Friday 29 January 2021

মেলার ডাইরি ২০২১

 মেলার ডাইরি, ১৫ই জানুয়ারী, ২০২১

পর্ব ৯ক


জনৈকা আত্মীয়া একবার বলেছিলেন,‘তোর চাকরীটা বেশ ভালো। খালি সাজুগুজু আর ছবি তোলা“।  


১২ই জানুয়ারী বেলা দুটো- স্যারকে মেসেজ করতে গিয়েও বুঝতে পারলাম না কি লিখি। এমন জটিল পরিস্থিতিতে বাপের জন্মে পড়িনি। প্রতিবছরই মেলার আগের দিন গোলমাল বাঁধে। গত বছর যেমন গেটের সামনে লাগানো শোলার হাতি নিয়ে চূড়ান্ত রাজনৈতিক নোংরামো করেছিল এক স্থানীয় ব্যক্তি। একটা মাতাল আর পলকে জমে যাওয়া ভিড়ের সামনে ভয়ে জড়সড় আমার টিমের ছবি দীর্ঘদিন দুঃস্বপ্ন দেখেছি আমি। পেঁচো মস্তানের সাথে মস্তানি করে তাকে পুলিশের জিপে তোলাটা আজ অবধি নিজের বিশের বছরের অন্যতম কৃতিত্ব বলে মনে করি। তবে সেটা তো বিগত বছরের কথা। এ বারের সমস্যা যে তার থেকে শতগুণ জটিল। 


১২ই জানুয়ারী বেলা ২টো দশ-স্যারের ফোনটা বেজে গেল। ওণার অনুমতি ছাড়াই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। যুযুধান দুপক্ষের একজনকে পত্রপাঠ বাড়ি পাঠাব বলে ঠিক করলাম। আমরা যতই নিজেদের অপরিহার্য বলে মনে করি না কেন- আদতে সবাইকে ছাড়াই সব হতে পারে। যেমন আমার অন্যতম নির্ভরশীল ইন্সপেক্টর নির্মলকে ছাড়াই এবছর মেলা করার দিকে এগোচ্ছি আমরা। নিরূপায়। সদ্য প্রিয়জন হারানো নির্মল আপাততঃ কাছা পরেই অসুস্থ মাকে নিয়ে বসে আছে কলকাতার এক নামী হাসপাতালে।


বেলা তিনটে- সমস্যাটা কোন মতে মেটানো গেল। আমি কঠোর পদক্ষেপ নেবারই পক্ষপাতী ছিলাম। বর্মন সাহেব মিটমাট করার পক্ষে। শেষ পর্যন্ত রণং দেহির ওপর বিজয় প্রাপ্ত হলেন শান্তিরূপিনী। এখনও বাকি প্রচুর কাজ। সবাই ফিরে এসো মেলা মোডে। 

শ্যামল মুড়ি কই? 


বেলা সাড়ে তিনটে- এখনও অর্ধসমাপ্ত স্টেজ। মাঠে টানা হয়নি ছাউনি। লাগেনি কোন আলো। সমীর দৌড়ে এল, মাঠের বাইরে পোস্টার মেরেছে ওরা। মুড়ি খাওয়া হাতেই রাস্তায় গিয়ে দাঁড়ালাম সবাই। মাঠের উল্টো দিকের বাড়ির দেওয়ালে হাতে লেখা মেলা তথা সরকার বিরোধী না না শ্লোগান। যার কিছুকিছু বেশ আক্রমণাত্মক। শুধু তাই নয়, মাঠের সামনের রাজপথ বরাবর যতদূর নজর যায়- দুপাশের ল্যাম্পপোস্টে কারা যেন রাতারাতি লাগিয়ে গেছে বিশেষ রাজনৈতিক দলের ঝাণ্ডা। গণ্ডগোলের পূর্বাভাষ ছিলই। এসপি থেকে জেলা প্রশাসন হয়ে থানা সবজায়গায় চিঠি করে যথোপযুক্ত  ফোর্স পাঠানোর অনুরোধ করেই রেখেছি। গোপন সূত্র থেকে মুহূর্তে মুহূর্তে খবর আসছে, আজ ওণাদের মিটিং চলছে। আমাদের চন্দ্রাকেও ডেকেছিল ঐ মিটিং এ। মেলা থেকে বিশ মিনিট দূরত্বে জমায়েত হবে ওণাদের। সেখান থেকে ট্যাবলো এবং মিছিল নিয়ে এসে হাজির হবে আমাদের মেলায়। ইতিপূর্বে যথেষ্ট দুর্ঘটনা ঘটে গেছে অন্যান্য জেলায়। প্রচারিত হয়েছে কুৎসামূলক খবর। আর সর্বক্ষেত্রে আসামীর কাঠগোড়ায় দাঁড় করানো হয়েছে বেচারা আধিকারিককে। 


বেলা চারটে- নির্মলই সাধারণতঃ থানার সাথে কথা বলে, সে এখনও এসে পৌঁছায়নি কলকাতা থেকে।  নির্মল এলে সাথে চঞ্চল বা কৌশিককে থানায় পাঠানো হবে। আপাততঃ আরেকবার ঝালিয়েনি নিজেদের প্ল্যান। সামনের গেটে থাকবে দুজন জাঁদরেল মহিলা। বলাগড়ের প্রীতি শীল আর বাঁশবেড়িয়ার মহুয়া নাথ। শ্যামল আপত্তি করে, ‘মেয়েরা শুধু পারবে না। আমরা কজনও থাকি। ’ একসাথে মুখ ঝামটা দি আমরা। আমরাই পারি। ইন্সপেক্টর মৃণালের রিশেপসন টিম থাকবে প্রীতি দি আর মহুয়াদির পিছনে। দূরদূরান্ত থেকে আমাদের যে এসএলও বা কালেক্টিং এজেন্টরা লোক নিয়ে আসবেন, তাঁদের গেটের পাশে দাঁড় করিয়ে, এক একজন করে স্যানিটাইজার গেটের ভিতর দিয়ে ভিতরে ঢুকবে। মাস্ক পরা বাধ্যতামূলক। মাস্ক পরে না এলে মাস্ক সরবরাহ করব আমরাই। সার্জিক্যাল মাস্কের বাণ্ডিল রাখা থাকবে মহুয়াদির কাছে। স্লোগান হবে, ‘মাস্ক পরুন, মেলা দেখুন’। 


আর যদি স্থানীয় মানুষ মেলা দেখতে আসেন। তাঁরা অবশ্যই স্বাগত। তাদের ছাড়পত্র দেবে বাঁশবেরিয়ার মহুয়াদি। অচেনা কেউ না। আর হ্যাঁ একবার ঢুকে পড়লে, উদ্বোধন শেষ না হওয়া পর্যন্ত বেরোতে দেওয়া হবে না। বাহির গেটে ডিউটি দেবে বাঁশবেড়িয়ারই নূপুরদি আর তরুণী মধুমিতা। 


যদি এদের চোখে ধুলো দিয়ে কোন বিক্ষোভকারী ঢুকেও পড়েন, তাঁকে সামলাবে মাঠ কমিটি। মাঠ কমিটির মাথায় থাকবে আমাদের ইন্সরেক্টর দর্প। আর তার সাথে থাকবে প্রদীপ, সমীর, প্রিয়াঙ্কা, শান্তনু আর আশিস। দূরত্ববিধি মেনে পাতা চেয়ারগুলির ফাঁক দিয়ে সমানে পায়চারি করবে এরা। যদি দেখা যায় কেউ ব্যাগ থেকে কোন ফেস্টুন বার করছে, তাকে বুঝিয়ে শান্ত করার দায়িত্ব এদের। 

এত উৎসাহী এই ছেলেমেয়েগুলো যে এদের সামলানো বেশ চাপ। বিশেষতঃ প্রিয়াঙ্কা তো একাই লড়তে চায় বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে। এ মেয়েকে সামলাতে আরও গুটি কতক মেয়েকে বলা হল, ওকে সামলে রেখো বাপ।   


বিকেল পাঁচটা- নির্মল এসে পৌঁছালো। ওর মাকে কালই ভর্তি করতে হবে  হাসপাতালে। এবারে আর নির্মল মেলা হবে না আমাদের। থাকতে পারবে না মেলার মূখ্য উদ্যোক্তা শ্রী নির্মল কুমার শেঠ। বাকি দুই ইন্সপেক্টর চঞ্চল আর কৌশিক আশ্বাস দিল, ‘আমরা সামলে নেবো ম্যাডাম’। বেশ। 


রাত পৌনে আটটা- থানা থেকে ফোন করল চঞ্চল। 'দুটো মেল আইডি পাঠাচ্ছি ম্যাডাম। বড় বাবু বলছেন একটা চিঠি করতে হবে। তবে ফোর্স চাইবেন ওণারা।’ সে আবার কি? এত রাতে আমি গাড়ি থেকে কি করে চিঠি করব? মেমো নম্বর পাব কোথা থেকে? আর এত যে চিঠি করলাম? সেগুলো কি অর্থহীন? অসহায় গলায় জবাব এল, 'সেই সব চিঠি এখনও ওণাদের কাছে নামেনি।'

অনির মেলার ডাইরি ১৫ই জানুয়ারী, ২০২১

পর্ব-৯ খ

https://m.facebook.com/story.php?story_fbid=10222728040936852&id=1449214651  এর পর 


১২ই জানুয়ারী রাত আটটা- স্যারকে ফোন করলাম। মিটিং সেরে ফুলের লোক আর ফুল গাড়িতে তুলে মাঠে যাচ্ছেন স্যার। উনি আসছেন বলেই বাড়ির দিকে রওণা দিয়েছি আমি। ঠিক বাড়ি নয়। মেলার আগের রাতে হেয়ার স্পা করানোটা আমার বার্ষিক রিচুয়্যাল বলতে পারেন। একটা তুক থাকে না সকলেরই। 

স্যার আশ্বস্ত করলেন, ‘তুমি যাও। দরকার হলে মাঠে পৌঁছে হাতে চিঠি করে দেবো আমি। ’ এত চিঠি, ধাপে ধাপে ধাপে চিঠি করার পরও কেন চিঠি করব আমরা? ফোন করলাম অতিরিক্ত জেলা শাসক, সাধারণ মহাশয়কে। উনি স্বয়ং ফরোয়ার্ডিং চিঠি সমেত আমার চিঠিটি পাঠিয়েছিলেন পুলিশের কাছে। তার আর পর থাকতে পারে নাকি? 

সব শুনে জানালেন, ‘তুমি সিম্পলি আমার চিঠিটার একটা হার্ড কপি থানায় পাঠিয়ে কি ফিড ব্যাক পাও আমায় জানাও।’


রাত সাড়ে আটটা-  মাঠে প্রিন্টার কোথায়? চিঠিটা থানার মেলে আর নির্মলকে হোয়াটস্অ্যাপে পাঠালাম। সামাজিক মুক্তি কার্ড আর পিপিও প্রিন্ট ল্যামিনেট করাতে গেছে রমেশ। তাকেই বলা হল, ওটার একটা প্রিন্ট এনে দে বাবা। শুনলাম সময় লাগবে। সব প্রিন্ট নিয়ে চুঁচুড়া থেকে বাঁশবেড়িয়া আসতেও লাগবে অন্তত আধঘন্টা। রাস্তা ভয়ানক খারাপ। আচ্ছা সামলে আয়। 


রাত সাড়ে নটা- রমেশের ফোন বন্ধ। বুঝলাম চার্জ শেষ। গোপন সূত্রে কিছু খবর পেলাম। সংবাদ প্রদানকারী আশ্বাস দিলেন, ‘মেলা বয়কট করবেন বটে,বানচাল করবেন না ওণারা। বিক্ষোভ দেখাবেনই। ’ বললাম দেখুন বিক্ষোভ দেখানো আপনাদের অধিকার। তাতে হস্তক্ষেপ করতে চাই না। তবে চার বছর এই জেলায় কাটিয়ে দেওয়ার পরও যদি ‘শ্রমিকবিহীন শ্রমিকমেলায় চলছে বিরিয়ানি উৎসব’ বা ‘সরকারী মেলায় চলছে চটুল অশ্লীল নাচগান’ মার্কা খবর পড়তে হয়, তার থেকে বেদনাদায়ক কিছু হতে পারে না। 


রাত দশটা- থানা থেকে ফোন করল চঞ্চল,‘ম্যাডাম আপনাকে খবরটা কে দিয়েছে? এণাদের কাছে কিন্তু খবর আছে বিরাট গণ্ডগোল হবে। সারাদিনের উত্তেজনা আর ক্লান্তি ঘুম হয়ে নেমে আসে ফোনের এপ্রান্তে। সোর্স কেউ জানায়? আমার যা করার আমি করেছি। এরপর যদি কিছু হয়, হবে। তুমি ফিরে এসো। কাল ভোর থেকে প্রচুর চাপ।  


রাত এগারোটা- মাঠ থেকে ফোন করল ডেকরেটর। ম্যাডাম গুটি তিন চ্যাঙড়া ছেলে এসে হুমকি দিচ্ছে কাল সব ভাঙচুর করবে। ক্লান্তি জড়ানো গলায় জানালাম, করুক। যার যা প্রাণ চায় করুক। শুধু যখন ভাঙচুর করতে আসবে, আপনি আপনার মূল্যবান জিনিসগুলি সরিয়ে রাখবেন। 


১৩ই জানুয়ারী ভোর ছটা- অ্যালার্মটাকে ঘুম জড়ানো হাতে বন্ধ করে জড়িয়ে ধরলাম ঘুমন্ত বরকে। আমি বেশ যাব না আজ। যার যা খুশি মারামারি  করে নিক। আধঘুমন্ত আলিঙ্গন সহ, ফিসফিস করে ভেসে এল সোহাগী বাণী,‘ সেই ভালো যাস না। বড় সাহেব আছেন তো। আর বর্মনও আছে।’


সকাল পৌনে আটটা- সাড়ে সাতটায় বেরোব ভেবেও দেরী হয়ে গেল। বের হবার আগে শৌভিককে দিয়ে একটা ছবি তোলানোটাও তুক বলে মনে করি আমি। কাজের সময় এমন বেয়াড়া আব্দারে ভয়ানক বিরক্ত হয় শৌভিক। তাকে পটাতে গিয়েই দেরী আর কি। 

 জলদি চালান সুবীরবাবু। এইসব দিনগুলোতে ভীষণ মৃত্যুচিন্তা নিয়ে খেলা করতে মন চায় আমার। কি হয়,যদি আজ রাস্তায় উল্টে যায় গাড়ি? ওরা অপেক্ষা করবে আমার জন্য। ফোন করবে বারে বারে। তারপর সামলে নেবে ধীরে ধীরে। টেনশন চেপেও চালিয়ে যাবে নিজ- নিজ দায়িত্ব। ঐ যে শেক্সপিয়র সাহেব বলে গেছেন না, কুশীলব বদলে গেলেও-‘দা শো মাস্ট গো অন’। দেখা যাক আজ কি শো থাকে কপালে- 

(চলবে)

অনির ডাইরি জানুয়ারী, ২০২১

 অনির ডাইরি ২৭শে জানুয়ারী, ২০২১


ঘোরতর আপিস টাইমে ফোন করেন তিনি,‘মা আমি একটা অপাট করেছি’। বিগত দশ বছরের অভিজ্ঞতা যাবতীয় অপাট সম্পর্কে মোরে করেছে অনেকটাই সহিষ্ণু। আজকাল আর আঁতকে উঠি না। কেজো গলায় জানতে চাই, কি ঘটিয়েছেন শ্রীমতী অঘটনঘটনপটিয়সী? উত্তর আসে, বাড়িতে পরার হাওয়াই চপ্পলখানি দেহ রেখেছেন। এতদিন কেন যে রাখেননি, তা পরমেশ্বরই জানেন। সারাদিন মোটামুটি খালি পায়েই তো ঘোরে তুত্তুরী। পায়ের তলায় মাখা থাকে দুনিয়ার কালিঝুলি। আর চপ্পল জোড়া বিমর্ষ হৃদয়ে পড়ে থাকে কখনও খাটের কোণায় তো কখনও খাবার টেবিলের নীচে। 


আজ তাঁরা দেহ রাখায় বড়ই বিমর্ষ কন্যা আমার, বারংবার আশ্বস্ত করে, ‘একটা ফেভিকুইক কিনে এনো তো। জোড়া যাবে মনে হয়। ’ দাঁত থাকতে যেমন বোঝা যায় না দাঁতের মর্ম, তেমনি হয়তো চপ্পল থাকতেও কেউ কেউ বোঝেন না-। তাঁরা মারা গেলে হঠাৎ বড় দীন, বড় শীতকাতুরে হয়ে ওঠেন কেউ কেউ। আপন মনে করুণ সুরে বিড়বিড় করে তুত্তুরী, ‘দাদু(মাতামহ) থাকলে ঠিক জুড়ে দিত।’ হয়তো দিতো। এসব ব্যাপারে দাদু সাক্ষাৎ বিশ্বকর্মা। যুগটাই যে অমন ছিল। প্রাচুর্য শব্দটাই বোধহয় ছিল সবথেকে দুষ্প্রাপ্য।   


তুত্তুরী জন্মের পর শ্বশুরমশাই একবার বলেছিলেন, ‘যা চাইবে সঙ্গে সঙ্গে দিও না। অভাববোধ যেন তৈরী হয়। ’ যিনি এই অমূল্য জ্ঞান দিয়েছিলেন, তুত্তুরী তাঁর প্রাণ। তিনি নিজে এই জ্ঞান ভুলে গেছেন কবেই। তবে তিনি না মানতে পারলেও, আমি থুড়ি আমরা দোঁহে মেনে চলি। থাক না একটু অভাব। তৈরী হোক না সামান্যতম মূল্যবোধ। 


 বাবামায়ের পেশাদারী ব্যস্ততার ফাঁকে মায়ের চপ্পল জোড়াই দখল করে তুত্তুরী। মাত্র কয়েক মুহূর্তের জন্য, তারপরই ফেরৎ দিয়ে যায়, আহাঃ মায়ের পায়ে ঠাণ্ডা লাগবে কি না। ছেঁড়া চপ্পল পরেই বাড়িময় ঘুরতে থাকেন তিনি, কর্মব্যস্ত মাকে অফিস বেরোনোর সময় আশ্বস্ত করেন তিনি,‘ মা এটা তো দিব্যি পরা যাচ্ছে। তোমায় চিন্তা করতে হবে না।’ কড়া আধিকারিক, বিস্তর (অ)জ্ঞানবতী মায়ের চোখের কোণা কেন যে ভিজে ওঠে অকারণে- 


শ্রীরামপুর শ্রমিকমেলার দপ্তরী দায়িত্ব সেরে, তড়িঘড়ি চপ্পলের দোকান খোঁজে মা। বাড়ি ফিরলেই প্রশ্ন করেন তিনি, ‘কি এনেছো মা?’ কোন মিটিং এর ঠাণ্ডা টিফিন প্যাকেটই হোক বা কোন উৎসবের শুঁটকে মার্কা স্টিক বুকে বা ছাপোষা আপদ উত্তরীয়, যেগুলি না পারা যায় বয়ে আনতে না পারি ফেরৎ দিতে, সব ঝেঁটিয়ে বাড়ি আনি আমি। তিনি খুশি হন যে।  আজ অবশ্য যথারীতি ফেলে এসেছি শ্রীরামপুর শ্রমিকমেলার উত্তরীয়টা। বৈদ্যবাটির ইন্সপেক্টর দেবারতির ইন্সপেক্টরগিরির হাতেখড়ি আমাদের চুঁচুড়ায়। আজ আর তার ওপর আমাদের কোন দপ্তরী অধিকার নেই বটে, তবে দপ্তরীয় সম্পর্কের বাইরেও রয়ে গেছে বেশ খানিকটা উষ্ণতা। শ্রীরামপুরের কোন অনুষ্ঠানে গেলেই আমি দেবারতিকে খুঁজি, আর ও আমায়। দেবারতিই পরিয়ে দিয়েছিল সাধ করে। দিব্যি গলায় পরে বসেও ছিলাম, শান্তশিষ্ট নক্ষ্মী অতিথি হিসেবে। তারপর যা হয় আর কি। কখন যে পাট করে পাশে রেখেছি আর মনে নেই।  


যথারীতি, মায়ের জলদি বাড়ি ফেরা তথা নতুন চপ্পল জোড়া উপহার পাওয়ার পরও তাঁর দুঃখ হল ফেলে আসা নীল সাদা উত্তরীয় খানার জন্য। অন্তত একটা নীলসাদা ওড়ণাও যদি মায়ের থাকত, গলায় পরে মান্যগণ্য অতিথি হয়ে ঘুরতেন তিনি। ধুত্তেরি! 

অতিথিবরণের ঝকমকে সোনালী জরি দেওয়া ব্যাজটা অবশ্য দিব্য পছন্দ হল তাঁর। যতো ঝকমকে ততো বেশী পছন্দ, বেশ বুঝলাম রাতে ঘুমাতে যাবার আগে ঐ ব্যাজটি খুলছেন না মাননীয় অতিথি। ব্যাজ পরিয়ে, হাতে পিটুনিয়ার টব ধরিয়ে বরণ করার পর মাননীয় অতিথির সাথে তুলতে হল খানকতক ছবিও। এবার মাননীয় অতিথির ভাষণ দেবার পালা- তবে সে তো অবশ্যি অন্য গল্প। এইভাবেই গড়াক না জীবন, অলসছন্দ প্রতি মুহূর্তে তৈরী করুক না নতুন নতুন গপ্প। ছড়িয়ে পড়ুক ভালোলাগা আর ভালোবাসার রঙ জীবনের প্রতিটি পল থেকে অনুপলে। দর্পনে নিজের প্রতিচ্ছবির মুখোমুখি হয়ে যাতে বলতে পারি,‘ এই বেশ ভালো আছি।’

অনির ডাইরি ২১শে জানুয়ারী, ২০২১


বেলা এগারোটার অ্যালার্ম বাজার সাথে সাথেই দিতে হয় হাজিরা। এগারোটা দশে আসবে লিঙ্ক। সেই লিঙ্ক পাঠাতে হবে অন্য একটা নম্বরে। বাড়িতে ল্যাপটপ খুলে বসে থাকবে একজন। তার নিজের তো ফোন নেই। মাসির ফোনে যায় লিঙ্ক। সেই লিঙ্ক দেখে নিজেই খোলে গুগল মিট। বসায় কোড। তারপর বসে ক্লাস করতে। এই ভাবেই গড়ায় দিন। 

প্রতিটা দিনই নিজের সাথে বয়ে আনে নানা জটিলতা। কোনদিন আচমকা কিবোর্ডে হাত পড়ে গিয়ে উড়ে যায় দরকারী ফাইলপত্র। পাগলের মত তলাশ করে সে। মায়ের আপিসের ল্যাপটপ। মায়ের দরকারী ফাইলপত্র। হারিয়ে গেলে কি হবে? মা যে পড়ে যাবে ভয়ানক বিপদে। হাউহাউ করে কাঁদতে কাঁদতে ফোন করে সে। মা ব্যস্ত জরুরী মিটিং এ। কেজো সুরে ‘পরে করছি’ বলে রাখতে রাখতে হাত কাঁপে মায়ের। গুগল ক্রোমটাও বোধহয় খুঁজে পাচ্ছে না সে। ক্লাশ করবে কি করে। চটজলদি মেটেও না আপদ মিটিংগুলি। 


মিটিং শেষে মা যখন ফোন করে, সে বলে, ‘তুমি চিন্তা করো না মা। আমি ক্রোম খুঁজে বার করেছি। শুধু তোমার ফাইলগুলো খুঁজে পাচ্ছি না।’ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে মা শেখায়, যা হবার তা হবেই। সমস্যায় পড়লে মোকাবিলা করবে। অবলার মত কাঁদতে বসবে না। তবেই না শক্তপোক্ত হবে। 


কখনও বা হ্যাং হয়ে যায় বুড়ো কম্পুটার। কখনও অকারণে নিতেই থাকে আপডেট। আজকাল আর কাঁদে না কেউ। শুধু নার্ভাস গলায় ফোন করে জানতে চায়, ‘ক্লাস যে শুরু হয়ে গেল মা। সবে ৩৫ শতাংশ-’। ঠিক তখনিই দরজা ফাঁক করে মুখ গলায় কোন পরিচিত মুখ, তাড়া তাড়া বিল এসে জমে টেবিলের ওপর। পারে না মা সমস্যা মেটাতে। অসহায় অবলার মত বলে, একটু অপেক্ষা কর। আর ঠাকুর ডাক। সারাদিন এত যে ‘মুণ্ডমালা শোভিনী ভয়ংকরী ত্রিনয়নী’ গেয়ে বেড়াস। বিপদে পড়লে তাকে ডাকিস না কেন? বলতে বলতে বাড়তে থাকে মায়ের হীনমন্যতার মাত্রা। দপ্তরী কাজ করতে করতে মোবাইলের স্ক্রীনের দিকেই তাকিয়ে থাকে মা- কত শতাংশ হল?কিছু বলে না কেন? টুং করে নেচে ওঠে মুঠোফোন- কোন ভারিক্কি দপ্তরী গ্রুপে ভেসে উঠতে থাকে কাজের খতিয়ান। তারই ফাঁকে আসে প্রাণের বাণী, ‘৮৫ শতাংশ মা। তুমি চিন্তা করো না। এই তো খুলে গেল। ওয়াইফাইও লাগিয়ে নিলাম। এবার ক্লাশ করি। ’ কন্যার ক্ষুদ্রতম জয়েও ঝরে পড়তে চায় কড়া আধিকারিকের আনন্দাশ্রু। ঘর ফাঁকা হলে কাঁপা কাঁপা হাতে মেসেজ করে মা, ‘তোমার পাশে না থাকতে পারার বেদনা আমায় কুড়ে কুড়ে খায়। বড় ভালোবাসি যে তোমায়। বাবার থেকেও বেশী। ’ ক্লাস থামিয়ে ধমকে ওঠে মেয়ে, ‘কাজে মন দাও মা। আমি তো রইলামই।’  তাজ্জব মায়ের হৃদয় ভরে ওঠে কানায় কানায়, এমন গতিতে কি আদৌ ছোটার কথা ছিল জীবনের? এত উত্তেজনা- সাফল্য, এত উষ্ণতা, বিষণ্ণতা, হঠাৎ ব্যর্থতা, এত নির্ভরশীলতা,এত ভালোবাসা কি সত্যিই প্রাপ্য ছিল? প্রাপ্য ছিল চূড়ান্ত ঋণাত্মক পরিস্থিতির মধ্যেও এত আনন্দ? কিছুই তো পারতাম না আমি। আজও পারি না। পারি শুধু ভালবাসতে, ভাগ্যিস জীবন সমুদ্রসম, যত ভালোবাসি, ফিরে ফিরে আসে শতগুণ হয়ে।





Saturday 16 January 2021

তুত্তুরী উবাচ, ২০২১


তুত্তুরী উবাচ ৩০শে এপ্রিল, ২০২১


(মাসির সাথে দাবাখেলা নিয়ে সক্কাল সক্কাল তুমুল বিবাদ, বেশ কিছুক্ষণ বাক্যালাপ বন্ধ এবং অবশেষে মায়ের পীড়নে ক্ষমা চেয়ে মিটমাট করার পর)  


👩🏻-দেখছ তো, ক্ষমা চাইলে আর শাস্তি পেতে হয় না। 

👧🏻-(হাসি চেপে) তাই বলে খুন করে ক্ষমা চাইলে কি আর মার্জনা করা হয়?

👩🏻-(জ্ঞান দেবার সুরে) নাঃ তা হ-য়-না। তবে ফাঁসিও হয় না। যাবজ্জীবন  কারাদণ্ড হয় হয়তো, অথবা সাত আট বছরের জেল।  

👧🏻-(খানিক চিন্তা করে) আচ্ছা মা কেউ যদি আমার ছুরির ওপর পেট নিয়ে আসে, তাহলেও কি আমার শাস্তি হবে?

👩🏻-(প্রবল হাসির দমকে, কাশতে কাশতে) এ আবার কেমন প্রশ্ন। কেউ খামোকা তোর ছুরির ওপর পেট নিয়ে আসতে যাবে কেন? 

👧🏻-(বোঝানোর ঢঙে) নাঃ ধর, আমি রাস্তা দিয়ে ছুরি নিয়ে যাচ্ছি, কেউ পেট নিয়ে আমার ছুরির ওপর পড়ল-

👩🏻- (হাসতে হাসতে) তুই খামোকা রাস্তা দিয়ে ছুরি নিয়ে যাবিই বা কেন? আর যদি যাস ও তাহলে এমন ভাবে মুড়ে নিয়ে যাবি,যাতে হোঃ হোঃ হোঃ কেউ তোর ছুরির ওপর পেট না নিয়ে আসতে পারে।  

👧🏻-(খানিক ভাবনা চিন্তা, খানিক পায়চারি যাকে ঠাম্মা বলে ‘হুমহাম’ করে পুনরায় রান্নাঘরের দরজায় আবির্ভূত  হয়ে) আচ্ছা মা, তুমি দৌড় বোম্বাই আম খেয়েছ?

👩🏻-(তাজ্জব হয়ে) অ্যাঁ? সে আবার কি? 

👧🏻-(বোঝানোর ঢঙে) হ্যাঁ গো মা। এক ধরণের আম আছে, যার নাম দৌড় বোম্বাই আম। মাম্মাম (দিদা)  মাঝেমাঝে কিনে আনত, অফিস ফেরত। দাদু বলেছে সেই আম এত টক যে বাঘের পিছনে দিলে বাঘ দৌড়ে পালাবে। 

👩🏻-(হাসতে হাসতে বিষম খেয়ে) কি শুরু করেছিস তোরা বলতো? খামোখা বাঘের পিছনে আম দিতে যাবি কেন?



 তুত্তুরী উবাচ, ৬ই এপ্রিল, ২০২১


👧🏻-(খেতে বসে উত্তেজিত হয়ে) মাসি তুমি আবার শুক্তোতে উচ্ছে দিয়েছ? 

👩🏽‍🍳-(তাজ্জব হয়ে) শুক্তো তো উচ্ছে করলা দিয়েই হয়। উচ্ছে না দিলে আবার শুক্তো হয় নাকি? 

👧🏻-(যুক্তি মেনে খানিক ভাত খেয়ে, পুলকিত স্বরে) মাসি জানো তো আমার মাথায় না সবসময় উল্টোপাল্টা চিন্তা ঘোরে। যেমন ধরো, রসগোল্লার শুক্তো আর উচ্ছের পায়েস রাঁধলে কেমন খেতে হবে? তুমি একদিন রাঁধবে?


(বিশেষ পাত্তা না খেয়ে খানিকবাদে দাদুকে ফোন করে) 


হ্যালো দাদু, জানো তো অামার মাথায় সবসময় নানা উদ্ভট চিন্তা আসে। আচ্ছা তুমি বলো তো, কলাগাছের চারা থেকেই তো কলা হয়, আবার সেই কলার বীজ থেকেই তো গাছ হয়, তাহলে প্রথম কলাগাছের চারাটা এসেছিল কোথা থেকে?


তুত্তুরী উবাচ ২রা এপ্রিল, ২০২১


👧🏻-(ঘুম চোখে, দুধের কাপে চুমুক দিয়ে) হ্যালো দাদু, একটা গল্প বলো না। 

👴🏻-  (প্রাতকালীন চিনি ছাড়া চায়ে চুমুক দিয়ে, ক্লান্ত সুরে) সকাল সকাল কি গল্প শোনাই বলো তো। বুড়ো হয়েছি, মাথা কি আর অত চলে। তুমিই বরং একটা গল্প শোনাও। 

👧🏻-(খুশি হয়ে,তরল গলায়) আচ্ছা দাদু, শ্রীকৃষ্ণের যে ১৬১০৮টা বউ ছিল তুমি জানতে?

👴🏻- বেশ।  শুনলাম। অত জন একসাথে থাকত?

👧🏻- আরে নাঃ। অষ্ট ভার্যার আটটা মহল ছিল-

👴🏻- অষ্ট ভার্যা?

👧🏻- হ্যাঁ, রুক্ষ্মিণী, জাম্ববতী, সত্যভামা, কালিন্দী,মিত্রাবিন্দা,নাগনাজীতি, ভদ্রা আর লক্ষ্মণা। 

👴🏻- (ক্লান্তি চেপে)অ। আর বাকি ১৬১০০?

👧🏻- তারা? তাদের গল্প আলাদা। তুমি শুনবে?

👴🏻-(আঁতকে উঠে) না। না। এতজনের কথা বলতে গিয়ে তোমার আমার চার-পাঁচদিন কেটে যাবে। 

👵🏼-(দিদা থুড়ি মামমাম পাশ থেকে মিনতির সুরে) সকাল থেকে কেন এসব কেষ্টবিষ্টু নিয়ে পড়েছ মা। একটু পড়তে বসো না মায়ের কাছে। 

👧🏻-(ঠক্ করে দুধের কাপ নামিয়ে ঝাঁঝালো সুরে) কারো ঠাকুমা-দিদিমা যে তাদের ঘুম থেকে উঠেই পড়তে বসতে বলে, এ আমি জীবনেও শুনিনি।  (অতঃপর কিঞ্চিৎ শান্ত হয়ে দাদুর উদ্দেশ্যে) শোননা, এক অসুর ছিল, তার নাম ছিল নকাসুর। 

👴🏻-( মধ্যস্থতার সুরে) নকাসুর! কি অদ্ভূত নাম। শুনে খুউব ভালো লাগল। 

👧🏻-(তুরীয় মেজাজে) নকাসুর ১৬১০০জন সুন্দরী মেয়েকে ধরে এনেছিল। সবাই অভিজাত বাড়ির মেয়ে। তাদের বাড়ির লোকেরা শ্রীকৃষ্ণের কাছে নালিশ করল, শুনে শ্রীকৃষ্ণ তো গেল ক্ষেপে,বলল, ‘এই নকা, আজ তোর একদিন কি আমার একদিন।’ তারপর যুদ্ধ হল আর শ্রীকৃষ্ণ নকাসুরকে বধ করল। তারপর হল কি, শ্রীকৃষ্ণ ঐ ১৬১০০জন কন্যাকে তাদের বাবামায়ের কাছে ফেরৎ দিতে গেল-‘একে কি আপনারা নেবেন? তারা বলল,‘ না নেবো না। ’

👴🏻- (দুঃখী স্বরে) কি অবিচার!

👧🏻- হ্যাঁ তো। তখন  শ্রীকৃষ্ণ কোন উপায় খুঁজে না পেয়ে তাদের বিয়েই করে নিল। 

👴🏻-(হতভম্ব স্বরে) একসাথে?

👧🏻-(মাথা চুলকে) হ্যাঁ তাই বোধহয়। একটা একটা করে বিয়ে করতে তো পাঁচ ছয় বছর কেটে যেত- 

👴🏻-(দুষ্টুমির সুরে) তাহলে একটা কাপড়ে এতগুলো গাঁটছড়া বাঁধা হল কি করে? শ্রীকৃষ্ণ কি মালায় ঢেকে গিয়েছিল? একদিনে এতজনকে মালাই বা পরাল কি করে? 

👧🏻-(চিন্তিত সুরে) তা জানি না। (বিজ্ঞ ভাবে) কিন্তু বিয়ের পর শ্রীকৃষ্ণ কখনও তাদের সাথে থাকেনি। বা কথা বলেনি,বা সম্পর্কও রাখেনি। 

👴🏻-তারা কোথায় থাকত?

👧🏻- দ্বারকামহলেই হবে।

👴🏻-অ।  অষ্ট ভার্যা ছাড়া তাহলে আর কারো সাথেই সম্পর্ক রাখেনি শ্রীকৃষ্ণ?

👧🏻- নাঃ। (আহ্লাদী সুরে) তোমার কেমন লাগল গল্পটা দাদু। 

👴🏻-(ক্ষ্যামা চাওয়ার সুরে) খুউব ভালো লেগেছে। সকাল সকাল এত বিয়ের গল্প শুনে তো আমারই আর একটা বিয়ে করতে ইচ্ছে করছে।

তুত্তুরী উবাচ ১৯শে মার্চ, ২০২১


👧🏻-(সকাল সকাল দুধের কাপ হাতে গম্ভীর গলায়) হ্যালো, ইলেকশন কমিশন থেকে বলছি। সরমা চ্যাটার্জী বলছেন?

👴🏻-(হাসি চেপে)হ্যাঁ বলছি। 

👧🏻-(আরো গম্ভীর গলায়,ধমকের সুরে) না বলছেন না। তিনি তো মহিলা। 

👴🏻-(কৌতুকের সুরে) উনি আমার বউ। বেবিকটে শুয়ে শুয়ে এখন কাঁদছেন। 

👧🏻- (উত্তেজিত হয়ে) অ্যাঁ? ওণার এত বড় সাহস? উনি আবার জন্মেছেন? ওণার ভোটে নাম কেটে গেছে দ্বিতীয়বার জন্মানোর অপরাধে। (কিঞ্চিৎ ধাতস্থ হয়ে) আচ্ছা সরমা চ্যাটার্জিকে দিন। 

👵🏼-( স্নেহাদ্র কণ্ঠে) হ্যাঁ সন্তু বলো। (প্রসঙ্গতঃ তুত্তুরীকে তার দিদা আদর করে সন্তু বলেও ডাকেন। )

👧🏻-(পুনরায় ধমকে) কে সন্তু? আমি ইলেকশন কমিশন থেকে বলছি। ধ্যারঃ, আপনি দ্বিতীয়বার জন্মেছেন কোন সাহসে? এই অপরাধে ভোট থেকে আপনার নাম কেটে গেছে জানেন?

👵🏼-(আদর মাখা কণ্ঠে) ও আচ্ছা। এবার কি হবে?

👧🏻-(হাসি গোপন করে, উত্তেজক কণ্ঠে) কি আর হবে? আবার নাম তুলতে হবে। আপনি শীঘ্রই আপনার পাখি কার্ড, প্যান কার্ড, আধার কার্ড বানিয়ে নিয়ে আসুন। 

👵🏼- ও আচ্ছা। তা পাখিটাকেও কি ভোট দিতে নিয়ে যাব?

👧🏻-হ্যাঁ। আপনার পাড়ার সব লোককে বলুন, তাদের পোষা পশুপাখি নিয়ে যেন ভোট দিতে আসে। আপনারা ভোট দেবেন আর আমরা ওদের গায়ে দাগ কেটে দেব। 

👵🏼-(ক্ষ্যামা দেওয়া সুরে) আ-চ-ছা। 

👧🏻-(মজার সুরে) তা আপনি তো একটা ছোট বাচ্ছা,বেবি কটে শুয়ে কাঁদছেন, আপনার দুধ টুধ কম পড়েনি তো? 

👵🏼-না না কিচ্ছু কম পড়েনি। তুমি বরং এবার আমার পাকা চুলো বুড়ো বরটার সাথে কথা বলো।  

👴🏻-(দাদুর গলা পেয়ে, পুনরায় ধমকে) এই যে, আপনার বউ দ্বিতীয়বার জন্মেছে, এই অপরাধের প্রায়শ্চিত্ত স্বরূপ আপনাকে একখানা কুকুর পুষতে হবে। 

👴🏻-কেন? আমাকে কি এবার কুকুরটাকেও বিয়ে করতে হবে?

👧🏻-(হেসে কুটোপুটি হয়ে) উফঃ আমি আর পারছি না। ইলেকশন কমিশন সেজে নতুন ডায়লগ বানানো আর সম্ভব নয়। দাদু আমি আবার তোমার সোনার তুত্তুরী হয়ে গেছি। একটা গল্প বলো-

তুত্তুরী উবাচ, ১৫ই মার্চ ২০২১


👧🏻-আচ্ছা বাবা, ইনস্যাশিয়েবল সেক্সুয়াল অ্যাপেটাইট মানে কি? ( অফিস টাইমের ভাত খেতে বসেছে শৌভিক, পাশেই বসে ইংলিশ লিটারেচর পরীক্ষা দিচ্ছে তুত্তুরী। এক পলক আমার দিকে অসহায ভাবে তাকিয়ে পুনরায় ভাত খাওয়ায় মন দিল। অগত্যা-)

👩🏻- (ভালো মানুষের মত মুখ করে) পরীক্ষায় এসেছে? কোন চ্যাপ্টার থেকে বল তো?

👧🏻- (লেখা থামিয়ে, চোখ তুলে) নাঃ পরীক্ষায় আসেনি। একজনের সম্বন্ধে পড়লাম। তাই জানতে চাইছি- 

👩🏻-পড়লি? আচ্ছা কোথায় পড়লি? কনটেক্সটটা একটু  বল, তবে না মানে বলতে পারব- 

👧🏻- দ্রৌপদীর সম্বন্ধে পড়লাম। গুগল বলল। আগের জন্মে দ্রৌপদী একজন ঋষির বউ ছিল। গুগল বলছে ইনস্যাশিয়েবল সেক্সুয়াল অ্যাপেটাইটের জন্য তার বর তাকে অভিশাপ দিয়েছিল, পরের জন্মে তোমার একটা নয়, দুটো নয়, পাঁচ পাঁচটা বর হবে। সবটা বুঝতে পারলাম, শুধু ঐটুকু বুঝিনি। তাই বাবার কাছে জানতে চাইছি-

👩🏻-(বেচারী বাবার করুণ মুখ দেখে হাসি গোপন করে) তার মানে হল একটা বরে সে সন্তুষ্ট ছিল না। 

👧🏻-মানে? বরের ওপর অসন্তুষ্ট কেন ছিল?

👩🏻- তার আরও চাহিদা ছিল (বলেই প্রমাদ গুণলাম)

👧🏻- কিসের চাহিদা ছিল মা? আরোও গয়নার- 

👩🏻-(স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে) হ্যাঁ আরো ভালো ভালো শাড়ি,  আরোও গয়না, খাওয়া, বেড়াতে যাওয়া এইসব আর কি।  

👧🏻-আচ্ছা। (তরল স্বরে) জান তো মা, দ্রৌপদীর ছেলেদের নামগুলো কি শক্ত, আমি তো উচ্চারণ করতেই পারলাম না। বেচারী দ্রৌপদী, দ্রৌপদী শুধু অর্জুনকেই ভালোবাসত। ( বিজ্ঞ স্বরে) অর্জুন কিন্তু দ্রৌপদীকে ভালোবাসত না। অর্জুন শুধু সুভদ্রা আর চিত্রাঙ্গদাকেই ভালোবাসত। 

👨🏻-(গম্ভীর মুখে)কথা হয়েছে? 

👧🏻-(থতমত খেয়ে) কার সাথে অর্জুনের সাথে? (হাসিতে ফেটে পড়ে) নাঃ অর্জুন পিসের সাথেও হয়নি। তবে গুগল কাকার সাথে হয়েছে।

তুত্তুরী উবাচ ১১ই মার্চ ২০২১

-আরেঃ।  কি করছিস? এই অন্ধকারে ছবি তুলছিস কেন? 

-(দৃঢ় স্বরে) আমি এই মশাটার ভিডিও তুলে ভাইরাল করে দেবো। তখন থেকে পোঁ পোঁ করে জ্বালাচ্ছে। মা

-(হাসি চেপে) মশার ভিডিও ভাইরাল করলে কি হবে?

-(দাঁতে দাঁত চেপে) তখন ওকে সবাই চিনে যাবে, আর পুলিশে ধরে নিয়ে গিয়ে জেলে পুরে দেবে। 

-কাকে?

-(তিক্ত স্বরে) মশাটাকে। আবার কাকে? (অতঃপর তরল স্বরে) মা জানো তো মশাদের জেল কেমন হয়? আমাদের জেলের মত হয় না। তাতে ছোট ছোট ফুটো থাকে। যাতে মশারা না পালাতে পারে। (আচমকা তেড়ে ফুঁড়ে উঠে) এই মশা জেলে যাবি? 


তুত্তুরী উবাচ ৮ই ফেব্রুয়ারি ২০২১

👧🏻-(বাড়ি ঢোকার সাথে সাথে অত্যুৎসাহী হয়ে) মা, আমি আজ মিসকে বলেছি, বাবা তো ইলেকশন নিয়ে ভীষন ব্যস্ত, আর মায়েরও খুব চাপ। সকালে আমায় একটু খানি পড়িয়েই মা অফিস বেরিয়ে যায়-

👩🏻-(ক্লান্ত স্বরে) মোদ্দা কথাটা বল। 

👧🏻- তাই বললাম আর কি, যদি আমি আর আমার মাসি যাই প্রজেক্ট জমা করতে? মিস বলল সরি চাইল্ড। আই কান্ট অ্যালাও। প্লিজ টক টু ইয়োর পেরেন্টস্। 

👩🏻-ঠিকই তো বলেছে। তোকে এত কথা বলতে কে বলেছে? প্রজেক্টটা ডেকরেট করতে হবে কি না শুধু এইটুকু জানতে বলেছিলাম। 

👧🏻-হ্যাঁ করতে হবে তো। ম্যাম বললেন ইয়েস চাইল্ড। ডেকরেট ইট উইথ স্টোন স্টিকারস্। 

👩🏻-(ভ্যেংচি কেটে)ডেকরেট উইথ স্টোন স্টিকার্স! যেই বড়মামা কিনে দিল, অমনি মিস বলল, ঐটা দিয়েই ডেকরেট করতে হবে?

👧🏻-(নিষ্পাপ মুখে) তা আমি কি জানি? জানো তো মা, সেদিন বড়মামা আমাকে আর দাদাকে নিয়ে কদমতলা বাজার গেল না, ওই যে গো স্টোন স্টিকার কিনতে, ফেরার পথে একটা বাজারওলার কাছ থেকে কি যেন একটা কিনল। বেশী না পাঁচশ গ্রাম মাত্র। কেনার সময় বড় মামা আমায় প্রশ্ন করল, ‘এটা কি বলতো?’ আমি বললাম বরবটি। শুনে বড় মামার কি হাসি। বলল,‘তুই নাকি তোর বাবার সাথে রোজ বাজার যাস? এই তুই বাজার চিনিস?’ তারপর দাদাকে প্রশ্ন করল, ‘তুই বলতো দেখি?’ দাদা বলল, ‘ঢ্যাঁড়শ’। ওটা আসলে কি ছিল জানো? ডাঁটা। 

বড়মামা তাই হাসতে হাসতে  কি বলল জানো? বলল,‘এরা সব এক গোয়ালের গরু।  একটা বোকা গরু আর একটা চালাক গরু। ’ 

👩🏻- (হাসি চেপে) বোকা গরুটা কে? 

👧🏻-( দুষ্টু  দুষ্টু মুখে) দাদা।


তুত্তুরী উবাচ ৩রা ফেব্রুয়ারি, ২০২১


👧🏻-হ্যালো এষা পিসি! (আদুরে গলায়) কি করছ?

👩🏻‍🎓-এই তো সবে বাড়ি ঢুকলাম। তুই কি করছিস?

👧🏻- তেমন কিছু না। এবার মাছেদের খেতে দেবো। 

👩🏻‍🎓- হ্যাঁ আমিও দেবো।

👧🏻- তোমাদের অ্যাকোরিয়ামে কটা মাছ আছে?

👩🏻‍🎓- আপাততঃ একটা। বাকি গুলো মরে গেছে। 

👧🏻-এ বাবা। মাত্র একটা? আরোও কয়েকটা কেনো না শিগ্গির। 

👩🏻‍🎓-(নালিশের সুরে) তোর পিসেকে বল। যখনই বলি, একই কথা-‘ওটা আগে মরুক। তখন কিনব’। 

👧🏻-(হতভম্ব হয়ে) ওটা কি চাল নাকি, যে শেষ হলে তবে কিনে আনবে?

তুত্তুরী উবাচ ১৬ই জানুয়ারী, ২০২১


👧🏻-(দরজা খোলার সাথে সাথে) মা জানো আজ কত বড় বিপদ হচ্ছিল? আমি তো ঠাম্মা দাদুর কাছে যাচ্ছি, পথে বড় মাঠটার কাছে দেখি কয়েকটা তুলোর বলের মত কুকুর ছানা গড়াগড়ি খাচ্ছে। আমি দাঁড়িয়ে খানিকক্ষণ ওদের খেলা দেখলাম। তারপর দেখি ওরা কোথায় যেন চলে গেল। আর ওদের মা’টা এতক্ষণ দূর থেকে আমায় দেখছিল, সে এসে আমায় শুঁকতে লাগল। তারপর আমার গায়ে দুধের গন্ধ পেয়ে সটান আমার বুকে পা তুলে দাঁড়িয়ে পড়েছিল। 

👩🏻-সে কি রে বাবু। কি সর্বনাশ। তারপর?

👧🏻- তারপর আর কি? আমি তো প্রবল চিৎকার করতে লাগলাম, বাঁচান! বাঁচান! একটা লোক দৌড়ে এল, ‘কি হয়েছে?’ আমি বললাম, ‘এই যে কৌটোটা দেখছেন এতে গুড়ের পায়েস আছে। আমার মা দিয়েছে ঠাম্মা-দাদুর জন্য। এই পায়েসের লোভে কুতুয়াটা আমায় আক্রমণ করছে-। ঐ সামনেই তো দাদুর ফ্ল্যাট। আমাকে একটু ঐ বিল্ডিং অবধি এগিয়ে দিন না প্লিজ’। 

👩🏻-বাপরেঃ। তুই তো বীরাঙ্গনা রে। কি সুন্দর বিপদে থেকে নিজেকে উদ্ধার করেছিস। প্রাউড অব ইউ। 

👧🏻- হ্যাঁ জানো তো, দাদু বলল, ‘আমি তোমাকে আর একা ফিরতে দিচ্ছি না।’ শেষে কাকিমা সাইকেলে চাপিয়ে পৌঁছে দিল। 

👩🏻-বাঃ। খুব ভালো। 

👧🏻- জানো তো মা, লোকটা ঠাম্মা দাদুর বাড়ি অবধি এগিয়ে দিয়ে বলল,‘তুমি রোজ ফ্লাওয়ার শো দেখতে আসো না? ডালিয়ার কুঁড়িটা কি তুমি ছিঁড়েছ?’ আরেঃ আমি ছিঁড়ব কেন? তুই ব্যাটা অপদার্থ। অামাদের ডালিয়া গাছে কুঁড়ি এসে গেল আর তোদের এল না?  

👩🏻- আচ্ছা এবার থাম। আর বড়দের অপদার্থ বলতে নেই । বিশেষতঃ উপকারীকে তো নয়ই। 

👧🏻-বড়রা ছোটোদের বলতে পারে?

👩🏻-হ্যাঁ। 

👧🏻- আজব নিয়ম তো? (মা নিরুত্তর দেখে, ফাজিল সুরে) মা হাতিদের টুথপিক লাগে?

👩🏻-(বিরক্ত সুরে) আমি জানি না। যত উৎকট কথাবার্তা। 

👧🏻-(আরো খানিকবাদে,রহস্যের সুরে) মা বলোতো কোন ভারতীয় মহিলা প্রথম বিদেশে গিয়েছিলেন?

👩🏻-(চিন্তার সুরে) মাদাম কামা? না না দাঁড়া। সম্রাট অশোকের কন্যা সংঘমিত্রা। 

👧🏻-(ফাজিল সুরে) হল না। প্রথম বিদেশ যাওয়া ভারতীয় মহিলা  হলেন সীতা। শ্রীলঙ্কায় গিয়েছিল না? অার তার পিছন পিছন গিয়েছিল রাম। 

👩🏻-(তিক্ত সুরে) কোথা থেকে শিখিস এই পচাপাতকো জোকস্? হানিবানি থেকে?

👧🏻-(বিজ্ঞের সুরে)না না। আমি ইয়ে মানে ভেবে ভেবে বার করেছি। (খানিকপরে, আহ্লাদী সুরে) কি করছ বাবা? এপিক জেনারেট করছ? দাও না আমিও একটু করি?

👨🏻-(বিরক্ত সুরে) আর বাজে বকিস না তো। তুই করলে আমার চাকরী থাকবে?

👧🏻-(অবাক সুরে) আরে? এপিক জেনারেট হলেই তো হলো নাকি? শৌভিক ভট্টাচার্য করল না পুরোযা ভট্টাচার্য তাতে ওদের কি? 

(কিছুক্ষণ অন্যমনস্ক থেকে) আচ্ছা বাবা,কেউ যদি কানের ফুটোতে বন্দুকের নল ঢুকিয়ে চালায়, তাহলে কি সে খুব জোর আওয়াজ শুনবে?

👨🏻-(কম্পুটার চালাতে চালাতে প্রায় বিষম খেয়ে) সে কোন অাওয়াজই আর শুনতে পাবে না।

তুত্তুরী উবাচ ২৮শে জানুয়ারী, ২০২১


👧🏻-হ্যালো মামমাম। (আদুরে সুরে) হ্যাঁ মামমাম, চটি পরেছি। হ্যাঁ মা'ই তো এনে দিয়েছে কালকে। চটিটায় না কালকে দেখছিলাম সুগন্ধী তেল মাখানো ছিল। পরলেই পা হড়কে যাচ্ছিল। আজ ঠিক হয়ে গেছে মামমাম। কি নরম চটিটা। তুমি সেদিন বলছিলে না, তোমার ঐ আকুপ্রেশারওয়ালা চটিটা পরলে পায়ে লাগে, মাকে বলব তোমায়ও একটা কিনে দিতে। এই চটিটা পরলে পায়ের সব ময়লা উঠে যায়- পাটা ঝকঝক করে।

👩🏻-( পাশ থেকে ভেংচি কেটে) হ্যাঁ। কারণ পায়ের সব কালিঝুলি গিয়ে চটিতে লাগে। একদিনেই চটিটার হাল করেছে দেখো। 

👧🏻-উফ্। বড় বিরক্ত করো মা তুমি।(পুনরায় আবদারের সুরে) তোমার মেয়ে বড্ড জ্বালাতন করে মামমাম। সারাদিন শুধু (ভেঙিয়ে) 'পড়-পড়' করে পিছনেই পড়ে থাকে।(মায়ের থেকে একটু সরে গিয়ে,অভিমানী সুরে) জানো তো মামমাম, বাবাও আজ আমায় বকেছে। 

👵🏽- বাবা তো বকে না মা। কেন বকেছে? 

👧🏻- কেন আবার? আমি আঙুল চাটছিলাম তাই। 

👵🏽- খামোকা আঙুল চাটছিলে কেন? 

👧🏻- আরেঃ আমি মাছের ঝোলের সাথে লেবু মেখে ভাত খেয়েছিলাম। তারপর দই দিয়ে ভাত খাবার আগে ভাবলাম, লেবুর রসে যদি দুধ কেটে যায়, তাহলে দইটাও তো কেটে যাবে। তাই ভালো করে হাত চাটছিলাম। বাবা ধমকে বলল, ‘দুধ কেটেই তো দই হয়। দই খামোকা কাটতে যাবে কেন?’

(প্রসঙ্গ বদলে) দাদু আবার কবে রেশন আনতে যাবে? আমিও যাব তাহলে-। সেদিন খুব মজা হয়েছিল। দাদু তো আমায় রিক্সায় বসিয়ে আর কুড়িটাকার নোটটা দিয়ে রেশন তুলতে গেছে, বলে গেছে ,‘তুমি রিক্সাটাকে ধরে রেখো তুত্তুরী। ’ আমি তো রিক্সাটাকে চেপে ধরে বসেই আছি, বসেই আছি। রিক্সাওয়ালাটা বলে কিনা, ‘ বাবু একবার নামো তো।’ আমি ভাবলাম,পিছনের কাপড়টা ঠিক করবে বুঝি। যেই নামলাম, ওমনি অন্য একটা বুড়োকে বসিয়ে পোঁপাঁ দৌড়। আমি বোকার মত খানিক দাঁড়িয়ে রইলাম। তারপর গুটি গুটি দাদুর কাছে গিয়ে হাজির হলাম। দাদু তো হতবাক। ‘তোকে রিক্সাটাকে ধরে রাখতে বললাম যে-।’ ভাগ্যিস টাকাটা দিয়ে দিইনি।  তারপর রেশন নিয়ে রাস্তায় এসে আবার অন্য একটা রিক্সা ধরলাম আমরা। রিক্সায় ওঠার সময় দাদু বলল ,‘তুত্তুরী তুমি ঐ দিকটায় বসো। আমি একদিকে বসব। এদিকে রোদ আসছে,।  আমি রোদ পোহাতে পোহাতে যাব। ’শুনে তো আমি হেসে বাঁচি না। দাদু কি কুমীর নাকি? যে রোদ পোহাবে? 

যাই বলো। খুব মজা হয়েছিল সেদিন। জানো তো মামমাম, রেশন দোকানে প্যাকেটের মাল পাওয়া যায় না। সব গোটা গোটা। সব বিনা পয়সায় পাওয়া যায় রেশনে। 

👴🏼-(দাদু পাশ থেকে গলা তুলে) বিনা পয়সায়? ওটা কি আমার শ্বশুরমশাইয়ের দোকান নাকি রে?

Sunday 3 January 2021

অনির ডাইরি, ৩১শে ডিসেম্বর, ২০২০

 

“ঝটক কে গেঁসু যাঁহা চলে,তো সাথ মেঁ আশমাঁ চলে-”

সকাল আটটা। কিশোর কুমারের মধু ঢালা কণ্ঠ থামিয়ে বেজে ওঠা ফোনটা যখন ধরলাম, সিক্ত কেশ গুচ্ছ দিয়ে টপাটপ ঝরে পড়ছে মুক্তোকণা। গানটাকে গত রাতে কিছুতেই খুঁজে পাইনি। আজ সকালে অনুধাবন করলাম, “কেয়া সুরৎ হ্যায়” বলে অন্বেষণ করলে, “জরুরৎ হ্যায়”কে খুঁজে পাওয়া যায় না। 


ফোনের ওপারে জনৈক মস্ত বড় সাহেবের পিএ। ঘুম জড়ানো অসহায় কণ্ঠে জানান, অনিবার্য কারণ বশতঃ আজকের বৈঠক বাতিল। বসের নির্দেশ সবাইকে জানাতে হবে, অথচ ওণার গৃহে বা মোবাইলে কারো নম্বর নেই। লাজুক কণ্ঠে সবিনয় অনুরোধ, যদি বাকি আধিকারিকদের এট্টু জানিয়ে দিই- অত্যন্ত আনন্দের সাথে রাজি হয়ে যাই।  বর্ষবরণের প্রাক্কালে বৈঠক বাতিলের সংবাদ বহন অতীব পূণ্যকর্ম। 


আজ বছরের শেষ দিন। কোন এককালে এমন দিনে আপিস যেতে ডাক ছেড়ে কান্না পেত। উৎসব মুখর শহর আর খুশি খুশি নাগরিক বৃন্দ জাগাত ভয়ানক হীনমন্যতা।  জমানাই ছিল ভিন্ন, আর শৌভিকের ভাষায় আপিসটাও ছিল ‘জঘন্যের কাকাবাবু’।


এ হেন বালখিল্যচিত ছিঁচকাঁদুনে দুঃখবিলাস অবশ্যি আজকাল আর অনুভূত হয় না। জেলাটা ভালো, আপিসটা ভালো, লোকজন ভালো আর সবার ওপরে আপাততঃ মোদের শিরে সংক্রান্তি। 


আরে মশাই, বারো দিন বাদে আমাদের মেলা বুইলেন। সময় কম, লোক বল তলানিতে আর অর্থ বল? বাজেট কাটতেছাঁটতে যাকে বলে জেরবার আমরা। নির্দয় হাতে ছাঁটা হচ্ছে মেলার যাবতীয় সৌন্দর্যায়ন।  প্রতিপদে কেটারার আর ডেকরেটরের সাথে দরদাম করে চলেছে আমার অবশিষ্ট খঞ্জভঙ্গ টিম। শেষে গতকাল উনি হতাশ হয়ে বললেন, “বাজারদর সম্পর্কে আপনাদের কোন ধারণা আছে ম্যাডাম? আলু-পেঁয়াজের দাম জানেন? গ্যাসের দাম জানেন?” আলু-পেঁয়াজের সঠিক দাম না জানলেও, জানি বাজারে লেগেছে আগুন। আর সদ্য অনলাইন গ্যাসের বিল দিলাম, তাই এমাসে গ্যাসের দামটা ঠোঁটস্থ। উনি আমাদের সম্মিলিত অত্যাচারে এই ঠাণ্ডাতেও ঘেমে উঠেছিলেন। কপালের ঘাম মুছে হেসে বললেন, “ওটা তো ডোমেস্টিক ম্যাডাম। কমার্শিয়াল সিলিণ্ডার আরও অনেক বেশী মূল্যবান।” সে হোক। আমরা নিরূপায়। আপনার যা প্রাণ চায় করুন। যা খুশি বিল দিন। আমার এইটুকুই  সম্বল- 


সকাল নটা। গুড় নিয়ে ফিরল তুত্তুরী। গিয়েছিল আখের গুড় আনতে। কিনে এনেছে ভেলিগুড়। একখানা জাম্বো নারকেল দিয়েছে মা। বেহারী নারকেল। দেশ থেকে এনে দিয়েছে পৌরসভার ঝাড়ুদার। রোজ ময়লা নিতে এসে খোশগল্প করে বাবা আর মায়ের সাথে। যত এদের নিষেধ করি, অপরিচিত অর্ধপরিচিত মানুষের সাথে এত খোশ গপ্প করো না। জমানা খারাপ। তা শুনলে তো? কদিন আগে বোধহয় মা বলেছিল আমার জামাই আর নাতনী নারকেল নাড়ু খেতে বড় ভালোবাসে। বাজার গিয়ে বাবার পক্ষে নারকেল কিনে আনা প্রায় অসম্ভব। স্থানীয় যারা বাজার নিয়ে বসে তারা তো আর নারকেল বিক্রি করে না।  


মায়ের দুঃখে গলে গিয়ে, চারদিন কাজে ডুব মেরে, চার খানা খোক্ষস মার্কা নারকেল এনে দিয়েছে ঝাড়ুদার। দরাদরি অন্তে নগদ ৩৫০টাকায় কেনা চারখানা নারকেল, যার দুখানি নাড়ু রূপে আর একখানি গোটাগুটি এসে হাজির হয়েছেন আমার গৃহে। নারকেল তো পেলাম,ফাটাই কি দিয়ে? ছোট নারকেল হলে বাটনা বাটার নোড়া মেরে ঘায়েল করে লতা দি। এটা যা জাঁদরেল। 


রমেশকে বলেছিলাম একটা কাটারি কিনে দিবি বাবা? অত্যুৎসাহী জনগণ যত। নিজের বাড়ির ভারি কাটারিটাই গছিয়েছে দিন কয়েকের জন্য। তিনি এসেছেন তো এসেইছেন। কাজে আর লাগানো হচ্ছে না তাঁকে। মায়ের হাতের নাড়ু শেষ হলে তবে না নতুন নাড়ু পাকাব। 


গতকালই লতাদিকে বললাম,যা হয় হোক, এবার কাটারিটা ফেরৎ দিতে হবে। ভেবেছিলাম বছর শেষে আপিস ফেরতা চিনির নাড়ু পাকাব। বাপ-মেয়ের না পসন্দ। সাতসকালে তাই কৌটো নিয়ে দৌড়েছিল তুত্তুরী পাঁচশ আখের গুড় আনতে। মেয়েকে দোকানে পাঠাতে খুব একটা স্বচ্ছন্দ বোধ করে না শৌভিক। ভয় পায়। যা ট্যালা মেয়ে। তাই টাকাপয়সা ছাড়াই দোকান যায় তুত্তুরী। দোকানদার হোয়াটস্ অ্যাপে পাঠিয়ে দেয় বিল।  


আজ তিনি অনুপস্থিত। দোকানের পুঁচকে কর্মচারী আখের গুড় বোঝেনি। পাঁচশ ভেলি গুড় গছিয়েছে। তাই নিয়েই নাচতে নাচতে বাড়ি ফিরেছে আমার কন্যা। 


আখের গুড়ের পরিবর্তে ভেলি গুড় এনেছে বটে, তবে পথে কোন বুড়ো রিক্সাওয়ালা নাকি মামণি বলে ডেকে বিনামূল্যে বাড়ি পৌঁছে দিতে চেয়েছে, তাকে দিব্য মায়ের ভয় দেখিয়ে পাশ কাটিয়ে ফিরে এসেছে ট্যালা মেয়েটা। বর্ষ শেষে এটাই কম পাওনা কি? রোমে টিকতে হলে রোমান হতে হয়, আর জঙ্গলে বাস করতে হলে- 


বেলা দশটা- “আজ কোথাও যাচ্ছ তোমরা?” ফোনের ওপার থেকে সংকুচিত ভাবে জানতে চাইল উমা।  তুত্তুরীর প্রবল আপত্তি সত্ত্বেও ভেলিগুড় বিদায় করে, ধার করা কাটারি বগলে আপিস বেরোতে একটু দেরীই হয়ে গেছে। হাসি চেপে জানালাম, যাচ্ছিই তো। যে যার আপিস। “তাহলে সোনাইকে নিয়ে একটু বেরোব?” আবার জানতে চায় উমা। উমা অর্থাৎ কাকিমা আর তার সোনাই অর্থাৎ তুত্তুরীর মধ্যে সাধারণত ঢুকি না আমি। যতক্ষণ  না দুটোতে ঝটাপটি করছে, যা খুশি কর না বাপু তোরা।   


বেলা এগারোটা- আপিসে ঢুকতেই সঞ্চিতা বলল, “ওরা কিন্তু আসবে ম্যাডাম। দল বেঁধে।” ওরা আসবেই, জানি। গতকাল মেলার সমস্ত দপ্তরী দায়িত্ব থেকে ওদের অব্যাহতি দিয়েছি যে। তারপর থেকেই উত্যক্ত করছে ওরা। 


বড় সাহেবই বলেছিলেন, ‘তোমার ছেলেমেয়েগুলো ভালো, তুমি বললে ওরা ফেলতে পারবে না। কিন্তু সাংগঠনিক ভাবে যদি ওরা মেলা বয়কটের সিদ্ধান্ত নেয়, তাহলে আমাদের চাপ দেওয়া অনুচিত। দেখো কি করবে-।’  আমার ছেলেমেয়ে গুলো সত্যিই ভালো, মেলা নিয়ে আমাদের থেকে ওদের উত্তেজনা বেশী। শ্যামল তো রোজই লিখে চলেছে, ‘দূরদূরান্ত থেকে মানুষ আসবে আমাদের মেলা দেখতে। কত লোক চাই ম্যাডাম। আমি আনব।’ ধরে বেঁধে থামাতে হয় এদের। বাপঃ করোণা এখনও আছে কিন্তু। 


তবুও ভেসে আসে নানা অপ্রীতিকর বার্তা। অন্য মহকুমার লোকজনের তিক্ত ঝাঁঝালো উক্তি। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের জন্য ফোন করে অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে কৌশিক। “জানেন না আমাদের কি অবস্থা?”  অবস্থা আমাদের থেকে ভালো কে জানে? তুচ্ছ ফিল্ড আপিসের ওপর গোঁসা হতেই পারে, কিন্তু ফিল্ড আপিসের অসহায়তা বুঝবি না তোরা? তাহলে কে বুঝবে? ক্ষোভ অভিমান তো আমাদেরও হয়- তাই লিখেছিলাম,  মেলা তো তোমাদেরই, অবশ্যই মেলায় এস, মেলার কাজে অংশগ্রহণ করো, কিন্তু স্বেচ্ছায়। এবার অফিশিয়ালি যাবতীয় দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়া হল সকলকে। ‘আপনি আর কপনি’ নিয়েই লড়ে যাব আমরা। 


বেলা একটা- তুত্তুরীর ফোন আর থামেই না। দারুণ কাটছে আজকের দিনটা। পিছনের কেরিয়ারে সোনাইকে বসিয়ে সারা আবাসন সাইকেলে চক্কর মেরেছে কাকিমা। জীবনে কখনও সাইকেলের কেরিয়ারে বসেনি তুত্তুরী। তারপর পাড়ার ছোট্ট পার্কে ঢুকে এক অবাঙালি শিশুর থেকে ধার করা ফুটবল নিয়ে হুল্লোড়বাজি, দোলনায় চড়া, ঢেঁকিতে চড়া আর তারপর মাঠে রোদ পোয়াতে আসা জনৈক দাদুর আদরের থলথলে ল্যাব্রাডর কুতুয়াকে ধার নিয়ে আশ মিটিয়ে চটকেছে দোঁহে। আদরের দাপটে নাজেহাল কুতুয়া মাঝে একবার পালিয়ে গিয়ে পাশের গাছে পা তুলে কিভাবে ইয়ে করেছে সেই গল্পও শোনায় তুত্তুরী। সারা বেলা টইটই করে ঘুরে, হাফ প্যাডেল শেখা তথা শেখানোর ব্যর্থ প্রচেষ্টান্তে বাড়ি ফিরেছে দুজনে। উফঃ এমন দিন কেন যে রোজ আসে না, একসাথে চিৎকার করে দুটোতে, সাধে এদের মধ্যে ঢুকি না।  


বেলা তিনটে-কালো হয়ে আসা মুখগুলিতে মাখামাখি আব্দার আর আর্তি।  “ও ম্যাডাম, রাগ করবেন না।” “দুঃখ পাবেন না। মেলা থেকে প্লিজ আমাদের সরিয়ে দেবেন না। আমরা আসব হ্যাঁ।” ওদের মেলা থেকে ওদের বাদ দেবার ক্ষমতা কি আমার আছে? কত বড় শক্তিধর আমি? আর রাগ? রাগ হলেও তার স্থায়িত্ব কতক্ষণ এরা ভালোমতই জানে। মন কষাকষি, মান অভিমান, রাগ-অনুরাগ মিটতে মেটাতে গড়িয়ে যায় বেলা। বর্মন সাহেব গলা ঝেড়ে, হাত কচলে, জানান দেন, সব তো হল, এবার একটু কিছু খাওয়া দাওয়া হবে না? আজ যে বছর শেষ। বুঝতে বাকি থাকে না, বাইরে থেকে শিখিয়ে পড়িয়ে পাঠিয়েছে সবাই মিলে। ছদ্ম গাম্ভীর্যের প্রসাধনের আড়ালে ফিক করে হেসে ওঠে হৃদয়,‘ এমনি ভাবেই কাটুক না বছর গুলো, কিছু নরমে, কিছু গরমে। কিছুটা লোহায় আর বাকিটা নিখাদ সোনায়।’