Monday 24 February 2020

অনির ডাইরি, ২৪শে ফেব্রুয়ারি, ২০২০

“মেঘ পিওনের ব্যাগের ভিতর মন খারাপের বস্তা”- সকালটাই কেমন যেন ভিজে ভিজে। টলটলিয়ে উঠছে আকাশের আঁখি, বড় অগছাল ঘরদুয়ার,থরে থরে পাট করে রাখা, সদ্য কাচা পশমী বস্ত্র, আলমারি খুললেই ওডোনীল আর ন্যাপথলিনের চেনা চেনা গন্ধে উঁকি মারে শৈশব, আলমারির লুকানো কোণা থেকে উঁকি মারা, লালচে জাব্দা পিচবোর্ডের বাক্স থেকে ভেসে আসে মনকেমনিয়া জুঁই ফুলের সুবাস। লাল ভেলভেটের অ্যালবামের পাতার পর পাতা জুড়ে, শুধুই সুখস্মৃতি। নতুন শাড়িতে আড়ষ্ঠ সদ্য শাঁখাপলা পরা নতুন বউ, টোপর পরা ছোকরা বরের কান এঁটো করা একগাল হাসি, কপাট বক্ষে লেপটে থাকা গায়ে হলুদের রঙ- তত্ত্বের ট্রেতে শোওয়ানো ঘোমটা দেওয়া এত্ত বড় কাতলার নাকে নথ- আঙুলের ফাঁক গলে ঝরে পড়া জলের মতই হারিয়ে যাচ্ছে সময়- রেখে যাচ্ছে শুধু একরাশ মনখারাপ।
“হেলো, আপনি সিএমও তে ফোন করেছিলেন-?” “কি? ছিএমো? কোথা থেকে বলছেন?” জিভ কেটে আবার বলি, “দিদিকে বলো’তে ফোন করেছিলেন?” ইতি তৃতীয় ব্যক্তি, বড় সাহেব লিস্ট পাঠিয়েছেন নব্বই জনের, ভাগ করে ফোন করছি আমরা, জানতে চাইছি কি সমস্যা, শ্রমদপ্তরের বিরুদ্ধে কি অভিযোগ। এর আগের দুই জন মোটেই খুশি হননি, আমাকে পেয়ে। ওনারা “দিদি”কে চান, কোন দিদি বলে দিতে হবে না আশা করি, সমস্যা অবশ্য তেমন গুরুতর ছিল না, একটি ছিল নিছক মা-মেয়ের চুলোচুলি, তাতে শ্রম দপ্তর কি করবে বুঝতে পারলাম না যদিও। দ্বিতীয় ব্যক্তি জানেনই না, কে নালিশ করেছে দিদির কাছে। ওনার কোন অভিযোগ নেই। তিন নম্বরকে ধরতে যাবার আগেই বাইরে থেকে আমাদের সঞ্চিতার প্রবল চিৎকার। জানতাম এটাই হবে।আমি নিজেও যথেষ্ট ভয়ে ভয়ে ফোন করছি,  মোবাইলে অচেনা মহিলার গলা পেলেই বাঙালী (অবাঙালী ও) পুরুষের হৃদয়ে প্রেমের সুড়সুড়ি লাগে। দৌড়ে এসে ফোনটা কেড়ে নিয়ে পিতৃসুল্ভ স্নেহে বোঝাতে লাগলেন আমাদের বর্মণ সাহেব। “এমন কি করতে আছে বাবা?” ডান হাতে- বাঁ হাতে ব্যাট করে চলেছেন ভদ্রলোক, একাই ৫৭ জনকে ফোন করে ফেলেছেন দিনের শেষে, তবে সে তো অনেক পরের কথা।
বেড়ে যায় বেলা, কাজের ফাঁকে ফোকরে আমি যাদের ফোন করি, হয় ফোন বন্ধ। নয় ধরে না। দম নিতে বারন্দায় যাই, ওল্ড কালেক্টরেটের সুবিশাল ঝুল বারন্দা, হাজি মহম্মদ মহসিন সাহেবের আস্তাবল ছিল নাকি, কেউ বা বলে গোরাদের সৈন্য ব্যারাক। আপিসের সামনের চেয়ার দখল করেছে যেন কারা, এক কোঁচর মুড়ি কোলে এক বয়স্ক মানুষ, সামনে দাঁড়িয়ে দুটো ছোট ছোট বাচ্ছা, সামান্য আবডালের প্রচেষ্টা মাত্র, খোসা সমেত শসা আর মুড়ি চিবোচ্ছে তিনজনায়। অপরিসীম সারল্য মাখামাখি বাচ্ছা দুটোর মুখ। ছোটটা হঠাৎ বাড়িয়ে দেয়, আধ খাওয়া কচি শসাটা। “এই” বলে ধমকে ওঠে, দেবু, পিছনের বার কামরায় বসেন বার জন অফিসার, দেবু তাদের সবেধন নীলমণি একটিই মাত্র পিওন। সসম্ভ্রমে উঠে দাঁড়িয়ে বলে, “এরা কোর্টে এসেছে ম্যাডাম। কতক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকবে, বাচ্ছা দুটোকে নিয়ে, তাই আপনাদের চেয়ারে বসতে বলেছি।“
সন্ত্রস্ত হয়ে ওঠে বৃদ্ধ, উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করেন, আশ্বস্ত করতে জানতে চাই, “কোর্টে কেন গো? আর এই বাচ্ছা দুটোকে এনেছেন কেন?” ছোটটা সামান্য প্রশ্রয় পেয়ে এগিয়ে আসে আধ খাওয়া শসা নিয়ে, মাথা নেড়ে জানাই খাব না বাবা, তুই খা। বৃদ্ধের চোখটা বোধহয় সামান্য চকচকিয়ে ওঠে, “এই টুকুন বাচ্ছা, কতদিন হয়ে গেল মাকে ছেড়ে আছে। আজ ওর মাকে কাঠগড়ায় তুলবে, তাই নিয়ে এয়েছি—“ দীর্ঘ অস্বস্তিকর নীরবতার পর, “বাড়িতে তো আর তেমন কেউ নেই--।“ বাচ্ছা দুটোর নিষ্পাপ চোখের দিকের তাকিয়ে প্রশ্ন করতে পারলাম না, কি এমন করেছে ওদের মা। শুনলাম, খুনের দায়ে জেল খাটছে মেয়েটি। মাছ কাটা বটি দিয়ে কুপিয়ে কুপিয়ে খুন করেছে সোয়ামীকে। “বাড়ির অমতে, পালিয়ে গিয়ে  ভাবের বিয়ে। বিয়ের পর জানতে পারে, আগের পক্ষের এক খানি জ্বলজ্যান্ত বউ আর চার-চারটে বাচ্ছা আছে লোকটার। ভাত দেবার ভাতার নয় কিল মারবার গোঁসাই ছিল গো বরটা, দুদুটো ছোট বাচ্ছার পেট ভরানোর জন্য বাজারে মাছ বিক্রি করত মেয়েটা, সেই পয়সার ভাগ নিয়ে মারধর খাওয়া ছিল নৈমিত্তিক ব্যাপার। বাচ্ছাদের মাছ-ভাতের পয়সায় দোজবরে বরের মদ গেলা যেদিন আর সয়নি, আঁশ বটির বাড়ি বসিয়ে দিয়েছে কয়েক ঘা। তারপর সটান রক্তাক্ত বটি নিয়ে হাজির হয়েছে থানায়।“ বৃদ্ধেরই মেয়ে। কোন উকিল বাবু নাকি আশ্বাস দিয়েছে, বেকসুর খালাস করিয়ে আনবে মেয়েটিকে। সেই অনাগত শুভদিনের তাকিয়েই দিন গুনছে বৃদ্ধ বাপ আর দুটি আপাতঃ অনাথ শিশু।
পরের মিটিং এর লোকজন এসে হাজির, ফাঁকা বয়লার সাফ করতে গিয়ে, বের হওয়া গ্যাসে মারা গেছে এক শ্রমিক, তিনজন ধুঁকছে হাসপাতালে। বাইপাসের ধারের অভিজাত হাসপাতাল, প্রতিদিন লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে বিল। ভয়ে কারখানা খুলতে পারছে না মালিক, গুদামে পচছে মাল, ঠিক সময়ে ডেলিভারি দিতে না পারলে, সমূহ লোকসান। মজুরী না পেয়ে ধুঁকছে শ্রমিকরাও—সবার আশা, যদি ত্রিপাক্ষিক বৈঠকে বের হয় কোন সমাধান সূত্র- তৃতীয় পক্ষ আমি। চেম্বারে ঢোকার আগে, বাচ্ছা দুটোকে একটু আদর করে যাই। মেয়েটা বড়, বলি, “মন দিয়ে পড়াশোনা কর।” ছোটটার অক্ষরজ্ঞান হয়নি বোধহয়, আবার বাড়িয়ে দেয় তখন থেকে কামড়ানো শশার টুকরোটা, মনে মনে বলি, “ভালো থাকিস বাবা। মায়ের বাছা, ফিরে পাক মায়ের কোল-“। জীবন বড়ই রুক্ষ। দুদণ্ডের দুঃখবিলাসটুকুই যা সম্বল- তারপর আবার শুরু ইঁদুরদৌড়- সূক্ষ্ম ভূলই যে কখন অজান্তে ছুঁড়ে ফেলে দেয় কয়েক আলোকবর্ষ পিছনে- ভাবতে বসলে অবাক লাগে বৈকি-

Thursday 13 February 2020

অনির ডাইরি, ৯ই ফেব্রুয়ারি, ২০২০


ঝুমা বলল, “ম্যাডাম, একটা অনুরোধ করব?” বাপরেঃ এদের এত ভালোবাসি, তাও এদের এত সঙ্কোচ আর ভণিতা। বললাম, ঝট করে বলেই ফেলো। আব্দেরে  আর্জি জানালো, “ সামনে আমার মেয়ের জন্মদিন। ওর জন্মদিনের কার্ডটা আপনি লিখে দেবেন-”। কার্ড অর্থাৎ নিমন্ত্রণ পত্র? এ আর এমন কি ব্যাপার? জানতে চাইলাম কার নামে কার্ড হবে? কবে? আর ঝুমার মেয়ের ভালো নামটা-
শুনলাম- সুদ্যুতি। বাপরেঃ ঐ পুঁচকেটার এত ভারি নাম? যাকে দেখলেই বলি, “মিষ্টি খাবো?” প্রথম দেখেছিলাম, টিম চুঁচুড়ার অফিস পিকনিকে, সে বিগত বছরের কথা। কয়েক মাস হল এনসিএলপির চার্জ নিয়েছি। ঝুমা তার ম্যানেজার। ঠিক টিম চুঁচুড়ার প্রত্যক্ষ সদস্য নয়। সত্যি? বললে ঝুমা মানবে?
পিকনিকে ঝুমার হাত ধরে যিনি এলেন তাঁকে দেখে তো পুরো চুঁচুড়া টিম ক্লিন বোল্ড। তিনি এলেন- লকড়ি কি কাঠি গাইলেন- সকলের প্রাণেশ্বরী হয়ে বিদায় নিলেন। শুনলাম তাঁর নাম মিষ্টি। সেই থেকেই শুরু, “মিষ্টি খাবো” উপাখ্যান। তিনি আবার তুত্তুরীর প্রগাঢ় অনুরক্তা। তুত্তুরী হল, তাঁর ভট্টাচার্য দিদি। ভাবুন খালি !
তো মিষ্টি ওরফে সুদ্যুতির জন্মদিনের নিমন্ত্রণ পত্র লিখে ফেললাম সময় করে, এ আর এমন কি কথা। বাঁধা গৎ- মাননীয় মহাশয়, অমুক তারিখে আমাদের পৌত্রী/দৌহিত্রীর শুভ জন্মদিন উপলক্ষে মদীয় বাসভবনে/ অমুক স্থানে প্রীতিভোজে যোগদান করিয়া বাধিত করিবেন ইত্যাদি-। ঝুমার মুখটা হাঁড়ি হয়ে গেল পড়ে। পছন্দ হল না। লিখতে হবে, প্রাণের কথা-
লিখতে বসে দেখলাম, ব্যাপারটা বেশ কঠিন। আমি পাতার পর পাতা লিখে যেতে পারি তুত্তুরীকে নিয়ে। অতটা না পারলেও পারি ভাইপোদ্বয় বাবু বা বুল্লু বাবুকে নিয়ে। যাদের শৈশবের সাক্ষী আমি। কিছুটা হলেও সুকন্যার উটো বাবুকে নিয়েও- রোজই শুনি যে তাঁর কৃতকর্মের উপাখ্যান। মিষ্টিকে নিয়ে লিখতে গিয়ে দেখলাম- কিছুই জানি না তো মিষ্টি খাবোর সম্বন্ধে। অগত্যা শরণাপন্ন  হলাম ঝুমার। কিছু তো বলো- কেমন ছিল সে? কেমন অনুভূতি হয়েছিল প্রথম দর্শনে? টেকো ছিল কি? নাকি একমাথা ঝুমুর ঝুমুর চুল? কি বলে ডাকে, দাদু-ঠাম্মা বা দাদু-দিদা? শোনাও কিছু দুষ্টুমির গল্প। মায়ের চোখ দিয়ে দেখি মিষ্টির শৈশব-
দিন দুয়েক বাদে পেলাম এক সদ্যোজাত এক নিঁখুতির ছবি। ভ্রু কুঁচকে কি যেন ভাবছিল সে। সাথে ঝুমার কিছু হাতে লেখা, কিছু টাইপ করা চিঠি- মায়ের থেকে ভালো বোধহয় কেউ আঁকতে পারে না, শৈশবের ছবি। ঝুমার চোখ দিয়ে দেখলাম, ওয়াকার চড়েই, দাদুর দই বাটি ধরে চম্পট দেওয়া- দেখলাম, ঘুরে ঘুরে সবার পাত থেকে চিংড়ি মাছ তুলে নেওয়া- ঠাম্মার সাথে প্রবল ঝগড়া এবং ভাব, প্রথমবার পাহাড় দেখার উত্তেজনা- পাহাড় থেকে নেমে ঠাম্মার ঘরের দেওয়াল জুড়ে পাহাড় রচনা। অনুভব করলাম, প্রথম কথা বলতে পারার আনন্দ- প্রথমবার খাট থেকে ডিগবাজি খেয়ে পড়ার যাতনা।
ঝুমার কথাগুলোই গুছিয়ে দিলাম কার্ডে। যথারীতি এবার সবার দিলখুশ। ছেপে এল হলদে সোনালী কার্ডে মিষ্টির জন্মদিনের আমন্ত্রণ পত্র। সাথে নির্দেশ- ভট্টাচার্য দিদিকে নিয়ে না গেলে মিলবে না প্রবেশাধিকার। ভট্টাচার্য দিদির এদিকে হেবি গোঁসা। আমি কোন ওর জন্মদিনে যাব? ও তো আসেনি? কি উদ্ভট লজিক মাইরি। অগত্যা দিতে হল কানমলা। সেজেগুজে গেলাম মা-মেয়েতে। ওদিক থেকে এলেন বর্মন সাহেব, অরুণ বাবু, রমেশ আর বিদ্যুৎ। সেজেগুজে পরী হয়ে ঘুরছিল মিষ্টি। দেখেই যথারীতি,“মিষ্টি খাবো” বলার সিথে সাথেই চকাস্।  আজ রীতিমত দরাজ দিল আমাদের মিষ্টি-
বনেদী বাড়ির হার্দিক অভ্যর্থনায় অভিভূত হয়ে, ম্যাজিক দেখে, পর্যায়ক্রমে তপসে মাছের জিভ পোড়ানো ফ্রাই, টক দই আর সর্ষে মাখোমাখো ঘটৎকচ মার্কা পার্শে, কলাপাতা মোড়া আঙুল পোড়ানো পাতুরী, সুগন্ধী পোলাও, মুর্গীর ঠ্যাং, ক্ষীরের মত পায়েস খেয়ে যখন উঠতে যাচ্ছি, পাতে পড়ল ইয়া বড় একখানি দরবেশ। আরেঃ এতো আমার ছোটবেলার দরবেশ- ফ্যাকাশে হলদে রঙের বোঁদের লাড্ডুর মাঝে একখানি কাজু, একটা দামড়া কিশমিশ, আর ইতি উতি লুকিয়ে থাকা খোয়া ক্ষীরের ডেলা। মনে পড়ে গেল, চাটুজ্জে বাড়ির সমস্ত শুভ কাজে বসত ভিয়েন, তৈরি হত এমনি দরবেশ। মনস্থ করে ফেললাম- এবার থেকে টিম চুঁচুড়ার সমস্ত খাবার প্রোগামের মিষ্টির কনট্র্যাক্ট ঝুমাকেই দেওয়া হবে। মিষ্টির মা যদি না মিষ্টি আনে, আনবে কেটা শুনি-

অনির ডাইরি, ১৩ই ফেব্রুয়ারি ২০২০


রক্তাক্ত আনন্দবাজারটা লাট খেয়ে পড়েছিল ডাইনিং টেবলের ওপর। তার উপরে দুইটি রক্তাভ গোলাকার চুলের ব্যাণ্ড। ঠকঠক করে ঢুকল তুত্তুরীর বাবার মেসেজ, সকালেও কচিঘাসের মত শ্যামল বরণ ছিল যাদের, তারাই আপাততঃ সুকন্যার উপহার দেওয়া জল রঙ মেখে, মেটে লাল। লাল রঙ মেখেছে তুত্তুরীর দুই হাত, গাল, গলা এবং জামা। শিয়ালদহ মেন লাইনের বিখ্যাত সিগন্যালিং এর কাজের দৌলতে, আটকে আছে তুত্তুরীর মা দুটি স্টেশনের মাঝে, দীর্ঘক্ষণ। বেশ কয়েকবার বেজে গেছে তুত্তুরীর ব্যগ্র তথা আর্ত কণ্ঠস্বর, “ব্যাণ্ড কিনে আনো মা।কালই লাগবে- ”
স্কুল থেকে চিড়িয়াখানায় নিয়ে যাবে, মেয়ের আমার খুশির সীমা নেই। আপদ স্কুলের ফরমাইশ, দুহাতে দুইটি লাল ব্যাণ্ড পরে যেতে হবে চিড়িয়াখানা। নতুবা, আবাসিক ভেবে খাঁচায় পুরে দেয় যদি-। কখন ফিরবে মা? হাঁ করে ঘড়ি দেখে তুত্তুরী। দৌড়ে চলা মিনিটের কাঁটা টেনে নিয়ে যায় ঘন্টার স্থূলাকৃতি কাঁটাকে- । তাও বাড়ি ফেরে না মা।
  ভারি হয়ে আসে মায়ের চোখের পাতা, মনের কোণে জমতে থাকে, দিনভর ছায়াযুদ্ধের ক্লেদ আর তিক্ততা।  আসেপাশে সকলেই চলেছে কাজে। রাতভর ডিউটি করবে এরা, তারপর ভোরের ট্রেন ধরে বাড়ি। বাড়ি ফিরে নিজের হাতে বড় গ্লাস ভর্তি চা আর দুটো বিস্কুট খেয়ে চড়াবে রান্না। কারো বর, খেয়ে কাজে বেরোবে। তো কারো ছেলে। রান্না শেষে, কাচতে বসবে জামাকাপড়। মধ্যাহ্নভোজের পর সামান্য জিরিয়ে নিয়েই শুরু করবে রাতের রান্না। বর-ছেলের খাবার গুছিয়ে, রাতের খাবার টিফিন বাক্সে ভরে কাজে বেরোবে আবার। এত ব্যস্ততার মধ্যে এই ট্রেন যাত্রাটুকুই এদের বিনোদন। কত যে খোশ গল্প করে এরা, সামনের আয়ামাসি যেমন শুনিয়েই চলেছে, প্রথম উড়োজাহাজে চড়ার অভিজ্ঞতা। হাঁ করে শুনছে, দুটো সিটে বসা আটজন মানুষ। শুনছে তুত্তুরীর মাও। যে বাড়িতে রাতের আয়ার কাজ করেন, তাদের সৌজন্যেই সম্প্রতি প্লেনে চড়েছেন- গিয়েছিলেন সুদর চেন্নাইয়ের লাগোয়া কোন সমুদ্র শহরে। সেখানকার পাঁচতারা হোটেলে কার যেন বিয়ে ছিল-। পাঁচতারা হোটেলের খাবার বিন্দুমাত্র মুখে রোচেনি ওণার। “ম্যা গো! কোন সোয়াদ নেই-। বিরিয়ানিতে নেই কোন খুশবু-। ” বিরিয়ানি ছেড়ে এবার সদলবলে ঢুকলেন উড়োজাহাজের শৌচাগারে। যাবার সময় ভয়ে ওপথ মাড়াননি। ফেরার সময় বমি করতে গিয়ে তো রীতিমত উচ্ছ্বসিত। মিথ্যা ভয় দেখিয়েছিল, বৌদি, পুঁচকে শৌচাগারে ঢুকলে যদি আটকে যায়-। তুত্তুরীর মা বলতে গেল,“ তুত্তুরী আর আমি দুজনে একসাথে ঢুকি তো, মা না গেলে জিন্সের ইয়ে-।” বলতে গিয়েও বলতে পারে না মা। আমি কত্ত বার প্লেনে চেপেছি- বলাটা অকারণ বড়লোকী দেখানো হয়ে যাবে না? এই দুঃসহ ভিড়ে একা হয়ে যাবে না তুত্তুরীর মা? আয়া দিদি ততোক্ষণে অবশ্য শৌচাগার থেকে মূত্রে উপনীত হয়েছেন। সাইন্স সিটি টপকে কোন নির্মীয়মান আবাসনের ভিতর যেন ঢুকেছিল দাদা। অন্ধকারে ঝোপের ঘাড়ে, যেই না- অমনি এসে হাজির এক অনামুখো ট্রাফিক পুলিশ। সটান ফাইন- ৫০০ট্যাকা। দাদা যত বলে, “ আমি তো ডায়বেটিস রুগী, আমি তো ওষুধ খাই। আমি তো চাপতে পারি না-”। পুলিশ তাও শোনে না। শেষে কড়কড়ে ৩০০টি হিসুর টাকা দিয়ে মুক্তি পেল দাদা। বাড়ি এসে দাদা সমানে বলে যাচ্ছে, “আমার হিস্যুর ট্যাকা, তোর হজম হবে?” আয়া দিদির চোখ ছলছলিয়ে উঠল, “তুই ট্যাফিক পুলিশ, তুই রাস্তা দেখ। তা না। কে কোথায় মুতছে, ঝোপে ঝাড়ে, তোর দেখার কি দরকার শুনি? ৩০০ ট্যাকায় দু পেলেট বিরিয়ানি হয়ে যায়- ।” কেউ বুঝি ফেলল দীর্ঘশ্বাস। এক রাতের রোজ ৩০০ টাকা পায় এরা- 
কোন স্টেশনে যেন থমকে দাঁড়াল ট্রেনটা, দুজন নামল তো ছয়জন উঠে পড়ল গোঁতাগুতি করে। এত ভিড়ের মধ্যেও একজনকে পথ ছেড় দিল বাকিরা। আহাঃ পোয়াতি না। ঢাউস উদর মহিলা জমিয়ে বসলেন জানলার ধারে। এতক্ষণ ঐ সিটটি ছিল সবৎসা এক মহিলার। তাঁর বাচ্ছাটির বয়স বড় জোর দুই-ইতিমধ্যে দুপ্যাকেট পাঁপড় ভাজা নষ্ট থুড়ি উদরস্থ  করেছেন তিনি। মা জানলা দিয়ে বাইরে তাকালেই, উঃ উঃ করে মায়ের মুখটা ঘুরিয়ে নিচ্ছিল নিজের দিকে। মা উঠে যাবার পর দিব্যি বসে আছে, স্ফীতোদরা রমণীর পাশে। দিব্যি গল্প ফেঁদেছেন যিনি সিট ছেড়েছেন, আর যিনি সিট দখল করেছেন দুজনে। এপাশ ওপাশ থেকে পড়ছে ফোড়ন। পোয়াতি মেয়েমানুষের কি করা উচিৎ- অনুচিৎ এই আলোচনার ফাঁকে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছে বাচ্ছাটা। একটা হাতে ঝুলছে দুই পায়ের ফাঁকে, অন্যটি রাখা আছে পার্শ্ববর্তিনীর স্ফীত উদরের ওপর। যাদের জাত-ধর্ম ছাড়ুন, ভাষাটাও আলাদা। অন্যমনস্ক ভাবে জানলা দিয়ে বাইরে তাকায় তুত্তুরীর মা-  কাল বুঝি ভালোবাসার দিন? ধীর গতিতে চলতে থাকা ট্রেনের জানলা দিয়ে ভয়ে ভয়ে ঢুকে আসে বসন্তগন্ধী হাওয়া। অন্য কি যেন গল্প জোড়ে আয়া মাসিরা- এইটুকই প্রাণখুলে বাঁচা। ট্রেন থেকে নামলেই তো আবার শুরু প্রাত্যহিক ইঁদুর দৌড়-

Thursday 6 February 2020

অনি এবং তুত্তুরীর ডাইরি, ৫ই ফেব্রুয়ারি, ২০২০


শেষ শীতের কামড় কি না জানি না, সামান্য জ্বরজ্বর  ভাব, কাতর হয়ে কিয়ৎক্ষণের জন্য বন্ধ করেছিলাম চোখের পাতা- আচমকা-“মা। মা। শিগ্গির ওঠো। ” তুত্তুরীর আর্ত স্বরে ঘুম পালাল জানলা দিয়ে- কি হল? ধড়মড় করে উঠে বসছি, তুত্তুরী বলল,“ সব্বনাশ হয়েছে মা। গিজার বার্স্ট করেছে-”। অ্যাঁ? গিজার বার্স্ট করল কি করে? পড়িমরি করে বাথরুমের দিকে যেতে গিয়ে খেয়াল হল, আমার কন্যার ওষ্ঠাধর প্রগাঢ় তথা ঝিকিমিকি বেগুনী। ঐ একই রঙ শোভা পাচ্ছে তুত্তুরীর নাকে, গালে, দুই হাতে তথা জামায়। এতক্ষণে অনুধাবন করলাম, ঘুমের ঘোরে শুনতে ভুল করেছি। তুত্তুরী বলেছে বা বলতে চেয়েছে, তা হল- গ্লিটার পেনটা বার্স্ট করেছে। বেচারা গ্লিটার পেনের আর দোষ কি, তাকে খুলে তার রিফিলের পিছন দিকটা যদি মুখে ঢোকানো হয়-

টুকটুকে পার্পল রঙা ছোট্ট জিভটা আর অপরাধী আঁখিদ্বয় যেন টাইম মেশিন, চোখের সামনে ভেসে উঠল এমনি এক অলস দ্বিপ্রহর। বাবা- মা অফিসে, মস্ত বড় বাড়িটা যেন খাঁ খাঁ করছে। উত্তরপশ্চিমের ঘরের চারটে জানলা দিয়ে ছুটে আসছে রোদ আর হাওয়া। খুলে রাখা জানলার কাঠ পাল্লায় বসে,গম্ভীর গলায় ডাকছে কাক-কদাচিৎ এসে বসছে পায়রা আর ঘুঘু। একলা একটা মেয়ে কেবলই ঘুরপাক খাচ্ছে ঠাকুমার বিয়ের সাবেকী কারুকাজ করা খাটটাকে ঘিরে। দেওয়াল ঘেঁষে রাখা দেরাজের ওপর বসানো বাবার ঠাকুরদার আমলের নীলরঙা দেওয়াল গিরি। যার তলার পাত্র তথা পলতের কলটা ব্রোঞ্জের। দুটো পলতে।  চিমনিটাও কেমন চ্যাপ্টা। লোডশেডিং হলে বুড়ো দেওয়ালগিরি একাই একশ। কান ধরে পড়তে বসায় মা-। ব্রোঞ্জের নক্সী বাটির ওপর পলকাটা কাঁচের পাত্রের ভিতর টলটলে কেরোসিন। নিজের অজান্তে কখন যে পলতে ধরে টানাটানি করতে শুরু করেছিল মেয়েটা। যখন খেয়াল হল- দেখা গেল দুদুটি পলতেই তলার কেরোসিন তেলের পাত্রে সাঁতার কাটার বৃথা চেষ্টা করে টুপ করে ডুবে গেল। অতঃপর? অফিস ফেরৎ মায়ের স্কেল পেটা? দৌড়ল মেয়েটা- বিশাল দালান টপকে, একুশ খানা সিঁড়ি দিয়ে তরতর করে নেমে, একতলার দালানকে আড়াআড়ি পার হয়ে, কালো ঠাকুরঘরের রোয়াকের বুক বরাবর ছুট্টে উঠোনের ওপাড়ে সাবেকী রান্নাঘর।ঘড়িতে বেলা বারোটা বাজল বুঝি, সবে জলখাবার খেতে বসেছেন বৃদ্ধা ঠাকুমা। জলখাবার বলতে যৎসামান্য এক-দুখানি হাতে গড়া রুটি, খানিকটা  ট্যালট্যালে গরম ডাল আর চিনি। কখনও বা ডালও হত না, নিছক চিনি-জল দিয়েই রুটি খেতেন চাটুজ্জে বাড়ির দোর্দণ্ডপ্রতাপ গিন্নী। মেয়েটা গিয়ে কেঁদে পড়ল- ঠাকুমা বাঁচাও। ঠাকুমার নির্দেশে, জলখাবার না খেয়েই দৌড়ে এল মেজো পিসি। বাবাদের দিদি। ভাইপো-ভাইঝিরাও বলে দিদি। কি দস্যি মেয়ে বাবা- বলতে বলতে, কাঁচ খুলে পরিয়ে দিল পলতে। মুছেও দিল কাঁচটা। যাবার সময়ে বলে গেল-“চুপ করে ঘুমিয়ে পড়ো।” ঘুম? ঘুম তো আসে না। বালিশে মাথা দিয়ে  ঢিমে তালে ঘোরা সাবেকী ডিসি পাখার দিকে তাকিয়ে খানিক নিজের মনেই রাজারাণীর গল্প বলে মেয়েটা। খানিকভাব জমানোর চেষ্টা করে, জং ধরা কড়ি বরগার ফাঁক গলে ছোটাছুটি করা চড়াইদের সাথে।এমনকি পায়রা ধরার লোভে উঁকি মারা জেঠুর পোষা বেড়ালের সাথেও- পাত্তা পায় না মেয়েটা।  বড় ব্যস্ত সবাই।  ব-ড় বে-শীইইই ব্যস্ত। তারপর?

“ঠাকুমা।লাল ওষুধ আছে?” ঘড়িতে বোধহয় আড়াইটে-তিনটে। সদ্যস্নাতা ঠাকুমা,উঠোনের তারে মেলছিল সাদা শাড়ি। ও পাশের রোয়াকে ফ্যান গালছিল পিসি, ভাতের ডেকচি ফেলে দৌড়ে এল- লালে লাল মেয়েটার মুখ, সাদা টেপ ফ্রক। দুহাত দিয়ে টপটপ করে ঝরছে রক্ত। হাঁউমাউ করে উঠল বৃদ্ধা, “কি সর্বনাশা কাণ্ড রে। তোর বাপ-মা যে আমাদের ভরসায় রেখে গিয়েছিল-কি জবাব দেবো তাদের?” ঘাবড়ে গিয়ে মেয়েটা কিছুক্ষণ বাকহারা। তারপর, বাড়িয়ে দিল একটা খালি  লাল ওষুধের শিশি। নতুন কেনা লাল ওষুধ, রাখা ছিল দেওয়াল আলমারিতে। হাত দিয়ে কর্কটা না খুলতে পেরে লাগিয়েছিল দাঁত- পরিণামে-- এখন শুধু একটু লাল ওষুধ যদি জোগাড় করে দেয় ঠাকুমা, বাকিটা জল ভরে আবার সাজিয়ে রাখবে আলমারিতে। বাবা বুঝতেও পারবে না-

বেগুনী জিভ বার করে বোদাকালী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে তুত্তুরী, আর তার মা না জানি অতীতের কোন গলিতে হারিয়ে হেসেই চলেছে। যা ব্যাটা- আজকের মত মাপ করে দিলাম তোকে। তোর মধ্যে দিয়েই তো ফিরে পাই হারিয়ে যাওয়া শৈশব। আর সেই মানুষটাকে,না জানি কোথায় হারিয়ে গেছে যে। আকাশের কোন তারাটায় তার বর্তমান বসবাস কে জানে?

Monday 3 February 2020

তুত্তুরী উবাচ- ৩রা ফেব্রুয়ারি, ২০২০


- “মা, এ দেখো।” জুতো খোলার আগেই সোল্লাসে বলল, তুত্তুরী। মুখেচোখে সহস্র ওয়াটের উজ্জ্বলতা।
কি দেখব? হাতে এক টুকরো, ছেঁড়া গোল কাগজ। তাতে পেন্সিল দিয়ে হিজিবিজি  কাটা। তুত্তুরী জানালো, ওটা “ক্লাব অর্ঘ্য”র সদস্য হবার অঙ্গীকার।ক্লাব অর্ঘ্যটা কি বস্তু? বুঝলাম না। বোধহয় মুখে চোখে ফুটে উঠেছিল অজ্ঞতা। তুত্তুরী জ্ঞান দেবার ভঙ্গীমায় হাত নেড়ে চোখ ঘুরিয়ে বলল, “অর্ঘ্য একটা ক্লাব খুলেছে। আমি তার সদস্য-”। তা ভালো।
জুতো খুলে, ব্যাগ রাখতে না রাখতেই, শুরু পরের পর্ব। “ মা, তুমি লেবু খাওনি? তোমার ব্যাগে চারটে লেবু আর একটা আপেল রয়েছে। ” বোঝালাম, লেবুটা ট্রেনে কেনা। আপেলটা- ইয়ে মানে,খাবার টাইম পাইনি। বিনতি করলাম, বাপকে যেন না বলে। তিনি পারলে এই বুড়ো বয়সে, কান ধরে ডনবৈঠক দেওয়ান আর কি-
হাত নেড়ে, এক চোখ বুজতে গিয়ে দুই চোখ পিটপিট করে, তুত্তুরী জানাল, বলবে না। বিনিময়ে শুনতে হবে সারাদিনের গপ্প। “মা জানো তো, যত এমব্যারাসিং ব্যাপার স্কুলেই ঘটে। আজ আমার পেট এত গোঁ গোঁ করছিল,যে সামনে-পিছনের বেঞ্চ থেকে বন্ধুরা বলল, ‘হাস্। কোয়ায়েট।’  বললাম, “নট মি। মাই টামি-”।” হাসব না কাঁদব বুঝতে পারলাম না। তুত্তুরী ততোক্ষণে অটোপাইলট মোডে, বকেই চলেছে,“অদ্রিজা দাস,বলল, ‘ডিডন্ট ইউ হ্যাভ ব্রেকফাস্ট?’” এটা অবশ্য আমারও মনে হয়েছিল। প্রাতঃরাশ ছাড়ুন। ও তো ভাত খেয়ে ইস্কুলে যায়। টিফিনে মনপসন্দ চিজ টোস্ট। তাও বেশী করে দেওয়া হয়, বন্ধুদের সাথে যাতে ভাগ করে খেতে পারে। তা সত্ত্বেও পেট গোঁ গোঁ করে কেন? জবাব পেলাম, টিফিন টাইমে,হাত ধুতে যাবার সময়, একটি টোস্ট কেউ সাবড়ে দিয়েছে। এতো নৈমিত্তিক ব্যাপার। রোজই তুত্তুরীর টিফিন কেউ সাবড়ে দেয়-। ঐ বয়সে আমারও দিত। তবে মজার কথা, আজ যিনি সাবড়েছেন, তিনি অপরাধ বোধে ভুগে, শেষ বেলায়, ঐ চোতা কাগজটি তুত্তুরীকে গছিয়েছেন। চীজ টোস্টের বিনিময়ে ক্লাব মেম্বারশিপ। মন্দ হয়। উপরি পাওনা প্রতিশ্রুতি, তার মা অচীরেই মটন চাউমিন করে দেবেন টিফিনে,তার ভাগ পাবে তুত্তুরী। কে জানে, চীজ টোস্টের দুঃখে না মটন চাউমিনের লোভে গোঁ গোঁ করে পেট-
মুখহাত ধুয়ে, চা নিয়ে বসেছি, উল্টো দিকে গুছিয়ে বসে পরের,পরের পর্ব শুরু করল তুত্তুরী। “মা জানো, সানরাইজ না সর্ষে, পোস্ত পাউডার বার করেছে-”। বিশেষ পাত্তা পেল না, দেখে আরও উৎসাহ নিয়ে শুরু  হল,“ ইমামি হেলদি এন্ট টেস্টিও বার করেছে মা। পাশের ফ্ল্যাটের ঠাম্মার রান্নাঘরে-”। এতক্ষণে চমক ভাঙল মায়ের, প্রায় বিষম খেতে খেতে জানতে চাইলাম, পাশের ফ্ল্যাটের রান্নাঘর দেখল কি করে। প্রশ্ন করার অবশ্য দরকার ছিল না, তুত্তুরী বলেই চলেছে,“ওদের রান্নাঘরে কি বিশাল একটা চিমনি লাগিয়েছে। হ্যাঁ গো মা। আমি দেখেছি। সেদিন ওদের ফ্ল্যাটে যখন রঙ হচ্ছিল,স্কুল থেকে ফেরার সময়,  আমি ওদের গ্রীলের গেটের বাইরে থেকে দেখছিলাম। ও বাড়ির ঠাম্মাটা খুব ভালো। উনিই তো ডেকে নিয়েগেলেন। সব ঘর-রান্নাঘর ঘুরিয়ে দেখালেন-। জানো ওদের বাড়ির ভাইটার সবে দুমাস বয়স, ঠাম্মা বলছিল।  আমি শুনে বললাম-এ হে হে,তোমরা এখনই ফ্ল্যাট রঙ করে নিলে? আমি তো এত্ত বড়। তাও আমি দেওয়ালে ছবি আঁকি। দেওয়াল নষ্ট করি-”।  এতদিনে বুঝলাম,কেন পাশের ফ্ল্যাটের কাকিমা দেখা হলেই তুত্তুরীর তত্ত্বতলাশ করেন। দেওয়াল রঙ করা নিয়ে মা নতুন করে কিছু বলছে না দেখে, তুত্তুরীর বোধহয় সাহস বেড়ে গেল,“মা একটা সত্যি কথা বলব? তুমি জানো আমি কি কি দিয়ে দেওয়ালে এঁকেছি আজ অবধি?” শুনে কি অষ্টাবক্র লাভ হবে জানি না, তবে কান তো বন্ধ করা যায় না। “আমি প্রথমে আঁকতাম পেন্সিল দিয়ে, তারপর চামচ দিয়ে। তারপর তোমার পুজোর ধূপ দিয়ে। স্কেচপেন দিয়ে, ফেব্রিক কালার দিয়ে, তারপর গ্লিটার পেন দিয়ে-পার্মানেন্ট মার্কার দিয়ে- ”। আর কি যে শুনতে বাকি রইল- হে ধরিত্রী দ্বিধা হও মা।