Wednesday 24 October 2018

পায়ের তলায় সর্ষে

আগরতলা থেকে উনকোটির দূরত্ব গুগল খুড়ো বলছে  ১৪৫কিলোমিটার।  আদতে আর একটু বেশী।গুগল নির্ধারিত সময়ের থেকেও আরো পৌনে এক ঘন্টা বেশী সময় লাগল যেতে। প্রায় পাঁচ ঘন্টা। দেখে পরিতৃপ্ত হয়ে গাড়িতে উঠে, জলটল খেয়ে খেয়াল হল, ও হরি ফিরতেও তো ঘন্টা পাঁচেকের গপ্প। শৌভিক বলল,“আর কি লাঞ্চ করার দরকার আছে?” আমি আর দেবু সমস্বরে বললাম,“দরকার কি? খিদে তো তেমন পায়নি। ” সত্যি বলতে কি আসার সময় ঐ প্যাঁচালো রাস্তায় বার তিনেক বমি করে এমনিতেই পাকস্থলীর অবস্থা কেরোসিন।
ড্রাইভার এতক্ষণ এক মনে পান মশলা চিবুচ্ছিল,এবার আর থাকতে না পেরে বলল,“আমি কিন্তু ভাইত খামু।” বাঃ তাহলে আমরাও বরং খেয়ে নেব। তা খাবেন কোথায়?পথে তো কোন দোকান বাজার দেখতে পেলাম না। ড্রাইভার বলল,“আপনারা কি উখানে খাইতে পারবন?ট্রাইবাল হোটেল আইজ্ঞা। তেমুন কিছু না। ” হোক না। ক্ষতি কি?
গাড়ি থামিয়ে একলাফে ড্রাইভার দৌড়ল হাত ধুতে। বাবারে মারে করতে করতে আমরাও নামলাম। সাত আট ঘন্টা ঘন্টা গাড়িতে বসে থাকা,তারওপর ঘন্টা দেড়েক দৌড়োদৌড়ি। কোমর, পিঠ, পা বাবারে মারে করবে না?
হোটেল লাম্প্রাই। মাটির মেঝে। টালির চাল। কাঠের বেঞ্চ। বেঞ্চের ওপর স্টীলের চকচকে থালা আর গ্লাস উল্টে রাখা। দেবু,শৌভিক আর আমি একটা বেঞ্চে বসলাম। সব কিছুতে অসম্ভব পরিচ্ছন্নতার ছাপ। একজন আদিবাসী ছোকরা এগিয়ে এল, আমরা ঠিক করেছিলাম ডিম ভাত খাওয়াই ভাল। জিজ্ঞাসা করা হল, কি আছে? আধো আধো বাংলায় বলল,“শুয়োর,মোরগ আর মাছ আছে। ” মোরগ দিতে বলা হল। সর্বপ্রথমে থালায় পড়ল ভাত,কাগজী লেবুর টুকরো,এক টুকরো পেঁয়াজ আর একটা কুঁচি কাঁচা লঙ্কা। একনজরে দেখে মনে হবে,চিঁড়ে ভিজিয়ে নিকড়ে মণ্ড করে দিলে যেমন লাগে। তারপর যেটা এল দেখেই আমরা বললাম শুক্তো। জবাব পেলাম “কুটো কুটো।” পরে শুনলাম ঐটাকে ভুদকও বলে।  ছিঁটে ফোঁটা তেল দিয়ে রান্না করা। প্রচণ্ড ঝাল।মুখে দিতেই কি যেন একটা মুখে পড়ল। চিবিয়ে গিলতেই পারি না,ছিবড়েটা কেমন যেন মরা উচ্চিংড়ে টাইপ। তেমনি বিকট গন্ধ। পরে জানতে পেরেছিলাম ওগুলো আসলে শুঁটকি মাছ। পাশে শৌভিক আর দেবু দেখলাম গবগব  করে খাচ্ছে। বললাম আর কি আছে? সব্জি এল। পাতলা জলের মত সব্জি,তেল ছিটিয়ে, হাল্কা হলুদ, নুন আর গুচ্ছ গুচ্ছ ঝাল দিয়ে বানানো। তরকারীর সব্জির মধ্যে খোলা সমেত আলু আর স্কোয়াশ চিনতে পারলাম। আর একটা কি যেন ছিল ছিল। সাদা সাদা,গোল গোল,কচকচে খেতে। শৌভিক জিজ্ঞাসা করল ,“এটা কিসের তরকারী গো?” জবাব পেলাম “বাঁশ।” ব্যাম্বু  এর আগে খেয়েছিলাম বটে চাং ওয়া রেঁস্তোরায়।  বাঁশের সব্জি আরও একবার খেলাম দিন দুয়েক বাদে ছবি মুড়ায়। মন্দ না। তবে স্থানীয় খাবারে ঝাল বড় বেশী। আর তেল ততোধিক কম। শেষে এল মোরগের মাংস । চার টুকরো , শুকনো খটখটে। ঝোল নেই।আমাদের কসা চিকেনের মত নয়, একেবারেই খটখটে শুকনো। তবে এই দিনের তারকা ছিল কাঁচা লঙ্কা। বাপরে এই টুকু লঙ্কার কি ঝাল! এক কামড় দিতেই মনে হল রীতিমত কান দিয়ে ধোঁয়া বেরোচ্ছে। দেবু আবার সাইজ দেখে তাচ্ছিল্য করে গোটাটা এক কামড়ে মুখে পুরেছিল- খেয়ে হাত ধুয়ে গাড়ি যখন আগরতলার দিকে ল্যাজ তুলে দৌড়চ্ছে তখনও জিভ অসাড় হয়ে আছে ঝালে। ড্রাইভার হাসতে হাসতে বলল,“এমন লঙ্কা শুধু ট্রাইবালদের লগেই পাবেন। গরীব মানষের খাবার। ” আগরতলা থেকে যখন প্লেনে উঠছি, দেখলাম সিকিউরিটি ধরে ধরে ব্যাগ চেক করছে, লঙ্কা বা লঙ্কার আচার পেলেই কেড়ে নিচ্ছে।মাইরি বলছি,মা কালীর দিব্যি, একটা প্লেন হাইজ্যাক করার জন্য এক ডজন ত্রিপুরী কাঁচা মরিচই যথেষ্ট ।

Monday 15 October 2018

ঘন্টা-


“মানা,এর মধ্যে কোনটা তোর দেওয়া?” উফ্ কি জ্বালাতন মাইরি,বেলা নটার সময় কাঁচা ঘুম ভাঙিয়ে এ কি প্রশ্ন রে বাবা। কোনমতে চোখ খুলে দেখি বাবার হাতে তিনতিনটে আনকোরা টিশার্ট। কোন মতে হাই চেপে বললাম,“রেমণ্ডের কোনটা দেখো না?অলিভ গ্রীন কালার। ”“হুঁ। তাহলে এটা। ”হৃষ্ট চিত্তে বলল বাবা। বুঝলাম আপাততঃ ঘুমের দফা গয়া। ঐ টি শার্টটি এবার গায়ে গলিয়ে বাবা জানতে আসবে, কেমন লাগছে? পেটটা কমেছে কি না? মাস তিনেক ধরে প্রাণায়াম করছে,তাতে নাকি বাবার ভুঁড়ি হড়হড়িয়ে কমে যাচ্ছে। সবকটা প্যান্ট ঢলঢলে হয়ে গেছে। বিগত শুক্রবার থেকে আমার পিছনে পড়ে আছে,“তুইও কর। ”
একটু বাদে আবার এসে হাজির,“মানা,দেখো তোমার মোচি। ”কি কুক্ষণে অনলাইন মোচির চটি কিনে দিয়েছি মাইরি,দাম শুনে ইস্তক গাল দিয়ে বাপের নাম ভুলিয়ে দিচ্ছে, তবে আজ মাঞ্জা দেবার জন্য পায়ে গলিয়ে পায়চারি করছে দেখলাম। আজ ঘন্টার বিবাহবার্ষিকী। আশ্বিন মাসে বিবাহ?আজ্ঞে হ্যাঁ মশাই,ঘন্টা ওরফে শ্রী দিলীপ দাস, আজ থেকে আঠারো আগে এমনি এক শারদ প্রভাতে সইসাবুদ করে বিয়ে করেছিলেন পাড়ার বুঁচিকে। শনিবার সাত সক্কালে লাঠি ঠুকঠুক করতে করতে ঘন্টানন্দ এসেছিলেন বাবাকে নিমন্ত্রণ করতে। আমি তখন মুরগীর মাংসে দই আর রসুন বাটা মাখিয়ে চটকাচ্ছি, বললাম,“খেয়ে যাও। ” বলল,“পাগল?তোর কাকিমা পঞ্চব্যঞ্জন রেঁধে বসে থাকবে রে পাগলী। ” তাজ্জব হয়ে গেলাম, কাকিমা অন্তত ৭৫,তিনি এত রাঁধেন নাকি? উত্তরে একগাল হাসতে গিয়ে বাঁধানো দাঁত প্রায় ছিটকে এল,“নাঃ। রাঁধুনী আছে,তবে বেড়ে তো দেয়। ঠাণ্ডা হয়ে গেলে গরম করে দেয়। ”বললাম,“চা খেয়ে যাও অন্তত। ” তো বলল,“দূর পাগলী। এখন চা খেলেই হিসি পাবে। তারপরই পাইখানা পাবে। ” মধ্যহাওড়ার ঘটি আমরা অত পরিশীলিত বাক্য ঘরোয়া আড্ডায় অনুগ্রহ করে আশা করবেন না।
১৯৫৮ সালে হাওড়া বেলিলিয়াস স্কুল থেকে স্কুল ফাইনাল পাশ করেছিল ৩৬জন ছেলে। তারপর কেটে গেছে ৬০টা বছর, গঙ্গা দিয়ে বয়ে গেছে না জানি কত জল আর কত রক্ত, সেদিনের তরুণ তুর্কীরা আজ অশীতিপর বৃদ্ধ,বিভিন্ন সময় ঝরে গেছে অনেকে,হারিয়ে গেছে কালের গর্ভে, কিন্তু ১৯৫৮ব্যাচের একতা আজও ঈর্ষণীয় ভাবে অটুট।
তো শ্রীমাণ ঘণ্টা বাবু,হ্যাট্রিক করে স্কুল ফাইনাল কোন মতে পাশ করেই বুঝেছিলেন মা সরস্বতী ওণার প্রতি তেমন সদয় নয়। বিশাল পরিবারের জেষ্ঠ্য পুত্র,মা বছর বছর মা ষষ্ঠীর কৃপায় বংশবৃদ্ধি করে চলেছে, বাবার রোজগারে আর হরিমটরও জোটে না। গোকুলে বাড়ছে ছয় ভাই আর চার বোন। অগত্যা পেটের ধান্ধায় ঘন্টা কাকু পাড়ি দিল সুদূর পাঞ্জাবের ফাগুয়ারা।
ফাগুয়ারা হতাশ করেনি,কটন মিলের দয়ায় হাতে দুচার পয়সা আসতেই দিলে জাগল আশনাই। যে পাঞ্জাবি মালকিনের বাড়িতে ভাড়া থাকত,তার ডাগর কন্যা, মনে হল গররাজি। রোজ সকালে স্নান করে ঘন্টা যখন ছাতে উঠত ভিজে গামছা মেলতে, অন্দরমহলের সিঁড়ি দিয়ে ঠিক সেই সময় বানোও উঠত ছাতে, তারপর? বিশাল ছাত জোড়া ভিজে পোশাকের এপাশ থেকে ওপাশে ছুটে যেত তির-এ-নজর। জখমি জিগর নিয়ে মিলে যেত ঘন্টানন্দ। ধীরে ধীরে সাহস করে ফুটোফাটা ইংরেজিতে প্রেম পত্র লিখেই ফেলল ঘন্টা। লুকিয়ে হস্তান্তর ও হল। জবাবও এল,চতুর্গুণ ভুলে ভরা,কিন্তু প্রেমরসে জবজবে। দিব্যি চলছিল,হঠাৎ বাধ সাধল,বানোর “মঙ্গেতর”।কি ভাবে যেন জানাজানি হয়ে গেল।  বেজাতে পিরীত? ব্যাপারটা এমন দাঁড়িলো ভোলি পাঞ্জাবন কে প্রেমের জালে ফেলেছে “শালা বাঙ্গালী”। কৃপাণ নিয়ে বানোর গোষ্ঠী গিয়ে হাজির কটন মিলে। কোনমতে প্রাণ নিয়ে পালিয়ে বাঁচল ঘন্টা। কাপুরথালা জেলারই অন্য মিলে কাজও জুটে গেল কর্মক্ষেত্রে অর্জিত সুনাম এবং ভদ্র ব্যবহারের জন্য।
এরপর আর জীবনে কোন মেয়ের দিকে তাকায়নি ঘন্টা। একমনে চাকরী করে গেছে আর বাড়িতে পয়সা পাঠিয়েছে। ঘন্টার অর্থেই মেরামতি হয়েছে ফুটিফাটা বাস্তুভিটের। একএক করে বিয়ে হয়েছে ভাই এবং বোনেদের। শুধু ঘন্টার বিয়ের কথাই কেউ কখনও ভাবেনি,বলেওনি। ঘন্টাও পেটে খিদে মুখে লাজ নিয়ে পালন করে গেছে জেষ্ঠ্য পুত্রের গুরুদায়িত্ব।
ষাট বছর বয়সে,অবসর নেবার পর, বোরিয়া-বিস্তর নিয়ে বাস্তুভিটেয় হাজির হয়ে ঘন্টা দেখল যে মায়ের অনুমতি এবং প্রচ্ছন্ন প্রশয়ে ভাইবোনেরা বাড়ি আপোসে ভাগ করে নিয়েছে। শুধু ঘন্টার ভাগেই লবডঙ্কা। এত মালপত্র নিয়ে থাকবে কোথায়?ভাইয়েরা নিরুত্তর।মাকে বলল,“মা তোমার ঘরে অন্তত থাকতে দাও। ”মা আমতা আমতা করে জানালেন, তাঁর ঘরটা তিনি তাঁর কোন প্রিয় নাতিকে দেবেন বলে প্রতিশ্রুতি বদ্ধ। তাই জ্যেষ্ঠপুত্রকে সেখানে জায়গা দেওয়া সম্ভব নয়। স্বদেশে ফিরে প্রথম রাতটা ঘন্টার কাটল সিঁড়ির সামনের তক্তোপোশে।
আজও মনে আছে,অফিস থেকে ফিরে সদ্য চায়ের কাপটা মুখে তুলেছে বাবা, পিসি চিৎকার করে উঠল,“হিটলার,তোর সঙ্গে একজন দেখা করতে এসেছে। ” আজ্ঞে হ্যাঁ আমার বাবার ডাকনাম হিটলার।
ঘন্টা কাকু নাকি আমাদের সাবেকী সদর দরজার সামনে দাঁড়িয়ে রীতিমত হাউমাউ করে কেঁদেছিল সেদিন। ধন্য বাবাদের ব্যাচের একাত্মতা। সেরাতে আর নিজের বাড়ি ফিরতে হয়নি ঘন্টাকে। মনোজকাকুর কিনে রাখা অতিরিক্ত ফ্ল্যাটে সাময়িক আশ্রয় পায় ঘন্টা কাকু। দিন সাতেকের মধ্যেই সরস্বতী ক্লাবের গলিতে এক সদ্য নির্মিত ফ্ল্যাটবাড়ির একতলায় একটা আনকোরা ফ্ল্যাটের চাবি ঘন্টা হাতে তুলে দেয় হারু কাকু। ঘন্টা নাকি ইতস্ততঃ করে বলেছিল,“এতগুলো টাকা-কোথায় পাই?সবটাকা তো ভাইঝিগুলোর বিয়ের জন্য ফিক্সড করে বসে আছি। ” বন্ধুরা একসঙ্গে নাকি চিৎকার করে উঠেছিল,“বাঞ্চোৎ ভাইঝি দেখাচ্ছো?রাস্তায় রাস্তায় ঘুরছিলে,কোন ভাইঝি বাঁচাতে এসেছে তোমায়?” মা পোস্টাফিস থাকায় খুব সুবিধা হয়,নামমাত্র সুদ হারিয়ে সব ফিক্সড ডিপোজিট ভেঙে ফ্ল্যাট কেনা হয়।
মাস ছয়েকের মধ্যে আমাদের বৈঠকখানা ঘরে সে কি হল্লা, হারু কাকুর গলা বোধহয় গলির মোড় থেকে শোনা যাচ্ছিল,“হারামজাদা বুড়ো হয়েও অালুর দোষ যায়নি?এটা ভদ্দরলোকের পাড়া।” নতুন বাড়িতে উঠেই ঘন্টা পাড়ার বুঁচির সাথে আশনাই জুড়ে দেয়। বুঁচি ও পাড়ার অত্যন্ত সম্মানীয় মহিলা, পিতৃমাতৃহীন ভাইবোনেদের একা হাতে মানুষ করেছেন,নামি স্কুলে শিক্ষকতা করতেন, শ্রী অরবিন্দের শিষ্যা ছিলেন,বছরে একবার পন্ডিচেরী যেতেন। নিয়মিত প্রাতঃভ্রমণ আর ধ্যান করতেন। এহেন বুঁচিকে কি ভাবে জপালো কটন মিলের এক মামুলী শ্রমিক কে জানে। তবে পাড়ায় ঢিঢি।
বাবা শেষে বলল,“কি চাস ঘন্টা? এভাবে আমাদের মুখ ডোবাস না। বিয়ে করবি?” ঘন্টা তো সাধিলেই রাজি। ওদিকে কুমারী বুঁচিও। এমনি শারদ প্রভাতে বন্ধুদের উদ্যোগে নতুন ফ্ল্যাটে সইসাবুদ করে সম্পন্ন হল বিয়ে।ঘন্টার পক্ষে অন্যতম স্বাক্ষরকারী আমার পিতা স্বয়ং। বুঁচির তরফে তার সহোদর। তারপর কেটে গেছে বছর আঠারো। বুড়োবুড়ি দুজনাতে মহাসুখে থাকে- বুড়ি বসে তামাক সাজে,বুড়ো বসে কাশে। ঘন্টাকাকুর বেতো নিম্নাঙ্গে ডেনিম ব্লু জিন্স সোচ্চারে ঘোষণা করছিল এই পচাগলা সমাজকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে কি অসম্ভব সুখে আছে দুজনায়।
ঠাকুর দেখতে বেরিয়েছি আমরা মা মেয়েতে, ঘড়ির কাঁটা সন্ধ্যে পাঁচটার ঘর পেরিয়েছে, রাস্তায় কি অসভ্যের মত জ্যাম মাইরি। একটা ট্যাক্সি পাচ্ছি না। ওলা উব্র সব ভোঁভা। ইতিমধ্যে “মা জিও” বার দুয়েক ফোন করে ফেলল। কি জ্বালা মাইরি,ওলা গাড়ি খুঁজছে,এমন সময় ফোন ধরলে সব ঘেঁটে যাবে। কেটে দিলাম। উফ্ মা যদি ফোন কেটে দেওয়াটা বোঝে। আবার করছে দেখো। খ্যাঁক করে ফোন করে বললাম,“ ট্যাক্সি খুঁজছি তো। পেলে ফোন করব। ”ওপার থেকে বাবার নিঃস্ব স্বর ভেসে এল,“মানা। মানা রে-। ”বুকটা ছ্যাঁৎ করে উঠল,বাবা তো এমন করে না। কি হল বাবা?সব ঠিক আছে?“ঘন্টা মারা গেছে। ” সে কি?কি করে? আজই তো বাবাদের নিমন্ত্রণ ছিল। বাবা আর দেবা কাকু একসাথেই রিক্সা করে গেল। ওদিক থেকে সলিল কাকু আসছিল,পথে দেখা আমাদের সঙ্গে। বাবা ব্যথিত স্বরে বলল,“জানি না। সবাইকে খাইয়ে দাইয়ে রওণা করে,বুঁচিকে বলেছে,‘একটু শুই বুঝলে। এত সুখ এত আনন্দ- বড় দেরী হয়ে গেল বুঁচি। ” ফোনটা কেটে গেল, আনন্দমুখর উৎসবের কলকাতা,নিয়ন আলোয় জ্বলজ্বলে,সব ছাপিয়ে দুচোখে ভেসে উঠল এক আনন্দোদ্বেল বৃদ্ধের প্রশান্ত মুখমণ্ডল-সত্যিসত্যিই যিনি পাড়ি দিয়েছেন মহাসিন্ধু।
(সবচরিত্র কাল্পনিক। শুধু কিছু মানুষের নাম ধার নিয়েছি মাত্র)©Anindita Bhattacharya

Wednesday 10 October 2018

এক যে ছিল কন্যা-

ঠাণ্ডাটা আজ বেশ জব্বর পড়েছে, জ্বলন্ত অগ্নিকুণ্ডের সামনে একাকিনী এক নারী। জ্বলতে থাকা আগুনের আভায় ভাস্বর এক দেবী। যেন বিষাদের প্রতিমূর্তি। রমণী এক মনে মাথা নীচু করে সেলাই করে চলেছেন। “রাণীমা!” জনৈকা সহচরীর ডাকে চমকে উঠলেন নারী, সহচরী নতমস্তকে কুর্নিশ করে জানাল,“ রাজামশাই এর ব্যক্তিগত সহায়ক  আপনার সাক্ষাৎ প্রার্থী। ”
মৃদু কেঁপে উঠল বুক, রাজামশায়ের এই ব্যক্তিগত সহায়কের রাণীমাকে এক্কেবারেই না পসন্দ, এ কথা অজ্ঞাত নয় নারীর। একদিন প্রশ্নও করেছিলেন,“আমার প্রতি আপনার এই বিরাগের কারণটা জানতে পারি কি?”  জবাবে কুর্নিশ করে তিনি বলেছিলেন,“আমি এক তুচ্ছ সেবক রাণীমা, বলতে গেলে আপনি আকাশের চাঁদ,আর এ অধম ক্ষুদ্র বামন মাত্র। ” অন্যমনস্ক ভাবে ইশারা করলেন রাণীমা, দুই সহচরী দৌড়ে এল, অন্তর্বাসহীন রাত পোশাকের ওপর জড়িয়ে দিল রেশমী আচ্ছাদন। মাথায় চড়িয়ে দিল রত্নখচিত মুকুট। এমন মুকুট রাণীমার অগণিত। বর্তমানে সাদা পোশাকের সঙ্গে মিলিয়ে মাথায় পরলেন মুক্তার মুকুট। এক একটা মুক্তা প্রায় পায়রার ডিমের আকারের।
সহায়ক প্রবেশানুমতি পেলেন। নতজানু হয়ে অভিবাদন জানালেন রানীমাকে। ব্যক্তিগত ভাবে এই রাজ্যের আপামর অধিবাসীর মত উনিও পরম শ্রদ্ধা করেন এই জনমদুখিনী নারীকে। কোন ছোট্ট বেলায় বাগদত্তা হয়ে ভিনদেশ থেকে সমুদ্র পাড়ি দিয়ে এদেশে এসেছিলেন, তখন বোধহয় রাণীমার বয়স পাঁচ থেকে ছয় বছর হবে। শোনা যায় জাহাজে ওঠার আগে মাকে জড়িয়ে আকুল কেঁদেছিলেন সেদিনের  সেই বালিকা। বদলে শুনতে হয়েছিল উপদেশ,“রাজকন্যারা দেশ এবং রাজনীতির জন্য বলিপ্রদত্ত। বুক ফাটবে কিন্তু চোখ না ফাটে।” কালাপানি পেরিয়ে এসে যুবরাজের বাগদত্তা হলেন শিশু রাজকন্যা। যুবরাজের যখন চোদ্দ বছর বয়স, জানা গেল হবু যুবরাণী সদ্য রজঃস্বলা হয়েছেন। চটজলদি বিয়ের আয়োজন করলেন তৎকালীন মহারাজ। দেশবিদেশ থেকে এলেন অথিতিদের দল, হবু যুবরাণী আশা করেছিলেন এত বছর বাদে হয়তো দেখা হবে বাবা-মায়ের সাথে। বদলে এল আশির্বাদ জ্ঞাপক পত্র মাত্র। ওণার দেশে নাকি রাষ্ট্রবিপ্লব  ঘটেছে,তাই রাজা বা রাণীর পক্ষে দেশত্যাগ অসম্ভব,বদলে এল থরে থরে ধনসম্পত্তি,মণিমাণিক্য আর ধর্মগুরুর আশির্বাদ।
বিয়ের পর তরুণ যুবরাজ আর যুবরাণী পাড়ি দিল অঙ্গরাজ্যে,এখান থেকেই দেশ শাসনের হাতে গরম তালিম পাবে যুবরাজ। এখানেই হবে ফুলশয্যা।

একি ফুলশয্যা? শয়নকক্ষে প্রবেশ করে চমকে উঠলেন সালংকারা নববধূ । শয়ন কক্ষ ভর্তি লোক,গিজগিজ করছে। কে নেই তাদের মধ্যে? যুবরাণীর সহচরীবৃন্দ-যুবরাজের সহচর বৃন্দই গোটা ছয়, এদের কর্তব্য যুবরাজ এবং যুবরাণীকে বিবস্ত্র করা। এছাড়া দাস-দাসী অন্তত এক ডজন, নানারূপ ফল,মিষ্টি নিয়ে নতমস্তকে দণ্ডায়মান। এছাড়া কমসেকম তিনজন যাজক, তাঁদের কর্তব্য হল, যুবরাজ আর যুবরাণীর প্রথম মিলনের মুহূর্তে সোচ্চার প্রার্থনা করা, যাতে প্রথম মিলনেই যুবরাণীকে গর্ভবতী করতে সক্ষম হন যুবরাজ এবং কালানুক্রমে একটি সুস্থ সবল পুত্র সন্তান প্রসব করেন যুবরাণী।
কি আড়ষ্টই না ছিলেন কিশোর যুবরাজ আর সদ্য বিবাহিত যুবরাণী। সর্বসমক্ষে বস্ত্র উন্মোচন করে পাতলা দুধ সাদা রাত পোশাক পরানো হল , সুগন্ধী আগরবাতি  নিয়ে পরিক্রমা করা হল , যাতে যাবতীয় কুনজরকে ঝেড়ে ফেলে নতুন জীবনে প্রবেশ করতে পারেন দোঁহে। ছেটানো হল সুগন্ধী, যাতে শরীরের যাবতীয় বদগন্ধ দূর হয়, অতঃপর পালঙ্কে উঠলেন যুবরাজ এবং যুবরাণী,  কয়েক বছর আগেও যাঁরা ছিলেন একে অপরের খেলার সাথী। কত হাতাহাতি, কত মারামারির সাক্ষী এবং সঙ্গী। পালংকের দুপাশে থরে থরে সাজানো না না সুস্বাদু ফল,দুধ, মিষ্টি এবং সুরা। পাতলা সাদা মখমল দিয়ে ঢেকে দেওয়া হল পালঙ্ককে।  
বাইরে অতন্দ্র প্রহরায় সকলে, সোচ্চারে মন্ত্রপাঠ চলছে, ফিসফিস করে রসের আলোচনা চলছে যুবরাজ এবং যুবরাণীর সহচর এবং সহচরী  বৃন্দের মধ্যে, উৎকীর্ণ  সকলের কান। এইবার শোনা যাবে যুবরাণীর তীব্র শীৎকার। কিন্তু এতো শীৎকার নয়,এযে চিৎকার। তীব্র চিৎকার করে উঠলেন যুবরাজ, উচ্চ স্বরে কেঁদে উঠলেন কিশোরী যুবরাণী । রসালো ইঙ্গিতে খলবলিয়ে উঠল যাজকদের চক্ষুও।
উত্তরোত্তর বাড়তে লাগল চিৎকার, ভোরের দিকে যুবরাজের আর্তনাদ ক্রমশ পরিণত হল গোঙানিতে।যুবরাণীর কাতর চিৎকার আর হৃদয়বিদারক কান্না আর অনুনয় বিনয়ে  আর থাকতে পারল না পরিচারকের দল, এত দীর্ঘ সময়ব্যাপী চলতে পারে না এই প্রক্রিয়া। ব্যাপার কি? ধীরে ধীরে পর্দা তুলে আঁতকে উঠল সকলে, তীব্র শারীরিক বেদনায় কাটা পাঁঠার মত ছটফট করছে দোঁহে, দুজনের ঘামে জবজবে ভিজে গেছে রাজশয্যা।  ক্রমেই নেতিয়ে পড়ছে দুই সদ্যবিবাহিত কিশোর কিশোরী।  ডাকা হল রাজবৈদ্যকে। তিনি দেখেই বললেন, “এতো ঘামরোগ। ভয়ানক ছোঁয়াছে। ” শুনেই আঁতকে উঠল সকলে।এতো রোগ নয়,মহামারী।  দুদ্দাড় করে পালিয়ে গেল সহচর আর পরিচারক বৃন্দ। পালাল যাজকগণ।
কোন মতে জনা দুয়েক দাসকে জবরদস্তি আটকে রাখলেন রাজ বৈদ্য। যাঁর পোশাকী নাম ডাক্তার। এই রোগের কোন সম্ভাব্য চিকিৎসা তিনিও জানেন না। শুধু শুনেছেন শরীর থেকে বদরক্ত যদি বের করে দেওয়া যায় হয়তো প্রাণে বাঁচতে পারে রোগী। যুবরাজের শরীরে ভোঁতা পেরেকের মত যন্ত্র হাতুড়ি দিয়ে ঠুকে ঠুকে রক্ত বার করতে লাগলেন ডাক্তারবাবু। পাশ থেকে গোঙানির সুরে অনুরোধ করলেন যুবরাণী,“ডাক্তারবাবু, আমাকে বাঁচান। আর সহ্য হচ্ছে না এ যাতনা। ডাক্তার নির্বিকার। তাঁর ওপর নির্দেশ আগে বাঁচাতে হবে যুবরাজকে। ভিনদেশী রাজকুমারী বাঁচল না মরল তাতে এই মুহূর্তে কিস্যু যায় আসে না এই রাজ্যের রাজারাণীর। বরং ঐ অশুভ মেয়ে মরে গেলেই তো ভালো। বিনা চিকিৎসায় পড়ে রইলেন যুবরাণী। ভরসা শুধু প্রার্থনা। , দিগ্বিজয়ী  সম্রাটের আদরের আত্মজা, এতবড় রাজ্যের হবু রাণীর ভরসা শুধুই ঈশ্বর।
যে বদরক্ত যুবরাজের দেহ থেকে অতি যাতনায়, অতি কষ্টে  বার করতে হল, তা এমনিই অঝোরে ঝরে গেল সদ্য রজঃস্বলা তরুণীর দেহ থেকে। ফলে দেশ জুড়ে যখন মড়ক, জনশূণ্য হয়ে পড়ছে পল্লীর পর পল্লী, গণচিতায় আগুন দেবার লোক নেই, তারই মধ্যে আশ্চর্য ভাবে বেঁচে উঠলে যুবরাণী। বাঁচলেন না শুধু যুবরাজ। বিয়ের ভোজ হজম হবার আগেই বিধবা হলেন যুবরাণী।
(চলবে)
©Anindita  Bhattacharya
এক যে ছিল কন্যা- ২
প্রথম বৈধব্যের অনুভূতি কেমন, আজ যদি এ প্রশ্ন করেন, তবে সেদিনের সেই অ-শোকাতুরা বালিকার কথা ভেবে ভয়ানক লজ্জা পাবে এই মধ্যবয়সী রাজরাজেশ্বরী। না সেদিনের সেই বালিকা নিজের সদ্য মৃত স্বামীর কথা ভেবে ছিটেফোঁটাও চোখের জল ফেলেনি।যদিও আজ বললে কেউ বিশ্বাস করবে না। সেদিনে সেই দুর্গে বর্তমান থাকা সকল সহচর-সহচরী, দাসদাসী প্রত্যক্ষ করেছিল সদ্যবিধবা যুবরাণীর মর্মান্তিক শোক। হাপুস নয়নে কেঁদে গেছে যুবরাণী,সকলে ভেবেছে হয়তো সদ্য মৃত যুবরাজের জন্য, আসলে সে কান্না ছিল কোন ছোটবেলায় বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া মায়ের জন্য। অসুস্থ অবস্থায় মায়ের কথা বড় মনে পড়ত মেয়েটির।
কাল অবধি যে ছিল সকলের নয়নের মণি, দেশের হবু রাণী, যুবরাজের মৃত্যু পলকে যেন তাকে করে তুলল চোখের বালি। তদানিন্তন রাণীমা তো মুখদর্শনেও সম্মত হলেন না হতভাগ্য বিধবা পুত্রবধূর। বাক্সপ্যাঁটরা গুছিয়ে অলক্ষ্মী কন্যাকে পাঠিয়ে দেওয়া হল, রাজধানী থেকে বহুদূরে এক অনামা অখ্যাত দুর্গে। নামমাত্র পরিচারক আর গোটা চারেক সহচরী সমেত। সহচরীরা সকলেই রাজকন্যার সাথে এদেশে এসেছিল। সকলেই  হয় অভিজাত পরিবারের অনুঢ়া কন্যা অথবা কোন ধনী বণিকের দুহিতা। মূল লক্ষ্য ভালো বর যোগাড় করে,পরিবারের মুখোজ্জ্বল করা। মুস্কিল হচ্ছে ভালো বর পেতে হলে রাজধানী তথা রাজপ্রাসাদে থাকা বাধ্যতামূলক। তবেই না এদেশের অভিজাত জমিদার বা তাদের পুত্রদের সাথে মোলাকাৎ হবে। অভাগিনী সখীর সাথে সাথে তাদেরও নির্বাসন দেওয়া হল।
তিনদিকে ঘন সবুজ মাঠ আর আঙুর বাগিচা আর একদিকে গাঢ় নীল সমুদ্র, মাঝে কে জানে কত শত বছরের পুরানো সেই দুর্গ। জায়গায় জায়গায় বিশাল ফাটল,শিকড় মেলতে চায় মহীরুহ, খোদ রাজকুমারীর ঘরের ছাদই ফুটো। বৃষ্টি নামলে পাঁচ সখী দৌড়ত রন্ধনশালা থেকে হাঁড়িপাতিল আনতে। দুর্গে প্রহরী বলতে জনা পঁচিশেক রাজ সৈন্য। যাদের কেউ কেউ বেশ সুদর্শন ছিল। সাগরের ঝড়ো হাওয়ায় দপদপ করতে থাকা মোমবাতির আলোয় আলোকিত দুর্গের আলোআঁধারি যেন ছিল কোন রূপকথা। রাতের পর রাত জেগে সমুদ্রের ঢেউ গোণা দেখত কন্যা। ভোর রাতে চিঠি লিখতে বসত পিতামাতাকে। বয়ান মোটামুটি এক,“আমি ফিরে যেতে চাই। আমায় দয়া করে কাছে টেনে নাও মা। কতদিন তোমায় দেখিনি। কতদিন তোমার গায়ের গন্ধ শুঁকিনি মা-। ” নিজ হাতে গালা গলিয়ে সিল করত সে চিঠি। তারপর গভীর ক্লান্তিতে তলিয়ে যেত ঘুমে, স্বপ্নে আসত মা- জাহাজ থেকে নামত কন্যা নিজ দেশে, স্বদেশের সমুদ্রের লবণাক্ত হাওয়ায় প্রাণ ভরে শ্বাস নিত কন্যা।
হতভাগী জানত না,যে একটি পত্রও সাগর পেরোয় না। প্রতিটি চিঠি খুলে পড়ত একজন, তার নাম, ধরে নেওয়া যাক উলযি। রাজার মুখ্য পরামর্শদাতা। উলযির রাজনৈতিক দূরদর্শিতা ছিল অসাধারণ, প্রতিবেশী দেশের মহাক্ষমতাধর সম্রাটের কন্যাকে এভাবে ফেরত পাঠানো যে এই দেশ তথা এই মহাদেশের জন্য আদৌ শুভ পরিণাম বহন করবে না, তা বুঝতে উলযির বাকি ছিল না। যদিও তৎকালীন রাণীমা মনেপ্রাণে চাইতেন প্রতিবেশী কন্যাকে পত্রপাঠ স্বদেশে পাঠাতে, নাগাড়ে বাধা দিতেন উলযি। একদিকে রাণীর জেদ অপরদিকে উলযির দূরদর্শিতায় নাজেহাল অবস্থা রাজার। উলযিই পরামর্শ দিলেন,“মহারাজ যাকে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনের জন্য খাতির করে এদেশে এনেছেন,তাকে এভাবে নিষ্ফলা ফেরত পাঠাবেন না। ” “তাহলে কি করি?” হতাশ এবং বিরক্ত স্বরে বলে উঠলেন রাজা,“যুবরাজের সাথে বিয়ে দেবার প্রতিশ্রুতি তো পালন করেছি আমরা, কিন্তু সেই যখন নেই, তখন কি করি বলো তো?” রাজার বিরক্তি শেষের দিকে মৃদু গর্জনে পরিণত হলেও ভয় পেলেন না উলযি,“মহারাজ, অপরাধ মার্জনা করবেন,যুবরাজের আসন তো শূণ্য নেই, তাহলে যুবরাণী কেন-”। রাজার কুঞ্চিত ভ্রুর খাঁজ আরো গভীর হল,“কি বলতে চাও উলযি?আমার দ্বিতীয় পুত্রের সাথেও বিয়ে দেব ঐ মেয়ের?রাণী মানবেন?” উলযি বাঁকা হেসে বললেন,“মহারাজ-। ”
রাণী মানলেন কি মানলেন না,তাতে রাজামশাই কর্ণপাত করলেন না। ডেকে পাঠালেন নতুন যুবরাজকে,বয়সে কন্যার থেকে বছর পাঁচেকের ছোট, কন্যা যখন বাগদত্তা হয়ে এদেশে আসেন নতুন যুবরাজ তখন মাতৃক্রোড়ে,মুখে বুলি ফোটেনি। একসাথেই বড় হয়েছেন দুজনে,দুজনের সখ্যতাও ছিল গভীর। অবশ্য জ্যেষ্ঠ ভ্রাতার মৃত্যুর পর বিগত কয়েক বছরে আর দেখাসাক্ষাৎ হয়নি দুজনার। এই যুবরাজ বড় একরোখা,বড় জেদী,বড় বেশী সুদর্শন, বড় বেশী রঙ্গিলা। অভিজাত পরিবারের অনুঢ়া এবং স্বল্পবয়সী বিবাহিত রমণীরা ছেঁকে থাকে এই যুবরাজকে। যোগ্যসঙ্গত করেন যুবরাজও। কন্যার সাথে বিবাহের প্রস্তাব এক কথায় খারিজ করে দিলেন তিনি। “পাগল নাকি? আজ যে যুবরাণী,কাল সে রাণী হবে, আর রাণী হবার প্রথম শর্তই হল অক্ষত যোনি হয়ে বাসরে প্রবেশ- আর এক্ষেত্রে-”। এক্ষেত্রে কি বুঝলেন রাজা, বুঝলেন উলযিও।

কিছু জানল না,বুঝল না শুধু কন্যা। রাজধানী থেকে বহুদূরে  প্রাসাদ আর আঙুরক্ষেত  আর সমুদ্র নিয়ে যার দিন কাটছিল মহানন্দে। প্রতিদিন সূর্যোদয়ের সাথে সাথে, একাকী কন্যা আঙুর ক্ষেত টপকে হেঁটে যেত দূরে গ্রামের মধ্যে এক ছোট্ট গির্জায়। যেখানে একাকী যিশু দুহাত প্রসারিত করে দাঁড়িয়ে থাকতেন রক্তাক্ত ক্রুশে। পুবে লালনীল কাঁচের জানলা গলে আসা প্রথম সূর্যের আলো চুম্বন করত তাঁর চরণ যুগল। একাকী প্রার্থনা করত কন্যা,হাতের জপমালা ঘুরে যেত অবিশ্রাম,ওষ্ঠে কাতর ফিসফিস অনুরোধ,“আমায় ফিরিয়ে নাও প্রভু। আমি নিজের দেশে ফিরতে চাই। ” সেদিনও বিড়বিড় করে তাই বলছিল কন্যা, বেলা হয়েছে অথচ সূর্যের মুখ ডেকেছে গাঢ় মেঘ আর কুয়াশা। আচমকা কে যেন পিছন থেকে বলে উঠল,“তুমি কোনদিনই আর স্বদেশে ফিরতে পারবে না। ”হকচকিয়ে উঠল কন্যা,“কে?কার এত সাহস?” যিশুর পিছন থেকে বেরিয়ে এল এক অল্পবয়সী যুবা,পরনে যাজকের পোশাক, দুই চোখে উদ্ভ্রান্ত দৃষ্টি,“আমি জানি। আমি জানি। একদিন তোমার জন্যই পুড়ে মরব আমি। উঃ আঃ জ্বলে গেলুম-হে ঈশ্বর”বলে আর্তনাদ করতে করতে দৌড়ে গির্জা ছেড়ে বেরিয়ে গেল সে। হতচকিত  কন্যার বুক ধড়ফড়ানি কমলে ধীরে ধীরে দুর্গে ফিরে এল,পথে প্রতিজ্ঞা করল, আর কোনদিন একা যাবে না। দুজন প্রহরী সঙ্গে থাকলে হয়তো এমনটা হত না। দুর্গে প্রবেশ করা মাত্র দৌড়ে এল সখীরা,“রাজকন্যা, পত্র এসেছে। দেশ থেকে পত্র এসেছে। ” এতদিন-এত বছর পর-আনন্দে নেচে উঠল কন্যার প্রাণ।
(চলবে)
©Anindita Bhattacharya