Thursday 12 May 2022

অনির ডাইরি ১১ই মে, ২০১৮

 

“বললাম, গাড়ি করে যাই-” গজগজিয়ে উঠলেন বৃদ্ধা। দমদম থেকে ট্রেনে উঠেছেন সৌম্য দর্শন বৃদ্ধ দম্পতি, বৃদ্ধর বয়স সম্ভবতঃ আশির দোরগোড়ায়, বৃদ্ধাও সত্তরোত্তীর্ণা। একজনের গাত্র বর্ণ উজ্জ্বল শ্যাম,অপরের টকটকে ফর্সা। বৃদ্ধা উঠেই হাপরের মত হাঁপাচ্ছেন, হাঁপাচ্ছেন বৃদ্ধও মুখে যদিও দুষ্টু হাসি। রুমাল দিয়ে ঘষে ঘষে মুছতে লাগলেন মুখ। 

হাঁপাতে হাঁপাতে বৃদ্ধা আবার শুরু করলেন,“বললাম, গাড়ি ভাড়া করো। ঠাণ্ডায় ঠাণ্ডায় যাই, তা নয় ট্রেনে চল।” বৃদ্ধ সহাস্যে বললেন,“গাড়ি ভাড়া করলে হাজার টাকার ধাক্কা, তারওপর ছ ঘন্টা কেটে গেলেই শালারা বারো পনেরো যা খুশি চায়। চলো না, ট্রেন চললেই হাওয়া আসবে। নেমে অটোয় চাপাব না, রিক্সা ধরে নেব। ” বৃদ্ধা মুখ ঝামটা দিলেন। বৃদ্ধ গদগদ সুরে বলতে লাগলেন,“আরে আগে তো ট্রেনেই যাতায়াত করেছি। তোমার বাবা কাকা দাদা যা ছিল সব একএকটা। নামি গুণ্ডা। তাদের ভয়ে ভিড় ট্রেনে চেপে কোন ফাঁকা স্টেশনে নেমে দেখা করতে হত। বাপসঃ। ” এবার সত্যিই কুরুক্ষেত্র লেগে গেল। আমার যদিও প্রচণ্ড মজা লাগছিল, ওণাদের ডেটিং এর গল্প শুনতে। 

বেশ খানিক ঝগড়ার পর নেতিয়ে পড়লেন বৃদ্ধা। এই গরমে মাথায় ঘোমটা দিয়ে আঁচল প্রান্ত গায়ে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়ানো। এই লাইনে অনেক মধ্যবয়সীই হিজাবের পরিবর্তে শাড়ির আঁচল জড়ান। বৃদ্ধ চটজলদি ব্যাগ থেকে জলের বোতল বার করে দিলেন।গায়ের চাপা খুলে দিতে অনুরোধ করলেন।  জল খেয়ে খানিক ধাতস্থ হয়ে আবার ঝগড়া। 

বৃদ্ধ রীতিমত গলার শির ফুলিয়ে বৃদ্ধাকে অভিযুক্ত  করতে লাগলেন, বৃদ্ধা নাকি  ঠিকঠাক ওষুধ খান না। বৃদ্ধাও সমান তেজী। বেশ খানিক তর্কের পর ওষুধের হিসেব নিতে বসলেন বৃদ্ধ। কোন ওষুধ কটা পড়ে আছে। গো হারান হেরে গেলেন বৃদ্ধা। 

সাময়িক শান্তি। তারপর বৃদ্ধ শুরু করলেন,“ওদের বাড়িতে যতই বলুক, বুঝলে পেট ভরে খাবো না। ফেরার পথে স্টেশন রোডের ফুচকা।” মহিলা বোধহয় ঝাল নিয়ে কিছু বললেন, বৃদ্ধ বললেন,“তুমি ঝাল ছাড়াই খেয়ো। তেমন হলে শুকনোই খেয়ো। একটা খেয়ো অন্তত। না হলে-”।  বলে এমন অভিমানী ভঙ্গীতে মাথা নত করে বাইরের দিকে তাকালেন, যে বোঝাই গেল গিন্নী ব্যতীত উনি ফুচকায় স্বাদ পাবেন না। বৃদ্ধা ফিসফিস করে কিছু আব্দার করলেন, বৃদ্ধ খুশি হয়ে বললেন,“বেশ। হবে। ফুচকাও হবে, আইসক্রীম ও হবে। তুমি গায়ের চাপাটা এবার খোলো। সিদ্ধ হয়ে মরবে।  কেউ কিচ্ছু বলবে না। আরেঃ আমি বলছি,”।  ট্রেন বেশ ফাঁকা, বৃদ্ধা এদিক ওদিক তাকিয়ে ধীরে ভীরে মাথা এবং গা থেকে আঁচল সরিয়ে জড়সড় হয়ে লাজুক নবোঢ়া বধূর মত স্বামীর গায়ে গা লাগিয়ে বসলেন। চমকে গেলাম, বৃদ্ধার মাথা ভর্তি চকচকে টাক। দুহাতে অজস্র সূঁচ ফোটানোর  কালো দাগ। কেমো চলছে অথবা কেমো হয়েছে। বৃদ্ধ মজা করে বলে চলেছেন,“আমার বউ টেকো হতে পারে তাই বলে কি কম সুন্দর নাকি-”। বৃদ্ধা মুখ বেঁকিয়ে বোধহয় বললেন মরণ। চোখের কোণটা এত কড়কড় করছে কি বলব, প্রচণ্ড রাগ হচ্ছে নিজের ওপর। দিন কয়েক আগে বোধহয় আমিও ভাবছিলাম এ শহর বিস্মৃত হয়েছে প্রেম। আজ এদের দেখে মনে হচ্ছে, সত্যিই, ফুল ফুটুক না ফুটুক আমার শহরে বিরাজমান  চিরবসন্ত।

অনির ডাইরি ১১ই মে, ২০২২

 



আর পারছি না গুরু, সেই সকাল সাতটা থেকে শুরু। এত বছর তো নিজে পড়াশোনা করলাম। তারপর আবার চাকরীর জন্য পড়তে হল। চাকরী পেয়েও পড়তে বসলাম, আপদ ডিপার্টমেন্টাল পরীক্ষার জন্য। নাহলে নাকি চাকরী পাকা হবে না। তারপর কয়েকটা বছর একটু শান্তিতে কাটল বটে, অতঃপর আবার শুরু করতে হল, ‘অ লেখ রে ভাই, দাগে, দাগে।’ আবার ভর্তি হতে হল স্কুলে। আবার পড়ে গেলাম সেই ষাণ্মাসিক আর বার্ষিক পরীক্ষার চক্করে।  কেন, কেন এবং কেন আমাকে দুবার করে পড়তে হবে? আমি আর পড়তে বসতে রাজি নই। যাঁর উদ্দেশ্য করে বলা, তিনি অনন্তকাল ধরে এক কাপ আদা মধুর জল নিয়ে বসে আছেন। একটু আগেই তিনি ঘোষণা করেছেন তিনি বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থায় বিরুদ্ধে সম্মিলিত প্রতিবাদ গড়ে তুলবেন। ওণার দাবী, ‘যতই গ্রীষ্ম- বর্ষা-শীত-বসন্ত আসুক ক্লাস হোক কেবল অফ লাইন, আর পরীক্ষা হোক অনলাইন।’ 


মামার বাড়ির আব্দার মাইরি। শ্রীমতী তুত্তুরীর বক্তব্য হল, অফলাইন ক্লাশ হলে কেমন বন্ধুদের সাথে দেখা হয়, ভাবের আদানপ্রদান চলে। অনলাইন ক্লাশ হলে তো কেবল স্যার একাই বকে যান। এতই যদি অফলাইন ক্লাশ পছন্দ, তাহলে পরীক্ষা অনলাইনে চাইছিস কেন? ‘ অনেক দিন দিইনি। জানি না আর পারব কিনা’। উদাস দার্শনিক ভাবে জবাব দেয় তুত্তুরী। অতঃপর একখান রাম কানমলা এবং যাবতীয় বৈপ্লবিক চিন্তা ভাবনা জানলা গলে পগার পার। 


 সকাল সাড়ে সাতটা। সক্কাল সক্কাল আজকাল বাবাকে ফোনটা করেনি। সারাদিন আমি সকল কাজের পাই যে সময়, সময় হয় না শুধু বুড়ো নিঃসঙ্গ বাপটাকে ফোন করার। বাবা সেদিন দুঃখ করে বলেই ফেলল, ‘বুড়ো হয়েছি তো। একটু বেশি বকি। আর আমার তো তুমি ছাড়া আর কেউ নেই,যে আমার বকবক সহ্য করবে। তুত্তুরীটাও আজকাল কেমন যেন বড় হয়ে যাচ্ছে। ওর মতের বিরুদ্ধে কিছু বললেই, বলে, “আচ্ছা দাদু, এখন রাখছি। হোমওয়ার্ক করতে হবে।“’ 


তা বলে বটে, শ্রীমতী তুত্তুরীর মতের বিরুদ্ধে গেলেই তিনি আজকাল ভয়ানক বিরক্ত হন। বাবা তো শুধু ফোনে শুনে আহত হয়, আমি তো নিত্য দেখতে পাই, তাঁর অভিব্যক্তি গুলো। আমার সব কথাই তাঁর আজকাল করলার রস গেলার মত লাগে। তুত্তুরীর প্রিয়তম ব্যক্তি হলেন তাঁর বাবা। কারণ শ্রীমতী তুত্তুরী উচ্ছন্নে গেলেও তিনি কিছুই বলেন না। উল্টে বলেন,“সবাইকে যে মানুষই হতে হবে কোথায় লেখা আছে? দু চারটে তো গেছো বাঁদর হবেই।” 


সবে আটটা বাজছে, এরই মধ্যে রোদে পুড়ে যাচ্ছে চরাচর। মুঠো ফোন বলছে বাইরের তাপমাত্রা ৩২ মাত্র, যদিও ‘রিয়েল ফিল’ ৩৮মত। এত রোদেও গাছে জল দিয়েই যাচ্ছে বাগানে কাজ করতে আসা মাসির দল। দিন কয়েক আগে অমনি তুত্তুরীকে স্কুল থেকে বাড়িতে নামাতে গিয়ে দেখি, বিকাল সোয়া চারটের তুখোড় রোদে চলছে গাছে জল দেওয়া। মাথার ওপর দেদীপ্যমান দিনমণি,মাটি থেকে উঠছে তাপ, প্রায় ফুটছে ট্যাঙ্কের জল, সেই জলে স্নান করানো হচ্ছে আমার সাধের জিনিয়া, কশমস আর নয়নতারাদের। এরপরই ঢ্যাঁড়স,ঝিঙে,শসা,কুমড়ো, টমেটো আর বেগুন গাছের পালা। 


সিকিউরিটি ছেলেটা বিরস বদনে পর্যবেক্ষণ করছে, তাকে ডেকে বললাম,‘শিগ্গির নিষেধ করো রে বাবা।’  তিতকুটে স্বরে জবাব এল, ‘আর বলবেননি ম্যাডাম। বললেও শুনতেছে না। খালি বলতেছে, তুমি চুপ করছু। ম্যাডামকে বলা আছে। ম্যাডাম সব জানতেছেন।’ এতো মহাজ্বালা। কারো সঙ্গে দুদণ্ড কথা বললেই, সে আমার নামে সব চালিয়ে দেয় হেথায়। আরেঃ আমি শহুরে ভূত হতে পারি, গাছপালা তেমন নাও চিনতে পারি, তাই বলে এটুকু তো জানি যে এই তুখোড় রোদে গাছে জল দিলে গাছ ধড়ফড় করে মরে যায়। সেযাত্রা আমার অনুরোধ আর সিকিউরিটি ছেলেটির হম্বিতম্বিতে দুপুর বেলা জল দেওয়া বন্ধ হলেও চালু হয়েছে সকাল বেলা। অগত্যা বলতেই হয়,‘ও দিদিরা আর জল দিবেননি গো। আপনাদেরই হাতে লাগানো গাছ, সব মরে যাবে এবার।’ 


সকাল সাড়ে আটটা, স্নান করতে যাবেন শ্রীমতী তুত্তুরী। তার আগে মাথায় তেল মাখবেন জবজবে করে। তবে সেই তেল মাখানোর গুরুদায়িত্বটি মোটেই মায়ের উপর ছাড়তে তিনি নারাজ। মা যে ঘোরতর নারকেল তেলের পন্থী। নারকেল তেলের শিশি হাতে বেকুবের মত দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে ভীষণ মিস করি ১৭ বছর আগে হারিয়ে যাওয়া প্রবল ব্যক্তিত্বশালিনী এক বৃদ্ধাকে। নারকেল তেলের মর্ম যদি ঠাকুমা বেঁচে থাকতে থাকতে বুঝতে পারতাম-। 


বেলা সাড়ে দশটা, ‘তুমি কিন্তু আজ বাড়িতে খেতে আসবে।’ যাকে উদ্দশ্য করে বলা তিনি নীচু হয়ে জুতোর ফিতে বাঁধছেন। ‘হ্যাঁ তা আসাই যায়।’ এটাই নৈমিত্তিক দায়সারা জবাব। তুত্তুরীর স্কুল থাকলে টিফিন নিয়েই যাই আমি, আর ছুটি থাকলে বেলা তিনটে নাগাদ খেতে আসি। শৌভিক কোনদিন আসে না। টিফিনে কি খায়? কোনদিন মুড়ি চিবোয়, কোনদিন বা গোলাপীর মাখন পাঁউরুটি আর ডিমের অমলেট। কে যেন কিছুদিন আগেই গল্প করছিল,গোলাপীর ঘুঘনিতে পোকা আর ডিমে আরশোলার বাচ্ছা পেয়েছে। সে গল্প বড় মুখ করে শৌভিকই শুনিয়েছে আমায়। তাও গোলাপী প্রীতি ছাড়তে পারে না। প্রসঙ্গতঃ গোলাপী নামটা মহিলাসুলভ হলেও, তিনি আদতে পুরুষ। 


আরে ভাই,মুড়িই যদি খাবি,তো বাড়িতে এসে খা। মাখন পাঁউরুটিও কি বাড়িতে জোটে না তোর? সপরিবারে থাকিস, তাও খামোকা গোলাপের পাউরুটি চিবোস কেন? যাঁর উদ্দেশ্য বলা, ততোক্ষণে গড়িয়ে গেছে তাঁর গাড়ির চাকা। চিৎকার করে বলি,‘ আমি ফোন করব, পৌনে তিনটে নাগাদ বেরিয়ে পড়বি অফিস থেকে।’  


পৌনে এগারোটা, কে বলবে তুফান আসছে, কি বিকট গরম। গাড়ি থেকে নেমে লিফট অবধি পৌঁছাতেই ঘেমে গেলাম। লিফটের দরজা আটকে দুই মহিলা আর এক পুরুষ। কি করছে রে ভাই? উঠছেও না, উঠতে দিচ্ছেও না। গলায় একরাশ কেজো বিরক্তি নিয়ে বললাম, ‘সরুন। সরুন। অযথা গেট আটকে রাখবেন না।’


 ‘এই তো, এই দিদি  যাচ্ছেন, এণার সাথে চলে যাও', বলে ওঠে ছেলেটা। দুই গ্রাম্য ভদ্রমহিলা, দম দেওয়া পুতুলের মত নড়তে নড়তে লিফটে উঠলেন। নিজের তলার বোতাম টিপে, জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালাম, বললেন আমার ওপরের তলায় যাবেন। বোতাম টিপে দিলাম। দরজা বন্ধ হল, লিফট উঠতে শুরু করল। সঙ্গে সঙ্গেই পাশের ভদ্রমহিলা আমায় জড়িয়ে ধরলেন। হতবাক হয়ে জানতে চাইলাম,‘ কি হয়েছে?’ সরল, গ্রাম্য ভঙ্গিমায় বললেন,‘খুব ভয় করছে। আগে চড়ছি না তো।’ পাশের মহিলা দেখলাম ওণাকে চেপে ধরেছেন। তিনিও বেশ ভীত। আশ্বস্ত করলাম, ভয়ের কিছু নেই। তবু যুগলে বললেন,‘তোমায় একটা কথা বলব, আমাদের একটু নামিয়ে দিয়ে আসবে?’ এত সরল, অকপট অনুরোধ কি ফেলা যায়? চলুন আপনাদের জন্য একতলা বেশিই উঠি না হয় আজ। 


বেলা দুটো, অফিসের রাবার গাছটা আজ মরে গেল। এই আপিসে কি আছে কে জানে, এত বড় বড় জানলা, এত রোদ আলো ঢোকে, তবু গাছ বাঁচে না। এই নিয়ে তিন চারটে গাছ মরে গেল। ফাঁকা টব গুলো পড়ে থাকে ভূতের মত। এখানেও যদি মাম্পির মত কেউ থাকত-। এত বকুনি খেত, তাও সুযোগ পেলেই একাধিক ব্যাগ ভর্তি করে নদীর পলি মাটি, বালি, শতেক রকমের গাছের চারা, মাটি কোপানোর খুরপি ইত্যাদি নিয়ে হাজির হত চুঁচুড়ার আঞ্চলিক শ্রম দপ্তরে। তমলুকেও একবার এসো না মাম্পি, প্লিজ। দূরত্ব অনেকটা মানছি, গরমটাও মাত্রা ছাড়া, বর্ষা নামলেই না হয় এসো, তোমার বাড়ির গাছ গুলো যত বাচ্ছা দেবে, সবকটা আমার চাই। পাগলি মেয়েটা হেসে গড়িয়ে পড়ে ফোনের ওপারে। ‘আমি সত্যিই যাব ম্যাডাম। সদ্য পক্স থেকে উঠিছি তো, একটু শরীরটা সারতে দিন, প্রিয়াঙ্কাকে নিয়ে চলে যাব। আপনার আপিস পুরো গাছে ভরে দেব আমরা।’ আকাশকুসুম পরিকল্পনা করি দুজনে। জানি বাস্তবায়ন অসম্ভব। 


বেলা তিনটে, কি রে খেতে আসবি? ওপাশ থেকে ভেসে আসে দীর্ঘশ্বাস। নাঃ তোরা খেয়ে নে। এভাবে কাজ ফেলে যেতে পারব না। ধুত্তোরি বলে ফোন রাখতে রাখতে থমকে দাঁড়াই, হয়তো আমাকে খুশি করতেই ওপাশ থেকে ভেসে আসে সনির্বন্ধ অনুরোধ, ‘আজ রাতে একটু চিকেন করবি?’  রাতেই তো করি, সকালে সময় পাই কোথা? 


বিকাল সাড়ে পাঁচটা, অপিসের গাড়িটা সবে এসে থেমেছে গাড়ি বারন্দার নীচে, কাঁচুমাচু মুখে এগিয়ে এসে দরজা খুলে দিলেন শ্রীমতী তু্ত্তুরী, ‘এই মা,একটা কেলো হয়েছে।’ কি হল আবার? তীব্র উৎকণ্ঠা নিয়ে যার দিকে তাকিয়ে আছি, তিনি ভয়ে নীরবতার আশ্রয় নিয়েছে। মাসি পাশ থেকে জানান, পায়ে পেরেক ফুটেছে শ্রীমতী তুত্তুরীর। কি ভাবে নিজের হাতে ফুটে যাওয়া নাছোড়বান্দা  পেরেকটাকে টেনে বার করেছে তুত্তুরী সেই বীরগাথা শুনতে শুনতে তাকে টিটেনাস দিইয়ে আনি। আগামী এক ঘন্টা যে তিনি জনে জনে ফোন করে তাঁর বীরবত্তার গল্প শোনাবেন, তা বেশ বুঝতে পারি। উত্তম কুমার বলে, ' ম্যাডাম দুটো ব্যথার ট্যাবলেট কিনে নিলে পারতেন,ব্যথা হয় যদি।' হোক না, ব্যথা সইতেও তো শিখতে হবে। 


সন্ধ্যা সাড়ে ছটা, সাধারণ চিকেন রাঁধতে একদম ইচ্ছে করছে না। ভীষণ ভীষণ রেজালা রাঁধতে মুঞ্চায়। রাতে আর কি করেছ গো মাসি, ভাত না রুটি? জবাব আসে ভাত। ভাতের সাথে রেজালা, শুনে ঢোঁক গেলে শৌভিক। 'তার থেকে ঝোলই কর। বেশি করে আলু দিয়ে লম্বা ঝোল।কেমন?' রাঁধব তো আমি, তাও নিজের ইচ্ছে মত পারব না?  কোন দিন এবাড়িতে যদি আমার মর্জিমাফিক কিছু হয়। 


রাত সাড়ে সাতটা- আমার বাংলা পড়ানো শেষ। এবার ইংরেজি বইটা নিয়ে বাপের কাছে যা। করলা গেলা মুখ নিয়ে গেল বটে তুত্তুরী, ফিরে এল গাল ভরা হাসি নিয়ে। বাবা বলেছে, অত পড়তে হবে না। আজ তোর ছুটি। কিসের ছুটি রে? বাবা স্প্যানিশ থ্রিলার দেখবে, তাই নাকি মেয়ের ছুটি। ‘আমি সওওব পড়িয়ে দেব।’ জানি না আমার ভয়েই কিনা, মেয়ের পিছু পিছু দোতলা থেকে নেমে এসে আমাকে আশ্বস্ত করে যায় শৌভিক। কবে? এই প্রশ্নের উত্তরে অনেক হিসেব টিসেব কষে, কান এঁটো করা হাসি সমেত জবাব আসে, ‘ কাল। না না কাল তো হবে না। তাহলে পরশু। বুঝলি তো বুজু, তুই আর আমি, পরশু সব পড়ে ফেলব-’।


রাত নটা, রান্না প্রায় শেষ, না তেরা না মেরা, মার্কা ঝোল করেছি চিকেনের। টক দই, মরিচ গুঁড়ো, আদা রসুন বাটা আর সাদা তেল দিয়ে ম্যারিনেট করা মাংসকে কষেছি পোস্ত আর কাজু বাদাম বাটা দিয়ে। গুটি কয়েক গোটা শুকনো লঙ্কা ও দিয়েছি ফোড়ন হিসেবে। দিয়েছি অল্প ঘি, গরম মশলা আর সামান্য একটু বেশি মিষ্টি। গোলাপ আর কেওড়ার জল আর মাখানা মেশালেই পুরো রেজালা হয়ে যেত মাইরি। এমনিতেই যা ভুরভুর করে গন্ধ বেরোচ্ছে। সামান্য বেশি কষার জন্য, একটা হালকা হলদেটে রং এসেছে যদিও। সত্যিই রেজালা তো নয়, অত নিখুঁত করার দরকারটাই বা কি? 


পদ্ধতি এক হলেও হিসেব বহির্ভূত কেবল আলুটা। আলু না দিলে গোঁসা হয় যে এদের বাপ মেয়ের। এমনিতেই শ্রীমতী তুত্তুরী উপুড় করে রেখেছেন অনুযোগের ডালি। আমি কেন তার বাবাকে খোঁচালাম, তাই না বাবা বলল, তুত্তুরীকে নিয়ে সব পড়ে ফেলবে বাবা। মুস্কিল হচ্ছে, মোটেই সব পড়তে রাজি নয় তুত্তুরী। বোকা মা যে কেন বোঝে না, পড়াশোনা করতেই আগ্রহী নন তিনি। বিরক্ত হয়ে বলি, ‘লেখাপড়া না শিখলে বড় হয়ে ফুচকা বেচতে হবে যে-’। জবাব আসে, ‘ফুচকাওয়ালা হওয়া তো ভালো। বড় বড় লোকেরা আমার সামনে বাটি হাতে দাঁড়িয়ে থাকবে।’  হে ঈশ্বর, আমায় তুলে নাও প্রভু। অথবা হে ধরণী তুমি দ্বিধা হও, এই বাপ মেয়ের সংসারে, আমার যে বেঁচে থেকে কোন লাভ নেই, আমি বেশ বুঝতে পারছি।

Tuesday 10 May 2022

অনির ডাইরি ৯ই মে, ২০২২

 

#তাম্রলিপ্তকড়চা 

দরিদ্র, অপাংক্তেয় শ্রম দপ্তরের অগোছলো সেকশনের এক কোণে, হঠাৎই একদিন এসে বসলেন তিনি। কি যেন একটা তুফানে কেঁপে ওঠার কথা পূর্ব মেদিনীপুর। আকাশের মুখ ঘোর কৃষ্ণ, মাঝেমাঝেই ছুটে আসছে মাতাল হাওয়া, এলোমেলো করে দিয়ে যাচ্ছে সাধের তুরস্ক নীলরঙা পর্দা গুলোকে। উড়ে বেড়াচ্ছে যত কুচো আর বাতিল কাগজ। দূরের লোকজনকে আগেই ছেড়ে দেওয়া হয়েছে, ছুটির ঘন্টা বাজতে তখনও বেশ খানিক বাকি, ঘন্টা বাজলেই গুটি গুটি রওণা দেব আমরাও। এমন আবহাওয়ায় রুদ্ধ চেম্বারে গ্যাঁট হয়ে বসে থাকতে পারি না আমি, ভালো লাগে ঘুরে বেড়াতে, প্রতিটা জানলায় দাঁড়িয়ে দেখতে, কতটা অন্যরকম লাগে মেঘলা আকাশ, বিদ্যুতের ঝলক আর দামাল হাওয়াকে। 


তেমনি পায়চারির ফাঁকে আচমকাই তাঁর সাথে দৃষ্টি বিনিময়। উড়ন্ত অবাধ্য কেশগুচ্ছকে দ্রুত শাসন করে উল্লাস না চাপতে পারা চপল স্বরে জানতে চাইলাম, এণাকে কোথায় পেলে? চঞ্চল,শান্তনু আর শুভাশিস ততোধিক উল্লসিত স্বরে জানাল, ‘ছিলেন তো ম্যাডাম। আমাদের পুরাণ অফিসেও শোভা পেতেন।এখানেও এসেছিলেন, আমাদের সাথে, তারপর কোথায় যে বস্তাবন্দি হয়ে লুকিয়ে বসেছিলেন। অতি কষ্টে, অনেক ধুলো ঘেঁটে খুঁজে বার করা হয়েছে, বৃদ্ধকে।’ 


সেই থেকে আমাদের অকিঞ্চিৎকর সেকশনের মাঝেই আসন পাতা তাঁর। নীরবে প্রত্যক্ষ করেন আমাদের কার্যকলাপ। দুরন্ত হাওয়ায় মাঝেমধ্যে হেলে দুলে যান বটে,  দুয়েক দিন ছাড়া,ছাড়াই সাফ ডাস্টার দিয়ে সাফ সুতরো করে দেওয়া হয় তাঁকে। দিন দিন আরো আরো উজ্জ্বল হয়ে উঠছেন আমাদের ঘরের রবি। 


সপ্তাহ পেরোলেই 'আমাদের ঘরের রবি'র জন্মদিন। তো এ হেন রবি বাবুকে কি আমরা একটা মালাও পরাব না? 


শুক্রবার এমনিতেই ভিড় বেশি হয় এই অফিসে, পাশবই রিনিউ করতে, পেনশনের আবেদন নিবেদন করতে জমায়েত হন, একরাশ পরিবহন শ্রমিক, আসেন ট্রেড ইউনিয়নের নেতারাও। সকলের ব্যস্ততা থাকে তুঙ্গে। সদ্য কাজে যোগ দেওয়া বেবি ইন্সপেক্টর দ্বয়কে আজ বসানো হয়েছে জনতার দরবারে। ক্ষণিকের জন্য সবাইকে ডেকে প্রস্তাব রাখলাম, ঘরের রবির জন্মদিন পালনের। আর কিছু না পারি, সামান্য একটা পুষ্প হার, দুয়েক কলি তাঁর গান বা কবিতা, শুভদীপ্তর কন্যার একটা নাচ, আর সবার শেষে জনগণমন, এই আর কি। বাহুল্য নয়, শুধুখানিক আন্তরিকতা আর অনেকটা ভালোবাসা। 


মুস্কিল হল, এই তাপপ্রবাহ দীর্ণ খর দুপুরে এই আপিস পাড়ায় মালা কোথায় পাব? পৌনে চারটে নাগাদ স্কুল ছুটি হয় তুত্তুরীর, ভাবলাম ওকে নিয়ে ফেরার পথে কিনে আনব খন। শুভাশিস বলল, ‘ আপনারা যে রাস্তা দিয়ে ফেরেন, ঐ রাস্তায় পাবেননি ম্যাডাম। আপনাকে বর্গভীমা মন্দিরের সামনে দিয়ে ঘুরে আসতে হবে।’ বর্গভীমা মন্দিরের সমনের রাস্তাটা বড়ই সঙ্কীর্ণ আর তেমনি যানবাহনপূর্ণ। ওদিকে যেতে হবে বললেই গজগজ করে আমাদের উত্তমকুমার। ‘সকাল থেকে বলতে পারলনি শুভাশিস দা। এখন মালা কোথায় পাবেন?’ এতবড় শহর, একছড়া মালা পাব না? ‘আহাঃ পাবেননি কেন,কিন্তু এই গরমে কোন ফুলওয়ালা আপনার জন্য বসে থাকবে বলুন দিকি।’ তাও বটে, তবুও কপাল ঠুকে রওণা দিলাম আমরা। দুই বেবি ইন্সপেক্টরকে বলে গেলাম, সবার নাম টুকতে। হয় গান গাইতে হবে, নয়তো আবৃত্তি করতে হবে। কিছুতো করতেই হবে,মুখ খুলতেই হবে ঘরের রবির খাতিরে। 


ভারি ব্যাগ সমেত তুত্তুরীকে গাড়িতে তুলে প্রায় অর্ধেক শহর পরিক্রমা করে ফেললাম আমরা, মনের মত মালা কোথায় পাই? মন্দিরের সামনে ঝোলানো আধশুকনো জবার মালাগুলো দেখে গাড়ি থামালই না উত্তম। শেষে এক কাঠের পোলের পাশে অর্ধেক ঝাঁপ বন্ধ দোকান থেকে দেড় গুণ মূল্যে পাওয়া গেল তাঁর মালা। প্রবল কাশির দমকে অস্থির, ক্লান্ত তুত্তুরীকে বাড়িতে নামিয়ে যখন আপিসে পৌঁছালাম, ততোক্ষণে নতুন করে পাতা হয়েছে 'আমাদের ঘরের রবি'র আসন। হাতল ছাড়া চেয়ারের ওপর তকতকে সাদা তোয়ালে পেতে বসেছেন তিনি। আপিসের সব থেকে সেরা গাছ গুলো দিয়ে ঘিরে রচিত হয়েছে তাঁর নিজস্ব শান্তিনিকেতন। কাগজের কাপে মাটি দিয়ে পোঁতা হয়েছে গোছা গোছা ধুপ। 


আপিস জুড়ে বইছে তপ্ত আবেগের  বাতাস। গান আবৃত্তি নয়, ছোট্ট করে বক্তব্য রাখবে শান্তনু আর শুভাশিস, কবিতা পড়বে চঞ্চল, পেনশন আর রিনিউয়ালে ফাইল গুছোতে গুছোতে গুণ গুণ করে আবৃত্তি অভ্যেস করছে নন্দন বাবু।  মোবাইল থেকে গুগল খুলে, কি সব গান টুকছেন জহর বাবু। নিজের চেম্বারে সেঁদিয়ে যেতে যেতে বললাম, ' আজ কিন্তু এ আমার গুরু দক্ষিণা গাইবেন না কেমন?' জিভ কেটে জহর বাবু দেখিয়ে গেলেন, উনি 'একলা চলো রে' টুকছিলেন। 


 জানলার বাইরে ঘনিয়ে আসছে সন্ধ্যে, একে একে জ্বলে উঠছে নিমতৌড়ির হলদেটে নিয়ন আলো গুলো। সপ্তাহান্তিক  ছুটির মেজাজে খালি হয়ে যাচ্ছে অন্যান্য আপিস গুলো, আর আমরা তৈরি হচ্ছি ঘরের রবির জন্মদিন পালনে। ফাইল পত্র গুটিয়ে, কম্পিউটার গুলো বন্ধ করে জড় হচ্ছি তাঁকে ঘিরে। ভিজে রজনীগন্ধার মালা থেকে বেরোচ্ছে মিষ্টি মিষ্টি ফুলেল সৌরভ। শান্তনু বলল,‘ম্যাডাম আপনি পরিয়ে দিন।’ ভেবেছিলাম তুত্তুরী বা তিথির হাত দিয়ে মালা পরাব তাঁকে, একজন জ্বরগ্রস্ত, আরেকজন তখনও এসে পৌঁছায়নি। বড্ড ছোট যে, স্কুল থেকে বাড়ি ফিরে,মুখ হাত ধুয়ে তবে না নাচতে আসবে। এই প্রবল দাবদাহে তিনি যে আদৌ আসতে রাজি হয়ছেন, তাতেই ধন্য আঞ্চলিক শ্রম দপ্তর, তাম্রলিপ্ত। 


অগত্যা শান্তনুকে বললাম, তুমিই পরাও। থোড়াই পদ মর্যাদা দেখবেন রবি বাবু, রবির আলোকে তো সবাই সমান, ‘হে মহান, নেমে এসে তুমি যারে করেছ গ্রহণ,সৌন্দর্যের অর্ঘ্য তার তোমা-পানে করুক বহন।’ 


নতুন ইন্সপেক্টর দ্বয়ের প্রথম অ্যাসাইনমেন্ট ছিল,সবাইকে দিয়ে গান আর আবৃত্তি করানো। দেখলাম লম্বা তালিকা প্রস্তুত। প্রাথমিক জড়তা, কাটিয়ে, দপ্তরী পদমর্যাদা তথা সংকোচ ভুলে সবাই খোলা মনে উজাড় করে দিল, শ্রদ্ধার ডালি নিয়ে। নিজেদের মধ্যে যে এত প্রতিভা লুকিয়ে আছে কেউ কি জানত, সবই যে তাঁর মহিমা। বাঙালির প্রাণের ঠাকুর কি সাধে কয়।


Saturday 7 May 2022

অনির ডাইরি ৩০শে এপ্রিল, ২০২২

 


রাত আটটা। বাইরে মুষলধারে  বৃষ্টি পড়েই চলেছে। সাথে তীব্র ঝড়ো হাওয়া। প্রায় আধেক ঘন্টা ধরে একই অবস্থা। বিরক্ত হয়ে মেসেজ করলাম,‘ আমি যদি না যাই, তোরা কি খুব দুঃখ পাবি?’ বৈশাখীর গলাটা এমনিতেই ভয়ানক মিষ্টি, আরো মিষ্টি লাগে যখন কাঁদো কাঁদো গলায় অনুনয় বিনয় করে। ‘এমন করিস না অনি। আমার এত দিনের শখ। তুই আমার জন্য তমলুক থেকে হাওড়া এলি, আর এইটুকু আসতে পারবি না? প্লিজ আয়।’ যাব এবং অনেকক্ষন থাকব বলেই না সংসার গুছিয়ে, বিকেল পাঁচটা নাগাদ শ্রীমতী তুত্তুরীকে নিয়ে তমলুক থেকে বেরিয়েছি। সাতটা নাগাদ হাওড়ার বাড়িতে ঢুকে, ব্যাগটা রেখে, মায়ের হাতের এককাপ চা খেয়েই দৌড়াব, এমন বাদ সাধল প্রকৃতি। বৈশাখীর জন্মদিনে কালবৈশাখী, কি আজব সমাপতন মাইরি। 


 যাঁরা আমার অনির ডাইরির নিয়মিত পাঠক, তাঁরা সকলেই জানেন, আর যাঁরা জানেন না, তাদের উদ্দেশ্যে বলি, আমাদের স্কুলের নাম ছিল তারাসুন্দরী বালিকা বিদ্যাভবন। আমাদের বেড়ে ওঠার দশক গুলিতে, হাওড়া জেলার অন্যতম সেরা তথা মেয়েদের সেরা স্কুল ছিল আমাদের বিদ্যলয়। তারা সুন্দরীর প্রাক্তনী হিসেবে আজও আমরা নিজেদের "তারা" বলে পরিচয় দিতে অত্যন্ত শ্লাঘা বোধ করি। স্কুল ছেড়েছি প্রায় সিকি সেঞ্চুরী হতে চলল, আজও চৈতালীর ভাষায়,আমরা ‘বেঁধে বেঁধে থাকি,বেঁধে বেঁধে রাখি।’ ফেসবুক হোয়াটস্অ্যাপে একে অপরের হাঁড়ির খবর তো রাখিই, তাছাড়াও ছলছুঁতো খুঁজতে থাকি,সামনাসামনি মিলিত হবার। 


আধিকারিক-সাংসারিক- বৃহত্তর পারিবারিক, সামাজিক যাবতীয় চরিত্রে প্রথাসিদ্ধ রূপদান করার সফল/বিফল প্রচেষ্টার মধ্যেও আমরা ঠিক সময় খুঁজে নিই একে অপরের জন্য। সময়ের স্রোতের বিপক্ষে সাঁতার কেটে, ভৌগলিক দূরত্বকে তুড়ি মেরে আজও সরস্বতী পুজোর দিন হলুদ পোশাকে আমরা সমবেত হই বুড়ো স্কুলটায়। সবাই হয়তো পারি না, সবসময় হয়তো পারি না, তবুও দোলপূর্ণিমার সন্ধ্যায় চৈতালীদের ছাতে আবির মেখে ভাঙের আসর না বসালে কেমন যেন অসম্পূর্ণ থেকে যায় আমাদের বসন্তোৎসব। নববর্ষের প্রাক্কালে আমাদের বাড়ির দোতলায় সাদা লাল পোশাকে জমে ওঠে আমাদের বর্ষবরণ। সব তারাদের জন্য গুণে গুণে বেল আর জুঁই ফুলের মালা কিনে আনে অনিন। আমার বিয়ের খোঁপার কাঁটা আর হেয়ারপিন,যা পরম যতনে গুছিয়ে রেখেছিলেন শাশুড়ি মা, ব্যাগ খুলে উল্টে দেয় তুত্তুরী। আহাঃ মাসিরা মাথায় ফুল লাগাবে যে- 


প্রথম কাশফুল ফোটার সাথে সাথেই চড়তে থাকে আমাদের উন্মাদনার পারদ। কোথায়, কবে দেখা হবে তারাদের? কোথায় হবে প্রি-পুজো খাওয়াদাওয়া, কোথায় বসবে পুজোর তারার হাট? এমনি কোন আড্ডায় একবার বলেছিল বটে বৈশাখী,‘জানিস, আমার খুব ইচ্ছে, তোদের সাথে জন্মদিন পালন করার। তোরা আসবি?’ তখন তো সবাই বলেছিলাম, অবশ্যই যাব। পৃথিবী উল্টে গেলেও যাব। তারপর যা হয়, সব স্মৃতি, সব প্রতিশ্রুতির ওপর জমে সময়ের ধুলো। ‘কিছু ভুলেছ তুমি, আমিও গেছি ভুলে’। 


ঘোরতর আপিস টাইমে বৈ যেদিন ফোন করে মনে করায়, প্রাথমিক অভিব্যক্তিটা ছিল, ভাগ ব্যাটা। সপ্তাহের মাঝখানে জন্মেছিস কেন? দীর্ঘ বাদানুবাদের পর দেখা গেল,  এ বছরটায় অন্তত তিনি সপ্তাহান্তেই জন্মেছেন। তাও আসল জন্মতিথিতে আর পৌঁছে উঠতে পারলাম না আমরা। এক সাথে এক ডজন তারার সহাবস্থান কি মুখের কথা? বিশেষতঃ এই দুর্দম গরমে। আজ এর বাচ্ছার জ্বর, তো কাল সে শৌচালয়ে শয্যা পাতে। 


হয়তো আরো পিছিয়ে যেত, যদি না কোন এক ভোরের বাতাস সুদূর পুরুলিয়া থেকে বয়ে আনত বিশেষ বার্তা,‘ আমি আসছি। তোরাও আয় ভাই।’ দেবু আর বৈ উভয়েরই জন্মতিথি এক। বার বার কাতর অনরোধ করছিল বটে বৈ,‘ আয় দেবু এক সাথে কেক কাটি।’ আমরা কেউ স্বপ্নেও ভাবিনি, প্রিয় বন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে সত্যিই পুরুলিয়া এক্সপ্রেসে চেপে বসবে দেবু। অত দূর থেকে দেবু আসতে পারলে, একটা নদী এপার ওপার করতে পারব না আমরা?


শনিবার বিকেল পাঁচটায় যখন তুত্তুরী সহ রওণা দিলাম তমলুক থেকে, তখনও রোদের দমকে ভাপ ছাড়ছে উত্তপ্ত মাটি। ঝকঝকে আকাশ। মোবাইলে টুং টাং মেসেজ, ‘কটায় ঢুকছিস?’ ‘কি পরছিস?’ ' এই গরমে শাড়ি পরার নামও করিস না' ইত্যাদি প্রভৃতি। হাওড়ায় ঢোকার সাথে সাথেই কেমন যেন বদলে গেল মরশুম। প্রথমে ঠাণ্ডা হাওয়ার ঝলক, তারপরই প্রবল ঝড় এবং মুষলধারে বৃষ্টি। একে তো আবহাওয়ার চোখ রাঙানি, তার ওপর আমার মায়ের রক্ত চক্ষু। এত রাতে, এই আবহাওয়ায় তুত্তুরীকে নিয়ে বন্ধুদের সাথে ধিঙ্গিপনা মায়ের কিছুতেই মাথায় ঢোকে না। 


একাধারে আমার গর্ভধারিণী অপরদিকে প্রকৃতির যুগ্ম চোখ রাঙানিকে উপেক্ষা করে আধ ভেজা অবস্থায় বৈ এর বাড়ি যখন পৌঁছালাম, রাত সোয়া আটটা। তুত্তুরীর কান বাঁচিয়ে বর্ষিত হল একরাশ খিস্তিখেউড়, আসব না বলার গর্হিত অপরাধে। অপরাধই তো। শুধু আমাদের জন্য, কি খাটুনিই না খেটেছে সদ্য জন্মানো দুই তারা। বিগত দুদিন ধরে ক্ষেপে ক্ষেপে বাজার করেছে বৈ, আজ সকাল থেকে ছানাপোনা সহ আমাদের জন্য সবটুকু নিজ হাতে রেঁধেছে। পুরুলিয়া থেকে হাওড়া স্টেশনে নেমেই ছুটে এসেছে দেবু। হাত লাগিয়েছে প্রাণের সহচরীর সাথে। 


জানলার বাইরে প্রকৃতির রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে নাচ,গান, আনন্দ,হুল্লোড়ের কয়েকটা ঘন্টা যে কিভাবে কেটে গেল। কব্জি ডুবিয়ে নৈশাহার সেরে,  রাত পৌনে বারোটার সময় যখন গলির মুখে নামিয়ে দিল রাখি, ঘুমিয়ে পড়েছে পুরো পাড়া। এমনকি পাড়ার সারমেয়গুলোও  কুণ্ডলী পাকিয়ে গভীর নিদ্রামগ্ন। আমার বৃদ্ধ-বৃদ্ধা তখনও অভুক্ত অবস্থায় আমাদেরই জন্য প্রতীক্ষমাণ। যথারীতি মায়ের 'এত সাহস ভালো নয়' এর সাথে বাবার, ' হ্যাঁ, হ্যাঁ, খুব ভালো। আমরাও তো এমনিই ছিলাম,নাকি। ১৯৫৮র স্কুল ফাইনালের ব্যাচ আমাদের, ২০১৬ অবধি এমনিই উদ্দাম আড্ডা, ফিস্ট, ফ্যামিলি ফিস্ট করে কাটিয়ে দিয়েছি আমরা। তারপর কি যে হল, একে একে অন্য দুনিয়ায় পাড়ি দিল অনেকে, বাকিরা এমন অসুস্থ, স্থবির হয়ে পড়ল, কেউ কেউ হাওড়া শহরের পাট গুটিয়ে ছেলেমেয়ের কাছে অন্য শহরে চলে গেল,  নাহলে দেখতিস আজও হত আমাদের আড্ডা। আর তুই তো আমারই মেয়ে। বেশ করেছিস।' এই না হলে আমার বাবা। মুখ হাত ধুয়ে, পথ শ্রম আর হইচই পর্বের ক্লান্তিতে যখন ঢুলে আসছে চোখ, ভেসে এল সেই চিরাচরিত স্নেহ আর ভালোবাসায় জবজবে কথা গুলো, ' হ্যাঁ রে, পেট ভরে খেয়েছিস তো? নাকি আমাদের সঙ্গে একটা রুটি খাবি-। দুটো রুটি বেশি করেই করেছি কিন্তু ’ অন্য সময় হলে হয়তো হেসেই গড়িয়ে পড়তাম, আজ কেন জানি না, মনটা খারাপ হয়ে গেল হঠাৎ। ভালোবাসার এই মুহূর্তগুলো কেন যে এত স্বল্পস্থায়ী। খেতে তো পারব না, তবুও একটু না হয় এমনিই বসি ডাইনিং টেবলে। জানি গল্প শুনতে উন্মুখ হয়ে আছে দম্পতি। গল্প বলতে বলতে বন্ধুদের সাথে চলুক ছবি দেওয়া নেওয়া, আরো বহু বহু বছর যেন এভাবেই একে অপরের অ্যালবাম ভরিয়ে রাখতে পারি আমরা। ট্যাগ হোক, ত্যাগ নয়।

অনির ডাইরি ১লা মে, ২০২২

 


‘দিদি কাল আমার সাথে যাবে?’ যাঁর উদ্দেশ্যে বলা, তিনি ঘোলাটে দৃষ্টিতে ছাতের কড়িকাঠের দিকে তাকিয়ে ছিলেন এতক্ষণ। সম্পর্কে আমার বাবার দিদি, কিন্তু আমরা চার খুড়তুতো জেঠতুতো ভাইবোন এমনকি আমাদের ছানাপোনারাও দিদি বলেই ডাকে। ৮৬টা বসন্ত কাটিয়ে ৮৭র দিকে পা বাড়িয়েছে দিদি। একমাত্র হাই প্রেশার ছাড়া ঈশ্বরের কৃপায় কোন ব্যধি নেই আমার পিসি থুড়ি দিদির। ইদানিং কানে একটু কম শুনছে, আর হাঁটুর ব্যথাটাও অল্প বেড়েছে। তাই নিয়েই দিনরাত কাজ করে চলে পিসি। অপ্রয়োজনে চার বার ঝাঁট দেয় গোটা বাড়ি। এঁটো বাসন পড়ে থাকতে দেখলেই দৌড়ে গিয়ে মেজে দেয়।  খুড়তুতো ভাই অয়ন সেদিন বিরক্ত হয়ে বলছিল,‘বয়স্ক লোকজনকে কোথায় বলতে হয়, অত বসে থেকো না। একটু নড়াচড়া করো। আর আমাদের দিদিকে দেখ, একে হাত জোড় করে বলি তুমি একটু সুস্থির হয়ে বসো, অত কাজ করতে হবে না। তাও শোনে না।’ অমনিই আমার পিসি। 


আজ শ্রীমান অনিন্দ্যর জন্মদিনের পার্টি। আমরা অর্থাৎ আমি আর তুত্তুরী হাওড়ায় গেলেই একটা না একটা পার্টি হয়ই। ‘পার্টি’ শব্দটা নিছক গৌরবার্থে ব্যবহার করি আমরা, আসলে তিন প্রজন্ম মিলে সামান্য খাওয়া দাওয়া। একটু গানবাজনা। চৈতি অর্থাৎ আমাদের আদরের ভাতৃবধূর নাচ আর রাত সাড়ে বারোটা- একটা অবধি চুটিয়ে আড্ডা, এই আর কি। অনিন্দ্যর আসল জন্মদিনটা হয়ে গেছে সেই মার্চ মাসের শেষের দিকে। তখন সিমলিপালের জঙ্গলে বেড়াতে গিয়েছিলাম আমরা। তারপর যতবারই অনিন্দ্য(এঃ ডাকনামটা বাদ দিয়ে পোশাকি নামে ডাকতে কি অস্বস্তিই না হচ্ছে।) খাওয়াতে চায়, কিছু না কিছু কারণে পিছিয়ে যায় ব্যাপারটা। এবারে তাই হাওড়ায় আসার আগে, যেচেই পার্টি আদায় করেছি আমি আর তুত্তুরী। 


কেক কাটার তালে তালে দারুণ জমে উঠেছে আমাদের পার্টি। আমাদের আনন্দে সামিল হতে আবহাওয়াটাও হঠাৎ যেন ভোল বদলে ফেলেছে। একতলার বসার ঘরটায় হৈ হৈ করে এসে ঢুকছে  তুমল ঠাণ্ডা হাওয়া। সেই হাওয়ায় ভিজতে ভিজতেই পিসিকে বললাম,‘কাল সকালে আমার সাথে তমলুক যাবে দিদি?’ বুড়ো পিসির চোখে হাজার ওয়াটের আলো জ্বলে উঠেও নিভে গেল। ‘আমি কি পারব?’ 


সবাই মিলে বললাম, পারবে না মানে? মাত্র দুটো দিনের তো ব্যাপার। সোমবার ভোরে বেরোব আর বুধবার বিকেলে ফিরে আসব। ঈদ যদি সোমবার হত, তাহলে আর এভাবে তমলুক ফিরতে হত না।  আমাদের হক বাবু বলেও ছিলেন,‘ঈদ সম্ভবতঃ সোমবারই হয়ে যাবে ম্যাডাম।’ আমিও আশায় আশায় ছিলাম। একটু আগেই হক বাবু জানালেন, ঈদ মঙ্গলবার। অর্থাৎ কাল আপিস যেতেই হবে। শ্রীমতী তুত্তুরী অবশ্য থেকেই যাবেন। ঈদের ছুটি কাটিয়ে ফিরবেন। তখন না হয় আমার সাথে ফিরে আসবে পিসিও। 


শ্রীমান অয়ন বলল,‘ তবে দিদি, দোহাই যে শাড়ি গুলো বাড়িতে পরো,সেগুলো নিয়ে যেও না। আর প্রেশারের ওষুধটা অবশ্যই নিও। আর চশমাটাও। নাঃ থাক, দাঁড়াও আমিই গুছিয়ে দেব তোমার ব্যাগটা।’ কটা বুড়ি পিসিকে এত ভালোবাসে তার ভাইপোরা কে জানে! 


বাচ্ছা আর বয়স্কদের খাইয়ে আমাদের খেতে বসতে বসতে রাত সাড়ে বারোটা। পিসি তখনও দোদুল্যমান। হয়তো মানসিক সমর্থন পেতেই বলল, ‘অনেকদিন তো এ বাড়ি ছেড়ে কোথাও যাইও নি বল-’। ঠিক কাকে উদ্দেশ্য করা বলা কেউ বুঝল না, অয়ন বলল, ‘ আরে দিদি মন খারাপ করছ কেন? আজ রাতে ফুরফুরে মন নিয়ে ঘুমিয়ে পড়ো, কাল উত্তম কুমার আসবে তোমায় নিয়ে যেতে।’ ‘অ্যাঁ উত্তম কুমার? সে আবার কি?’ ভেবলে গিয়ে প্রশ্ন করে পিসি। হেসে কুটোপুটি খেতে খেতে অয়ন বলে, ‘কেন ওর ড্রাইভারের নাম যে উত্তমকুমার তুমি জানো না।’ অতঃপর ‘ তিন ভাইপো ভাইঝি আর দুই নাতি নাতনীর সম্মিলিত চিৎকার, ‘ভদ্দর ঘর কি লড়কি থুড়ি বুড্ডি ভাগি ডেরাইভার কে সাথ-’। রাত একটা অবধি 'ছোঃ ছোঃ ছোঃ কেয়া শরম কি বাত' চলল আমাদের। এরপর কখন যে পিসি ব্যাগ গুছাবে আর কখন যে ঘুমাবে ভগবান জানে। আপাতত আমি ঘুমাতে গেলাম, কাল ভোর ভোর বেরোব আমরা, উত্তমকুমারের গাড়ি চেপে।