Saturday 31 October 2020

কোজাগরী



কোজাগরী রাত।  চরাচর ব্যাপী মধুজোছনা ছড়িয়ে, শ্যাওলা ধরা দীঘির জলে স্নান করতে নামে রূপার থালার মত পূর্ণযৌবনবতী চাঁদ। 

কিছুক্ষণ,মাত্র কিছুক্ষণে জন্য ঝুরঝুর করে ভেঙে পড়ে চারশ বছরের পুরাতন গাঁথুনি। 

খসে পড়ে মরচে ধরা শিকলির দল। 

আড়ামোড়া ভেঙে চৌকাঠ ডিঙোন সুন্দরী। 

দীঘির পাড়ে অধীর প্রতীক্ষায় অস্থির সম্রাট। 

গ্রাহ্য করেন না সুন্দরী। সর্পিল কুঞ্চিত কেশদাম আঙুলে পেঁচিয়ে ভেঙে পড়া, ফাটল ধরা ঘাটের সিঁড়িতে এসে বসেন পদ্মাক্ষী। 

দীঘির জলে তখন দুইখানা চাঁদ। কাঁপন ধরায় বৃদ্ধ সম্রাটের শতাব্দী প্রাচীন হৃদয়ে। 

এগিয়ে যান পায়ে পায়ে। মরচে ধরা হাঁটু নিয়েও নতজানু হয়ে বসেন- 

ঈষৎ বিভঙ্গে তাকান সুন্দরী। পলকে স্তব্ধ হয়ে যায় চরাচর। শ্বাসরোধ করে উৎকীর্ণ  হয়ে ওঠে  হিমেল হৈমন্তী বাতাস,  স্নান থামিয়ে মাথা তোলে শশধর। 

না বলা কথাগুলি ফুলে ফেঁপে ফুঁসতে থাকে দুটি হৃদয়, বিদ্রোহ করে। বড় বেইমান রসনা। 

সুন্দরীর কোমল রক্তাভ পদযুগল তুলে নেন, ক্রোড়ে। 

মুগ্ধ দৃষ্টিতে রচিত হয় প্রসাধন। 

অকপটে স্বীকার করেন বৃদ্ধ সম্রাট, “ওহে সুন্দরী, বড় ভালোবাসি তোমায়। বড়, বড় বেশী ভালোবাসি। ”

বিশ্বাস করে কি সুন্দরী? বড় রহস্যময়ী তিনি। মান-অভিমানের পালা রচনায় বড় পটীয়সী। 

কথায় কথায় রাত ঢলে। ম্লান মুখে স্নান সেরে আকাশে ফিরে যায় বিগতযৌবনা চাঁদ। 

কখন যেন পূব আকাশে টুক করে উঁকি মারে ঢুলঢুলে শুকতারা।

শিকল হাতে হাজির হয় কন্ধকাটা প্রহরীর দল, শিকলে জড়ান সুন্দরী। নতুন করে গাঁথা হয় চারশ বছরের পুরাতন কুঠুরীর দুয়ার। 

অন্তিম পাথরটি গাঁথার সময় শেষবারের মত হয় শুভদৃষ্টি।  ছলছলিয়ে ওঠে কন্যার দুই চোখ- 

নতুন করে ফাটল ধরে চারশ বছরের বুড়ো সুলতানের বুকে। 

চারশ বছর তো হল, আর কতদিন? আরো কতদিন?

জবাব চান সুলতান। 

নীরব রাত। নীরব চাঁদ। জবাব দেয় না কেউ।  বদ্ধ কুঠুরির দেওয়ালে মাথা রেখে প্রতিবার একটাই কথা বলেন, বুড়ো সুলতান,“ আবার দেখা হবে আসছে কোজাগরীতে। যখন নাইতে নামবে চাঁদ।”

Tuesday 20 October 2020

অনির পুজোর ডাইরি, অক্টোবর, ২০২০

 অনির পুজোর ডাইরি, ১৮ই অক্টোবর, ২০২০

কবে যেন বেরিয়েছিলেন বাবা। সঙ্গী ছিলেন শাশুড়ী মাতাও। ঐ আর কি টুকটাক গৃহস্থালির সরঞ্জাম কিনতে, ফেরার পথে কিনে এনেছিলেন তিনটি শাড়ি। একটি ওণার প্রিয়তমা সহধর্মিনীর জন্য, আর বাকি দুটি, দুই আদুরে পুত্রবধূর জন্য। সাথে আবার উমার আর আমার জন্য ম্যাচ করে পাথর সেটিং ঝুটো দুলও আনতে ভোলেননি। 


দুই পুত্র তো জানতে পেরে রাগে অগ্নিশর্মা। বৃদ্ধকে নিয়ে বড়ই আতঙ্কে থাকি আমরা। একে তো দুই দফা কর্কট রোগাক্রান্ত  হয়েছিলেন, তারওপর প্রায় তিন দশক ধরে ফুসফুসের ব্যাধিতে জেরবার। বুকের ডাক্তার বছর খানেক আগে বলেই রেখেছেন,“জিতেন  বাবু যদি প্রাণে বাঁচতে চান, তো বাড়িতেই থাকুন। রাস্তার ধুলো ধোঁয়া নিতে পারবে না আপনার ফুসফুস। ” বৃদ্ধ এমনিতে বেশ বাধ্য, তারওপর  আগত অতিমারি তো রীতিমত লক্ষ্মণরেখা টেনে দিয়েছে ওণার দুয়ারে। 


টুকটাক দোকানবাজার ফোনে বলে দিলেই দিয়ে যায়। তারপর দুই পুত্র আর অনলাইন তো আছেই, তবুও উনি বেরিয়েছিলেন।  বলতে গেলে স্বপক্ষে যুক্তি দেন নিজে না পছন্দ করলে হয়? তারপর কিঞ্চিৎ  লজ্জিত হয়ে জানান, শুধু যে বেরিয়েছিলেন তাই নয়, বেরোবার তাড়ায় ভুলে গিয়েছিলেন মাস্ক পরতে।  


বাবার ভুলে যাওয়া অবশ্য প্রবাদপ্রতিম। সারা দিন ধরে কত কি,যে  ভুলে যান উনি। ওণাকে মনে করিয়ে দেওয়াটাই আজকাল শাশুড়ীমাতার মূখ্য তথা প্রধান করণীয়। তিনি যদিও মাস্ক পরেছিলেন, কিন্তু যেকোন কারণেই হোক না কেন, বাবা যে মাস্ক পরতে ভুলে গেছেন, এটা আর খেয়াল করতে পারেননি। 


তারপর? এই প্রশ্ন করলে কাঁধ ঝাঁকিয়ে জবাব দেন বাবা, “দোকানে ঢুকতে যেতেই আটকাল, বলল মাস্ক কোথায়?” তখন কি করলেন? এবার একটু চওড়া করে হাসেন বাবা, “পকেটে রুমাল ছিল। বড় রুমালটা বেশ করে বেঁধে নিলাম নাক আর মুখ ঢেকে। ব্যাস্” বাপরেঃ কি ডানপিটে বুড়ো। 

প্রসঙ্গতঃ শাড়িগুলো ছিল নববর্ষ উপলক্ষে পাওয়া।  তারপর তো কত জল বয়ে গেল গঙ্গা দিয়ে, ঘটে গেল কত্ত কিছু। দুগ্গা এল ঘরে,সময় ঘনিয়ে এল, সকন্যা এবার আমিও পাড়ি দেবো পিত্রালয়ে। যাবার আগের সান্ধ্য আড্ডায় যখন বাবার সনির্বাচিত শাড়ি পরে বাবার পাশে বসলাম, দেখলাম  বাবা যথারীতি ভুলে গেছেন এই শাড়ি আসলে ওণারই উপহার। বলেছিলাম না, বাবার ভুলে যাওয়া- প্রবাদপ্রতিম।

অনির পুজোর ডাইরি, ১৯শে অক্টোবর, ২০২০


ভোর ভোর রওণা দেব আমরা। আকাশে তখনও থাকবে শেষ অক্টোবরের মায়াবী পশমী কুয়াশা। D কদাচিৎ ফাঁক ফোকর দিয়ে উঁকি মারবে কুসুম কুসুম কমলা রঙা সূর্য। 


উত্তেজনায় প্রায় বিনিদ্র যাপিত হয় রজনী। পূব আকাশে একমুঠো লালচে-কমলা রঙ ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথেই কান ধরে ঘুম ভাঙায় মুঠো ফোনের বেয়াড়া অ্যালার্ম। জানলার বাইরে মনখারাপ করা ঝিমঝিমে সকাল। কাঞ্চন গাছের শাখাপ্রশাখায়R তখনও লুকিয়ে টুকরোটাকরা কুয়াশা।


দীর্ঘ সাত মাস পর, ফিরব প্রিয় শহরে। এর আগে কচিৎ ঝাঁকিদর্শন হয়েছে বটে,তবে সে তো নিছক কর্তব্য। জীবনের প্রথম তিনদশক কাটিয়েছি যে বাড়িতে, যার পলেস্তারা খসা দেওয়াল, জানলার খড়খড়ি আর লোহাচুর ঝরে পড়া কড়িবরগা জানে আমার সব গোপন কথা, ফিরে যাব তার কাছে। আবেগে সুখে টইটুম্বর হৃদয়ে তবুও বাজে বিষাদী বেহালা। বয়স মাত্রই কটা  বছর, তবুও বড় মায়াবীk আমার সংসার। আমার সোনালী ঝুমকো লতা, আমার নীল অপরাজিতার থোকা, আমার বেলফুল গাছে ধরা মরশুমের শেষ কলি, আমার ছোট্ট জলাধারে তুত্তুরী পরম আদরে লালিত দুই মারকুটে মাছ, ঘর ভর্তি পেঁজা তুলোর মত উড়ে বেড়ানো আমার ভালোবাসার ওম - থাকবে তো এমনি? অপেক্ষা করবে তো আমার তরে? বড় বেইমান এই মন- 


গড়িয়ে যায় গাড়ির চাকা, পিছনে ফেলে বড় বেশী অভ্যস্ত, চেনা পরিমণ্ডল। তখনও ভালো করে ঘুম ভাঙেনি মহানগরের। যত বেলা বাড়বে, পথে পথে নামবে জনপ্লাবন। কিঞ্চিৎ আতঙ্কিত তুত্তুরী। ভিড় যে আপাততঃ বিষবৎ পরিত্যাজ্য। বিগত রাতে মুঠোফোনের পর্দা কাঁপানো মণ্ডপগুলিতে এখন শুধু গুটিকয় নিদ্রালু স্বেচ্ছাসেবক আর বেওয়ারিশ সারমেয়দের ভিড়। অধিকাংশ মণ্ডপে এখনও হয়নি উদ্বোধন। ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে তার, কাপড় আর প্লাস্টিক।  বাগবাজারের বিশালাক্ষীর পরনে শুধুই অন্তর্বাস। লজ্জায় খবরের কাগজের আবডালে মুখ ডেকেছেন সবৎসা জননী। বাইরে প্রতীক্ষারত তুত্তুরী, একটিবার-শুধু একটি বার দাও দর্শন। বুড়ো ঝাড়ুদার ঝাঁটা ফেলে ছুটে আসে সান্ত্বনা দিতে, “কাল এসো। কালই তো উদ্বোধন। কত লোক আসবে। মা তখন কত সোন্দর করে সাজবে। ” ছলছল চোখে তাকায় তুত্তুরী। তবে কি এবছরের মত আর দেখা হবে না মা?


কমলা সূর্যের আলোয় লাগে কাঁচা সোনা রঙ। অবাধ্য ছিঁচকাঁদুনে সন্তানের ডাকে সাড়া দেন বিশালাক্ষী। একে একে মুখ খোলে লক্ষ্মী-সরস্বতী-কার্তিক। “গণু দাদা প্লিইজ-”। আর্তি জানায় তুত্তুরী। গণেশের মুখ থেকেও সরে যায় আবরণ। অর্ধ উলঙ্গ জননী দর্শনে পরম পুলকিত হয়ে ওঠে মেয়ে আমার। 


বাড়ির গলিতে পা রাখার সাথে সাথেই যেন অলিখিত উৎসবের বাতাস বয়ে যায় শতাব্দী প্রাচীন বাড়িটার শিরা উপশিরায়। দোতলার বন্ধ জানালা আর বদ্ধ বাতাসে লুকোচুরি খেলা করে শারদীয়া সুর। আর তু্ত্তুরীর চোখে-ঠোঁটে-গালে-হাতে-পায়ে ফুটে ওঠে না জানি কত নাম না জানা রঙ। মেহেন্দি আর আলতার সুবাসে ভরে ওঠে এবাড়ির বাসিন্দাদের হৃদয়।দুগ্গা এল ঘরে- । তাই না পরম আদরে হাতে পায়ে হেনার নকশা কেটে দেয় বড় মামি। সুখের বেলা গড়িয়ে কখন যেন নামে সন্ধ্যা। দপ্তর ফেরৎ বড়মামার সামনে বসে বসে জুড়িয়ে যায় চায়ের কাপ। তুত্তুরীর পায়ে ফুটে ওঠে লালচে আলতার রঙ। মেহেন্দি আর আলতার রূপে রসে সৌরভে ঝলমলিয়ে ওঠে উৎসবী রাত। মণ্ডপে কার্ফু, হৃদয়ে তো নয়।


অনির পুজোর ডাইরি, ২১শে অক্টোবর, ২০২০


দেড়শ বছরের পুরাণ বাড়িটা বছরের অন্য সময় বুড়ো চিলের মত বসে বসে ঝিমোয়। হয়তো তখনও মাথার ওপর বিছিয়ে থাকে এমনই আশমানী নীল চাঁদোয়া । তখনও হয়তো এমনই গলানো সোনা রঙা রোদ লুকোচুরি খেলে বাবার সাধের আম আর কাঁঠাল গাছের পাতায়। ঘন সবুজ আম্রপল্লবে প্রতিফলিত সকালী রোদ হয়তো জানলা গলে এমনই আঁকিবুকি কেটে যায় বৈঠকখানার শ্বেতমর্মর মেঝেতে। খেয়ালই করে না কেউ- প্রভাতী বাতাসে হয়তো তখনও মাথা ঝাঁকিয়ে আড়ামোড়া ভাঙতে ভাঙতে মাকে ডাকে, মায়ের হাতে লাগানো তরুণ পেয়ারা গাছ। উঠোনের সাদা-লাল-গোলাপী কৃষ্ণচূড়া আর নয়নতারার ফাঁকে এমনই গুনগুনিয়ে যায় হলুদ কালো প্রজাপতি থেকে লাল-কালো পিঁপড়ের দল। কেউ আড়ি পেতে শোনে না সেই কলতান। 


                 বর্তমানে অবশ্য সেই নীরবতা ইতিহাস মাত্র। দীর্ঘ সাত মাস ব্যাপৃত আমাদের অনাবাস আর বৃদ্ধ এবং তাঁর বেতো স্ত্রীর অপারগতার সুযোগে এবাড়ির রন্ধ্রে রন্ধ্রে জমেছে পুরু ধুলিকণার আস্তরণ। কোণায় কোণায় আবর্জনার স্তুপ। সেই আবর্জনা দূর করা নিয়েই শুরু হয় দিনটা। অপরিসীম মায়ার বাঁধনে জড়ানো এ বাড়ির সবকিছু। প্রতিটি আবর্জনার জন্য এবাড়িতে আছে একখানা রূপকথা। ওই যে আলমারির কোণায় অবহেলে পড়ে থাকা কালচে রঙের প্যান্টটা- ওটা তো রাণীর উপহার। প্রথম বেতন পেয়ে কেনা। সেদিনের তরুণী রাণী অর্থাৎ ছোট মাসি ইস্টার্ন রেলওয়ে অডিট থেকে অবসর নেবার পরও কেটে গেছে কতগুলি বছর। শুধু বাতিল প্যান্টটাই আর ফেলা হয়ে ওঠেনি। 


                         

                           সেবার  কোথা থেকে যেন বেশ কিছু টাকা পেয়েছিল বাবা, মাকে না জানিয়েই কিনে এনেছিল তিনটে সাউথ কটন শাড়ি। মধ্যবিত্ত সংসারে এই খামখেয়ালি অবিমৃষ্যকারিতা বেশ কিছুদিন দাম্পত্যকলহে ঘৃতাহূতির কাজ করেছিল। সে অনেককাল আগের কথা। নব্বইয়ের দশকের সূত্রপাত সবে, মায়ের ক্রমাগত অনুযোগ তথা শাড়িগুলির অনুপম নক্সায় বিমুগ্ধ হয়ে জনৈক শাড়ি বিক্রেতা মাসি কিনে নিতে চেয়েছিলেন শাড়িগুলি ন্যায্য মূল্যে। বিক্রি করেনি মা। বেশ কয়েক বছর পর একবার পরতে চেয়েছিলাম, তখন বোধহয় কলেজে পড়ি, অন্য একডজন শাড়ি বার করে দিয়েছিল মা। ঐ তিনটি শাড়ি দেয়নি প্রাণে ধরে- এখন সবই বিবর্ণ, পাটে পাটে ধরেছে ফাটল,  তবুও ফেলতে চাইলে আঁতকে ওঠে মা। আর ঐযে মুসৌরির ম্যাল থেকে কেনা লাল ব্যাগী পুলওভারটা- উননব্বই সালে যার দাম ছিল মাত্র কুড়ি টাকা! আমার কন্যারও ছোট হয় আজকাল। দুই প্রজন্মের অত্যাচারে খুলে এসেছে উলের বাঁধুনী। তবুও ফেলা নিষেধ। হয়তো আরেক প্রজন্মের জন্য জমিয়ে রাখতে চায় মা। ছাতের সিঁড়িতে পুঁটলি করে রাখা তুত্তুরীর পুরানো শৈশবের জামার দিস্তাকে স্পর্শ করাও নিষেধ। এটা পরে  প্রথম ভাত খায় দাদুর সোনার তুত্তুরী, প্রথম জন্মদিনে ঐ জামাটা উপহার দেন শ্বশুরমশাই- দ্বিতীয় জন্মদিনে কিনে দেওয়া তেচাকা সাইকেল, একহাতে দুধের বোতল  মুখে ধরে সাইকেল চালাত তুত্তুরী। হোক না আজ ধুলোপড়া ন্যাতাকানি, তবুও প্রতিটি ছত্রে ছত্রে মাখামাখি জীবনের অমূল্য সব স্মৃতি। 


                             শুধু যে আবর্জনা আর রদ্দি নিয়েই সমস্যা হয় তা নয়, দ্বন্দ্ব বাঁধে বিদ্যুতের অপব্যবহার নিয়েও। সারাদিন ধরে আলো জ্বলে আর পাখা ঘোরে এ বাড়িতে। মায়ের জন্য সোহাগ করে গুচ্ছ খানেক বৈদ্যুতিক পাখা লাগানো সারা বাড়ি জুড়ে। বাতানুকূল যন্ত্র থাকা সত্ত্বেও প্রতিটি শোবার ঘরে দুটি করে পাখা ঘোরে এবাড়িতে। একটি খাটের ওপর আর অপরটি ঘরের বাকি অংশের জন্য। দালান তথা বসার ঘরে,শৌচাগারে এমনি রান্নাঘরেও লাগানো একটি পাখা। পাখা চালিয়ে আনাজ কাটে মা। খাবার টেবিলে বসে শব্দজব্দ করে বাবা। বুড়ো পাখার ঘর্ঘর শব্দে রচিত হয় দুর্বোধ্য প্রেমের কবিতা। উঠে গেলেও পাখা নেভানোর কথা মনে থাকে না কারো। অনুযোগ করতে গেলে ওষ্ঠ ফুলে ওঠে বৃদ্ধের। অভিমানী কণ্ঠে মনে করিয়ে দেয়, কোন এককালে যখন একটি মাত্র ডিসি পাখাই ছিল সম্বল,হতো ভয়ানক লোডশেডিং, সারা রাত হাতপাখা চালাত বাবা আর মা ভাগাভাগি করে। হাতপাখার বাতাস থামলেই নাকি ককিয়ে উঠত ওদের শিশুকন্যা। আর আজ যদি মা একটি দুটি পাখা নেভাতে  ভুলেই যায়--


                                গুচ্ছখানেক বুড়ো শিলিং ফ্যান ছাড়াও আছে একটি মান্ধাতা আমলের টেবিল ফ্যান। বয়স বোধহয় বছর কুড়ি। মায়ের সাধের ককটেল বার্ড, যার পোশাকী নাম টুঁইটুঁই, তিনি স্নান করে এলে ঐ পাখাটা চালিয়ে শুকানো হয় তার পালক। মায়ের মতই পাখার হাওয়া ছাড়া থাকতে পারে না টুঁইটুঁই। আমি বা তুত্তুরী যদি ভুলেও বন্ধ করি পাখা, অমনি “মা-মা-মা” করে সোচ্চারে নালিশ জানায় টুঁইটুঁই। স্পেশাল সূর্যমুখীর বীজ এনেছিল বাবা টুঁইটুঁই এর জন্য, খেলে নাকি বাড়বে জৌলুস। দুদিন ঠুকরে আর মুখ ঠেকায়নি টুঁইটুঁই। মায়ের মতই টুঁইটুঁইয়ের প্রিয় খাদ্য মুড়ি। আর হাতে গড়া রুটির নরম ফুলকো। সে রুটি বানাতে হবে স্বয়ং মাকে। রান্নার দিদির বানানো রুটি ছুঁয়েও দেখে না টুঁইটুঁই। উল্টে গলা ফাটিয়ে নালিশ করে “মা-মা-মা”। বাবা এবং তুত্তুরীর ধারণা এত খাদ্যবিলাসী হওয়ার জন্য দিনদিন মোটু হয়ে যাচ্ছে টুঁইটুঁই। নাদু হচ্ছে রীতিমত। সে অবশ্য কেবল তুত্তুরী আর তুত্তুরীর দাদু ছাড়া কেউই দেখতে পায় না। 


অশান্তির আরো একটা কারণ হল বাবার মিষ্টি প্রিয়তা। অতিমারি বড় বেশী থাবা বসিয়েছে এই মহল্লায়। প্রায়ই আসেপাশের বাড়ি থেকে ভেসে আসে বাসি মৃত্যুর বাস। নিরাপত্তার কারণে বাবা-মা-পিসির গতিবিধির ওপর নিয়ন্ত্রিত কড়া বিধিনিষেধ। আগে পাঁচটা মনিহারি দ্রব্য কিনতে পাঁচবার বাজার যেত বাবা। পেডোমিটার চালিয়ে বারেবারে বাজার যাওয়াটাই ছিল বাবার প্রিয় শরীরচর্চা। পথে এবাড়ির বারন্দা, ওবাড়ির রক, সে বাড়ির জানলা থেকে চলত কুশল বিনিময়। টুকটাক রাজ্য-রাজনীতির গল্প। বিগত সাত মাসে সবই বন্ধ প্রায়। গল্প করার মানুষগুলোর অনেকেরই উইকেট পটাপট ফেলে দিয়েছে করোণা। বাকিরাও কেমন যেন জবুথবু হয়তো বা শোকাহতও। মাঝে মাঝে বাবা বেরোয় বটে, চালায় পেডোমিটারও, তবে মোড়ের মাথায় পৌঁছাতে পৌঁছাতেই হাঁফিয়ে পড়ে আজকাল। ভালো মিষ্টি পাওয়া যায় না এপাড়ার দোকানে, কিনতে হলে যেতে হবে অদূরের কদমতলা বাজারে। উচ্চ ন্যায়ালয় যতই প্রতিবন্ধকতার দেওয়াল তুলুক না কেন, বাজার সবসময়েই সরগরম। পুজোর মুখে থিকথিকে ভিড় বাজারে। তারই মধ্যে যেতে চায় বাবা, মিষ্টি কিনতে। নিজের জন্য নয়, তুত্তুরী আর বুল্লু বাবুর জন্য। উৎসবের দিন, ঘুরতে ফিরতে টপাটপ গালে চালান করবে মিষ্টি, তবে না বাঙালী বাড়ির পুজো। 


কলহ থামলে, জমে থাকা বাজারের ফর্দ নিয়ে বেরোই টুকিটাকি নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী কিনতে। প্রিয় শহরের বুকে তখন নামে সন্ধ্যা। আলোকমালা প্রসাধনে অপরূপা হয়ে ওঠে পাঁচশ বছরের বুড়ি শহর। সজ্জিত মণ্ডপ থেকে ভেসে আসে মাইক্রোফোনের নানা সুর।  মণ্ডপে একাকী প্রতিমাকে সাক্ষী রেখে “ডাকের তালে- কোমর দোলে”। উদ্দাম নাচ জোড়ে গুটিকয় কচিকাঁচার দল- যাদের মধ্যে ধেড়েটার বয়স বোধহয় বছর ছয়েক।  কিংকর্তব্যবিমূঢ়, মাঝারি মাপের ভিড় জমে পথেঘাটে, দোকানপাটে। সাধ থাকলেও সাহস নেই মার্কা হতাশা মেখে শেষ হয়ে আসে উৎসব মুখর আরেকটা সাবধানী দিন। ব্যাগ ভর্তি ঘিয়ে ভাজা দরবেশ আর লাল দই কিনে চটজলদি পা চালাই দেড়শো বছরের বুড়ো বাড়ির দিকে, হাঁটতে হাঁটতে ভাবতে থাকি, গরম চায়ের পেয়ালার সাথে কি ভাবে জমিয়ে তুলব সান্ধ্যকালীন মুচমুচে কলহ-বিবাদ। ঝিমিয়ে পড়া বাড়িটা আর তার বাসিন্দাদের চাঙ্গা করতে কলহ যে বড় অব্যর্থ। ঝগড়া করুন- ভালো থাকুন। মণ্ডপে কার্ফু- মনে তো নয়।




Wednesday 14 October 2020

অনির ডাইরি ১৪ই অক্টোবর, ২০২০

 


এর আগেও চাকরী ছেড়েছিল ছেলেটা। রাত সাড়ে আটটায় ফোন করে বলেছিল, মালিকের সাথে প্রচণ্ড ঝগড়া করে ফেরৎ দিয়ে এসেছে গাড়ি। কাল থেকে ও আর নেই। তখন সদ্য শুরু হয়েছে আনলক ডাউন, ৭৫শতাংশ স্টাফ নিয়ে গমগমিয়ে চলছে আপিস। পটাপট চাকরী হারাচ্ছে সাধারণ শ্রমিকের দল। আপিসে ডাকা গুচ্ছ গুচ্ছ মিটিং। সরকারী ফরমান একখান আছে বটে গুগল মিটে মেটাও সব মিটিং। গুগল মিটওয়ালা ফোনটার যে বড় অভাব আমার শ্রমিকদের মধ্যে। এদিকে বন্ধ লোকাল ট্রেন এবং নৈহাটি-চুঁচুড়া ফেরি। মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েছিল সেদিন। কাল যাব কি করে অফিস? 



শেষ পর্যন্ত অবশ্য সমস্যা হয়নি। আমাদের ইন্সপেক্টর কৌশিকের তাড়নায় গাড়ির মালিক অন্য ড্রাইভার জোগাড় করে সময়মতো পাঠিয়ে ছিলেন গাড়ি। দিনদুয়েক পরে আবার ফোন করেছিল ছেলেটি। ইনিয়েবিনিয়ে বলেছিল, খেপ খাটা ছাড়া তোমন কিছু পায়নি। বাজার খুব খারাপ ইত্যাদি। খোদ শ্রমদপ্তরে একজনের চাকরী যাবে ঐ আকালে, তাই দুপক্ষকে বসিয়ে আলোচনা করিয়ে মিটিয়ে দেওয়া হয় সেবার। নারাজ মালিক বলে যান, “আপনি বলছেন বলে শুধু ফেরৎ নিচ্ছি ওকে। ”



দিনদুয়েক আগে আবার সেই ফোন। এই মাসটা ডিউটি করে চাকরী ছেড়ে দেবে সে। চালাবে অন্য আধিকারিকের গাড়ি। বয়ান অনুসারে সেই মালিক নাকি দেবতুল্য। অনুরোধ করে, ঐ আধিকারিক যদি ফোন করেন আমি যেন দুচারটে ভালো কথা বলি ওর সম্বন্ধে। এ আর এমন কি কথা? যেখানে ভালো বেতন পাবে, পাগলেও সেখানে যাবে। আগাম নোটিশ দিয়ে কাজ ছাড়ায় কোন সমস্যা তো নেই।


 

গতকাল এমনিতেই খারাপ ছিল মনটা। কন্যার লালচে নাকের ডগা, ছলছল আঁখি আর ধরা গলা দেখে বেরোতে হয়েছে। শারদাকে পত্র লিখেছিল তুত্তুরী, লুকিয়ে। লিখেছিল অবুঝ নয় সে। আগত অতিমারি সম্পর্কে অতিসচেতন। তাই তো বেশী নয়, মাত্র দুটি ঠাকুর দেখতে চায় সে। প্রথমা বাগবাজারের বিশালাক্ষি আর দ্বিতীয়া হাওড়া সেবাসঙ্গের একচালা সাবেকী প্রতিমা। তুত্তুরী ডাকে মোটু দুর্গা বলে। আজও আসেনি সেই পত্রের জবাব। শোকাহত কন্যা, দেওয়াল-ফ্রীজ-আয়না ইত্যাদি জনে জনে প্রশ্ন করে বেড়াচ্ছে,“আমি কি ভুল লিখলাম? মা দুর্গা কি আমার চিঠি পড়তে পারেনি?খুব বানানভুল হল কি?” 



যে নীলাম্বর আর কাঁচা সোনা রোদ অন্যান্য বছর জাগায় বাঁধনহীন পুলক, তারাই কেমন যেন হাতচাবুক চালাচ্ছে শপাশপ। তারই মাঝে বলল ছেলেটা, আজই শেষ, আমায় বাড়ি পৌঁছিয়ে গাড়ি মালিককে ফেরৎ দিয়ে আসবে ছেলেটি। মানে? কালই যে বললে, এই মাসটা শেষ হলে। রোদে ভেজা রাজপথ থেকে ভেসে আসে উত্তর, নতুন গাড়িটা নিয়ে একটু অভ্যস্ত তো হতে হবে। 



পুজোর মুখে নতুন বিশ্বস্ত ড্রাইভার জোটানো অসম্ভব। রীতিমত বিপদে পড়ব আমরা। বিশেষতঃ আমি। রাত বাড়লে হাইরোডের জ্যাম সুপ্রসিদ্ধ। লরিতে লরিতে পলকে ছয়লাপ হয়ে যায়। বেশ কয়েকবার হয়েছে, জাস্ট ঘুমিয়ে পড়েছে গাড়ি। দুএক মিনিটের জন্য নয়, ঝাড়া আধ বা একঘন্টা। প্রগাঢ় আঁধার রাজপথে মৃতপ্রায় যানবনের সারির মাঝে ডিভাইডারে দাঁড়িয়ে হাওয়া খায় ড্রাইভার, আর নেটফ্লিক্স দেখি আমি। আর হয় টায়ার পাংচার। এই তো বিগত শুক্রবারেই, শেওড়াফুলির বিশাল পানিফলের ঝিলের ধারে, ঝপ করে দাঁড়িয়ে গেল গাড়ি। শাড়ি সামলে এক হাঁটু ধুলোয় নেমে মোবাইলের টর্চ জ্বালিয়ে ধরলাম, চাকা পাল্টালো ছেলেটা। নতুন কারো সাথে এই নির্ভরতার সম্পর্ক গড়ে উঠতেও তো লাগবে বেশ কিছুদিন। কবে যে চলবে লোকাল ট্রেন-। বেশ মনখারাপ হয়ে গেল, আইন আদালত সম্পর্কিত নানা সমস্যায় জেরবার ছিল ছেলেটি, গোটা চুঁচুড়া আপিস তখন দাঁড়িয়েছিল ওদের পাশে। বড় ভালোবেসে ফেলি আমরা মানুষকে। নাঃ ঠাকুমা ঠিকই বলত, কলিযুগে উপকারীকে বাঘে ধরে-। 



মনখারাপী সুরের মাত্রা চড়েই আপিসে ঢুকলাম। উপহার হিসেবে পেলাম টেবিল আলো করা জনৈক উকিলবাবুর চিঠি। বেশ কিছুদিন আগে মিথ্যা তহবিল তছরুপের অভিযোগে চাকরী হারানো ব্যক্তির চাকরী ফিরে পাওয়া উচিৎ বলে চিঠি করেছিলাম অন্যদপ্তরে। যে ক্ষুদ্র প্রতিষ্ঠানে কাজ করত লোকটি, তাদের ম্যানেজারের উকিলবাবু রীতিমত ভয় দেখিয়ে চারপাতা চিঠি পাঠিয়েছেন। শেষের চারলাইনে খোলাখুলি হুমকি, ভবিষ্যতে যদি কেসে আমি নাকগলাই, তাহলে আমি শূর্পনখা হব এবং উনি লছমন। নাঃ কলিযুগে উপকারীকে সত্যিই দেখি- 



মুস্কিল হচ্ছে ভয়টয় কাউকেই খুব একটা পাই না। হাইকোর্ট থেকে ইনফরমেশন কমিশন সবেতেই হাজিরা হয়ে গেছে,তবে রাগ তো হয়ই। এমন অভব্য ভাষার চিঠি পড়ে কি করা উচিৎ? যেটা করতে প্রচণ্ড ইচ্ছে করছে,সেটা বোধহয় বেআইনি হবে। আসন্ন পুজো উপলক্ষে বোনাস সংক্রান্ত ঝামেলা নিয়ে ব্যস্ত সবাই। কার সময় আছে কোন অবরবর্গীয় অফিসারের তুচ্ছ অভিযোগ(পড়তেই পারেন ঘ্যানঘ্যান) শোনার? 


সম্বল বলতে তো সুকন্যা। দুজনে মিলে বেশ খানিকক্ষণ সমবেত গালিগালাজ করার পর খেয়াল হল, দুজন দুই ভিন্ন ব্যক্তিকে গাল পাড়ছি। সু ভেবেছে ঐ দপ্তরের আধিকারিক আমায় নাক গলাতে নিষেধ করেছেন বুঝি। তিনি তো আমার চিঠিকে বেদতুল্য জ্ঞান করে,বেশ খানিকটা কপিপেস্ট করে পাঠিয়েছেন লোকটিকে কাজে পুনর্বহাল করার জন্য। “ধ্যাৎ তাহলে পাত্তা দিচ্ছ কেন?” বলে ফোন কেটে দিল সুকন্যা। 



বিকালে প্রৌঢ় মালিক এসে হাজির। গাড়ির মালিক।  কৌশিক এসে বলল, “উনি এসেছেন একবার দেখা করে নিন ম্যাডাম। ” কোন মুখে দেখা করি, আমি বলাতে ঐ ছেলেটিকে পুনর্বহাল করেছিলেন উনি। বলেছিলাম আমি জামিন রইলাম, ভবিষ্যতে ছেলেটি হুট করে অমন বিপদে আর ফেলবে না। মুখ রাখল কোথায় এবার? হে ভগবান। একদিনে কটা বাঘের সাথে কোস্তাকুস্তি করতে হবে?



উনি যথারীতি অনুযোগ দিয়ে শুরু করলেন, “দেখেছেন ম্যাডাম, আপনারাই মাথায় তোলেন এদের। আপনারা বললেন বলেই। আমি জানি তো, ও তখন থেকেই ঐ মালিকের সাথে যোগাযোগ করছে তলে তলে। আগের ড্রাইভারটা নড়ছিল না বলে এ যেতে পারছিল না। এখন ওদের কোর্টের ঝামেলাটাও মিটে গেছে। আপনাদের আর দরকার নেই ওর।” কি জবাব দি? মানুষের দুর্দশা শুনলে, সীমিত সামর্থ্য নিয়েও ঝাঁপিয়ে পড়ার অভ্যাসটা মায়ের থেকে পাওয়া। প্রায় মজ্জাগত। মালিক বলেই চলেছেন,“কোথায় বিশ্বস্ত ড্রাইভার পাই এখন?পুজোর সময়।” শুকনো মুখে ঘাড় নাড়ছি কৌশিক আর আমি। 



শেষ বিকালের নালিশের মাঝেই বেজে ওঠে দূরভাষ। ওপারে সেই আধিকারিক,যার গাড়ি চালানোর জন্য,আমাদের পথে বসানোর বন্দোবস্ত প্রায় পাকা। “এই আপনার ড্রাইভারটা আমার গাড়ি চালাতে চাইছে। আপনি আগে বলুন তাতে আপনার কোন অসুবিধে হবে না তো? আপনার অসুবিধে করে ড্রাইভার চাই না আমার। যদি সুবিধা হয় ছাড়বেন,নাহলে আমাদের মালিক অন্য ড্রাইভার দেখবে।বুঝেছেন।  ” 


চেম্বারে ফোনের টাওয়ার থাকে না। কথা বলতে লাগে খোলা বারন্দা। ফোন সেরে ফিরে দেখি দীর্ঘ নালিশের পর কিঞ্চিৎ শান্ত প্রৌঢ়। উঠে পড়েছেন, যাবার আগে বলে গেলেন, “চিন্তা করবেন না। দেখছি। আর ওকেও বলেছি, অফিসটাকে ডুবিয়ে যদি তোর ইচ্ছে মত কেটে পড়িস, তাহলে পাওনাগণ্ডা  নিয়েও আমি আমার ইচ্ছে মত বসব। আর যদি তা না করিস, তাহলে ষষ্ঠীর আগেই চুকিয়ে দেব সব হিসেব। পুজো কাটলে একটা ব্যবস্থা হয়েই যাবে। ” 


ফেরার পথে দেখলাম ড্রাইভার সুমিষ্ঠ স্বরে জানতে চাইল, পরের দিন কটায় বেরোব। ফেরার পথেই উচ্চ ন্যায়ালয় নিয়ে গুচ্ছ গুচ্ছ ফাইল ঘাঁটা জনৈক সুহৃদ, দূরভাষে  আশ্বস্ত করল  “ওরে  ওগুলো হুমকি নয়। প্রেমপত্র। আমি তো কলকাতায় থাকাকালীন রোজ পেতাম। অস্বীকার করব না, প্রথম দিকে আমিও হাইপার হয়ে পড়তাম। তারপর যা হয় আর কি পড়তামও না। যা করেছিস, বেশ করেছিস। ছাড় তো। বাড়ি যা।” ঘরের মুর্গির সোয়াদ যদিও ডালের মত, তবে এই কথাগুলোই বোধহয় বলেছিল গৃহকর্তাও। 



 অন্ধকার রাজপথের বুকের ওপর ঘরে ফেরা যানবাহনের দমচাপা ভিড়। আকাশে মুখ লুকিয়েছে চাঁদ। আর দিনদুয়েক পরেই বোধহয় অমাবস্যা। তারপরই বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত মতে প্রতিপদ। পুতিগন্ধময় ধরার মা আসছেন। প্রায় সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলেছিলাম, বদলে ফেলব অনেককিছুই, এখন এই অন্ধকারে খোলা জানালা দিয়ে ছুটে আসা হুহু হাওয়া কেন জানি না বলে যাচ্ছে, কি দরকার? এই তো বেশ ভালোই আছি। জীবন যদি লেবু দেয়,লেমনেডও বানিয়ে দেবে খন। 

Saturday 10 October 2020

   অনির ডাইরি ৭ই অক্টোবর ২০১৯

গন্তব্য- হিন্দুস্তানের হৃদয়


পুজোর মাঝে বাক্সপ্যাঁটরা গুছিয়ে, লটবহর বগলে কোথাও যাওয়া যে কি ঝঞ্ঝাট, তা কেবল বোঝে বাড়ির গিন্নীরা। পুজোয় খোলা টোটো কোম্পানীর দাপটে খুলে আসতে চাওয়া হাঁটু আর নুইয়ে পড়া কোমরকে পূর্ণোদ্যমে খাড়া করে, আলমারির পাল্লা খুললেই ঝাঁপিয়ে কোলে উঠে আসতে চাওয়া জামাকাপড়ের প্লাবনকে “একটু লক্ষ্মী হয়ে থাক বাপ, ফিরে এসেই তোদের ব্যবস্থা করছি” বলে ঠেলে ঠুলে ঢোকানো, কাজের মাসির হাতেপায়ে ধরে,  স্বহস্তে রঙ করা টবের আদুরে গাছপালা গুলোয় জল দেবার ব্যবস্থা করা, ফ্রিজে জমে থাকা আনিজপাতি আর দুধের দায়িত্ব শাশুড়ীর হাতে তুলে দিয়েও দেখা গেল হাফ লিটার দুধ আর আধ প্যাকেট পাঁউরুটি আর গোটা পাঁচেক ডিমের দায়িত্ব কেউই বহন করতে রাজি নন। 


ফ্লাইট তো সেই দুপুর দুটো পঞ্চাশ, যাব ইন্দোর। সাধারণতঃ এত বেলায় আমরা কখনও যাত্রা শুরু করি না, কিন্তু এ যাত্রা নিরুপায়। কলকাতা থেকে ইন্দোর ওয়ান স্টপ ফ্লাইট ঐ একটিই। ঘোষিত সময় লাগবে একঘন্টা পঞ্চাশ মিনিট। অর্থাৎ দেবী অহল্যা বাই হোলকার বিমানবন্দরে অবতরনের ঘোষিত সময় বিকাল পাঁচটা। তারপর গাড়িতে আরও ঘন্টা দুই আড়াইয়ের যাত্রা। ভালো করে খেয়েদেয়ে বের হওয়াই মঙ্গল। 

সকালে দুধ পাঁউরুটি আর দুপুরে তুত্তুরীর পার্টি লাঞ্চ( আদতে প্রেশারকুকারে এক সাথে সিদ্ধ করা চাল, মুসুর ডাল আর তুলতুলে আলুর ওপর অপরিমিত ঘি, অনুসঙ্গে সদ্যোদিত সূর্যের ন্যায় মাখন দিয়ে ভাজা একটি ডিমের পোচ)  করে আমরা যখন বের হলাম, ঘড়িতে তখন বেলা একটা বেজে দশ। ইন্ডিগো সকাল সকালই মেসেজ পাঠিয়ে রেখেছে,“ বিমানবন্দরে বড্ড ভিড়। জলদি এস। অন্তত ঘন্টা দুয়েক আগে অবশ্যই ঢুকো কিন্তু। ” এসব মেসেজে আমরা তেমন ডরাই না। আরেঃ ঘরের পাশেই তো বিমানবন্দর। তবে ওলা উব্রের যা গাড়ির আকাল সেটা নিয়েই যা কিঞ্চিৎ দুশ্চিন্তা। 


তখন কি আর জানি, যে  ইন্দোরের আকাশে  ঘনিয়েছে ঘন বাদল। যত্র তত্র গজিয়েছে বিশ্রী এয়ারপকেট, মাঝেমাঝেই এমন ঝাঁকুনি দিচ্ছে কেঁপে উঠছি আমরা। প্লেনটা নামতেই পারল না নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে, অগত্যা দু বার পাক খেয়ে গেল ইন্দোরের মাথার ওপর দিয়ে। 

পরিশেষে অবতরণান্তে, লটবহর জুটিয়ে বাইরে এসে যখন গাড়িতে চাপলাম ঘড়ির কাঁটা বলছে সময় পাঁচটা বেজে চল্লিশ। ড্রাইভার তথা গাড়ি দুই মধ্যপ্রদেশ ট্যুরিজমের। আজ রাতের জন্য গন্তব্য ওঁঙ্কারেশ্বর। পুরো ট্যুরটাই আমার বড় সাহেবের প্ল্যান করে দেওয়া। উনিই বলেছিলেন, “মধ্যপ্রদেশ আমার সবথেকে প্রিয় অঙ্গরাজ্য। বহুবার গেছি। পারলে ঘুরে এসো।” হিন্দুস্তানের হৃদয় বলে কথা, ছত্রিশগড়কে আলাদা করে দেবার পরও কমপক্ষে সাত থেকে আটটা সার্কিট হয়। বেসরকারী হোটেল থাকলেও, মধ্যপ্রদেশ ট্যুরিজমের হোটেলগুলিই সবথেকে ভালো এবং নির্ভরযোগ্য।এদের পেশাদারীত্ব অতুলনীয়।  চাইলে গাড়িও ওণারাই দিয়ে দেন। বিমানবন্দর থেকে তুলে আবার বিমানবন্দরে নামিয়ে দেবার গাড়ি-। 


গাড়িতে উঠে, শৌভিক আলগা ভাবে জানতে চাইল,“রাত আটটার মধ্যে ঢুকতে পারব কি?” মিনমিনে সুরে জবাব এল, “থোড়া জায়দা টাইম লাগেগা সাব। রাস্তা খারাব হ্যায়। ”

খারাপ মানে খারাপ? বাপরে যত্রতত্র গাড্ডা আর গর্ত। সদ্য বর্ষার পানি জমে সে গুলির কয়েকটা রীতিমত ডোবার রূপ নিয়েছে। ড্রাইভার সাহেব বেশ কয়েকবার বললেন, “তিন মাহিনা পয়লে ভি আচ্ছি সড়ক থি সাব। বারিশ কি পানিনে সব ধো ঢালা”।রাস্তা তো রাস্তা আমাদেরও ধো ঢালা বাপ্। 


তেমনি ট্রাকের উৎপাত। কলকাতা থেকে বেশ খানিকটা পশ্চিমে বলেই হয়তো ছটা অবধি দিব্যি আলো ছিল। ইন্দোর বেশ সবুজ শহর। শুনলাম সম্প্রতি মধ্যপ্রদেশের পরিচ্ছন্নতম শহরের মর্যাদা পেয়েছে।  প্রচুর গাছপালা। বেশ পরিষ্কারও। অবশ্য আমরা মূল শহরে ঢুকেছি কি না জানি না। তবে গুচ্ছ গুচ্ছ মল, নামী তথা দামী হোটেলের উপস্থিতি কোথাও না কোথাও বুঝিয়ে দেয়, ইন্দোরবাসীদের আর্থিক স্বাস্থ্য বেশ ভালোই। 


সাড়ে বারোটায় খাওয়া পার্টি লাঞ্চ কখন হজম হয়ে গেছে পর্যায়ক্রমে বিমান আর গাড়ির ঝাঁকুনিতে। নেমেই বলা হয়েছিল একটা দুকান থেকে দাঁড় করাতে, “চায়েনাস্তা” করব। রাস্তার দুধারে অগুনতি ধাবা। ধাবা ভর্তি শুধু চাট। সামোসা চাট। কচৌরি চাট। আর ছাচ, মানে লস্যি বোধহয়।  শুধু চা’টাই যা দুর্লভ। এই পথে এত ধাবা, এত ট্রাক, কিন্তু কেউ তেমন চা খায় না নাকি? কে জানে। 

সাতটা নাগাদ সৌভাগ্য হল।হাইওয়ের ধারে টিমটিমে আলো জ্বলা ধাবা। কড়াইয়ে টগবগ করে ফুটছে মোষের দুধ। বললেই চা পাতা আর চিনি দিয়ে ফুটিয়ে দেবে।  নাস্তা বলতে  অবশ্য সেই সামোসা আর কচৌরি। তাও ভেজে রাখা।  তাই সই। এই মোটা ছাতুর পুর দেওয়া ঠাণ্ডা কচৌরির ওপর লাল চাটনি আর ঝুরি ভাজা ছড়ানো আর জিভ পোড়ানো মোষের দুধের মিষ্টি চা। দুটিই অম্বলের আহ্বায়ক। দুটিই স্বাদে অনবদ্য। 


ক্রমে গাড়ি গাঁয়ের রাস্তা ধরল। কিছুটা দূরে দূরেই হিন্দিতে সাইন বোর্ড দেওয়া- “ধীমে চালাইয়ে। আগে গাঁও হ্যায়। ” ধীরে ধীরে ঘাট শুরু হল। আসলে বিন্ধ্যাচলের ক্ষয়ে যাওয়া অংশ।  এরা বলে ঘাট। ঘাটের নাম কি? জানতে চাইলে ড্রাইভার আকাশ থেকে পড়ে, “গাঁও কা নাম সেই হোগা সাব।”


দুপাশে জঙ্গল। আকাশে ক্ষয়া কিন্তু নবমীর টলটলে চাঁদ আর অগুনতি তারাদের দঙ্গল।দূষণ,ধোঁয়া কম বলে সবকিছু অতি স্বচ্ছ।  চতুর্দিক নিঃঝুম। মাঝেমাঝে শুধু উল্টো দিক থেকে আসা গাড়ির আলো বাদে সে এক অপার্থিব পরিবেশ। মনে হচ্ছিল বাতানুকূল গাড়ির কাঁচ ভেদ করে ছড়িয়ে পড়ছে মাতাল ঝিমঝিমে জোছনা।

Thursday 8 October 2020

অনির ডাইরি ৮ই অক্টোবর, ২০২০


কত মত। কত পথ। কত জ্ঞান- পাল্টা জ্ঞান। সমালোচনা। বাদ-বিবাদ। ছিছিক্কার। এইসব কিছু থেকে অনেক অনেক দূরে বাস করে মানু। জানেন মানু কিন্তু বাঙালী নয়,মারাঠি মুল্গি। যদিও বললে মানু হেসে গড়াগড়ি যেত। বলত, "আমি মুল্গি নই গো ম্যাডাম দিদি। মুল্গি হল কচি। ডবকা মেয়ে। আমার বয়স কত জানো? দুই কুড়ি পাঁচ। ” তারপরই বলত, "কিছু নেবে নাকি? নাও না। আসল সোনার বাউটি আছে, বালা আছে, চুড়ি আছে, পলা আছে। ” এই বলেই চিৎকার করত মানু। আসল ল্যাকমে কোম্পানির  গয়না বেচত বলে মানুর মাটিতে পা পড়ত না। আরেঃ এ ল্যাকমে ঐ দামী কসমেটিক ব্রাণ্ড নয়, যার মুখপাত্র তৈমুরের মা। এ হল লোকাল ট্রেনের লোকাল ব্রাণ্ড। তো যা বলছিলাম, এক বাঙালী ছেলের সাথে পালিয়ে বঙ্গদেশে পা দিয়েছিল মানু। এইসব গল্পে যা হয় আরকি। দেশে এসে দেখে ঘরে জাজ্বল্যমান সতীন। মানুর গর্ভে তখন তিলে তিলে বাড়ছে লক্ষ্মী। এই নামই দিয়েছে মানু তার মেয়ের। মেয়ে নিয়ে আলাদাই থাকে মানু। শিয়ালদা মেন লাইনের ট্রেনে হকারী করে চলে যায় দুটো প্রাণ। থুড়ি চলে যেত। পুজো আসার মাস দুয়েক আগে থেকে হুহু করে বিক্রি বেড়ে যেত মানুর। অনেক অনেক টাকার গয়নাগাটি মুখ দেখে দিয়ে দিত মানু। পয়সা পরে বা কিস্তিতে দিলেও চলত। একবার এই করতে গিয়ে এক মহিলা ৫০০টাকার জিনিস নিয়ে আর পয়সা না দিয়েই কেটে পড়েছিল। সেই দুঃখের গল্প শুনে খুব ধমকেছিলাম গত বছর। আবার অনেক সময় অনেক মহিলা যাত্রী এমনিই দু-পাঁচশ টাকা দিয়ে দিত মানুর হাতে। “মিষ্টি খাস মানু।” অথবা “পুজোয় অন্তত একটা নতুন শাড়ি কিনিস মানু।” এবছর কি করে সংসার চলছে মানুর কে জানে? কি খাচ্ছে মা-মেয়েতে? 

সুদেব গুড়বাদাম বিক্রি করত ট্রেনে। লেডিজেই বেশী ছিল খরিদ্দার। জন্মান্ধ সুদেব হকারী করতে গিয়ে ট্রেন থেকে পড়ে কব্জি থেকে হারিয়েছে বাঁ হাত। তবুও ছাড়েনি হকারী। বিগত সাড়ে তিনবছর ধরে, দেখে আসছি, আজ অবধি নিজের অবস্থার কথা বলে কোন সহানুভূতি চায় না সুদেব। আমার দেখা সবথেকে পজিটিভ মানুষ। কতই বা বয়স? বছর চল্লিশ অথবা আরো কম। দীর্ঘ ক্ষয়াটে চেহারা। একদিন ফাঁকা ট্রেনের দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বলেছিল, ‘যতদিন গতর চলবে, খেটে খাব দিদি। অন্ধ বলেই কি হাত পাততে হবে বলুন?’ জীবনিশক্তির এমন জলচ্ছবি কেমন আছে কে জানে? আছে কিনা তাই বা কে জানে।লকডাউন আর কোভিড আতঙ্কের মধ্যেই দক্ষিণ এশিয়া আর আফ্রিকার প্রায় তিন কোটি মানুষ অর্ধাহার বা অনাহার জনিত কারণে অপুষ্টি-আক্রান্ত। এটাও মাস খানেক আগেকার তথ্য। এখন হয়তো আরো বেড়েছে। প্রসঙ্গতঃ খাদ্যের কিন্তু অভাব নেই। অভাব সুষ্ঠ বিলিবন্টনের। সৌজন্য- অবশ্যই কোভিড। শ্রীলেদার্সের ভিড় নিয়ে জম্পেশ একটা পোস্ট দিয়েছেন তো? 


তনিমা একজন আধাসরকারী কর্মচারী। অন্তত তনি তাই মনে করে। চুপি বলি, আসলে তনি পাতি এজেন্ট। যেমন যেমন কাজ করে বদলে কমিশন পায়। তনির একটা পুঁচকে ছানা আছে। লকডাউনের মধ্যেই হারিয়ে গেছে তার অনেকগুলো ভ্যাকসিনের ডেট। তনি পারেনি ছানাটাকে ইঞ্জেকশন দেওয়াতে। লকডাউনে বন্ধ ছিল ওর বরের কারখানা।বন্ধ ছিল তনির আপিসও। মাঝে এমন একটা দিন এল, যখন গোটা বাড়ি খুঁজেও একটা টাকা বার করতে পারেনি কর্তাগিন্নীতে। এখন হাঁড়ি চড়ছে কোনমতে। ওসব ভ্যাকসিন-ট্যাকসিনের কথা চিন্তাও করতে পারছে না ওরা। শুধু ওরা নয়, আফ্রিকা আর দক্ষিণ এশিয়ায় প্রায় দেড় কোটি বাচ্ছা পায়নি কোন ইম্যুনাইজেশন। এই বাচ্ছাগুলো পরে বড় হয়ে কোন ব্যাধিতে আক্রান্ত হবে কে জানে? আপাততঃ ওদের বাবা-মাও হয়তো তনিদের মতোই ভাবছে,  দেখা হলেই যেমন প্রশ্ন করে তনি, “আবার লকডাউন হবে না তো ম্যাডাম? না খেয়ে মরে যাব এবার।” 


আর আমার সেই বান্ধবী, যার বাড়িতে ঘটে গেছে এক মর্মান্তিক দুর্ঘটনা। তীব্র শোকের মধ্যেও  হেসে উঠেছিল সে, “অনি রে যখন পুলিশ এল,কি ভিড় প্রতিবেশীদের। সবাই ভিড় করে কেচ্ছা দেখতে এসেছে বুঝলি। আর মেজোবাবু যখন বললেন, “কেউ একটু আসুন। বডিটা নামাতে হবে”। তখন কেউ এল না জানিস। কেউ না। এত করোণার ভয় মানুষের অনি?  আমার বৃদ্ধ অসহায় বাবা, যে কিনা সক্কাল সক্কাল আবিষ্কার করেছে তার মৃত পুত্রের দেহ, আমার নার্ভাস হয়ে বসে পড়া বর আর আমি ছাড়া কেউ ছিল না অনি। আমি। আমি। আমি নামালাম জানিস। তারপর থেকে আর চোখ বোজাতে পারছি না। চোখ বুজলেই, চোখে ভেসে উঠছে ঐ দৃশ্য। ” মাত্র চারজনের কথা লিখলাম। শ্রমদপ্তরে চাকরী করি, সপরিবারে জয় করেছি কোভিডকে এরকম আরো চল্লিশজনের উদাহরণ দিতে পারি, যাদের জীবন তছনছ করে দিয়েছে এই ব্যাধি। নাঃ এরা কেউ আক্রান্ত হয়নি। আক্রান্ত হয়েছে এই সমাজ। ভয় যদি পান, বাড়িতে বসে থাকুন। আপনি ভাগ্যবান, বাড়িতে বসে সোশাল মিডিয়ায় বিপ্লব করছেন। কিন্তু সবাই এত ভাগ্যবান নয়। আর এদের গরিষ্ঠাংশেরই কোন সোশাল মিডিয়া অ্যাকাউন্ট নেই, যে বিরুদ্ধ মতটাও আপনার গোচরে আনবে। আপনি বেঁচে থাকুন। আমাদের মত খেটেখাওয়া মানুষগুলোকেও একটু বাঁচতে দিন। করোনায় না মরলেও অর্ধাহারে অনাহারে মরেই যাবে হয়তো।

Sunday 4 October 2020

অনির ডাইরি, ১লা অক্টোবর, ২০২০

 


আজকের সকালটা বড় মনোরম। অক্টোবর পড়েই গেছে, ভোরের বাতাসে লেগেছে হাল্কা হিমেল একটা আমেজ। মায়ের আসছেন, আর তো কটা দিন। আকাশে-মেঘে-রোদে সর্বত্র খুশির গন্ধ। শুধু গুটি কয়েক মিটিং সালটে দিতে পারলেই, মাঝারি লম্বা একটা সপ্তাহান্ত।  

মিটিংগুলোও বড় ভুলভাল। প্রথম কেসটিতে যাঁকে নিয়ে মিটিং তিনি অ্যাসিস্টান্ট ম্যানেজারের পদে কর্মরত ছিলেন। লাখ বারো টাকা তহবিল তছরুপের অভিযোগে খুইয়েছেন চাকরীখানা। ভালো করে বুঝিয়েছিলাম, ম্যানেজার পদাধিকারীদের পাশে দাঁড়ানোর এক্তিয়ার নেই আমার। শ্রম দপ্তর তথা শ্রম আইন শুধুই শ্রমিকদের জন্য।  তহবিল তছরুপ নিয়ে কিছু বলিনি,কারণ নীতি পুলিশগিরিটা আমার কর্তব্যের মধ্যে পড়ে না। 


ভদ্রলোক সেই শুনে এমন কান্নাকাটি জুড়লেন কি বলি। মহিলাদের অশ্রু তাও হজম হয়, পূর্ণ বয়সী পুরুষের চোখের জল সহ্য করা বেশ দুষ্কর। ওণার বক্তব্য আমার অপরিচিত নয়, ‘নামেই অমন ম্যানজার ম্যাডাম। বেতন কত দিত শুনবেন?’ ভুল কিছু বলেননি,বেতন যেকোন সিকিউরিটি গার্ডের থেকে ইতরবিশেষ। ওণার পোশাকপরিচ্ছদও সোচ্চারে তাই ঘোষণা করে। তহবিল তছরুপ নিয়েও উনি অনড়, “আমি এট্টা নয়া পয়সাও চুরি করিনি দিদি। ’ এরা যখন কান্নাকাটি  জোড়ে, তখন হঠাৎ ম্যাডাম থেকে দিদি হয়ে যাই-এটা আগেও দেখেছি। 


কিছু করতে পারব না, হাতপা বাঁধা বললেও যদি কমলি না ছাড়ে, তখন বাধ্য হয়েই মাথা গলাতে হয়। ইনি আবার আত্মঘাতী  হবার ভয় দেখালেন। কাগজপত্র ঘাঁটতে গিয়ে দেখলাম, লকডাউনের আগে একটা মোটা অঙ্কের টাকার চেক ওণাকে দেওয়া হয় ব্যাঙ্কে জমা করার জন্য। ব্যাঙ্কে ঐ সময় অসম্ভব ভিড় আর চাপ। উনি চেকটা জমা করে চলে আসেন। 


মাসখানেক পর যখন প্রথম আনলক ডাউন হয়, আপিসে গিয়ে দেখেন টাকাটা ওনার ব্যক্তিগত অ্যাকাউন্টে ঢুকে বসে আছে। তৎক্ষণাৎ ব্যাঙ্কে দৌড়ে চিল্লাচিল্লি করে টাকাটা আবার আপিসের অ্যাকাউন্টে ঢোকানোর ব্যবস্থা করেন উনি। দুটি অ্যাকাউন্ট একই ব্যাঙ্ক তথা ব্রাঞ্চে। ফলে অসুবিধা হয়নি। টাকাপয়সা যথাস্থানে পাঠিয়ে যখন উনি দপ্তরকে জানাতে গেলেন তখনই বাঁধল গোল। এতদিন এসব কেউ জানতও না। খোঁজও করেনি। জানার সাথে সাথেই শোকজ এবং পরদিন টার্মিনেশন। তাজ্জব ব্যাপার, এতো ঠাকুমার ভাষায়, ‘কলিযুগে উপকারীকে বাঘে খায়’ কেস। সবথেকে বড় প্রশ্ন যেটা একটা সরকারী ব্যাঙ্ক এমন কেলো করল কি করে? চেক ক্রশ করা ছিল না? কার নাম ছিল চেকে? চেকের ফটোকপিতে লেখা দেখলাম,‘ সেল্ফ’। সই করেছেন প্রেসিডেন্ট এবং সেক্রেটারি। তো সেই চেক আপনার অ্যাকাউন্টে ঢোকাল কেন? শুনলাম ব্যাঙ্ক ম্যানেজার ইতিমধ্যে বদলী হয়ে গেছেন। তবে এর আগেও এইরকম দপ্তরী টাকাপয়সা ভদ্রলোকের অ্যাকাউন্টে ঢুকেছে এবং তা ওণার দপ্তরের অনুমোদন সহ। অনুমোদন পত্রের ফটোকপি দেখালেন, যেখানে লেখা আছে, ইব্যাঙ্কিং ইত্যাদির জন্য ওণার অ্যাকাউন্ট দপ্তরী কাজে ব্যবহার করা যাবে।  


গুপি কেস মাইরি। সবকাগজ ঘাঁটলে বোঝাই যায়, টাকা চুরি হয়নি, পাইপয়সা ঢুকেছে যথাস্থানে। সেই টাকা থেকে ওণার দপ্তর খরচাও করছে দেদার, অথচ লোকটাকে চোর অপবাদ দিয়ে বিতাড়ন করে বসে আছে। এমন কেসে তো হস্তক্ষেপ করতেই হয়।


 এইসব কেসে সাধারণত  চিঠি পাঠিয়ে বিপক্ষের বক্তব্য জেনে তবেই ত্রিপাক্ষিক মিটিং ডাকা হয়। লোকটার আর্থিক তথা মানসিক যাতনা দেখে সোজা ত্রিপাক্ষিক মিটিং ডেকে বসে আছি। পোস্টাফিসের মাধ্যমে চিঠি পাঠালে পাছে দেরীতে পায় বা ঐ অজুহাত দেখায়, আমাদের শান্তনু স্বয়ং গিয়ে দিয়ে এসেছে  মিটিং এর শমন।  

বাদী এসেছে যথাসময়ে, বিবাদী বলতে এসেছেন এক বয়স্ক ব্যক্তি। শুনলাম তিনিই নাকি প্রেসিডেন্ট। তাঁর পোশাক পরিচ্ছদ হাবভাব সবই অবসর প্রাপ্ত শিক্ষকদের মত। পরিচয় দেবার সাথে সাথে বুঝলাম আমার অনুমান অব্যর্থ। এবার চেপে ধরতে সুবিধে হল। ‘কি মশাই, আপনি সরকারী লোক হয়ে, তুচ্ছ অভিযোগে একটা ছেলের চাকরী খেয়ে নিলেন? তাও আবার চুরির বদনাম দিয়ে? আমি হলে তো সর্বাগ্রে মানহানির মামলা ঠুকতাম। চুরির দায়ে তাড়ালেন, অথচ পুলিশকে জানালেন না? ব্যাঙ্ককে কিছু বললেন না।  আর যে পাইপয়সা ফিরিয়ে দিয়ে ব্যাপারটা আপনাদের দৃষ্টিগোচর করল, তাকে দিলেন ভাগিয়ে? বেশ মজা না?’ উনি থতমত খেয়ে জানালেন, ‘আমি জানি ম্যাডাম। চূড়িন্ত অন্যায় হয়েছে ওর সাথে। আমি প্রতিবাদ করেছিলুম। এইভাবে রাতারাতি কাউকে ছাঁটাই করা যায় না। কেউ কর্ণপাত করলে না। আসলে দলাদলি-’। 


অ্যাঁ? দল? তুমি কোন দল করো ভাই? গ্রামের দিকে দলাদলি এসে গেলেই তো কেস জণ্ডিস। উভয়েই আশ্বস্ত করলেন না, তেমন কোন ব্যাপার নয়। সবাই একই দল,তবে ঐ গোষ্ঠিবাজি একটু আধটু আর কি। বললাম, তাহলে লিখে দিন, ওর ছাঁটাই অনৈতিক। আপনি চান ও চাকরী ফিরে পাক। বৃদ্ধ দেখলাম সটান পেন বার করে প্রস্তুত। আহাঃ প্রথম মিটিংটাই নির্বিঘ্নে মিটে গেল- যেই ভেবেছি, ম্যানেজারের চিঠি। তিনি সবিস্তারে লিখেছেন, যে পুরাতন বোর্ড আপাততঃ মুলতুবি। ফলে ঐ বোর্ডের নেওয়া সিদ্ধান্ত সম্পর্কে তাঁরা কিছু জানেন না। এব্যাপারে যদি কিছু করতেই হয়, তাহলে সংশ্লিষ্ট সরকারী অাধিকারির সঙ্গে যেন যোগাযোগ করা হয়।  


আধিকারিক বসেন বিডিও আপিসে। তাঁর সাথে ফোনে যোগাযোগ করা হলে, তিনিও মানলেন যে অন্যায় হয়েছে। তাঁর রিপোর্টেও তিনি নাকি এটা লিখেছেন। সর্বোপরি, বাদীকে আমার কাছে পাঠানোর পিছনেও তিনিই আসল কলকাঠি নেড়েছেন। সে তো হল, এবার এর কি হবে? এর উত্তর আধিকারিকের কাছে নেই। তিনি জানালেন, জেলাস্তরীয় আধিকারিককে বলে যদি আমি কিছু করতে পারি। তিনি আবার পাশের বিল্ডিং এ বসেন।  

বেশ তাই হোক তাহলে। সুকন্যার সাথে শলা করে, যুৎ করে চিঠি লিখলাম, সঙ্গে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র দিয়ে। গোটা গোটা করে লিখলাম, এই ভাবে পুশিলকে না জানিয়ে, একদিনের নোটিশে, কাউকে ছাঁটাই করা শুধু শ্রম আইনই নয়, বাদীর মৌলিক অধিকারেরও পরিপন্থী। অবিলম্বে যথোপযুক্ত ব্যবস্থা নিয়ে বাধিত করুন। 


 ধীমান চিঠি নিয়ে রওণা দেবার পর, ভদ্রলোককে বললাম, আমার দৌড় এখানেই শেষ। এবার আমার সমমর্যাদার অন্য দপ্তরীয় আধিকারিকের পালা। আশা করি তিনি আপনাকে নিরাশ করবেন না। যদি হয়, নির্ঘাত হবে, অবশ্যই আমাকে জানিয়ে যাবেন,কেমন? 


এবার দ্বিতীয় মিটিং এর পালা। সূর্য মধ্যগগন ছেড়ে পশ্চিমাভিমুখী। এটা বোনাসের মিটিং। দুপক্ষই পূর্বপরিচিত। এর আগেও বিভিন্ন ইস্যুতে বেশ কয়েকবার মিটিং হয়েছে। শ্রমিকদের মুখপাত্র যিনি, ট্রেড ইউনিয়নের এক বয়ঃজেষ্ঠ্য সর্বজনশ্রদ্ধেয় নেতা, শুনলাম তিনি অসুস্থ। উনি থাকলে আমায় বিশেষ আর মুখ খুলতে হয় না। ভদ্রলোক রীতিমত সব্যসাচী। দুহাতে ব্যাট চালান। কখনও মালিককে ধমকান তো কখনও শ্রমিকদের। আজ তিনি নেই,মানে কপালে দুঃখ আছে। 


আসতে বললাম, দুই পক্ষকে। একদল অচেনা লোক ঢুকে এল হুড়মুড় করে। আপনারা কারা মশাই? ট্রেড ইউনিয়নে কি নেতৃত্ব বদল হয়েছে? আমার সামনের চেয়ারে ধপ করে বসা স্থূলাঙ্গ ব্যক্তি নিজের পরিচয় দিতে বুঝলাম, এরা ঐ মিটিং এর সঙ্গে সম্পর্ক বহির্ভূত। ইনি স্থানীয় বড় রাজনৈতিক নেতা। আর সঙ্গের লোকগুলি প্যাণ্ডেল তথা ডেকরেশনের কাজ করে। অন্যান্য বছর এইসময় ঐ গ্রামগুলি পুরুষ বিবর্জিত থাকে। সবাই ছড়িয়ে পড়ে দূরদূরান্তে পুজোর কাজ করতে। এবারে কোন কাজ নেই। সংসার চলছে না। সপরিবারে আত্মঘাতী হবে সবাই, তাই আমাকে জানাতে এসেছে। 


কি যন্ত্রণা। সবাই আত্মঘাতী হবার হুমকি এই অধমকেই দেয় কেন? কি চাই বাবাসকল? আমার প্যাণ্ডেল বাঁধানোর কোন ক্ষমতা নেই। টাকাপয়সা, চাল বা অনুদান দেবার মতও কোন সাধ্য নেই। একেবারেই অকর্মণ্য  অধম আমি। ওণারা দেখলাম আমার এই অসহায় স্বীকারোক্তিতে বেশ সন্তুষ্ট  হলেন। নেতা মশাই বললেন,‘ আপনি অন্তত আমাদের কথা তো শুনলেন। অমুক সাহেবের কাছে গেলুম, তিনি তো দেখাই করলেন না। জানেন?’ বেচারা অমুক সাহেব। তাঁর যে কত যন্ত্রণা, আমি তো বুঝি। আরো খানিক অনুযোগ শুনে, দুই বড় সাহেবের সরকারী নম্বর আর ইমেল আইডি দিয়ে তাঁদের রওণা করলাম। ওপরমহলে পৌঁছাক ওদের আর্তি। জানি আগামী দিনে এরকম আরো অনেক আবেদন আর্তি ভেসে আসবে।  পুজো হলে রাজ্যটা কেরালা হয়ে যাবে, আর না হলে, মানুষ অভুক্ত হয়ে মরবে। এযেন ক্ষুরস্য ধারা।  


এবার বোনাসের মিটিং এর পালা। দরাদরিটা আমার মোটেই আসে না, তবে তাই করতে হবে এখন। কত দেবেন? কত চাও? বারবার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে এই প্রশ্ন করে যেতে হবে। যতক্ষণ না উভয়পক্ষ আসে একে অপরের কাছাকাছি। তখন দিতে হবে মোক্ষম চাপ। যা হবে আজকেই মিটিয়ে নিন আপনারা। ষষ্ঠীর দিন বিকালে এসে বোনাসের মিটিং যদি আমায় করতে হয়, তাহলে কারো রক্ষা নেই। অার যত তাড়াতাড়ি দেবেন বা পাবেন ততো জলদি যাবেন দোকানে। ভিড় জমে ওঠার আগেই কিনতে পারবেন বাচ্ছার জামা। বা বউয়ের শাড়ি। তারাও তো বসে আছে এই মিটিংএর দিকে তাকিয়ে। মিটিয়ে ফেলুন না মশাই, কেন ঝঞ্ঝাট পাকান আপনারা। 

পুনশ্চ-ছবিতে মিটিং শেষে সকলে। ১৮ শতাংশ বোনাস পাবে শ্রমিকরা। উপকৃত হবে শতাধিক পরিবার। পুজো ইস্পেশাল খুশি বলতে তো এইটুকুই।তাই বা কম কি? নামধাম না হয় উহ্যই থাকুক।  

Saturday 3 October 2020

 অনির ডাইরি, ৩রা অক্টোবর, ২০২০


এক ঝলক দেখে মনে হবে আটচালা হিন্দু মন্দির বুঝি। চুনকামের ফাঁকফোকর গলে এখনও বেরিয়ে আসে টুকটাক পোড়া মাটির ভাস্কর্য। নাম- হেনরী মার্টিনের প্যাগোডা।  


শ্রীরামপুরে গঙ্গার ধারে, বড় বড় মহীরুহ আর সদ্য বর্ষার বেয়াড়া ঝোপজঙ্গলের মাঝে নিরালা নিঃসঙ্গ চুনকাম করা এক প্যাগোডা, আর কয়েকশ বছরের নীরব ইতিহাস। অন্তর্জাল ঘাঁটলে শোনা যায় নানা কিস্যা। শোনা যায় জনৈক রুদ্ররামের আখ্যান।  সে অনেককাল আগের কথা, ষোড়শ শতক। দিল্লীর দখল নিয়ে তখনও লড়াই করেই চলেছেন বাদশা হুমায়ুন।  বাংলায় তখন নড়বড়ে সুলতানী শাসন। ঘাড়ের উপর নিঃশ্বাস ফেলছেন  এক দোর্দণ্ডপ্রতাপ পাঠান, নাম, শের শাহ সুরী। এই জটিল রাজনৈতিক দাবাখেলা থেকে বহুদূর তৎকালীন শ্রীরামপুরের চাটরা অঞ্চলে মাতুলালয়ে বড় হয়ে উঠছিলেন বাবু রুদ্ররাম। সাংসারিক জটিলতা থেকে বহুদূর, পবিত্র গঙ্গা কিণারে, গভীর জঙ্গলের হৃদপিণ্ডে, নির্জনে ধ্যানে বসেছিলেন বাবু রুদ্ররাম। ধ্যানমগ্ন অবস্থাতেই দর্শন পেলেন, তাঁর। কৃষ্ণবর্ণ, অনুপম রূপবান বংশীধারী অনুরোধ করলেন একটি মন্দির স্থাপনের জন্য। কিন্তু কোথায় গড়ে উঠবে এই মন্দির? কেন, যেখানে ধ্যানে বসেছেন রুদ্ররাম। কালে কালে ঐ অঞ্চলই তো খ্যাত হবে বল্লভপুর নামে। শুধু মন্দির স্থাপন করলে হবে না, নির্দেশ এল, মন্দিরের অধিষ্ঠাতা দেবতার মূর্তি তৈরী করতে হবে, এক বিশেষ কষ্টিপাথর দিয়ে। আর সেই কষ্টিপাথর আনতে হবে,সুদূর গৌড় নগরী হতে। জনৈক যবন শাসকের অট্টালিকার সিংহদুয়ারের মাথা থেকে খুলে। গৌড় তখন সুলতানী বাংলার রাজধানী, এতো রীতিমত বাঘের গলায় ঘন্টা বাঁধার কাজ- 


তবুও রওণা দিলেন রুদ্ররাম, সম্বল বলতে শ্রীধরের প্রতি অকৃত্রিম বিশ্বাস আর অগাধ প্রেম। গৌড় নগরী  পৌঁছে অবিশ্বাস্য ভাবে আলাপ হল, ঐ শাসকের প্রধান অমাত্যের সাথে। যিনি আবার ধর্মে ছিলেন হিন্দু।  রাধামাধবের নির্দেশ অমান্য করার ক্ষমতা তাঁরও ছিল না।  বাকি গল্পের ওপর পড়েছে ইতিহাসের ধুলো।  কিভাবে যে কয়েকমণ ওজনের কষ্টি পাথর খোলা হল, সিংহদুয়ার থেকে, আর কিভাবে যে তা এসে পৌঁছাল সুদূর দক্ষিণবঙ্গের এক অনামা ঘাটে তা সম্পূর্ণ রহস্যাবৃত। শোনা যায় গঙ্গা নদী স্বয়ং ভাসিয়ে আনেন প্রস্তরখণ্ড খানি। বল্লভপুর ঘাটে এসে আটকে যায় পাথর। অতঃপর ঐ পাথর থেকে তৈরী করা হয় রাধাবল্লভের মূর্তি।  গড়ে ওঠে আটচালা মন্দির।  

অতঃপর কেটে যায় আরো এক শতক। হিন্দুস্তানে এসে পৌঁছয় শ্বেতাঙ্গ বণিকের দল। প্রথমে দক্ষিণ, পরে পশ্চিম হয়ে, পূব উপকুলেও এসে পৌঁছয় পালতোলা জাহাজের সারি। গঙ্গার খাত বরাবর কেউ আস্তানা গড়ে তোলে কলিকাতায়, কেউ বা চন্দননগরে, কেউ আবার চুঁচুড়া বা শ্রীরামপুরে। গড়ে ওঠে বিভিন্ন দেশীয় ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী। মৃত্যুর অব্যবহিত পূর্বে, ড্যানিশ ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানিকে বাংলায় বাণিজ্য করার অনুমোদন তথা ফরমান দিয়ে যান নবাব আলিবর্দী খাঁ। সন ১৭৫৫। অচীরেই শ্রীরামপুরে গড়ে ওঠে ড্যানিশ উপনিবেশ। আসে ক্রিশ্চান মিশনারির দল। 


ইতিমধ্যে ঘটে গেছে অনেককিছু, বিপজ্জনক ভাবে এগিয়ে আসা গঙ্গানদী এবং যবন স্পর্শ বাঁচিয়ে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে রাধাবল্লভকে। 

পরিত্যক্ত মন্দির সংলগ্ন অঞ্চল দখল করে গড়ে উঠেছে এক অনুপম বাংলো প্যাটার্নের বাড়ি। যার পোশাকী নাম অলড্রিন(নাকি অলডিন) হাউস। ১৮০৩ সালে কলকাতার ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের প্রোভস্ট রেভারেণ্ড ডেভিড ব্রাউন কিনে কেন মন্দির সংলগ্ন এই বিশাল চত্বর। বছর তিনেক পর, শ্রীরামপুরে এসে উপস্থিত হন, হেনরী মার্টিন নামক জনৈক ধর্মযাজক। তিনি হ্যামলেটের দেশের বাসিন্দা নন। জাতে আগমার্কা বৃটিশ। শ্রীরামপুরে পৌঁছে স্বদেশীয় ব্রাউন সাহেবের কাছে প্রার্থনা করলেন আশ্রয়। বাংলোর নিকটবর্তী পোড়ো মন্দিরে ঠাঁই হল তাঁর। পরিত্যক্ত মন্দিরটিকে প্যাগোডা বলে পরিচয় করানো হয় ওণার সাথে। রাতের অন্ধকারে, নদীর তীরে নির্জন প্যগোডায় থাকতে প্রথম দিকে বেশ ভয়ই পেয়েছিলেন মার্টিন, ওণার ভাষায়, “ My habitation assigned to me by Mr. B, is a pagoda in his grounds, on the edge of the river. Thither i retired at night and really felt something like superstitious dread, at being in a place once inhabited as it were by devils.” ডেভিল অর্থাৎ রাধামাধব। ধীরে ধীরে এই প্যাগোডাতেই গড়ে ওঠে ওণার পাকাপাকি আস্তানা। নিয়ে আসেন অর্গান।  জমায়েত হতে থাকেন অন্যান্য মিশনারীরা। লোকশ্রুতি যে ভারতবর্ষের প্রথম ধর্মান্তর এখানেই সংঘটিত হয়। খ্রীষ্ট ধর্মমতে বিবাহও সংঘটিত হয়েছে এই প্যাগোডায়। 


তারপর যা হয়, আবার ছড়ি ঘোরায় ইতিহাস। কানপুরের উদ্দেশ্য রওণা দেন হেনরী মার্টিন।  ১৮১২ সালে মারা যান ব্রাউন সাহেবও। পুনরায় পরিত্যক্ত হয়ে পড়ে অলডিন হাউস এবং হেনরী মার্টিনের প্যাগোডা। ১৮৪৫সাল নাগাদ এই মন্দির থেকে রূপান্তরিত চার্চটিতে গড়ে ওঠে মদের কারখানা। যার পোশাকী নাম ছিল প্যাগোডা রাম ডিসটিলারি। ১৮৯৩এ আবার ভোল বদল, এবার সমগ্র চত্বর দখল করে হাওড়া ওয়াটার ওয়ার্কস্। গড়ে ওঠে বিশাল বিশাল জলাধার। ভূতের বাড়ি হয়ে পড়ে থাকে অলডিন হাউস আর হেনরী মার্টিনের সাধের প্যাগোডা।

হাওড়া ওয়াটার ওয়ার্কসের জলাধারের পাশ দিয়ে, এবড়োখেবড়ো মেঠো রাস্তা দিয়ে জঙ্গলের ভিতর ঢুকে দর্শন মেলে এই জনহীন প্যাগোডার। বড় মনোরম পরিবেশ। শুধু যদি যান, একটু সচেতন থাকবেন, কিছুদিন আগেই একটি চন্দ্রবোড়া সাপের হদিশ পাওয়া গিয়েছিল এই তল্লাটে। তিনি আপাততঃ বনদপ্তরের অতিথি, তবে তাঁর আত্মীয়স্বজন- পাড়াপ্রতিবেশী তো থাকতেই পারে।  ©অনিশৌভিক


             একনজরে অলডিন হাউস, শ্রীরামপুর

অলডিন হাউস, শ্রীরামপুর। যাবার পথ এবং প্রহরীবৃন্দ

               হেনরি মার্টিনের প্যাগোডা

     হেনরি মার্টিনের প্যাগোডা থেকে উল্টো দিকে গান্ধী ঘাট

                     অলডিন হাউস, ক্লোজ আপ

Thursday 1 October 2020

দাদু আর তুত্তুরীর বৈঠকী গপ্প

 


“দাদু একটা গল্প বলো না।” “রোজ রোজ কি আর গল্প বানাব বলো তো? আচ্ছা আজ তোমাকে শম্ভু দার গল্প শোনাই। শম্ভু মিত্তির।”


“শম্ভু মিত্র? যিনি নাটক -”।


 না না এ অন্য শম্ভু মিত্তির। তাহলে গোড়া থেকে বলি শোন। শম্ভুদার বাবা ছিলেন বৃটিশ আমলে পুলিশের বেশ বড় অফিসার। শম্ভুদারা তিন ভাই। বড় দুভাই পড়াশোনা শিখে বড় চাকরী পেলেও, শম্ভুদার আর লেখাপড়া করা হয়ে উঠল না। শম্ভুদার মাথায় ঢুকল বিপ্লব-”।  “চ্যাটার্জী?” “ধ্যাৎ। এমন ফাজলামি মারলে কিন্তু আর গল্প বলব না। বিপ্লব মানে বিপ্লব। রেভোল্যুশন। দেশ সমাজ বদলে দেবার স্বপ্ন।”


“অ। তারপর?” “ তারপর আর কি? তারপর ঘোষিত হল নির্বাচন। পার্টি দাঁড়িয়ে গেল ভোটে-। বিপ্লব আর হল না। মাঝখান থেকে শম্ভুদাই পড়ে রইল অর্ধশিক্ষিত বেকার ভবঘুরে হয়ে। তখন শম্ভুদার দাদারা করল কি, একে তাকে ধরে, শম্ভুদাকে হোম-পলিটিক্যাল দপ্তরে একটা ড্রাইভারের চাকরী জুটিয়ে দিল। দিনে ড্রাইভারী করত- যাকেই দেখত, বাঁ হাত মুঠো করে বলত লাল সেলাম।  আর ডিউটি শেষ হলে এক পেট মদ গিলে বাড়ি ফিরত। "


“মদ খেত? এ বাবা। ” “হ্যাঁ।  তারপর শোনোই না। আমাদের সাথে যখন শম্ভুদার প্রথম দেখা, তখন আমরা ইছাপুরে একটা নাইটস্কুল চালাতাম। কোথা থেকে যেন শম্ভুদা জেনেছিল, আমার রাজনৈতিক পরিচয়-” 


“রাজনৈতিক পরিচয় মানে কি, দাদু?” “মানে আমি কোন মন্ত্রে দীক্ষিত-”। “ তোমার দীক্ষা হয়েছিল নাকি? তোমার গুরু কে দাদু?” 

“আমার কি আর একটা গুরু তুত্তুরী। আমার পাঁচ পাঁচখানা গুরু। তাদের নাম শুনতে চাও- মহান লেনিন,---”।  “নাঃ থাক। পরে শুনব। গল্পটা বল।”  


“ মোদ্দা কথা আমায় ভীষণ স্নেহ করত শম্ভুদা।  শম্ভুদার ছেলের নাম ছিল করালী। তাকে আমাদের নাইট স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিয়েছিল শম্ভুদা। স্কুল শেষে আমরা যখন বড়কর্তার চায়ের দোকানে আড্ডা জমাতাম, টলতে টলতে বাড়ি ফিরত শম্ভুদা। এক পেট মদ খেয়েও বসে পড়ত,আমাদের সাথে এক ভাঁড় চা খাবে বলে। এই চাটা আমাকেই খাওয়াতে হত, এটাই ছিল শম্ভুদার আব্দার। যেদিন শম্ভুদা এসে শুনত, যে করালী ক্লাশ করতে আসেনি, সেদিন কিন্তু আর চা খেত না। টলতে টলতে চলে যেত সোজা বাড়ি। শম্ভুদার খুব দুঃখ ছিল, লেখাপড়াটা করেনি বলে, প্রায়ই বলত, 'আমার ছেলেটাকে একটু লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষ বানিয়ে দিও তোমরা",  করালী নাইট ইস্কুলে আসেনি শুনলেই,তাই বাড়ি গিয়ে কি করত জান? সমস্ত জামাকাপড় খুলে ফেলে, খাটের তলা থেকে একটা মস্ত কাতান বার করে তাড়া করত ছেলেটাকে- আর চিৎকার করত, ‘কালীর বাচ্ছাটাকে আজ কেটেই ফেলব। ’ শম্ভুদার মায়ের হাউমাউ চিৎকারে কতবার আমরা দৌড়ে গেছি করালীকে বাঁচাতে তার ইয়ত্তা নেই। ”


“ হা-হা-হো- হো। কি বললে দাদু, নেন্টু হয়ে কাতান নিয়ে তাড়া করত-। আচ্ছা কালীর বাচ্ছা বলত কেন? ওটা তো শম্ভুর বাচ্ছা-”। 


“সেই খানেই তো মজা। তাহলে তোমাকে শম্ভুদার বিয়ের গল্প শোনাতে হয়। তখন আমাদের এই নতুনরাস্তা- ইছাপুর-সৌম্যচণ্ডীতলা এই সব জায়গা ধুধু করছে ফাঁকা জলাভূমি। এই জলাভূমির মাঝেই ছিল ভটকার জঙ্গল। প্রায় ৭৫বিঘে ঘন জঙ্গল। রাত নামলে তো কথাই নেই, দিনের বেলাও লোকে ঐ জঙ্গলটা এড়িয়ে যেত।  লোকে বলত ঐ জঙ্গলে পেত্নী থাকে। শম্ভুদা একপেট মদ খেয়ে রাতের বেলা ঐ জঙ্গলে ঘুরে বেড়াত। কেউ জিগ্যেস করলে বলত, ‘পেত্নী খুঁজছি।  বে করব। পেত্নী ছাড়া আমায় আর কে বিয়ে করবে?’ 


একদিন হয়েছে কি, একটি মেয়ে মনের দুঃখে ঐ জঙ্গলে এসেছে গলায় দড়ি দেবে বলে। প্রগাঢ় আঁধারে, হঠাৎ বাবলা গাছের তলায় দুজনের দেখা। মাতাল শম্ভু ভাবল এই তো এট্টা পেত্নী পেয়েছি। সোজা মেয়েটাকে কাঁধে ফেলে দৌড়। পরদিন সকালে মায়ের বেনারসী পরিয়ে পাঠশালার মোড়ের মন্দিরে গিয়ে বিয়ে- বিয়ের পর বৌদির একটা ভালো নাম দেয় শম্ভুদা, তবে বিয়ের আগের নাম ছিল কালী। মদ খেলেই শম্ভুদা বৌকে কালী বলে সম্বোধন করত- আর চিৎকার করত, কালীর বাচ্ছাটাকে আজ কেটেই ফেলব”। 



“কি বাজে লোক।” আরে না না মোটেই বাজে লোক নয়। খুব রঙীন লোক। শম্ভুদার যে এমন কত মজার মজার গল্প আছে-” । 


“দাদু জানো তো মদ খাওয়া মোটেই ভালো নয়। প্রথম প্রথম খেতে ভালোই লাগে। তারপর একদিন লিভারে পচন ধরে। তারপর একদিন মানুষ চোখ খুলে দেখে সে হাওয়ায় ভাসছে আর পিছনে একটা ভয়ানক দর্শন যমদূত দাঁড়িয়ে আছে।  তার হাতে একটা ইয়া বড় ত্রিশূল। পক করে পিছনে খোঁচা মারে আর বলে, ‘এই মদ খাবি?’ লোকটা তো লোভে লোভে বলে, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ। খাব। খাব’ অমনি কাঁটা চামচ দিয়ে চিলি ফিশ গাঁথার মত ত্রিশূল দিয়ে লোকটাকে গেঁথে ফুটন্ত তেলের কড়ায় চোবায় আর বলে,‘ খা।  খা।  আরো খাবি? আরো খাবি?’ আবার কখনও কখনও বলে, ‘এই পেন্টুল খোল’ লোকগুলো তখন ভয়ে ভয়ে বলে, ‘কেন যমদূত জী?’  আর যমদূত বলে, “জ্বলন্ত উনুনের ওপর বসতে হবে না?’ মরার পর তো আর কেউ মরতে পারে না দাদু।”