Tuesday 28 April 2020

অ্যালবেয়ার কামুর, দা আউটসাইডার থেকে কিঞ্চিৎ বঙ্গানুবাদ।

“বৃদ্ধাশ্রম থেকে পাঠানো টেলিগ্রামটায় শুধু লেখা ছিল, মা মারা গেছে, আগামী কাল তার অন্তেষ্টি। পড়ে ঠিক বুঝতে পারলাম না,মা কবে মারা গেল, আজ না গতকাল।
আমাকে ম্যারেঙ্গো যেতে হবে। অ্যালজিয়ার্স থেকে ম্যারেঙ্গো শহরের দূরত্ব প্রায় আশি কিলোমিটার। বেলা দুটোর বাসটা যদি ধরি, পৌঁছতে পৌঁছতে বিকাল হয়ে যাবে। তাহলে কাল মায়ের শেষ ক্রিয়াকর্ম সেরে কাল রাতের মধ্যে ফিরে আসতে পারব। বসের কাছে দুদিনের ছুটি চাইলাম। এই পরিস্থিতিতে না বলতে পারল না হয়তো, তবে খুশি হল না মোটেই। আমি এটাও বললাম, যে এতে আমার কোন দোষ নেই, তাও কিছু বলল না। বলার পরেই মনে হল, এটা বলা আমার উচিৎ হয়নি। আমি কেন খামোখা ক্ষমা  চাইতে গেলাম, উল্টে ওণারই তো উচিৎ আমাকে সমবেদনা জানানো। হয়তো জানাবেনও,পরশু যখন ফিরে আসব, শোকের কালো  পোশাক পরে। এখনও কেন জানি না বারবার মনে হচ্ছে হয়তো মা মরেনি- কবর দেওয়া হয়ে গেলে অবশ্য আর এটা নিয়ে ভাবনাচিন্তা করার কোন অবকাশ থাকবে না। তখন আক্ষরিক অর্থেই সব শেষ হয়ে যাবে-
আর পাঁচটা সাধারণ দিনের মতই সিঁলিস্টির রেঁস্তোরাতে খেয়ে বেলা দুটোর বাস ধরলাম। প্রচণ্ড গরম। সিঁলিস্টির রেঁস্তোরায় সকলে সমবেদনা জানালো, সিঁলিস্টি তো বলেই ফেলল, “মায়ের মত কেউ হয় না।” ওরা সবাই আমাকে দরজা অবধি এগিয়ে দিতে এসেছিল, আমার একটু অস্বস্তি লাগছিল। কারণ যাবার আগে আমাকে ইমানুয়েলের কাছ থেকে কালো টাই আর আর্মব্যাণ্ড ধার করতে হবে। ওর কাকা মারা গেছে কয়েক মাস আগে-
দৌড়তে দৌড়তে বাসে উঠলাম। একে প্রচণ্ড রোদ আর গরম, তার ওপর দৌড়োদৌড়ি, ভিড়, খারাপ রাস্তা, বাসের ঝাঁকুনি সব মিলিয়ে প্রচণ্ড ক্লান্ত লাগছিল। কখন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম জানি না। ঘুম ভাঙতে পাশের সহযাত্রী মৃদু হেসে জানতে চাইল, অনেক দূর থেকে আসছি কি না, কোনমতে দায়সারা জবাব দিয়ে মুখ ঘুরিয়ে নিলাম। কথা বলতে একদম ইচ্ছা করছে না।
গ্রাম থেকে বৃদ্ধাবাসটা দুকিলোমিটার দূরে। হেঁটেই গেলাম। পৌঁছেই মাকে দেখতে গেলাম, কিন্তু বৃদ্ধাবাসের কেয়ারটেকার জানাল, ডাইরেক্টরের সাথে আগে দেখা না করে, মাকে দেখতে পাব না। উনি ব্যস্ত মানুষ। আমাকেই বসতে হল।
ডাইরেক্টর একজন ছোটখাট চেহারার বয়স্ক মানুষ। করমর্দন করার সময় উনি দীর্ঘক্ষণ আমার হাতটা ধরে রইলেন, হাতটা টেনে সরিয়ে নেওয়া উচিত হবে কি না বুঝতে পারলাম না। ডেস্কের ওপর কয়েকটা কাগজ ঘাঁটতে ঘাঁটতে বললেন, “মাদাম মেঁরেশ আমাদের সাথে প্রায় তিন বছর ছিলেন। নিজের বলতে কেউই ছিল না আপনাকে ছাড়া। আপনি চাইলে তাঁকে কিছু টাকাপয়সা দিয়ে সাহায্য করতে পারতেন- ”। উনি ভর্ৎসনা  করছেন ভেবে আত্মপক্ষ সমর্থনে কিছু বলতে গেলাম, উনি থামিয়ে দিলেন। “তোমার কিছু বলার দরকার নেই বাবা। আমি তোমার মায়ের ফাইলটা ভালো করে পড়েছি। আমি জানি তোমার সামর্থ্যে কুলোয়নি। একজন নার্স রাখতে পারলে ভালো হত। তোমার সীমিত আয়ে তুমি পারোনি। তাতে কি? উনি আমাদের এখানে ভালোই ছিলেন।” মাথা নেড়ে সহমত প্রকাশ করলাম। “ওণার এখানে কত বন্ধু ছিল জানো?ওণার সমবয়সী লোকজন, যাদের সাথে উনি মনখুলে কথা বলতে পারতেন। ভাগ করে নিতেন অতীত। তোমার বয়স অল্প, তোমার সাথে থাকলে উনি নির্ঘাত একাতীত্বে ভুগতেন-”। 
এটা ঘটনা। যখন আমরা একসাথে থাকতাম,মা সারাদিন চুপচাপ একাই থাকত। বাড়ি থেকে বেরোতে বা ঢুকতে কেবল দেখা হত মায়ের সাথে। কিছু বলত না মা। বৃদ্ধাবাসে পাঠাবার পর,প্রথম প্রথম কয়েকটা দিন খুব কান্নাকাটি  করত মা। হয়তো বদলে যাওয়াটার সাথে মানিয়ে নিতে সমস্যা হত মায়ের। সে তো মাত্র কয়েকটা দিন। তারপর তো দিব্যি মানিয়ে নিয়েছিল মা। তখন হয়তো এই হোম ছেড়ে যেতে বললেই কেঁদে ভাসাত মা।  সেই জন্যই গত বছর খুব বেশীবার আসিনি আমি মাকে দেখতে। আসলে গোটা রবিবারটা নষ্ট হত। টিকিটের দাম, টিকিট কাটার ঝক্কি, বাসে চেপে দুই-দুই, চার ঘন্টা যাতায়াত, সবমিলিয়ে মনে হত বড় হ্যাপা- ”- অ্যালবেয়ার কামুর, দা আউটসাইডার থেকে কিঞ্চিৎ  বঙ্গানুবাদ।

✍🏼 অ্যালবেয়ার কামুর, দা আউটসাইডার থেকে কিঞ্চিৎ  বঙ্গানুবাদ- আজ দ্বিতীয় পর্ব

(আগের পর্বের লিঙ্ক-কমেন্ট বক্সে)


“ডাইরেক্টর সাহেব একনাগাড়ে বলেই চলেছেন, সবকথা যে মন দিয়ে শুনছি তা নয়। অবশেষে উনি বলে উঠলেন, “মাকে দেখবে তো? চলো। ” চেয়ার ছেড়ে উঠে, নীরবে ওণাকে অনুসরণ করলাম। চেম্বার থেকে বেরিয়ে সিঁড়ি ভাঙতে ভাঙতে উনি বললেন, “আমাদের একটা ছোট মর্গ আছে, আজকের মত ওণাকে আমরা ওখানেই রেখেছি। যাতে আবাসিকরা খুব বেশী কাতর না হয়ে পড়ে, আসলে যখনই এখানে কেউ মারা যান, বাকি আবাসিকরা সাময়িক ভাবে, দুই-তিন দিনের জন্য শোকে এমন বিহ্বল, বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন, যে আমাদের কাজ করতে খুব সমস্যা হয়।”

নীচে ছোট উঠোনে অনেক বয়স্ক মানুষ, ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে, বসে বসে গল্প করছিলেন, আচমকা আমাদের দেখে সবাই থমকে গেল। আমরা দৃষ্টির আড়াল হতেই, আবার শুরু হয়ে গেল কিচিরমিচির। একটা ছোট বাড়ির সামনে এসে থমকে দাঁড়ালেন ডাইরেক্টর সাহেব, “মসিয়েঁ মেরেশঁ, আপনি যান। আমি আর ভিতরে যাচ্ছি না। আমি আপিসেই রইলাম, যদি কোন প্রয়োজন হয়, জানাবেন। আর একটা কথা, আপনার মা তাঁর বন্ধুুদের প্রায়ই বলতেন, উনি মারা গেলে যেন সমস্ত আচার মেনেই যেন ওণাকে কবর দেওয়া হয়-। ওণার শেষ ইচ্ছানুসারেই,  আপনার অনুমতি না নিয়েই, আমরা সব ব্যবস্থা করেছি, আগামী কাল সকাল দশটায় ওণাকে কবর দেওয়া হবে।” ডাইরেক্টর সাহেবকে ধন্যবাদ জানিয়ে এগোলাম। মা নাস্তিক ছিল না বটে, তবে ধর্ম নিয়ে কোন আদিখ্যেতাও তো কখনও দেখিনি।  


একটা বেশ বড়, আলো ঝলমলে ঘরে রাখা হয়েছে মাকে, দেওয়াল গুলো ধপধপে সাদা, চুনকাম করা। ছাতটা কাঁচের। ছড়িয়ে ছিটিয়ে অনেকগুলো চেয়ার রাখা। ঘরের মাঝখানে একজোড়া “ X” আকৃতির কাঠের পায়ার ওপর ডালাবন্ধ কফিনটা রাখা। দেখেই বোঝা যায় যে, আখরোট কাঠের পাল্লার গায়ে চকচকে পিতলের স্ক্রুগুলো আলগা করে আটকে রাখা। কফিনের পাশে,কুঁচি দেওয়া ঢলঢলে সাদা পোশাক পড়া একজন আরবী নার্স দাঁড়িয়ে ছিল। উজ্জ্বল রঙা একখণ্ড কাপড়  দিয়ে চোখ বাদে গোটা মাথা-মুখ ঢাকা। 

দৌড়তে দৌড়তে ঢুকলেন কেয়ারটেকার ভদ্রলোক, হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন “আমরা ডালাটা ফেলে রেখেছি আপনার জন্য। আপনি এলেই যাতে খুলে দেওয়া যায়। ” বলতে বলতে এগিয়েই যাচ্ছিলেন কফিনের ঢাকাটা খুলতে, মাঝপথে থামিয়ে দিলাম অামি। “থাক। দরকার নেই। ” থতমত খেয়ে বললেন, “মানে? খুলব না?” বললাম, “নাঃ”। বলেই কেমন যেন অস্বস্তি হতে লাগল, এভাবে বলাটা বোধহয় উচিৎ হল না। উনি হতভম্ব হয়ে জানতে চাইলেন, “কেন?” এর জবাব আমারও অজানা। উনি বোধহয় আরো কিছু জানতে চাইছিলেন, সংযত কিন্তু দৃঢ় ভাবে জানালাম, “আমি জানি না। ” ভদ্রলোকের গায়ের রঙ লালচে, ফ্যাকাশে নীল দুই চোখ, অন্যমনস্কভাবে পাকা গোঁফে হাত বোলালেন এক দু বার, তারপর বললেন,“বুঝতে পারছি। ” তারপর তড়িঘড়ি একটা চেয়ার টেনে আনলেন আমার জন্য। ইঙ্গিতে বসতে বলে, বেশ খানিকটা দূরত্ব বজায় রেখে বসলেন আমার থেকে। 

একটু পরেই উল্টোদিকের নার্সটা ঘর ছেড়ে যেতে উদ্যত হল, উনি আমার দিকে হেলে পড়ে ফিসফিস করে বললেন, “মেয়েটার কুষ্ঠ হয়েছে জানেন তো”। প্রথম চোটে ওণার কথাটা মাথায় ঢুকল না, তারপর ভালো করে তাকিয়ে দেখলাম, রঙীন হিজাবের তলায়, মেয়েটার গোটা মুখটা, চোখের তলা থেকে সাদা ব্যাণ্ডেজে মোড়া। নাকটা গলে গেছে বোধহয়, নাকের জায়গায় ব্যাণ্ডেজটা টানটান। 


কিছুক্ষণ পর উনি বললেন, “তা-হ-লে আমি আসি-”।বললেন বটে,তবে গেলেন না। আমার চেয়ারের পিছনে দাঁড়িয়েই রইলেন, ঘাড়ের কাছে কেউ এভাবে দাঁড়িয়ে থাকলে ভয়ানক অসোয়াস্তি হয়। বাইরে ধীরে ধীরে সন্ধ্যা নামছে, কাঁচের ছাতের ভিতর দিয়ে চুঁইয়ে চুঁইয়ে নামছে শেষ বিকালের মনোরম আলো। জানলার বাইরে গুঞ্জনরত দুটো ভ্রমর- সবমিলিয়ে কেমন যেন ঘুমপাড়ানিয়া আবহ। জুড়িয়ে আসছে চোখ, প্রচণ্ড ঘুম পাচ্ছে। মাথা না ঘুরিয়ে ভদ্রতাবশতঃ জানতে চাইলাম, “অনেকদিন আছেন এখানে?” উনি বোধহয় আমার প্রশ্নেরই অপেক্ষায় ছিলেন, ঝটিতি জবাব দিলেন, “তা প্রায় বছর পাঁচেক তো বটেই। ” 


অনেকক্ষণ ধরে একতরফা বকেই চলেছেন ভদ্রলোক। বললেন ওণার বয়স ৬৪। উনি কখনও স্বপ্নেও ভাবেননি, কয়েকবছর আগেও যদি কেউ বলত, উনি বিশ্বাস করতেন না, যে এইভাবে সুদূর ম্যারেঙ্গোতে এক বৃদ্ধাবাসের কেয়ারটেকার হিসেবে কোনদিন ওণাকে জীবিকা-নির্বাহ করতে হবে। মাঝপথে থামিয়ে জানতে চাইলাম, “আপনি স্থানীয় বাসিন্দা নন?” বলার সাথেসাথেই মনে পড়ে গেল, ডাইরেক্টর সাহেবের জন্য যখন অপেক্ষা করছিলাম, তখন উনি বলেছিলেন বটে, এখানে ভীষণ গরম। যত তাড়াতাড়ি মায়ের দাফন-কাফন শেষ করা যায় ততোই মঙ্গল। তখনই উনি বলেছিলেন, উনি কাজের জন্য প্যারিঁ থেকে এখানে এসেছেন বটে,তবে নিজের শহরকে একদণ্ডের জন্যও ভুলতে পারেননি। প্যারিঁতে মৃতদেহ তিন থেকে চার দিন খুব সহজেই রেখে দেওয়া যায়, আর এখানে? একদিন রাখলেই পচে দুর্গন্ধ বেরোবে। আমার শুনতে মন্দ লাগছিল না, তবে ওণার স্ত্রী মাঝপথে ধমকে উঠেছিলেন, “তুমি থামবে? বেচারার সামনে এখন এসব কথা কেউ বলে?”এই মুহূর্তে এই ছোট মর্গে বসে উনি বলে চলেছেন, কি ভাবে কপর্দকশূন্য অবস্থায় উনি এখানে এসে পৌঁছান, নেহাৎ শরীরস্বাস্থ্য মজবুত ছিল, তাই এই বৃদ্ধাবাসের কেয়ারটেকারের কাজটা পেতে কোন সমস্যা হয়নি। আমি ঘাড় ঘুরিয়ে জানতে চাইলাম, “তারমানে শেষ বিচারে আপনিও এই বৃদ্ধাবাসের একজন অধিবাসী, তাই তো?” উনি বলে উঠলেন, “না। না। ” অবাক হলাম বেশ, এখানকার অনেক আবাসিকই ওণার সমবয়স্ক। তাদের সম্পর্কে কিছু বলার সময়, উনি বারবার, “ওরা”, “বাকিরা”, “আবাসিকবৃন্দ” এই ধরণের শব্দবন্ধ ব্যবহার করছিলেন, কখনই “বুড়োমানুষ” বা “বুড়োবুড়ি” মার্কা সম্বোধন করছিলেন না। শেষ বিচারে তারা অবশ্য নিছক আশ্রিত আর উনি তাদের তত্ত্বাবধায়ক, কেয়ারটেকার। ওণার কতৃত্ব অবশ্যই বেশী, নির্ঘাত সুযোগসুবিধাও।”


✍🏼অ্যালবেয়ার কামুর "দা আউটসাইডার" থেকে কিঞ্চিৎ  বঙ্গানুবাদ। আজ তৃতীয় পর্ব। 

(আগের-পরের পর্বের লিঙ্ক কমেন্ট বক্সে)


"ঝপ্ করে সন্ধ্যা নামল। মর্গের কাঁচের ছাতের ওপর   নিকষ আলো আকাশের চাঁদোয়া। কেয়ারটেকার ভদ্রলোক উঠে আলোগুলো জ্বালিয়ে দিলেন, অকস্মাৎ তীব্র আলোয় ধাঁধিয়ে গেল চোখ। উনি আমাকে এইবেলা নৈশ ভোজ সেরে নিতে অনুরোধ করলেন, কিন্তু একদম খিদে নেই। অন্তত এককাপ কফি খাবার জন্য পিড়াপিড়ি করছিলেন ভদ্রলোক, জানালাম কফিতে আমার আপত্তি নেই। নিজেই দৌড়লেন এককাপ সাদা কফি আনতে, কফিটা শেষ করার পর, একটা সিগারেট ধরাতে ইচ্ছে করছিল। মায়ের সামনে এই অবস্থায় সিগারেট ধরানোটা কতটা যুক্তিযুক্ত হবে বুঝতে পারলাম না। তারপর মনে হল, এই মুহূর্তে সিগারেট ধরানো বা না ধরানোয় মায়ের খুব একটা কিছু আসে যায় না। 

কেয়ারটেকারকে সিগারেট অফার করতেই উনি রাজি হয়ে গেলেন,  দুজনে নীরবে ধূমপান করছিলাম, এমনসময় উনি বললেন, “ আমি এবার উঠি বুঝলেন। এখুনি আপনার মায়ের বন্ধুরা এসে পড়বে। কয়েকটা চেয়ার আর কফির ব্যবস্থা করি। ওঁণারাও আজ রাতটা এই ঘরেই কাটাবেন, আপনার সাথে। এখানে এমনই হয়। ”  উনি উঠে যাচ্ছিলেন, আমি অনুরোধ করলাম, যাবার আগে যদি অনুগ্রহ করে কয়েকটা আলো নিভিয়ে দিয়ে যান, রীতিমত চোখে লাগছে। উনি কাঁচুমাচু মুখে জানালেন, সেটা সম্ভব নয়। সুইচ একটাই, ফলে একটা নেভাতে গেলে সবকটাই নিভে যাবে। 

কিছুক্ষণের জন্য অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলাম, তারই মধ্যে উনি বেশ কয়েকবার ঢুকলেন, বেরোলেন,চেয়ার গুলো সাজালেন, কয়েকটা কাপ আর পট ভর্তি কফি এনে একটা চেয়ারের ওপর রাখলেন, তারপর কফিনের ওপারে আমার মুখোমুখি একটা চেয়ারে গিয়ে বসলেন। আমার পিছনের দরজাটা খোলা, ঠাণ্ডা শিরশিরে একটা বাতাস বারবার এসে ঘুরপাক খাচ্ছে ঘরের মধ্যে। বাতাসে একটা চাপা মিষ্টি ফুলেল গন্ধ। গরম কফিটা খেয়ে ছিলাম বলেই হয়তো বেশ আরাম লাগছিল- কখন চোখ জুড়ে গেছে বুঝতে পারিনি। 

গায়ে হাল্কা কিছুর স্পর্শে ঘুমটা ভেঙে গেল, তড়িঘড়ি চোখটা খোলা মাত্রই ধাঁধিয়ে গেল। সাদা দেওয়াল গুলোর জন্য আলোর উজ্জ্বলতা আরো বেড়ে গেছে। মায়ের বন্ধুরা আস্তে আস্তে ঢুকতে শুরু করেছে। সব মিলিয়ে জনা দশেক হবে। মহিলারা সকলেই বেঢপ মোটা, কোমরে টাইট করে বেঁধে রাখা অ্যাপ্রনের জন্য পেটগুলো ঢাউস বলের মত ফুলে আছে। পুরুষরা অপরদিকে পুরুষরা সকলেই সিড়িঙ্গে, সকলেই লাঠি ঠুকঠুক করে হাঁটে। ওণারা নীরবে প্রবেশ করে, পেতে রাখা চেয়ারগুলিতে বসে পড়লেন। প্রত্যেকের মুখ বলিরেখায় ঢাকা, চোখই দেখা যায় না। চোখের কাছটা সামান্য চেরা, যার ভিতর থেকে একটা ফ্যাকাশে মরা মরা আলো বেরিয়ে আসে। ওণারা সকলেই আমাকে দেখে সামান্য মাথা ঝুঁকিয়ে অভিবাদন জানালেন। আমাকে দেখে কি না জানি না,মনে হল সামান্য বেঁকে গেল মুখগুলো, অবশ্য ভুলও হতে পারে, কারোরই তো দাঁত নেই, ঠোঁটগুলো   এমনিতেই চুপসে গিয়ে মুখগহ্বরে ঢুকে গেছে। তখনি খেয়াল করলাম, আমার পাশে কেউ বসেনি। সকলে একজোট হয়ে কেয়ারটেকারকে ঘিরে আমার উল্টোদিকে গিয়ে বসেছেন। কয়েকটা মুহূর্তের জন্য মনে হল, এনারা আমাকে পর্যবেক্ষণ করার জন্যই আজ এখানে জমায়েত হয়েছেন বুঝি- 

তখনি এক বৃদ্ধা কাঁদতে শুরু করলেই, দ্বিতীয় সারিতে বসেছেন ভদ্রমহিলা, এপাশ থেকে আমি ওণাকে দেখতে পাচ্ছি না, শুধু একঘেঁয়ে মৃদু ফোঁপানির আওয়াজ পাচ্ছি। উনি কেঁদেই চলেছেন, কখন থামবেন কে জানে। অন্যান্য সকলেই নির্বাক, শোকস্তব্ধ,  গুটিসুটি  মেরে বসে আছেন যে যার চেয়ারে। হয় একদৃষ্টিতে কফিনের দিকে তাকিয়ে আছেন, অথবা তাকিয়ে আছেন হাতের লাঠিটার দিকে। মহিলা কেঁদেই চলেছেন। একটু খারাপ লাগছিল ওণার জন্য, উনি কে আমি জানি না, আমি চাই উনি শান্ত হন, কিন্তু সেকথা বলার মত সাহস জোটাতে পারছিলাম না। কেয়ারটেকার ভদ্রলোক ওণার পাশে বসে সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করলেন খানিকক্ষণ। ফিসফিস করে কিছু কথাবার্তাও হল। মহিলা মাড়া নেড়ে কিছু বললেন, তারপর আবার ফোঁপাতে শুরু করলেন। হাল ছেড়ে দিয়ে উঠে পড়লেন কেয়ারটেকার। কফিনটাকে ঘুরে আমার পাশে এসে বসলেন, বেশ খানিকক্ষণ নীরব থেকে, আমার দিকে না তাকিয়ে, আস্তে আস্তে বললেন, “ আপনার মায়ের সাথে খুব ভাব ছিল ওণার। উনি বলছেন, এই আশ্রমে আপনার মা’ই ওণার একমাত্র বন্ধু ছিলেন। আর ওণার আপন বলতে কেউ রইল না। ”

Wednesday 22 April 2020

অনির ডাইরি ২২শে এপ্রিল, ২০২০


#lockdown #lockeddown

মেঘলা সকাল, জানলার ওপারে ভিজে কাঞ্চন আর দেবদারু পাতায় তখনও টলটল করছিল স্ফটিকের মত জলের দানা।বারন্দায় টবগুলোর মাটি ভিজে ভিজে, আজ আর জল দেবো না। পাতি লেবুর বীজ ফেলেছিল তুত্তুরী, দুটি কচি চারা বেরিয়েছে। ছাতে একটা মাটি ভর্তি ভাঙা টব পড়েছিল অনেকদিন ধরে, নামিয়ে আনলাম। বাছার কাকুর টব। ওণার খুব গাছের শখ ছিল।একরাশ লালিমা ছড়িয়ে সূর্য যখন ঢলে পড়ত পশ্চিমে, উনি ছাতে যেতেন জল দিতে।ওৎ পেতে থাকত তুত্তুরীও। ছাতের ওপর বসত গপ্পে দাদুর আসর। ওণার স্ত্রীর শখ ছিল, আর একটু বড় ফ্ল্যাটের। যেখানে একটা ঘর থাকবে শুধু ঠাকুরের। অবসর নেবার পর ফ্ল্যাট তো কিনেছিলেন, কিন্তু কাকিমার আর যাওয়া হয়ে ওঠেনি। দীর্ঘদিন বন্ধ থাকত ফ্ল্যাটটা। তারপর একদিন চলেই গেলেন,ছেলেমেয়েকে নিয়ে। একই তো আবাসন,স্থানান্তরিত হবার পরও আসতেন গাছের টানে। ইদানিং আর আসেন না। শুকিয়ে যাওয়া গাছ আর ফাঁকা টবগুলো পড়ে আছে একাকী। তারই একটায় বসালাম কচি লেবু চারা। শৌভিক যথারীতি বিরক্ত। চিবিয়ে চিবিয়ে জানতে চাইল, টবটা কোথায় থাকবে? আর আমরা কোথায় থাকব?
    আমাদের আবাসনটা বার্ধক্যের বারাণসী। বয়স্ক মানুষের সংখ্যাই বেশী। কিছুদিন আগেও রেড যোন এরিয়া ছিল। আপাততঃ কন্টেনমেন্ট এলাকা। আজ থেকে গেটের মুখেই রোবটের মত পোশাক পরা মানুষজন ঘুরছে, কাউকে দেখতে পেলেই কপালে তাক করছে বন্দুক। থার্মাল স্কিনিং এর বন্দুক।
মানুষ জন বেরোচ্ছেও কম। দোকানপাটও ফাঁকা। রাজা রোজই গল্প দিচ্ছে, “সওব আছে বৌদি। শুধু আনতে পারছি না। এট্টু টাইম দিন। কালকেই ঠিক হয়ে যাবে সবকিছু। ” কালকের গল্প চলছে সপ্তাহ জুড়ে। মনিহারি দোকানে নিত্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী থাকুক না থাকুক, চোরাগোপ্তা সুরা যোগান দেবার গুজব কান পাতলেই শোনা যায়। সেদিন ফোন করেছিল হুসেন। সেই সুদূর উত্তরবঙ্গের এক অনামী গ্রাম থেকে। কোন আদ্দিকালের সহকর্মী হুসেন মিঞাঁ, রোজ ধমক খেত। ধমকাতাম আপন করে, কান চুলকে ধমক খেত হুসেন আর ভালোবাসত মেয়ের বয়সী ম্যাডামকে। আজও বাসে, হিন্দু-মোছলমান যারই পরব হোক না কেন, হুসেন তার পুরোনো ম্যাডামকে ফোন করবেই। এবারে যেমন বলল, “বাড়িতে আটকে গেছি ম্যাডাম।এরা বেরুতে দিচ্ছে না। বলছে তুমি বুড়া না, বাইরে গেলেই রোগ বাঁধাবে।  উঠানেই হাঁটাচলা করছি একটু। ” শ্যামল যেমন দিন কয়েক আগে বলছিল, “ম্যাডাম! আমি বাড়িতে আটকে গেছি ম্যাডাম। কি হবে?” বাড়িতে আটকে গেলে ম্যাডাম কি করবে রে বাপ?  আমি তো নিজেই আটকে গেছি। লাল-নীল-সবুজের বাঁধনে। শ চারেক মিটার দূরত্বেই কোয়ারান্টাইন সেন্টার- স্যানিটাইজ করার জন্য তালাবন্ধ নার্সিং হোম।

বহুদিন বাদে পট্টনায়ক কাকুর সাথে দেখা। মাস্ক পরে চেনাই দায়। ডিভিসির ইঞ্জিনিয়র ছিলেন। স্বেচ্ছাবসর নিয়ে মহানন্দে অবসর জীবন যাপন করছেন। শ্বশুরমশাইয়ের বিশেষ অনুগত তথা স্নেহধন্য মানুষ। এমন পরোপকারী মানুষ সচরাচর দেখা যায় না। অসহায় নিঃসঙ্গ বৃদ্ধ আবাসিকদের কত কাজ যে করে দেন কাকু- অনলাইন বিল দিয়ে দেন, ওষুধ, সব্জি, দুধ, মাছ পৌঁছে দেবার বন্দোবস্ত করেন। কেউ আচমকা অসুস্থ হয়ে পড়লে, নিজেই গাড়ি চালিয়ে হাসপাতালে নিয়ে যান। অবসর নিয়ে এইসবই করেন। সব সময় পজিটিভ এনার্জিতে টগবগে প্রৌঢ় আজ বেশ বিমর্ষ মনে হল।  আজ শুধুই দুঃসংবাদ ছিল ওণার ঝুলিতে,জনৈক আবাসিক বৃদ্ধ মারা গেছেন। কাকুর বিশেষ পরিচিত। বছর আশি-বিরাশি বয়স হবে, পণ্ডিত তথা বিদগ্ধ মানুষ। প্রতিষ্ঠিত সন্তানরা বিদেশবাসী। হঠাৎ গলার গ্ল্যাণ্ড ফুলেছিল, সামনের নার্সিংহোম স্যানিটাইজ করার নামে তালাবন্ধ, গিয়েছিলেন সল্টলেকের এক নামী বেসরকারী হাসপাতালে ভর্তি হতে। মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে হাসপাতাল। আগে কোভিড নেগেটিভ সার্টিফিকেট আনুন, তবে বাকি কথা-। বৃদ্ধাকে নিয়ে দৌড়েও ছিলেন বেলেঘাটা। পাঁচশ সাতশ লোকের লম্বা লাইন। ঘন্টা তিনেক লাইনে দাঁড়িয়ে, ধড়ফড় করে মারা গেছেন-।
তালাবন্ধ হাসপাতালের এমন মহিমা যে আরেক বৃদ্ধ,নিয়মিত ডায়ালিসিসের পেশেন্ট কোথাও ভর্তি হতে পারছেন না। পুরোনো কাগজ ঘেঁটে যখনই দেখা যাচ্ছে, উনি বন্ধ হাসপাতলের প্রাক্তন রোগী, পত্রপাঠ ফেরৎ পাঠাচ্ছে নামী এবং দামী হাসপাতাল- নার্সিংহোম।

মনখারাপের মধ্যেও কাকু মাস্ক পরে বেরিয়েছেন জনৈক নিঃসঙ্গ বৃদ্ধকে নেশার রসদ পৌঁছে দিতে। বৃদ্ধের সুরার ভাঁড়ার খালি। পট্টনায়ক কাকুর কাছে গোটা দুয়েক দুই না আড়াই শ মিলিলিটারের শিভাস রিগ্যাল ছিল। তারই একটা দিতে যাচ্ছিলেন। নাম শুনেই চমকে উঠলাম। তার তো অনেক দাম! জানতে চাইলাম আপনি শিভাস রিগ্যাল খান নাকি? জানালেন দু বোতল সিগনেচার কেনা ছিল নাকি।একটি শেষ, অবশিষ্টটা চলছে। থাকতে না পেরে জিজ্ঞাসা করেই ফেললাম, সিগনেচারের দাম কি শিভাস এর থেকে বেশী?  উনি হেসে উঠলেন হো হো করে।
আবাসিকদের হোয়াটস্ অ্যাপ গ্রুপে এবার চূড়ান্ত সতর্কতা জারি করা হয়েছে। দেখাল শৌভিক।সিকিউরিটি আর সিসিটিভির নজর বাঁচিয়ে, এখনও কেউ কেউ চোরাগোপ্তা ডেকে আনছেন কাজের মাসিদের। বৃদ্ধাদের এত কায়িক পরিশ্রমে কাহিল হয়ে পড়ছেন তাদের গৃহকর্তারা। আমার শ্বশুরমশাইও ফোন করেছিলেন, সমবায়ের সভাপতিকে। যদি অনুগ্রহ করে ঝাড়পোঁছের মেয়েটিকে আসার অনুমতি দেন ওণারা। উনি অপারগতা জানিয়ে ক্ষমা চেয়েছেন। আমাদের সবিতা মাসিকে অবশ্য ডেকে নিয়েছে একঘর বুড়োবুড়ি। মাসি মাঝেমাঝেই এসে দরবার করেন, “আসতে দাও না গো বওদি। না খাইটলে খাবো কি?” আশ্বস্ত করি, বেতন কাটব না, তাও মাসির অবুঝ মন ভয় পায়। এই বৃদ্ধ-বৃদ্ধা বড়ই অসহায়। বৃদ্ধ কাহিল হয়ে পড়েছেন, রোজের কাজের চাপে। মাসি রাজপথ ধরে আসতে গিয়ে প্রথম দিনই পুলিশের হাতে ধরা পড়ে। “মন্নিঙ ওকে বেরিয়িছি রে বাবা” বলে ছাড় পায় সে যাত্রা। পরের দিন থেকে গলি গলি দিয়ে সাত পাড়া ঘুরে কাজে যেতে শুরু করে। এবার আটকায় সিকিউরিটি। বেতন আনতে যাচ্ছি বলে মুকুব হয় মাসির অপরাধ। তৃতীয় দিনে অন্যান্য আবাসিকরা ধরে ফেলে, যাচ্ছেতাই অপমান করা হয় মাসি এবং বুড়োবুড়িকে-
গত রবিবার মালপোয়া বানিয়েছিলাম। ছবিটা আর পোস্ট করা হয়নি। জনৈক রাজকুমারের অভব্যতায় বেশ আহত তথা বিরক্ত হয়েছিলাম। আমাদের জঙ্গলের রাণীকে অপমান করা? বা বলা ভাল অপমানের প্রচেষ্টা? বলি কি, আপনার বয়স অল্প, তবুও সার্ভিস তুলে খিস্তি মারাটা, মাইরি রাজকুমার বাবু বড়ই বালখিল্যচিত ব্যাপার। আপনি হয়তো আপিসের চেয়ারটা মাথায় নিয়ে ঘোরেন, তা ঘুরুন, তবে ব্যাপারটা বুঝলেন কি না, নাম আপনার রাজা-গজা- রাজকুমার যাই হোক না কেন, দিনের শেষে আপনিও এক পাতি রাজকর্মচারী মাত্র। সরকারী চাকর। খাস হতেই পারেন, তবে চাকর তো বটেই। ঈশ্বর আপনাকে কিঞ্চিৎ  ধুসর বস্তু প্রদান করুন, এই কামনা করি।
জঙ্গলের রাণী যে ভাবে লোপ্পা বলটাকে গ্যালারির পার করেছে, ছবিটা এবার পোস্ট করাই উচিৎ।  শুধু চোখের সামনে কেন যে বার বার ভেসে উঠছে এক বছর বারোর না খেতে পাওয়া মেয়ের মুখ। মাত্র ১২। তিনদিন ধরে না খেয়ে, অপরিচিত একদল মানুষের সাথে, লুকিয়ে, পুলিশের নজর বাঁচিয়ে বন জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে যখন হেঁটে আসছিল বোকা মেয়েটা- কি ভাবছিল? মায়ের কথা ভাবছিল কি?

Friday 17 April 2020

অনির ডাইরি, ১৬ই এপ্রিল, ২০২০


#lockdown #lockeddown
বেচারা তুত্তুরী, এখনও রেজাল্ট বেরোয়নি। নতুন বইখাতা পায়নি। তাতে অবশ্য মহানন্দেই আছে তুত্তুরী। ইদানিং শুধু বাবা জবরদস্তি ব্যায়াম করাতে আর বই পড়াতে শুরু করেছে। পড়ার বই নয় অবশ্য, গল্পের বই। সকাল থেকেই ব্যায়াম করার সময় আর পাতার সংখ্যা নির্দিষ্ট করে দিচ্ছে বাবা, অত পাতা পড়লে তবেই মিলবে মোবাইল। থুড়ি আজকাল মোবাইলও তো পায় না, ল্যাপটপে সিনেমা দেখায় বাবা। সোনার কেল্লা থেকে শুরু করে ফেলুদার সব সিনেমাই দেখে ফেলেছে বাপ-মেয়েতে। দেখে ফেলেছে আজব গাঁয়ের আজব কথা, আলিনগরের গোলকধাঁধা আরও কি যেন সব। সিনেমা শুরুর আগে অবশ্য প্রতিবারই শৌভিক রান্নাঘরে এসে এক প্রস্থ নাকে কেঁদে যায়। একা সিনেমা দেখতে চায় না তুত্তুরী। পাশে বসে দেখতে হয় বাবাকেও। বুঝিয়ে দিতে হয়। শুধু কি তাই? কেউ বন্দুক বার করলেই বাবার কোলে উঠতে চায় তুত্তুরী। কেউ খুন হলেই,সিনেমা ফেলে রান্নাঘরে ছুটে আসে তুত্তুরী।

অবসাদ হলেই আমার ঘনঘন খিদে পায়। আর বেশী খেয়ে ফেললেই ঘিরে ধরে তীব্র অপরাধ বোধ। মনেপ্রাণে চাই একটু অতিভোজন করুক না হয় শৌভিকও, তাহলে নির্ঘাত কিছুটা হাল্কা হবে অপরাধ বোধ। আমরা সবাই পাপী, সবাই হ্যাংলা, মার্কা স্বস্তির অনুভূতি হবে একটা। পেড়াপিড়ি করি, আর একটা রুটি বেশী খাও। আর এক হাতা ভাতা নাও অন্তত। আর একটু চাউমিন নেবে না? এ বাবা আমি যে আবার নিলাম। রেগে যায় শৌভিক। লকডাউনের আগে,রোজ ঘন্টাখানেক শরীরচর্চা করত। পাঁচটা জিনিস কিনতে পাঁচবার বাজার যেত। ইচ্ছে করে আবাসনের বাজারে ঢুঁ না মেরে ঘুরপথে, দূরের বাজারে যেত। রোদ পুড়ে তামাটে হয়ে ফিরত, ঘামে সপসপ করত গেঞ্জি। সেসব এখন ইতিহাস। কোভিড ভিজুয়ালাইজারে ক্ষণে ক্ষণে সারা পৃথিবী প্রদক্ষিণ করে, তাও নাকি তার আজকাল খিদে হয় না। মাঝে মাঝে ভয় দেখায়, একাহারী হবে। বন্ধ করে দেবে রাতের খাওয়াটা। এসব শুনলেই মনে হয়, এর থেকে সন্ন্যাস নেওয়া ভালো। আজ বলেই ফেললাম, গৃহত্যাগী হব। খপ করে বাঁ হাতটা চেপে ধরল তুত্তুরী, “না মা। ” কন্যার সীমাহীন ভালোবাসায় আদ্র হয়ে ওঠে হৃদয়, সান্ত্বনা দি, না, না তুমি বড় হও, স্বনির্ভর হও তবে না। তখন যাব। কন্যার বাপকে খোঁচা দেবার জন্য বাঁকা সুরে বলি, “তখন বাবার আবার বিয়ে দিও। কেমন-”। গম্ভীরমুখে রুটি চিবোতে চিবোতে ঘাড় নাড়ে শৌভিক। প্রথম চোটে অবাক হয় তুত্তুরী, তারপর একরাশ দুশ্চিন্তা নিয়ে আমাকে বোঝাবার চেষ্টা করে, “কিন্তু বাবা তো তখন বুড়ো হয়ে যাবে মা। আর বুড়ো লোককে কেউ বিয়ে করে না। ” জানালাম আলবাৎ করে।  শুনে খুশি হয়ে ওঠে তুত্তুরী, বলে, “হ্যাঁ। তাহলে একটা ফর্সা মোটা বুড়ি খুঁজতে হবে। তার সাথে বাবার বিয়ে দেবো। ” আবার ফর্সা আর মোটা? না বাবু, এটা বরং বাবাকেই বেছে নিতে দিস্। এঁটো হাতেই বুড়ো বাপের স্বয়ম্বর সভার পরিকল্পনা করতে শুরু করে তুত্তুরী। অলস মস্তিষ্ক হলে যা হয়-।

রাতের বাসন মাজা শেষ। শেষ হয়ে আসছে আর একটা তালাবন্ধের দিন। বিছানা করতে করতে হুঁশিয়ারি দেয় শৌভিক, খাট কাঁপিয়ে হাসা চলবে না।ওমন রোজই বলে-  ফ্রেন্ডস্ দেখা শুরু করেছি, নতুন করে। এই নিয়ে কত বার যে দেখলাম তার ইয়ত্তা নেই। প্রতিটা চরিত্র হাতের তালুর মত চেনা। মুখস্থ প্রতিটা এপিসোড। নেটফ্লিক্সে প্রথম যখন ফিরে এসেছিল ফ্রেন্ডস্, ঠিকই করে নিয়েছিলাম, আর দেখব না। ঢের হয়েছে। স্কুলের শেষ ভাগ থেকে কলেজ ঘুরে চাকরী, প্রেম- বিরহ- বিবাহ জীবনযুদ্ধের প্রতিটা মুহূর্তে যারা ছিল সত্যিকারের দোস্ত, কবে যেন ছেড়ে দিয়েছিলাম তাদের হাত। বছর পাঁচেক আগে, একবার দেখার চেষ্টা করেছিলাম, তীব্র মনখারাপ নিয়ে বন্ধ করে দিতে বাধ্য হই দূরদর্শন যন্ত্রটা। কবে বেড়ে গেল এতটা বয়স? আর কিছুতেই একাত্ম হতে পারিনি ফুরফুরে চরিত্রগুলোর সাথে। বরং রীতিমত ঈর্ষান্বিত বোধ করেছিলাম। ফেলে আসা সময়, হারিয়ে যাওয়া বন্ধুদের জন্য হাহাকার করে উঠেছিল হৃদয়। কি ভাবে বদলে গেল জীবন? সেক্স ইন দা সিটির সারা জেসিকা পার্কার আর তার গার্ল গ্যাং এর সাথে বরং খুঁজে পেয়েছিলাম অনেক মিল। দেখতে বাধ্য করেছিলাম আমার প্রিয়বান্ধবীদের। তথাকথিত এক আঁতেল দিদি তো বিগলিত হয়েই বলেই ফেলেছিল, “ওরে,এতো পুরো আমরা রে!” তাহলে আবার ফ্রেন্ডস্ কেন? কি জানি? হয়তো লকডাউন জনিত অবসাদের জন্যই আশ্রয় খুঁজতে গিয়েছিলাম প্রিয় বন্ধুদের কাছে- পুরোনো মদের মতই, হয়তো সম্পর্কগুলোও যত পুরোনো হয়, ততোই বাড়তে থাকে তাদের আবেদন। যাই হোক। আপাততঃ এইটুকুই, প্রতীক্ষারত আমার বন্ধুরা। চুপিচুপি বলি, যাদের একজনের প্রতি বরাবরই বিশেষ দুর্বল আমার হৃদয়। সে কে? সেটা বরং উহ্যই থাক-

Wednesday 15 April 2020

অনির ডাইরি, ১৫ই এপ্রিল, ২০২০


ঠিক এই মুহূর্তে কুড়ি লাখ ছাড়াল বিশ্বব্যাপী আক্রান্তের সংখ্যা। মৃত সোয়া লক্ষ। আঙ্কল শ্যাম যথারীতি সবার আগে,আক্রান্তের সংখ্যা ছাপিয়েছে লাখ ছয়েক, যার মধ্যে মৃত ছাব্বিশ হাজার। কোথায় যেন পড়লাম, প্রকৃতিগত ভাবে কোভিড ভাইরাস বেশ সদাশয়। আশ্রয়দাতাকে কোতল করার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা এর নেই। বরং “হোস্ট” জীবিত থাকলেই কোভিডের লাভ-। প্রকৃত আক্রান্তের সংখ্যা আর মৃত্যুকে যদি পাশাপাশি ফেলে হিসেব করা যায়, দেখা যাবে করোনায় মৃত্যুর হার মেরে কেটে ২-২.৫শতাংশ।  কিন্তু ঐ যে বললাম, প্রকৃত আক্রান্তের সংখ্যা, ঐ খানেই আছে প্যাঁচ, প্রকৃত আক্রান্তের সংখ্যা কত কেউ জানে না। কোভিড ভাইরাসের ইনকিউবেশন পিরিয়ড ইতিমধ্যেই আমাদের ঠোঁটস্থ, WHO যদিও বলছে গড়ে ৫-১৪দিন, মোটামুটি হপ্তা দুয়েকই ধরুন না। অর্থাৎ আপনার কোভিড আক্রান্ত হবার হপ্তা দুয়েকের আগে আপনি টেরও পাবেন না, আপনাকে “সে” ধরেছে। তারপরও না টের পেতে পারেন। WHO বলছে, কোভিডের আশ্রয়দাতা অথচ শরীরে ছিটেফোঁটাও করোনার লক্ষণাবলী প্রকাশ পায়নি, এমন মানুষের সংখ্যা খুব কম কিছু নয়। আর এরাই সবথেকে বিপজ্জনক। এদের অজ্ঞাতেই এরা ছড়িয়ে দেয় এই সদাশয় মহামারী।এদের পোশাকী নাম, Asymptomatic।  WHO তো আরও বলছে, শতকরা ৮০ভাগ আক্রান্তের প্রয়োজনও হয় না কোন চিকিৎসার। প্রতি ছয় জনের মধ্যে মাত্র একজন ভোগে তীব্র শ্বাসকষ্টে, তিনি যদি ভাগ্যবৈগুন্যে immunocompromised হন, অর্থাৎ যাঁর অনাক্রম্যতার প্রাচীরে আগে থেকেই ধরেছে ফাটল, তাহলে অবশ্যই করোণা তাঁর পক্ষে মারাত্মক। বয়স্করা যেহেতু গণ হারে সুগার-প্রেশার-ডায়বেটিস ইত্যাদিতে ভোগেন, তাই বারংবার তাঁদের স্বাস্থ্যের দিকে ধ্যান রাখতে বলা।

এখন কথা হচ্ছে যে ব্যধিতে মৃত্যুর হার এত স্বল্প, তাই নিয়ে এত মাতামাতি কেন? হয় যদি করোণা হোক না। বরং একবার আক্রান্ত হয়ে বেঁচে গেলে, শরীরে তৈরি হয় অ্যান্টিবডি, ফলে হিসেব মত আর দ্বিতীয়বার আক্রান্ত হবার থাকে না কোন সম্ভবনা। এই তথ্যকে মাথায় রেখেই লকডাউন করেনি সুইডেন। খোলা আছে, সিনেমা-থিয়েটার, হোটেল-রেস্তোরাঁ- পাব। জনগণের সুমতির ওপর ভরসা রেখেছে সরকার, আপনারা সাবধান হোন। দূরত্ব বজায় রাখুন। বাকি জীবন চলুক আপন ছন্দে।  আমেরিকা থেকে ট্রাম্প খুড়ো জুড়েছে বেজায় হল্লা, গোটা বিশ্ব যার ভয়ে থরথর, যে ব্যধির হাত থেকে মুক্তি পায়নি খোদ বৃটেনের বুড়ো যুবরাজ এবং প্রধানমন্ত্রী, বা কানাডার প্রধানমন্ত্রীর ঘরনী, যে রোগের কোপে ভুগছে খোদ সৌদি আরবের রাজপরিবার, মারা গেছেন স্পেনের রাজকুমারী, হেন রাজরোগ নিয়ে এই ভাবে ছেলেখেলা? আমেরিকা অবশ্য খোদ বসে আছে আগ্নেয়গিরির মাথায়। সারা দেশে এই মুহূর্তে আক্রান্ত সোয়া ছয় লক্ষ ছাপিয়েছে। আক্রান্ত পড়লেন কি? পড়বেন না, পড়ুন সনাক্ত। আক্রান্ত কত কে জানে? সনাক্তকে মোট জনসংখ্যা দিয়ে ভাগ করলে আমেরিকার ফল আসে 0.19%। আর সুইডেনের আসে 0.11%। তাহলে কি দাঁড়াল? কোনটা বেশী কার্যকর লকডাউন না তালা খোলা?
বড় জটিল এই হিসেব, ঘরে বসে তথ্যের কচকচি করাই যায়, কিন্তু কথা হল,  স্বয়ং WHO যেখানে ঘেঁটে আছে। আমরা কোন ছাড়। আমরা তো এই আকালেও স্বপ্ন দেখি। কেটে যাবে কালো মেঘ, খুলে যাবে বাতায়ন। শৌভিকের চাপে, কদিন আগেই পড়া অ্যালবেয়ার কামুর প্লেগ উপন্যাসটার কথা থেকে থেকে মনে পড়ে। মনে পড়ে যায়, উত্তর অ্যালজিরিয়ার ওরাণ শহর আর তার অধিবাসীদের কথা। যেখানে প্রথমে মরছিল ইঁদুর, ইঁদুর থেকে সংক্রামিত হল মানুষে। গড়িমসি করতে করতে অবশেষে স্বীকার করতে বাধ্য হল কতৃপক্ষ, হ্যাঁ ফিরে এসেছে প্লেগ। রাতারাতি অবরুদ্ধ হল শহর। কোন কাজে যারা বাইরে গিয়েছিল, বন্ধ হয়ে গেল তাদের ফেরার পথ। আর যারা ভিতরে আটকে গেল- তারা ভিড় করতে লাগল নগরীর বন্ধ গেটের সামনে। অনুনয়-বিনয়- উৎকোচ। কিছুই খোলাতে পারল না নগরীর প্রবেশ দ্বার। দিন যায়, হপ্তা কেটে মাস ঘুরে যায়। ঘুরে যায় মরশুম। নগরবাসীরা প্রতিনিয়ত ভাবে, আর তো কটা দিন- তারপরই মূল স্রোতে ফিরবে জীবন। পাঠক পড়ে আর অজানা আতঙ্কে কেঁপে কেঁপে ওঠে। অবশ্য ওরানের ডাক্তার বা নার্সদের কেউ পিটিয়েছিল কি না কোথাও লেখা নেই। লেখা নেই জবরদস্তি উচ্ছেদের কথাও। এতটা নির্বোধ বোধহয় ছিল না ওরানবাসীরা।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে, ছয় বছরে প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ ভাবে মারা গিয়েছিল সাড়ে আট কোটি মানুষ। করোনার বয়স সবে মাস তিনেক। প্রত্যক্ষ শিকার ছাপিয়েছে সোয়া লক্ষ। আর পরোক্ষ? সে অঙ্ক কষতে পারে হয়তো বান্দ্রায় পড়ে থাকা ধুলিমলিন সস্তা আধছেঁড়া চপ্পলের দল। কষতে পারে দিল্লীর ক্রন্দসী জননী, খালি পেটে থাকতে থাকতে যার শুকিয়ে আসছে অমৃতধারা। কষতে পারি,হয়তো কষবও, আমরা।আপনার করোনা হোক বা নাহোক, নিশ্চিত থাকুন আমূল বদলে যেতে বসেছে আপনার আমার জীবন। ২০২০ সত্যই জলবিভাজিকার বছর, সন্ধিক্ষণ, যাকে টপকে কখনই আর ফিরে যাওয়া যাবে না- ফিরে পাওয়া যাবে না পুরোনো জীবনকে।

Sunday 12 April 2020

অনির ডাইরি, ১২ই এপ্রিল, ২০২০


#lockdown #lockeddown

অন্যদিনগুলোর থেকে আজকের দিনটা একটু আলাদা। আজ নীল। অন্যান্য বছর গুলোতে সকাল সকাল,দিদির (বাবার দিদি আসলে) সাথে ক্ষীরেরতলা মাঠের বুড়ো শিবের মাথায় জল ঢালতে যাই। দিন দুয়েক আগে থেকে টুকটুক করে সব যোগাড় করে দিদি। পাঁচ রকম ফল, সন্দেশ, বেল পাতা, কাঁচা দুধ, গঙ্গা জল, আকন্দ ফুলের মালা, কাঁটাওয়ালা ধুতরো ফল। ভোর থেকে তাড়া লাগায় দিদি, মন্দিরে ভিড় বেড়ে যাবে যে। স্নান করে, পাটভাঙা শাড়ি পরে, চুপড়িতে পুজোর উপকরণ সাজিয়ে, রওণা দি পিসি ভাইঝি। দিদির হাতে পিতলের কমণ্ডুলে টলটল করে কাঁচা দুধ। ভিড় বেড়েই যায় মন্দিরে। লাইন পড়ে পুরনারীদের। চলে গেরস্থালীর চর্চা। কেউ না কেউ পিসিকে ফিসফিসিয়ে জানতে চায়, “কে এটা?” পিসি সদর্পে বলে, “আমার মেয়ে। ”
জানুয়ারী পড়তে না পড়তেই হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়েছিল পিসি। ডান দিকটাই অসাড়। শুয়ে থাকত জড়বস্তুর মত। কি সেবাটাই না করত দুই খুড়তুতো ভাই। আজও করে চলেছে। কি যে হয়েছিল, কেউ বলতে পারে না। প্রেশার-সুগার-কলেস্টরেল সবই তো নর্মাল। বুড়ো পারিবারিক  ডাক্তার খালি বলে চলে, “ভয় পেয়েছে পিসিমা।” কিসের ভয় তোমার দিদি? জিজ্ঞাসা করলে, দুহাতে চেপে ধরত আমার হাত, “আমায় যেন ভুলে যাস নে। তোকে তো মানুষ করেছি বল-”। ভুল হয়ে যাচ্ছে না দিদি? শুধু আমায়? তুমি আসলে  মানুষ করেছো তিন প্রজন্ম, বাবা থেকে আমি হয়ে তুত্তুরী। প্রতিবছর নীলের দিন, শৌভিক তুত্তুরীর সাথে সাথে তোমার নামেও জ্বালাই বাতি। অষ্টমীর অঞ্জলিতে আলাদা করে লেখা থাকে কিছু চাটুজ্জে আর কিছু ভট্টাচার্যর নাম। এত সহজ নাকি ভোলা? কিন্তু ভয়টা কি? এই ভয় হল মৃত্যু হয়। চাটুজ্জে বাড়িতে জানুয়ারী মাসটা একাধিক মৃত্যু ডেকে এনেছে। প্রথমে ঠাকুমা, তারপর বড়পিসি, ছোটকাকু আর কাকিমাও পর্যায়ক্রমে তিনবছরষ একদিনের ব্যবধানে। তুমি বোধহয় ভেবেই নিয়েছিলে এটা তোমার বছর? এত সহজে আমরা তোমায় ছাড়ছি না দিদি। তোমায় খাড়া হতেই হবে। যেতেই হবে আমার সাথে বুড়ো শিবের কাছে। কথা দিয়েছিল পিসি। যাবে আমার সাথে। সত্যিই সেই খাড়া হয়ে উঠল। দোতলা থেকে আজকাল একাএকাই নেমে আসে। হাল্কা একটু হাত ধরলেই পেরিয়ে যায় উঠোন। অথচ আমিই যেতে পারলাম না। ভিডিও কলে হাসে পিসি ঝলমলিয়ে। আমরা তিন ভাইবোন ফোনের এপার ওপার চিৎকার করে উঠি, আসছে বছর আবার হবে। মরুক ব্যাটা করোনা। মরুক। নির্বংশ হোক করোনার গুষ্টি।

ভিজে সাবু চটকে আজ সেরেছি প্রাতরাশঃ। নারকেল কোথা পাব, শুধু কলা আর চিনিই ভরসা। বাতাসা গুলো চকলেট মনে করে  আগেই খেয়ে নিয়েছি আমরা মা-মেয়ে। দুপুরে সোনামুগ ডাল দিয়ে সাবুর খিচুড়ি। ভুরভুরে ঘি গন্ধী। আধখানা ফুলকপি আর গুটি কয়েক বিন ফ্রীজের কোণে পড়ে শুকোচ্ছিল, এই মওকায় সদ্ব্যবহার হয়ে গেল। রাতে পরোটা খাবার আব্দার করছে, বাপ-মেয়ে। আমার ব্রততিরেস  হলে এদের খুব আনন্দ হয়, দেখি-

টিভিতে কি যেন দেখছে তুত্তুরী। এক ভুষো কালি মাখা বাক্ষুসী চোখ গোল গোল করে, এক রূপসী নেকু রাজকন্যাকে কি যেন বলছে। একা দেখতে ভয় পায়। তাই আমাকে বসিয়ে রেখেছ তুত্তুরী। শ্বেতকপোত সাবানের বিজ্ঞাপন দেখাচ্ছে, নব্বইয়ের দশকের শুরুতে যার দাম ছিল তিরিশ টাকা। সেই বাজারে আগুনছোঁয়া দাম। আমার এক তুতো ভাই, আব্দার করে কিনিয়েছিল কাকুকে দিয়ে। শুধুমাত্র বিয়ে বাড়ি পড়লেই, মুখে মাখার অনুমতি ছিল। বিজ্ঞাপনে ঘোষণা হচ্ছে, ১০টাকা- ২০টাকাতেও পাওয়া যাচ্ছে এখন। দ্রব্যমূল্যবৃদ্ধির বিরুদ্ধে রীতিমত প্রচারের মুখ হতে পারে এই সাবান।
বিজ্ঞাপনের সুন্দরী লাজুক হেসে বলছে, শ্বেত কপোতের আদরে গাল এত কোমল, এত মোলেম হয়েছে, বর নাকি রীতিমতো মোহিত। গালের নাম দিয়েছে রসগোল্লা। কাদের বরেরা এসব বলে ভাই? 

এই বুড়ো বয়সে রাক্ষুসী আর রাজকন্যা ন্যাকামি দেখতে দেখতে রীতিমত কান্না পাচ্ছে মাইরি- বাসি কাগজটায় চোখ বুলাচ্ছিলাম। বাচ্ছারা নাকি আজকাল খুব রেগে যাচ্ছে। জনৈকা বিশেষজ্ঞ মতামত দিয়েছেন দেখলাম, বাচ্ছাগুলো "ফ্রি টাইম" পেলেও, "মি টাইম" পাচ্ছে না। বাবামায়েদের নজরদারিতে অতিষ্ঠ হয়ে উঠছে-। কোন বাচ্ছা ভাই এরা? কাদের বাচ্ছা? তুত্তুরী কিছুটা মি টাইম কাটালে আমি আর শৌভিক তো বেঁচে যাই। যাকেই ফোন করি একই কথা শুনি, সেদিন অন্তরা বলল, “কি ভালো বল পিটতে শিখে গেলাম ভাই। রান্নাবান্না, ঝাড়পোঁচ, বাসনমাজার পর, আজকাল ছেলের সাথে বল পিটতে হয় কি না?” এক দাদা, গতকালই বলল,“এদের কবে স্কুল খুলবে বলতো? গৃহবন্দী হয়ে গৃহের কাজ মন্দ লাগছে না। তবে এই মেয়েটা বড় জ্বালাচ্ছে। উফ্ খালি খাইখাই। পনেরো মিনিট ছাড়া ছাড়া এসে বলছে, ‘খিদে পেয়েছে বাবা। আমি কি খাব?’” সত্যিই বাবা, স্কুল কবে খুলবে? “আমার সময় কাটছে না। আমি কি করব?” এই প্রশ্নের জবাব দিতে দিতে ক্লান্ত হয়ে পড়েছি শৌভিক আর আমি। রীতিমত  তুত্তুরী রেশনিং চলছে বাড়িতে, সকালে শৌভিক ছানা সামলেছে, এবেলা আমার পালা। অগত্যা রাজকন্যা আর রাক্ষুসীই ভরসা- অন্তত ভয় পেলেও মুখটা তো বন্ধ আছে 🙏🏼😒।

Saturday 11 April 2020

অনির ডাইরি, ১১ই এপ্রিল,২০১৮


এলেখা তাঁদের জন্য নয়,যাঁরা প্রতিনিয়ত আলস্য ভরে পোস্ট দেন, “আমি নারীবাদী নই। আমি সাম্য বাদী। ওসব নারীবাদ হল আসলে ‘নারী বদ’। বদ মেয়েদের স্বেচ্ছাচারিতা। ” এলেখা বাকি আণুবীক্ষণিক পাঠকের জন্য। নিয়ম করে কন্যাভ্রুণ হত্যার খবর যাদের কপালে ভাঁজ ফেলে, পার্কস্ট্রীট থেকে দিল্লী হয়ে, বারাসাত থেকে বদায়ুঁন হয়ে কামদুনী ঘুরে যারা উন্নাও এর অন্ধকারে হারিয়ে যান,গলা ফাটিয়ে চিৎকার করতে ইচ্ছা করে,অথচ কি বলবেন বুঝতে পারেন না।  এ লেখা শুধুই তাদের জন্য। 
 দুহাজারের প্রথম দশকের প্রথমার্ধ, কেবল্ টিভির সদ্য অনুপ্রবেশ ঘটেছে আমাদের তিনজনের সাতরঙা সংসারে। কেবল্ মানেই সারাদিন খবর, কেবল্ মানে পৃথিবীর সবখেলার লাইভ ফিড, কেবল্ মানেই সোনি, Zee, স্টারপ্লাস, সর্বোপরি কেবল্ মানে এইচবিও। ছুতোনাতা পেলেই, ঘর অন্ধকার করে টিভি খুলে বসে যাওয়া। কত সিনেমা যে মাঝখান থেকে দেখেছি তার ইয়ত্তা নেই।

এইচবিওতেই তাদের সঙ্গে পরিচয়, মিনার্ভা, প্যাট্রিয়া, ডিডি এবং মারিয়া মিরাব্যাল। চার বোন। ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জের এক পুঁচকে দেশ ডোমিনিকান রিপাবলিকের বাসিন্দা। শহরতলী নয় আদতে গ্রাম “ওহো ডি আগুয়া”,সেখানেই মিরাব্যালদের বিশাল খামারবাড়ি। প্রজাপতির মত উড়ে উড়ে কেটেছে তাদের শৈশব। কৈশোরের দরজায় কড়া নাড়তে না নাড়তেই নিস্তরঙ্গ খামারে ঝড় তুলল মিনার্ভা। বড়ই কটু তথা স্পষ্টভাষীনি সে, মেয়ে বলে কি লেখাপড়া শিখব না নাকি? বাবার বড় আদরের মির্নার্ভা বড় জেদী, গোঁ ধরে বসে রইল, অবশেষে রাজি হয়ে গেলেন প্রৌঢ় এনরিক। মিনার্ভা, ডিডি আর মারিয়া পাঁচ বছরের জন্য ভর্তি হল দামী আবাসিক স্কুলে।ভুঁইফোঁড় নাটুকে মিনার্ভা সেখানেও সর্দারনী, সেবার স্কুলের বার্ষিক অনুষ্ঠানে সম্মানীয় অথিতি, মাননীয় রাফায়েল ট্রুহিজো। ১৯৩০ এর দশক থেকে ৬০ এর দশক পর্যন্ত ডোমিনিকান রিপাবলিকে একচ্ছত্র একনায়ক। তৎকালীন চার্চ থেকে ইন্টেলিজেন্সিয়া, ভূস্বামী থেকে গণমাধ্যম -সমস্তই ছিল ওণার পোষা সারমেয়তুল্য। ট্রুহিজোর দীর্ঘ শাসনের একটাই মন্ত্র ছিল,বিরোধীশূণ্যতা। প্রতিবাদী কণ্ঠ শুধু চেপে দেওয়া নয়, ঘ্যাচাং ফু।
তো এ হেন ট্রুহিজোর বড়ই মনে ধরল নাটুকে স্পষ্টভাষী ন্যাকামি বিবর্জিত মিনার্ভাকে। মিনার্ভার ডার্ক চকলেট রঙা ত্বক, উস্কোখুস্কো একরাশ চুল, ঋজু মেরুদণ্ড বড়ই চিত্তাকর্ষক। মিনার্ভার মনে তখন অন্য স্বপ্ন। স্কুল থেকে বেরিয়ে মোটেই সু-কন্যার মত বিয়ের পিঁড়িতে বসতে আগ্রহী নয় মিনার্ভা। তার স্বপ্ন ওকালতি। আইন পড়তে চায় মিনার্ভা। কিন্তু দেশের আইনে মেয়েদের আইন পড়া নিষেধ। অনুমতি দিতে পারেন কেবল ট্রুহিজো। মিরাব্যাল পরিবারকে চমকে দিয়ে আচমকা একদিন এক নিমন্ত্রণ পত্র এসে হাজির। নিমন্ত্রণকর্তা ট্রুহিজো স্বয়ং। এনরিক মিরাব্যাল কাঁপতে কাঁপতে স্ত্রী এবং চার কন্যা সহ পৌঁছলেন ট্রুহিজোর প্রাসাদে। বিশাল বল রুম, অসংখ্য নৃত্যরত জুটি,মিনার্ভার সাথে নাচতে নামলেন বৃদ্ধ ট্রুহিজো স্বয়ং। নাচতে নাচতে ফিসফিস করে নিজের মনের ইচ্ছা ট্রুহিজোকে জানিয়ে আইন পড়ার অনুমতি চাইল মিনার্ভা। জবাব এল “না। ” শুধু তাই নয়, সামান্য অসভ্যতাও করে ফেললেন সর্বশক্তিধর ট্রুহিজো। ফলাফল কল্পনারও অতীত, এইটুকু চাষীর মেয়ে মিনার্ভা সাঁটিয়ে কষাল এক চড়। অতঃপর? যাকে বলে “পিনড্রপ সাইলেন্স”। মিরাব্যাল পরিবার দৌড়ে এল মিনার্ভার পাশে। যাইহোক মিটিয়ে নিলেন ট্রুহিজো, কোথাও ভুল বোঝাবুঝি হয়েছে। নিরাপদে বাঘের ডেরা থেকে বেরিয়ে এল মিরাব্যালেরা।
বাড়ি ফিরে মিনার্ভার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল তার মা। আহাঃ অত বড়া আদমি, নাহয় একটু ইয়ে করেছে, তাই বলে প্রকাশ্যে গায়ে চড়? দেখো এর পরিণাম কি দাঁড়ায়?(চেনা চেনা লাগছে কি?)
পরের দিনই এনরিক মিরাব্যালকে তুলে নিয়ে গেল ট্রুহিজোর পুলিশ। চার বোন আর বৃদ্ধা মা দৌড়ে বেড়ায় এই জেল থেকে সেই থানা, কেউ জানে না বৃদ্ধ কোথায়। খাতায় কলমে তাকে কেউ গ্রেপ্তার করেনি! ট্রুহিজোর প্রাসাদে আবার গিয়ে হাজির মিনার্ভা। বাবাকে ফিরিয়ে দিন। ক্রুর হেসে ট্রুহিজো বলল, দিতেই পারি, বদলে থেকে যাও আমার যৌনদাসী হিসাবে। শিকারকে জালে আটকে নির্মল হেসে ট্রুহিজো বললেন,“এসো পাশা খেলি। আমি জিতলে তো জানোই-আর তুমি জিতলে? তোমায় আমি নিরাপদে যেতে দেব। মুক্তি পাবে তোমার বাবা। চলো তোমাকে আইন পড়ার অনুমতিও দেব। ” হল খেলা। বিজয়ী মিনার্ভা। বাবাকে নিয়ে বাড়ি ফেরার আনন্দ তেরাত্রি পোহালো না। অকথ্য অত্যাচারে ভেঙে দেওয়া হয়েছিল এনরিকের শরীর এবং মন। শেষ নিশ্বাসটুকু শুধু আটকে রেখেছিলেন প্রিয়জনেদের সান্নিধ্যের আর্ত প্রতীক্ষায়।
পিতাকে কবর দেবার মাঝেই পুলিশের হাতে আইন পড়ার অনুমতি পাঠালো ট্রুহিজো। অন্য নারী হলে হয়তো এত বড় অপমানে ভেঙে পড়ত। মিনার্ভা অন্য ধাতুতে তৈরি। ট্রুহিজোর প্রতি তীব্র ঘৃণার আগুনে বাতাস দিয়ে  ল স্কুলে ভর্তি হল মিনার্ভা। অচীরেই ট্রুহিজো বিরোধী প্রতিবাদী রাজনীতির মুখ হয়ে দাঁড়াল মিনার্ভা মিরাব্যাল। যাকে স্থানীয় ভাষায় অনুগামী তথা অনুরাগীরা বলত, ম্যারিপোযা। স্প্যানিশ ভাষায় প্রজাপতি।
এই ডোমিনিকান প্রজাপতিকে শেষ পর্যন্ত যদিও ডিগ্রীটা দেয়নি ট্রুহিজো, অন্তিম অধিবেশনে,সর্বসমক্ষে মিনার্ভার ডিগ্রীটা ছিঁড়ে ফেলে দেন তিনি,মেয়েমানুষ বলে কথা, পড়ার অনুমতি দিয়েছি,ডিগ্রী দেবার তো কথা ছিল না।
এরপর শুরু হয়,ট্রুহিজো বনাম প্রজাপতিদের দীর্ঘ অসম লড়াই। একদল সশস্ত্র তথা ধনী অন্যদল নির্ধন তথা নির্বল। এরই মাঝে বিয়ে হয় প্রজাপতিদের, সমমার্গের বিদ্রোহীদেরই বিবাহ করে মিরাব্যাল বোনেরা। সন্তানসন্ততি হয়। সাথে সাথে পাল্লা দিয়ে চলতে থাকে পালা করে জেলে যাওয়া। তুচ্ছাতিতুচ্ছ কারণে জেলে ঢোকানো হয় মিনার্ভা, তার বোন এবং তাদের স্বামীদের। মিনার্ভার চরিত্রে মাতাল করা অভিনয় করেছিলেন সালমা হায়েক।

 একটা দৃশ্যের কথা মনে পড়ে,জেলে আছে মিনার্ভা, স্বামী তথা সদ্যোজাত সন্তানকে ছেড়ে থাকার বেদনায় দ্রবীভূত। মিনার্ভার সেই মানসিক শক্তি আজ শুধু গল্পকথা। ছোট ছোট করে কাটা চুলে উকুনের বাস,নোংরা আলখাল্লার ওপর দিয়ে থেকে ঘসঘস্ করে গা চুলকাচ্ছে মিনার্ভা, শারীরিক মানসিক অত্যাচারে মানসিক রোগীতে পরিণত হতে আর বেশী দেরী নেই, এমন সময়, সেলের ঘুপচি জানলা দিয়ে বাইরে আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখেন, দূরে কে যেন কচি হাতে কাগজ জুড়ে বানিয়েছে এক কাঁচা প্রজাপতি, পতপত করে পাখা মেলে উড়ছে নীল আকাশে। ফিরে এস ম্যারিপোযা, ফিরে এস প্রজাপতি।

এর বেশ কিছু বছর বাদে হঠাৎই একদিন মিনার্ভার বাড়ি উপস্থিত হলেন ট্রুহিজো। কেমন আছো মিনার্ভা? নাকি প্রজাপতি বলে ডাকব তোমায়? সেই মুহূর্তে মিনার্ভার পাগল পাগল দশা। দীর্ঘদিন ধরে বর,একবোন এবং ভগ্নীপতিদের খোঁজ নেই। লড়াই করার শক্তি নিঃশেষিত। মিনার্ভা অনুরোধ করল, ওদের ছেড়ে দিন। ট্রুহিজো একগাল হেসে বলল, অবশ্যই, এবার তোমার সব দুখের রাতি পোহালো।তোমায় মুক্তি দিলাম যাও।
তিন মিরাব্যাল বোনকে অনুমতি দেওয়া হল, জেলে গিয়ে নিজেদের বর এবং বন্দিনী ছোট বোনের সাথে সাক্ষাৎ করার। সাক্ষাৎ করে হৃষ্ট চিত্তে বাড়ি ফিরছিল তিনবোন,আচমকা রাস্তার ওপর ঘিরে ধরল একপাল লোক। টেনে হিঁচড়ে নিয়ে গেল জঙ্গলে- তারপর? পিটিয়ে পিটিয়ে মেরে ফেলল তিন তিনটে প্রজাপতিকে। দিনটি ছিল ২৫শে মে ১৯৬০।
শোনা যায় প্রজাপতিদের মৃত্যুর পর বেশীদিন বাঁচেনি ট্রুহিজোর একনায়কত্ব। দেশের মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত বিপ্লবের কাছে পরাস্ত হয় ট্রুহিজো। মিনার্ভার মৃত্যুর সাত মাসের মাথায় উন্মত্ত জনতা ঘিরে ধরে কুকুরের মত গুলি করে মারে ট্রুহিজোকে।
২৫শে নভেম্বর যেদিন পিটিয়ে মারা হয়েছিল তিন বিদ্রোহী “নারী বদ”কে,সেই দিনটিকে রাষ্ট্রসংঘ পালন করে, “ডে ফর এলিমিনেশন অব ভায়োলেন্স এগেন্স্ট উইমেন”। উন্নাও এর সাথে তো ডোমিনিকান রিপাবলিকের তো কোন মিল নেই,তবু কাগজ খুললেই কেন বারবার প্রজাপতিদের কথা মনে পড়ছে বলুন তো? কেন মন চাইছে, আর একটি বার,  ফিরে আসুন ম্যারিপোযা

Friday 10 April 2020

✍শ্রী শরৎচন্দ্র দাশের, “জার্নি টু লাসা,ডাইরি অব আ স্পাই” বইটি থেকে কিঞ্চিৎ বঙ্গানুবাদ।

“আজ, ৭ই নভেম্বর, ১৮৮১। দার্জিলিং এর মাথার ওপর জাজ্বল্যমান পূর্ণচন্দ্রের সুষমায় আচ্ছন্ন চরাচর। বুকের ভিতর এক অদ্ভুত দোটানা নিয়ে রওনা দিলাম নিজের জন্মভূমি ছেড়ে। কি হবে? ফিরে আসতে পারব তো স্বদেশে? ইতিউতি ঘুরে বেড়ানো দু চারটে কালো মেঘের পুঞ্জ, অকালবর্ষণের সঙ্কেতবাহী। বারবার চোখ ঘুরে যাচ্ছে, দূরে পূবের পর্বতমালার দিকে। এখানে বর্ষণ মানে, ওখানে তুষারপাত। একদিকে বরফ চাপা পড়ে মরার ভয়, আর অপরদিকে অজানা অচেনা প্রকৃতিকে জয় করার চ্যালেঞ্জ-

নীরবে চলেছি আমি, সকলের নজর এড়িয়ে। উল্টো দিক আসা দু চারজন ভুটিয়া ছাড়া জনশূণ্য পথ। নিস্তব্ধ রাতের বুক চিরে, বহুদূর থেকে ভেসে আসছে কুলিকামিনদের গান, মাদল আর বাঁশির সুর।
নদীর ধারে, লামা উগেন গ্যাৎসো আমার জন্য প্রতীক্ষা করছিলেন। এই সময়, নদী বেশ চওড়া। নদীর বুকের ওপর আলগা ভাবে ফেলে রাখা গোটা চারেক বাঁশই হল সেতু। আমার ভুটিয়া কুলি ফুরচুং বেশ বুদ্ধিমান, ও যদি সাহায্য না করত, এই পিচ্ছিল সেতু এত সহজে পেরোতে পারতাম না।
গোক গ্রামে পৌঁছলাম রাত দেড়টা নাগাদ। অন্য সময় গমগম করে এই গাঁ, বড় হাট বসে, কত দোকানপাট। একটা বৌদ্ধ স্তুপও আছে। দার্জিলিং থেকে ব্যবসায়ীরা আসে ভুট্টা আর ছোট এলাচ কিনতে। আপাততঃ জনমানবশূন্য। কেবল ফাঁকা খাটালে শুয়ে নাক ডাকাচ্ছে এক নেপালী। ঐ খাটালের মেঝেতেই কম্বল বিছিয়ে শুয়ে পড়লাম আমরা। একটু জিরিয়ে নেওয়া আবশ্যক। কাল আবার কাকডাকা ভোরে শুরু হবে আমাদের যাত্রা।
শোয়াই সার, ঘুম আর এলো না। মাটি বড় অসমান এখানে। বড় এবড়োখেবড়ো। পাতলা কম্বল ভেদ করে ফুটতে লাগল শুকনো ঘাস আর আগাছা। গায়ের ওপর দিয়ে হেঁটে চলে বেড়াতে লাগল একপাল পোকামাকড়, সর্বোপরি আচমকা বৃষ্টি এসে একেবারে কাকভেজা করে দিয়ে গেল।

ভোর চারটেতে আবার শুরু পথচলা। পায়েচলা সরু পথ, মেরেকেটে একফুট চওড়া হবে হয়তো। বড় বড় ঘাস আর আগাছায় ঢাকা।সদ্য বৃষ্টিতে পিচ্ছিল।  লণ্ঠন হাতে আমি ফুরচুং কে অনুসরণ করে চললাম। ফুরচুংএর পিঠে ভারী মোট, মোটের সাথে শক্ত করে বাঁধা আমার শটগান। হড়কাতে-হড়কাতে,সামলাতে-সামলাতে আমরা যখন রাম্মামে এসে পৌঁছলাম, সদ্য উদয় হচ্ছেন দিনমণি।

৮ই নভেম্বর-রাম্মাম হল রঙ্গীতের অন্যতম প্রধান উপনদী। সিংলী পর্বতমালা থেকে উৎপন্ন এই নদী রচনা করেছে বৃটিশ ভারত আর স্বাধীন সিকিমের সীমানা। এই সময় রীতিমত খরস্রোতা এই নদী। পারাপারের জন্য ছোট একটি বাঁশের সেতু ভরসা। ব্রীজের কাছাকাছি উল্টো দিক থেকে আসা একটা বড় দলের প্রায় মুখোমুখি পড়ে যাচ্ছিলাম আমরা। অন্তত জনা কুড়ি তো হবেই। দার্জিলিং বাজারে কমলালেবু বিক্রি করতে যাচ্ছিল।  কোন মতে ওদের দৃষ্টি এড়াই আমরা।

এদিকে প্রচুর শাল গাছ চোখে পড়ে। পাহাড়ের মাথায় ছোটএলাচ আর তুলো গাছে ফসল পেকেছে। বাঁদর আর ভাল্লুকের হাত থেকে ফসল বাঁচানোর জন্য, উঁচু করে বাঁধা বাঁশের মাচায় বসে আছে সদা সতর্ক প্রহরীর দল। শুনলাম এখানে এক ধরণের বীর হনুমানের বড় উৎপাত। সাধারণ বাঁদর বা হনুমানের থেকে আয়তনে বেশ বড়, ফসলের দুশমন। চাষীরা এদের যমের মত ভয় পায়। একলা মহিলা দেখলেই আক্রমণ করে এরা। এদের হাত থেকে নিষ্কৃতি পেতে করমচা (ডগস্ বেন) এবং অন্যান্য বিষাক্ত গাছের শিকড় ভাত বা অন্য খাবারের সাথে মিশিয়ে ছড়িয়ে রাখে লেপচারা।
রাম্মামের তীরে প্রাতরাশ সেরে, ভারতীয় পোশাক পাল্টে পরে নিলাম তিব্বতী পরিধান। মিতশাং রোডকে ডানদিকে রেখে, শুরু হল চড়াই ভাঙা। এদিকে প্রচুর কৃষ্ণসার হরিণ (অ্যান্টিলোপ) আর জংলী ছাগল দেখতে পাওয়া যায়। গ্রামবাসীরা টুকটাক শিকার করে বটে, তবে বড় দরিদ্র এরা। মেরে কেটে এক ডজন বন্দুক হয়তো খুঁজে পাওয়া যাবে। এদিকে নেপালীই বেশী। কয়েকঘর ব্রাহ্মণ আর ছেত্রীও দেখলাম। মূলতঃ দুধ আর মাখন বিক্রি করাই এদের পেশা। বেশ কয়েক জায়গায় দেখলাম পাহাড়ের ঢালে ধাপী কেটে ধান চাষ করা হয়েছে। লাঙল টানছে বলদে। ভুটিয়ারা ধাপ চাষ করে না।ওরা লাঙলও ব্যবহার করে না। মান্ধাতার আমলের কিছু যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে বটে, ফলে ফসল মোটেই ভালো হয় না। লিম্বুরা আবার পর পর তিনবছর চাষ করে, তারপর তিনবছর আবাদ না করে ফেলে রাখে জমি। তারপর আবার আগাছা উপড়ে, শুরু করে চাষবাষ- ।
অনেকটা চড়াই একটানা ভেঙে অবশেষে যেখানে পৌঁছলাম, সেখান থেকে দূরে ধূরমদিয়েং উপত্যকা পটে আঁকা ছবির মত দেখতে পাওয়া যায়। এখানে অনেক গুলি ছোট বৌদ্ধ স্তুপ আছে, পাহাড়িয়ারা এটাকে বলে মনি-দারা। আর ভুটিয়ারা বলে চোটেং-গ্যাং। যেনামেই ডাকা হোক না কেন, অর্থ একই, “পবিত্র স্তুপের পাহাড়”।
স্থানীয় লিম্বুদের থেকে দু বোতল মুরুয়া( বীয়র) আর কিছু আনাজপাতি কেনা হল, এই পবিত্র পাহাড়ে, এক ছোট্ট ঝোরার ধারে আজ রাত্রিবাস করব আমরা।”

✍শ্রী শরৎচন্দ্র দাশের, “জার্নি টু লাসা,ডাইরি অব আ স্পাই” বইটি থেকে কিঞ্চিৎ  বঙ্গানুবাদ।

৯ই নভেম্বর, ১৮৮১- পাহাড় থেকে নেমে, এই মুহূর্তে আমরা যে উপত্যকার উপর দিয়ে চলেছি, তা তুলনামূলকভাবে বেশ ঘনবসতিপূর্ণ। তাপমাত্রাও বেশ বেশী। আমরা হেঁটে চলেছি লিম্বু বসতির ভিতর দিয়ে। বিগত দুইদিনে যে উচ্চাবচ পেরিয়ে এসেছি, সে তুলনায় পথ সুগম। লিম্বুদের বাড়ির সামনে ভেড়া অথবা শুয়োরের খোঁয়াড় থাকে।  ছাগল আর গরুও বাঁধা আছে দেখলাম।
ধনী দরিদ্র নির্বিশেষে সমস্ত লিম্বু বাড়িতে অন্তত তিন থেকে চারটি ঢোল থাকবেই। সমস্ত পরবে, উৎসবে ওরা ঢোল বাজায়। এমনকি গৃহকর্তা যখন কোন কাজে বেরোয়, তার স্ত্রী আর সন্তানরা তার জন্য সম্মিলিত ভাবে ঢোল বাজায়, আবার বউবাচ্ছারা যখন বেরোয়, তখন গৃহকর্তা বসে ঢোল বাজাতে । 

১০ই নভেম্বর, ১৮৮১- আজ সকাল থেকেই আকাশের মুখ ভার। ঘন কুয়াশায় আচ্ছন্ন চরাচর। আমরা রওনা দিলাম। এক ছোট্ট ঝোরার ধার দিয়ে এঁকে বেঁকে চলেছি আমরা। চতুর্দিকে উঁচু উঁচু পাইন আর রাক্ষুসে ফার্নের জঙ্গল। জঙ্গল আরো ঘন হয়ে উঠল, পাহাড়ের ওপর থেকে মাঝে মাঝেই ঝাঁপিয়ে নামছে খলবলে জলরাশি। বয়ে যাচ্ছে নদীর মত।  নদীর ধারে ধারে বেত ধরণের গাছের ঘন ঝোপ। জঙ্গল এখানে এতটাই ঘন হয়ে উঠেছে যে, সুউচ্চ ফাইন, ওক আর ম্যাগনোলিয়া গাছের মাথা ডিঙিয়ে দেখা যায় না আকাশ।
অনেকগুলো ছোট ঝোরা পেরিয়ে, বেলা একটা নাগাদ আমরা হি লা পাহাড় চূড়ায় উঠলাম। একটা ফাঁকা খাটাল দেখে বিশ্রাম নিতে ভীষণ ইচ্ছে করছিল, কিন্তু বড় জোঁকের উপদ্রব। শয়ে শয়ে জোঁক ঘুরে বেড়াচ্ছে এদিক ওদিক। রীতিমত আতঙ্কিত হয়ে, যত তাড়াতাড়ি পারলাম , পাতাতাড়ি গুটোলাম।
উৎরাই পথে নামতে নামতে বেলা চারটের সময় আমরা যেখানে পৌঁছালাম, বেঁটে বেঁটে বাঁশের জঙ্গল। মাঝে মাঝেই বাঁশঝাড়ের মাথায় লাল কাপড় বাঁধা। ফুরচুং প্রতিটা লাল কাপড়ের কাছে দাঁড়িয়ে বিড়বিড় প্রার্থনা(লা সল) করতে করতে নামছিল। সন্ধ্যে নামছে, জঙ্গলের মধ্যে এক বুড়ো ওক গাছের তলায় মোটামুটি সাফ করে আজকের মত রাত্রিযাপন করার সিদ্ধান্ত নিলাম আমরা। চতুর্দিকে বিছুটি জাতীয় বড় বড় লতার জঙ্গল। মহীরুহগুলিকে জড়িয়ে উঠে গেছে। প্রায় একশ ফুট লম্বা লতাও দেখতে পেলাম। পাতি বিছুটি গাছও ছিল। বিছুটি গাছের কচি পাতা দিয়ে দারুণ স্যুপ বানায় কুলিরা । বেশ ভালো খেতে।

১১ই নভেম্বর, ১৮৮১- আজও আকাশের মুখ ভার। কুয়াশা। উপর্যুপরি রোদ আর বৃষ্টির লুকোচুরি। ভুটিয়ারা একে বলে, “মেটগ চারপা” বা পুষ্পবৃষ্টি। আমরা হি গাঁয়ে পৌছলাম। সিংলি পাহাড় থেকে উৎপন্ন কালাই নদী প্রায় কুড়ি মাইল পথ পরিক্রমা করে, তাশিডিং পাহাড়ের পাদদেশে রঙ্গীতের সাথে মিশেছে। কালাই নদীর দুই ধারে, পাহাড়ের ঢালে গড়ে উঠেছে অনেকগুলি ঘনবসতিপূর্ণ গ্রাম। অনেকটা বক্ষপিঞ্জরের মত। কালাই নদী যদি মেরুদণ্ড হয়, গাঁ গুলো পাঁজরা।

হি ও এমনি একটি গ্রাম। এই গাঁয়ে কয়েকঘর ভুটিয়া, লেপচা আর লিম্বুদের বাস। লিম্বুরা এদের মধ্যে অপেক্ষাকৃত সচ্ছল। চাষবাসই এদের মূল জীবিকা। এরা মোষ দিয়ে লাঙল টানায়। লিম্বুদের সম্পর্কে আরও অনেক কথা জানলাম। যেমন, লিম্বুদের সমাজে পাঁচ ধরনের পুরোহিত দেখা যায়। প্রথম শ্রেণীকে বলে “ফেডংবা”, এরা মামুলী পুরুত। পুজো আচ্ছা নিয়েই থাকে। টুকটাক হাত দেখা, ভবিষ্যৎবাণী করা অবধি এদের দৌড়। দ্বিতীয় শ্রেণীকে এরা বলে “বিজুবা”। ওঝা বলতে পারেন। টুকটাক তুকতাক করে। এদের আচারবিধির অন্যতম অঙ্গ হল নাচ। রীতিমত দর্শনীয়, সে নাচ ।
তৃতীয় শ্রেণী হল, “দামী”। এরা অশুভ আত্মা তাড়ায়। যাদুবিদ্যা বা ডাকিনীবিদ্যার সাহায্যে ভূত তাড়ায়। লিম্বুরা মনে করে, দামীর প্রভাবে,ঘাড় থেকে নেমে প্রেতাত্মা বেরিয়ে আসে মানুষের মুখ দিয়ে।
চতুর্থ শ্রেণীকে বলে “বইদাং”। এরা বৈদ্য। সম্ভবতঃ বইদাং নামটাও সংস্কৃত বৈদ্য শব্দের অপভ্রংশ।  পঞ্চম তথা অন্তিম শ্রেণীটি হল, “শ্রীজাংগা”। এরা পুরোহিত শ্রেষ্ঠ। ধর্মশাস্ত্র অধ্যয়ন তথা ব্যাখ্যা করার অধিকার শুধু এদেরই আছে। যাঁর থেকে আমি লিম্বুদের সম্পর্কে এত তথ্য জানতে পেরেছিলাম তিনিও শ্রীজাংগা। শুধু তাই নয়, তিনি বাকি পুরোহিতদের বিদ্যাতেও সমপারদর্শী। বলাইবাহুল্য লিম্বুদের মধ্যে তিনি অত্যন্ত শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি।
কালাই নদীর অববাহিকাকে নীচে ফেলে আমরা আরও ওপরে উঠতে শুরু করলাম। বড় বড় ঘাস আর কাশফুলের মত গাছের ঘন ঝোপে ভর্তি পথ। এদিকে বড় জংলী শুয়োর আর শজারুর উৎপাত। বিশেষতঃ শজারু নিয়ে স্থানীয় অধিবাসীরা রীতিমত আতঙ্কে ভোগে। সামান্য ডালকলাই, মূলো আর রাঙালু চাষ করে এরা।তাতেই চলে সম্বৎসর। তাও বরবাদ করে দেয় শজারু।
দিনের শেষে কালাই নদী থেকে প্রায় ৩০০০ফুট উপরে উঠে এলাম আমরা। বহু নীচে এঁকেবেকে বয়ে যাওয়া কালাইয়আর রাটাং নদী আর তার দুধারে ঢালে গড়ে ওঠা ছোট ছোট গ্রামগুলি যেন পটে আঁকা ছবি। আমাদের ডানদিকে লিংচ্যাম গ্রাম। কমলালেবুর বাগান। মুরুয়ার ক্ষেত। আজ রাতটা এক লিম্বু গৃহে আশ্রয় নেবো আমরা। কুলিরা আসার পথে, পাহাড়ের ফাঁক ফোকর থেকে প্রচুর বুনো পেঁয়াজ (লাগগ) তুলে এনেছে। তরকারি বানাবে।  লাগগের গন্ধ অনেকটা আমাদের রসুনের মত। যদিও ঝাঁঝ অনেক কম। মাংসেও দেয়। মাংসে দিলে অদ্ভূত একটা গন্ধ হয়। বলে, খেলে নাকি কাশি হয়।
১২ই নভেম্বর- যাত্রা শুরু। আজ আবার চড়াই ভাঙা। সরু পায়ে চলা পথ, পথের ধারে ধারে ভুট্টা ক্ষেত। দু চারটে হতদরিদ্র  লিম্বু কুটির। মাঝে মাঝে দু-এক মহিলাকে দেখলাম জঙ্গল থেকে ঝুড়ি করে জংলী এপ্রিকট তুলে আনতে। এই পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে চ্যাংগাচেলিং মঠে যখন পৌঁছালাম বেলা দুটো বাজছে। খাদের ধারে মসে ঢাকা এক চোর্টেন স্তুপ।
দুদণ্ড জিরিয়ে এগিয়ে চললাম আমরা।  এবার পথ ঘন জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে।  আকাশ ছোঁয়া ওক আর পাইন গাছের জঙ্গল। নীচে দুর্ভেদ্য বিছুটি বা নেটল জাতীয় লতার ঝোপ। ঝোপ কেটে সরিয়ে আমরা এগোতে থাকলাম। প্রায় ঘন্টা দুয়েক পর পৌঁছানো গেল টেল গাঁয়ে। এখানেই আপাততঃ নিশিযাপন করব আমরা। ছোট্ট গ্রাম টেল। বড়জোর গোটা কুড়ি পরিবার বাস করে। গৃহপালিত পশু বলতে ঘোটকী, মোষ, শুয়োর বেশ কিছু গরু চোখে পড়ল। এখানে লবণের বড় অভাব। ইয়ুংপুং  লবণ ব্যবসায়ীরা অক্টোবরের তুষারপাতের পর আসা বন্ধ করে দেয়।এই সময় তাই কোন অভিযাত্রী দল এ পথে এলেই ভিড় জমায় গ্রামবাসীরা। চ্যাং বা দিশি মদের বিনিময়ে লবণ বেচার জন্য পিড়াপিড়ি করে। আমাদেরও ঘিরে ধরল গ্রামবাসীরা। কিন্তু আমরা নিরুপায়। আমাদের রসদ যে অত্যন্ত সীমিত-। প্রয়োজনের বেশী এককণাও অতিরিক্ত আনতে পারিনি আমরা।