Wednesday 27 May 2020

অনির ডাইরি ২৭শে মে, ২০২০


রান্না করে আপিস যাওয়া, আবার আপিস থেকে ফিরে রান্না চাপানো। ভুলে গেছি সবার আগে ঘর-দালান-উঠান ঝাঁট দেওয়া, অতঃপর স্নান-আহ্নিক সেরে রসুই ঘর সামলে, বর-মেয়েকে খাবার বেড়ে দিয়ে, রান্নাঘরেই হাঁটু মুড়ে বসে গপাগপ গরাস গরাস ভাত গেলা। তারপর বাসনকোসন মেজে ধুয়ে, পোশাকআসাক পরে, মুখে খানিক ল্যাকটোক্যালামাইন আর পণ্ডসের ফেস পাউডার ঘষে ব্যাগ কাঁধে,চটি ফটফটিয়ে দৌড়। আপিস থেকে ফিরে চা বানিয়ে খাওয়া- অল্প বিশ্রাম, তারপর রাতের রুটি তরকারী বানাতে যাওয়া- এটাই ছিল মায়ের জীবন। কি ভাবে পারতে মা? মাস দুয়েক বাসন মেজেই হাতগুলো শৌভিকের থেকেও বেশী খসখসে,নখগুলো ভাঙা। কিউটিকলে ভর্তি। ঘুম ভাঙলেই আগে কাজের হিসেব কষি, কোনটা কোনটা শৌভিক করবে, কোনটা আমি। রোজ ঘর ঝাঁট দিলেও, মোছা একদিন ছাড়া। তাও তো তোমার মত হাঁটুমুড়ে না, মস্ত ডাণ্ডাওয়ালা মপ দিয়ে।
আজ ঘর মুছিনি। আপিসটাইমে ঘর ঝাড়পোঁচ করে শ্যাম্পু করতে গেলে বড় দেরী হয়ে যায়। রান্নাও যৎসামান্য, ফ্রীজের খাঁজে লুকিয়ে থাকা একফালি ওল সিদ্ধ করতে সেই প্রেশারকুকারটা ব্যবহার এবং মাজতে হল। জলখাবারের বালাই নেই, আমার সঙ্গেই ভাত খাইয়ে দিয়েছি সবকটাকে। দুপুরে খিদে পেলে ম্যাগি বানাতে পারে ওরা। থালাবাসনগুলো জল ঢালাই থাক। যদি ইয়ে,মানে কেউ দয়াপরবশঃ হয়ে মেজে রাখে-
এবার ব্যাগ গুছানোর পালা। স্যানিটাইজারটা সবার আগে ঢোকালাম, খুঁজে পেতে চশমাটাও। হেড ফোনটা গত দিন আপিসে ফেলে এসেছি-। মনে করে টিফিনটা নিতে হবে, নইলে হরিমটর। টিফিনের রুটিও আপিস টাইমেই বানাত মা, ঝপঝপ করে। ওপথ মাড়ালাম না, দুটো বিস্কুটই নিলাম, ফ্রীজের মাথায় একজোড়া কালো কলা পড়ে আছে, শৌভিক ওগুলো মুখ বুজে খেয়ে নেয়- আজ না হয় আমিই নিলাম।

এবার তৈরী হবার পালা, জামাকাপড় গুলো পরি আর কাচি, ফলে সবই বিবর্ণ। সেদিন স্পেন্সারে দেখলাম লেখা আছে- নো ট্রায়াল, নো রিটার্ন, নো এক্সচেঞ্জ।ইয়ার্কি নাকি? ঐ ভাবে কেবল তুত্তুরীর হাফ প্যান্ট কেনা যায়-তাও ২২৯টাকা করে।নৈহাটীর বাজারে অমন ইজের ৫০টাকায় হেসেখেলে মেলে। নেহাৎ লোকাল ট্রেন বা লঞ্চ কিস্যু চলছে না। 
মুখে মাখার কিছুই নেই, খানিক তুত্তুরীর পড়ে থাকা বেবি পাউডারই লাগালাম মুখে, চোখে একটু কাজল-  । মেকআপ করলে নাকি সংক্রমণের ভয় বেশী, দিনরাত পাখিপড়া করে আমার বর। একই কারণে ঘড়ি পরা বারণ। একবার বাড়ি যাব ভেবেছি, খালি হাতে মায়ের সামনে দাঁড়ালে প্রচুর গালি খেতে হবে।

সারা পৃথিবী স্যানিটাইজারের ওপর বেঁচে আছে, কেবল আমাদের বাড়িতেই স্যানিটাইজার নেই। আগের দিন গিয়ে চাইলাম,বাবা কোথা থেকে একটা ধুলো পড়া খেলনা স্যানিটাইজারের কৌটো বার করে আড়াই মিনিট ধরে স্প্রে করেই গেল, বেরোল না ছিটেফোঁটাও।ওমন এক পিস তুত্তুরী ওর খেলনা ছানাপোনাদের হাতে ঘষে। সেদিন বলল হ্যাণ্ডওয়াশও তলানিতে। পাড়াতেই করোনা পজিটিভ, তাও বৃদ্ধ মাস্ক পরে বেরিয়েছে লিক্যুইড সোপ কিনতে- না পেলেও অকুতোভয়- গায়ে মাখার সিন্থল আছে তো অনেকগুলো। চটি ফটফটিয়ে দৌড়বার প্রাক মুহূর্তে মনে হল একটা ছেল্ফি তুলেইনি, ঐ যে ফিরিঙ্গী ভাষায় বলে না, সামান্য “সেল্ফ প্যাম্পারিং” আর কি। তারপর? সময় দৌড়ল নিজের গতিতে, প্রতিটা দিন কি আর রূপকথা হয়? ভাগ্যিস হয় না। 

Thursday 21 May 2020

অনির ডাইরি ২১শে মে ,২০২০



ঝড় আসছে। ঝড় আসছে। রব উঠেছে কদিন ধরেই, মোবাইলের পর্দায় নীল সায়রে দাপিয়ে ওঠা কমলা ঘূর্নি। ও ঝড়, তুই যাবি কুথা? বাংলাদেশ আছে না, প্রতিবারই তো ওরা টেনে নেয় সব ঝঞ্ঝা, আমাদের ভাগে জোটে মনউদাসী কালো আকাশ,অল্পস্বল্প ঝোড়ো বাতাস আর কয়েক পশলা বৃষ্টি।

নাঃ। এবার শুনি গন্তব্য আমাদের বাংলা। দীঘার কাছে নাকি আছড়ে পড়বে ঝড়। গুচ্ছ গুচ্ছ সতর্ক বার্তা, ঝড়ের আগে কি করবেন-ঝড় উঠলে কি- আর ঝড় চলে গেলে কি করবেন দেখিয়ে-শুনিয়ে ঝালাপালা করে দিল কান আর মাথা। কোথায় ঝড়?দিব্যি পরিষ্কার আকাশ, দমচাপা গরম, নড়ছে না গাছের পাতা-

আজ ঝড়ের দিন, গত সন্ধ্যা থেকে কোথা থেকে যেন পঙ্গপালের মত ছুটে আসছে কালচে মেঘের পাল। বেলা দশটা- সাড়ে দশটায় নেমে আসল সন্ধ্যার আঁধার। মহানগরীর ন্যুভোরিশ এলাকায় রাজপথের লাগোয়া ঘন সবুজ সুসজ্জিত আবাসনের হোয়াটস্অ্যাপ গ্রুপে তখনও আসছে আশ্বাসবাণী, আমরা সর্বত প্রস্তুত। বিদ্যুৎবাতি নিভে গেলেও ভয় নেই, চলবে জেনারেটর- হ্যাঁ চলবে না বটে গিজার বা বাতানুকূল যন্ত্র।
বন্ধ জানলার ওপাড়ে ধীরে ধীরে মাথা দোলাতে লাগল সুসজ্জিত বনস্পতির দল। এক পায়ে দাঁড়ানো ফ্যান্সি সুপারি গাছগগুলো শিকড়সুদ্ধ আছড়ে পড়ল মাটিতে-ঝনঝনিয়ে ভাঙতে লাগল কাদের বাড়ির কাঁচ। শৌচাগারের স্বল্প খোলা জানলা দিয়ে কামানের গোলার মত ছুটে আসতে লাগল হাওয়া, আছাড় খেল ভারি কাঠের দরজা। তালেগোলে ঝপ করে চলে গেল বিদ্যুৎ। সম্ভবতঃ নিরাপত্তার স্বার্থে।

শুরু হল তুত্তুরীর হাউমাউ কান্না,  নাঃ ভয়ে নয়, মনোকষ্টে।  শৌখিন বারন্দায় সাজিয়ে রাখা টব গুলিতে উপছে পড়ছে জল, গলা জলে ডুবতে বসেছে তুত্তুরীর হাতে বসানো সদ্য অঙ্কুরিত কুমড়ো আর লঙ্কা গাছের সারি। পলকের জন্য বারন্দার দরজা খোলা মাত্রই, হুড়মুড়িয়ে ঢুকতে লাগল জলকণা।
 চানঘরের শাওয়ার খোলার মত তোড়ে ঝরছে জল, আবাসনের মেন গেটের মাথার ওপর সাজানো ঝুমকো লতা, ঝড়ের দাপটে উড়ে এসে বন্ধ করে দিয়েছে বারন্দার নালী। বারন্দা উপছে জল ঢুকছে ঘরে, জল তো নয় যেন নাদির শাহের ভারত আক্রমণ। অওয়ধ আর নিজামের  ইগোর লড়াই আর আয়েসী অবিমৃষ্যকারী রঙ্গিলা সুলতানের অদূরদর্শিতা যেমন ডুবিয়েছিল সেদিনের ভারতকে, অনেকটা তেমনি ভাবে ভেসে গেল আমাদের শৌখিন বাসাখানি।  শৌভিক অওয়ধের নবাব সফদর জং এর মত পুরোনো জামাকাপড় দিয়ে সাময়িক ভাবে ঠেকানোর চেষ্টা চালাল, হায়দ্রাবাদের নিজাম-উল-মুল্কের মত গোঁয়ার্তুমি দেখিয়ে ঝড়ের মধ্যেই বারন্দার নালী খোঁচাতে গিয়ে নাকখৎ দিলাম আমি, আর  সুলতান মহম্মদ শাহ রঙ্গীলার মত ক্রন্দসী তুত্তুরী নাকেকেঁদেই গেল-।

আয়লায় আমাদের বিয়ে, ঝড়-জল দুর্বিপাককে  খুব একটা ডরাই না আমরা, তবে ঘন্টাখানেক ধরে পর্যায়ক্রমে রাবার পুলার, মুড়ো ঝ্যাঁটা আর চারখানা পুরানো তোয়ালে দিয়ে চারহাত পায়ে গোটা বাড়ি নিংড়ে চার বালতি জল বার করার পরও যখন গড়িয়ে আসে জলস্রোত,তখন সত্যিই কান্না পায়। প্রতি মুহূর্তে মন বলছিল, এত শক্তিশালী প্রতিপক্ষের সাথে লড়াই করা মানুষের সাধ্যাতীত। সবার ওপর মাননীয় মূখ্যমন্ত্রীর বাণী, ওণাকে এমন অসহায় কখনও দেখিনি, ভেঙে পড়া গলায়, ক্লান্ত দৈহিক বিভঙ্গে, বিজিত দলপতির মত উনি বলে চলেছেন, “সব শেষ। আমরা বিপর্যস্ত”। দলপতির এই হেরে যাওয়া রূপটা কেন জানি না আরো গাঢ় করে দিচ্ছিল ঝড়ের রাতের অন্ধকার।
তবু থেমে থাকে না সময়। সকাল যখন হল,ক্লান্ত হয়ে হাল ছেড়েছে জেনারেটর। মোবাইলে টিমটিম করছে চার্জ।ঘরের বাইরে দিব্যি নিরীহ মুখের আকাশ- কে বলবে কালকের রাতটা অমন ভয়ঙ্কর কেটেছে। আসেনি খবরের কাগজ, আসেনি পৌরসভার ময়লাওয়ালা। খোলা জানলার ওপারে অভূতপূর্ব নৃশংসতা, পড়শী ধনী ব্যবসায়ীর চালের ওপর উড়ে এসে পড়েছে কার যেন বাঁশ আর টিন দিয়ে বাঁধা একখান ছাপোষা গুমটি, আবাসনের রাস্তায় ওপাশ-ওপাশ করে শুয়ে আছে এখনও তরতাজা গাছের দল। পাখিগুলো কোথায় গেল কে জানে? ভোরবেলা যে কোকিলটার ডাকে ঘুম ভাঙে, মুখে আজ কুলুপ এঁটেছে সেটা। রাজপথের ধারে ধারে  পাকিয়ে মণ্ড হয়ে গেছে নানা ঝুলন্ত তার, ছেঁড়া তারে দোল খাচ্ছে শিকড় উপড়ে পড়া বনস্পতির দল। অধিকাংশ প্রিয়জনের কাছে যাচ্ছে না ফোন, আর যেখানে ঢুকছে,চূড়ান্ত অবসাদমাখা একটাই কথা ভেসে আসছে ইথারে, প্রকৃতির এই রূপ আগে কখনও দেখিনি। মোবাইলে একের পর এক মনখারাপ করা ছবি, উড়ে যাওয়া ছাতের নীচে অসহায় বৃদ্ধা, তছনছ হয়ে যাওয়া গরীবের কুটির, মধ্যবিত্তের বাড়ি ধ্বসিয়ে হেলে পড়া মহীরুহ, আধাআধি তুবড়ে যাওয়া বাস, তছনছ হয়ে যাওয়া বিমানবন্দর, ডুবো গলি- আর সবার ওপর অভিমান। এমন দিনেও রাজনীতি বড়দা? একটা ট্যুইট পর্যন্ত করতে পারলেন না? ঘোষণা করলেন না তো জাতীয় বিপর্যয় বলে? আর আপনার ঐ হিন্দি মিডিয়া কেন খামোশ? কেন জনপ্রিয় হচ্ছে না কোন হ্যাশট্যাগ? কেন উত্তাল হচ্ছে না দেশ আমাদের ক্ষততে? আপনিও যদি সেই দলে পড়েন, তো অনুগ্রহ করে গুজবে কান দেবেন না,বড়দার ব্যাপারে মন্তব্য করতে অপারগ তবে টুইটারাটিদের মনোযোগ বা হ্যাশট্যাগই যদি আপনার কাম্য হয়, তবে আরেকবার চেক করে দেখুন #PrayforBengal এবং #PrayforWestBengal দুটোই খুঁজে পাবেন। সমবেদনা জানিয়েছেন অনেক ছোট-বড়-মাঝারি মাপের যশস্বী ব্যক্তি। সমবেদনা থাকবে-রাজনীতিও থাকবে- আর থাকবে লড়াই, মধ্য-নিম্নমধ্য আর নিম্নবিত্তের চিরসাথী। আমাদেরই আগের প্রজন্ম বলেছিল না,“লড়াই করে বাঁচতে চাই”। কোমর বাঁধুন মশাই, সামনে লড়াইটা বেশ কঠিন-

Tuesday 19 May 2020

#চেনা_ইতিহাস_অচেনা_সুর উইলিয়াম ড্যালরিম্পলের দা অ্যানার্কি থেকে


"অযোধ্যার নবাব সুজাউদ্দৌল্লা ( ১৭৩২-৭৪)

মুঘল উজির সফদর জঙ্গ এর পুত্র এবং উত্তরসূরী সুজাউদ্ধোল্লা ছিলেন এক দৈত্য। উচ্চতায় প্রায় সাত ফুট, ওষ্ঠাধরের ওপরে উড়ন্ত ঈগল পাখির ডানার মত সুবিশাল তৈলচর্চিত গোঁফ। তেমনি ছিল গায়ের জোর। প্রায় কিংবদন্তী।  যৌবনের উপান্তে এসেও এক কোপে একটা মোষের মাথা উড়িয়ে দিতে পারতেন, দুহাতে ঘাড় ধরে শূণ্যে তুলে ধরতে পারতেন দুইজন সেপাইকে। অসম্ভব আত্মবিশ্বাসী আর আত্মম্ভরী ছিল লোকটা। তেমনি উচ্চাকাঙ্ক্ষী। নিজের ক্ষমতা সম্পর্কে বড় বেশী উচ্চ ধারণা পোষণ করতেন, এই কারণেই হয়তো তৎকালীন শহুরে শিক্ষিত সম্প্রদায় খুব একটা পছন্দ করত না ওণাকে। গুলাম হুসেন খাঁ ওণার সম্পর্কে লিখে গেছেন, যে ‘লোকটা যতটা বলশালী প্রায় ততোটাই নির্বোধ। বেশ গবেট’। ”


অ্যানার্কি
#চেনা_ইতিহাস_অচেনা_সুর #2
"The collecting of Mughal Taxes was henceforth subcontracted to a powerful multinational corporation- whose revenue-collecting operations were protected by its own private army." William Dalrymple about the East India Company, in The Anarchy. Why am I having this ominous feeling of repeating history.

অ্যানার্কি
#চেনা_ইতিহাস_অচেনা_সুর #3
“ভারতে বৃটিশ আধিপত্য বিস্তার, এই শব্দবন্ধের মধ্যে লুকিয়ে আছে এক অশুভ সত্য। অষ্টাদশ শতকের মাঝামাঝি থেকে সমগ্র ভারত বর্ষ জুড়ে যে লুটপাট শুরু হয়েছিল, তার পিছনে বৃটিশ সরকারের কোন ভূমিকা ছিল না। এর জন্য দায়ী ছিল, এক নিয়ন্ত্রণহীন প্রাইভেট কোম্পানী। যার সদর দপ্তর বলতে ছিল পাঁচখানা জানালা পাশাপাশি জুড়লে যতটা চওড়া হয়, লণ্ডনের বুকে সেই মাপের একটা ছোট্ট আপিস। আর ভারতবর্ষে তাদের প্রতিনিধি হিসেবে এক চরম নিষ্ঠুর,হিংস্র, অবস্থা বিশেষে মানসিক ভারসাম্যহীন কর্পোরেট জন্তু, যার নাম- ক্লাইভ।”
অ্যানার্কি
#চেনা_ইতিহাস_অচেনা_সুর #4
“এমনিতেই যুদ্ধবিগ্রহে বিপর্যস্ত ছিল বঙ্গদেশ, গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মত দেখা দিল ১৭৬৯ এর মন্বন্তর। ঐ অবস্থাতেও খাজনার হার ছিল বেশ চড়া। খাজনা আদায়ের জন্য কোম্পানীর ট্যাক্স কালেক্টররা যথেচ্ছ নির্যাতন চালাত, পদে পদে লঙ্ঘিত হত মানবাধিকার। খুব দ্রুত খালি হয়ে আসছিল বঙ্গদেশের ধনভাণ্ডার। এখানকার সমৃদ্ধশালী তাঁতি আর কারিগররা নির্যাতিত নিঃস্ব হয়ে পরিণত হচ্ছিল ক্রীতদাসে।

বঙ্গদেশের ধনভাণ্ডারের একটা বৃহৎ অংশ গিয়েছিল ক্লাইভের পকেটে। ক্লাইভ যখন বৃটেনে ফিরে যায়, তার ব্যক্তিগত সম্পত্তির পরিমাণ ছিল ২,৩৪,০০০ পাউণ্ড। সেই সময় সমগ্র ইউরোপে ক্লাইভের থেকে ধনাঢ্য ব্যক্তি কেউ ছিল না। বিশ্বাসঘাতকতা, জাল জোচ্চুরি আর ঘুষের বিনিময়ে ১৭৫৭এর পলাশীর যুদ্ধে জেতার পর ক্লাইভ, পরাস্ত নবাবের কোষাগার লুণ্ঠন করে  প্রায় ২৫লক্ষ পাউণ্ড পাঠিয়েছিল ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীর ভাঁড়ারে। এত টাকা এর আগে কেউ কখনও চোখে দেখেনি। বঙ্গদেশের ভাঁড়ার বা ট্রেজারি খালি করে একশ খানা নৌকা গঙ্গাপথে পাড়ি দিয়েছিল মুর্শিদাবাদ থেকে, গন্তব্য সুদূর কলকাতার ফোর্ট উইলিয়াম।”

অ্যানার্কি
#চেনা_ইতিহাস_অচেনা_সুর  #5
“পোওইজ দুর্গে রাখা বাদশা শাহ আলম আর রবার্ট ক্লাইভের ছবিটা মোটেই যথার্থ নয়, বরং অনেক ভুল তথ্যে ভরা। চিত্রকর বেঞ্জামিন ওয়েস্ট কোনদিন  ভারতের মাটিতে পা রাখেননি। ছবিতে প্রথমেই যেটা চোখে লাগে, তা হল পটভূমিকায় আঁকা মসজিদের সাথে আমাদের সেন্ট পল ক্যাথিড্রালোর অদ্ভূত আকৃতিগত সাদৃশ্য।
বাস্তবে কোন আনুষ্ঠানিক জমায়েত হয়নি, ক্ষমতার হস্তান্তর হয়েছিল নিরালায়, নিভৃতে, লোকচক্ষুর অন্তরালে। এলাহাবাদে সদ্য বিজিত মুঘল দুর্গের এক প্রান্তে, ক্লাইভের তাঁবুতে মুখোমুখি বসেছিলেন পরাভূত সম্রাট আর বিজেতা ক্লাইভ। ছবিতে বাদশা শাহ আলমের জমকালো মখমলী সিংহাসন, আসলে ডাইনিং টেবলের সামনে টেনে আনা, ক্লাইভের হাতলওয়ালা চেয়ারের ওপর সামান্য সুতির ছিট চাদর।
ক্লাইভ নির্দেশ দিয়েছিল আর পরাস্ত,ভীত বাদশা শাহ আলম নীরবে মেনে নিয়েছিল সমস্ত শর্তাবলী- পরবর্তীকালে বৃটিশরা যার গালভরা নাম দিয়েছিল, এলাহাবাদের চুক্তি (১৭৬৫)। তৎকালীন মুঘল ঐতিহাসিক গুলাম হুসেন খাঁ লিখে গেছেন, “এত বড় একটা চুক্তির জন্য কতদিন আগে থেকে উত্তাল হয় মন্ত্রীসভা, দুপক্ষের মতামত আর সন্দেশ বয়ে দৌড়ায় বিচক্ষণ আর পরিপক্ক রাষ্ট্রদূতের দল, চলে দীর্ঘমেয়াদী দর কষাকষি- চাপানউতোর, তবে স্থির হয় প্রতিটি শর্ত। অথচ এই ক্ষেত্রে এত বড় চুক্তি হতে যা সময় লেগেছিল, তার থেকে বেশী সময় বোধহয় গরু-ছাগল কেনাবেচাতে ব্যয় হয়। ”

অ্যানার্কি
#চেনা_ইতিহাস_অচেনা_সুর #৬

“ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানি একদিকে পূবে চীনকে সরবরাহ করত আফিম, আবার চীনের চা নিয়ে গিয়ে বিক্রি করত সুদূর পশ্চিমে আমেরিকার ম্যাসাচুসেটস্ এ। বস্টন বন্দরে এই চা নামানোকে কেন্দ্র করেই শুরু হয়েছিল আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধ। আমেরিকান স্বদেশ প্রেমীদের মনে ভয় ছিল, যুদ্ধের সময়, আমেরিকানদের জব্দ করার জন্য, বৃটিশ সরকার বকলেস খুলে ছেড়ে দেবে ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানীকে। আর একবার যদি কোম্পানী জমিয়ে বসতে পারে, নির্বিচারে লুটতরাজ চালাবে ওদেশেও। বাংলার মতই জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দেবে আমেরিকাকে।

১৭৭৩এর নভেম্বরে, আমেরিকান নেতা জন ডিকচিনসন, বলেছিলেন, কোম্পানীর চা, “অভিশপ্ত আবর্জনা” বিশেষ, কোম্পানী যদি আমেরিকায় টিকে যায়, তাহলে এমন দুর্দিন ডেকে আনবে, কেউ বাঁচবে না। যত্রতত্র পচাগলা দেহ ইঁদুরে খুবলে খাবে। তিনি আরও বলেছিলেন, “শয়তানের প্রতিভূ এই দেউলিয়া কোম্পানী। নিপীড়ন আর অত্যাচারে বাংলাকে ছারখার করে এবার এদের লোলুপ দৃষ্টি পড়েছে আমেরিকার ওপর।"
অ্যানার্কি
#চেনা_ইতিহাস_অচেনা_সুর #৭

“ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানী, বৃটিশ সরকার প্রদত্ত প্রাতিষ্ঠানিক অনুমতি বা চার্টার পাবার দুমাসের মাথায়, ১৩ই ফেব্রুয়ারি, ১৬০১, উলউইচ থেকে যাত্রা শুরু করল নবরূপে সজ্জিত পোত “রেড ড্রাগন”। দোসর বলতে তিনটি অপেক্ষাকৃত ছোট জাহাজ- হেক্টর, সুজান আর অ্যাসেনশন। ফেব্রুয়ারির শীতে, কুয়াশাচ্ছন্ন টেমস নদীর বুকে পাল তুলে ভেসে তো পড়ল - কিন্তু ডেনভারের অদূরে টেমসের মোহনায় গিয়ে আটকে পড়ল নৌবহর। হঠাৎ করে স্তব্ধ হয়ে গেল বাতাস। অতঃপর বাতাসের মুখাপেক্ষী হয়ে, বসে থাকা ছাড়া কোন গতি রইল না।আর এই সুবাতাসের জন্য, এই নৌবহরকে অপেক্ষা করতে হয়েছিল পাক্কা দুমাস-।  , -”

অ্যানার্কি
#চেনা_ইতিহাস_অচেনা_সুর #৮

“ইস্টইণ্ডিয়া কোম্পানী প্রথম দিকে যাদের নিয়োগ করত, তাদের কথা যত কম বলা যায় ততোই ভালো। অধিকাংশই ছিল নিউগেট জেল থেকে ছাড়িয়ে আনা দাগী আসামী। কোম্পানীর প্রথম দিকের একটি চিঠিতে অনুযোগ করা হয়েছে, ‘এদের যাও বা আমরা কিছুটা বশে আনতে পেরেছি, কিন্তু এবার তো বেডলামের পাগলা গারদ থেকে লোক পাঠানো শুরু হয়েছে দেখছি- ।’ কোম্পিনীর এই কর্মচারীদের নামে নিত্য নালিশ আসত, ‘ভয়ঙ্কর দাঙ্গাবাজ, পাঁড় মাতাল আর তেমনি বেশ্যাসক্ত’।  এমনি একটি চিঠিতে তৎকালীন ডাইরেক্টরদের করুণ ভাবে অধুরোধ করা হয়েছে,‘অনুগ্রহ করে যদি কিছু ঠিকঠাক লোক পাঠান খুব ভালো হয়।  দায়িত্বজ্ঞানহীন, মাতাল আর লম্পটদের নিয়োগ না করাই ভালো।’"

অ্যানার্কি
#চেনা_ইতিহাস_অচেনা_সুর #৯
“২৮শে অগষ্ট, ১৬০৮, সুরাট বন্দরে এসে থামল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর জাহাজ হেক্টর, ভারতের মাটিতে পা রাখলেন কোম্পানীর প্রথম কম্যান্ডার উইলিয়াম হকিন্স। সেই সময় ভারতবর্ষের জনসংখ্যা ছিল ১৫ কোটি। সমগ্র পৃথিবীর জনসংখ্যার এক পঞ্চমাংশ মানুষ বসবাস করত এই দেশে। আর পৃথিবীর যাবতীয় উৎপাদনের এক চতুর্থাংশই উৎপাদিত হত এই দেশে।ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রাণকেন্দ্র ছিল ভারতবর্ষ। বিশেষতঃ বস্ত্রশিল্পে ভারত ছিল অপ্রতিদ্বন্দ্বী। ইংরাজি ভাষায় চিন্টজ্,শল, ক্যালিকো, পাজামা, খাকি, ডাংগ্রী, কমরবন্ধ, টাফেট্টার মত শব্দগুলি আজও তার সাক্ষ্য বহন করে।”

“তুলনায় ইংলণ্ডের জনসংখ্যা ছিল ভারতের পাঁচ শতাংশ মাত্র। বিশ্বের উৎপাদনের মাত্র তিন শতাংশ উৎপাদিত হত ইংলণ্ডে। ভারতীয় ব্যবসা বাণিজ্যের মুনাফার একটা বড় অংশ গিয়ে জমা হত মুঘলদের তোষাখানায়। যা থেকে বাদশাহের আয় হত প্রায় দশ কোটি পাউণ্ড। নিঃসন্দেহে ভারতসম্রাট ছিলেন বিশ্বের ধনীতম ব্যক্তি। বৈভবে-ঐশ্বর্যে মুঘলদের রাজধানী ছিল অতুলনীয়। জেস্যুইট পাদ্রী ফাদার অ্যান্টনিও মনট্সেরা লিখে গেছেন, ‘আয়তন, জনসংখ্যা আর ঐশ্বর্যের নিরিখে এশিয়া বা ইউরোপের কোন শহর এদের ধারেকাছে আসে না’। 

সপ্তদশ শতকের শুরু থেকে ইউরোপীয়রা অন্যান্য জনজাতিগুলিকে খুব সহজেই যুদ্ধে পরাস্ত করে আসছে। ১৫২০তে মাত্র এক মাসের মধ্যে অ্যাজটেক সম্রাটের বিশাল সৈন্যদলকে ছত্রভঙ্গ করে দেয় স্পেনীয়রা। মলাক্কা প্রণালীতেও, স্থানীয় শাসকদের দিকে কামান তাক করে ডাচরা। এতদিন যাদের সাথে ছিল ব্যবসায়িক সম্পর্ক, নির্বিবেক ভাবে তাদেরই আক্রমণ এবং হত্যা করে ডাচরা। ৪৭জন দলপতিকে নির্যাতন পূর্বক হত্যা করা হয়। কিছুদিন আগেও যে স্থানীয় অধিবাসীরা ক্যানো চড়ে হাসি মুখে এসে অভ্যর্থনা জানাত ভিনদেশী অতিথিদের, তাদেরই বন্দর জবরদখল করে, আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয় তাদের বসতিতে। নির্বিচারে চালানো হয় গণহত্যা।”

“কিন্তু মুঘল শাসনাধীন ভারত বর্ষে এই গোস্তাকি করার সাহস হয়নি কোন ইউরোপীয় শক্তির। ক্যাপ্টেন হকিন্স নেমেই বুঝতে পারেন, এখানে বেচাল হবার প্রশ্নই ওঠে না। মুঘল সম্রাটের ছিল ৪০লক্ষ সশস্ত্র সুপ্রশিক্ষিত সৈন্য। ১৬৩২এ যখন সুলতানের গোচরে আসে যে হুগলীতে পতুর্গীজরা বিনানুমতিতে দুর্গ বানাচ্ছে এবং বাদশাহের সুস্পষ্ট নিষেধ সত্ত্বেও তাঁর প্রজাদের জবরদস্তি খ্রীষ্টধর্মে ধর্মান্তরিত করছে, তিনি তৎক্ষণাৎ পর্তুগীজদের গড় ধ্বংস করে, তাদের সদলবলে উচ্ছেদ করার নির্দেশ দেন। কয়েকদিন নামমাত্র প্রতিরোধ করার পরই আত্মসমর্থন করতে বাধ্য হয় পর্তুগীজরা। যারা নদীপথে পালাবার চেষ্টা করে, নিঁখুত ভাবে তাদের নৌকা লক্ষ্য করে গর্জে ওঠে ভারতীয় কামান।ডুবে মারা যায় অনেকে। আর যারা বেঁচে যায়, তাদের বন্দী করে, সুলতানের করুণা ভিক্ষার জন্য পাঠানো হয় আগ্রা। এই প্রসঙ্গে পাদশাহনামায় লেখা আছে যে, “প্রায় ৪০০পর্তুগীজ কয়েদী, বিধর্মী মূর্তি সহ ধরা পড়ে। যারা ক্ষমা চাইতে অস্বীকার করে, তাদের ক্রীতদাস হিসেবে ভাগবাটোয়ারা করে দেওয়া হয় আমির-ওমরাহদের মধ্যে। অথবা দেওয়া হয় কারাদণ্ড, যেখানে নির্যাতন সইতে না পেরে অনেকেই পচে মরে।” গোয়ার পর্তুগীজ গভর্নর সমস্ত ঘটনাবলী নীরবে প্রত্যক্ষ করা ছাড়া কিছুই করতে পারেননি। ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানী প্রথম থেকেই বুঝেছিল,যে এদেশে টিকে থাকতে হলে সম্রাটের সাথে সুসম্পর্ক স্থাপন একান্ত জরুরী।”

অ্যানার্কি 
#চেনা_ইতিহাস_অচেনা_সুর #১০

"সুরাট থেকে ক্যাপ্টেন হকিন্সের আগ্রা পৌঁছতে লেগে যায় এক বছর। আফগান আমিরের ছদ্মবেশে আগ্রায় প্রবেশ করে, স্বল্প সময়ের জন্য সুলতানের দর্শন পান তিনি। সুলতানের সঙ্গে তুর্কী ভাষায় বাক্যালাপও করেন, তবে তাতে বিশেষ সুবিধা হয়নি। অর্ধশিক্ষিত ফিরিঙ্গী নাবিককে ছিটেফোঁটাও গুরুত্ব দেননি বাহশাহ জাহাঙ্গীর। খালি হাতে ফিরতে হয় ক্যাপ্টেন হকিন্সকে, এক আর্মেনিয়ান মহিলাকে ঘরণী করে ঘরে ফিরে যান তিনি। 
প্রথম অভিযানের ব্যর্থতায় হতোদ্যম না হয়ে, কোম্পানী স্যার হেনরি মিডলটনের নেতৃত্বে আরেকটি নৌবহর পাঠায় ভারতে। কিন্তু এই নৌবহরের যাত্রীদের আর ভারতের মাটিতে পা রাখার সৌভাগ্য হয়নি। সুরাট বন্দরে নোঙর করার আগেই, স্থানীয় পর্তুগীজ ব্যবসায়ীদের বিক্ষোভের চোটে, বন্দর কর্তৃপক্ষ সুভালি থেকে তাদের ফেরৎ পাঠান। 
পরপর দুটি অভিযান ব্যর্থ হওয়ার পর, তৃতীয় অভিযানের পূর্বে তৎকালীন ইংলন্ডেশ্বর রাজা জেমসের শরণাপন্ন  হয় কোম্পানী। কোম্পানীর অনুরোধে, রাজপরিষদের অন্যতম সদস্য, এমপি তথা দক্ষ কূটনীতিবিদ স্যার টমাস রো’কে রাজদূত হিসেবে ভারতে পাঠানো হয় দৌত্য করার জন্য। ইতিপূর্বে অ্যামাজন অভিযান ছাড়াও কিছুদিনের জন্য  কনস্ট্যান্টিনোপলে ইংলণ্ডের রাজদূত ছিলেন স্যার টমাস রো। 
১৬১৫খ্রীষ্টাব্দে আজমীরে পৌঁছান স্যার রো, সঙ্গে  উপঢৌকন হিসেবে নিয়ে আসেন ইংলিশ ম্যাস্টিফ এবং আইরিশ গ্রে হাউন্ডের মত শিকারী কুকুর, রাজকীয় ইংলিশ কোচ, বিলাতী বাদ্যযন্ত্র, কিছু বিখ্যাত ম্যানারিস্ট পেন্টিং আর অনেকগুলি ক্রেট ভর্তি রেড ওয়াইন। সুরার প্রতি জাহাঙ্গীরের দুর্বলতা তাঁর অজ্ঞাত ছিল না। 
ব্যক্তি হিসেবে বাদশাহ জাহাঙ্গীর ছিলেন অত্যন্ত বুদ্ধিমান, বিচক্ষণ এবং সংবেদনশীল। বংশগরিমা সম্পর্কে অতিসচেতনতা সত্ত্বেও অন্যান্য দেশ এবং সেখানকার জীবনধারা সম্পর্কে তাঁর ছিল অপরিসীম ঔৎসুক্য। দেশবিদেশের মূল্যবান সম্পদ সংগ্রহ করার নেশা ছিল তাঁর। ভেনিশিয়ান সোর্ড থেকে পারস্যের স্যাফাভিড রেশম, জেড পাথরের নুড়ি থেকে নারওয়াল তিমির দাঁত কি না ছিল, তাঁর সংগ্রহে। জীবজন্তুর কৃত্রিম প্রজননএবং প্রতিপালনে বেশ উৎসাহী ছিলেন জাহাঙ্গীর। উৎসাহী ছিলেন চিকিৎসা শাস্ত্র এবং জ্যোতির্বিদ্যায়ও। উৎসাহ ছিল না কেবল ব্যবসাবাণিজ্যে। 
বেশ কয়েকমাস ধরে চলা আলাপচারিতার ফাঁকে ফাঁকে স্যার রো যতবার কথা ঘোরাবার চেষ্টা করতেন বাণিজ্য, কূটনীতি, ফরমান বা সুরাটে ইংলিশ ফ্যাক্টরী স্থাপনের অনুমতি বা ভারতে ইংলিশ বণিকদের সুরক্ষা তথা ইংলণ্ডের সাথে সৌহার্দ্যপূর্ণ বাণিজ্যিক সম্পর্কের দিকে, ততোবারই ‘ওসব কেজো কথা পরে হবে’, বলে থামিয়ে দিতেন বাদশাহ। উল্টে বরং তিনি প্রশ্ন জুড়তেন ভারত থেকে ইংলণ্ডের দূরত্ব কত, জানতে চাইতেন সেই কুয়াশা ঢাকা ছোট্ট দ্বীপের কথা, যেখান থেকে এসেছেন স্যার রো। সেখানকার জীবনশৈলী, শিল্প-কৃষ্টি- সংস্কৃতি।”

“ক্ষেত্র বিশেষে বেশ কড়া সুরে মুঘল আমলের সমালোচনা করেছেন স্যার রো, লিখে গেছেন, ‘ধর্ম অনেক, কিন্তু আইনকানুন শূন্য।’ এতদসত্ত্বেও ভারতের ঐশ্বর্য আর বৈভবে বারংবার ধাঁধিয়ে গেছে তাঁর চোখ। ১৬১৬ সালে বাদশাহের জন্মদিনের উৎসবে উপস্থিত থাকার সৌভাগ্য হয়েছিল তাঁর, মাণ্ডু থেকে তৎকালীন যুবরাজ(পরবর্তী রাজা) প্রথম চার্লসকে লেখা পত্রের ছত্রে ছত্রে ফুটে উঠেছে ভারতের অবিশ্বাস্য বৈভবের ছবি।
জন্মদিনের মূল উৎসবটা হয়েছিল এক অপরূপ সুন্দর বাগিচায়। জলের মাঝে বিশাল চৌকনা বাগান। বাগানের চতুর্দিকে ঘন সবুজ গাছপালা, গাছে গাছে ফুটে আছে রঙবেরঙের ফুল। বাগানের মাঝখানে একটা উঁচু বেদীর ওপর রাখা সোনার তুলাযন্ত্র। যাতে রাখা হবে সম্রাটের সমান ওজনের মণিমুক্তা। ‘বেদীকে ঘিরে পেতে রাখা কার্পেটে বসে সম্রাটের প্রতীক্ষা করছিলেন সব আমির ওমরাহরা। অবশেষে এলেন সুলতান। সুলতান আদৌ পোশাক পরেছেন নাকি শুধুই হীরা-চুনি-পান্না আর মুক্তায় ঢেকে নিয়েছেন নিজেকে বুঝতে পারলাম না।অলংকারের দ্যুতিতে ধাঁধিয়ে গেল চোখ। ওণার মাথা, গলা,বুক, কনুই অবধি বাহু, কব্জি থেকে হাতের আঙুল সবই অলঙ্কারে ঢাকা। প্রতিটি আঙুলে কম করে দুই থেকে তিনটি রত্নাঙ্গুরীয়। এত বড় হীরে, চুনি বা মুক্তা সচরাচর দেখা যায় না। চুনীগুলি আকারে আখরোট বা তার থেকেও বড় আর মুক্তাগুলি প্রায় আমার চোখের সমান। সারা বিশ্বের সমস্ত মণিমুক্তা যেন এসে জমা হয়েছে ওণার রত্নভাণ্ডারে।’ 
মুঘলদের অন্যদিকে ইংলন্ড সম্পর্কে সামান্য কৌতুহল ছাড়া কোন মুগ্ধতা ছিল না। স্যার রো বুঝতে সময় লাগেনি যে ইংলন্ডের সাথে কোন রকম সম্পর্ক স্থাপনে ছিটেফোঁটাও উৎসাহ নেই মুঘলদের। রাজদূত হিসেবে মোটেই তেমন খাতিরযত্ন পাননি তিনি, সপার্ষদ রাজদূতকে থাকার জন্য কারবাঁ সরাইতে বরাদ্ধ হয় মাত্রই চারটে কামরা। স্যার রো তাঁর পত্রে লিখেছেন, ঘরগুলির আয়তন, ‘কোনমতেই আভেনের থেকে বড় নয়। ঘরের ছাতটা গোলাকার, দরজা না খুলে রাখলে কোন আলো ঢোকে না। মাত্র দুটো জুড়িগাড়ির মাল ঢোকাতেই সব ঘর ভর্তি হয়ে যায়।’” 

“তিন বছর সময় লাগে, শেষ পর্যন্ত অবশ্য বাদশাহের ফরমান নিয়েই দেশে ফিরে যান স্যার টমাস রো।”

অ্যানার্কি
#চেনা_ইতিহাস_অচেনা_সুর #১১
“ভারতে ইংরেজদের প্রথম ঔপনিবেশিক শহর, মাদ্রাজ। সপ্তদশ শতকের মধ্যভাগে গড়ে ওঠা এই শহরের জনসংখ্যা ছিল প্রায় চল্লিশ হাজার,ছিল নিজস্ব প্রশাসন ব্যবস্থা, পৌরসভা। এমনকি ছিল নিজস্ব স্বর্ণমুদ্রাও।”
“ভারতে কোম্পানীর দ্বিতীয় বড় উপনিবেশটি পর্তুগালের রাজপরিবারের তরফ থেকে বিবাহসূত্রে যৌতুক হিসেবে পাওয়া। ১৬৬১খ্রীঃ পর্তুগালের রাজকন্যা ক্যাথরিন ব্রাগাঞ্জা, ইংলণ্ডের রাজা দ্বিতীয় চার্লসের ঘরণী হিসেবে আসার সময় যৌতুক হিসেবে নিয়ে আসেন  মরক্কোর ট্যানজিয়ার বন্দর আর “Islands of Bumbye”। রাজকন্যার বিয়ের কনট্র্যাক্টের সাথে যে ম্যাপে এই Islands of Bumbye এর অবস্থান নির্দেশিত ছিল, তা পর্তুগাল থেকে লণ্ডন আসার পথে কোনভাবে হারিয়ে যায়, ফলে Bumbye কোথায়, এই নিয়ে ইংলণ্ডে তৈরী হয় ব্যাপক ধোঁয়াশা। অনেকের ধারণা হয়  Bumbye নির্ঘাত ব্রাজিলের কাছাকাছি কোন অজানা দ্বীপ। 
এই জট কাটতে লেগে যায় বেশ কিছুদিন, তারপরও দ্বীপের দখল পেতে লাগে আরো অনেকদিন। বম্বের পর্তুগীজ গর্ভনর দ্বীপ হস্তান্তরের কোন নির্দেশ পাননি, ফলে স্বাভাবিক ভাবেই দ্বীপের নিয়ন্ত্রণ ছাড়তে রাজি হননি। ১৬৬২খ্রীঃ যখন স্যার আব্রাহাম শিপম্যান সদলবলে গিয়ে উপস্থিত হন দ্বীপের দখল নিতে, বন্দুকের ডগায় তাদের হটিয়ে দেওয়া হয়। ৪৫০লোক নিয়ে স্যার শিপম্যান নোঙর করতে বাধ্য হন,সুদূর দক্ষিণের এক ঊষর দ্বীপে। দ্বীপের দখল পেতে ইংলণ্ডের লেগে যায় আরও তিনবছর, ততোদিনে অবশ্য তীব্র গরম আর হিটস্ট্রোকে মারা গেছেন স্যার শিপম্যান। কেবল একজন ছাড়া মারা গেছে তাঁর সমস্ত অফিসার। ১৬৬৫ খ্রীষ্টাব্দে, দ্বীপের দখল নেবার জন্য শিপম্যানের সেক্রেটারি যখন বম্বেতে পদার্পণ করে, তার সঙ্গী বলতে অবশিষ্ট ছিল কেবল ১জন পতাকাধারী, দুজন গোলান্দাজ সেপাই আর ১১১ জন অধঃস্তন কর্মচারী। 
শুরুটা গোলমেলে হলেও অবিশ্বাস্য দ্রুততায় দক্ষিণ এশিয়ার সেরা বন্দর হিসেবে গড়ে ওঠে বম্বে। অচীরেই সুরাটকে পিছনে ফেলে এশিয়ায় কোম্পানীর সবথেকে বড় ঘাঁটি হয়ে ওঠে বম্বে। সুরাটের জনগন অবশ্য ততোদিনে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে উচ্ছৃঙ্খল ইংরেজদের অত্যাচারে। কোম্পানী জনৈক কর্মচারীর  লেখা থেকে জানা যায়, “সুরাটের মানুষ ইংরেজদের ওপর বীতশ্রদ্ধ। আমাদের দেখলে মুখ ফিরিয়ে নেয়, রাস্তাঘাটে আমাদের দেখলে গালিগালাজ করে। আর এর জন্য দায়ী, আমাদেরই অপরিসীম বেশ্যাপ্রীতি,মাতলামো আর দাঙ্গাবাজী।এরা পয়সা দিয়ে খাস বেশ্যা পোষে, তারপরও সময়-অসময়ে বেশ্যালয় আর সুঁড়িখানায় গিয়ে হল্লা আর ভাঙচুর করে বেড়ায়-। সুরাটের লোকজন রাস্তাঘাটে ইংরেজ দেখলেই Ban-chude- আর Betty-chude- বলে খিস্তি মারে।' ”

Sunday 17 May 2020

অনির ডাইরি ১৭ই মে, ২০২০



ছাতের প্রিয় কোণাটায় আজকাল আর দাঁড়াতে ইচ্ছে করে না। সব একই আছে, তারা জ্বলজ্বল রাতের আকাশী চঁদোয়া, নিয়ন আলোয় ধোয়া রাজপথ, সারি সারি উদ্ধত বহুতল, ফুটপাত জুড়ে ঝাঁকড়া মাথা দোলানো মহীরুহের সারি, ঝপাং করে নেমে আসা ফ্লাইওভার,নেই শুধু প্রাণ। লকডাউনের প্রথম দিকে শহরের ব্যস্ততম রাজপথের এই অচেনা ঝিমানো  রূপ বেশ প্রশান্তি জাগাত। আজকাল ভয় ধরে, কোন অদৃশ্য যাদুকরের যাদুকাঠির ছোঁয়ায় বুঝি ঘুমিয়ে পড়েছে প্রিয় শহরটা-

আজকাল একটা নতুন খেলা আবিষ্কার করেছি, বাসন মাজার আগে গুনেনি কটা বাসন আছে, তারপর কল্পনা করি প্রতিটা থালা-বাটি-গ্লাস-চামচ আসলে একএকটা দশক বা শতক। যেমন ধরুন রাতে বাসন একটু কম পড়ে, রাতের গুলো শতক। আর দিনের গুলো দশক। এবার মনে করার চেষ্টা করি ঐ দশক বা শতকে কি ঘটেছিল। আশির দশকে বিশ্বকাপ জিতেছিল ভারত। গ্লাসনস্ত আর পেরেস্ত্রৈকা। আগুনে সত্তর আর দেশজোড়া জরুরী অবস্থা। চল্লিশের বিশ্বযুদ্ধ আর হলোকাস্ট এই ভাবে পিছিয়ে যেতে যেতে হারিয়ে যাওয়া সময়ের অলিন্দে কখনও মোলাকাৎ হয়ে যায় কানা বাদশা শাহ আলমের সাথে তো কখনও সাক্ষৎ হয় পূষ্যভূতির বংশীয় সম্রাট হর্ষবর্ধনের সাথে। এভাবেই কখন যেন মাজা হয়ে যায় বাসনগুলো। কাজের মাসিদের বোধহয় আর এজন্মে প্রবেশাধিকার দেবে না এই আবাসন!

অতিমারীর হাত থেকে বাঁচা অসম্ভব, বেশ বুঝতে পারি। অল্পক্ষণ মাস্ক পরলেই, বন্ধ হয়ে আসে দম, ইলাস্টিক স্ট্রাপে কানের পিছনে উঠে যায় ছাল। প্রতি আড়াই মিনিটে একবার করে ঠিক করতে হয় মাস্ক। এদিকে পাড়াতেই ধরা পড়েছে করোনা রোগী। জনৈক পাড়াতুতো পিসি, কি ভাবে ধরালো রোগটা কে জানে?  ফোনের ওপার থেকে সাবধান বাণী আওড়ে চলে বাবা,“এখন একদম এ পাড়ায় আসবি না।” শুনলাম ওণাদের বাড়ির সকলে আপাততঃ গৃহবন্দী, মাঠে আড্ডা মারতে বসা ছেলেছোকরার দলকেও হঠিয়ে দিয়েছে পুলিশ। আপিস যাবার পথে একবার ঢুঁ মারা বিশেষ দরকার। হপ্তা ঘুরে গেল মাসকাবারীর লিস্টে পাঠিয়েছে বাবা, সুখের দিনের বন্ধু বিগ বাস্কেট, যার জন্য পরিত্যাগ করেছিলাম পাড়ার মুদির দোকান,পাত্তাই দিল না। যখনই খুলি, একই বুলি ফাঁকা স্লট নাই। কারা যে এত স্লট বুক করেছে কে জানে? অগত্যা মাথা নীচু করে পাড়ার দোকানেই লাইন দেওয়া-। যা ডানপিঠে বুড়ো, নাহলে নির্ঘাত নিজেই বেরিয়ে পড়বে ঝোলা নিয়ে। আপিস যাবার পথে পলকের জন্য থামা, বাপি বলে, “আপনাদের এই গলিতে কি আদৌ কেউ লকডাউন মানছে ম্যাডাম?” স্থানীয় দোকানগুলিতে বেশ ভিড়। সৎসঙ্গের সামনে সব্জি নিয়ে বসেছে চেনা ছেলেপিলের দল। ছোট্টবেলার খেলার সঙ্গী সব, মাস্ক পরা সত্ত্বেও দিব্যি চিনতে পারে। একসাথেই বলে উঠি উভয়ে,“কি রে? কেমন আছিস? সাবধানে থাকিস। ”  চৌকাঠ ডিঙিয়ে মাটিতে মালপত্র ঢেলে, ঘন্টা দুয়েকের আগে হাত দিতে নিষেধ করি। আনারসের জ্যাম চেয়েছিল বাবা, মেলেনি দোকানে। মেলেনি ব্লিচিং পাউডারও। জনৈক বয়স্ক কাকু এসেছিলেন পিটা ব্রেড কিনতে, পিৎজা  বানাবেন গিন্নি আর কন্যার আব্দার বিশেষ ব্রাণ্ডের শাওয়ার জেল - নাঃ মেলেনি সেসবও।

আগের তুলনায় আজকাল রাস্তায় ভিড় একটু বেশী।আপিস টাইমেও দিল্লী রোডে সার দিয়ে যাতয়াত করে মালবোঝাই ট্রাকের দল। রোদের তেজ বড়ই বেশী। তবুও গাড়ির কাঁচগুলো নামিয়ে দিতে বলি, আঁতকে ওঠে বাপি, “আপনাদের এখানে গিজগিজ করছে করোণা। কাঁচ নামালেই ঢুকে পড়বে। ” আমাকে নিতে আসার আগে, গাড়িটা স্যানিটাইজার দিয়ে মুছে আনে বাপি। শুধু স্যারের ভয়ে চাবিটা বোধহয় মোছে না।
লকডাউনের বাজারেও সুজয় বাবুর চায়ের দোকান বন্ধ হয়নি। দোকান থোড়াই, কালেক্টরের কোন অচেনা বারান্দায় জনতা স্টোভে জল ফুটিয়ে চা বানায় সুজয়। সাথে বাদাম দেওয়া বিস্কুট। জিরে-কালো জিরে দেওয়া বিস্কুটও থাকে, তবে ওগুলো দেখলে আমার মটকা গরম হয়ে যায় বলে আমার ঘরে আনে না।  এগারোটা নাগাদ একবার দুধ কফি দিয়ে যায়। তারপর ঘন্টায় ঘন্টায় কালো চা। এলেই গপ্প শোনায়, আমাদের গাছ গুলোতে নাকি ও রোজ জল দেয়। প্রত্যেকের নামে একটা করে গাছ লাগিয়েছিলাম আমরা। নিজেরাই জল দিতাম। যত্ন করতাম। লকডাউনের বাজারেও দিব্যি আছে গাছগুলো। বিদ্যুতের জবা গাছে এত বড় কমলা জবা ধরেছে। প্রীতির হাজারি গোলাপ গাছে কুচি কুচি গোলাপী ফুল। ভালো আছে কৌশিকের পাম আর নির্মলের পাতাবাহারও। কি যেন একটা বেগুনী গাছ, এক চুপড়ি এনে রেখে গেছে রমেশ। ওটা ফাঁকা বাতিল র্্যাকে লাগাবে। গাছগুলো ভালো আছে, তবে মোটেই সুজয় বাবুর জন্য নয়। আমি জানি কে যত্ন নেয় আমাদের গাছগুলোর-

সম্পর্কে তিনি আমাদের কেউ না, জেলাশাসকের প্রাক্তণ সাফাইকর্মী। সাফাই করার সূত্রেই আমাদের সাথে আলাপ। শুধু সাফাই না, রোজ সকালে আপিস খোলেন তিনি, সন্ধ্যা গাঢ় হলে তালাও মারেন তিনি। অবসর নেবার পর ঘুরে গেছে বছর, না তিনি আমাদের ছাড়তে পারেন না আমরা তাঁকে। তিনি আমাদের সর্বজনপ্রিয় অজিত দা। 

জানেন কি, দীর্ঘ ৩৪-৩৫বছরের কর্মজীবনে মাত্র চারদিন ছুটি নিয়েছিলেন অজিত দা। দুদিন নিজের বিয়ের জন্য আর বাকি দুই দিন দুই মেয়ের বিয়েতে। এখনও এই বৃদ্ধের কর্মতৎপরতা তথা সক্ষমতা লজ্জা দেয় আমাদের। আপিসে মালপত্র এলে একাই নীচে থেকে তুলে আনেন অজিতদা। মেলার আগে যখন আপিস গুটিয়ে মাঠে যাবার সময় আসে, কাগজপত্র, ফাইল-দস্তাবেজ, ট্রফি-স্মারক, উত্তরীয়-ব্যাজ থেকে কম্পুটর দুহাতে আর মাথায় করে মালপত্র বয়ে গাড়িতে তোলে অজিত দা। শুভজিৎ, সোমনাথ, রমেশ আর বিদ্যুতের একটা বাক্স নিয়ে যেতে যেতে তিনবার ওপরনীচ করে ফেলে অজিতদা। আমাদের সর্বঘটে কাঁঠালি কলা অজিত দা। সেদিন থার্মাল গান কেনার কথা হচ্ছিল, নির্মল প্রশ্ন তুলল চালাবে কে? রমেশ আর আমার মুখ থেকে একসাথে বের হল কেন অজিত দা? স্যার শুনে আঁতকে উঠেছিলেন, আরেঃ ওণারই তো আক্রান্ত হবার সম্ভবনা সবথেকে বেশী।
সেদিন নালিশ জানাতে এসেছিলেন অজিত দা, ম্যাডামের কাছে মাঝেমধ্যেই না না নালিশ তথা আব্দার জানায় অজিতদা। সেদিন অনুযোগ করছিলেন, “একটা টিপিনও দিল না ম্যাডাম। প্রচেষ্টার ফর্ম জমা নিচ্ছিলুম আমরা। কত লোক। কি বিশাল লাইন। বেলা তিনটে অবধি আমরা পাঁচজন রইলুম, ওরা প্রচেষ্টার নাম করেই টিপিন আনল আমাদের দিল না। আমি চাইতে গেলুম। তাও দিল না।” ওরা মানে পাশেই জেলা প্রশাসনের জনৈক হোমরাচোমরা আধিকারিকের দপ্তর। আধিকারিক অত্যন্ত বিনয়ী, সহৃদয় এবং ভালোমানুষ। কিন্তু তাঁর দপ্তরে যারা আছেন, তাঁরা রীতিমত নমস্য। স্পষ্ট মনে আছে, বিগত সংসদীয়  নির্বাচনের পরদিন রণিত বলেছিল, “সারা দিন খেতে পাইনি ম্যাডাম। সব দোকানপাট বন্ধ। ঐ আপিসে গাদা গাদা প্যাকেট এল বটে। একটাও -”। রণিত, শুভজিৎ আর বর্মন সাহেব তো লজ্জার মাথা খেয়ে চাইতে পারেনি সেদিন, কিন্তু অজিত দা চেয়েছিল। তাও পায়নি। তাই ম্যাডামকে পেয়েই উগরে দিয়েছে মনের দুঃখ।  ভালোবাসে বলেই তো আব্দার জানায়। ম্যাডামও ভালোবাসে অজিতদাকে। কিন্তু আপাততঃ বড়ই অসহায়। চেনা দোকাপাট সব বন্ধ। তবে নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন অজিত দা, উঠুক লকডাউনট। খুলুক দোকানপাট। সুদ সমেত খাওয়াতে হবে পাঁচজনকে-। আপাততঃ চলুন দেখি, কেমনি পোজ দিতে পারেন, গাছগুলোর সঙ্গে আপনার একখান ছবি তুলি, ওরা বেঁচে আছে তো শুধু আপনারই জন্য। আপনার মত মানুষজন এখনও আছে বলেই বোধহয় কোথাও বোধহয় বজায় আছে ভারসাম্য। 

Sunday 10 May 2020

অনির ডাইরি, ১০ই মে, ২০২০

#Happy_Mothers_Day
মেয়েটি মুখচেনা। এমনিতে মুখ চোরা, তবে শুনতে পাই, রাজনৈতিক ভাবে বেশ সক্রিয়। ঝাণ্ডা নিয়ে মিছিলে হাঁটা পাবলিক। মাঝে মাঝে কাজ নিয়ে আসে আমাদের আপিসে, লোক নিয়ে আসে আমাদের মেলায়। ঝকমকে একটা গোলাপী শাড়ি পরে এসেছিল এবারের মেলায়- থিমই তো ছিল গোলাপী।
দিন কয়েক আগে হঠাৎ ফোন, “ম্যাডাম, বড় আশা নিয়ে আপনাকে ফোন করেছি, নিরাশ করবেন না। ” কথাটা এই কদিনে অগণিত বার শুনেছি, বহু বহু যোজন দূর থেকে ফোন করে চলেছে মানুষজন, “বাড়ি ফিরতে চাই, একটু সাহায্য করুন। ” যে কোন সরকারী ওয়েবসাইট থেকে যারই নম্বর পাচ্ছে ফোন করছে ওরা। অন্য জেলা হলে, সেই জেলার শ্রম কমিশনারদের নম্বর বিলিয়ে দি অকাতরে। মনে মনে মার্জনা চেয়েনি, বিনা অনুমতিতে নম্বর দিয়েছি বলে-।   আর আমার জেলা হলে, চেয়েনি বিশদ বিবরণ, কতজন আছেন, কোথায় আছেন, কোথায় যাবেন-। অতঃপর অতিরিক্ত জেলাশাসকের হাত ঘুরে, জেলাশাসক হয়ে তা চলে যায় নবান্ন।
বুঝলাম মেয়েটিরও ওমনি সহায়তা প্রয়োজন। ঠিকই বুঝেছি, মেয়েটি জানাল ওর স্বামী সহ বারো জন আটকে আছে সুদূর দাক্ষিণাত্যের কোন বড় শহরে। যেখানে থেকে ভেসে আসে বিরিয়ানির সৌরভ আর মুক্তার দ্যুতি। এ আর এমন কি ব্যাপার, গড়গড় করে বলেদিলাম, কি কি তথ্য পাঠাতে হবে আমায়। মেয়েটি সলাজে জানাল, না ঠিক এই সহায়তা ও চায় না। সরকারী ব্যবস্থা কবে কার্যকর হবে,কবে পৌঁছাবে ট্রেন (মনে রাখবেন বেশ কয়েকদিন আগের গল্প, তখনও দৌড়য়নি পরিযায়ী ট্রেন) ওরা আর ধৈর্য্য রাখতে অপারগ। রমজান মাস, সামনেই বাঙালীর মুসলিমদের সবথেকে বড় উৎসব, তার আগেই ঘরের লোক ফিরে আসুক ঘরে,এটাই মনপ্রাণে চায় মেয়েটি। তাই ওরা ঠিক করেছে একটা গাড়ি। বারো সিটের গাড়ি, মূল্য ধার্য হয়েছে আশি হাজার টাকা। বিষম খেলাম, বলতে গেলাম, এত টাকা? কিন্তু কেন? এতদিন ধৈর্য্য ধরলে আর কটা দিন সবুর করো না বাপু। বলতে পারলাম না। খালি মনে হল, দুর্গা পুজোর সময় যদি আমার ঘরের মানুষ আটকে থাকত এমন করে, কি করতাম আমি? মেয়েটি তো অনেক শক্ত আমার থেকে-।  একটা পাশ চায় মেয়েটা। ওদিক থেকে বেরিয়ে গেছে পাশ, এদিকেরটা পেলেই ছেড়ে যাবে গাড়ি।
বলার সময় বললাম, এ আর এমন কি কথা, কার্যক্ষেত্রে দেখলাম ব্যাপারখানা বেশ দুরূহ। কে দেবে পাশ, এটা নিয়েই লেগে গেল গোটা তিনেক ফোন। যে বড় সাহেবকে রাত তিনটেতেও মেসেজ করে বিপর্যস্ত শ্রমিকদের বিবরণ পাঠিয়েছি আমি, উনি এটা দেখেন না। যিনি দেখেন, উনি অত্যন্ত দায়সারা ভাবে জানালেন, ওসব পাশটাস দেওয়া যাবে না। “স্নেহের পরশ”এ আবেদন করুক ওরা। স্নেহের পরশ নামটার সাথে হয়তো অনেকেই পরিচিত, বিদেশে আটকে পড়া শ্রমিকদের ন্যূনতম হাজার টাকা আর্থিক সহায়তা- এটা ইতিমধ্যেই পেয়ে গেছে ওরা। বলতে গিয়ে দেখি, কেটে গেছে ফোন।
তুলনায় সংবেদনশীল অন্য এক কর্তাব্যক্তি জানালেন, এভাবে আন্তঃরাজ্য পাশ দেওয়াতে নানা প্রশাসনিক জটিলতা আছে, বরং পোর্টালে আবেদন করুক ওরা, সময় হলে সরকারী ট্রেনে জায়গা পেয়ে যাবে, আর যদি সবুর করতে না পারে তাহলে, যদি ওদিক থেকে কোন গাড়ি যোগাড় করে আসে, তাহলে কোন সমস্যা থাকে না। সেক্ষেত্রে দায়িত্ব ঐ রাজ্যের-। প্রয়োজনীয় লিঙ্ক, হেল্পলাইন নম্বরও পাঠিয়ে দিলেন উনি।

তাই জানালাম মেয়েটাকে। ওদিকে থেকে ভেসে আসা জবাব বুঝিয়ে দিল যতটা ঘেঁটে আছি আমি,ততোটাই ঘেঁটে আছে মেয়েটা। পরদিন ভোরবেলা ফোন, “সারা দিন- রাত চেষ্টা করেছি ম্যাডাম। চারজন, চার জয়গা থেকে চেষ্টা করেছি, পারিনি ম্যাডাম”। শয়ে-শয়ে, হাজারে-হাজারে মানুষ আবেদন করে চলেছে পোর্টালে, সুযোগ পাওয়া এত সহজ না। তাহলে কি হবে? ওদিক থেকে গাড়ি করবে কি? সেখানেও সমস্যা, তিন থেকে চারজনের জন্য গাড়ির অনুমোদন পাওয়া যেতে পারে, তাতে অবশ্যই খরচটা আর বহনযোগ্য থাকছে না। কি করা যায়? আপাত অসহায়তা লুকিয়ে মেয়েটাকে বললাম, ভেঙে না পড়ে, পোর্টালে চেষ্টা চালিয়ে যেতে, আর ওদিকে ওর বরও যেন চেষ্টা চালিয়ে যায়- সে দিন বুদ্ধপূর্ণিমা।

বড় সাহেব ফোন করেছিলেন অন্য কোন কাজের দরকারে, জানালাম, কাজে একদম মন নেই, খুব মন খারাপ মেয়েটার জন্য। স্যার বললেন, “মন্ত্রীমশাইকে ফোন করেছ?” নাঃ মন্ত্রীমশাইকে ফোন করার কথা মাথাতে আসেনি। হুগলী সদরের মাননীয় পূর্ণমন্ত্রী, অত্যন্ত অমায়িক ব্যবহার। এবছর মেলার আগের রাতে, জনৈক মস্তান যে হুজ্জতি বাঁধিয়েছিল, মন্ত্রীমশাইয়ের প্রত্যক্ষ সহায়তা ছাড়া তাকে জব্দ করতে পারতাম না। ফোন করা মাত্র সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিলেন উনি, জানালেন এখুনি নিজের প্যাডে চিঠি করে দেবেন-। লোকগুলির ঠিকুজি পাঠাতে পাঠাতে মেয়েটিকে বললাম, এখুনি দৌড়ও। প্রখর রোদে সাইকেল নিয়ে দৌড়ে গেল মেয়েটা।
মন্ত্রীমশাই চিঠি করে পাঠিয়েও দিলেন জেলাশাসককে, তিনি পাঠাবেন নবান্ন। ট্রেন চালু হলেই সর্বাগ্রে ফেরার ব্যবস্থা হবে ওদের।
তাহলে ব্যাপারটা হল ঘুরে ফিরে আবার প্যাভিলিয়নে ফিরে এলাম আমরা। মেয়েটিও বলল, “তাহলে তাই হোক ম্যাডাম। কটা দিন পরেই ফিরুক। ” আমারও মনে হল, আর কিই বা করা যেত, অন্তত নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের এতগুলো টাকা তো বেঁচে যাবে।
বিকালে ফোন করল মেয়েটা, “ম্যাডাম ওরা ওখান থেকে পাশ পেয়ে গেছে। তবে গাড়ি না, বাসে আসতে হবে। খরচটা একটু বেশীই পড়ছে। কি আর করা যাবে। সীমান্তে না কোন ঝঞ্ঝাট হয়, একটু দেখবেন ম্যাডাম। ” জানালাম পাশটার ছবি তুলে পাঠাতে, আর জানতে চাইলাম কত পড়ছে, উত্তর এল, “এক লাখ টাকা। ” প্রায় পড়ে যাচ্ছিলাম, এত টাকা! বাসে তো কম হবার কথা? জবাব পেল, “সব সঞ্চয় শেষ ম্যাডাম। ঘরের লোকটা ঘরে ফিরে আসুক। আর এটা এমনি বাস নয়কো, স্পেশাল বাস-দূরত্ব রেখে বসে আসতে হবে তো”। কিছু বলার নেই, মেয়েটির জায়গায় আমি থাকলেও এটাই করতাম। উৎসবের দিন ঘরের মানুষ ঘরে ফিরে আসুক।
পরশু গভীর রাতে ছাড়ল বাস। জেলা প্রশাসনের বড় কর্তাকে সব তথ্য পাঠিয়ে রাখলাম, উনিও আশ্বস্ত করলেন কোন সমস্যা হবে না। গতকাল আবার ফোন মেয়েটির, “ম্যাডাম তিনজনের পাশ বেরিয়ে গেছে, পোর্টাল থেকে। কি হবে ম্যাডাম?” মন্ত্রীজী কথা রেখেছেন। এক ধাক্কায় বারো জনের না হলেও খেপে-  খেপে বেরোতে শুরু করেছে। এই রেঃ, ওরা যে বাসে করে বেরিয়ে পড়েছে এটা তো ওণাকে জানানো হয়নি।“ কি হবে ম্যাডাম?” কাঁদোকাঁদো সুরে জানতে চাইল মেয়েটা। গলায় ছদ্ম সাহস এনে বললাম, কি আবার হবে? শ্রমিকরা অপেক্ষা করে থাকতে পারেনি, ধারধোর করে ঘটিবাটি বেচে রওণা দিয়েছে। এতে দোষের কি অ্যাঁ? চুপচাপ থাকো।
তখনকার মত ঝামেলা মিটল বটে, বিকালে সবে জুড়ে এসেছে চোখের পাতা, মন্ত্রীমশাইয়ের ফোন। “রবিউলের বউকে ফোনটা দিন।” সর্বনাশ যেখানে বাঘের ভয়-। কাঁপতে কাঁপতে জানালাম, আমি চুঁচুড়ায় নেই। মেয়েটিকে বলছি, ওণাকে ফোন করতে এখুনি। মেয়েটিকে বললাম, আবার দৌড়ে যা বাবা। গিয়ে মার্জনা চেয়ে নে। তারপর আমি সামলাচ্ছি। পাঁচ মিনিট বাদেই মেয়েটার ফোন, “ম্যাডাম, ইয়ে আমার বরের নাম রবিউল নয়তো। ঐ বার জনের মধ্যে কোন রবিউল নেই। ” যাক স্বস্তির নিশ্বাস পড়ল। মন্ত্রীমহোদয়কে ফোন করে জানালাম, রবিউলের হয়ে কোন তদ্বির আমি করিনি। যাদের হয়ে করেছিলাম, তারা বাড়ি ফেরার জন্য কাতর হয়ে পড়েছিল এবং বাস ভাড়া করে ফিরে আসছে। উনি অত্যন্ত সহৃদয় ভাবে জানালেন, ঠিক আছে। ভবিষ্যতেও এমন সমস্যা হলে যেন ওণাকে জানাতে দ্বিধা না করি।
ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল। রাত এগারোটার সময় মেয়েটা জানালো উড়িষ্যা ছাড়িয়েছে ওরা। প্রার্থনা করে ঘুমোতে গেলাম, মানে মানে ঘরের ছেলেগুলো ঘরে ফিরুক। ভোর সাতটায় মেয়েটার মেসেজ, এবং তার সাত মিনিটের মধ্যে ফোন, ওদের বাস চুঁচুড়ায় ঢুকেছে। সদর হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে ওদের পরীক্ষার জন্য। মধ্যাহ্নে খবর এল, ছেড়ে দিয়েছে ছেলেগুলোকে। আপাততঃ একজনের ফাঁকা বাড়িতে আইসোলেশনে থাকবে ওরা। নিজেরাই রান্নাবান্না করে খাবে- জানালাম, “সে ভালো। তবে এখনি জড়িয়ে ধরে হামিটামি খেতে যেও না। আর কটা দিন সবুর করো। ” সলাজ হেসে প্রভূত কৃতজ্ঞতা জানাতে জানাতে কেঁদেই ফেলল মেয়েটা। জানতাম। আমি হলেও কেঁদেই ভাসাতাম। অনেকবার বাংলা ইংরাজিতে থ্যাঙ্কু জানাল মেয়েটা, জানালো গোটা পরিবার আমার মঙ্গলাকাঙ্খায় দোয়া চাইবে ওপরওয়ালার কাছে- অনেকবার বোঝালাম, নিছক সহমর্মিতা দেখানো ছাড়া কিছুই করিনি আমি। তারপর মনে হল, থাক আর বিনয় দেখাব না। দুহাতে লুটে নি এই ভালোবাসা আর শুভকামনা। তারপর উপহার স্বরূপ পাঠিয়ে দেব সবটুকু, আমার মাকে, আজ মাদার্স ডে কি না। খুব ভালো থেকো মা। যতদিন যাচ্ছে ততোবেশী তোমার মত হয়ে উঠছি আমি। আর জীবনের থেকে সেটাই আমার সবথেকে বড় পাওনা।

Friday 8 May 2020

#প্রাণের_কথা #রবীন্দ্রজয়ন্তী


চলুন, চলুন। দাদা-দিদি-ভাই এবং বোনেরা, আর দেরী করবেন না, উঠে পড়ুন। অনুগ্রহ করে মাস্ক-গ্লাভস্ ইত্যাদি খুলে রাখুন। স্যানিটাইজারের বোতল ছুঁড়ে ফেলে দিন কোপাই এর জলে-  এই না, এটা করবেন না। খামোখা দূষণ বাড়বে। স্যানিটাইজার থাক বরং।
ঐতিহাসিক এই বটগাছের তলা থেকে শুরু হচ্ছে আমাদের এই ভার্চুয়াল ট্যুর। লেডিজ এন্ড জেন্টেলমেন বেশী হল্লা করবেন না, কেলাশ চলছে কিনা। জানেন না বুঝি, এখেনে বেলা একটা অবধি খোলা আকাশের নীচে,  গাছের ছায়ায় জমিয়ে চলে পঠনপাঠনের আসর। সেই তাঁর সময় থেকে চলে আসছে এই নিয়ম। তিনি ও পড়াতেন গো। যেখেনে তিনি বসতেন, সেই জায়গায়ে একটা ছোটখাটো সিংহাসন মত করা আছে। দেখাব, দেখাব- সব দেখাব। ব্যস্ত হন ক্যানে?
 নাঃ আপনাদের বিশ্বাস নেই, এখনই যা হল্লা জুড়েছেন। ছাড়েন। ভিতরে পরে ঢুকব।চলেন  আগে বাইরেটা ঘুরে দেখাই। এই দেখেন গিয়া প্রতীচী। কার বাড়ি বলেন তো এটা? ঠিক ধরেছেন। জানেন অমর্ত্য সেন, মাঝেমাঝেই এসে থেকে যান এখেনে। বছরে এক থেকে দু বার তো আসেনই আর যখনই আসেন, সাইকেল নিয়ে বেড়িয়ে পড়েন। কাছেই কালোর চায়ের দোকান। ওখেনেই ওণার ঠেক। কালো আর বেঁচে নেই গো বাবুবিবিরা,তবু উনি যান। বসেন। চা খান। আড্ডা মারেন।
এই দেখেন আনন্দধারা। আমাদের মোহর দিদির বাড়ি। আপনাদের কণিকা বন্দোপাধ্যায় গো? কান পাতেন, কান পাতেন- শুনতে পাচ্ছেন কি,ঐ তো মোহর দি গুনগুন করছে-  “নিরালায় তোর বনেরও মাঝে, সেথা কি এমন নূপুর বাজে?” কিছুদিন আগেও এখানে গোরা সর্বাধিকারী থাকতেন। এখন কে থাকেন ঠিক জানি না গো বাবু-বিবিরা। সারি সারি সব তালাবন্ধ কুঠি গুলো পড়ে আছে। কান পাতলেই ভেসে আসে দু এক কলি গান- কখনও বা উড়ে আসে কে জানে কার তপ্ত দীর্ঘশ্বাস। ফিসফিস করে কথা বলে কারা।
মনটা বড় ভারি হয়ে গেল গো, চলেন  খানিক গিয়ে বসি কোপাই এর ধারে- সেই যে গো, “আমাদের ছোট নদী চলে আঁকে বাঁকে-”। তবে বৈশাখ মাসেও মোটেই হাঁটু জল থাকে না, দেখছেন কি না। পাশেই “আমার কুঠির”। যদি কিছু সওদা-টওদা করতে চান, করতেই পারেন। দেওয়াল জোড়া সারি সারি স্বদেশী বিপ্লবীদের ছবি, বড় দুঃখ হয় জানেন, ওণারা যদি জানতেন, সংগ্রাম একদিন সফল হবে বটে, পরিবর্তে ছিনিয়ে নেবে ভিটেমাটি-
একটা বাজতে এখনও দেরী আছে, খোয়াই যাবেন নাকি গো? নাঃ আজ হাটবার নয়। হাট বসবে না জানি, খোয়াই জুড়ে আপাততঃ বিরাজমান অসীম শূণ্যতা। গনগনে রোদে পোড়া লাল মাটির বুকের ওপর দিয়ে এই সময় ছুটে বেড়ার তপ্ত বাতাস। কাকে খোঁজে কে জানে? হয়তো লক্ষ কোটি পদচিহ্নের ভিড়ে তলাশ করে বেড়ায় জনৈক দীর্ঘদেহী দাড়িওয়ালা বৃদ্ধের চরণধূলি।

চলুন,প্রতীক্ষার অবসান। এবার গন্তব্য বিশ্বভারতী। এই দেখেন শদুয়েক বছরের পুরাতন বট গাছ, এই দেখেন দেহলী।  নতুনবাড়ি, আম্রকুঞ্জ, বকুলবীথি, শান্তিনিকেতন কুঠি, সুরুল কুঠি, মহুয়া কুঠি,পূর্ব তোরণ, পশ্চিম তোরণ, ছাতিমতলা, কালো বাড়ি।  শান্তিনিকেতন তো শুধু চর্ম চক্ষে দেখার নয় গো বাবুবিবিরা, এ হল গে অনুভবের বস্তু। কত বছর হয়ে গেল তিনি নেই, অথচ আজও কি ভীষণ ভাবে সর্বত্র বিরাজমান উনি। পারছেন অনুভব করতে? কায়াহীন দাড়িবুড়োর উপস্থিতি- ওণার নেশায়, ওণার উপস্থিতি-অনুপস্থিতির আলোছায়ায় আজও বুঁদ হয়ে আছি গো আমরা। তিনি নেই, অথচ তার সেই আসনটি যেখানে বসে একদা তিনি ক্লাস নিতেন আজো রয়েছে, ভাবলেই গায়ে কাঁটা দেয়। বসেন বসেন ওনার আসনের উল্টোদিকে এট্টু বসেন, বন্ধ করেন চোখ, তারপর কল্পনা করেন, উনি শিক্ষক আপনি হলেন ওণার ছাত্র/ছাত্রী। দিচ্ছে না গায়ে কাঁটা? জাগছে না রোমাঞ্চ?
আপনাদের বোধহয় দেরী হয়ে যাচ্ছে,তাই না? জানি অনেক দূর ফিরতে হবে, তবে  কলের বাঁশি না দেখে কি শান্তিনিকেতন ত্যাগ করা যায়? স্বর্গীয় রামকিঙ্কর বেজ মহাশয়ের অমর সৃষ্টি- এলেনই যখন চলুন “গৌতম বুদ্ধ এবং সুজাতা”, মহাত্মা গান্ধী আর সাঁওতাল পরিবারকেও দেখিয়ে দি চলেন। মহাত্মা গান্ধীর পদতলে করোটির গায়ে কেমন শ্যাওলা জমেছে দেখছেন। দেশের জনকের চরণতলে শ্যাওলা মাখা নরকরোটি-কিসের সঙ্কেত বহনকারী কে জানে? তবে ভয় নাই গো বাবুবিবিরা, রাত্রি যতই প্রগাঢ় হোক না কেন, রবির ছটায় দুদ্দাড় করে পালাবে সব আঁধার। কি বলেন?