Monday 16 January 2023

অনির ডাইরি ১৬ই জানুয়ারি, ২০২২

 


#অনিরডাইরি #কাঁথিরকিস্যা 


সাড়ে এগারোটায় বেরোনোর কথা ছিল। মাত্র নয় মিনিট লেট করেছি আমি। গন্তব্য অনেকদূর, তিলোত্তমা কলকাতা। দিন দুয়েক আগে ভূপতিত হয়েছেন শাশুড়িমাতা। সকালে উঠে চায়ের জল চড়িয়ে বাথরুমে গিয়েছিলেন। বেরিয়ে আসা মাত্রই টলে উঠেছে মাথা। শ্রবণেন্দ্রিয়ের দুর্বলতা জনিত কারণে  ভারসাম্য রাখার সমস্যা ওনার আছেই। তার ওপর আছে ভার্টিগো। ফলে মাথা ঘুরে পড়ে যাবার বেশ লম্বা ইতিহাস আছে অতসী দেবী থুড়ি শাশুড়ী মাতার। এই তো গত বছরেই সোফা থেকে উঠতে গিয়ে মাথা ঘুরে এমন পড়ে যান যে অপারেশন করে পায়ে বসাতে হয় প্লেট।


সেই সময় ছেলেদের ভয়ে একজন রাতদিনের আয়া রাখতে বাধ্য হলেও তার স্থায়িত্ব ছিল বড়ই স্বল্প। শাশুড়ী মাতার বক্তব্য হল, মেয়েটি ভয়ানক অপরিচ্ছন্ন। বড় কাজ করে ফ্লাশ করে না। তার থেকেও বড় কথা হল, সে নাকি শাশুড়ী মাতার গোটা তিনেক বাটি ঝেঁপে দিয়েছে। বাটি গুলি ছিল শৌভিকের অন্নপ্রাশনে পাওয়া উপহার। উনি দাবী করেন, ওণার অধিকাংশ বাটিই নাকি জ্যেষ্ঠপুত্রের অন্নপ্রাশনে পাওয়া। দেখলে বিশ্বাস হয় না যদিও। নিজে হাতে যত্ন করে মেজে, ধুয়ে, জল ঝরিয়ে, মুছে, গুছিয়ে রেখে এসেছেন এত বছর। ফলতঃ সব কিছু ঝকঝক করে এ বাড়িতে। 


মোদ্দা কথা হল ইয়ে করে, ইয়ে না করাটাও উনি হয়তো মেনে নিতেন, তিনটি বাটি নিখোঁজ হওয়াটা উনি কিছুতেই মানতে পারেননি। ফলে চাকরী গেছে বেচারীর।শুধু তাই নয়, তারপর শতানুরোধেও আর কাউকে রাখতে রাজি হননি বৃদ্ধা। বললেই বলেন, ‘আর লোক রাখলে আমি পাগল হয়ে যাব।’


বৃদ্ধ এবং তাঁর প্রিয়তমা বৃদ্ধার বক্তব্য হল,এমনিতে তো রান্না আর বাসন মাজার দিদিরা আছেন, তাঁরা রন্ধনে দৌপদী না হলেও ওণাদের পরম স্নেহ ভাজন তথা বিশ্বাসের পাত্রী। টুকটাক দোকানবাজার করে দেবারও লোক আছে। এরপরেও আর লোক রেখে কি হবে। 


যাই হোক, এমনিতে হয়তো সব ঠিকঠাকই চলে। মুস্কিল হয় যখন ঘায়েল হয়ে পড়েন যুগলের কোন একজন। সেদিন যেমন শাশুড়ী মা পড়ে যাবার পর হয়েছিল। ভদ্রমহিলা আড়ে এবং বহরে শ্বশুরমশাইয়ের দেড় গুণ।  দু-দুবার কর্কটরোগ আক্রান্ত হেঁপো বৃদ্ধের সাধ্য কি ওণাকে টেনে তোলেন। বৃদ্ধাকে ঐ অবস্থায় ফেলে রেখে দৌড়ে গিয়ে ফোন করলেন বাসন মাজার দিদিকে। অন্য বাড়ির কাজ ফেলে ছুট্টে এসে, প্রায় চাগিয়ে শাশুড়ী মাতাকে সোফায় তুলে নিয়ে যায় মেয়েটি। দৌড়ে নিয়ে আসে বমি করার বালতি। এক দফা বমি করেই চাঙ্গা হয়ে ওঠেন শাশুড়ী মা। মেয়েটিকে পাঠিয়ে দেন অন্য বাড়ির কাজ সারতে এবং নিজে যান চা বানাতে। 


পিছন পিছন ঘুরতে থাকেন শ্বশুরমশাই,‘কি গো, ঠিক আছ তো? অমন ভাবে উল্টে পড়লে কোথাও লাগেনি তো?’ বেশী প্রশ্ন করলেও চটে যেতে পারেন প্রিয়া। বেচারা শ্বশুরমশাই। সকালের অঘটনকে পিছনে ফেলে পূর্ণ বিক্রমে নৈমিত্তিক সাংসারিক কাজে লেগে পড়েন শাশুড়ী মা। টানতে পারেন না অবশ্য বেশীক্ষণ। হুড়মুড় করে গা গুলিয়ে বেরিয়ে আসে সকালের চা টুকু। এবার মুখের কাছে বালতি ধরেন শ্বশুরমশাই। দ্বিতীয় দফার বমির পর সব কাজ ফেলে সটান শুয়ে পড়েন বৃদ্ধা। ঘন্টা তিনেক অচৈতন্যের মত ঘুমান। তারপর, সব ঠিক। 


ব্যাপারটা লিখতে বা পড়তে যতটা সহজ, এই অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে যাওয়াটা মোটেই অত সহজ ছিল না। প্রতিটি ধাপে কেঁপে কেঁপে উঠেছি আমরা। কপালগুণে সেই দিনই আমার দেওরের আশার কথা ছিল দুর্গাপুর থেকে। দায়িত্ব নিয়ে ডাক্তারের সাথে কথা বলে, ওষুধ এনে দেয় সেই। শ্বশুর-শাশুড়ীও সমানে জানাতে থাকেন, দিব্যি আছেন দোঁহে, হঠাৎ ঠাণ্ডা পড়ায় কেবল সামান্য বাতের ব্যথা বেড়েছে একজনের আবার হঠাৎ ঠাণ্ডা টা কমে যাওয়ায় সামান্য শ্বাসকষ্ট বেড়েছে আরেকজনের। বাড়িতেই আনিয়ে নিয়েছেন অক্সিজেন সিলিণ্ডার। ডাক্তারের সাথে কথা বলে অ্যান্টিবায়োটিকও। 


সবই ভালো, শুধু মন যে মানে না আমাদের। বৃদ্ধ-বৃদ্ধা বড় জেদী, সহস্রবার বলা হয়েছে, আমাদের সাথে তমলুক/কাঁথিতে এসে থাকতে। বললেই মিল্টন আওড়ান বৃদ্ধ। নিজেদের সাজানো সংসার ছেড়ে নড়তে ইচ্ছুক নন কেউই। ঠিক একই কথা শুনি আমার বাবা-মায়ের মুখেও। ‘তোরা বুঝবি না, এই বয়সে নতুন করে ভিন্ন পরিবেশে মানিয়ে নেওয়ার কাজটা কত কঠিন। তোরা তোদের মত সুখে থাক, আমাদের অসুবিধা হলে তো ডাকবই।’ এর থেকেও বড় অসুবিধা/সমস্যা যে কি হতে পারে ঈশ্বরই জানেন। 


গতকালও কি সব ফিল্ড ভিজিটে বেরিয়েছিল শৌভিক। তাই আর যাওয়া হয়ে ওঠেনি কলকাতা। আজ তাই আর বিলম্ব নয়। শ্রীমতী তুত্তুরীর গুচ্ছখানেক প্রজেক্ট বাকি, শিয়রে পরীক্ষা। তাই তাকে রেখে যাওয়া হল। সত্যি কথা বলতে কি, একদিনে কাঁথি থেকে কলকাতা হয়ে আবার কাঁথি ফেরা বেশ পরিশ্রমসাধ্য ব্যাপার। অন্তত শ্রীমতী তুত্তুরীর পক্ষে। কাল ভোরেই আবার তাঁর স্কুল। 


যে পথে নিত্য আপিস যাই, ছুটির দিনও ঐ পথে সফর করতে জাস্ট কান্না পায়। কিন্তু কাঁথি শহর ছেড়ে বেরোনোর যে এই একটিই রাস্তা। কন্টাই বাজার থেকে রূপসী বাইপাস ধরে ছুটে চলি আমরা। বাজকুল ছাড়ানোর সাথে সাথেই কাঁথি মহকুমা শেষ হয়ে শুরু হয় তমলুক।


চণ্ডীপুরের ঝাঁ চকচকে গহনার দোকানের সারি ফেলে, মকরাজপুরের নির্মীয়মান উড়াল পুলের তলা গলে নরঘাট ব্রিজ। নীচে দিয়ে কুলকুল করে বয়ে চলেছে হলদি নদী। আজ মকর সংক্রান্তি, নদীতে পূণ্যস্নানের জোয়ার এসেছে। নববধূর মত সেজে উঠেছে পাশের গঙ্গা মন্দিরটি। বিশাল মেলা বসেছে। ব্রিজের উপরে-নীচে শয়ে শয়ে লোক। মাইক্রোফোনে ভেসে আসছে বার্তা, ‘ অমুকপুরের শ্রীমান/ শ্রীমতী তমুকের কাছ থেকে ১০/২০/৫০ টাকা আমরা মন্দির কমিটির পক্ষ থেকে পরম কৃতজ্ঞচিত্তে গ্রহণ করছি।’ আজ্ঞে হ্যাঁ, লাখ নয়, হাজার নয়, এমনকি ৫০০ও নয়, প্রণামীর পরিমাণ ১০-৫০,তাও সোচ্ছারে জানিয়ে চলেছে মেলা কতৃপক্ষ। 


এদিকে মকর সংক্রান্তি বেশ বড় উৎসব। পিঠে-পুলি- পায়েস তৈরী হবে আজ ঘরে ঘরে। দেবতাকে দেওয়া হবে অর্ঘ্য।  উপোসী থাকবে শুধু আমার ঠাকুর। অন্যান্য বছর আমিও বানাই, গুড়ের পায়েস, নোনতা- মিষ্টি পুলি, দুধ পুলি,মালপোয়া, পাটিসাপটা, ভাজা পিঠে এবং সরু চাকলি। তিনদিন ধরে করার মত সময় পাই না বলে একদিনই সব বানিয়ে ধরি ঠাকুরের সামনে। এবারে আর পারব না। বাড়ি ফিরতে ফিরতেই রাত নটা বাজবে। তারপর আর কখন-। আসার আগে মার্জনা চেয়ে এসেছি, আগে মানুষ গুলোকে দেখি, পিঠেপুলি তোমাদের পরে ছুটির দিন খাওয়াব। আশা করি বুঝবে। আমার চিলতে ঠাকুর ঘরে বড়ই উদারমনা দেবদেবীদের বাস। আমি যে জন্ম কুঁড়ে, অলবড্ডে এবং অপদার্থ ওণারাও জানেন। 


চলন্ত গাড়িতে মোবাইল দেখলে বড় মাথা ঘোরে। জানলা দিয়ে আর বাইরে কতক্ষণ তাকিয়ে থাকা যায়। আপদ রাস্তা আর শেষ হয়ই না। দরজা খুলে খুশিতে ডগমগ হয়ে যান শাশুড়ি মাতা। অতঃপর আর পাঁচজন স্নেহশীলা জননীর মতই আওড়ান,‘ বুড়োবুড়ির জন্য সেই এতটা পথ দৌড়ে এলি? কেন এলি বল তো? আমি তো ঠিকই আছি। তোর বাবা বরং বেশ কাহিল।’ অক্সিজেন নিচ্ছিলেন শ্বশুরমশাই, আমাদের গলা পেয়ে বেরিয়ে এলেন। মহানগরে আজ বড় গরম, ঘামে ভিজে গেছে আমার জ্যাকেট। পায়ে কুটকুট করছে মোজা। বৃদ্ধ এরই মধ্যে ফুলহাতা শার্টের ওপর একখানা ফুলস্লিভ পুলওভার চাপিয়েছেন। মাথায় উলের টুপি। 


জ্যেষ্ঠ পুত্রের কাছে মাঝেমাঝেই আব্দার করেন বৃদ্ধ নতুন সোয়েটার বা জ্যাকেট কিনে দেবার। অ্যামাজন খুলে সেগুলো বকলমে পছন্দ আমিই করি। তবে এই সোয়েটারটা চিনতে পারলাম না। ভুষো ভুষো রঙ। বেঢপ সাইজ। মনে হচ্ছে যেন হ্যাঙারে ঝুলছে। মাথার টুপিটাও হড়কে নেমে এসেছে নাকের কাছে। শৌভিক আবার বলছিল বাবার নাকি আড়াই কিলো ওজন বেড়েছে। 


জানতে চাই,‘বাবা এটা কি নতুন?’ বেজায় খুশি হয়ে বৃদ্ধ জানান সোয়েটারটা নাকি ১৯৭৪সালে কেনা। বাপরে। ওটা আমার বাবা মায়ের বিয়ের বছর। এত পুরাতন জিনিস, বেশ আছে তো। পাশ থেকে বিরক্ত শৌভিক বলে ওঠে,‘মোটেই না। এটা লেট নাইনটিজ্ এ কেনা। দিল্লী থেকে। তখন তুমি খাদি বোর্ডে ছিলে।’ নব্বইয়ের দশকের শেষে কেনা হলেও সোয়টারটার বয়স বছর পঁচিশ। সেটাই কি কম রে বাপু। 


সময় এগোয়, গল্প গড়ায়। দিনরাত না হলেও শুধু একবেলার জন্য একজন আয়া রাখার জন্য পিড়াপিড়ি করি আমরা। শাশুড়ী মাতা অনড়। উল্টে উনি দাবী করেন কাজের লোকেদের অত্যাচারে উনি এবার বৃদ্ধাবাসে যাবেন। কোথায় নাকি পড়েছেন, একবারে আড়াই লক্ষ টাকা দিয়ে দিলে আর মাসে মাসে মাত্র সাড়ে পাঁচ হাজার টাকার বিনিময়ে বৃদ্ধাবাসে থাকা যায়। তারাই যত্ন নেবে, ডাক্তারবদ্যিও তারাই দেখাবে। সংসারের যাবতীয় কাজ তারাই করে দেবে। বৃদ্ধ-বৃদ্ধা এক্কেবারে ঝাড়া হাত পা হয়ে থাকতে পারবে। এত্ত সুবিধে তাও শ্বশুরমশাই কেন যে রাজি হচ্ছেন না। 


হাসি চাপতে গিয়ে চোখে জল এসে যায় আমার। শ্বশুরমশাই মুখ নীচু করে হাসেন আর প্যাঁচার মত মুখ করে তাকিয়ে থাকে শৌভিক। বৃদ্ধার মস্তিষ্কে এমন সব পরিকল্পনা আসতে যেতেই থাকে। যত উৎপটাং খবরাখবর কেবল ওণার চোখেই পড়ে, তারওপর ভিত্তি করে নানা আজব পরিকল্পনা করেন এবং আশা করেন তাতে উনি বাড়ির লোকেদের সম্মতি এবং সহযোগিতা পাবেন। যথারীতি যখন কাউকে পাশে পান না, মনের দুঃখে ওণার পেটেন্ট নেওয়া সংলাপটি আওড়ে গোঁসা ঘরে খিল দেন, ‘বেঁচে থেকে আর লাভ নেই’।  অনেকবার ভেবেছি তুত্তুরী উবাচের মত ধারাবাহিক ভাবে, শাশুড়ী উবাচ লিখতে শুরু করি, নেহাৎ সাহসে কুলোয় না আর কি। 


বেচারা শ্বশুরমশাই সোচ্চারে হাসতেও পারেন না। প্রিয়ার অভিমান বড়ই মর্মন্ত্তদ। উঠে গিয়ে জেবিএল এর ছোট স্পিকারটা নিয়ে আসেন। এই এক খুড়োর কল কিনে দিয়েছে আমার বর। ব্লু টুথ দিয়ে কানেক্ট করে ইউটিউবের গান শুনবে বাবা এই আশা নিয়ে। মিথ্যে বলব না, বৃদ্ধ শুনতও। স্পিকারটি ওণার বড় প্রিয়। মুস্কিল হল প্রায় প্রতিবারই আমরা চলে আসার পর উনি ভুলে যান কি ভাবে গানটা শুনতে হয়। বহু চেষ্টা করেন, সাধের স্পিকার তাও নীরবই থাকে। নেড়েচেড়ে দেখিয়ে দেয় শৌভিক আবার। আবার। আবার। শাশুড়ী মাতাকে চমকে চারবার গেয়ে ওঠেন হেমন্ত বাবু, ‘শোন কোন এক দিন-’।  তাও মাথা চুলকান বৃদ্ধ। ‘শোন না, আরেকবার দেখা তো।’ সহমর্মী  হয়ে বলি,‘স্টেপগুলো লিখে দিই না বাবা।’ পছন্দ হয় না বৃদ্ধের। আরেকবার দেখালেই নাকি উনি পারবেন সবকিছু। 


‘এতদূর থেকে এলি,কি খেতে দিই বলতো’ বলতে বলতে সোফা থেকে উঠে পড়েন শাশুড়ী মাতা। যুগলে  হাঁহাঁ করে উঠি। কিচ্ছু খাব না। তুমি বসো তো। সন্দিগ্ধ দৃষ্টিতে আমাদের দিকে তাকিয়ে বৃদ্ধা বলে ওঠেন,‘কেন রে? আমার কষ্ট হবে বলে?’ জবাব দেবার আগেই টেবিলের ওপর চলে আসে খোলায় ভাজা চিঁড়ে, ফুরিয়ে যেতে বসা বিস্কুটের ডাব্বা, মুড়ি ওয়ালার থেকে কেনা গুলি গুলি নারকেল নাড়ু। শ্বশুরমশাই মনে করিয়ে দেন,‘ফ্রিজে গুড়ের রসগোল্লা আছে না? দাও না।’ 


বড় জোরে দৌড়ায় সময়। মহানগরের বুকে নামে সন্ধ্যা। আড়ামোড়া ভেঙে উঠে পড়ি আমরা।অভিমানী বৃদ্ধা বলে চলেন,‘এমন আশার কি যে মানে হয়, কতক্ষণই বা বসতে পারলি।’ বৃদ্ধ জানান শীঘ্রই ডাক্তারের কাছে যেতে হবে, আমাদের অসুবিধা থাকলে উনি একাই-। পুনরায় হাঁহাঁ করে উঠি যুগলে। 


চাকা গড়ায় কাঁথির দিকে, গাড়ির কাঁচে যার ছায়া পড়ে, তার মুখে এক পোঁচ ক্লান্তির কালি মাখা। বিকট হাই তুলি আমি। ক্লান্তিতে বুজে আসে চোখের পাতা, চমকে উঠে চোখ খুলি যখন নরঘাট ব্রিজ পেরোচ্ছি। ঘড়িতে সাড়ে আটটা। মাইকে তখনও হয়ে চলেছে একই ঘোষণা।


মহকুমা শাসকের নিবাসে যখন পৌঁছাই ঘড়িতে পৌনে নয়। ছুট্টে আসে তুত্তুরী, 'মা দেখবে এসো রঞ্জিত কাকু কত পিঠে বানিয়েছে। যা যা তুমি প্রতিবছর বানাও সব বানিয়েছে মা। মাসি আমাকে একটাও খেতে দেয়নি, বলেছে তুমি এসে ঠাকুরকে দেবে তবে খাব।'  রঞ্জিত বাবু মহকুমা শাসকের পাকশালা সামলান। বিভিন্ন প্রদেশের অফিসারদের মুখরোচক রান্না করে দিতেই অভ্যস্থ রঞ্জিত। বানাতে পারে গুজরাটি থেপলা থেকে হায়দ্রাবাদী বিরিয়ানি সবকিছুই। আমাদের নৈমিত্তিক রুটি আর কুমড়োর ঘ্যাঁট বানাতে বানাতে রীতিমত মনমরা হয়ে পড়েছিল রঞ্জিত। আজ সুযোগ পেয়ে তাই উজাড় করে দিয়েছে নিজের প্রতিভা। পথ দেখিয়েছে তুত্তুরীর মাসি। বলে বলে দিয়েছে, পুলি পাকিয়ে দিয়েছে।  মাঝপথে ফুরিয়ে গেছে দুধ। দৌড়ে গিয়ে দুধও কিনে এনেছে রঞ্জিৎ।


 নতুন ডাইনিং সেটের না ব্যবহার হওয়া থালা বাটিতে সাজিয়ে দিই রঞ্জিত আর মাসির হাতের কাজ। তুলে ধরি আমার ঠাকুরের মুখের সামনে, আর মনে মনে বলি, ঠাকুর তুমি ধন্য। আমার মত সব অলবড্ডে অপদার্থ মেয়েদের পাশে সারাজীবন এমনিই থেকো প্রভু। মন্ত্র তন্ত্র তেমন জানি না, যা জানি তাও কতটা সঠিক কে জানে। তবে একটা জিনিস জানি,‘আই লাভ ইউ ঠাকুর।’ এটাই আমার প্রাণের মন্ত্র। এভাবেই ভালো থেকো আর রেখো কেমন।

অনির ডাইরি ১৫ই জানুয়ারি, ২০২৩

 

#অনিরডাইরি 


ষষ্ঠ শ্রেণী, ষাণ্মাসিক পরীক্ষা, অঙ্কে পেলাম ৫২। মাথায়, পিঠে গদাগুম যা পড়ার তাতো পড়লই, তারপরেও মায়ের আর্তনাদে কেঁপে উঠল ধরিত্রী, দুলে উঠল আকাশ। ‘হে ঈশ্বর, আমার মেয়েটা বুঝি গণ্ডমূর্খই থেকে গেল।’ 


বাবা-মা দুজনেই চাকুরীরত। যৌথ পরিবার। উভয়ের ব্যস্ত দিনলিপিতে আমাকে নিয়মিত পড়ানোর মত সময়ের বড়ই অভাব। পড়াতে আসতেন প্রতিবেশিনী পুষ্প দিদিমণি। ওণার পঠন -পাঠন, সদ্য হাতে খড়ি হওয়া শিশুদের জন্য যতটা অব্যর্থ, ষষ্ঠ শ্রেণীর ডেঁপো ছাত্রীর জন্য যে ততোটা নয়, সেটা জানিয়ে উনি পঞ্চম শ্রেণীতেই অব্যাহতি চেয়েছিলেন। অত্যন্ত সম্ভ্রান্ত  পরিবারের গৃহবধূ ছিলেন ভদ্রমহিলা। ঐ 'নামেই তালপুকুর, ঘটি ডোবে না' টাইপ। কপালের  ফেরে ওণার স্বামীর ধূপ বিক্রয়ের সামান্য কটি টাকা ছাড়া, সেইসময় এই টিউশন ফিটুকুই ছিল দিদিমণির সংসার চালানোর একমাত্র সম্বল। মায়ের সহেলী ছিলেন। মাকে অসম্ভব ভালোবাসতেন, মাও বাসত বৈকি। সবে মিলে আমার হাত থেকে নিষ্কৃতি পাননি দিদিমণি। নিয়মিত আসতেন, সৎ ভাবে যতটুকু পারতেন পড়াতেন। এদিক-ওদিক থেকে গোঁজ দিত বাবা। পরিণাম যা হবার তাই হয়েছিল। 


ভালো মাস্টারমশাই/দিদিমণি কোথায় পাই বলে কদিন চুল ছিঁড়লেন জননী আমার। অতঃপর গিয়ে ধরলেন খোকন চন্দরকে। শ্রীমান খোকন, ওরফে অনিত কুমার সিনহা হলেন সম্পর্কে আমার বড়দা। নাঃ আমরা সহোদর নই, তার থেকেও বহু বহু গুণ বেশী। বড়দার জননী আর আমার মাতৃদেবী সহোদরা বটে, কিন্তু মায়েদের চার বোনের মধ্যে টানটা এতই বেশী যে আমরা তাঁদের পুত্রকন্যাগণ একে অপরকে সহোদর হিসেবেই গণ্য করি এবং পূর্ণ বিক্রমে একে অপরের হাড় জ্বালাই। 


চার দাদার একটি মাত্র বোন আমি। মাত্রা ছাড়া আদরে বেড়ে উঠেছি। সেজদা- ছোটদার হাতে গোটা কতক গাঁট্টা বা থাবড়া খেলেও বড়দা আর মেজদা ছিল অখণ্ড স্নেহের আধার। সদ্য রেলে চাকরিতে ঢুকেছে বড়দা, আপিস ফেরতা গুটি কয়েক টিউশনি তখনও করে বটে,সেটা অনেকটাই অভ্যাসের বশে। মাসি অর্থাৎ আমার মায়ের অনুরোধ ফেলতে না পেরে বড়দা এল আমায় পড়াতে। 


ঐ যে আপনারা বলেন না,প্রতিটি সফল পুরুষের পিছনে লুকিয়ে থাকেন একজন মহীয়সী, ঠিক তেমনিই প্রতিটি সফল নারীর পিছনে বেত হাতে দাঁড়িয়ে থাকেন একাধিক পূজনীয় পুরুষ। সাফল্যের নিরিখে আমায় যত নম্বরই দিন না কেন, জীবনে যতটুকু অর্জন করেছি তার জন্য তিন জন পুরুষই দায়ী। প্রথম এবং প্রধান পুরুষ অবশ্যই আমার বাপ, তৃতীয় পুরুষ তুত্তুরীর বাপ আর মধ্যম পুরুষ হল আমার বড়দা। 


আজও মনে আছে, প্রথম দিন পড়াতে এসে কত্ত খোশ গল্প করেছিল বড়দা। টিভি দেখা নিয়ে মা এত খিটখিট করে কেন, কি কি দেখতে ভালোবাসি ইত্যাদি প্রভৃতি। তখনও কেবল্ আসতে বাকি এক দশক, দূরদর্শনই ভরসা। বোকার মত বলে বসেছিলাম, সোমবারের সুপার হিট মুুকাবিলা আমার ভয়ানক প্রিয়। অপেক্ষা করে থাকি বুধবারের চিত্রহার আর শনিবারের হিন্দি ফিচার ফিল্মের জন্য। গপ্প শেষে বইপত্র নাড়াচাড়া করে, বাড়ি ফেরার সময় ভবিষ্যতের নির্ঘন্ট শুনিয়ে গিয়েছিল বড়দা,প্রতি সোম, বুধ আর শনিবার আপিস ফেরৎ পড়াতে আসবে। অঙ্ক দিয়ে শুরু করে মাস ঘোরার আগেই বাংলা ইংরেজি ভিন্ন অন্য সব বিষয়ের দায়িত্ব ঘাড়ে তুলে নিল বড়দা। 


বাংলা-ইংরেজি পড়ানো, উত্তর, রচনা, প্যারাগ্রাফ লিখে দেবার দায়িত্ব ছিল বাবার।একবার বাবা লিখে দিলে তা নিয়মিত পড়ানো, পড়া ধরা আর লিখতে দেবার কাজটা অবশ্য বড়দাই করত। বলতে ভুলে গেছি, সবটুকুই কিন্তু ছিল অবৈতনিক। ধীরে ধীরে অন্য টিউশনি গুলো ছেড়েই দিল বড়দা। আমিই রয়ে গেলাম একলা একেশ্বরী, বড়দার সবটুকু অবসর জুড়ে। আপিস ফেরতা আমাকে পড়ানো আর আমাকে পড়িয়ে বঙ্গমিলনী ক্লাবে বন্ধুদের সাথে আড্ডা মারা, দীর্ঘ ছ-সাত বছর এই ছিল বড়দার জীবনের প্রধান মনোরঞ্জন। 


দশম শ্রেণীতে অন্যান্য সহপাঠিনীদের মত আমিও ভর্তি হলাম এক কোচিং এ। তবুও সরে যায় না বড়দা। আগের মতই চলতে থাকে সবকিছু। কোচিং এর পড়াও অভ্যাস হতে থাকে বড়দার তত্ত্বাবধানে। দেখতে দেখতে এসে পড়ে মাধ্যমিক পরীক্ষা। পরীক্ষার দিন চারেক আগে কানের ব্যথায় কাহিল হয়ে পড়ি আমি। সদ্য হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাওয়া বাবা বা ঘর-বাহির সামলে হাঁপিয়ে পড়া মায়ের জন্য অপেক্ষা করেনি বড়দা, অফিস কামাই করে, কান ধরে আমাকে নিয়ে গিয়ে ডাক্তার দেখিয়ে ওষুধ কিনে দিয়ে গিয়েছিল বাড়ি। রেজাল্ট বেরোল, স্টার পেলাম। অঙ্কে লেটার। আজকালকার দিনে অতি দীন হলেও, সে সময় আমার কাছে ওটা ছিল স্বপ্নের মত।  মা আর বাবার অফিসে ফোন করে খবরটা দিয়েই,  স্কুল থেকে সোজা দৌড়ালাম বড় মাসির বাড়ি। বাবা-মা-দাদা কেউ সেদিন অফিস যেতে চায়নি। আমিই জোর করে পাঠিয়েছিলাম। বড় মাসির গলির মুখে দাদার সাথে দেখা, রাস্তা না পেরিয়েই চিৎকার করে উঠলাম   ‘দাদা আমি অঙ্কে লেটার পেয়েছি’ । আজও মনে আছে, আনন্দের অভিঘাতে সামান্য টলে গিয়েছিল বড়দা। 


একাদশ শ্রেণীতে ভর্তি হলাম। ইতিহাসের পুনরাবর্তন ঘটল যেন। পঞ্চম শ্রেণীতে পুষ্প দিদিমণির মতই এবার অব্যাহতি চাইল বড়দা। যদিও দুজনেই বিজ্ঞানের ছাত্রছাত্রী। তাও এত বছর পর একাদশ-দ্বাদশের বিজ্ঞান বিভাগ পড়ানো মোটেই সহজ নয়, বরং বেশ মুস্কিল। সেটাই অকপটে জানাল বড়দা।  শুনে সে কি হাপুস নয়নে কান্না আমার। প্লিজ বড়দা তুমি আমায় ছেড়ে যেও না। কোচিং এর পড়া কিচ্ছু মাথায় ঢুকছে না আমার। 


একাদশ দ্বাদশে আমার সঙ্গ না ছাড়লেও, কলেজে ভর্তি হবার পর বড়দা বলেই দেয়, আর নয়। এবার 'একলা চলো রে'। ‘আর আমায় ডাকলেও পাবি না।’ ততোদিনে বড়দার জীবনেও ঘটে চলেছে অনেককিছু। বাড়িতে আসতে চলেছে নতুন অতিথি,  নাগেরবাজারের মিত্র বাড়ির আদরের দুলালী শ্রীমতী রিঙ্কু ওরফে বড় বৌদি। সে কি উত্তেজনা। বিয়ের দিন বরের গাড়িতে এক চিলতে জায়গা পাবার জন্য সে কি আকুতি। প্লিজ বড়দা,আমায় ফেলে বিয়ে করতে যেও না। ১৯৯৯ সালের ১৫ই জানুয়ারীর সন্ধে বেলা, বড় মেসোমশাই আর বাবার সাথে বর নিয়ে গেলাম আমিও। পরদিন কাক ভোরে মেজদার সাথে বউ আনতেও গেলাম আমি। 


আজও মনে পড়ে বধূ বিদায়ের আগে চলছে আশির্বাদ পর্ব। বৌদির গতরাতের সাজসজ্জা প্রায় বিলুপ্ত চোখের জলে। বৌদির পাশেই ঘরোয়া  শাড়ি পরে বসে আছেন মাসিমা অর্থাৎ বৌদির মা। দুই হাতে চেপে ধরে আছেন আদরের কন্যার দুই হাত। দুজনেই কেঁদে চলেছেন অনর্গল। যতবার আশির্বাদ করতে ডাকা হচ্ছে মাথা নেড়ে না বলে চলেছেন মাসিমা। মেসোমশাই একাই বসলেন আশির্বাদ করতে। পাছে চোখের কোণ ছাপিয়ে যায়, তড়িঘড়ি উভয়ের মাথায় ধান দূর্বা দিয়েই উঠে পড়লেন মেসোমশাই। পুরুষদের কাঁদতে নেই যে। সরে যাবার আগেই ঝাঁপিয়ে পড়ল বৌদি, দুই হাতে চেপে ধরল বাবার পা, করুণ স্বরে ডুকরে উঠল,‘ও বাবা, বাবা গো।’ সে যে কি করুণ দৃশ্য। ডুকরে ডুকরে কাঁদতে লাগলাম আমিও। আক্ষরিক অর্থেই কেঁদে ভাসালাম। 


বউদির সাথে ফোঁপাতে ফোঁপাতেই গাড়িতে উঠলাম। ওঠার সাথে সাথেই খটাস্ করে এক গাঁট্টা মারল মেজদা। আর বড়দা তাজ্জব হয়ে বলে উঠল, ‘তুই ঠিক কোন পক্ষে আছিস বল তো?’ ১৯৯৯ থেকে আজ অবধি, আমি চিরকালীন আমার বৌদির দলে। যেদিন লেবার সার্ভিসের তকমা লাগেনি, শৌভিককে চিনতামও না, তুত্তুরী ঘুমিয়ে ছিল আমার মায়ের কোন গহীন স্বপনে, যেদিন ফেসবুক ছিল না, ইনস্টাগ্রাম ছিল না, যেদিন জীবন ছিল বড়ই দীন, নিছক অতি নিম্নসাধারণ, সেদিন বড় আর মেজ বৌদি ছিল আমার সহেলী। বড় মাসির বাড়ি গিয়ে বৌদিদের সাথে রাত্রিবাস করাটাই ছিল জীবনের প্রথম তথা সবথেকে উত্তেজনা মাখা, ‘গার্লস্ নাইট আউট।’ আর বাবু অর্থাৎ শ্রীমান অরিত্র, ওরফে আমার জ্যেষ্ঠ ভ্রাতুষ্পুত্র যখন ভূমিষ্ঠ হল, সাময়িক ভাবে মনে হল গোটা পৃথিবীটাই বুঝি ঘুরতে লেগেছে পুঁচকে নবজাতককে কেন্দ্র করে। 


দেখতে দেখতে কত্ত বছর পেরিয়ে গেল। পাবলিক সার্ভিস কমিশনের আপিস থেকে প্রথম চাকরী পাবার খবর পাঠালাম বড়দাকে। পাড়ার কম্পুউটার সারানোর দোকান থেকে ফোন করে জানালাম, লেবার সার্ভিস পেয়ে গেছি দাদা। আয়লা মাথায় আমায় শ্বশুরবাড়ি পৌঁছে দিয়ে এল বড়দা। শ্রীমতী তুত্তুরী এলেন।  আরো কতকিছুই না ঘটে গেল। বদলে গেল পৃথিবী। বড়দা আর বড়বৌদি শুধু রয়ে গেল একই রকম। আমার দেখা সবথেকে রোম্যান্টিক জুটির আজ ২৪ তম বিবাহবার্ষিকী। এক আকাশ শুভেচ্ছা আর শুভকামনা রইল বড়দা আর বড়বৌদি তোমাদের জন্য। খুব ভালো থেকো, সুস্থ থেকো দোঁহে। এমনি একে অপরের ভালোবাসায় জবজবে থেকো। এমনি ছাতা হয়ে থেকো এই অধমের মাথার ওপর।

অনির ডাইরি ১১ই জানুয়ারি, ২০২৩

 


#তাম্রলিপ্তকড়চা #অনিরডাইরি 

খামোখা বেনিফিট ডিসট্রিবিউশন প্রোগ্রামের দরকারটা কি? কেউ মারা গেলে বা প্রভিডেন্ট ফাণ্ডের টাকা তুলতে হলে বা পেনশনের সময় হয়ে এলে মানুষ এসে আবেদন পত্র জমা করবেন তাঁর এলাকার কালেক্টিং এজেন্ট বা এসএলওর কাছে। ট্রেড ইউনিয়নের প্রতিনিধিরাও অবশ্য অনেক সময় জমা করে যান তাঁদের সদস্যদের বিভিন্ন আবেদন-নিবেদন।   


চেকিং,ভেরিফিকেশন,এনকোয়ারি করে দেখবেন আমাদের ইন্সপেক্টর সাহেবরা। সব ঠিক থাকলে তা উপরে উঠবে,না হলে আটকে রাখা হবে প্রয়োজনীয় নথিপত্রের জন্য। সরকারি ব্যবস্থায় একদম বাতিল তো কিছু হয় না, চট করে। ইন্সপেক্টর সাহেবরা ছাড়লে তবে দেখতে পাব আমি। আমি ছাড়লে, বড় সাহেব পাঠিয়ে দেবেন কলকাতা। কলকাতা অনুমোদন আর টাকা দিলে, ব্যাঙ্কে অ্যাডভাইজ পাঠাব আমরা। ব্যাস্ টাকা ঢুকে যাবে নির্দিষ্ট বেনিফিশিয়ারির অ্যাকাউন্টে। 


মোদ্দা কথা হল, ঘরে বসেই অনুদান বা পেনশন পেতে পারেন যখন, খমোখা তাদের ডেকে এনে বিব্রত করা কেন বাপু। তাছাড়া একটা অনুষ্ঠান করার হ্যাপা কি কম? হল বুক করো, জেলায় হলে সে না হয় মাননীয় জেলাশাসক মহোদয়ের আনুকুল্যে ওণার হলগুলি আমরা বিনি পয়সায় পাই। অন্যত্র দিতে হয় বৈকি সামান্য কিছু ভাড়া।  লাগে ফ্লেক্স, পিপিটি, ডামি চেক, ল্যামিনেট করা শংসা পত্র ইত্যাদি প্রভৃতি। প্রথম দিকে অবিকল ব্যাঙ্ক চেকের মত শংসা পত্র দিয়েছিলাম আমরা, পরদিনই তা নিয়ে ব্যাঙ্কে দৌড়ছিলেন কিছু মানুষ।সে কি কেলেঙ্কারি। সমাজের সবথেকে তলার, সবথেকে অবহেলিত মানুষগুলোকে নিয়ে আমাদের কারবার। শহুরে পারিপাট্য বা পরিশীলন আশা না করাই ভালো।


এর বাইরেও লাগে চা-জল- ন্যূনতম কিছু টিফিন।

খুব সাদামাটা অনুষ্ঠান করলেও, খুব কড়া হিসেব করে চললেও, খরচপত্র কখনই বাঁধা অঙ্কে আটকে থাকে না। ফলে বিল ছাড়তে গিয়ে হামেশাই হাতে থেকে যায় পেন্সিল। হেড আপিসে ফোন করে দরবার করতে হয়, ‘আর দুটো টাকা, আর একটা allotment হবে না?’ 


তা সত্ত্বেও আমরা করি, করি তার প্রথম এবং প্রধান কারণ হল, মানুষগুলোকে খুব দেখতে ইচ্ছে করে। কে সেই মেয়ে, যে কর্মসূত্রে আপাতত অন্য রাজ্যের অধিবাসিনী, যার বিড়ি শ্রমিক মা নদী তীরে জমা করে রাখা মাটি চাপা পড়ে মারা গেছেন অকালে? বর্ষায় পাঁচিল ধ্বসে পুত্র হারা হয়েছেন যে মা, মারণ ব্যাধি কেড়ে নিয়েছে যাঁর স্বামীকে, বয়স হয়ে গেছে বলে আর যোগাড়ের কাজ জোটে না যে ভদ্রমহিলার, গায়ে জোর নেই বলে আর মালপত্র লোডিং এর কাজ করতে পারেন না যিনি  বা চোখে কম দেখেন বলে বাস চালানো ছেড়ে দিয়েছেন যে বৃদ্ধ ভদ্রলোক তাদের আমি অন্তত ব্যক্তিগত ভাবে দেখতে চাই। চাই দুটো কুশল বিনিময় করতে, শুনতে চাই  তাদের গল্প, বলতে চাই, ' ভালো থাকবে/এন।'   নিছক নিষ্প্রাণ পোর্টাল আর শুকনো ব্যাঙ্ক অ্যাডভাইজ নয়, যে রক্তমাংসের মানুষগুলোকে পরিষেবা দিলাম আমরা তাদের সাথে আলাপিত হতে চাই। খোলাখুলি কথা বলতে চাই, টেবিলের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্তে। 


বাঁধাগতের দপ্তরী জীবনের বাইরে, এই দিনগুলো যেন এক ঝলক টাটকা বাতাস বয়ে আনে।পরিচিত মধ্যবিত্ত জীবনের বাইরেও যে একটা দুনিয়া আছে, এই দিনগুলো নতুন করে তা দেখায়। অনুষ্ঠান গুলো যে শুধু একতরফা ভাবে আমারই প্রিয় তা নয়,ভালোবাসে আমার টিমের প্রতিটি সদস্যই।  সেদিনই গল্প শোনাচ্ছিল এক জুনিয়র ইন্সপেক্টর, ‘বুঝলেন তো ম্যাডাম, ওরা আদিবাসী। মাটির ছোট্ট একটা ঘর। যখন ইন্সপেকশন করতে গেছি, বাড়ির কর্তা কাজে বেরিয়েছে। বউটা দুটো ছোট বাচ্ছাকে খেতে দিয়েছে। কি খাচ্ছে জানেন ম্যাডাম, দেখলে আপনার চোখ ফেটে জল আসবে। শুধু গরম ভাত আর আলু- উচ্ছে সিদ্ধ। আর কিচ্ছু নয় ম্যাডাম। আর কিচ্ছু নয়। ’ আবেগ তাড়িত স্বরে বলছিল ছেলেটা। আমার কিন্তু ভীষণ গর্ব হচ্ছিল আমার পরিবারের এই তরুণ সদস্যের জন্য।  কতই না অভিযোগ থাকে সাধারণ মানুষের সরকারি দপ্তরের  অমানবিক মুখ নিয়ে, সরকারি কর্মচারীদের নিয়ে।  আসলে তো আমরাও হুকুমের নৌকর। আমাদেরও হাত- পা বাঁধা থাকে। 


এই ধরণের অনুষ্ঠান করার পিছনে আরেকটাও কারণ থাকে, সবার সাথে দেখা হওয়া। সত্যি কথা বলতে কি তমলুকের দায়িত্বভার গ্রহণ করার পর, দেখেছিলাম এখানে চট করে কেউ আমার আপিসে আসে না। এসএলও/সিএ ছাড়ুন ব্লক/পুরসভার সিকেসিও/ ইন্সপেক্টররাও কেউ খুব একটা আসত না সদর আপিসে। নির্দিষ্ট দিন ছাড়া কেমন যেন খাঁ খাঁ করত আপিসটা। চুঁচুড়ায় তো তাড়ানোই যেত না লোকজনকে। সবসময় গমগম করত আপিসটা। আর এখানে ডেকে পাঠাতে হত। প্রথম আলাপে তাই সাফ জানিয়ে দিয়েছিলাম, এমন করলে হবেনি বাপু। আপিসটা তোমাদেরও। না এলে আমাদের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে উঠবে কেমনে? সুযোগ পেলেই চলে আসুন, কাজে আসুন, অকাজেও আসুন। 


সমস্ত উৎসব অনুষ্ঠান উপলক্ষে তাই মিলিত হই আমরা। বানিয়ে নিই মিলনের অছিলা। বাইশের বছরের শেষ কর্মদিবসেও তেমনি মিলিত হবার ব্যবস্থা করেছিলাম আমরা। তবে এবার আর সদর আপিসে নয়, অনুষ্ঠান হবে ময়নায়। ময়না আমার সবথেকে অবহেলিত সন্তান। প্রায় সাত-আট বছর হল ময়নায় কোন পাকা ইন্সপেক্টর নাই। নেই কোন সিকেসিও। ফলে ময়নাকে আমি যখন পাই, বলা যায় ময়না ছিল পক্ষাঘাত গ্রস্ত। জমে উঠেছে কাজের পাহাড়। নিত্য অসন্তোষ। এসএলওদের মধ্যেও চাপা বিক্ষোভের আগুন। নালিশের ঠেলায় জিভ বেরোনোর খাপ। সেখান থেকে বিগত এক বছরে আমার দুই সুযোগ্য ইন্সপেক্টর প্রথমে শ্রী রঞ্জিৎ রাণা এবং পরে শ্রী সৌরভ চৌধুরীর দাক্ষিণ্যে অনেকটাই সেরে উঠেছে ময়না। খরা কাটিয়ে বেরোতে শুরু করেছে বেনিফিটের ফল্গু ধারা। তেমনি অনুদান প্রাপ্ত কিছু মানুষকে নিয়ে বছরের শেষ কাজের দিনটা কাটানোর পরিকল্পনা ছিল আমাদের। 


সেই উপলক্ষেই হলদিয়ার বড় সাহেবকে নিমন্ত্রণ জানাতে গিয়ে জানতে পারলাম তিনটি বোর্ডের মাথা তথা আমাদের অতিরিক্ত শ্রম কমিশনার সাহেব ঐ দিন খোদ হলদিয়ায় আসছেন শিল্প তালুক সংক্রান্ত মিটিং করতে। এ সুযোগ কি ছাড়া যায়? ইতিপূর্বে আমাদের কোন অনুষ্ঠানে এ সিইও সাহেব থাকতে পারেননি। যদি ঐদিন আমাদের পনেরো কুড়িটা মিনিট সময় দেন, পুরো টিম তাম্রলিপ্ত ধন্য হয়।  বিশেষতঃ ময়নার জন্য এটা বিরাট ব্যাপার হয়। 


আমাদের বড় সাহেবের অনুরোধ ফেলতে পারেন না সিইও স্যার। সম্মতি দেন উপস্থিত থাকার। শুধু দুটো শর্ত ছিল, প্রথমতঃ অনুষ্ঠানটি বছরের শেষ কর্মদিবসে করা যাবে না। কারণ ঐ দিন বিশেষ কারণবশতঃ নবমহাকরণের আপিস ছেড়ে  আসতে পারবেন না উনি।  আর দ্বিতীয়তঃ অনুষ্ঠানটি জেলাশাসকের করণে করতে হবে এবং তাতে আমন্ত্রণ জানাতে হবে খোদ জেলাধীশকে।  


আমাদের খামখেয়ালী - তুচ্ছ অনুষ্ঠানে ইতিপূর্বে কখনও ডিএম সাহেবকে ডাকার কথা আমরা ভাবিওনি। আমাদের দৌড় বড়জোর মহকুমা শাসক অবধি। তাও যখন তিনি আমার গৃহকর্তা ছিলেন। অন্যথায় হলদিয়ার বড় সাহেব আর আমরাই নিপটে নিই নিজেদের মত করে। এত্ত বড় সাহবদের খাতিরযত্ন করার সাধ্য কি আমাদের। সময়ও বেশ কম। ইয়ে বাজেটের কথা বলে আর লজ্জা পেতে চাই না। ভাগ্যে ক্যান্টিনে ধারবাকি চলে।  


দেখতে দেখতে এসে যায় নির্দিষ্ট দিনটা। বড় হলটা পাই না আমরা। মাঝারি হলের জন্য কমিয়ে দিতে হয় লোক। কোলাঘাটের সৌম্য অনুষ্ঠানের নাম দেয়, ‘শ্রমিকসঙ্গে নববর্ষ- ২০২৩’। অফিস আসার পথে ফ্লেক্স ছাপিয়ে আনে শুভাশিস। সময় জানিয়ে আরেকবার পেনশনারদের ফোন করে নেয় নন্দন। রঙিন শংসা পত্র ল্যামিনেট করিয়ে এনে শান্তনু দেখে Seikh/Sekh আর Sk এ বিস্তর গোলমাল। গোলমাল মাঝি আর মাজিতেও। নন্দকুমার থেকে রামচন্দরের নাম ঢোকানোর জন্য পিড়াপিড়ি করতে থাকে রঞ্জিৎ। রাগের চোটে কোথা থেকে ল্যামিনেট করার মেশিনটাই তুলে নিয়ে চলে আসে শান্তনু।চটজলদি ভিআইপি ফোল্ডারের রিপোর্ট বানায় বেদজ্যোতি। সেজেগুজে হাজির হয়ে যায় আমাদের মেয়েরা। কাউকে কিছু বলতে হয় না। তেল দেওয়া যন্ত্রের মত নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করে যায় আমার টিম। 


ঘড়ি ছোটে, সঞ্চালনা মক্স করি সৌম্য আর আমি। কোনটা কে বলবে। সম্প্রতি আমাদের টিমের এক সদস্যকে হারিয়েছি আমরা। নন্দকুমার ব্লকের কল্যাণপুর পঞ্চায়েতের এসএলও তাপস বাবু পাড়ি দিয়েছেন অমৃত লোকে। তাঁর স্মৃতির উদ্দেশ্যে এক মিনিট নীরবতা পালনের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম আমরা। সৌম্য প্রস্তাব দেয় তাপস বাবুর সাথে আমাদের মৃত বেনিফিশিয়ারিদের উদ্দেশ্যেও এক মিনিট নীরবতা পালন করা হোক। 


দেখতে দেখতে এসে যায় মাহেন্দ্রক্ষণ। বড় সাহেবের জন্য নীচের গেটে প্রতীক্ষারত ইন্সপেক্টর রঞ্জিত দৌড়ে এসে খবর দেয়, সিইও স্যার এসে গেছেন। সাথে ডিএম স্যারও আসছেন। আর আসছেন এডিএম ম্যাডাম। হক বাবু আর শুভাশিস ইশারায় জানায়, আছে আছে ফুল আর উত্তরীয় দু-চার খানা বেশিই আছে। চন্দনের ফোঁটা, পুষ্পস্তবক, উত্তরীয় দিয়ে মাননীয় অতিথিদের বরণ করে নেয় আমাদের মেয়েরা। প্রারম্ভিক ভাষণ দেন হলদিয়ার বড় সাহেব। এডিএম ম্যাডাম বক্তৃতা থেকে অব্যাহতি চান। মূল্যবান বক্তব্য রাখেন ডিএম সাহেব। সবশেষে মাইক হাতে নেন আমাদের সিইও মহোদয়। 


ঘড়ি ছোটে। বেনিফিট প্রদান শুরু হয়। সৌম্যর হাতে মাইক, একে একে নাম পড়া হয়। কে পাচ্ছেন,কি পাচ্ছেন,কোথা থেকে পাচ্ছেন। বার বার ময়নার নাম উঠতে থাকায় বোধহয় কুঞ্চিত হয় ডিএম সাহেবের ভ্রু। সৌম্যকে থামিয়ে মাইক ধরি আমি। বলি ময়না আমার দুর্বলতম LWFC ছিল। রঞ্জিত আর সৌরভের জন্য আজ অন্তত লাঠি নিয়ে হাঁটছে। ডিএম স্যার খুশি হয়ে দেখতে চান এই রঞ্জিত আর সৌরভ কারা। উঠে দাঁড়ায় আমার দুই ইন্সপেক্টর। ভূয়সী প্রশংসা পায় জেলাধীশের কাছে। হাততালিতে ভেসে যায় পেক্ষাগৃহ। তারই মধ্যে সৌরভ বলে ওঠে, ‘ একলা পারতাম না স্যার। প্রচুর সাহায্য পেয়েছি ময়নার SLOদের থেকে। যা করেছি, সবাই মিলেই করেছি।’ 


অনুষ্ঠান শেষ হয়ে যায়, মান্যগণ্য অতিথিরা বিদায় নেন। সন্ধ্যে নামে। ব্যাগ গোছাই। অন্য এক যুদ্ধের জন্য।  আগামী কাল ছুটি, বাসে নির্ঘাত আজ মারকাটারি ভিড় হবে। হেঁড়িয়া অবধি সিট পাবার কোন গল্প নেই। বেরিয়ে আসছি, কে যেন বলল,‘ কাজ না তুলতে পারার জন্যই বকুনি খেয়েছি এতদিন। এই ভাবে সবার সামনে দাঁড় করিয়ে প্রংশসা-'।

Monday 9 January 2023

অনির ডাইরি ৯ই জানুয়ারি, ২০২৩

 

#অনিরডাইরি #কাঁথিরকিস্যা 


গতকাল সন্ধ্যায় তুত্তুরীকে পড়াতে বসে হাউ হাউ করে কাঁদছিলাম, আর এখন ফোন হাতে উদ্বিগ্ন হয়ে দাঁড়িয়ে আছি, বাংলোর গেট খুলে। অফিসারের সুন্দরী, পরিশীলিত স্ত্রী হবার কোন যোগ্যতাই আমার নেই। ইতিপূর্বে কোন মহকুমা শাসকের বউ যে এমন ভাবে ছোট গেটে দাঁড়িয়ে কারো প্রতীক্ষা করেননি, বেশ বুঝতে পারছি। সিকিউরিটি অরূপ বাবু বার চারেক গলা খাঁকারি দিয়ে অবশেষে বলেই ফেললেন, ' আপনি ভিতরে গিয়ে বসুন ম্যাডাম,দরকার হলে আমি দাঁড়াচ্ছি বাইরে গিয়ে। ওরা ঠিক চলে আসবে। ' 


চলে তো আসবেই, ওরা আমার তারা যে। কদমতলা পাওয়ার হাউসের তেমাথার মোড়, ওই যে যেখানে বুড়ো বটের নীচে নীরবে দাঁড়িয়ে থাকেন খণ্ডিত বঙ্গের প্রথম মুখ্যমন্ত্রী, ওখান থেকে মাত্র কয়েক কদম দূরেই আমাদের বিদ্যালয়, ‘তারাসুন্দরী বালিকা  বিদ্যাভবন।’ তারাসুন্দরীর প্রাক্তনী হিসেবে, আজও আমরা নিজেদের তারা বলে পরিচয় দিতে অত্যন্ত শ্লাঘা বোধ করি। 


মনে হয় এই তো সেদিনের কথা। ভোর ভোর বসত প্রাইমারি স্কুল, বেলা বাড়লে সেকেণ্ডারি। শিশু শ্রেণী থেকে অষ্টম অবধি ইউনিফর্ম ছিল সাদা জামা, লাল বেল্ট, পায়ে সাদা কেডস্ আর মাথায় লাল ফিতে।  বুকে লাল সোনালী ব্যাজে ডানা মেলে উড়তে উদ্যত দুই মরালী। নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণীর লাল পাড় সাদা শাড়ি।


জীবনের অমূল্য ১২/১৩ বছর কেটেছে ঐ স্কুলে। গড়ে উঠেছে শ্যামল মোলায়েম বন্ধুত্ব। সময়ের উত্তাপে আগ্নেয় শিলার মত জমে পাথর হয়ে গেছে কিছু সম্পর্ক, কিছু বা হারিয়ে গেছে, ভেঙে গেছে সময়েরই অভিঘাতে। বিদ্যালয়ের নিরাপদ জীবন শেষে ছিটকে পড়েছে তারারা মহাকাশ জুড়ে। রক্ষণশীল স্নেহাদ্র পরিবারে বেড়ে ওঠা আর পাঁচটা মেয়ের মতোই আমাদেরও ধারণাই ছিল না, জীবন কতটা রূঢ়, কতটা নির্মম। লড়তেই হয়, নয়তো হারিয়ে যেতে হয়। যে যার নিজস্ব সংগ্রামে এমন ব্যাপৃত হয়ে পড়েছিলাম আমরা, বলতে পারেন হারিয়েই ফেলেছিলাম সব প্রিয় সম্পর্ক গুলোকে। 


কিন্তু কমলি কি অত সহজে ছাড়ে। তাই তো দূরে গিয়েও ফিরে ফিরে আসি আমরা। ভৌগলিক দূরত্বকে বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ দেখিয়ে বেঁধে বেঁধে থাকি আমরা। একত্রিত হই যাবতীয় উৎসব, অনুষ্ঠানে। ভাগ করে নিই একে অপরের সাংসারিক জটিলতা, উদ্বেগ, হতাশা, অবসাদ থেকে তুচ্ছাতিতুচ্ছ আনন্দও। চয়ন বলে, ' ভাই তোদের সুখের দিনে আমায় বেমালুম ভুলে যা, কোন ব্যাপার না। দুঃখের দিনে কেবল ডাকতে ভুলিস না।'  


অধম অবশ্য এক আনন্দমাখা প্রভাতেই  ডেকেছিল তার তারাদের। তখনও আমরা তাম্রলিপ্ত নগরীর নিবাসী। সদ্য বিদায় নিয়েছেন শ্যামাঙ্গিনী। খুলে ফেলা হয়েছে দীপাবলীর আলো, মফস্বল জুড়ে হেমন্তের ছোঁয়া। কুয়াশায় মোড়া মায়াবী ভোরে বাগানে আড্ডা জমিয়েছিল একদল দুধ সাদা বক। বন্ধ কাঁচের জানলার এপার থেকে দেখে মনে হয়েছিল, ' ঠিক যেন আমরা।'  লুকিয়ে তোলা সেই ছবি গ্রুপে পাঠাতেই, 'তমলুক যাব ' বলে লাফিয়ে উঠেছিল অন্তরা। 


ডিসেম্বর-জানুয়ারির কোন এক ছুটির দিনের পূণ্য প্রভাতে তাম্রলিপ্তে তারাদের আগমনের নির্ঘন্ট তো স্থির হল, তারপরই ঝুপ করে বদলে গেল আমাদের নিবাস। পিছিয়ে এলাম প্রায় সত্তর কিলোমিটার। ধামাচাপা পড়ে গেল সবকিছু। 


দিন দশেক আগে নতুন বাড়িতে গৃহপ্রবেশের আমন্ত্রণ জানালো জনৈকা বান্ধবী। মিলনস্থল হাওড়া শহরেই। আমার মত হতভাগ্য জনা দুই ছাড়া সবাই এক বাক্যে রাজি হয়ে গেল। খ্যাঁক করে উঠল কেবল অন্তরা। ‘তোরা কি রে? ঐদিন আমরা অনির বাড়ি যাব বলে কথা দিয়েছি না। আর কেউ না যাস আমি একাই যাব আমার ছেলেকে নিয়ে।’ 


অনির বাড়ি তো আসবে, কিন্তু আসবে কি করে? চয়ন আমায় ফোন করে ঘোর অফিস টাইমে, ‘ বল রে ইয়েটা, কি ভাবে যাব?’ আমরা নিজেরাই সদ্য এসেছি। কিছুই জানি না। তাও আমতা আমতা করে বললাম, কেন, ট্রেনে করে। দীঘার ট্রেনে উঠে কন্টাই নেমে পড়বি। শীতকালের সপ্তাহান্তের সকালে যেন দীঘার টিকিট পাওয়া অতই সোজা। তাও আবার এতজনের। আসার যাও বা মেলে, ফেরার টিকিট মেলে না। 


বাসেও আসা যায় স্বছন্দে, দীঘার বাস খুব সহজেই মিলবে বেলেপোল থেকে। তবে এই ট্যুরিস্ট মরশুমে, ছুটির দিনে বাচ্ছা সমেত এতগুলো মেয়ে, কি আদৌ অত ভিড় বাসে উঠতে পারবে? বাকি রইল গাড়ি। এই সময় গাড়ি পাওয়াও কি অত সহজ রে ভাই। যা ছিল সব আগেই বুক করে নিয়েছে ভ্রমণ পিপাসু তথা পিকনিক প্রেমী সমঝদার জনতা। ধীরে ধীরে পিছু হঠতে থাকে বেশ কয়েকজন তারা। এতটা দূর, যাওয়া-আসা নিয়ে ভোর থেকে প্রায় মাঝরাতের গল্প। উৎসব মুখর দিনে প্রিয়জনকে ছেড়ে অতক্ষণ থাকা যায় নাকি? 


হতোদ্যম হয় না কেবল অন্তরা, "না যাবোই আমরা তোর কাছে।"  চয়ন, অন্তরা, শুভমিতা আর অ্যাঞ্জুলা এই চারজন পাগলের মত গাড়ি খুঁজতে থাকে। ছোট,বড় যা হয় হোক, ঠেসেঠুসে ধরেই যাবে সবকটা। শেষ পর্যন্ত যোগাড় হয়েই যায় একটা বড় গাড়ি। হয়তো অনেকটা বেশি দামী, তা হোক, ওরা আসবেই, ওদের অনির কাছে। 


দিন গুনি, ঘর সাজাই, মেন্যু বানাই আমি। কি করব, কি খাব, কি পরব, কোথায়, কিভাবে ছবি তুলব  ইত্যাদি প্রভৃতি। পেঁচার মত গোল গোল চোখ করে দেখতে থাকে শৌভিক। ‘তোর বন্ধুরা এত টাকা খরচা করে, এত দূর কাঁথি আসবে শুধু তোকে দেখতে? আর কোথাও যাবে না? দীঘা? তাজপুর? মান্দারমনি?’ ব্যাপারটা বোধগম্য হয় না আমার বরের। জবাবে বলি, "আমরা তারা না, আমরা ওমনিই।' 


 সত্যিই, আমরা তারা বলেই হয়তো আজ ওরা আসছে। আর কি যে অসম্ভব প্রতিকূলতার মধ্যে দিয়ে আসছে, তা সিকিউরিটি অরূপ বাবু জানেন না বটে, আমি জানি। চয়নটার নার্ভের ব্যামো আছে। যখন তখন উল্টে যায়। ‘গিরি হুয়ি অউরৎ’ বলে ক্ষেপাই আমরা। দিন কয়েক আগেই ভোরের ট্রেন ধরতে গিয়ে গড়িয়ে পড়েছে হাওড়া স্টেশনের সাবওয়েতে। সাত- আটটা সিঁড়ি গড়িয়ে পড়েও থমকায়নি, উঠেছে, ধুলো ঝেড়েছে তারপর ঐ অবস্থায় দৌড়ে ট্রেন ধরেছে। ভিন রাজ্যের সেমিনার অ্যাটেন্ড করেছে, তারপর আর উঠে দাঁড়াতে পারেনি। হোটেলের লোকেরা আক্ষরিক অর্থেই তুলে নিয়ে গেছে স্থানীয় ডাক্তারের কাছে। ইঞ্জেকশন আর ওষুধের জোরে কোন মতে বাড়ি ফিরেছে বটে, সেই থেকে শয্যাশায়ী। না হাঁটতে পারছে, না ডান হাতে কিছু তুলতে পারছে।


শুভমিতার অবস্থা আরোও খারাপ। পরশুদিন খাট থেকে পড়ে গেছেন ওর মা। আপদ হাওড়া শহর, জনে জনে ফোন করেও কোন ডাক্তারকে বাড়িতে আনতে পারেনি। স্থানীয় এক ডাক্তারবাবুর কম্পাউন্ডার, যিনি নিজেকে হাফ ডাক্তার বলে দাবী করেন,শেষ পর্যন্ত  তিনি দেখে বলেছেন সম্ভবতঃ হিপ জয়েন্ট ফ্রাকচার। এক্সরে করা আবশ্যক কিন্তু রুগীকে নড়ালে বিপদ বাড়বে। গতকাল মেশিন এনে বাড়িতে এক্সরে হয়েছে কাকিমার। সেই রিপোর্ট ছোঁয়া মাত্র বড় অস্থি বিশেষঞ্জ ছুঁড়ে দিয়ে বলেছেন,‘সার্জারি করিয়ে নিন।’ দুশ্চিন্তা দুর্ভাবনায়, গতকাল সন্ধ্যে বেলাও পাগলের মত করছিল মেয়েটা। 


নেহাৎ অন্তরা জোর করে ধরে নিয়ে গিয়েছিল এক বয়োজ্যেষ্ঠ অস্থি বিশারদের কাছে। রাত দশটার ফোনে অন্তু বলছিল,‘বুড়োটা আমার কাছে ভগবান। বুঝলি অনি। এই আপদ দুটোকে সেটাই বললাম। চল একবার দেখিয়ে নে।’   


 অন্তরার নিজেরও যা অবস্থা। সামনেই ছেলের বোর্ড পরীক্ষা।  এমনিতে টিনটিন খুব ভালো ছেলে, দক্ষিণ কলকাতার সবথেকে বড় কনভেন্ট স্কুলের ছাত্র, উঠতি চকলেট হিরোদের মত দেখতে, অসম্ভব ভালো গানের গলা। নম্র, ভদ্র, বিনয়ী এবং অন্তরা যতই অস্বীকার করুক, মায়ের ভয়ানক বাধ্য। সব মিলিয়ে সোনার টুকরো। দোষ একটাই, বড় বেশী রকমের ভোম্বল। একটা উদাহরণ দিলেই বুঝতে পারবেন, তিনি সম্প্রতি প্রি বোর্ড পরীক্ষার রুটিন না দেখে ভূগোল পরীক্ষার দিন কেমিস্ট্রি পড়ে চলে গিয়েছিলেন।  


 তো এহেন টিনটিন বাবু  প্রি বোর্ড পরীক্ষার আগে আচমকা অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাকে নিয়ে কলকাতা-হাওড়া করে করে নাজেহাল হয়ে একটু সুস্থ করে তুলেছে অন্তরা। এরই মধ্যে তো হঠাৎ মারা গেলেন ওর জেঠু। 


সবথেকে বড় দুঃসংবাদ এসেছে গতকাল রাত্রে। আচমকা মাতৃহারা হয়েছে আমাদের এক প্রিয় বান্ধবী। এমনি- এমনি কাঁদিনি গতকাল রাতে। যত বয়স বাড়ছে, প্রিয় জন হারানোর ভয় এবং বেদনাও যেন ততো তীব্র হচ্ছে। শোকের আর আপন পর থাকছে না। 


গাড়িটা বাতিল করে দিয়েছিল ওরা। আমিও বলেছিলাম, এই ভাবে আসা যায় নাকি। বুড়ো ডাক্তারের বদান্যতায় যখন জানা গেল, কাকিমা শুধু ট্র্যাকশন দিলেই সুস্থ হয়ে যাবেন, আর চয়ন রেস্ট নিলেই আবার চাঙ্গা হয়ে যাবে, পুনরায় উজ্জীবিত হয়ে উঠল তারা এন্ড কোং। সঙ্কোচের মাথা খেয়ে বাতিল করা গাড়িকে ফোন করতে লাগল এঞ্জুলা। ঝাড়া এক/দেড় ঘন্টার চেষ্টায় যখন ফোন ঢুকল না তাঁর মোবাইলে, বৈশাখী আমায় ফোন করে জানাল, ' তুই ভাবিস না। আমরা যাবোই। একটু ভোর ভোর বেরিয়ে বাসেই চলে যাব।' শৌভিক আবার বলল, ' এত কষ্ট করে কেন আসবে? তোকে দেখতে?' কি বলি? হয়তো তাই, আমরা ওমনিই!


শেষ পর্যন্ত অবশ্য পাওয়া যায় গাড়ি দাদাকে। তিনি অন্য ভাড়া না পেয়ে মনের দুঃখে বনে গিয়েছিলেন হয়তো, পর্যায়ক্রমে এতগুলো বৌদির ফোন পেয়ে তৎক্ষণাৎ রাজি হয়ে গেলেন কাঁথি আসতে। পইপই করে বলেদিলাম, যত পারিস ভোরে বেরোস। প্রাতরাশের জন্য কোথাও দাঁড়াস না। গরম গরম কড়াইশুঁটির কচুরি আর গুলি আলুর দম খাওয়াব, মানে মানে এসে উদ্ধার কর।  তখনও কাজ চলছিল, বন্ধ ছিল সাঁতরাগাছি ব্রিজ। আসার রাস্তা অন্য দেখাচ্ছিল গুগল। ভুলেও যেন ও পথ ধরিস না। আটকে গেলে ফেঁসে যাবি ব্যাটারা। একটু দাঁড়াতে হলেও হাই রোড ছেড়ে নড়িস না। 


এতকিছুর পর যখন ঘটে গেল এত বড় অঘটন, আর কাউকে কিছু বলার মুখ রইল না। মধ্যরাতেও অন্তরা লিখেছিল,‘জানি না অনি। বুঝতে পারছি না কি করব। এখনও খাওয়া হয়নি। কখন খাব, কখন শোব জানি না। চয়নটাও এত ভেঙে পড়েছে, ওর যা শরীরের অবস্থা। শুভমিতাও যেতে চাইছে না, কাকিমাকে ঐ অবস্থায় ফেলে। কাকিমা যদিও বলেই চলেছে, 'তোরা ওকে নিয়ে যা। জোর করে ধরে নিয়ে যা। মেয়েটা একা একা এত কিছু করছে, দুদণ্ড বিশ্রাম পাক। কাকু আছে, আয়া আছে আমার কোন সমস্যা হবে না।’  


ফোন চার্জে বসিয়ে যখন কম্বলের নীচে ঢুকলাম, আধ ঘুমন্ত শৌভিক জানতে চাইল, ‘তোর বন্ধুরা কাল আসছে না তো?’ বললাম জানি না। যদি আসে, কজন আসবে? ভদ্রমহিলার এক কথা, 'জানি না।'  বিরক্ত হয়ে পাশ ফিরে শুতে শুতে গজগজ করে শৌভিক,‘ যদি আসে খাওয়াবি কি? কি রাঁধবি, কজনের জন্য রাঁধবি কিছুই তো জানিস না দেখি।দোকান বাজার ও কিছু করলি না।’ সত্যিই কিছু জানি না আমি। জানে না কেউই। 


ভোর সাতটা বাজতে পাঁচে যখন ঝনঝনিয়ে উঠল ফোনটা, ধড়মড় করে উঠে বসলাম দোঁহে, ফোনের ওপার থেকে শুভমিতার তীব্র চিৎকার,‘অনিইইইই আমরা আসছিইইইই। সবাই আসছিইইই। পাক্কা আট জননননন”। আধ ঘুমন্ত বরকে মারলাম এক গোঁতা,‘বাজার কর। খাবার অর্ডার দে। আট জন আসছে।’ মাথা চুলকায় শৌভিক, এতজন কি করে হল। কি হল, কেন হল,কিভাবে হলর গল্প তো চলতেই থাকবে, আপাততঃ ব্যাটারা আসুক তো। 


কড়ায় ঠাণ্ডা হচ্ছে বাগানের ধনে পাতা ছড়ানো গুলি আলুর দম। কড়াইশুঁটির পুর উদরস্থ করে রেডি হয়ে আছে, সাদা ময়দার লেচিরা। গরম গরম নতুন গুড়ের রসগোল্লা ও রেডি। ব্যাটারা আসুক তো। "দাঁড়া নাচিন্দা মায়ের মন্দিরে মাথা ঠুকে যাই" মেসেজ করেছে শুভমিতা পনেরো মিনিট আগে। ওখান থেকে আমাদের নিবাস বড়জোর মিনিট পনেরো। জলদি আয় ব্যাটারা আর যে তর সয় না। 

ঘাড় ঘুরিয়ে জবাব দিই,‘অরূপ বাবু আপনি বসুন, আজ আমিই এই বাংলোর সিকিউরিটি। ওরা এলে বড় দরজা আমিই খুলে দেব।’ নাহলে এই অতিথিদের মান থাকবে নাকি।

Sunday 8 January 2023

অনির ডাইরি ৭ই জানুয়ারি, ২০২৩

 

#অনিরডাইরি #কাঁথিরকিস্যা 



পাঁচ ঘন্টা দশ মিনিটের টানা মিটিং, মিটিং চলাকালীন যতবার কোন পক্ষ বলছে, ‘আর পারছি না ম্যাডাম, মাথা ভোঁ ভোঁ করছে-। ’ ততোবার একটাই বুলি আউড়ে যাচ্ছি, আমি পারছি কি করে? আপনাদের তিনচার গুণ দূরত্ব সফর করে এসেছি, আবার এতটাই পথ পেরিয়ে বাড়ি ফিরব। শুধু কি তাই, বাড়ি ফিরে মেয়েটাকে আবার পড়তেও বসাতে হবে। 


তমলুকে অন্তত বিজ্ঞান বিভাগটা পড়ানোর জন্য একজন দিদিমণি ছিলেন, এখানে তো তাও নেই। সেশন শেষ হতে আর খুব জোর বাকি এক মাস, কোন দিদিমণি/মাস্টারমশাই এমন সময়ে আমার গুণধরের দায়িত্ব নেবে মশাই? অগত্যা,  বাংলা, হিন্দি, দুটো ইংরেজি(ভাষা এবং সাহিত্য), অঙ্ক, পদার্থবিদ্যা, রসায়ন,জীববিজ্ঞান,কম্পুটার বিজ্ঞান মায় নাগরিক বিজ্ঞান পর্যন্ত সবাই সদলবলে আমার ঘাড়ে চেপেছেন। সে যে কি চাপ- 


শৌভিকের ভাগে ছিল ইংরেজি সাহিত্য। কিন্তু কাঁথির এমন চাপ সে বেচারা সত্যিই মাথা তুলতে পারে না আজকাল। তাই আমিই পড়িয়ে দিই, বুঝিয়ে দিই। প্রশ্নোত্তর লেখে তুত্তুরী স্বয়ং, চেক অবশ্য শৌভিক করে দেয়। দরকারে টুকটাক লিখেও দেয়। মুস্কিল হয় আমার। এত গুলো বিষয় পড়ানো,লিখতে দেওয়া এবং সেই হোমওয়ার্ক চেক করার জন্য যে সময় এবং অধ্যাবসায় প্রয়োজন,তার কোনটাই আমার নেই। প্রায় দিনই পড়াতে বসে মনে হয়, ছেড়ে দে মা, কেঁদে বাঁচি। 


তাও যদি ছাত্রী একটু পদের হত। পড়তে বসতে কারো যে এত অনীহা থাকতে পারে,মাইরি বলছি তা বাপের জন্মেও দেখিনি। বই নিয়ে আয় বললে তিনি কুঁতিয়েকাতিয়ে শুধু বইটাই নিয়ে এসে হাজির হন। খাতা নিয়ে আসতে বললে, পেন আনেন না। পেন আসে তো পেন্সিল আসে না। জ্যামিতি করাতে বসে দেখি সব পেন্সিলের শিস্  ভাঙা। সারা বাড়ি তোলপাড় করেও জোটে না, পেন্সিল বাড়ার কল। হোমওয়ার্কের পাতায় কি ভাবে যেন জল এমনকি দুধও উল্টে পড়ে মুছে যায় অনেককিছু। সবার ওপর তাঁর নিরন্তর বিড়বিড় করে যাওয়া। কি যে বলেন বুঝি না বটে, তবে গ্রহান্তরের কোন ভাষায় যে অধমের মুণ্ডপাত চলছে তা বেশ বুঝতে পারি। 


তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরলেই তাঁর মুখ শুকিয়ে যায়। তখন তিনি দৌড়ে হোমওয়ার্ক করতে বসেন। রাত বাড়লে টোটো পাবার সমস্যা হয় বলে,ফোন করলে বাসস্ট্যান্ডে গাড়িটা পাঠিয়ে দেয় শৌভিক। সামান্য সুবিধা হয়, পাঁচ সাত মিনিটে বাড়ি পৌঁছে যাই আর কি- । তাতেও তার ঘোরতর আপত্তি। বাপকে জপান, ‘গাড়ি পাঠিও না বাবা। এলেই তো- ’ 


এতদিন বাপ একাই হাড় জ্বালাত, এখনও কন্যাও সেই দলে ভিড়েছে। এমনকি আদর করতে গেলেও তিনি আজকাল সন্ধিগ্ধ স্বরে প্রশ্ন করেন,‘ পড়তে বসতে বলবে নাকি?’ আমার বাপের নাম হিটলার হতে পারে, আমার তো নয়। মেয়ের মন পাবার জন্য হরেক রকম কসরৎ করি। হাত ধরে বাগানে হাঁটতে বেরোই দুজনে, জানতে চাই, কোন খেলা খেলবে কি না। শ্রীমতী তুত্তুরীর অন্যতম প্রিয় খেলা অ্যটলাস। অনেকটা অন্তক্ষরীর মত। শুধু শেষ বর্ণটা দিয়ে কোন গান গাইতে হয় না। বলতে হয় কোন দেশ বা জায়গার নাম। প্রায়ই খেলি আমরা এবং শ্রীমতী তুত্তুরী গোহারান হেরে যান। আরে ভাই আমি হলাম সাবেকী বাংলা মিডিয়াম। সবকিছুই এমন ঘাড় ধরে পড়ানো হত আমাদের, তারপাশে সিবিএসসি, আইসিএসসির ছেলেমেয়েরা না সেদিন দাঁড়াতে পারত না আজ পারে। 


আমাকে হারানোর উদগ্র বাসনায় অ্যটলাস বই খুলে রীতিমত দেশের নাম মুখস্থ করে রাখে তুত্তুরী। খুব একটা হেরফের হয় না ফলাফল। তারাসুন্দরী জিন্দাবাদ! রাত বাড়ে, কুয়াশা নামে। বাগানের নিম গাছের ডালের আড়াল থেকে মুখ বার করে শশধর। সজনে ডাঁটার গাছের কোটর থেকে হু হু করে চিৎকার করে ওঠে পেঁচাটা। আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরে  সারাদিনের ক্লান্তি। বিছানা, বালিশ আর গোলাপী কম্বলটার জন্য আক্ষরিক অর্থে ‘কাঁন্দে প্রতি অঙ্গ মোর।’     


ঘরে ফিরতে উদগ্র মায়ের হাত চেপে ধরে তুত্তুরী। ‘আর একটু খেলো না মা, প্লিজ।’ মেয়ের দুইচোখের চরম আকুতিকে অগ্রাহ্য করা আমার সাধ্যাতীত।  খেলার ফরম্যাট বদলে দেয় তুত্তুরী, অন্তক্ষরী নয়, প্রশ্নোত্তর পর্ব হবে এবার। একে অপরকে একটা করে অক্ষর দেব আমরা, তাই দিয়ে বলতে হবে দেশের নাম। হাই চেপে বলি, বেশ, তবে কেবল দশ দান খেলব কিন্তু। তারপর ঘুমাতে যাব।


 ‘ এম দিয়ে দুটো দেশের নাম বলো’। প্রথম দান দেয় তুত্তুরী। এ আবার কেমন খেলা? দুটো দেশের নাম কেন বলব? থতমত খায় তুত্তুরী, সামান্য ভেবে বলে,‘আচ্ছা একটাই বলো না হয়।’ ততোক্ষণে অবশ্য মালয়েশিয়া হয়ে মালদ্বীপে পৌঁছে গেছি আমি। এবার আমার প্রশ্ন করার পালা, এস দিই আমি তুত্তুরীকে। দুটো দেশেরই নাম বল ব্যাটা।  সুদান থেকে সৌদি আরব হয়ে অস্ট্রেলিয়া, বুরুন্ডি,ডেনমার্ক, এল সালভাডোর, জাপান, কসোভো হয়ে হন্ডুরাসে পৌঁছাই আমরা। দশ দান যে কখন বিশ পঁচিশ হয়ে গেছে খেয়াল থাকে না কারো। 


পঞ্চাশই হয়ে যেত হয়তো, যদি না মাঝে বেরসিকের মত কিছু দেশের রাজধানীর নাম আমি না ধরতাম। বা কোন মহাদেশে অবস্থিত মার্কা বেরসিক প্রশ্ন না করতাম। শোবার সময় সমাগত। রাত এগারোটার মধ্যে আলো নিভিয়ে না শুয়ে পড়লে পরদিন ভোরে উঠতে কাঁদতে হবে। শুয়ে পড়ি দুজনে যে যার ঘরে, নিভে যায় আলো। তন্দ্রা এসে ঘিরে ধরে, সাথে সাথে ঘিরে ধরেন তিনিও। ‘আর একটু খেলো না মা প্লিজ। কাল তো সেই ভোর বেলায় আমায় স্কুলের গেটে ছেড়ে চলে যাবে, তারপর আবার রাতে দেখা হবে।’ 


সেন্টু দিচ্ছে বুঝতে পারি, তাও গলে যায় মায়ের হৃদয়। ভালো করে কম্বলে জড়িয়ে নিই মেয়েকে। খেলতে পারি, তবে আর দেশ-মহাদেশের খেলা নয়। তারথেকে বরং গল্প বানাই চল। সে আবার কেমন খেলা, সন্ধিগ্ধ হয় তুত্তুরী। এই অছিলায় আবার কিছু পড়াতে চাইছে নাকি মা? হেসে বলি, তুইই শুরু কর বরং। পৃথিবীর যে কোন বিষয় নিয়ে। তোর যা ইচ্ছে, সেই গল্প হবে। 


বেশ খানিকক্ষণ, ‘ আমার কিছু মাথায় আসছে না’ করতে করতে শ্রীমতী তুত্তুরী শেষ পর্যন্ত বলেই বসেন। ‘এক যে ছিল রাজা। রাজার সুন্দরী নারীদের প্রতি অসম্ভব ঝোঁক। সুন্দরী মেয়ে পেলেই তাকে বিয়ে করে ফেলে।’ জানলা দিয়ে ঘুম পালায়। এ কেমন গপ্প রে ভাই। আজব দুশ্চরিত্র রাজামশাই মাইরি। আমার দান না আসা পর্যন্ত মুখ খোলা যাবে না। অন্ধকারে দাড়ি থুড়ি থুতনি চুলকাই। ‘রাজার হাতি শালে হাতি, ঘোড়া শালে ঘোড়া, প্রাসাদ ভর্তি রাণী।’ বলে থেমে যায় তুত্তুরী,‘ এবার তুমি বলো।’ 


মাথার ঝিমন্ত কলকব্জাগুলিকে খোঁচাই আমি, গল্প শুরু হলে তাকে শেষ না করে ছাড়া পাপ। অসমাপ্ত কত গল্প যে হাওয়ায় উড়ে বেড়ায়। সিংহলের রাজকন্যা, চিতোরের রাণীকে স্মরণ করে মুখ খুলি আমি, ‘একদিন সেই রাজার সভায় এসে হাজির হল এক চারণ কবি।’ চারণ কবি ব্যাপারটা বোঝাতে কিছুটা সময় যায়। এগোয় গল্প,‘সেই চারণ কবি এসে বলে, রাজা শুনেছি তুই সৌন্দর্যের পৃজারি। দেশের যাবতীয় সুন্দরী রাজকন্যা তোর ঘরনী। তাই নিয়ে তোর বড় অহংকার। কিন্তু জেনে রাখ, এই সসাগরা ধরিত্রীর সবথেকে সুন্দরী রমণী কিন্তু নেই তোর ঐ হারমে।’ 


চেনা গল্পের গন্ধ পায় তুত্তুরী। নিজের অংশটুকু মক্স করে মনে মনে। কিন্তু এত সহজে দান ছাড়ব নাকি আমি? আমার গল্প এগোয়,‘রাজা জানতে চায়, কে সেই অনিন্দিতা নারী?’ মায়ের নাম শুনে ফিক্ করে হেসে ওঠে তুত্তুরী। তুত্তুরীর বাংলা শব্দভাণ্ডারের সীমিত রূপ নিয়ে ব্যঙ্গ করি আমি। অতঃপর গল্পে ফিরে যাই দোঁহে। ‘চারণ কবি বলে, তারে আমি চোখে দেখিনি। তার অনেক গল্প শুনেছি। সব চারণ কবিরাই তার কথা জানে। তাকে নিয়ে গান বাঁধে। কিন্তু কেউ তাকে দেখতে পায় না। নগরাজ হিমালয়ের কোন গোপন উপত্যকার রাণী তিনি। তিনি সবাইকে দেখতে পান, তাঁর কাছে সবার খবর থাকে। কিন্তু তাঁর খবর কারো কাছে থাকে না। তাকে খুঁজে বার করা দুঃসাধ্য।’ 


ব্যাস গপ্প শেষ। ঘুমাতে যা বলে ঠেলি মেয়েকে। তুত্তুরী নড়ে না। তুত্তুরীর রাজা বেরিয়ে পড়ে সেই পাহাড়ি সুন্দরীর তত্ত্বতালাশে। সঙ্গে যায় লোকলস্কর, হাতিঘোড়া। রাজা একপা যায় আর পথচলতি মানুষজনকে প্রশ্ন করে, ‘কোথায় পাব তারে?’ অবশেষে রাজা একদিন সেই স্বপ্নসুন্দরীর সন্ধান পান।’ কেলেংকারি মাইরি। এবার নির্ঘাত স্বপ্নসু্ন্দরীকে ঘোড়ায় চাপিয়ে বাড়ি ফিরবে রাজা। অতঃপর হারেমের চার দেওয়ালে দম আটকে মরবে আমার হিমালয়ের রাণী।  কিছুতেই রোম্যান্টিক গল্প হতে দেব না আমি। 


মাঝপথে জোরজবরদস্তি গপ্পে ঢুকে পড়ি আমি। ‘এবার আমার পালা। কিন্তু দেখা যায়, এর আগের উনপঞ্চাশ বারের মত, এবারের তথ্যও ভুল। ভেঙে পড়েন রাজামশাই। ফেরৎ পাঠিয়ে দেন যাবতীয় লোকলস্কর, সৈন্যসামন্ত। রাজবেশ ফেলে দিয়ে পরিধান করেন ফকিরের বসন। ছাড়তে পারেন না কেবল তরবারি আর আদরের ঘোড়াটাকে। ঘোড়ায় চেপে পাহাড়ি পথে একাই পরিভ্রমণ করেন রাজা, ঘুরে বেড়ান এই উপজাতি থেকে ঐ উপজাতির রাজ্যে। ক্ষুন্নিবৃত্তির জন্য আতিথ্য দেন ছাপোষা গরীর মানুষের। শিকারে সাহায্য করেন গাঁয়ের পুরুষদের। খেলা করেন ছেঁড়া পোশাকের শিশুদের সাথে। গল্প করেন গাঁওবুড়োদের সঙ্গে। তেমনি এক গাঁওবুড়ো একদিন বলে,‘ আশা ছাড়িস না রাজা। তুই তাকে দেখতে পাচ্ছিস না বটে, সে তোকে দেখছে কিন্তু। তোর কাজে, তোর পরিবর্তনে খুব খুশি হচ্ছে সে। দেখবি ঠিক একদিন তোর সামনে এসে হাজির হবে সে।’ 


আর রাজার কষ্ট সইতে পারে না তুত্তুরী। টেনে নেয় গল্পের রাশি। ‘একদিন রাজা এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে যাচ্ছে, এমন সময় ঘনিয়ে এল রাত। সঙ্গে নামল তুষার ঝড়। কোনমতে একটা গুহায় মাথা গুঁজল রাজা। গুহার মুখে আগুন জ্বালিয়ে ঘুমিয়ে তো পড়ল রাজা, যখন ঘুম ভাঙল, দেখে সে একটা অন্য জায়গায় শুয়ে আছে।’


এই রে আবার রোম্যান্টিক গল্পের দিকে গড়াল তুত্তুরীর গল্পের গরু। রাশ ধরি আমি,‘ চোখে এসে পড়ছে প্রভাতী সূর্যের কিরণ। রাজা নড়তে গিয়ে বুঝতে পারল, পিচমোড়া করে বাঁধা তার হাত পা। ঘাড় ঘুরিয়ে রাজা এদিক তাকায়, ওদিক তাকায়। যতদূর চোখ যায়, শুধু মেয়ে আর মেয়ে। একটাও পুরুষ নেই। মেয়েরা সবাই সশস্ত্র।এমনকি বালিকারাও।  অস্ত্র নিয়েই কেউ রান্না করছে, কেউ সওদা করছে, কেউ পড়াচ্ছে, কেউ অস্ত্র বানাচ্ছে ইত্যাদি প্রভৃতি। একটা গোল পাথরের চাকার ওপর শুয়ে আছে রাজা। সামান্য নড়তেই, দুজন নারী উঠে এল কাজ ছেড়ে। একটু দূরে দাঁড়িয়ে অভিবাদন জানাল, তারপর নম্র অথচ ঋজু সুরে বলল,‘ মার্জনা করবেন, এভাবে রাতের আঁধারে আপনাকে তুলে আনার জন্য। আপনার ঘোটক এবং অস্ত্র আমাদের জিম্মায় সযতনে রক্ষিত আছে। আমাদের রাণী আপনার সাক্ষাৎপ্রার্থী।’


রাজা কো রাণী মিল গ্যয়ার আনন্দে খলবল করে তুত্তুরী। আমি বলি, তুই বলবি বাকিটা। ঘাড় নাড়ে তুত্তুরী। তোমারটা দারুণ হচ্ছে। তুমিই বলো। বেশ, গল্প গড়ায়, পাহাড়ি নদীতে অবগাহন করে রাজা। ফল দিয়ে প্রাতরাশ সারে রাজা। দুচারজন গ্রাম্য মহিলার সাথে কুশল বিনিময় করতে যায় রাজা। কিন্তু ব্যর্থ হয়। সবাই সম্মান দেয়, সবাই হাসে, কিন্তু আপন করে নেয় না রাজাকে। অবশষে আসে সেই পরম কাঙ্ক্ষিত মুহূর্ত। দুই প্রহরিনীকে অনুসরণ করে রাজা মশাই এসে উপস্থিত হন এক উঁচু ঢিপির সামনে। ঢিপির গায়ে কাটা ধাপ বেয়ে রাজা ওপরে ওঠেন, ওপরের খোলা চত্বরে চলছে পাঠশালা। মন দিয়ে শাস্ত্র শিক্ষা করছে জনা ছয়েক অপরূপা বালিকা। প্রত্যেকের পাশে রাখা তার নিজস্ব অস্ত্র। কারো তরবারি তো কারো তীরধনুক। যিনি পড়াচ্ছেন তিনিও অপরূপা। পক্ককেশ, কপালে মুখে হাল্কা বলিরেখা, মুখমণ্ডলে মাখামাখি পরম প্রশান্তি। যেন স্নেহময়ী পরমেশ্বরী। দেখলে মন শান্ত হয়। 


কিন্তু রাণী কই? ব্যগ্র হয়ে ওঠেন রাজা। দুই প্রহরীর একজন, গিয়ে অভিবাদন জানায় শিক্ষয়ত্রীকে। ফিসফিসিয়ে কিছু বলে।  তিনি মৃদু হেসে ওঠেন। ঝলমলিয়ে ওঠে যেন পাহাড়ি উপত্যকা। ইশারায় ছাত্রীদের বলেন, ভাগ্। তোদের ছুটি। ইশারায় চলে যেতে বলেন, প্রহরীদেরও। এবার তাকান রাজার দিকে, চোখ নামিয়ে বলেন বসতে। এ আদেশ অমান্য করা শিবেরও অসাধ্য। মাটির ঢিপির ওপর বসে পড়েন রাজা। মুখোমুখি ঢিপির ওপর বসেন সেই বয়োজ্যেষ্ঠা নারী। তারপর জলতরঙ্গ আর সেতারের যুগলবন্দির সুরে বলে ওঠেন,‘এবার বলো তো বাপু, কেন আমায় খুঁজছিলে?’ 


তারপর? সাগ্রহে জানতে চায় তুত্তুরী। ‘সেটা তো তুই বলবি। ভাব, ভাব, ভাবা প্রাকটিশ কর। আপাততঃ মধ্যরাত হতে বসেছে, ঘুমিয়ে আমায় ধন্য করো মা।

অনির ডাইরি ৫ই জানুয়ারি, ২০২৩

 


#তাম্রলিপ্তকড়চা 

তমলুকে জয়েন করে ইস্তক একাধিক বার শোকজ খেয়েছি ওপর থেকে। সবথেকে প্রথম শোকজটা ছিল একদল এসএলওর নালিশের ভিত্তিতে। নালিশখানা প্রত্যক্ষ ভাবে আমার নামে ছিল না যদিও, ছিল আমার চেয়ারের বিরুদ্ধে। তবুও, শোকজ তো রে বাবা- 


যাঁর সইয়ে শোকজ এর মেলটা এসেছিল, তাকেই  ফোন করে চড়াও হলাম,‘ এত বছর চাকরি করে, শেষে আমার বিরুদ্ধে এই অভিযোগ? আর তোমরা সেসব বসে বসে শুনছ?’ উনি অসহায় ভাবে বললেন, ‘ তাও তো নালিশের চিঠিটা তোমায় পাঠাইনি। আরো কদর্য ভাষায় লেখা হয়েছে সে চিঠি।’ তাই নাকি? তা কি এমন কদর্য ভাষায় আমার থুড়ি আমার চেয়ারের বদনাম করেছে ব্যাটারা? উনিও পাঠাবেন না, আমিও ছাড়ব না। অনেক ধস্তাধস্তির পর শেষমেষ চিঠিটা যোগাড় করলাম। 


পড়লাম। নাঃ তেমন খারাপ কিছু লাগল না। ওদের কিছু নালিশ ছিল, সেটা তেমন অন্যায্য কিছু না। চেয়ারে বসার পর, সে কথা আমাকে জানিয়েও ছিল মৌখিক ভাবে। কিন্তু সেই ব্যথায় মলম দেওয়ার সাধ্য আমার ছিল না। ব্যর্থ মনোরথ হয়ে, আমার ওপরমহলে জানিয়েছে আর কি। শোকজের জবাবে সেকথাই লিখলাম। আর মৌখিক ভাবে ব্যাটাদের ডেকে বললাম, বাপুরে একটু সময় দাও। তোমাদের অভিযোগ গুলোকে যদি ভালোবাসায় না বদলাতে পেরেছি, তো আমি টিম চুঁচুড়ার অনিন্দিতা ম্যাডাম নই। 


তারপর, বদলে গেছে ছটা ঋতু। এদিকে বুড়ো রূপনারায়ণ আর ওদিকে বুড়ি কংসাবতীর বুক দিয়ে বয়ে গেছে কতই না বারি ধারা। সেদিনের নালিশওয়ালাদের থেকে আর কোন নালিশের চিঠি যায়নি কলকাতা। বরং আজকাল ওরা এসে বলে যায়, কথায় কথায় যে ,‘ আপনি আছেন তো, আমাদের অভিভাবক।’ বকলে, ধমকালে, ঘর থেকে দূর করে দিলে, মুখ চুন করে চলে যায়, পরের দিন এসে বত্রিশ পাটি দেখিয়ে বলে, ‘আপনি মায়ের মতো, ভালোবাসেন তাই বকেন।’ 


আর উপহার!সে যে কত পাই তার ইয়ত্তা নেই। আজই যেমন পেলাম, প্রণব বাবু আর লাবণীর থেকে। প্রণব বাবু আমাদের কোলাঘাটের এসএলও। তাঁর কন্যা লাবণী। ভদ্রলোক একদিন এসে বলে গিয়েছিলেন বটে,‘ আমার মেয়েটা  আপনাকে দেখতে চায়। একদিন নিয়ে আসব?’ বলেছিলাম হ্যাঁ, কেন আনবেন না। 


আজ সকালে যখন মেয়েটাকে নিয়ে এলেন, তখন তীব্র ব্যস্ততার চোটে সকলের নাভিশ্বাস উঠছে। আড়াইটে থেকে আমাদের বেনিফিট ডিসট্রিবিশন প্রোগ্রাম। হলদিয়ার বড়সাহেব আসবেন, বোর্ডের সিইও স্যার আসবেন। কানাঘুষো চলছে, উপস্থিত থাকবেন নাকি খোদ ডিএম সাহেবও। তাদের খাতির যত্নের সুবন্দোবস্ত করা, রিপোর্ট বানানো, লোকজন যোগাড় করা, ব্যানার, ফ্লেক্স, ডামি চেক, PPO, শংসা পত্র, টিফিন,জল, চা ইত্যাদি প্রভৃতির ধাক্কায় যে যেদিকে পারে দৌড়াচ্ছে। ভুলভাল কাজ এবং কথার জন্য জনৈক ট্রেড ইউনিয়ন নেতাকে উদোম ঝাড়ছি আমি, তারই মধ্যে সকন্যা উপস্থিত প্রণব বাবু। ‘এই যে ম্যাডাম, আমার মেয়ে। সেই যে বলেছিলাম না, ও আপনাকে দেখতে চায়।’ 


একা প্রণব বাবু এলে, সেই মুহূর্তে কপালে সলিড দুঃখ ছিল। কার রাগ যে কার ওপর ঝেড়ে দিতাম। ভাগ্যে মেয়েটা সঙ্গে ছিল। চড়াই থেকে উৎরাইয়ে সুর নামিয়ে বললাম,‘ একটু বাইরে বসুন প্লিজ। ডাকছি।’ তারপর যা হয় আরকি, ব্যস্ততার অভিঘাতে ভুলেই গেলাম। মাঝে প্রণব বাবু এবং জলধরকে ডেকে কি সব নির্দেশও দিলাম আমি। উনিও বললেন না, আমিও বেমালুম ভুলে গেলাম মেয়েটার কথা। বেশ অনেকক্ষণ পর ফাঁকা হয়ে চেম্বার ছেড়ে বেরিয়েছি, দেখি আমার ঘরের সামনের ভিজিটর্স চেয়ারে একদল বেনিফিশিয়ারির মাঝে শুকনো মুখে বসে আছে মেয়েটা। 


তড়িঘড়ি ডেকে পাঠালাম বাপ আর মেয়েকে। মার্জনা চাইলাম নিজের ব্যস্ততা এবং ভুলো মনের জন্য। মেয়েটা একগাল হেসে ব্যাগ থেকে বার করল চারটে অপরূপ সুন্দর গয়নার সেট। সবকটাই কাপড়ের ওপর হাতে আঁকা। অবাক হয়ে জানতে চাইলাম তুমি এঁকেছ? মেয়েটা সলজ্জ হেসে ঘাড় নাড়ল আর প্রণব বাবু একগাল হেসে বলল,‘ঐ তো করে ম্যাডাম। সারা রাত জেগে।’ বাপরে! শুনলাম মেয়েটি বিএ, এমএ পাশ করে, বিএড ও করে ফেলেছে। বেশ কিছু হাতের কাজের ছবি ও ভিডিও দেখাল। শাড়ি,ব্লাউজে এঁকেছে মেয়েটা, বানিয়েছে ওয়ালহ্যাংগিং। বড়ি দিয়েছে যেন আল্পনা। 

কি যেন ফাইল বগলে ঘরে ঢুকেছিল শুভাশিস, মেয়েটির কাজ দেখে মুগ্ধ হয়ে বলে উঠল,‘তুমি বুটিক খুলেছ? না খুলে থাকলে খুলে ফেল শীঘ্রই। ’ কন্যা গর্বে গর্বিত প্রণব বাবু  বললেন,‘ পাড়ার সব বাচ্ছা স্কুলের হাতের কাজ গুলো ওকে দিয়েই করায়। ’ 


সামনে রাখা চারটে গয়নার মধ্যে একটি সেট তুলে নিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, এটার দাম কত? মেয়ে এবং মেয়ের বাবা হাঁহাঁ করে উঠল। ‘দাম আবার কি ম্যাডাম। এগুলো সব আপনার জন্য এনেছি। উপহার। আপনাকে নিতেই হবে।’ নেব তো অবশ্যই। তাই বলে বিনা মূল্যে কেন? আর এতগুলোই বা কেন? একটা নিই। মেয়েটি নাছোড়বান্দা,‘না ম্যাডাম। বাবার মুখে শুনেছি, আপনি সাজতে ভালোবাসেন,আপনার জন্যই বানিয়ে এনেছি। সব আপনার। মা বলেছে ম্যাডামকে পরিয়ে একটা ছবি তুলে আনবি।’ 


পুরো গলে গেলাম গো। অনলাইনে কেনা কানের ঝুটো দুলটা খুলে তৎক্ষণাৎ পরে ফেললাম মেয়েটার হাতে বানানো গয়না। ভাবলাম উপহার পর্ব সমাপ্ত হল বুঝি। ও হরি! 


ব্যাগ থেকে বেরোল মস্ত বড় ডাব্বা ভর্তি গয়না বড়ি, নিজের হাতে দিয়েছে মেয়েটা। প্রণব বাবু বললেন, ' ওর মাও একটু সাহায্য করিছে বৈকি। ডালটা বেটে দিইছে, ভিডিও তুলে দিইছে।' এটা নিতে কোন ওজর আপত্তি করলাম না। পূর্ব মেদিনীপুরের গয়না বড়ি আমার ভয়ানক প্রিয়। বলতে নেই, তমলুকে আসা অবধি এই বস্তুটা কখনও কিনে খেতে হয়নি। কখনও আশিষ দিয়েছে, তো কখনও অরূপ তো কখনও SDO বাংলোর সিকিউরিটি ছেলেগুলো এনে দিয়েছে কৌটো ভর্তি করে। কারো বউ কারো বা মায়ের হাতে বানানো গয়না বড়ি। কারো মেয়ের হাতের এত নক্সা করা বড়ি আজ অবধি পাইনি। মাথায় ঠেকিয়ে ব্যাগে ঢোকানোর চেষ্টা করছি, বাপ আর মেয়েতে ক্ষণিক চোখে চোখে কি কথা হল, তারপর একরাশ সংকোচ নিয়ে মেয়েটা বলল, " ম্যাডাম রেগে যাবেননি, আপনার জন্য আর একটা জিনিষ আনতেছি।" 


আবার কি? এত মাল নিয়ে বাসে ফিরব কেমন করে? ইতিমধ্যে মেয়েটার ব্যাগ থেকে বেরিয়েছে সোনালী রাংতায় মোড়া একটা মস্ত মণ্ড। প্রণব বাবু বললেন,‘আপনার জন্য ও নিজের হাতে কেক বানিয়ে  আনতেছে ম্যাডাম। এটা আপনাকে নিতেই হবে।’ এমন অমূল্য উপহার কি আদৌ ফেরানো যায়? 


 চেপে চেপে ব্যাগে ঢোকালাম যতটা পারলাম। বড়ির কৌটো উত্তমকুমারকে দিয়ে বললাম,‘ কাল নেবো।  যত্ন করে রেখো। আমার বড়ি ভাঙলে কিন্তু-’। বাক্য সম্পূর্ণ করার পূর্বেই ডাব্বা বগলে কেটে পড়ল উত্তমকুমার। অরূপকে ডেকে বললাম,‘শুধু আমার একার নয়, তিনজনেরই একটা ভালো দেখে ছবি তোলো তো-’। এই ভালোবাসা আর এই মুহূর্ত গুলোর জন্যই তো বেঁচে থাকা। নইলে তো সবটুকুই নেহাৎ চাকরগিরি।

অনির ডাইরি ৩০শে ডিসেম্বর, ২০২২

 

#অনিরডাইরি 

‘হেল্লো শোন না পুপু বিয়ে করতে রাজি হয়েছে।’ পার্শ্ববর্তিনী তারস্বরে কাকে যেন বললেন। বাসে উঠেই সিট পেয়ে গেছি আজ। দুইজনের সিট। জানলার ধারের অল্প বয়সী ছেলেটি উঠে যাওয়ার পর ভদ্রমহিলা সরে গেছেন জানলার ধারে। পাশের সিটটি দখল করেছি আমি। যদিও ভদ্রমহিলার সেটা খুব একটা পছন্দ হয়েছে বলে মনে হয় না। আমার ডানদিকের তিন সিটের একদম ধারে বসে থাকা বৃদ্ধকে উনি ডেকেছিলেন ওণার পাশের সিটটি অলংকৃত করার জন্য। বৃদ্ধ যাননি। উল্টে হাসি মুখে আমায় বলেছেন,‘তুমি বসে পড়।’ 


রূপসী বাইপাসে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে, চা জল খেয়ে হুহু করে ছুটছে বাস। ঝড়ের মত সরে সরে যাচ্ছে দুর্মুঠ, দইসাই, মারিশদা, নাচিন্দা, কানাইদীঘি, হেঁড়িয়া, বাজকুল। মহিলা ব্যাগ থেকে প্রচুর ঘেঁটেঘুটে বার করে আনলেন একটা পুঁচকে বোতাম টেপা মুঠো ফোন। শুরু হল খোশগল্প। ভেবেছিলাম আজ বাসে উঠে একটু ঘুমাব। সে আর হবে বলে মনে হয় না। 


পাশের মাসিমার খোশগল্প তো তাও অন্তত কর্ণপটহ বিদারণকারী নয়। গতকাল কি যে সাংঘাতিক একটা সিনেমা চলছিল বাসে, পৌনে দুঘন্টার বাস পথে সাকুল্যে গোটা পঁচিশ ত্রিশ ডায়লগ শুনেছি আমি বাকিটা পুরোটাই ঝাড়পিঠ। লাথি/ঘুঁষির ও যে এমন বজ্রনির্ঘোষ হতে পারে বাপের জন্মে প্রত্যক্ষ করিনি। গোটা সিনেমা জুড়ে নায়ক শুধু কেলিয়েই গেল আর সবাই পড়ে পড়ে মার খেয়েই গেল। ওয়ান ম্যান আর্মি আর কাকে বলে। একাই বিশ/ত্রিশ জনকে কোতল করছে তাও দাঁত খুঁটতে খুঁটতে। এক একটা ঘুঁষি মারছে শত্রু দশ বিশ ফুট উড়ে যাচ্ছে।মার্ভেল কমিকসের হাল্ক কাকাও লজ্জা পাবে ভাই। বাস থেকে যখন নেমেছিলাম রীতিমত মাথা টলছিল। বেলা বাড়ার সাথে সাথে বাড়ছিল দেশী হাল্কের গুঁতোও। প্রবল থেকে প্রবলতর হচ্ছিল মাথা টনটনানি। ফেরার পথেও নিস্তার মেলেনি, মাথা ব্যথা আরও বাড়াতেই বোধহয়, যে বাসে সওয়ার হয়েছিলাম তাতে গমগম করে চলছিল ঝিনচ্যাক নাচাগানার ভিডিও। উদোম নাচ ছিলেন মিঠুন দা আর গোবিন্দ। 


আজকের বাসেও একটা ভিডিও স্ক্রিন আছে বটে, ঈশ্বরের অশেষ আশির্বাদ যে তিনি এ যাত্রা ঘুমন্ত। ইশ আমিও যদি একটু ঘুমাতে পারতাম! ঘুমাতে না পেরে মাসিমার গল্পে মন দিলাম। বুঝলাম কর্তা গিন্নীতে দীঘায় এসেছিলেন দিন দুয়েকের জন্য। একত্রিশ ডিসেম্বর উপলক্ষে ভিড় বাড়ার আগেই কেটে পড়েছেন মানে মানে। অতঃপর খাওয়াদাওয়া, গ্যাসঅম্বলের গল্প হল খানিক। দীঘায় মাতালদের বাওয়ালের গল্পও হল। ট্রেনে না ফিরে কেন বাসে ফিরছেন সে গল্পও হল বটে। সব শেষে আসল কথা, ‘শোন না পুপু বিয়ে করতে রাজি হয়েছে।’


আহাঃ এতক্ষণে একটা মনের মত টপিক পেলাম গো। কান খাড়া করে শুনতে লাগলাম, পুপুর জন্য কি খুঁজছেন মাসিমা ছেলে না মেয়ে। তাতে পুপুর লিঙ্গ সম্পর্কে সম্যক ধারণা পাওয়া যাবে, আর কিছুই না।মাসিমা বললেন,‘ হ্যাঁ রে, আমরা তো কবে থেকে বলছি, শেষ পর্যন্ত বাবুর মতি ফিরেছে বলতে পারিস। শোন না, ভালো মেয়ে সন্ধানে থাকলে একটু জানাস।’ বুঝলাম পুপু তাহলে ছেলে। মাসিমা নিশ্চয়ই মেয়ের জন্য মেয়ে খুঁজবেন না। এত উদার পাড়ার মাসিমারা বোধহয় এখনও হয়নি। 


মাসিমা এবার কেমন মেয়ে চাই, সেই চরিত্রচিত্রনে নিমগ্ন হলেন। কুমারটুলিতে অর্ডার দিতে হবে নির্ঘাত, ভেবে হাই তুললাম। মাসিমা বললেন,‘ আমাদের পছন্দ অপছন্দ কিছু নেই। পুপুর পছন্দ হলেই হল।দুজনে দুজনকে দেখে বুঝে সিদ্ধান্ত নেবে, ব্যাস।’ এমনি সব গপ্পের চিত্রনাট্যে সাধারণত খুব একটা অদলবদল হয় না। আবার হাই চাপলাম। জনসমক্ষে  হাই  তোলা অভব্যতা, কার যেন লেখায় পড়েছিলাম। সুনীল গাঙ্গুলী কি? নাকি শঙ্কর? 


’অসবর্ণ  হলেও আপত্তি নেই। এমনকি পুপু বলেছে হিন্দু না হলেও কোন সমস্যা নেই। ভালো মুসলমান মেয়ে থাকলেও জানাস।’ চোখ বন্ধ করে ঘুমানোর চেষ্টা করছিলাম আমি। চমকে উঠলাম সহসা। মাসিমা বলে কি? এই বিষে আচ্ছন্ন ধরায় উনি পুত্র বা পুত্রতুল্য কারো জন্য বিবাহযোগ্যা পাত্রী অন্বেষণ করছেন এবং তাও জাত ও ধর্মের ঊর্ধ্বে। অসবর্ণ  বিবাহে আপত্তি নেই তা তো হরদম চোখে পড়ে কিন্তু অস্বধর্মে বিয়ে করতে চায় এ কে ভাই?


নামার সময় হয়ে আসছে। আজও টাইমের গণ্ডগোল করেছি আমি। যত সকাল সকালই বেরোই না কেন, রোজই লেট হয়ে যাচ্ছে। সময়টাকে কিছুতেই মুঠোয় ধরতে পারছি না। পাশের ভদ্রমহিলা ফোন ব্যাগে ভরে চুপচাপ জানলার বাইরে তাকিয়ে আছেন। ইতঃস্তত করে জিজ্ঞাসা করেই ফেললাম,‘কোথায় নামবেন মাসিমা?’স্নেহ মিশ্রিত স্বরে বললেন,‘সাঁতরাগাছি।’ অতঃপর জানতে চাইলেন,‘তুমি কোথায় নামবে মা?’ জানালাম আমি সামনেই নামব। জানতে চাইলাম, ওণারা নেমে ট্রেন ধরবেন নাকি বাস। ভদ্রমহিলা মুখ খোলার আগেই ডান পাশের হাসিমুখ বৃদ্ধ মাঝে ঢুকে পড়ে জানাল,‘সাঁতরাগাছি মানে ঠিক সাঁতরাগাছি নয়, তার থেকে দুটো স্টপেজ পর নামব আমরা।’ জানতে চাইলাম বাকসাড়া না বেলেপোল? ভদ্রমহিলা তাজ্জব হয়ে হাসি মুখে বললেন তুমি চেনো? এবার আমার হাসার পালা,  আমার শহর আর আমি চিনব না!


ভদ্রলোককে ইশারায় আমার সিটটা দখল করতে বলে উঠে পড়লাম। দিন কয়েক আগে এমনি এক শহরবাসীর সাথে গল্প করছিল তুত্তুরী, ছেলেটি এমন সব বিস্ফোরক তথা সাম্প্রদায়িক কথাবার্তা বলছিল যে, মাঝপথে শৌভিককে মেসেজ পাঠিয়েছিলাম আমি,‘সার্ফের জল রেডি রাখিস। বাড়ি গিয়ে মেয়েটার কানে ঢালব। যা ময়লা ঢোকাচ্ছে আমার মেয়ের মাথায়, আক্ষরিক অর্থে ব্রেন ওয়াশ না করে উপায় নেই।’ 


সেদিন বাস্তবিকই মনে হয়েছিল শহরটা পচে গেছে বুঝি, ইউটিউব আর হোয়াটসঅ্যাপর সৌজন্যে পাঁচশ বছরের বুড়ি শহরটার রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে পড়েছে সন্দেহ আর বিদ্বেষ। আজ এই ২০২২ এর শেষ কর্মদিবসে এসে মনে হল, নাঃ প্রিয় শহর, একটুও বদলাও নি তুমি। এখনও আশা আছে।

অনির ডাইরি ২৩ শে ডিসেম্বর, ২০২২

 


#তাম্রলিপ্তকড়চা  #অনিরডাইরি


টিম তাম্রলিপ্তর মুখপাত্র হিসেবে রীতিমত গর্বিত আমি। কি নেই, কে নেই আমার টিমে। ধর্ম নিয়ে আদৌ মাথা না ঘামানো লোকজন আছে, ঘোরতর নাস্তিক আছে, আছেন ধর্মপ্রাণ হিন্দু এবং মুসলমান, devout ক্রিশ্চান আছে, ভারত বর্ষের অন্যতম প্রাচীন ধর্ম যার নাম ‘সারি ধরম’ যেখানে প্রকৃতিই পরম এবং চরম উপাস্য সেই ধর্মের মানুষ আছেন, এমনকি আছে টিকিওয়ালা তিলককাটা বৈষ্ণব ও। মাছ-মাংস-ডিম -পেঁয়াজ-রসুন ছাড়ুন দীক্ষা না নেওয়া মানুষের হাতে অন্ন গ্রহন পর্যন্ত করে না ছেলেটি। একবার দুয়ারে সরকারের ক্যাম্প দেখে ফেরার পথে প্রবল বিষম খেয়েছিলাম আমি, জুন মাসের বেপোট গরম, ঠিক সেই মুহূর্তে এক ফোঁটাও জল অবশিষ্ট ছিল না আমার বা উত্তমকুমারের বোতলে। ছেলেটা সামনের সিট থেকে চটজলদি নিজের বোতল বার করে ধরেছিল আমার মুখের সামনে। জীবনে প্রথম বার বেজায় ভয় পেয়েছিলাম আমি,‘হ্যাঁ হে তোমার বোতল আমায় দিচ্ছ কেন? আমি তো দূর আমার বাপ-পিতেমহ ও কোনদিন দীক্ষা নেননি আর আমি কি রকম আমিষাশী তো জানোই। তোমার জল ছুঁলে দোষ হবে যে।’ ছেলেটা তাতে রেগে গিয়ে বলেছিল, ‘আপনি খান  তো।’ 


 এত বিচিত্র ধর্ম এবং বর্ণের সমাহার বলে, ঝোলেঝালে অম্বলে উৎসব লেগেই থাকে এ আপিসে। হোক না দরিদ্র শ্রম দপ্তর। আনন্দ আর উৎসবের আবার কুলীন অকুলীন কি? 


নগর বদল, বাসা পরিবর্তন এবং শ্রীমতী তুত্তুরীর নতুন স্কুলে ভর্তি তথা থিতু হবার জন্য কয়েকদিন ছুটি নিয়েছিলাম। ছুটি কাটিয়ে যখন কাজে ফিরলাম বড়দিনের ছুটি পড়তে বাকি মাত্র দিন চারেক। জনে, জনে আলাদা ভাবে এসে বলে গেল,‘ এদ্দিনে আপিসটা আবার প্রাণ পেল ম্যাডাম।’ কোন এক শ্রমিক সংগঠনের দুই বয়োজ্যেষ্ঠ প্রতিনিধি তো রীতিমত হুমকি দিয়ে গেল, ‘ স্যার(শৌভিক) গেলেন, গেলেন, আপনাকে আমরা কোথাও যেতে দিচ্ছি না। যত প্রমোশন আছে, সব পান, কিন্তু এখেনেই থাকেন।’ আরেকদল এসে একখানা একটা কাঠের পাল তোলা নৌকা উপহার দিয়ে গেলেন। ‘ অমুক রাজ্যে আমাদের জাতীয় অধিবেশন ছিল, এই ছোট্ট স্মারকটা ওখান থেকে আপনার জন্য কিনে এনিছি।’ 


আমার টিমের পাশাপাশি এদের জন্যও এই উৎসব গুলি করি আমরা। বিশেষ বিশেষ দিনে হাতে সামান্য দুটি টফি ধরিয়ে দিলে বা মণিবন্ধে একটা সস্তা সুতোর রাখি পরিয়ে দিলেও কি যে খুশি হয়ে যান এণারা। খুশি হয় শ্রমিকরাও। অনেকে তো বিশ্বাসই করতে পারে না। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে প্রথম চোটে। ভাবে হয়তো দিয়ে আবার কেড়ে নেব আমরা।  


এতই অল্প পায় আমাদের শ্রমিকরা, তাতেই অভ্যস্থ হয়ে পড়েন। উটকো কিছু পেলেই তাই ভেবলে যান প্রথম চোটে। ভাবতে ভাবতেই মনে হল, এবারের বড়দিনের আগের শেষ কর্মদিবসটা শুক্রবার। ঐদিন এই আপিসে ট্রান্সপোর্টের কাজ হয় বলে সমবেত হন প্রচুর মানুষ। এসএলওরা আসে, আসেন বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠনের প্রতিনিধিরাও। ঐদিন যদি সান্টা ক্লজ হো-হো-হো করে এণাদের সকলকে দুটি করে টফি দেন কেমন হয়? বড়দিন  হিসেবে তো আপিস সাজাবই আমরা। গতবছরও সাজিয়ে ছিলাম।  ভাঁড়ার ঘর থেকে ঝেড়ে ঝুড়ে বিগত বছরের ক্রিসমাস ট্রিটা বার করতে লেগেই পড়েছেন জহর বাবু। গতবছর অবশ্য কোন স্যান্টাক্লজ ছিল না। এ বছর তো থাকতেই পারে -


প্রথমে ঠিক হয়েছিল নতুন ইন্সপেক্টর শান্তনু কয়ালকে সান্টা বানানো হবে। তারপর মনে হল এক্কেবারে কচি, যদি দুঃখ পায়। তখনই রঞ্জিতের কথাটা মাথায় এল। ঘর ফাঁকা হতেই ফোন করলাম রঞ্জিতকে। ‘তোমাকে স্যান্টা হতে হবে।’ রঞ্জিতের প্রাথমিক প্রতিক্রিয়াটা এখনও কানে,‘ অ্যাঁ? এই রে!’ আসন্ন মাধ্যমিক পরীক্ষা সংক্রান্ত এক গুরুত্বপূর্ণ মিটিং এ ছিল রঞ্জিত। মিটিং শেষে যখন আপিসে ঢুঁ মারতে এল, দেখলাম ব্যাপারটা নিয়ে বেশ উৎসাহী।


এত বড় স্যান্টার জামাকাপড় পাই কোথায়? তমলুকে পুঁচকে স্যান্টাদের জামাকাপড় বিক্রি হচ্ছিল বটে, সেগুলিরই যা দাম। এত ধেড়ে স্যান্টার জামা কিনতে কিডনি না বেচতে হয় আমাদের। স্যান্টা নিজেই তার সল্যুশন বার করল, ‘একটা লাল জামা পরে নেব ম্যাডাম। আর একটা সাদা বা হাল্কা রঙের প্যান্ট। শুধু দাড়ি আর টুপিটা লাগবে।’ জানতে চাইলাম,লাল জামা তোমার আছে? রঞ্জিতের লাল জামা না থাকলেও দেখা গেল জহর বাবুর একখান লাল পাঞ্জাবি আছে। ওনাকে বলা হল,ওটাকেই কেচে শুকিয়ে নিয়ে আসতে। শুধু টুপি, গোঁফ আর দাড়িটা যোগাড় করতে পারলেই ঝিলিক মারবে আমাদের সান্টা বুড়ো।


যেহেতু যোশুয়ার পরব, তাই আপিস সাজানোর দায়িত্বটাও ওর। সঙ্গতে শান্তনু আর হকবাবু। উফঃ পুরো ভারতের পতাকা মাইরি। মুস্কিল হল, যখন গত বছরের ক্রিশমাস ট্রিটা বার করা হল, দেখা গেল তিনি আর অক্ষতদেহী নন। গরীর আপিসের সস্তার গাছ, একবছরেই তিনি রীতিমত ল্যাংড়াচ্ছেন এবং একটা হাত ভেঙেছেন। বিকল্প হিসেবে ঝাউ গাছের খোঁজ পড়ল। কাছাকাছি কারো বাড়িতে পাওয়া গেল না। একটা নার্সারি দেবে বলল, দাম চাইল পঞ্চাশ টাকা, তাও ভাড়ায়। ছুটির পর খুলে নিয়ে চলে যাবেন ওণারা। যোশুয়া বিরক্ত হয়ে বলল,‘ থাক ম্যাডাম। আমাদেরটা দিব্যি আছে।’ 


ল্যাংড়া ক্রিশমাস ট্রিকে কি ভাবে যেন খাড়া করে ফেলল ওরা, ভাঙা হাতটাও সেট করা হল। সেই হাতে বল, তারা, পুঁচকে স্যান্টা পুতুলও ঝোলানো হল দিব্যি। বাক্সবন্দি দীপাবলীর আলোগুলো নব উদ্দীপনায় জ্বলে উঠল বেথলেহেমের শিশুকে অভর্থ্যনা করার উদ্দেশ্যে। ডিএম আপিসের নকল সিলিং এ ফুটে উঠল নীল সোনালী তারার দল। যোশুয়া বলে বড়দিনের আসল প্রতীক এই তারাদের দল। রাংতার ঝুলঝুলি ঝুলতে লাগল এদিকে-সেদিকে। আমার আর সৌম্যজিতের টেবিলেও ঝুলল ঝিল্লির মালা। সর্বত্র বড়দিন আর বর্ষশেষের সৌরভ। 


সবই হল, সবই পাওয়া গেল, মিলল না কেবল স্যান্টার গোঁফ আর দাড়ি। কি হবে এবার? আমি বললাম, ‘গালে সাদা তুলো চিপকে দাও ব্যাটার’। সৌম্যজিৎ তো আরেক কাঠি সরেস, বলল,‘আর ভুরুতে কোলগেট।’ রঞ্জিতের স্পোর্টিং স্পিরিট তুলনাহীন, রাগ করা তো দূরস্থান। উল্টে সে নিজেও নানা মতামত দিতে লাগল। শেষ পর্যন্ত অবশ্য তেমন কিছু করতে হয়নি। মা বর্গভীমার মন্দিরের কাছের একটা দোকান থেকে মিলল একখান যুৎসই মুখোশ। 


জহর বাবুর লাল পাঞ্জাবি, টুপি আর মুখোশ পরে তৈরি হয়ে গেল আমাদের স্যান্টা। ঝোলা কোথায় পাই, একখান কার্ডবোর্ডের বাক্সেই ঢালা হল ট্রফি। সারাদিন যত অসংগঠিত শ্রমিক এলেন, শ্রমিক সংগঠনের প্রতিনিধিরা এল, আমাদের এজেন্ট এসএলরা এল সবার হাতে ধরানো হল দু একখান করে ল্যাবেঞ্চুষ। কতজন যে আমাদের সান্টার সাথে সেলফি তুলল তার ইয়ত্তা নেই। বেচারা রঞ্জিত সারাদিন একবার করে মুখোশ খুলছিল আর একবার করে পরছিল।


 কি সব যেন মিটিং ছিল, কারা যেন লাইফ সার্টিফিকেট সই করাতে এল, কিসের যেন ট্রেনিং হল, বড় সাহেবের রিভিউ মিটিং হল সবেতেই হাসি মুখে হাজির আমাদের স্যান্টা। জীবন বড় ছোট বাবুমশাই, কাল কি হয় কে জানে, সেই চিন্তায় খামোখা আজটাকে নষ্ট করে লাভ কি-।ভালো থাকুক না সবাই। চেতন থেকে অবচেতনে আমরা সবাই বোধহয় সেটাই চাই,তাই না।