Saturday 24 December 2016

অনির ডাইরি ২৪শে ডিসেম্বর ২০১৬


এক ঢিলে দুই পাখি, অর্থাৎ একদিনে দুটি সিনেমা দেখলাম আমরা আজ, সকাল সাড়ে দশটার শোয়ে ব্যোমকেশ পর্ব এবং বিকাল সাড়ে তিনটের শোয়ে ডবল ফেলুদা। পুরো ব্যাপারটাই শৌভিকের মস্তিষ্ক প্রসূত। এর আগে আমি যতবার প্রস্তাব করেছি এক দিনে একাধিক সিনেমা দেখা, ততবারই তা নাকচ হয়েছে। কারণ তাতে নাকি যথার্থ ভাবে কোন সিনেমাটিরই রসাস্বাদন করা যায় না। কিন্তু এবারে যখন শৌভিক নিজে থেকেই প্রস্তাব দিল, আমি তো একপায়ে খাড়া। তা নাহলে সত্যি আর সময় কোথায়? তুত্তুরীকে নিয়েও কোন চিন্তা নেই, কারণ বহুদিন বাদে হাওড়া এসেছি। দাদু-মামমামকে (দিদা) পেলে তুত্তুরীর আর কাউকেই প্রয়োজন নেই।
সুতরাং ভোর বেলা(অর্থাৎ বেলা আটটা) উঠে শ্যাম্পু করে (সারাদিন মলে থাকব কি না), চটজলদি প্রাতরাশ করে দুজনে দৌড়লাম অবনী রিভার সাইড মলের উদ্দেশ্যে। দশটার সময় যখন অবনীতে ঢুকলাম, গোটা মল ঘুটঘুট করছে অন্ধকার। সব দোকানপাট বন্ধ এবং অন্ধকার। আমাদের মত জনা কয়েক সিনেমা পাগল আর মুষ্টিমেয় সিকিওরিটি গার্ড ছাড়া কেউ নেই। ফাঁকা হলে দেখতে বসলাম ব্যোমকেশ পর্ব। আসল গল্প তো অমৃতের মৃত্যু, টানটান উত্তেজনায় ভরপুর। দেখতে বসেই বেশ হতাশ হলাম, এখানে গল্পের শুরুতেই ব্যোমকেশ বেশ একচোট ‘মারব এখানে লাশ পড়বে শ্মশানে’ মার্কা ডিসুম- ডিসুম করে নিল। প্রচণ্ড রাগে গা রিরি করে উঠল, ব্যোমকেশ বক্সী বড়জোর এক ঘা ব্রজ মুষ্টি প্রহার করতে পারে, কিন্তু এই ভাবে ভ্যান ডেম বা অক্ষয় কুমার টাইপ ফাইট করছে এটা আমি কিছুতেই হজম করতে পারলাম না। যদিও আমার বর বলল, “আউট অফ কন্টেক্সট হলেও বড় খাসা ফাইট করল কিন্তু ব্যোমকেশ।”  এরপর শুরু হল ব্যোমকেশ এবং সত্যবতীর ন্যাকা ন্যাকা দাম্পত্য প্রেম। বহ্নিপতঙ্গ সিনেমাটিতে দেখান হয়েছিল সদ্যবিবাহিত ব্যোমকেশ এবং সত্যবতীর দুষ্টু মিষ্টি দাম্পত্য প্রেম। সেটা যদিও গল্পে ছিল না, তাও মন্দ লাগেনি দেখতে। কিন্তু স্যার বিশ্বাস করুন আর নেওয়া যাচ্ছে না। সোহিনী সরকার আমার অত্যন্ত প্রিয় অভিনেত্রী, কিন্তু ঐ আদুরে আদিখ্যেতা আর স্ফুরিত অধর মার্কা প্রেম স্রেফ বিবমিষা জাগায়। ব্যোমকেশ আর সত্যবতীর এতখানি অধঃপতন একজন শরদ্বিন্দু ভক্ত হিসেবে মেনে নিতে পারছি না। যাইহোক গল্প এগোয় শম্বুকগতিতে ব্যোমকেশ এবং অজিত সান্তালগোলায় গিয়ে হাজির হয়, সাথে সত্যবতীও যায়। সেখানে গিয়ে দিব্যি বোরলি মাছ, টাটকা সব্জি, কচি পাঁঠা, পোলাও ইত্যাদি কেনা, রান্না, খাওয়া, গান গাওয়া চলতে থাকে। অমৃতের মৃত্যু ঘটে, আমায় শৌভিক ফিসফিস করে আশ্বস্ত করে, ‘এবার গল্প গতি নেবে দেখ’। কচু পোড়া। সদানন্দ শুর মারা যান। সত্যবতীর সাথে সখ্য জমে ওঠে বিশ্বনাথ মল্লিক রুপী কৌশিক সেনের ঝিঙ্কু গিন্নী জুন মালিয়ার। ক্লাব পার্টি, পিকনিক, আদিবাসী নাচের তালে কোমরও দুলিয়ে নেয় দুজনে। রাগে গজগজ করতে থাকি আমি। গল্প আরও এগোয়, সদানন্দ শুর সম্পর্কে খোঁজ নিতে কোলকাতার লালবাতি এলাকায় এসে সরোজ খানের কোরিওগ্রাফিতে সায়ন্তিকার কোমর দোলান মুজরা হয়, রেস কোর্সের আস্তাবলে গিয়ে জনৈক বুকির সাথে আরেক প্রস্ত ঝাড়পিঠ করে অবশেষে ক্লাইম্যাক্সে প্রভূত মারামারি করে ভিলেনকে পাকড়াও করে ব্যোমকেশ। এবং বেআইনি অস্ত্রব্যবসায়ী ভিলেন পুলিশের ভ্যানে ওঠার আগে এক প্রস্ত জ্বালাময়ী বক্তৃতাও দেয়, “আমাদের লড়াই চলতেই থাকবে। এ আজাদি ঝুটা হ্যায়” ইত্যাদি বলে। হল থেকে বেরিয়ে বিশ্বাস করুন কান্না পাচ্ছিল, এতো বাজে সিনেমা দেখব বলে, এই শীতে লেপের আদর ত্যাগ করে দৌড়ে দৌড়ে এলাম? যেমন খারাপ নির্দেশনা, তেমনি খারাপ অভিনয়। সুমন্ত মুখোপাধ্যায় আর ঋত্বিক চক্রবর্তী ছাড়া আর কারো অভিনয় বিন্দুমাত্র দাগ কাটে না। এর থেকে হরিপদ ব্যান্ডওয়ালা দেখলে খুব খারাপ হত না বোধহয়।

  দ্বিতীয় ছবিটি ছিল ডবল ফেলুদা। দুটি গল্প সমাদ্দারের চাবি এবং গোলকধাম রহস্য।যেমন টানটান গল্প, তেমনি অসাধারণ চরিত্রচিত্রণ তথা নির্দেশনা। নাম দেখানোর সময় থেকেই দর্শকদের মনোযোগ আকর্ষণ করে। আর সাথে সত্যজিৎ রায়ের সেই বিখ্যাত মিউজিক। কিছু লেখার নেই। সমালোচনা করার কোন জায়গাই রাখেননি সন্দীপ রায়। বহুদিন বাদে সব্যসাচী চক্রবর্তীকে আবার ফেলুদা হিসাবে পেলাম। একটু বয়স্ক বটে, তবে অভিনয়ের গুণে তা ঢাকা পড়ে গেছে। শুধু ফেলু মিত্তিরের ভুঁড়িটা কিছুতেই চাপা দেওয়া যায়নি। তবে এত ভাল সিনেমায় ঐ টুকু ত্রুটি মার্জনীয়, অন্তত কারো ভুঁড়ি নিয়ে আমি তো কিছু বলতেই পারি না বাবা। সন্দীপ রায়কে অসংখ্য ধন্যবাদ বর্ষ শেষে এত ভাল একটা সিনেমা উপহার দেবার জন্য।

Sunday 4 December 2016

স্বপ্ন ২


স্বপ্ন দেখলাম, তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছে। না মিত্র-শ্ত্রু পক্ষ মার্কা কিছু পশ্চাৎপক্ক দেশের যুদ্ধ-যুদ্ধ খেলা নয়।  আইসিস মার্কা কোন উগ্র ধর্মান্ধ শক্তির সাথে তথাকথিত শুভবুদ্ধি সম্পন্ন প্রথম বিশ্বের  মানবতা রক্ষার সংঘাত ও নয়। এ এমন এক যুদ্ধ, যা প্রতিনিয়ত মানবজাতিকে অবলুপ্তির দিকে এক ধাপ করে এগিয়ে দিচ্ছে। কতদিন কোন নবজাত শিশুর কান্না ধ্বনিত হয়নি এই ধরায়। ধরা আজ দুই গোষ্ঠীতে বিভক্ত। একদিকে আমাদের মত মুষ্টিমেয় আশাবাদী মানব সন্তান, যাদের না আছে কোন পূর্ব অভিজ্ঞতা, না কোন মিলিটারি ট্রেনিং। আছে শুধু মনের জোর। আমরা রোজ লড়ি বা, বলা ভাল লড়ার চেষ্টা করি। হারি-জিতি যাই হোক আমরা আশা ছাড়ি না, আমাদের নেতা বলেন, “ যেদিন আমরা আশা ত্যাগ করব, সেদিনটি হবে পৃথিবীতে মানব প্রজাতির অন্তিম দিন।” আমাদের নেতা কোন আর্মি জেনারেল নন। বরং এক ক্ষীণকায়, খর্বাকৃতি, মুণ্ডিতমস্তক, খেটো ধুতি পড়া ন্যুব্জ বৃদ্ধ। গুজরাটের কোন জঙ্গুলে উপজাতির সর্দার ছিলেন এককালে। মাতৃভাষা ছাড়া অন্য কোন ভাষাও জানেন না। চোখে গোল চশমা, যার একটি ডাঁটি ভাঙ্গা, দড়ি দিয়ে কানের পিছনে আটকানো। আমরা আদর করে ডাকি “বাপুজি” বলে।
আমি এই ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর একজন উদ্ধারক। প্রত্যহ সকালে, বাপুজির নির্দেশ মোতাবেক আমার উদ্ধারকরা ছড়িয়ে পড়ি, পৃথিবীর না না প্রান্তে, যেদিন যেখানে শত্রুপক্ষের হামলা হতে পারে, তার আগাম আভাষ পেয়ে জান বাপুজি। আমরা টেলিপোর্টেশন মারফৎ সেখানে পৌঁছে, সেখানকার জনগণকে নিরাপদে আমাদের এই ক্ষুদ্র ক্যাম্পে নিয়ে আসি। কিন্তু এই ক্যাম্প ও বেশিদিন নিরাপদ থাকে না, ফলে এক্সোডাসের মত, প্রায়ই বাপুজির পিছু পিছু শিবির ত্যাগ করি আমরা। গড়ে তুলি কোন নতুন কলোনি। এই প্রায় যাযাবর জীবনযাপনের ফলে খাদ্যের বড় অভাব আমাদের। যাই হোক আজ সকালেও অপেক্ষা করছিলাম আমার গন্তব্য সংক্রান্ত নির্দেশাবলীর জন্য, আচমকা আমাকে জানানো হল, বাপুজি আমায় ডেকেছেন। চমকে উঠলাম, এক নিতান্ত মামুলী উদ্ধারক আমি। এক- দুই জনের বেশি কাউকে টেলিপোর্ট করার ক্ষমতা আমার নেই। বাপুজি কেন আমার সাথে দেখা করতে চান? আমার মত পৃথুলা, অবলা নারীকেও এই কাজ করতে হচ্ছে, কারণ সমর্থ পুরুষ বা সবলা নারীদের আগেই দখল করে নিয়েছে শত্রুপক্ষ। ভাবতে ভাবতে কখন যে বাপুজির সামনে এসে দাঁড়িয়েছি খেয়াল করিনি। বাপুজি একটা বড় গাছের তলায় ছেঁড়া আসন পেতে ধ্যান করছিলেন, আমাকে দেখে হেসে নিজের ভাষায় কিছু বললেন, যা আমি আমার মাতৃভাষায় স্পষ্ট শুনতে পেলাম, আমার মাথার মধ্যে। উনি বলছেন, “নিজেকে দয়া করা, মানুষের সবথেকে প্রিয় চিত্তবিনোদন।” জিভ কাটলাম। বাপুজি যে মনের কথা পড়তে পারেন তা ভুলে গেছিলাম।
বাপুজি গলা ঝেড়ে বললেন, “বাংলাদেশে আজ হামলা হবে রে মা।” বাংলাদেশে? মানে কোথায়? ওদিকে তো আজকাল হামলা হয় না। এই রে বাকি উদ্ধারকরা তো বেরিয়ে গেল। বাপুজি বললেন, “ তোমাদের ঐ সব দেশ সীমানা আমি বুঝি না। তোমাদের মহল্লায় হামলা হবে।” মাথাটা টলে গেল। আমাদের মহল্লা? বাবা-মা-তুত্তুরী? আমাদের মহল্লায় এর আগেও একবার হামলা হতে পারে বলে সতর্ক করেছিলেন বাপুজি। আমরা উদ্ধারকরা সকলকে না পারলেও বেশ কিছু মানুষকে নিরাপদে টেলিপোর্ট করতে পেরেছিলাম। তাদের মধ্যে  বাবা-মা-তুত্তুরীও ছিল। ওরা এখানে আমাদের সাথেই ছিল বেশ কিছুদিন। তারপর বাবা উসখুস করতে লাগল। নিজের পিতৃপুরুষের ভিটে, বাবার ঠাকুমা, কাকা, পিসি আমার দাদু-ঠাকুমা,জেঠু, কাকু, পিসির স্মৃতিবিজড়িত। মায়ের বউ হয়ে আসা, আমার জন্ম, বেড়ে ওঠা, বিয়ে, তুত্তুরীর জন্ম, শৈশবের লীলাক্ষেত্র। বাবার প্রাণ কাঁদত ঐ ভিটার জন্য। বাপুজির সাথে ব্যাপক দোস্তি হয়ে গিয়েছিল বাবার। বাপুজির অনুমতি নিয়ে একদিন ফিরে গেল ঐ ভিটেয়। সঙ্গে মা আর তুত্তুরীও। বাবাকে ছেড়ে মা থাকবে না, আর মাকে ছেড়ে তুত্তুরী। আমি তখন উদ্ধারকার্যে ব্যস্ত অন্যত্র। ফিরে এসে প্রবল রাগারাগি করেছিলাম। তারপর মেনে নিলাম। আমাদের ভাঙাচোরা জনমানবহীন শহরে বেশ জমে উঠেছিল ওদের লালনীল সংসার। মাঝে মাঝে আমিও যাই।
শুধু ওদের জন্য আমাদের মহল্লায় হামলা করবে? আমার চোখ দিয়ে দরদর করে জল পড়ছে। মনে হচ্ছে পাগল হয়ে যাব। আর একজন উদ্ধারক নেই। আমি একা তিনজনকে আনতে পারব না। কি করি? বাপুজির নির্দেশে ঈশ্বরকে ডাকার পুরানো অভ্যাস ছেড়েছি বহুদিন। বাপুজির মতে ঈশ্বর বড় বিভেদের জন্ম দেয়। মন স্থির করতে না পারলে আমিও পৌছতে পারব না। দরকার হলে তিনবার যাব, আগে তো পৌঁছই।
নীরব জনহীন শহরে, শুধু আমাদের বাড়ি থেকেই প্রবল কলরোল ভেসে আসছে। মা আর তুত্তুরী খাবার নিয়ে কোস্তাকুস্তি করছে। অন্যদিন হলে মাথায় আগুন জ্বলত, যেখানে কেউ পেট ভরে খায় না, সেখানে আমার কন্যা খাওয়া নিয়ে নখরা করছে? আজ প্রবল কান্না পেল। মা আমাকে দেখে খুশি হতে গিয়েও থমকে গেল, “কি রে?” গলায়  ব্যথা ঝেড়ে বললাম, “বাবা কোথায়? এখুনি যেতে হবে।” তুত্তুরী দৌড়ল ভিতরে, “দাদুউউউউউউ। মা ডাকছে।” বাবা সিগারেট লুকোতে লুকোতে দৌড়ে এল, কোথায় পায় কে জানে? আমি কিছু বলার আগেই সদর দরজার অদূরে এসে দাঁড়ালো একটা ট্যাঙ্ক। সারি দিয়ে নামতে লাগল, শত্রু সৈন্যের দল। ভাবলেশহীন রোবটের দল। কোন এককালে আমাদের মত মানুষই ছিল। আজ আর তার কোন অনুভূতিই অবশিষ্ট নেই। ওদের নেতার নির্দেশ মোতাবেক শিকার ধরে নিয়ে যায় ওরা। ওদের কাছে কোন শস্ত্র থাকে না। ট্যাঙ্ক থেকে বেরিয়ে এল, ওদের নেতা। এতদিন শুধু গুজব শুনেছি, আজ দেখলাম। নারী না পুরুষ বুঝলাম না। কালো চকচকে ট্রেঞ্চ কোট আর কালো প্যান্ট পরা। শ্বেতাঙ্গ। মাথায় কালো চুল, প্রায় কোমর অবধি। কপাল ঢাকা চূর্ণ কুন্তলে। আমরা চারজনেই আঁতকে উঠলাম চোখ দুটি দেখে। চোখ পুরো সাদা। কোন মণি নেই।
শোনা যায়, এই চোখ দিয়েই নাকি মানুষের আত্মা শোষণ করে নেয়। মানুষটা বেঁচে থাকে, কিন্তু তার মধ্যে কোন ক্ষুধা তৃষ্ণা, সুখ, দুঃখ, ভালবাসা, ব্যথা বেদনার অনুভূতি থাকে না। জড় পদার্থ রোবটে পরিণত হয় মানুষ। রোবটের মত ওনার হুকুম তামিল করে, তারপর একদিন অনাহারে, জলশূন্যতায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে বাঁ বসে বসে মরে যায়। পৃথিবীর অর্ধেকের ওপর জনসংখ্যা এভাবেই শেষ হয়ে গেছে। এবার আমাদের পালা।

কি করি? আমি কি করি? তিনজনকে এক সাথে তো নিয়ে যেতে পারব না। আর ফিরে আসার অবকাশ ওরা আমায় দেবে না।  বাবা সিগারেট ছুড়ে ফেলে বলল, “তুত্তুরী। ওকে বাঁচা।” মেয়েকে বাঁচাব বলে বাবা-মাকে মৃত্যুর মুখে ছেড়ে চলে যাব? পারছি না। কেঁদেই যাচ্ছি। মায়ের মায়া মাখানো মুখ, ছলছল চোখ, বাবার মুখের সিগারেটের গন্ধ আর তুত্তুরীর গা থেকে ভেসে আসা দুধের গন্ধ। এদের বিনিময়ে আমি মরতে রাজি আছি। কিন্তু প্রাণ থাকতে আমি পারব না। “আঃ। তুত্তুরুকে বাঁচা”। বাবা চিৎকার করে উঠল। আমি কেঁদেই যাচ্ছি। বাবা এগিয়ে এসে আমার কাঁধ ধরে প্রচণ্ড ঝাঁকাতে লাগল, চোখ খুলে দেখি, শৌভিক ঠেলছে, “কাঁদছিস কেন ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে? এই? কি হল?” কাহিনীর এই অংশটার কথা তো ভুলেই গেছিলাম। উদ্ধারক এসে গেছে। আর চিন্তা নেই। J

Monday 14 November 2016

শুভরাত্রি


ঘরে ঢুকেই দেখলেন মানিনী একগাল হেসে ওনার দিকে তাকিয়ে আছেন। চট করে মাথাটা গরম হয়ে গেল রামদুলাল বাবুর। রাগে গরগর করতে করতে বললেন “সব সময় দাঁত কেলিয়েই আছেন।”মানিনীর হাসি তো কমলই না, উল্টে বোধহয় বেড়েই গেল। কৌতুকের সুরে বললেন, “ কার রাগ কার ওপর ঝাড়ছ শুনি? মেয়ে ফোন করেনি বলে এত উত্তেজিত হচ্ছ কেন? কোনদিন করে না?” “কোনদিন করে না?” ভেঙিয়ে উঠলেন রামদুলাল বাবু। “বুঁচু জানে যে বাবা রাত এগারোটায় ঘুমের ওষুধ খেয়ে শুয়ে পড়ে-।” কথা শেষ করতে পারলেন না, তার আগেই ঝাঁঝিয়ে উঠলেন মানিনী দেবী, “বুঁচু? ইশ। ফের যদি ঐ ঘেটো নামে ডেকেছ।” “বেশ করব। বেশ করব” গলা ফাটিয়ে চিৎকার করতে লাগলেন রামদুলাল বাবু। “ আমি ঘটি। আমার মেয়েও ঘটি। কি আমার বাঙাল এলেন রে? এ দেশে জন্ম কম্ম, শিক্ষা দীক্ষা চাকরি, আর বলার বেলায় ‘আমাগো দ্যাশ’? যাও না। যাও- তোমাগো দ্যাশে গিয়ে থাকো। যদি পারো তো আমি কান কেটে ফেলে দেব। বিয়ের সময় মা বলেছিল, ‘রামু বাবা তুই আর মেয়ে পেলি না? একে বাঙাল তায় চাকরী করে। তার ওপর আবার জাতে সুঁড়ি।”
“ওরে আমার কুলীন কায়েৎ রে। আমার বাবাও বলেছিল, ‘ মানু, এত কষ্ট করে তোদের দুই বোনকে বড় করলাম, লেখাপড়া শেখালাম। তোরা  দুজনেই নিজ চেষ্টায় সরকারি চাকরীও জোটালি। আর শেষে কিনা রামদুলালকে বিয়ে করবি? কোন অংশে ও তোর সমকক্ষ বল দেখি? সারা জীবন তুই ফার্স্ট হলে ও এক থেকে দশের মধ্যেও আসতে পারত না। দিদির বর সেইলের কর্মচারী আর তোর বর মামুলী রাজ্য সরকারী কেরানী। এতো দেখছি তোর সংসারও আমায়ই টানতে হবে।”
“তোমার বাপটা একটা রাম ঢ্যামনা ছিল। শালা মালের দোকানের পয়সা অথচ কোনদিন এক বোতল মাল ও দেয়নি।” হাত ঝেড়ে তাচ্ছিল্যের ভঙ্গীতে বললেন রামদুলাল বাবু। মানিনী কোমরে হাত দিয়ে ঝুঁকে পড়ে বললেন, “ হাঁ। তাই তো। আমার বাপ ঢ্যামনাই হোক আর যাই হোক, তোমার মায়ের মত বিষধর নয়। ভুলে যেও না, রাকার জন্য যা করার আমার মা-বাবাই করেছে। তোমার মা-বোনের টিকিটিও দেখা যায়নি। ঐ দুর্দিনে মা-বাবা যদি রাকাকে নিজেদের কাছে না নিয়ে গিয়ে রাখত, রাকা বাঁচত? বুকে হাত দিয়ে বল দেখি?” রামদুলাল বাবু গলা ঝেড়ে, রণে ভঙ্গ দেবার গলায় বললেন, “ সেতো আয়াও ছিল বাবা।” “আয়া?” হিসহিসিয়ে উঠলেন মানিনী, “আয়া তো এখানেও ছিল রাম। তোমার মা কি বলেছিলেন মনে আছে? এতটুকু বাচ্ছার দায়িত্ব আমি নিতে পারব না। আমার বাবা-মাও যদি তাই বলত? কি করতাম আমরা? বাবা তো ঐ জন্যই বলত, সব দায়দায়িত্ব যখন আমাদেরই, তখন, মেয়েটার নামটাও পাল্টে রাকা বসু থেকে রাকা সাহা করে দিলেই তো হয়। আসলে কি জানো তো, নাতিনাতনির ক্ষেত্রে মেয়ের বাবা-মায়েদের সব সময়ই মনে হয়, এটা আমার সন্তানের সন্তান, আর ছেলের বাবা-মায়ের মনে হয় এটা বউমার বাচ্ছা। হুঃ”
ঝগড়ার প্রাথমিক পর্ব মানিনীই জিতছেন, বুঝতে পেরে, অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে বসলেন রামদুলাল বাবু, ধরা ধরা গলায় বললেন, “ সে যাই হোক, সাড়ে এগারোটা বাজে, বু ইয়ে মানে রাকা এখনও কল করল না। বিয়ের পর মেয়েরা সত্যি পর হয়ে যায়।” “হাঃ।” শাণিত ছুরির মত মানিনী বলে উঠলেন, “তোমার মা তো উল্টোটাই বলেন-। ছেলে নাকি বউ অন্ত প্রাণ।”

গাঢ় গলায় রামদুলাল বাবু বলে উঠলেন, “সেটা কি খুব ভুল বলে? আমার জীবনের চার নারী, মা-দিদি-তুমি আর রাকার মধ্যে যে আমি তোমাকেই সবথেকে বেশি ভালোবাসি তা কি আর কোন প্রমাণের অপেক্ষা রাখে?” মানিনী কিছু বললেন না, কৃষ্ণবর্ণ গালে কি অপরূপ আলতার ছোপ ফুটে উঠল, আজ এত বছর পরেও। মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়েছিলেন রামদুলাল বাবু তাঁর সাতাশ বছরের পুরানো স্ত্রীর দিকে। তির্যক কটাক্ষে মানিনী বললেন, “ যত বয়স বাড়ছে, বুড়োর ঢলানিও ততো বাড়ছে।” রামদুলাল বাবু হেসে বললেন, “কত বছর কেটে গেল মানু। আমরা বুড়ো হয়ে গেলাম।” মানিনী মুখ ঝামটা দিয়ে বলে উঠলেন,”তুমি বুড়ো হয়েছ, আমি নই।” সত্যি তো মানিনী বুড়ো হননি, এখনও কোমর ছাপানো এক মাথা ঘন কালো চুল, মুক্তোর মত ঝকঝকে দাঁত, সরু হিলহিলে কোমর, টানাটানা দুটি আয়ত চক্ষু রামদুলাল বাবুর আদরিনী স্ত্রী। রামদুলাল বাবু বললেন, “মানু, আমরা দুজনেই চেয়েছিলাম, জানতাম ও যে মেয়ে হবে। মেয়েই হবে। তোমার সেই ফোলা পেটে হাত রেখে তখনও আমরা ঝগড়া করতাম, আমি বলতাম ওর নাম হবে বুঁচু আর তুমি বলতে কক্ষনও নয় ওর নাম রাকা। সবই হল মানু। শুধু...”। কথা শেষ করতে পারলেন না, ফোনটা বেজে উঠল, “হ্যালো বাবা?” রাকার ফোন, রামদুলাল বাবু গম্ভীর হয়ে বললেন, “এত ক্ষণে বুড়ো বাপকে মনে পড়ল?” রাকা হাসি চেপে বলল, “সরি বাবা। মিটিং ছিল। এই শেষ হল। শেষ হতেই হল থেকে বেড়িয়ে তোমায় কল করছি। চিন্তা কোরনা, মহাবীর গাড়ি নিয়ে বাইরে অপেক্ষা করছে, আমাকে বাড়ি নিয়ে যাবে বলে। আর রাতের ব্যাঙ্গালোর অনেক সেফ, তোমাদের কলকাতার মত নয়। আর আমার বর তো আমার সঙ্গেই আছে।” “হু। সাবধানে ফিরিস। আমি জেগেই রইলাম। বাড়ি ফিরে ফোন করিস।” অধৈর্য গলায় রাকা বলে উঠল, “ মেসেজ করে দেব বাবা। নাউ বি আ গুড বয়, ঘুমের ওষুধ খেয়ে শুয়ে পড়। মায়ের ছবির সাথে আর গল্প করতে বস না। প্লিজ বাবা। ইউ নিড আ লাইফ। পচিশ বছর ধরে একটা মৃত মানুষের স্মৃতি জড়িয়ে বেঁচে আছ। আর কত দিন? মেনে নাও বাবা। শি ইজ নো মোর। মা নেই। কোথাও নেই...। শুভরাত্রি বাবা।” 

https://www.facebook.com/amianindita.blogspt.in/

Saturday 12 November 2016

স্বপ্ন



স্বপ্ন দেখলাম, পালিয়ে বেড়াচ্ছি।  কার ভয়ে? ইংরেজদের নাকি মুঘলদের জানি না।  আমি একা নই।  রাজা নাকি বাদশাহ জানি না, লুকিয়ে পালিয়ে বেড়াচ্ছেন সপরিবারে সাথে কেবল একদল বিশ্বস্ত সৈনিক আর স্বল্প সংখ্যক পরিচারক পরিচারিকার দল। রাজার মাথায় বিঁড়ের মত রাজ উষ্ণীষ ঠিক যেমন টিপু সুলতান পড়ত।রাজা ঠিক লুকিয়ে বেড়াচ্ছেন না উনি লুকিয়ে লুকিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তুলছেন সেই সর্বশক্তিমান সাম্রাজ্যবাদী প্রাতিষ্ঠানিক শক্তির বিরুদ্ধে ।  সারা দেশ যার কাছে মাথা নত করেছে এক তুচ্ছ রাজার সাধ্য কি তার সাথে লড়ে? পরিণতি অবোধগম্য নয়। রাজা হারছেন বারবার।  আপাততঃ নতুন বাহিনী  গড়ে তোলার মত রসদ রাজার নেই।  তাই কিছুটা মনখারাপ সকলের।  রাজার এক পুত্র। হতে পারে এইটি সদ্য সাবালক হয়েছে বাকি গুলি এখনও দুগ্ধপোষ্য। রণক্লান্ত সেপাহি এবং পালিয়ে বেড়ানো পরিজনদের মনে আনন্দ দেবার জন্য রাজা হঠাৎ  ঘোষণা করলেন পুত্রের বিবাহ দেবেন। পাত্রী কৈ? পাত্রী ঐ ক্ষুদ্র গোষ্ঠীতেই মওজুৎ আছে, নাম “তারা”।  তারা মূলতঃ রাণীমার ঘর এবং হেঁসেল সামলায়। সদ্য যৌবনপ্রাপ্ত চঞ্চলা কিশোরী। তারা মত সাধারণ কূলশীলের মেয়ের সাথে নিজ পুত্রের বিবাহ দিতে রাণীমার কিঞ্চিৎ  আপত্তি ছিল। তাছাড়া তারা বয়সেও একটু বড়। প্রায়ই রাণীমার অগোচরে ধমকধামক দেয় রাজপুত্রকে ঠিকঠাক খাওয়া দাওয়া না করলে বা জিনিসপত্র অগোছালো  করে রাখলে। যদিও সদ্য গোঁফের রেখা ওঠা বড়কুমারের জগৎই তো তারাময়। মহল ছেড়ে যেদিন পালাতে হয়েছিল কুমার সেদিন নিজের পাদুকা নিজে পড়তে জানত না।  চতুর্দিকে পালাও পালাও রব।  সব ছুটে পালাচ্ছে, রাজা এবং রাণী পর্যায়ক্রমে কোষাগার এবং শিশু কুমার কুমারীদের সামলাতে ব্যস্ত। বাকি বিশ্বস্ত দাসদাসীরা ঘোড়া হাতি তথা অন্যান্য গৃহস্থালি সামলাতে ব্যস্ত।  কেউ কেউ সুযোগ বুঝে কিছু হাতিয়ে পালাতে ব্যস্ত কিন্তু কেউ বড় কুমারের খোঁজ নিচ্ছে না।  বড়কুমার অস্থির হয়ে পায়ে পা ঘষে চলেছে পায়ের সামনেই হীরক খচিত পাকুদাদ্বয় ব্যগ্র ভাবে কুমারের প্রতিক্ষারত। কিন্তু আজন্মলালিত অভ্যাস কেউ স্বহস্তে  ঐ জুতা রাজকুমারকে না পরিয়ে দিলে সে পরে কেমনে। দূরে বিজয়ীশক্তির পদধ্বনি ক্রমশঃ স্পষ্ট হয়ে উঠছে। কুমার কি করে? এমন সময় দৌড়ে এল তারা, কোমরে হাত দিয়ে বলল, “যা ভেবেছি।  নিজের পাদুকা নিজে পরা অভ্যেস কর সোনা। ঝুঁকে হাত দিয়ে পায়ের কাছে টেনে নাও আর পা গলাও। দিন পাল্টাচ্ছে সোনা।  নিজেকে না বদলাতে পারলে পচে মরবে। ” চোখ বন্ধ করে তারার নির্দেশ পালন করেছিল কুমার।  এমন কিছু খারাপ লাগেনি তো। বংশের মাথানত হয়েছিল বলেও মনে হয়নি।
আর সেবার? সদ্য যুদ্ধে যাবে কুমার। জীবনের প্রথম যুদ্ধ তাও সেই সর্বশক্তিমান সাম্রাজ্যবাদী প্রাতিষ্ঠানিক শক্তির বিরুদ্ধে ।  যুদ্ধ বিদ্যার পাঠ অসমাপ্ত রেখেই পালিয়ে আসতে হয়েছিল রাজ্যপাট ছেড়ে। শিবিরে নিয়মিত অস্ত্রবিদ্যার অনুশীলন তো হয় কিন্তু লড়াই করার মানসিকতাই যে নেই কুমারের। কুমার ভালবাসে চাঁদনী রাতে বাঁশি বাজাতে, ভালবাসে উদ্দেশ্যহীনভাবে জঙ্গলে ঘুরে বেড়াতে। কাঁচা সোনা রোদে মাঠে শুয়ে নীল  আকাশে সাদা মেঘের কারিকুরী দেখতে। ভালবাসে তারার বকুনি  খেতে। ভালবাসে ছোট ছোট ভাইবোনের সাথে অহেতুক  খুনসুটি করতে। যুদ্ধ, হত্যা,রক্তপাত সইতে পারে না কুমার। তারা বর্ম পরাচ্ছিল এক্ষুণি রাণীমা আসবেন বরণ করতে রক্ততিলক পরাতে। আচমকা ভেউ ভেউ করে কাঁদতে লাগল কুমার। পারবে না, কুমার পারবে না লড়াই করতে।  স্নেহময়ী ধাত্রীর মত কুমারের অশ্রুসিক্ত গালে চকাস করে একটা চুমু খেল তারা। তারপর বলল,“ দেখে নাও কি ভাবে বর্ম বাঁধছি। যদি দেখ পরাস্ত হতে চলেছ, সোজা বর্ম খুলে উষ্ণীষ খুলে এক খাবলা মাটি মুখে হাতে ঘষে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিয়ে যেও। মিশে যেও সাধারণ মানুষের ভিড়ে।” কুমার শিউরে উঠে বলল,“ তারা তুই আমায় রণে ভঙ্গ দিয়ে পালাতে বলছিস? তাহলে তো সবাই আমায় কাপুরুষ বলবে?” তারা ফোৎ করে একটা বিদ্রুপাত্মক শ্বাস ছেড়ে বলল,“ বলুক গা।  ওরা ভারি বীর পুরুষরে। তোমার বাবার ওপর শত্রুপক্ষের  সাংঘাতিক রাগ। আসমুদ্রহিমাচলে একমাত্র আমাদের রাজামশাই ই ওদের বশ্যতাস্বীকার  করেনি। আমাদের রাজামশাইকে লুকিয়ে লুকিয়ে গোটা দেশ মান্যিগণ্যি করে। তলায় তলায় বহুলোক প্রস্তুত হচ্ছে ওদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের জন্য। তোমাকে যদি ওরা একবার পায় কি হবে বুঝতে পারছ? চোখ গেলে দেবে, জিয়ন্ত গায়ের চামড়া খুলে নেবে, ফুটন্ত  তেল ঢেলে দেবে গায়ে। যদি দেখ না পালাতে পারছ ঐ তরোয়াল দিয়ে নিজের গলা নিজে কেটে ফেল তবু ঐ শকুন গুলোর হাতে ধরা পড় না। ”

তারাকে বিয়ে করতে একফোঁটাও আপত্তি ছিল না কুমারের। বিয়ের দিন লুকানো শিবিরে সীমিত  সামর্থ্যের  মধ্যে এলাহি ব্যবস্থা করলেন রাজাজী। বাইরের নিমন্ত্রিত বলতে শুধু দুজন। একজন বড় রাজামশাই, আমাদের রাজার দাদা। শত্রুপক্ষের প্রিয়পাত্র। ওণার রাজ্য শত্রুপক্ষই চালায়, উনি সুরা এবং নারীতে মত্ত। শত্রুপক্ষের চোখে ধুলো দিয়ে মাত্র গোটা পনেরো দেহরক্ষী নিয়ে উনি কি করে এসেছেন জানি না। বিশাল মোটা ঘোড়ায় চাপলে বেচারা ঘোড়া না দেহরক্ষা করে। আর দ্বিতীয় নিমন্ত্রিতা হলেন রাণী পিসিমা।  রাজা মশাইয়ের একমাত্র ভগিনী । ওণার শ্বশুরবাড়ির সঙ্গে শত্রুপক্ষের রীতিমত দহরমমহরম চলে। রাজামশাইয়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ওনাদের পরিবার প্রতিবার শত্রুপক্ষের দল ভারী করে। উনি এসেছেন মাত্র চারজন সখী তথা দেহরক্ষীণীকে নিয়ে। এককথায় উনি অপরূপা।  দুধের সরের মত গাত্রবর্ণ । শাঁখের মত টানাটানা দুটি চোখ।  আধেক শুকনো গোলাপ পাপড়ির মত দুটি ঠোঁট। বিধবা তাই পরণে একটিও গহণা নেই।  শুধু দুধসাদা মখমলী শারারা আর মাথায় ওড়ণা যা উর্ধাঙ্গকে ও আবৃত করে রেখেছে।

বিবাহ শুরু হল। তারাকে স্বল্প অলংকারে সাজানো হয়েছে।  বেশ সাধারণ দর্শনা তারা, বিশেষত রাণী পিসি বা আমাদের রাণীমার কাছে। হোক তবু বিয়ের কনে হিসাবে ঝলমল করছে আমাদের তারা। বিয়ের রীতি অনুসারে বড় রাজা অর্থাৎ কুমারের জেঠামশাই একটা হীরকখচিত সোনার টিকুলি পরিয়ে দিলেন তারার মাথায়। বংশের জেষ্ঠ পুত্রবধুর প্রাপ্য ঐটি। জেঠা রাজার কোন ছেলে নেই। তারাই বড় বউ। রাণী পিসি এসে শিরচুম্বন করলেন।নিজের গলা থেকে সাতছড়া হীরের ঝাপটা খুলে পরিয়ে দিলেন তারার গলায়। ভারি হারে একটু কি কুঁজো হয়ে গেল তারা? বীণার মত মিষ্ট সুললিত  স্বরে রাণী পিসি বললেন,“ তোমরা বংশ পরম্পরায় আমাদের সেবা করে আসছ। আশা করব আমাদের কুলতিলকের কোন রকম অযত্ন হবে না। প্রাণ দিয়েও ওকে রক্ষা কর তারা। ”
শুরু হল উৎসব। যে যা পারল তারাকে উপহার দিল। বেশির ভাগই শুভকামনা জানালো। পালিয়ে বেড়ানো লোকজনের দেবার মত কি বা আছে? যেমন আমি। আমি রান্নাঘরে তারার সহযোগী । তারা বাটনা বাটে আমি শিল ধুই। তারা রান্না করে আমি উনুন নিকোই। আজ কেন জানি না প্রচণ্ড  কান্না পাচ্ছে, কান্নার দমক চাপতে গিয়ে থরথর করে কাঁপছি। এবার আমার পালা নববধূকে উপহার বা শুভকামনা জানানোর। তারার কাছে গিয়ে আর চাপতে পারলাম না।  কাঁদতে কাঁদতে বললাম, “ তুমি জানো তো? আমরা কেউ বাঁচব না।” তারা স্বভাবসিদ্ধ হেসে বলল,“জানি। তাই বলে বাঁচব না?”
#Aninditasblog
https://www.facebook.com/amianindita.blogspt.in/

মধ্যরাতে গড়ের মাঠে



- এতরাত্রে? একা?
- তাতে তোমার কি? যতঃ গায়ে পড়া পাবলিক।
-নাঃ আমার আর কি? ( কিয়ৎক্ষণ নিস্তব্ধতার পর) তা হয়েছেটা কি? ব্যর্থ প্রেম নাকি খারাপ রেজাল্ট?
-উফ্ ভগবান।  ( উঠে স্থানবদল)
- কি? ব্যর্থ প্রেম না খারাপ রেজাল্ট?
- সেই আমার পিছন পিছন ?এখানেও এসে জুটেছো? এবার কিন্তু আমি পুলিশ ডাকব বলে দিলাম। তুমি বোধহয় জানো না আমি ক্যারাটে তে ব্ল্যাকবেল্ট।
- বাঃ। তা এত রাত্রে গড়ের মাঠে কেন?ব্যর্থ প্রেম নাকি খারাপ রেজাল্ট?
- আরে বাপরে!!!! ছিনে জোঁক।  দেখ ভাই আই অ্যাম নট ফিলিং ওয়েল।  গিভ মি সাম স্পেস অর আইল বিট দা  শিট আউটা ইউ।
 --এত ইংরাজি বুঝি না বাপু। ইংরেজি গোটাটাই গোবিন্দর দেখে টুকেছিলুম । সে ব্যাটাচ্ছেলে ফেল করে গেল আর আমি করেগেলুম পাশ। জানো গোটা মহল্লায় কেবল আমিই পাশ দিয়েছিলুম।  গোটা মহল্লায় বাবাঃ হুঁ।
-ওক্কে।  গ্লাড টু নো দ্যাট স্যার্। নাউ প্লিজ লিভ মি এলোন।
- ব্যর্থ প্রেম নাকি খারাপ রেজাল্ট? আমার রেজাল্ট ভালো হওয়া সত্ত্বেত্ত, পাশ করা সত্ত্বেত্ত  মা বলল,’ বিনয় বাবা চাকরী খোঁজ।  দেখচিস তো, তোর বাপের শারীরিক  অবস্তা কি করে আগে পরাব বলদিনি? দু দুটো সমর্থ বোন বাড়িতে বসে। ’ এত রাগ হল।  বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে এলুম এই গড়ের মাঠে। ঘণ অন্ধকারে বসে রইলুম কতক্ষণ। খুব মনে পড়ছিল মায়ের কথা। কি সোন্দর দেখতে ছিল মা।  আর খেটে খেটে কি হয়ে গেছে।  আর পুঁটু আর ফুলি আমার দুই বোন ঠিক যেন ডল পুতুল গো। আর আমার পঙ্গু বাপ।  কতবার মনে হল ফিরে যাই।  কিন্তু তীব্র অভিমান পথ আটকালো।  পড়তে দেবে না?   আমায়? যাঃ। চাই না পড়তে। চাই না বাঁচতে। ঝুলে পড়লাম গলায় ধুতি জড়িয়ে।  ঐখানে একটা তেঁতুল গাছ ছিল জানো ঐটাতে-
-ওঃ গস্।  প্লিজ ম্যান আয়াম স্কেয়ার্ড।
- ব্যর্থ প্রেম নাকি খারাপ রেজাল্ট? আমার কথা শোনো বাড়ি ফিরে যাও।  মরার পর বুঝেছিলুম কি ভুল করলুম। আমার শোক বাবা নিতে পারেনি। পনেরোদিনের মধ্যেই বাবাও--।  মা দুই সমত্থ মেয়েকে কতদিন আগলাবে? ৪৬ এর রায়টে ছোটটাকে তুলে নিয়ে গেল মোছলমানেরা।
-রায়ট? কি যা তা বলছেন? ১৩৪৬? ১৪৪৬-- ইংরেজি মতে কোন সাল? কলকাতায় তো কোন রায়ট হয় নি।
-বুঝে গেছি ফেল করেছো।  তাই বাড়ি ছেড়ে পালিয়েছো।  ১৪৪৬ আসতে এখনও ২৩ বছর বাকি আর ১৩৪৬  কেটে গেছে ৭৭ বছর আগে হুঁঃ।
- ওঃ। ১৯৪৬।  ঐ ডাইরেক্ট অ্যাকশান ডে, নোয়াখালি এন্ড অল দ্যাট।
- এন্ড অল দ্যাট- উফ।  যাক বাপু তোমার সাথে আর কথা বাড়িয়ে লাভ নেই।  তুমি ভালোয় ভালোয় বাড়ি যাও।  আর দেরি কোর না।  রাত  বাড়লেই ওরা এসে হাজির হয়।  ওরা আমায় ও ডরায় না। ছেলে মেয়ে বাছবিচার ও করে না।  যা পায় ছিঁড়ে খায়।
- এই আমার সত্যি ভয় করছে। একদিকে ওদের ভয় আর একদিকে আপনার আষাঢ়ে গপ্প।
- যাক আপনি বলতে জানো তোমরা। যা বলেছি একবর্ণও মিথ্যা নয়।  আমাদের ধর্মে বলে আত্মহত্যা মহাপাপ।  সে যে কতবড় পাপ যে ভুক্তভুগী সে ছাড়া কেউ বোঝে না। এই ভাবেই ঘুরে বেড়াচ্ছি আজ ৭২ বছর ধরে।  আমার কোথাও যাবার নেই।  কোন মুক্তি নেই। বিগত ৭০ বছরে তোমার মত কতজনকে এই পাপ থেকে বিরত করেছি তার ইয়ত্তা নেই। তবু আমার মুক্তি হয়নি। ( দীর্ঘ নীরবতার পর ধরা গলায়) বাড়ি ফিরে যাও।
- একা যেতে ভয়- ।  বাবা - মা খুব মারবে-
- কেউ কিছু বলবে না।  ফিরে যাও।  আর বললেও মা- বাবার মুখনিঃসৃত বাণী অমৃতবৎ।
- ( ক্যাব বুক করাবার জন্য মোবাইল  অন করল মেয়েটি।  তৎক্ষণাৎ ফোন) (কাঁপা কাঁপা গলায় ফোন ধরল মেয়েটি ) হ্যালো মা।
(আর কথা বলতে পারল না।  কাঁদতে লাগল। )
আমার ভুল হয়ে গেছে মা।  চরম ভুল হয়ে গেছে।  আমায় বাড়ি নিয়ে চল প্লিজ----

- মা বাবা আসছে আমায় নিতে।
-বলেছিলাম।  আমি আসি।
- শুনুন।  আপনার জন্য কিছু করতে পারি?
- এ কথা বহুবার শুনেছি।  কেউ কথা রাখেনা।  তবু যদি পার হাড়কাটা গলির ভিতরে একটা তিনতলা বাড়ি আছে। বিনু নিকেতন নামটা এখনও পড়া যায়। ওখানে বেবুশ্যেরা থাকে। বাড়ির বুড়ি মালকিনের বয়স ৮৫।  নাম সুললিতা দেবী। খুব অসুস্থ । বেশি দিন বাঁচবে না।  ওকে বলো, “ফুলিরে আমায় মাপ করে দিস। ”
https://www.facebook.com/amianindita.blogspt.in/

পাঁচশ- হাজার টাকা



- এজ্ঞে স্যার, এতক্ষণ ধরে এখেনে বসে আছেন, তাই ভাবছি-
- (অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে) তাতে তোমার কি হে ছোকরা? আরো তো বেঞ্চ আছে, তাতে বসো না। তা না তখন থেকে এই বেঞ্চেই বসে আছে।
- না, মানে স্যার, জায়গাটা তো বিশেষ ভালো না তাই আর কি। সামনেই মা গঙ্গা খলখল করে বয়ে যাচ্ছে-
- তো?
- অনেকেই সুসাইড করে আর কি!
- (ক্রোধে হতবাক হয়ে) মানে? আমাকে দেখে কি তোমার মনে হচ্ছে যে আমি সুইসাইড করব বলে বসে আছি?
- আজ্ঞে! সেই রাত আটটা থেকে বসে আছেন, এখন রাত বারোটা প্রায়। এতক্ষণে একটাও ফোন করলেননি। কেউ আপনাকে ফোনও করলনি। এর মানে আপনি মোবাইলটা বন্ধ করে –
- (গলার পর্দা বেশ উঁচুতে তুলে) তুমি বোধহয় জানো না, আমি কে?
- আজ্ঞে, জানি তো। আপনি মুখুজ্জে বাড়ির মেজ কর্তা। লতুর বাপ।
- লতু? হাউ ডেয়ার ইউ? লবঙ্গলতিকা কে লতু?
- চটছেন কেন স্যার? লতু তো পুরো মহল্লার গর্ব। কত সুন্দর দেখতে,এনজিনিইয়ার। তারপর বিয়ে করে বিদেশ যাচ্ছে।  কি চাবুকের মত ইংরাজি বলে।আমি তো চুনোপুঁটি। খোদ রন্তুদাই ফিদা ছিল ওর ওপর। রোজ সকালে যখন লতু স্কুলের বাস ধরতে যেত পেছন পেছন যেত। আবার ফেরার সময়ও। একদিন লতু পেছন ফিরে ইংরাজিতে এমন গটমটখট করে বকে দিল, যে রন্তুদা দুহাত তুলে, “ইয়েস- নো- সিস্টার-মাদার-” বলে দে দৌড়। হা হা হা।
- গুড। এই না হলে রামদুলাল মুখুজ্জের মেয়ে। তা এ শালা রন্তু আবার কে?
- রন্তুদা স্যার? এম এল এ সাহেবের ইয়ে আগে ডান হাত ছিল- এখন বোধহয় বাঁ হাত হবে। চিনতে পারছেন না, ওর ভালো নাম রতনচূর ভটচাজ্যি?
- অঃ। মনোময় বাবুর অপোগণ্ড ছোট ছেলেটা। ঠিক করেছে লতু। বেবুন হয়ে চাঁদে হাত- স্কাউন্ড্রেল।
- এমন বলবেননি স্যার।চাকরি পায়নি তাই এম এল এ সাহেবের আসেপাশে ঘোরে। সবাই কি জজ ব্যারিস্টার হবে বলুন? ভেবেছিল এম এল এ সাহেব খুশি হয়ে অন্তত ওকে কাউন্সিলার করে দেবে। ওমা? সে যে তলে তলে তার শালির ছেলের জন্য দরবার করছিল সে কি আর রন্তুদা জানে? আর তা ছাড়া রন্তুদার সাথে তো আপনারাই লতুর বিয়ে দেবেন বলেছিলেন।
- হে ভগবান! সে তো কোন ছেলেবেলায়---। মানিনী মানে আমার স্ত্রী আর মনোময় বাবুর স্ত্রী বলত, আদিখ্যেতা যত। মানিনী চলে গেছে আজ বিশ বছর হয়ে গেল----। সারা জীবন পাশে থাকার প্রতিশ্রুতি দিয়ে যে রাখেনি তার দেওয়া খেলনা প্রতিশ্রুতি রাখার কোন দায় আমার নেই (গলা ভেঙে গেল- চোখ মুছলেন ধপধপে ধুতির খুঁটে)
- তা তুমি কে হে? তখন থেকে আমার পিছনে পড়ে আছ?
- না পিছনে পড়ে নেই স্যার। তবে কি না কেমন সন্দ হচ্ছে যে আপনার অভিপ্রায়ে কিছু গড়বড় আছে- আর তাছাড়া আপনি উঠে গেলে আমি – (মাথা নামিয়ে কান চুলকে) একটু মদটদ খেতাম আর কি।
- তা খাও না। এত বড় ঘাট পড়ে আছে-
- আপনার সামনে না আজ্ঞে-
- হু। তা তোমার নাম কি?
- আলি আজ্ঞে।
- আলি? কার ছেলে?
- তহমিনা বিবির। বাপের নাম আমি করি না। সেই শুয়ারটা আমার জন্মের আগেই মাকে তালাক দিয়ে অন্য একজনকে নিয়ে ভেগেছিল।
- ত-হ-মি-না? নামটা চেনা চেনা- ( বলতে বলতেই ভদ্রলোকের মুখে শোকের ছায়া নেমে এল) ওঃ- তুমি তহমিনার ছেলে।
- আজ্ঞে। (অল্প হেসে)আমার আম্মিকে সবাই চেনে একডাকে- । এই ঘাটের পাশেই মায়ের লাশ মিলেছিল। আমি তখন তিন। সেদিন সন্ধ্যে বেলা মা আমাকে নিয়ে ব্যাগ গুছিয়ে বাড়ি থেকে বেরোবার সময় নানীকে বলে বেরিয়েছিল, “আম্মু নিকে করে নতুন জামাই নিয়ে ফিরব। দেখিস কি সুন্দর জামাই আনব-”। তালাকের পর নানী আর মামুদের সাথেই থাকতাম আমি আর আম্মি। কুত্তার বাচ্ছাটা আম্মিকে নিকে করার লোভ দেখিয়ে ভোগ করতে চেয়েছিল। আমার আম্মিটা এত বোকা ছিল না- (গলার নোংরা গামছায় চোখ মুছে গলা ঝেড়ে) নিকে করো- নিকে করো করে লোকটার পিছনেই পড়ে গিয়েছিল। সবই শোনা- শাদিসুদা বালবাচ্চাওলা লোকটা থোড়াই একটা তালাকশুদা মেয়েকে বিয়ে করত? তা সে যত ডবকাই হোক না-। নিকে করার নাম করে ডেকে এনে গলার নলি কেটে দিয়েছিল—সারা রাত মরা আম্মিকে জড়িয়ে ঘুমিয়েছিলাম। সকালে উঠে দেখি চারদিকে লোকেলোকারন্য- কত কাঁদলাম- আম্মিকে কত ডাকলাম- সাড়াই দিল না স্যার (উচ্চ স্বরে কান্না)
- (কাঁধে হাত রেখে) তারপর?
- আর কি স্যার? নানী যতদিন বেঁচে ছিল নানীর কাছেই ছিলাম, আট বছর হতে না হতেই নানীও- । মামুরা থোড়াই দেখত? ওদেরও শাদি-তালাক- বালবাচ্চা নিয়ে নাজেহাল অবস্থা। রাস্তায় রাস্তায় ঘুরলাম কটা দিন আধপেটা খেয়ে না খেয়ে- তারপর পাঁচু দা ডেকে ওর চায়ের দোকানে কাজ দিল। ওখানেই থাকতাম রাতে- ওখানেই রন্তুদার সাথে আলাপ- আমার সামনেই লতু ওকে ইংরাজিতে ধমকেছিল- আরে হাঁ- পরশু লতুর বিয়ে না? আপনি এখেনে কি করছেন স্যার? এখনো কত কাজ বাকি- মন খারাপ নাকি?
- কি বলব বাপ। তুই ঠিকই ধরেছিস। আমি এখানে মরতেই এসেছিলাম-। আমার মত অপদার্থ পিতার জীবিত থাকার কোন অধিকার নেই- মানিনী চলে যাবার পর দ্বিতীয় দারপরিগ্রহ করিনি। জেদ করে ভেবেছিলাম মেয়েকে একাই মানুষ করে দেখিয়ে দেব। আর তাছাড়া উপায়ই বা কি ছিল? কেউ পাশে ছিল না বাপ। কেউ না।  পাছে দায়িত্ব নিতে হয় সবাই এড়িয়ে যেত জানিস। অথচ সকলের দায়ে অদায়ে আমি ছুটে গেছি সবার আগে-
-জানি তো।  পাড়ায় আপনার কত সম্মান- কত খাতির করে সবাই-
- হাতির মাথা করে।  আজ আমার এতবড় বিপদে কেউ পাশে দাঁড়াল?
- বিপদ?  মানে?
- আমার লতুর বিয়ে ভেঙে যাবে- কাল সকালে দুই লাখ টাকা তুলে এনেছিলাম। কেটারার ডেকরেটার লাইট জল মিষ্টি -- আজ সে গুলো এক বস্তা কাগজ মাত্র। কি করব?   আমি কি করব? একলা বুড়ো মানুষ। পায়ে ধরতে বাকি রেখেছি শুধু।  বিয়েটা হয়ে যাক আমি ধার রাখিনা---
- ইল্লি আর কি? লতুর বিয়ে ভেঙে যাবে? কোন হারাম--( জিভ কেটে) কাল সকালেই চলুন।  আমি আর রন্তুদা গিয়ে চমকালে সুড়সুড় করে দিয়ে দেবে চাচা।  আপনি  ঘর যান। আমরা কাল ভোরেই আসছি।  আর হ্যাঁ (লুঙ্গির গেঁজে থেকে এক গোছা নোট বার করে) এটা রাখুন।  বেশি নেই হাজার সাত হবে। একটু একটু করে জমাচ্ছিলাম একটা চায়ের দোকান করব বলে।  আমি আর রন্তুদা- রন্তুদা বলে কি জানেন স্যার,“ আলি সবাই আমাদের খারাপ ভাবে- ভাল হবার সুযোগ কেউ দিতে চায় না। আরে একটা সুযোগ দিয়ে তো দেখুক-”
- বেঁচে থাক বাপ। কিন্তু এ টাকা আমি নিতে পারব না।
- নিন স্যার । পিলিজ। ভালো কাজের সুযোগ রোজ থোড়াই আসে- লতুর বিয়ে বলে কথা। ধারই তো--- একটাও পাঁচশ হাজার নাই স্যার।
-বেশ। নিলাম। তবে শুধু টাকা নয়, টাকার মালিককেও চাই। আমার একতলার গ্যারাজের পাশে বেশ খানিকটা জায়গা আছে।  ওখানে চায়ের দোকান বানা।  তবে ঠেক বানালে চলবে না।
- স্যার।
-নো স্যার।  চাচা বা কাকাবাবু চলতে পারে। তবে আমি ম্যানেজারি করব কিন্তু। শুধু চা নয় বুঝলি- আলুর দম, ঘুঘনি, ডিম পাউরুটি----- আস্তে আস্তে আমরা হোম ডেলিভারি করব----

https://www.facebook.com/amianindita.blogspt.in/
#Aninditasblog

Wednesday 2 November 2016

Lekha 4

He woke her up and said in hushed tone, "somebody broke in". "What?" " i am going downstairs. Stay here and lock the door."
After few mintutes a loud thud and somebody shriked. She couldnt resist herself and ran down. Thank god it isnt her husband. She found him sitting on the steps he gave her a blank look and then she found it, the clearly lifeless body of the intruder.
"What have i done?" He was crying, he was afraid, shaking like a dry leaf in a strong breeze. " im going to the jail for sure who'll look after you and the kids?" He was murmuring to self.
She was in tears as well. He is all she got. Her parents disowned her when she chose him over the man of their choice. She couldnt lose the love of her life. Love is all she ever prayed for. And the kids? They do need an earning member. A jobless housewife cant do anything for her kids but she can definitely do something to save her husband ... the father of her kids.

She has been sentenced to 7 years rigorous imprisonment as she successfully made the court understand that it was an accident not an intentional cold blooded murder. The man broke into her house... she tried to stop him from stealing and he attacked her... in order to protect her modesty she hit him with her son's cricket bat.

She was released after 6 years for good conduct. She was taken aback that neither her husband nor their sons had come to receive her. She went to her home, but its not her anymore. Her husband got a new wife. They are really happy together... all of them her husband, his wife, her sons. Her sons, her own flesh and blood believe that she is a cold blooded murderer. She killed the husband of their new mom. Her world shattered..

What to do now? She has no place to go. She thought of committing suicide... but she is too cowardice... finally she knocked the door of the house where she had grown up... the door had been closed for so many years. To her utter surprise the door opened and she found her old ailing parents are waiting for her to return... they have been waiting for her since the day she left. They had indeed threatened her to disown but never meant it.... all her life she craved for love... true love... but it was right there unfortunately she had taken it for granted.
#Aninditasblog

কথোপকথন-



-কেমন আছো?
-ভালোই তো। আর তুমি?
-খুব ভাল।------তোমাকে প্রায় দেখি। ফেসবুকে।
-ওঃ। হ্যাঁঃ।
-তুমি দেখনি আমায়?
-সময় পাই কোথায়।
-হুঁ। যদি দেখতে পেতে? বাড়িয়ে দিতে বন্ধুত্বের হাত?
-উঁ ভাবতাম। ভয় পেতাম যদি তুমি না ধর।
-আজো ভুল বোঝ আমায়। আমিই তো আগে----

- আছো?
-বলো?
-নাঃ।  জাস্ট এমনি--

-আছো?
- বলো।
- নাঃ। জাস্ট-
-বলোই না? জাস্ট এমনিতে আমি ক্লান্ত। আজ না হয় বলেই দাও।
১০
-আছো?
- মনে যা আছে বলেই দাও। কেন শুধু ব্যথা পাও। যা মুখে বলা যায় না তাও এখানে লেখা তো যায়-
-একটা কথা বলবে আমাদের গেছে যে দিন তাকি তোমার কখনও-
- মনে পড়ে কি না? তোমার?
- নাঃ। আমি খুব ভাল আছি।
- তবে কেন জানতে চাও?
-জানি তোমার পড়ে না।  আমি প্রথমা ছিলাম না শেষতমাও নয়। কেনই বা পড়বে?
-তোমারও তো পড়ে না। দামি ঘর-বর-পুত্র পরিজন। তবে কেন জানতে চাও আমার মত নিতান্ত  সাধারণ এলেবেলের মনের কথা।
- আমি ভুলিনি। তোমার দেওয়া প্রতিটি ব্যথা দগদগে ঘা হয়ে আজোও জ্বালায় আমায়।
-আর তোমার দেওয়া ব্যথা গুলো? ভেবেছ আমি ভুলে গেছি? কোনদিন ক্ষমা করতে পারব না তোমায়।
- আমিও না।
একে অপরকে আনফ্রেণ্ড এবং ব্লক করে মর্মাহত দুটি হৃদয় একসাথে ডুগরে উঠল- ইস্।  কি বলতে চেয়েছিলাম আর একি হল।  আর কি কখনও-
#Aninditasblog
https://www.facebook.com/amianindita.blogspt.in/

Thursday 27 October 2016

বেনারস ডায়রি


আমাদের স্কুলের নাম ছিল তারাসুন্দরী বালিকা বিদ্যাভবন, তৎকালীন মধ্যহাওড়ার সেরা মেয়েদের স্কুল হিসাবে পরিগণিত হত আমাদের স্কুল।আমরা প্রাক্তনীরা আজো নিজেদের “তারা” বলে পরিচয় দিতে অত্যন্ত শ্লাঘা বোধ করি।  তারাদের একটা গ্রুপ আছে, ছোট গ্রুপ, সেই গ্রুপে হঠাৎ চৈতালিই কথাটা তুলল, “এই ভূত দেখতে যাবি?” “ভূত” দেখতে? কোথায় যাব? রাখি প্রথমেই উড়িয়ে দিল, “ভাগ শালা। ভূত আবার একটা দেখার মত জিনিষ? গেলে শান্তিনিকেতন চল, মন্দারমনি চল- ও সব ভূত-টুত চলবে না বস।” চৈতালি হাল ছাড়ল না, “বাকিরা কি বলিস? শোন আমার এক সহকর্মীর কাকার বেনারসের বাঙালিটোলায় একটা বাড়ি আছে। সেই বাড়িতে নাকি ভূত আছে।” অস্মিতা অট্টহাস্য করে উঠল, “ চৈ তুই ঠিক কি খেয়ে চ্যাট করছিস বলতো? এক ছিলিম গাঁজা টেনেছিস নাকি আরো বেশি? আমরা প্রতিবছর বেনারস যাই মামণি, বাঙালিটোলা হল এককথায় বেনারসের বড় বাজার।সারি সারি দোকান, থিকথিক করছে লোকজন, শয়ে শয়ে ধর্মশালা আর সবার ওপর বাবা বিশ্বনাথ, ওখানে আর যাই থাক, ভূত নেই বাপ।” চৈতালি শান্ত ভাবে জবাব দিল, “ইউ আর রাইট। ওটা একটা ভিড়ভাট্টা ওলা বাজার এলাকা, তাই তো? তাহলে ওখানে বিগত ষাট-সত্তর বছর ধরে কোন বাড়ি ফাঁকা পড়ে থাকার কথাই নয়। ট্রাষ্ট মি গার্লস, দ্বারভাঙ্গা ঘাটের কাছে, বাঙালিটোলায় ঐ কোঠা বাড়িটা জনমানব শূন্য হয়ে দাঁড়িয়ে আছে প্রায় অর্ধ শতাব্দী ধরে। আমার বন্ধুর কাকা হোটেল বানাবে বলেই কিনেছিল, ওরা মাড়োয়ারি, কোন প্রপার্টি কিনে ফেলে রাখার লোক নয়। ঐ বাড়িতে কেউ থাকতে পারে না, একজন কেয়ারটেকার রেখেছিলেন,  সে দুরাত কাটাবার পর নাকি উন্মাদ হয়ে যায়। এমনকি কোন দারোয়ান পর্যন্ত থাকে না।” “বাবা গো। যদি সত্যি হয় আমি নেই” বলেই দিল সঞ্চিতা। আর কেউ কোন উচ্চবাচ্য করল না, চৈতালি হতাশ হয়ে বলল, “কেউ যাবি না, তাহলে? আমি কিন্তু যাব। যাবই।”
          চুপচাপ ওদের কথা পড়ছিলাম, কিছু লিখিনি। ফোনটা বন্ধ করে চোখ বন্ধ করে অনেক ভাবলাম, বেনারস- হানা বাড়ি- বন্ধুদের সাথে একা একা বেড়াতে যাওয়া- বাড়ির বাইরে একা রাত কাটানো। সব কটার আকর্ষণই প্রবল। কিন্তু মেয়েকে ছেড়ে? নাঃ থাক। দেখি ওরা কেউ যায় কি না। আবার ফোনটা খুলে দেখি, শুধু অন্তরা জবাব দিয়েছে, “কদিনের জন্য যাবি চৈ? ছেলে ছেড়ে বেশীদিনের জন্য যেতে পারব না বাপু।” চৈ উৎফুল্ল হয়ে লিখেছে, “যাবি? সত্যি? বেশীদিনের জন্য কে যাবে বে? আমার বস ছাড়বে? বেড়াতে যাচ্ছি বললে তো হরগিজ ছাড়বে না। সিম্পলি যাব না আর বলব পেট খারাপ। শুক্রবার ট্রেনে উঠব, শনিবার ভুতের বাড়িতে রাত্রিবাস, রবিবার বাবা বিশ্বনাথের দর্শন করে রাতে ট্রেন, সকালে আবার ছুটতে হবে ইয়ের অফিসে-।”অন্তরা জবাব দেবার আগেই আমি বলে উঠলাম, “এই আমি যাব।” চৈতালি বা অন্তরা কিছু বলার আগেই সঞ্চিতার মেসেজ, “সর্বনাশ। শয়তানটা একা থোড়াই যাবে, আমাকে শুদ্ধ টেনে নিয়ে যাবে। অনি আমি কিন্তু যাব না বলেদিলাম, নিজের দায়িত্ব নিজে নিবি।” আমি অন্তরা এবং চৈতালি তিনজনেই বুঝলাম, এ হল, ‘আর একবার সাধিলেই খাইব।” চৈতালি শুধু বলল, “ আমি আজ রাতেই চার জনের টিকিট কেটে নিচ্ছি। শুভরাত্রি।”
প্রচন্ড অপরাধ বোধে জর্জরিত হয়ে, শৌভিককে বললাম, বরকে ছাড়া আমি কোথাও বেড়াতে যাই না। শৌভিক শুধু মাথা নেড়ে বলল, “যাচ্ছিস যা। কিন্তু মাঝ রাতে আমায় ফোন করে যেতে বললে কিন্তু আমি যেতে পারব না।” আমার ভীষণ ভূতের ভয়। যেরাতে শৌভিক ফিরতে পারে না, তুত্তুরীর প্রবল আপত্তি সত্ত্বেও আমি টিউবলাইট জ্বালিয়ে শুই। সারারাত বাথরুমের চৌকাট ও ডিঙোই না। এমনকি মেয়েকেও বলি, “চেপে শুয়ে থাক। ভোরবেলা যাবি।” এতদসত্ত্বেও ভূতের ছবি দেখা ছাড়ি না।  ইলেকশন চলাকালীন একবার বাহাশিস কাপুরের ভুতের শর্ট ফিল্ম দেখে এত ভয় পেয়েছিলাম যে, রাত দুটোর সময় শৌভিককে ফোন করে কান্নাকাটি জুড়েছিলাম, খালি মনে হচ্ছিল ভুতটা খাটের তলায় লুকিয়ে ঘাপটি মেরে বসে আছে। পায়ের আঙুল বা হাতের আঙুলের ডগা পেলেই ধরে টানবে। সেই খোঁটাটাই সুযোগ বুঝে দিল আর কি।
          যাই হোক শেষ পর্যন্ত আমরা রওনা দিলাম, আমরা চার তারা শুক্রবার সন্ধ্যা বেলার কালকা মেলে চড়ে, গন্তব্য বারানসি। লোকে যায় ভূতনাথের দর্শন করতে, আর আমরা চলেছি স্বয়ং ভূতের সন্ধানে।
রাত পৌনে আটটা নাগাদ ট্রেন ছাড়ল, ভোর সাড়ে ছটায় মুঘলসরাই নামতে হবে, ওখান থেকে অটো বা ট্যাক্সি করে বারানসী। এসি টু টায়ার, কিন্তু চার জনের সিট এক সাথে পড়েনি, শেষ পর্যন্ত অবশ্য আমাদের মতই ভুলভাল সিট পড়া অপর একটি পরিবারের সাথে রদবদল করে তিনজন এক কাট্টা হলাম, আর অন্তরার লাস্যময় অনুরোধ না ফেলতে পেরে এক ওড়িয়া ভদ্রলোক স্বেচ্ছায় তাঁর সিটটি আমাদের সাথে বদল করে নিলেন। পর্দা টেনে আরাম করে বসে যে যার বাড়িতে ফোন করলাম, সিঙ্গুর নিয়ে শৌভিকের মাত্রাতিরিক্ত ব্যস্ততার জন্য তুত্তুরীকে আমার মা-বাবার কাছে রেখে গেছি। আড়াই দিনের তো মাত্র ব্যাপার, যাই হোক, বাড়িতে ফোন করা মাত্রই তুত্তুরী ধরল, “মা! ভূত দেখলে?” হাসি চেপে বললাম, “সবে তো ট্রেন ছাড়ল মা। আগে পৌঁছই।” “ওঃ” নিতান্ত বিরস গলায় তুত্তুরী জিজ্ঞাসা করল, “মা, রাতে তোমার কাছে কে শোবে? কোন বাচ্ছা?” হাসতে হাসতে বললাম, “ কে আবার শোবে? ট্রেনে কোন বাচ্ছা নেই। তুই নিশ্চিন্ত থাক।” যা জানার ছিল জানা হয়ে যাওয়াতে তুত্তুরীর আর কথা বলার উৎসাহ রইল না, দায়সারা ভাবে, “এ নাও দাদুর সাথে কথা বল,” বলে বাবাকে ধরিয়ে দিল। বাবা প্রবল উৎসাহে চিৎকার করতে লাগল, “মানা! ট্রেন ছেড়েছে?” উত্তর শোনার সাথে সাথেই বাবা বলে উঠল, “ বাবা ভূতনাথের ওখানে যাচ্ছ, ভূত দেখতে পাও বা না পাও গাঁজা খেতে ভুলো না।” এই না হলে আমার বাবা। ভাল করেই জানে আমি ধোঁয়া টানতে পারি না, জীবনে একবারই সিগারেট টেনেছিলাম তাও বাবারই দেওয়া কাউন্টার, হেঁচে, কেশে কেঁদে সে যা বিকট কান্ড হয়েছিল, সেই প্রথম সেই শেষ। বললাম, “ও সব ছিলিম টিলিম টানা আমার পোষাবে না।” বাবা উল্টে ষড়যন্ত্র মূলক স্বরে ফিসফিস করে বলতে লাগল, “আরে, ছিলিম টানবি কেন? সিগারেটের পেটটা টিপে টিপে হাফ মশলা ফেলে দিবি- তারপর গাঁজা পাতাটাকে ওর মধ্যে ঠুসে ঠুসে ভরে নিবি। ব্যস। গাঁজা আর বেনারসের রাবড়ি- আহা।” আমি কিছু বলার আগেই শুনতে পেলাম, ওদিক থেকে মায়ের চিল চিৎকার, “ ধিঙ্গি মেয়ে, কচি বাচ্ছা ফেলে রেখে বন্ধুদের সাথে ধিঙ্গিপনা করতে যাচ্ছেন আর বাপ তাকে কি করে গাঁজা খেতে হয় সেই শিক্ষা দিচ্ছেন- কি পাগলের সংসারে পড়েছি বাপু আমি?” বাবা রীতিমত গম্ভীর স্বরে বলল, “হ্যাঁ ঠিক আছে রাখছি। পৌঁছে ফোন করিস” আর ফিসফিস করে বলল, “গাঁজা খেয়ে রাবড়ি খেতে কিন্তু ভুলিস না।” “রাবড়ি খাব কিন্তু গাঁজা খাচ্ছি না” বলে ফোন রাখা মাত্রই চৈতালি বলে উঠল, “খাবই। বাবা বিশ্বনাথের থানে  গিয়ে বাবার প্রসাদ সেবন করবি না কি যে বলিস?”
রাত নটা নাগাদ বর্ধমান ছাড়ানো মাত্রই বাকি প্যাসেঞ্জাররা নৈশাহারে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। আমরা চারজন গল্পেই মশগুল। কি ভাবে চৈতালি পেট খারাপের নাটক করে পাঁচটা নাগাদ অফিস কেটেছে সেই নিয়ে ব্যাপক হাসাহাসি হল এক চোট। তারপর চৈতালি ব্যস্ত হয়ে পড়ল ক্যামেরার সেটিং নিয়ে আর আমরা তিনজন মত্ত হলাম পিএনপিসিতে। সত্যি তো বাবারা যখন বউ বাচ্ছা ফেলে ট্রেক করতে যায় বা বন্ধুদের সাথে বেড়াতে যায় সমাজ কিচ্ছু বলে না, অথচ আমরা দুই মা নিজেদের বাচ্ছাকে দাদু-দিদাদের কাছে রেখে আড়াই দিনের জন্য বেনারস কি যাচ্ছি, যেন মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যাচ্ছে। অন্তরা তেঁতো গলায় বলল, “ভালো হয়েছে জানিস। বাচ্ছা গুলোরও একটু বোঝা দরকার, যে মায়েরা ওদের জীবনের কতখানি জুড়ে আছে।” চৈতালি ধড়াম করে ফ্ল্যাশটা বন্ধ করে বলল, “ আমি সাধারণত তোদের এই মেয়েলী ঘ্যানঘ্যানানি গুলো শুনি না মানে পড়ি না আর কি। আজ তো কোন উপায় নেই, কানে ঢুকেই যাচ্ছে, তোদের কত সমস্যা, কত কষ্ট- এর সব কিছুর একটাই সমাধান।” আমরা তিনজন জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালাম, চৈতালি মুচকি হেসে বলল, “চল মাল খাই।” সঞ্চিতাই জবাবটা দিল, “ তুই খা না চৈ। ভূতের সঙ্গে আসর জমাস। আমরা দেখব খন।” চৈতালি হেসে বলল, “ সে তো খাবই। আর অনির সাথে ভূতের ছবিও তুলব। বেচারার এত সেলফি তোলার শখ।” আড্ডা ফাজলামি আর বৃথা ঘুমের চেষ্টায় রাতটা যে কখন কেটে গেল বোঝার আগেই নেমে পড়লাম মোগলসরাই স্টেশনে। অটোয় চেপে যখন বেনারসের গোধডুলিয়ায় নামলাম তখনও কুয়াশার চাদর সরিয়ে সূর্যি দেব ওঠেননি। গোধডুলিয়া থেকে সাইকেল রিক্সা করে হরিশ্চন্দ্র বোর্ডিং হাউস(নাম পরিবর্তিত)ঘিঞ্জি বাজারের মধ্যে তিনতলা সাবেকি ধর্মশালা। একতলায় সারি সারি দোকান সবই হিন্দি সাইনবোর্ড। শুধু ধর্মশালাটার নাম টিনের বোর্ডে বাঙলা এবং হিন্দি উভয়েই লেখা, তাও বিবর্ণ। কড়ি বরগা ওলা ছাত, চুনকাম করা দেওয়াল, ঘন সবুজ জানলা দরজা, দোতলা এবং তিনতলায় লম্বা বারান্দা, এবং বারান্দার লাগোয়া সারি সারি ঘর। মালিক বাঙালি, কর্মচারীরাও সকলেই বৃদ্ধ এবং বাঙালি।
চা জলখাবার খেয়ে স্নান সেরে দশটা নাগাদ আমরা বেরোলাম হানা বাড়ি দেখতে। বর্তমানে যে বেতনভুক কর্মচারীটি ঐ বাড়ির দেখভাল করে, তাকে বলা ছিল, সেও আসবে, আমাদের দেখে শুনে জানাতে হবে আমরা কোন ঘরটায় রাত্রিবাস করব, তাহলে সেই ঘরটা সাফ করে বিছানার ব্যবস্থা করে দেবে আরো যদি আনুসাঙ্গিক কিছু প্রয়োজন হয় তাকে বললে সে ব্যবস্থা করে দেবে, তবে সব কিছুই দিনের আলো থাকতে থাকতে। সন্ধ্যা বেলায় আমাদের ধরমশালায় এসে আমাদের চাবিটা দিয়ে যাবে, আগে রামভরসা।
বিশাল সাবেকি বাড়ি, পাঁচিল দিয়ে ঘেরা, আসেপাশে থিকথিক করছে দোকান, শুধু ঐ বাড়িটার পাঁচিলের লাগোয়া কোন দোকান নেই। রাস্তা থেকে তিন ধাপ ইট বের করা সিড়ি উঠে গেছে, তারপর বিশাল রঙ জ্বলা সেগুন কাঠের সদর দরজা। দরজায় ইয়া বড় তালা ঝুলছিল।দরজার পাশে ভাঙা শ্বেত পাথরের ফলকে বাড়ির নাম লেখা, প্রায় অপাঠ্য, তবু পড়া যায় বাঙলায় লেখা “শ্রীকৃষ্ণনিবাস”।  দারোয়ানজী তালা খুলে ইশারায় আমাদের ঢুকতে বললেন, ঢুকেই বিরাট উঠোন, উঠোনকে চারদিক দিয়ে ঘিরে বাড়িটা উঠেছে। ভুল বললাম, ভাল করে দেখলে বোঝা যায়, তিন দিকে একতলা ছোট ছোট ঘর সম্ভবত রান্না ঘর,ভাঁড়ার ঘর, দাসদাসীদের ঘর কলতলা, একটা বড় ইঁদারা ইত্যাদি আর দক্ষিণ কোনে বিরাট দোতলা বাড়ি। পলেস্তারা খসে ইট বেরিয়ে গেছে, কোথাও কোথাও ছোট ছোট চারা গাছ মাথা তুলেছে। ছাত থেকে একটা বড় অশ্বত্থ গাছ ক্রমশ শিকড় প্রসারিত করছে। বাইরে বাজারের শোরগোল এই উঠনে যেন ভয়ে সম্ভ্রমে প্রবেশ করতে গিয়েও করতে পারছে না। কি দম চাপা এক নৈশব্দ। দারোয়ানজী সদর দরজার লাগোয়া তালা দেওয়া বৈঠকখানায় রাত্রি বাসের সুপারিশ করছিলেন। চৈতালি রাজি হল না। বড় উঠোনটা যখন আমরা পেরোচ্ছি মহলে ঢুকব বলে, কেন জানি না অজান্তেই সারা শরীরে বিদ্যুৎ খেলে গেল, আমার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বরাবর প্রবল এবং সেই ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় বারবার নিষেধ করতে লাগল, আর না, সীমানায় দাঁড়িয়ে আছিস, আর এগোনো উচিত নয়। ফিরব কি? চৈতালি, অন্তরা, সঞ্চিতা ততোক্ষণে একতলার বারন্দায় পা রেখেছে।
অনি আয় রে-” ওদের ডাকে সম্বিৎ ফিরে পেলাম, উঠোনের ঠিক মাঝখানে দাঁড়িয়ে হাঁ করে বাড়িটাকে দেখছিলাম। সাবেকি বাংলো প্যাটার্নের দোতলা বাড়ি। একতলা এবং দোতলায় লম্বা বারন্দা, এবং বারন্দার পিছনে সারি সারি ঘর। বারন্দা গুলো কোন এক কালে কাঠের জাফরি দ্বারা অর্ধাবৃত ছিলদোতলার বারন্দায় কাঠের জাফরি থেকে খসখস জাতীয় কিছু ঝোলানো ছিল, সম্ভবত শীতলতার জন্য এবং কিছুটা আব্রুর জন্য। যা এই দীর্ঘ অবহেলায় বিবর্ণ-ছিন্নবিচ্ছিন্ন হয়ে এমন ভাবে ঝুলছে যে দেখে এক নজরে মনে হল, আগন্তুকদের খাবার জন্য বাড়িটা হাঁ করে আছে। বাড়িটার আর একটা বৈশিষ্ট্য হল বাড়ির পূর্বদিকে রয়েছে বড় ইঁদারাটা আর পশ্চিমদিকে উঠোন থেকে সোজা সিঁড়ি উঠে গেছে দোতলা হয়ে ছাতে। বাড়ির বাইরে দিয়ে এমন সিঁড়ি আমি এর আগে কোন বাঙালি বাড়িতে দেখিনি। একতলায় চারটে ঘর, কোনটাতেই ভাল আলো ঢোকে না, তায় স্যাঁতস্যাঁতে গন্ধ। কোনটাই ওদের পছন্দ হল না। পরম উৎসাহে চৈতালি আর অন্তরা সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠতে লাগল। আমি আর সঞ্চিতা তখনও উঠোনেই দাঁড়িয়ে। দারোয়ান জী ফিসফিস করে বলল, “মেমসাব, কিঊ আপলোগ খুদখুশি করনে পে তুলে হুয়ে হো? মেরি বাত মানো, আপলোগ মেরে বেহেন জ্যায়সা হো, উপরওয়ালা কামরে কুছ ঠিক নেহি হ্যায় জী।” কিছু বলতে যাব, ওপর থেকে অন্তরার চিৎকার “ সঞ্চি-অনি শিগ্রি আয়।”
          দোতলায় ও চারটে ঘর, সিঁড়ি দিয়ে দুদ্দাড় করে আমরা যখন দোতলায় পৌঁছলাম, উত্তরপূর্বের ঘরের দরজা হাট করে খোলা, সামনে কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে অন্তরা। “আমরা আজ রাতে এই ঘরটায় থাকব। দেখে যা। এটা এ বাড়ির সেরা ঘর।” লম্বা বারন্দা দিয়ে হেঁটে উত্তরপূর্বের ঘরে যাবার সময় একটা জিনিষ খেয়াল করলাম, এই ধরণের বাড়ির বারন্দা গুলি সাধারণত পায়রাদের পীঠস্থান হয়। পায়রাদের মল জমে জমে পাথর হয়ে যায়, কিন্তু বারন্দায় ধুলো থাকলেও একটিও পায়রার বিষ্ঠা নজরে পড়ে না। কথাটা ফিসফিস করে সঞ্চিতাকে বলাতে ও বলল, যে ব্যাপারটা ও খেয়াল করেছে।
সত্যি ঐ ঘরটা ঐ বাড়ির সেরা ঘর। ঘরের তিনদিকেই বড় বড় জানলা, ভিতরে কাঁচের শার্সি, ধূলিমলিন কিন্তু অটুট। প্রতিটা জানলার মাথায় রঙ বেরঙের কাঁচের আর্চ, সেই লাল-নীল- সবুজ কাঁচের মধ্য দিয়ে সৌরশ্মি ঢুকে মেজে তে চিত্র বিচিত্র আল্পনা কাটছে। ঘরে এখনও কিছু আসবাব পত্র রয়েছে। যেমন একটা পেল্লায় খাট, যার ছত্রি গুলো ভেঙে পড়েছে, খাটে কোন গদি পাতা নেই, ছিল হয়তো নষ্ট হয়ে গেছে। কেবল দুটো ভাঙাচোরা পিসবোর্ড একটার ওপর আর একটা বেখাপ্পা ভাবে চেপে খাটটির লজ্জা নিবারণ করছে। একটা পুরানো দেরাজ, যার একটা পাল্লা কোথায় হারিয়ে গেছে, আর একটা সুদৃশ্য ড্রেসিং টেবিল। নির্ঘাত বিলিতি মাল, আয়নাটা যে আসল বেলজিয়াম গ্লাস তা বলা নিষ্প্রয়োজন। আমি আর সঞ্চিতা ধুলো পড়া  আয়নায়  মুখ দেখার আর সেলফি তোলার চেষ্টা করছিলাম যখন, চৈতালি আর অন্তরা দারোয়ানজীকে ডেকে সবিস্তারে বুঝিয়ে দিল কি করতে হবে। ঘর ভালো করে সাফ করে, কার্বলিক অ্যাসিড ছড়িয়ে একটা তোষক আর গোটা আটেক তাকিয়া (মাথা এবং পা চাপানোর জন্য) দিতে হবে। গোটা চারেক এমারজেন্সি লাইটের ব্যবস্থা করে দিতে হবে আর রাতে যদি কারো ছোট বাইরে যেতে হয় তাই নীচে ইঁদারার ধারে গোটা দুই বালতি জল ভরে রেখে যেতে হবে। আর হ্যাঁ মশা মারার কয়েল আর লিটার তিন চার মিনারেল ওয়াটারও রেখে দিতে বলা হল। এই সব কিছুর জন্য হাজার দুয়েক টাকাও দেওয়া হল, কম পড়লে রাতে নিয়ে নেবে আর বেশি হলে ফেরত দেবার দরকার নেই।
বাকি দিনটা বেনারসের গঙ্গায় নৌকা বিহার, রাবড়ি সেবন, টুকটাক কেনা কাটা, ছবি তোলা আর দিবানিদ্রা দিয়ে কেটে গেল (রাত জাগতে হবে না?)। আমরা যখন নৈশাহার সমাপ্ত করে তালা খুলে শ্রীকৃষ্ণনিবাসে ঢুকলাম, ঘড়ির কাঁটা তখন সবে রাত দশটাকে ছুঁইছুঁই করছে। বাইরে বাজারের হৈহট্টগোল কিছুটা স্তিমিত, সবাই দোকান গুটোতে ব্যস্ত। তালা খুলে বাড়ির ভিতরে ঢুকতেই বুকটা ধড়াস করে উঠল। বাইরে বাঙালিটোলা রোড নিয়ন লাইটের আলোকে ঝকমক করছে, সেই আলো কিছুটা চুইয়ে ঢুকে উঠোনে নানা রহস্যময় আঁকিবুঁকি কাটছে বটে, কিন্তু ঐ পর্যন্তই। আসল বাড়িটা নিকষ অন্ধকারে হাঁ করে দাঁড়িয়ে আছে। “কি ব্বে? ভয় পাচ্ছে নাকি মামণিরা?” চৈতালি হাসি চেপে জিজ্ঞেস করল। ভয় ভালোই পাচ্ছিল, আর হারামজাদা দারোয়ান চারটে এমাজেন্সি লাইটও জোগাড় করতে পারেনি। সম্বল মাত্র দুটো।
দুটো লাইটে ঘরটা মন্দ আলোকিত হয়নি, কিন্তু চৌকাটের বাইরে নিকষ ঘন অন্ধকার যে ওঁৎ পেতে আছে তা আমার ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় আমায় বারবার বলে চলেছিল। কেবল মনে হচ্ছিল, ঐ দরজাটা খোলা রাখার থেকে বন্ধ রাখলে বিপদকে কিছুক্ষণের জন্য হলেও এড়ানো যেতে পারে। বিপদের কথাটা লুকিয়ে(নইলে সবাই হাসবে যে) দরজা বন্ধ করার কথাটা বলাতে দেখলাম কেউ আপত্তি করল না। উঠে গিয়ে ভেজিয়ে এলাম, খিল ভেঙে পড়েছে। চুপচাপ বসে আছি চারজনে, বাইরে বাজারের কোলাহল ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হচ্ছে ক্রমশঃ। চৈতালি গলা ঝেড়ে বলল, “ব্যস? তোদের চার্জ শেষ? শুরু থেকেই কেলিয়ে পড়লে কি করে হবে? এই সঞ্চিতা ওঠ। একদম শুবি না। শুলেই মাল তুমি ঘুমিয়ে পড়বে। এই আমি বলে দিচ্ছি যে ঘুমিয়ে পড়বে তার গায়ে আমি ঠাণ্ডা বিয়র ঢেলে দেব।” “বিয়র? বিয়র কোথা থেকে পাবি?” আমরা তিনজন সমস্বরে বলে উঠলাম। “হু হু বাবা। জোগাড় করতে হয়। হানাবাড়িতে ভূতদর্শন করতে হলে ভূতেশ্বরীর আশীর্বাদ অবশ্যপ্রয়োজনীয়। মা কালির আশীর্বাদ ধন্য এই কারণ পান কর বালিকারা, সব ভয়, ভয় তো কি, ভয়ের বাবা ও জানলা গলে পালাবে।”
সত্যি বিয়রের প্রভাবে কি না জানি না, অল্পক্ষণের মধ্যেই আমরা সব ভুলে গল্পে মত্ত হলাম। বাইরে বাজারের হট্টগোল যে কখন স্তব্ধ হয়ে গেছে খেয়াল করিনি। হঠাৎ অন্তরা যখন বলল, “ শালা অ্যাডাল্ট ডায়পার আনা উচিত ছিল।” সঞ্চিতা বলল, “হ্যাঁরে আমাকেও যেতে হবে। অনেকক্ষণ থেকে চেপে আছি একা যেতে হবে ভেবে।” চৈতালি বলল, “একা কেন যাবে মামণি? চল সবাই মিলে যাই। যাবি অনি?” যাবার প্রয়োজন না থাকলেও যেতাম, একা ঐ ঘরে কে থাকবে? আর যেতে হবে তো লম্বা বারন্দা টপকে পাক্কা ২৪টা সিঁড়ি ভেঙে আড়াআড়ি উঠোন টপকে কুয়োতলায়। ষষ্ট ইন্দ্রিয় ফিসফিস করে যেন কি সব বলে চলেছে, শুনতে শুনতে উঠে পড়লাম। হাত ঘড়িতে তখন রাত সাড়ে বারোটা। একটা এমারজেন্সি ঘরে রেখে আমরা আর একটা নিয়ে বেরোলাম। বেরোবার সময় আমার ব্যাগপ্যাকটা আমি পিঠে চাপিয়ে নিলাম। চৈতালি আর সঞ্চিতা খুব হাসতে লাগল, “শালা ইয়ে করতেও পিঠে ব্যাগ নিয়ে যাবি? পালাবার তাল করছিস নাকি বে অনি? চাবি কিন্তু আমার পকেটে।” কিছু বললাম না।
কাজ মিটিয়ে আমরা যখন ফিরছি, চতুর্দিক নিস্তব্ধ, সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠলাম, দূরে ঘরটা থেকে রেখে আসা আলোটা লম্বা আলোর রেখাপাত করেছে দোতলার বারন্দায়। আচমকা আমাদের হাতের এমারজেন্সিটা দপ করে নিভে গেল। “কি হল?” বলার আগেই ঘরের দরজাটা সশব্দে বন্ধ হয়ে গেল, কোথাও কোন হাওয়ার নাম মাত্র নেই। আবার সেই ঘন দম বন্ধ করা অন্ধকার, ঝুপ করে ঘিরে ধরল আমাদের। তৈরি ছিলাম, জানতাম এমন কিছু হবে, কাছে আসার আগেই মুহূর্তের মধ্যে ফস করে জ্বালিয়ে দিলাম মোবাইলের টর্চটা। 
সাময়িক বিহ্বলতা কাটিয়ে, সঞ্চিতা আর চৈতালিও নিজের নিজের মোবাইলের টর্চ জালিয়ে দিল, দ্রুতপদে আমরা গিয়ে দাঁড়ালাম উদ্দিষ্ট ঘরটির সামনে। বন্ধ দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ভয়ে গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। দরজার ওপারে কি অপেক্ষা করে আছে কে জানে? দড়াম করে এক ধাক্কায় দরজা খুলে আগে ঢুকল অন্তরা, ভিতরে ঘুটঘুটে অন্ধকার। মোবাইল টর্চের আলোয় দেখলাম আমাদের বিছানা এবং জিনিসপত্র যেমন ছিল তেমনি আছে। তড়িঘড়ি চৈতালি আর সঞ্চিতা ব্যস্ত হয়ে পড়ল এমারজেন্সি দুটো কে নিয়ে, অন্তরা আনমনে গিয়ে দাঁড়াল ড্রেসিং টেবিলটার সামনে, আমি আগে দরজাটা বন্ধ করে দিলাম। ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় যদিও ফিসফিস করে বলেই চলেছে বৃথা সবই বৃথা।
মিনিট খানেক ব্যর্থ প্রচেষ্টা চালিয়ে ওরা রণে ভঙ্গ দিল। একটা এমারজেন্সিও কাজ করছে না। চৈতালি বেশ ঘাবড়ে গিয়ে বলল, “কি হবে রে? মোবাইল তো বেশি ক্ষণ চলবে না।” আমি আর সঞ্চিতা প্রায় এক সাথে বলে উঠলাম, “চল বেড়িয়ে যাই এখান থেকে।” সঞ্চিতা আবার বলল, “দেখ এই রকম হানাবাড়িতে আমরা রাত পৌনে একটা অবধি কাটিয়েছি, আমার কাছে এটাই বিরাট অ্যাচিভমেন্ট। সারা রাত কাটাতে গিয়ে কোন বিপদে পড়তে চাই না। আর আমার মন বলছে কোন বড় বিপদ ঘটতে চলেছে।” চৈতালি হতাশ সুরে বলল, “পালিয়ে যাব? বুক বাজিয়ে বলে এলাম আমরা চার তারা ভূতের বাড়িতে-”। “আমি কোথাও যাব না।” অন্যমনস্ক গলায় বলল অন্তরা। মোবাইল ততক্ষণে কাঁপতে লেগেছে। আমরা বোঝাবার চেষ্টা করলাম, সে রকম হলে সদর দরজা খুলে বাইরের সিঁড়িতে বসে রাতটা কাটিয়ে দেওয়া অধিক নিরাপদ। অন্তরা কোন জবাব না দিয়ে, সটান একটা তাকিয়ায় মাথা দিয়ে শুয়ে পড়ল। চৈতালি অসহায় ভাবে বলল, “তাহলে কি হবে? এই অন্ধকারে?”
ব্যাগপ্যাকটা ঐ জন্যই কাছছাড়া করিনি। ব্যাগে চারটে বড় বড় মোমবাতি ও দেশলাই ছিল। আসার আগে শৌভিকই গুছিয়ে কিনে দিয়েছিল, যদি কোন কারণে দেশলাই ভিজে যায় তাই একটা লাইটারও সঙ্গে দিতে ভোলেনি। মনে মনে নিজের বরকে অশেষ ধন্যবাদ জানিয়ে একটা মোমবাতি ধরালাম। মোমবাতির হলুদ আলোয় ঘরটা যেন আরও রহস্যময় হয়ে উঠেছে। কোথাও হাওয়ার নাম মাত্র নেই তাও মোমের শিখা থিরথির করে কেঁপেই চলেছে, যেন এখুনি নিভে যাবে। সঞ্চিতা দুহাত দিয়ে শিখাকে আঁকড়ে বিড়বিড় করে কোন মন্ত্র পড়ে চলেছে। আমি আর চৈতালি চুপ করে বসে আছি, অন্তরা সেই যে শুয়েছে আর ওঠেনি। ঘুমোয়নি যদিও চোখ খোলা।
ঘড়ির কাঁটা দেড়টা ছাড়িয়ে পৌনে দুটোর দিকে পা বাড়িয়েছেবিগত পয়তাল্লিশ মিনিটে নতুন কিছুই ঘটেনি। আমাতে আর সঞ্চিতাতে ঘেঁষাঘেঁষি করে বসে আছি। একটু দূরে চৈতালি এক দৃষ্টিতে মোমবাতির শিখার দিকে তাকিয়ে আছে। দম আটকানো পরিবেশকে হাল্কা করতেই যেন ও বলে উঠল, “ হে হে। তিনিই বোধহয় আমাদের ভয় পেয়েছেন জানিস। ভেবেছিল সামান্য আলো নিভিয়ে বা ক্যাঁচ করে দরজা বন্ধ করে আমাদের ভাগাতে পারবে। জানে না তো, আমরা হাওড়ার মেয়ে তায় আবার তারাসুন্দরীর বাচ্ছা।” আমরা অল্প হাসলাম। এবার সিরিয়াস গলায় চৈতালি বলল, “তবে তোদের জন্য আমার খুব খারাপ লাগছে ভাই। আমার দোষেই তোদের এই শাস্তি পোয়াতে হচ্ছে।”
“শাস্তি?” অন্তরার গলা শুনে আমরা চমকে উঠলাম। কখন উঠে বসেছে, “শাস্তি কাকে বলে তোরা জানিস না। সবথেকে বড় শাস্তি হল অমরত্ব। মানুষ ভাবে মরলেই সব জ্বালা জুড়োবে, কিন্তু সত্যিই কি তাই? যদি জ্বালা না জুড়োয়? আর তো কোথাও যাবার নেই? কোথাও পালাবার নেই?” আমরা চুপ। অন্তরা বলেই চলেছে, “একটা গল্প বলি শোন, হৈমবতীর গল্প। সময়টা ১৯৩০ এর দশক। হৈমবতীর বাবা ছিলেন হাওড়ার ব্যাঁটরা এলাকার বেশ ধনী ব্যক্তি।তার ওপর জাতীয় কংগ্রেসের ছোটখাটো নেতাও বটে। হৈম ওনাদের প্রথম সন্তান পরম আদরের দুলালী। হৈমর মামার বাড়ি ছিল আহেরিটোলায়। হৈম তখন আট, মামার বাড়িতে বেড়াতে গেছে। তখন বেশ রাত, ছোট্ট মামাতো ভাইকে দোতলায় হৈমর জিম্মায় দিয়ে ওর মা-মাসি-মামিরা হেঁসেলে খেতে বসেছে। ভাই ঘুমোচ্ছে, আর হৈম পাশে বসে পুতুল নিয়ে খেলছিল, যদিও মামার বাড়িতে বৈদ্যুতিক বাতি আছে, তবে সেদিন লোডশেডিং, খাটের পাশে একটা হ্যারিকেন রাখা আছে। আপন মনে খেলতে খেলতা হৈমর হঠাৎ মনে হল, জানলা দিয়ে কে যেন ওকে দেখছে, চমকে তাকিয়ে দেখে গোটা জানলা জুড়ে একটা প্রকান্ড মুখ, তার জিভটা জানলার গারদ গলে ততক্ষণে ঘরে প্রবেশ করেছে এবং খাটের দিকে দ্রুত বেগে এগিয়ে আসছে, ঠিক যেখানে ভাই ঘুমোচ্ছে। তীব্র আতঙ্কে হৈম গলা ফাটিয়ে চিৎকার করতে লাগল। কয়েক মিনিটের মধ্যে সবাই দুদ্দাড় করে ছুটে এল, যথারীতি জানলায় কাউকে পাওয়া গেল না। সেই রাতে হৈমর ধুম জ্বর এল আর পরদিন দুপুরে হৈমর ছোট্ট মামাতো ভাইটা দুম করে মরে গেল।
সেই থেকে কেন জানি না কিন্তু হৈম মৃত্যুকে অনুভব করতে পারত। ওর বাবার জেঠিমা, যেরাতে মারা গেল, হৈম সেরাতেও বাড়ির উঠোনে একটা কালো ছায়া দেখেছিল। যেই ঠানদি মারা গেল, ছায়াটাও আস্তে আস্তে মিলিয়ে গেল। বললে কেউ বিশ্বাস করত না, তাই হৈম নীরব থাকত। তের বছর বয়সে হৈমর বিয়ে হল, কাশির ধনাঢ্য বাবু মাধব বন্দ্যোপাধায়ের জ্যেষ্ঠ পুত্র শ্রীমান বিনোদের সাথে। মাকে ছেড়ে ট্রেনে করে কাশি যাবার সময় কি অসম্ভব কষ্টই যে হচ্ছিল, মাকে ছেড়ে কোনদিন থাকেনি হৈম।
কাশীর বাড়িতে প্রবেশ করার সময় কেন জানি না, হৈমর গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল, উঠোনে মাঝে দাঁড়িয়ে শাশুড়ি যখন ওদের বরণ করছিল, তখন হৈম না তাকিয়ে স্পষ্ট বুঝতে পারছিল, দোতলার বারন্দায় জমাট বেঁধে আছে একটা কালো ছায়া। বিয়ের পর বরের সাথে ভাব জমতেই হৈম তাকে কথাটা বলল, “ ওগো এ বাড়িটা মোটে ভাল নয়। এখানে কেউ একজন আচে, যে চায় সব জ্বলে পুড়ে ছারখার হয়ে যাক।” বিনোদ কলকাতার রিপন কলেজ থেকে সদ্য স্নাতক, এসব বুজরুকি বিশ্বাস করে নাদিনে দিনে হৈমর চারদিকে সেই ছায়া গাড় হচ্ছে, আতঙ্কে হৈমর ঘুম আসে না। সুযোগ পেলেই বিনোদকে কাকুতিমিনতি করে, “ আমাকে অন্য কোথাও নিয়ে চল। এ বাড়ি আমাদের সবাইকে খাবে।”
এরই মধ্যে হঠাৎ জানা গেল, হৈম গর্ভবতী। বিনোদ খুশি হয়ে বলল, “হৈম এবার যাও, তোমার বাবা আনতে আসচে। বাপের বাড়ি গিয়ে কটাদিন কাটাও আর আমিও দেকি কলকাতায় কোন কাজ জোগাড় করতে পারি না।” ভেবেছিল হৈম আনন্দে আত্মহারা হয়ে যাবে, হৈম তাকিয়ে দেখলও না পর্যন্ত, শুধু বলল, “ বড্ড দেরি হয়ে গেছে গো। অত করে বললুম শুনলে না আর পালাবার পথ নেই।”
হৈমর একটা মেয়ে হল, ফর্সা, ফুটফুটে তুলোর বল। বাড়ুজ্জে বাড়ির প্রথম সন্তান, সকলের নয়নের মণি। মেয়ের যখন ছ্ মাস বয়স, একদিন রাতে হঠাৎ ফোঁপানির আওয়াজে বিনোদের ঘুম ভেঙে গেল, কি হল আবার? হৈম তো আজকাল আর ও সব আজেবাজে বকে না। ভীষণ চুপচাপ হয়ে গেছে হৈম, এক মুহূর্তের জন্য মেয়েকে চোখের আড়াল করে না। তাহলে? আধো অন্ধকারে পাস ফিরে দেখে, মেয়ের মুখের ওপর ঝুঁকে পড়ে হৈম ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে, আর বলছে, “আমার কি দোষ ছিল? তবে কেন? কেন-” আর কথা বলতে পারল না মুখে আঁচল গুজে ফোঁপাতে লাগল। হৈম না বুঝলেও মেয়ে বোধহয় বুঝতে পারল যে বাবা জেগে গেছে, তখনি বাবার দিকে ফিরে খিলখিল করে হেঁসে উঠল। হতভম্ব বিনোদ মেয়ের দিকে তাকিয়ে বলল, “হৈম কি হয়েচে?” হৈম আর চাপতে না পেরে হাউহাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বলল, “ ও গো বুজতে পারচ না? ও সে। আমাদের শাস্তি দিতে এয়েছে। কেন এলি তুই? যদি আমার কাচে নাই থাকবি তুই কেন এলি মা? আমি যে তোকে বড় ভালোবেসে ফেলেচি। আমার প্রথম সন্তান তুই।”
যত দিন যেতে লাগল, মেয়ের প্রতি হৈমর অধিকার বোধ সীমা ছাড়াতে লাগল। কিছুতেই মেয়েকে কাছছাড়া করতে চায় না। সব সময় চোখে চোখে রাখাটা প্রায় বাতিকের পর্যায়ে গিয়ে ঠেকল। বেচারা বিনোদ, ওদের দাম্পত্য শুধু মাত্র পিতামাতার সম্পর্কেই সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ল। তাতে বিনোদের খুব একটা সমস্যা না থাকলেও, মাধব বাবু এবং তাঁর গিন্নী ক্রমশঃ উদ্বিগ্ন হয়ে পড়তে লাগলেন। নাতনী যতই আদরের হোক, এত বড় হয়ে গেল, অথচ এখনও পর্যন্ত আর একটিও  ভাইবোন হল না, ব্যাপারটা ওনাদের কাছে আদৌ সহজপাচ্য ছিল না। বিনোদের প্রতি হৈম  যে কোন কর্তব্যই পালন করে না, বরং বেশ অবহেলা করে এই ধারণা বদ্ধমূল হয়ে উঠল। ফলতঃ বিনোদের বাবা-মা প্রায় চেষ্টা করতেন যাতে হৈমকে তার মেয়ের থেকে দূরে রাখা যায়, অন্তত কিছুটা সময়ের জন্য হলেও যাতে রাধা বিনোদের সাথে একটু সময় কাটাতে পারে। নাতনীও দাদু-ঠাকুমার একান্ত অনুগত ছিল। মায়ের দম বন্ধ করা শাসনের পাশে দাদু ঠাকুমার অফুরন্ত স্নেহ তথা প্রশ্রয় শিশুকে  বেশি আকর্ষণ করত।  মাধব বাবু পরম আদরে নাতনীর নাম রেখেছিলেন শ্রীরাধিকা। মাধবের নয়নমণি প্রাণাধিকা শ্রীরাধিকা ওরফে রাধু। রোজ সকালে মাধব বাবু যখন সেরেস্তায় গিয়ে কাজে বসতেন, রাধুও গিয়ে বসত দাদুর কোলের কাছে। যথারীতি হৈম আপত্তি করেছিল, কিন্তু সে কথা কেউ কানে তোলেনি।
রাধু তখন পাঁচ, দাদুর কিনে দেওয়া ট্রাইসাইকেল নিয়ে সারাদিন গোটা বাড়ি ঘুরে বেড়াচ্ছে, সেদিন দোতলার দালানে সাইকেল চালানো নিয়ে সকালবেলাই একচোট ঝামেলা হয়ে গেল মা-মেয়ের। রাধু প্রচন্ড জেদি হয়ে উঠছে, হৈম কিছুতেই দোতলায় চালাতে দেবে না, রাধুও কথা শুনবে না। শেষে রাধু কাঁদতে কাঁদতে গিয়ে নালিশ করল দাদুকে। ঠিক সেই সময় বিনোদ খেয়েদেয়ে আপিসে যায়, মাধববাবু গম্ভীর গলায় হুকুম দিলেন,দিদি তুমি দোতলাতেই সাইকেল চালাও।আমার আর সেরেস্তায় বসে কাজ নেই, খাতাপত্র ওপরের দালানে বসেই দেখে নেব। আমি তোমার কাছে বসছি আর মাকে বল, বাবা  এখুনি খেতে বসবে, মা যেন হেঁসেলে যায়। আমার ছেলেটার দিকে তো কারো কোন নজরই নেই।পুরো নিমপাতা খাওয়া মুখে রান্নাঘরে গিয়ে বিনোদকে খেতে দিল হৈম। বেচারা বিনোদ, দুএকটা কথা বলার চেষ্টা করল বটে হৈমর সেদিকে কানই নেই। খালি রান্না ঘরের জানলা দিয়ে গলা বাড়িয়ে দেখছে, হঠাৎ প্রবল আওয়াজ, আর মাধববাবুর হৃদয়বিদীর্ণ চিৎকার,  দিদিইইইইইইইইহৈম পাথরের মত বসে রইল, বিনোদ খাওয়া ফেলে লাফিয়ে উঠে দৌড়ল, রাধু সাইকেল সমেত দোতলার বারন্দা থেকে সিঁড়ি দিয়ে গড়িয়ে পড়ে গেছে অজান্তে কখন সাইকেল চালাতে চালতে সিঁড়ির কাছে চলে গিয়েছিল মাধববাবু খেয়াল করেননি।হয়তো সাময়িকভাবে একটু ঝিম লেগে গিয়েছিল।
রাধুর মৃত্যুর শোক সবথেকে বেশি প্রভাব ফেলেছিল মাধব বাবুর ওপর। চোখের সামনে                নাতনীর  মৃত্যু উনি মেনে নিতে পারেননি, ফলশ্রুতি সান্নিপাতিক রোগে (সেরিব্রাল)একেবারে পঙ্গু হয়ে পড়লেন মাধব বাবু, চোখের দৃষ্টিও হারালেন সাথে সাথে। বিনোদের হল শিরে সংক্রান্তি, একদিকে পঙ্গু অন্ধ বাবা ওপর  দিকে জীবনের প্রতি সম্পূর্ণ উদাসীন হৈমবতী, স্নান করে না, খায় না, চুল আঁচড়ায় না, কারো সাথে বার্তালাপ পর্যন্ত করে না। ঘর থেকে টেনেও বার করা যায় না। তারওপর পরিবারের জ্যেষ্ঠ পুত্র হিসাবে বাবার পঙ্গুত্বের জন্য জমি-বাড়ি, দোকান, মামলামোকদ্দমা সবই দেখাশোনা করতে হচ্ছে বিনোদকেই। বিনোদের ইচ্ছা  করে, সবকিছু ছেড়েছুঁড়ে দিয়ে হৈমকে নিয়ে কোথাও পালিয়ে যায়। কেন যে বিয়ের পর হৈমর কথা শোনেনি? আজ খুব আফসোস হয়, সত্যি যদি সেদিন বাড়ি ছেড়ে কোথাও চলে যেত?
দিনগুলো যেমন তেমন ভাবে কেটে যায়, কাটে না রাত গুলো। তীব্র ক্লান্তিও ঘুমকটেনে আনতে ব্যর্থ হয়। সোনার পুতুল থেকে হৈমর দিকে তাকালে ওর চোখ ফেটে জল আসে। বিনোদ রোজ বোঝায়,  সেরাতেও  বিনোদ বোঝাচ্ছিল, “যা ঘটে গেছে, তা মর্মান্তিক, কিন্তু এভাবে ভেঙে পড়লে চলবে কেন? আমাদের সামনে গোটা জীবন পড়ে আছে, তোমার কি বা বয়স। আবার কেউ আসবে, হয়তো রাধুই  ফিরে আসবে।” ঠান্ডা শান্ত চোখ তুলে হৈম ওর দিকে তাকালো, তারপর অদ্ভুত শীতল স্বরে বলল, “ রাধু আর কোনদিন ফিরে আসবে না। ও এসেছিল প্রতিশোধ নিতে। তোমার বাবাকে জিজ্ঞেস কোর লীলা কে?” লীলা আবার কে রে বাবা? বিনোদ আর কথা বাড়ায়নি। হৈমর এসব খামখেয়ালী কথাবার্তার সঙ্গে ওর পরিচয় তো আর অল্প দিনের নয়।
শেষ পর্যন্ত ওর অনুরোধ না ঠেলতে পেরে ওর পাশে শুতে রাজি হয়েছিল হৈম।  বহুদিন বাদে স্ত্রীকে জড়িয়ে হৈমর চুলের ঘ্রাণ নিতে নিতে কখন যে ঘুমিয়ে গিয়েছিল বিনোদ নিজেও জানে না। ভোর বেলা যখন ঘুম ভাঙল, হৈম ওর পাশে নেই, পরনের কাপড় গলায় দিয়ে ছাত থেকে ঝুলছে। হৈমর মৃত্যু বিনোদ কিছুতেই মেনে নিতে পারছিল না। হৈমকে দাহ করে ফিরে এসে ফাঁকা ঘরে বসে হুহু করে কেঁদে উঠল বিনোদ। মাত্র কয়েক বছরের দাম্পত্যের স্মৃতি ছাড়া আর তাহলে কিছুই রইল না বিনোদের? কেন এমন হল? কার অভিশাপে বিনোদের জীবনটা এভাবে ধ্বংস হয়ে গেল? ভাবতে ভাবতে হঠাৎ বিনোদের মনে পড়ে গেল, হৈম কি বলছিল? “লীলা?” কে এই লীলা? বাবার যা শারীরিক অবস্থা বাবাকে জিজ্ঞাসা করতে সাহসে কুলাল না, তরতর করে সিঁড়ি দিয়ে নেমে সেরেস্তায় ঢুকল বিনোদ। নায়েব মশাই, বহু বছর ধরে ওদের সেরেস্তায় কাজ করছেন, বিনোদের বাবাকেও উনি ছোট থেকে চেনেন। বিনোদ ওনাকে ধরল, “কাকাবাবু আপনি বহু বছর আছেন আমাদের পরিবারে।  বলতে পারেন লীলা কে?” নায়ব মশাই মাথা চুলকে বললেন, “লীলা? কই এ নামে তো কাউকে চিনি না?”  বাবাকে আপনি আশৈশব চেনেন।বাবার সাথে কোন লীলার--? কথাটা শেষ করার আগেই নায়েব মশাই এর দেহের ভাষা পাল্টে গেল। বেশ ভয় পেয়েই উনি বললেন “আমি জানি না ।” নায়েব মশাই চলে যেতে উদ্যত হলেন কিন্তু বিনোদ তার আগেই তাঁর সামনে হাঁটু মুড়ে বসে পড়েছে, “কাকাবাবু আমাকে জানতেই হবে। অনুগ্রহ করে বলুন। কে এই লীলা? হৈম বলেছিল এই লীলার জন্যই আমাদের সর্বনাশ হল, আগে রাধু তারপর হৈম। আমার কই দোষ বলুন?” নায়েব মশাই শশব্যস্ত হয়ে বিনোদকে তুলে দাঁড় করালেন, “দেখ বাপু বিনু, লীলা যেই হোক সে তোমাদের কোন ক্ষতি করতে পারবে না,বহু বছর হল সে মৃত।” “মৃত? মানে?” হতভম্ব বিনোদের দিকে তাকিয়ে নায়েব মশাই মাথা নামিয়ে বললেন, “ কর্তাবাবু খুব ভালো মানুষ। দেবতুল্য। কিন্তু যৌবনে জেদের বশে একটা ছোট ভুল করে ফেলেছিলেন। এই বারাণসীর কাছে আখোদা গ্রামে আমাদের কিছু জমি জিরেত ছিল। সেটা দেখতেই বড় বাবু কর্তা বাবুকে পাঠিয়েছিলেন। সঙ্গে ওনার কিছু বন্ধু-বান্ধব ও গিয়েছিল, কটা দিন গ্রামে কাটিয়ে আসবে, আরাম করে। খাজনাও আদায় হয়ে যাবে আর সাথে শিকারেরও সুযোগ ছিল। ঐ গ্রামেরই কোন প্রজার মেয়ে ছিল লীলা। আমি দেখিনি, তবে শুনেছি দেখতে শুনতে মন্দ ছিল না। দিন কয়েকের মধ্যেই মেয়ের বিয়ে বলে লীলার বাপ অনুরোধ করতে এসেছিল খাজনা যদি কিছু মাপ হয়। গরিবগুর্বো মানুষ জন। কর্তামশাই এর মাথায় কি ভূত চাপল, নাকি বন্ধু রাই ওসকাল, বললেন, মেয়েকে আজ রাতে পাঠিয়ে দিস, তোর খাজনা মাপ হয়ে যাবে। বুড়ো তো শাপ-শাপান্ত করতে করতে চলে গেল, যাবার সময় বোধহয় বাঙালি বলেও কিছু গালি দিয়েছিল। যাই হোক রাতের বেলা কর্তা মশাই পাইক নিয়ে গিয়ে মেয়েটাকে তুলে আনলেন। দিন দুয়েক পরে ছেড়ে দেন, তবে তার আগে নিজে এবং ওনার বন্ধুরা-”। বিনোদের মাথা ঘুরছিল, ছিঃ বাবা? নায়েব মশাই চোরের মত মাথা নীচু করে বললেন, “মেয়েটা ফিরে গিয়েছিল মা-বাবার কাছে, কিন্তু” একটু থেমে বললেন, “যা হয় আর কি। নষ্ট মেয়েকে কি কেউ আর গ্রহণ করে? নাকি তাদের বিয়ে হয়। ওর ভবিষ্যৎ বারানসির কোন কোঠাই ছিল হয়তো, কিন্তু মেয়েটা তার আগেই আত্মহত্যা করে। শুনেছি গলায় দড়ি।” বিনোদ আর  পারল না, ধীর পদক্ষেপে বাড়ি ছেড়ে বেড়িয়ে গেল। আর ফিরে এল না। বুড়ো কর্তা গিন্নী এত শোক আর নিতে পারল না, তারাও চলে গেল একে একে। আর যারা ছিল তারাও সব কে কোথায় মরে হেজে গেল। বাড়ি এখন লীলার। লীলা একাই থাকে। লীলা চায় না কেউ এবাড়িতে আসুক। বিশেষত রাতের বেলা-”। “অন্তু প্লিজ চুপ কর।”  চিৎকার করে উঠলাম আমি, ভয়ে গলা ভেঙে গেল, চোখ ফেটে জল আসছে। অন্তু মাথা নেড়ে হাসতে হাসতে বলল, “লীলা আসছে-।” ঘরের বাইরে সত্যি কার যেন পায়ের আওয়াজ, একবার মনে হল কোন বাচ্ছা যেন সাইকেল চালাচ্ছে, পর মুহূর্তেই এক গা গয়না পরে কে যেন মল বাজাতে বাজাতে এগিয়ে আসছে। হে ভগবান কি করি? মোমের শিখা প্রায় নিভু নিভু, সঞ্চিতা আমায় ভয়ে আঁকড়ে ধরেছে, চৈতালি সমানে অন্তরাকে ঝাঁকাচ্ছে, “পিঙ্কি? পিঙ্কি?” ভয়ে আমাদের ঘাড়ের রোম খাড়া হয়ে উঠেছে, সে আসছে, তার পায়ের আওয়াজ ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠছে। যে কোন মুহূর্তে এক ধাক্কায় খুলে যাবে দরজা, তারপর কি হবে? আমিও জানি না।
[শেষ]