Thursday 29 April 2021

কোভিড কথা

 কোভিড কথা - ২৯শে এপ্রিল, ২০২১


১। বাতাসের শতকরা ২১ ভাগই হল অক্সিজেন। এমনিতে একজন সুস্থ মানুষ এই ২১ শতাংশ অক্সিজেন নিয়ে দিব্য থাকতে পারে, কিন্তু কোভিডে ধরলে বা শ্বাসকষ্ট শুরু হলে তা মোটেই যথেষ্ট নয়। তখন প্রয়োজন শতকরা ৯৮ ভাগ বিশুদ্ধ অক্সিজেন। যা পাওয়া যায় অক্সিজেন সিলিন্ডার থেকে এবং বর্তমানে যার তীব্র আকাল সমগ্র দেশ জুড়ে। 


২। জানেন কি, আমাদের দেশে অক্সিজেনের আদতে কোন ঘাটতি নেই? যেখানে এই পরিস্থিতিতেও দেশের মোট চাহিদা দৈনিক ৭০০০ মেট্রিকটন মাত্র, ভারতের  উৎপাদন ক্ষমতা ৭৮০০ মেট্রিকটন। বর্তমান পরিস্থিতিতে ভারত সরকার যা বাড়িয়ে করেছেন ৯০০০ মেট্রিকটন। 


২। আমাদের সমস্যা উৎপাদন নয়, সমস্যা হল পরিবহন। অক্সিজেন গ্যাসকে তো আর এমনি পরিবহন করা যায় না।  -১৮৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের তরল অক্সিজেন পরিবহন করতে প্রয়োজন বিশেষ ধরণের ট্যাঙ্কার, যাদের বলে ক্রাইওজোনিক ট্যাঙ্কার। 


৩। কি ভাবছেন এই ক্রাইওজেনিক ট্যাঙ্কার আমাদের নেই? নাঃ মশাই,দিব্যি আছে। কিন্তু যখন আচমকা ফিরে এল মহামারী, দেখা গেল সংখ্যা অপ্রতুল হলেও আছে তো, কিন্তু ছড়িয়ে আছে দেশ জুড়ে। 


৪। ভারতে অক্সিজেন মূলতঃ তৈরী হয় রাউড়কেল্লা, দুর্গাপুর, ভাইজাগ ইত্যাদি স্টিল প্ল্যান্ট গুলিতে। খালি ট্যাঙ্কার গুলিকে এই প্ল্যান্টে পৌছানো  এবং ভর্তি ট্যাঙ্কার নিয়ে যাওয়ার জন্য আপাততঃ কোমর বেঁধে নেমেছে ভারতীয় বিমানবাহিনী এবং ভারতীয় রেল।  


৫। বায়ুসেনার সবথেকে বড় যুদ্ধ বিমান সি-১৭ গ্লোব মাস্টারে ভর্তি করে আনা হচ্ছে খালি ট্যাঙ্কার, আবার ভর্তি ট্যাঙ্কার নিয়ে দৌড়চ্ছে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে।  


৬। তেমনি একসাথে অনেকগুলি খালি বা ভর্তি ট্যাঙ্কার বহনের জন্য ভারতীয় রেল চালু করেছে RO-RO Train Service। সোজা কথায় Roll-on/roll-off। শয়ে শয়ে ট্যাঙ্কার একলপ্তে পরিবাহিত হচ্ছে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে।  


৭। এছাড়াও সিঙ্গাপুর থেকে বেশ কিছু ক্রায়োজেনিক ট্যাঙ্কার আমদানি করেছে ভারত। বেশ কিছু ট্যাঙ্কার আনিয়েছে টাটাও।  


৮। পাশে দাঁড়িয়েছে ভারতীয় সেনাবাহিনী।ভারতীয় সেনাদের জন্য  DRDOর বানানো বিশেষ ভাবে তৈরী অক্সিজেন সিলিণ্ডারও দেওয়া হচ্ছে নানা হাসপাতালে।  


৯। জার্মানি থেকে ২৫ খানা পোর্টেবল অক্সিজেন জেনারেশন প্ল্যান্ট কিনেছে ভারত। যা ঝটপট বাতাস থেকে নিঙড়ে নেবে বিশুদ্ধ অক্সিজেন।  


১০। পরিস্থিতি বদলাচ্ছে। তবে রাতারাতি তো আর বদলাবে না। বদলাতে লাগবে সময়। বিশেষজ্ঞরা ইতিমধ্যেই বারংবার বলে চলেছেন আগামী ১৫-২০শে মে’র মধ্যে শীর্ষে পৌছাবে করোণার দ্বিতীয় ঢেউ। যখন দৈনিক সংক্রমণের মাত্রা ছোঁবে ৫ থেকে ১০ লাখ। প্রত্যহ মারা যাবেন পাঁচ থেকে দশ হাজার মানুষ। তাই এই মুহূর্তে সবথেকে জরুরী যেটা, সেটা হল সাবধানে থাকুন। নিয়ম মেনে চলুন। মাত্র কটা দিন। চায়ের ঠেকের মাতব্বররা যাই বলুক না কেন, সরকার সচেতন হয়েছে, লোহার বাসরঘরের ফুটোও মেরামত করার আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে। পরিস্থিতি বদলাবেই।  আপাততঃ যেটা করবেন- 

ক) মাস্ক, স্যানিটাইজার, দূরত্ববিধি ছাড়াও রোজ জিঙ্কওয়ালা একটা ভিটামিন খান নিয়ম করে। 

খ) খান ভিটামিন সি।  

গ) মাপতে থাকুন অক্সিজেন। অক্সিজেনের মাত্রা ৯৫ এর সামান্য নীচে নামলেই অক্সিজেন খুঁজতে বেরোবেন না। প্রুনিং পোজিশনে শুয়ে পড়ুন। জানেন তো আমাদের দুই ফুসফুসেরই কিছুটা অংশ বিশেষতঃ মাঝের অংশটুকু সাধারণ ভাবে অব্যবহৃত থেকে যায়।  এমতবস্থায় যদি বুকের নীচে দুটো বালিশ রেখে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়েন, ফুসফুসে যে চাপ পড়ে, তাতে চলতে শুরু করে ঐ অংশটুকুও। সকাল বিকাল আধঘন্টা করে অমন শুয়ে থাকুন। মাঝে মাঝে পাশ ফিরে শোন।  তবে দুটো হাতই যেন একদিকে থাকে। তারপর পীঠে বালিশ ঠেস দিয়ে কিছুক্ষণ বসুন। এতেই কাজ হবে।


সবশেষে বলি আবারও সাবধানে থাকুন, অযথা আতঙ্কিত হবেন না। ভরসা রাখুন। এই অন্ধকারেও আমরা একা নই। বন্ধুরা আছেন। রাশিয়া যেমন কথা দিয়েছে প্রতি সপ্তাহে ৪ লক্ষ করে রেমডেসিভার পাঠাবে। পাঠাবে অক্সিজেন। ক্রায়োজেনিক ট্যাঙ্কার। এমনকি পাশে দাঁড়িয়েছে পাকিস্তানও। 


ভিরাফিনের গল্প শুনেছেন তো? আমাদের নিজেদের তৈরী ওষুধ, বানায় আমাদের ঘরের কোম্পানি Zydus Cadila। ভিরাফিন কিন্তু অনেক দিন ধরেই বাজারে চলে, হেপাটাইটিস-বি এর ওষুধ হিসেবে। ভিরাফিন যেটা করে তা হল আমাদের শরীরে ইন্টারফেরন আলফা নামক কোষের সংখ্যা বাড়িয়ে দেয়। যারা মুখোমুখি যুদ্ধ করে শরীরে অনুপ্রবেশকারী যে কোন অবাঞ্ছিত অতিথির সাথে। হেপাটাইটিস বি ভাইরাসও  RNA ভাইরাস আর কোভিডও তাই।  পরীক্ষা করে দেখা গেছে মাত্র সাতদিনে কোভিডকে ঠেঙিয়ে বের করে দেয় এই ওষুধ। রাতারাতি ভারত সরকার অনুমতি দিয়েছে ভিরাফিন ব্যবহারের, তবে শুধু মাত্র হাসপাতাল গুলিতে।  


যাই হোক মোদ্দা কথা আবার বলি- সাবধানে থাকুন। অন্তত ২০শে মে অবধি টিকে থাকুন।  তারপর পরিস্থিতি বদলাবেই।  আমি ভয়ানক আশাবাদী।  


কোভিড কথা- ৩০শে এপ্রিল, ২০২১


আজকের পরিসংখ্যান দেখেছেন নাকি? সরকারি বুলেটিন অনুযায়ী গত ২৪ ঘন্টায় রাজ্যে নতুন করোনা আক্রান্ত ১৭,৪১১, মোট নমুনা পরীক্ষার(৫৩,২৪৮) প্রায় ৩২.৬৯% । মৃত ৯৬ জন।


সারা ভারতের আজকের পরিসংখ্যান এখনও সম্পূর্ণ নয়, কিন্তু গতকালই আক্রান্ত হয়েছিলেন ৩ লক্ষ ৮৬ হাজার মানুষ। মৃত সাড়ে তিন হাজার। বিগত বেশ কিছুদিন ধরে এই পরিসংখ্যান খুব মনোযোগ দিয়ে দেখছি আমি, দেখাচ্ছি আমার টিমকে। কারণ যাই হোক, আপিসটা তো করতে হবে-। আবার পিতৃদত্ত প্রাণটাও বাঁচাতে হবে।  তো যা বলছিলাম, নিয়মিত পরিসংখ্যান পর্যবেক্ষণ করলে যেটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখা দেয় তা হল, প্রতিনিয়ত যে সংখ্যক মানুষ খাতায়কলমে আক্রান্ত হচ্ছেন, মারা যাচ্ছেন তার শতকরা ১ ভাগ মানুষ। 


এমতবস্থায় আজকে আত্মপ্রকাশ করা মাননীয় মূখ্য সচীবের যে অর্ডারটিকে (618-ISS/2M-22/2020 dated 30th April, 2021) ঘিরে এত বিতর্ক, এত বিশেষ ভাবে অজ্ঞ মতামতের আদানপ্রদান চলছে, সেটা যদি একটু কষ্ট করে পড়ে দেখেন, তাতে কোথাও 'আংশিক লকডাউন' শব্দবন্ধটি ব্যবহারই করা হয়নি। 


এতে বলা হয়েছে যে বিগত ২৫ এবং ২৯ তারিখে প্রকাশিত ভারত সরকারের স্বাস্থ্য এবং পরিবার কল্যাণ দপ্তরের দুটি নির্দেশনামা অনুসারে এবং বিপর্যয় মোকাবিলা আইনের ২২ নং ধারা অনুসারে-


'১। সমস্ত শপিং কমপ্লেক্স, মল, বিউটি পার্লার, সিনেমা হল,  জিম, সুইমিং পুল, স্পা, রেস্তোরাঁ, বার সব অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ থাকবে।  কিন্তু হোম ডেলিভারি এবং যাবতীয় অনলাইন সার্ভিস খোলা থাকবে।'


অর্থাৎ রেস্তোরাঁ বন্ধ বলে যারা হাহুতাশ বা মুণ্ডপাত করছিলেন, তা কিন্তু যথার্থ নয়। গিয়ে বসে খেতে পারবেন না বটে, সুইগি, জ্যোমাটো কিন্তু এনে দিতেই পারে। মল বন্ধ বটে কিন্তু চলতেই পারে অ্যামজন, মিন্ত্রা বা নাইকাতে শপিং।  


'২।যাবতীয় সাংস্কৃতিক, সামাজিক, শিক্ষামূলক বা বিনোদনমূলক জমায়েত নিষিদ্ধ। '


এখন এই নিয়ে যদি আপনার মটকা গরম হয়, তো দাদা/দিদি আইসব্যাগ কিনে নিন না একটা।


 

'৩। বাজার/হাট খোলা থাকবে  সকাল ৭-১০টা আর বিকাল  ৩-৫টা।  কিন্তু যাবতীয় মুদির দোকান, ওষুধের দোকান বা মেডিক্যাল ইকুইমেন্টের দোকান ইত্যাদি আপদকালীন পরিষেবা মূলক দোকানগুলি এই নিয়মের মধ্যে পরে না। '


আর বলা হয়েছে যে 'কাউন্টিং হল বা বিজয়ীদের মিটিং, মিছিল , রালি ইত্যাদি কেবল মাত্র নির্বাচন কমিশনের ২৭ শে এপ্রিলের নির্দেশ নামা মেনেই হবে। বলা হয়েছে কেউ যদি এই নির্দেশনামা উলঙ্ঘন করেন তবে বিপর্যয় মেকাবিলা আইন এবং আইপিসি অনুসারে তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।'  


মোটামুটি আক্ষরিক তর্জমা করে দিলাম, অর্ডার নম্বরটিও দিলাম, পারলে একবার আসল অর্ডারটি পড়ে নিন। ভুলত্রুটি হয়ে থাকলে নিজগুণে মার্জনা করবেন। 


এখন আপনি প্রশ্ন করতেই পারেন এই নির্দেশনামা কবে থেকে বলবৎ হবে? উত্তর হল আজ থেকেই। পড়তে গেলেই দেখতে পাবেন লেখাই আছে, ‘This order will take immediate effect’।  কতদিন পর্যন্ত? যতদিন না পরবর্তী নির্দেশনামা বেরোচ্ছে।  ততদিন পর্যন্ত সাবধানে থাকুন, নিয়ম মেনে চলুন, মাস্ক পরুন, হাত সাফ রাখুন, ভিটামিন খান, অক্সিজেন মাপুন আর প্লিজ প্লিজ উল্টোপাল্টা গুজব ছড়াবেন না বা তাতে কান দেবেন না। কেমন?

 অনির ডাইরি ২৭শে এপ্রিল, ২০২১


একসাথে দল বেঁধে সাঁতার কাটত হাঁসগুলো। নালার দৈর্ঘ্য বরাবর গাঁয়ের এমুড়ো থেকে ও মুড়ো অবধি সাঁতরে যেত আবার ফিরে আসত। 'ঠিক সন্ধ্যে নামার মুখে, তোমার নাম ধরে কেউ ডাকে', দাওয়া থেকে হাঁক পাড়ত দিদা, ‘ আয়- আয়- আয়- চৈ-চৈ-চৈ’। কি ভাবে বুঝত কে জানে, হাঁক শুনলেই, ঠিক দিদার হাঁসগুলো দলচ্যুত হয়ে উঠে আসত পাড়ে। তারপর পশ্চাদ্দেশ বেমক্কা উঁচু করে, উন্নাসিক সুন্দরীদের মত গিয়ে সেঁদিয়ে যেত আপন বাসায়। শেষ হাঁসটা ঢুকে পড়লেই ঝাঁপ ফেলে দিত দিদা। ঝাঁপের ওপর লেখা ছিল, ‘হাঁসেদের বোটেকখানা’-সৌজন্য সেজদা। প্রসঙ্গতঃ বোটেকখানা হল আপনাদের বৈঠকখানা। 


বছরে একবারই যেতাম দিদার বাড়ি। সারা বছর তীর্থের কাকের মত পথের দিকে তাকিয়ে বসে থাকত দিদা। অপেক্ষা করত শেষ বাসের জন্য। যদি কেউ নামে। শেষ বাস চলে গেলে অপেক্ষা করত পোস্টম্যানের জন্য। যদি আসে কারো চিঠি- দাদপুরের স্বর্গীয় শিক্ষক মনোরঞ্জন দাশের কন্যা স্বর্গীয়া সুনীতি রাণী ঘোষের মনের জোর ছিল সাংঘাতিক। 


বড় দূরে থাকত দিদা। সেই উত্তরবঙ্গের সীমান্ত ঘেঁষা অজগ্রাম রামনগর। যাবার হ্যাপা কি কম? বেশ কদিনের ছুটি ছাড়া যাওয়া যায় নাকি? কাশ আর শিউলি ফুটলে তবে না যাব দিদার বাড়ি। কাক না ডাকা ভোরে ঘুম থেকে তুলে রেডি করে দিত মা। বোঁচকাবুঁচকি নিয়ে আমরা যখন বেরোতাম তখন রাতপাহারা শেষে ঘুমের তোরজোর করত পাড়ার নেড়িরা। 


সৎসঙ্গের সামনে থেকে মিনিট তিনেক হেঁটে গলির মোড়। মোড়ের মাথায় তখনও ঝাঁপ বন্ধ সারি সারি দোকান। বরাবরের দিলখোলা বেহিসেবী বাবা, আর কিঞ্চিৎ  বুঝে চলা ঘোর সংসারী মায়ের ছুটকো দাম্পত্য কলহের ফাঁকে চাতক পাখির মত চেয়ে থাকা, হে ভগবান, হে মা দুগ্গা, হে শিবঠাকুর একটা ফাঁকা ট্যাক্সি পাঠিয়ে দাও- 


ট্যাক্সির ফালতু খরচ ভাঁজ ফেলত মায়ের প্লাক না করা ভ্রু যুগলে। বাবার মুখের দরাজ হাসি দেখে বেশ বুঝতে পারতাম, ‘আজি প্রাতে সূর্য ওঠা, সফল হল কার ’। নিজের শহরকে ছেড়ে যাবার যাবতীয় বিষাদকে জানলা দিয়ে উড়িয়ে হলদে ট্যাক্সি দৌড়ত হাওড়া ব্রীজের পেট চিরে। মহাত্মা গান্ধী রোড তখন প্রথম আলোয় সদ্যস্নাত। কলেজ স্ট্রিটের মুখে ডাঁই করে রাখা সবুজ ডাবের পাহাড়, মেহবুব ব্যাণ্ডের বন্ধ দোকান ছাড়িয়ে শিয়ালদা। সকাল আটটার লালগোলা প্যাসেঞ্জার। কুলিকে টাকা দিয়ে চলন্ত ট্রেনে সিট রাখত বাবা। জানলার ধারের সিট। রাণাঘাট অবধি ডিজেল ইঞ্জিন, রাণাঘাট থেকে কয়লা। নাকি উল্টোটা? আজ আর মনে আছে থোড়াই। শুধু এটুকু মনে আছে কয়লার ইঞ্জিন হলে হাওয়ার দিকে বসলে চোখে এসে পড়ত কুটো।  


প্রথম দিকে রান্না করে নিয়ে যেত মা। অ্যালুমিনিয়ামের টিফিন কৌটো ভরে লুচি তরকারী আর সুজি। কেউ ছুঁতাম না আমরা। ট্রেনে উঠে ঘরের খাবার খাব ক্যান। নৈহাটির ঝালমুড়ি দিয়ে শুরু হত মুখচলা। ঠোঙা ভর্তি কুন্দ ফুলের মত মুড়ি, মাখামাখি ঝাঁঝালো সর্ষের তেল, পেঁয়াজ কুচি, মুড়ি মশলা আর লাল বাদামে। সবার ওপর কাস্তের মত একখানি নারকেলের টুকরো। ঝাঁঝালো তেলের স্বাদে গন্ধে নাকের জলে মিশত চোখের জল।  উঠত কাঁচের বাক্স ভর্তি মিষ্টি। শালপাতার দোনায় কি ছানার রসালো মিষ্টির সোয়াদ বেড়ে যায়?  উঠত মিষ্টি ডালমুট। সুতো দিয়ে কাটা গরম সিদ্ধ ডিম। রাণাঘাটে ইঞ্জিন বদলাত, অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকত গাড়ি। প্লাটফর্মে বিক্রি হওয়া কচুরি, ঝোল ঝোল কুচো আলুর তরকারী আর ছানার জিলিপি কিনে আনত সেজোমাসি।


খেতে খেতে কখন যে এসে পড়ত দেবগ্রাম ইস্টিশন। আর দুটো ইস্টিশন পরেই নামতে হবে আমাদের।  মাঝে পড়বে পাগলাচণ্ডী নদী। নাকি নদ? ভিখারির মত হাত পেতে বসে থাকতাম যদি একটা পাঁচ বা দশ পয়সা দেয় বাবা। নিদেনপক্ষে যদি ২ পয়সাই দেয়,  ছুঁড়ে ফেলব নীচে নদীর বুকে। ছোট মেসো একবার পঁচিশ পয়সা দিয়েছিল, কি বকেছিল মা সেবার। আর একবার মাকে লুকিয়ে পাক্কা একটি টাকা গছিয়েছিল ছোট মেসো, সেদিনের ফূর্তির কথা ভেবে আজও লিখতে লিখতে হাসির ঢেউ খেলে যাচ্ছে আধবুড়ো ওষ্ঠাধরে।  যাই বলুন শৈশব বড় দামাল, বড় বাচাল, বড় বেশী বেহিসেবী। তাই বুঝি শৈশব এমন মূল্যবান। হারিয়েও হারায় না।  


শৈশব যে সত্যিই হারায় না, বারবার ফিরে ফিরে আসে, তা আমার বৃদ্ধ বাবা-মা-পিসি-শ্বশুর আর শাশুড়িমাতাকে নিয়ে হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। বাপস্!পাঁচ-পাঁচটা ধেড়ে খোকাখুকুকে সামলাতে রীতিমত নাকের জলে চোখের জলে তুত্তুরীর বাবা-মা। তাও আমাদের দাবী অতি সামান্য, দয়া করে ভ্যাকসিনটি নিয়ে আমাদের ধন্য করো। 


যখনই ভ্যাকসিন নেবার দিন ঠিক হয়, কোথা থেকে যে সমস্যা পেড়ে আনে এরা। ওদিক থেকে বাবা হুঙ্কার ছাড়ে, ‘আমাদের ওপর কিছু চাপিয়ে দেবে না’। তো এদিকে শ্বশুরমশাই বাঁধান জ্বর। তা হ্যাঁ বাবা, যতবার ভ্যাকসিন দিতে নিয়ে যাব বলব, ততোবার জ্বর বাঁধাবেন আপনি। ওঃ থুড়ি, আজকাল আপনি বললে হেব্বি রেগে যাচ্ছে বৃদ্ধ। বারো বছরের অভ্যেস রাতারাতি বদলে আমায় কইতে হবে তুমি। যতই বলি, ওরে বাবা, আমি সাবেকী বাড়ির মেয়ে, ঠাকুমার কাছে মানুষ,স্বভাব চরিত্রে যতই উগ্র নারীবাদী হই না কেন, মানুষটা বেশ সেকেলে। সময় তো দিতে হবে। রাতারাতি কাউকে আপনি থেকে তুমি আর তুমি থেকে তুই বলতে পারি না আমি। উমা তো সেই কবে থেকে ভয় দেখাচ্ছে, 'আমাকে তুই বলবে কি না,বলো।' তাকেই পারি না। এই তুই কই,তো এই তুমি।  


শেষ পর্যন্ত অবশ্যি শ্বশুরমশাইকে ছাড়াই বাকিদের ছুঁচ ফুটিয়ে আনলাম আমরা। যথারীতি ভ্যাকসিন নেবার দিন সকাল থেকে জ্বরে শালিকপাখির মত চিচি করছিলেন শ্বশুরমশাই। দীনু খুড়োও বলল, ‘জিতেন দাকে তোরা এবার ছাড়। দেখ না মাস তিনেক পর,পাড়ার দোকানে বিক্রি হবে ভ্যাকসিন। তখন শঙ্কর এসে দিয়ে যাবে খন। ’ দা গ্রেট দীনু খুড়োর নির্দেশ শিরোধার্য। লোকটাকে যে বেজায় ভালোবাসি মাইরি- 


চার চারটে নড়বড়ে মানুষকে ভ্যাকসিন ফুটিয়ে গাড়িতে তুলে যার যার কুলায় ফিরিয়ে দিতে দিতে আর দ্বিতীয় ডোজটা নেওয়া হয়নি আমার। গোটা রাস্তা শাশুড়ী মা দুঃখ করতে করতে এলেন, ‘আমাদের সামলাতে গিয়ে তোমারই আর নেওয়া হল না। ’ বোঝাতে পারলাম না, বাবা মা হলে তো এমনিই হয়। তোমরাই তো শিখিয়েছ। 


আর যেটা ওণাকে বলতে পারিনি তা হল,আমার পরিবার যে আসলে বিরাট বড়। শুধু কি রক্ত আর বৈবাহিক সম্পর্কে আমি জননী? দপ্তরী সম্পর্কে নই? তাহলে আপিস মাস্টার মানে কি? নিছক প্রভু? কেবল প্রভুত্ব করব? ভালোবাসব না? 


প্রায় কান ধরে নিয়ে গিয়েছিলাম গোটা টিমকে ভ্যাকসিন দিতে। চুঁচুড়ার ইমামবাড়া হাসপাতালের এসিটেন্ট সুপারের কাছে আমাদের কৃতজ্ঞতার অন্ত নেই। নাঃ কোন ভিআইপি ট্রিটমেন্ট দেননি উনি আমাদের এযাত্রা। প্রথম ডোজের সময় দিতে পারলেও, এ যাত্রা দিতে অপারগ তা প্রথমেই জানাতে কসুর করেননি। আমরাও চাইনি, সকাল থেকে লাইন দিয়ে দাঁড়ানো অশীতিপর মানুষদের নাকের ডগা দিয়ে গটগট করে ভ্যাকসিন নিতে। তাই কতজন ভ্যাকসিন নেবো জানিয়ে, সুপার সাহেবের বেঁধে দেওয়া সময়ে দলবেঁধে হাজির হয়েছিলাম আমরা। তারপরও হয়তো বেশ খানিকক্ষণ বসতে হয়েছে, দাঁড়াতে হয়েছে। আমাদের সঞ্চিতা আর সায়নী টেনশন করেছে,যদি ভ্যাকসিন ফুরিয়ে যায়।  আমাদের ধীমান টেনশন করেছে যদি লোক বেশি বলে ওকে ফিরিয়ে দেয় ওরা। কৌশিক টেনশন করেছে যদি ভ্যাকসিন নেবার পরও করোণা হয়? বাদল, সোমনাথ আর আমি টেনশন করেছি যদি আবার খুব লাগে? 


সব টেনশন মিটিয়ে প্রায় সন্ধে ছটা নাগাদ ভ্যাকসিন নেওয়া আমরা। ফিরিঙ্গী ভাষায় আমার ফুল অফিস ভ্যাকসিনেটেড, ফুললি ভ্যাকসিনেটেড। এই ভাবেই চলুক না জীবন, কিছুটা শৈশব আর কিছুটা অভিভাবক হয়ে।



Thursday 22 April 2021

অনির ডাইরি ২২শে এপ্রিল, ২০২১

 

বেশ চিন্তিত ছিলেন শ্রীমতী তুত্তুরী। মা যেসব রাতে না ফিরতে পারে, মাসি অন্তত থাকে। কিন্তু এবারে যে মা আর মাসির নির্বাচন একই নির্ঘন্টে। কার কাছে থাকবে তুত্তুরী? এমনিতে মা আর মাসির সাথে যত খুনসুটি, বাবার সাথে ততোটাই সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক শ্রীমতী তুত্তুরীর। তাই বলে বাবা নামক ব্যক্তির সাথে একাকী দিনযাপন অসম্ভব। লোকটা কেমন যেন কলিযুগের হিটলার টাইপ। সবকিছু তার চলে নিখাদ নিয়ম মেনে। মাকে কাবু করতে না পারলেও, তু্ত্তুরীকে কেবলই নিয়মের বেড়াজালে বাঁধতে চায় বাবা। ‘দিনে তিন দান দাবা খেলবি, মিষ্টি খাবি না, দুঘন্টা গল্পের বই পড়বি আর আমার সাথে দেড় ঘন্টা ব্যায়াম করবি’- তুত্তুরীর জন্য এই হল বাবার ফরমান। সবথেকে বড় কথা- ‘অপ্রয়োজনে বেশী বকবক করবি না।’ হ্যাঁ বাবার সেবা করলে থুড়ি বাবাকে আমেজ করে দিলে যেমন ধরুন চুল ঘেঁটে দিলে, কান মুলে দিলে, হাতের বা পায়ের আঙুলগুলিকে টেনে লম্বা করে দিলে অবশ্য আনলিমিটেড বকবকানির অনুমতি মেলে, তবে তা ততক্ষণই স্থায়ী হয়, যতক্ষণ চলে আমেজ। 


এত ঝঞ্ঝাটের পর কেবল আধঘন্টা মোবাইল দেখার অনুমতি মেলে শ্রীমতী তুত্তুরীর। ভাগ্যে মাসির মোবাইলটা সারাদিন গড়াগড়ি যায় হেথায়-হোথায়। মাঝেমধ্যে মুখ বন্ধ রাখার শর্তে অবশ্য মোবাইল দেয় মাও। 


যাই হোক এখন প্রশ্ন হচ্ছে, মা এবং মাসির অনুপস্থিতিতে শ্রীমতী তুত্তুরী থাকবে কুথায়? নির্বাচনী নির্ঘণ্ট জারি হওয়ার সাথে সাথেই হাওড়া থেকে দাদু বলেছিল বটে, ‘ওকে এখানে রেখে যা’। কিন্তু নিজের দোষেই সেই সুযোগ হারাল তুত্তুরী। ভর সন্ধ্যে বেলা এমন হাঁউমাউ জুড়ল মাসি, ‘সোনা মা এটা কি?’ তুত্তুরী যতই বোঝায় ও কিছু নয়, নিছক  গুগল অ্যাসিস্টান্ট। তুত্তুরীকে সহায়তা করতে চায়, মাসি তো ভয়েই সারা। মোবাইল খুললেই কেবল অনামুখো গুগল বলে, ‘হ্যালো পুরোযা ভট্টাচার্য, আজ কি গান শুনবে? একটু অরিজিৎ সিং শুনে দেখবে নাকি? বা হাড্ডিগুডুম গাড্ডিগুডুম।’ যা না মা পড়তে পারে, না মাসি। উচ্চারণ করতে গিয়ে দাঁত কটকটিয়ে ওঠে। 


যাই হোক কথাটা মায়ের থেকে গিয়ে পৌঁছাল বাবার কানে। গম্ভীর মুখে মাসির মোবাইলটায় চোখ বুলিয়ে বজ্রগম্ভীর কণ্ঠে ফয়সালা শুনিয়ে দিল বাবা, ‘হাওড়া যাওয়া ক্যান্সেল। ’ একটা দুটো রাতেরই তো ব্যাপার, তুত্তুরী দিনের বেলা থাকবে ঠাম্মা-দাদুর বাড়ি, রাতে আপিস ফেরতা ফেরৎ আনবে বাবা। 


কাকিমা থাকলে এই প্রস্তাবে ধেই ধেই করে নাচত তুত্তুরী। কিন্তু কাকিমা যে সেই সুদূর দুর্গাপুরে।  ঠাম্মার সাথে অবশ্য ভালোই জমে, কিন্তু ঠাম্মা সারাদিন বড় ব্যস্ত থাকে। আর বাবার বাবা, এক্কেবারে বাবার মত। তাঁর সাথে চলে না আবোলতাবোল গল্প। মা দুর্গা বা শ্রীকৃষ্ণের গল্প জুড়লেই দাদু খুলে বসে গীতবিতান। নাহলে শোনায় ম্যাকবেথ বা জুলিয়াস সিজারের হত্যা রহস্য। তারপর গছায় একখান বই, ‘এটা পড় তো চেতা। ’ আর বই দেখলেই পিলে চমকায় চেতা ওরফে শ্রীমতী তুত্তুরীর। 


বাবাকে পটানোর দিনরাত চেষ্টা চালায় তুত্তুরী, আমেজ করে দেয় আশ মিটিয়ে, পাঁচন খাওয়া মুখে উপেন্দ্র কিশোরের ছোটদের রামায়ন খুলে বসে, এমনকি বীরাঙ্গনা হয়ে হাওয়াই চটি দিয়ে পটাশ করে বাথরুমে উড়ন্ত আরশোলাও হত্যা করে তুত্তুরী। মরা পেচকে যাওয়া আরশোলা দেখে মা ভির্মি খাবে বলে ফুলঝাড়ু আর বেলচা দিয়ে তুলে ডাস্টবিনেও ফেলে আসে তুত্তুরী। এহেন বীরবত্তায় রীতিমত প্রীত হয়ে বাবাজীবন অনুমতি দেন, হাওড়া যাবার। উপরন্তু অনুমতি দেন নিছক দু-এক দিন নয়, পাক্কা ছয় দিন পাঁচ রাত হাওড়ায় থাকতে পারে তুত্তুরী। শর্ত শুধু একটা, ভুঁড়ি না বাড়ে। রোজ ব্যায়াম করতে হবে, আর মিষ্টি খাওয়া একদম নিষেধ। বাধ্য কন্যার মত ঘাড় নাড়ে তুত্তুরী। সেই মত হাওড়ায় দফায় দফায় ফোন করে বলা হয়ে যায়- ‘দাদু মিষ্টি কোল্ডড্রিংক কিচ্ছু এনো না যেন। না চকলেটও নয়। বাবা বারণ করেছে। ’


আপিস যাবার পথে ৯ তারিখ সকালে ব্যাগব্যাগেজ সমেত কন্যাকে বাপের বাড়ি পৌঁছাতে গিয়ে দেখি, ডাইনিং টেবিলের ওপর ইয়া বড় এক বাক্স দেশবন্ধুর দরবেশ রাখা। পাশে এককেজির লাল ঘণ ক্ষীর দই। কিছু বলতে যাবার আগেই ধমকে ওঠে বাবা, ‘আঃ আমি খাব। কেন আমি খেতে পারি না?’ তা তো পারেই, আশি পেরিয়ে সুগারের ঘোড়া টগবগ করে ছুটছে, প্রবল ধূমপানে ফুসফুস আধা জখম, তিনি মিষ্টি খাবেন না তো, কে খাবে? দীর্ঘশ্বাস ফেলে, ফ্রিজের দরজা খুলে যথারীতি দর্শন পেলাম দুই লিটার থামস্ আপ আর পুঁচকে বোতলে মাজা। মাখন রাখার তাকে গোটা চারেক ডেয়ারি মিল্ক রাখা, ফ্রীজের মাথায় গোটা কয়েক প্যাকেট ওরিও আর অন্যান্য ক্রিম বিস্কুট। একটা ডেয়ারি মিল্ক ব্যাগে ঢোকাতে গিয়ে তড়িদাহত হলাম। খ্যাঁক করে উঠল মা। ঝুলি থেকে বেরোল বেড়াল। তুত্তুরীর জন্য আনা চকলেট আমি ব্যাগে ঢোকাই কোন মুখে! কেমন মা আমি? হ্যাংলা। মধ্যস্থতা করার সুরে বাবা বলল, ‘আচ্ছা নিক। আমি ওবেলা এনে দেবো।’ 


গাড়িতে উঠে শৌভিককে ফোন করলাম, ওগো আমায় তুমি ছাড়া আর কেউ ভালোবাসে না গো।

Tuesday 20 April 2021

বই পড়ি-

বই পড়ি- ২০শে এপ্রিল, ২০২১


‘২২শে ফেব্রুয়ারি, সন ১৯৪১। কাবুল শহরে তখন বিকেল। আচমকা কাবুলের ইতালীয় দূতাবাসের পিছনের দরজায় কড়া নাড়ল এক স্থানীয় ব্যক্তি। পরিষ্কার করে দাড়িগোঁফ কামানো, ছোট্টখাট্ট চেহারার  আপাতঃ সাধারণ লোকটার মাথায় কারাকুলি আফগান টুপি, পরণে হাঁটু পর্যন্ত লম্বা কুর্তা আর ঢোলা পাজামা। ধূমপানের জন্য পিছনের দরজায় ভিড় জমানো দূতাবাসের আফগান কর্মচারীদের একবারও সন্দেহ হল না, লোকটি স্থানীয় বাসিন্দা নয়। 


সমস্ত রকম যুদ্ধ বিগ্রহ থেকে বহুদূর,আফগানিস্তান তখন নিরপেক্ষ দেশ।  ১৭ মাস আগে শুরু হওয়া মহাশক্তি সংগ্রাম তখনও পরিণত হয়নি মহাযুদ্ধে। ইউরোপে নাৎসীরা ক্রমেই দুর্দম হয়ে উঠছে, একলা বৃটেন কেবল চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে তার সাথে টক্কর দেবার। আপোসে পোল্যাণ্ডকে ভাগাভাগি করে, হিটলার এবং স্ট্যালিন তখনও পরষ্পরের পরম মিত্র। আমেরিকার সাথেও জাপানের সম্পর্ক সৌহার্দ্যপূর্ণ। ‘ আমাদের ছেলেরা কোন তৃতীয় দেশের যুদ্ধে লড়তে যাবে না’ এই মর্মে আমেরিকার মাতা- পিতাদের প্রতিশ্রুতি দিয়ে সদ্য সদ্য তৃতীয়বারের জন্য আমেরিকার রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হয়েছেন ফ্রাঙ্কলিন রুজভেল্ট।

 


লোকটির ইতালীয় রাষ্ট্রদূতের সাথে সাক্ষাৎ করা ভীষণ দরকার। কিন্তু এইভাবে এসে দেখা করতে চাইলেই তো আর দেখা হয় না। লোকটি রক্ষীদের জানাল, সে পেশায় পাচক, তাকে হুজুরের সাথে দেখা করতে বলা হয়েছে। 


রক্ষীর পিছুপিছু উঁচু শিলিংওয়ালা যে ঘরটিতে লোকটা প্রবেশ করল, তার দেওয়ালে টাঙানো ইতালীয় পতাকা আর বড় করে বাঁধানো ইতালীয় স্বৈরাচারী শাসক বেনিতো মুসোলিনির ছবি। মস্ত বড় ডেস্কের উল্টোদিকে বসে থাকা ইতালীয় রাষ্ট্রদূত মোটেই খুশি হলেন না লোকটাকে দেখে। কাবুলের বসবাসকারী অন্যান্য কূটনৈতিকদের মতই তিনিও অনাহূত স্থানীয় আগন্তকদের বেশ ভয় পেতেন। ব্যাটারা হয় সরকারী চর,নয়তো অন্যদেশের গুপ্তচর হয়। এই লোকটাও গুপ্তচর কি না তিনি ঠিক বুঝতে পারলেন না।  এমনকি লোকটি যখন জানাল যে ‘কাবুল সিমেন্সের হের থমাস আপনার কাছে পাঠিয়েছেন। ’ তখনও বিশেষ স্বস্তি বোধ করতে পারলেন না তিনি। 


“কেন পাঠিয়েছে’ খেঁকিয়ে উঠলেন তিনি। লোকটি অত্যন্ত ঋজু ভাবে বলল, ‘তা জানি না।  আমাকে বলা হয়েছে, এসে আপনার সাথে দেখা করতে। ’ লোকটির গলার স্বরে এমন কিছু ছিল, যাতে ইতালীর রাষ্ট্রদূতের বুঝতে বাকি রইল না, এ কোন সাধারণ আফগান হয়। কি মনে করে উনি ফোন করলেন থমাস সাহেবকে।  দুজনের মধ্যে জার্মান ভাষায় বেশ খানিকক্ষণ ফিসফিসিয়ে কথা হল। যার বিন্দুবিসর্গও বুঝলে না আগন্তুক। তবে এটুকু খেয়াল করল যে, বেশী কথা থমাস সাহেব ওপাশ থেকে বলে গেল, আর রাষ্ট্রদূত চুপচাপ শুনে গেল।  


ফোন নামিয়ে, ব্যক্তিগত আর্দালি এবং অন্যান্য কর্মচারীদের বাইরে যেতে ইশারা করলেন রাষ্ট্রদূত। ঘরের দরজা বন্ধ হতেই তিনি ইশারায় আগন্তুককে আসন গ্রহণ করতে বললেন, তারপর ভাঙা ইংরাজিতে বললেন, ‘আমি পিয়েত্রো কুয়ারোনি। আমি কাবুলে ইতালীয় রাষ্ট্রদূত। ’  


আগন্তুক তার পরিচয় দিল। নাম রহমত খাঁ। আফগান নয়, বরং জন্মসূত্রে ভারতীয়।  নামটা সঠিক না হলেও বাকি তথ্যে কোন ভ্রান্তি ছিল না। আগন্তুক জানাল পেশোয়ার থেকে কাবুল এই দীর্ঘ ২০০ মাইল দুর্গম পথ সে পদব্রজে পার হয়ে এসেছে দুর্ধর্ষ তথা দুর্দম উপজাতি অধ্যুষিত এলাকার মধ্যে দিয়ে যারা বৃটিশ ভারত এবং আফগানিস্তানের মধ্যে রচনা করে সীমানা। 


গত ২৭শে জানুয়ারী সে কাবুলে এসে পৌঁচেছে। তবে একা আসেনি, সঙ্গে করে নিয়ে এসেছে ভারতীয় বিপ্লবী সুভাষ চন্দ্র বোসকেও। সুভাষের পথপ্রদর্শক  তথা দেহরক্ষী হিসেবেই খাঁয়ের কাবুলে আগমন। খাঁ আরো জানাল যে আপাততঃ কাবুলেই আত্মগোপন  করে আছে সুভাষ, কাবুল থেকে সীমান্ত টপকে রাশিয়া হয়ে বার্লিন যেতে চান সুভাষ, ভারতকে পরাধীনতার শিকল থেকে মুক্ত করার জন্য জার্মান সহায়তা চাইতে।  


কাবুলে এসেই তাঁরা জার্মান দূতাবাসের সাথে যোগাযোগ করেন, বেশ কয়েকবার মিটিং হয়, কিন্তু ফলপ্রসূ হয় না কিছুই।  এদিকে সম্পূর্ণ বেআইনি ভাবে কাবুলে এসেছেন সুভাষ আর রহমত খাঁ।  না আছে তাদের পাশপোর্ট বা অন্যান্য দরকারী কাগজপত্র, কোনমতে এক আফগান পুলিশ আপিসারকে ঘুষ দিয়ে গ্রেপ্তার এড়িয়ে আত্মগোপন করে আছেন তাঁরা।  যত দিন কাটছে, ততোই বাড়ছে তাদের বিপদ। এই ভাবে বেশীদিন গ্রেপ্তারী এড়ানো অসম্ভব।  আর আফগান পুলিশ একবার ধরতে পারলেই, সোজা তুলে দেবে বৃটিশ সরকারের হাতে। এমতবস্থায় কুয়ারনিই তাদের একমাত্র ভরসা।  


জার্মানদের মত ঝুলিয়ে রাখল না কুয়ারনি। পরবর্তী তিনটি সপ্তাহ আর কয়েকটি মিটিং এর পরই ইতালীয় কূটনৈতিক পাশপোর্ট সমেত সুভাষকে নিরাপদে পার করিয়ে দেওয়া হল আফগান সীমান্ত। তুলে দেওয়া হল মস্কোগামী ট্রেনে। তারপর বোসের কি হল, অথবা হল না আমরা সবাই জানি অথবা জানি না। কিন্তু যে সঙ্গীকে তিনি ছেড়ে গেলেন কাবুলে তাঁর গপ্পও বোসের থেকে কিছু কম চিত্তাকর্ষক নয়। ”

তবে সে গল্প আবার কাল, অথবা পরশু বা কখনই নয়। কে জানে- 


পুনশ্চঃ সবটুকুই মিহির বোসের দা ইন্ডিয়ান স্পাই থেকে।  পাতা- ১৩-১৫।


বই পড়ি- ২৩শে এপ্রিল, ২০২১


“সুভাষ বোস ইউরোপ রওণা দেবার অল্পদিনের মধ্যেই,  রহমত খাঁয়ের পদোন্নতি  ঘটল, নিছক দেহরক্ষী থেকে গুপ্তচর। কাবুলের ইতালীয় রাষ্ট্রদূত পিয়েত্র কুয়ারোনি বহুদিন থেকেই এমনি এক অস্ত্রের সন্ধানে ছিলেন, যার মাধ্যমে  ভারতে বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদী শক্তির ওপর সরাসরি আঘাত হানা যায়। কুয়ারোনির বদ্ধমূল ধারণা ছিল, বৃটিশ সাম্রাজ্য নামক শিকলের সবথেকে দুর্বল, সবথেকে নড়বড়ে আংটা হল ভারত।  এখানে ঠিকঠাক আঘাত করলে শিকল ছিঁড়তে বাধ্য।  


যাবার সময়, বোস যখন ইতালীয়দের সাথে সহযোগীতা করার জন্য খাঁকে তাঁর এজেন্ট নিয়োগ করে গেলেন, কুয়ারোনি এই সুযোগ ছাড়লেন না। কয়েক মাসের মধ্যেই আরেক অক্ষশক্তি জার্মানিও খাঁকে তাদের চর হিসেবে নিযুক্ত করল। ইতালী এবং জার্মানি দুই ফ্যাসিস্ট দেশের হয়ে কাজ করলে বা পারিশ্রমিক নিলেও খাঁ কিন্তু আদতে ছিল গোঁড়া কম্যুনিস্ট। ফলে প্রথম থেকেই খাঁ দুই দেশকে ভুলভাল তথ্য সরবরাহ করে আসত। 


এই ভুল তথ্য পরিবেশন প্রথমদিকে স্বতঃপ্রণোদিত হলেও, ‘অপারেশন বার্বারোসা’র পর অর্থাৎ হিটলারের রাশিয়া আক্রমণের পর, খাঁ হাত মেলায় রাশিয়ার সাথে এবং রাশিয়ানদের সরবরাহ করা তথ্য নাৎসি বাহিনীর কাছে পৌঁছে তাদের ভুল পথে পরিচালনা করতে থাকে।  


দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষের দিকে  খাঁ ইংরেজদের হয়েও কাজ করতে থাকে। বৃটিশরাই তাঁর নাম দেয়, ‘সিলভার’। যাঁকে ব্যঙ্গ করে রহমত খাঁর নাম রাখা হয়েছিল সিলভার, সেই আসল মিঃ সিলভার ছিলেন এক ওপরতলার বৃটিশ অফিসার, যিনি ইংলণ্ডে বসে সমগ্র ভারতে যাবতীয় আণ্ডার কভার অপারেশনের তদারকি করতেন। 


জার্মানরা কোনদিন ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারেনি যে সিলভার তাদের ইচ্ছাকৃত ভাবে ভুল তথ্য পরিবেশন করছে। তারা সিলভারকে এতটাই বিশ্বাস করত এবং তার কাজে এতটাই সন্তুষ্ট ছিল, যে সিলভারকে তৎকালীন জার্মানির সবথেকে বড় মিলিটারি পুরষ্কার, ‘ দা আয়রণ ক্রস’ প্রদান করা হয়। জার্মানরা সিলভারকে একটি ট্রান্সমিটারও দিয়েছিল,যার মাধ্যমে সিলভার সরাসরি বার্লিনে হিটলারের স্পেশাল সিক্রেট সার্ভিস, Abwehr এর সদর দপ্তরের সাথে কথা বলতে পারত। জার্মানরা এক মুহূর্তের জন্য সন্দেহ করেনি যে সিলভারের প্রদত্ত যাবতীয় মিলিটারি তথ্য আসলে বৃটিশ সিক্রেট সার্ভিসের বানানো গপ্প। যা ফাঁদা হত খোদ দিল্লীতে ভাইসরয়ের প্রাসাদে বসে। 


যুদ্ধ শেষের আগে সিলভার কিছুদিন জাপানের হয়েও গুপ্তচরবৃত্তি করেন। একসাথে পাঁচ পাঁচটা দেশের হয়ে গুপ্তচরবৃত্তির এহেন নজির দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ইতিহাসে আর খুঁজে পাওয়া যায় না।” 

- Pg-16, The Indian Spy, The True Story of the Most Remarkable Secret Agent of World War II by Mihir Bose.


  বই পড়ি- ৩, ২৫শে এপ্রিল, ২০২১


"১৫ কোটি পাউণ্ড, ১১লক্ষ লোকলস্কর সহ প্রথম বিশ্বযুদ্ধে সর্বাত্মকভাবে বৃটেনের পাশে দাঁড়িয়েছিল ভারত। যার মধ্যে ১লক্ষ ৩৮ হাজার সেপাই লড়েছিল শুধু ইউরোপেরই নানা রণাঙ্গনে। মূলতঃ ভারতীয়দের জন্যই বৃটিশ সাম্রাজ্য প্রসারিত হয়েছিল রাশিয়ার দক্ষিণে ট্রান্স ক্যাস্পিয়ান আর ককেশিয়া এবং পারস্য ছাড়িয়ে সুদূর মেসোপটেমিয়া। ভারতীয়দের জন্যই ইরাক দখল করে বৃটেন, পরিস্থিতি এমন দাঁড়ায় যে বেশ কিছুদিনের জন্য ভারতীয় টাকাই ছিল ইরাকের জাতীয় মুদ্রা।  এমনকি যে সৈন্যসামন্ত নিয়ে প্যালেস্টাইনের যুদ্ধে অ্যালেনবি তুরস্ককে পরাস্ত করেছিল তার পদাতিক বাহিনীর দুই তৃতীয়াংশ আর অশ্বারোহী সেনাদলের এক তৃতীয়াংশই ছিল ভারতীয়। যুদ্ধে বৃটেনের পাশে দাঁড়াতে ভারতীয়দের অনুপ্ররণা দেবার জন্য গান্ধীজী কাইজার- এ-হিন্দ এর শিরোপাও পান।  


 অগণিত লস্কর, নাবিক, জাহাজী ছাড়াও ষাট হাজারের বেশী ভারতীয় সৈন্য নিহত হয় এই যুদ্ধে। যুদ্ধ শেষে যে ইনফ্লুয়েঞ্জা অতিমারিতে(* স্প্যানিশ ফ্লু) আক্রান্ত হয় বিশ্ব, ভারতে তা তেমন ভাবে দেখা না গেলেও প্রায় বিনা চিকিৎসায় মারা যান ১কোটি ৭০ লক্ষ মানুষ, যা ছিল তৎকালীন মোট জনসংখ্যা ৫শতাংশ। এত চড়া হারে মৃত্যুর একটাই কারণ ছিল, দেশের অধিকাংশ ডাক্তার আর নার্সকে খেয়ে বসেছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধ। 


এতকিছুর পর, নূন্যতম ধন্যবাদের বদলে ভারতের কপালে জুটল বেত্রাঘাত। গান্ধীজী সমেত গোটা ভারতবর্ষই ভেবে বসেছিল, মহাযুদ্ধে এমন সর্বাত্মক সহায়তার পর, নিশ্চয় হোমরুলের দাবী মেনে নেবে বৃটেন। অন্যান্য সাদা উপনিবেশ গুলি যথা অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যাণ্ড, কানাডা বা সাউথ আফ্রিকা যেমন বহু আগে থেকে ভোগ করে আসছে স্বায়ত্তশাসন। এমনকি দীর্ঘ সশস্ত্র বিপ্লবের মধ্যে দিয়ে আয়ার্ল্যাণ্ডও স্বাধীনতা পেল, শিকে ছিঁড়ল না কেবল ভারতের ভাগ্যে।  


বদলে ভারতবাসী দেখল, আরো কঠোর, আরো নির্মম হয়ে উঠেছে বৃটিশ শাসন। যুদ্ধ শেষ হতে না হতেই, ডিফেন্স অব ইণ্ডিয়া অ্যাক্টের প্রতিক্রিয়াশীল ধারাগুলি আরো কঠোর ভাবে বলবৎ করল বৃটিশ সরকার। হৃত হল সংবাদপত্রের স্বাধীনতা, মিটিং মিছিলের ওপর চেপে বসল নিষেধাজ্ঞা, চালু হল পরোয়ানা ছাড়াই গ্রেপ্তার, বিনা বিচারে একবছর অবধি হাজতবাস। যার মেয়াদ বাড়ানো একেবারেই কতৃপক্ষের ইচ্ছাধীন। এমনকি কারো কাছে দেশদ্রোহ মূলক কোন ইস্তেহার পাওয়া গেলে গ্রেপ্তার হবার পর স্বপক্ষে উকিল নিয়োগ করারও অধিকার কেড়ে নিল বৃটিশ সরকার।  লোকে বলত, ‘না দলিল, না ভকিল, না আপিল।’ বৃটিশদের প্রতি আনুগত্য ঝেড়ে ফেলে রাতারাতি বিদ্রোহী হয়ে উঠলেন গান্ধীজী।  ডাক দিলেন দেশ জোড়া গণ আন্দোলনের।  


আর এই গণবিক্ষোভকে কেন্দ্র করেই ১৩ই এপ্রিল ১৯১৯, সিলভারের গ্রাম গল্লা ঢেড় থেকে মাত্র ২৫০ মাইল দূরে অমৃতসর শহরে ঘটে গেল এক পাশবিক হত্যাকাণ্ড। বৃটিশদের প্রায় দুশো বছরের ঔপনিবেশিক শাসনে এত নৃশংস, এত ন্যক্কারজনক ঘটনা কখনও প্রত্যক্ষ করেনি এই উপমহাদেশবাসী।


নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও গণবিক্ষোভ চলছিলই, এমতবস্থায় পরিস্থিতি আয়ত্তে আনতে অমৃতসর শহরের আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব  তুলে দেওয়া হল আর্মির হাতে। জ্যুলাণ্ডার ব্রিগেডের কম্যাণ্ডার, ব্রিগেডিয়ার  জেনারেল রেজিন্যিল্ড ডায়ার অমৃৎসর শহরের দায়িত্ব নেবার সাথে সাথেই জারি করলেন মার্শাল ল। এমন সময়ে তাঁর কাছে খবর এল, তাঁর নির্দেশ অগ্রাহ্য করে জালিয়ানওয়ালা বাগে সমবেত হয়েছে এক বিশাল জনতা। জালিয়ানওয়ালা বাগ ছিল এক অতিকায় মুক্তাঙ্গন, কিন্তু প্রবেশ বা প্রস্থানের পথ কেবল একটি।  তাও অত্যন্ত সরু এক গলি বরাবর। খবর পাওয়া মাত্রই ডায়ার লোকলস্কর নিয়ে হাজির হলেন এই সরু রাস্তার মুখে। 


প্রায় হাজার বিশেক নিরস্ত্র শান্তিপূর্ণ জনতা জমায়েত হয়ে শুনছিল নেতাদের বক্তব্য। দিনটি ছিল বৈশাখী, সমগ্র উত্তরভারত জুড়েই ঐ দিনটি উৎসব হিসেবে পালিত হয়, তাই জমা হওয়া জনতার মধ্যে কতজন ঠিক রাজনৈতিক কারণে জমা হয়েছিল বলা দুষ্কর। ছিলেন শিশু সন্তান কোলে অগণিত মহিলা। সবথেকে বড় কথা, প্রত্যেকেই ছিল নিরস্ত্র। তাতে অবশ্য জেনারেল ডায়ারের কিছু যায় আসেনি।  


ডায়ার যখন দেখলেন এত সরু রাস্তায় তার সাজোয়া গাড়ি ঢুকবে না, তখন তিনি গাড়িগুলি রাস্তার মুখে দাঁড় করিয়ে, গুর্খা সেপাইদের নির্দেশ দিলেন রাস্তা আটকে, গুলি চালাতে।  কোন সচেতনবাণী ছাড়াই।


এম্যুনিশন শেষ না হওয়া পর্যন্ত থামেনি গুলিবর্ষণ। শুধু সরকারী হিসেবেই মারা গিয়েছিলেন ৩৩৭ জন পুরুষ, ৪১ জন মহিলা এবং একটি ৭ সপ্তাহের দুধের শিশু। আহত ১৫০০।  কংগ্রেসের মতে মৃতের সংখ্যা  ছিল হাজারের অনেক বেশী।


ডায়ারের কৃতকর্মের তালিকা বেশ লম্বা। নানা অজুহাতে এদেশীয়দের চাবুকপেটা করা ছাড়াও তিনি কুখ্যাত ছিলেন, ‘ক্রলিং অর্ডার’ এর জন্য। জনৈকা শ্বেতাঙ্গ রমণী আক্রান্ত হয়েছিলেন একদল এদেশীয়দের দ্বারা, যেখানে এই ঘটনাটি ঘটেছিল, ডায়ার নির্দেশ দেন, সেই পথে যাতায়াত করতে হলে ভারতীয় পুরুষদের যেতে হবে বুকে হেঁটে। অন্যথা হলেই জুটবে বেধড়ক মার এমনকি বেয়নেটের খোঁচাও। বৃটিশ লাইব্রেরিতে রাখা একটি ছবিতে দেখা যায়, এইভাবে সরীসৃপের মত বুকে হেঁটে চলা ভারতীয়দের বেয়নেটের খোঁচা মারছে ২৫ তম রেজিমেন্টের গোরা সেপাইরা। জনৈক প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ থেকে জানা যায়, ‘রাস্তাটা অনেকটাই লম্বা, এইভাবে উপুড় হয়ে শুয়ে, হাত আর কাঁধে ভর দিয়ে বুক ঘষটে সরীসৃপের মত চলতে থাকা বেশ দুরূহ এবং ভীষণ কষ্টকর। কারো পাছা মাটি থেকে সামান্য উঁচুতে উঠলেই লাথি মারছিল টহলদার গোরা সেপাইরা। ’ 


এতকিছুর পরেও ভারতবাসীর কাছে যেটা সবথেকে বেদনাদায়ক ছিল তা হল, যদিও ডায়ারকে আর্মি ছাড়তে হয়, কিন্তু তাছাড়া তার বিরুদ্ধে কোন শাস্তিমূূলক ব্যবস্থা নেওয়া হল না। তাকে সসম্মানে অবসর গ্রহণের সুযোগ দেওয়া হল, এমনকি অবসর নেবার পর তার পেনশন ইত্যাদিও চালু করা হল। 


যেটুকু সামান্য শাস্তি দেওয়া হয়েছিল তার জন্যও বৃটিশ পার্লামেন্টে ঝড় ওঠে। জালিয়ানওয়ালা বাগ নিয়ে আলেচনার প্রস্তাব বিপুল ভোটে খারিজ হয়ে যায় হাউস অব কমনস্ এমনকি হাউস অব লর্ডসেও। এই নিয়ে আলোচনার প্রস্তাব দেবার জন্য তীব্র সমালোচনার মুখে পড়ে সেদেশের সরকার। আসলে এদেশে বা ইংলণ্ডে বসবাসকারী গোরাদের চোখে ডায়ার ছিল নায়ক। তিনি যা করেছিলেন তা বৃটিশ রাজের মঙ্গলের জন্যই করেছিলেন এই মতবাদ আজও  খোলাখুলি ভাবে অনেক বৃটিশ লেখক পোষণ করে থাকেন। 


ডায়ারের মৃত্যুর পর রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় তাঁর শেষকৃত্য সম্পন্ন হয়। তাঁর জন্য একটি বিশেষ তহবিল খোলা হয় যাতে বহু গণ্যমান্য ব্যক্তি অর্থপ্রদান করেন। যাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন লেখক রুডিয়ার্ড কিপলিং। কারণ শতিনেক নিরস্ত্র ভারতীয়কে হত্যা করার পিছনে তাঁরা কোন অনৈতিকতা, কোন অন্যায় খুঁজে পাননি। “ 


 Pg- 35-37, The Indian Spy, The True Story of the Most Remarkable Secret Agent of World War-II by Mihir Bose.

Tuesday 13 April 2021

অনির ডাইরি, ১৩ই এপ্রিল, ২০২১

 



বলেছিলাম, আগামী কাল নীল, একটা বেল এনো তো। তা এনেছেন বটে, তবে আমার সুবিধার কথা ভেবে বেলটিকে ফাটিয়ে এনেছেন।  তাই দিলাম ঠাকুরকে, 'প্রভু, তোমার যা অভিরুচি'। 


এই বাড়ির নিয়মকানুন কিছুই জানি না। শ্বশুরমশাই যেমন কড়া নাস্তিক, শাশুড়ীমা তেমনি প্রগতীশীলা। উপোসতিরেস প্রসঙ্গে প্রথমেই জানিয়ে দিয়েছিলেন, ‘তোমার যা প্রাণ চায়,কোরো-’। এমনিতে যে আমি খুব ধর্মপরায়ন লক্ষ্মীমন্ত মেয়ে তা নই, বরং সর্বার্থে লক্ষ্মীছাড়া, অলবড্ডে তথা হদ্দ কুঁড়ে ‘নারী বদ’ বলে অত্যন্ত শ্লাঘা বোধ করি, তবুও বছরে ছটা ষষ্ঠী অার দুটো অষ্টমী করেই ফেলি টুকটুক করে। সবটুকুই আমার বাপের বাড়ির নিয়ম মেনে।  কেন করি? এ প্রশ্ন বিগত এক যুগে আমার শ্বশুরমশাই তথা তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র অগণিত বার করেছেন- জবাবটা আমিও ঠিক জানি না। করি, কারণ মা করত, থুড়ি এখনও করে। আর করি, মেয়েটার শিকড়ে খানিক বাঙালীয়ানার মাটি জোগাতে। বড় বেশি ট্যাশ তৈরি হচ্ছে এরা, একটু তো বাঙালী হোক, বারো মাসে বাঙালির তেরো পার্বণের সাথে কিছুটা তো আলাপ জমুক। 


জৈষ্ঠ্যে আসে জামাইষষ্ঠী। ভাদ্রে চাপড়া ষষ্ঠী। দুর্গা ষষ্ঠীর ঠিক একমাস আগে। কি দারুণ মিষ্টি মিষ্টি মুগডালের বড়া বানাত ঠাকুমা, চাপড়া ষষ্ঠী এলেই। মিষ্টি দই মাখিয়ে সেই বড়ার আস্বাদ আজও কোথাও জেগে আছে স্বাদকোরকের কোন গহীন অংশে। রান্নাঘরের মস্ত শিলনোড়াখানি এই সময় রাতারাতি হয়ে যেত মা ষষ্ঠী। গোটা ফল দিয়ে পুজো হত তাঁর। কোলের বাছাদের স্নান করতে নিষেধ করত ঠাকুমা। সন্ধ্যা ঢললে, যখন পশ্চিমের নিম গাছের ফাঁক দিয়ে উঁকি মারত বুড়ি চাঁদ, উঠোনের লাগোয়া দখিন খোলা রোয়াকে আঁচল বিছিয়ে শুয়ে, চাপড়া ষষ্ঠীর গল্প শোনাত ঠাকুমা। কোলের কাছে বিড়ালছানার মত ঘেঁষে থাকতাম আমরা তিন খুড়তুতো জেঠতুতো ভাইবোন। সব কি আর মনে আছে, স্মৃতিপটে জমেছে বিস্তর ধূলিকণা। এই দিনে নাকি গঙ্গাস্নান করতে গিয়ে সন্তান হারায় কোন এয়োস্ত্রী। আচমকা আসা বান খালি করে যায় কোল। সন্তানহারা জননীর করুণ আর্তিতে আবির্ভূত হন ষষ্ঠীদেবী স্বয়ং। তারপর জানা যায়, আপন পাপেই সন্তান হারিয়েছে নারী। বাছার দুধের বাটিতে ঠোঁট ডোবানো বিড়ালছানাকে চ্যালাকাঠ পিটিয়ে হত্যা করারই মাসুল গুণছে রমণী। পরিত্রাণের উপায় আছে বটে, তবে তা ভয়ানক। ঘাটেই পড়ে থাকা আধপচা, পোকা কিলবিল করা মরা বেড়ালছানার দেহে মিষ্টি দই ঢেলে চাটতে হবে তাঁকে। ঠিক যেমন সোহাগ করে চেটে দিত ছানাটার মা বেড়াল। পুত্রশোকে মূহ্যমান নারী অক্ষরে অক্ষরে পালন করেন মা ষষ্ঠীর নিদান। পরিণতি, আবার আসে বান, মায়ের আঁচল ধরে ভেসে ওঠে ডুবে যাওয়া শিশু। 


আশ্বিনে দুর্গা ষষ্ঠী। মাঘে আসে শীতল বা শেতল ষষ্ঠী। সরস্বতী পুজোর ঠিক পরের দিন। এই একটিই ষষ্ঠী যেদিন ভাত খায় মায়েরা। গরম ভাত নয় অবশ্য, আগের রাতে করে রাখা, জল ঢালা ভাত, অথবা সকালে করেও জলে ভিজানো ভাত। সাথে আর যাই থাকুক না কেন গোটাসিদ্ধ আর মিষ্টি দই থাকবেই। 


পরপর দুটো ষষ্ঠী আসে চৈত্রে। বাসন্তী পুজোর ষষ্ঠী বা অশোক ষষ্ঠী। আগে থেকে তুলে রাখা, শুকনো ছখানি অশোকফুল, কাঁঠালি কলার খণ্ডিতাংশে চটকিয়ে কপ্ করে গিলে খেতে হয় সকালে। জল দিয়ে গিললে হবে না, আবার না গিলতে পেরে ওয়াক তুললেও হবে না।  সদ্য সদ্য মা হবার পর, প্রথম অশোক ষষ্ঠী পড়েছিল যখন, তখন আমি বিডিওর ঘরণী। খড়্গপুরের উপান্তে এক ছোট্ট গাঁয়ে মোদের ঘরসংসার। সারা গাঁ ঘুরে কোথাও জুটল না অশোকফুল। কি করি? পিসি নিদেন দিল, ছটা কাঁচা মুগকড়াই কলায় চটকে গিলে খেতে। তারপর থেকে অবশ্য কখনও সমস্যা হয়নি। আমাদের আবাসনেই আছে ঝাঁকড়া অশোকগাছ। ইস্কুল ফেরৎ রিক্সামামাকে দিয়ে পাড়িয়ে আনে তুত্তুরী।  


চৈত্র মাসে দ্বিতীয় তথা বছরের শেষ ষষ্ঠী আজ। শ্বশুরমশাই প্রত্যেকবার মাথা চুলকান, “তিথি গত ভাবে আজ তো ষষ্ঠী নয়। চৈত্রসংক্রান্তির আগের দিন নীল তথা শিবের উপাসনা হয় বটে, তাকে খামোখা তোমরা ষষ্ঠী বানাও কেন?” এ প্রশ্নের সদুত্তর কি ছাই আমার কাছে আছে? আমাদের মধ্যহাওড়ায় নীলের সাথে সাথে ষষ্ঠীরও উপাসনা যে হয় আজকের দিনে। পঞ্চানন তলার লালবর্ণ বুড়ো পঞ্চাননের পাশে ছেলে কোলে বসে থাকেন তন্বী ষষ্ঠীদেবী। 


আগে নিয়ম অনেক কঠোর ছিল, মধ্যাহ্ন অবধি জলগ্রহণ পর্যন্ত করতেন না জেনানাকুল। বেলা বারোটা বাজলে তবে শিবের মাথায় কাঁচাদুধ মেশানো গঙ্গাজল ঢেলে, ধুঁতরো ফুল, আকন্দ ফুলের মালা, সিদ্ধি পাতা, পাঁচরকম ফল আর পৈতে দিয়ে বুড়ো শিবের উপাসনা করে, চরণামৃত সহযোগে উপবাস ভঙ্গ করতেন তাঁরা। উপাচার একই আছে, তবে বেলা বারোটা অবধি অপেক্ষা করার নিয়ম বর্তমানে অনেক শিথিল। 


বরাবর নীলের দোসর আমার পিসি। পুজোর যাবতীয়  যোগাড় করে রাখে পিসি। আমার করণীয় বলতে শুধু ধরাচূড়া পড়ে নীলের সকালে পিসির হাত ধরে পিতলের কমণ্ডুল ভর্তি দুধ গঙ্গাজল আর সাদা রুমাল ঢাকা ফুলফলের টুকরি নিয়ে বুড়ো শিবের দুয়ারে হাজির হওয়া। এবারে অবশ্য হাওড়া যাওয়া বা মন্দিরে গিয়ে পুজো দেওয়ার বিলাসিতা আর হয়ে ওঠেনি। ঘরেই নমঃ নমঃ করে পুজো সারা। ধুতরো ফল, সিদ্ধি পাতা বা আকন্দ ফুলের মালা আনতে বলে আর বিব্রত করিনি নিজের বরকে। 


 পুজো শেষে বানাতে বসেছিলাম বেলের শরবৎ , নীল আর বেলের শরবৎ বা পানা কেমন যেন একে অপরের সম্পূরক।  বাড়ির গাছের বেল সন্তর্পনে ফাটিয়ে হাতে করে জলে গুলে, পরিষ্কার সাদা কাপড়ে ছেঁকে, পরিমাণ মত মিষ্টি, সামান্য নুন আর কয়েকফোঁটা লেবুর রস মিশিয়ে যে অমৃত তৈরী করত ঠাকুমা, অবিকল তেমন না হলেও কাছাকাছি তো এসেইছে ব্যাপারটা। সমস্যা একটাই, ব্যাপারখানা বেলের পানা না হয়ে, কেমনি যেন বেলের স্মুদি হয়ে গেছে। তা হোক, প্রতি চুমুকে না হয়, আরেকটু ঘন হয়ে আসুক হারিয়ে ফেলা শৈশব, আর হারিয়ে যাওয়া মানুষগুলো।

Sunday 11 April 2021

অনির ডাইরি ১০ই এপ্রিল, ২০২১

 


ভালো করে ঘুমই হয়নি কাল রাতে। একাকিনী হোটেলে রাত কাটানো অবশ্যি কালই প্রথম নয়। বিগতপাঁচ তারিখেও তো একাই ছিলাম হোটেলে। সৌজন্য নির্বাচন। নির্বাচনের আগের রাতে কোন সরকারী আস্তানা পাওয়া অসম্ভব, ভাগ্যে এই হোটেলখানা ছিল। ঠিক পাঁচ বছর আগের বিধানসভা নির্বাচনের সময় হুগলী তৎকালীন ওসি ইলেকশনের আপৎকালীন মাথা গোঁজার ঠাঁই ছিল বাসস্ট্যাণ্ডের ধারের এই হোটেলখানা। তিনি আবার সম্পর্কে তুত্তুরীর বাবা, তাঁর পরামর্শেই তড়িঘড়ি রমেশকে পাঠিয়ে বুক করেছিলাম ঘর। বাসস্ট্যান্ডের ধারের ছোট্ট হোটেল,একতলায় মালিকেরই মিষ্টির দোকান, দুই-তিন-চার তলায় থাকার ব্যবস্থা। আহামরি কিছুই না,মোটামুটি কাজ চালানোর মত। 


চারতলার ঘরগুলি তুলনামূলকভাবে এট্টু বড়, একটা ছোট্ট জানলাও আছে,যা দিয়ে দেখা যায় সামনের রাজপথ। বাথরুমে গিজার- হ্যাণ্ড শাওয়ার লাগানো। দেওয়ালে স্পিল্ট এসি, একটা কাঠের আলমারি, এলসিডি টিভিও ছিল। দোতলার ঘরটা তুলনায় বেশ ছোট, গিজার হ্যান্ড শাওয়ার কিছুই নেই। বালতি মগই ভরসা। বাথরুমটাই এত ছোট, নড়ানড়া করা দায়। ঘরে একখান দেওয়ালে লাগানো এসি আছে বটে, তবে তা থেকে নিখাদ হাওয়া বেরোয়। জানলাও আছে একটা, চেপে বন্ধ করে,তারওপরে জাল লাগানো। টিভিও আছে, সেই সাবেকী ছোট্ট পোর্টেবল টিভি। আর আছে একখান কাঁচের গ্লাস,  তারপাশে বড়বড় করে লেখা, ‘এখানে মদ্যপান নিষেধ’।  


ওপরের ঘরের দরজায় দুইখানি ছিটকিনি ছিল, এইঘরে একটি সম্বল। তুত্তুরী জোরে লাথি মারলেই ভেঙে পড়বে ছিটকিনি। কি আর করা। মালিক প্রভূত ক্ষমা চেয়েছেন, এইঘরটি দিয়েছেন বলে, কিন্তু উনি নিরুপায়। জেলা স্বাস্থ্য আধিকারিকের দলবল অনেক আগে থেকেই বুক করিয়ে রেখেছিল ভালো ঘরগুলি।  অবশ্য ওপরের ঘরে দুইটি ছিটকিনি থাকলেও লাগত কেবল একটি। বহু চেষ্টাচরিত্র করেও লাগাতে পারিনি তলার ছিটকিনিটা। ভেবেছিলাম গ্লাসটপ টেবিলটাকে ঠেলে দরজা আটকে শোব, তাঁকে সামান্য হিলাতেই তিনি যা ক্যাঁচোরম্যাচোর জুড়লেন, অগত্যা একখান নকল বেতের মোড়া ছিল, সেটাকেই দরজায় ঠেস দিয়ে, তার ওপর আমার পিট্টু ব্যাগটা চাপিয়ে ঘুমিয়েছিলাম সেরাতে। 


রাতই বা কোথায়? কয়েকটা তো ঘন্টা। স্নানাদি সেরে,তৈরিটৈরি হয়ে ব্যাগব্যাগেজ গুছিয়ে পাঁচটার মধ্যে ঢুকতে হয় কন্ট্রোল রুম। তার আগে ফোন করে ঘুম ভাঙাতে হয় ড্রাইভারের। তিনি দেরী করলেই মারা পড়ব যে। এমনিতেই একা শুতে বেশ গাছমছম করে,রোজই তাই টিউব জ্বালিয়ে শুই আমি, গতরাতে আবার তারই মধ্যে দরজায় ঠকঠক্। রাত এগারোটার সময় কে আবার দরজা পিটোয়। আবার দরজায় কোন পিপ হোলও নেই যে দেখব। অবশ্যি আমি চিরদিনই ডাকাবুকো, আর এরা সবাই ভালোমতই চেনে আমায়। তাই দিলাম দরজা খুলে। দরজার ওপারে সংকুচিত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে হোটেলের কর্মচারী, তাকে ঘিরে গোটা পাঁচেক কেন্দ্রীয় পুলিশের অস্ত্রধারী। উল্টোদিকের ঘরের অতিথির সাথে বাক্যালাপ রত। লোকটি হাত কচলে জানাল,পুলিশের রেড পড়েছে, ওণারা কিছু প্রশ্ন করেই চলে যাবেন, তারপর আর কেউ জ্বালাবে না আমায়। উর্দিধারীদের মাথা যদিও টুপি খুলে,সবিনয়ে ‘কোই নেহি জী। আপ শো যাইয়ে’ বলে আশ্বস্ত করে গেলেন, ঘুম আর এল না। 

এও ছিল কপালে, রাতবিরেতে হোটেলের ঘরে দরজা ধাক্কাবে পুলিশে। শৌভিকের কাছে সবটুকুই কৌতুকের ব্যাপার। আমার অনুযোগের প্রত্যুত্তরে আমোদে মাখোমাখো সুরে জানাল, ‘ভোটের আগের রাতে অমন হয়। ওখানে অনেক সময় পলিটিক্যাল পার্টির লোকজনও থাকে তো। আমার সময় অমুকের দলবল সারারাত এমন খোল করতাল পিটিয়েছিল যে রাতে ঘুমোতেই পারেনি। ’ 


ভোর চারটের অ্যালার্ম যখন বাজল, শিরায় উপশিরায় অসীম ক্লান্তি। এত সকালে তালা খোলে না হোটেলের সদর দরজার। অন্ধকার সিঁড়ি দিয়ে মালপত্র সহ হাতড়ে নেমে, করিডরে ঘুমিয়ে থাকা কর্মচারীকে ডেকে তুলে খোলাতে হয় দরজা। দরজার সামনেই গাড়ি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন আমাদের সুবীর বাবু। আমায় নামিয়ে দিয়েই আবার বাড়ি চলে যান উনি। গিয়ে খানিক ঘুমিয়ে নটা নাগাদ আবার আসেন টিফিন তুলতে। আমার টিফিনটা রোজ উনিই পৌঁছিয়ে আসেন কন্ট্রোল রুমে। 


নতুন কালেক্টরেটের তিনতলার গতিধারা হলটাই আপাততঃ জেলা কন্ট্রোল রুম। দেওয়াল জুড়ে লাগানো গোটা বিশেক অতিকায় টিভি। যার মধ্যে আমাদের ভাগ্যে পড়ে নয় থেকে এগারোটা। প্রতিটি বিধানসভা ক্ষেত্রের জন্য বরাদ্দ একটি করে টিভি।  ইলেকশন কমিশনের নির্দেশ মোতাবেক দেড় থেকে দুই হাজার সংবেদনশীল বুথে লাগানো হয়েছে ক্যামেরা। পোল ডের আগের দিন সকাল থেকেই, ক্যামেরা গুলির লাইভ ফিড চলতে থাকে টিভিতে। 


আমাদের ডান পাশের টিভি গুলিতে চলতে থাকে নানা সংবাদ চ্যানেলগুলি। আর বাঁ পাশের টিভিতে পর্যবেক্ষণ করা হয় সেক্টর অফিসারদের গতিবিধি। ক্যামেরা লাগানোর কাজ শেষ হয়েছিল আগেই, গতরাতে অনেকক্ষণ থেকে, দেখে  গেছি আমরা, সব বুথ থেকে লাইভ ফিড আসছে কি না। একসাথে অবশ্য কখনই অনলাইন থাকে না সব ক্যামেরা। তবুও অফলাইনের অনুপাত যত কমানো যায় ততোই মঙ্গল। 


কাক না ডাকা ভোর থেকে বিএলটিপিদের ফোন করতে থাকি আমরা, ‘কি ব্যাপার তোমার অমুক বুথ কেন অফলাইন?’ কখনও বা ফোনে ধরা হয় প্রিসাইডিং অফিসারকে, ‘শুনুন না, আপনাদের ক্যামেরার ওপর থেকে কাপড়টা সরিয়ে দিন। ’ এই সমস্যা কেবল মহিলাবুথগুলির জন্যই নির্দিষ্ট। যেহেতু বুথেই রাত্রিবাস করেন ওণারা, তাই ক্যামেরার ওপর চাপা দিয়ে দেন কোন কাপড়। তাতে কিছু না,শুধু ভোর সাড়ে পাঁচটার মকপোলের আগে সরিয়ে দিলেই হল। সরাতে গিয়ে অনেক সময় বেঁকে যায় ক্যামেরা, উপড়ে যায় দেওয়াল থেকে। আবার ধরতে হয় টেকনিক্যাল পার্সনকে। তাকে না পেলে এজেন্সির সুপারভাইজার।  প্লিজ একটু দেখুন-। এই ফিড দেখতে পায় কলকাতর সিইও অফিস। দেখতে পায় দিল্লীর কমিশন। 


পুরুষ বুথে অবশ্য সে সমস্যা নেই। ঊর্ধাঙ্গ অনাবৃত করে রীতিমত স্ট্যালোন হয়ে ঘোরে লোকজন। ক্যামেরা সামনে দড়ি টাঙিয়ে শুকায় গামছা। পাশাপাশি ঘুমোয় পোলিং পার্সোনেল আর কেন্দ্রীয় বাহিনী। ভোট চলাকালীনও শুকায় গামছা আর লুঙ্গি। আহাঃ একটা দিনের তো ব্যাপার।  


গতিধারা হলের ডিজিট্যাল ঘড়িতে বাজে সকাল সাতটা। স্বস্তির নিঃশ্বাস বয় কন্ট্রোল রুম জুড়ে ভোট শুরু হয়ে গেছে। ক্যামেরার ফিড বলে দরজার বাইরে বিশাল লাইন এই সাতসকালেই। কেজো ফোনের পাশাপাশি ফোন করি আমার বুড়োকে, ‘ভোট দিতে যাবে না বাবা?’ দীর্ঘশ্বাস ফেলে জানায় বাবা, ‘ আর্যবালিকা স্কুল অবধি গিয়ে কি আর হেঁটে ফিরতে পারব? এবার ভাবছি দেবো না। ’ করোনার আবহে ভোট দিতে না যাওয়াই মঙ্গল, তবুও বড় মনখারাপ হয়ে যায়। জানি বৃদ্ধের ভোট দেবার কি তীব্র ইচ্ছে, ভোটের ফলাফল নিয়ে প্রতিনিয়ত কাটাছেঁড়া করে চলেছে যে মানুষটা, সে বয়ঃজনিত শারিরীক  অসমর্থতার কারণে ভোট দিতে পারবে না, ভাবতেই ব্যাথাতুর হয়ে ওঠে মন। 


কাপের ফেনার সাথে দুঃখ গিলে আবার ঘোরাতে হয় ফোন, করতে হয় মাতব্বরী। আপনার বুথে এত লোক ঢুকেছে কেন? লাইনটা প্লিজ বাইরে দেওয়ান। বা আপনার বুথের ইভিএম স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে যে, কম্পার্টমেন্টটা ঘুরিয়ে দিন একটু। বা একি আপনার এভিএমের পিছনের জানলা/দরজাটা খোলা নাকি? বন্ধ করুন শীঘ্র। প্রিসাইডিং অফিসারকে ফোনে না পেলে প্রথম পোলিং অফিসারকে। কখনও ধরেন, কখনও বা বেজে যায় ফোন, কখনও বা ঘুম চোখে ফোন ধরেন তাঁর স্ত্রী, ‘এই ফোনটা তো বাড়িতে রেখে গেছে- । ’ 


একান্তই কাউকে না পাওয়া গেলে তখন ধরতে হয় সেক্টর অফিসারকে। সেক্টর অফিসারদের তালিকা খুব মনযোগ দিয়ে দেখি আমি। আইএমডব্ল্যু দেখলে অদ্ভূত আপনভাবে ভরে ওঠে মন। এই তো আমার নিজের লোক।  ‘শুভঙ্কর ক্যামেরার সামনে গামছা শুকোচ্ছে বাবা। একটু সরিয়ে দিতে বলো প্লিজ।’ বেচারা শুভঙ্কর একবার ছেড়ে তিনবার ফোন করে, ‘সবকটা বুথ থেকেই গামছা সরিয়ে দিয়েছি ম্যাম। এবার দেখুন তো। ’ 


কখনও বা বলা হয়, ও মশাই বুথ ছেড়ে সবাই গেলেন কোথায়? ক্যামেরার সামনে ফোন হাতে এসে দাঁড়ান প্রিসাইডিং অফিসার, ‘আছি ম্যাডাম। আমি আছি। বাকিরা খেতে গেছে। ’ বেলা ঢলে বিকালের দিকে। লোক কমতে থাকে বুথে। অশক্ত বৃদ্ধ বাবা বা মাকে ধরে ধরে ভোট দিতে নিয়ে আসে পুত্র তথা পরিজন বর্গ। আসেন দৃষ্টিহীন ভোটার। এঁণাদের ভোট দেবার আগ্রহ দেখে ভরে ওঠে মন। এই না হলে আমার দেশ, বিশ্বের বৃহত্তম গণতন্ত্র। এক ফাঁকে মেসেজ করে বাবা, ‘ভোট দিয়ে এলাম।’





Thursday 8 April 2021

ইতি বুজুর মা।

 ইতি বুজুর মা- ৮ই এপ্রিল, ২০২১


আজ খুব ইচ্ছে করছে, তোমাকে একটা চিঠি লিখি। কেন ইচ্ছে করছে জানি নে বাপু। তুমিই শিখিয়েছিলে, ‘ইচ্ছে হল এক ধরণের গঙ্গা ফড়িং, অনিচ্ছেতেও লাফায় খালি তিড়িংবিড়িং। 


 চিঠি লেখার নিয়মে প্রথমেই বোধহয় একটা সম্বোধন দিতে হয়। যেমন গুরুজন হলে পরম পূজনীয় বা শ্রীচরণকমলেষু ইত্যাদি। আর তোমার কন্যার ভাষায় ল্যাঘুজন হলে প্রিয়বরেষু বা প্রিয়তমেষু এই ধরণের কিছু বোধহয়। তবে এতবছর বাদে তোমায় প্রিয়তমেষু বলে সম্বোধন করলে, তুমি নির্ঘাত হোঃ হোঃ হোঃ করে অট্টহাস্য করবে। যেমন করো, তুমি আর তোমার বিশ্বপাকা মেয়েটা। আমার সবকিছুতেই কেন যে তোমরা এত খুঁত খুঁজে পাও, মানছি আমি হদ্দ কুঁড়ে,অলস, অলবড্ডে এবং তোমাদের তুলনায় বেশ খানিকটা নির্বোধ এমনকি হয়তো কিছুটা অগোছালো, অপরিষ্কারও। নাহয় তোমার মায়ের মত গৃহকর্মনিপুনা নই, তাই বলে বুঝি আমি এতই ফেলনা? 


শুধু ‘প্রিয় অমুক’ অবশ্যি লেখাই যায়, কিন্তু মুস্কিল হচ্ছে তোমার পোশাকী নামটা ধরে তো কোনদিনই তেমন ভাবে তোমায় ডাকিনি, তাই ঐ প্রিয় অমুক লিখতে গেলে শেষে বাবু জুড়ে বসব নির্ঘাত, জানোই তো আমি কতটা সেকেলে। আমি যে তোমার অচল পয়সা।  ব্যাপারখানা কেমন যেন পরপুরুষকে চিঠি লেখার মত হয়ে যাবে। তাতে পূব-পশ্চিম রাগ- অনুরাগ থাকতে পারে বটে, কিন্তু তোমার-আমার এই সুখী দাম্পত্য, আমাদের খুচরো অভাব, তুচ্ছ হীনমণ্যতা, আমাদের সামান্য মনখারাপ, আমাদের সামান্য পিছিয়ে পড়া, ছাপোষা লড়াই, আমাদের তেল নুন লকড়ির গল্প তো করা যাবে না।


আর আমি তোমার সাথে গল্পই তো করতে চাই। হোয়াটস্অ্যাপে লাইভ লোকেশন পাঠিয়ে, ‘বাড়ি ফিরছি’ নয়, আমি তোমার সাথে বলতে চাই অনেক অনেক কথা। চিৎপুর মার্কা ভালোবাসায় জবজবে সেই সমস্ত কথায় থাকব শুধু তুমি আর আমি। জানাতে চাই, ঠিক কখন, কখন, ঠিক কতবার অনুভব করেছি, তোমার মত  আর কেউ নেই। তোমর থেকে ভলো আর কেউ হতে পারে না।  শুধু একটাই অনুরোধ, অনুভূতিটা অনুভব করো, দয়া করে বানান ভুল ধরতে বসো না। তোমর কখনও মনে হয়েছে কিনা জানি না, আমার প্রায়ই মনে হয় বড় বেশী বাবা-মা হয়ে পড়ছি আমরা, সব সময়েই আমাদের মধ্যে বিরাজ করে তৃতীয়া কোন ব্যক্তি। সব শেষে জীবনের রঙ্গমঞ্চে প্রবেশ করেও সবথেকে বেশী গুরুত্ব পায় সে। হ্যাঁগা তুমি তাকে আমার থেকে বেশী ভালোবাসো না তো? মাঝে মাঝে তাকে বকাঝকা বা ঠ্যাঙানোর পর যেভাবে কালো হয়ে থাকে তোমার মুখ,দেখে রীতিমত কেঁপে উঠি আমি। মা হিসেবে সন্তানকে সুশিক্ষা দেবার দায়িত্ব যে মুখপোড়া সমাজ চাপিয়েছে আমার কাঁধে, খারাপ হলেই বলবে আমার মেয়ে, আর ভালো হলেই, তোমার আর তোমাদের বাড়ির মেয়ে  কিনা। 


আমি তোমায় সোহাগ করে যে নামে ডাকি, সেই নামে অবশ্যি সম্বোধন করতেই পারি, কিন্তু সেই নামটা যে আমার সমস্ত কিছুর পাসওয়ার্ড। চিঠি বেহাত হলেই যে বিপদগ্রস্ত হব।  অবশ্যি তুমি সবই জানো, আমার সমস্ত পাসওয়ার্ড, যাবতীয় পিন, আমার তুচ্ছ উপার্জন ইত্যাদি প্রভৃতি- কোনকিছুই তোমার অজ্ঞাত নয়। তোমার ডেবিট আর ক্রেডিট কার্ডের পিন ছাড়া বাকি কোন কিছু অবশ্য লুকিয়ে রাখো না তুমিও। চুপি চুপি তোমায় বলি,ঠিকই করো।  আমার খরচপাতির হিসেবটা তো তুমি জানো না মশাই। তুমি আমায় যতই চোখবন্ধ করে বিশ্বাস করো না কেন, আজ স্বীকার করছি, অনেককিছু বেমালুম চেপে যাই আমি। মানে টুকটাক কেনাকাটার গপ্প। ভয় পাই, জানতে পারলে যদি কুরুক্ষেত্র করো তুমি, সামনাসামনি স্বীকার না করলেও বড় ভয় পাই তোমায়। ধরা পড়লেও তুমি অবশ্য কিছুই বলো না, বড়জোর বলো, ‘বড় বাজে খরচা করো/করিস। মনমর্জি মোতাবেক কখনও তুমি কখনও তুই বলো তুমি। আমিও তাই বলি।  পরিস্থিতির  তাপমাত্রা অনুযায়ী নির্ধারিত হয় আমাদের সম্বোধন। 


বড় বাজে বকছি।পশ্চিমের মরা চাঁদ এবার বুঝি হেলে পড়বে পূবে। ঘুমোতে যেতে হবে এবার, কাল আবার একখান কর্মব্যস্ত দিন। বলার ছিল কতই কথা, বলতে পারলাম কই? বলতে চেয়েছিলাম যা তা মৌখিক ভাবেও হয়তো বলেছি অনেকবার। বলছি কি না, তুমি ভালো থেকো গো। তুমি ভালো থাকলেই ভালো থাকব আমি আর ঐ ছোট্ট লোকটা।।  দেখো আবার তার কথা তুললাম। বলেছিলাম না বড় বেশী বাবা-মা হয়ে গেছি আমরা। 


ইতি

বুজুর মা। 

পুনশ্চঃ-ধ্যাৎ তেরি।

Monday 5 April 2021

ইতি তোমার মা-

 ইতি তোমার মা- ৫ই এপ্রিল, ২০২১


প্রিয় বুকু,

কি করছ? আজ ভীষণ ইচ্ছে করছে তোমায় একটা চিঠি লিখি। আমরা যত মেসেজে দড় হচ্ছি, ততোই ভূলে যাচ্ছি চিঠি লিখতে। আমরা কথা বলছি, সারাদিন কথা বলছি, তবুও ঠিক সম্পূর্ণ হচ্ছে না ভাবের আদানপ্রদান। অনেকদিন অভ্যেস নেই তো, জানি না কেমন লিখব, ভূলত্রুটি হলে মার্জনা করো। 


আজ তোমার জন্য একটু বেশীই মন খারাপ করছে কি না, তাই ভাবলাম তোমায় একটা চিঠিই লিখি। যেমন লিখে,সেঁটে রেখে যেতাম ফ্রিজের গায়ে। তুমি তখন আরও অনেক অনেকটা ছোট। সকালের স্কুলে পড়ো। ভোর ভোর তোমায় ঘুম থেকে তুলে, একরাশ মনোবেদনা সহ ছেড়ে আসতাম স্কুলের গেটে। ভারি ব্যাগটা পিঠে নিয়ে প্রবল অনিচ্ছা আর অপরিসীম ক্লান্তি নিয়ে এগিয়ে যেতে যেতে একবার পিছন ফিরে তাকাতে তুমি, আমি হাত নেড়ে ইশারায় বলতাম এগিয়ে যাও। মাথা নীচু করে, মাটিতে পা ঘষতে, ঘষতে এগিয়ে যেতে তুমি। এরপর তোমার সাথে দেখা হতে-হতে সন্ধ্যা ঢলে পড়ত রাতের পথে।  


অধিকাংশ রাতেই তোমাতে পড়তে বসানো নিয়ে বাঁধত অশান্তি। দুচার ঘা উত্তমমধ্যম খেয়েই যেতে তুমি। সকাল হলে তোমায় স্কুলের গেটে ছেড়ে আসার সাথে-সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকত মনস্তাপ। প্রতিটি সকালে আমি নতুন নতুন করে উপলব্ধি করতাম,কতটা, ঠিক কতটা বদলে দিয়েছ তুমি আমায়। বদলে দিয়েছ জীবন তথা সম্পর্কের যাবতীয় সংজ্ঞা। বেশি শক্ত হয়ে গেল বুঝি, সহজ করে বলতে গেলে, বুঝতে পারতাম আমার জীবনের কতটা জুড়ে একচ্ছত্র রাজত্ব করো তুমি। অথচ রাতে ফিরে তোমায় পড়াতে বসালেই কিভাবে যেন কর্পূরের মত উবে যেত সারাদিন ধরে লালন করা যাবতীয় সুকুমার অনুভূতিগুলো। তাই আঁধার নামার আগেই লিখে রাখতাম চিঠিগুলো। 


মনে মনে ভাবতাম অনেককিছুই, লিখতে পারতাম থোড়াই। আর লিখে ফেললেই বা কি হত? না তুমি ভালো করে পড়তে পারতে বাংলা, না ইংরেজি। মনে আছে, বাবা তোমাকে ক্ষেপাতে বলত, ‘তুই অশিক্ষিত, তাই তোর আধারকার্ড হবে না। ’ একেবারে অশিক্ষিত না হলেও সদ্যস্বাক্ষর তো ছিলেই তুমি। তাই দুচারখানা মনের কথা লিখেই আঁকতে বসতাম ছবি। পড়তে না পারলেও ছবির ভাষা তুমি দিব্যি বুঝতে। হয়তো সব শিশুই বোঝে। ভালো তো আঁকতে পারি না,তবুও একটা যে কোন পশুর ছবি এঁকে, তার চোখ থেকে টপটপ করে ঝরে পড়া জলকণার ছবি আঁকলেই তুমি বুঝতে পারতে মায়ের মনে ঘনিয়েছে ঘোর কৃষ্ণ মেঘের ঘনঘটা। আপিস থেকে ফিরে হতভম্ব হয়ে দেখতাম, পাশে কচি কচি হাতে আঁকা ঐ পশুটিরই একটি শাবক। তারও মনে জমেছে মেঘ, তারও উছলে উঠেছে ছলোছলো আঁখি। মমির মন খারাপ, তাই বেবিটারও মন খারাপ বোঝাতে চাইতে তুমি। 


কখনও বা একটা বড় ফুল/পাখি বা বিড়ালের পাশে আরেকটা ছোট্ট ফুল/পাখি/বিড়াল এঁকে উভয়ের মাঝে একটা পুঁচকে পানপাতা এঁকে রেখে যেতাম। তুমি উভয়ের আসেপাশে এঁকে রাখতে আরো অনেক অনেক পানপাতা। বেবিটাও যে মাকে ভীষণ ভালোবাসে। কখনও কখনও তুমি খাতার পাতার কোণা ছিঁড়ে এঁকে রাখতে তিনটে বিভিন্ন মাপের পুঁচকে হাসিখুশি মুখ। তারপর উপহার দিতে আমাদের। উপহার পছন্দ হয়েছে কিনা জানার জন্য লোভাতুর দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে আমাদের মুখের পানে।


জানিনা তোমার মনে আছে কিনা, কিন্তু এমন প্রতিটা চিরকূট, প্রতিটি চিঠি যত্ন করে গুছিয়ে রাখতে বলতাম আমি। কারণ এই সমস্ত চিঠির আঁকিবুকি, সমস্ত ছবির বাঁকে লুকিয়ে আছে তোমার অমূল্য শৈশব। পুতগন্ধময় e-জগতের বাইরে তোমার একেবারে নিজস্ব মোমরঙের দুনিয়া। 


এই দেখো লিখতে বসেছিলাম আমার কথা, আমার বর্তমান পরিস্থিতি, আমার ভালো লাগা না লাগার কথা, অথচ লিখে চলেছি তোমার,শুধু তোমার কথা। মা হবার এটাই সবথেকে বড় যাতনা। জীবনটাই যে আবর্তিত হয় তোমাকে ঘিরে। তুমি হলে আমার সূর্য, আর আমি তোমার বুড়ো পৃথিবী। 


ইতি

তোমার মা।