Wednesday 29 May 2019

অনির ডাইরি মে ২০১৯

অনির ডাইরি ২২শে মে, ২০১৯
মা, হওয়া কি মুখের কথা? না বাপু, মোটেই মুখের কথা নয়। যেমন ধরুন, কি কুক্ষণে,যে তুত্তুরীকে বলেছিলাম, হৃদপিণ্ডের যে প্রচলিত প্রতীক, তা আসলে মানুষের পশ্চাৎদেশের উল্টানো প্রতিবিম্ব। মানে আমরা যাদের ভালোবাসি, শুধু তাদেরই নয়, ঘোরতর অপছন্দের পাত্র/পাত্রীকেও আমরা প্রয়োজন বিশেষে “হার্ট” পাঠাতে পারি। ফলশ্রুতি? আমার গোটা গায়ে, গোটা পাঁচেক বিভিন্ন বর্ণের হৃদপিণ্ডর ছবি জ্বলজ্বল করছে। অপরাধ? তুত্তুরীকে পর্যায়ক্রমে বকা, পড়তে বসতে বলা এবং গর্হিততম অপরাধ হল, তুত্তুরীর ভাগের তিনটি চকোলেট সাবাড় করে দেওয়া।
এখন আপনি বলতেই পারেন, এসব অসভ্য কথা, নিজের শিশুকন্যাকে শেখানোর কি দরকার ছিল বাপু? ওতো ছেলেমানুষ, তুমি বলবে, আর ও শিখলেই দোষ? কারণটা, ঐ যে বললাম মা হওয়া কি মুখের কথা? মোবাইল খোলার উপায় নেই মাইরি। যাই দেখতে বসি, যাকেই মেসেজ করতে বসি, যেই ফোন করুক, তিনি নিঃশব্দ চরণে পিছনে এসে দাঁড়াবেন। “কে ফোন করেছে?” “কি বলল?” “তুমি ঐ কথা বললে কেন?” “তুমি হাসলে কেন?” হরি হে মাধব, চান করব না গা ধোব! শৌভিককে এসব প্রশ্ন করে, বিশেষ সুবিধা হয় না, সদ্য জন্মানো বেড়াল বা কুকুরছানার মত ঘাড় ধরে, ঘর থেকে বার করে দেয়। মা হয়ে তো আর, অগত্যা-। তেমনি কোন ইংরাজি সিরিয়াল দেখার সময়, তিনি আমার ঘাড়ের ওপর দিয়ে হামলে পড়ে ছিলেন। তলার সাবটাইটেল দেখে খানিকটা বুঝেছিলেন, বাকিটা অবশ্য এই অধমই-।
আরো যে কত রকমের প্রশ্নাবলীর সম্মুখীন হতে হয়, “ছেলে হয়ে, ছেলেকে চুমু খাচ্ছে কেন?” “ছেলেতে- ছেলেতে বিয়ে হয় নাকি?” “ জন যে স্যামকে বিয়ে করল, ওদের বেবি হলে, কে বাবা হবে, আর কে মা?” “যেমন সারোগেট মাদার হয়, তেমনি সারোগেট ফাদার হয়?” “মা হলে তো উম্ব ভাড়া দেয়, সারোগেট বাবারা কি ভাড়া দেয়?”  “পেনি বিয়ের সময় অত মোটা হয়ে গেল কি করে? কি বললে? বেবি হবে? ওর তো এখনও বিয়েই হয়নি। বিয়ে না হলে, কারো বেবি হয়?” “ হয়?” “তাহলে তুমি খামোকা বাবাকে বিয়ে করতে গেলে কেন?”
শুধু কি তাই? তুত্তুরীর জ্বালায় ঘনঘন মোবাইলের পিন বদল করতে হয় আমাদের। ঈশ্বরের দিব্যি, আমাদের মোবাইলে কোন উল্টোপাল্টা জিনিসপত্র পাবেন না। বন্ধুবান্ধবদের পাঠানো ইল্লি মার্কা ইয়ে আমরা পারতপক্ষে ডাউনলোডই করি না। করলেও, একে অপরকে পাঠিয়েই ডিলিট। তবু ঘনঘন বদলাতে হয় কোড। উপায় কি? বছর চার পাঁচ আগের, কোন এক মধ্য রাতে, যখন শৌভিক এবং আমি গভীর নিদ্রামগ্ন, তুত্তুরীর কোন অজ্ঞাত কারণে নিদ্রাভঙ্গ হয়, এবং আমাদের সম্পূর্ণ অজ্ঞাতে জনৈক বড় সাহেবকে তুত্তুরী মেসেজ পাঠায়, “ইলেকট্রিক শক”।সাথে ২৫খানা ইমোজি। তখনও হোয়াটস অ্যাপে মেসেজ ডিলিট করা যেত না, নেহাত তিনি অত্যন্ত সহৃদয় ব্যক্তি, ঈশ্বর তাঁর মঙ্গল করুন। কিন্তু এই টেনশন নিয়ে বাঁচা যায়? আমরা নতুন কোড দি, আর মোবাইলের ওপর আঙুলের নাড়াচাড়া দেখে তুত্তুরী বুঝে যায়, নতুন কোড কি-।
মা হওয়া মোটেই মুখের কথা না, যেমন ধরুন, আপনি একদিক থেকে ঘরদোর সাফ করবেন, অন্যদিক থেকে অবিশ্বাস্য দ্রুততার সঙ্গে তাকে পুনরায় পূতিগন্ধময় করে তুলবে তুত্তুরী। সত্যি বলছি, জুতো রাখার র‍্যাক থেকে ওয়াশিং মেসিনের মাথা পর্যন্ত থরে থরে সাজানো, তুত্তুরীর বই, খাতা, খেলনা এবং পুতুল। দাঁড়ান, দাঁড়ান, গোটা পুতুল ভাবলেন নাকি? না মশাই। কোথাও পুতুলের মুণ্ডু পাবেন, কোথাও ধড়। কোথাও কিছুই পাবেন না, এক দু পাটি চপ্পল পাবেন কেবল।  আর পাবেন, ক্লাশ শেষে স্কুলের মাটি থেকে কুড়িয়ে নিয়ে আসা গুচ্ছ-গুচ্ছ, গুড়ি-গুড়ি পেন্সিল এবং রাবার। সবকটিই ব্যবহারের সম্পূর্ণ অযোগ্য, তবুও, ঐ গুলির প্রতি তুত্তুরীর যে কি অপরিসীম মায়া। এছাড়াও পাবেন, আমার বাতিল করে দেওয়া বিবর্ণ ঝুটো গয়নাগাটি এবং কয়েকশ পেস্তার খোলা। ক্র্যাফট বানাবে তুত্তুরী, তাই যত্ন করে জমিয়ে রেখেছে। মাঝে মাঝেই গোনাগাঁথা করে দেখে, কিছু হারায়নি তো? আরও পাবেন শেষ হয়ে যাওয়া কয়েক ডজন স্কেচ পেন, যে গুলি, সময় বিশেষে দেওয়ালে ঘষে দেখা হয়,রঙ সত্যিই শুকিয়ে গেছে কি না। নতুন কোন শব্দ শিখলেও আগে তা দেওয়ালে লেখে তুত্তুরী। মাঝে মাঝে পুরানো পড়াও কি সুন্দর দেওয়ালে লিখে অভ্যাস করে। ঐ জিনিসটাই খাতায় লিখতে বলুন, দেখি-। কি বাজে লোক মশাই আপনি। অখাদ্য। ঠিক তুত্তুরীর মায়ের মত। শুধু পড়া নয়, মাঝে মাঝে ছবিও আঁকে তুত্তুরী। অবশ্যই দেওয়ালে। ভালো না হলে আবার ইরেজার দিয়ে মুছেও দেয়, অবশ্য।সেসব ছবি দেখে মাঝে মাঝে আমাদের হার্ট অ্যাটাক হবার উপক্রম হয় যদিও।
আরো অনেক কিছু করে তুত্তুরী, যেমন বোতল-বাটি- ঘটি- গ্লাসে করে ডিপ ফ্রিজে বরফ জমায় তুত্তুরী। অবশ্যই মায়ের অসাক্ষাতে। মামমামকে (দিদা) গায়ের জোর দেখাতে, ভিডিও কল করে, আসবাব পত্র ধরে পর্যায়ক্রমে টানাটানি এবং ঠেলাঠেলি করে তুত্তুরী। গ্লুকন ডি জলে গুলে, আইসক্রিম বানায় তুত্তুরী। ফুল ফুটতে দেরী হলে, গাছ গুলোকে প্রবল ধমকায় তুত্তুরী এবং সর্বোপরি ড্রয়ারের কোন কোণে অনাদরে পড়ে থাকা বাতিল মোবাইল ফোনে চার্জ দিয়ে সেটাতে আবোলতাবোল ভিডিও তোলে তুত্তুরী-

অনির ডাইরি ২৬শে মে, ২০১৯

বললে বিশ্বাস করবেন কি না জানি না, আমার না, দুধ কেটে গেল প্রচণ্ড আনন্দ হয়। কোথায় যেন পড়ছিলাম, প্যাকেট বন্দী হবার, দুদিনের মধ্যে যদি দুধ না কাটে, তাহলে,“তু শালা কাম সে গ্যায়া”।  ওটা দুধ নয়, সোডা আর গন্ধক। একটু কয়লার গুড়ো মেশালেই তুবড়ি- । সত্যি মিথ্যা জানি না বাপু। তবে মাদার ডেয়ারির দুধ কিন্তু ফ্রিজে থাকলেও দু- একদিনের মধ্যেই কেটে যায়। কাটে না আমুল তাজা।
না, না এবং না। আমুলের ওপর ছিটেফোঁটাও অবিশ্বাস করছি না। আমি এবং আমার কন্যা উভয়েই আমুলের দুধ খেয়েই বেড়ে উঠেছি। অধম তো আজও বাড়ছে। বহরে নয়, আড়ে যদিও। আমুল স্প্রে তো আমি আজও এমনি এমনি খাই।পেলেই হল।
কিন্তু আপদ দুধ কাটেই না। ছোটবেলায় কেটে যাওয়া দুধের ছানাকে ঘি আর চিনি দিয়ে তাড়ু মেরে কি অসাধারণ সন্দেশ বানাত মা। গাওয়া ঘি আর এলাচের ভুরভুরে গন্ধওয়ালা ঝুরোঝুরো সন্দেশ- আঃ সাক্ষাৎ জর্জ ক্লুনি।
তবে সচরাচর মা কেটে যাওয়া দুধের ছানা দিয়ে কোন কিছুই বানাতে চাইত না। যাবতীয় সুখাদ্যের প্রতি কেন যে মায়ের ভয়ানক বিরাগ কে জানে। যেমন ধরুন দিদার বাড়ির পান্তাভাত। আহাঃ।দিদার বাড়ি ছিল, সেই উত্তরবঙ্গের সীমানা ঘেঁষা, মুর্শিদাবাদের এক অজ গাঁয়। গ্রামের নাম রামনগর। শিয়ালদা থেকে আটটার লালগোলা ধরে,নৈহাটির ঝালমুড়ি,কাঁচরাপাড়ার শোনপাপড়ি, কালিনারায়ণপুর জং এর কাটা সিদ্ধ ডিম, রাণাঘাটের  লুচি-তরকারি,কাঁচের  বাক্সে কৃষ্ণনগরের সরভাজা সাঁটিয়ে বারোটা- সাড়ে বারোটা নাগাদ নামতে হত পলাশী। অতঃপর রিক্সায় চড়ে, টলটল করতে করতে পলাশীর ঐতিহাসিক আমবাগানের ভিতর দিয়ে গঙ্গার ঘাট। পথের কোন একটা বাঁকে, বিশাল ধানক্ষেতের মাঝে ছিল তিনটি ফলক, সুবে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজৌদ্দল্লা - আর তাঁর যোগ্য অনুগামী মীর মদন আর মোহনলালের স্মৃতিতে উৎসর্গীকৃত। পাশেই ছিল একটা শিমূলতুলোর গাছ।মিহি তেলতেলে তুলো উড়ে বেড়াত গোটা সমাধি ক্ষেত্র জুড়ে। যেন প্রকৃতির শ্রদ্ধার্ঘ।
হাতে টানা নৌকায় গঙ্গা পেরিয়ে ওপাড়ে রামনগর।পারানির কড়ি,ছিল কয়েক পয়সা মাত্র।  বুঝতেই পারছেন,  বছরে একবারই যাওয়া হত সাকুল্যে। আর পাঁচটা তৎকালীন গ্রামের মতই, রামনগরবাসীদের প্রাতঃরাশ হত পান্তা খেয়ে। বাবা বা মেসোমশাই মার্কা শহুরে জামাইদের জন্য অবশ্য লুচি ভাজা হত। পাটকাঠির আগুনে। আর আমাদের জন্য, মাটির হাঁড়িতে সিদ্ধ, ঘরের লালচে চালের ভাত, সারারাত ভিজে,পরের দিনে তৈরি হতো পান্তা। হাল্কা টক ভাব না এলে সেটা পান্তা হিসেবে মোটেই কৌলিন্য পেত না।  নেহাত অর্বাচীন। মাটির মেঝেতে মাসিদের হাতে তৈরি, লাল ঝালর দেওয়া আসনে বসে,  “পুরী” লেখা অ্যালুমিনিয়ামের থালায় অল্পভাত, অনেকটা জল। ডেলা পাকানো কড়কড়ে নুন, ঘানি ভাঙা বিটকেল গন্ধওলা, সর্ষের তেল। চাষের জমির ছোলা, ঘরে পাটকাঠির আগুনে ভেজে, জাঁতায় গুঁড়িয়ে বানানো ছাতু। আউস চালের মুড়ি। ছোট্ট ছোট্ট গ্রাম্য কাঁচা পেঁয়াজ আর কাঁচালঙ্কা। এ বলে আমায় দেখ, ও বলে আমায়। এক কামড় মারলেই, নাক এবং কান দিয়ে যুগপৎ ধোঁয়া বেরোতো। আর দিদার হাতে বানানো, খেতের মুসুর ডালের তলতলে বড়া। উফ্। সাক্ষাৎ স্বর্গ। কিন্তু মা কিছুতেই খেতে দিত না মাইরি। খেলে নাকি মোটা হয়ে যাব। যেন আমি কোনদিন রোগা ছিলাম। স্টিলের থালায়,পরিপাটি করে সাজানো ধপধপে সাদা জুঁই ফুলের মত ফুলকো লুচি আর হলুদ ছাড়া আলুর তরকারী আর শেষপাতে ঘি গন্ধী সুজির হালুয়া বা দেশের রসগোল্লা দেখলে আমার কান্না পেত- দিদার বাড়ির পান্তার পাশে সাদা ময়দার লুচি? যেন লুচি রসগোল্লায় ক্যালরি কম থাকত।

পান্তার মতই,  কেটে যাওয়া দুধও মায়ের কাছে ছিল অবশ্য পরিতাজ্য। কেটে গেছে মানেই পচে গেছে। ছিঃ ওসব পচাপাতকো জিনিস কারো বাচ্ছা খায়? আব্দারের মাত্রা সীমা ছাড়ালে, লেবু দিয়ে কাটানো দুধের ছানা দিয়ে মাঝেমাঝে ঐ ঝুরো সন্দেশ তৈরি হত বটে, তবে তা মোটেই সুখাদ্য হত না। লেবুর গন্ধ আর ঘিয়ের গন্ধ,কেমন যেন লাঠালাঠি এবং কাটাকাটি করে দিত বারোটা বাজিয়ে, আসল সোয়াদটাকে।
নিজের সংসার শুরু করা ইস্তক কতবার দুধ কেটেছে, গাঁট গুনে বলতে পারি। আর আপনি শোনাচ্ছেন বিশ্বায়ন আর উষ্ণায়নের গপ্প। রাখুন মশাই।
যাই হোক, আজ হেব্বি মজা হল,সকাল সকাল দুধটা গেল কেটে। উফ্ কার মুখ দেখেছিলাম কে জানে।নিজেরই বোধহয়।  আসলে প্যাকেটটা ছিল বিগত ২৩তারিখের। কিভাবে যেন চিলারের এক কোণায় তিনি জায়গা করে নিয়েছিলেন। ফলতঃ তুত্তুরীর মাসিমণির নজরে আসেননি। সপ্তাহান্তে যখন রন্ধনশালের দায়িত্ব অর্পিত মম স্কন্ধে, তখন তিনি পর্যায়ক্রমে আবিষ্কৃত এবং উত্তপ্ত হলেন। অতঃপর পড়লাম আতান্তরে। কি করা যায়? তুত্তুরী তো আপাততঃ হাওড়ায়। দাদু এবং দিদার নিরাপদ ছত্রছায়ায়। সন্দেশ বানালে খাবে কে? আমার বরের এখনও পঞ্চাশ হতে ঢের দেরী, তবে তিনি পুরোদস্তুর মিডলাইফ ক্রাইসিসে আক্রান্ত। ওসব চিনি মিষ্টিতে তাঁর ঘোর অনীহা।  তদোপরি তিনি তাঁর শাশুড়ী মাতার যোগ্য জামাতা, দিবারাত্র কি খেলে আমি ফেটে যাব, সেই তত্ত্বানুসন্ধানে ব্যাপৃত। সর্বোপরি এই প্রথমবার দেখলাম, কেটে যাওয়া দুধের ছানাটায় হাল্কা বোঁটকা একটা গন্ধ। উষ্ণায়ণের তত্ত্ব এবং তথ্যাবলী বোধহয় ততোটা ভ্রান্ত নয়। কি কন?

তাই বলে ফেলে দেব? আমিও আমার শাশুড়ীমাতার যোগ্যা শিষ্যা, উনি কোন জিনিস ফেলেন না। খাদ্য সাক্ষাৎ মা লক্ষ্মী। এর থেকেও বড় কথা হল, “কেউ যদি বেশি খাও, খাবার হিসেব নাও/কেননা অনেক লোক ভাল করে খায় না। ”
কি যে করি,ভাবতে ভাবতেই ছাঁকনির ওপর উল্টে দিলাম কেটে যাওয়া দুধের গামলা। জল ঝরলে, একটু কর্নফ্লাওয়ার, নুন আর চিনি দিয়ে বেশটি করে চটকে, এক আইসক্রীম চামচ লঙ্কাগুঁড়া মিশিয়ে, সাদাতেলে ভেজে নিলাম। মন্দ হল না, মিষ্টি মিষ্টি ছানার চ্যাপ্টা চ্যাপ্টা নরম নরম বড়া।তবে গন্ধটা কেমন যেন হাল্কা হাল্কা রয়েই গেল।হয়তো মনেরই ভুল।
অতঃপর  প্যানে পর্যায়ক্রমে সাদা তেল, জিরে,গোটা দুয়েক শুকনো লঙ্কা, একটি তেজপাতা, ৪-৫টি কাবাবচিনি, ৪/৫টি সাদা এবং কালো মরিচ দিয়ে, তাতে মিহি করে বাটা, পোস্তএবং কাজুবাদাম, একচামচ ধনে গুঁড়া, লঙ্কাগুঁড়া আর দেড় দু চামচ টকদই ,পরিমাণমত নুন আর একটু বেশী মিষ্টি দিয়ে কষে, যখন তেল ভেসে উঠল, পরিমাণমত জল আর বড়া গুলো দিয়ে ফুটিয়ে  নিলাম।মাখোমাখো হয়ে এলে, নামিয়ে নিয়ে শুকনো ভাতের সাথে গপাগপ্। রান্না হবার পরে, বোঁটকা গন্ধটা আর পাইনি।
বারো ঘন্টা কেটে গেছে, পাকযন্ত্রে এখনও কোন ক্রটি পাইনি।  শৌভিক যদিও কেটে যাওয়া দুধের গল্প জানে না। জানলেও কোন চিন্তা নেই,বলে না দিলে ও কোন বদ গন্ধই পায় না,অন্তত খাবারে।  মন্দ হয়নি কেটে যাওয়া দুধের ছানার ডালনা। ছানা কাটানো পাউডার দিয়ে করে দেখতে পারেন। ঘি-গরম মশলা দিয়ে দেখতে পারেন। তবে যাই বলুন,কেটে যাওয়া দুধের ছানার সোয়াদই আলাদা- । কেমন যেন ফিরে ফিরে আসে শৈশব।

অনির ডাইরি ২৯শে মে, ২০১৯

জনাকীর্ণ মহানগরের উপান্তে, ধুলিমলিন ক্লান্ত সড়কের এক অবহেলিত কোণে, সারি সারি দু তিনটি দোকান। প্রতিটা দোকানের সামনে গুটি কয়েক বিবর্ণ, ছাল ওঠা প্লাস্টিকের চেয়ার। দোকান আর চেয়ারের মাঝখান দিয়েও বয়ে চলে জনস্রোত।ভেসে আসে মেহনতী জনতা আর টগবগে জীবনের সৌরভ।   “আইয়ে বাবু,লস্যি খাইয়ে। লস্যি খাবেন নাকি! ও দিদি! আও বাবু আও। ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা মিঠা মিঠা লস্যি। ” আসব তো বটেই। আসবার জন্যই তো এই ঝাঁ ঝাঁ রোদে আমরা মা মেয়েতে হাওড়া ময়দানে এসে নেমেছি।
সেই সত্তরের দশকে এটাই ছিল বাবা-মায়ের প্রিয় হ্যাংআউট স্পট। দুই ইয়া বড় ভাঁড় “মালাই মারকে” লস্যি হাতে চলত প্রেমালাপ। বাবা অবশ্য এসব কথা তুললেই,মা রেগে যায়। কারণ বাবার গল্প অচীরেই লস্যি ছেড়ে আমার বড় মেসোমশাইয়ে গিয়ে কেন্দ্রীভূত হয়। শৈশবে পিতৃহারা মা মাসিরা বড় ভয় পেত তাদের দুই নম্বর বাবাকে। অর্থাৎ বড় মেসোমশাইকে। সেই নিয়ে সেদিন অবধি কি খিল্লি যে করত বাবা।
নব্বইয়ের দশকে, পিকচার থেকে মা আউট। এটা হয়ে দাঁড়াল আমাদের বাবা আর মেয়ের আড্ডা মারার জায়গা। “মালিক দো লস্যি,বড়া ভাঁড়মে। মালাই মারকে।” রাজকীয় চালে বলত বাবা। তারপর সামনে রাখা কাঠের লড়বড়ে বেঞ্চে বসতাম আমরা। হাঁ করে দেখতাম,সরু পায়ে চলা পথের ওধারে ফুল ছাপ্পা ওয়েল ক্লথ ঢাকা উঁচু কাঠের টেবিলের ওপর সারি সারি মাটির ভাঁড়ের প্রাসাদ। একপাশে জ্বলন্ত উনুনে টগবগ করে ফুটছে ঘণ দুধ। দুধের ওপর ইয়া মোটা সর। তার পাশেই মাটির গামলায় কাপড় ঢাকা দই। কি অনুপম মাপে, একটা অ্যালুমিনিয়াম হাতা দিয়ে কয়েক হাতা দই তুলে একটা অ্যালুমিনিয়ামের ঘটি টাইপ পাত্রে ঢেলে, ছোট চায়ের ভাঁড়ের এক দু ভাঁড় চিনি মিশিয়ে, একটা খর্বাকৃতি গোলাকার কাঠের ডান্ডা দিয়ে মা যশোদার ঘোলমৌনির  মত ঘটঘট করে বার কয়েক ঘেঁটে নিয়ে, কাঠের গুঁড়ো মাখানো বরফের চাঁইকে ধাঁই ধাঁই করে পিটিয়ে, খানিক ঝুরো বরফ মিশিয়ে আবার শুরু হল ঘাঁটা। অবশেষে বাবা স্পেশাল বিশাল ভাঁড়, যা শৈশবে গামলা ভেবে পুলকিত হতাম, দুবার উল্টো করে ঠুকে নিয়ে, অনেকটা ওপর থেকে ঢালা দুগ্ধফেননিভ লস্যির ওপর অনেকটা মালাই ভাসিয়ে বাড়িয়ে দিত বুড়ো মালিক। বাবা আবার দেখে নিত,“মালাই ঠিক সে দিয়ে না মালিক?” মালিক তার লাল ঝোলা দাঁত বার করে হাসত,“হাঁ বাবু। আপনাকে কি বলতে লাগে?” তারপর জমত গল্প।   জুলে ভার্নে থেকে মঁপাসা হয়ে গড ফাদার।এমনকি হ্যাডলি চেজ। মহান মার্ক্স- এঙ্গেলেস্। ডায়লেকটিক্স অব নেচার।  লেনিন-স্ট্যালিন- মাও। ছেচল্লিশের দাঙ্গার টুকরো স্মৃতি- খাদ্য আন্দোলন। এমনকি স্কুল বা কলেজের কোন দুষ্টু শিক্ষককে জব্দ করার গপ্পও।  গল্প শুনতে শুনতে গরম হয়ে যেত লস্যি। বুড়ো মালিক বসে থাকত, ইনস্টিঙ্কট বশতঃ ভাঁড় বাড়িয়ে দিতাম আমরা। আবার ভরে উঠত ফেনিল লস্যিতে। তবে মালাই আর পেতাম না।
নতুন সহস্রাব্দের শুরুতেই অমৃতলোকে পাড়ি দিল বুড়ো মালিক। তার ছেলেরা অবশ্য বাঁচিয়ে রেখেছে দোকানটাকে। প্রতিটা চাকরীর পরীক্ষা দিয়ে এসে, বাপ মেয়ে ঠেক জমাতাম লস্যি হাতে। কত ব্যর্থতা কত মোহভঙ্গের স্মৃতি জড়িয়ে দোকানটার সাথে। দুভাঁড় লস্যি নিয়ে আকাশকুসুম স্বপ্ন সাজাতাম আমরা। মা বলত, “ রাতে ছেঁড়া কাঁথাটা পেতে শুস। বাপ মেয়েতে। ” সব স্বপ্নই একদিন সত্যি হল। আজকাল বাপমেয়ে আড্ডা মারি, অন্য শীতল পানীয় হাতে, ঠিক যেমন একদিন স্বপ্ন দেখেছিলাম।
এবার তুত্তুরীর পালা। মোলাকাৎ হোক জীবনের সাথে। আপাত রুক্ষ নির্দয় জীবনের মাঝে খুঁজে নিক প্রাণধারা। ও বলতে শিখুক,“লাভ ইউ জিন্দেগী। লাভ মি জিন্দেগী। ”

Saturday 4 May 2019

চন্দ্রকান্তমণি

চন্দ্রকান্তমণি- (c) Anindita Bhattacharya

“দুধ ম্যাডাম”।
“  থ্যাঙ্কস্ এডওয়ার্ড। ” আশি বছরের মিস মার্থার দুচোখে ফুটে উঠল পরম বিশ্বাস। ফুটবে নাই বা কেন? বিগত ছাপ্পান্ন বছর ধরে এই একই রুটিন চলে আসছে। প্রতিরাতে আমি একগ্লাস উষৎ উষ্ণ দুধ এনে দি ম্যাডামকে।  দুধ ছাড়া ওণার ঘুম আসেনা। এই গডউইন কাসলের বিশ্বস্ত বাটলার আমি এডোয়ার্ড অস্টিন। ম্যাডামের সব অভ্যাস, পছন্দ, অপছন্দ আমার নখদর্পনে। ম্যাডাম আমায় চোখ বন্ধ করে ভরসা করেন। কেনই বা করবেন না,বিগত ছাপান্ন বছরে একটাও অবিশ্বাসের কাজ করেছি আমি? আজ ছাড়া।
মাপ করে দেবেন ম্যাডাম। মাপ করে দেবেন মৃত শ্রী এবং শ্রীমতী গডউইন। ওণাদের পবিত্র আত্মা শান্তি পাক। ওণাদেরও পরম স্নেহভাজন ছিলাম যে আমি। গডউইনদের সেবায় আত্মনিয়োগ করতে গিয়ে কবে যে ঝড়ে গেল যৌবন,তার হিসেব রাখিনি। আমি নির্লোভ বিশ্বস্ত বাটলার এডোয়ার্ড অস্টিন, আজ করে বসেছি এক চরম অন্যায়।কিন্তু আমি নিরুপায়।
যেদিন থেকে নতুন অথিতির প্রবেশ ঘটেছে এই গডউইন কাসলে, আমি বোধহয় পাগল হয়ে গেছি।

মিঃ মার্কাস এসে যখন একান্তে কথা  বলছিলেন, ম্যাডামের উচিৎ হয়নি আমাকে ডাকা। কেন যে ডাকতে গেলেন। মিঃ মার্কাস মোটেই স্বচ্ছন্দ বোধ করছিলেন না। আমিও না। ম্যাডামের অনুরোধে ঢেঁকি গিললাম দুজনে। মিঃ মার্কাসের পরিচয়টা দিতে ভুলে গেছি বোধহয়, বয়স হলে এমনি হয়। মিঃ মার্কাস হলেন জেনকিন্স পরিবারের উকিল। জেনকিন্স আর গডউইনরা সম্পর্কে আত্মীয়। আত্মীয়তা যদিও বহুদূরের। তা জেনকিন্স পরিবারের শেষ উত্তরাধিকারী তথা ম্যাডামের কাজিন মিঃ উইলিয়াম জেনকিন্স সম্প্রতি মারা গেছেন। উইলের বয়স বেশী নয় কিন্তু। বছর ২৩-২৪। কি যে হয়েছিল, বোধহয় মানসিক বিষাদে ভুগছিলেন। ঠাকুরদার বিশাল দোনলা বন্দুকের নলটা গলার নলিতে ঠেকিয়ে টিপে দেন ট্রিগার। দুম্।
উইল একা নয়। জেনকিন্সদের বিষাদের ইতিহাস আছে বাবু। উইলের ঠাকুরদা মিঃ জেমস্ জেনকিন্স, উনি আর্মির বড় অফিসার ছিলেন। কর্মসূত্রে ওণাকে পাড়ি দিতে হয় সুদূর ভারতবর্ষ।  অনেক নেটিভ ভারতীয় রাজ্যের বিরুদ্ধে বৃটিশ আর্মিকে উনি নেতৃত্ব দেন। শত্রুপক্ষকে নির্দয় ভাবে কচুকাটা করার বদনাম বা সুনাম ছিল ওণার। ইন্ডিয়ান পুরুষ বা নারী ছিল ওণার দুচক্ষের বিষ।শিশু থেকে বৃদ্ধ,  পুরুষগুলোকে কচুকাটা করতেন, আর নারীদের-। এই বিরাশি বছর বয়সে এটুকু বলতে পারি, ভারতীয় নারীদের ওণার ছিটেফোঁটাও পছন্দ ছিলনা। তবে তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে নির্দয় ভাবে তাদের উপভোগ করার মধ্যে একধরণের পৈশাচিক আনন্দ পেতেন মিঃ জেমস্। বলতে পারেন জাতিশ্রেষ্ঠত্বের অহংকার তৃপ্ত হত ওণার।তবে অভিজাত বিজিত রমণী ছাড়া কাউকে স্পর্শ করতেন না তিনি। রাণী/বেগম বা রাজপরিবারের রমণীদের ধর্ষণ করে তীব্র জাতিশ্রেষ্ঠত্বের শ্লাঘা অনুভব করতেন তিনি। ওণার অত্যাচার আর নিষ্ঠুরতার গল্প ছিল কিংবদন্তী। পৌঁছেছিল খোদ ইংলণ্ডেশ্বরীর কানেও। কোম্পানী ওণাকে বাঁচাতে কম অর্থব্যয় করেনি। কিন্তু লাভ হয়নি। কথিত আছে একজাহাজ সোনা-দানা-হিরে জহরৎ নিয়ে ফিরে আসেন মিঃ জেমস্ জেনকিন্স। তারপরই কি যে হয়,বছর পাঁচেকের মধ্যেই ঐ একই দোনলা বন্দুক দিয়ে নিজেকে শেষ করে দেন তিনি। ঠিক ঐ একই ভাবে। যেভাবে ওণার নাতি উইল শেষ করেছিল নিজেকে।
উইলের অবশ্য আত্মহত্যা করাটা অস্বাভাবিক না। চোখের সামনে রাতারাতি টাকার কুমির থেকে পথের ভিখিরি হয়ে গেল জেনকিন্স পরিবার।মিঃ জেমসের লুট করে আনা অত ভারতীয় ধনরত্ন যে কিভাবে নিঃশেষিত  হয়ে গেল তা আজও লণ্ডনের অভিজাতদের বিস্ময়।  কিভাবে যে এরা টাকা ওড়ায়,  তা আমার মত সাধারণ ইংরেজ বাটলার কল্পনাও করতে পারবে না। শুধু কি তাই? কতগুলো মৃত্যু ঘটল জেনকিন্স পরিবারে,গুণে শেষ করা যাবে না। বলতে গেলে সব অপঘাতে মৃত্যু।
এমনিতে যে জেনকিন্স আর গডউইন পরিবারের সম্পর্ক মধুর,তা বলা যায় না। বিগত শত বছরে কেউ কারো মুখ দেখেনি। কিন্তু জেনকিন্সদের আপন বলতে তিনকুলে আর কেউ নেই,তাই উইলের মৃত্যুর পর তার সম্পত্তি ম্যাডামের ভাগ্যে জুটেছে।

দাঁড়ান। দাঁড়ান। সম্পত্তি বলতে আপনারা কি ভাবছেন? বলেছি না জেনকিন্সরা কপর্দকশূন্য।সদ্য আত্মঘাতী উইলের বাড়িটাও বন্দক। আর ছাড়াবার সামর্থ্য গডউইনদের নেই। ম্যাডামও উকিল বাবুকে তাই বোঝাচ্ছিলেন। আমায় ডাকলেন সাক্ষ্য দিতে। শুঁড়ির সাক্ষী মদ্যপ আরকি।
উকিল বাবু বিরক্ত হয়ে উঠে গেলেন। যাবার আগে ম্যাডামকে একটা টিনের কৌটো আর একটা চিঠি দিয়ে গেলেন। পাতি গোল টিনের কৌটো। গায়ের রঙটাও উঠে গেছে। ম্যাডামের নির্দেশে আমিই খুললাম। খালি।
খালি তো হবারই কথা ম্যাডাম। উইল আপনার তুতো কাজিন হতেই পারে। তাই বলে সে যে পথের ভিখারি তা নিয়ে তো কোন দ্বিমত নেই?ফেলে দিতে চাইলাম কৌটোটা। নোংরা টিনের কৌটো। ইন্ডিয়ায় তৈরি।গায়ের লাল সোনালী হাতি ঘোড়া বিবর্ণ। রঙ চটা।  ম্যাডাম দিলেন না। পরের দিন আটেক শুধু ঐ কৌটো আঁকড়ে পড়ে রইলেন ম্যাডাম। না না ধারালো যন্ত্র দিয়ে এফোঁড় ওফোঁড় করছিলেন কৌটোটাকে। করতে করতেই একদিন টপ করে খসে পড়ল ম্যাডামের কোলে। পায়রার ডিম?না না দরজার নবের মত প্রকাণ্ড একটুকরো পাথর। পূর্ণিমার চন্দ্রের মত সৌম্য তার কান্তি। মুহূর্তে ফায়ার প্লেসের আগুনে চকমক করে উঠল। ছিটকে বেরোল তার দ্যুতি। এক টুকরো দ্যুত্যি প্রতিফলিত হল মোর মুখমণ্ডলে। পলকে যেন প্রগাড় শান্তি নেমে এল মোর শিরা ধমনীতে। এই তো সে। আমার মোক্ষ।
ম্যাডাম ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখছিলেন। দেখছিলাম আমিও। ম্যাডাম যেই তাকে ড্রয়ারে রাখতে যাবেন,খপ করে চেপে ধরলাম ম্যাডামের হাত। না। না। না। এ পাথর,এই মণি শুধু এডোয়ার্ড অস্টিনের। জীবনে আমার এইরূপ দেখেননি ম্যাডাম।আমিওকি ম্যাডামের এইরূপ দেখেছি? দুই নরপিশিচের মত ঝাপটাঝাপটি করছিলাম আমরা। দুজনের মুখদিয়েই বেরোচ্ছিল রক্তজল করা আওয়াজ,“দেঁ-দেঁ-দেঁ। এই মঁণি আঁমার”। ডেইজি, ম্যাডামের সেক্রেটারি দৌড়ে এসেছিল আমাদের অতিপ্রাকৃত চিৎকারে। “এ কি?” চিৎকার করে উঠেছিল ডেইজি। পলকে যেই তাকালাম ডেইজিরর দিকে, আলগা হল মুঠি, খপ্ করে মণিটা কেড়ে নিলেন ম্যাডাম। আর তারপর পাশে রাখা ওয়াকিং স্টিকটা তুলে নিয়ে বসিয়ে দিলেন সপাৎ করে এক বাড়ি। মাথা কেটে ঝরঝর করে ঝরতে লাগল রক্ত। সম্বিত ফিরে পেলাম ম্যাডাম আর আমি। সামলে নিলাম দুজনেই। ছুটে বেরিয়ে গেলাম ম্যাডামের ঘর থেকে। পিছন পিছন দৌড়ে এল ডেইজিও।
এরপর কেটে গেছে একপক্ষ। নিজের ছন্দে ফিরেছে গডউইন কাসল। ম্যাডাম ক্ষমা করে দিয়েছেন আমাকে। ক্ষমা চেয়েওছেন। আমি শুধু জানতে চেয়েছি,“ওটা কি ছিল ম্যাডাম?ওটা কোথায়?” জবাবে ম্যাডাম বলেছেন,“ওটা নিয়ে তোমায় ভাবতে হবে না এডওয়ার্ড। খুব যত্নে রেখেছি ওকে। ও মণি আমার শেষ বয়সের পরম প্রাপ্য। জানো ভারতীয়রা কি বলে ওকে? চন্দ্রকান্তমণি। ”
চন্দ্রকান্তমণি! হ্যাঁ ঐ চন্দ্রকান্তমণি,  শুধুই এডওয়ার্ড অস্টিনের। বিগত একপক্ষ ধরে ফিসফিস করে কত কথা বলেছে সে আমার সাথে। ম্যাডাম ভাবছেন এডোয়ার্ড জানে না,চন্দ্রকান্তমণি কোথায় লুকানো আছে,কিন্তু ম্যাডাম জানেন না, চন্দ্রকান্তমণি স্বয়ং অহর্নিশ ঘোষণা করে চলেছে কোথায় আছে সে। আজ অমাবস্যা। ইন্ডিয়ান ফেরিওয়ালাটা বলছিল, এই অসুধের গুণ অমাবস্যায় ভালো খোলে। ম্যাডাম এখনও জানেন না, ৫৬বছরের বিশ্বস্ত এডওয়ার্ড ম্যাডামের দুধে মিশিয়েছে গুণে গুণে ছটা গুলি-। এডওয়ার্ড তো একটাই দিতে চেয়েছিল,চন্দ্রকান্তমণিই বলল,“আরো দে। আরো। আরো। আরো। ”
(চলবে?)
চন্দ্রকান্তমণি পর্ব-২

দুধের গ্লাস শেষ হতে না হতেই,ম্যাডামের মাথাটা হেলে পড়ল বালিশের ওপর। মুখমণ্ডল  থেকে ধীরে ধীরে মুছে গেল সজীবতার উষ্ণ লালিমা। ধিকিধিকি ফায়ার প্লেসের আগুন ছাড়া কেউ জানল না। বাইরে তখন ঝিরিঝিরি তুষারপাত হচ্ছে। আজ ঠাণ্ডাটা বড় জব্বর। পশমী কম্বল টেনে দিলাম,ম্যাডামের গলা অবধি। ফায়ারপ্লেসের আগুনের প্রশয়ে লুকোচুরি খেলছে আলোআঁধার। দেরাজের চাবি ম্যাডামের বালিশের নীচে থাকে। দেরাজের ভেতরে তন্নতন্ন করে খুঁজছি, কোথায় সে? জামাকাপড়ের  আবডালে লুকানো ফোকরে। নেই। বুকশেল্ফে মূল্যবান চামড়া দিয়ে বাঁধানো সোনার জলে নাম লেখা শতশত বই,টান মেরে মেরে ফেলে দিলাম মাটিতে। নেই। ম্যাডামের ডেস্ক তোলপাড় করে ফেললাম।  নেই।  সব টানা ড্রয়ার খুলে তছনছ করে ফেললাম। নেই । নেই নেই কোথাও নেই। আবেগে থরথর করে কাঁপছি আমি। হঠাৎ ম্যাডামের কাঁপা কাঁপা গলা ভেসে এল-“এডওয়ার্ড মণি খুঁজছ?ঐ মণি অভিশপ্ত।” চমকে তাকিয়ে দেখি, ম্যাডাম আবার পূর্ববৎ নির্জীব হয়ে পড়েছেন। ঝাঁপিয়ে পড়লাম। না। না। না। এভাবে আমাকে ফাঁকি দিতে দেবো না। বলো কোথায় আমার মণি? ম্যাডাম একই রকম নির্জীব হয়ে পড়ে রইলেন। নিষ্প্রাণবৎ। কিন্তু আমি জানি, সব ম্যাডামের অভিনয়। পাশ থেকে বালিশ তুলে চেপে ধরলাম ম্যাডামের মুখে,এতটুকু প্রতিবাদ করলেন না ম্যাডাম।শরীর ইতিমধ্যেই বরফের মত ঠান্ডা।  মৃতের আবার শ্বাস নেবার কি প্রয়োজন। কিন্তু এই মাত্র যে কথা বললেন ম্যাডাম?
পিছন থেকে চিৎকার করে উঠল এক মহিলাকণ্ঠ। চমকে তাকিয়ে দেখি ডেইজি। ম্যাডামের সেক্রেটারি। ডেইজি নীচের ঘরে শোয়। হয়তো আমিই মালপত্র টানাহেঁচড়া  করতে গিয়ে বেকার শব্দ করে বসেছি। ডেইজি চিৎকার করেই চলেছে, ঝাঁপিয়ে পড়তে গেলাম ডেইজির দিকে। ঝলঝলে রাতপোশাক গুটিয়ে দৌড়ল ডেইজি, সমানে চিৎকার করছে বাঁচাও। বাঁচাও।
ইদানিং ম্যাডামের সব চিঠিপত্র,কাগজ,দস্তাবেজ সামলায় ডেইজি। নির্ঘাত মণিটা ওর হেফাজতেই আছে। মণি আমার চাই। মণি আমায় ডাকছে। সিঁড়ির বাঁকে ধরে ফেললাম ডেইজিকে, সপাটে এক চড়। ছিটকে নীচে পড়ল ডেইজি। সিঁড়ির রেলিংএ ঠকাস করে ঢুকল মাথাটা। ঘাড়টা কেমন যেন খড়ভরা পুতুলের মত বেঁকে গেল। চোখ খুলেই পড়ে রইল ডেইজিই লাশ। দুচোখে সীমাহীন আতঙ্ক। আমার বিরাশি বছরের বুড়ো শরীর এবার জবাব দিচ্ছে। হাপরের মত হাঁপাচ্ছি। হাঁটুগুলো এবার ভেঙে পড়বে মনে হচ্ছে। টলতে টলতে কোনমতে নামলাম,ডেইজির মৃত শরীরটাকে ডিঙিয়ে ঢুকলাম ওর ঘরে। এইঘরটা বেশ ঠাণ্ডা। ফায়ারপ্লেসের আগুন নিভু নিভু। হাঁপাতে হাঁপাতে তোলপাড় করছি ডেইজির  ডেস্ক। ডেইজির দেরাজ। তোরঙ্গ-।
এ বাড়ির বড় ঘড়িতে ঢং ঢং করে চারটে বাজল। আর কত খুঁজব তোকে মণি। পড়ে আছে দোতলা একতলায় দুদুটো লাশ। রীতিমত ভয় করছে এবার। আর তিন চার ঘন্টা পরেই ফর্সা হবে আকাশ। হয়তো রোদ উঠবে না। তাই বলে এবাড়ির দাসদাসীরা কাজে আসবে না? হঠাৎ মনে হল, ডেইজির শৌচালয়টা একবার দেখি-
একহাতে দেওয়াল গিরি নিয়ে ঢুকলাম ডেইজির শৌচালয়ে। সাবান রাখার জায়গায় একগাদা নুড়ি পাথর। কেন?
ধুচ্ছি প্রতিটি পাথর। ডেইজির শৌচাগার কি অসম্ভব ঠাণ্ডা। বাইরে বোধহয় ঝড় উঠল, মেথর আসার দরজাটা ঠকঠকিয়ে চমকে দিল আমায়। মিথ্যা। মিথ্যা। সব মিথ্যা। এগুলো নিছক পাথর। আমার মণি কই? আমার চন্দ্রকান্তমণি? সে যে আমায় ডাকছে- আমার বুড়ো ধমনীতে তীব্র হচ্ছে রক্তের বেগ। টলতে টলতে রান্নাঘর থেকে বিশাল ছুরি নিয়ে ফিরে এলাম। ফেড়ে ফেলছি ডেইজির বালিশ- তোশক। নেই। নেই। তবে কি ম্যাডামের কাছেই? বেরোতে যাব, চোখ পড়ল মেজেতে পড়ে থাকা ডেইজির তোরঙ্গের ওপর। ভিতরের জিনিসপত্র লণ্ডভণ্ড হয়ে পড়ে আছে মাটিতে। তোরঙ্গটা বেশ পুরোনো, বিবর্ণ, চামড়া ফেটে গেছে কয়েক জায়গায়।  কিন্তু বেশ দামী চামড়া। এ জিনিস ডেইজির হতেই পারে না। অনাথ আশ্রমে বেড়ে ওঠা সেক্রেটারিকে ম্যাডামই দিয়েছিলেন দয়াপরবশ হয়ে। ভিতরে দামী শাটিনের আস্তরণ, দেওয়াল গিরির মরা আলোতেও ঝিলিক দিচ্ছে গোলাপী শাটিন। যদিও তাও ছেঁড়া। তাপ্পি মারা। কাঁপা কাঁপা হাত বোলাচ্ছি তোরঙ্গের শাটিনের আস্তরন বরাবর। কি যেন একটা আছে ভিতরে, গোল মত,দরজার নবের মত।
আমার মণি। বরফের মত শীতল। তবু তাকে ওষ্ঠে ছোঁয়ানো মাত্র উষ্ণতার স্রোত বয়ে গেল বুড়ো শরীরে। কি তীব্র মায়া। ম্যাডাম,ডেইজিকে মারতে এতটুকু হাত কাঁপেনি আমার। প্রয়োজনে আবার মারতে পারি। মরতেও পারি। দেওয়ালগিরির আলোতে কেমন যেন ম্রিয়মান লাগল মণিকে। কি হয়েছে রে মণি তোর? সেদিন তো রূপে ঝলমল করছিলি,আজ এমন শীতল কেন?
“কারণ সেদিন ছিল পূর্ণিমা। আর আজ অমাবস্যা। চন্দ্রের ক্ষয় এবং বৃদ্ধির সাথেই বাড়তে বা কমতে থাকে মণির দীপ্তি। তাই তো এর নাম চন্দ্রকান্তমণি-”।  কে যেন বলে উঠল পিছন থেকে। চমকে ফিরে তাকালাম, পিছনে দাঁড়িয়ে আব্দুল। এ বাড়ির মেথর বলতে পারেন। আব্দুল শৌচাগার সাফ করে, মাথায় করে বয়ে নিয়ে যায় বর্জ্য পদার্থ। পিছনের লোহার সিঁড়ি দিয়ে উঠে, চেম্বারপট সাফ করে, নীরবে নেমে যায়। মূল কাসলে কখনও প্রবেশ করে না। আজ এই ভোর রাতে আব্দুল,ডেইজির ঘরে কি করছে?নিশ্চয় শৌচাগারের মেথর দরজা দিয়ে ঢুকে এসেছে। বাগিয়ে ধরলাম ছুরি,দুটোকে নিকেশ করেছি। আর এটাতো কালো ইন্ডিয়ান। পুলিশ জানবে,অর্থের লোভে আব্দুলই মেরেছে, ম্যাডাম আর ডেইজিকে। আর বুড়ো এডওয়ার্ড মেরেছে আব্দুলকে- ।
(চলবে?)