Tuesday 9 August 2022

অনির ডাইরি ৫ই আগস্ট, ২০২২

 


জানলার বাইরে ডুবিছে দিনমণি। দেখতে দেখতে শেষ হয়ে গেল সপ্তাহটা। এই তো মনে হয় একটু আগেই বলছিলেন শ্বশুরমশাই, ‘বুঝলে, আমাদের দুই পুত্রবধূই খুব চটপটে।’ ঠিক সেই মুহূর্তেই গভীর মনোযোগ দিয়ে দইবড়া ভাগ করছিলেন শাশুড়ী মাতা, সেই দইবড়া যা আনানো হয়েছে শুধুই আমার তরে। আগাম সতর্ক করে রেখেছিলেন শ্বশুরমশাই, ‘যখন থেকে শুনেছে তুমি আসছ, একটাই কথা বলে গেছে, মেয়েটা অতদূর থেকে আসবে, ভাতও খাবে না, তাহলে ওকে যে কি খেতে দিই। তোমার জন্যই বিল্ডিং এর  সিকিউরিটি গার্ডকে দিয়ে আনিয়েছে। প্লিজ খেয়ে নিও। না বলো না। যা অভিমানী তোমার শাশুড়ী মাতা।’ শাশুড়ী মাতা আর তাঁর দুর্জয় অভিমান উভয়কেই বড় ভয় পাই আমরা দুই বউ, ভয় পায় আমাদের প্রিয় শ্বশুরটাও। শাশুড়ী মাতার মন এবং মান রাখতে ভাত খাবার অনুরোধ এবং আব্দার বেশ কয়েকবার করেছিলেন শ্বশুরমশাইও, শুনতে এবং রাখতে পারিনি। ভাগ্যে পারিনি, নাহলে এই সাড়ে চারটের সময় ভাত খেতে হত বাপ মেয়ে থুড়ি শ্বশুর পুত্রবধূকে। 


শ্রীমতী তুত্তুরীর সঙ্গে ভাত খেয়ে, তাঁকে ইস্কুলে পাঠিয়ে বেলা দশটা নাগাদ বেরিয়েছিলাম তাম্রলিপ্ত নগরী থেকে।  মধ্যাহ্নে মহানগরে পৌঁছে, শ্বশুরমশাইকে বগল দাবা করে রওণা দিয়েছিলাম নিউ টাউনের টাটা মেডিকেল ক্যান্সার হাসপাতালে। বেশ কিছুকাল যাবৎ পারিবারিক ডাক্তার বাবু সন্দেহ করছিলেন, যে পুনরায় বুঝি কর্কট রোগ বাসা বেঁধেছে বৃদ্ধের উদরে। কর্কট ব্যধি আর আমাদের শ্বশুরমশাইয়ের সম্পর্ক অবশ্য নবীন নয়, ইতিমধ্যেই দু বার সোজা ব্যাটে খেলে তাকে মাঠের বাইরে পাঠিয়েছেন ভদ্রলোক। প্রথমবার আমাদের বিয়ের অব্যবহিত পূর্বে, পাকস্থলীতে নন হজকিন্স লিম্ফোমা নামক ব্যামো ধরা পড়ে। কেটে বাদ দেওয়া হয় বেশ খানিকটা পাকস্থলী। নিতে হয় গোটা ছয়েক কেমো। তার জেরে আমাদের বিয়ের দিনই অনুপস্থিত ছিলেন বৃদ্ধ। সেজ জেঠু, ফুল কাকা, মণিকাকার আশির্বাদ আর ভালোবাসায় ভিজতে ভিজতেও নতুন কনে আমার দুই চোখ খুঁজছিল এক রুগ্ন ক্ষীণজীবী বৃদ্ধকে। হাতে হাত রেখে মন্ত্র পড়ার ফাঁকে ফিসফিস করে জিজ্ঞাসা করেছিলাম শৌভিককে, ‘বাবা আসেনি?’ 


এর ঠিক সাত বছর বাদে, আবার কর্কটের কামড় পড়ে বৃদ্ধের উদরে। এবার আক্রান্ত হয় কোলন। সে যাত্রা অবশ্যি কেমো নেবার দরকার পড়েনি। তারপর আবার ঠিক বছর সাতেক বাদে পুনরায় কর্কটের পদধ্বনি। বাড়ির ডাক্তার তো হাত গুটিয়ে নিলেন, পাঠিয়ে দিলেন ক্যান্সার বিশেষজ্ঞের কাছে। তিনি দেখলেন বেশ ভালো করে টিপেটুপে। প্রেসক্রিপশনে লিখলেনও NAD অর্থাৎ নাথিং অ্যাডভার্স ডিটেক্টেড। আরও একটা কি যেন লিখলেন যার অর্থ নো লিম্ফ নোড ডিটেক্টেড। তাহলে কি তিনি আসেননি এবার? এটা কি নিছক নিশির ডাক। পুঁচকে ডাক্তারবাবু গম্ভীর হয়ে বলেন, ‘সেটা এখনই বলা যাবে না। আমরা এথিক্যালি পারি না।’ দিলেন গুচ্ছের রক্তপরীক্ষা। প্রত্যেকটা পরীক্ষায় ফুল মার্ক পেয়ে পাশ করেও গেল মাইরি শ্বশুরটা। তাও কেউ বলল না, বাড়ি যান মশাই। আপনি, বিলকুল সুস্থ আছেন। বরং বলা হল, পেট সিটি স্ক্যান করতে হবে। 


ছুটি নিয়ে গিয়ে স্ক্যানটাও করিয়ে আনল শৌভিক। এবার রিপোর্ট নেওয়া আর ডাক্তারবাবুকে দেখানোর পালা। ছুটির দিন বা সপ্তাহান্তে বসেন না ডাক্তারবাবু, শ্বশুরমশাইয়ের দুই পুত্রের পক্ষেই আপাততঃ আরোও একটা কর্মব্যস্ত দিনে ছুটি চাওয়া বা পাওয়াটা বেশ জটিল। উমারাণী তো নড়তেই পারছে না আমাদের দুমাসের প্রাণপুতলী শ্রীমতী ফুলঝুরিকে ছেড়ে। অবশিষ্ট রইলাম আমি। এসব ব্যাপারে আমাকে যে এবাড়ির কেউ ভরসা করে না, অপ্রাপ্তবয়স্ক গোবলু গোবিন্দ বলে মনে করে, তা আমি বেশ বুঝি। তাও নিরূপায় হয়ে আমার সাথেই যেতে হয় বৃদ্ধকে।


রিপোর্টে অবশ্য তেমন কিছু মেলেনি। ডাক্তারবাবু থুতনি চুলকে বললেন, ‘পেট সিটিতে ছোট কিছু তো ধরা পড়ে না। কিছু অ্যানোম্যালি আছে বটে আপনার ফুসফুস গহ্বরে। একটু বুক আর পেটের বিশেষজ্ঞ ডাক্তার দেখিয়ে নিন বরং। তারপর যদি কিছু পান, আসবেন-’। প্রায় ত্রিশ বছর ধরে হাঁপানিতে ভুগছেন শ্বশুরমশাই। ওণার ফুসফুস জোড়া এমনিতেই ভয়ানক ঘায়েল। মোদ্দা কথা ইনি কিছু পেলেন না।


 রীতিমত কাল্পনিক ব্যাণ্ডপার্টি বাজাতে বাজাতে বাড়ি ফিরলাম আমরা শ্বশুর আর পুত্রবধূ। মনের খুশিতে আমাকে লুকিয়ে একখান সিঙ্গল মল্টই কিনে ফেললেন বৃদ্ধ। কোন বন্ধুর সাথে কি সব যেন সিনেমা দেখতে যাবেনও ঠিক করে ফেললেন।


 তারপর আর কি, বৃদ্ধকে তাঁর বৃদ্ধার জিম্মায় পৌঁছিয়ে, তাঁর আদরের কনিষ্ঠ পুত্রবধূ থুড়ি কন্যাকে খবর দিয়ে বাড়ি ফিরলাম আমি। আসার আগে অবশ্য খেতে হল দইবড়াটা। মাইরি বলছি, এতটুকুও আপত্তি করিনি আমি। শাশুড়ী মায়ের নিজের হাতে বেড়ে দেওয়া দই বড়া, যা বৃদ্ধা আনিয়েছে শুধুই আমার তরে,এ জিনিস কি সহজে ছাড়া যায়। ভাবলাম ছবি তুলে উমারাণীকে পাঠাই, ‘এই দ্যাখ।আমার জন্য এনেছে, আমায় খাইয়েছে। তোকে দেয়নি, দুয়ো দুয়ো।’ তারপর মনে হল বয়স বাড়ছে, এতটা ছ্যাবলামো করাটা বোধহয় যুক্তিযক্ত হবে না। এইসব করি বলেই এরা আমায় প্রাপ্তবয়স্ক গণ্য করে না মাইরি। তারওপর ওসব দেখে উমারাণী যা হাত পা ছুঁড়বে। নির্ঘাত কথা বলাই বন্ধ করে দেবে কিছুদিনের জন্য।  তাই দইবড়ার ছবি আর তুললাম না, বৃদ্ধের সঙ্গেই একটা ছবি তুললাম। সেটা অবশ্যি উমা রাণীকে পাঠালাম, ওতে তেমন দোষ নেই, বোধহয়। ছবিটা যদিও তেমন ভালো হয়নি,সারাদিনের ক্লান্তি ফুটে উঠেছে দুজনেরই মুখে চোখে তাও বেশ পছন্দ হল উমারাণীর। প্রচুর ভালোবাসা পেলাম হোয়াটস্অ্যাপ মারফৎ। দইবড়ার গল্পটা অবশ্য চেপে গেলাম চুপচাপ-। প্রাপ্তবয়স্ক হতে গেলে ওটুকু তো করতেই হয়

তুত্তুরী আর ফুলঝুরির গপ্প - ২ তাং - ২ রা আগস্ট, ২০২২

 


"একটি আছে দুষ্টু মেয়ে, একটি ভারি শান্ত,/

একটি আছে দখিন হওয়া, আরেকটি দুর্দান্ত।          

আসল কথা, দুটি তো নয় একটি মেয়েই মোটে,

হটাৎ ভালো হটাৎ সেটি দস্যি হয়ে ওঠে।" 

                

 এই তো সেদিনের কথা, ঘোরতর আপিস টাইমে মেসেজ করেছিল উমা, “সোনাইটাকে (ওরফে শ্রীমতী তুত্তুরী) দাও বাপু আমায়, এটাকে(অর্থাৎ শ্রীমতী ফুলঝুরি) নিয়ে যাও। এ মেয়ে শান্ত হবে না গো। দিন দিন এমন পাজি হচ্ছে, সারা রাত তো জেগে কাটাচ্ছেই,যতক্ষণ জেগে থাকছে, সারাক্ষণ ছটফট, ছটফট করছে। একটু এদিক ওদিক হলেই কেমন ক্যাঁক ক্যাঁক করে ধমকাচ্ছে। মাঝে মাঝে বেশ রাগ হচ্ছে কিন্তু আমার। মনে হচ্ছে তোমার ইচ্ছে পূরণ করবে এ মেয়ে, এক নম্বরের গেছো ছানা হবে।”


হ্যাঁ আমি বলেছিলাম বটে গেছো মেয়ে হবে। জন্মেই এমন গালে হাত দিয়ে ঘুমাচ্ছিল শৌভিক তো দেখেই ভবিষ্যৎ বাণী করেছিল, মস্ত ভাবুক হবে এই মেয়ে। ঠিক ওর বাবার মত। গুরুগম্ভীর অধ্যাপক হবে। জটিল আমার মত অধমের অবোধগম্য কবিতা লিখবে। আপত্তি করেছিলাম আমি। মোটেই না, ও আমাদের উমার মত হবে। গেছো মেয়ে হবে একটা। তুত্তুরী বাপু বড় ভালো, ঠাণ্ডা,লক্ষ্মী লক্ষ্মী। মিষ্টি মিষ্টি।  ফুলঝুরি একটু ঝাল ঝাল হোক না। গুণ্ডা হোক বেশ। দু চারজনকে একটু ঠেঙিয়ে টাঙিয়ে আসুক বেশ। 


ফুলঝুরি তার বাপের মত হবে, না মায়ের মত হবে এই নিয়ে এই সেদিনই এত তর্ক করলাম আমরা, আর আজকেই দেখুন কেমন বেমালুম ভোল পাল্টে ফেললেন তিনি। বেটি এমন ভাবুক হয়ে পড়েছে, যেন ভুবনের ভার বাস্তবিকই তাঁর কচি স্কন্ধে। ধন্যি মেয়ে এক্কেরে 😊🙏🏼

অনির ডাইরি ৩১শে জুলাই, ২০২২

 



রাত একটা। চাটুজ্জে বাড়ির বুড়ো দেওয়াল ঘড়িটা যদিও চিৎকার করছে, ‘হুঁশিয়ার! পৌনে দুটো বেজে গেছে কিন্তু।’ ওটা অমনিই করে। সবসময় এক ঘন্টা এগিয়ে দৌড়য়। তাতেই নাকি সবার সুবিধা। 


সামান্য উসখুস করতে শুরু করেছে আমার বাবা। আমাদের আড্ডা শুরু হওয়া ইস্তক গোটা দুই সিগারেট ইতিমধ্যেই ফুঁকে ফেলেছে। আরেকটা ফোঁকার সময় সমাগত। আশি পেরিয়েছে কয়েক বছর হল, সিগারেট ছাড়ার কথা বলে বলে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে পারিবারিক ডাক্তার বাবু। দুদিন বন্ধ রাখে বাবা। তৃতীয় দিন থেকে আবার পুনঃমুষিক ভব। মৃদু তাড়া দেয় মা, রাত অনেক হল এবার ঘুমাতে হবে তো নাকি? যাদের উদ্দেশ্য করে তাড়া দিল মা, তাদের একদল, ‘সাইকেলের দুদিক চাকা,মধ্যে ফাঁকা’ গানে উদ্দাম হাত পা ছুঁড়ছে। অপর দল তাদের দেখে হেসে উল্টে যাচ্ছে। আজ দুপুরে হাওড়া থুড়ি বাপের বাড়ি এসেছি আমি আর আমার দ্বাদশী কন্যা তুত্তুরী, কর্মসূত্রে বর্তমানে আমরা তাম্রলিপ্ত নগরীর বাসিন্দা। কাল বিকেলে আবার ফিরে যাব নিজ নিকেতন। আবার শুরু হবে ইঁদুর দৌড়। হাতে অবকাশ বলতে এই রাতটকুই। আমি আর তুত্তুরী হাওড়া এলেই জম্পেশ আড্ডা বসে ব্যাঁটরার চাটুজ্জে বাড়িতে, বাবা আর পিসি দুই ভাইবোন, আমরা তিন খুড়তুতো জেঠতুতো ভাইবোন, তুত্তুরী আর বুল্লুবাবু দুই মামাতো- পিসতুতো ভাইবোন, আমার মা আর আমাদের আদরের ভাতৃবধূ চৈতি সব মিলিয়ে আড্ডাবাজদের সংখ্যা  কি কম?  আর এটা তো শ্রীমতী তুত্তুরীর জন্মদিন স্পেশাল আড্ডা। শুধু আজকের জন্য শ্রীমতী তুত্তুরীকে নিজে হাতে সাজিয়ে দিয়েছে তার প্রাণাধিক প্রিয় বড় মামী। জন্মদিন উপলক্ষে জম্পেশ দেখে একটা গল্পের বই উপহার দিয়েছে বড়মামা। 


জমে উঠেছে আমাদের আড্ডা থুড়ি পার্টি। নাচ গানের ফাঁকে ফাঁকে চলছে যে যার স্কুলের গল্প। তুত্তুরী আর বুল্লুবাবু অর্থাৎ আমার কন্যা আর ভাইপোর গল্পগুলো আধুনিক যুগের, আমাদের তিন খুড়তুতো-জেঠতুতো ভাইবোন অর্থাৎ অয়ন, অনিন্দ্য আর অনিন্দিতার গুলো মধ্য যুগের, বাবা আর পিসির গুলো সেই আদি প্রস্তর যুগের। তা হোক, স্বাদে-গন্ধে-সৌরভে- দুষ্টুমি আর দুরভিসন্ধিতে সব সমান। উফ কি নচ্ছারই না ছিলাম আমরা। এমন অনেক গল্পই আজকাল আমরা খোলাখুলি বলতে পারি, যা এক দশক আগেও মা বা পিসির সামনে বললে পিঠের চামড়া তুলে ডুগডুগি বাজানো হত। বাবা অবশ্যি চিরকালীন বেস্ট ফ্রেণ্ড। 


স্বর্গীয় ছোটকাকুও তাই ছিলেন। তাঁর গল্পও ওঠে কোন না কোন প্রসঙ্গে। উঁচু টেবিলের ওপর দাঁড় করানো,নকল মুক্তোর মালা পরানো ছবিটায় কি কোন আলোড়ন ওঠে? খেয়াল করি না কেউ। হয়তো পাশের ছবিটা থেকে খেয়াল করেন ছোট কাকিমা। আজ যেমন অনিন্দ্য, ছোটকাকুর হাতে বিভিন্ন কারণে ঠ্যাঙানি খাবার গল্প বলছিল। রঞ্জিত মল্লিকের মত বেল্ট খোলার বদভ্যাস থাকলেও ছোটকাকুর হাতই ছিল যথেষ্ট। 


মারকুটে অবশ্য আমার মাও কম ছিল না। শৌভিক বিশ্বাস করে না, কিন্তু কাঠের লম্বা স্কেল থেকে, হাত পাখার হাতল, প্লাস্টিকের চিরুনি, সাঁই করে ছুটে আসা হাওয়াই চপ্পল কিসের দ্বারাই না আহত হয়েছি আমি। হাওয়াই চটির মহিমা আপামর রাজ্যবাসীর ঢেড় আগে থেকে টের পেয়েছি আমরা। অয়ন, অনিন্দ্যও কি ও রসে থুড়ি অভিজ্ঞতায় বঞ্চিত ভেবেছেন।


মা আবার মৃদু তাড়া দেয়। বুড়ো ঘড়িতে সোয়া দুটো। মানে রাত দেড়টা। চুনোপুঁটি দুটো তখনও হাত পা ছুঁড়ছে কি যেন ভয়ানক গানে। এইসব অনিন্দ্যর অপকীর্তি। কোথা থেকে বানায় এমন প্লে লিস্ট ভগবান জানে। ব্যাটারা একটা ভদ্রসভ্য গান চালা না। অয়ন বিরক্ত স্বরে বলে, ‘ওসব মুর্গি ডান্স বন্ধ কর। রাতে ঘুম আসবে না তোদের। দাঁড়া আমি একটা চালাই।’ ঘর ভেসে যায়, ‘পহেলা নেশা’র মূর্ছনায়। 


আবার তাড়া দেয় মা। সিগারেট ধরিয়ে উঠে পড়ে বাবা। সম্প্রতি ভাইরাল ফিভার থেকে উঠে বড্ড দুর্বল হয়ে গেছে বাবা। কানেও যে কি বাঁধিয়েছে। পিছন থেকে গাড়ির হর্ন শুনতে পাবে না এই ভয়ে বেশ কদিন আর রাস্তায় বেরোচ্ছে না বাবা। বিরাম নেই শুধু সিগারেট টানার। রাত দশটা থেকে এইটি তিন নম্বর সিগারেট। তাহলেই বুঝুন।


মায়ের তাড়া খেয়ে মনে পড়ে যায়, কেকটাই তো কাটা হয়নি এখনও। আজ আমাদের পার্টি শুরুই হয়েছে একটু বিলম্বে। প্রায় রাত দশটায় আপিসের কাজ মিটিয়ে বাড়ি ফিরেছে অনিন্দ্য। আসার সময় ভাগ্নির জন্য বয়ে এনেছে জব্বর একখান কেক। কেক কম, ক্রিম বেশি। ঠিক যেমনটি ভালোবাসেন শ্রীমতী তুত্তুরী। হাক্লান্ত অনিন্দ্যকে একটু ধাতস্থ হবার সময় দিতে গিয়ে আর কাটাই হয়নি কেকটা। ঠিক হয়েছিল, নৈশ ভোজন মিটলে, ওটা আমরা ডেজার্ট হিসেবে খাব সবাই মিলে। 


মায়ের গুঁতো খেয়ে অবশেষে চটজলদি সাজানো হয় কেকটা। গ্লাসে গ্লাসে ঢালা হয় জিরু। আমাদের আড্ডা বসবে আর জিরু বাবু থাকবে না, তাও কি হয়। কেককে ঘিরে সুন্দর করে সাজানো হয় জিরুর নটি গ্লাস। ছুরি নিয়ে প্রস্তুত হয়ে যান শ্রীমতী তুত্তুরী।  মামা-ভাগ্নি অর্থাৎ অনিন্দ্য এবং তুত্তুরীর প্রবল আপত্তি সত্ত্বেও কেকের ওপর থেকে রং মশালটা সরিয়ে দিই আমি। ওটা মহা আপদ। বড্ড বারুদ ছেটায়। আর এর আগেও তো দুবার রং মশাল জ্বালিয়ে কেক কেটে ফেলেছে তুত্তুরী। পরিবেশের আর কত ক্ষতি করবি বাপু তোরা। যুক্তিতে হেরে গিয়ে পিছিয়ে যায় মামা ভাগ্নির টিম। স্পিকারে বেজে ওঠে, "হ্যাপি বার্থ ডে টু ইউ" এর  ধুন। কেকের একটা পুঁচকে টুকরো কেটে সবার মুখে মুখে ধরে তুত্তুরী। কেক কামড়াতে গিয়ে তুত্তুরীর আঙ্গুল মৃদু কামড়ে ফেলে পিসি, হাসির হুল্লো়ড় ওঠে একচোট। কে যেন বলে আসছে বছর আবার হবে, হোক হোক বলে উল্লাস জাহির করে জিরুর গ্লাসে ঠোঁট ডোবাই আমরা। কে জানে কি হবে আসছে বছর, বাবা মা পিসির স্বাস্থ্য প্রতিদিন ভেঙে পড়ছে একটু একটু করে। ওরাই তো আমাদের শিকড়, যতদিন ওরা থাকবে ততোদিনই মূলের সঙ্গে যুক্ত থাকব আমরা, আর তারপর কি হবে- সে চিন্তা এই মুহূর্তে করে লাভ কি? আপাতত এই সুখের মুহূর্তটাকে তো পান করেনি এক নিঃশেষে। কাল যা হবে,দেখা যাবে।

অনির ডাইরি ৩০শে জুলাই, ২০২২

 


আঞ্চলিক শ্রম দপ্তর, তাম্রলিপ্তের দায়িত্ব ভার গ্রহণের পর প্রথম মিটিং। আগেই জানিয়ে রেখেছিলাম উৎকণ্ঠিত হওয়া নিষ্প্রয়োজন,  এটা একেবারেই পরিচয় আদানপ্রদানের মিটিং। সবার সাথে প্রাথমিক আলাপটা অবশ্যি আগেই হয়েছিল, আমার দুই পূর্বসূরীর বিদায় সম্বর্ধনা অনুষ্ঠানে। সেদিন দুই বিদায়ী আধিকারিকদের জন্য যে হারে কান্নাকাটি করছিল এরা, আমার সাথে আলাপটা একেবারেই জমেনি। তাই ডাকা আর কি। 


নভেম্বর মাস, ভাঁড়ে ভবাণী। তাই মিটিং শেষে নেহাৎ ছাপোষা চা-বিস্কুট। চা তো এল তার সাথে এল দারুণ সুন্দর একটা কাপ কেক। ঠিক যেমন রিলস্ গুলোয় দেখি। রঙ বেরঙের ক্রিমের মুকুট পরানো।হরেক রকম স্প্রিংকলস্  ছড়ানো। এত সুন্দর জিনিস এই মেদিনীপুরে কে বানাল? চা ওয়ালা? শুভাশিস হেসে বলল,‘না ম্যাডাম। শান্তনুর বউ বানিয়েছে। এটা শান্তনু খাওয়াচ্ছে সবাইকে।’ শুধু যে কেক গুলো দেখতে সুন্দর ছিল তা নয়,স্বাদেও ছিল জবরদস্ত। সবথেকে বড় কথা মিষ্টি একেবারে যথাযথ। আমাদের হাওড়া-কলকাতার তুলনায় এই জেলার লোক মিষ্টি একটু কম খায়। তরকারিপাতি ছাড়ুন, বার দুয়েক তো এমন কলাকাঁদ খেয়েছি যাতে চিনির সাথে সাথে মেশানো ছিল লবণও। 


তো সেই প্রথম কেক চাখার দিন থেকে আমি শান্তনুর গিন্নির অনুরক্ত।  ফরমাইশ মত বেশ কয়েকবার কেক বানিয়ে দিয়েছে শান্তনুর বউ। প্রতিবারই জিতে নিয়েছে সবার রসনা। শেষ নভেম্বরে বিবাহবার্ষিকী ছিল আমাদের এক পরম প্রিয় দম্পতির। শান্তনুকে ডেকে জিজ্ঞাসা করলাম,‘তোমার বউ ছবিওয়ালা কেক বানাতে পারবে?’ জবাব পেলাম ঐ বাটার পেপারটা পাওয়া গেলেই পারবে। অতঃপর শান্তনু গেল ঐ বিশেষ কাগজ খুঁজতে আর আমি গেলাম মেয়েটির প্রোফাইল থেকে একখান সুন্দর ছবি খুঁজতে। যাতে কর্তাবাবু, গিন্নিমা আর তাদের চতুষ্পদী ছানা তিনজনেই থাকবে স্বমহিমায় বিদ্যমান। এমন ভাবে কাউকে কোনদিন ‘stalk’ করিনি মাইরি। মেয়েটির এবং ছেলেটির গোটা অ্যালবাম ঝাঁট দিয়ে ফেললাম, যতগুলো ভালো ছবি পেলাম সবকটাতে বাবুরা শুভেচ্ছা বার্তা লিখে রেখেছেন। অতি কষ্টে পৌনে একঘন্টার চেষ্টায় একখান ভালো বার্তা বিহীন ছবি পেয়েছিলাম সেবার। তবে কেকটা যা বানিয়েছিল শান্তনুর গিন্নী, একেবারে লাজবাব।


এবারেও তাই তুত্তুরীর জন্মদিনের আগে বলেছিলাম, শান্তনু একটা ভালো কেক বানিয়ে দিতে হবে। সেভাবে তুত্তুরীর জন্মদিন উপলক্ষে কোন অনুষ্ঠান কখনই করি না আমরা। যা হয়,যেটুকু হয় সেটা নিছকই পারবারিক। এবারে তো তারও উপায় নেই দাদু -দিদা বা ঠাম্মা-দাদুর যা শারিরীক অবস্থা, কেউ তমলুক আসতে পারবে না। কাকার কর্মসূত্রে ফুলঝুরি সমেত কাকিমাও আপাততঃ দুর্গাপুরে। সপ্তাহের মাঝে এষাদের ডাকার কথাও চিন্তা করা যায় না। তাই এমনিতেই তুত্তুরীর মন খারাপ। বারবার বলছিল, ‘মা কেকটাও কি কাটা হবে না?’ বাচ্ছাদের যে কি কেকের প্রতি টান ভগবান জানে।  


কথাটা তুলেছিল আমাদের উত্তমকুমার, ‘হায় ম্যাডাম, তুত্তুরীর জন্মদিন, আর আমাদের অফিসে কিছু হবে নি?’ হলেই হয়। শান্তনু কেক তো বানাচ্ছেই, তাহলে দুটো বানাও বরং। একটা একেবারে ক্রিম ছাড়া আর একটা তোমার যা খুশি। তুত্তুরীর বাপের ক্রিম কেকের ওপর জন্মবিরাগ। তাই ক্রিম ছাড়াটা আমি বাড়ি নিয়ে যাব আর ক্রিমওয়ালাটা অফিসে কাটা হবে। শুধু কি কেক খাওয়াব লোকজনকে? মিষ্টির সাথে নোনতা কিছু থাকবে নে কো? আমাদের ক্যাথলিন বা মিও আমোরের মত তমলুক নগরীর বিখ্যাত বেকারী হল বিদ্যুৎ বেকারী। তাই বললাম কেকের সাথে বিদ্যুৎবেকারী থেকে কিছু আনলে হয় না?


 জহরবাবু বললেন, ‘ম্যাডাম ঠাণ্ডা?’ ঠাণ্ডা অর্থাৎ কোল্ড ড্রিঙ্ক। এই আপিসে ১২মাসই ঠাণ্ডা সেবন চলে। ওটাকে আমি বলি চুঙ্গি কর। কেউ ভালো জামা পরে এলে থামস্ আপ খাওয়াতে হয়। কেউ নতুন জুতো পরে এলে স্প্রাইট। এ ছাড়াও কেউ ঘড়ি পাল্টালে, কেউ চুল কাটলে, অফিস টাইমে কারোর বন্ধু দেখা করতে এলে  ইত্যাদি প্রভৃতি চুঙ্গি আদায় চলতেই থাকে। চুঙ্গি দিতে আমারও আপত্তি নেই। তবে আর থামস্ আপ বা স্প্রাইট নয় রে বাবা। একটু অন্য স্বাদের ঠাণ্ডা হোক না। উত্তমকুমার বলল জিরু হোক। আরও অনেকে অনেক রকম মত দিল বটে, শেষ পর্যন্ত হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হয়ে জিতল লিমকা আর ফ্যান্টা।


 সাথে একটা করে গরম গরম চিকেন স্প্রিং রোল আর কাঠি কাবাব। বিদ্যুৎ বেকারীর কাঠি কাবাব যাকে বলে, ‘ওয়ার্ল্ড ফেমাস ইন তমলুক।’ একখান লম্বা কাঠির ডগায় গোটা দুয়েক চিকেন,বেশ কয়েকটি পেঁয়াজ টুকরো গেঁথে কোন মোটা ব্যাটারে চুবিয়ে ভাজা। ভাবতেই জিভে জল। সবকিছু আগের দিন ঠিক করে বাড়ি ফিরলাম, ঐদিনটি যদিও আনুষ্ঠানিক ভাবে ছুটি নিয়েছিলাম, তবুও অফিস যাব। একটু বেলা হবে। জন্মদিনেও ইস্কুল যাবেন শ্রীমতী তুত্তুরী, তাঁকে স্কুল থেকে ফেরৎ নিয়ে তবে যাব। 


সাড়ে চারটে নাগাদ সকন্যা আপিসে পৌঁছে হকচকিয়ে গেলাম একেবারে। আমার চেম্বারটাকে চেনাই যাচ্ছে না। একবেলার অনুপস্থিতিতেই ভোল পাল্টে গেছে তার।হরেক রঙের বেলুনের আভরণে, ‘হ্যাপ্পি বাড্ডে’লেখা ব্যানারে তিনি হয়ে উঠেছেন অপরূপা। এসব কখন করলে রে? জিজ্ঞাসা করলে মুখ টিপে হাসে সবাই। একে একে সবার আগমনে ভরে ওঠে ঘর, কাপ কেক হাতে ডোনাল্ড ডাক ওয়ালা কেক দেখে মুগ্ধ হয়ে যায় সবাই। অতঃপর কেক কাটার পালা। সযতনে ডোনাল্ড ডাকে বাদ দিয়ে কেক কাটতে উদ্যোগী হন শ্রীমতী তুত্তুরী, ঘিরে ধরে টিম তাম্রলিপ্ত নামক পরিবারের সদস্যবৃন্দ , এমন সময় সমবেত লোকজনকে সরিয়ে মুখ বাড়ান শ্রীমতী কচি। যাঁর ভালো নাম কুমারী সমাদৃতা জানা। আমাদের শুভদীপ্তর অসীম গুণবতী তথা নৃত্য পটিয়সী কন্যা। বিকাল চারটেয় স্কুল থেকে ফিরে, মুখহাত ধুয়ে সামান্য জলযোগ সেরেই তিনি হাজির হয়েছেন তুত্তুরী দিদির জন্মদিন পালন করতে।


  আমাদের হক বাবু সামান্য লজ্জা লজ্জা মুখ করে বলেন, ‘আপনাকে না জিজ্ঞাসা করেই ওকে আসতে বলেছি ম্যাডাম। শান্তনুর মেয়েকেও বলেছিলাম। সেটা এখনও ঘুমাচ্ছে। আপনি রাগ করলেন-’। হাসব না কাঁদব বুঝতে পারলাম না। হক বাবু আপনি কি খেপেছেন, এতদিনে আমায় এই চিনলেন? অথবা ঘুরিয়ে বললে বলতে হয়, আপনারা আমায় এই কদিনে কি ভীষণ ভালো চিনেছেন হকবাবু। কচিকাঁচা গুলো আসলে যে আমার আনন্দ বহুগুণ বেড়ে যাবে এটা আপনারা না বুঝলে বুঝবে কে।

তুত্তুরীর দ্বাদশ জন্মদিন



 সময় বয়ে যায়, এক যুগেরও পার। এই তো মনে হয় সেদিনের কথা, প্রথম মোলাকাৎ তার সাথে। আর্কেডিয়ার উজ্জ্বল হলুদ রঙা ঘর, মাথার ওপর ঘুরন্ত ঘরঘরে পাখা, কপালে বয়স্ক ডাক্তারবাবুর স্নেহশীল হাত, কানে মৃদু রসিকতা, “হ্যাঁরে, তা শুনলাম তুই নাকি লেবার কমিশনার- আমাকে একটা চাকরী দিবি মা?” বলতে গেলাম কতকিছুই, বলার ছিলও অনেক কথা- পারলাম কই? জোড়া ফুসফুসের দখলদার তখন অচেনা কোন দৈত্য। এক ঝলক বাতাসের জন্য হাঁকপাঁক করতে করতে, ক্রমেই চোখের সামনে ঝাঁপিয়ে পড়ছিল ঘোলাটে এক আস্তরণ- এমত ক্ষণে, সব পর্দা ফর্দাফাই করে ভেসে এল কার যেন হুঙ্কার-  প্রবীণ ডাক্তারবাবু সহর্ষে বলে উঠলেন, “বাপরেঃ না ভূমিষ্ঠ হতেই কি গলার জোর- শুনলি? শুনলি কি? তোর মেয়ে চিৎকার করছে, শোন।”  


 শৌভিকের সাথে বাইরে অপেক্ষা করছিল দিদিভাই-দাদাভাই- দাদারা- ছোট মাসি আরও যেন কারা কারা,  “প্রায় ফুটবল টিম ছিলাম আমরা” কৌতুকের সুরে গল্প শুনিয়েছিল শৌভিক। সবার শেষে এসেছিল আমার বাবা, পিতৃসুলভ আবেগে গদগদ হয়ে শৌভিক আজও বলে, “শ্বশুরটা ভয় পেয়ে গিয়েছিল খুব”। মেয়ে নয় তো, শৌভিকের ইচ্ছাশক্তির জয় হয়েছিল সেদিন- বারবার বলত, “বুজু হবে। বুজু আসছে।”  কাঁচের ঘরের ভিতর থেকে নার্স দিদি দেখিয়েছিল ছোট্ট ঘুমন্ত বুজুটাকে, তারপরই পায়ের আঙুলে মেরে ছিল টকাস করে এক টোকা। কাঁচের দেওয়ালের ওপার থেকে ভেসে এসেছিল গগনভেদী হুঙ্কার। এপাশে অলক্ষ্যে দাঁত কিড়মিড় করেছিল বাবাও, খামোকা আমার মেয়েটাকে কাঁদায় কেন এরা, দুষ্টু লোক। দাদু অবশ্য হুঙ্কার শুনেই নাম রেখেছিল জগজ্জননী থুড়ি নজদগজনী।    


প্রথম দিকে বয়স মাপা হত দিনে, বাইশ দিনের মাথায়, এক কলসি পাউডার মাখিয়ে, তোয়ালে মুড়ে কি যেন একটা ইঞ্জেকশন দিতে নিয়ে গিয়েছিল মা আর দিদিভাই। ডাক্তারদিদির কড়া নিষেধ ছিল, তবুও ছোট্ট পায়ের পাতায় নিটোল কাজলের ফোঁটা এঁকেছিল জ্যাঠাইমা। সূঁচ ফোঁটাতেই নাকি ডাক্তার দিদিকে, “অ্যাও” বলে জব্বর ধমকেছিল তুত্তুরী। 


 দিনের হিসেব পাল্টে গেল সপ্তাহে। শিকারী বেড়ালের মত আসেপাশে ঘুরঘুর করত বুল্লু দাদা, ঘর ফাঁকা দেখলেই সনির্বন্ধ  অনুরোধ করত কচি গলায়, “একটু বোনিকে দাও না গো পিসি, একটি বার আমার কোলে দাও-”। একটু বড় হতেই, বোনির ডানা পাখনা গজাল, অনুমতির তোয়াক্কা না করেই দেড় পায়ে হামা টেনে টেনে দৌড়ত দাদার পিছু পিছু। একজনের দুধে দাঁত আর অন্যজনের ফোকলা হাসির ফাজলামিতে, উল্লাসে ফেটে পড়ত ব্যাঁটরার চাটুজ্জে বাড়ি। 


 সপ্তাহের হিসেব টপকে এল মাস, ঘুরল বছর। প্রথম জন্মদিনে মামমামের কোলে চেপে দাদুর হাতে পায়েস খাওয়া- রাতের বেলা হামলে পড়ে খাপলে খাওয়া জীবনের প্রথম চকলেট কেক। দ্বিতীয় জন্মদিনে বিশেষ কারণবশতঃ ছুটি পাইনি আমি। আমার অনুপস্থিতিতে আটকায়নি কিছু, পঞ্চব্যঞ্জন সাজিয়ে নাতনীর মুখের সামনে ধরেছিল মা। কোলে বসিয়ে পায়েস খাইয়েছিল  বাবা। ছুটি নিয়ে দৌড়ে এসেছিল শৌভিকও। সন্ধ্যে বেলা বাড়ি ফিরে ছবি দেখেছিলাম। মেয়ের জন্মদিন পালনের ছবি। তেচাকা সাইকেলে চড়ে দুধের বোতল হাতে ঝুমরো-ঝুমরো চুলে পোজ দেওয়া তুত্তুরী। 


 তৃতীয় জন্মদিনের কেকটার ওপর দুটো সাদা ক্রীমের হাঁস ছিল। কেক না কেটে, পরম হরষে হাঁসগুলোকে জবাই করেছিল তুত্তুরী। চতুর্থ জন্মদিনটা ছিল আমাদের ফ্ল্যাটে পালন করা প্রথম জন্মদিন। নাতনীর জন্য বেলুন ফুলিয়ে ফুলিয়ে বুকে ব্যথা হয়ে গিয়েছিল আমার বাবার। তখনও লিফট বসেনি,হাঁপানি রুগী হওয়া সত্ত্বেও নাতনীর জন্য হেঁটে চারতলায় উঠেছিলেন শ্বশুরমশাই। শুধু কি তাই, তুত্তুরীর জন্য টুপিও পরেছিল সবাই, ঝকমকে রাংতার টুপি। 


 পঞ্চম জন্মদিনে মেঘ ভাঙা বৃষ্টিতে ভেসে গিয়েছিল মহানগর। কোথায় যেন বেড়াতে গিয়েছিলাম আমরা- ষষ্ঠ জন্মদিনের আগে ডিপথেরিয়া বাঁধিয়েছিল তুত্তুরী। ষষ্ঠ জন্মদিনের আগে আরও একটা ঘটনা ঘটেছিল। তুত্তুরীর জীবনের অংশ হয়েছিল এষা আর অর্জুন। আজও মনে আছে যেচে পড়েই ফোন করেছিল এষা,‘এই দিদি, সামনেই তো তুত্তুরীর জন্মদিন-’।  ব্যাস ঐটুকুই, আর বলতে হয়নি। আর বলেও না এষা। প্রতি জন্মদিনের আগে একবার করে তাজ্জব হয়ে যায় শৌভিক, ‘এষাটাকে কে বলল?’ প্রতিবার একই জবাব দিই আমি,‘ এষাটাকে কি বলতে লাগে?’। এষা আর তুত্তুরীর মধ্যে অনুপ্রবেশের অধিকার কি আদৌ আমার আছে? না শৌভিকের আছে? একে এষায় রক্ষে নেই,তার ওপর আবার অর্জুন আর কুট্টুস দোসর। 


  সপ্তম জন্মদিনে প্রথম বার হাজিরা দিয়েছিল কাকিমা। নবম জন্মদিনে কেঁদেকেটে রেসিডেন্সিয়াল ট্রেনিং ছেড়ে পালিয়ে এসেছিলাম আমি। দশম জন্মদিনে কোভিড আক্রান্ত  হয়েছিলাম তুত্তুরী আমি। সম্পূর্ণ গৃহবন্দী অবস্থায় পালিত হয়েছিল তুত্তুরীর জন্মদিন। একাদশতম জন্মদিনের আগে ভয়াবহ দুর্ঘটনা ঘটিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল মা। প্রায় একপক্ষ ধরে চলেছিল যমে মানুষে টানাটানি। তারই মধ্যে মহকুমা শাসক হয়ে মহানগর ছাড়তে হয়েছিল শৌভিককে।  


আজ তাঁর দ্বাদশ জন্মদিন। বিগত এক বছরে বদলে গেছে অনেক কিছুই। নিজের বাড়ি, নিজের পাড়া, নিজের শহর ছাড়তে হয়েছে তুত্তুরীকে। ছাড়তে হয়েছে ছোট্টবেলার স্কুল। ছাড়তে হয়েছে প্রিয়তমা বান্ধবীকে। তাও থমকায়নি তুত্তুরী। হতোদ্যম হয়নি তুত্তুরী।  দাদু তাকে শিখিয়েছে যে, ‘সারভাইভাল অব দা ফিটেস্ট’। পরিবর্ত পরিস্থিতির সাথে মানিয়ে নিতে না পারলে যে পিছিয়ে পড়তে হয়, আর যার নামই পুরোযা, সে তো পিছিয়ে পড়তে পারে না। পুরোযা মানেই যে অগ্রবর্তিনী বা পথপ্রদর্শিকা। 

 

 ভালো থেকো পুরোযা। লক্ষ্মী মেয়ে নয়, বরং লক্ষ্মী বাঈ হয়ে জমিয়ে মোকাবিলা করো জীবনের, তোমার জন্য ভালোমত একটা পৃথিবী রেখে যেতে পারব না হয়তো,তবে পৃথিবীর জন্য একজন জবরদস্ত জগজ্জননী রেখে যাব, এটাই থাকুক অঙ্গীকার।

অনির ডাইরি ২৫শে জুলাই, ২০২২



‘আমি বোধহয় আর চাকরী পাব না, জানো-’। শুকনো মুখে বলেছিল মেয়েটা। একের পর পর চাকরির পরীক্ষা দিয়েই যাচ্ছিল মেয়েটা। আরও ভালো করে, আরও মনযোগ দিয়ে পড়ছিল মেয়েটা। বড় কষ্টে মানুষ মেয়েটা। প্রত্যন্ত গাঁয়ের মেয়ে, গ্রামের স্কুলের পাঠ চুকিয়ে, নিকটস্থ মফঃস্বল ঘুরে উচ্চ শিক্ষার জন্য মহানগরের বাসা গড়েছিল  মেয়েটা। ডিগ্রী পাবার পর আর সময় নষ্ট করেনি, টুকটাক কাজ করে, টিউশনির পাশাপাশি পুরোদমে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল একটা চাকরীর জন্য। অধ্যাপিকা হবার স্বপ্ন দেখত মেয়েটা। না হলে হাইস্কুলের শিক্ষিকা। এমনকি প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষিকা হতে পারলেও খুশি হয়ে যেত মেয়েটা। একা একা শহরতলীতে থেকে কাজ আর পড়াশোনা চালাত। গাঁয়ে অপবাদ দিত নিন্দুকের দল। নির্ঘাত কিছু খারাপ কাজ করে, নাহলে মহানগরের এত মধু কিসের। সেসব কথা ছিটকে কানেও আসত মেয়েটার। ভেঙে পড়ত কখনও কখনও। গোঁত্তা মারতাম আমি। “কুছ তো লোগ কহেঙ্গে।” পড়াশোনাটা ছাড়িস না বাপু। পড়লে, খাটলে, চাকরী ঠিক হবে। আমাকে দেখছিস না। আমার বন্ধুদের দেখছিস না। চাকরী একটা পেতেই হবে। উপার্জন না করলে, এত পরিশ্রম, এত অপবাদ সহ্য করা, সব বৃথা। এই যে এত কষ্ট করলি, আর একটু ধৈর্য ধর। 


সেদিন রবিবার। আকাশের মুখ ছিল ভার। কেমন যেন থমথমে ছিল পরিবেশ। কি যেন পরীক্ষার ফল বেরিয়েছে। তলার দিকের অনেকে পেয়ে গেছে। মেয়েটার নাম নেই। লিস্ট এনে দেখাচ্ছিল মেয়েটা। ‘এই দেখ। এ তো কোয়ালফাই করতেই পারেনি। ও আমার থেকে অনেক অনেক পিছনে ছিল। এদের কি করে হয়ে গেল গো?’ জবাব দিতে পারিনি। তবে ধমকেছিলাম খুব। শুধু দুর্নীতি খুঁজলে হবে? হেরে গিয়ে বসে পড়লে, রণক্ষেত্র ছেড়ে পালালে হবে?খুব বড় মুখ করে বলেছিলাম, কেন চাকরী পাবি না? আমি তো পেয়েছি। আমরা তো পেয়েছি। মন দিয়ে পড়। পরিশ্রমের কোন বিকল্প নেই,আমার বাবা শিখিয়েছিল। 


আরোও কিছুদিন লড়েছিল মেয়েটা। আরও অনেকদিন লড়েছিল মেয়েটা। দিয়েছিল আরও কিছু পরীক্ষা। সেই একই গল্প, ভীষণ ভালো হয় পরীক্ষা। ফলাফল হয় বেরোয় না। আর বেরোলেও কারা যেন ভরে দেয় সব আসন। মেয়েটার হাতে থেকে যায় পেন্সিল। সংসারে মন দেয় মেয়েটা। এখানে কোন দুর্নীতির গন্ধ পায় না। শ্বশুর-শাশুড়ির নয়নমণি হয় মেয়েটা। স্বামীর পরম সুহৃদ, প্রেমের আধার হয় মেয়েটা। নবজাতক সন্তানের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করে মেয়েটা। কেউ আজকাল আর ওকে বলে না, চাকরী কিন্তু পেতেই হবে। নিজের পায়ে দাঁড়াতেই হবে। সবাই আশা ছেড়ে দিয়েছে। সবাই মেনে নিয়েছে, সবাই মানিয়ে নিয়েছে। শুধু আমি বলি। দেখা হলেই বলি। এভাবে ছেড়ে দিস না। এভাবে হেরে যাস না। নিজেকে ভুলে যাস না।নিজের পায়ে দাঁড়া, নিজের পরিচয় বানা। ক্লান্তি মাখা একটা হাসি ফুটে ওঠে মেয়েটার ঠোঁটে। হেরে যাওয়া হাসি। 


মেয়েটা তো তবু সাংসারিক আচ্ছাদনের আড়ালে ঢেকে নিয়েছে নিজেকে। কিন্তু ছেলেগুলো? তাদের কি হল? তারা কোথায় লুকালো? এ সমাজ যে বড় নির্মম, উপার্জনহীন পুরুষকে যে মানুষ গণ্য করে না। কেউ বোঝে না তাদের অপারগতা। কেউ শোনে না তাদের ব্যর্থতার গল্প। কেউ মানতে চায় না, সব দোষ তাদের নয়।


 জনগণের স্মৃতি শক্তি বড় দুর্বল, আজকের উত্তেজনা অচীরেই দখল করে নেবে আগামী কালের ভিন্নতর কোন উত্তেজনা। আসবে নতুন নটনটি আর কুশীলবের দল। সময়ের মেকআপে আজকের খলনায়ক আবার অবতীর্ণ হবেন নায়কের নাম ভূমিকায়। মক্ষিরানিদেরও অভাব হবে না। টিস্যু পেপারে কালিমা মুছে নির্ঘাত ফিরে আসবেন মাননীয় আপ্ত সহায়ক মহোদয়। ফেঁসে যাওয়া আর ফাঁসিয়ে দেওয়ার কত যে গল্প ঘুরবে সোশ্যাল মিডিয়ায়, গলা ফাটাবেন, সওয়াল- জবাব করবেন অভিযুক্তদের শুভানুধ্যায়ীদের দল। দুনিয়া চলবে নিজের গতিতে, দীর্ঘশ্বাস গিলে, দগদগে ক্ষতে সময়ের মলম লাগিয়ে, আবার কোমর বাঁধবে হারিয়ে দেওয়া ছেলেমেয়েগুলো। কোমর বাঁধবে নতুন কোন লড়াইয়ের জন্য। ভিন্নতর কোন যুদ্ধের জন্য। এবার যেন ওরা জেতে, সর্বান্তকরণে এই প্রার্থনাই করি। মাথা উঁচু করে বাঁচা এবং যোগ্যতা অনুযায়ী উপার্জনের অধিকার সকলেরই আছে। 

অনির ডাইরি ২৩শে জুলাই, ২০২২

 তুত্তুরী আর ফুলঝুরির গল্প -১



শ্রীমতী ফুলঝুরির আগমনের খবর শুনে মোটেই তেমন পুলকিত হয়নি তুত্তুরী। কাকিমার উদরের মধ্যে হঠাৎ কেউ মাথা চাড়া দিয়েছে, ব্যাপারটা প্রথম চোটে অবশ্য তেমন বোধগম্য হয়নি তুত্তুরীর। খুশির খবর পেয়ে বাড়ির সকলের সঙ্গে আনন্দে মত্ত হয়েছিলেন তিনিও। ধীরে ধীরে তিনি অনুধাবন করলেন, ও বাবা, আসন্ন অতিথি তো ভূমিষ্ঠ  হয়েই দখল করে বসবে কাকিমাকে। তুত্তুরী এবং তার কাকিমার মধ্যে অন্য কেউ, ব্যপারটা মোটেই পছন্দ হল না তার। ঠারেঠোরে এমনকি শেষ পর্যন্ত সোচ্চারে সেটা জানিয়েও দিলেন তিনি। শুনে মা আর কাকিমা তো হেসেই খুন। 


বেচারী কাকিমা প্রায় রোজই বলতে লাগল,‘ওরে না রে। তুই তো আমার প্রথম বাচ্ছা। তুই তো আমার প্রিয়তম বন্ধু। তোর জায়গা কি কেউ নিতে পারে?’ সাময়িক ভাবে গলে যায়, ভুলে যায় তুত্তুরী। আবার কেউ ঢুকিয়ে দেয় সন্দেহের বিষ, ‘তুমি বড় দিদি হয়ে যাবে। বেবি হলে তো কাকিমা তাকে নিয়েই ব্যস্ত থাকবে।’ কিঃ আমার জন্য আর সময় থাকবে না কাকিমার হাতে? হে ঠাকুর এ কি হল- 


দেখতে দেখতে, বোঝাতে বোঝাতে,হাসতে হাসতে এসে যায় নির্দিষ্ট দিনটা। ধরা ধামে অবতীর্ণ হন জুনিয়র তুত্তুরী। হুঁশ ফিরতেই ছবি পাঠায় কাকিমা, ‘তুই তো বোনই চেয়েছিলি-’। সে বোধহয় কোন দুর্বল মুহূর্তে কাকিমার আদরে দ্রবীভূত হয়ে বলে ফেলেছিলেন শ্রীমতী তুত্তুরী, বোন হলে বেশি খুশী হবেন। কিন্তু ফুলঝুরি আগমনের খবরে তিনি ১৮০ ডিগ্রী ঘুরে গেলেন মাইরি। ‘আমি কক্ষনো বোন চাইনি। আমি ভাই চেয়েছিলাম। দেখছ ও আসতেই কাকিমা আমার কথা ভুলে গেছে-’।  


বেচারী কাকিমা, সেলাই না শুকানোর যাতনায়, ছোট্টটার রাত জাগায়, ধেড়েটার অভিমানে হাবুডুবু খেয়ে মরে। কাকিমা আর তুত্তুরীর আভ্যন্তরীণ সম্পর্কে সাধারণতঃ জড়াই না আমি। কারণ কয়েকবার নাক গলানোর চেষ্টা করে দেখেছি, ব্যাটারা নিজেরা যতই মারামারি হাতাহাতি করুক, মাঝখানে আমার বা আমার নাকের উপস্থিতি উভয়েরই ঘোরতর নাপসন্দ।  তবে এক্ষেত্রে তো আর হাত গুটিয়ে বসে থাকা যায় না। 


তুত্তুরীকে শোনাই এমনি দুই জেঠতুতো-খুড়তুতো বোনের কথা। যাদের মধ্যে বয়সের ফারাক প্রায় তুত্তুরী আর ফলঝুরির মতই। রুনু-ঝুনুর গল্প।  দিদিভাই আর আমার গল্প। দিদিভাইয়ের অন্ধ অনুগামিনী ছিলাম আমি।  আমার চোখে সেরা রূপসী ছিল আমার দিদিভাই। তেরো বছরের বড় জেঠতুতো দিদির চলন,বলন, হাসি, সাজগোজ, নিপাট সাদাসিধে বোকা-বোকা প্রশ্ন সবকিছু অন্ধের মত নকল করতাম আমি। যত্ন না করা সত্ত্বেও মাছি পিছলে যাওয়া দিদিভাইয়ের পেলব ত্বকের দিকে কি হ্যাংলার মতই না তাকিয়ে থাকতাম আমি। কি প্রসঙ্গে যেন, কাকে একবার খুব সুন্দর দেখতে বলে দীর্ঘশ্বাস ফেলেছিল দিদিভাই, তাজ্জব হয়ে গেছিলাম আমি। বলো কি? তোমার থেকেও সুন্দর? কেউ হতে পারে? অসম্ভব।  তখন কলেজে পড়ি, বড় মাসি একবার বলেছিল, 'তোকে দিনদিন রুণার মত দেখতে হয়ে যাচ্ছে।' রুণা অর্থাৎ আমার দিদিভাই। কি যে পুলকিত হয়েছিলাম সেদিন। রীতিমত উড়তে উড়তে বাড়ি ফিরেছিলাম মাটির আড়াই ইঞ্চি ওপর দিয়ে।


অন্ধের মত নকল করতাম, দিদিভাইয়ের চালচলন,বাচনভঙ্গী। আজও করি, চেতন এবং  অবচেতনে। গভীর চিন্তামগ্ন হলে যেভাবে দাঁত মুখ খিঁচিয়ে বাঁদরের মত মুখ করে থাকি, সেটাও তো আমার দিদিভাইয়ের নকলেই। ও যখন করত, ওকে সদ্য ফোটা কুসুমের মত লাগত। আমাকে যে কেন অমন লাগে না, বলে দাঁতমুখ খেঁচাই আমি। হেসে কুটোপুটি হয় তুত্তুরী। 


দ্রব হওয়া কচি হৃদয়ে ভালোলাগা আর ভালোবাসার বীজ ছড়াই আমি। ফুলঝুরিও তো আমার মতই হবে। তুত্তুরী দিদিই তো হবে তার আদর্শ। তুত্তুরীকে যে এবার একটু বেশীখাটতে হবে। নিজেকে তুলে ধরতে হবে ভালো উদাহরণ হিসেবে।  কারণ সব ব্যাপারে ফুলঝুরি তো নকল করবে তার তুত্তুরীদিদিকেই। ভাগ করে নেবে তার ভালো মন্দ, চেনা-অচেনা অভিজ্ঞতা যত। আর বয়ঃসন্ধিক্ষণে? কে হবে শ্রীমতী ফুলঝুরির মেন্টর? কে বোঝাবে, ছেলেদেরও ভালো লাগতে পারে, মেয়েদেরও। অথবা ভালো লাগতেই পারে উভয়পক্ষকে,কোনটাই দোষের না। কোনটাই পাপ বা অন্যায় নয়। কার সঙ্গে চিলেকোঠার ছাতে গিয়ে লুকিয়ে প্রথম সিগারেটে টান দেবে ফুলঝুরি? আর সেই যে, ‘শেলি বায়রন, শেক্ষপিয়র,টেনে গেছে শুধু ব্রাণ্ডি বিয়র’, তা কার কাছে প্রথমবার ব্রান্ডি/বিয়র খাওয়ানোর আব্দার করবে ফুলঝুরি? তুত্তুরীর কাছেই তো। ছোট বোন অন্য কারো পাল্লায় পড়লে কি আদৌ খুশি হবে তুত্তুরী। আর যেদিন আমরা কেউ থাকব না, কে থাকবে সেদিন তুত্তুরী আর ফুলঝুরির? একে অপরের ভরসাতেই তো পাড়ি দিতে হবে আরোও অনেক অনেক বছর। চোট আঘাত লাগলে, সামলাতে হবে একে অপরকে, বলতে হবে আহা রে তোর লাগল? 


শুধু কি তাই, একটু বড় হলে ফুলঝুরিকে পড়াতেও হবে তুত্তুরীকে, পাশ থেকে ফোড়ন কাটে কাকিমা। নর্মালি পড়াশোনার কথা তুললেই বিরক্ত হয় তুত্তুরী। কিন্তু এক্ষেত্রে যেহেতু ছাত্রী ফুলঝুরি এবং দিদিমণি গিরি করবে তুত্তুরী তাই ব্যাপারটা তাঁর হেব্বি পছন্দ হয়। পছন্দ হয় শ্রীমতী ফুলঝুরিকেও। ‘ও মা কি মসৃণ স্কিন দেখো, গায়ে কি মিষ্টি গন্ধ দেখো, কি রকম পুটুস পুটুস করে তাকায় দেখো।’ দুই বোনের পিরিত দেখে গলে যায় মা আর কাকিমা। ব্যাপারটা বেশ ভালোই চলছিল, আচমকা, শ্রীমতী তুত্তুরীর কোলে এবং হাতে একটু অপকর্ম করে ফেললেন শ্রীমতী ফুলঝুরি। যিনি করলেন, তিনি তো প্রকৃতির আহ্বানে সাড়া দিয়ে অত্যন্ত মুক্ত বোধ করলেন এবং খিলখিলিয়ে উঠলেন, যাঁরা দর্শক, মোহক উল্লাসে ফেটে পড়লেন তাঁরাও, কেবল যার অপকম্মটা হল তিনি রেগে আগুন এবং তেলে বেগুন। 


সে যাই হোক, শ্রীমতী তুত্তুরী এবং ফুলঝুরির অঙ্ক থুড়ি গপ্প তো সবে শুরু। আমরা মা এবং কাকিমা ঠিক করেছি, আমরা কোন দলে থাকব না। আমরা কেবল রগড় দেখব। কারণ মুখে যাই বলুক, আদতে দুটোই মহা ধড়িবাজ। দুটোর মধ্যে মিলও প্রচুর। তিনিও নিশাচর ছিলেন, ইনিও। ঘুম পাড়ানোর চেষ্টা করা হলে তিনিও অমনি করতেন, যেমন রাত দেড়টায় এখন ইনি করছেন।