Wednesday 23 June 2021

অনির ডাইরি, ২৩শে জুন, ২০২১

 অনির ডাইরি, ২৩শে জুন, ২০২১


আপিস ফেরতা দরজায় কড়া নাড়লেই, টের পাওয়া যায় প্রবল হট্টগোল। ভেসে আসে উচ্ছ্বাসে ডগমগ কলকাকলি, ‘মা এসেছেএএএএএ। আমিইইই খুলব’। ঝণাৎ করে দরজার ছিটকানি খুলে মুখ বাড়ায় কেউ, ‘মা। আমি আজ কোন অপাট করিনি। ’ দিনান্তে সন্তানকে বুকে পাবার টলটলে আবেগ পলকে ফুস্ করে কোথায় যেন উবে যায়। ধড়াস করে ওঠে অভিজ্ঞ জননীর হৃদয়। আজ আবার কি কেলো বাঁধিয়েছিস বাবু?


যাকে প্রশ্ন করা, তিনি ততোক্ষণে গভীর মনোযোগ সহ ব্যস্ত হয়ে পড়েন অঙ্ক করতে। এত দ্রুত মা আসার উচ্ছ্বাস থেকে মনোযোগী ছাত্রী হয়ে যাবার মধ্যেও কেমন যেন অন্য গন্ধ পায় মা। টের পায়, বাপ-মেয়ের মধ্যে ইশারা-ইঙ্গিতে চলছে কোন গভীর ষড়যন্ত্র। একজনের মুখে, ‘বলে দেব নাকি’ মার্কা দেখন হাসি। আর অপর জনের চোখেমুখে কাতর বিনতি, ‘প্লিজ বোলো না বাবা। ’ অথচ তাকালেই, দিব্যি ভালো মানুষের মত কফির কাপে চুমুক দেয় একজন। অন্যজন তো অঙ্কে মগ্নমৈনাক। কাল সকালে খাতা দেখতে বসে চুল ছিঁড়ব আমি, সাতটা অঙ্কের মধ্যে করা হবে মাত্র চারটে। বাকি তিনটে নাকি দিয়ে, কেটে দিয়েছি আমিই। রোজই নাকি অমন করি। লিখতে দিই, তারপর কেটে দিই। অস্বীকার করলে ঘোঁট পাকিয়ে ঝগড়া করতে আসে বাপ আর মেয়ে।  


আজ যদিও, ততোটা ঐক্যমত মনে হল না। বরং বেশ ঘুষ দিতে ইচ্ছুক বলে মনে হল, এক পক্ষকে। অপর পক্ষ যেন আরো একটু দর বাড়াতে ইচ্ছুক।  কর্মক্লান্ত দিনের শেষে এমন টেনশন তথা রহস্যময়তা কার ভালো লাগে মাইরি। গভীর মনোযোগ সহ পর্যবেক্ষণ করি, সবকিছুই তো গোটাগুটিই লাগছে। আমার সাধের গাছপালা, আমার অবশিষ্ট গুটি কয় লিপস্টিক, কাজল পেন্সিলের মাথা, আধ শুকনো নেলপলিশ, আমার B আর Z বোতাম হারানো ল্যাপটপ, আমার বর, আমার মেয়ে সবই তো অটুট। তাহলে ঘটিয়েছেন কি শ্রীমতী অঘটনঘটনপটিয়সী? 


ধৈর্য্যচ্যুতি ঘটে বিকট দাঁত কিড়মিড় করার পর জানা যায়, তেমন কিছুই না। শোবার ঘরে, ফুটবলে লাথি মারা প্র্যাকটিশ করতে গেলে যা হয় আর কি, ফুটবলটি যথাস্থানে থাকলেও একপাটি চপ্পল সোজা আত্মগোপন করে মস্ত বাক্স-পালঙ্কের  নীচে মাঝবরাবর। তবে আমার চিন্তার কোন সম্যক কারণ নেই, মাটিতে দীর্ঘক্ষণ গড়াগড়ি খেয়ে, গোটা দুয়েক ফুলঝাড়ু এবং ঝুলঝাড়ুর সম্যক ব্যবহারে শেষ পর্যন্ত তাঁকে উদ্ধার করেছেন শ্রীমতী তুত্তরী।


 ভুল বললাম, উদ্ধার তো করেছেন বাবা, তুত্তরীর হাত অত লম্বা থোড়াই? তবে শ্রীমতী তুত্তরীও উদ্ধার করেছেন বৈকি, খাটের নীচে নিরূপদ্রবে আস্তানা বানানো বিস্তর চুল আর ঝুল। যাদের চিহ্ন শোবার ঘরের মেঝে জুড়ে তো বটেই, এমনকি এখনও জবজবে করে লেগে আছে কন্যার গা তথা মাথাতেও। সাফাইওয়ালি বাড়ি না থাকলে যা হয় আর কি। 

উফঃ মাগো। মা হওয়া কি মুখের কথা। হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি, মা।

অনির ডাইরি ২১শে জুন, ২০২১

 অনির ডাইরি ২১শে জুন, ২০২১

#Happy_Fathers_day

 #কোন_দিনটা_বাবা_দিবস_নয়

আমার এই নাতিদীর্ঘ জীবনে, মাত্র দুই বার কাঁদতে দেখেছি বাবাকে। প্রথম বার, ২৩শে জানুয়ারী, ২০০৫। রাত বোধহয় দশটা। ছোট ক্যাম্প খাটে শুয়ে আছে ঠাকুমা, অক্সিজেন চলছে। ক্যাথিটার লাগানো। নড়তে চড়তে, কথা বলতে কিছুই পারে না তখন ঠাকুমা। শুধু তাকিয়ে থাকে। খাওয়ার সময় হলে, নাকে লাগানো নলে, একটা মস্ত বড় সিরিঞ্জ লাগাই আমি, আর আস্তে আস্তে তাতে ঢেলে দি, সিদ্ধ সব্জির স্যুপ বা ফলের রস। এক্কেবারে তরল। থাকে না কোন দানা বা পাল্প।  তারপর ইঞ্জেকশন দেবার মত করে ঢুকিয়ে দি ঠাকুমার শরীরে। ডাক্তার জবাব দিয়েই দিয়েছেন, এইভাবে যে কটা দিন চলে। নাঃ কোন আয়া রাখা হয়নি ঠাকুমার জন্য। বাবা- ছোটকাকু- পিসি আমার দুই খুড়তুতো ভাই হামেহাল পড়ে আছে ঠাকুমাকে নিয়ে। দুবেলা ছুটে আসছে দিদিভাই। বিছানাতেই বড় কাজ করে ফেলছে ঠাকুমা, ছোট্ট শিশুর মত, আদর করে তা সাফ করে দিচ্ছে দিদিভাই বা পিসি। আমার কাজ বলতে শুধু টাইমে টাইমে নাক দিয়ে ওষুধ আর লিকুইড খাবার খাওয়ানো।  


এরই মাঝে আমার জন্মদিন। বাড়িতে মুমূর্ষু রোগী থাকতে আবার জন্মদিন কিসের, তুবও ওরই মধ্যে সামান্য মিষ্টি, জ্যাঠাইমার এনে দেওয়া পেস্ট্রি। রাত দশটা নাগাদ, ঠাকুমাকে ঘিরে জমে উঠেছে গল্প। ক্যাম্প খাটে ঠাকুমার পায়ের কাছে বসে আছে ছোটকাকু, তার পাশে দাঁড়িয়ে বাবা। অদূরে ঠাকুমার সাবেকী কাঠের পালঙ্কে বসে আছে মা, আমি আর পিসি। আচমকা খেয়াল করল মা, কখন যেন থেমে গেছে ঠাকুমার হৃদস্পন্দন। একটু আগেও সামান্য অক্সিজেনের জন্য হাপরের মত ওঠানামা করছিল যে শরীরটা, হঠাৎ যেন চরম প্রশান্তিতে ঘুমিয়ে পড়েছে সে। আশঙ্কার কথা জানাতে জাস্ট উড়িয়েই দিল ছোটকাকু। ‘কি যা তা বলছ। মা ঘুমিয়ে পড়েছে বোধহয়। ’ বাবা কিন্তু এত সহজে ফেলল না মায়ের কথা গুলো, পাগলের মত একবার ঠাকুমার বুকের ওপর হাত রাখল,তারপর অক্সিজেন সিলিণ্ডারটার দিকে। তারপর কি যে হল, হাঁটু মুড়ে বসে পড়ল বাবা,সমস্ত মুখ পলকে হয়ে গেল টকটকে লাল। হেঁচকি তুলে গুমরে গুমরে কাঁদতে লাগল বাবা।  কনিষ্ঠ তথা ঠাকুমার সবথেকে আদরের সন্তান ছিল আমার ছোটকাকু। বোধহয় বাবার ঐ আকস্মিক শোক দেখেই কাঁদতে পারেনি ছোটকাকু। বাবাকে জড়িয়ে ধরে, বারবার বলেই যাচ্ছিল, ‘আমি তো আছি। তুই কাঁদছিস কেন?’ 


আর দ্বিতীয় বার কাঁদতে দেখেছিলাম, ২৫ শে মে, ২০০৯। আকাশ- বাতাস জুড়ে শুধুই আয়লার আগমন বার্তা। ঝমঝমে বৃষ্টিতে ভেসে যাচ্ছে মহানগর। বৃষ্টির দাপটে ঠকঠক করে কাঁপছে জানলার কাঁচ। তারই মধ্যে শ্বশুরবাড়ি চলেছি আমি। বাসর জাগার প্রভাবে, রীতিমত ঢুলছে শৌভিক। ঐ বৃষ্টি মাথায় নিয়ে ছুটে এসেছে দাদারা,বৌদিরা, সুজাতা বৌদি আর আমার দুই প্রাণাধিকা সহেলী সঞ্চিতা আর পম্পা। বাসরে ঘেঁটে যাওয়া মেকাপ, ধেবড়ে যাওয়া সিঁদুরকে গুছিয়ে-গাছিয়ে নতুন করে বেনারসী আর গয়না পরে বউ সাজছি আমি। যত সময় যাচ্ছে, ততো পারদ চড়ছে বাবার। যত শীঘ্র আমায় বিদায় দিতে পারে ততোই যেন শান্তি। 


আমাকে ঠেলে শ্বশুরবাড়ি পাঠানোর মূল দায়িত্বে আমার ছোটমাসি। আমি তো জানিই না ছাই, শ্বশুরবাড়ি যেতে হলে এত জিনিস বগলদাবা করে নিয়ে যেতে হয়। ছোট বলে বলে দিচ্ছে, গায়ে হলুদে আসা জিনিসপত্র, তার সাথে সাথে বাড়িতে পরার পোশাক পরিচ্ছদ সব গুছিয়ে তত্ত্বে আসা মস্ত ভিআইপিতে ঢোকানো হচ্ছে সবাই মিলে। কি যে ঢোকাচ্ছে দেখতেও দিচ্ছে না ছাই, তাকালেই গাঁট্টা মারছে সঞ্চিতা, চন্দন ঘেঁটে যাচ্ছে নাকি। মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে ফিসফিস করে জানতে চাইছি আমি, ‘হ্যাঁ রে, টাকা দিয়েছে শৌভিক?’ টাকা অর্থাৎ জুতো চুরির টাকা।  বোনপো রণি আর পম্পা-সঞ্চিতাতে মিলে জুতো লুকিয়েছিল বিয়ের পর। শৌভিকও টাকা দেবে না, ওরাও ছাড়বে না।এদিকে দেরী হয়ে যাচ্ছে নৈশ ভোজের, নব দম্পতির সাথে ভোজন করবে বলে বসে আছে বাড়ির লোক, মায় আমার আশি বছরের জেঠুও। শেষে খালি পায়েই  খেতে নামছিল শৌভিক, হাঁ হাঁ করতে করতে নিজের জুতোটাই খুলে দিয়েছিল বাবা। ‘বাবা জামাই,আমার জুতোটাই পরো।’ কেলেঙ্কারির একশেষ। সুড়সুড় করে জুতো ফিরিয়ে দিয়েছিল রণি। তারপর থেকে নতুন বরকে জপিয়েই যাচ্ছি। কিছু টাকা দে না বাপ। কত আশা করে জুতো চুরি করেছে ছেলেমেয়েগুলো।  


বড় উত্যক্ত  করছিল বাবা, শুনতেও দিল না, কত টাকা দিয়েছে। গিয়ে বসলাম আশির্বাদের আসনে। সবার আগে আশির্বাদ করবে বড়জেঠু আর জেঠিমা। কেঁদে কেঁদে হেঁচকি উঠছে জেঠিমার। ঝরঝর করে কাঁদছে বুড়ো জেঠুও। তারপর বড়মাসি। পিসি। আরোও কারা কারা যেন। বাবাকে ডেকেই যাচ্ছে সবাই, ‘ও মেসো। ও কাকু এসো না। ’ নীচে থেকে দোতলায় আর আসেই না বাবা। মা আমার পাশে  বসে, বাচ্ছা মেয়ের মত কেঁদেই যাচ্ছে। অবস্থা খারাপ আমার ছোট মাসির। কাকে ছেড়ে কাকে সামলায়। এরই মধ্যে লৌকিকতা। সবাইকে চা দেওয়া। ক্রমেই খারাপ হচ্ছে আবহাওয়া। অথচ বাবা আশির্বাদ না করলে কি যেতে পারি আমি। 


কে যেন ধরে আনল বাবাকে। নীচে কোন তদারকিতে ব্যস্ত ছিল কে জানে। লজ্জিত হয়ে উঠে এল। বেতো হাঁটু মুড়ে বসল কোন মতে, দুটো ধান দুর্বো নিল, তারপরই, সমস্ত মুখ পলকে হয়ে গেল টকটকে লাল। হেঁচকি তুলে গুমরে গুমরে কাঁদতে লাগল বাবা। মাত্র কয়েক মুহূর্তের জন্য। তারপর ছুটে পালাতে গেল বাবা, এবার খপ করে চেপে ধরলাম আমি, সেই দশ বছর বয়স থেকে বিয়ে করার শখ, ঠিক এমনি করে, লাল চেলী পরে, কপালে চন্দন, এমনি প্রিয়জন পরিবৃত হয়ে, বন্ধুদের শুভাশিস আর শুভেচ্ছা মেখে, আলোর রোশনাই আর আতরের সুবাসে সুবাসিত হয়ে, স্বপ্নের পুরুষের হাত ধরে তার রাজ্যে পাড়ি দেব আমি। সব স্বপ্নই তো সত্যি হল, কিন্তু তার সাথে সাথে যে বাবা এবং মাকে ছেড়ে যেতে হবে এই সামান্য হিসেবটুকু কেন যে মাথায় আসেনি। ‘ও বাবা, বাবা গো। তুমিও চলো না আমার সঙ্গে। কি ভাবে বাঁচব বাবা, তোমাকে আর মাকে ছেড়ে? কিভাবে টিকব এই চেনা পরিমণ্ডল আর চেনা গন্ধগুলোকে ছেড়ে-।


আজও প্রতি মুহূর্তে এই একই কথা বলে যাই আমি, প্লিজ বাবা, আর কয়েকটা দিন, আর কয়েকটা বছর প্লিজ থেকে যাও বাবা। আমি সেদিন তোমায় ছেড়ে এসেছিলাম, বলে তুমি যেন আমায় ছেড়ে যেও না বাবা। কি ভাবে বাঁচব বাবা, তোমায়/ তোমাদের ছেড়ে---

অনির ডাইরি ১৮ই জুন, ২০২১

 

বাকিরা এখুনো না পোস্টাইলেও, ইতিমধ্যে অনিন, রাখি, সঞ্চিতা, অনুশ্রী, অস্মিতা এবং আমার ফেবু ফেরেন্ডরা  নিশ্চয় জেনেই গেছেন, যে আষঢ়স্য প্রথম দিবসে ছিমতী চৈতালীর ঝুলি থেকে বেরিয়েছে একঝাঁক  বিলাই😺😺।


তাইলে খুলেই বলি শুনুন, এক্ষেত্রে ঝুলি হল গিয়ে ছিমতী চৈতালীর বিখ্যাত ক্যামেরা।  যাকে আমাদের অনুশ্রী আদর করে নাম দিয়েছে ‘খেলনা’। সেই যে গলির ঋষি কাকুর  দোকানে বিক্রি হত না, পাঁচ সিকে বা দেড় টাকার প্লাস্টিকের ক্যামেরা, যা চোখের সামনে ধরে, মুখে ব্যাপক খচাৎ খচাৎ আওয়াজ করতাম আমরা ছোট্টবেলায়। একটু দামী হলে,  যার আয়তাকার বাক্স থেকে বেরিয়ে থাকত, হ্যারিকেনের পলতে তোলার মত একখানি তারের আঙটা, সেই আঙটা ঘোরালে ভিতরে পরপর উঠত-নামত জয়াপ্রদা, জিতেন্দ্র, শ্রীদেবীর রঙীন ছবি।  তেমনি খেলনা।


 প্রতিটা গেট্টুতেই যে খেলনা, চৈতালী সাধ করে তুলে দেয় টিনটিন বাবুর হাতে। টিনটিন হল আমাদের অন্তু ওরফে অন্তরার সুপুত্তুর। টিনটিন অতীব সুবোধ বালক, কিন্তু ক্যামেরা হাতে পাবার পর যা হয় আর কি। প্রতি গেট্টু শেষে যখন বাড়ি ফেরার জন্য আড়ামোড়া ভাঙি আমরা অথবা সারা রাত ঠাকুর দেখে যখন পূবের আকাশে ফোটে প্রথম আলো, টিনটিন কাঁচুমাচু হয়ে জানায়, চৈতালীর ক্যামেরার ঢাকাটি নিরুদ্দেশ। অতঃপর, আকাশ পাতাল জুড়ে ধ্বনিত হয় টিনটিনের জননীর বজ্রনির্ঘোষ, পিটিয়ে ছাতু করার হুঙ্কার, চামড়া দিয়ে ঢোল বানিয়ে ডুগডুগি বাজানোর প্রতিশ্রুতি এবং চৈতালীর প্রবল গজগজানি। যুগপৎ  টিনিটিনের জননীর ক্রোধ এবং চৈতালীর বিরক্তির খোঁচায় আমরাও উথাল পাতাল করে খুঁজতে থাকি, কিছু একটা। খুঁজতে খুঁজতে সমুদ্র মন্থনের মত উদ্ধার হয় অনেক কিছুই- রুমাল, খুচরো পয়সা, মাথা ভাঙা পেন, চকলেটের লুকানো মোড়ক। সবশেষে অমৃতের মত কারো না কারো পকেট থেকে মুখ বাড়ান তিনি। ক্যামেরা ঢাকা- 


তো যাই হোক, এ হেন ঝুলি বা খেলনা বা ক্যামেরা যে নামেই ডাকুন না কেন, তা নিয়ে প্রতিবার নানা কসরৎ করে ছবি তোলে চৈতালী। এখানে দাঁড়া- ওখানে বোস- ঘাসের ওপর শুয়ে পড় মার্কা নির্দেশ শুনে তটস্থ হয়ে উঠি আমরা। ঘাসে শুলে পাছে মাথায় ইয়ে, উকুন টুকুন হয়, তাই ওটা অবশ্যি আমরা করি না। বাকি যা বলে, চিত্রনাট্যে যতটুকু থাকে তার থেকে বেশীই করি আমরা। 


রঙ-ঢং, লাস্যহাস্য মেখে ছবি তো তোলা হয়, কিন্তু সে ছবির মুখ আমরা চট করে দেখতে পাই না। দরের ফটোগ্রাফাররা বোধহয় এমনি হয়। বিরক্ত হয়ে অনুশ্রী ওটার নাম দেয় খেলনা। আরও নানা খারাপ খারাপ কথা বলি আমরা, সে তো বলবই, আমরা হলাম খাস হাওড়ার মেয়ে, তারাসুন্দরী বালিকা বিদ্যাভবনের ছাত্রী, একে অপরের সন্দর্শনে  ভদ্র ,পরিশীলিত, সুচারু ভাষায় বার্তালাপ করলে, কান দিয়ে রক্তক্ষরণের সমূহ সম্ভবনা থাকে। 


কিন্তু এবারে বিলম্বিত লয়ের যাবতীয় রেকর্ড চূর্ণবিচূর্ণ করে মাত্র দুই মাসের মধ্যে খেলনা ক্যামেরার ঝুলি থেকে আত্মপ্রকাশ করেছে চৈতালীর চিত্রসমূহ। সেই গুলিই হল বিলাই  বা মেকুর বা বিল্লিদাস যা বলেন আপনারা। 


আর পাঁচটা প্রতিভাধর উন্নাসিক চিত্রগ্রাহকদের মতোই, নিজের কাজের কঠোরতম সমালোচক চৈতালী। কোন ছবিই তার তেমন মনঃপূত হয়নি।নিজের কাজের সমালোচনা করার পূর্ণ অধিকার চৈতালীর আছে,  তবে দীর্ঘ অদর্শনের খরার পর একসাথে জমায়েত হওয়া এক ডজন উদ্বেল বাল্যবন্ধু আর তাদের এক ডজন দুষ্টুমিষ্টি বাচ্ছাকে নিয়ে সরগরম আমাদের হাওড়ার বুড়ো বাড়িতে, সকলকে সুসংবদ্ধ ভাবে দাঁড় করিয়ে, ছবি তোলা যে কতখানি দুষ্কর, তা ছবি গুলো পরপর দেখতে থাকলেই বোঝা যায়- 


 যেমন ধরুন, দলবদ্ধ প্রথম ছবিটিতে প্রথমা ওরফে শ্রীমতী অনিন ওরফে অনিন্দিতা রায় মুখার্জী একগাল হেসে লাস্যময়ী চারুলতা হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলেও, দ্বিতীয়া অর্থাৎ আমাদের রাখি ঘুরে গেছে ১৮০ডিগ্রী। হাত নেড়ে পিছনে দাঁড়ানো সঞ্চিতাকে ঠিক কি যে বলছে রাখি, তা শোনা না গেলেও, মনে পাপ থাকলে একনজরে মনেই হতে পারে, যেন বলছে, ‘আমার গ্লাস থেকে এক চুমুক খেয়ে দেখবি নাকি-’। জবাবে বুঝি বিগলিত হেসে তৃতীয়া সঞ্চিতা বলছে, ‘দে তাহলে এক চুমুক-’। তার পিছনে সাদাকালো বাঙলা সিনেমার নায়িকাদের মত বঙ্কিম হেসে অপাঙ্গে অনুশ্রী কি বলছে ‘টুকি’?  তার পাশে যথারীতি অর্ধনিমিলিত চক্ষে ঢুলন্ত আমি, আমার মাথায় দিব্য গাল রেখে ক্লান্ত চোখ মেলেছে দেবীকা। যেন ছবি তোলা হলেই ঢুলতে বসব দোঁহে, দেবীর পিছনে সপ্তমী এ্যাঞ্জুলা পরিপাটি,নিভাঁজ, নিখুঁত বটে তবে অষ্টমা দেবযানী খিলখিল করে হাসছে,‘ওরে আমার মাথায় গামছা কেন রে?’ পুরাণ বাড়িতে গেট্টু করবে, আর হাওড়া স্পেশাল গামছা শুকাবে না এটা আশা করা বাপু এট্টু বাড়াবাড়ি না। দেবুর পাশে  নবমী-দশমীকে দেখে  মনেই হতে পারে বৈশাখীর হাত ধরে টানছে অন্তরা, ‘সামনে চল, না হলে ভালো ছবি উঠবে না। ’ সবশেষে একাদশী অস্মিতার শুধু মুণ্ড খানি দৃশ্যমান। দু চোখে করুণ দৃষ্টি, ‘ওরে তাড়াতাড়ি কর রে মেয়েগুলো- ।বাড়ি ফিরতে দেরী হলে, মা আর আস্ত রাখবে ভেবেছিস? ’ ঠিক যেভাবে, স্কুলে বলতাম আমরা- । 


তার পরের ছবিতে অবশ্য সম্পূর্ণ গায়েব অস্মিতা। ওখানেই তো ছিল, ছবিতে উঠল না কেন, বুঝ যে জন।  নিখুঁত মুহূর্তটিকে ক্যামেরা বন্দি করার তালে দশমী অন্তরার মুখেচোখে, মূল্যবান সময় নষ্ট হয়ে যাওয়ার মৃদু উদ্বেগ। কিঞ্চিৎ গোলপানা হয়েছে প্রথমা অনিনের বদন। ঘর্মাক্ত ত্বকে পিছলে যায় বাবার সাবেকী টিউবলাইটের সাদা আলো। স্বভাবসিদ্ধ ফাটাফাটি পোজ দিয়েছে দ্বিতীয়া রাখি। পেশায় শিক্ষিকা, তৃতীয়া সঞ্চিতা কে জানে, কাকে আঙুল দেখিয়ে বলছে, ‘ কান ধরে ক্লাসের বাইরে বের করে দেব! দেখবি?’ সঞ্চিতার হাতে আবৃত চতুর্থী অনুশ্রীর বদন, ফলে তার বিভঙ্গ এক্ষেত্রে কিঞ্চিৎ রহস্যাবৃত বটে, তবে আমি ঠিক কি করছি বুঝতে পারলাম না। সম্ভবতঃ হাত পা নেড়ে সঞ্চিতাকেই সমর্থন করছি আমি। দে সব কটাকে কান ধরে দাঁড় করিয়ে 😊😊।   পিসার হেলানো টাওয়ার থেকে ঘরের পাশের অক্টারলোনি মনুমেন্টের মত খাড়া হয়ে দাঁড়িয়েছে বটে দেবিকা, তবে তিনিও পেশায় শিক্ষিকা কি না,  মুখে মাখামাখি পেশাসুলভ গাম্ভীর্য। সপ্তমী এ্যাঞ্জুলা যে পেশায় খাদ্য বিশেষজ্ঞ, তা তার ঋজু অপরূপ বিভঙ্গে সুস্পষ্ট প্রতীয়মান।   রীতিমত টেক্কা দিচ্ছে প্রথমা এবং দ্বিতীয়ার সাথে। অষ্টমী দেবুর মাথার পিছনে  পূর্ণবিক্রমে দ্রষ্টব্য  নীলচে গামছা খানি। দেবুর খিলখিলে হাসি সীমানা ছাড়িয়ে বাংলাদেশ অবধি প্রসারিত। 


তৃতীয় ছবিতেও একেক রকম কর্মকাণ্ডে ব্যাপৃত একেক জন। দেখতে দেখতে, একে অপরের মনের ভাব, দৈহিক বিভঙ্গ বিশ্লেষণ করতে করতে উছলে ওঠে খুশির নদী। পলকে বিস্মৃত হয় অসুস্থ পৃথিবী, পেশাগত চাপ, গৃহবন্দি সন্তানদের জন্য  সযতনে লালিত দুঃশ্চিন্তা সমূহ। বিস্মৃত হয় জীবনের যাবতীয় জটিলতা। সময়ের চাকা বুঝি নিয়ম ভেঙে আজ রওণা দেয় পিছন পানে।  চিত্রগ্রাহিকা হিসেবে চৈ যতই খুঁত খুঁজে বার করুক না কেন, মন বলে,


 ‘ - ফিরে এসো, ফিরে এসো, চাকা,

রথ হয়ে, জয় হয়ে, চিরন্তন কাব্য হয়ে এসো ।

আমরা বিশুদ্ধ দেশে গান হবো, প্রেম হবো, অবয়বহীন সুর হয়ে লিপ্ত হবো পৃথীবীর সব আকাশে ।’ 



Wednesday 16 June 2021

অনির ডাইরি ১৬ই জুন, ২০২১

 


ঠাকুমা প্রায়ই বলতো,‘জন-জামাই-ভাগনা তিন নয় আপনা।’ কিন্তু নাতজামাইয়ের ক্ষেত্রে বোধহয় এ নিয়ম প্রযোজ্য ছিল না। চাটুজ্জে বাড়ির বড় জামাই শ্রী সিদ্ধার্থ ব্যানার্জী ওরফে আমাদের টুলটুল দাদা ছিল আক্ষরিক অর্থেই সবার নয়নমণি।  


দিদিভাইয়ের যখন বিয়ে হয়েছিল, তখন আমার বয়স বছর চারেক, বুল্লু বাবুর বাবা শ্রীমান অয়ন তখন সদ্য তিন আর কাকা শ্রীমান অনিন্দ্য সবে দাঁড়াতে শিখেছে। বাকি তুতো ভাইবোনদের অবস্থাও তথৈবচ। ফলে দিদির বিয়ের স্মৃতি বেশ অস্পষ্ট, সাদাকালো,ধোঁয়া-ধোঁয়া।


 শুধু মনে পড়ে, সদর দরজার বাঁ হাতে খোলা বাগানে ম্যারাপ বেঁধে পংক্তিভোজের আয়োজন হয়েছিল। টেবিলে পাতার জন্য যে পাতলা মোম কাগজ কেনা হয়েছিল, তার বেশ কিছু রোল বেঁচে যায়। যা দিয়ে পরবর্তী কালে বাড়ির খাতা বানিয়ে দিত বাবা। বিশাল উঠোনে ম্যারাপ বেঁধে সম্পন্ন হয়েছিল বিবাহের আচারবিধি। স্বহস্তে বড় নাতনীকে সম্প্রদান করেছিলেন ঠাকুমা। 


পশ্চিমের বাগানে বড় বড় মাটির উনুন বানিয়ে হয়েছিল রান্নাবান্না। তবে সবার আগে বসেছিল ‘ভিয়েন’। শুভ কাজ উপলক্ষে বাড়িতেই মিষ্টান্ন প্রস্তুত করাকে আমাদের মধ্য হাওড়ার ভাষায় বলে ভিয়েন। চাটুজ্জে বাড়ির যাবতীয় শুভকাজের বিশেষত্বই ছিল ঘরে তৈরি দরবেশ। লাড্ডু পাকানোর আগে ভেজে তোলা লাল-হলুদ বোঁদের পাহাড়,জীবনে সেই প্রথম দেখা। 


সাবেকী বিশাল রান্নাঘরে মাটির উনুনে গড়ে হয়েছিল নিরামিষ রান্নাবান্না। জগন্নাথ ঠাকুর আদতে ছিলেন উড়িষ্যার বাসিন্দা। এ দেশীয়া রমণীকে বিবাহ করে, গলির মুখে একখানি ‘উড়ের হিন্দু হোটেল’ খুলে বসেছিলেন। যাবতীয় শুভকর্মে নিরামিষ রান্নার দায়িত্ব বরাবরই জগন্নাথ ঠাকুরকেই সমর্পিত হত। মনে আছে নিরামিষ হেঁশেলকে ঘিরে বয়স্কাদের আড্ডা। কে ছিল না তাতে? ঠাকুমা, বড় পিসিমা, মুন্সিরহাটের পিসি, বাবার পিসিরা,বাবার মাইমারা। কে জানে অন্য কোনও জ্যোতিষ্কে হয়তো আজও একই রকম ভাবে আড্ডা বসিয়েছেন তাঁরা। 


মনে আছে দিনের বেলা রান্নাঘরের সামনের রোয়াকে কলাপাতা পেতে খেতে বসানো হয়েছিল যাবতীয় কুচোকাচা তুতো ভাইবোনেদের এবং রীতিমত রাবণের মত অট্টহাস্য করে কেমন আমার পাতে হিসি করে দিয়েছিল বছর দুই আড়াইয়ের পিসতুতো ভাই নয়ন। সেটাই প্রথম বা শেষ নির্যাতন নয়, কেন যে আমার প্রতি এমন প্রেম ছিল ব্যাটার। দিব্যি মনে আছে গায়ে হলুদের অব্যবহিত পূর্বে ছিছি মার্কা অপকর্ম করে ব্যাপক ধোলাই খেয়েছিলাম মায়ের হাতে। 


মনে পড়ে স্বর্গীয় ছোটকাকু আর তাঁর বয়স্য গোপাল কাকুর সাথে বর আনতে গিয়েছিলাম আমিও। মনে পড়ে  দক্ষিণ-পূব-পশ্চিম খোলা দোতলার দালানে এক রাশ ভেলমেটে মোড়া তাকিয়া আর প্রচুর কুচো ফুল ছড়িয়ে বাসর সাজানো হয়েছিল দিদিভাই আর টুলটুল দাদার জন্য। সারা সন্ধ্যা যাতে গড়াগড়ি দিয়ে খেলা করছিলাম আমরা কুচো চিংড়ির দল। বিবাহ কার্য সমাপনে যখন বাসরের দিকে হাঁটা লাগিয়েছে নবদম্পতি, সিঁড়ির দরজা আটকেছিল অন্য দিদিরা। টাকা না দিলে খুলবে না বাসর ঘরের দরজা। বর পক্ষও নাছোড়বান্দা, দরকার কি বাসরঘরের? এই তোরা সিঁড়িতেই বসে পড় তো। ধপ করে কারা যেন বসিয়ে দিল দিদিভাই আর টুলটুল দাদাকে। তারপর কি হল? কারা জিতল? তা অবশ্য জানি না। টুলটুল দাদা কোন টাকাপয়সা দিয়েছিল কি না, তাও জানি না। দিয়ে থাকলেও আমাদের ভাগ দেয়নি কেউ।  আর দিলেও যে সেই টাকা নিয়ে কি করতাম, তাও জানি না। 


পরদিন সবাইকে কাঁদিয়ে হাত নাড়তে নাড়তে দিদিভাইয়ের শ্বশুরবাড়ি চলে যাবার কথাও খুব মনে পড়ে। যদিও আজ মনে হয়, ওটা আমার শৈশবের নিছক কল্পনা ছিল, দিদিভাই মোটেই সায়রা বানুর মত ‘ম্যায় চলি, ম্যায় চলি’ করতে করতে শ্বশুরবাড়ি যায়নি। 


বিয়ের পরও চলতে থাকে কত যে অাচার- অনুষ্ঠান। বছরে কতবার যে তত্ত্ব পাঠাত জ্যাঠাইমা আর জেঠু তার ইয়ত্তা নেই।  পুজোয় পোশাকপরিচ্ছদের তত্ত্ব, শীতে গুড়- পাটালি-মোয়ার তত্ত্ব, গরম কালে আম-কাঁঠাল-লীচুর তত্ত্ব। জেঠু-জ্যাঠাইমার সাথে থালা ভর্তি দ্রব্যাদি নিয়ে আমরাও যেতাম। আর যেত দেবীদি আর মনসা দা। দিদিভাইয়ের সমবয়সীই ছিল দেবীদি। এখনকার ভাষায় গৃহশ্রমিক, তবে আমি বা অয়ন- অনিন্দ্য দিদি বলেই জানতাম।  আর মনসা দা ছিল এক নিঃসহায় বৃদ্ধ। সন্ধ্যা বেলা কালিবাড়ির মন্দিরে কাঁসরঘন্টা বাজাত মনসা দা। আর টুকটাক ফাইফরমাশ খাটত।আশির দশকের হাওড়া প্রায়শই ডুবে যেত বিদ্যুৎহীনতার আঁধারে। অন্ধকার গলিঘুঁজি দিয়ে টর্চ হাতে এগোত জেঠু, পিছন পিছন লাইন দিয়ে চার আনা- আট আনার দল। সবার পিছনে অতন্দ্র প্রহরীর মত টর্চ জ্বেলে জেঠাইমা। আমাদের সে কি উৎসাহ দিদিভাইয়ের বাড়ি যাবার বাপস্।  গেলেই দিদিভাইয়ের শাশুড়ী মাতা গরম গরম দুর্লভ কেবিনের মোগলাই পরোটা আর মল্লিক সুইটসের রসগোল্লা খাওয়াবে যে-  


আর জামাই ষষ্ঠী এলে তো কথাই নেই। দেড়শো বছরের ফোকলা বাড়িটা যেন ঝলমলিয়ে উঠত। সক্কাল সক্কাল ফোঁটা নিতে আসত টুলটুল দাদা। ঠাকুমার কাঁপা কাঁপা হাতের ফোঁটার পর, মস্ত পিতলের রেকাবি ভর্তি ছয় রকম ফল সহ বাড়ির একমাত্র জামাইয়ের হাতে হরেকরকম মিষ্টি, নতুন পোশাক তুলে দিত জ্যাঠাইমা। জ্যাঠাইমার মত সাজিয়ে দিত না বটে, তবে শুধু টুলটুল দাদার জন্যই থলে ভরে বাজারের সেরা আম আর সবথেকে বড় মিষ্টি কিনে আনত বাবা। আপিস বেরোবার আগে জামাই ফোঁটা দেবে যে মা। 


আসল ভুরিভোজ জমত রাতে। সারাদিন ধরে টুকটুক করে কত কি যে রান্না করত জ্যাঠাইমা। পিতলের রেকাবি, পিতলের বাটি,কাঁসার গ্লাসে সাজিয়ে দেওয়া হত সুখাদ্য। টোপাটোপা সাদা ময়দার লুচি, খাসির টকটকে ঝাল, মাংসের পুর ভরা পটলের দোলমা আরো কত কি। বরবধূ ছাড়াও আমন্ত্রিত থাকত আরো বেশ কিছু মান্যগণ্য অতিথি। দাদাভাই-সোমাদি অর্থাৎ টুলটুল দাদার দাদা-বৌদি তো ছিল আমাদের ঘরের লোক।  আজও চাটুজ্জে বাড়ির যাবতীয় শুভ কর্মে স্বমহিমায় ভাস্বর থাকেন দোঁহে, ওণারা ছাড়াও আরো অনেকে। খাওয়া দাওয়ার ফাঁকে দিদিভাই আর সোমাদিকে জপাত জ্যাঠাইমা-‘হ্যাঁ রে, মাত্র একটাতেই তোদের হয়ে গেল? এখনও সময় আছে, আরো একটা নে-’। দুই তরুণী জননী শুনেই আঁতকে উঠত, রক্ষা করো মা/মাসি , একে রামে রক্ষে নেই-। 


তারপর কত জল বয়ে গেল গঙ্গা দিয়ে। বদলে গেল কত দশক। হারিয়ে গেলেন কত প্রিয়জন। মুচে গেল কত সম্পর্ক। সাদাকালো জীবনে লাগল রঙের ছোঁয়া। জামাই হয়ে এল শৌভিক। শ্বশুর হয়ে দাদু হয়ে গেল টুলটুল দাদা। সেদিনের 'ম্যায় চলি, ম্যায় চলি' করে হাত নেড়ে শ্বশুরবাড়ি যাওয়া দিদিভাই আজ জাঁদরেল শাশুড়ি মা। পঞ্চব্যঞ্জন রেঁধে ফোঁটা দেয় জামাইকে। মাঝে মাঝে তাই মনে হয়, কুশীলব বদলে গেলেও চিত্রনাট্য বোধহয় থেকে যায় অবিকৃতই।

Saturday 12 June 2021

অনির ডাইরি, ১০ই জুন, ২০২১

 


#বুনো_তেউড়ির_ফুল


সরকারি চাকরগিরির বৈশিষ্ট্যই হল, বারংবার আপনার অপারগতাটুকুকেই বড় করে দেখা। আর সাফল্যটুকুকে চুপড়ি চাপা দিয়ে রাখা। ওটা তো আপনার কাজ মশাই,নিজের কাজটুকু করার জন্য আবার বাহবা চান নাকি? 


ভাগ্যে আমার ওপরওয়ালারা এমন নন। প্রোবেশন পিরিয়ডের হাকুচ তেঁতো, পাঁচন এবং পিছন মার্কা অভিজ্ঞতা টুকু বাদ দিলে, বারবরই আমার ওপরওয়ালা এবং ওয়ালীরা যুগিয়ে গেছেন পূর্ণ সমর্থন, করে গেছেন চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস। আর নীচের তলা প্রমাণ দিয়ে গেছে অখণ্ড নির্ভরশীলতার। আগের দিনেও বলেছিলেন অরুণ বাবু, ‘ম্যাডাম, এতো গুলো লোক, তারপর যখনই জানাজানি হবে, এখানে ভ্যাকসিন দেওয়া হচ্ছে, হামলে পড়বে আসেপাশের মানুষ। আগের দিন এনিয়ে ব্যাপক মারামারি হয়েছে। কি ভাবে সামলাব আমরা? আপনি সিভিক পুলিশ রিকুইজিশন করুন। ’ করিনি আমি। ভরসা ছিল আমার টিমের ওপর, কতজন আসবে? কত লোক আসে আমাদের মেলায়? নূন্যতম হাজার?তারওপর থাকে ভিআইপি আর স্থানীয় সাংবাদিকদের ভিড়, যারা হেলায় ঐ জনপ্লাবন সামলে দেয়, তাদের কাছে এতো নিছক নস্যি।   


কে বলবে লক ডাউন? চলছে না গাড়িঘোড়া? পৌনে দশটার মধ্যেই চুুঁচুড়ার হাইমাদ্রাসায় জমায়েত হয়ে গিয়েছিল আমার টিম। নাঃ আমি যাইনি। আমি বসেছিলাম অফিসে। জনৈক স্নেহশীল বড়দা বারবার বলছিলেন ফোন করে, ‘তুই একবার যা। গিয়ে দেখ তো, কোন সমস্যা হচ্ছে কি না?’ আমি যাইনি। কারণ, জানতাম আমি গেলেই তৈরী হবে সমস্যা। উথলে উঠবে অভিমানের ঝাঁপি। ওরা জানে, আমি পাশেই আছি, যে কোন সমস্যায় শুধু একটা ফোনের দূরত্ব।  


আমার কাজ শুধু মাথা ঠাণ্ডা রাখা, আর ফোন করে যাওয়া পরপর। লোক জমায়েত হল কি? ভ্যাকসিন এল কি? কি বলছেন আরো ল্যাপটপ লাগবে? ওয়াইফাই লাগবে? এই আশঙ্কাই করেছিলাম, কপালের নাম গোপাল। মঙ্গলবারের বজ্রপাতে দেহ রেখেছেন আপিসের অর্ধেক কম্প্যুটার আর যাঁরা জীবিত তাঁরা ইন্টারনেট কি বস্তু বুঝতেই পারছেন না। বাধ্য হয়ে তুত্তুরীর ক্লাশ করার জিওফাইটা ব্যাগ বন্দি করে নিয়ে এসেছি। ও রমেশ, এসে নিয়ে যা বাবা। পাসওয়ার্ড কেবল সোমনাথের মোবাইলেই পাঠাব। বড় ভালো ছেলে আমার সোমনাথ। সাঁওতাল বলেই বোধহয় এত ভালো, এমন সাদাসিধে- ‘সোমনাথ দেখো বাবা,ঐ ওয়াইফাই দিয়ে ইস্কুল করে তুত্তুরী, এমন কিছু কেউ খুলো না,যে তুত্তুরী আমায় প্রশ্ন করে, ‘মা এটা কি বস্তু?’ লজ্জায় মাটিতে মিশে যায় সোমনাথ।  


এগারোটা বেজে যায়, রমরমিয়ে শুরু হয়ে যায় শ্রীরামপুর আর আরামবাগের ছুঁচ ফোটানো কর্মসূচী। চুঁচুড়ার কি হল? নির্মল? অরুণ বাবু? চালু করলেন আপনারা? রমেশ আর বর্মন সাহেবের ল্যাপটপ আর তুত্তুরীর ওয়াইফাই নিয়ে প্রস্তুত আমাদের সোমনাথ আর বাদল, বাইরে জমে উঠেছে জনপ্লাবন, কিন্তু পোর্টালের মুখ ভার যে। ঢুকতেই দিচ্ছে না আমাদের। তা হ্যাঁ পোর্টাল, আমাদের ওপরই কেন এত ক্ষোভ বাপু তোর? শুরু হতে হতে সাড়ে বারোটা বাজালি? আর একটা ল্যাপটপ হলে ভালো হত, শুনে মাটিতে মিশে যাই আমি, আমার ল্যাপটপ খানা আনলেই হত, কিন্তু প্রথম কথা তাতে ক্লাশ করছেন কেউ আর দ্বিতীয়তঃ তার কিবোর্ড থেকে B এবং Z অক্ষর দুটি কে জানে কি ভাবে যেন গায়েব হয়ে গেছে। এই নিয়ে প্রতি দিনই চলে দোষারোপ তথা পাল্টা দোষারোপের পালা। যতক্ষণ না তিতিবিরক্ত শৌভিক চিৎকার জোরে, ‘তোরা দুটোই সমান অলম্বুষ। ’ 


বাইরে থেকে ক্রমেই ঢুকে আসছে অন্য মানুষজন, প্রিয়াঙ্কা-সমীর-প্রদীপ-শান্তনু-আশিস সামলাতে সামলাতে বেদম, ‘দাদা আজ এখানে শুধু লেবার দপ্তরের লোকজনেরই ভ্যাকসিনেশন। ছুঁচ তো গোনাগাঁথা। আপনারা বরং সদর হাসপাতাল বা পৌরসভায় চলে যান। ’ তাও আসতে থাকে অনুরোধের ঠেলা, ‘আমি লেবারের লোক না হলেও, আমার মামাতো কাকার পিসেমশাই লেবারে চাকরি করেন। ’ প্রিয়াঙ্কা গম্ভীর মুখে জানায়,লিস্টে নাম নেই।  কখনও বা আসে মৃদু হুমকি, ‘আমি অমুক দাদার লোক।  দাদা বলে দিয়েছেন।’ দাদা দেখালেই এগিয়ে যায় নির্মল, ‘ভাই আমাদের হাতে তো ছুঁচ নেই, ওটা স্বাস্থ্যদপ্তর দেখবে। আপনারা বরং দাদাকে বলুন, ওণাদের জানাতে। ’ আবার কখনও বা আসে মরমী অভিমান, ‘আমি লেবারের নই বলে কি আমায় দেবেন না? তাহলে শুধু আপনারাই বাঁচুন। আমার আর বেঁচে থেকে লাভ নেই। ’ এত করুণ-কঠোর বাক্যবাণ হজম করতে পারে না আমার টিম। নির্মল তাকে আদর করে বসায়, ‘ভ্যাকসিন নেবেন তো? একটু বসুন। দেখছি।’ তারপর ফোন করে আমায়, ‘একে ফেরাতে পারব না ম্যাডাম। ’ 


সাড়ে বারোটা বেজে যায়। সকাল সকাল এক কৌটো ঘরে তৈরি আমসত্ত্ব দিয়েছিল সায়নী, টেনশনে তার অর্ধেক সাফ করে ফেলি আমি। উপহার হিসেবে পাওয়া যায় এক কৌটো সূর্য মোদকের পান্তুয়া আগেভাগে সরিয়ে রাখে ধীমান। ‘ম্যাডাম এটা খুলবেন না কিন্তু। এটা তুত্তুরীর জন্য। ’


সাড়ে বারোটা বাজে। পোর্টালের বাঁদরামির জন্য এখনও শুরু হয় না ভ্যাকসিনেশন। আর এক কাপ চা পেলে ভালো হত, কিন্তু কালেক্টরেটের দুই চাওয়ালাকেই জবরদস্তি ভ্যাকসিন দিতে নিয়ে গেছে ধীমান। স্থানীয় স্বাস্থ্য অধিকর্তা আশ্বস্ত করেন, ‘ঘাবড়াচ্ছেন কেন, আধঘন্টায় আপনার লাইন ফাঁকা করে দেবো আমরা।’ তবে পোর্টালের অভিমান তখনও হয় না দূর।  আপাততঃ ম্যানুয়াল এন্ট্রি মারতে থাকে সোমনাথ আর বাদল। দুটোর মধ্যে ময়দান সাফ। হোয়াটস্অ্যাপ ভরে ওঠে টিম চুঁচুড়ার বিখ্যাত, ‘ভি-সেলফি’তে।  মাম্পি এসে দিয়ে যায় এক ব্যাগ চারাগাছ আর নদীর পলিমাটি।  কি নেই তাতে-মানিপ্ল্যান্ট থেকে লতানে পান, সিঙ্গোনিয়ামের ঝাড় থেকে ক্যালাঞ্চো। কারি পাতা থেকে ইংলিশ ক্রিপার আর একগাদা গুঁড়ি গুঁড়ি ফুলের গাছ। সাথে এক বস্তা বালিও বয়ে এনেছে মেয়েটা, অল্প করে ছড়িয়ে দিতে হবে শিশিতে রাখা গাছের জলে। পাগল মেয়েটার জন্যই এই গরমেও আমাদের অফিসে ডানা মেলেছে থোকা থোকা পুদিনা। লতিয়ে বাড়ছে পার্পল হার্ট। খাড়া হয়ে দাঁড়িয়ে আছে কি যেন একটা পাতা বাহার গাছ। এক হাতে গাছ,অন্য হাতে বালি আর বগলে খোন্তা নিয়ে আমার চেম্বারে ঢোকে মেয়েটা। ঢোকার আগে আপিসের গাছগুলোর মাটি খুবলে এসেছে। তিনবার প্রশ্ন করে মেয়েটা, ‘বালি নেবেন না?’ না রে বাবা। এতো গাছ নিয়ে যাবার অপরাধেই হয়তো নির্বাসন দেবে বর আমার-। তারওপর এককলসি বালি কোথায় রাখি? 


গঙ্গাপাড়ের বুড়ো ডাচ কলোনিতে নামে মেঘলা বিকেলের স্নিগ্ধতা । নির্মল জানায়, ওণারা বিদায় নিলেন, এবার আমাদের পোর্টালে এন্ট্রি করা আর মেসেজ পাঠানোর পালা। তাতে লাগবে ঢের সময়। রাত আটটা তো বটেই। জেলাতুতো আধিকারিক বোন আর স্বাস্থ্য দপ্তরের আধিকারিকদের মেসেজে ধন্যবাদ জানাই। এতদিন ধরে আমাকে সহ্য করা কি কম বড় কথা! আর বড়দির কাছে জানাই, রাত আটটা বাজবে মনে হচ্ছে। দুটো ল্যাপটপ আর তিনটে মোবাইল মিলিয়ে কাজ করছে আমার টিম তাও-। বড়দি জানেন, মাঝেমধ্যে অমন সুখী সুখী ঘ্যানঘ্যান করি আমি। বড়দি বলেন ,‘সাবধানে থেকো, মেয়েমেয়েগুলো কিছু ভালোমন্দ খাইয়ে দিও। ’ সে তো দেবোই,তবে আজ না। অন্যদিন, যেদিন কাজের অজুহাতে শুধু খেতেই জমায়েত হব সবাই, আজ খাওয়ালে উপভোগ করতে পারবে না কেউ। আজকের জন্য বড়জোর ঘড়ির মোড়ের ব্যানার্জীর দোকানের রুটি তড়কা বা প্রাক্তন বড় সাহেবের প্রিয় নৈশ ভোজ, রুটি আর আলুপোস্ত। তবে তার আগে, একপ্রস্থ ছবি তোলা হবে না, তা আবার হয়? সারাদিনের উত্তেজনায়, গায়েগতরে খাটুনিতে সবার মুখে জমেছে পুরু তেলের আস্তরণ, অবিন্যস্ত কেশবাস- তবে মুখে ঝলকাচ্ছে খুশির দীপ্তি। এই ছবির নাম থাক, ‘বুনো তেউড়ির ফুল।’ 


পুনশ্চঃ নামটা আমার খুড়তুতো ভাই শ্রী অয়ন চট্টোপাধ্যায়ের থেকে ধার নেওয়া। বাপের বাড়ির বুড়ো আঙিনায় ফুটে থাকা থোকা থোকা রঙবেরঙের একরাশ বুনো ফুলের নাম, অয়ন বাবু রেখেছে বুনো তেউড়ির ফুল। এরাও তেমনি আমার বুনো তেউড়ির ফুল। আর এই ডাইরি হল, উপরওয়ালা হিসেবে আমার বাহবা। খুব ভালো থেকো আমার বুনো তেউড়ির ফুলেরা। তোমাদের ভালোবাসাই এই চাকরি জীবনের শ্রেষ্ঠ উপহার। বাকিটা তো নিছক চাকরানী গিরি।

Wednesday 9 June 2021

অনির ডাইরি ৯ই জুন, ২০২১

 


মা হবার সবথেকে বড় সমস্যা হল, যে কোন সুখাদ্য আস্বাদন করতে গেলেই,  চোখের সামনে ভেসে ওঠে, একজোড়া কচি কচি কুৎকুতে চোখ। খেতে বড় ভালোবাসে মেয়েটা আমার। চুঁচুড়ার স্পাইসির স্পেশাল মটন বিরিয়ানির কাছে ওসব আপনাদের আরসালান, আমিনিয়া বা রহমানিয়া নেহাৎ শিশু। এক কৌটো সুবাসী ভাতের মধ্যে একখণ্ড তুলতুলে তোবলা আলু, তার নীচে লুকিয়ে থাকা একটি সিদ্ধ ডিম আর থুলথুলে একখান মাটন। 


কাল আমাদের মহারণ, তার আগে চাঁদা তুলে বিরিয়ানি খাওয়া। বলির আগে ইয়েকে কচি কাঁঠাল পাতা খাওয়ানোর সমতুল হলেও, খেতে আর পারলাম কই, কয়েক চামচ সুবাসী ভাত আর আলুটা খেলাম বটে, বাকিটা প্যাক করে ব্যাগে ঢোকালাম। বিরিয়ানির আলুটা মোটেই পছন্দ করে না তুত্তুরী, তবে আতরে জবজবে ভাত,মাটন আর ডিমটা বড় ভালোবাসে।


গাড়িতে বসে মোবাইল দেখলে, যেমন মাথা ঘোরে তেমনি গা গুলায়। পাপী পেটের ব্যাপার, ফোন করতে,ফোন ঘাঁটতে,রিপোর্ট মেলাতে, ফোন তুলে লোককে ধমকাতে, চমকাতে, মতামত চাইতে, মতামত দিতে, জনসংযোগ করতে ঘাঁটতেই হয় মোবাইল। অসম্ভব গা গুলোতে থাকায় নেমেই পড়লাম হাই রোডের ধারে। নীল দিগন্তে তখন ম্যাজিক। বজ্র বিদ্যুৎ সহ বৃষ্টিপাত হতে পারে নাকি কাল, যুগপৎ বাড়িতে শৌভিক আর আপিসে রমেশ ভয় দেখিয়েছে - হলেই চিত্তির। যাবতীয় কৃতকর্মের ওপর আইস টি।


ছোট্ট দোকান, দোকানের সামনের রোয়াকে পা দুলিয়ে বসে গল্প করছে তিন জোড়া কপোতকপোতী। বাকি অংশে  রাখা কয়েকটা হেলমেট। ভিতরে সৌম্য দর্শনা প্রৌঢ়া ছ্যাঁকছোঁক করে কি সব রান্নাবান্না করছেন। গরম অমলেটের সুবাসে মথিত রাজপথ। প্রশ্নের জবাবে ঘাড় নেড়ে জানালেন চা হবে। বড় ভাঁড় না ছোট ভাঁড়। প্রাক্তন বড়সাহেব থাকলে নির্ঘাত বলতেন, ‘সবথেকে বড় ভাঁড়। ’ স্যার অমনি ছিলেন। চা-তাল। তবে আমি বা সুবীর বাবু কেউই অত চা একসাথে খেতে পারি না। তাই একদম এক চুমুকে নিঃশেষ এমন ভাঁড় না হলেই চলে। চায়ের দোকানে কাঁচের বয়ামে রাখা বিস্কুটের প্রতি অসম্ভব শিশুসুলভ লোভ ছিল স্যারের। নিজেও খেতেন,  ড্রাইভার আর আমাকেও জোর করে খাওয়াতেন। কাঁচের বয়ামে রাখলে বিস্কুটগুলো কি একটু বেশী সুস্বাদু হয়ে যায়? রাজপথের ধারে এই চায়ের দোকানগুলোতে কত রকম যে বেকারী বিস্কুট পাওয়া যায়! আর পাওয়া যায় টিফিন কেক। নামী ব্রাণ্ডের দামী কেক নয়। ছোট্ট বেলার পাখির ছবিওয়ালা পার্পল রঙের প্যাকেটে মোড়া ফিলিপস্ বা হলুদ-সবুজ ওরাং-ওটাং রঙা বাপুজী। একটু বেশী মিষ্টি বটে,তবে ওগুলো চায়ে ডুবিয়ে খেলে মনে হয় সাক্ষাৎ অমৃত। সুবীর বাবুকে প্রশ্ন করলাম, ‘বিস্কুট খাবেন? আমি কিন্তু খাব। ’ দোকানের সামনে রাখা জলের বোতল থেকে ঢকঢক করে জল খাচ্ছিলেন উনি, মাথা নেড়ে জানালেন কিচ্ছু চাই না। তারপর ইশারায় সামনের রোয়াকটা দেখিয়ে বললেন, ‘বসুন না ম্যাডাম। ’ যেখানে বসতে বললেন,  সেখানে বিরাজমান দুটি জাব্দা হেলমেট। পাশের ছেলেটি, সঙ্কোচে হেলমেট সরিয়ে বলল ,‘বসুন না। ’ বসেই তো ছিলাম সারাদিন।  বসে বসেই ধরে গেল মাথা। বসব না বলার পর, ছেলেটি ইতঃস্তত করে প্রশ্নটা করেই ফেলল, ‘ট্রেন কবে চলবে?’ সরকারী বাহন দেখেই বোধহয় প্রশ্নটা করেছে ছেলেটা, কিন্তু এই প্রশ্ন তো আমারও। ট্রেন কবে চলবে? কবে চলবে ট্রেন? 


 স্টিলের থালায় দুটি ধুমায়িত ভাঁড় নিয়ে হাজির হলেন ভদ্রমহিলা। গরম চায়ে একচুমুক দিতেই জুড়িয়ে গেল মনপ্রাণ। হেসে বললাম, ‘কি করে জানব বাবা? তুই যেখানে আমিও সেখানে।’ সামনের কাঁচের বয়ামের ভিতরে রাখা বই গজাগুলো বড়ই সুন্দর দেখতে। গজা দিয়ে চা খেলে কি অ্যাসিড হবে? লোকে বলে বটে, তবে হাওড়ার ছেলেমেয়েদের ওসব হয়টয় না বোধহয়। দিদি একটা গজা দিন তো,আর কয়েকটা প্যাকও করে দিন। একটু কিটকিটে মিষ্টি বটে, তবে ভালো লাগবে নির্ঘাত মেয়েটার। নাঃ মা হওয়ার সত্যিই জ্বালা মাইরি!

অনির ডাইরি ৬ই জুন, ২০২১

 

তুত্তুরী বলল, ‘মা আই হ্যাভ আ ক্রাশ।’ আর মাসখানেক বাদে এগারোয় পড়বে, এই বয়সে ক্রাশ না থাকাটাই তো অস্বাভাবিক। আমার তো এর ঢেড় আগে থেকে ছিল। গোবিন্দা আহাঃ! বুধবারের চিত্রহার আর চিত্রহারে গোবিন্দা। দিদি-মাসি- পিসিরা তখন আকণ্ঠ নিমজ্জিত ইমরান খান আর ওয়াসিম আক্রমের প্রেমে। দিশি প্লেবয় বলতে রবি শাস্ত্রী। শাস্ত্রির অডি গাড়ি জেতা এবং শ্যাম্পেনের বোতল খোলা স্বচক্ষে  না দেখলেও, এত গল্প শুনেছিলাম বাপস্। মিঠুনও ছিল বটে। তবে মিঠুনের ভক্তবৃন্দের মধ্যে জুলফি ওড়ানো হুমদোদের সংখ্যাই ছিল বেশী। প্রথম প্রেম যদি কেশব হন, তো দ্বিতীয় প্রেম অবশ্যই ছিল গোবিন্দা। আর ১৯৮৯থেকে তো সবাইকে হঠিয়ে হৃদয়ের দখল নিয়েছিলেন জনৈক পাঁচ ফুট চার ইঞ্চির মারাঠি ছোকরা।  


যাই হোক, তুত্তুরীর কথায় ফেরা যাক। তুত্তুরীর যে ভয়ানক ক্রাশ তৈরী হয়েছে, তা শৌভিক এবং আমি প্রতিনিয়ত অনুভব করছি। গুগল বা ইউটিউব খুললেই দেখা যায় পদচিহ্ন ছেড়ে গেছেন শ্রীমতী তুত্তুরী। স্টার জলসায় বাংলায় ডাব করে দেখানো রাধা-কৃষ্ণ নামক সিরিয়াল এবং তার কুশীলবদের চূড়ান্ত অনুরাগিনী তুত্তুরী। অনুরাগের মাত্রা এতটাই চিটচিটে যে এক প্রস্থ  দুপুর বেলা বাংলায় দেখার পর, রাত নামলে পুনরায় হিন্দিতে ঐ একই সিরিয়াল দেখেন তিনি। ওই সিরিয়ালের প্রতিটি কুশীলবের নাম  ঠোঁটস্থ তাঁর। কবে, কার জন্মদিন গেল, কবে কে বিয়ে করলেন, সেই বিয়ে বা জন্মদিনের পার্টিতে কারা কারা উপস্থিত ছিলেন তা সবই শ্রীমতী তুত্তরীর নখদর্পণে। 


সম্প্রতি জনৈক সুমেধ মাডগালকার নামক অভিনেতার প্রতি একটু বেশিই দুর্বল তুত্তুরী। তাঁর চোখের রঙ নাকি সমুদ্র সবুজ। গায়ের রঙ দুধে আলতা। শ্রীকৃষ্ণ অমন দুধেআলতা বরণ কবে হলেন এসব প্রশ্ন করা অর্থহীন। এতে শ্রীমতী তুত্তুরীর উত্তেজনাই শুধু বাড়ে। এমনিতেই যথেষ্ট উত্তেজিত তুত্তুরী, ইউটিউবে কারা যেন সুমেধের সাথে কোন অভিনেত্রীকে জড়িয়ে অনর্থক কুৎসা রটাচ্ছে। ট্রোল করছে। 


যাই হোক, আবার ফিরে যাই, শ্রীমতী তুত্তুরীর ক্রাশের কাছে। খেতে বসে তুত্তুরী যখন জানাল, তাঁর একটি ক্রাশ তৈরী হয়েছে, তখন তো প্রশ্ন করতেই হয়, সেই ব্যক্তিটি কে? মাছের কাঁটা বাছতে বাছতে দুষ্টু হেসে জবাব দেয় তুত্তুরী, ‘রোহন মাডগালকর’। সে আবার কে? একটাই তো, মাডগালকরের কথা শুনে আসছি এযাবৎ। জবাব পেলাম, ইনি তাঁর প্রিয় পোষ্য বিশেষ। জাতে খাস সোনালী রিট্রিভার। সম্প্রতি সুমেধ মাডগালকরের কোন ভিডিওতে নাকি তাঁর সাথে পরিচয় হয়েছে তুত্তুরীর।  


দিবারাত্র বোকাবাক্সের কৃষ্ণনাম শুনে শুনে কান পচে গেল মাইরি। তাই বলতে গেলাম, কিছুদিন নাহয় ওকে স্টক করা ছাড়। বলেই পড়লাম ফ্যাসাদে। এবার বোঝাও স্টকিং কারে কয়?ভাগ্যে  গুগল ছিল, গুগল বলে স্টকিং এর সংজ্ঞা হল- মাত্রাতিরিক্ত তথা অযাচিত মনোযোগ দিয়ে কাউকে হয়রান করা। সামান্য ভিডিও দেখে কি করে সুমেধকে হয়রান করা হয়,  এই প্রশ্নের উত্তরে যখন নাকানিচোবানি খাচ্ছি, টেবিলের ওপার থেকে গম্ভীর মুখে বলে ওঠে শৌভিক, ‘এটাকে ঠিক স্টকিং করা বলে না। ও কি জানে তার টয়লেট রুটিন কি বা সে কি টয়লেট ক্লিনার ব্যবহার করে।’ অসাধারণ! এই পৃথিবীর যে কোন আলোচ্য বিষয়কে নিয়েই এরা বাপমেয়ে যে কিভাবে, ‘টয়লেট এক প্রেম কথা' বানাতে পারে, তা বোধহয় এই ডাইনিং টেবিলে না বসলে জানা সম্ভব নয়।  তেলেবেগুনে জ্বলে ওঠে তুত্তুরী।  কিছুতেই পরাস্ত হতে রাজি নন তিনি। সুমেধের প্রাতঃকৃতের শিডিউল তার অজ্ঞাত বটে,তবে তিনি এটা তো জানেন,  যে রোজ সকালে ঘুম  থেকে উঠেই সুমেধ চা বানায়। জবাবে বাবা বলে, ‘তা সে ও চা খেলে তো ওকেই বানাতে হবে।’ নাঃ মোটেই শুধু নিজে খাবে বলে বানায় না, সাথে সাথে   মা আর পিসিকেও চা বানিয়ে খাওয়ায় সুমেধ। তুত্তরী এটাও জানে  যে, চা খেয়ে বাগানে গাছে জল দেয় সুমেধ। তারপর? তারপরের পর্বটা না হয় উহ্যই থাকুক। এত কিছু লিখলে যদি সুমেধ জানতে পেরে যায়। তাহলে সেটা বড়ই লজ্জার ব্যাপার হবে।সুমেধ অবশ্য আমার ফ্রেন্ডলিস্টে নেই-ইয়ে আপনারাও বলবেন না কিন্তু।