Sunday 26 December 2021

ছোট্ট কবিতার বড়দিন

 


মৃদু হলেও, মুখোমুখি ধাক্কা। দোষ আমারই, টিকিটটা পড়তে পড়তে হাঁটছিলাম যে। শশব্যস্ত হয়ে মার্জনা চাইতে গিয়ে থমকে গেলাম। বড় চেনা, বড় প্রিয় এক জোড়া চোখ। বরাবরের মতই চোখ ভর্তি হাল্কা বিরক্তি। কবেই বা আমার দিকে প্রসন্ন হয়ে তাকিয়েছে ঐ চোখের মালিক। থতমত খেয়ে, ক্যাবলার মত হেসে জানতে চাইলাম, সব ভালো কি না। জানতাম উত্তরে ‘হ্যাঁ’ই আসবে। তারপর আর একটু হেসে ভিড়ে মিশে যাব আমি। যদিও মধ্যাহ্ন, তবুও বড়দিন তো বটে। আশেপাশে ক্রমেই জমে উঠেছে উৎসবমুখর রঙবেরঙের সুখী মানুষের ভিড়। ওই ভিড়েই হারিয়ে যাব আমি, মুখকে এবার কিছুতেই আর মনের আয়না হতে দেব না। 


প্রশ্নের উত্তরে ভেসে এল প্রশ্ন।  নাঃ আমি কেমন আছি, জানতে চাইল না সে। স্বভাবসিদ্ধ উদাসীন হয়তো বা সামান্য তাচ্ছিল্যপূর্ণ ভাবেই জানতে চাইল,‘একা?’  অত্যন্ত কুণ্ঠিত ভাবে জানালাম, দোকা আর পাই কোথায়? মেয়েটাকে বলেছিলাম বটে আসতে, এল না। তার চলন্ত সিঁড়িতে উঠতে দারুণ ভয়। অথচ ছোটবেলায় কি ভালোই না বাসত চড়তে, বলত ‘মজার সিঁড়ি।’ বলতে বলতে ব্রেক কষলাম,বড় বেশি ব্যক্তগত কথা বলছি। সে তো জানতেও চায়নি। প্রশ্ন ছিল, আমি একা এসেছি কি না। জবাবে শুধু হ্যাঁ বলে দিলেই তো মিটে যেত। এতক্ষণে বাড়তে থাকা জনারণ্যে মিশে যেতাম আমি। তা নয়, কেন যে নিজেকে এত ছ্যাবলা প্রমাণ করি, বার-বার।  


‘কোন সিনেমা?’ জানতে চাইল সে। জবাব দিলাম। ‘এর টিকিট কাটতে হলে আসতে হয় নাকি? বাড়ি বসেই তো-’। বললাম, তা যায় বটে, তবে খামোখা কনভিনিয়েন্স ফি’র নামে অনেকটা টাকা কেটে নেয় ব্যাটারা। বলেই জিভ কাটলাম। কি আনস্মার্টের মত যে কথা বলি আমি। অন্য কিছুও তো বলা যেত। এত স্বচ্ছ হবার দরকারটাই বা কি? মেয়েরা যত  রহস্যময়ী হয়, ততোই বাড়ে তাদের আবেদন। আর  আমায় দেখো-। এতগুলি বছর কিছুই শেখাতে পারল না আমায়। শিখে উঠতে পারেলাম না কি করে বুনতে হয় আলোআঁধারি মায়াজাল। 


ওদিক থেকে অবশ্য ভেসে এল সমর্থনের সুর। ‘হ্যাঁ প্রায় একশ টাকা কাটল বটে।’ তারপর বেশ অনেকখানি নিস্তব্ধতা। শুধু বুকের মধ্যে বিষম যুদ্ধ। নির্বোধ হৃদয় চাইছে, খানিক থমকে দাঁড়াক না এ সময়। আরো কিছু বলুক সে, ফুসফুসে আর একটু ভরেনি তার সৌরভ। অভিজ্ঞ পোড়খাওয়া মস্তিষ্ক বলছে, আবার কেন? 


একই সিনেমা দেখতে এসেছি দুজনে, নাঃ পাশাপাশি সিট পড়েনি। এটা তো আর সিনেমার স্ক্রিপ্ট নয়। সবথেকে সস্তার টিকিট কেটেছি আমি, একদম সামনের রো এর পরের-পরেরটা। ‘ঠিক আছে’ বলে পিছন দিকে এগিয়ে গেল সে। হলের বাতি তখনও নেভেনি, অথচ কেমন যেন অন্ধকার হয়ে গেল সবকিছু। দম নিতেও চাপা কষ্ট। অঝোর গালি দিচ্ছে পোড় খাওয়া মাথা। বলেছিলাম না, এবার এই ব্যথা সারতে কে জানে লাগবে আরো কত-কত বছর। কি সব বিজ্ঞাপন চলছে পর্দা জুড়ে, বিস্বাদ লাগছে সবকিছু। আলো নিভলে, উঠে যাব কি? 


আলো নেভার আগেই পাশে এসে দাঁড়াল, ইশারায় বলল, পাশের সিটে যেতে। বোকার মত বললাম, এটা যাঁর সিট, তিনি যদি আসেন?  জবাব এল,‘এলে অন্য কোথাও বসবে। ম্যাটিনি শো, সবই তো ফাঁকা-’। 


আলো নিভল, বুকের ভেতর অকারণ বড় ছটফট করছে হৃদয়, মন বসাতে পারছি না একদম। কি যে হচ্ছে পর্দা জুড়ে। মন থেকে মনে কোন সিগন্যাল যায় কি না জানি না, কানের কাছে ফিসফিস করে বলল সে, ‘এটা পি আর মান সিং, ওদের ম্যানেজার, প্রায় ফাদার ফিগার ছিল গোটা টিমের কাছে।’ গল্প এগোচ্ছে, সাথে ফিসফিসানিও। গুলিয়ে ফেলছি, কোনটা কে। বলে দিচ্ছে সে, ‘এটা মদনলাল। ওটা কীর্তি আজাদ। মহিন্দর অমরনাথের বাবার রোলে খোদ মহিন্দর অমরনাথ।’ ধীরে ধীরে থেমে যাচ্ছে মন আর মাথার দ্বৈরথ, ডুবে যাচ্ছি আমিও শৈশবের একরাশ স্মৃতিতে। সমবয়সী আমরা। ঘটনাপ্রবাহ যে সময়কার, তখন নিছক অবোধ শিশু আমরা। ক্রিকেট কি কিছুই বুঝতাম না কেউই। কিন্তু এই দিনগুলোর গল্প তো কম শুনিনি আমাদের বাবা-কাকা-জেঠাদের কাছে। 


উৎসাহী শ্রোতা পেয়ে বলেই যাচ্ছে সে, ‘ একদম ক্লাইভ লয়েডের মত ভাবভঙ্গী।  হাঁটছেও অমনি সামান্য কুঁজো হয়ে। বকের মত। পুরো ভিভ রিচার্ডস্ এর মত করে ব্যাট চালাচ্ছে।’ গলায় ঝরে পড়ছে উত্তেজনা। আমী জানি লোকটার প্রাণের প্রতিটা তন্ত্রিতে মিশে আছে ক্রিকেট। বড় ভালো খেলত এককালে। তখনও ঘণ কৃষ্ণ কেশদামের ফাঁকে উকি মারেনি একটা দুটো কাশফুলের গোছা। জানি এখনও সুযোগ পেলে ইউটিউব খুলে পুরাণ ম্যাচের রেকর্ডিং দেখে লোকটা। লোকটার কাছে ভিভ রিচার্ডস নিছক ক্রিকেটার নন, ঈশ্বর স্বয়ং।  


ব্যাগের মধ্যে কেঁপে উঠল বেরসিক মুঠোফোন। বার করতে গেলাম, বিরক্ত হল সে।  ‘থাক না। ওটা থাক।’ পরক্ষণেই তরল হয়ে এল কণ্ঠস্বর, ‘এই ম্যাচটা কিন্তু ইণ্ডিয়া হারবে। পরেরটাও। ম্যালকম মার্শালের বল বেঙ্গসরকারের থোবড়া ভেঙে দেবে।’ থুতনিতে সত্যিই আঘাত পেল পর্দার বেঙ্গসরকার, বিবেকহীনের মত, বল থেকে টুসকি মেরে রক্ত ঝেড়ে ফেলল পর্দার মার্শাল। নিজের সিটে সটান হয়ে বসল সে, বলল, ‘ ওয়েস্ট ইন্ডিজের প্লেয়ারদের এমন ভিলেনের মত দেখাচ্ছে কেন? আসলে তো ওরা ভিলেন নয়। নিছক বিপক্ষ কেবল। যেটা দেখালো না, সেটা হল,পরের বলটা করতে গিয়ে মার্শাল দেখেছিল বলটায় খানিক মাংস আর রক্ত লেগে। দেখে ও মাঠেই বমি করে দিয়েছিল।’ বেশ বুঝতে পারি, মন আর মাথাকে ক্রমশঃ  ঘিরে ধরছে অপরিসীম মুগ্ধতার কুয়াশা।D


বাড়ছে উত্তেজনার পারদ। এর পরের ম্যাচটা জিতবে তো? ব্যগ্র হয়ে জানতে চাই আমি। ‘হ্যাঁ একদম। এরপরের ম্যাচেই তো জিম্বাবোয়ের বিরুদ্ধে কপিলের ওয়ার্ল্ড রেকর্ড।’ ৯রানে পড়ে যায় ৪ উইকেট। যদিও জানা ইতিহাস, তবুও ড্রাম বাজতে থাকে বুকের মধ্যে। অন্ধকারে কি করে বোঝে সে কে জানে, বলে ১৭ রানে পাঁচ উইকেট পড়ে গিয়েছিল। তারপর মদনলাল আর কিরমানিকে সঙ্গে নিয়ে বেদম পেটায় কপিল।’


দমবন্ধ  করা সুখ বড় স্বল্পস্থায়ী। জ্বলে ওঠে সিনেমা শেষের আলো। স্ক্রিনে তখন মুখ খুলেছেন আসল কপিল দেব। স্ক্রিন জুড়ে ফুটে উঠছে একের পর এক সাদাকালো ছবি। কেউ বসে দেখছে, কেউ বা উঠে ভিড় জমাচ্ছে এক্জিট লেখা দরজার সামনে। একদম ইচ্ছে করছে না উঠতে, নীরবে পর্দার দিকে মোহিত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে পাশের জনও। তবুও উঠতেই হয়, একটু আগের দমবন্ধ করা সুখের মুহূর্ত গুলোকে স্মৃতিতে তালা বন্ধ করে ধরতেই হয় নিজের নিজের রাস্তা। R


হ্যাংলা মন শুধু চিৎকার করে ওঠে, 'আরও কিছুক্ষণ না হয় রইলে কাছে--'। শুনতে যে পেল না সেও বুঝলাম। মুখ বন্ধ ছিল যে। বড় সাহস বেড়ে গেছে মনের, আজ আর কিছুতেই থামতে দিতে চায় না কথার স্রোতকে। নিছক খেজুরে কথা বলার জন্যই বললাম,“ তোমার সেই ডাস্ট এলার্জি?সেরে গেছে বুঝি?” জবাবে ভ্রু কুঁচকে বলল,“কমোনি তো দেখছি এক ছটাকও। ” মোটা বলল বুঝি, রাগ হল না তো?হৃদয়ের বেদনা যেন কিছুটা উপশম হল, বললাম,“নাঃ কমিনি। শত্রুর মুখে ছাই দিয়ে বরং বেড়েই গেছি। ” হাল্কা হাসির রেখা ফুটে উঠল কি  ওষ্ঠ আর অধরের জটিল বিভঙ্গে? সুযোগ বুঝে বললাম,“একটা সেল্ফি?” বলল,“সেল্ফাইটিস্ টাও বেড়েছে দেখছি।” বলতে পারলাম না,“কয়েদ করে রাখতে চাই এই মুহূর্তটাকে। যেমন রেখেছি তোমার সঙ্গে কাটানো আরো অজস্র মুহূর্ত।" বলতে পারলাম না, একদলা কষ্ট কোথা থেকে এসে চেপে ধরল বুক আর গলা। ছলছলে চোখকে অন্যদিকে ঘোরালাম, ধরা পড়তে চাই না। কিছুতেই না। সূর্য কি পশ্চিমে ঢলে পড়ল খানিকটা? এবার যেতে হয় এবং যেতে দিতেও হবে। মন বলল,“ভালো থেকো। ” আর সে? সে বলল,“চলো তোমার ছবিটা তুলে নি”। হাসলাম দুজনেই। ক্যামেরার সামনে হাসতে হয় তো। শাটার বন্ধের সাথে সাথেই কি নেমে আসবে নিশ্ছিদ্র  অমানিশা?না কি সব নিয়ম ভেঙেচুরে দুমড়ে মুচড়ে উল্টোদিকে দৌড়বে পৃথিবী?K

Wednesday 22 December 2021

অনির ডাইরি ২২শে ডিসেম্বর, ২০২১

 


#তাম্রলিপ্তকড়চা 


চেম্বারের দরজায় পর্দা লাগাতে চেয়েছিল সাপ্লায়ার ছেলেটি। ‘পর্দা লাগিয়ে নিন ম্যাম। নাহলে যে সে ঢুকে পড়বে। এখানকার সব অফিসারদের ঘরেই দরজায় পর্দা লাগানো।’ এক কথায় নাকচ করে দিয়েছি। ইল্লি আর কি! একে তো ভাঁড়ে মা ভবাণী। টাকাপয়সার জন্য রীতিমত অ্যালুমিনিয়াম বাটি হাতে হেড আপিসে চক্কর কাটি আজকাল। ‘টাকা, নেই, টাকা চাই, টাকা কই’ করে মহানগরে এমনি রেপুটেশন বানিয়েছি যে, আমায় দেখলেই সেকশন ফাঁকা। হেড আপিসে ফাণ্ড অ্যালটমেন্ট ছাড়ে যে ছেলেটি, আগেরদিন বলেই ফেলল, ‘আপনাকে দেখলে আজকাল আমার হেবি ভয় লাগে ম্যাডাম।’ সুকন্যা সাক্ষী। একটুও বাড়িয়ে বলছি নেকো।


তবে টাকা না থাকার থেকেও বড় কথা হল, আমি চাই না মানুষ আমার চেম্বারে ঢুকতে ভয় পাক। এটা ল্যাবার দপ্তর। সমাজের একদম তলার দিকের মানুষদের নিয়ে আমাদের কাজ, তারাই যদি তাদের দাবীদাওয়া সুখবিসুখ না জানাতে পারে, কি লাভ অমন চেয়ারে বসে। এত বচ্ছরের লেবারগিরি একটা জিনিস শিখিয়েছে, যত অভিযোগের মূল হল যোগাযোগের অভাব। কেউ এটা ভেবে আসে না যে আমার হাতে সোনার কাঠি আছে, ছোঁয়াব আর সব মনোমত হয়ে যাবে। কি পারব, কতটুকু পারব, আদৌ পারব কি না, কেন পারব না বা কেন পারছি না খুলে বলে দিলে অনেকাংশে ঝামেলা মিটে যায়। অন্তত স্তিমিত তো হয় রে বাপু।


এই জ্ঞানের কথা শুনিয়ে, কাগজের কাপে আদা, গোলমরিচ আর বিটনুন দেওয়া একখানা পাঁচন মার্কা চা খাইয়ে আমার কোলাঘাটের ইন্সপেক্টর পার্থকে বললাম, তাহলে বুঝলে কি না? যত অভিযোগের মূল হল যোগাযোগের অভাব। চলো যোগাযোগ করি। এত গুলো বেনিফিট ছাড়ছ, যোগাযোগ না করে ছাড়বেই না কেন? যোগাযোগ করো বিধায়ক মশাইয়ের সাথে, বিডিও সাহেব যদিও প্রচণ্ড ব্যস্ত তবুও বলোই না তাঁকে একবার। বলো পঞ্চাযেত সমিতির সভাপতি, সহ সভাপতি, পঞ্চায়েত সমিতি তথা জেলা পরিষদের সদস্য, পঞ্চাযেত প্রধানদের। কোলাঘাট আমার সবথেকে বড় এলডব্লুএফসি। এই ব্লকের প্রায় ৬৪ হাজার মানুষ আমাদের নথিভুক্ত শ্রমিক।শুধু এই ব্লক থেকেই ১৫৭ জন নির্মাণ আর পরিবহন কর্মীকে পেনশন দিই আমরা। সবথেকে বেশি ডেথ কেস এবং ফাইনাল পেমেন্ট অর্থাৎ মেয়াদপূর্তিতে টাকা ফেরতের আবেদনও আসে এই ব্লক থেকে। এত কাজ করো, সেটা কেউ জানতেই পারে না। আর যেটা পারো না, সেটা নিয়েই উড়ে বেড়ায় অভিযোগের গরম বাতাস। 


আমার জ্ঞান না কালেক্টরেটের চায়ের গুণ জানি না, দারুণ ভালো একটা প্রোগ্রাম নামাল বটে আজ পার্থ, শুভদীপ্ত আর তাদের দলবল। ৩৩জন মৃত বেনিশিয়ারীর উত্তরাধিকারীর হাতে তুলে দেওয়া হল প্রায় ২২লাখ টাকার মৃত্যুকালীন অনুদান। জনা ৩০ কে দেওয়া হল মেয়াদপূর্তির টাকা। তবে আজকে আমাদের অনুষ্ঠানের স্টার যিনি ছিলেন, তাঁর নাম হল শেখ ইসমাইল। এই সেদিন অবধি বাস চালাতেন উনি। তখনই নাম লিখিয়েছিলেন আমাদের পরিবহন কর্মীদের সামাজিক সুরক্ষা প্রকল্পে। ষাট বছর হবার পর আবেদন করেন পেনশনের জন্য। একটু সময় লেগেছে বটে, তবে যেদিন থেকে ওণার ষাট বছর হয়েছে সেইদিন থেকে ধরে আজ পর্যন্ত নিঁখুত ভাবে গণনা করে মোট সাড়ে তেত্রিশ হাজার টাকার পেনশন ঢুকেছে ওণার ঝুলিতে। প্রোগাম শেষে আমি স্বয়ং ওণার কাছে গিয়ে বললাম, ‘দাদা চলুন তো, আপনার সাথে একটা ছবি তুলি। আপনারাই হলেন আসল যোগাযোগ। আপনারা আছেন বলেই এই দপ্তরটাকে এত ভালোবাসি। ’ 


পার্থকে যে জ্ঞান দিয়েছিলাম,  তা বাকিদেরও খাওয়ানোর চেষ্টা করেছিলুম। সেগুলো শুনল বটে, মাথাও চুলকালো বেজায়, তারপর কোথায় সটকে পড়ল একে একে। ভাবছে আমি খেয়াল করিনি-।সবকটাকে চেপে ধরব, শুধু একবার ফাণ্ডটা ঢুকতে দিন।

Sunday 19 December 2021

অনির ডাইরি ১০ডিসেম্বর, ২০২১

 

গতকাল মাসির জন্মদিন ছিল। মাসির  জন্মদিন। ভূতের  জন্মবার। আর পাঁচজন মাসির জীবনচরিতের মতই তুত্তুরীর মাসিরও জীবন পাক খেয়েছে একই পাকদণ্ডী বরাবর, যার গতিমুখ  বড়ই উচ্চাবচ। 

শৈশবে উদ্দাম মজা, ঝপাং করে ঝাঁপিয়ে পড়ে ডুব সাঁতারে জোড়া পুকুর এপাড়ওপাড়। মশারি দিয়ে বর্ষাকালে চুনো মাছ ধরা। জোড়া বিনুনী দুলিয়ে ইস্কুল যাওয়া। পথেই আলাপ তাঁর সাথে, যাঁকে কোন এককালে তুত্তুরী ডাকত মেসো। তারপর আর কি? গন্ধর্ব থুড়ি পালিয়ে গিয়ে বিয়ে। মাসির তখন সপ্তম শ্রেণী, মাসির সদ্য শাড়ি। 

তারপর বড়দিদি,বড়দাদা এবং ছোটদিদি।সংসারের হামানদিস্তার বাড়ি খেয়ে ভালোবাসা পালাল জানলা গলে। শুরু হল সংগ্রাম। জীবন সংগ্রাম। বাড়ি বসে আচার-নাড়ু-পাটালি বানানো। ধূপ বানানো। চানাচুর বানানো।শায়া-ব্লাউজ বানানো।  চেষ্টা তো করেছে মাসি অনেকই। হয়তো করেছিলেন মেসোও। আমরা তো এক পক্ষের গপ্প শুনি কেবল। 

কোথায় যেন চাকরী পেয়েছিল মেসো, ছোট চাকরী,তবে সরকারী তো বটে। শুধু যেতে হত বহু দূর। মেসোর মা ছাড়েননি তাঁর আদরের দুলালকে। কেঁদে কেটে কাটিয়ে দিয়েছিলেন নাম। জীবনে কখনই আর ঘুরে দাঁড়াতে পারেননি মেসো। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছিল সংসার, বাধ সাধল মেসোর বাবার হঠাৎ অসুস্থতা। ঘটি বাটি বেচেও বাঁচানো গেল না তাঁকে।  কাজের ধান্ধায় স্থানীয় নার্সিংহোমে আয়ার কাজ সেই তখন থেকে-। আজও জনৈক স্বর্গীয় ডাক্তারের নাম করার সময় কপালে হাত ঠেকান মাসি। হাতে ধরে কাজ শিখিয়েছিলেন যে ডাক্তারবাবু।

 

তুত্তুরী তখন ছ দিন বয়স। সোমবারে জন্মেছে বটে,রবিবারের আগে ছাড়েননি বুড়ো ডাক্তারবাবু। মা প্রচুর কান্নাকাটি  জুড়েছিল, বাড়ি যাবে বলে। ততোধিক ধমকেছিলেন ডাক্তারবাবু। অবশেষে রবিবার ভোরে বাড়ি ফেরা। উফ্ কি বৃষ্টি, ধুয়ে যাচ্ছে হাওড়া শহর। ঠাম্মাদাদুর কোলে চেপে হাওড়ার বাড়িতে ঢুকল তুত্তুরী। চকাস্(বড় মাসি), টুলটুল দাদা(বড় মেসো), বড় দাদু, আতুপাতু(বড় দিদা), দিদি(পিসি দিদা), দাদু,মামমাম(দিদা), ছোট দাদু, বড় মামা,বড় মামি সবাই মিলে সে কি টানাটানি। এ বলে আমায় দে। ও বলে আমায়। কত কি যে পেল তুত্তুরী, রূপোর টাকাই তো কতগুলো। আর বেশ কিছু পাঁচশ হাজারের নোট। যার দুটি এই তো সেদিন বের হল, মামমামের লক্ষ্মীর ঝাঁপি থেকে। দাদুর কি চিৎকার, কি বকল মামমামকে। ওগুলো নাকি পচা টাকা। টয়লেট পেপার সমতুল। 

যাই হোক সবার আদরের মাঝে, ঐ বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে কে যেন এল। এসেই স্নান করে, ডেটল জলে কাচা জামাকাপড় পরে কোলে নিল তুত্তুরীকে। তাকিয়ে দেখল তুত্তুরী, ও মা!মাসি তো। 


সেই থেকে বিগত এগারো বছরে তু্ত্তুরীর জীবনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ মাসি। যখনই তুত্তুরী কোন দুষ্টুমি করে, কারো সাথে কথা বলে না বা মিশতে চায় না। লোকে তো দুটো কথাই বলে, “ইশ্ মা কোন শিক্ষা দেয়নি! ইশ্ আয়ার কাছে মানুষ!” তাতে তুত্তুরীর ঘন্টা। তোমাদের কাছে আয়া হতে পারে,তুত্তুরীর পরিবার তো অসম্পূর্ণ মাসি ছাড়া। 

কে তু্ত্তুরীর অপরিসীম বকবক মন দিয়ে শোনে?কে পড়ে শোনায় উপেন্দ্রকিশোর বা অবন ঠাকুর? কাকে কষ্ট করে ঝিলের ধারের বাড়ি পড়ে শোনায় তুত্তুরী? তুত্তুরী দুর্ব্যবহার করে ক্ষমা চাইলেই এক কথায় মার্জনা করে দেয় কে? কে মায়ের চোখ বাঁচিয়ে এখনও আব্দার করলেই খাইয়ে দেয় মাঝে মাঝে? মাখতে দেয় পমেটম? বানিয়ে দেয় মনের মত মুখচাট টিফিন? মাসিই তো। 


মেসো যখন ঝপ করে পাড়ি দিল অন্য জগতে, কে সাদা শাড়ি পরতে দেয়নি মাসিকে? মাসি নিরামিষ খেলে কে রাগ দেখায় আজও? বাড়িতে কোন খাবার এলেই কে তার ভাগের খাবারটা নিয়ে দৌড়য় মাসিকে চাখাবে বলে? কে সুযোগ পেলেই মাসির স্মার্ট ফোনটা হাতিয়ে নেয় আর লাইক,কমেন্ট সাবস্ক্রাইব করে বেড়ায় যত পরিচিত জনের ইউটিউব ভিডিও আর চ্যানেল? তুত্তুরীই তো। কাজেই দাদা-দিদি,মাসএবং কাকারা, আপনারা যদি তুত্তুরীর পরিচিত হন এবং কাল আবিষ্কার করেন যে আপনার ভিডিওতে কমেন্ট করেছেন জনৈকা কনকলতা দত্ত তাহলে মোটেই হতবাক না কিন্তু। 


যাই হোক,মাসি আর মাসির সোনামা এর এত জটিল সম্পর্কের মধ্যে ঢুকে আমাদের কাজ নেই ভাই, মোদ্দা কথা হল হ্যাপি বার্থ ডে মাসি। এমনই থাকুক তোমার সম্পর্ক, আদরে আর অধিকারে মাখা।

অনির ডাইরি ১৪ই ডিসেম্বর, ২০২১

 


যবে থেকে তাম্রলিপ্তে বসতি পত্তন করেছি, জনে জনে শুধু ডেকেই গেছি। এসো না গো, দুদণ্ড জিরোতে। আমাদের সাথে হাসিমজার কটা মুহূর্ত কাটাতে। কে নেই সেই তালিকায়, উভয়ের আত্মীয়স্বজন, যৌথ বন্ধুবান্ধব, উভয়ের সার্ভিস তুতো দাদা-দিদি, ভাই-বনু। মোট কথা যাদের সাথেই সুর বা তালে মিলেছে, মিলেছে লয় এবং ছন্দে তাদেরই আহ্বান করেছি আমরা। আমরা না হয় নাই যেতে পারি মহানগর, মহানাগরিকরাই নাহয় একটু কষ্ট করে আসুক আমাদের কাছে। 


কি ভালো মাছ পাওয়া যায় এই জেলায়। রোজকার রুই-কাতলা-ভেটকিও স্বাদে অতুলনীয় হেথায়। অতিকায় পমফ্রেটই বলুন বা ছোট্ট ছোট্ট গুলি পাবদা স্বাদে যেন অমৃত। আর চিকেন? এখানে এক বিশেষ ধরণের চিকেন পাওয়া যায়, কাঁচা অবস্থায় দেখে রেড মিট বলে ভ্রম হয়। সোয়াদেও খাসির মাংসের মতই খেতে। স্থানীয়রা বলে লড়াই চিকেন। নিজে হাতে রেঁধে খাওয়াব। এত প্রলোভন দেখানো সত্ত্বেও জনগণ আসে কই? আসে কেবল এষারা। এষা-অর্জুন আর কুট্টুস। একবার ডাকলেই চলে আসে। বেশ কিছুদিন না ডাকলে ছটফট করে। তুচ্ছ ব্যাপার নিয়ে মেসেজ করে আমাকে। সম্পর্কে শৌভিকেরই সার্ভিস তুতো বোন, কিন্তু দাদাকে হেব্বি ভয় পায়। যত আব্দার দিদির কাছে। সপ্তাহান্তে ওদের ফেলে যেখানেই যাই, এষার মেসেজ ঢোকে, ‘ কি ভালো ঘুরেছ। তোমরা আমাদের ভুলে গেছ দিদি-’। 


যখন এষা জ্বালায় না, তখন তাকে জ্বালাতন করে  তুত্তুরী। ভুলভাল ইংরেজিতে মেসেজ পাঠাতেই থাকে, অনুরোধ উপরোধ করে, ‘এসো না এষা পিসি।’ শুধু এসোই না, জলদি জলদি এসো। আপিসের কাজ ফেলে, দরকারে আপিসে তালা মেরে পালিয়ে এসো। শুধু যে উৎকট দাবী করে তাই নয়, এষাদের আসার ঢের আগে থেকে বাগানে পায়চারি করে । দূর থেকে কোন গাড়ির আওয়াজ এলেই ছুটে যায় গ্রীলের বড় গেটটার কাছে। উঁকিঝুঁকি মারে। অতঃপর ব্যর্থ মনোরথ হয়ে ফিরে আসে বসার ঘরে বা ঢুঁ মারে বাবার বাংলো চেম্বারে। কর্মব্যস্ত শৌভিকের নজর এড়িয়ে তুলে নেয় বাবার বা আমার ফোন, তারপর ফিসফিস করে জানতে চায়,‘হ্যালো এষা পিসি বা অর্জুন পিসে, তুমি যে বলেছিলে চারটের মধ্যে অফিস থেকে বেরোবে? সাড়ে ছটা বেজে গেল তো!’ 


শেষ পর্যন্ত এষাদের গাড়িটা যখন হর্ন বাজিয়ে এসে থামে তাম্রলিপ্তের মহকুমার শাসকের সরকারী আবাসের সামনে, এদিকে হুড়মুড় করে ছুটে যায় শ্রীমতী তুত্তুরী আর ওদিক থেকে নামানো কাঁচের ফাঁক গলে বেরিয়ে ছুটে আসতে চায় শ্রীমান কুট্টুস। আতঙ্কে যত চেপে ধরে এষা, যত ধমকায় অর্জুন ততো লম্ফঝম্ফ বাড়ে দুই এবং চারপেয়ে দুই ভাইবোনের। শৌভিক বিরস বদনে মন্তব্য করে, ‘এষা বুঝতে পারছ তো,  আসলে কার প্রতীক্ষায় বসেছিল এতক্ষণ। ’ 


আট বছরের  তুত্তুরীর সাথে যখন প্রথম মোলাকাৎ হয়েছিল কুট্টুস বাবুর তখন আমাদের হিসেবে ওর বয়স ছিল কয়েক মাস মাত্র।  আর ওদের হিসেবে চার বা পাঁচ বছর। আমাদের এক বছর সমান ওদের ছয় বছর, এই তত্ত্ব সেদিনই প্রথম শুনেছিলাম। সেদিন থেকেই  তুত্তুরী দিদি আর কুট্টুস ভাই। তারপর বিগত দুবছরে বেড়ে উঠে কুট্টুস এখন বছর আঠারোর তরতাজা যুবক। দিদি সেটা মানলে তো। এখনও দিদির মতোই খবরদারি করে। ধমকায়। কথা না শুনলে বা দুষ্টুমি করলে নালিশ করে, কখনও কখনও গর্হিত অপরাধ যেমন লুকিয়ে প্লাস্টিকের ফুল চিবোলে বা একপেট মাংস আর সেরেলাক খেয়েও হ্যাংলার মত রান্নাঘরের ময়লার বালতি হাঁটকে মাংসের হাড় চিবোলে চোরাগোপ্তা কষিয়েও দেয় দুটো থাপ্পড়। কুট্টুসও কামড়ে দেয় কুটকুট করে। আবার ঝগড়া ঝাঁটি করে,ওকে ফেলে তুত্তুরী চলে গেলেও তীব্র হল্লা জুড়ে দেয় কুট্টুস।


অবিকল মানুষের ছানার মত খেলা করে দোঁহে। ছুটোছুটি-হুটোপাটি-লাফালাফি-নাচানাচি তো বটেই এমনকি স্লিপওভার-স্লিপওভারও খেলে দুজনে। সেটা কি খেলা প্লিজ আমায় জিজ্ঞাসা করবেন না। অনেকক্ষণ মেয়ের সাড়াশব্দ না পেয়ে দেখতে গিয়েছিলাম কি করছে সে, দেখি ভালো করে চাদর মুড়ি দিয়ে শুয়েছে তুত্তুরী। পাশের বালিশে মাথা রেখে শুয়েছে কুট্টুস। তাকে কিসব সাপব্যাঙ গল্প শোনাচ্ছে তুত্তুরী, জবাবে চোখ পিটপিট করছে,হাই তুলছে আর মাঝেমাঝে খরখরে জিভটা দিয়ে দিদির মুখটা চেটে সাফ করে দিচ্ছে কুট্টু বাবু। আমি ঢুকতেই ধড়মড় করে খাটের ওপর উঠে দাঁড়িয়ে লেজ নাড়তে লাগল কুট্টুস। আর ‘মাআআআআআ  তুমি ওকে তুলে দিলে’ বলে প্রবল শোরগোল জুড়ে দিল তুত্তুরী। 


এষারা রাতে থেকে গেলে, ঘুমায়ও দুজনে একসাথে। আগের বার আলাদাই শুয়েছিল দুজনে। দিব্যি মানুষ বাবা-মার মাঝে চার হাতপা তুলে ঘুমিয়েও পড়েছিল কুট্টুস। তারপরই কি যে হল, লাফিয়ে খাট থেকে নেমে দরজা আঁচড়াতে লাগল কুট্টুস। মাঝরাতের ন্যাকামো বলে বেশ খানিকক্ষণ পাত্তা দিল না এষা আর অর্জুন, তখন করুণ সুরে কাঁদতে লাগল কুট্টুস। পেট ব্যথা বা অন্য সমস্যা হচ্ছে ভেবে যেই খোলা হল ঘরের দরজা, ওমনি এক ছুটে তুত্তুরী দিদির ঘরে। সোজা খাটে উঠে, পিছন দিয়ে তুত্তুরী দিদিকে ঠেলে- তার বালিশটা দখল করে গুটিসুটি মেরে শুল। তুত্তুরী তো হেসেই খুন, এষা আর অর্জুন  কোমরে হাত দিয়ে বকেই চলেছে, কি নাটুকে ছানা রে তুই। মাঝরাতে আর কত ঢঙ করবি। 


ঢঙই তো। দিব্যি নদীর ধারে পোজ দিয়ে বসেছিল অর্জুনের সাথে। গোটা দুয়েক ওদের ছবি তোলার পর, তুত্তুরীকে বলা হল, তুই ওর পাশে গিয়ে বস। একসাথে তিনটের ছবি তুলবে বাবা। ওমা তুত্তুরী যেই উবু হয়ে বসল, প্রথমে  তার দিকে একবার তাকাল, তারপর সটান হাত দিয়ে তার হাতটা চেপে ধরল কুট্টুস। যেন ডাকছে, একটু আমার দিকেও তাকা দিদি। তাকাবে কি, দিদি তো হেসেই খুন।

অনির ডাইরি ১৯শে ডিসেম্বর, ২০২১

 


রূপনারায়ণ নদে তখন পূর্ণ জোয়ার। আমরা চলেছি স্রোতের বিপরীতে, মাঝ নদী বরাবর। ঘড়ি বলছে সময় ঠিক মধ্যাহ্ন, শেষ ডিসেম্বরের রেশমী রোদ মোটেই গা জ্বালানো নয়। বরং বেশ মনোরম।উত্তুরে বাতাসে হালকা হিমেল ভাব। ফোলানো স্পিড বোটে নৌকা বিহারে বেরিয়েছি আমরা।  নদীর বিপরীত দিকে হাওড়া জেলার তটভূমি আপাততঃ হাল্কা কুয়াশার চাদরে মোড়া। মুছে যাওয়া তটভূমির জন্যই কেন জানি না, বেশ সমুদ্দুর মার্কা একটা অনুভূতি হচ্ছিল আমাদের। 


বলাতে শৌভিক বলল, কিছুদিন আগে কারা যেন এমনিই বোটে চড়ে সমুদ্রে গিয়েছিল, সমুদ্রের তিন চার কিলোমিটার ভিতরে গিয়ে আচমকা খারাপ হয়ে যায় বোট। পাক্কা দেড় ঘন্টা তারা, চড়া রোদে মাঝ সমুদ্রে বসেছিল ওমনি খারাপ হয়ে যাওয়া বোটে। এক্কেবারে হিচকক সাহেবের 'লাইফবোট' এর মত কেস আর কি। 


বলতে না বলতেই বন্ধ হয়ে গেল আমাদের বোট খানা। খুব এক চোট দাঁত কিড়মিড় করলাম আমি, কোন সময় কোন কথাটা বলতে নেই, সেটাও জানে না মাইরি। তারপর আর কি, বিস্তর খোঁচাখুঁচি, টানা হ্যাজরা এবং হে ঠাকুর এবারের মত তরিয়ে দাও প্রভু।  আমাদের দেরী দেখে অনেকটা এগিয়েও পিছিয়ে এল আরেকটা বোট। তবে খুব কাছে এলো না। মোচার খোলার মত ফোলানো বোট কি না, চলমান বোটের ঢেউ এর ধাক্কায় না হলে উল্টে যাবে যে। 


আমরা সাকুল্যে নয় জন। পাঁচটা লেবার, একটা এক্সিকিউটিভ আর তিনটে ছানা। এত লোক তো আর একটা ফোলানো বোটে ধরে না, তাই ভাগ করে উঠেছি আমরা। আমাদের বোটটা ছাড়ার সময় ও বেগড়বাই করছিল। বন্যার পর থেকে গুদামজাত হয়ে পড়ে থেকে নাকি কি একটা সুইচ বসে গেছে। একটা পিন বা পেরেক না পেলে তাকে তোলা যাচ্ছিল না। বিরক্ত হয়ে শৌভিক বলল, 'এই মনোরঞ্জন তোমার রিভলভারটা এনেছ?' মনোরঞ্জন ওরফে মনা হল মহকুমা শাসকের ব্যক্তিগত দেহরক্ষী। তাঁর পকেটে সবসময়ই একখানা  বন্দুক আর গাড়িতে দুখানা জবরদস্ত লাঠি থাকে বটে। 


মনা তো হেসেই অস্থির। আমরা সমস্বরে হাঁ হাঁ করে উঠলাম, কাকে গুলি করবে? বোটটাকে? দুই বোটম্যান তড়িঘড়ি বলে উঠল, 'গুলি করলে আর চলবেই নি স্যার।' যাই হোক তখন মোনার বন্দুকের ভয়ে দৌড়েছিল বটে, এখন এই মাঝ দরিয়ায় তো আর  মনা নেই। তাহলে কি হবে? বাড়ি ফিরব কি করে? বোট চালকদের অবশ্যি কোন হেলদোল নেই। ওরা জলের বোতল আর কেকের প্যাকেট নিয়েই উঠেছে। আবার শুরু করল টানাটানি। 


কান টানলে মাথা আসার মত, বিস্তর টানাটানির পর অবশেষে ছুটতে শুরু করলেন তিনি। এবার আবার স্রোতের বিপরীতে এমন জোরে ছুটতে লাগলেন যে রীতিমত ঢেউয়ের তালে উঠতে এবং নামতে লাগলাম আমরা। জলের ছিটেয় অর্ধেক ভিজেই গেলাম বিদিশা দি আর আমি। আর তুত্তুরী বলল, 'উফঃ কি গদাগুম রাইড হচ্ছে মাইরি। বাড়ি ফিরেই দাদুকে বলব-'। 



Saturday 11 December 2021

অনির ডাইরি, ৮ই ডিসেম্বর, ২০২১

 


‘হ্যালো, তোমরা কি বেরোলে?’ ফোনের ওপার থেকে ভেসে আসা হ্যাংলা আওয়াজটা দিল মটকা গরম করে। সকাল থেকে দম ফেলার ফুরসৎ পাইনি, দুদিনের জন্য সংসার ফেলে যেতে হলেও কেন যে এত মালপত্র গোছাতে হয়? তারওপর সব দরজায় চাবি দেওয়া, সব জানলা বন্ধ করা, শ্রীমতী তুত্তুরীকে রেডি করা। সক্কাল সক্কাল তাঁর ব্যাগ গোছাতে গিয়ে অন্নপ্রাশনের ভাত উঠে এসেছে গা গুলিয়ে। কি বোঁটকা গন্ধ আলমারিতে। নির্ঘাত পরা জামাকাপড়ই তুলে রেখেছে ভিতরে। তুলে মানে পাট করে ভাবলেন কি? আজ্ঞে না মশাই, জাস্ট পাকিয়ে দলামোচড়া করে ঠেসে ঢুকিয়ে রাখা। 


যাই হোক, একটু ঝেঁঝেই বললাম, ‘আঃ বারবার ফোন করছ কেন? বেরিয়ে, গাড়িতে উঠে ফোন করব বলেছি তো!’ ওপারের হ্যাংলা স্বরটা কিঞ্চিৎ  আশাহত শোনাল, ‘অঃ। এখনও তমলুক থেকে বেরোওনি? আমি ভাবলাম কদমতলা বাজার বা সাঁতরাগাছিতে আছ বুঝি।’ কি করে যে বাবা এরকম ভেবে নেয় জানি না। সকাল এগারোটা নাগাদ আপিসে ঢুঁ মেরে মেয়ে বগলে বেরোব জানিয়েই রেখেছিলাম। তাও-। একগাদা পেনশন কেস নিয়ে যাব মহানগর। বলেছিলাম যা পড়ে আছে, সব নিয়ে যাব। রাজীব, অরূপ আর কারা যেন বলল, ‘ম্যাডাম সব মিলিয়ে পনেরো কেজি হবে। ’ ১৫কেজি পেনশন বইবার ক্ষমতা আমার বা আপিসের গাড়ি কারোরই নেই। মাপজোখ  করে তিন-চার কেজি দিয়েছে ওরা।


সব গুছিয়ে, মেয়ে,মেয়ের প্লাস্টিক (বলা তো যায় না, এককালে গাড়িতে উঠলেই বমি করত তুত্তুরী। সরকারী গাড়িতে বোমো বাচ্ছা তুললে তার মুখে রবি ঠাকুরের দাড়ির মত প্লাস্টিক বাঁধি আমি) নিয়ে বেরোলাম যখন সাড়ে এগারো। মানভঞ্জনের জন্য ফোন লাগালাম বৃদ্ধকে,‘ বেরিয়েছ? সবে? কখন পৌঁছাবে? এসে আবার আপিসও যাবে?’ বাবার সাথে কথা বলার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হল, বাবাই প্রশ্ন করে এবং বাবাই উত্তর দেয়। বাবা বনাম বাবার মধ্যে সবেগে ঢুকে নিজের সমস্যা বা নিজের অভিজ্ঞতার কথা বলতে বসলে, অমনি বাবা টেনে আনে তাদের বা ক্ষেত্র বিশেষে পিতামহের সময়কালের কোন ঘটনা। রঙ্গ রসিকতার মাধ্যমে ঘটনাপ্রবাহ বিশ্লেষণ করে বোঝায়, আমার অভিজ্ঞতা বা অনুভব সে যত তিক্ত বা যতই রসাল হোক না কেন, তা অভূতপূর্ব মোটেই নয়। অগণিত বার বাবার এই টোটকায় হারানো আশা বা উদ্যম ফিরে পেয়েছি আমি, আজ তেমন দিন নয়, তাই বৃদ্ধকে মাঝপথে থামিয়ে জানতে চাইলাম আমার মা জননী কোথায়? সকাল থেকে একটি বারও তাঁর কণ্ঠস্বর শুনিনি কেন?


মা মোটেই অন্তঃপুরবাসিনী বা পর্দানশীন নয়, তবে বাবা আর আমার বাক্যালাপ থেকে বরাবরই নিরাপদ দূরত্ব বজায় রাখে। সর্বোপরি মায়ের একটা অদ্ভূত প্রতিভা আছে, যখনই কেউ ফোন করে, মা, বাবার সামনেই বসে থাকে বা আসেপাশে ঘোরাফেরা করে। কিন্তু ঠিক যেই মুহূর্তে টেলিফোনরত ব্যক্তিটি মায়ের সাথে দুটি কুশল বিনিময়ের আকাঙ্ক্ষা জাহির করেন, কিভাবে যেন ঠিক তখুনি খুব গুরুত্বপূর্ণ কোন কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে অন্য কোথাও চলে যায় মা। আবার মাকে ফোনে না চাইলেও গোঁসা করে মা। আজও তার ব্যতিক্রম নয়। মা কই, প্রশ্ন করার সাথে সাথে বিকট হল্লা শুনতে পেলাম হাওড়া থেকে তাম্রলিপ্ত। ‘ওগো তুমি কোথায়-’।  বাবার গলা দূরভাষ ছাড়াও দিব্যি শোনা যায় এই সব মুহূর্তে। 


ওদিক থেকে কোন জবাব আসে না। বেশ খানিকক্ষণ হৈচৈ করে অবশেষে ফোনের ক্যামেরাটা অন করে বাবা, দেখি দূরে দালানের বেসিনে দাঁড়িয়ে কি যেন করছে মা। ঘাড় নেড়ে ইশারায় বলছে, অপেক্ষা করতে। স্বভাবসিদ্ধ রসাল সুরে বাবা বলে,‘দেখতে পাচ্ছ?তোমার গর্ভধারিণী কি কচ্ছেন? তেনাকে ফোন ধরতে বললেই তেনার দর কি রকম বেড়ে যায়? ইঁদুরে গু(আমরা একে ঘটি, তায় হাওড়ার বাসিন্দা ফলতঃ এই শব্দটি আদৌ অপশব্দ  নয় আমাদের কাছে) থেকে কিছু রোগের ওষুধ তৈরি হয়। এখন ইঁদুর যদি সেটা জানতে পারে,তাহলে তাদের পায়া ভারি হয়ে যায়। বুঝলে কি না। রোজ রান্নাঘরে ইয়ে(আসল শব্দটা সেন্সর করলাম) করে যায়, অথচ সেদিন সে গাড়ু নিয়ে যায় তিনতলার ঠাকুরঘরে ইয়ে( আবার বিপ্ এবং সেন্সর্ড) করতে। তোমার মায়ের হল তেমনি অবস্থা। এতক্ষণ আমার সামনে গালে হাত দিয়ে বসে মুচকি মুচকি হাসছিলেন, ঠিক তুমি চাইলে তার আগের মুহূর্তে ওণার মনে হল জলখাবারের বাসনগুলো মেজে আসি।তারপর বাসন মাজতে গিয়ে মনে হল, মাজবই যখন, তখন বাসনের সাথে সাথে দাঁতটাও আরেকবার মেজেনি।’ প্রবল হাসতে হাসতে ফোন কাটলাম। কোলাঘাট ব্রিজের ওপর দিয়ে লেজ তুলে  ছুটছে গাড়ি, তলায় চিকচিকে রূপালী রূপনারায়ণ নদ। নদ পেরোলেই আমার জেলা, আর একটু এগোলেই আমার শহর। প্রিয় শহর, আর একটু ধৈর্য ধরো। আসছি আমি, তোমার সব রূপ-রস-গন্ধ পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে শুষে নিতে। আবার কবে সুযোগ দেবে সময় কে জানে? আর কতদিন সুযোগ দেবে, কে জানে?তবে আজ মোটেই তা ভাবতে বসব না। আজ মোটেই মনখারাপের দিন না-

Thursday 9 December 2021

অনির ডাইরি, ৯ই ডিসেম্বর, ২০১৮

 বন্ধুবান্ধব কোনদিনই তেমন ছিল না। তাতে অবশ্য সহপাঠী বা পাড়াতুতো সমবয়স্কদের কোন দোষ ছিল না।  ভয়ানক অমিশুক ছিলাম আমি।হাতে গোণা কয়েকজন ছাড়া কাউকেই যেন তেমন পছন্দ হত না। সুযোগ পেলেই স্কুলে ডুব। কলেজে তো কহতব্য নয়। কোনমতে উপস্থিতির হারটুকু বজায় ছিল। 

আসলে বাইরে বন্ধু খোঁজার কখনও প্রয়োজনই হয়নি। বাবা ছিল যে। “আজ আর অফিস যেও না বাবা” আব্দার করলেই হল, কত যে ছুটি নিত বাবা। বেতন কাটার পরিস্থিতি যতক্ষণ না আসত, আমার আব্দার রাখতে পিছপা হত না বাবা। রিটায়ার করার সময় লিভ স্যালারি বাবদ এক নয়া পয়সাও পায়নি।

গ্রীষ্মের আগুন ঝরানো দুপুরে কাঠের খড়খড়ি বন্ধ করে,ঘড়ঘড়ে ডিসি পাখার তলায়, ঠাকুমার ঠাকুরদাদার সুবিশাল বার্মাটিকের পালিমচটা খাটে জমত আড্ডা। খড়খড়ির ফুটো দিয়ে গুড়িগুড়ি সৌরশ্মি ঢুকে আসত আমাদের গল্প শুনতে। শীতে কাঠপাল্লা খুলে,বন্ধ করা হত কাঁচের তিনপাল্লা। দুষ্টু উত্তরে হাওয়া ঠকঠকিয়ে প্রবেশাধিকার চাইত।শীতে  চাদর লেপ সহযোগে ইগলু বানাত বাবা। ইগলুর মধ্যে ঢুকে কল্পনা করতাম আমরা হলাম এস্কিমো। আর ঘোর বর্ষায়? পশ্চিমের জানলা দিয়ে অনুপ্রবেশকারী মিহি জলকণা আর ভেজা বাগানের সোঁদা সোঁদা গন্ধ রচনা করত অ্যামাজন অরণ্যের রহস্যময়তা। 

কি নিয়ে গল্প হত না?বাবা মানে  দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ আর হিটলার(প্রসঙ্গত বাবার ডাকনামটাও হিটলার), ১৯৪৩এর “ভাত দাও মা- ফ্যান দাও মা” দুর্ভিক্ষের হাহাকার। তীব্র অনাহারে কঙ্কালসার মৃতা রমণীর শুষ্কস্তন কামড়ে ধরে মৃত শিশুর ছবি গুগল দেখাবার অনেক আগে দেখেছিলাম বাবার চোখ দিয়ে। বাবা মানে “ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে”র হুঙ্কার আর রক্তপাত। বাবা মানে প্রথম স্বাধীনতার ভোর, বেতারে পণ্ডিত নেহেরুর ঐতিহাসিক ভাষণ।স্বাধীনদেশের মুক্ত বাতাসে উড্ডিয়মান তেরঙা।  বাবা মানে খাদ্য-আন্দোলন, বিমলা-অমিয়া-প্রতিভা দিবস পালন, বাবা মানে বেলিলিয়াস স্কুল আর নরসিংহ দত্ত কলেজ,বাবা মানে আগুনে সত্তর। বাবা মানে বরানগরের গঙ্গার লালচে জল। বাবা মানেই মার্ক্স-এঙ্গেলস্- লেনিন-স্ট্যালিন-মাও।  বাবা মানেই নকশালবাড়ি- বাবা মানেই মায়ের মাধবীলতা হয়ে ওঠা-বাবা মানে ঠিক মধ্যরাতে রাষ্ট্রপতি ফকরুদ্দিন আলি আহমেদের কণ্ঠে ঘোষিত জরুরী অবস্থা, বাবা মানে ধরে ধরে জবরদস্তি নাসবন্দীর গল্প, বাবা মানে শান্তির আশির দশক,রেশনের চাল-চিনি, গম ভাঙানো গরম আটা, বন্ধ হতে থাকা কলকারখানা, কলকাতায় রিলায়েন্স কাপ, বাবা মানে ভেঙে পড়া বাবরি মসজিদ, প্রথম কার্ফু,টহলদার সাঁজোয়া গাড়ি, বাবা মানে হার না মানার অদম্য জেদ- বাবা মানেই চারমিনার(এখন অবশ্য ফ্লেক্স দিনে দুই থেকে আড়াই প্যাকেট,এমনকি তিনও হয় মাঝেসাঝে )- বাবা মানেই খকখকে কাশি- বাবা মানেই গড ফাদার(সেই যে প্রতিশোধ বাসি হলে মিষ্টি হয়)- বাবা মানেই পথের পাঁচালী,কাঞ্চনজঙ্ঘা, বাইশে শ্রাবণ-ভুবন সোম-বাবা মানেই শাম্মী কাপুর ,তিসরি মঞ্জিল- বাবা মানেই নিউ মার্কেট- বাবা মানেই মোহনবাগান- বাবা মানেই শৌভিক আর আমার নিরন্তর ঘটি-বাঙালের দ্বৈরথ। বাবা মানে হারিয়ে যাওয় ছেলেবেলা-বাবা মানে মূলের সাথে জুড়ে থাকা।সর্বোপরি বাবা মানে নিরন্তর হারিয়ে ফেলার ভয়, শুভ জন্মদিন বাবা। বড় বেশী ভালোবাসি তোমায়, আজও-

অনির ডাইরি ৯ই ডিসেম্বর,২০২০



 জানুয়ারী মাস, কনকনে ঠাণ্ডায় কাঁপছে বঙ্গদেশ। শিয়ালদা থেকে রাতের লালগোলা ধরল লোকটা। মাসের শেষ, হাত খালি। কিছু টাকা পাবার কথা ছিল এক পরিচিতর কাছে, বিনা পারিশ্রমিকে তার অনেক কাজ করে দিয়েছিল লোকটা, জানিয়েছিল টাকাটা পরে নেবে, সময়মত। আজ যখন চাইতে গেল- নাঃ থাক ওসব কথা ভেবে আর মনটা খারাপ করবে না লোকটা। আপাততঃ কিছু টাকা ধার তো পাওয়া গেছে, যেতে হবে অনেকদূর। সেই সুদূর পলাশী। পৌঁছাতে পৌঁছাতে রাত সাড়ে তিনটে। অত রাতে বাস থাকবে না। তাই হাঁটতে হবে  প্রায় সাত কিলোমিটার। তারপর ভোররাতের প্রথম ফেরী নিয়ে যাবে, ওপাড়ে শ্বশুরবাড়ি। সেখানে আছে আসন্ন প্রসবা স্ত্রী। এখনও আসন্ন প্রসবা কি? ডাক্তারের দেওয়া তারিখ শেষ হচ্ছে আজ। মিছিমিছি টাকাটার জন্য দেরী হয়ে গেল- 


ভোর রাতে নদী পেরিয়ে ধান ক্ষেতের ওপর দিয়ে ছুটছে লোকটা, মুর্শিদাবাদের কনকনে ঠাণ্ডা সূঁচের মত বিঁধছে লোকটার মুখেচোখে।  ভালো গরম জামার বড় অভাব। উচ্চপদস্থ দাদার ওভারকোট খানা ধার করে এনেছিল ভাগ্যিস। মাথায় একটাই চিন্তা, ছানাটা কি, বাবা না আসতেই জন্মে গেল? 


নাঃ জন্মায়নি ছানাটা। নির্দিষ্ট তারিখ পেরিয়ে যাবার পরও জন্মায়নি। বাবা আসেনি যে। মায়ের জঠরে বেড়ে উঠলেও, বাবার সাথে নাড়ির টান কম না তার। 


 কুয়াশা মোড়া এক অজ গাঁয়ের ছোট্ট সরকারী হাসপাতালে সূর্যের প্রথম কিরণ এসে পড়ল লোকটার মুখে- কি করবে বুঝতে পারছে না লোকটা। কাকে কাকে খবর দেবে? কাকে কাকে মিষ্টি খাওয়াবে?  সোমপাড়া বাজারের সেরা দোকান থেকে গোটা দশেক হাঁড়ি রসগোল্লা কেনার পর খেয়াল হল, সদ্যোজাত বাচ্ছাটাকে স্পর্শ করেছে যে, তাই গাঁয়ের মানুষ তো তার হাত থেকে কিছু নেবে না। আঁতুড় বড় বালাই। কুচ পরোয়া নেই, দোকানীকে দুদণ্ড দাঁড়াতে বলে, ধার করা ওভারকোট,টুপি সমেত গঙ্গায় ডুব দিল লোকটা।  অতঃপর কনকনে ঠান্ডায়, ভিজে সপসপ করতে করতে ঘরে ঘরে বিতরণ করতে লাগল মিষ্টান্ন। মেয়ে হয়েছে যে-। 


মেয়ে বড় হবার সাথে সাথে একটাই দুঃস্বপ্ন দেখত লোকটা। কোন অচেনা জায়গায় বউ আর মেয়েকে দাঁড় করিয়ে, ট্যাক্সি খুঁজতে গিয়ে ফিরে এসে দেখে কেউ নেই- প্রতিবার ঘেমে চান করে যেত লোকটা। মেয়ে তো নয়, প্রাণ। আর বউ? ইয়ে ওকথা না হয় নাই কইলাম। শুধু এটুকু বলতে পারি, বউমেয়েকে ছেড়ে কোথাও একটা রাতও কাটাতে চাইত না লোকটা। যত গুরুত্বপূর্ণ কাজই থাকুক, যত রাতই হোক, বাড়ি ফিরে আসতই লোকটা। কতবার কত অনুষ্ঠানে যে মুখ দেখিয়েই পালিয়ে এসেছে লোকটা, বাড়ি ফিরে বউমেয়ের সাথে দুধরুটি বা আলুসিদ্ধ ভাত খাবে বলে-  একবার তো এক বর্ষার রাতে, ওমনি কোন নিমন্ত্রণ বাড়ি থেকে জলদি বাড়ি ফেরার তাড়ায়,শর্টকাট করতে গিয়ে, সদ্য খোঁড়া কবরেই পড়ে গিয়েছিল লোকটা। 


মেয়ের প্রতি বরাবরই ছিল সীমাহীন প্রশ্রয়। বড় হবার সাথে সাথে বেপোট আদর পেয়েই কি না জানি না, মেয়ে হল নাদুসনুদুস, ন্যাদোশ পানা। স্কুলে সহপাঠিরা ক্ষেপায় আর মেয়ে বাড়ি এসে ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে। লোকটা পড়ল মহাজ্বালায়, শক্তপোক্ত হতে হবে তো। খেলাচ্ছলে বলে বসে, “মোটা তো মোটা আমার খেয়ে মোটা। বলে দিস বন্ধুদের।” ব্যাস। গুণধরী কন্যা বলেও এল, “মোটা তো মোটা, আমার বাবার খেয়ে মোটা। তোর বাবার তো নয়-”। নালিশ এল বাড়িতে। গিন্নীমা তো বেলুন নিয়ে প্রস্তুত, ঠেঙিয়ে বড়লোক করে দেবেন আজ কন্যাকে। বাধ সাধে লোকটা,“বেশ করেছে। আবার বললে আবার বলবি। বাকি আমি বুঝে নেব-”। 


সময় এগোয়, বড় হবার সাথে সাথে পথেঘাটে অনুভূত হয় অবাঞ্ছিত স্পর্শ, কানে অাসে চটুল অশ্লীল মন্তব্য। ঘাবড়ে যায়,মুষড়ে পড়ে কিশোরী মেয়ে।  লোকটা শেখায়, কি ভাবে চলতে হয়, ভিড়ের মধ্যে, নিজেকে বাঁচিয়ে। আর যদি তারপরও- তাহলে মহৌষধ হাওড়া জেলার আদি অকৃত্রিম খিস্তি।  মেয়েটার খিস্তির ভাঁড়ার যে আজ এমন ঈর্ষণীয়, সৌজন্য শুদ্ধু ঐ লোকটা। 


কোনদিনই নিখাদ প্রশ্রয়দাতা বা শাসনকারী বাবা নয়, বরং মেয়ের পরম বন্ধু হতে চাইত লোকটা।বয়ঃসন্ধির কিটকিটে ব্রণয় যখন ছেয়ে গেল মেয়েটার মুখ, লোকটাই পরিচয় করালো শ্বেতচন্দনবাটার সাথে। চুল উঠছে মেয়ের তো খুঁজে পেতে আনত সুগন্ধী তিলের তেল। অকালে পেকে যাওয়া চুলের জন্য বড়বাজার থেকে রাজস্থানী হেনা। 


 প্রথম সিগারেটটা নিজেই এগিয়ে দিয়েছিল মেয়ের দিকে, “টেনে দ্যাখ”।  সেবার, যখন বুড়ো ধাড়ি মেয়ে আর তার স্যাঙাৎরা ঠিক ধরল দোলপূর্ণিমার রাত্রে সিদ্ধি খাবে-সেই মত সব যোগাড়যন্ত্র হল,মাঝখান থেকে তারাসুন্দরীরা ভুলে গেল খালি সিদ্ধি পাতাটাই। শিবরাত্রির সিদ্ধি চাটুতে নেড়ে কিভাবে ঠান্ডাইতে মেশাতে  হয় শিখিয়ে ছিল লোকটা।


মেয়ের নিষেধ সত্ত্বেও, প্রতিটা চাকরীর পরীক্ষায় সঙ্গে যেত লোকটা। বসার জায়গা পেলে ভালো, না হলে ঘন্টার পর ঘন্টা দাঁড়িয়ে থাকত, ছোট্ট পকেট রেডিওটা চালিয়ে। দুটো পরীক্ষার মাঝে খবরের কাগজ পেতে ফুটপাতে বসে, সকালে গিন্নীমায়ের সেঁকে দেওয়া চিনি ছড়ানো মাখন পাঁউরুটি খেতে খেতে মেয়েকে বোঝাত ফিউডালিজম। 


ইয়ে বলতে ভুলে গেছি, লোকটার আজ জন্মদিন। শুভ জন্মদিন বাবা, আমার জীবনের কতটা জুড়ে একলা তোমার আধিপত্য তা বোধহয় তুমিও জানো না। এই কোভিডের বছরে শুধু এই টুকুই বলব, খুব ভালো থেকো, খুব সাবধানে থেকো। সবথেকে বড় কথা মাথার ওপর এমনি ছাতা হয়ে থেকো। এক সমুদ্র, এক আকাশ ভালোবাসাও বুঝি তোমার জন্য যথেষ্ট নয়-

অনির ডাইরি ৯ই ডিসেম্বর, ২০২১

 


সেদিন সপ্তমী। শারদীয়া নীল আকাশে পেঁজা তুলোর মত উড়ে বেড়াচ্ছে একপাল দুষ্টু মেঘের দল। স্নান সেরে বরের আলয়ে সদ্য প্রবেশ করেছেন শ্রীমতী কলা বউ। বাতাসে খুশির সানাই। পাড়ার গলি থেকে সোশ্যাল মিডিয়া সর্বত্র উড়ে বেড়াচ্ছে রঙীন জোড়া প্রজাপতির দল। এই চারদিনের রোদে বোধহয় লুকিয়ে থাকে ম্যাজিক, হঠাৎ করে অনেকটা সুন্দর হয়ে যায় সবাই। খাবার গ্রুপ গুলিতে সাবেকী বাঙালি খানার জয়জয়কার। সবদিকে এক চূড়ান্ত খুশির আমেজ এপার বাংলা জুড়ে। 


স্বার্থপর দৈত্যের বাগানের মত কেবল আঁধার আমাদের ১৪নম্বর বাড়ি জুড়ে। এবাড়িতে প্রবেশ করে না খুশির বসন্ত। এবাড়ির উঠোন জুড়ে কেবল ছুটে বেড়ায় দোর্দণ্ডপ্রতাপ হতাশা। কোনায় কোনায় জমে থাকে ভারী মনখারাপের মণ্ড। আজ বোধহয় তার প্রকোপ একটু বেশীই।  আজ নিয়ে পাক্কা নয়দিন হাসপাতাল বাস পূর্ণ করল বাবা। উৎসবের দিনে যদি কারো প্রিয়জন হাসপাতালে থাকে, তাহলে তাদের থেকে দুর্ভাগা বোধহয় আর কেউ নেই। শুধু যে হাসপাতালে আছে তাই নয়, বিগত নয়দিনের মধ্যে দেড় বেলা ছাড়া অভুক্ত আছে বাবা। শুধু স্যালাইন দিয়ে ফেলে রাখা আছে একাশি বছরের বৃদ্ধকে। কি যে তাঁর ব্যধি কেউ জানে না। তীব্র পেটে ব্যথা নিয়ে ভর্তি হয়েছিল মহালয়ার আগের দিন। নাকে রাইজ টিউব পড়ানোর সাথে সাথেই বেরিয়ে এসেছিল প্রায় দেড় লিটার কুচকুচে কালো জল। প্রথমে বলা হয়েছিল ওটা রক্ত। বাবার উচ্চ হিমোগ্লোবিনের রিপোর্ট ভুল প্রমাণ করে তা। এখন বলা হচ্ছে ওটা বাইল বা পিত্ত রস। কেন অত বাইল জমেছিল তা উদ্ধার করতে ব্যর্থ হয়েছে ডাক্তার। যত রকম টেস্ট হয় স্থানীয় নার্সিংহোমে বা গঙ্গাপাড়ের এই বুড়োশহরে, হয়ে গেছে তার সবকটাই। সব রিপোর্টই ভালো। রোজ একরাশ আশা নিয়ে যাই, আজ হয়তো ছেড়ে দেবে লোকটাকে। আর বৃথা মনোরথ হয়ে ফিরে আসি প্রতিদিন।ছাড়তে নারাজ ডাক্তার, রোগটাই যে ধরা পড়েনি এখনো। 


আজ সকালে খবর এল, দক্ষিণ কলকাতার জনৈক নামজাদা হাসপাতালে হবে বিশেষ কোন টেস্ট। ওরাই নিয়ে যাবে। তবে সঙ্গে যেতে হবে আমায়। উৎসব মুখর শহর আর সুসজ্জিত নরনারীদের ভিড় কাটিয়ে এক সেট বিবর্ণ জামা পরে চটি ফটফটিয়ে হাসপাতালে পৌঁছালাম আমি। স্ট্রেচারে করে বাবাকে এনে তোলা হল অ্যাম্বুলেন্সে। উল্টোদিকে পায়ের কাছে বসলাম আমি। আমার পাশে হাসপাতালের সুইপার ছেলেটি। বিনানুমতিতেই অ্যাম্বুলেন্সে চড়ে বসেছে পাশের রাজ্য থেকে আসা ফচকে ছেলেটি। ‘দাদু’কে বড় ভালোবেসে ফেলেছে এই নয়দিনে। 


উৎসবের শহর আর সুসজ্জিত মুণ্ডপ গুলোকে পাশ কাটিয়ে ছুটল অ্যাম্বুলেন্স। চোখ বন্ধ করে হাসি মুখে শুয়ে আছে বাবা। অস্বাভাবিক রকমের চুপচাপ আজ। যারা লোকটাকে চেনেন, তাঁরা জানেন, সর্বক্ষণ খই ফোটে লোকটার মুখ দিয়ে। জানলা দিয়ে মাঝে  মাঝে ভেসে আসছে রবীন্দ্রসঙ্গীত বা টুম্পা সোনার মত চটুল গানের কলি আর সুর। হাল্কা ঘাড় তুলে দেখার চেষ্টা করছে বাবা। ভেসে আসছে উৎসবের সুবাস। রবি অর্থাৎ বেহারি সুইপার ছেলেটি মাঝে মাঝে হাত বাড়িয়ে ধরছে বাবার হাতটা আর জনৈক রাজনৈতিক সুপ্রিমোর সুরে মজা করে জানতে চাইছে, ‘দাদু, ও দাদু। ও দাদু ঠিক আছ তো?’ প্রতিবারই মৃদু হেসে চোখ বন্ধ করছে বাবা। আলতো করে পায়ে হাত বুলিয়ে দিলাম আমি। বললাম,‘ বাবা আমিও আছি।’ চোখ বন্ধ করেই ঘাড় নাড়ল বাবা। 


বড় সুপার স্পেশিয়ালিটি হাসপাতালে প্রবেশ করার সাথে সাথে মনে হল যেন অন্য দুনিয়ায় প্রবেশ করেছি।  উৎসবের নাম গন্ধও নেই হেথায়। ঝাঁ চকচকে মহার্ঘ চত্বর জুড়ে ভেসে বেড়াচ্ছে শুধুই রোগব্যাধির গন্ধ আর চাপা দীর্ঘশ্বাস। বড় পেশাদার এরা। নামে সেবা সদন হলেও, সেবার প্রবেশ নিষেধ হেথায়। দরকারী সইসাবুদ করে, টাকাপয়সা মিটিয়ে বাবাকে নিয়ে যাওয়া হল স্ক্যান রুমের সামনে। রবিও এসেছে আমার সাথে সাথে। শুয়েই আছে বাবা। হাতে চলেই যাচ্ছে স্যালাইন। রবিকে বলে পাঁচ মিনিটের জন্য বাইরে বেরালাম আমি। এক বোতল জল না কিনলেই নয়। পঞ্চাশ টাকা দিয়ে পাঁচশ মিলিলিটার জল কিনলাম আমি। কে জানে কি আছে এতে, হয়তো মেশানো আছে কয়েক ফোঁটা তরল সোনা। 


ঠাণ্ডা জলের বোতলটা হাতে নিয়ে গিয়ে দাঁড়ালাম বাবার কাছে।  আরো একটু সময় লাগবে বাবার নম্বর আসতে। লম্বা ফাঁকা করিডোরে আপাততঃ বাবা আর আমি। উদাস চোখে নকল শিলিং এর দিকে তাকিয়েছিল বাবা। আমি গিয়ে দাঁড়াতে চোখ নামিয়ে আমার দিকে তাকালো। তারপর চোখ জোড়া ঘুরে গেল আমার হাতের জলের ভর্তি বোতলটার দিকে। লোভে চকচক করে উঠল দুই চোখ। তারপর শুয়ে থাকা অবস্থায় এদিক ওদিক যতটা চোখ যায় মাথা ঘুরিয়ে দেখে, ফিসফিস করে বলল,‘ হাঁ করছি। ছিপি খুলে চটপট একটু ঢেলে দে তো।’ দীর্ঘ নদিন ধরে জলও খেতে দেয়নি ওরা বাবাকে। নয়দিনের তৃষ্ণার্ত বৃদ্ধকে না বলা যে সন্তান হিসেবে কতখানি দুষ্কর, তা কেবল ভুক্তভোগীরাই জানে। তবুও না বলতেই হয়। প্রিয়জনের সর্বাঙ্গীণ মঙ্গলের জন্য কত পাপই যে করতে হয় হাসি মুখে। 


শুকনো অপরাধী মুখে নকল হাসি এনে বলতে হয়,‘তুমি সুস্থ হয়ে ওঠো। তরপর যত ইচ্ছে জল খেও। ’ যে বলে, আর যে শোনে দুজোড়া ফুসফুস নিঙড়েই বেরিয়ে আসে হাহাকার মাখা দীর্ঘশ্বাস। ভারি হয়ে ওঠে মূল্যবান হাসপাতালের  আপাত জনশূণ্য এই করিডোর। বেশ কিছুক্ষণ অস্বস্তিকর নীরবতার পর অনদিকে তাকিয়ে ছলছল চোখে, ভেজা স্বরে বৃদ্ধ বলে,‘সুস্থ কি আর কোনদিন হবো? মনে হয় না। ’


 ঠিক সেই মুহূর্তে ঐ একই নেগেটিভ অনুভূতিতেই মাখামাখি ছিল আমারও মন আর মাথা, আমারও সমস্ত জগৎ জুড়ে নামছিল হতাশার প্রগাঢ় আঁধার।  বৃদ্ধের মুখের কথাগুলো যেন চাবুকের মত এসে পড়ল মুখের ওপর। অ্যাসিডের মত, গোড়া থেকে পুড়িয়ে দিল যত সব নেগেটিভ চিন্তার আগাছা। কোথা থেকে যে ভেসে এল এত পজিটিভ এনার্জি। লোকটার শুকনো খসখসে হাতটা চেপে ধরে, প্রবল আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে বললাম, ‘সুস্থ তোমাকে হতেই হবে বাবা। সুস্থ তুমি হবেই। বাজি ধরবে?’ বললাম, আপদ হাসপাতাল আর ডাক্তার যাই বলুক, সুস্থ হয়ে বাড়ি তুমি ফিরবেই। তোমার বাপের ভিটে, যার প্রতি তোমার ভালোবাসা আর টান তুত্তুরীর থেকেও প্রবল, সেখানে আবার প্রতিষ্ঠিত হবে তোমার সর্বাঙ্গীণ কতৃত্ব। এতদিনের অভুক্ত থাকা আর শুয়ে থাকার ফলে পেশীগত জোর কতটা ফিরে আসবে জানি না, কিন্তু তোমার বিক্রম ফিরে আসবে হুড়মুড় করে প্রবল বিক্রমে। আবার মায়ের সাথে কোমর বেঁধে ঝগড়া করবে তুমি। ধমকে থামিয়ে দেবে পিসিকে। ঘন্টা খানেক ধরে ফোনে খোশগল্প করবে আবার আমার শ্বশুরমশাইয়ের সাথে। আবার জমিয়ে তুলবে চাটুজ্জে বাড়ির মধ্যরাত্রির আসর। আবার গল্প শোনাবে বুল্লু আর তুত্তুরীকে। সব হবে বাবা। শুধু সময়ের অপেক্ষা। আবার পালন করব আমরা তোমার জন্মদিন। হৈহৈ করে কেক কাটব সবাই মিলে। শুনতে শুনতে হঠাৎ শরীরের সমস্ত শক্তি একত্রিত করে সবেগে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে নিল বৃদ্ধ। চোখের ওপর চাপা দিল অস্থিচর্মসার একখান হাত, তারপর ধরা গলায় আমায় ধমকে বলল,‘স্তোকবাক্য দিস না। ওদিকে গিয়ে বোস। ’ সেদিন বলতে পারিনি, তবে আজ বৃদ্ধের ৮২ তম জন্মদিনে এসে তো বলতেই পারি, স্তোকবাক্য দিইনি বাবা, সমস্তটাই ছিল আমার ইনট্যুশন। আর যাদের ভীষণ ভীষণ ভালোবাসি তাদের ক্ষেত্রে আমার ইনট্যুশন যে কতখানি অব্যর্থ তা কি তুমি জানতে না। 

শুভ জন্মদিন বাবা। বারবার ঘুরে ঘুরে আসুক আজকের দিনটা। বটগাছ হয়ে আমাদের জড়িয়ে থাকো আরও বহু বহু বছর। এত এত ভালোবাসি তোমায়, তবুও মনে হয়, খুব খারাপ সন্তান আমি, তোমার যে আরো অনেক অনেক বেশি ভালোবাসা প্রাপ্য ছিল বাবা।

Saturday 4 December 2021

অনির ডাইরি ৩০শে নভেম্বর, ২০২১

 

#তাম্রলিপ্ত_কড়চা

প্রথম আলপেই পিলে চমকে দিয়েছিলেন জহর বাবু।আঞ্চলিক শ্রম দপ্তর তাম্রলিপ্তের চার্জ নিয়েছি সদ্য। তখনও চিনে উঠতে পারিনি কাউকেই। নামও হয়নি মুখস্থ।  ইন্সপেক্টর-সিকেসিও- পিওনদের ভিড়ে খুঁজি এত দিনের পরিচিত মুখ গুলোকে। আপিসটা সদ্য উঠে এসেছে নিমতৌড়ির নব্য প্রশাসনিক ভবন চত্বরে। সবকিছু বড় ঝাঁ চকচকে এথায়। তুলনায় আমাদের আপিসটাই বেশ অগোছালো। পূর্বসুরীরা অনেকটাই করে দিয়ে গেছেন, এবার গুছিয়ে নেওয়ার দায়িত্ব আমাদের। 


জানলার বাইরে খোলা মাঠ আর ফুটে থাকা থোকা থোকা কাশফুলের দিকে তাকিয়ে তাই হয়তো ভাবছিলাম, এমন সময় চেম্বারের দরজার বাইরে থেকে কে যেন বলল, ‘সেলাম ম্যাডাম। ’ চমকে তাকিয়ে দেখি, দরজার বাইরে করজোড়ে দাঁড়িয়ে আছেন পাঞ্জাবি-পাজামা-জহর কোট পরিহিত জনৈক ব্যক্তি। গলায় তুলসি কাঠের মালা, কপালে এত্ত বড় বড় মেটে সিঁদুরের টপ্পা। প্রথম দর্শনে মনে হয়েছিল, কোন শ্রমিক সংগঠনের প্রতিনিধি হবেন। তবে কোনো সাংগঠনিক নেতাকে কোনদিন টপ্পা পরে লেবার আপিসে আসতে দেখিনি। নিজেকে সামলে জানতে চাইলাম, ‘হ্যাঁ বলুন?’ জবাব এল, ‘কিছু বলবনি ম্যাডাম। এমনি আর কি। আমি জহর বাবু। এই আপিসের ডিসিএন।’ যাঁরা জানেন না তাঁদের অবগতির জন্য জানাই, ডিসিএন হল দারোয়ান কাম নাইটওয়াচ ম্যান। 


গতকাল ঝাঁক বেঁধে সবাই এসেছিল আলাপ করতে, এই ভদ্রলোককে তখন দেখেছিলাম কি না মনে পড়ল না। নির্ঘাত দেখিনি। দেখলে মনে থাকত, অমন টপ্পা। প্রশ্ন করার আগেই উত্তর ভেসে এল, ‘কাল আপনার সঙ্গে দেখা হয়নি। এট্টু দরকার ছিল, তাই রবিকে বলে বাড়ি চলে গেছলুম। ’রবিবাবু এই আপিসের পিওন। খামোকা আমি থাকতে তাঁকে বলে কেন গিয়েছিলেন বুঝলাম না। সামান্য ডেঁটে বললাম, ‘পরের বার থেকে আমাকে বলে যাবেন। ’ উনি ঘাড় নেড়ে সুরেলা গলায় বললেন, ‘আজ্ঞে। ’ 


দিন কয়েক পরের কথা, ততোদিনে আমি জেনে গেছি, জহর বাবু আর দিন কয়েকের মেহমান মাত্র।নভেম্বর মাসেই ওণার কর্মজীবন শেষ। তবে উনি আমাদের ছেড়ে যেতে ঘোরতর ভাবে অনিচ্ছুক। আমরা ওণাকে রেখে দিতে ততোধিক ইচ্ছুক, কিন্তু ফাণ্ডের যে বড় আকাল।


 ততোদিনে আমি জেনে গেছি জহর বাবু অত্যন্ত মজার মানুষ। মজাটা উনি জেনে বুঝে করেন নাকি ওণার আচরণে নিছক আমোদিত হই আমরা বলা বেশ মুস্কিল। যেমন ধরুন উনি মাঝে মধ্যেই আমার চেম্বারের দরজা খুলে মুণ্ডু গলান আর বলেন, ‘প্রণাম ম্যাডাম বা সেলাম ম্যাডাম। ’ এত সেলাম আমার গুষ্টির কেউ কোন জন্মে পায়নি রে বাবা। ওণার সেলাম আমি নিলাম কি নিলাম না সেটা নিয়ে ওণার মাথাব্যথা নেই। 


সেদিন কি যেন কাজে সেকশনে গেছি,জহর বাবু এক গলা জিভ কাটলেন। ‘এই যাঃ ম্যাডাম, আমরা সব খেয়ে ফেললুম, আপনাকে তো দিলুম নি। ’ হাসব না কাঁদব বুঝতে পারলাম না। তখন ঘড়িতে সন্ধ্যা পাঁচটা বেজে গেছে। ঘোর অন্ধকারে ডুবতে বসেছে নিমতৌড়ির নতুন কালেক্টরেট। জহর বাবুর হাতে একটা হাফ পাউণ্ড পাঁউরুটি আর ওণার সামনে বসে বা দাঁড়িয়ে থাকা শান্তনু, শুভাশিস, হক বাবু বা রবি বাবুর হাতে কাগজের চায়ের কাপ। যুগপৎ জহর বাবু আর আমার ভেবলে যাওয়া অবস্থা দেখে বাকিরা কুলকুল করে হাসছে। পরিস্থিতির গুরুত্ব অনুধাবন করে হো হো হাসিতে ফেটে পড়লাম আমিও। শুধু জহর বাবু প্রচণ্ড সিরিয়াস। 


যেমন ধরুন মাঝে মাঝেই আমার আপিসে চলে আসেন শ্রীমতি তুত্তুরী। বিশেষতঃ মাসি না থাকলে তো আমার আপিস ছাড়া গতি নেই। আমার মিটিং ইত্যাদি থাকে তাই হলদিয়ার বড় সাহেবের ফাঁকা চেম্বারে আস্তানা গাড়েন শ্রীমতি তুত্তুরী। চুঁচুড়া আপিসে প্রীতি, রমেশ, ঝুমা কত্তজনের সাথে যে বন্ধুত্ব ছিল তুত্তুরীর। এ আপিসে তারা কেউ নেই বটে,তবে জহর বাবু আছেন। জহর বাবু ফাঁক পেলেই গিয়ে তুত্তুরীকে প্রশ্ন করেন, ‘তা আমাদের ম্যাডামকে তোমার কেমন লাগে?’ যুগপৎ আনন্দিত এবং ক্রোধিত হয়ে তুত্তুরী জবাব দেয়, ‘কেমন আবার লাগবে?  ম্যাডাম তো আমার মা।’ ঘাড় নাড়তে নাড়তে চলে যান জহর বাবু। আবার খানিক বাদে ফিরে আসেন, প্রশ্ন করেন, ‘তা তোমার বাবা কি করেন?’ হতবাক তুত্তুরী বলে, ‘বাবা এসডিও না?’ জহর বাবু কাঁচাপাকা দাড়িগোঁফ চুলকে বলেন, ‘হ্যাঁ। হ্যাঁ। তাই তো। ম্যাডাম তো এসডিওকে বিয়ে করেছে-’। আজ এত বছর বাদে এত ধেড়ে কন্যা সন্তানের জননী হয়েও আমি কাউকে বিয়ে করেছি, শুনে হেব্বি খুশি হয়ে যায় দিল। 


তো এ হেন জহর বাবু বিদায় নিলেন বিগত ৩০শে নভেম্বর। চটজলদি চাঁদা তুলে আয়োজন করা হল তাঁর বিদায় সম্বর্ধনা। ভালো থাকবেন জহর বাবু। আমরা জানি আপনি ভালো থাকবেনই। আপনার মত মানুষেরা কখনও খারাপ থাকে না। তারা যেখানেই যায়, মাতিয়ে রাখে আসেপাশের মানুষগুলোকে।

অনির ডাইরি ১লা ডিসেম্বর, ২০২১

 


#সব_চরিত্র_কাল্পনিক


সে অনেককাল আগের কথা। তারপর কত্ত কি হল, বারো বছরের বনবাস, এক বছরের অজ্ঞাতবাস, আরো না জানে কত, কত কি। সেদিনও এমনিই মিঠে রোদ উঠেছিল। বাতাসে ছিল হাল্কা হিমেল স্পর্শ। অল্প ধোঁয়াশা-কুয়াশা মাখা মহানগর জুড়ে কেমন যেন উৎসবের গন্ধ। রামধনু রঙা পশম আর পশমী পোশাকের পসরা সাজিয়ে ওয়েলিংটনে বসেছিল একেবারে পুতুলের মত দেখতে ভুটিয়া নরনারীর দল, ময়দানে বাঁশ বাঁধছিল যেন কারা, মেলা বসবে যে।  


সেজে গুজে, সবথেকে ভালো জামাটা পরে বেরোল যখন মেয়েটা, ঘড়ি বলছে বেলা এগারো। সাজতেও তেমন জানত নাকি মেয়েটা? সাজ বলতে তো সেই ল্যাকমের ক্লেনজিং মিল্ক, আয়ুরের গোলাপী টোনার আর ভ্যাজলিন বডি লোশন। তাই মুখে মাখত মেয়েটা। তার ওপরে ল্যাকমের সানস্ক্রিন, চোখে ল্যাকমেরই কালো আইলাইনার আর ঠোঁটে লিপস্টিক। লিপস্টিকও একটাই ছিল মেয়েটার। গোলাপী রঙের। ভাগ্যে অমন সুন্দর সোনালী পশমী রোদ উঠেছিল, তাই না অমন অপরূপা লাগছিল মেয়েটাকে। অন্তত মেয়েটার তাই মনে হয়েছিল বটে সেদিন, ‘আমি অপরূপা। আমি অতুলনীয়া।’ সবই মরশুমের দোষ মশাই। 


হেঁটে হাওড়া ময়দান। সেখান থেকে বৈষ্ণবঘাটা মিনি। থিয়েটার রোডে নামবে মেয়েটা। প্রতীক্ষা করছে কেউ। এর আগে একবার দেখা হয়েছিল বটে, সে আরো অনেককাল আগের কথা। ভালো করে আলাপ পরিচয় কিছুই তেমন হয়নি। ছেলেটাকে হেব্বি নাক উঁচু মনে হয়েছিল মেয়েটার। বড় বেশী সবজান্তা। জানিস তো জানিস, তাই বলে দেখানোর কি আছে রে ভাই। না হয় তুই সোনারটুকরো, আমি ঢিপচালতি গোবরগণেশ। তাই বলে, সেটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখানোর কি আছে? কানাকে কানা, খোঁড়াকে খোঁড়া, গোবরগণেশকে গোবরগণেশ বলতে নেই, এটাও জানিস না? 


তবে সে সব অবশ্যি, এখন অতীত। বিগত কয়েকমাসে দূরভাষের মাধ্যমে বন্ধুত্ব বেশ ভালোই হয়েছে উভয়ের। প্রাথমিক খোলস, সঙ্কোচের বাঁধন খোলার পর দুজনেই তাজ্জব হয়ে গেছে। বড় বেশী রকম মিল উভয়ের মধ্যে। কোথাও যেন মিলে যায়, অনুরণন সৃষ্টি করে উভয়ের হৃদয়ের তরঙ্গ। যেমন যেমন ঘুঁচেছে হৃদয়ের দূরত্ব, তেমনি তিল তিল করে ফুলে উঠেছে মেয়েটা। বাড়িয়ে ফেলেছে বেশ কয়েককেজি ওজন। কে জানে ছেলেটা ওকে চিনতে পারবে কি না। কথাটা তুলেওছিল আগের রাতের আলাপে, উল্টোদিক থেকে জবাব এসেছে, ‘মানুষ মোটা হয় কি করে? এক জোড়া জুতো কিনে, দৌড়তে শুরু করো, সব ঠিক হয়ে যাবে। ’ বলেছিলাম না, বেশ আঁতেল আর অনেকটা কাঠখোট্টা ছেলেটা। 


থিয়েটার রোডের বেশ খানিক আগেই নামিয়ে দেয় বাসটা। সাহারা সদনের সামনে দাঁড়াবে ছেলেটা, দুরুদুরু বুকে হাঁটতে থাকে মেয়েটা। রাস্তা পেরিয়ে মুখোমুখি হয় তার সাথে, একটা সাদা ঢলঢলে গেঞ্জি আর সবজে প্যান্ট পরে দাঁড়িয়ে আছে সে। হাতে রোল পাকানো কাগজের বাণ্ডিল। ইতিউতি তাকিয়ে বোধহয় মেয়েটাকেই খুঁজছিল ছেলেটা। সামনে গিয়ে হাত নাড়তে সম্বিত ফিরে পেল ছেলেটা। অদূরে আরেক স্থূলাঙ্গিনীকে দেখিয়ে নার্ভাস ভাবে বলল,‘ আমি তো ভাবছিলাম ঐটা তুমি।’ 


বাকি গল্পটার সাক্ষী মহানগর, সাক্ষী রবীন্দ্রসদন আর নন্দনচত্বর। সাক্ষী ঋতুপর্ণা-সাহেব চ্যাটার্জি আর জয় সেনগুপ্তর ‘চতুরঙ্গ’। সাক্ষী একাডেমির পিছনের ছোট্ট ক্যান্টিন। আর সাক্ষী ধর্মতলা, নন্দন থেকে হাঁটিয়ে ধর্মতলা নিয়ে এসেছিল ছেলেটি। ততোক্ষণে অস্ত গেছেন সূয্যি মামা। জ্বলে উঠেছে মহানগরীর বুকের ওপর শতেক আলোকমালা। বেশ কয়েকবার ফোন করে ফেলেছে গুটি কয়েক ফাজিল বন্ধুবান্ধবের দল। ছেলেটি শুধু একবার জানতে চেয়েছিল, ‘আমার সাথে দেখা করতে এসেছো, এটা জানে না, এমন কেউ আছে?’ বাসে তুলে দিয়ে নীচে দাঁড়িয়ে ছিল ছেলেটা। ক্লান্ত মেয়েটার মুখে তখন কয়েক হাজার ওয়াটের দ্যুতি। বাসে স্টার্ট দিল ড্রাইভার,কন্ডাকটর হাঁক পাড়ল ,‘হাওড়া-হাওড়া। বেবোন রোড- হাওড়া স্টিশন-ময়দান-কদমতলা। ’ হাত নাড়ল মেয়েটা। ঘুরিয়ে হাত নাড়ল না ছেলেটা, সামান্য মাথা নাড়ল শুধু। তারপর আলগোছে থুতনি চুলকে বলল,‘আরেকটু জোরে হাঁটা প্রাকটিশ করো। বড্ড আস্তে হাঁটো।’ এবং ‘মানুষ যে কি করে, মোটা হয়?’


আবারও বলছি কিন্তু, সব চরিত্র নিছক কাল্পনিক।

অনির ডাইরি ২৯শে নভেম্বর, ২০২১

 



যবে থেকে তাঁর পরীক্ষা শেষ হয়েছে, আমার সকালগুলো শুরুই হয় লাইভ তুত্তুরী উবাচ দিয়ে। যেমন ধরুন আজ সকালে শ্রীমতী তুত্তুরী বললেন ‘জানো তো মা, কাল না অমুকের ইয়ে(পড়ুন অন্তর্বাস) দেখেছি।’ সদ্য কিছুক্ষণ আগে ঘুম থেকে উঠেছি, তখনও কাটেনি খোঁয়ারি। সামনে রাখা এক গ্লাস উষদুষ্ণ গরম জলের দিকে কেষ্ট মুখুজ্জের মত চোখে তাকিয়ে ভাবছিলাম মালটা দিয়ে ঠিক যেন কি করি? মানে কি করতে বলেছিল আমার তন্বী ডায়েটিশিয়ান? দিব্য নিয়ম মেনে চলছিলুম, মাঝখান থেকে দিন দুয়েকের মহানগর বাসটা দিল সব চটকে। একদিন হাটারি, একদিন আর্সলান, একদিন সিটি সেন্টার, তারপর যে ডায়েট বানানটা মনে রাখতে পেরেছি সেই ঢের। শুক্রবার দুপুর থেকে রবিবার সন্ধ্যাটা যে কিভাবে গিলে নিল তিলোত্তমা, নিজেরাই বুঝতে পারলাম না। নিজ আলয় তথা নিজের শহর ছেড়ে আসার সে যে কি তীব্র মনোবেদনা-   


মহানগরের জাদু এই ছোট্ট শহরটায় নেই। তবুও বড় মনোরম এদিকের প্রাক শীতের সকালগুলো। বাতাসে কুয়াশা ভেজা মাটির মিঠে সুবাস, সবুজ ঘাসে গড়াগড়ি খাওয়া আদুরে নরম পশমী রোদ, বারান্দার গ্রিলে ঝাঁক বেঁধে বসে রোদ পোয়ানো ফুলোফুলো ছাতারে পাখির দল,পাঁচিলের ওপারে থোকা থোকা কুয়াশা। এমন সময় কেউ কারো অন্তর্বাসের কথা যে কি তুলতে পারে, তা মা না হলে হয়তো জানতেও পারতাম না। তবেই না বলে, 'মা হওয়া কি মুখের কথা'। 


চমকে যাওয়া পিলেকে সামলে, হারিয়ে যেতে বসা বোধবুদ্ধির গোড়ায় ধোঁয়া দিয়ে জানতে চাইলাম,সে কে? কোন নায়িকা বা উপনায়িকা নাকি? জবাব এল, তিনি শ্রীমতী তুত্তুরীর জনৈকা সহচরী। অনলাইন ক্লাশ চলাকালীন বোধহয়, তার হাঁটুতে কোন চোট লাগে, তাই তিনি ক্যামেরা অন থাকা অবস্থাতেই আতঙ্কিত হয়ে চেয়ারের ওপর সটান উঠে স্কার্ট নামিয়ে হাঁটু থেকে রক্ত মুচছিলেন। 


যেমন তুত্তুরী, তেমনি তার বন্ধুবান্ধব। দুদিন আগেই শুনছিলাম মিস কাকে যেন, ‘ইউ নটি গার্ল, ইউ অসভ্য গার্ল, ইউ হনুমান, বাঁদর, জলহস্তী, খ্যাঁকশেয়াল’ বলে গালাগালি দিয়েছিলেন। কারণ তিনি নাকি ক্লাশ চলাকালীন বন্ধুদের তাঁর অনাগত যৌবনের কিছু নিদর্শন দেখাচ্ছিলেন। মিস রেগে আগুন, তেলে বেগুন হয়ে গেলেও আমি রাগতে পারিনি। বিগত দুবছর ধরে কোন শৈশব নেই বাচ্ছাগুলোর। অহর্নিশি বাড়িতে থাকা,  ক্লাশ চলাকালীনই যা বন্ধুদের সাথে দেখাসাক্ষাৎ হয় আর কদাচিৎ ভিডিও কলে প্রবল হৈহুল্লোড়। উঠতি বয়সের ছেলেমেয়েদের দল, দেহে এবং মনে কত পরিবর্তন ঘটে চলেছে প্রতিনিয়ত, কার সাথে ভাগ করে নেবে সেসব অনুভব? 


সকাল গড়িয়ে বেলা বাড়ে, বাজে আপিস টাইমের ঘন্টা। আজ মাসি নেই, এত বড় বাংলোতে তো আর একা রেখে যেতে পারি না, তাই আমার সঙ্গে আমার আপিসে যাবে তুত্তুরীও। এই আপিসে হলদিয়ার বড় সাহেবের নামাঙ্কিত একখানি ফাঁকা চেম্বার আছে, যা তাঁর অনুপস্থিতির কারণে আজ ফাঁকাই থাকবে। সেই ঘরেই বসে ক্লাশ করবে তুত্তুরী। তবে স্কুল ইউনিফর্ম পরে নয়। 


ঐ ইউনিফর্ম পরে ভদ্রসমাজে মেলামেশা করা যায় না। একে তো দুবচ্ছর আগের, স্কার্টটা আর গলেই না, শার্টটারও সেই কটি বোতামই লাগে,যতটুকু ল্যাপটপের ক্যামেরায় ধরা পড়ে। শুধু বোতামহীনই নয়,রীতিমত শতরঙী জামাটা। যত্রতত্র জাঁকিয়ে বসেছে হরেক রকম দাগ। যার মধ্যে কি না নেই-পেন্সিলের দাগ, প্যাস্টেল কালার, ওয়াটার কালার,তিন চার রকম জেল পেনের কালি, চকলেট। মোটামুটি সারাদিনে তুত্তুরী যা করে,যা খায় ওর শার্টটাও তাই করে এবং খায়। 


খেয়ে উঠে, থালাবাসন তুলে টেবিল মুছে, বেঁচে যাওয়া খাবার ঠাণ্ডা আলমারিতে তুলে, সেজেগুজে আপিস যাবার জন্য রেডি হয়ে গেলাম অথচ শ্রীমতী তুত্তুরীর বকবকানি আর থামেই না। বকেই চলেছেন অনর্গল। ক্লাশ থ্রিতে পিটি ম্যাম কি করতেন, চলছে সেই মহাকাব্য কথন। ম্যাম নাকি পিটি ক্লাসে খুঁটিয়ে চেক করতেন প্রত্যেকের ইউনিফর্ম, নখ, চুল ইত্যাদি। তারপর প্রশ্ন করতেন, ‘ইনার পরেছো? প্যান্টি পরেছ?’ প্রহারের ভয়ে সবাই বলত পরেছি। কিন্তু মিস নাকি ঠিকই বুঝতে পারতেন, কারা পরেছে আর কারা পরেনি। বলতেন এদিকে আয়, দেখি।  শার্টের গলা সামান্য টেনে ধরলেই দেখা যেত ভিতরে নাদুসনুদুস গা। অমনি কপালে জুটত কানমোলা। ওপরেরটা নিয়মিত চেক করলেও, তলারটা অবশ্য মিস কোনদিন চেক করার সাহস পাননি।ওটা মুখের কথাতেই বিশ্বাস করতেন। মিসের ভয়ে সবাই থরহরি হলেও, কে যেন ছিল সম্পূর্ণ বিন্দাস। তাকে মিস যখন প্রশ্ন করত, ‘ইনার?’ সে বলত, ‘নো ম্যাম’। মিস রেগে দাঁত কিড়মিড় করতে করতে জানতে চাইত, ‘প্যান্টি?’ নির্বিকার মুখে আকাশের দিকে তাকিয়ে তিনি জবাব দিতেন, ‘নো ম্যাম। ’ গোটা ক্লাস হাসিতে ফেটে পড়ত, আর হতাশ মিস চড়াও হতেন তার পরবর্তী ছাত্র বা ছাত্রীর ওপর। তার কপালে সেদিন সলিড দুঃখু থাকত। 


তাঁর গল্প শোনানোর এমন তাগিদে, যে তিনি আমার পিছন পিছন সারা বাড়ি ঘুরতে ঘুরতে শেষ পর্যন্ত চানঘরেও ঢুকে পরছিলেন আর কি। তাঁকে যাও বা ধমকেধামকে তৈরি করলাম, মঞ্চে অবতীর্ণ হলেন তাঁর পিতৃদেব। সব অবতার একেকটা। ভগবান বেছে বেছে আমার কপালেই দিয়েছেন। তাঁর নাকি আজ কি সব জমকালো, চমকালো মিটিং-ভিসি-ডেপুটেশন আছে অথচ তিনি যে শার্টটা পরে বেরোচ্ছেন তা আমার মায়ের ভাষায়, 'রাস্তায় ফেলে দিলেও কেউ কুড়াবে না'। কুঁকড়ে-কুঁচকে এমন বিশ্রী অবস্থা। 


তা তাঁর শার্ট, তাঁর মিটিং, তাঁর ভিসি। আমার কি? কিছুই না। তবুও আমায় অভিযুক্ত হতে হয়, আমার জন্যই নাকি তাঁর এই দুরবস্থা, আমি কেন সময় থাকতে ইস্ত্রি করে দিইনি। আবার ইস্ত্রিওয়ালাকে দিতেও দিইনি। যত নষ্টের গোড়া নাকি আমিই। দোষ যে আমার কিছুটা আছে তা মানছি, কোন বিস্মৃতপ্রায় অতীতে আমিই স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে সোহাগ করে বলেছিলুম, ‘ওগো, কেন আর খামোখা ইস্ত্রিওয়ালাকে দেবে, তার থেকে আমায় আমায় দিও, আমি করে দেব।’ তারপর বেশ দুয়েক বার করেও দিয়েছিলাম।ভেবেছিলুম খুশি হবে, কিছু বকশিশ অন্তত পাব। ওমা সে গুড়ে বালি। বকশিসের ভাঁড়ে ভবানী, উল্টে পাওনা বলতে গুচ্ছ খানেক নালিশ, অভিযোগ আর অভিমান।


বাবা বাছা করে, শাশুড়ি মাতার অভিমানী ছানার মান ভাঙিয়ে, শার্ট খুলিয়ে চটজলদি ইস্ত্রি করতে করতে মনে হল, নাঃ বউ হওয়াও মোটেই মুখের কথা নয়। হেব্বি চাপ মাইরি।


ইয়ে ছবিতে সদ্য ইস্ত্রি করা জামা গায়ে তিনি। না খুশি হলেন না পেলাম বকশিশ 😏। উল্টে শুনতে হল, ইস্ত্রীওয়ালা নাকি আরো অনেক ভালো ইস্ত্রি করে।