Wednesday 1 March 2023

অনির (বুল্লুবাবুর উপনয়নের) ডাইরি, ২২শে ফেব্রুয়ারি, ২০২৩

 

পর্ব - ১



আমরা বলতাম, ‘ছিরি।’ আসল নাম যদিও শ্রী। অন্নপ্রাশন থেকে উপনয়ন, এমনকি বাড়ির বড় সড় পুজো- যাবতীয় শুভকাজের অন্যতম উপকরণ এই শ্রী। শ্রী বানাত বটে আমার জ্যাঠইমা, স্বর্গীয়া শ্রীমতী কল্পনা চট্টোপাধ্যায়। শুধু চাটুজ্জে বাড়ি নয়, যাবতীয় আত্মীয়- অনাত্মীয়, পাড়া প্রতিবেশী সকলের কাছ থেকে রীতিমত শ্রী বানানোর বরাত পেত জ্যাঠাইমা। যার বাড়িতে যা শুভকাজ পড়ত, এসে একবার হাঁক পাড়ত শুধু, ‘ডলি দি’। কল্পনা নামটা বোধহয় খোদ জ্যাঠাইমারও আর মনে ছিল না। 


  মূলতঃ চালের গুঁড়ি বা গুঁড়ো দিয়েই তৈরি হয় শ্রী। এখন বারোমাস সহজলভ্য হলেও, তখন পৌষ মাস ছাড়া বাজারে মিলত না চালের গুঁড়ি। ফলে ভোর ভোর চাল ভেজাত জ্যাঠাইমা। জেঠু ছিল সুগার পেশেন্ট। সেই ১৯৮২ সাল থেকে রক্তে মাত্রা ছাড়া শর্করা নিয়ে চলত জেঠু, চড়া ডোজের ওষুধের পাশাপাশি, খাওয়া-দাওয়ার ছিল হাজার খানেক ধরাকাট। বাতে প্রায় পঙ্গু হলেও জেঠুর তত্ত্বাবধানে এতটুকু খুঁত রাখত না জ্যাঠাইমা। নিজে বাজার করে আনা থেকে, পঞ্চব্যঞ্জন রান্না, সুন্দর করে কাঁসার থালা বাটি গ্লাসে সাজিয়ে পরিবেশন,  সবটুকু করত একাহাতে। তারওপর ছিল জেঠুর মিনিটে মিনিটে চায়ের ফরমাইশ। ব্যাঁটরার চাটুজ্জেরা জন্ম -চা-তাল। চায়ের সাথে মেজাজ অনুযায়ী ছোলা- বাদাম ভাজা বা নোনতা বিস্কুট সব কিছু সাজিয়ে মুখের কাছে ধরে, সব সামলে উঠতে উঠতে, সূর্যি মামা আসর গুটিয়ে রওণা দিত পশ্চিমে। আকাশে লাগত রঙের ছোঁয়া। বাতাস মুখরিত হত কুলায় ফিরতে উন্মুখ পাখিদের কলতানে। তখন নিরালায় ঠাকুর ঘরে বসে শ্রী গড়াতে হাত লাগাত জ্যাঠাইমা। 


কাঁসা বা স্টিলের কাঁসির(প্লেট) ওপর নিপুন হাতের কাজে ফুটে উঠত অনবদ্য সব নকশা। মূল কাঠামোটা একই হত, একটা দেউলের মত উঁচু চাউলের মণ্ড, তার গায়ে লাল-লীল-সবজে নক্সা। লাল হত সিঁদুর দিয়ে,নীল বা লীল রঙ আসত রবিন ব্লু দিয়ে। গুঁড়ো হলুদ ধরাত হলদে রঙ। সবুজ কি দিয়ে করত মনে নেই। সম্ভবতঃ কোন গাছের পাতা বেটে। সব হলে ওপর থেকে অকাতরে সর্ষের তেল ঢালত জ্যাঠাইমা। শ্রী নাকি সর্ষের তেলে চুবিয়ে এবং ডুবিয়ে রাখতে হয়। 


যবে থেকে বুল্লু বাবুর পৈতে থুড়ি উপনয়নের প্রস্তুতি শুরু হয়েছে,কত শত সহস্র বার যে জ্যাঠাইমার নাম উঠেছে। শুধু শ্রী গড়া নয়, চাটুজ্জে বাড়ির যাবতীয় নিয়মকানুন যার মগজে তালাবন্ধ ছিল সে ছিল আমার জ্যাঠাইমা। মা আছে, পিসি আছে কিন্তু  নিয়মকানুনের কিছুই ওদের অধিগত নয়। থাকবে কেন? জ্যাঠাইমা জীবিত থাকতে কোনদিন জানার প্রয়োজন পড়েছে নাকি? প্রথম শুভকাজ, জ্যাঠাইমা ছাড়া। যে যা প্রশ্ন করছে, আমরা শুধু ভাবছি। ভাবছি জ্যাঠাইমা থাকলে কি বলত। 


ভাবতে ভাবতে এসে পড়ল শুভ দিনটা। কাক না ডাকা ভোরের দধি মঙ্গল থেকে সাড়ে নটার গায়ে হলুদ। পর পর হয়েও গেল সবকিছু। এবার বরণের পালা, মাসিমা অর্থাৎ চৈতির মা অর্থাৎ বুল্লু বাবুর দিদিমা আমায় বললেন, ‘শ্রী টা তুমি নাও’। শ্রী? শ্রী গড়েছে নাকি কেউ? তাকিয়ে দেখি অবিকল জ্যাঠাইমার মতই গড়া হয়েছে শ্রীটা। কে গড়ল রে? পাশ থেকে চৈতি বলল,‘ আমার মা খানিক গড়েছিল, বাকিটা ওর বাবা মানে তোমার ভাই (শ্রী অয়ন কুমার চট্টোপাধ্যায় ) গড়েছে।’ ভরে উঠল হৃদয়, জ্যাঠাইমা না থেকেও রয়ে গেছে। এইভাবেই তো থেকে যায় আমাদের পূর্বসুরীরা,আমাদের মধ্যে দিয়ে। থেকে যায় তাদের শিক্ষা- সংস্কৃতি, আশির্বাদ। নাঃ কিছুই হারায় না মশাই। কোথাও না কোথাও থেকে যায় সবটুকুই।


পর্ব - ২ 



#অনিরডাইরি #কাঁথিরকিস্যা 


আইবুড়ো ভাত বেশ কয়েকজনকে খাওয়ালেও, অপৈতে ভাত ইতিপূর্বে কখনও কাউকে খাওয়াইনি। সত্যি কথা বলতে কি, এমন যে কিছু আছে তাই তো জানতাম না। আমার মাতৃকুল কায়স্থ, ফলে ওদিকে কারো উপনয়নের গল্প ছিল না। আর পিতৃকুলে যে সব ভাইদের উপনয়ন হয়েছে তা এমন মান্ধাতার আমলে হয়েছে যে কেবল ন্যাড়ামুণ্ডি হওয়া ছাড়া কোন স্মৃতিই তেমন নেই আর। 


কিছুদিন আগে জনৈকা বন্ধুপুত্রের উপনয়নের ছবি দেখতে গিয়ে প্রথম জানতে পারি অপৈতেভাতের কথা। তখনও বুল্লু বাবুর উপনয়ন জল্পনা-কল্পনার স্তরে। কথা প্রসঙ্গে অপৈতেভাতের কথাটা তুলেছিলাম, ব্যাপারটা কি এবং কেন ইত্যাদি। বুল্লুবাবুর জননী ওরফে আমার ভ্রাতৃবধু চৈতি বুঝিয়ে বলল,‘ ও দিদিভাই, পৈতে হলে তো এক বছর আঁশ খাওয়া নিষেধ। মাছ-মাংস- ডিম- পেঁয়াজ কিছুই খেতে নেই। তাই আর কি, সবাই অগ্রিম ডেকে পেট পুরে খাইয়ে দেয়।’ 


 বুল্লুকুমার কি আদৌ এক বৎসর নিরামিষাশী হয়ে থাকতে পারবে? একথা ভাই ভূতেও বিশ্বাস করবে না। তা নাই করুক, আচার বিধি নাই মানতে পারুক, আমি ওকে খাওয়াবই, অপৈতেভাত। সেই মত যবে থেকে দিন স্থির হয়েছে, আমি পর্যায়ক্রমে সবার পিছনে পড়ে থেকেছি। ওরে আয় রে, হবু ব্রহ্মচারীকে একটু পেট পুরে খাওয়াই। 


দেখতে দেখতে,যাচ্ছি- যাব করতে করতে দিন গড়ায়। ২২ তারিখে উপবীত ধারণ করবেন শ্রীমান বুল্লু। ১০ই ফেব্রুয়ারি দুপুর বেলা ফোন করে অয়ন, বুল্লু বাবুর পিতৃদেব। ‘শোন না তোকে নেমন্তন্ন করতে যাব ভাবছি। এই রবিবার।’ শুনে লাফিয়ে উঠি আমি। আয় ভাই,আয়। নেমন্তন্ন না করলেও চলবে, ব্যাটাকে অপৈতেভাতটা খাওয়াই। কিভাবে আসবি, কি ভাবে যাবি এই সব কথায় কথায় জানতে পারলাম, অয়ন ভাবে এখনও বুঝি আমরা তাম্রলিপ্ত নগরীর নিবাসী। ‘কেন? দাশনগর থেকে ট্রেন ধরব। মেচেদায় নামব। না হলে বেলেপোল থেকে ফাঁকা বাস ধরে নেব, নিমতৌড়িতে নেমে পড়ব।’ বলি তারপর? অকুতোভয় অয়ন বলেই চলে, “তারপর আর কি? ওখান থেকে তো তোদের বাংলো হাঁটা পথ।”


হাসি চেপে বলি, একদম হাঁটা পথ। গুগলে বলছে বেশি না তেরো ঘন্টা হাঁটলেই কেল্লা ফতে। “অ্যাঁ?” আঁতকে ওঠে অয়ন। “তোরা এখন কোথায় থাকিস রে?” হোক কাঁথি, তাও বদলায় না পরিকল্পনা। ভোরের তাম্রলিপ্ত এক্সপ্রেস ধরে এসে হাজির হয় সবাই। রাতের কাণ্ডারী ধরে ফিরে যায়। “নিরাপদে বাড়ি পৌঁছেছি রে“ মেসেজটা যখন এসে পৌঁছায় তখন মধ্য রাতি পেরিয়ে গেছে। 


ওদের ওপর ব্যাপারটা অকথ্য নির্যাতন হলেও আমাদের যে কি আনন্দে কেটে যায় দিনটা। মনের মত করে বাগানের ফুল তুলে এনে সাজিয়ে দিই বুল্লু বাবুর থালাবাটি। চৈতি আবার দৌড়ে গিয়ে তুলে আনে আরোও কিছু ফুল। একই রকম ভাবে খেতে দেওয়া হয় শ্রীমতী তুত্তুরীকেও। সকাল থেকে যিনি মুখ ভার করে ঘুরছিলেন আর থেকে থেকে নালিশ করছিলেন, ‘কেন? কেন? শুধু দাদা কেন? কেবল ছেলেদেরই কেন? মেয়েদের কেন পৈতে হয় না?” নালিশ শুনতে শুনতে বিরক্ত হতে হতে মনে পড়ে যাচ্ছিল কয়েক দশক পূর্বে এমনিই এক হিংসুটে মেয়ের কথা। যার পিঠোপিঠি খুড়তুতো ভাইদের যখন পৈতে থুড়ি উপনয়ন হচ্ছিল এমনিই তীব্র ঈর্ষার জ্বালায় জ্বলছিল মেয়েটা। এমনি ভাবেই নালিশ করে বেড়াচ্ছিল তার বাবার পিছন পিছন। আর তার বাবা বলছিল,‘ মেয়েদের যদিও উপনয়ন হয় না, তা না হোক। তোর আমি পৈতে দেবো। ন্যাড়া হবি তো? ভেবে দেখ-”। বুঝতেই পারছেন আশা করি মেয়েটা কে? আর তার রাম-ফাজিল বাপটাই বা কে। চিত্রনাট্য একই থাকে মশাই, সময়ের সাথে সাথে শুধু বদলে যায় কুশীলব। এই যা।




পর্ব - ৩


রাত সাড়ে চারটে। দধিমঙ্গল হবে বুল্লু বাবুর। একদম বিয়ের মতই, সূর্যোদয়ের আগে পেট পুরে দই,চিঁড়ে,সন্দেশ মেখে খেয়ে নিতে হবে। এরপর খেতে পাবে সেই বিকালে, যজ্ঞাদি মিটলে, দণ্ডীঘরে ঢুকে। তাও ডাল-ভাত-মাছ নয়। চরু। চরু জিনিসটা কি, ঠাকুমা বলত বটে, এখন আর বিশদে মনে নেই। পায়েসের মত কিছু একটা। 


এত ভোরে বুল্লু আদৌ উঠতে পারবে কি না, তাই নিয়ে রীতিমত দুশ্চিন্তায় ছিলাম আমরা। আমি স্বয়ং উঠতে পারব কি না, ভয় ছিল তা নিয়েও। গতকাল কাঁথি ছেড়ে যখন বেরিয়েছি তখনও নটা বাজেনি।হাওড়া ঢুকতে ঢুকতে ঘড়ির কাঁটা গড়িয়ে গেছে পৌনে ছয়ের ঘর। খুব ইচ্ছে ছিল সকাল সকাল আসার। কিন্তু সাম্প্রতিক সরকারী নির্দেশনামার পরিপ্রেক্ষিতে ছুটি তো দূর, অর্ধদিবস ছুটিও অসম্ভব ছিল। তাও বড় সাহেবকে অনুরোধ করে একটু আগে বেরিয়ে এসেছি। সন্ধ্যে থেকে আনন্দনাড়ু ভাজার কথা-


আমাদের যাবতীয় শুভ অনুষ্ঠানের আগের দিন চালের গুঁড়ো, সাদা তিল, নারকেল কোরা, আর আখের গুড় দিয়ে একটা নাড়ু ভাজা হয়। আমরা বলি আনন্দনাড়ু।আমার বিয়ের আনন্দনাড়ু ভেজেছিল আমার জ্যাঠাইমা আর বড় মাসি মিলে। নিমন্ত্রণ করতে এসে বুল্লুর বাপ অর্থাৎ অয়ন অনুরোধ করেছিল এসে নাড়ু ভাজায় হাত লাগাতে। এই নাড়ু সবাই ভাজতে পারে না। যাদের পরিবারে এই নিয়ম আছে, কেবল তারাই নাকি হাত লাগাতে পারবে। নিকটাত্মীয় কারোরই তেমন নেই, যাদের আছে তাদের সবাইকে অনুরোধ করা হয়েছে। অয়ন সাগ্রহে আমার কাছে জানতে চাইল, ‘তোদের আছে তো?’ 


আমাদের অর্থাৎ ভটচায বাড়ির? কখনও তো দেখিনি বা শুনিনি। কাকে শুধাই? আমার বরের মতই আমার শ্বশুরমশাই জন্ম নাস্তিক। শাশুড়ীমাতাও তেমন নিয়ম জানেন না। ফলে আমি বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে আজও চাটুজ্জে বাড়ির নিয়মই অনুসরণ করি। বিস্তর ভাবনা চিন্তা করে, শেষ পর্যন্ত ফোন করলাম ছোট খুড় শ্বশুরকে। শৌভিকের ছোটকাকার থেকেই আমি জেনেছিলাম আমাদের গোত্র কি। এটাও নির্ঘাত উনিই বলতে পারবে। ভদ্রলোককে ওণার ভ্রাতুষ্পুত্ররা মোমো বলে সম্বোধন করে, আমিও তাই বলেই ডাকি। প্রশ্ন করলাম, ‘হ্যাঁ গো মোমো, আমাদের আনন্দনাড়ু আছে?’ প্রথমে তো বললেন না। তারপর খানিক ভেবে বললেন, এটা কি সেই চালের গুঁড়ি আর তিল দিয়ে বানায়? আমি উৎসাহিত হয়ে বললাম, হ্যাঁ,হ্যাঁ। ওটাই। ওটাই। আছে কি আমাদের কুলে? মোমো খানিক মাথা চুল্কে বলল,‘হত তো আগে। তবে ওকে আনন্দনাড়ু বলে কি না জানি না। দাঁড়া তোর কাকিমার সাথে কথা বল।’ ছোট খুড়ি শাশুড়ি মাতা অভয় দিলেন, ‘হ্যাঁ। হ্যাঁ। আমাদের আছে। আমাদেরও আনন্দনাড়ুই বলে। তুই নির্ভয়ে ভাজগে যা।’ 


নিয়ম যতই থাকুক, সরকারী চাকরবৃত্তি করলে কি আর ওসব হয়। ভাগ্যে চৈতির(বুল্লুর মা) মেজ পিসি এসেছিলেন,ওণাতে আর আমার মায়ে মিলে যখন কড়ায় নাড়ু ছাঁকতে শুরু করেছেন তখন গিয়ে পৌঁছালাম আমি। নাঃ কেউ কথা রাখে না, এমনকি আমি নিজেও না। 


পুনশ্চ - ধুতিটা কিন্তু বুল্লু বাবু নিজেই পরেছে। ঘুম চোখে এত অল্প বয়সে, এত ভালো করে ধুতি পরতে আমি আজ অবধি কাউকে দেখিনি। ❤️❤️


অনির (বুল্লুবাবুর উপনয়নের) ডাইরি, ২২শে ফেব্রুয়ারি, ২০২৩

পর্ব - ৪


ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। তুত্তুরীকে বলে শুয়েছিলাম, মাত্র পনেরো মিনিট শোব। যদি ঘুমিয়ে পড়ি, সোয়া ছটা বাজলে ডেকে দিস তো। তুত্তুরী ডেকেছে, তার ওপর ভরসা না করে সেট করে রাখা মোবাইলের অ্যালার্ম তো বেজে গেছে,আমি শুনতে পাইনি। নিথর হয়ে ঘুমিয়েছি কে জানে কতক্ষণ। শীত বিদায় নেবার সাথে সাথেই যেন বহুগুণ বেড়ে গেছে পথশ্রমের ক্লান্তি। পথশ্রমে কেন যে ক্যালোরি পোড়ে না ভগবান জানে। এত লম্বা লম্বা দূরত্ব গ্যাঁট হয়ে বসে পাড়ি দিই, তাও একটুও কমি না মাইরি। উত্তর-মধ্য-অন্ধ্র যাবতীয় প্রদেশের আয়তন ক্রমবর্ধমান। 


সাতটা নাগাদ কোন মতে নিজেকে চাগিয়ে তুললাম সুপ্তির অতল খাদ থেকে। ঘর ফাঁকা। পাশ থেকে মোবাইলটি হাতিয়ে কখন সটকে পড়েছেন শ্রীমতী তুত্তুরী। বাইরে থেকে ভেসে আসছে শানাইয়ের মধুর আওয়াজ। সদর দরজার মাথার ওপর ঝলসাচ্ছে ঝর্ণা আলোর রোশনাই। স্বর্গীয় ছোটকাকুর বসার ঘর, রান্নাঘর থেকে ভেসে আসছে নারীকণ্ঠের কলকাকলি। গোটা বাড়িটার গায়ে আজ লেগেছে উৎসবের ফাগ। সদ্য ভাজা আনন্দ নাড়ুর সৌরভে মম করছে চারিধার। চৈতির মেজোপিসির সঙ্গে সই পাতিয়েছে আমার মা। কি খোশগপ্পই যে করছে দুই জনে, সবাইকে ছাপিয়ে শোনা যাচ্ছে দুই বৃদ্ধার কলতান। অবশ্য বৃদ্ধা বললে পিসিমা হয়তো লাঠির বাড়ি আমাকে দিতেও পারেন দুয়েক ঘা। 


এও যেন এক রূপকথা। বুল্লু বাবুর উপনয়নের আনন্দনাড়ু ভাজছে তার মেজ জেঠঠাকুমা আর মেজো পিসিদিদা। আজকালকার দিনে কটা ছেলে/মেয়ের এমন সৌভাগ্য হয়। এত কিছু ভেবে আরোও ঘুম পেয়ে গেল যেন, কোন মতে টলতে টলতে বাবাকে গিয়ে বললাম,‘ যা যা করার কাল করব কেমন? আরেকটু ঘুমাই, কেমন বাবা?’ 


যা যা করা বলতে, বেশ অনেককিছুই করার আছে, যেমন ধরুন মায়ের ব্লাউজ কেনা। শাড়ির সঙ্গে ম্যাচ করে মায়ের ব্লাউজ কেনার কাজটা বোধহয় আমি নবম বা দশম শ্রেণী থেকে করে আসছি। হাওড়া ময়দানের যাকে বলে ওয়ার্ল্ড ফেমাস ইন হাওড়া দি বসাক ব্রাদার্স ছাড়া অন্য কোন দোকানের ব্লাউজ মায়ের কোনদিন পছন্দ হয়নি। উৎসবে অনুষ্ঠানে বসাকে খুনোখুনি করার মত ভিড় হয়, তাও আমায় যেতে হত এবং হয় মায়ের শাড়ি বগলে। শুধু যে মারামারি করে কিনে আনব আর মিটে যাবে তা কিন্তু নয়। রঙমিলান্তি একটা বড় চাপের ব্যাপার। নীল মানে এমন নয়, অমন নীল। সবুজ পানে হলুদ নয় ইত্যাদি প্রভৃতি। ধরুন ঐ পরীক্ষাতেও আমি পাশ করে গেলাম, তারপর মা নাক সিঁটকাবে, ‘কাপড়টা কি? রুবিয়া? ভয়েল? অরবিন্দ মিল?’ ধরুন এটার জবাবও আমি দিতে পারলাম। এরপরের প্রশ্ন, ‘এঃ হাতাটা কত বড়/ছোটরে। এ চলবে না পাল্টে নিয়ে আয়।’ শুধু কি হাতা? ‘পিটটা এত কাটা কেন? এটা কি প্রিয়াঙ্কা চোপড়ার ড্রেস?’ মায়ের পৃথিবীতে এই একজনই আছেন যিনি খোলামেলা পোশাক পরেন। অন্য কারো নামধাম আমার মায়ের কোন কালে মনে পড়ে না। সবকিছুতেই এটা তো প্রিয়াঙ্কা চোপড়ার ড্রেস বলে নাক সিঁটকায় মা। আবার যদি পিঠ ঢাকা ব্লাউজ আনি তো, শুনতে হয়,‘এটা কি এনেছিস?এটা পরে তো আমার গরমে ঘামাচি বেরিয়ে গেল।’ আরোও আছে, হুক গুলো এত বাজে ভাবে বসানো কেন? সেলাই করেছে দেখ যেন মানুষ সেলাই করেছে ইত্যাদি প্রভৃতি। 


দীর্ঘ দিন ধরে এই কাজ করছি তাও আজ পর্যন্ত একটাও মায়ের মনোমত ব্লাউজ আনতে পারিনি। যবে থেকে পৈতের দিনস্থির হয়েছে রোজ ফোনে একটাই কথা বলে যাচ্ছে মা, ‘আমায় একটা ব্লাউজ কিনে দিস তো। পৈতের দিন পরব।’ বসাক ব্রাদার্স খোলে বেলা বারোটার পর। ফলে কাল সকালে বেরিয়ে কিনে আনতে আনতে আর মায়ের পরা হবে না। দুচোখে পাঁচ কেজির বাটখারা চাপানো, কিন্তু হৃদয়ে যে কাঁটা ফুটছে। মেয়েটাও কাল শাড়ি পরবে। ওর আপাততঃ একটাই ব্লাউজ। ও মহানন্দে তাই পরতে রাজি হয়ে গেছে যদিও। কিন্তু আমি মা হয়ে সেটা কেমনে হতে দিই। 


সাড়ে সাতটার সময় শেষে থাকতে না পেরে, গুগল করে ফোন নম্বর বার করে, ফোন করেই ফেললাম বসাক ব্রাদার্সে। চেনা কণ্ঠ বলল, আটটায় বন্ধ হয়ে যাবে। ঊর্দ্ধশ্বাসে পোশাক বদলে দৌড়ালাম। দৌড়ানোর আগে বাবার হাত থেকে ছিনিয়ে নিলাম ভিক্ষা দেবার সরঞ্জামের তালিকা। হবু ব্রহ্মচারীকে ভিক্ষা দেবে মা। এই ভিক্ষার থালা এবং উপকরণ নিয়েও কয়েকদিন ধরে দাম্পত্য যুদ্ধ চলছে আমাদের গৃহে। বাবা চায় কাঁসার থালা। মায়ের মত স্টিল। কাজে আসবে। কাঁসা আজকাল কেউ ব্যবহার করে নাকি? 


প্রথম রাউন্ডে অবশ্য বাবা জিতেছে। কাঁথি থেকে বড় কাঁসার থালা কিনে বাবু অভিজ্ঞান চট্টোপাধ্যায়ের নাম এবং উপনয়নের দিনটির বাংলা তারিখ লিখিয়ে দিয়ে গেছি আমি আগেই। সে কি কেলেংকারি। কার্ডটা না নিয়েই দোকানে চলে গেছিলাম আমি। অত্যন্ত আত্মবিশ্বাসের সাথে বলেছি লিখে দিন মাঘ, ১৪২৯। বাংলা সাল নির্ণয় আমার বরাবরই নিখুঁত কিন্তু তারিখ সম্পর্কে কোন ধারণাই থাকে না। দোকানদারই বললেন, ‘ম্যাডাম তারিখটা ফোন করে জেনে নিন না। তারিখ সমেত লিখি, ভালো লাগবে।’ ফোন করে জানতেও চাইলাম বুল্লুর বাপের কাছে। সে তখনও অফিসের কাজে ব্যস্ত। বলল,‘বাড়ি গিয়ে তোকে রাতে জানাচ্ছি।’ অত রাত অবধি কাঁথির দোকান খোলা থাকবে নাকি? দোকানদারই শেষে কোথা থেকে ছেঁড়া বাংলা ক্যালেণ্ডার যোগাড় করে লিখে দিল ৯ই ফাল্গুন,১৪২৯। 


যাই হোক,থালার যুদ্ধে বাবা জিতলেও,ভিক্ষা সামগ্রীর যুদ্ধে মাই জিতেছে শেষ পর্যন্ত। বাবা যদিও সহজে হার মানেনি। রীতিমত পুরোহিত মহাশয়কে ফোন করে জেনে, একগাল মাছি হওয়া সত্ত্বেও টুকে রেখেছে কি কি আনতে হবে। ব্লাউজ পর্ব সফল ভাবে মিটিয়ে গেলাম কদমতলা বাজারে। সেখানে তখন বিশাল ভীড়। পত্নীসহ বিসর্জনে চলেছেন ভোলেবাবা। উদ্দাম ঢাক ঢোল বাজাচ্ছে ভূতপ্রেতের দল। বাতাসে ফুরফুরে গাঁজার সৌরভ। পাশকাটিয়ে যাওয়া দুষ্কর।


 কোনমতে চাল, ফল,মিষ্টি, হরিতকী, পৈতে ইত্যাদি বগলে যখন টোটোয় উঠলাম, ঘড়ির কাঁটা নটা ছুঁইছুঁই। আমার উল্টোদিকে আমারই মত কেউ বসে আছে, তারও মুখেচোখে সারাদিনের পরিশ্রম আর শ্রান্তির কালিমা। সহমরমি দুই জোড়া ঢুলুঢুল চোখ একে অপরের ওপর পড়তেই ঝলমলিয়ে উঠল যেন শহরটা। আরে এতো আমাদের অদিতি। দুইজনেই ‘তারাসুন্দরী’, দীর্ঘদিনের সহপাঠী। 


আমাদের বিদ্যালয়ে পদবীর প্রথম অক্ষর ধরে বিভাগ নির্ধারিত হত। যেমন আদক থেকে দাসেরা ক বিভাগ। আবার মণ্ডল,মুখার্জী, নন্দীরা গ বিভাগ।আমি চাটুজ্জে তাই আমার সেকশন ছিল এ আর অদিতি লাহা ছিল বলে সম্ভবতঃ বি। জীবন বড় নির্মম, স্কুলের নিরাপদ পরিমণ্ডল ছেড়ে বেরিয়ে আসার পর সময়ের অভিঘাতে ক-খ-গ-ঘ সব মিলেমিশে একাকার। গোটা রাস্তা স্কুলের মেয়েদের মতই কলকল করতে করতে এলাম আমরা। একে অপরকে শোনালাম, “-- কী রকম ভাবে বেঁচে আছি, তুই এসে দেখে যা।” নিজেরাই তাজ্জব হয়ে গেলাম, আমরা কি সত্যিই এতটাও সবলা ছিলাম! শৈশবে বুঝিনি তো। বুঝলেই বা কি হত? অন্যরকম হত কি জীবনটা? লেখা হত অন্য কোন গপ্প? নাঃ মশাই, এই বেশ ভালো আছি। 


ঝাউতলায় নেমে গেল অদিতি, ‘তোর ভাড়াটা দিয়ে গেলাম,তুই আবার দিতে যাস না। আর একদিন মিট করি চল -’ বলে। আবার খানিক ঝিমিয়ে পড়ল যেন বুড়ো শহরটা। গোটা পাঁচেক ব্যাগ বগলে লটরপটর করতে করতে বাড়ি পৌঁছে দেখি বুল্লুর বাপ বসে আছে আমারই প্রতীক্ষায়। সুসংবাদ দিলেন। কাল সকাল চারটের সময় উঠতে হবে। সূর্যোদয়ের পূর্বে বুল্লুবাবুকে দধিমঙ্গলে বসতে হবে। প্রয়োজন তিনজন এয়োস্ত্রীর। বুল্লুর মা-দিদিমা ছাড়া অপর ভাগ্যবতী আমি। যৎপরনাস্তি পুলকিত হয়েও খেয়াল হল, এই রে পট্টবস্ত্র পরতে হবে তো।সাকুল্যে এনেছি তিন সেট জামাকাপড়। একটা পরে এসেছি এবং বাজার গেছি। অন্যটা পরে রাতে ঘুমাব আর তৃতীয়টা কাল অনষ্ঠান বাড়িতে পরব। অপারগতা জানিয়ে বললাম,‘মাকে নিয়ে যা না।’ সিঁড়ি ভাঙার নামে ককিয়ে উঠল মা। আর অয়নও নস্যাৎ করে বলল,‘মানার (আমার মা এবং অয়নের জেঠিমা) একটা শাড়ি পরে নিবি। আমি তোকে চারটের সময় ফোন করব।’ 


অয়নের ফোনের ভরসায় না থেকে ভাগ্যে মোবাইলে অ্যালার্ম দিয়েছিলাম। আমি উঠলাম, মায়ের কাচা শাড়ি পরলাম, মুখ ধুলাম,মাথায় গঙ্গা জল ছিটালাম, বাইরে রোয়াকের আলো জ্বালালাম,তালা খুললাম,মোবাইলে ফেসবুকও দেখে ফেললাম প্রায় মিনিট বিশেক কেউ ডাকে না। শেষে বিরক্ত হয়ে আমিই ফোন করতে গেলাম, ওরা আদৌ উঠেছে কি না জানতে। এদিকে চারটে সাঁইত্রিশ বাজে। ফোন করতে গিয়ে দেখি আমার ফোনটাই চমকে বসে আছে। ফোন যাচ্ছে না অর্থাৎ আসছেও না। সাহস করে দরজা খুলে উঠোনে যখন নেমেই পড়লাম উল্টোদিকের বারন্দা থেকে অয়ন বলল,‘তুই উঠেছিস? আমি তো ভাবছি মেজ জেঠু উঠে আলো জ্বেলে সিগারেট খাচ্ছে বুঝি।’ বোঝ কাণ্ড। আমায় যে কেন কেউ সিরিয়াসলি নেয় না। শাশুড়ি মাতা যথার্থই বলেন, "বেঁচে থেকে আর লাভ নেই।"


অনির (বুল্লুবাবুর উপনয়নের) ডাইরি, ২২শে ফেব্রুয়ারি, ২০২৩

পর্ব - ৫



পেশাদার চিত্রগ্রাহিকা বলেছিলেন, "গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানটা বাইরে করুন না।প্লিজ।" চৈতি বলল, " কেন?সব যোগাড় তো এই ঘরেই করা হয়েছে।" মেয়েটি বলল, " আসলে বাইরে তুললে প্রেক্ষাপটটা বেশ ভালো আসত। এখানে 🫤।" চৈতি কখনও গলা তুলে কথা বলে না। হুকুম করে না। তবে সেই মুহূর্তে চৈতির কণ্ঠ স্বরে ফুটে উঠল, এক অদ্ভুত ঋজুতা। " না এখানেই তুলুন। পিছনে এই ছবি দুটো যেন থাকে।" যাঁরা চেনেন না তাঁদের উদ্দেশ্যে বলি ছবি দুটি হল আমার স্বর্গীয় ছোট কাকু এবং কাকিমা অর্থাৎ অসিত কুমার চট্টোপাধ্যায় এবং কণিকা চট্টোপাধ্যায়ের। চৈতির শ্বশুর শাশুড়ি এবং বুল্লু বাবুর পিতামহ এবং পিতামহী। দুজনেই নেই আজ বেশ অনেক গুলো বছর।


অনির (বুল্লুবাবুর উপনয়নের) ডাইরি, ২২শে ফেব্রুয়ারি, ২০২৩

পর্ব - ৫


আমার জননী এবং আমার কন্যা। দুজনকেই সাজানোর কৃতিত্ব এই অধমের। দ্বিতীয় জন সানন্দে সাজুগুজু করে নিলেও,প্রথম জনকে সাজাতে হয়ে গেছে একখানা ছোট্টখাট্টো কুরুক্ষেত্র। আমার মায়ের বক্তব্য হল,‘সাজবি তো তোরা। আমি বুড়ো মানুষ, খামোখা আমায় নিয়ে টানাটানি কেন?’ বললেই হল? কমলি কি অত সহজে ছাড়ে? আর এক্ষেত্রে কমলি তো আর সংখ্যায় একটা নয়। 


বিগত সপ্তাহান্তে, শ্রীমতী তুত্তুরীকে হাওড়া ছাড়তে গেছি, সদর দরজার বাইরে থেকে শুনতে পাচ্ছি মায়ের রাগত কণ্ঠস্বর। মায়ের নিষেধ সত্ত্বেও আমার তিরাশি পেরোনো বাপ গিয়ে পাড়ার দোকান থেকে কিনে এনেছে চুলের রঙ। বুড়ি মেজ জেঠিকে রোয়াকে বসিয়ে মিষ্টি মিষ্টি কথায় ভুলিয়ে তাই লাগিয়ে দিচ্ছে আমার খুড়তুতো ভাই অয়ন। মা দিব্যি রোদে বসে মাথায় কলপ থুড়ি রঙ করছে এবং চাটুজ্জে গুষ্ঠির মুণ্ডপাত করছে। দেখে মন ভরে গেল। প্রতিনিয়ত ভাগ্যের কাছে কতই না অভিযোগ করে মা হাঁটুর ব্যথা, অবসাদ, আমার বাড়ি থেকে বহুদূরে পোস্টিং, বাবার মাত্রাতিরিক্ত সিগারেট খাওয়া, খকখকে কাশি ইত্যাদি প্রভৃতি। যা নেই তার শোকে মা যে কেন দেখতে পায় না, আদতে মা কত ধনী। মায়ের সম্পদ নিক্তিতে মাপা যায় না, এই যা। 


চুল তো হল, এবার পোশাকের পালা। কিছুতেই ভালো শাড়ি পরবে না মা। এমন একখান শাড়ি পরল যেটা ২০১৩ সালে আমিই এনে দিয়েছিলাম আগ্রা থেকে। বাঁশ না কলার খোসা কি দিয়ে যেন তৈরি শাড়িটা। ১৪০ না ১৫০ টাকা দাম নিয়েছিল যেন। একেবারে ন্যাতা এবং জ্যালজেলে শাড়ি। উৎসব বাড়িতে অন্য সবার ঝকমকে পোশাকের পাশে আমার মা প্রায় অদৃশ্য। অতঃপর রীতিমত খণ্ডযুদ্ধ, শ্রীমতী তুত্তুরীর গ্যালন খানেক অশ্রুপাতের পর নমনীয় হল মা। ভালো শাড়ি পরবে বটে, তবে তা যেন ভারি না হয়। হলহলে সিল্কের না হয়। চকরাবকরা না হয়। ইত্যাদি,প্রভৃতি। ভদ্রমহিলার নক্সা কি কম। 


অনেক ভেবে চিন্তে জ্যাঠাইমার দেওয়া এই শাড়িটা বার করলাম। আইবুড়ো ভাত খাইয়েছিল জ্যাঠাইমা এই শাড়িটা দিয়ে। শাড়িটা আমার ভয়ানক,ভয়ানক পছন্দ ছিল। মহানগরে পোস্টেড থাকাকালীন যতবার মাননীয়ার প্রোগ্রাম হয়েছে আর আমার স্টেজ ডিউটি পড়েছে, এই শাড়িটাই পরে গেছাি আমি। বারবার। লাগাতার। কে বলবে শাড়িটার বয়স ১৪ বছরেরও বেশী। 


আর শ্রীমতী তুত্তুরীর শাড়িটার বয়স কত বলুন তো? পাক্কা ২৪বছর। দাদার বিয়েতে পাওয়া। জীবনে প্রথম বার ননদ হিসেবে কিছু পেয়েছিলাম। দাদা বৌদির ফুলশয্যার তত্ত্বে নিজের নাম দেখতে পাওয়া, সে যে কি আনন্দ, ভাষায় অপ্রকাশ্য। বউদির বাপের বাড়ি থেকে পাঠানো উপহার,তাই কেবল বৌদির অনুমতি নিয়েই ট্রেটা তুলে নিয়েছিলাম। তখনও আমি অপ্রাপ্তবয়স্ক। আরো অনেকের অনুমতি নেওয়া উচিৎ মাথাতেও আসেনি। ছোট থেকে জানি,চার দাদার একমাত্র বোন আমি। গুরুজনরা যে ভিন্ন মত পোষণ করেন, তা বোঝার মত পরিপক্কতা আমার ছিল না। ওনারা যদি একবারও বলতেন, আমি নিতাম ও না। সবটাই ছিল এক নাবালিকা তরুণীর নিছক আনন্দ।      


যাঁরা সমালোচনা, পরচর্চা করেন,তাঁরা তো বেশ রসিয়ে আলোচনা করেন, যাদের নিয়ে করেন,ব্যাপারটা তাদের কাছে যে কতটা বেদনার তা বোঝেন না। আর কখনও কারো বিয়ের পর কিছুতে হাত দিইনি। আমার নাম লেখা ট্রে হলেও না। বৌদিরা ডেকে, ভালোবেসে হাতে তুলে দিয়েছে, মেজ বৌদি তো ট্রে বগলে চলেই এসেছে আমাদের বাড়ি। তাও হাত বাড়িয়ে নিতে কেঁপেছে হাত। আবার না কেউ কিছু বলে বসে। আবার না মাকে শুনতে হয়, 'মেয়েকে কোন শিক্ষা দিসনি।' এমনও হয়েছে,ট্রে খুলে আসে পাশে উপস্থিত সকলের মধ্যে ভাগ বাটোয়ারা করে দিয়েছি বডি স্প্রে,পাউডার, আয়না, চিরুনি ইত্যাদি। তাও মোছেনি দাগ। তাও ভরেনি ক্ষত। এমনও ভাবতাম যে, যেদিন বেকারত্ব ঘুচবে, বেতন পেয়ে সব কিছু দুটো করে কিনে প্যাক করে ফেরত দিয়ে আসব। যেদিন সত্যিই রাইটার্স বিল্ডিং এর কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রিজ এ অবর বর্গীয় সহায়কের চাকরিটা পেলাম, প্রথম বেতন হাতে এল, ৬০৩৬ টাকা। ততোদিনে কেটে গেছে সাত বছর। বেড়েছে পরিপক্কতা। সেদিন মনে হল, যদি সত্যিই ফেরত দি, তাহলে সেদিন যারা সমালোচনা করেছিলেন তাদের আদৌ কিছু যায় আসবে না। অপমানিত হবে আমার বৌদি আর তার পিতামাতা। তাঁরা তো একদিনের জন্যও কিছু বলেননি। তাঁরা তো বরং বারবার ভালোবেসে জানতে চেয়েছেন, আমার কেমন লেগেছে শাড়িটা। কতটা পছন্দ হয়েছে তত্ত্ব ইত্যাদি। 


 ভীষণ পছন্দ হলেও, অভিমান করেই বহুদিন পরিনি শাড়িটা। তোলা ছিল আলমারির কোণে, নরম কাপড় মুড়ে। ভুলেই গিয়েছিলাম শাড়িটার কথা।দাদার উপনয়নে শাড়ি পরার অনুমতি পেয়ে আহ্লাদিত শ্রীমতী তুত্তুরীই খুঁজে বার করেছিলেন শাড়ি খানা। ভেবেছিলাম পাটে পাটে ফেঁসে গেছে বুঝি। মেয়েকে পরাতে গিয়ে দেখলাম আজও নতুন আছে শাড়িটা। নাহ্ এ তো সুন্দর শাড়িটার ওপর অভিমান করাটা আমার মস্ত ভুল হয়েছে। শাড়ি গুলো তো নিছক শাড়ি নয়, প্রতিটা শাড়ি আসলে একেকটা ইমোশন। প্রতিটা শাড়িই আসলে একটা উপন্যাস।


No comments:

Post a Comment