকা জুড়ে আশ্রম। বেশ অনেকটা রাস্তা হাঁটলাম আমরা। একদিকে মস্তপুকুর আর অন্যদিকে বড় বড় বিল্ডিং আর বাগান।
খোলা মাঠে ত্রিপল টাঙিয়ে বানানো হয়েছে ছাউনি। ছাউনির নিচে সারি সারি চেয়ারপাতা। সামনে সিমেন্টের তৈরি পাকা মঞ্চ। সেখানে নাচছে অধিবাসী মেয়েরা। এগোতে এগোতে দাঁড়িয়ে পড়ে শৌভিক দেখালো, আকাশে ড্রোন উড়িয়ে ছবি এবং ভিডিও তোলা হচ্ছে। মঞ্চের পিছনে লাগানো আছে মস্ত এলইডি স্ক্রিন। পর্দায় ফুটে উঠছে ছবি এবং ভিডিও। সবকিছুই বেশ হাইটেক এখানে। কোথাও তাচ্ছিল্য বা অবহেলা বা দীনতার কোন ছাপ নেই।
একদম সামনের তিনটি চেয়ার বরাদ্দ হল আমাদের জন্য। অধিবাসী এক শিশু কোথা থেকে এক চুবড়ি পাঁপড় ভাজা নিয়ে এসে হাজির হল। উপস্থিত অভ্যাগতদের চা আর পাঁপড় ভাজা দিয়েই খাতির করা হচ্ছে এখানে। কুলোয় করে তিন রঙা আবির নিয়ে এসে হাজির হলো তিন সুসজ্জিতা আশ্রম বালিকা। মোদের তিনজনের গালে লাগল নতুন করে আবিরের ছোঁয়া। বাঁদিকের লম্বা মাটির দাওয়ায় পেতে রাখা কাঠের টেবিল এবং বেঞ্চে বসে বসে পা দোলাচ্ছে কয়েকটি বালিকা। প্রত্যেকেই বেশ সুন্দর সাজুগুজু করেছে, বুঝতে পারলাম এদের অনুষ্ঠান এখনও বাকি।
যে প্রৌঢ় ভদ্রলোক আমাদের অভ্যর্থনা জানিয়ে নিয়ে এসেছেন, দেখলাম তিনি মঞ্চে উঠে গিয়ে সঞ্চালিকার কানে কানে কিছু বলে এলেন। অতঃপর সঞ্চালিকার সুললিত আহ্বানে মঞ্চে উঠতে হলো তিনজনাকে। সদ্য বাবার পুরাণ ক্যামেরাটার দখল পেয়েছে তুত্তুরী, গলা থেকে ক্যামেরা নামাচ্ছে না মোটে। গলায় ক্যামেরা ঝুলিয়ে এসেছে এখানেও, তুলছিলও কিছু ছবি, আচমকা মঞ্চে ডাক পেয়ে, অত্যন্ত অপ্রস্তুত হয়ে, ভোম্বলের মতোই স্টেজে উঠল। গৌরবার্থে বহুবচনের মতই মহকুমা শাসকের সাথে সাথে বরণ করে নেওয়া হলো আমাদেরও। মনোজ্ঞ অথচ সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখতে হলো শৌভিককে। তারপর আমরা আবার নেমে গিয়ে দর্শকের আসন গ্রহণ করলাম।
খালি গলায় অসম্ভব সুন্দর গান শোনালো এক আশ্রম বালিকা। তারপর আবার নাচের পালা, নাচ সাঙ্গ হলে আবার গান। দাড়ি বুড়ো যে কতগুলো বসন্তের গান লিখে গেছেন তার ইয়ত্তা নেই। আজও যেকোনো বসন্ত উৎসবের প্রাণপুরুষ কেবল তিনিই। সঞ্চালিকা ঘোষণা করলেন এবার দশ মিনিটের নৃত্যনাট্যের পালা। ফিসফিস করে বলল শৌভিক, "বোর লাগলে উঠে পড়তে পারি। দীঘাও যাওয়া যায়।" যায় তো বটে, কিন্তু একটুও বোর হচ্ছি না যে। কি ভালো গান গাইছে, কি সুন্দর নাচছে ছেলেমেয়েগুলো। কি উৎসাহ সবকটার। কি মিষ্টি লাগছে বাচ্ছাগুলোকে। ফিসফিস করে জানতে চাইলাম, " এত সুন্দর বাচ্ছাগুলোকে, কে অনাথ আশ্রমে রেখে গেল গো।"
নৃত্যনাট্য শেষে, অনুষ্ঠানে সাময়িক বিরতি ঘোষণা করে, সঞ্চালিকা যিনি আবার কর্মসূত্রে পাঁশকুড়া পুরসভার কর্মীও, মঞ্চে ডেকে নিলেন এই অনাথ আশ্রমের প্রধান কর্ণধার তথা প্রাণপুরুষ শ্রী বলরাম করণকে। হলুদ গোল গলা গেঞ্জি আর সাদা পাজামা পরিহিত যে প্রৌঢ় ভদ্রলোক আমাদের অভ্যর্থনা জানিয়ে এনেছিলেন, বুঝলাম উনিই হলেন বলরাম বাবু।
করজোড়ে সকলকে নমস্কার জানিয়ে তিনি শুরু করলেন অন্ত্যোদয় অনাথ আশ্রমের গল্প। স্ত্রী আর তিন মেয়ে ময়না-চায়না আর মণিকে সঙ্গী করে একার চেষ্টায় এই আশ্রমটি গড়ে তোলেন নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি। তখন আবাসিকের সংখ্যা ছিল হাতে গোনা। সামর্থ ছিল নগন্য। একটি মাত্র ঘর সম্বল। মেদিনীপুরের ভূমিপুত্র কিনা, তাই জেদ অদম্য। পিছু হটেননি বলরাম বাবু। গ্রামের বাড়ি বাড়ি গিয়ে, দিয়ে এসেছেন একটি করে মাটির হাঁড়ি। ওণার ভাষায়, মা লক্ষীরভান্ডার। আর অনুরোধ করেছেন বাড়ির মা বউদের, " মাগো, তোমরা যখন তোমাদের ছেলেমেয়ের জন্য ভাত বসাবে, তখন আমার অনাথ শিশু গুলোর কথাও একটু ভেবো। একমুঠো চাল ওদের জন্য ফেলে দিও এই হাঁড়িতে। মাসের শেষে এসে, সেই হাঁড়ির চাল নিয়ে যাব আমি। তাই দিয়েই ভরবে আমার বাচ্ছাগুলোর পেট।"
এই ভাবেই লড়েছেন কিন্তু পিছু হটেননি। বন্ধ হয়নি আশ্রম। আনন্দবাজার পত্রিকার স্থানীয় প্রতিবেদক শ্রী সুব্রত গুহ, যখন জানতে পারেন বলরামবাবু আর ওনার এই লক্ষ্মীর ভান্ডারের গল্প, তখন উনি এই নিয়ে একটি লম্বা প্রতিবেদন লেখেন। আনন্দবাজার পত্রিকার প্রথম পাতায়, ২০০৪ সালে আট কলম জুড়ে ছাপা হয় সেই প্রতিবেদন। তারপরে আর পিছু ফিরে তাকাতে হয়নি বলরাম বাবুকে। বর্তমানে এই আশ্রমে ৫০ জন বালক এবং ৫০ জন বালিকা থাকে। পাশেই আর একটি আশ্রম গড়ে তুলেছেন বলরাম বাবু। যেখানেই থাকেন আরো ৬৫ জন মেয়ে ও শিশু।
বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত, সাংবাদিক সুব্রত বাবু স্বয়ং উপস্থিত ছিলেন এই অনুষ্ঠানে। তাঁকে মঞ্চে ডেকে নিলেন বলরাম বাবু। ডেকে নিলেন উপস্থিত অন্যান্য মান্যগণ্য ব্যক্তিদের। দীর্ঘদিন এই আশ্রমের সঙ্গে যুক্ত এঁরা সকলেই। শুধু যে নগদ অর্থে সাহায্য করেছেন বা করে চলেছেন তাই নয়, এমনও মানুষ আছেন যিনি ছেড়ে দিয়েছেন কলকাতায় তাঁর ব্যক্তিগত দোতলা বাড়ি। সেখানে খোলা হয়েছে আশ্রমের একটি টেম্পোরারি অফিস। আশ্রমের কোন শিশু অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে ওখানে রেখে ডাক্তার দেখানো হয়। যে সমস্ত আবাসিক বালক বা বালিকা প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে গেছে, তারা ওখানে থেকেই পড়াশোনা করে। যেমন বর্তমানে নার্সিং পড়ছে বেশ কয়েকজন মেয়ে।
গল্প শোনাচ্ছিলেন জনৈক দম্পতি, এই আশ্রমের সঙ্গে ওনাদের ১৯ বছরের সম্পর্ক। ভদ্রমহিলা বলছিলেন," প্রথম যখন আসি সেটা ২০০৪ সাল। খবরের কাগজ পড়ে বলরামের সাথে ফোনে যোগাযোগ করি। সেটা মোবাইলের যুগ নয়। আমি শুধু বলেছিলাম, আমরা পাঁশকুড়া স্টেশনে দাঁড়াবো, আর আমি লাল পাড় সাদা শাড়ি পরে থাকবো।" আজও তাই পরে আছেন ভদ্রমহিলা। ওণার স্বামী একটু আগে বলছিলেন, তাঁর বয়স ৮০। বর্তমানে বিদেশে বসবাস করেন। কখনও সিঙ্গাপুর, তো কখনো আমেরিকা। দুই পুত্রই বিদেশে সুপ্রতিষ্ঠিত। জ্যেষ্ঠ পুত্র গুগলে মস্ত অফিসার। অনুষ্ঠান শেষে শৌভিককে গল্প শোনাচ্ছিলেন, Google Pay তে যত ট্রানজাকশন হয়, তার জন্য উনি রয়ালটি পান। কারণ ওটা ওনার জ্যেষ্ঠ পুত্রেরই ডিজাইন।
বলছিলেন ১৯ বছর ধরে এই আশ্রমের সঙ্গে জড়িত, মায়া পড়ে গেছে এই আশ্রম আর এর প্রতিটি আবাসিকের ওপর। যেখানেই থাকুন প্রতিবছর এই অনুষ্ঠানে ছুটে আসেন। দুঃখ করছিলেন, "আর কতদিন আসতে পারব জানিনা। বয়স ৮০ হল, তবে এটুকু আশ্বাস নিয়ে যেতে পারব পরপারে, যে আমার পরেও আমার ছেলেরা পাশে থাকবে, এই বাচ্ছা গুলোর।"
বেশ অনেকক্ষণ বসলাম আমরা, আরো কিছুক্ষণ বসতে পারলে ভালো হতো কিন্তু বলরাম বাবু ধরে নিয়ে গেলেন আশ্রম দেখতে, বিশাল এলাকা জুড়ে আশ্রম। অনাথ আশ্রম চালানো ছাড়াও আরো অনেক কিছু করেন ওনারা। গণবিবাহ দেন, বিনামূল্যে ছানি অপারেশন শিবির করেন ইত্যাদি প্রভৃতি। সবশেষে ধরে নিয়ে গেলেন পাশের আশ্রমে, এটি একটি বিশেষ আশ্রম এখানে থাকে বিশেষ ধরনের শিশু যারা যৌন নির্যাতনের শিকার বা যারা ১৮ বছরের কম বয়সে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করেছে। বিনা অনুমতিতে এই আশ্রমে প্রবেশ করা নিষিদ্ধ চতুর্দিকে নিরাপত্তার কড়াকড়ি, সিসিটিভি ক্যামেরার ছড়াছড়ি। শৌভিক সাবধান করে দিল তুত্তুরীকে, "গলা থেকে ক্যামেরা খুলে,গাড়িতে রেখে যা। এখানে কোনরকম ছবি তোলা যাবে না।"
তালা লাগানো মস্ত লোহার গেটের ভিতরে চকচকে নিকানো উঠোন, উঠোনে তুলসী মঞ্চ। উঠোনকে ঘিরে দুদিকে দুটো দোতলা বাড়ি। যার একতলায় রয়েছে অফিস। অফিসে টাঙানো রয়েছে আশ্রমিকদের খাদ্য তালিকা, কখন কি ক্লাস আছে, কে পড়াতে আসবেন ইত্যাদি। দেখলাম লেখাপড়া ছাড়াও নাচ,গান,সেলাই, পাটের কাজ এবং অন্যান্য হাতের কাজ শেখানো হয়। কে, কখন এইসব স্পেশাল ক্লাস নিতে আসবেন, ঝোলানো আছে তারও তালিকা।
বেরিয়ে আসছি, দোনা মোনা করে একটা প্রশ্ন করেই ফেললাম, বাচ্ছাগুলো এই ট্রমা কাটায় কি করে? বিশেষ আশ্রমের দেখাশোনা করেন যে ম্যাডাম, উনি বললেন কাউন্সিলর আসেন। কাউন্সেলিং হয় নিয়মিত। জানতে চাইলাম, ভোলা যায়? কেউ ভোলে? উনি হাসলেন কেবল। প্রশ্নটাই বড় বোকাবোকা যে। কিছু প্রশ্নের উত্তর না জানাই বোধহয় ভালো। মিশুক না বাস্তবে কিছুটা কল্পনার রং। যেখানে ভালো থাকবে প্রতিটা শিশু, যেখানে মুছে যাবে সমস্ত কুৎসিত দাগ।
ছবি সৌজন্য - শ্রীমতী তুত্তুরী
No comments:
Post a Comment