Sunday 24 September 2023

অনির ডাইরি ৪ঠা সেপ্টেম্বর, ২০২৩ #অনিরডাইরি

 


পাহাড় ঘেরা ছোট্ট একতলা বাংলো। সরকারি বাংলো যেমন হয় আর কি, আহামরি কিছু না। বাংলোর সামনে দিনে একবার এসে থামে মস্ত সরকারি বাস। দু চার জন ঢুলন্ত যাত্রীকে নামিয়েই কোথায় যে হারিয়ে যায়। বাকি দিন জুড়ে বিরাজ করে অখণ্ড নৈঃশব্দ্য। আজ এখানে তুষারপাত হবে। আবহাওয়ার পূর্বাভাস তাই বলেছে। পুরো "রোজা জানে মন" গানের দৃশ্যাবলীর মত শুভ্র চাদরে নিজেকে মুড়ে নেবে চরাচর। মুঠোফোন নিয়ে প্রস্তুত আমিও, তুষার স্নান করার জন্য, এমন সময় বেজে উঠলো অ্যালার্ম।


তুত্তুরীর পরীক্ষা চলছে, ষাণ্মাসিক। তাকে স্কুলে ছাড়তে, রোজ যে কেন আমাকেই যেতে হয়? গজগজ করতে করতে উঠেই পড়লাম। স্বপ্ন দেখার বিলাসিতা যার পোষায় সেই দেখুক। ঘুম ভেঙেছে তারও, তবুও তিনি উঠবেন না। চাদর মুড়ি দিয়ে ঝগড়া করবেন গলা ফাটিয়ে, তবুও না। মেয়ে যেন আমার একার।

এত ভোরেও শ্বশুর-শাশুড়ির ঘরে আলো জ্বলছে, উঁকি মেরে দেখি শাশুড়ি মাতা নিদ্রিতা, নিঃসঙ্গ শ্বশুরমশাই ডুবে আছেন বইয়ে। স্বল্পদিন হল ওনাদের কাঁথিতে নিয়ে এসেছে শৌভিক। শাশুড়িমাতা বড়ই অসুস্থ হয়ে পড়েছিলেন। এখনও যে সম্পূর্ণ সুস্থ তা নয়, সারাদিন কেমন যেন ঝিমোচ্ছেন। যখনই শ্বশুরমশাইয়ের ঘরের দরজায় এসে দাঁড়াচ্ছি, সেই কথাই হচ্ছে দুজনে। যে মহিলাকে উনি এবং ওনার দুই পুত্রবধূ যমের মত ডরায়, তিনি এমন নিস্তেজ হয়ে পড়লে কি করে চলবে। ছায়ার সাথে তো আর যুদ্ধ করা চলে না।


"মাসি! মাসি!" করে ডেকেই চলেছে তুত্তুরী। গত রাতের বাসি বিনুনীর উপর চিরুনি বুলিয়ে, ঝুরো চুলে দুটো ক্লিপ আটকাতে হবে। এটা রোজ মোলায়েম হাতে মাসিই করে দেয়। আজ মাসি বড় ব্যস্ত সকাল থেকে। ঠাম্মা দাদুর চা, সময়ে প্রাতঃরাশ, আমাদের অফিস টাইমের ভাত, দুপুরের টিফিন- মাসির নাকের জলে,চোখের জলে অবস্থা। সরকারী সহযোগী একজন আছেন বটে, তাঁর আসতে সাড়ে সাতটা বেজে যায়। বার দুয়েক মৃদুভাবে বললাম," আয় আমি করে দিই।" শুনলে না। এরা বাপ-মেয়ে কেউ ভালো কথা শোনার পাত্র নয়। অগত্যা রুদ্রমূর্তি ধরতেই হয়। বৃদ্ধ - বৃদ্ধার উপস্থিতিতে গলার আওয়াজ চড়াতে পারি না, তাতেও কোন সমস্যা নেই। নীরবে কিভাবে আত্মারাম খাঁচা ছাড়া করতে হয়,বিগত এক যুগের মাতৃত্ব আমায় ভালোভাবেই শিখিয়ে দিয়েছে।


মেয়েকে গাড়িতে তুলছি যখন, মাসি ছুটতে ছুটতে এল, "তোমার মাসি তোমারই থাকবে সোনা মা। কেউ তাকে চুরি করছে না।" এতক্ষণে হাসি ফুটল তার মুখে। বয়স বাড়ছে, মাথাটা যে কবে বাড়বে মেয়েটার।এখন ভালো করে পরীক্ষাটা দিলে বাঁচি। যেটা নিয়ে সামান্যতম বাক্যব্যয়েও তিনি উৎসাহী নন। বাসা থেকে ইস্কুল গোটা পথটা তিনি উল্টে আমার পড়া ধরতে ধরতে গেলেন।" মা একজন ফুটবলারের নাম বল তো?" এত সকালে যার কথা প্রথম মনে পড়ল, তাই বললাম। "সুব্রত ভট্টাচার্য।" দীর্ঘশ্বাস ফেলে তিনি বললেন, " থাক।বুঝেছি। আমি নাম বলছি, তুমি বলো তুমি এদের চেনো কি না?" অতঃপর একে একে গাড়িতে সওয়ার হলেন পুসকাস, প্লাতিনি, বেকেনবাওয়ার, মালদিনি, পেরলো সহ আরো ৪১ জন।


বাড়ি ফিরে আরেকবার মেসেজাঘাত করলাম আমার টিমকে, "সবাই পাক্কা দশটার মধ্যে ঢুকে যেও বাবা।" ডি এম সাহেবকে নিয়ে আমাদের বন্ধন ও শ্রম সখ্য উৎসব শুরু হবে পাক্কা সাড়ে বারোটায়।  শেষ মুহূর্তে সবকিছু ঝালিয়ে নিতে হবে আরো একবার। বড় সাহেবের আজ মহানগরের মিটিং,  ওনার অনুপস্থিতি আরো ঘাবড়ে দিচ্ছে আমাদের।


যেখানে বাঘের ভয়, সেখানেই কেন যে সন্ধ্যা হয়। কাঁথির কুখ্যাত জ্যামে আটকে যখন অফিস ঢুকলাম, সোয়া দশটা। বার বার মিলিয়ে নিতে থাকি সবকিছু। কোথাও কিছু ভুলে যাইনি তো -। কিছু বাকি থেকে যায়নি তো? হল, ফ্লেক্স, লোকজন, চা, জল, টিফিন, ভিআইপি ফোল্ডার, ফোল্ডারে দেওয়ার রিপোর্ট, প্রেস নোট - রেডি আছে তো সব? আর রাখি? অনুষ্ঠানের জন্য স্থানীয় এক প্রতিবন্ধী মহিলা স্বনির্ভর গোষ্ঠীর থেকে সুদৃশ্য পাটের রাখি আমরা আগেই কিনে রেখেছিলাম।গত সন্ধ্যায় নভোনীল বাবু প্রস্তাব দিলেন, আমাদের স্কিমের নামওয়ালা রাখি বানালে কেমন হয়? রাখির আগের সন্ধ্যায় কে রাখে আমাদের আব্দার? অগত্যা চালাও পানশি কোলাঘাট। 


সাড়ে দশটা, নাগাদ দেখি,SLO প্রণব বাবুর কন্যা বানিয়ে এনেছে গোটা ১৫ রাখি, যাদের ওপর সুন্দর করে লেখা আছে কি করি আমরা। ডিএম সাহেবের মণিবন্ধে মঙ্গলসূত্র বাঁধবে কে, এই নিয়ে ধন্ধে ছিলাম আমরা। আজ সেই ধন্ধের অবসান হল। স্রষ্টাই বাঁধুক তার সৃষ্টি। 


পৌনে এগারোটার সময় হক বাবু এসে খবর দিলেন,"ম্যাডাম একটু সমস্যা হইছে। SLO রা বুঝতে পারছে না, কখন আসবে। আমায় বেশ কয়েকজন ফোন করছে।" কি সর্বনাশ, অত করে বললাম যে সাড়ে এগারোটার মধ্যে হল ভরে যাওয়া চাই। 

সাড়ে এগারোটা, হলে যাব বলে বেরোতে যাচ্ছি,দল বেঁধে ঢুকল ডিএম অফিসের সুইপার দিদিরা। কব্জিতে বেঁধে দিল সুগন্ধী ফুলের রাখি। হাতে ধরিয়ে দিল এক বাক্স মিষ্টি। 

বেলা বারোটা নাগাদ সেমিনার হলে প্রবেশ করে মাথা ঘুরে গেল।লোক কই? হল তো অর্ধেক ও ভরেনি। যাঁরা এসেছেন তাঁরাও একে অপরকে রাখি বাঁধতে ব্যস্ত। কি বকান বকলাম সবকটাকে, প্রধান অতিথি অনুপস্থিত আর আপনারা রাখি বেঁধে ফেললেন? উনি এসে দেখে কি ভাববেন? আমি নিজে খুলে এসেছি প্রিয় ফুলের রাখি খানা।বাড়িতে কাউকে নিমন্ত্রণ করে, আগে কি নিজেরা খেয়ে নেন?  আর লোকজন অনুপস্থিত কেন? হলের পিছনের দরজা দিয়ে ঢুকবেন ডিএম সাহেব, আর ঢুকে দেখবেন পিছন দিকটাই গড়ের মাঠ? দপ্তরের মান ইজ্জত বলেও তো কিছু আছে নাকি?


সাড়ে বারোটা নাগাদ শুভদীপ্ত যখন খবর দিল, ডিএম স্যার চেম্বারে ঢুকেছেন, নভোনীল বাবু আর হক বাবু তখন সামনে বসা লোকজনকে ফাঁক ফাঁক করে বসাচ্ছেন। যাতে হলটা ভরাট লাগে। প্রথা মাফিক ডিএম স্যারকে ডাকতে গিয়ে দেখি, ইলেকশন কমিশন থেকে কারা যেন এসেছেন। ভয়ানক ব্যস্ত ডিএম স্যার। আমায় দেখে বললেন," তোমরা শুরু করে দাও। আমি একটা সোয়া একটা নাগাদ যাব। অসুবিধা হবে কি?"


ঐ মুহূর্তে এর থেকে বড় সুবিধে আর কি হতে পারে? লোকজন এসেই যাচ্ছে, হল ভরে উঠছে ধীরে ধীরে। সুইপার দিদি গুলোকেও ডেকে নিয়েছি আমরা। ওদের সবার বই আছে। ওরা সবাই আমাদেরই তো লোক। ঠিক একটা পাঁচে ডিএম স্যার যখন এলেন, হল তখন কাণায় কাণায় ভরে উঠেছে। আমার ছেলেগুলোর আর বসার জায়গা নেই।

বলেছিলেন ৫ মিনিটের বেশি সময় দিতে পারবেন না, কার্যক্ষেত্রে আধ ঘন্টারও অনেক বেশি ডিএম স্যার আমাদের জন্য ব্যয় করলেন। রাখি পরলেন, শ্রমিকদের হাতে বেনিফিট তুলে দিলেন, মনোজ্ঞ বক্তৃতা দিলেন। উনি চলে যাবার পর শুরু হল আমাদের রাখি উৎসব। আগামীকাল থেকে শুরু হতে চলেছে দুয়ারী সরকার। মারাত্মক চাপে থাকবে সবাই। আসতে চলেছে নতুন প্রকল্প। তার আগে একটা দিন সবাই প্রাণ খুলে আনন্দ তো করুক।  সবার আগে মার্জনা চেয়ে নিলাম, খুব বকেছি না?  তমলুক ব্লকের দুই বয়ঃজ্যেষ্ঠা কালেক্টিং এজেন্ট এসেছিলেন, যাবার সময় বলে গেলেন," আমরা মোবাইলের দিকে তাকিয়ে বসে থাকি ম্যাডাম।কবে আপনি ডাকবেন।"


এত ভালো দিনটায় এক ফোঁটা চোনার মত ছিল বড় সাহেবের অনুপস্থিতি। মহানগরের মিটিং সেরে উনি যখন ঢুকলেন, ঘড়িতে প্রায় তিনটে বাজে। স্যার বলেছিলেন বটে, সবাইকে ছেড়ে দিতে, আমাদের মেয়েগুলো কেউ ফিরে যায়নি। হোক না আমার ছোট্ট চেম্বার, তাও পুষ্পস্তবক-উত্তরীয় দিয়ে বরণ করা হল, রাখি বাঁধা হলো প্রথা মাফিক।


সব মিটলে ভেবেছিলাম টুকুস করে পালিয়ে আসব। কাল তুত্তুরীর দুটো পরীক্ষা। কার্যক্ষেত্রের তিন দফা ভি সি সেরে বাড়ি ঢুকলাম যখন, ঘড়িতে রাত আটটা। তুত্তুরীর মুখ ভার। বলেই দিল," আমার পরীক্ষার কথা তোমায় ভাবতে হবে না।"


অভিমানী মেয়ে বলতেই পারে, কিন্তু ভাবতে যে আমাকে হবেই। ভাবতে হবে, দিনের এই শেষ কয়েক ঘন্টার মধ্যে কতখানি সময় বরের সাথে কফি কাপ নিয়ে গুলতানি করে কাটাব, কতটা সময় শাশুড়ির পাশে বসে সারা দিনের তত্ত্বতালাশ করব। শ্বশুরমশাই এর সাথে দেশদুনিয়ার চর্চা করব, তারপর গান শুনতে শুনতে সান্ধ্যভ্রমণের নাম করে মেয়েটাকে টেনে আনব বাগানে। কৃষ্ণ প্রতিপদের বুড়ি চাঁদের আলোয়, বকুল-গুলঞ্চ আর কামিনী ফুলের দম বন্ধ করা সৌরভী বাতাস ফুসফুসে ভরতে ভরতে কায়দা করে জানতে চাইব, কেমন হয়েছে আজ সকালের পরীক্ষা? কেমন হবে আগামী কালকের পরীক্ষা?  ভাবতে আর পারতে যে আমাকে হবেই। মায়েদের যে না পারলে চলে না।

অনির ডাইরি ৯ই সেপ্টেম্বর, ২০২৩

 

#অনিরডাইরি 


তাম্রলিপ্ত নগরীতে পা রাখার সাথে সাথেই সকলে সাবধান করেছিল,“আর যেখানেই যাও না রে ভাই সপ্তসাগর পার-” অমুক জায়গায় যেন যেও না খবরদার। অমুক হল এমন একটা পঞ্চায়েত, যেখানে নাকি বৃষ্টির মত পটকা পড়ে। হাতা-খুন্তির মত ঘরে ঘরে অস্ত্র রাখা থাকে। ওখানকার মেয়েরা নাকি পুরুষদের থেকেও বেশি লড়াকু এবং দুর্ধর্ষ। ব্রুস লির থেকেও দ্রুত গতিতে আঁশ বটি চালায়।


বহিরাগত কেউ সেথায় পা রাখলেই হল, আসুনD পথ দেখিয়ে দিই বলে তাকে ভুলিয়ে ভালিয়ে নিয়ে যাবে বাড়িতে। তারপর দরজা জানলা বন্ধ করে প্রশ্ন করবে, “বল কোন পার্টি করিস?” এবার কি জবাব দেবেন আপনি? ধরুন “দাদা আমি এখনও যে ইস্কুলে পড়ি” অর্থাৎ অরাজনৈতিক বললেন। অমনি ঘচাং ফুঃ। Rধরুন আপনি সত্যিই রাজনৈতিক ভাবে সচেতন এবং কোন বিশেষ দলের সমর্থক। তাই বললেন  বুক ফুলিয়ে। যদি মিলে যায়, জামাই আদরে পৌঁছে দিয়ে আসা হবে আপনার গন্তব্যে। আর যদি না মেলে? এই প্রশ্নের জবাবে নীরব থাকেK সবাই। সচেতন ভাবে তৈরি করে ভয়ের আবহ। 


গল্প শোনায় আপনি একবার ইউট্যুব খুলে সার্চ করেননি, Dদেখবেন কেবল মারামারির ভিডিও। গল্প শোনায় ওই সালে,  ডিএম সাহেবের গাড়ি আটকে দিয়েছিল কারা যেন। সেই সালে এসপি সাহেবেরR গাড়ি ভাঙচুর হয়েছিল। জাতীয় স্তরের তমুক নেতার গাড়ি ঘিরে সবাই মিলে তবলা বাজিয়েছিল।এছাড়া ঐ দলের পদাধিকারীকে এমন ভাবে হত্যা করা হয়েছে, তমুক দলের পদাধিকারীকে সপরিবারে উচ্ছেদ Kকরা হয়েছে এসব তো আছেই। 


তমলুকে এটা আমার পঞ্চম দুয়ারে সরকার। প্রায় সব ব্লকের সব পঞ্চায়েতের ক্যাম্পে পা রাখলেও আজ অবধি ওখানে যাওয়া হয়নি। আমি এমনিতে বেশ ডাকাবুকো। যেতেও ইচ্ছুক, এমন বীর এবং বীরাঙ্গনাদের স্বচক্ষে প্রত্যক্ষ করতে উদগ্র। কিন্তু প্রতি বার বেঁকে বসেন ইন্সপেক্টর সাহেব। “না ম্যাডাম। যেনে শুনে আপনাকে ওখানে নিয়ে যেতে পারি না।”


 Dবাঁশের চেয়ে কঞ্চি দড়, ইন্সপেক্টর যত বলে, SLO কুল চিৎকার করে তার দেড় গুণ। “না ম্যাডাম, ওখানে যাবেন নি।” পাশের, তার পাশের পঞ্চায়েতের SLOরা গল্প শোনায়, ‘জানেন ম্যাডাম, ঐ দুয়ারে সরকারে স্যার তো আমাদের ডিউটি দিয়েছিলেন। গিয়ে দেখি যে স্কুলে ক্যাম্প, তার গেটে তালা। সব শুনশান। হেড স্যারR পাশেই ভাড়া থাকেন, তার দরজা পিটিয়ে তাঁকে ডেকে তুললাম। তিনি Kকইলেন,‘ আজ নাকি? অ। তা তুমরাই চাবি নিয়ে গিয়ে খুলে বসো।’


 আর একজন বলে,‘ সেই যে সে বার, স্যার বললেন, তুমিও যাও। স্থানীয় SLO একা সামলাতে পারবেনি। তো গ্যালাম ভগবান ডাকতে ডাকতে। গিয়ে দেখি,যে স্কুলে ক্যাম্প, তার পাশের মাঠে বাইক রাখতে হয়। সেখানে একটা গুমটিতে একটা লোক বসে বসে পেটো বাঁধছে। আমার তো আত্মারাম খাঁচছাড়া। তাকে জিজ্ঞাসা করলাম,‘ ভাই মোটর সাইকেল এখেনে রেখে যাব? কিছু হবেনি তো? আমি গরীব মানুষ, অনেক কষ্টে কিনিছি।’ তো লোকটা পেটো বাঁধতে বাঁধতে ঘাড় তুলে কইল,‘যাও যাও। আমি দেখব তোমার মোটর সাইকেল।’


ক্যাম্প শেষে, ইষ্ট নাম জপ করতে করতে গ্যালাম মাঠে। দৃঢ় বিশ্বাস যে আমার মোটর সাইকেল এতক্ষণে উড়ে গেছে। গিয়ে দেখি লোকটা তখনও পেটো বাঁধছে। আমার সাইকেল অক্ষত। আমাকে দেখে হেসে বলল,‘এ নাও গো। তোমার সাইকেল। এটা অমুক জায়গা, এখেনে আমরা পেটোও বাঁধি আবার সাইকেলও রাখি।”


গতকাল আড়াইটে নাগাদ ইন্সপেক্টর সাহেব যখন মেসেজ করলেন,‘ম্যাডাম আজ আমি ঐ ক্যাম্পে। যা ভিড়। সব রেকর্ড ব্রেক করে দিল। সিস্টেম না ভেঙে পড়ে হুড়মুড়িয়ে।” হেব্বি রাগ হল। আরে আমায় বলবি তো। আম্মো যেতাম। রাত পৌনে আটটা নাগাদ, আঞ্চলিক শ্রম দপ্তরে গ্রুপে একটি ভিডিও পোস্ট করল স্থানীয় SLO ছেলেটি। শেয়ার করছি না। ছেলেটি এবং ইন্সপেক্টর সাহেবের পরিচয় প্রকাশ করার কোন ইচ্ছে নেই বলে। 


ভালো করে দেখলাম, খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলাম, কই কেউ তো বোমা, পেটো নিয়ে আসেনি। ছুরি-ছোরা, ঘোড়া-পিস্তল,আঁশবটিও তো নেই। আর পাঁচটা ক্যাম্পে ভিড় করে আসা মানুষ জনের সঙ্গে কোন প্রভেদই তো নেই এণাদের। বললামও কথাটা। স্থানীয় ছেলেটি বলল,‘ তবেই বুঝুন ম্যাডাম। কেমন অপপ্রচার চালায় লোকজন। বাঁধছে আতশ বাজি এরা তাকে পেটো ভেবে ভয়েই অস্থির হয়ে যায়। ”


কে জানে, কোনটা সত্যি, কোনটা (অপ)প্রচার। সব ছাপিয়ে আমি দেখতে পেলাম আমার ইন্সপেক্টরটাকে, আমার SLOদের। ক্যাম্পের সময় সীমা কখন পেরিয়ে গেছে। পাটে বসতে চলেছেন সূর্যদেব। তাও ক্যাম্প গুটিয়ে ওঠেনি ওরা। মোবাইলের টর্চ জ্বেলে কাজ করছে। যতদূর ভদ্রভাবে পারা যায়, ফর্ম দিচ্ছে, নিচ্ছে।তথ্যের আদানপ্রদান করছে। 


কাল ঘোষণা হবে চূড়ান্ত সফল দুয়ারে সরকার। বাহবা কুড়োবেন আসল রণাঙ্গন থেকে অনেক অনেক উঁচুতে আলোকবর্তিকায়  বসবাসকারী কিছু মানুষ। আসল সৈনিকদের কথা ভাবার মত অবকাশ তাঁদের কই। হুকুমের চাবুক, সমালোচনার ভর্ৎসনা  থামিয়ে একটু প্রশংসা,দু- একটা মিষ্টি কথা, অতিরিক্ত একটাকা সাম্মানিকও জুটবে না মোদের কপালে। আমাদের জন্যই যে বজায় থাকে রাষ্ট্রের কল্যাণমূলক রূপ, রাষ্ট্র সে কথা ভাবে না।  নাগরিকগণ ভাবেন কি? দূর। তাঁরা ব্যস্ত হয়ে পড়বেন, সরকারী কর্মীদের মুণ্ডপাতে। নামি সাহেবী ইস্কুল থেকে পাশ করা, দামী প্রাইভেট হাসপাতালে প্রাক্টিস করা জনৈক ডাক্তার বাবু যেমন সেদিন চিবিয়ে চিবিয়ে কইছিলেন, “... private healthcare is a lucrative business arena now, but the basic flaw lies in the govt. sector with no work culture..esp. in Eastern India।" সব শুনে দীর্ঘশ্বাস ফেলে,  “বলেছিলাম ওদের ভালো হোক। ” এত ঐশ্বর্য, এত উপার্জনের পরেও দরিদ্র সরকারী লোকজনের প্রতি এত অসুয়া, এত মাৎসর্য যখন, কুছ তো বাত হ্যায়, যা হয়তো আমরাই দেখতে পাই না।

অনির ডাইরি ২৪শে সেপ্টেম্বর, ২০২৩

 

#অনিরডাইরি 

সদ্য অফিস থেকে বাড়ি ফিরেছি, মুখ হাতটা ও ভালো করে ধুইনি, এক মুঠো খুচরো পয়সা, দু চারটে ভাঁজ করা ময়লার নোট আমার সামনে ফেলল তুত্তুরী। "মা এতে ১১৩ টাকা আছে, তুমি খুচরো গুলো নিয়ে আমাকে গোটা নোট দিতে পারবে?" সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, "কেন রে? আর তুই এত টাকা পেলি কোথা থেকে?" সামান্য নার্ভাস হয়ে বার কয়েক নাক চুলকে তিনি জবাব দিলেন," ওই যে তোমরা মাঝেমধ্যে টাকা দাও না, স্কুলে যদি কোন দরকার পড়ে বা কিছু কিনে খেতে ইচ্ছে করে-সেটাই জমিয়ে রেখেছিলাম। রথের দিনও কিছু টাকা পেয়েছিলাম।" 


আবার প্রশ্ন করি, "তুই এই টাকাটা নিয়ে করবি কি?" জবাব আসে, স্কুলে কোন এনজিও থেকে এসে বলেছে কিছু চাঁদা তুলে দিতে, দাতব্য বৃদ্ধাবাস বানানো হবে। যারা ১০০ বা তার বেশি তুলবে তাদের কোন ফুটবলারের অটোগ্রাফ দেওয়া হবে যেন। চোখের সামনে থেকে সরে যায় না জানি কতগুলো বছর, ভেসে ওঠে সাদাকালো কিছু দৃশ্য। এমনই একটা এনজিও এসেছিল আমাদের স্কুলেও। এমনি মাত্রা ধার্য হয়েছিল চাঁদার। মাত্রা ছাড়াতে পারলে জুটত তৎকালীন ভারতীয় ক্রিকেট টিমের অটোগ্রাফ। পেয়েও ছিলাম আমি, লম্বা সাদা কাগজে পাশাপাশি দুটো কলামে বারো জন ক্রিকেটারের নাম আর স্বাক্ষরের সস্তা ফটোকপি। আজও রাখা আছে কাগজটা, যত্ন করে হাওড়ার বাড়িতে।


খানিক কথা বলেই বুঝলাম, “আবার সে এসেছে ফিরিয়া”। বললাম, বৃদ্ধাবাসের জন্য চাঁদা তোলা তো খুব ভালো কথা, তো চাদা তুললেই তো পারিস। জমানো ব্যাঙের আধুলি খরচা করছিস কেন? "কার থেকে চাঁদা চাইব মা? কিভাবে চাঁদা চাইব মা?" কাতর স্বরে প্রশ্ন করে তুত্তুরী। বাইরের ঘরে বসে সকালের বাসি সংবাদ পত্রখানা রিভিশন দিচ্ছিলেন শ্বশুরমশাই, ইশারাতে বললাম, "ধর দাদুকে।"


সঠিক পথ দেখিয়েছি, অচীরেই বুঝতে পারলাম। পিতামহ শুধু নিজে দিলেন তাই না, পিতমহীর নামেও দিলেন। সেই খবর মুঠোফোনে যখন হাওড়া পৌঁছালো, তুত্তুরীর মাতামহ জানতে চাইল, "দাদু কত দিয়েছে? আচ্ছা, ওর ডবল তুমি আমার নামে লেখো। আচ্ছা, ঠাম্মার নামেও দিয়েছে! তুমি আমার পাশাপাশি মামমাম (দিদা), দিদি (পিসি), আর লক্ষ্মীর (আয়া দিদি) নামও লেখো।" নাম লেখা তো হল, টাকাটা হাওড়া থেকে আসবে কি করে? দাদু উদার স্বরে বলল, " তোমার মাকে দিয়ে দিতে বল। হাওড়া এলে আমি দিয়ে দেব। এমনি দেবে না, আমার মেয়েটা যা কিপটে, বলো তোমারটাও দাদু দিয়ে দেবে বলেছে।" 


গল্প এখানেই থামল না রোজ বাড়ি ফিরি আর দেখি উত্তরোত্তর বাড়ছে চাঁদা দেওয়া লোকের সংখ্যা। তুত্তুরী মুখ ফুটে না চাইতেই বাড়ছে, শাশুড়ি মায়ের জন্য যে আয়া দিদিকে রাখা হয়েছে, তিনি দিয়েছেন। বাংলায় রান্না করে যে ছেলেটি, সে আর তার চার দিদি দিয়েছে। তুত্তুরীর মাসি, তার দুই মেয়ে, জামাই, নাতি সবার নাম লেখা রয়েছে কাগজে। লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে চাঁদার অঙ্ক। চওড়া হচ্ছে মেয়ের মুখের হাসি। বুঝতে পারি পাশ করে গেছি পরীক্ষায়। 


দিন কয়েক পরের কথা, অফিস থেকে ফিরেছি, দেখি মেয়ের মুখ ভার। চোখ ছলছল। "তোমার কি একটু সময় হবে?" কান্না চেপে প্রশ্ন করে তুত্তুরী। ১৫০ কিলোমিটারের দৈনন্দিন যাতায়াত, গুচ্ছের দপ্তরী ঝামেলা আর জটিলতায় জেরবার হয়ে বিকট তিতকুটে মুডে সদ্য বাড়িতে পা রেখেছি। কয়েক মুহূর্ত আগেও শারীরিক ক্লান্তি আর মানসিক তিক্ততায় ভেঙ্গে পড়তে চাইছিল শরীর, মেয়ের অবস্থা দেখে কোথায় যেন উবে গেল সব ক্লান্তি আর বিষণ্ণতা। অফিসের ঘেমো পোশাক, নোংরা হাতপায়েই ধপ করে বসে পড়ি, "কি হয়েছে বাবু?" বিশদে শুনি, শিক্ষক দিবস উপলক্ষে বড় অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা করেছে তুত্তুরীর ক্লাশ। তাতে আমন্ত্রণ জানানো হবে স্কুলের সব স্যার আর ম্যাডামদের। ছাত্রছাত্রীদের নাচ-গান-আবৃত্তি-শ্রুতিনাটকে ঠাসা জমজমাট অনুষ্ঠান। ইংরেজি-বাংলা দুটোই ভালো বলতে পারে বলে, ক্লাসের সর্বসম্মতিক্রমে এই অনুষ্ঠানের সঞ্চালনা বর্তেছে তুত্তুরীর ওপর। কাজটা খুব পছন্দ ওর। আজ স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে হঠাৎ তার অডিশন নিতে আসেন কোন স্যার। তিনি যখন আসেন, টিফিন খেয়ে হাত ধুতে গিয়েছিল তুত্তুরী। ক্লাস যে চার পাঁচজন ছেলেমেয়েকে সিলেক্ট করেছে, ও ছাড়া বাকিরা কপাল গুণে ক্লাসেই ছিল। তারা অডিশন দিয়েওছে, সব শেষে স্যার যখন জানতে চেয়েছেন, আর কেউ দেবে কি না, তখন কয়েকজন তুত্তুরীর নাম বলেছে, আর একজন বলেছে, "ওর অডিশন নেবার দরকার নেই স্যার, ও খুব একটা স্মার্ট নয় আর একটু তোতলায়।" সেই শুনে স্যার, আর অপেক্ষা করেননি, চলে গেছেন। 


যে মেয়েটি বলেছে,আজ সকালেও তার গুণমুগ্ধ ছিল তুত্তুরী। তার মুখে এই কথা তুত্তুরীর কাছে চরম বিশ্বাসঘাতকতার সামিল। " মা তুমি বলো, আমি কি তোতলাই? ও কেন এমন করল মা?" ক্রন্দসী কন্যাকে কি বলে সান্ত্বনা দিই খানিক মাথায় আসে না। বুঝতে পারি এবারের পরীক্ষা বেশ কঠিন। "ওকে তো আমি ভালো বন্ধু ভাবতাম মা। গত বছর নভেম্বরে যখন ভর্তি হলাম, ও আমাকে ওর সব খাতা দিয়েছিল। আমিও দিই। টিফিন ভাগ করে খাই আজও -"। বলতে ইচ্ছে করে, এই তো জীবন কালিদা। এটাই মানবচরিত্র। বলতে ইচ্ছে করে, জীবনের প্রতিটি বাঁকে, প্রতি পদে তুমি এমন মানুষ পাবে। 


বলি না। কি দরকার, কয়েকটা পুঁচকে ছেলেমেয়ের ঝামেলায় নাক গলিয়ে, কি দরকার এত অল্প বয়সে মেয়ের মন বিষিয়ে দিয়ে। বরং স্বাবলম্বী হবার শিক্ষা দিই। ঢোঁক গিলে বলি, “ব্যাপারটা কি তোর কাছে খুব গুরুত্বপূর্ণ?” জোরে জোরে মাথা নাড়ে তুত্তুরী। তাহলে তো তোর জন্য, তোকেই লড়তে হবে। স্যারকে গিয়ে বলতে হবে, “আমাকে অডিশন দেবার একটা সুযোগ দিন।” তারপর উনি যা সিদ্ধান্ত নেবেন সেটাই মাথা নত করে মেনে নিতে হবে। ব্যাপারটা বেশ মনে ধরে তুত্তুরীর, সাময়িক ভাবে মনে হয় পাশ করে গেছি, ভুল ভাঙে, পরদিন প্রভাতে। 


ভোর বেলা ঢুলতে ঢুলতে মেয়েকে স্কুলে ছাড়তে যাচ্ছি, অন্যমনস্ক ভাবে তুত্তুরী বলল, “ধর মা, স্যার আমার অডিশন নিলেন, নিয়ে আমায় সিলেক্ট করলেন, তাহলে তো আমার জন্য আমার অন্য বন্ধুরা বাদ পড়ে যাবে, ওদের ও বিশ্বাসভঙ্গ হবে। তখন ওরাও তো ওদের মায়েদের কাছে আমার নামে একই কথা বলবে, তাই না?” ঘুমন্ত মস্তিষ্ককে কয়েক ঘা বেত্রাঘাত করে জাগিয়ে, সামান্য ভেবে বলি, সে সিদ্ধান্ত তো তোমাকেই নিতে হবে সোনা। যদি মনে করো, এটা তোমাকে পেতেই হবে, তাহলে লড়ো, আর যদি মনে করো, তোমার জন্য তোমার বন্ধুদের হৃদয় ভঙ্গ হবে, তাহলে লড়ো না। সমস্যাটা তোমার, তুমি যাই সিদ্ধান্ত নেবে, তাকেই আমি সম্মান করব। বিন্দুমাত্র ‘জাজ’ করব না। “থাঙ্কু মা” বলে এক গাল হেসে গাড়ি থেকে নেমে যায় তুত্তুরী। 


 দুপুর তিনটে নাগাদ সবে টিফিন বাক্সটা খুলেছি, মাসির মোবাইল থেকে উত্তেজিত তুত্তুরীর ফোন, “মা, মা আমি চান্স পেয়ে গেছি।” মেয়ের চিৎকারে বিষম খেয়ে খানিক কেশে বললাম, “আর বন্ধুরা?” তুত্তুরী বলল, “তুমি জানো, আমার জন্য ওরা কত বড় সাক্রিফাইজ করতে যাচ্ছিল, ওরা দল বেঁধে স্যারকে বলতে যাচ্ছিল, আমাদের চাই না, পুরোযাকে একটা সুযোগ দিন। যে বলেছিল আমি তোতলাই, সেও এসে ক্ষমা চাইল। আমি বললাম, ঠিক আছে, কাউকে কারো জন্য সাক্রিফাইজ করতে হবে না। চল সবাই মিলে গিয়ে স্যারকে বলি, মে দা বেস্ট ওয়ান উইন।” ফোন রেখে ঈশ্বরকে ধন্যবাদ দিই, না তুত্তুরী নির্বাচিত হয়েছে, তাই জন্য নয়, মা হিসেবে পাশ করেছি বলে। যেদিন থেকে মাতৃত্বের শিরোপা পরেছি, এটাই তো করে আসছি। কত রকম যে পরীক্ষা দিয়ে চলেছি, প্রতিটা মুহূর্তে, কখনও পাশ করছি, কখনও ডাহা ফেল। তিনি আমার সূর্য, তাঁকে ঘিরেই আবর্তিত হয়ে চলেছে আমার জীবন। প্রতিটা দিন, রাত, মুহূর্ত জুড়ে রাজত্ব করেন কেবল তিনি। আর আপনারা বলেন কেবল আজ নাকি কন্যা দিবস।