Monday 16 December 2019

এক যে দেশে-

(c)Anindita Bhattacharya
৭৯৬৯৩৬০২ এর আজ আনন্দের শেষ নেই। আনন্দের ঢেউ গোটা মহল্লা জুড়েই। অবশেষে সেই বহু কাঙ্ক্ষিত ক্ষণ সমাসন্ন, সময় ঠিক মধ্যাহ্ন।  ভেসে এল মাননীয় দেশনেতার জলদগম্ভীর  কণ্ঠস্বর, “প্রিয় মিত্রগণ,অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গে জানাচ্ছি, আমাদের বহু শতকের মেহনত ফলপ্রসূ হয়েছে। জম্বুদ্বীপ আজ আবার জগৎসভায় শ্রেষ্ঠাসনে আসীন। দেশ থেকে অবশেষে আমরা নির্মূল করতে পেরেছি, “ধর্ম” নামক বিষাক্ত নেশার গুষ্ঠি। ধর্মনিরপেক্ষ নয়,আজ থেকে আমরা নির্ধর্ম রাষ্ট্র। উল্লাস প্রিয় মিত্রগণ!“। দেশনেতার অমৃত বাণী  থামার সাথে সাথেই গর্জে উঠল দেশ, যার বিস্তার গিরিরাজের কপোল থেকে মহাসিন্ধুরD কিণারা অবধি। “উল্লাস”। নিছক উল্লাসে মেতে উঠল সমগ্র রাষ্ট্র।
ধর্ম নামক অসুখকে নির্মূল করতে অনেক যাতনা সয়েছে জম্বুদ্বীপ। ঝরেছে অনেক রক্ত। ৭৯৬৯৩৬০২ শুনেছে তার মায়ের মুখে,মায়ের প্রপিতামহের প্রপিতামহের সময় নাকি সমগ্র জম্বুদ্বীপে ছড়িয়ে পড়েছিল ভয়াবহ গৃহযুদ্ধ R।নির্বিচারে মারা পড়ছিল ছাপোষা মানুষ।
ধর্মের নেশায় বুঁদ ছিল সমগ্র রাষ্ট্র। তারপর এলেন তিনি।ইতিহাস যাঁকে চেনে ১ হিসেবে। অতি সাধারণ দেখতে ওণাকে, নাতি দীর্ঘ উচ্চতা, পাতলা হয়ে আসা চুলের মাঝে মাঝে চাকাচাকা চকচকে টাক,চোখে গোল ফ্রেমের চশমা, যার একটি ডাঁটি আবার ভাঙা, গৃহযুদ্ধের অভিঘাতে ভেঙেছিল, উনি সারাননি। সুতো দিয়ে বেঁধে পড়তেন। উনিই প্রথম ডাক ছিলেন, পরিত্যাগ করুন ধর্ম নামক বিষাক্ত  নেশা। তখন নাকি ধর্মানুসারে নাম হত মানুষের। উনি ত্যাগ করেন ওণার নামK। নামের বদলে ধারণ করেন সংখ্যা।বংশানুক্রমিক  ধর্মস্থানে খোলেন দাতব্য চিকিৎসালয় আর বিদ্যাচর্চার কেন্দ্র।
২ ওণার প্রথম অনুগামী। তারপর ৩-৪-৫-। নামের বদলে বাড়তে থাকে সংখ্যা। লুপ্ত হতে থাকে দেবস্থান আর ধর্মালয়।  আর আজ? আজ দেশ জোড়া শুধুই সংখ্যা। প্রায় এক শতাব্দীর অধিক পরিত্যক্ত পড়ে আছে সমস্ত উপাসনালয়। জ্বলেনি সাঁঝবাতি। ভেসে আসেনি প্রার্থনার মোহক সুর, যা রক্ত পিপাসু করে তুলত মানুষকে। দেবস্থানগুলির অনেক কটাই বর্তমানে সংগ্রহালয়। এমনই একটি সংগ্রহালয় দেখতে যাবে আজ ৭৯৬৯৩৬০২। মায়ের মুখে শুনেছে প্রায় এক শতাব্দী জুড়ে কয়েক লক্ষ মানুষের রক্ত খেয়েছে এই দেবালয়। গড়েছে এক পক্ষ,ভেঙেছে অপর। আবার তৈরি হয়েছে নতুন পক্ষ, আবার চলেছে ভাঙা-গড়ার খেলা। মাটির নীচে পরতে পরতে লুকিয়ে আছে এমন ভাঙা গড়ার গপ্প। আজ দেখবে ৭৯৬৯৩৬০২। আর ভাববে কতখানি নির্বোধ ছিল ওর পূর্বপুরুষ তথা পূর্বমহিলাগণ।

Saturday 14 December 2019

মধ্যমেধার মধ্যবিত্তের রোজনামচা-১৪ই ডিসেম্বর,২০১৯

আমার তেত্রিশ কোটি দেবতার মধ্যে, মহঃ রফি একজন। আজ্ঞে হ্যাঁঁ, “আভি না যাও ছোড়কর, কে দিল আভি ভরা নেহি-”। এই পেলব অমৃতস্বরূপ স্বর স্বয়ং ঈশ্বর ছাড়া আর কার হতে পারে বলুন দিকি? কিশোরের সাথে খুনসুটি চলতে পারে, জমতে পারে হাল্কা ফুল্কা প্রেমও। মুকেশজীর সাথে গভীর সম্পৃক্ত প্রেম। কিন্তু রফি সাব? উনি এই তুচ্ছ সাধারণ মেয়েটার ধরা ছোঁয়ার বাইরে। যাঁর পদতলে করজোড়ে বসে মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে থাকতে মন চায়। যাঁর আত্মভোলা হাসিতে নত হয়ে যায় মম গর্বিত শির।
পকেটহীন হলুদ পাঞ্জাবি পরা, খালিপা এক বাংলাদেশী যুবার হাত ধরে, নীল শাড়ি পরে মিশে যেতে চাই জনসমুদ্রে। কদমফুল যাঁর ভীষণ প্রিয়। হস্তচুম্বন করতে চাই তাঁর স্রষ্টার। শরদ্বিন্দু বন্দোপাধ্যায়ের পর এত গভীর ভাবে কোন লেখকের অনুরাগিনী হইনি। আর সেই হেঁপো বুড়ো মিশির আলি, কি যে বলি তাঁকে নিয়ে? ভাগ করে নিয়েছি প্রিয় বান্ধবীদের সাথে। সবকটা তাঁর প্রেমে দিওয়ানা-
আর সেই সদ্য বিপত্নীক বৃদ্ধ, অবসর নেবার দিন যিনি বলেছিলেন, “ও আমার আরেকটা মেয়ে-”। আমার দুই বাপ ছাড়া এত ভালো আমায় কে বেসেছে? তিনিও তো ধর্মে মুসলমান। রোজা রাখতেন না বলে কত পিছনে লেগেছি, “আপনি ভুলভাল মুসলমান নজরুল সাহেব-”।  কান ধরে কবিতা পড়াতেন যিনি। কবিতার প্রতি যতটা ভালোবাসা,সবটুকুই তাঁর থেকে পাওয়া। আজও তাঁর তিরিশ সেকেণ্ডের হড়বড়ে ফোনে আদ্র হয়ে ওঠে উত্তেজিত শুষ্ক মন আর মাথা।

  সংবিধানের প্রস্তাবনা তো সেদিনের শিশু। ধর্মনিরপেক্ষতা আমার রক্তে। ক্রোমোজোমে। প্রপিতামহ ছিলেন চার্বাকপন্থী। ঋণং কৃত্বা ঘৃতং পিবেৎ।  লুকিয়ে অস্ত্র আনতে কালাপানি পেরিয়ে একঘরে হয়েছিলেন ঠাকুরদা। ইয়ে আজাদী ঝুটা হ্যায় বলেছিলেন ছোটদাদু। জেলখাটা নকশাল আমার বাবা। উদারমনা শ্বশুর-শাশুড়ী। ঘোরতর আস্তিক বটে,তবে আমার মতই উদার আমার ঠাকুর। এক স্যালুটেই খুশি। অতি ভক্তিতে কুঁচকে যায় তাঁর/তাঁদের ভ্রু।
বিশ্বাস করুন, এসব কথা আপনাদের শোনাচ্ছি না। শোনাচ্ছি নিজেকে। এহেন আমারও আজন্মলালিত সংস্কার, বিশ্বাস তথা মূল্যবোধের গোড়া নড়ে গেছে কালকে তথা আজকের নোংরামিতে। “নোংরামি”। আজ্ঞে হ্যাঁ, কান্নিককে(Spade) কান্নিক বলাই শ্রেয়। এটা প্রতিবাদ বা পোতিবাদ নয়, এটা সহজ সরল নোংরামি। সুদূর মুর্শিদাবাদ থেকে কানের কাছের উলুবেড়িয়া অবধি কেঁপে উঠল যে নোংরামিতে, তাজ্জব ব্যাপার আমাদের গোয়েন্দা সংস্থা গুলো ঘুণাক্ষরেও টের পেল না এতখানি সংঘবদ্ধ  প্রতিরোধের? আর আমাদের মূখ্য সংবাদপত্র কি লিখছেন, “- আইনের প্রতিবাদে সরব বাংলা”!  মাইরি সত্যি? শুধু সরব? তাহলে অরাজকতা তথা গুণ্ডামির সংজ্ঞাটা অনুগ্রহ করে জানাবেন দাদা/দিদি?
বাতানুকূল ঘরে, অনাগত শীতের অপেক্ষায় ওম্ পোহাতে পোহাতে ওমন কথা লেখা যায় বৈকি।ফেবুতে তপ্ত কুড়মুড়ে স্টেটাস্ লেখা যায়,“বেশ করেছে ভাঙচুর করেছে---। ওদের অস্তিত্ব বিপন্ন। এখন কি ভেবে ভেবে ডেমোক্রেটিক পথে ঝামেলা করবে---”।
আর আমার যে বন্ধু কাল সকালে চেন্নাই মেল ধরবে? সুস্থ ভাবে বাড়ি পৌঁছবে তো সে? বা যে লক্ষ্মীমন্ত বান্ধবীটির বর চাকরী করেন অশান্ত এলাকারই একটি স্কুলে? বিগত দাঙ্গায় বাইক ফেলে হামাগুড়ি দিয়ে ধানখেতের মধ্যে দিয়ে পালিয়ে এসেছিলেন, তাও টলেনি যাঁর ধর্মনিরপেক্ষতার প্রতি আস্থা। আগামী পরশু থেকে নিয়মিত দপ্তরে যেতে পারবেন তো তিনি? ভগ্নীসমা যে আধিকারিককে কাল রাতে ধমকাচ্ছিলাম, “গুলি মারো বড় সাহেবকে।স্টেশন লিভের নিকুচি করেছে, আগে বাড়ি ফেরো-”, স্বাভাবিক ভাবে কোয়ার্টারে ফিরতে পারবে তো সে? আর ঐ আধিকারিকের স্ত্রী আর কন্যা, আজ থেকে বছর নয় দশ আগে ঐ জায়গাতে তো আমিই ছিলাম-।
নড়ে গেছে যাবতীয় বিশ্বাস আর সংহতির ভিত। ভুলে গেছি পিঁয়াজের দাম বা না পাওয়া ডিএর বেদনা। পড়েও দেখিনি বিহারে নিগৃহিত তথা নিহত বছর দশেকের শিশু কন্যার খবর, শুধু ঘিরে ধরেছে অপরিসীম আতঙ্ক।

Wednesday 11 December 2019

অনির ডাইরি ১০ডিসেম্বর ২০১৯


গতকাল মাসির জন্মদিন ছিল। মাসির আবার জন্মদিন। ভূতের আবার জন্মবার। আর পাঁচজন মাসির জীবনচরিতের মতই তুত্তুরীর মাসিরও জীবন পাক খেয়েছে একই পাকদণ্ডী বরাবর, যার গতিমুখ  বড়ই উচ্চাবচ।
শৈশবে উদ্দাম মজা, ঝপাং করে ঝাঁপিয়ে পড়ে ডুব সাঁতারে জোড়া পুকুর এপাড়ওপাড়। মশারি দিয়ে বর্ষাকালে চুনো মাছ ধরা। জোড়া বিনুনী দুলিয়ে ইস্কুল যাওয়া। পথেই আলাপ তাঁর সাথে, যাঁকে কোন এককালে তুত্তুরী ডাকত মেসো। তারপর আর কি? গন্ধর্ব থুড়ি পালিয়ে গিয়ে বিয়ে। মাসির তখন সপ্তম শ্রেণী, মাসির সদ্য শাড়ি।
তারপর বড়দিদি,বড়দাদা এবং ছোটদিদি।সংসারের হামানদিস্তার বাড়ি খেয়ে ভালোবাসা পালাল জানলা গলে। শুরু হল সংগ্রাম। জীবন সংগ্রাম। বাড়ি বসে আচার-নাড়ু-পাটালি বানানো। ধূপ বানানো। চানাচুর বানানো।শায়া-ব্লাউজ বানানো।  চেষ্টা তো করেছে মাসি অনেকই। হয়তো করেছিলেন মেসোও। আমরা তো এক পক্ষের গপ্প শুনি কেবল।
কোথায় যেন চাকরী পেয়েছিল মেসো, ছোট চাকরী,তবে সরকারী তো বটে। শুধু যেতে হত বহু দূর। মেসোর মা ছাড়েননি তাঁর আদরের দুলালকে। কেঁদে কেটে কাটিয়ে দিয়েছিলেন নাম। জীবনে কখনই আর ঘুরে দাঁড়াতে পারেননি মেসো। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছিল সংসার, বাধ সাধল মেসোর বাবার হঠাৎ অসুস্থতা। ঘটি বাটি বেচেও বাঁচানো গেল না তাঁকে।  কাজের ধান্ধায় স্থানীয় নার্সিংহোমে আয়ার কাজ সেই তখন থেকে-। আজও জনৈক স্বর্গীয় ডাক্তারের নাম করার সময় কপালে হাত ঠেকান মাসি। হাতে ধরে কাজ শিখিয়েছিলেন যে ডাক্তারবাবু।

তুত্তুরী তখন ছ দিন বয়স। সোমবারে জন্মেছে বটে,রবিবারের আগে ছাড়েননি বুড়ো ডাক্তারবাবু। মা প্রচুর কান্নাকাটি  জুড়েছিল, বাড়ি যাবে বলে। ততোধিক ধমকেছিলেন ডাক্তারবাবু। অবশেষে রবিবার ভোরে বাড়ি ফেরা। উফ্ কি বৃষ্টি, ধুয়ে যাচ্ছে হাওড়া শহর। ঠাম্মাদাদুর কোলে চেপে হাওড়ার বাড়িতে ঢুকল তুত্তুরী। চকাস্(বড় মাসি), টুলটুল দাদা(বড় মেসো), বড় দাদু, আতুপাতু(বড় দিদা), দিদি(পিসি দিদা), দাদু,মামমাম(দিদা), ছোট দাদু, বড় মামা,বড় মামি সবাই মিলে সে কি টানাটানি। এ বলে আমায় দে। ও বলে আমায়। কত কি যে পেল তুত্তুরী, রূপোর টাকাই তো কতগুলো। আর বেশ কিছু পাঁচশ হাজারের নোট। যার দুটি এই সেদিন বের হল, মামমামের লক্ষ্মীর ঝাঁপি থেকে। দাদুর কি চিৎকার, কি বকল মামমামকে। ওগুলো নাকি পচা টাকা। টয়লেট পেপার সমতুল।
যাই হোক সবার আদরের মাঝে, ঐ বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে কে যেন এল। এসেই স্নান করে, ডেটল জলে কাচা জামাকাপড় পরে কোলে নিল তুত্তুরীকে। তাকিয়ে দেখল তুত্তুরী, ও মা!মাসি তো।

সেই থেকে বিগত নয় বছরে তু্ত্তুরীর জীবনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ মাসি। যখনই তুত্তুরী কোন দুষ্টুমি করে, কারো সাথে কথা বলে না বা মিশতে চায় না। লোকে তো দুটো কথাই বলে, “ইশ্ মা কোন শিক্ষা দেয়নি! ইশ্ আয়ার কাছে মানুষ!” তাতে তুত্তুরীর ঘন্টা। তোমাদের কাছে আয়া হতে পারে,তুত্তুরীর পরিবার তো অসম্পূর্ণ মাসি ছাড়া।
কে তু্ত্তুরীর অপরিসীম বকবক মন দিয়ে শোনে?কে পড়ে শোনায় উপেন্দ্রকিশোর বা অবন ঠাকুর? কে তুত্তুরী দুর্ব্যবহার করে ক্ষমা চাইলেই এক কথায় মার্জনা করে দেয়? কে মায়ের চোখ বাঁচিয়ে এখনও ইউনিফর্ম বা জুতো পরিয়ে দেয়? মাখতে দেয় পমেটম? বানিয়ে দেয় মনের মত টিফিন? স্কুলে কারো সাথে তু্ত্তুরী ঝগড়া করলে কে বাড়ি এসে তার গুষ্ঠির মুণ্ডপাত করে? মাসিই তো।

মেসো যখন ঝপ করে পাড়ি দিল অন্য জগতে, কে সাদা শাড়ি পরতে দেয়নি মাসিকে? মাসি নিরামিষ খেলে কে রাগ দেখায় আজও? কে ধ্বংস করবে বলে স্মার্ট ফোন কিনেছে মাসি? কার অনুরোধে, বাড়ির শাড়ি ছেড়ে সুন্দর শাড়ি এবং টুপি পরে তৈরী হয়ে গেল মাসি কেক কাটতে? তুত্তুরীই তো। এত জটিল সম্পর্কের মধ্যে ঢুকে আমাদের কাজ নেই ভাই, মোদ্দা কথা হ্যাপি বার্থ ডে মাসি। এমনই থাকুক তোমার সম্পর্ক, আদরে আর অধিকারে মাখা।