Sunday 14 January 2024

অনির ডাইরি জানুয়ারি, ২০২৪

অনির ডাইরি ২৬ শে জানুয়ারি, ২০২৪

#কাঁথিরকিস্যা #অনিরডাইরি 



প্যারেড শেষে টুপিটা উনি ফেলেই চলে আসছিলেন। অভ্যাস না থাকলে যা হয়। ভাগ্যে আমি ছিলাম। প্যারেডে যাবার সময় আমি আর তুত্তুরী শৌভিকের সঙ্গী হতে পারিনি, এমন দিনে মহকুমা শাসককে নাকি একলাই যেতে হয়। স্ত্রী-সন্তান-পরিবার বর্গের জন্য থাকে অন্য গাড়ি। ফেরার পথে অবশ্য মিলে মিশে যায় মুড়ি, মিছরি আর জল। শৌভিকের দপ্তরী বাহনের পিছনের সিটে ঘেঁষাঘেঁষি করে বসি তিনজনে। মোবাইল বার করে দেখায় শৌভিক, কাঁথির প্রাক্তন এক মহকুমা শাসকের মেসেজ। আজ সকালেই পাঠিয়েছেন ভদ্রলোক, মেসেজ জুড়ে একরাশ বিবর্ণ রঙিন ছবি।  যেমন তোলা হত নব্বইয়ের দশকের গোড়ার দিকে। ঠিক এমনি ভাবেই মাঠে ঢুকছেন মহকুমা শাসক, নিচ্ছেন অভিবাদন, চলছে প্যারেড আর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, পুরষ্কৃত করছেন কাঁথি মহকুমা তৎকালীন বিশিষ্ট ব্যক্তিদের। এক, হুবহু এক মুহূর্ত সব, যা এই মাত্র ঘটে গেলে আমাদের জীবনে, তারই অতীত, বিবর্ণ ছবি ফুটে আছে শৌভিকের মুঠো ফোনে। ওনার যা অতীত,আমাদের সেটাই বর্তমান। আর ওনার যা বর্তমান,সেটা আমাদের ভবিষ্যৎ। 

ভাবতে-ভাবতে, বলতে-বলতে বাড়ি পৌঁছে গেলাম, নামতে-নামতে শৌভিক বলল, "অত ভেবে কি করবি, তার থেকে বরং টুপি পর।"  টুপিই তো পরান তিনি আমায়, নৈমিত্তিক পরান, অষ্ট প্রহর পরান, তাও যে কেন আশ মেটে না 👹 

অনির ডাইরি ২৬ শে জানুয়ারি, ২০২৪

#অনিরডাইরি #কাঁথিরকিস্যা পর্ব ২


নটা বাজার একটু আগেই পৌঁছে গিয়েছিলাম তুত্তুরী আর আমি। কাঁথির অরবিন্দ স্টেডিয়ামে আজ জনারণ্য। স্বাধীনতা দিবস, প্রজাতন্ত্র দিবসের মতো দিনগুলোতে আবেগের বন্যা বয়ে যায় এই শহরে। বিপ্লবীদের জেলা,বিপ্লবীদের মহকুমা বলে কথা। মাঝে মাঝে আমার মনে হয়, খুঁজলে হয়তো তমলুক বা কাঁথির সব বনেদী তথা পুরাণ পরিবারেরই কারো না কারো নাম, কোন না কোন শহীদ বেদীতে মিলবে। 


কালই বলছিল শৌভিক, প্রজাতন্ত্র দিবস নিয়ে এবারের উত্তেজনা নাকি আরো বেশি। গতবারের থেকেও বেশ অনেকগুলি বেশি বিদ্যালয় থেকে এবার নাম দিয়েছে, নাম দিয়েছে প্যারেড থেকে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান সবকিছুতে। এমনকি কয়েকটি বেসরকারি স্কুলও নাকি এই অনুষ্ঠানের অংশীদার হবার ইচ্ছা প্রকাশ করেছে। মহকুমা তথ্য সাংস্কৃতিক আধিকারিক নাকি পাগল হয়ে যাচ্ছে অনুষ্ঠানটিকে বারোটার মধ্যে কি ভাবে গোটানো যায় ভেবে। মহকুমা শাসকের করণে কর্মরত কয়েকজন সুগায়ক গায়িকার সাথে দেখা হল তুত্তুরীর আর আমার, সাগ্রহে জানতে চাইলাম, ' কি গান গাইছেন?' জবাব এল, " এবার গাইছি না ম্যাডাম। বাচ্ছা গুলোকে তো সুযোগ দিতে হবে।" 


নির্ধারিত আসনে বসে একবার মাঠটা দেখে নিলাম আমরা, সামান্য ধোঁয়াশা আছে আজ। রোদটাও ওঠেনি ভালো করে। সেসব উপেক্ষা করে মাঠ ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে উর্দি পরা আর না পরা লোকজন, বাচ্ছাদের দল। বাজছে মস্ত বড় ড্রাম। SI সাহেব শেষ মুহূর্তের নির্দেশাবলী দিচ্ছেন সোচ্চারে। একবার " সাবধান", ঋজু হচ্ছে সবাই। একবার "বিশ্রাম", অমনি  শিথিল হচ্ছে সবাই । আকাশে বন্দুক তুলে ছদ্ম মহড়াও হল বোধহয়। ডানদিকে রাখা  হারমোনিয়াম ও প্যাপো শুরু করে দিয়েছে। সবাই উন্মুখ, মাঠ ঘিরে সমবেত জনতার মধ্যে তীব্র উত্তেজনা, কখন শুরু হয় আজকের অনুষ্ঠান। উত্তেজনা আর ফুরফুরে ভাব ছড়িয়ে পড়ছে আমাদের মধ্যেও। এখন অপেক্ষা কেবল মহকুমা শাসকের। 


ঘড়ির কাঁটা নটার ঘর স্পর্শ করার সাথে সাথেই ঘোষক মহোদয় ঘোষণা করলেন, " আমাদের মধ্যে এসে উপস্থিত হয়েছেন, মাননীয় মহকুমা শাসক, কাঁথি, শ্রী শৌভিক ভট্টাচার্য।" পেতে রাখা সবুজ কার্পেটের ওপর দিয়ে গট গট করে হেঁটে আসছেন মহকুমা শাসক। হ্যাংলার মত মোবাইল নিয়ে ছবি তুলছি আমি, আর তুলতে তুলতে ভাবছি, এই লোকটাই কি কাল রাতে, কে কম্বল বেশি টেনে নেয় তাই নিয়ে কোমর বেঁধে ঝগড়া করছিল আমার সাথে?

অনির ডাইরি ২৬ শে জানুয়ারি, ২০২৪

#কাঁথিরকিস্যা #অনিরডাইরি 


হাঁটতে যাবি? একগাল হেসে জানতে চায় শৌভিক। সদ্য ফিরেছি হলদিয়া শ্রমিক মেলার উদ্বোধন সেরে, এবার ধড়াচূড়া খোলার পালা। তেল প্যাটপ্যাটে মুখ, ধুলিমলিন কেশবাস সাফ করার পালা, সবার আগে শৌচালয় যাবার পালা। মেলা প্রাঙ্গণে শৌচালয় ছিল বটে, মেলার শৌচালয় যেমন হয়, তেমনিই। ফলে সকালে ফাঁকায় ফাঁকায় সেই যে একবার গিয়েছিলাম,ব্যাস আর ওপথ মাড়াইনি। মান্যগণ্য অতিথিরা যখন বিদায় নিলেন, আমিও গুটিগুটি গিয়ে বললাম বড় সাহেবকে, এবার আসি তাহলে। ঠিক তখনই স্যারের মোবাইলে ভেসে আসে জনৈক জনপ্রতিনিধির কণ্ঠস্বর, " একটু দেরী হয়ে গেল। আমি কাছাকাছি এসে পড়েছি,যদি অসুবিধা না হয়, আসব কি?" 


কি সর্বনাশ! এখন তো যাকে বলে ভাঙ্গা মেলা, মঞ্চের সামনের চেয়ারগুলি অধিকাংশই ফাঁকা। স্টেজ থেকে বেনিফিট দেবার জন্য যাদের ডাকা হয়েছিল,তারাও ডামি চেক বগলে কেটে পড়েছে। যাবার আগে প্রত্যেককে ধরে, ধরে বলেছে সৌম্য, অদিতি, যোশুয়া, "ওটা নকল চেক বাবারা, দয়া করে ব্যাঙ্কে নিয়ে যেওনি।" মোদ্দা কথা, নবাগত অতিথিকে অভ্যর্থনা জানানোর মত কিছুই আর অবশিষ্ট নেই। বরণ করার মেয়েগুলোও চম্পট দিয়েছে, একে একে। 

কোন মতে হাতের কাছে যাঁরা ছিল তাদের দিয়েই বরণ করা হল অতিথিকে। তিনি বেশ প্রসন্ন চিত্তেই অভ্যর্থনা গ্রহণ করলেন, সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখতেও সম্মত হলেন, হোক না ভাঙ্গা মেলা। ব্যাপারটা আয়ত্তে আসলে, আবার বললাম বড় সাহেবকে, "দাদা, এবার আমায় ছেড়ে দাও। সকাল সাড়ে এগারোটা থেকে বাথরুম যাইনি একবারও। ওই জন্যই বাড়ি যাওয়া দরকার।" 

স্যার আঁতকে উঠে বললেন, " আরে করেছ কি, হলদিয়া থেকে কাঁথি যাবে কি করে, এতটা রাস্তা? রাস্তার উল্টো দিকেই এমপ্লয়মেন্ট অফিস, দুমিনিট গেলেই আমাদের অফিস ওখানে যাও।" আর কে অফিস যায়, শৌচালয় যাবার বাহানা করে সপার্ষদ কেটে পড়লাম। গাড়িতে উঠে আগে দেড় বোতল জল খেলাম, বাথরুম যেমন যাইনি, জলও তেমন খাবার অবকাশ পাইনি সকাল থেকে। নন্দকুমার মোড়ে শুভদীপ্ত কে নামিয়ে খেয়াল হল, সকাল থেকে চা খাইনি একবারও। চণ্ডীপুর মোড়ে দাঁড়িয়ে চা খেলাম সকলে, ততক্ষণে সন্ধ্যা ঢলে রাত নেমেছে। কিছুটা দূর যেতে না যেতেই বুঝতে পারলাম পর্যায়ক্রমে জল এবং চা খাওয়াটা কতবড় অপরাধ হয়েছে। ইষ্ট নাম জপতে, জপতে কাঁথিতে যখন এসে নামলাম ব্লাডার ছাড়ুন, আমিই ফেটে যাবার উপক্রম।


 তখন বরের সোহাগী হাঁটতে যাবার কথা শুনলে কার না পিত্তি জ্বলে যায়? দিলাম মুখ ঝামটা, শৌভিক আরো বেশি করে বত্রিশ পাটি বার করে বলল, " না, হাঁটতে হাঁটতে কালকের স্পিচটা ভাবতাম আর কি।" আমার সাথে হাঁটতে হাঁটতে স্পিচ কি করে ভাবত, ব্যাপারটা বোধগম্য হল না যদিও। জিজ্ঞাসা করার সুযোগ পেলাম না,কারণ শৌভিক ততক্ষণে ট্র্যাক বদলে চলে এসেছে অন্য অভিযোগে, " ওই জন্য তোকে আমি রাস্তায় দাঁড়িয়ে চা খেতে দিই না। চায়ের দোকান দেখলেই তোর এই হ্যাংলামিটা অসহ্য।" ইত্যাদি, প্রভৃতি। 


আমার রাস্তায় দাঁড়িয়ে চা খাওয়া দিয়ে শুরু হওয়া দাম্পত্য কলহের পরিণতিতে যে উনি স্পিচ ভাবতে পারলেন না, সেটা সেদিন মধ্যরাত থেকে পরদিন সকাল আটটা অবধি ক্রমাগত বলে গেলেন তিনি। ফলতঃ প্রজাতন্ত্র দিবসের মূল অনুষ্ঠানে যখন ঘোষক ঘোষণা করলেন," এবার বক্তব্য রাখবেন মাননীয় মহকুমা শাসক", বেশ ভয় পেয়ে গেলাম আমি,কি বলবে রে বাবা লোকটা। কিছুতো মক্সই করেনি। ঝাড়া তেরো মিনিট বকে গেল শৌভিক, সুস্পষ্ট উচ্চারণে সুচারু ভাষায়, অনুপম শব্দ চয়নে বলে গেল, ঠিক যেটা বলা উচিৎ, বলল- 


" সুপ্রভাত, আগত সকলকে, কাঁথি মহকুমা প্রশাসনের তরফ থেকে ৭৫ তম সাধারণতন্ত্র দিবসের শুভেচ্ছা এবং অভিনন্দন। ১৯৫০ সালের আজকের দিনে, ভারতের আপামর জনগণ সংসদীয় গণতন্ত্রের প্রতি অনুগত থাকার অঙ্গীকার গ্রহণ করেন। সেটা একটা প্রতীকী সূচনা-


 আমাদের শাসন ভার, ব্রিটিশ শাসনের অবসানের পর, ১৯৪৭ সালের ১৫ই আগস্ট, যখন ব্রিটিশ ইউনিয়ন জ্যাকের বদলে, আমাদের তিরঙ্গা হাওয়ায় উড়েছিল, সেই দিন আমাদের দেশ ইতিহাসের পাতায় স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে পরিগণিত হয়েছিল। কিন্তু ১৯৫০ সালের ২৬ শে জানুয়ারি, আমরা সংসদীয় গণতন্ত্রের প্রতি আমাদের আনুগত্যের অঙ্গীকার গ্রহণ করি। 


এই সংসদীয় গণতন্ত্র সম্পর্কে বলতে গেলে সাধারণ মানুষের ধারণা, যে প্রত্যেক মানুষ ভোট দিয়ে সরকার গঠন করতে পারে, এইটাই হচ্ছে সংসদীয় গণতন্ত্র। নিশ্চিত ভাবেই, ভোটাধিকার জনসাধারণের জন্য, জাতি ধর্ম লিঙ্গ নির্বিশেষে প্রত্যেকের জন্য 'একটি করে ভোট' অর্থাৎ আমাদের প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিকদের জন্য প্রত্যেকের ভোটাধিকার, এটা গণতন্ত্রের প্রধান স্তম্ভ বটে। তবে গণতন্ত্র এতেই তো শেষ হয় না। এর ব্যাপ্তি আরো বিশাল। 


যেদিন আমরা সংসদীয় গণতন্ত্রের প্রতি আনুগত্য স্বীকার করেছি, সেইদিন থেকেই আমরা অঙ্গীকার বদ্ধ, দেশের প্রতিটি মানুষের জন্য সুশাসন এবং তার জীবন ধারণের জন্য সুস্থ স্বাভাবিক পরিবেশ তৈরি করে দেওয়া। এটা প্রত্যেক নাগরিকের সাধারণ অধিকার। অধিকার শুধু ভোটের নয়। ভোট দেবার অধিকার নয়, সেটা পাঁচ বছরে একবার আসে। নিশ্চিত ভাবেই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। যে আমাদের দেশ কারা শাসন করবে, সেটা আমরাই, নিজেরা নির্ধারণ করব। 


একটা নির্দিষ্ট সময় পাঁচ বছর, যেটা আমাদের সংবিধান বলে দিয়েছে, পাঁচ বছরের জন্য দেশের শাসন ভার, কাদের ওপর ন্যস্ত থাকবে সেটা আমাদের জনগণ ঠিক করে দেবে। কিন্তু যাদের হাতে আমরা শাসনভার অর্পণ করি, তাদের কাছ থেকে কড়ায়গণ্ডায় অধিকার বুঝে নেবার ক্ষমতাও কিন্তু সংবিধান আমাদের দিয়েছে। ১৯৫০ সালের ২৬ শে জানুয়ারি, আমাদের সমস্ত অধিবাসী, সমস্ত ভারতবাসী এতে অঙ্গীকার বদ্ধ হন, যে তাঁরা নিজেদের অধিকার নিজেরাই বুঝে নেবেন। 


কিসের অধিকার? শিক্ষার অধিকার, স্বাস্থ্যের অধিকার, সুস্থ ভাবে বেঁচে থাকার অধিকার, মত প্রকাশের অধিকার, সাংস্কৃতিক অধিকার। এগুলো সবই গণতন্ত্রের অঙ্গ।গত ৭৫ বছর ধরে,এটা আমাদের নিরলস সংগ্রাম। অর্থাৎ ১৯৫০ সালের ২৬ শে জানুয়ারি, যেমন একটা সংগ্রামের শেষ ইঙ্গিত করে, অর্থাৎ ব্রিটিশ শাসনের জোয়াল আমরা কাঁধ থেকে নামিয়ে, নিজেদের হাতে শাসনভার গ্রহণ করলাম, তেমনি ভাবে আর একটা সংগ্রামের সূচনাও করে। যেটা আরো অনেক কঠিন।আরো অনেক দুরূহ।


কারণ এখানে প্রতিপক্ষ সুনির্দিষ্ট নয়।নিজেদের অধিকার বুঝে নেওয়ার এই যে সংগ্রাম, এতে প্রশাসন অঙ্গাঙ্গী ভাবে জড়িত। আমাদের দেশ কল্যাণকামী রাষ্ট্র, এতে প্রত্যেক নাগরিককে, প্রান্তিকতম মানুষকে পরিষেবা পৌঁছে দেওয়া, এ সরকারের অঙ্গীকার। সে যে কোন সরকারই হতে পারে। ৭৫ বছর ধরে এই কাজ, বিভিন্ন স্তরে, আমাদের সরকার করে আসছে। তাতে কতটা সফল, কতটা ব্যর্থ তার খতিয়ান দেওয়ার কাজ আমার নয়।সেটা করার জন্য বিশেষজ্ঞরা আছেন। সমালোচনা করার অধিকার গণতন্ত্রই আমাদের দিয়েছে। সমালোচনা থাকবেই, কিন্তু প্রশাসন নিরলস ভাবে প্রচেষ্টা করে যাচ্ছে, যে প্রান্তিকতম মানুষটিও যেন সরকারী পরিষেবা থেকে বঞ্চিত না হন। 


এই সরকারী পরিষেবা আগে,মূলত কেন্দ্রীভূত থাকত আধিকারিকের করণ গুলিতে। সেটা কলকাতা হতে পারে, সেটা জেলাশাসকের দপ্তর হতে পারে, মহকুমা শাসকের দপ্তর হতে পারে, সমষ্টি উন্নয়ন আধিকারিকের দপ্তর হতে পারে, ওসি, আইসি, ডিএসপি, এসপির অফিস হতে পারে। কিন্তু প্রান্তিকতম মানুষ গুলির পক্ষে, পিছনে পড়ে থাকা মানুষ জনের পক্ষে, হতদরিদ্র, মহিলা, শিশু তাদের পক্ষে হয়তো ঐ প্রশাসনিক স্তর পর্যন্ত পৌঁছানো সম্ভব হয় না। সেই জন্য এখন প্রশাসন পৌঁছে গেছে ঘরে, ঘরে। এটাও গণতন্ত্রের অঙ্গ। প্রশাসনের গণতান্ত্রীকরণ। 


প্রশাসন উপভোক্তার দরজায় পৌঁছে যাচ্ছে , এখানে প্রত্যেক ব্যক্তি, প্রত্যেক নাগরিক, প্রত্যেক মানুষ সরকারি পরিষেবার উপভোক্তা। প্রশাসন প্রত্যেকের দরজায় দরজায় পৌঁছাচ্ছে, তাদের সুখ দুঃখের কথা, অভাব অভিযোগের কথা শুনছে, জানছে, পরিষেবা প্রদান করছে। আপনারা দেখেছেন, বিগত তিন চার বছর ধরে, দুয়ারে সরকার কর্মসূচি কত সফল ভাবে রূপান্তরিত হচ্ছে। এখন 'জনসংযোগ' কর্মসূচি চলছে। সাধারণ নাগরিকের কাছে সুযোগ আছে, সর্বোচ্চ স্তরে, এমনকি মুখ্যমন্ত্রী পর্যন্ত তার অভাব অভিযোগ পৌঁছে দেওয়া এবং তার দ্রুত যাতে নিষ্পত্তি হয় সেই ব্যাপারে প্রশাসন সর্বৈব ভাবে সচেষ্ট। 


আপনারা দেখেছেন বিভিন্ন রকমের উৎসাহ বর্ধক ভাতা এবং অন্যান্য যে পরিষেবা গুলো আছে, তাতে বৈষম্য মেটানোর চেষ্টা করা হয়েছে। শিক্ষা ক্ষেত্রে লিঙ্গ বৈষম্য একটা বড় অন্তরায় আমাদের উন্নয়নের পথে। সে ক্ষেত্রে আমাদের কন্যাশ্রী প্রকল্প কতটা কার্যকরী হয়েছে, সেটা পরিসংখ্যান দিয়ে আমি আজকে আপনাদেরকে ভারাক্রান্ত করব না। কিন্তু আপনারা প্রত্যেকেই জানেন, আপনাদের ঘরের কন্যা সন্তানদের শিক্ষা প্রদানে উৎসাহ দেবার জন্য সরকার কিছু প্রচেষ্টা নিয়েছে। 


প্রত্যেকে ছাত্রছাত্রীর ঘরে ঘরে সাইকেল পৌঁছে দেওয়া হয়েছে। শহুরে মানুষেরা হয়তো এর গুরুত্ব বুঝতে পারেন না, কিন্তু গ্রামাঞ্চলে, প্রত্যন্ত গ্রামে এই দূরত্ব যে কি বিশাল একটা অন্তরায়, মানে ফিজিক্যাল ডিসটেন্স যাকে বলে সেটা যে কি বিশাল একটা অন্তরায়, সেটা যারা ভুক্তভুগী তারা জানেন। তাদের কাছে সাইকেল মানে, পরিষেবা কত কাছে চলে আসছে। 


বিভিন্ন রকমের ভাতা প্রদান করা হয়েছে। অনেকে বলবেন যে মাসে পাঁচশ টাকা, হাজার টাকা প্রদান করে কি হবে? কিন্তু যদি আপনি দেখেন যে বছরে ছয় হাজার টাকা বা বারো হাজার টাকা - সেটা কিন্তু বেশ অনেকখানি টাকা। এছাড়া এটার একটা প্রতীকী অর্থ আছে, যে অর্থনীতিরও তো বিকেন্দ্রীকরণ হল। কিছু সম্পদ শুধুমাত্র কুক্ষিগত ভাবে কিছু গোষ্ঠীর কাছে রয়ে গেল না। সমস্ত মা বোনদের কাছে, বিধবাদের কাছে, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কাছে একটা সাম্মানিক ভাতা পৌঁছচ্ছে সরকার প্রতি মাসে। সরকার তাদের এই অর্থনৈতিক স্বাধীনতাকে স্বীকৃতি দিচ্ছে। 


বিভিন্ন ধরণের ক্ষুদ্র এবং মাঝারি উদ্যোগ গড়ে তোলার জন্য সরকার প্রচেষ্টা নিচ্ছেন, এটাও গণতন্ত্রের অঙ্গ। শুধুমাত্র বৃহৎ পুঁজিপতিরা শহরাঞ্চলে বসে উদ্যোগ গড়ে তুলবেন, তা নয়। বিভিন্ন স্বনির্ভর গোষ্ঠী, মহিলারা তাদেরকে উৎসাহ দেওয়া হচ্ছে, ঘরে, ঘরে ছোট, ছোট উদ্যোগ গড়ে তোলার জন্য। ভবিষৎ ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে যুব সম্প্রদায়কে উৎসাহ দেওয়া হচ্ছে, ছোট, ছোট উদ্যোগ গড়ে তোলার জন্য। কর্ম সংস্থান তৈরি করার জন্য। এগুলোও গণতন্ত্রের অঙ্গ। প্রশাসনের গণতান্ত্রীকরণ।


এর সঙ্গে আছে সাংস্কৃতিক গণতান্ত্রীকরণ। আপনারা জানেন যে জেলায় জেলায় মহকুমা স্তরে, এখন নাট্যমেলা, বইমেলা সরকারী পৃষ্ঠপোষকতায় সংগঠিত করা হয়। আগে এগুলি ছিল পুরোপুরি কলকাতা কেন্দ্রীক, শহর কেন্দ্রীক। যেন সংস্কৃতি মহানগরের কিছু শিক্ষিত জনগণের জন্য নির্দিষ্ট করা থাকত। কিন্তু এখন তা নয়। আপনারা, কাঁথিবাসীরা জানেন, আমাদের ঐতিহাসিক টাউন হল আছে, সেখানে বিভিন্ন সময়, বিভিন্ন ধরণের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়, জেলায় জেলায় নাট্যোৎসব হয়। বইমেলা হয়। যাত্রা উৎসব হয়। লোক সংস্কৃতির প্রসারের জন্য লোকপ্রসার শিল্পীদের উৎসাহ বর্ধক ভাতা প্রদান করা হয়। এরফলে লোক শিল্পের প্রসার ঘটে। এটা সাংস্কৃতিক গণতান্ত্রীকরণের অঙ্গ।


তো, আমার বক্তব্য যেটা, সেটা হচ্ছে যে, শুধুমাত্র ভোটাধিকার প্রয়োগে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হয় না। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হয় এই ধরণের সামাজিক, আর্থিক, সাংস্কৃতিক গণতান্ত্রীকরণের মাধ্যমে। এই প্রচেষ্টা, আমাদের প্রশাসনের নিরলস ভাবে চলছে। এবং এই সংগ্রামের কোন শেষ নেই। শেষ সেদিনই হবে, যেদিন জাতি হিসেবে আমরা বিলুপ্ত হব। এটা নিজেদের প্রতিষ্ঠার লড়াই, এই প্রতিষ্ঠার লড়াই জারি থাকবে। এবং সংগ্রামে কাঁথিবাসীরা সর্বদাই দেশের মধ্যে অগ্রগণ্য। দেশপ্রাণ বীরেন্দ্রনাথ শাসমলের জন্মভূমি এই মহকুমা। আরো কতশত বীর সন্তানসন্ততি তাদের জীবন, সর্বস্ব বাজি রেখে আজকে আমরা এই প্রজাতন্ত্র দিবস যাতে পালন করতে পারি সেটা সুনির্দিষ্ট করেছেন। বিদেশী শাসনের হাত থেকে দেশকে মুক্ত করেছেন। সেই ধরোহর আমাদের বয়ে নিয়ে যেতে হবে, আজ এই পবিত্র দিনে, কৃতজ্ঞ চিত্তে, তাঁদের অবদান আমরা স্মরণ করি, এবং আরো একবার অঙ্গীকার বদ্ধ হই, যে সংগ্রাম শুরু হয়েছিল, ১৯৫০ সালের ২৬ শে জানুয়ারি, সেই সংগ্রাম আমরা থামতে দেব না। আমরা এগিয়ে নিয়ে যাব এবং স্বশক্ত দেশ, স্বশক্ত রাজ্য গঠন করার এই যে প্রতিজ্ঞা আমরা নিয়েছি, তাতে আমরা সফল হব। আরেকবার সকলকে শুভেচ্ছা জানিয়ে, নমস্কার জানিয়ে, আমি আমার বক্তব্য শেষ করছি, ধন্যবাদ, জয় হিন্দ।"


অনির ডাইরি ১৮ই জানুয়ারি, ২০২৪

#অনিরডাইরি 



"আজকে স্কুলে একটা দারুন ঘটনা ঘটেছে, জানো তো বাবা।" প্রাত্যহিক নৈশভোজটা এই সংলাপ দিয়েই শুরু হয় আমাদের। আজও তার ব্যতিক্রম হল না। রোজই কোন না কোন রোমাঞ্চকর ঘটনা ঘটে শ্রীমতি তুত্তুরীর স্কুলে, অথবা  তিনি কোন না কোন প্রাপ্তবয়স্ক ব্যাপার-স্যাপার শিখে আসেন, স্কুল থেকে। অন্তত তিনি তাই মনে করেন, বটে। সেই প্রাপ্তবয়স্কতার বহর দেখে  শৌভিক আর আমি হাসতে হাসতে বিষম খাই আর কি।


সেদিন যেমন তিনি বললেন, যে তিনি আর তাঁর  এক সহচরী মিলে পাশের ক্লাসের কয়েকজন ষণ্ডাগুণ্ডা ছেলেকে উদোম ঝেড়েছেন। সহচরী মেয়েটি তো একটি ছেলের কলারই চেপে ধরেছিল নাকি রাগের চোটে। নেহাৎ শ্রীমতী তুত্তুরী ছিলেন - বাবা, বাছা করে অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতি সামলান কোন মতে। 


আমি একনিষ্ঠ নারীবাদী, মেয়েদের গায়ে হাত তোলাটা যেমন সহ্য করতে পারি না,ঠিক তেমনি ছেলেদের গায়ে হাত তোলাটাও আমার ঘোরতর না পসন্দ। শ্রীমতী তুত্তুরী ও সেটা জানেন। একরাশ বিরক্তি চেপে জানতে চাই, খামোকা কলার চেপে ধরতে হল কেন? শ্রীমতী তুত্তুরী হাতের আস্তিন গোটাতে গোটাতে বলেন, " করব না? ওরা আমাদের ক্লাসের সন্দর্ভর সাথে কি করেছে জানো? ওয়াশরুমে তিনজনে মিলে ঘিরে ওর প্যান্ট ভিজিয়ে দিয়েছে -"। 


তিনটে ছেলে মিলে একটা ছেলের প্যান্ট কিভাবে ভিজিয়ে দিল? হয়তো সেই প্রশ্নটাই ফুটে উঠেছিল আমার মুখে চোখে,  শ্রীমতি তুত্তুরী হাত দেখিয়ে থমকে বলে, " আঃ মা! জেট স্প্রে দিয়ে ভিজিয়েছে, অন্য কিছু নয়।" "একটা ছেলে অপদস্ত হয়ে, পালিয়ে এসে, তোদের বলল - আর ওমনি তোরা দুই বীরাঙ্গনা গেলি তার বিচার করতে?" প্রশ্ন করি আমি। শ্রীমতি তুত্তুরী নির্বিকার মুখের বলেন, " পৃথা প্রিফেক্ট আর আমি হলাম মনিটর। ক্লাসের সম্মানহানি হলে, তো আমাদেরই দেখতে হবে। আমাদেরই যেতে হবে তা পুনরুদ্ধার করতে।" 


বলতে বলতে থমকে দাঁড়ায় তুত্তুরী, শৌভিকের দিকে ফিরে বলে, " এই বাবা তোমার ওই যে সহকর্মী আছেন না, অমুক বাবু- ওনার ছেলেটাও না ওই ক্লাসেই পড়ে। আমরা যখন ঢুকছি, সে চিৎকার করছিল, "অন্য সেকশনের মেয়েরা আমাদের ক্লাসে ঢুকছে-।" পৃথা এমন ধমক লাগাল, ছেলেটা কাচুমাচু মুখে বসে পড়ল। আমি পিছন থেকে ইশারায় বললাম,  চুপ করে বসে থাকো, আমরা এখুনি চলে যাব। তবে কি জানো তো বাবা, আমাদের এত ঝগড়াঝাঁটি- সব বৃথা। ওরা যখন বলল আমাদের ক্লাসের ছেলেটা ওদের কি গালাগাল দিয়েছিল, লজ্জায় মাথা কাটা গেল আমাদের। এমন খারাপ গালাগাল কেউ দেয়, হাজার হোক একই স্কুলে তো পড়িস, বাপ মা তুলে এমন গালাগাল দিবি-  ছি ছি! স্যারকে ওরাও নালিশ করেছিল, আমরাও করেছিলাম। স্যার সব শুনে বললেন, " হ্যাঁরে বন্ধু-বান্ধবের বাবা-মাও যে পিতৃমাতৃ তুল্য হয় রে হারামজাদা। বলবার আগে একটু ভেবে বলবি না বাবা।" 


গল্প বদলে যায় দিন থেকে দিনান্তে। শ্রীমতি তুত্তুরী বলেন," আজ আমাদের সিসিএ( Co-curricular Activity) ক্লাস হয়নি। পাশের ক্লাসের মিস এসে বলে গেলেন, আস্তে আস্তে গানের লড়াই খেলতে। বেশি হইচই না করে। আমরা তাই খেলছিলাম, মেয়েরা অন্তত সবাই খেলছিল। ছেলেরা যা করে, তাই করছিল, নিজেদের মধ্যে গল্প, গুজগুজ -ফুসফুস, হাহা হিহি। আওয়াজ বেশি হলে ধমক লাগাচ্ছিলাম পৃথা আর আমি।  এর মধ্যে হয়েছে কি, একটা ছেলে আর একটা ছেলেকে বলেছে,  "'সিসিএ'র ফুলফর্ম কি বলত?" যাকে প্রশ্ন করেছে, সে একটা চিরকুটে যাচ্ছেতাই একটা  লিখে দিয়েছে, সে যে কি খারাপ কথা, মা কি বলবো তোমায়। সেই চিরকুট তারপর ঘুরে বেরিয়েছে গোটা ক্লাসময়। অবশেষে গিয়ে পৌঁছেছে ক্লাস টিচারের হাতে।


শৌভিক পুরাণ পাপী, তুখোর বুদ্ধিমান, অন্তত এই সব ব্যাপারে, "হুঁ" ছাড়া কিচ্ছু বলল না। আমি ট্যালা,  প্রশ্ন করি কি লেখা ছিল চিরকুটে? এই প্রশ্নের জন্যই বুঝি অপেক্ষা করছিল শ্রীমতী তুত্তুরী। অকপটে জানায়, কি লেখা ছিল চিরকুটে। শিরদাঁড়া দিয়ে পলকে বয়ে যায় হিমেল তরঙ্গ। ওরে আমি কলেজেও এইসব জানতাম না রে -। " সত্যি জানতে না?" অবিশ্বাসী মুখে প্রশ্ন করে তুত্তুরী, আমার জবাবে খুশি হতে না পেরে প্রশ্নবাণ ধেয়ে যায় বাবার দিকে, " আমার বয়সে তুমিও কি জানতে না।" " তোর মা ছাড়া সবাই জানত। ছাড়, একটা প্রশ্নের জবাব দে,টিচারকে কে লাগাল? তুই?" " না, না আমি না।" আতঙ্কিত সুরে বলে  তুত্তুরী। বন্ধুদের নামে চুকলী না কাটার শিক্ষাই দিয়েছি আমরা মেয়েকে। " যে লিখেছিল, তার গার্লফ্রেন্ডই টিচারকে লাগিয়েছে।" 


গত দুদিন ধরে সন্দর্ভ আবার ফিরে এসেছে আমাদের ডাইনিং টেবিলে। ইনিই সেই মহাপ্রাণ, যিনি প্যান্টুল ভিজিয়ে মনিটরদের পিছনে আত্মগোপন করেছিলেন। কালকের গল্পে জনৈক  স্যার যখন রিভিশন দিচ্ছিলেন, তখন ইনি পিছন থেকে আওয়াজ দেন, "ওরে কেউ জানতে চায় না রে" বলে। তুত্তুরীর বক্তব্য মোতাবেক স্যার মানুষটি অত্যন্ত সহৃদয়, নরম স্বভাবের। তাই গতকাল সামান্য কানমলা, দুটো গাঁট্টা আর তিনটে চিমটিতেই মিটে যায় ব্যাপারটা। স্যার শুধু যাবার সময় অভিমান করে বলে গিয়েছিলেন, "কাল থেকে আমার ক্লাসে যেন তোর টিকিটাও না দেখতে পাই।" আজ অবশ্য তিনি সে সব বেমালুম ভুলে গিয়ে নতুন করে রিভিশন শুরু করেন।ফাইনাল  পরীক্ষার আগে ওই স্যারের শেষ ক্লাস, ভালোই চলছিল,যে যা বলছিল, যার যা অবোধগম্য স্যার আবার নতুন করে বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন, সন্দর্ভ বাবুর বুঝি সেটা সহ্য হল না। পিছন থেকে আওয়াজ দিলেন," এত বকে কেন রে লোকটা!"


আরো অনেক কিছু বলার ছিল তুত্তুরীর, আরো অনেক কিছু বলতও হয়তো। কিন্তু আমার কানে খট করে লাগল একটাই কথা,' পরীক্ষার আগে শেষ ক্লাস'। মাঝপথে মেয়েকে থামিয়ে প্রশ্ন করলাম, পরীক্ষার রুটিন দিল কি? কি করে জানল এটাই শেষ ক্লাস?  এক আঁটি নিম পাতা চিবানোর মতো মুখ করে জানায়, তুত্তুরী, " হুঁ। দিয়েছে।" অতঃপর বিদ্রোহী কণ্ঠে, " স্কুলটা একদম ভালো নয়। প্রায় এক মাস জুড়ে পরীক্ষা চলবে। ওই কটা তো সাবজেক্ট, রোজ দুটো করে দিলেই তো হয়ে যায়।"


" তুমি তো সেটা বলবেই মা, ল্যাংটার নেই বাটপাড়ের ভয়-" বলি আমি। প্রতিবাদ করতে উদ্যত তুত্তুরীর দিকে তাকিয়ে শৌভিক বলে, " দুটো? মাত্র দুটো? চারটে করে দিলেও ওর কোন সমস্যা হবে না। বরং যারা ভালো ছেলেমেয়ে যারা, তাদের ফল খারাপ হয়ে যাবে। ওর এমনিতেও যা, অমনিতেও -"।


এরপর আলোচনা দীর্ঘায়িত হলে যে ওনারই সমস্যা, বুঝে চেয়ার ঠেলে উঠে পড়েন তুত্তুরী। এঁটো প্লেট আর জলের গ্লাসটা তুলে রান্নাঘরের দিকে অগ্রসর হন, হতে হতে বলেন, "আগে আমি পড়াশোনা করতাম না বটে, এটা সত্যি। তখন আমি ভেড়া ছিলাম। কিন্তু এখন আমি রক্তের স্বাদ পেয়েছি, এখন আমি -"। আরো হয়তো কিছু জ্ঞানগর্ভ প্রবচন লাভ হত, বাগড়া দিল শোভিক, "হুঁ,তাই ও এখন রক্তের স্বাদ পাওয়া ভেড়া হয়েছে।" আজকের নৈশ ভোজের আসরের এখানেই ইতি। দেখা যাক আবার কাল কি কিসসা নিয়ে আসেন, গুণধরী, শ্রীমতী তুত্তুরী।

অনির ডাইরি ১৬ ই জানুয়ারি, ২০২৪


#অনিরডাইরি #কাঁথিরকিস্যা 


ফিরিঙ্গি ভাষায় কাঁপা কাঁপা গলায় জানতে চাইলেন ভদ্রলোক, “ আমি কি কাঁথির মহকুমা শাসকের সঙ্গে কথা বলছি?” ঘড়িতে রাত নটা। এই মরশুমে প্রথম জমিয়ে শীত পড়েছে কাঁথিতে। হিমের পরশ মেখে বাগানে ঘুরছিলাম দোঁহে। আজ বাড়ি ফিরতে বেশ রাত হয়েছে শৌভিকের, তারপরও এসেছিলেন জনৈক সুহৃদ, তাকে যথোচিত আপ্যায়ন করে, সঙ্গ দিয়ে, বিদায় জানিয়ে হাঁটতে বেরিয়েছে বউয়ের সঙ্গে। দিনান্তে এটাই আমাদের নিখাদ দাম্পত্যালাপের সময়। সারাদিনে কার কি অভিজ্ঞতা হল ভাগ করে নিই আমরা। তার মাঝে অনন্ত গোটা চারেক ফোন তো আসেই। 


Dমুখ দিয়ে একরাশ ধোঁয়া ছেড়ে সাহেবী ঢঙে আমার বর বলল,‘ বলছি-’। ওপাশের ভদ্রলোক এবার নেমে এলেন নিখাদ বাংলায়। ‘ভাই আমিও এককালে কাঁথির মহকুমা শাসক ছিলাম। তখন নব্বইয়ের দশক।” ভদ্রলোক দীঘা আসতে চান, কোন সরকারী ব্যবস্থা আছে কি না জানতে ফোন করেছেন। R শৌভিক মাঝে মাঝে বলে,‘হসপিটাল আর হসপিটালিটি নিয়েই আছি-’। হসপিটাল অর্থাৎ বাবা- মা, শ্বশুর-শাশুড়ির শরীর স্বাস্থ্য (কারো কিছু হলেই মহানগর থেকে কাঁথি টেনে আনি আমরা। এখানকার সরকারী ডাক্তারবাবুরা সাক্ষাৎ ধন্বন্তরী) আর হসপিটালিটি বলতে দীঘা- মন্দারমনি। কত লোক যে আসে, কতরকম যে অনুরোধ-উপরোধ-আব্দার আসে। 


ইনি অবশ্য তেমন কিছু চাইলেন না। সার্কিট হাউস পাওয়া যাবে কি না জিজ্ঞাসা করলেন। দীঘায় কোন সার্কিট হাউস নেই শুনে বিড়বিড় করলেন সামান্য,‘ আগে তো ছিল। তুমি ইয়ে মানে আপনি ঠিক জানেন। ’ শৌভিকK হেসে জবাব দিল, তেমনি তো জানি। তবে পর্যটন দপ্তরের লজ আছে আরও অন্যান্য কয়েকটা সরকারী দপ্তরের থাকার জায়গা আছে, উনি চাইলে Dবুক করে দেওয়াই যায়। ভদ্রলোক অনুরোধ করলেন, খুব দামী যেন না হয়, ‘বুঝতেই পারছ Rরিটায়ার্ড মানুষ। ঘর থেকেই সমুদ্র দেখা গেলে ভালো হয়, বুঝতেই পারছ বয়স হয়েছে।”


Kকথাবার্তা শেষ হলে দুজনে বসার ঘরে টাঙানো বিশাল বোর্ড গুলোর সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম, বৃটিশ আমল থেকে কাঁথির যাবতীয় মহকুমা শাসকদের নাম আর পিরিয়ড নথিভুক্ত আছে হেথায়। নব্বইয়ের দশকে জাজ্বল্যমান ভদ্রলোকের নাম। প্রায় আড়াই বছর ছিলেন এই পদে। থাকতেন এই বাংলোয়। তখন অবিভক্ত মেদিনীপুর, ডিএম সাহেব বসতেন সুদূর মেদিনীপুর শহরে। ফলে কাঁথির মহকুমা শাসকের দাপট ছিল আজকের থেকে বহুগুণ বেশি। রীতিমত Dদণ্ডমুণ্ডের কর্তা ছিলেন যিনি, আজ তিনি একরাশ কুণ্ঠা নিয়ে সামান্য অনুরোধ করছেন তাঁরই ছেড়েR যাওয়া চেয়ারের বর্তমান দখলদারের কাছে। 


এই তো জীবন কালী দা। আমাদের সরকারী চাকKরির এটাই তো বৈশিষ্ট্য, চিত্রনাট্য একই থেকে যায়, কুশীলব বদলে যায় মুহূর্ত থেকে মুহূর্তান্তরে। তবুও মানুষের কত না গর্ব আর কতই না অহঙ্কার। পারলে সার্ভিস আর পদের নাম কপালে ট্যাটু করিয়ে রাখে। ঐ যে কোন মহানুভব লিখেছেন না, যে এত কষ্ট করে পরীক্ষা দিয়ে এত্ত বড় চাকরি পেয়েছেন, তাই তিনি সুপ্রতিষ্ঠিত লোকজন ছাড়া বাকিদের সাথে বন্ধুত্বে নারাজ। বলি ভাই রে তুই একা নোস, তোর মত মানুষজন বিগত প্রায় দুই দশকে কত যে দেখলাম। নতুন চাকরি পেলে অমন পুলক জাগেই, সবার জাগে। সোশাল মিডিয়ায় গর্বিত পোস্টের বন্যা বইয়ে দেয় লোকজন। কত স্বপ্ন, কত উচ্চাকাঙ্ক্ষা, কত বিপ্লব। তারপর যখন ফিল্ডে নামানো হয়, টের পায় "ঠ্যালার নাম বাবাজী" কারে কয়। 


চাকরি এবং চেয়ারটাকে অফিসেই রেখে আসা মঙ্গল, মাথায় চাপিয়ে ঘুরলে, অত ভার মাথায় নিলে গোমূত্র- গোময় মার্কা পোস্টই তো করবে। ভালো থাকুন না ভাই, সুখে থাকুন, অন্যদেরও থাকতে দিন। আজ বাঙালীর মকর সংক্রান্তি বলে কথা। পেট পুরে পিঠে পুলি খান। 


কত কি যে বানানো হয়েছে আজ এবাড়িতে- নোনতা পুলিই দুই রকম, তারওপর আছে মিষ্টি পুলি, শৌভিকের প্রিয় পাটি সাপটা, তুত্তুরীর প্রিয় দুধ পুলি, চুষির পায়েস, মালপোয়া, আমার প্রিয় ভাজা পিঠে বা মুগ সামলি। সৌজন্য লতা দি আর রঞ্জিত। চুষি গুলো অবশ্য শ্রীমতী তুত্তুরী পাকিয়েছেন (কিছুটা)। 


সন্ধ্যা নামলে মহকুমা শাসকের নিবাসে পাকশালা সামলাতে আসে রঞ্জিত। মহকুমা শাসক বদলে যায়, বাংলোর দখল নেয় জেলা থেকে জেলান্তর, প্রদেশ থেকে প্রদেশান্তের মানুষ। রঞ্জিত ও শিখে নেয় তাদের রন্ধনশৈলী, তাদের পছন্দের খাবার। রঞ্জিত সব পারে, ম্যাগী দিয়ে ঝালমুড়ি থেকে আলুর পরোটা, বিট- জিরে -গরম মশলা দিয়ে চাউমিন থেকে সেজওয়ান স্যুপ, মোমো থেকে বিরিয়ানি, ধোসা থেকে স্টিলের বাটিতে করে ইডলি এমনকি পিজ্জাও। বাড়িতেই এমন পিটা ব্রেড বানিয়ে পিজ্জা করেছিল যে খেয়ে তুত্তুরীর বন্ধুরা তো বিমোহিত। রোজ মেয়েকে জপায়,‘ঐটা আবার দিতে বল কাকিমাকে’। 


এহেন রঞ্জিতের মনে বড়ই দুখ, যবে থেকে আমরা এসেছি, এলাহি খাওয়াদাওয়া সব বন্ধ। অধিকাংশ রাতেই রুটি আর কুমড়োর ঘ্যাঁট খাই আমরা। তাও ন্যূনতম তেল মশলা দিয়ে। অতিরিক্ত বলতে স্যালাড বড় জোর। সেটাও কত সুন্দর করে কাটে ছেলেটা।রান্না হয়ে গেলে গালে হাত দিয়ে বসে থাকে ছেলেটা, এত্ত এত্ত যে রান্না শিখল,সেগুলি কাজে লাগবে কবে? স্যারকে যে খাইয়ে খুশি করবে তার কি যো আছে। একে তো সাহেব কিছুই খায় না, তাও যে একটু বেশি মশলা দিয়ে জমিয়ে রাঁধবে তারও উপায় আছে নাকি? শ্যেন দৃষ্টিতে নজর রাখে লতাদি। 


 আজ অবশ্য রঞ্জিত পুরো লাগাম ছাড়া, সঙ্গতে লতা দি খোদ যে। কে জানে কাল কি হয়,কোথায়, কোন নাটকের কোন কুশীলবের চরিত্রে অবতীর্ণ হতে হয়,তবে সে তো কালকের কথা,কাল ভাবব ক্ষণ। আপাতত তো এনাদের সদ্ব্যবহার করি। শুভ মকর সংক্রান্তি। শুভ পিঠে পুলি ভক্ষণ দিবস।




অনির ডাইরি, ১২ই জানুয়ারি, ২০২৪

#অনিরডাইরি #কাঁথিরকিস্যা 

বেরিয়েই পড়েছিলাম আমরা, এমন সময় ঘোষণা হল," - গান গাইতে আসছে,আমাদের হোমের দৃষ্টিহীন ছাত্রী -"। সামনের সারি থেকে যে মেয়েটি উঠে দাঁড়াল, তার বয়স কত হবে, ৭/৮ বড় জোর। পরণে নেভি ব্লু রঙের স্কুল ইউনিফর্ম।পাশের প্লাস্টিকের চেয়ারে বসা, একই রকম ইউনিফর্ম পরা, মানসিক প্রতিবন্ধী শিশুটি তখনও আঁকড়ে ধরে আছে মেয়েটির হাত। ঘোষক ঘোষণা করে চলেছেন, " ১০০% দৃষ্টিহীন মেয়েটিকে সঙ্গীত পরিবেশনে সহায়তা করছেন -"। 


তাকিয়ে দেখি বেশ অনেকটা এগিয়ে গেছে শৌভিক, কাতর স্বরে অনুরোধ করলাম, " এই গানটা শুনে যাই একটু, প্লিজ।" ঘড়ি দেখল শৌভিক, আজ স্বামী বিবেকানন্দের জন্মতিথিতে ওনারই নামাঙ্কিত এই প্রতিষ্ঠানে আমন্ত্রিত হয়ে এসেছি আমরা। মহকুমা শাসক পদাধিকার বলে এখানকার কি যেন কর্তাও বটেন, তাই বেশ অনেকক্ষণ ধরে প্রতিষ্ঠানের প্রতিটি অংশ ঘুরে ঘুরে দেখেছি আমরা, মানে শৌভিক। তুত্তুরী আর আমি ওনার লেজুড়। 


বিশাল এলাকা জুড়ে আশ্রমটা। মাঝে রয়েছে প্রশস্ত খেলার মাঠ, বাচ্ছাদের পার্ক, সাঁতার শেখার জলকুণ্ড। সবকিছুকে ঘিরে অনুপম বাগিচা, সেথা উপচে পড়ছে রংবেরঙের পুষ্প সমাহার। এত বড় গোলাপ জীবনেও দেখিনি আমি। একেকটা মুঠোয় ধরা যাবে না এমন সাইজ, আর তেমনি রংবাহারি। আর এই সব কিছুকে ঘিরে, বড় বড় বেশ কয়েকটা তিন চার তলা বাড়ি। 


প্রথম বাড়িটার দোতলায় উঠে জুতো খুলতে হল আমাদের। সিড়ির মুখেই রাখা আছে বেশ কয়েক জোড়া হাওয়াই চপ্পল, তাতেই পা গলিয়ে প্রথম যে ঘরটায় ঢুকলাম, সেখানে দুটো ছোট ছোট দোলনায় ঘুমাচ্ছে দুই ফুটফুটে শিশু। মশারি টাঙানো, রুম হিটার থেকে ভেসে আসছে তপ্ত বাতাস। কর্মকর্তা মহিলা জানালেন, এখানকার বাচ্ছাগুলোকে 'পালনা'র মাধ্যমে পাওয়া গেছে। 


সিনেমায় যেমন দেখায় না, নবজাতক শিশুকে কাপড়ে মুড়ে, কোন অনাথ আশ্রমের বাইরে রেখে ঘন্টা বাজিয়ে চলে যায় মা, যেতে যেতে বারবার ফিরে তাকায় অশ্রু সজল চোখে, যা দেখে কেঁদে ভাষায় দর্শক, এই বাচ্ছাগুলিকে ঠিক ওই ভাবেই পাওয়া গেছে। কে বা কারা রেখে গেছেন,ছেড়ে গেছেন তাদের কোনো পরিচয় পাওয়া যায়নি।  একটির বয়স তিন মাস, অপরটির চার। ছোটটি মেয়ে, বড়টি ছেলে। শীঘ্রই অ্যাডপশনের জন্য নথিভূক্ত করা হবে এদের। দত্তকসন্তান গ্রহণে ইচ্ছুক দম্পতিরা, যারা অনলাইন আবেদন করে বসে আছেন, তাদেরই কারো জীবনে আলো জ্বালাতে চলেছে এরা।


সবার অবশ্য ভাগ্য অত ভালো হয় না, যেমন লতিকা (নাম পরিবর্তিত)। বয়স সাড়ে পাঁচ, দত্তক নিয়েও ফেরত পাঠানো হয়েছে আশ্রমে। পালক পিতামাতা নাকি মানিয়ে নিতে পারেননি বাচ্ছাটার সাথে। শুনে মন খারাপ হয়ে গেল। কৃষ্ণবর্ণ বাচ্ছাটি অসম্ভব হাসিখুশি আর চঞ্চল। দীর্ঘক্ষণ ধরে আমাদের সঙ্গে সঙ্গেই ঘুরছে, দুষ্টুমি করছে টুকটাক। পরনে সস্তার ছিট কাপড়ের ফ্রক আর সোয়েটার। মাথার তেলতেলে কালো কয়েক গাছি চুল নারকেল গাছের মতো ঝুঁটি করে বাঁধা। হাত বাড়িয়ে আদর করতে গেলাম মেয়েটিকে, উল্টে করমর্দন করে দিল মেয়েটি।


কত দম্পতি সন্তান চেয়েও পায় না। নথিভুক্তির পরও গালে হাত দিয়ে বসে থাকতে হয় তিন- সাড়ে তিন বছর। অবিবাহিত বলে আমার এক বন্ধু তো বাচ্ছা চেয়েও পেল না।  আর ওনারা বাচ্চা পেয়েও ফিরিয়ে দিলেন, একটা পাঁচ বছরের বাচ্ছার সঙ্গে সামান্য মানিয়ে নিতে পারলেন না। মুখ ফুটে বলেও ফেললাম কথাটা। যে রূপসী ভদ্রমহিলা পরম মমতায় বাচ্ছা গুলির সাথে পরিচয় করাচ্ছিলেন,  উনি বললেন, " কি আর বলব বলুন। ওনাদের ক্লাস/ স্ট্যাটাসের বাচ্ছা আমরা কোথায় পাব? তারা থোড়াই নবজাতক সন্তানকে অনাথ আশ্রমে ছেড়ে যাবে? সেটা আমরা বলেও দিই দত্তক নেবার আগে। কাউন্সিলিংও করাই, তাও-"। এই আশ্রমে ছয় বছর অব্দি রাখা হয় বাচ্ছাগুলিকে তারপর পাঠিয়ে দেওয়া হয় অন্য হোম বা আশ্রমে। হাসিখুশি মেয়েটির হাতে সময় মাত্র ৬ মাস, তারপর চলে যেতে হবে আশৈশবের পরিচিত পরিমণ্ডল ছেড়ে, দত্তককন্যা হয়ে কোন স্নেহশীল পরিবারে অথবা কোন অচেনা হোমে । শুনতে শুনতে মুখ শুকিয়ে যায় তুত্তুরীর। "জীবন এমন ও হয় মা -"


ওই ভাবে ছেড়ে যাওয়া বাচ্ছা ছাড়াও, দুস্থ পরিবারের কিছু শিশুও রয়েছে এই আশ্রমে। প্রতিপালনে অক্ষম বলে যাদের পরিবার এখানে রেখে গেছে।  আছে শারীরিক ভাবে প্রতিবন্ধী কিছু বাচ্ছাও। যাদের মধ্যে একটি বছর দেড়েকের ছেলে শীঘ্রই পাড়ি দেবে আমেরিকা। ছেলেটির কোমর থেকে নিম্নাঙ্গে কোন সাড় নেই, একটি হাতও সরু লিকলিকে। শান্ত হয়ে বসেছিল বেবি কটের রেলিং ধরে। কর্মকর্তারা জানালেন শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধী হলে সেই শিশুকে ভারতীয়রা দত্তক নিতে চায় না, কিন্তু বিদেশীরা নেয়। 


অনাথ আশ্রম, ব্লাইন্ড স্কুল, মানসিক প্রতিবন্ধী শিশুদের আবাসিক স্কুলের পাশাপাশি বৃদ্ধাশ্রমও চলে এখানে। বেশ কয়েকজন আবাসিক বৃদ্ধা আছেন। একতলার প্রশস্ত ঘরগুলিতে চারটি করে চৌকি পাতা। ওটাই ওনাদের বিছানা। প্রতিটি ঘরে দুটি করে জানালা, হুড়মুড়িয়ে আসছে ১২ই জানুয়ারির রোদ।  শৌভিক কথা বলল বেশ কয়েকজন আবাসিকের সঙ্গে। অনেকেই বললেন,  ভালো আছেন। একসাথে থাকেন, গল্পগাছা করেন, একসাথে খেতে যান, সন্ধ্যেবেলা দল বেঁধে টিভি দেখেন। জনৈক কর্মকর্তা ফুট কাটলেন, 'ঝগড়াঝাঁটিও করেন'। লম্বা বারান্দার একপ্রান্তে লিস্ট টাঙান, কবে, কখন কি খেতে দেওয়া হয় ওনাদের। আশ্রমের নিজস্ব ডাক্তার, পুষ্টিবিদ আছেন। আপদকালীন অবস্থা ছাড়া সপ্তাহে একদিন আসেন।


সেখান থেকে পরিত্যক্ত মহিলা বিভাগ। রাস্তায় যে সমস্ত নিঃস্ব মহিলা ঘুরে বেড়ান, যাদের কোথাও ঠাঁই নেই,এখানে তাদের আশ্রয় দেওয়া হয়। খবর পেলে পুলিশ -প্রশাসন থেকেও তুলে এনে এখানে রেখে যাওয়া হয়। এদের মধ্যে কেউ কেউ মানসিক ভারসাম্যহীনও হন। গার্হস্থ্য হিংসার শিকার এক মহিলার সাথে আলাপ হল,শিশু কন্যাকে বুকে জড়িয়ে বসে আছেন। স্বামী মেরে মেরে আধমরা করে দিয়েছিল। শরীরে এখনও দগদগে ঘা। মায়ের সাথে লেপ্টে থাকা শিশু কন্যাটির বয়স চার/পাঁচ। আর এক, দেড় বছরই এই আশ্রমে থাকতে পারবে, তারপর কি হবে কে জানে। মায়ের থেকে ওকে আলাদা হয়ে যেতে হবে শুনে ভিজে ওঠে তুত্তুরীর চোখের কোণ। " মানুষ এত নিষ্ঠুর হয় মা -" । 


এরপর রাস্তা পেরিয়ে, একই প্রতিষ্ঠানের নার্সিং কলেজ ঘুরে, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে হাজিরা দেওয়া- সবমিলিয়ে কেটে গেছে ঘন্টা দেড় থেকে পৌনে দুই। তারপর পুস্পস্তবক দিয়ে স্বাগত জানানো হয়েছে মহকুমা শাসককে। "গৌরবার্থে বহুবচন" হয়ে স্টেজে বসার সুযোগ এমনকি একখানি পুষ্পস্তবক পেয়েছি আমিও। শ্রীমতী তুত্তুরীর দিকে তাকিয়ে এমন ছদ্ম ব্যঙ্গের  হাসি হাসছিল শৌভিক, যে আমার স্তবকটাই তুলে দিলাম পাশে বসা কন্যার হাতে। তিনি অবশ্য কাল্পনিক বন্দুক দিয়ে বাবাকে গুলি করছিলেন। আমার সংসারে," এতো আকছার ঘটে, সাদা কালো লং শটে"।  আমাদের পারিবারিক নাটকে খুশি হয়ে জনৈক কর্মকর্তা অবশেষে তুত্তুরীর হাতেও দুটো কুচো ফুল তুলে দিলেন। এরপর মহকুমা শাসকের সংক্ষিপ্ত বক্তব্য প্রদান, সকলকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন, পরিচিত এক মাস্টারমশাইয়ের মধু ঢালা কন্ঠে, " মন চল নিজ নিকেতনে" শুনে বিদায় নেওয়া।


"অনুষ্ঠান চলতে থাকুক"বলে, মঞ্চ থেকে নেমে প্রস্থান লেখা দরজার দিকে বেশ খানিকটা এগিয়ে গিয়েছিল শৌভিক। আদুরে বউয়ের, এই গানটা শুনে যাওয়ার, আব্দার ফেলতে পারলেন না মহকুমা শাসক।‌ বসে পড়লেন নীচে পেতে রাখা একটি প্লাস্টিকের চেয়ারে। সামনে সারিতে দুটি আসন ফাঁকা ছিল, একটিতে বসল তুত্তুরী, অন্যটিতে বসতে গিয়ে বাধা পেলাম আমি। গায়িকার মানসিক প্রতিবন্ধী বন্ধুটি কিছুতেই আমাকে ছাড়বে না তার ফেলে যাওয়া বন্ধুর চেয়ার। অনেক আদর করে, মাথায় হাত বুলিয়ে, গান শেষ হলে চলে যাবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে তবে বসতে পেলাম আমি। 


মেয়েটি ততক্ষণে গান ধরেছে,

" একা মোর গানের তরী ভাসিয়েছিলাম নয়ন জলে,

সহসা কে এলে গো, এ তরী বাইবে বলে।" 

নির্ভীক কণ্ঠে গেয়ে চলে মেয়েটি, 

"যা ছিল  কল্পমায়া সেকি আজ ধরল কায়া,

কে আমার বিফল মালা পরিয়ে দিল তোমার গলে - " 

কেন যে এত করকর করছে চোখ দুটো।




অনির ডাইরি ৬ই জানুয়ারি, ২০২৪

#অনিরডাইরি 

 ইনিও সিংহম 




সম্ভবতঃ জানুয়ারি মাস, জাঁকিয়ে পড়েছে শীত। দীর্ঘদিন বাদে মহানগরে ফিরেছি আমরা। পথশ্রমের ক্লান্তিতে অবসন্ন দেহ, মহানাগরিক সুখাদ্যে পরিপূর্ণ উদর। একটু তাড়াতাড়িই শুয়ে পড়েছিলাম সবাই, হঠাৎ বেজে ওঠা শৌভিকের ব্যক্তিগত মুঠোফোনের আওয়াজে ধড়মড় করে উঠে বসলাম।


ঘড়িতে রাত সাড়ে এগারো," উফ এত রাতে কে রে বাবা-" বলতে বলতে একরাশ বিরক্তি নিয়ে ফোনটা ধরল শৌভিক। ফোনের ওপারে জনৈক পরিচিত বৃদ্ধ। একই আবাসনে থাকেন ভদ্রলোক, আবাসিক সমবায় সমিতির বড় নেতা ও বটে। সন্ধ্যা বেলা লটবহর নিয়ে যখন আমরা আবাসনে ঢুকছি, তখনই দেখা হয়েছিল বৃদ্ধের সাথে। "কি খবর,অনেকদিন দেখি না! এখন কোথায় আছ? কতদিন থাকবে-" মার্কা কুশল সমাচারও আদান-প্রদান হয়েছিল। তিনিই ফোন করছেন এত রাতে। 


মধ্য রাত্রের নিস্তব্ধতার সৌজন্যে, মুঠো ফোনের পর্দা চিরে বৃদ্ধের আর্ত কণ্ঠস্বর সুস্পষ্টভাবে শোনা যাচ্ছে। চোখের সামনে ওনার জোয়ান ছেলে আত্মঘাতী হবার চেষ্টা করেছে। "৫০টা ঘুমের ওষুধ খেয়ে নিয়েছে, কি হবে এখন -?" ওনার হাহাকার পাক খেতে লাগল আমাদের ঘরে। তুত্তুরী আর আমি আতঙ্কে হিম হয়ে গেলাম। শৌভিক অস্বাভাবিক শান্ত স্বরে বলল," কিছু খাইয়ে বমি করানোর চেষ্টা করুন। হাসপাতালে ফোন করুন, অ্যাম্বুলেন্স পাঠাতে বলুন।" প্রসঙ্গত আমাদের বাড়ির উল্টোদিকে একটি বড় প্রাইভেট হসপিটাল আছে, তার নম্বর প্রায় সবার কাছেই থাকে।


বৃদ্ধর হাউমাউ তাও থামলো না," তুমি একবার এসো প্লিজ। আমার মাথা আর কাজ করছে না বাবা। ছেলেটা বলছে হাসপাতালে যাবে না।" বলতে বলতে চিৎকার করে উঠলেন বৃদ্ধ, "অয়, আবার মারামারি শুরু করল বউয়ের সাথে।" ফোন রেখে দাঁত কিড়মিড় করতে করতে শৌভিক বলল, " বুড়ো বাপ, অল্প বয়সী স্ত্রী, সন্তানের সামনে যে ছেলে আত্মঘাতী হবার চেষ্টা করে -তাও ঘুমের ওষুধ খেয়ে -।" 


শুনলাম সুদর্শন, সুউপায়ী ছেলেটি মানসিক অবসাদে ভোগে। ৫০ টা ঘুমের বড়ি সবার অলক্ষ্যে আগে থেকেই নাকি জমিয়ে রেখেছিল। আজ এই নতুন বছরে বউয়ের সাথে তুচ্ছ ঝগড়া করে, শৌচালয়ে ঢুকে তার সদ্ব্যবহার করেছে। বউ বুঝতে পেরে পাগলের মতো বাথরুমের দরজা পিটিয়ে পিটিয়ে, প্রায় ভেঙে ফেলে তাকে টেনে বার করে এনেছে। তখনও সবকটি ট্যাবলেট মুখে পুরতে পারেনি ছেলেটি। বউয়ের সামনে বাকিটা মুখে পুরেছে, তাই নিয়েই স্বামী স্ত্রীর ঝটাপটি হচ্ছিল ফোনের ওপারে। 


বেচারী বউটার কথা চিন্তা করে কান্না পেল আমার। শৌভিক নীরবে পোশাক বদলাল, দরজার তালা খুলল, লিফট না ডেকে সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে গেল। বৃদ্ধের ফ্ল্যাট সামান্য তফাতে। উপরের বারান্দা থেকে দেখলাম, বিরক্ত মুখে হেঁটে যাচ্ছে শৌভিক। আবাসনের সারমেয়র দল প্রবল চিৎকার করছে, মধ্যরাতের অবাঞ্ছিত অতিথিকে দেখে। ভ্রূক্ষেপহীন আমার বর। একবার শুধু ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল আমার দিকে। ইশারায় বলল 'ঘুমিয়ে পড়'।


বৃদ্ধের ফোন নম্বর ছিল না আমার কাছে, যে ফোন করে খোঁজ নেব।  দুশ্চিন্তায় ছটফটিয়ে কাটতে লাগল রজনী। বেশ খানিকক্ষণ সঙ্গ দিল তুত্তুরী, তারপর ঘুমিয়ে পড়ল কখন যেন। প্রায় ভোর রাতে এল শৌভিকের ফোন, "ঘুমাসনি কেন? তোকে বললাম না ঘুমিয়ে পড়তে।" উদ্বিগ্ন হয়ে জানতে চাইলাম, ছেলেটি কেমন আছে? জবাব এল," এমার্জেন্সিতে নিয়ে গেছে। ওয়াশ হচ্ছে। আমি আর ওর বাবা একসাথেই বসে আছি। ভদ্রলোক একটু সুস্থির হতে, বেরিয়ে এসে ফোন করছি তোকে।" 


শৌভিকের কথা মত ভদ্রলোক হাসপাতালে ফোন করেছিলেন। হাসপাতাল জানিয়েছে, ঠিক সেই মুহূর্তে কোন অ্যাম্বুলেন্স ফাঁকা নেই। তবে পেশেন্টকে নিয়ে এলে ওরা সাধ্যমত চিকিৎসা করতে পারে। শেষ পর্যন্ত বাড়ির গাড়ি বার করে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে ছেলেটিকে। 


 তাও যেতে চায়নি ছেলেটি, শৌভিক গিয়ে দেখে বৃদ্ধ,বৃদ্ধের পুত্রবধূ কাকুতি-মিনতি করছে, হাতে পায়ে ধরছে, নেমে গাড়িতে ওঠার জন্য। আর ছেলেটি গোঁ ধরে শুয়ে আছে। সে মরেই ছাড়বে। "দেখে এমন রাগ হল, সোজা জামার কলার ধরে হ্যাঁচকা টেনে তুললাম। বললাম সুইসাইড করা তোমার ঘোচাচ্ছি। তখন আমায় কি বলল জানিস?"  হাই চেপে বলে ক্লান্ত শৌভিক," বলল,' অ্যাই! অ্যাই! খবরদার!গায়ে হাত দিবি না। নইলে মেরে ফাটিয়ে দেব।" শুনে আমার মটকা গেল গরম হয়ে, মারলাম সজোরে এক ধাক্কা। সোজা ঘর থেকে ছিটকে বসার ঘরে। বসার ঘরের পিলারটাকে জাপটে ধরে কোনমতে ব্যালেন্স সামলে, সে কি হুঙ্কার," দেখবি? মারব কেমন-"। মূল্যবান সময় নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, শেষে বাড়ির লোকের সামনেই কলার ধরে হিড় হিড় করে টানতে টানতে সিঁড়ি দিয়ে নামিয়ে সোজা গাড়িতে -।" 


"মারিস নি তো?" ভয়ে ভয়ে জানতে চাই আমি। শৌভিক দাঁত কিড়মিড় করে বলে," না। তবে একটু আগে এমার্জেন্সির ডাক্তার যখন বৃদ্ধকে জিজ্ঞেস করছিল, ঠিক জানেন ৫০ টা সিডেটিভ খেয়েছে?  তাহলে তো তীব্র শ্বাসকষ্ট হওয়ার কথা, হার্ট রেট ও অনেক কমে যাবার কথা,সেন্স তো থাকারই কথা না। অথচ উনি সজ্ঞানে আছেন, যা প্রশ্ন করছি জবাব দিচ্ছেন -"  তখন সত্যিই মনে হচ্ছিল ঠ্যাঙাই -।" 


 শীত গিয়ে বসন্ত এল। এল গ্রীষ্ম, বর্ষা। আসব-আসব করছে শরৎ, এমন সময় এক পড়ন্ত বিকালে শৌভিকের ফোন, "আমি একটু সাগরপাড়ে ( নাম পরিবর্তিত) যাচ্ছি। ফিরতে দেরি হবে।" জায়গাটা কাঁথি মহকুমার মধ্যে হলেও কাঁথি শহর থেকে অনেক দূর।  প্রশ্ন করতে গেলাম, এই অবেলায় অত দূর কেন যাচ্ছিস, তার আগেই শৌভিক বলল," ওখানে মারাত্মক কাণ্ড হয়েছে। শুনছি অফিসারের গায়ে হাত পড়েছে।"


 "সে কি! একজন আধিকারিকের গায়ে হাত পড়েছে, এতো বিরাট ব্যাপার। পুলিশকে খবর দেওয়া হয়েছে-", উদ্বিগ্ন হয়ে প্রশ্ন করি আমি। শৌভিক দীর্ঘশ্বাস চেপে বলে, " পুলিশ তো ছিলই। অফিসের উল্টোদিকেই থানা, গণ্ডগোলের পূর্বাভাষ পেয়ে চারটে থানার পুলিশ ডেকে রাখা হয়েছিল। কিন্তু কিছু করা যায়নি। প্রায় তিন চার হাজার লোক নাকি জমায়েত হয়ে ভাঙচুর চালিয়েছে। ছেলেটা মার খেয়েছে, এমনকি ওর কোয়ার্টারেও ভাঙচুর হয়েছে শুনলাম।"


আতঙ্কিত হয়ে বললাম, "সাবধানে যাস। তোকে মারবে না তো?" শৌভিক হেসে বলল," তার আগে তো, আমি মারব। অন্তত চারটে'কে ধরাশায়ী করে তবে অন্য কথা-।"

বিকেল গড়ায়, সন্ধ্যা নামে। অফিস থেকে বাড়ি ফিরে আসি আমি। পাল্লা দিয়ে চড়তে থাকে উৎকণ্ঠার পারদ। ভয়ে ফোনও করতে পারি না, কি জানি কি অবস্থায় আছে।  সাতটা নাগাদ আসে সেই বহু প্রতীক্ষিত ফোনটা। "এই বেরোলাম। কাঁথি হাসপাতাল হয়ে ঢুকব। সাংঘাতিক অবস্থা এখানে। জানিস, ছেলেটা জ্বর নিয়ে আজ অফিস গিয়েছিল মিটিং করতে। মিটিংয়ে কিছু উত্তপ্ত বাদানুবাদের সময় ছেলেটা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ে। ওর স্টাফেরা ওকে তুলে হাসপাতালে নিয়ে যাবে বলে গাড়িতে তুলেওছিল, এমন সময় ভিড়ের চাপে গেট খুলে যায় আর জনতা চড়াও হয়। গাড়ি ভাঙচুর করে। ওর স্টাফরা মার খায়। গাড়ির ভাঙা কাঁচে পা কেটে সাংঘাতিক রক্তারক্তি কাণ্ড হয়।


এত কিছু ঘটে গেছে, আমি তো জানিই না। এডিএম স্যার এসেছিলেন, সারা দিন অন্য মিটিং এ ব্যস্ত ছিলাম। চারটে নাগাদ ওর এক স্টাফ কোন মতে  বেরিয়ে এসে আমাকে ফোন করে। ফোন পেয়েই স্যার আর আমি রওনা দিই। এসে দেখি চতুর্দিকে রক্ত,ভাঙ্গা কাঁচ পড়ে আছে। আমাদের দেখে ছেলেটার সে কি কান্না। কেবল একটাই কথা বলছিল," আমায় নিয়ে চলুন স্যার। আমি এখানে থাকলে মরেই যাব।" সব থেকে খারাপ কি হয়েছে জানিস, ওর কোয়ার্টারেও ইঁট মেরেছে। কাঁচ ভেঙেছে। কোয়ার্টারে তখন ওর বউ আর দুটো ছোট ছোট বাচ্ছা ছিল। তারা তো এখনও আতঙ্কে কাঁপছে।


তখনই এখান থেকে ওদের নিয়ে বেরিয়ে পড়তাম, মাঝে বাধ সাধলেন পুলিশের বড় কর্তা। উনি সমানে ছেলেটিকে বোঝাচ্ছিলেন, "আপনি থেকে যান। এতে প্রমাণ হবে প্রশাসন ভয় পায় না। পুলিশ ভয় পায় না।" কথা দিলেন সশস্ত্র প্রহরী দিয়ে দেবেন। আমি জানতে চাইলাম, " কতজন? কতজন গার্ড দেবেন?" উনি বললেন, ২৫-২৬ জন সশস্ত্র প্রহরী দেবেন যারা ছেলেটিকে, ছেলেটির অফিস আর কোয়ার্টার পাহারা দেবে। 


 থাকতে না পেরে বললাম, অপরাধ নেবেন না স্যার, পুলিশ তো আগেও ছিল। আপনাদের হিসেব মোতাবেক ৫০০ থেকে ৭০০ পুলিশ মোতায়েন ছিল। তাহলে তখন ওকে বাঁচানো যায়নি কেন? জবাব এল তখন ৩-৪ হাজার লোক জমায়েত হয়ে গিয়েছিল। আচ্ছা আবার যদি তারা ফিরে আসে, তাহলে এই ২৫/২৬ জন কি করবে? তখন বললেন, এই মুহূর্তে এমন কোন তথ্য ওনাদের কাছে নেই। 


দেখলাম কথায় কথা বাড়বে, তাই বললাম আমরা একবার ওর পরিবারের সাথে দেখা করতে চাই। যদি ওর স্ত্রী আপত্তি করে এখানে থাকতে, তাহলে কিন্তু আর কোন ওজরআপত্তি শুনব না। কোয়ার্টার গেলাম, পুলিশও গেল আমাদের সঙ্গে। ওখানে যেতেই, ওর বউ সোজা এসে আমার পায়ে আছাড় খেয়ে পড়ল, " স্যার বাঁচান। ও আপনাকে ভগবান মনে করে, আপনি না বাঁচালে দুটো বাচ্চা নিয়ে সিম্পলি মরে যাব।"


বললাম, তারপর? জবাব এল, "তারপর আর কি! এখন ওদের সপরিবারে তুলে নিয়ে কাঁথি ফিরছি। আবাসনের একটা ফাঁকা ফ্লাটে আপাতত ওদের থাকার ব্যবস্থা করতে বলেছি নাজির বাবুকে। ২-৩ দিন বা এক সপ্তাহ চলার মতন জিনিসপত্র কেনাকাটা করে রাখতে বলেছি। ওরা বলছিল বটে, একবার চলে গেলে আর ফিরে এসে ওই চেয়ারে বসতে পারবেন না। আমি বলে এসেছি, সে দায়িত্ব আমার, নিয়ে যাচ্ছি আমি, সঙ্গে করে এনে নিরাপদে চেয়ারে বসিয়ে যাবার দায়িত্ব ও আমার। আগে তো শারীরিক মানসিক ভাবে একটু সুস্থ হয়ে উঠুক ছেলেমেয়ে দুটো। 


আপাতত হাসপাতাল সুপারের সাথে কথা হয়ে গেছে, সোজা মহকুমা হাসপাতালে ঢুকব আমরা। ছেলেটার পা থেকে কাঁচ গুলো অপারেশন করে বার করতে হবে সবার আগে।  রক্তক্ষরণ হয়েই চলেছে। সেখানে আমি না গেলেও চলত, কিন্তু ছেলেটা ছাড়ছে না। এখনও বলে যাচ্ছে, " আপনি যাবেননি স্যার, আপনি গেলে মরে যাব স্যার।" 


তৃতীয় ঘটনাটা ঘটেছে গতকাল, কি যেন মিটিং এ দীঘা যাচ্ছিল আমার বর, ওর ভাষায়, " ঘুমিয়েই পড়েছিলাম গাড়িতে,আচমকা নূপুর (ড্রাইভার) ডাকল, ওই দ্যাখেন স্যার, গাড়ি থামিয়ে চাঁদা তুলছে। চোখ খুলে দেখি পর্যটক সমেত একটা বলেরো গাড়িকে ঘিরে ধরেছে এক দল লোক। তাদের একজন জানলা দিয়ে হাত গলিয়ে ড্রাইভারের কলার চেপে ধরে, গাড়ির মধ্যে মাথা গলিয়ে চাঁদা চাইছে। দেখেই বোঝা যাচ্ছে, একটাও প্রকৃতিস্থ নেই। সিকিউরিটিকে বললাম ধরো তো ব্যাটাদের। 


উর্দি পরা সিকিউরিটিকে নামতে দেখেই চাঁদা ফেলে সব ভোকাট্টা। নূপুর আর সিকিউরিটি ও দৌড়ল তাদের পিছু পিছু। দুজনকে ধরা গেল শেষ পর্যন্ত। গা থেকে ভুরভুর করে দিশি মদের গন্ধ আসছে দুটোরই। বলল, "গৌরাঙ্গ পুজোর চাঁদা তুলতেছিলাম স্যার। আর হবেনি স্যার। অন্যায় হয়ে গেছে স্যার।"  বললাম গাড়িতে তোল ব্যাটাদের। হবেনি তো বুঝলাম, তাই বলে মাননীয় অতিথিদের একটু খাতির করবনি আমরা। পুলিশকে বললাম, আমার গাড়ি চাপিয়ে দুজন গণ্যমান্য অতিথিকে নিয়ে আসছি, একটু যত্নআত্তি করে দেখুন তো আতিথ্যগ্রহণ না করেই যারা ভেগে গেল তাদের হদিশ পান কি না। পেলে তাদেরও যথাবিহিত খাতির করুন। আর পারলে একবার পুজোটাও দেখে আসি চলুন,কত বড় পুজো, যার জন্য পর্যটকদের গাড়ি আটকে এই ভাবে চাঁদার জুলুম চলছে। এদের জন্যই দীঘা মন্দারমনির এত বদনাম ছড়ায়। "


২০২৩ আমাকে অনেক কিছু শিখিয়েছে সিজিএম, স্কিন অ্যাক্টিভ, কোরিয়ান গ্লাস স্কিন, চাইনিজ গুয়া শা, কিগো হিগাশিনো ইত্যাদি প্রভৃতি। পাশাপাশি আর একটা জিনিসও শিখিয়েছে,  আমার বরটি আপাতদৃষ্টিতে নেহাৎই,"শান্তশিষ্ট, পত্নীনিষ্ঠ"  হলেও পরিস্থিতি বদলালে এক্কেবারে মারকুটে সিংহম মাইরি।

অনির বড়দিনের ডাইরি ২৫শে, ডিসেম্বর ২০২৩


 

#অনিরডাইরি #স্যান্টাবুড়ো_কে


"স্যান্টাবুড়ো কে?"র কথাটা প্রথম তুলি আমিই। সেদিন ১২ই ডিসেম্বর, আর তিন দিন পরেই শুরু হতে চলেছে অষ্টম দুয়ারে সরকার। ব্যস্ততার সীমা নেই, ব্রাউনিয় গতিতে চতুর্দিকে ছুটছে সবাই। টিম তাম্রলিপ্তর অফিসিয়াল হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে সকাল থেকে পোস্ট হয়েই চলেছে, একের পর এক অর্ডার, বাংলা/ইংরেজি SOP, নতুন প্রফর্মাওয়ালা ফর্ম, ম্যানিং এর প্রপোজাল ইত্যাদি প্রভৃতি। আর এসবের মাঝে আমার ছোট্ট মেসেজ, বড়দিনের আগে তো এমনিতেই আমাদের অফিস সাজানো হয়। এবারে তার সাথে একটা " সিক্রেট স্যান্টা" গেম রাখলে কেমন হয়?


তখন রাত সোয়া এগারোটা, শুধু প্রস্তাব রেখেই ক্ষান্ত হলাম না, খুঁজে পেতে খেলার নিয়মাবলীও পোস্টালাম গ্রুপে। সকালে উঠে দেখি কেবল যোশুয়া একটা বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ প্রদর্শন করেছে, আর সৌম্য লিখেছে, "খেলাই যায়।" নাঃ দমলাম না, ১৩ তারিখে যে কয়জন অফিসে ছিল তাদেরকে ডেকে বসালাম আমার উল্টোদিকে। তারপর বললাম, " বাপু হে সবাই  দুদণ্ড জিরোও। কাজ তো ১২ মাসই থাকবে। ওপরতলা সবসময়ই বলবে " এখনই করো"। আর নীচের তলা যখন একই দাবী করবে,  বদলে জুটবে হিরণ্ময় নীরবতা। সরকারি চাকরগিরির এটাই শাশ্বত নিয়ম। তাই কাজের পাশাপাশি নিজেদেরকেও ভালো রাখা অত্যন্ত জরুরী। চলুক না দুয়ারে সরকার, থাকুক না ক্যাম্প, ঘনাক না সন্ধ্যা, বড়দিন আমরা পালন করবই।  


কেক তো যোশুয়া খাওয়াবেই, সাথে ক্যান্টিনের দুধ-কফি থাকুক, থাকুক গৌরাঙ্গের সুইটসের মোয়া আর একটা করে কমলা লেবু। এই তো বাঙালির বড়দিন। দু'দণ্ড জিরিয়ে, কেক খেয়ে, আবার ফিরে যেও "ওয়ার্ক মোড" এ। এখন যে যার কাজে যাও, তবে যাবার আগে বলে যাও গেম খেলবে কিনা।

খুব সহজ খেলা, প্রত্যেকের নামের চিরকুট রাখা থাকবে একটা বাক্সের মধ্যে। সবাই একটা করে চিরকুট তুলবে, যার ভাগ্যে যার নাম উঠবে সে তার জন্য একটা উপহার কিনে আনবে। খুব দামি কিছু নয়, ৫০ থেকে ২০০ টাকার মধ্যে। দশ টাকা কমতেও পারে, বিশ টাকা বাড়তেও পারে, তবে কোনোমতেই আড়াইশোর বেশি যেন না হয়।

আর হ্যাঁ, কে কার নাম পেলে, সেটা কিন্তু কাউকে বলা যাবে না। উপহার কিনে, মোড়কে পুরে উপরে প্রাপকের নাম লিখে, লুকিয়ে ফেলে আসতে হবে আমাদের "গুপ্তধনের প্যাঁটরায়"। নির্দিষ্ট দিনে সবাই পাবে তার উপহার। 

খেলার নিয়ম বুঝিয়ে দেবার সাথে সাথেই, সবার কি উৎসাহ। যারা সেদিন অফিসে ছিল তারা টুপটাপ চিরকুট তুলে নিল, যারা ছিল না তাদের বলা হল, তুলে নাও বাপু সময়মত এসে। উপহারের সর্বাধিক মূল্য ২০০ টাকা ধার্য হল বটে, বাস্তবে দেখলাম ওই টাকায় কিছু কেনা খুব চাপের ব্যাপার। তাও এমন কিছু , যা আমি স্যান্টা হয়ে যাকে দেব, তার মনোমতো হয়।


চুপচাপ উপহার কেনা চলতে লাগল, তার পাশাপাশি চলতে লাগল সীমাহীন ফাজলামি। মণীশ এসে নালিশ করল," রবি আমার পিছনে পড়ে আছে।কেবল বলছে, ' আপনার থেকে গিফট আমি নিয়েই ছাড়ব'।" হাসি চেপে জানতে চাইলাম তোমার ভাগ্যে কি রবি উঠেছে? মণীশ এক গাল হেসে বলল," সেটা বলব না। আপনি নিষেধ করেছেন।" রবি আবার এসে নালিশ করে গেল হক বাবুর নামে। "তুই কার জন্য, কি কিনেছিস, আমি জানি" এই বলে নাকি তাকে ক্ষেপাচ্ছেন হক বাবু। এই একই কথা বলে জহর বাবুর পিছনে লেগে খুব একটা সুবিধে করতে পারল না বেদজ্যোতি। সৌম্য বায়না জুড়ল," আমার চিরকুটটা আমি বদল করব। আমার ভাগ্যে এমন একজন উঠেছে, তার জন্য কি কিনব আমি বুঝে উঠতে পারছি না।" নভোনীল বাবু আর শুভদীপ্তর কপালে ওদের নিজেদেরই নাম উঠল।  নভোনীল বাবু তাও সুবোধ হয়ে চিরকুট ফেরৎ/ বদলে নিলেন, শুভদীপ্ত কিছুতেই বদলাবে না, " আমি বেশ নিজেকেই গিফট দুব -" ইত্যাদি প্রভৃতি। কে বলবে পাশাপাশি দুয়ারে সরকার চলছে।টার্গেটের চাপে চাঁদি ফাটছে সবার।


দেখতে দেখতে এসে গেল নির্দিষ্ট দিনটা, ক্যাম্প সেরে অরূপ আর শান্তনুকে সঙ্গী করে ঝুরি আলো, রঙিন ফিতে, নকল শিকলী আর গুচ্ছগুচ্ছ তারা দিয়ে অফিস সাজিয়ে ফেলল যোশুয়া মুর্মু। বড়দিনের সঙ্গে তারার অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক যে। আর মাত্র কয়েকটা ঘন্টা, তারপরেই ধরাধামে ২০২৩ তম বারের জন্য আবির্ভূত হবেন বেথলেহেমের শিশু। সঙ্গে আসবেন স্যান্টা বুড়ো।


এখন প্রশ্ন হল, আমাদের অফিসের স্যান্টা বুড়ো ওইদিন আসবেন কি! গতবার রঞ্জিত স্যান্টা সেজেছিল, এবার এত চাপের মধ্যে আদৌ সাজতে রাজি হবে কি? আমার থেকেও দেখি রঞ্জিতের উৎসাহ বেশি, "হ্যাঁ ম্যাডাম, সেজে নেব। জহর বাবু, আপনার লাল পাঞ্জাবিটা ভালো করে ধুয়ে আনবেন কিন্তু।"  উৎসাহের দাপট সামলে যোশুয়াকে বললাম, এসে আগে ব্যাটার দাড়ি খুঁজো, গতবছর গুছিয়ে রাখা হয়েছিল যদিও, তবুও বলা তো যায় না ইঁদুরে কেটে থাকে যদি।


দেখতে দেখতে এসে গেল নির্দিষ্ট দিনটা, চারটে- সাড়ে চারটে বাজলে ক্যাম্প গুটিয়ে একে একে এসে হাজির হল সবাই। অনুষ্ঠান শুরু হতে হতে গড়িয়ে গেল সন্ধ্যা। স্যান্টা এসে, " হো হো হো" করে গেল, কফির কাপ, কেকের বাক্স ছেঁচে পুঁচে সাফ হয়ে গেল, কমলালেবুটা দেখলাম সম্মিলিত অ্যাসিড ভীতিতে বাতিল হয়েছে। এবার "আমার স্যান্টা কে" র পালা। গুদাম ঘর থেকে টেনে আনা হয়েছে পুরাণ এক কম্পিউটারের খালি বাক্স। ওটাই আজ আমাদের গুপ্তধনের প্যাঁটরা। সুযোগ বুঝে চুপি চুপি উপহার ফেলে এসেছে সবাই। উপহারের আধিক্যে আপাতত বন্ধই হচ্ছে না বাক্স খানা।


স্যান্টা বুড়ো, প্যাঁটরার মধ্যে হাত ঢোকাচ্ছে আর তুলে আনছে, সুদৃশ্য সব মোড়ক। পড়া হচ্ছে প্রাপকের নাম। যে পাচ্ছে, সে আন্দাজ করছে কে দিয়েছে। সৌরভ পেল দারুণ একটা মাফলার। কে দিয়েছে খুঁজতে হল না, কারণ ওই রকম একটি মাফলার বিগত সপ্তাহে পরে আসছিল চঞ্চল। যোশুয়ার ভাগ্যে বেরোলো, পেনড্রাইভ আর বেশ অনেকগুলো চকলেট।" হুম, যে দিয়েছে সে জানে আমি ভাঙ্গা পেনড্রাইভ দিয়ে কোনমতে কাজ চালাই। তাতেও এত ভাইরাস কিলবিল করে, যে মেশিনগুলো ওটার সাথে কাজ করতেই চায়না।"  বলতে বলতে খপ করে একটা টফি মুখে পুরতেই, হাঁ হাঁ করে উঠল সৌম্য, "আরে ওগুলো তোমার মেয়ের জন্য-"।  


কেলো বাঁধালো সুরজিৎ, প্রাপকের সাথে সাথে ভালোবাসা সহ নিজের নামটাও লিখে ফেলে, সবথেকে বড় বাক্সটা পেল শান্তনু, ভিতরে অসাধারণ একটি শোপিস। কে দিয়েছে ও আন্দাজ করতে না পারলেও, যারা হক বাবুকে ঢাউস ব্যাগ নিয়ে গুপ্তধনের ঘরে ঢুকতে দেখেছে তারা ধরেই ফেলল। IMW মণীশের স্যান্টা বেরোল, তারই CKCO নন্দন। মণীশ হেঁসে বাঁচে না, "উনি আমার পাশে বসেই আমাজন ঘাঁটছিলেন, আর আমি বলছিলাম বেশি দামি কিছু কিনবেন না, ম্যাডাম নিষেধ করেছেন।" নন্দনের স্যান্টা বেরোল কয়াল,  কয়ালের স্যান্টা আবার মণীশ। উপহার পাওয়া পারফিউমের সৌরভে মম করে উঠল গরীবের চেম্বার খানা। 


কাকতালীয় ভাবে বেদজ্যোতি আর রঞ্জিত বেরোল একে অপরের স্যান্টা। হক বাবু পেলেন এক কফি মগ। যার দুদিকেই জাজ্বল্যমান হক বাবু। একদিকে  লুঙ্গি - পাঞ্জাবি - ফেজ পরা হক বাবু, ইফতারের অব্যবহিত পূর্বে সদ্য নামাজ পড়ে উঠেছেন। তো অন্য দিকে বসন্তৎসবের লাল - কমলা - গোলাপী রং মাখা ভূত হক বাবু, জনে জনে মঠ - ফুটকড়াই বিলি করছেন। মাথা খাটিয়ে কি অসাধারণ উপহার বেছেছে শুভদীপ্ত।


স্যান্টা হিসেবে হুমায়ূন আহমেদের বই কেনাটা মস্ত ভুল হয়েছিল আমার। কিছুদিন আগেই ব্যাটাদের বলেছিলাম, ভদ্রলোক আমার অত্যন্ত প্রিয় লেখক। তুত্তুরীকে দিয়ে নাম লিখিয়েও আত্মপরিচয় গোপন রাখতে পারলাম না। মোড়ক খুলেই সন্দীপ চিৎকার করে উঠল, " ম্যাডাম এটা আপনি দিয়েছেন।" কিন্তু আমার স্যান্টাকে আমি এত সহজে ধরতে পারলাম না। এমন সুন্দর বাদামী - চন্দন আর কালো রঙের  হাতব্যাগটা কে দিতে পারে আমায়? শেষে হক বাবু উদ্ধারকর্তা হলেন, " রবি দিছে ম্যাডাম। যেদিন থেকে চিরকুট পেয়েছে, উফঃ, উফঃ করেই যাচ্ছিল। তখনই বুঝেছি,ওর ভাগ্যে আপনিই জুটেছেন।" 

সবার সব উপহার আদানপ্রদান হয়ে গেল সৌম্যর উপহার কই? কি সর্বনাশ! আমার টিমে দুটো অভিমানী শিশু আছে, বয়স যাই হোক, যাদের মনের বয়স বাড়েনি, তাদের একজন সৌম্য। ওকে খালি হাতে ফেরানো যায় নাকি? আমরা অফিস তোলপাড় করছি, সবাই সবাইকে জিজ্ঞাসা করছি, কার ভাগ্যে ওর নাম উঠেছিল, একদম অভিমানী শিশুর মতই মাথা নত করে মোবাইল ঘেঁটে যাচ্ছে সৌম্য। মাঝে মাঝে উদাস চোখে এদিক ওদিক তাকাচ্ছে,খানিক দাড়ি চুলকাচ্ছে, দুঃখী সুরে " ঠিক আছে। আমার উপহার না হলেও চলবে" বলছে। ঘরে উপস্থিত প্রতিটা সদস্য বুঝতে পারছে অভিমানের পাহাড় জমছে, এত অভিমান যে ভালো করে মিথ্যাও বলতে পারছে না। 


শেষ পর্যন্ত হক বাবুর আলমারি থেকে বেরোয় সৌম্যর উপহার। ওর স্যান্টা আমাদের বৈদ্যনাথ, চূড়ান্ত শারীরিক অসুস্থতার কারণে নিজে হাজির হতে পারেনি বটে, তবে উপহারটা পাঠিয়ে দিয়েছিল হক বাবুর হাতে। সেটা প্যাঁটরায় রাখতে ভুলে গেছেন হক বাবু। তাই যত কেলো। 


উপহার আদান প্রদান অন্তে সবাই যখন বেরোচ্ছি, সন্দীপ আর সৌরভ বলল, " বিশ্বাস করুন ম্যাডাম ভুলেই গেছি দুয়ারে সরকার চলছে।" জহর বাবু তখন রবিকে পাকড়াও করেছেন, " সব পড়বে। মুখস্থ করবে। আমি পড়া ধরব। পারলে আরো বড় ডিকশনারি উপহার পাবে।" বেচারা রবি, বেজায় কড়া স্যান্টার পাল্লায় পড়েছে যা দেখি।

অনির ডাইরি ২৪শে ডিসেম্বর, ২০২৩

 


#অনিরডাইরি #তাম্রলিপ্তকড়চা 


আজও সুস্পষ্ট ভাবে মনে আছে দিনটার কথা। সেকেন্ড ইয়ারে পড়ি বোধহয়, বিবেকানন্দ ইস্কুলের কাছে জনৈক স্যারের কাছে পড়তে যেতাম। বাড়ি থেকে বেশ অনেকটা দূর, রিক্সা ভাড়া দিতে কসুর করত না বাবা, তবুও হেঁটে যেতাম, হেঁটে ফিরতাম। বেকার মেয়ে, চাকুরী থেকে সদ্য স্বেচ্ছা অবসর নেওয়া বাপের ওপর এমনিতেই বোঝা, আর অতিরিক্ত চাপ দিতে মন চাইত না। 


সেদিনও হেঁটে ফিরছি, শ্যামাশ্রী সিনেমার সামনে জনৈক প্রাক্তন সহপাঠিনীর সাথে দেখা। আত্মবিশ্বাসের অভাবে ভোগা, নিজেকে চূড়ান্ত পিছিয়ে পড়া, হেরে যাওয়া, অবাঞ্ছিত, কুৎসিৎ কদর্য মনে করা সেদিনের আমি, এরকম কারো সাথে দেখা হলেই মাথা নীচু করে কেটে পড়ায় বিশ্বাসী আমি, সেদিনও পালিয়েই গিয়েছিলাম প্রায়। রাস্তা পেরিয়ে ছুটে এসে জড়িয়ে ধরল সহপাঠিনী মেয়েটি। " কি রে, সেদিন এলি না যে?" বেশ খানিক অপ্রস্তুত হয়ে, পলায়ন পর মনোবৃত্তিকে সাময়িক দমিয়ে, ঘেমো মুখের ওপর সস্তা বাটিক এর রুমালের বেশ অনেকগুলো প্রলেপ বুলিয়ে কোন মতে জিজ্ঞাসা করলাম, " কোথায়? কবে?" 


মেয়েটি হেসে বলল, " আরে ওই যে অমুকের বাড়ি? আমরা সবাই এসেছিলাম।" যার বাড়ির কথা হচ্ছে তার বাড়ি থেকে আমাদের বাড়ি হাঁটা পথে মিনিট চার। আমাদের স্কুলেই পড়ত সেই মেয়েটিও। তার বাড়িতে খামোখা যাব কেন? বলাতে আলিঙ্গন রত সহপাঠিনী থতমত খেয়ে বলল, " কেন? তোকে বলেনি? আমরা যারা এক সাথে বিজ্ঞান বিভাগে পড়েছিলাম সকলকেই বলেছিল তো? সবাই এসেছিল, তুই আর অমুক বাদে।"


লজ্জায় বেশ কয়েকটা ঢোঁক গিলেও সাহস অর্জন করতে পারলাম না বলার যে আমাকে তো বলেইনি মেয়েটা। সাহস করে বলতে পারলাম না, ওই মেয়েটার দুর্দিনে অর্থাৎ যেদিন চূড়ান্ত খারাপ ফল করে এক ঘরে হয়ে গিয়েছিল মেয়েটি, আমারই কলেজে ভর্তি হয়েছিল কোনমতে, প্রথমে পাশ কোর্সে, পরে সেযুগে  গ্ল্যামারহীন কোন বিষয়ে স্নাতক হিসেবে, তার ঘনিষ্ট তম বান্ধবীরাও পাত্তা দিত না,সেদিনও আমি গায়ে পড়ে কথা বলেছি মেয়েটার সাথে। যুগিয়েছি সাহস, নির্দ্বিধায় ভাগ করে নিয়েছি নিজের নোটস।


 আমাদের বাড়িতেও তো এসেছিল মেয়েটা কয়েকবার, আমাদের দেড়শ বছরের পুরাণ রহস্যময় ভাগের বাড়ি। পলেস্তারা খসা দেওয়াল, কার্নিশে গজিয়ে ওঠা বট,অশ্বত্থের চারা। সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময় একটা বিশেষ জায়গায় দাঁড়িয়ে হাততালি দিলে ঝুম ঝুম শব্দ হত। আমরা ভাবতাম নির্ঘাত ঘড়া ভরা মোহর লুকিয়ে রেখেছেন প্রপিতামহ অথবা আমাদের চিলে কোঠার ছাত, যার একটা বিশেষ জায়গায় একটা তামার পয়সা পোঁতা ছিল। চার্বাক পন্থী প্রপিতামহ বিশেষ তিথিতে সারা রাত ধরে সস্ত্রীক আরাধনা করে, ব্রাহ্ম মুহূর্তের অব্যবহিত পূর্বে, বিশাল তামার পরাতে করে পঞ্চব্যঞ্জন ভোগ রেখে আসত যেখানে। সূর্যের প্রথম কিরণের সাথে সাথে সেখানে গিয়ে হাজির হতেন তাঁর বিশ্বস্ত অনুচর তথা গৃহ পরিচারক, আর প্রতিবারই আবিষ্কার করতেন খালি থালা বাটি। কে যেন চেটে পুটে খেয়ে যেত সব। বাড়িটাকে ঘিরে ছিল আম - কাঁঠাল - পেয়ারা - নাগকেশরের জঙ্গল, বেঁজি, ভাম, হনুমানের গুষ্টি থাকত সেথায়, তাঁদেরই কেউ খেয়ে যেত হয়তো, কিন্তু বৃদ্ধ প্রপিতামহ ভাবতেন শিবায় খেয়ে গেছে সব। সব গল্প শুনিয়েছিলাম মেয়েটাকে। উল্টে শুনেছিলাম তার মনোবেদনা। মা অফিসে, পিসি গৃহকর্মে নিমজ্জিত,তাতেও কসুর থাকত না লৌকিকতার। স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে চা বানিয়ে দিত জ্যাঠাইমা। ফাটা কাপ, হাতল ভাঙ্গা কাপের  চাটা আমার হাত থেকে ছিনিয়ে নিত মেয়েটা। 


আর সেই মেয়ে একবার বলার প্রয়োজন বোধ করল না আমায়? অন্য যে মেয়েটি অনুপস্থিত ছিল এই গেট্টুতে, তারও আমাদের মতই অর্থনৈতিক অবস্থা। সদ্য অবসর নেওয়া বাবা, বর্ষায় জল পড়া ফাটা ছাদ, নিতান্ত সাধারণ গৃহকোণ। সেও একই কলেজে পড়ত, আমি পদার্থ বিদ্যা,আর সে রসায়ন। সেও জানত না এই গেটটুর কথা। আমি শুধাতে আকাশ থেকে পড়েছিল সেও। তারপর খানিক দম নিয়ে বলেছিল, " আসলে আমার বাবা তো খুব গরীব -"। হয়তো এটাই কারণ, তাও মানতে পারিনি আমি, আমার বাবার অর্থনৈতিক অবস্থা দিয়ে যেন যাচাই করা হবে আমায়? আমাদের ভাঙ্গা বাড়ি, আমাদের কার্নিশে গজিয়ে ওঠা বটগাছের চারা বা আমাদের হাতল ভাঙ্গা কাপ দিয়ে কেন আমার মূল্যায়ন হবে? আমি অনিন্দিতা,  আমি নম্বর দেখে কারো সাথে মিশি না, আমার জ্যাঠাইমা তার দেওর ঝি আর তার বন্ধুর মধ্যে কোন প্রভেদ করে না, আমার অকপট ভাবে বন্ধুর সাথে মেশা এগুলো কেন হিসেবে ধরা হবে না?


বাড়ি এসে যখন বাবার বুক ভিজিয়ে দিয়েছিলাম তপ্ত নোনতা জলে, প্রবল হেসে ছিল বাবা। তারপর শুনিয়েছিল সেই গল্পটা, গলির মুখে দাঁড়িয়ে প্রবল গালাগালি করছে একটা লোক। কোনমতে তার পাশ কাটিয়ে, ইশ্বরচন্দ্রের বাড়ি গিয়ে হাজির হলেন জনৈক অনুগামী। বিদ্যাসাগরের পদে প্রণতি জানিয়ে কইলেন, "মহাশয়, গলির মুখে জনৈক ভদ্রলোক আপনাকে অত্যন্ত কটু ভাষায় আক্রমণ করছে। কি সব অশ্রাব্য গালাগাল, কানে শোনা যায় না।" বাঙালির প্রাণ পুরুষ অট্টহাসিতে ফেটে পড়লেন, হাসির চোটে বেদম। উল্টো দিকের ভদ্রলোক পুরো বেকুব। বেশ খানিক পর, দম নিয়ে বিদ্যাসাগর কইলেন, " লোকটা আমায় খিস্তি করছে? কিন্তু কেন? আমি তো ওর কোন উপকার করিনি -"।


কলিযুগে উপকারীকে বাঘে খায়, ঠাকুমা বলত। পরবর্তী কালে বাবা ও সেই একই কথা বলে গেছে। বারবার, লাগাতার। আমি শুনিনি। কেমন যেন মনে হত , আজও হয়, কাউকে কাঠি করার থেকে কারো উপকার করা ভালো, বিশেষত আমাদের মত সরকারী আধিকারিকদের। তাই করি, বদলে কোন প্রত্যাশা রাখি না। কারণ বাবা শিখিয়েছে, 'প্রত্যাশাতেই যন্ত্রণা'। তাও খারাপ তো লাগেই। সেদিন যেমন জনৈকা বান্ধবী কইল, " অনিন্দিতা দি উনি তোমায় ক্লাস নিতে ডাকেননি? অমুককে তো ডেকেছেন। ক্লাস প্রতি এত টাকাও পাবার ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। আর তোমায় ডাকেননি? তোমার সাথে তো কত ভালো সম্পর্ক! তুমি তো সুযোগ পেলেই ওনাকে ডাকো।"


তা ডাকি বটে, আগামী দিনেও ডাকব। ঘুরিয়ে ওনার থেকে কিছু আশাও করি না। তবুও -। জুতোয় যেন কাঁকড় ঢুকল। শৌভিককে বললে নির্ঘাত খিল্লি ছাড়া কিছু জুটবে না। বাবা অন্তত খিল্লি করবে না। বাবাকেই বললাম। বাবা সেই একই কথা বলল, " তোমায় বলেছি তো। কলিযুগে উপকারীকে বাঘে খায়।" তা খায় বটে, তাই বলে কারো উপকার করতে পারব নি? তেনাদের জগৎ দেনাপাওনায় চলে হয়তো, আমার তো নয়। হাসল বাবা। "তা বটে, হাজার হোক চাটুজ্জে বাড়ির রক্ত, তোমার পিতামহ ও পারেনি। আমিও না। জিন ভূত থুড়ি আমাদের জিন, তোমার মধ্যেও ফুটে উঠবে এটাই স্বাভাবিক। শুধু একটা জিনিস ত্যাগ করো, প্রত্যাশাটা। দেখবে সুদ সমেত ফিরে পাবে সব। হ্যাঁ যার উপকার করবে,সে হয়তো সবসময় পারবে না। কিন্তু যখন তোমার প্রয়োজন হবে, যখন তুমি বিপদে পড়বে, দেখবে তোমায় উদ্ধার করতে অন্য অনেক লোক এসে হাজির হবে। মিলিয়ে নিও।" 


হাফ বিশ্বাস নিয়ে অফিসে এলাম। আজ শুক্রবার, বড়দিন আসতে আর মাত্র দিন দুয়েক বাকি। এখনও একটা ও কেক কেনা হয়নি। দূর আমার বরটাকে যে আটকে রেখেছে মহানগর, আসন্ন নির্বাচনের ট্রেনিং উপলক্ষে। কেকটা কিনবে কে? বানাতেও ইচ্ছে করছে না।  আসল লোকটা বাড়িতে না থাকলে ভালো লাগে নাকি। সবে চেয়ারে বসেছি, দরজা খুলে মুখ বাড়ালো একদল নীল সাদা শাড়ি পরিহিত মহিলা। এনারাই সম্মিলিত ভাবে সাফ রাখেন নিমতৌড়িরির এই নব্য প্রশাসনিক ভবন চত্বর। কেউ শৌচাগার সাফ করেন তো কেউ করিডর ঝাঁট দেন, কেউ বাগানের পাতা তোলেন তো  কেউ গাছে জল দেন, তো কেউ আবর্জ্জনা পূর্ণ আঁস্তাকুড় সাফ করেন। মাঝে মাঝে বিভিন্ন দাবী নিয়ে আমার কাছে আসেন। এমন সব দাবী যার কোনকিছুই আমার হাতে নেই। তবু শুনি। সরকারী দপ্তর সম্পর্কে সাধারণ মানুষের সব থেকে বড় নালিশ হল কেউ কথা শোনে না। তাই শুনি। টুকটাক পরামর্শ ও দিই। কোথায় কার কাছে আবেদন করতে হবে সেটা জানিয়ে দিই, অনেক সময় আবেদন পত্র গুলো মকস ও করে দিই। মাঝে মাঝে বিরক্ত ও হই। "এখন ব্যস্ত " বলে ভাগিয়ে ও দিয়েছি একবার। তাও আসেন ওনারা। আজও এসেছেন, ভাবলাম নতুন কোন সমস্যা নিয়ে, ভ্রু ভঙ্গিমায় বোধহয়  ফুটেও উঠেছিল মনের পটচিত্র, ওনারা জিভ কাটলেন। বদলে আমার হাতে ধরিয়ে দেওয়া হল একখান কেক। বুঝতে পারলাম, কালেক্টরেট এর সামনের দোকান থেকে কেনা। বুঝতে পারলাম চাঁদা তুলে কেনা এবং ওই দোকানের সবথেকে দামী কেকটা কেনা হয়েছে আমার জন্য। 


এহেন ভালোবাসার উপহার ফিরিয়ে দেওয়ার হিম্মত আমার নেই। পরম আনন্দে গ্রহণ করলাম ওনাদের উপহার। সবাইকে বড়দিন এবং আসন্ন নতুন বছরের শুভেচ্ছা জানালাম। আর ওনারা বললেন, " ম্যাডাম এই চত্বরে, এত গুলা অফিস আছে, এত জন সাহেব, ম্যাডাম বসেন, কিন্তু তাদের কারো সাথে আমাদের কথা বলার সাহস হয় না। একমাত্র আপনিই আছেন, যিনি আমাদের কথা শোনেন। শলা পরামর্শ দেন। আপনার উৎসাহেই আমরা বিভিন্ন দাবী দাওয়া তুলতে পারি। আমরা আপনাকে বড্ড ভালোবাসি। আপনি খুব ভালো থাকুন। কচি ( তুত্তুরী), স্যার (শৌভিক) ও খুব ভালো থাকুন। আপনার জন্য আমরা সব কিছু করতে পারি। আপনি যা বলবেন আমরা করব।" হাসব না কাঁদব বুঝতে না পেরে হেসেই বিদায় করলাম সবকটাকে। আর মনে মনে ভাবলাম চাটুজ্জে বাড়ির জিন ভূতটা এমনও কিছু খারাপ নয়। আরে বাবা তুমি অধম হতেই পারো, it's your choice baby, তাই বলে আমি উত্তম হব না কেন? It's my choice after all

অনির ডাইরি ১৯ শে ডিসেম্বর, ২০২৩

 


#অনিরডাইরি 


যবে থেকে শুনেছি অরূপ বিয়ে করছে, তবে থেকে ঠিক করেছি এই শাড়িটাই পরব। বড় সাধ করে, গুচ্ছ-গুচ্ছ রিলস দেখে, রিভিউ পড়ে, কিনেছিলাম শাড়িটা। আজ থেকে বছর ১৫ বছর আগে আমার বিয়ের বেনারসিটার যা দাম ছিল, প্রায় সমমূল্যে কিনেছি শাড়িটা। যার জন্য কেনা এবং পরা তিনি তো ফিরেও তাকালেন না। নিকষ আঁধারের চাদরে মোড়া বঙ্গোপসাগরের অদূরে, এক রেস্তোরাঁয় নৈশ ভোজে গিয়েছিলাম দোঁহে, দুটো প্রেমের বুলি ছাড়ুন, তাঁর নীরস শুঁটকো তত্ত্ব কথার দাপটে মনে হচ্ছিল জানালা গলে পালিয়েই যাই। নেহাৎ আটকে গিয়ে কেলেঙ্কারি হবে- 


যাই হোক, তারপর থেকে আর পরাই হয়নি শাড়িটা। সুযোগ আসে কোথায়? জেলার ভূত আমি, মহানাগরিকদের যাবতীয় জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠান থেকে সদা ব্রাত্য। আর এই মেদিনীপুরে কে আর রোজ রোজ বিয়ে করছে বা পার্টি দিচ্ছে। এইসব ভেবেচিন্তে পরে তো এসেছি শাড়িটা, কিন্তু স্বস্তি পাচ্ছি না মোটে। শাড়ি তো নয় যেন ছাতার কাপড়। কেবল হড়হড়িয়ে খুলে যেতে চায়। চাকা লাগানো চেয়ারে বসতে গেলে প্রতি মুহূর্তে মনে হয় হড়কে পড়ে গেলাম বুঝি। আঁটোসাঁটো করে গাছ কোমর বেঁধে পরতে গেলে জারদৌসি কাজের খোঁচায় পেট কুটকুট করে।


যাই হোক, কটা তো ঘন্টা, সন্ধ্যে নামলেই সদল বলে গিয়ে হাজির হব অরূপের ভাড়া করা লজে। যেদিন লাজুক মুখে নিমন্ত্রণ করতে এসেছিল ছেলেটা, সেদিন নির্লজ্জের মত বলেই দিয়েছিলাম, "তাড়াতাড়ি খেতে দিবে তো?" এদিকে রাত সামান্য গভীর হলেই বন্ধ হয়ে যায় অটো,টোটো,ট্রেকার।  যোশুয়া আর মণীশ সেই হাওড়া ফিরবে, রবি আর সন্দীপ বাগনান। আমি আর বেদজ্যোতি কাঁথি। ফলে বেশি দেরী করা যাবে না। বধূ সেজে আসতে দেরি করতেই পারে, আমরা পৌঁছেই সটান হাত ধুয়ে খেতে বসব।


অরূপ কথা দিয়েছে, সাড়ে ছটার মধ্যেই সব রেডি হয়ে যাবে। নিমতৌড়ির এই নব্য প্রশাসনিক ভবন চত্বর থেকে যেতে সময় লাগবে মিনিট পঁচিশ। সবমিলিয়ে সাড়ে পাঁচটার ঘন্টাটা পড়ার অপেক্ষা, বিয়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দেব আমরা। পৌঁছে আগে ফুচকা, কফি, পকোড়া তারপর মেন কোর্স। মেনুও জেনে নিয়েছি আগেভাগে। সব মিলিয়ে জনা পনেরো আমরা। মুড়ির টিনের মত ঠেসেঠুসেও কোন গাড়িতে ধরবে না, তাই বাইক নিয়ে যাবে কয়েকজন। কে কার বাইকে চাপবে, সেই নিয়ে খুনসুটি চলছে সকাল থেকে। আমাদের রবিবাবু এমন মাঞ্জা দিয়েছেন যে আমি পর্যন্ত হীনমন্যতায় ভুগছি, গোটা অফিস সেই নিয়ে চর্চায় উত্তাল। বিয়ে বাড়িতে বরকে আদৌ চেনা যাবে তো!


আজ বড়ই খুশি খুশি আবহাওয়া আকাশে-বাতাসে। এমন সময় যা হয় আর কি, ঢং করে মেসেজ ঢুকল জনৈকা বড় ম্যাডামের, সঙ্গে ঢুকল মুখ্যসচীবের এক খান পত্র। মুখ্যসচীব জেলাশাসকদিগকে কিছু নির্দেশ দিয়েছেন, যা আমাদের দপ্তর সংক্রান্ত। সেই নিয়েই আলোচনা করতে আমায় যেতে বলা হয়েছে, সন্ধ্যেবেলা। কি সর্বনাশ সন্ধ্যেবেলা কেন! তাহলে বে বাড়ি যাব কেমনে? আর তাছাড়া এই নিয়ে আলোচনা করার আমি কে রে বাবা? মানছি জেলা শাসকের করণে আমাদের অফিস, তাই বলে এই জেলার সব থেকে বড় অফিসার তো আমি নই। তিনি আমার বড় সাহেব, যিনি হলদিয়ায় বসেন। বাক্যালাপ, আলোকপাত, চায়ের চর্চা ইত্যাদি যা খুশি করার জন্য তিনিই যোগ্য ব্যক্তি।


তাঁকেই ফোন করলাম, যে দাদা তোমার জেলা তুমি সামলাও, আমি চললাম বিয়ে বাড়ি। কপালের এমন ফের, বড় সাহেবের সেই দিনই মহানগরের গুরুত্বপূর্ণ মিটিং। অগত্যা গরীবকেই যেতে হবে জবাই হতে। কি বলব সেটা তো অন্তত বলে দাও। বড় সাহেব হেসে বললেন,"বলো আমাদের দপ্তর থেকে এই সংক্রান্ত কোন নির্দেশ আমরা এখনও পাইনি। টাকা-পয়সাও কিচ্ছু নাই। তবুও জেলাধীশ যা নির্দেশ দিবেন, তাই শিরোধার্য।"


একটা একটা করে ফাইনাল পেমেন্ট ছাড়ি, আর জানলার বাইরে দেদীপ্যমান তপনের দিকে চাই, এবার তো ঢলে পড় রে বাবা। আজ না হয় বিকেল চারটেতেই সন্ধে করে দাও রে বাবা। সূর্যদেব একটা কথাও শুনলেন না বটে, তবুও সাহস করে চারটে নাগাদ ফোন করলাম ম্যাডামের আপ্তসহায়ককে। ম্যাডাম যদি চেম্বারে থাকেন তো সটান গিয়ে হাজির হই। সাজ দেখে বুঝতেই পারবেন আশা করি, যে বিয়ে বাড়ি যাব সন্ধ্যে হলে।


অভাগা যেদিকে চায়-  পিএ বাবু কইলেন," ম্যাডাম তো ডিএম সাহেবের সাথে মিটিং করছেন।" আচ্ছা ঠিক আছে, সাড়ে চারটে নাগাদ আবার করলাম, আবার একই জবাব। পৌনে পাঁচটা, পাঁচটা, সোয়া পাঁচটা- বারবার একই কথা শুধাই আমি, একই জবাব দেন তিনি। শান্তনু শুকনো মুখে এসে জানতে চায়," তাহলে কি হবে ম্যাডাম? আপনি যেতে পারবেননি?"


তাই আবার হয়, আমাদের অরূপের শুভবিবাহ আর তাতে গরহাজির থাকব আমি! পৃথিবী উল্টে গেলেও যাব। বললাম, তোমরা রেডি থাকো। আমি চললাম ম্যাডামকে পাকড়াও করতে। পৌনে ছটা নাগাদ যখন প্রশাসনিক ভবনের বি ব্লকের তিন তলা থেকে নেমে, প্রশস্ত আঙিনা পেরিয়ে এ ব্লকের তিন তলায় উঠছি, অবাক হয়ে তাকাচ্ছে ঘরফেরতা সরকারি লোকজন, "এই ম্যাডামটা আজ এত সেজেগুজে আসতেছে কেন?" আমি নিরূপায়, আমি ভ্রূক্ষেপহীন।


ম্যাডামের চেম্বারে ঢুকে দেখি শূন্য আসনের সামনে ফাইলের ছোটখাটো শিবালিক-হিমাচল এবং হিমাদ্রি। ম্যাডামের মুখ্য আর্দালি, যাঁকে আমি ঠাকুরমশাই বলে সম্বোধন করি, দৌড়ে এসে বললেন," ম্যাডাম আপনার আগে অনেকে লাইন দিয়েছে। ওই যে দেখেন ফাইল দিয়ে লাইন রাখা।"

থাক লাইন, আমি বেলাইনেই ঢুকব আজ। আমায় বিয়ে বাড়ি যেতে হবে রে বাবা। ইঁট পাতার মত সবথেকে উপরের ফাইলটার উপর হাতের দু কপি রিপোর্ট রেখে, পেপার ওয়েট চাপা দিলাম। গ্যাঁট হয়ে বসলাম সবথেকে সামনের চেয়ারটায়, কোনমতে যাতে আমাকে টপকে কেউ ম্যাডামের কাছে না ঘেঁষতে পারে। 

ঘড়ির কাঁটা ছুটছে আপন লয়ে, আমার হৃদপিণ্ড ছুটছে তার থেকে আড়াইগুণ দ্রুত গতিতে। ছটা- সোয়া ছটা- সাড়ে ছটা বেজে গেল প্রায়। স্বর্গের ৩৩ কোটির মধ্যে যতজনকে চিনি ডেকে ফেলেছি, কারো দেখা নেই, ম্যাডামেরও না। বসে বসে লম্বা মেসেজ লিখলাম ম্যাডামকে, বড় সাহেব যা বলতে বলেছেন তাই সুচারু ইংরেজিতে লিখলাম, সাথে রিপোর্টটাও দিলাম টাইপ করে। সবশেষে বিনীত অনুরোধ করলাম, প্লিজ ম্যাডাম যদি অনুমতি দেন তো বিদায় নিই। একটা বিয়ে বাড়ি যাবার আছে, আমার অন্যান্য সহকর্মীবৃন্দ আমার জন্য প্রতীক্ষারত।


"উত্তর আসবে না, তুমি আসবেই আমি জানি" করে ম্যাডাম এসে উপস্থিত হলেন আরো মিনিট ১৫ দেরীতে। পিছন পিছন ঢুকলেন জনা তিনেক গণ্যমান্য আধিকারিক। কেউ কিছু বলার আগে করজোড়ে মার্জনা চাইলাম আমি, একটু যদি আমাকে ছেড়ে দেওয়া হয়, যা বলার সব মেসেজে লিখে পাঠিয়েছি আমি। ম্যাডাম জিভ কেটে বললেন," আপনি মেসেজ করেছিলেন, আমি এতক্ষণ দেখিইনি। আসলে একটা ভিসি ছিল, তারপর বেশ কয়েকটা মিটিং, মোবাইলের দিকে তাকানোর সুযোগই হয়নি।কিন্তু আপনি এতক্ষণ অপেক্ষা করলেন কেন, চলে গেলেই পারতেন।


 উঁচু গোড়ালির জুতো আর হলহলে শাড়ি সামলে, বাতাসের থেকেও দ্রুত গতিতে দৌড়ই আমি, লিফট আসতে বড্ড দেরী করছে, সিঁড়ি ধরি আমি।  আমার প্রতীক্ষায় রয়েছে ১৪ জন, " সৌরভ-রঞ্জিত- শান্তনু -শুভাশিস - শুভদীপ্ত----- চলো চলো আর এক মুহূর্ত দেরি নয়। ফুচকাওয়ালা বসে আছে আমাদেরই প্রতীক্ষায়, ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে কফি আর পকোড়া গুলো, খেতে হবে তো। ছবি তুলতে হবে তো। জলদি জলদি গাড়ি বাইক স্টার্ট করো সবাই। এহে বড্ড রাত হয়ে গেল গো। যারা যাবার সময় সোহাগ করে বন্ধুর বাইকে যাচ্ছে, ফেরার সময় নিজের ব্যবস্থা নিজেরা করবে, একটাকেও বাড়ি পৌঁছিয়ে দেব না আমি।হক বাবু, উপহারটা নিলেন? খালি হাতে গেলে যদি খেতে না দেয় -

অনির ডাইরি ৭ই ডিসেম্বর, ২০২৩

 


#অনিরডাইরি #কাঁথিরকিস্যা 


হঠাৎ একদিন শুনলাম সুন্দর স্যার আসবেন। জে সুন্দরশেখর, প্রাক্তন আইএএস, অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত মুখ্য সচীব। কোন এক কালে কাঁথির মহকুমা শাসকের দায়িত্বভার সামলে ছিলেন। বর্তমানে হায়দ্রাবাদের পাকাপাকি বাসিন্দা। কি যেন কাজে সস্ত্রীক দীঘা আসছেন, এখন যদি বর্তমান মহকুমা শাসক অনুমতি দেন, তো ওনার প্রাক্তন নিবাসটি এক ঝলক দেখতে চান।  


বর্তমান মহকুমা শাসক, এহেন আব্দারে কিঞ্চিৎ হতভম্ব হয়ে সটান দৌড়ে এলেন তাঁর সহধর্মিনীর কাছে। অধম তখন সদ্য অফিস থেকে ফিরে মেয়ে পেটাতে, থুড়ি পড়াতে বসেছে। এমন সময় ঢংয়ের ছদ্ম অনুমতি ভিক্ষায় যৎপরনাস্তি ক্রুদ্ধ হলাম। এ বাড়ির কোন কাজে, কবে, কে আমার অনুমতির তোয়াক্কা করে? তাছাড়া বাড়িতে যে অতিথি স্বয়ং আসতে চান, তাকে না বলার কুশিক্ষা আমার আছে নাকি? 


গৃহকর্তা কান এঁটো করে হেসে বললেন, ' জানি তো। সেই ভরসাতেই বলেছি, অবশ্যই আসবেন।' জবাবে সুন্দর স্যার বলেছেন, "তোমার গিন্নি যদি ওই দিন থাকেন তো খুব ভালো হয়। আমার স্ত্রী ওর জন্য সামান্য কিছু উপহার নিয়ে যাবে।" কি সর্বনাশ! আবার উপহার কেন? অনাগত মান্যগণ্য অতিথিদের জন্য কি প্রতি-উপহার কেনা যায়, সেই নিয়ে বেশ খানিক মস্তিষ্ক প্রক্ষালন-পূর্বক আমরাও কিছু কিনলাম টুকটাক। শৌভিককে বললাম," বল, এলে কিন্তু অবশ্যই খেয়ে যেতে হবে।" বিজ্ঞের মতন মাথা নেড়ে শৌভিক বলল, "ঠিক ঠিক, খাবারে  ইডলি ঢোসা, দই বড়া রাখব।" 


এই না হলে আমার বর। দক্ষিণ ভারতীয়কে উনি দক্ষিণী খাদ্য দিয়ে আপ্যায়ন করবেন, কেন রে ভাই? বলি আমাদের কালিয়া, কোর্মা, পোলাও, শুক্তো, ছেঁচকি, চচ্চড়ি, ছ্যাচড়া, ডালনা, অম্বল, দই, মিষ্টি কি দোষ করল? শুধু একবার জেনে বল ওনারা নিরামিষাশী কিনা, বাকি বন্দোবস্ত আমার।

জানতে গিয়েই বাঁধল বিপত্তি। সুন্দর স্যার বললেন, কলকাতা থেকে কাঁথি পর্যন্ত উনি না খেয়ে আসতে পারবেন না।  কারণ ওনার ভাষায়, "When I'm hungry, I get very angry."  তাই কোলাঘাটে থেমে, লাঞ্চ করেই আসবেন, আমরা যেন অযথা ব্যস্ত না হই। 


বাপরে কি রাগী লোক রে ভাই! যতই বলুক কিছু খাব না, তবুও সামান্য জলযোগের ব্যবস্থা করাই হল। তখন গরম কাল, তাই- দইয়ের ঘোল, তরমুজ, আঙুর, পাকা পেঁপে, বাগানের কাজু, রসগোল্লা আর মিষ্টি দই। ভালো চা আনানো হল খুঁজে পেতে। কাঁথিতে যে চা আমরা খাই, তাতে না থাকে গন্ধ না স্বাদ। সবকিছু সেরে, সাজিয়ে গুছিয়ে, আদর্শ বঙ্গ বধূর মত সুতির শাড়ি পড়ে, অপেক্ষা করতে লাগলাম মাননীয় অতিথিদের জন্য।


অফিস ছেড়ে তিনটে নাগাদ চলে এল শৌভিক। কাঁটায় কাঁটায় সোয়া তিনটে, বাংলোর মস্ত সবুজ গেটটা খুলে, ঢুকে এল দুধ সাদা ইনোভা গাড়িটা। শৌভিক আর আমি ত্রস্ত হয়ে এগিয়ে যাবার আগেই গাড়ির দরজা খুলে লাফিয়ে বেরিয়ে এলেন, এক দশাসই চেহারার প্রৌঢ়। এক গাল হেঁসে, আমাকে করজোড়ে নমস্কার জানিয়ে বললেন, " বৌদি কেমন আছে?"  দক্ষিণ ভারতীয়দের মত ঘোর কৃষ্ণবর্ণ, মাথা ভর্তি একরাশ কালো চুল, ততোধিক কালো ঝোড়া গোঁফ এবং এক গাল হাসি। কে বলবে, এই লোকটা প্রায় সত্তর? 


গাড়ির অন্য দিকের দরজা খুলে ওনার স্ত্রী নেমে এলেন, আকৃতি এবং প্রকৃতিতে একেবারেই সুন্দর স্যারের বিপরীত মেরুর বাসিন্দা। নাতিদীর্ঘ উচ্চতা, গৌরবর্ণ, ধীর, স্থির, লক্ষীমন্ত মহিলা। আমরা যথোচিত আপ্যায়ন পূর্বক ভিতরে যাবার অনুরোধ করলাম যুগলে। কিন্তু ওনাদের চোখ বাংলো থেকে আর সরেই না। দুজোড়া চোখে উপচে পড়ছে একরাশ স্মৃতি আর অপার মুগ্ধতা। দেশী ভাষায় পরস্পরকে কিছু বলতে শুরু করে বোধহয় হুঁশ ফিরে পেলেন দুজনে। আমাদের উপস্থিতি সম্পর্কে সচেতন হয়ে ভাষাটা বদলে গেল  ইংরেজি, হিন্দি আর বাংলার সংমিশ্রণে। স্ত্রীর সাথে কয়েক মুহূর্ত সোহাগী দাম্পত্যালাপ করে, সুন্দর স্যার বললেন, "জানো, এইখান থেকে প্রথম সংসার জীবন শুরু করি আমরা-"। 


বৈশাখের প্রচণ্ড দাবদাহে পুড়ছে কাঁথি। কোন মতে প্রৌঢ় দম্পতিকে বসার ঘরে এনে, বাতানুকূল যন্ত্র চালিয়ে দেওয়া হল। মুখের সামনে ধরা হল দইয়ের ঘোল। টাটকা ফল, মিষ্টি আর কাজু। কাজু গুলো বাংলোর গাছের শুনে আর প্রতিবাদ করলেন না দোঁহে। ঘোলে চুমুক দিতেই সুন্দর স্যারের জাঁদরেল কালো গোঁফ, পলকে সাদা। 


মাতৃসুলভ ভঙ্গিতে ম্যাডাম বললেন, " জানো আমরা ক্লাসমেট। বিয়ের পর ও হঠাৎ করেই সিভিল সার্ভিস পরীক্ষাটা দিয়েছিল, বেঙ্গল ক্যাডার হওয়াতে কি খুশি যে হয়েছিলাম আমরা। কাঁথিতে পোস্টিং হল যখন, আমিও চলে এলাম বাচ্ছাদের নিয়ে। তখন বাংলোটা এমন ছিল না। চারিদিকে শুধু মাটি আর মাটি। সেবার শীতে ফুলকপি আর পালং শাক লাগিয়েছিলাম আমরা, এত হয়েছিল খেয়ে বিলিয়েও শেষ করতে পারিনি।"


বলতে বলতে কি যেন মনে পড়ে যায়, ভদ্রমহিলা আড় চোখে সুন্দর স্যারের দিকে তাকিয়ে বলেন, " একবার কি হয়েছিল জানো? সেদিন রবিবার, সুন্দরজী বাগানে দাঁড়িয়ে গাছে জল দিচ্ছেন, আর একটা লোক এসে বলে, 'এই মালি, এসডিও সাহেব আছেন?' সুন্দরজীও এত বদমাইশ ছিলেন, বললেন, ' একটু দাঁড়ান দেখে আসছি।'"


সম্মিলিত হাসির প্লাবনে ধুয়ে যায় মোদের সরকারি আবাসের বসার ঘরটা। শৌভিকের সাথে সুন্দরজীর গল্প জমে, তখন আর এখনকার কাজের ধারা, গণ্ডি, পরিসর, জটিলতা ইত্যাদি নিয়ে। আমার কাছে ম্যাডাম খুলে বসেন স্মৃতির ঝাঁপি।" খুব ভালো লাগতো কাঁথি, জান তো। আমার ছেলেমেয়েদেরও খুব প্রিয় এখানকার স্মৃতি। আমরা এখানে আসছি বলে ওদের কি আনন্দ। রাত্রি হলেই ফোন করবে সবাই আর খুঁটিয়ে জানতে চাইবে, কি দেখলাম। কেমন দেখলাম। চেনা কার সাথে দেখা হল এইসব। 


কাঁথি ছেড়ে যাওয়ার ইচ্ছে ছিল না আমাদের, কিন্তু সমস্যা দেখা দিল যখন বাচ্ছারা একটু বড় হল। একটাও ইংরেজি মিডিয়াম স্কুল ছিল না তখন আশেপাশে। বাড়িতে রেখে পড়াব যে, ইংরেজি জানা কোন ভালো টিউটর পর্যন্ত পাইনি তখন। কাঁথি আমার জন্য একদিক দিয়ে খুব লাকি।

এখান থেকেই চাকরির পরীক্ষা দিলাম, পেয়েও গেলাম। ছেলেমেয়েকে এখানে রেখেই গিয়ে জয়েন করতে হল হায়দ্রাবাদে। ২-৩ মাস বাংলো স্টাফেদের কাছেই রয়ে গেল ছেলে মেয়ে আমার। ওরা এত ভালোবাসতো আমার বাচ্ছাদের, যেদিন নিয়ে গেলাম সবার কি কান্না।"


 সুন্দর স্যারদের চমকে দেবে বলে,সেই সময়কার বাংলো স্টাফদের খুঁজে বার করার চেষ্টা করেছিল শৌভিক। পায়নি। সবাই বর্তমানে অবসৃত, কেউ কেউ মৃত। ম্যাডাম জানতে চান," পাশের ঘরটা কি করো তোমরা?" বুঝতে পারি উনি আর একবার ছেড়ে যাওয়া জীবন আর সংসারকে অনুভব করতে চান। সাদরে ভিতরে নিয়ে যাই, খাবার ঘর থেকে রান্না ঘর, অতিথি ঘর থেকে তুত্তুরীর ঘর, আমার অগোছাল শোবার ঘর -এক পা এক পা করে হাঁটেন উনি, পরম মমতায় হাত বোলান সরকারী ভাড়া বাড়ির উজ্জ্বল হলুদ রঙা দেওয়ালে। " এর আগেও একবার এসেছিলাম জানো তো। একদম ভালো লাগেনি। কি নোংরা, ধুলো পড়া, কুৎসিৎ ছিল সবকিছু। এবার খুব ভালো লাগছে। কি পরিষ্কার করে গুছিয়ে রয়েছ তোমরা।" স্মৃতি মেদুরতায় ভারী হয়ে আসে কণ্ঠ, "এই খানে খেতে বসতাম আমরা, এই ঘরটায় বান্টি পড়ত স্যারের কাছে, এই ঘরে মেয়ে নিয়ে ঘুমাতাম আমি, ওই ঘরের দরজা খুলে এক বর্ষায় এত বড় একটা সাপ দেখেছিলাম আমি -"। বলতে - শুনতে খেই হারিয়ে ফেলি আমরা। আমার মধ্যে উনি ওনার অতীতকে দেখেন আর আমি ওনার মধ্যে দেখি আমার ভবিষ্যৎ।


রোদ পড়ে আসে, সমুদ্র বায়ুর দাপটে মাথা ঝাঁকায় বাংলোর বুড়ো আম-জাম-তেঁতুল-কাজুবাদাম গাছ গুলো।শৌভিক আমন্ত্রণ জানায় অফিস দেখতে যাবার জন্য। উৎসাহিত হয়ে পদব্রজেই রওনা দেয়, প্রাক্তন আর বর্তমান মহকুমা শাসকদ্বয়। আমার হাত ছাড়েন না ম্যাডাম। "তুমি আমার সাথে গাড়িতে চলো।"  ইনোভা গাড়ি ভর্তি তন্তুজের শাড়ি, শ্রীলেদার্সের জুতো ইত্যাদি, এক টুকরো কলকাতা। 


ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে সুন্দর স্যারকে প্রতিটা সেকশন দেখায় শৌভিক। সুন্দর স্যারের সমসাময়িক লোকজন কেউই আর নেই, ওনার বিদায় সম্বর্ধনায় গান গেয়েছিল যে ছেলেটি, তিনি বর্তমান মহকুমা শাসকের গুরুগম্ভীর আপ্ত সহায়ক। মহকুমা শাসকের চেম্বারে বসে অন্ধ্রপ্রদেশ আর তেলেঙ্গানার বিবাদের কারণ বিশদে বোঝান ম্যাডাম। নিমন্ত্রণ করেন ওনার শহরে, " হায়দ্রাবাদ এসো।" সুন্দর স্যার বলেন, " চলো, চলো আমাদের সাথেই চলো। এত বছর আছি, আমরাও কিছু দেখিনি। তোমাদের সাথে আমরাও ঘুরব।" শৌভিক এর দিকে তাকিয়ে বলেন, " ডিএম কে বলব? দুদিন ছুটি দিতে -"। শৌভিক হাসে, ম্যাডাম মুখ ঝামটে বলে, " সুন্দরজীর রসিকতার রোগ আছে। কথায় কথায় ছড়া বানায় আর লোকজনের হাড় জ্বালায়। আজ সকালে তোমার বরকে কি বলেছে শুনেছ?" রাবণের মত হাহা করে হেসে মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে সুন্দর জী বলেন, "হ্যাঁ বলেছি, when I'm hungry, I get very angry."


বেলা গড়িয়ে যায় সূর্য ঢলে পড়ে। বিদায় নেন ওনারা। যাবার আগে আলিঙ্গন আর আশীর্বাদ করে যান ম্যাডাম, আর সুন্দর স্যার আমার মাথায় হাত রেখে বলেন, " চলে যাচ্ছি আম্মা, তবে যাবার আগে অনেক আশীর্বাদ করে যাচ্ছি। খুব ভালো থেকো। তোমাদের থেকে যে আতিথেয়তা পেলাম, অন্নপূর্ণা আর আমি বিমোহিত। এই না হলে বাঙালি! এই আতিথেয়তা কেবল বাঙালিরাই দিতে পারে। তাই দেখো, অবসর নেবার পরও,নানা ছুঁতোনাতায় বারবার ফিরে আসি এই রাজ্যে।"

অনির ডাইরি ১লা ডিসেম্বর, ২০২৩

 


#সব_চরিত্র_কাল্পনিক #অনিরডাইরি 


সে অনেককাল আগের কথা। তারপর কত্ত কি হল, বারো বছরের বনবাস, আড়াই বছরের অজ্ঞাতবাস, আরো না জানে কত, কত্ত কি। সেদিনও এমনিই মিঠে রোদ উঠেছিল। বাতাসে ছিল হাল্কা হিমেল স্পর্শ। অল্প ধোঁয়াশা-কুয়াশা মাখা মহানগর জুড়ে কেমন যেন উৎসবের গন্ধ। রামধনু রঙা পশম আর পশমী পোশাকের পসরা সাজিয়ে ওয়েলিংটনে বসেছিল একেবারে পুতুলের মত দেখতে ভুটিয়া নরনারীর দল, ময়দানে বাঁশ বাঁধছিল যেন কারা, মেলা বসবে যে।  


সেজে গুজে,গেরুয়া সবুজ রঙা সবথেকে ভালো জামাটা পরে বেরোল যখন মেয়েটা, ঘড়ি বলছে বেলা এগারো। সাজতেও তেমন জানত নাকি মেয়েটা? সাজ বলতে তো সেই ল্যাকমের ক্লেনজিং মিল্ক, আয়ুরের গোলাপী টোনার আর ভ্যাজলিন বডি লোশন। তাই মুখে মাখত মেয়েটা। তার ওপরে ল্যাকমের সানস্ক্রিন, চোখে ল্যাকমেরই কালো আইলাইনার আর ঠোঁটে লিপস্টিক। লিপস্টিকও একটাই ছিল মেয়েটার, গোলাপী রঙের, এল এইটিন ব্র্যান্ডের। নাম ছিল ক্যাম্পা কোলা।  ভাগ্যে অমন সুন্দর সোনালী পশমী রোদ উঠেছিল, তাই না অমন অপরূপা লাগছিল মেয়েটাকে। অন্তত মেয়েটার তাই মনে হয়েছিল বটে সেদিন, ‘আমি অপরূপা। আমি অতুলনীয়া।’ সবই মরশুমের দোষ মশাই। 


হেঁটে হাওড়া ময়দান। সেখান থেকে বৈষ্ণবঘাটা মিনি। থিয়েটার রোডে নামবে মেয়েটা। প্রতীক্ষা করছে কেউ। এর আগে একবার দেখা হয়েছিল বটে, সে আরো অনেককাল আগের কথা। ভালো করে আলাপ পরিচয় কিছুই তেমন হয়নি। ছেলেটাকে হেব্বি নাক উঁচু মনে হয়েছিল মেয়েটার। বড় বেশী সবজান্তা। জানিস তো জানিস, তাই বলে দেখানোর কি আছে রে ভাই। না হয় তুই সোনারটুকরো, আমি ঢিপচালতি গোবরগণেশ। তাই বলে, সেটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখানোর কি আছে? কানাকে কানা, খোঁড়াকে খোঁড়া, গোবরগণেশকে গোবরগণেশ বলতে নেই, এটাও জানিস না? 


তবে সে সব অবশ্যি, এখন অতীত। বিগত কয়েকমাসে দূরভাষের মাধ্যমে বন্ধুত্ব বেশ ভালোই হয়েছে উভয়ের। প্রাথমিক খোলস, সঙ্কোচের বাঁধন খোলার পর দুজনেই তাজ্জব হয়ে গেছে। বড় বেশী রকম মিল উভয়ের মধ্যে। কোথাও যেন মিলে যায়, অনুরণন সৃষ্টি করে উভয়ের হৃদয়ের তরঙ্গ। যেমন যেমন ঘুঁচেছে হৃদয়ের দূরত্ব, তেমনি তিল তিল করে ফুলে উঠেছে মেয়েটা। বাড়িয়ে ফেলেছে বেশ কয়েক কেজি ওজন।আসলে বেশ অনেক কেজি ওজন। কে জানে ছেলেটা ওকে চিনতে পারবে কি না। কথাটা তুলেওছিল আগের রাতের আলাপে, উল্টোদিক থেকে জবাব এসেছে, ‘মানুষ মোটা হয় কি করে? এক জোড়া জুতো কিনে, দৌড়তে শুরু করো, সব ঠিক হয়ে যাবে। ’ বলেছিলাম না, বেশ আঁতেল আর অনেকটা কাঠখোট্টা ছেলেটা। 


থিয়েটার রোডের বেশ খানিক আগেই নামিয়ে দেয় বাসটা। সাহারা সদনের সামনে দাঁড়াবে ছেলেটা, দুরুদুরু বুকে হাঁটতে থাকে মেয়েটা। রাস্তা পেরিয়ে মুখোমুখি হয় তার সাথে, একটা সাদা ঢলঢলে গেঞ্জি থুড়ি টি শার্ট আর সবজে প্যান্ট পরে দাঁড়িয়ে আছে সে। হাতে রোল পাকানো কাগজের বাণ্ডিল। ইতিউতি তাকিয়ে বোধহয় মেয়েটাকেই খুঁজছিল ছেলেটা। সামনে গিয়ে হাত নাড়তে সম্বিত ফিরে পেল ছেলেটা। অদূরে আরেক স্থূলাঙ্গিনীকে দেখিয়ে নার্ভাস ভাবে বলল,‘ আমি তো ভাবছিলাম ঐটা তুমি।’ 


বাকি গল্পটার সাক্ষী মহানগর, সাক্ষী মোহর কুঞ্জ- রবীন্দ্রসদন-নন্দনচত্বর। সাক্ষী ঋতুপর্ণা-সাহেব চ্যাটার্জি আর জয় সেনগুপ্তর ‘চতুরঙ্গ’। সাক্ষী একাডেমির পিছনের ছোট্ট ক্যান্টিন। আর সাক্ষী ধর্মতলা। নন্দন থেকে হাঁটিয়ে ধর্মতলা নিয়ে এসেছিল ছেলেটি। ততোক্ষণে অস্ত গেছেন সূয্যি মামা। জ্বলে উঠেছে মহানগরীর বুকের ওপর শতেক আলোকমালা। বেশ কয়েকবার ফোন করে ফেলেছে গুটি কয়েক ফাজিল বন্ধুবান্ধবের দল। ছেলেটি শুধু একবার জানতে চেয়েছিল, ‘আমার সাথে দেখা করতে এসেছো, এটা জানে না, তোমার পরিচিত এমন কেউ আছে?’ বাসে তুলে দিয়ে নীচে দাঁড়িয়ে ছিল ছেলেটা। ক্লান্ত মেয়েটার মুখে তখন কয়েক হাজার ওয়াটের দ্যুতি। বাসে স্টার্ট দিল ড্রাইভার,কন্ডাকটর হাঁক পাড়ল ,‘হাওড়া-হাওড়া। বেবোন রোড- হাওড়া স্টিশন-ময়দান-কদমতলা। ’ হাত নাড়ল মেয়েটা। ঘুরিয়ে হাত নাড়ল না ছেলেটা, সামান্য মাথা নাড়ল শুধু। তারপর আলগোছে থুতনি চুলকে বলল,‘আরেকটু জোরে হাঁটা প্রাকটিশ করো। বড্ড আস্তে হাঁটো,’ এবং ‘মানুষ যে কি করে, মোটা হয়?’


আবারও বলছি কিন্তু, সব চরিত্র নিছক কাল্পনিক। এক বর্ণ ও বিশ্বাস করবেন না কিন্তু।