Thursday 24 September 2020

অনির ডাইরি,১৪ই সেপ্টেম্বর, ২০২০

 অনির ডাইরি,১৪ই সেপ্টেম্বর, ২০২০


বিমানবন্দরের সীমানা ছাড়িয়ে বেলঘরিয়া এক্সপ্রেসওয়ে ধরে বালি ব্রীজ, একদিনে তিনজনে ঘর ছেড়ে হয়েছি বার- ।  অন্যান্য দিনে অসভ্যের মত ট্রাফিক জ্যাম হয় এই পথে, আজ রবিবার, সদ্য বিগত হয়েছে মধ্যাহ্ন, তাই বোধহয় যানজট কিছুটা ভদ্রোচিত। জানলার বাইরে টলটলে নীলাকাশে ঘন মেঘের ঘনঘটা, কাঁচ নামালেই অল্পস্বল্প জোলো বাতাস । “একপশলা বৃষ্টি হলে মন্দ হয় না” বলল শৌভিক। বিবেকানন্দ সেতুতে উঠে, দক্ষিণেশ্বর মন্দিরের চূড়া লক্ষ্য করে প্রণতি জানাতে না জানাতেই, অাবছায়া জানলার কাঁচ। 

ধূলাগড় টোলে, একপিঠের মূল্য ১০৫টাকা। ফিরব তো এই পথেই, তবুও দুপিঠের টোল কাটে না ওরা। টোল প্লাজার হাল্কা যানজট কাটতেই,ফাঁকা রাজপথ। গাড়ি দৌড়য় একশ কিলোমিটার গতিতে। উল্টোদিকে ছুটে যেতে থাকে, বাউরিয়া, চেঙ্গাইল, ফুলেশ্বর। উলুবেড়িয়ায় সামান্য দেরী হয় জট কাটতে, তারপর আসে বীরশিবপুর, বাগনান। দেউল্টি আসার সাথে সাথেই রাজপথ ছেড়ে বাঁদিকে নেমে যাই আমরা। তারপর ডানদিকে বাঁকলেই, রবিবার দুপুরের মরা বাজার। বাজারের সীমানায় মস্ত সাইনবোর্ড, সামতাবেড় শরৎবাবুর কুঠী ঐ পথেই। 


বাজার থেকে বেশ কিছুটা দূরে, পথের ওপরেই ওণার দ্বিতল কুঠী বাড়ি। চতুর্দিক টালির চাল দেওয়া বারন্দা দিয়ে ঘেরা। নিকানো তকতকে আঞিনা। আঙিনা ঘিরে যতনচর্চিত বাগিচা। আছে ওণার স্বহস্তে রোপিত পেয়ারা গাছ, ঝড়ে উপড়ে গেছে গোড়া, সংরক্ষিত শুধু শুষ্ক কাণ্ডখানি। ১৯২৬থেকে ১৯৩৮, দীর্ঘ একযুগ কাটিয়েছেন এই গৃহে। তখন নাকি সীমান্ত পাঁচিল স্পর্শ করে খলবলিয়ে বয়ে যেত রূপনারায়ণ নদ। এখন সরে গেছে বেশ কিছুটা দূরে।   তিনি তখন হাওড়া জেলা কংগ্রেসের বড় নেতা। কত তাবড় তাবড় বিপ্লবীর পদধূলিধন্য এই গৃহ। রাতের বেলা এসে মিটিং করে গেছেন খোদ নেতাজী। সবুজ শিকলাগানো দরজায় ঝুলছে তালা, সাড়ে তিনটের আগে খুলবে না। দরজার উল্টোদিকেই এক শান বাঁধানো পুকুর। এই পুকুরেই কার্তিক-গণেশের বাস ছিল বলে জনশ্রুতি। 

ঘড়িতে সোয়া তিন, এরই মধ্যে ভিড় জমেছে ভালোই। অনেক মানুষ আসে দেখতে। লকডাউন তথা করোণার আতঙ্কে জনজোয়ারে কিঞ্চিৎ ভাঁটা পড়লেও মন্দ কিছু নয়। রাস্তায় না দাঁড়িয়ে থেকে সীমান্ত প্রাচীরের গা বরাবর চললেই সামনে শ্যামল ধানক্ষেত, ক্ষেতের ওপারে চিকচিক করছে নদ। ক্ষেতের পাশ দিয়ে নদের ধারে যাবার রাস্তা ঢালাই হয়েছে পঞ্চায়েতের সৌজন্যে। পথের ধারে লাল ক্রোটন আর চায়না টগর গাছের সমারোহ। ফুটে আছে গুড়ি গুড়ি সাদা ফুল। বড় বড় নোটিশ টাঙানো, আবর্জনা ফেলবেন না। ভ্যাট ব্যবহার করুন। পচনশীল আর অপচনশীল আবর্জনার জন্য আলাদা রঙের ভ্যাটও রাখা আছে। তবুও পড়ে আছে শিখর জাতীয় গুটকার প্যাকেট। নদের পাড় বরাবর আছে অনেকগুলি বাঁধানো বসার জায়গা। মোটামুটি পরিচ্ছন্ন। পার বরাবর কাশ ফুটেছে। ওপাড়ে কোলাঘাট থার্মাল থেকে ভুসভুস করে বের হচ্ছে সাদা ধোঁয়া। আয়নার মত নীলাকাশে পেঁজা তুলোর মেঘের দল, মুখ দেখতে নামছে নদের বুকে। গুটি কয়েক আগন্তুকের ক্ষণিক উচ্ছাস ছাড়া এপাড়ে বিরাজমান  অখণ্ড নীরবতা। 

শরৎবাবুর কুঠীতে ঢুকতে কাটতে হয়না কোন টিকিট। যে বয়স্ক কেয়ারটেকার ঘুরিয়ে দেখান, উনি শুধু দাবী করেন, যদি কিছু খুশি হয়ে দিয়ে আসেন। জুতো খুলে উঠতে হয় দাওয়ায়। লাল সিমেন্টের চকচকে মেঝে। বাঁদিকের ঘরে রাখা ওণার আরাম কেদারা। পাশের ঘরে পাতা ফরাশ, রাখা তাকিয়া। ওণার গড়গড়া। লণ্ঠন। বাতিদান আরও কত কি। ঐ লণ্ঠনের অালোয় নাকি কোন এক রাতে রুদ্ধদ্বার কক্ষে মন্ত্রণায় বসেছিলেন কথাশিল্পী আর নেতাজী। কি কথা হয়েছিল, জানে শুধু সময়, আর জানে বোবা লণ্ঠন। ভিতর দিকে আছে শস্যের গোলা। ছিল এক রসুইঘর, যা আটাত্তরের বন্যায় ধূলিসাৎ হয়েছে। শূণ্য ভিত আজও বিদ্যমান। 

কাঠের রেলিং দেওয়া লাল সিমেন্টের সিঁড়ি নিয়ে যায় দোতলা। দোতলায়ও চারদিকে ঘিরে আছে বারন্দা। বারন্দা থেকে রূপার পাতের মত লাগে নদীকে দেখতে। দোতলাতেই ছিল তাঁর শয়নকক্ষ। আছে তাঁর পরিবারের সদস্যদের ছবি। ওণার নাতি জয় বাবু বোধহয় বর্তমান মালিক। বুড়ো কেয়ারটেকার তো তাই শোনাল- 

ওণার কুঠী থেকে অল্পদূরেই আছে সাড়ে  তিনশ বছরের পুরাতন মেল্ল্যকের মদনগোপাল জীউ এর মন্দির। দীর্ঘদিনের অযতনে নষ্ট হতে বসা, আটচালা পোড়া মাটির মন্দিরটি সম্প্রতি সংস্কার করা হয়েছে। সামতাবেড় থেকে গাড়িতে লাগে মিনিট দশ। পদব্রজে আরো একটু  বেশী সময় লাগবে হয়তো, তবে রাস্তাটা পায়েচলার পক্ষেই অধিক সুগম। ইঁটপাতা সরু রাস্তা, রাস্তার একপাশে কোথাও জনবসতি, কোথায় বা শুধুই ঝোপজঙ্গল।  অপরদিকে সবুজ ধানক্ষেত, গোচারণভূমি আর পুকুর। বড়ই মনোরম এই পথ। বাঁধের ধারে গাঁয়ের দুর্গামণ্ডপ, প্রস্তুত দেবীর কাঠামো। তারওপর পড়েছে মাটি। বাঁধের ওপর গাড়ি ছেড়ে বাকিটা পায়ে হেঁটে যেতে হয়। সরু পায়ে চলা পথের ধারে ফলে আছে কয়েৎবেল। ধরেছে বাতাবি লেবু। পুকুরের ধারে চরছে ছাগল ছানা। আর এদের সবাইকে পিছু ফেলে এগিয়ে গেলে হঠাৎ চোখের সামনে ফুটে ওঠে সাড়ে তিনশ বছরের বুড়ো মন্দির। বুড়ো বললাম কি, তার শরীরে এখনও ঢলঢল করছে যৌবন।

ফেরার সময় ঝক্কি অনেক কম। আবার সেই পানা পুকুর, ছাগলছানা, বাতাবি লেবু, তেঁতুল আর কয়েতবেল গাছের তলা দিয়ে এসে উঠতে হয় বটে বাঁধে। এখান থেকে একটা সরু রাস্তা সোজা এসে ওঠে বম্বে রোডে। শুধু যদি মন্দির দেখতে চান, ওই রাস্তা ধরে যাওয়াই বোধহয় সহজ হবে। তবে মনে রাখবেন, ওখানে নেট থাকে না, জিপিএস কোন কাজে আসে না। স্থানীয় মানুষই ভরসা।

                  শরৎবাবুর কুঠী

লাল প্রাকারের এপার থেকে - বার্মিজ স্টাইলে লেখক শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এর কুঠি

বন্ধ খিড়কি দুয়ার থেকে শ্রী শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এর কুঠি

বারান্দা থেকে দূরে রূপনারায়ণ নদ

এই পুকুরেই বাস ছিল কার্তিক আর গনেশ চন্দ্রের, সৌজন্য রামের সুমতি

নিঃসঙ্গ রূপনারায়ণ নদ, দেউল্টি

মদনগোপাল জীউ এর মন্দির মেল্ল্যক

©Anindita&ShouvikBhattacharya


তুত্তুরী উবাচ


তুত্তুরী উবাচ ১৮ই নভেম্বর, ২০২০


 👩🏻- একি রে! তোর হাতে এত মৌরি লাগল কি করে?

👧🏻- ঐ হাতটা ধুয়ে এসে, তুলে খেতে গিয়ে লেগে গেছে মা। 

👩🏻- হাত দিয়ে তুলেছ? ছি ছি,  চামচ দিয়ে তুলবে তো? 

👧🏻- (ভয়ে ভয়ে) চামচ দেখতে পাইনি তো?

👩🏻-চোখের সামনেই তো রাখা ছিল, বাবা- আমি নিলাম, আর তুমিই পেলে না?

👧🏻-ও হ্যাঁ, তাই তো! সত্যি মা,  হেঁ হেঁ, আমি একটা কুতকুতে হোঁদল। 

👩🏻-(হাসতে হাসতে প্রায় বিষম খেয়ে) কি অসাধারণ আত্মবিশ্লেষণ। আহাঃ।

👧🏻-( উৎফুল্ল স্বরে) আর তুমি হলে, জ্যান্ত ছানাওয়ালা পান্তু। ঐ যে দাদু 👴🏻 আমায় প্রায়ই ডাকে না,‘পান্তুর জ্যান্ত” বলে।

তুত্তুরী উবাচ ২২শে সেপ্টেম্বর,২০২০

👨🏻-(বাবা, ওষুধের বাক্স গোছাতে গোছাতে) আচ্ছা এই নরফ্লক্সটার ডেট ওভার হয়ে গেছে। এটা ফেলে দে। 

👧🏻-এ বাবা! এতো এক পাতা নতুন ওষুধ গো! এটা ফেলে দেবে?

👨🏻-(বাবা হাসি চেপে) এটা পেট খারাপের ওষুধ, তোদের হয়নি কেন? 

👧🏻- না বাবা, ফেলো না। এগুলো গুঁড়ো করে গাছের গোড়ায় দিয়ে দেবে মা। এই মা, একটু গুগল করে দেখো তো, গাছের গোড়ায় নরফ্লক্সের গুঁড়ো দিলে কি হয়?

👨🏻-( বাবা, খুকখুক করে হাসতে হাসতে) কি আর হয়? গাছের ইয়ে বন্ধ হয়ে যায়। মায়ের গাছের কোষ্ঠকাঠিন্য হলে মা তোকে আর আস্ত রাখবে? তুই বরং ওটা ফেলেই আয়।

তুত্তুরী উবাচ, ১২ই সেপ্টেম্বর ২০২০

👩🏻-(মা, কেজো স্বরে) অনেক বেলা হয়েছে, এবার একটু পড়তে বসো, না? 

👧🏻-(কয়েক মুহূর্ত পড়ার নাটক করে) চোখে অন্ধ, মুখে গন্ধ। মা তুমি এমন কাউকে চেন?

👩🏻- (মা হতভম্ব হয়ে) না তো? কেন?

👧🏻-এই একটু মনে হল। তোমার মোবাইলটা দাও তো দেখি, ধৃতরাষ্ট্রের মুখে দুর্গন্ধ ছিল না? 

👩🏻- (মা বিরক্ত হয়ে) যত ফালতু কথা, কি পড়ার সময়ই মনে পড়ে?

👧🏻- ( আরো খানিকক্ষণ নীরবে বইয়ের পাতা উল্টে) মা, পরের দিন যখন কুট্টুসের 🐕 সাথে দেখা হবে, কাকিমাকে ভিডিও কল করব, কেমন? কাকিমা কুট্টুসকে দেখতে চেয়েছে। 

👩🏻-(মা, আরো ক্রুদ্ধ স্বরে) যত বাজে কথা। কাকিমা মোটেই এমন কিছু বলেনি। আমি জানি। 

👧🏻-(আহ্লাদী সুরে) কাকিমা বলেনি তো। আমিই কাকিমাকে বলেছি, পরের দিন কুট্টুস দেখাব। কুট্টুসের কাণ্ডকারখানা শুনে কাকিমা তো হেসেই খুন। জানো তো মা, কুট্টুস এত ভালো, ওকে কামড়ে দিলেও কিছু বলে না। 

👩🏻-(মা, আতঙ্কিত স্বরে) মানে? তুই কুট্টুসকে কামড়ে দেখেছিস নাকি?

👧🏻-( আহ্লাদী সুরে) হ্যাঁ তো। ও বারবার আমায় কামড়াচ্ছিল, তাই বললাম, “আমিও কামড়াতে পারি দেখবি?” বলে ওর কানে কট করে কামড়ে দিলাম। 

👩🏻-(মা, আতঙ্কিত স্বরে) কি সর্বনাশ! এষা পিসি জানে? তুই তার কুতুয়াকে কামড়েছিস?

👧🏻-(দুষ্টু স্বরে) না বোধহয়। তোমরা তখন গল্প করছিলে।

👩🏻-(মা, মনখারাপী সুরে) জানতে পারলে, আর আসবে না এষা পিসিরা। তুই ওদের কুতুয়াকে কামড়েছিস- 

👧🏻-(আশ্বস্ত করার ভঙ্গীতে) আরে না না। ওরা কিছু বলবে না। আমি কুট্টুসের পিঠের ওপর বসে ক্যাসল স্টোরি খেললাম। তারপর ওর চোখে আলো ফেললাম, তারপর ওর সঙ্গে ভৌ ভৌ করে গল্প করলাম, তারপর ও আমায় কামড়াল, আমিও- 

👩🏻-(মা, অবসন্ন সুরে) থাক মা। তুমি ঐসবই করো। পড়াশোনা আর করে কি লাভ? আর করতে হবে না। 

👧🏻-(তড়াক করে লাফিয়ে উঠে, বইখাতা বন্ধ করে) হ্যাঁ মা। চলো গরু চরাই।🐄

অনির ডাইরি ২৩শে সেপ্টেম্বর, ২০২০

 


এনআরসির নাম শুনেই পুরানো মাসি যেন কোথায় গায়েব হয়ে গিয়েছিল। যাবার সময় বলে গিয়েছিল অবশ্য, “দ্যাশে যাইতেছি বওদি। সেখেনে অনেক কাজ আছে জানো। কবে ফিরব জানি না। আর কি কইব বলো? সবই আমার কপাল!” তা সে অনেককাল আগের কথা, তখনও শীতের আমেজে ভাসছে নগর কলিকাতা। মাসির কপালের ভরসায় বসে রইলাম, বেশ কিছু দিন। ফোন করলাম বেশ কয়েকবার, কিছুই হল না ওপাশে। উল্টে গম্ভীর গলায় ফিরিঙ্গী ভাষায়, জনৈকা মেসিনকণ্ঠী আমাকে বেশ খানিকটা ধমকে নিলেন। 

আবাসনের বাসিন্দাদের কাছে কাজের মাসি খুব দুর্লভ কিছু না।  নিরাপত্তারক্ষীদের কাছে, এমন অনেক মাসির নম্বর থাকে, বললেই গুটি কয়েককে পাঠিয়ে দেয়। নতুন মাসিকে তেমন ভাবেই পাওয়া। সদ্য বইতে শুরু করেছে বাসন্তী হাওয়া, মাসি এসে নাড়লেন কড়া। প্রথম দিন এসেছিলেন রাত আটটা নাগাদ, কথাবার্তা পাকা করতে। সেদিনই শুনলাম, মাসি বিধবা। আবাসনের পিছনের গলিতেই মাসির বাড়ি। দুই ছেলে, এক মেয়ে। বড় ছেলে রিক্সা টানে, তার বাড়িতেই থাকে মাসি। ছোট ছেলে রদ্দিওয়ালা। পাশেই থাকে।  মেয়ের বিয়ে হয়েছে পাশের পাড়াতে, জামাই ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে কাজ করে। সবই বেশ ভালো, বেতনেও পুষিয়ে গেল। দুবার আসা নিয়েও টালবাহানা করল না মাসি। বুঝিয়ে দিলাম, আমি বাড়ি থাকি না।  আমার অনুপস্থিতিতে বাড়ির গিন্নী বলতে মেয়ের মাসি, তার সঙ্গে ঝামেলা না বাঁধে। 


পরদিন ভোর ভোর কাজে এল মাসি, দরজা খুলে অবাক হয়ে দেখি,পিছন পিছন এসেছে একটি ফুটফুটে বালিকা। সাগ্রহে জানতে চাইলাম, “মাসি এটা কে গো?” জবাব পেলাম মাসির নাতনী। ভেবেছিলাম ওণার জ্যেষ্ঠ বা কনিষ্ঠ পুত্রের কন্যা, পরে বুঝলাম, আসলে দৌহিত্রী। মেয়েটি প্রায় আমার তুত্তুরীরই বয়সী, বছর আট- নয়। বেশ শান্ত, ভীরু ভীরু চোখে চারদিক তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছিল, ওর সামনে যে প্রশ্নটা করতে পারলাম না, তা হল, “তবে যে মাসি বলেছিলে, মেয়ের সদ্য বিয়ে হয়েছে, বছর দুয়েক হবে?”প্রশ্ন করতে হল না, বাসন মাজতে মাজতে মাসি নিজে থেকেই বলল, ফিসফিস করে, “এটা ওর পথম পক্ষের মেয়ে গো বৌদি। অল্প বয়সে একটু, ঐ যা হয় আরকি-। পাড়ারই ছেলে সে-। ভিভোস হয়ি গেছে,বুঝলে। ওর বাপও বিয়ে করি নিয়েছে। তার তো ছেইলেপিইলেও হয়ে গেছে, ও আমার কাছেই থাকে”।  মেয়েটি তখন তুত্তুরীর সাথে বসে ওর পুতুলগুলো নিয়ে ঘাঁটছে, মুখের দিকে তাকিয়ে বড় মায়া হল, আহা রে। বেচারা। 


মাসি একদিন ছুটি চাইল, জানাল ফুল্কির জন্মদিন। ফুল্কি মাসির দৌহিত্রী। ফুল্কির জন্মদিন বলে কথা, ছুটি দেবে না, এত সাহস কার? পরের দিন মাসি একাই কাজে এল, জানাল আগের রাতে ফুল্কি খুব ক্লান্ত ছিল, আজ আর উঠতে পারেনি। তুত্তুরী সাগ্রহে জানতে চাইল, ফুল্কি কি কি খেল, কি কি পেল-। মাসি ঝাঁট দিতে দিতে শোনাল, একটা পুতুল কিনে দিয়েছে। তার সামনে ফুল্কি যাই বলছে, সেও অমনি ঘুরিয়ে বলছে। ফুল্কি খুব খুশি, তবে মাসির পুত্র তথা পুত্রবধূ বেশ রুষ্ট, বড় দাম পুতুলটার কি না-। জানতে চাইলাম ওর বাবা-মা কি দিল? বাবার প্রসঙ্গে মাসি মুখবিকৃতি করল, জানাল, দুপুরের খাবারটা ঠাকুমা ডেকে খাইয়েছে। একটা জামাও দিয়েছে। আর মা? মাসি মাথা নীচু করে ঝুলো ফেলতে ফেলতে বলল, ‘ওর মা আর আসতে পারেনি। আমার জামাই সন্ধ্যেবেলা এসে কিছু দিয়ে গেছে।’ টুকটাক উপহার আর কি। জামাইয়ের প্রশংসায় পঞ্চমুখ মাসি, সৎ মেয়ের জন্মদিনে কে আর অমন আপিস ফেরৎ উপহার নিয়ে আসে?সত্যি হয়তো, তবুও সদ্য পরিচিত এক শিশুকন্যার জন্য, কে জানে না, কোন অব্যক্ত বেদনায় বিধুর হয়ে উঠল এক মায়ের হৃদয়।


তারপর তো লকডাউন। বন্ধ হয়ে গেল মাসির আসাযাওয়া। মাসে একবার লুকিয়ে এসে বেতন নিয়ে যেত মাসি, প্রতিবারই মুণ্ডপাত করে যেত লকডাউন নামক বস্তুটির। “আর কদ্দিন এমন চলবে বল দিকি বউদি। আমার নেহাৎ উপায় নেই, তাই আসি মাইনা নিতে, বিশ্বাস করো বউদি। নইলে গতরে না খেটে পয়সা নিতে আমার ঘেন্না করে-”। প্রতিবারই ফুল্কির খবর নিতাম আমরা। শুনতাম ফুল্কি ভালো আছে। শুধু বাড়িতে থেকে একটু বদমেজাজী হয়ে গেছে। মাঝেমাঝেই দিদার সাথে কোমর বেঁধে ঝগড়া করে- বুঝতাম ওগুলো দিদার সোহাগী ব্যাজস্তুতি মাত্র।  


তারপর এল আনলক ডাউন। আবার কাজে আসতে শুরু করল মাসি। তবে ফুল্কি আর আসে না। বাচ্ছা মানুষ, যদি ইনফেকশন ধরে যায়, তাই আনত না মাসি। তারওপর ফুল্কির লেখাপড়াও তো আছে। পাড়াতেই এক দিদিমণির কাছে ভর্তি করিয়েছে মাসি, নিজের বলত, ‘আমি মুক্কু মেয়েমানুষ, ওর মা তো বারো কেলাশের পরীক্ষাই দিল না। পালিয়ে গিয়ে বে করল- ও যদি তোমাদের মত পাশটাস দিয়ে কিছু করে’। ইতিমধ্যে ফুল্কির মা সরে গিয়েছে আরো দূরে, তার বর কর্মসূত্রে বদলী হয়ে গেছে সুদূর দক্ষিণ শহরতলীতে। কর্মস্থলের কাছেই বাড়ি ভাড়া নিয়ে উঠে গেছে কপোতকপোতী। এসেছে সুখের খবর, পুনরায় সন্তানসম্ভবা ফুল্কির মা। এর আগে একবার মিসক্যারেজ হয়েছিল, তাই এবার ওরা ভীষণ সতর্ক এবং সাবধানী। সীমিত আয়ে বড় ডাক্তার দেখায় জামাই। ফুল্কির মাকে কায়িক পরিশ্রম যাতে না করতে হয়, বাসনমাজা-ঘরপোঁছার মাসি রেখেছে জামাই বলতে বলতে চিকচিক করে ওঠে মাসির চোখ। ‘এমনকি রান্নাটুকুও করতে দেয় না সবসময় বুঝলে বউদি’ প্রগলভ হয়ে বলে মাসি। 


এই তো গত সপ্তাহের কথা, সেদিন বোধহয় শনিবার।  দুপুরবেলা, অন্য কাজ সেরে বাড়ি ফেরার পথে, যেকটা বাসন পড়েছে মাজতে এসেছে মাসি, বাসনের ঠুকঠাকের মাঝেই ফোন।  ঘাড়ে ফোনটা রেখে মাথা হেলিয়ে কথা বলে চলে মাসি। একই সাথে চলে হাত আর মুখ, এটা বেশ পরিচিত দৃশ্য। অন্য বাড়ি থেকে ফোন করে, ছেলেমেয়েরাও করে, ফুল্কি ফোন করে টুকটাক বায়না করে- সেদিন মাসির গলা দেখি ক্রমেই চড়ছে, তর্ক বা বাদানুবাদ চলল, বেশ খানিকক্ষণ। তারপর মাসি কাঁদতে কাঁদতে ফোন রেখে উগরে দিল একরাশ নালিশ। ‘মেয়েটা ফোন করে ট্যাকা চাইছে বউদি। ওর ওষুধপত্তরের অনেক দাম। জামাইটা একা একা আর কত টানিবে? সবই বুঝি বউদি। কিন্তু আমিই বা কোথা পাই বলোতো-’। আষাঢ় শ্রাবণের ঘন বাদল মুখে ফিরে গেল মাসি, পরদিন আবার দেখি মেঘ কেটে গেছে। জামাইয়ের প্রশংসায় পঞ্চমুখ মাসি, ‘জামাই আমার বড় ভালো গো বউদি। কাল রাতে বাড়ি ফিরে সবশুনেই আমায় ফোন করেছিল, জানাল ট্যাকাপয়সা কিছু চায় না। ওর যা আছে তাতেই ওর ছেলে ভালো করে হয়ে যাবে। চিন্তা করতে নিষেধ করিছে। শুধু বলছে, কটা দিন যদি গিয়ে থেকে আসি, এই সময় মেয়েটাকে একটু যত্নআত্তি-’ বলতে বলতে দীর্ঘশ্বাস ফেলল মাসি, ‘করতে পারলে তো ভালোই, বলো বউদি? তবে আমি চলে গেলে, ফুল্কিটার যে কি হবে? ওকে কে দেখবে?’ বলতে বলতে আঁচলের খুঁটে চোখ মোছে মাসি। 

কাজটা শেষ পর্যন্ত ছেড়েই দিল মাসি, মেয়ে বড় অশান্তি করছে, একবার দুর্ঘটনা ঘটে গেছে, আবার যদি কিছু হয়? বাড়িতে একজন গিন্নিবান্নি কেউ না থাকলে হয়? মাসির ছেলেবউদেরও তাই মত, বুড়ি কটা মাস মেয়ের কাছে থেকে আসুক- আর ফুল্কি? শেষ মাইনেটা হাত পেতে নিয়ে টকটকে লাল জবা ফুলের মত চোখদুটোর ওপর নোংরা আঁচল চেপে ধরা গলায় মাসি বলল,  “ওর বাপের বাড়ির লোকজন তো পাশেই থাকে-।ওরা রাখবে। ফেলে তো আর দেবে না। আর দিলে দেবে, আমি আর কি করব বউদি?রোজের এই অশান্তি আর ভালোলাগে না। কেন যে এত মায়া পড়ে যায় এদের ওপর, সেই তো গতর খাটাব, তবে দুটো খেতে পাব-”।

Sunday 20 September 2020

মধ্য রাতে মন খারাপে -


রাত এখন অনেক, পশ্চিশ আকাশে ঢলঢল সোহাগী চাঁদ। 

বড্ড গরম আজ, ঘুমন্ত চরাচর, অাঁধার ঘরে উড়ে বেড়াচ্ছে গুটি কয় জোনাকি। 

ভাবছি তোমার সিক্রেট মেসেজ পাঠাই, ‘তুমি কি এখনও আমায়_ _?‘ 

দূর কেন যে খামোকা এসব ভাবি? 

সেই যে, সেদিন সান্ধ্য মেঘ বয়ে এনেছিল তোমার মেসেজ, ‘.’। 

হ্যাঁ গো, ফুল স্টপ মানে কি? সব শেষ? 

নাকি শেষের পর, নতুন করে শুরু? 

কে জানে? অনেক পরে শুনেছিলাম, পরদিন গায়ে হলুদ রঙ মেখেছিলে তুমি- 

ফিকে হয়েছে কি সেই হলুদের রঙ, অথবা হয়েছে আরো প্রগাঢ়-

কে জানে? মন শুধু চায়, লুকিয়ে,সবার অলক্ষ্যে, একবার, শুধু একবার, ফুসফুসে ভরে নিতে, তোমার ঘেমো,মেঠো ঘ্রাণ-

“হ্যাঁ গো, তুমি কি, কখনও? মিথ্যে মিথ্যেই সই-? বলো না গো? প্লিজ। প্লিইইইইজ-”

Saturday 5 September 2020

অনির ডাইরি, ৫ই সেপ্টম্বর, ২০২০

 





সপ্তাহান্তেও কি যে অসভ্যের মত ভিড় পথেঘাটে। ট্রেন না চলার মাসুল গুনছে রাজপথ। দেহ রেখেছে হাওড়া আর হুগলী জেলার সংযোগ রক্ষাকারী মাইতি পাড়া ব্রীজ। বিগত চার বছর ধরে জ্বালিয়ে খাচ্ছে ডানকুনি সংলগ্ন এই সেতু।  আর এখন তো যানবাহনের অত্যাচার আরো অনেকবেশী। জীবিকার টানে প্রতিদিন শয়ে শয়ে হাজারে হাজারে বাইক ছুটে চলেছে, প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে মহানগরের পানে। পরিসংখ্যান কি বলে জানি না, তবে যাওয়া-আসার মাঝে অন্তত গোটা দুই দুর্ঘটনা প্রত্যক্ষ করি রোজই। শুধু যে বাইকগুলি দুর্ঘটনাগ্রস্ত হয় তা নয়, যত্রতত্র মুখ থুবড়ে পড়ে থাকে ট্রাক, কে জানে কাকে বাঁচাতে ডিভাইডারে উঠে পড়ে- আজ দেখি রাজপথে টাল খেয়েছে পটল বোঝাই গাড়ি। স্টিয়ারিং থামিয়ে বাপি বলল, “কত লোকে পটল তুলছে ম্যাডাম-”। ক্রুদ্ধ স্বরে বলি, “যার ইচ্ছে তুলুক। তোমার আর পটল তুলে কাজ নেই। ”


বেলা বাড়ছে, এগারোটা নাগাদ মহেশ্বরপুর মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকার কথা চঞ্চল আর কৌশিকের। আমার দুই আদুরে ইন্সপেক্টর। ইন্সপেকশনে যাব তিনজনে মিলে, সারপ্রাইজ ইন্সপেকশন। পটল-জ্যাম কাটিয়ে গাড়ি উঠল দুর্গাপুর এক্সপ্রেস ওয়েতে। মাখনের মত মসৃণ ছিল কিছুকাল আগেও, করোনার অত্যাচারে তরুণ ওম পুরীর গালের মত চেহারা হয়েছে।  


মহেশ্বপুরের কাছেই আছে একটি আন্তর্জাতিক স্তরের ব্রুয়ারি। ধনিয়াখালীর প্রচুর মানুষ কাজ করে ওখানে। বিভিন্ন শ্রম আইন তথা শ্রমিক সংক্রান্ত সমস্যায় ওণারা প্রায়ই যোগাযোগ করেন আমাদের সাথে। কাকতালীয় ভাবে ওণাদের নতুন অধিকর্তা আবার আমাদের পাড়ার ছেলে। সদ্য জয়েন করেছে, অন্য নামী ব্রুয়ারি থেকে-। ফাঁকা থাকলে ব্রুয়িং সম্পর্কে নানা গল্প শুনিয়ে যান ওণারা। মল্টটা আসে বিদেশ থেকে। দিশী খুদের সাথে, বিলাইতি মল্ট মিশিয়ে পচিয়ে তৈরী হয় বিয়র। এক্সাইজ ডিউটি বেড়ে যাওয়ায় বিগত বছর থেকে খুব চাপে ছিলেন ওণারা। কমছিল বিক্রি। এই প্রসঙ্গে ওণারা নিজেরাই বলতেন, “এত দাম দিয়ে বীয়র কেন খাবে মানুষ, দামী হুইস্কি খাবে-”। 


স্ট্রং বিয়রের থেকে লাইট বিয়র কেন ভালো, সেই প্রসঙ্গেও লম্বা লেকচার দিয়েছিলেন বটে, আমি যথারীতি ভুলে মেরেছি। তবে ওণাদের ব্রাণ্ড আমার বর এবং বন্ধুবান্ধবদের ভয়ানক প্রিয়। ব্রহ্মদেশে বেড়াতে গিয়ে জনৈক মায়নমার বিয়র খেয়ে মোহিত হয়ে গিয়েছিলাম আমরা, পরে যেদিন ওণারা দেখা করতে এলেন, কথায় কথায় শোনালাম ব্রহ্মদেশী বিয়রের গল্প, ভাবলাম চমকে যাবেন হয়তো। ভদ্রলোক মুচকি হেসে জানালেন, মায়নমার বিয়রও আসলে ওণাদের কোম্পানীরই তৈরী। 


আমরা গিয়ে দাঁড়ালাম বিশাল বন্ধ গেটের সামনে, মাস্ক  ফেসশিল্ড পরা নিরাপত্তা রক্ষী এসে ড্রাইভারের তাপমাত্রা মাপল। মুণ্ডু গলালাম, কাঁচ নামিয়ে, ইশারায় জানাল দরকার নেই। কাঁচ উঠিয়ে গোটা গাড়িতে স্যানিটাইজার স্প্রে করা হল। বিশাল সাজানো কমপ্লেক্স। খবর পেয়ে ছোট বড় সাহেবরা দাঁড়িয়ে ছিলেন রিশেপশনে। ইন্সপেক্টর সাহেবরা তাঁদের সাথে কাজের কথা বলতে লাগলেন, আমার নজর কাড়ল রিশেপসনে রাখা সুদৃশ্য অ্যাকোয়ারিয়ামটি। ভিতরে জাম্বো সাইজের গুটি কয় মাছ কেবল। যাদের কারো রঙ সোনালী কমলা, কারো কাঁচা হলুদ। তাঁরাও এগিয়ে এল আমায় দেখতে, অবাক হয়ে দেখলাম, দুই চোখের মাঝে একটি সুস্পষ্ট নাক বিদ্যমান। পিছন থেকে জনৈক অধিকর্তা জানালেন এই মাছের নাম প্যারট ফিশ।


 অ্যাকোরিয়াম তো আমাদের আপিসেও একখানা আছে, ভেসে বেড়ায় গুটি কয় লাল-কালো-হলুদ মাছ। নিয়মিত শ্যাওলা পরিষ্কার করে রমেশ। সকাল বিকাল খাবার দেয় অজিত দা। অ্যাকোয়ারিয়ামের মাথাতেই পেপসির খালি বোতলে রাখা, দুর্গন্ধী গুলি, ঐ খায় আমাদের মাছ। কিন্তু এমন সুন্দর মোটু মাছ তো আমাদের নেই। কৌশিককে জানালাম, এমন মাছ আমাদেরও চাই। জবাব পেলাম ঐ মাছের দাম সাত থেকে আটশত টাকা। তাও পুঁচকে হবে। ধেড়ে হতে লাগবে দু-তিন বছর। অত দিন থোড়াই এই শহরে থাকব আমি- 


মনখারাপী মন নিয়ে ফ্যাক্টরীতে ঢুকলাম। ওণারা জানতে চাইলেন সেফটি শ্যু চাই কিনা। যদি পায়ে কিছু লেগে টেগে যায়। প্রায় দেড় তলা হিলতোলা জুতো পরি, ওসবে ভয় পাই না। 

ফ্যাক্টরীর ভিতরটা বিশাল, তুলনায় শ্রমিক খুব কম। কোভিডের জন্য খুব অল্প সংখ্যক শ্রমিক নিয়ে কাজ চলছে, খুব ভয়ে থাকেন ওণারা। অবাক হয়ে জানতে চাইলাম, “আপনারা তো অ্যালকোহল বানান, কোভিডকে আপনাদের কি ভয়?” ওণারা হেসে জবাব দিলেন বীয়রে অ্যালকোহল এমনিতেই কম থাকে। ওতে কোভিডের টিকিও বাঁকে না।


 ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখালেন পুরো প্ল্যান্ট। মল্ট আর খুদ আলাদা আলাদা মেশিনে ঝাড়াই-বাছাই হয়। ধুলো- কাঁকড়, টুকরো লোহা বা ধাতু যদি থাকে, তা বেছে ফেলে, তার সাথে ইস্ট পচানো হয়। তারপর ছাঁকাই হয়। মাঝে আরো অনেক কিছু হয় বটে, সব ভুলে মেরেছি যথারীতি। তবে এটুকু মনে আছে, যেখানে পচাই হয়,বিটকেল গন্ধ মাইরি। পুরোটাই অটোমেটেড প্রসেস, সেটাও দেখালেন ওণাদের অপারেটর।  দেখালেন কোভিড রুখতে কত কিছু করেছেন ওণারা। থার্মাল চেকিং, স্যানিটাইজার, সকাল-দুপুরে মাস্ক পাল্টানো ছাড়াও, উড়িয়ে দিয়েছেন সব দরজার হাতল। ওখানে সব দরজা পা দিয়ে খোলা হয়। বসিয়েছেন সেন্সরড স্যানিটাইজার ডিসপেন্সার। তলায় হাত পাতলেই ঝরে পড়ছে সুগন্ধী তরল। অফিস বাস এবং ক্যান্টিনে মার্কা করা আছে, যাতে কেউ পাশাপাশি না বসে। এমনকি হাত ধোবার জায়গাতেও কল খুলে ফেলা হয়েছে। বদলে বসানো আছে পাম্প। পায়ের চাপ দিলেই ঝরবে জল। ওনাদের ব্যবস্থাপনা দেখে রীতিমত সমীহ হচ্ছিল। 


ইন্সপেকশন সেরে বেরিয়ে আসার সময় ওণারা দুঃখ করলেন, পরিস্থিতি যদি আগামী কালও স্বাভাবিক হয়ে যায়,তাও এবছর মাত্র ১২-২০শতাংশ ব্যবসা হবে। লাভ তো ছেড়েই দিন। জানালেন এটা শুধু বাংলা নয়, সারা ভারত তথা বিশ্বের চিত্র। একধাক্কায় প্রায় দেড় থেকে দুই দশক পিছিয়ে গেছে পৃথিবী। 


বেরিয়ে এলাম মধ্যাহ্নে। পরবর্তী গন্তব্যস্থল কাকগাছির আরেকটি ফ্যাক্টরী। এখানে প্যাকোজিং এর কাগজ আর কার্ডবোর্ডের বাক্স তৈরী হয়। না থার্মাল গান ঠেকালো নিরাপত্তা রক্ষী, না কেউ জানতে চাইল কি চাই-। বিশাল কারখানার শেডে গরগর করে চলছে মেশিন, বের হচ্ছে করোগেটেড কাগজ। যাঁরা কাজ করছেন, না আছে তাঁদের মুখে মাস্ক, না আছে কোন সামাজিক দূরত্ব। দুই ইন্সপেক্টর সাহেব প্রবল হম্বিতম্বি করাতে কোথা থেকে যেন নোংরা রুমাল বার করে মুখে জড়ালো কয়েকজন। বাকিরা দৌড়ল বড় সাহেবকে ডাকতে। যিনি এলেন তিনি এসেই হাউমাউ জুড়লেন। “সব ব্যাটাকে মাস্ক দেওয়া হয়েছে। কেউ পরে না। দেখুন না স্যার-।”চঞ্চল ধমকালো, তা সেই মাস্কগুলো কই? স্যানিটাইজারই বা কই, ম্যানেজার বাবু দৌড়লেন স্যানিটাইজারের বোতল আনতে, রাগতে গিয়েও কেন জানি না, হেসে ফেললাম, আন্তর্জাতিক কোম্পানীর চকচকে ব্যাপার তো বিরলতম দৃশ্য, এই না হলে আমার দেশ।

Thursday 3 September 2020

অনির ডাইরি, ৩রা সেপ্টেম্বর, ২০২০ (তুত্তুরীর দিনলিপি)

 


আপিস থেকে বাড়ি ঢুকতে না ঢুকেই মস্ত বড় লিস্টটা ধরিয়ে দিল তুত্তুরী। সারাদিন ধরে, দীর্ঘ ভাবনাচিন্তা করে লিখেছে আর কেটেছে। বিষয়, আসন্ন পুজোয় কি কি খাবে, আর কি কি করবে। যার মধ্যে নাগরদোলাটা তৎক্ষণাৎ বাতিল হল। কেন? ভ্রু কুঁচকে জানতে চাইল তুত্তুরী। জানালাম, নাগরদোলা হল, সংক্রমণের আঁতুরঘর। পরের প্রশ্ন, আবার “কেন? আমরা তো আলাদা চেয়ারে বসব।” উত্তরে ধৈর্য ধরে বোঝাতে উদ্যত হই, আমাদের আগে, পরে কত লোক ঐ চেয়ারে বসবে। ওরা কি স্যানিটাইজ করে বসতে দেবে আমাদের? কচু। ঘেঁচু এবং ঘন্টা। চোখ গোলগোল করে তাজ্জব স্বরে বলে ওঠে কন্যা, “বাপরেঃ। পোঁ ইয়ে মানে পশ্চাৎদেশ দিয়েও সংক্রমণ হয়?” হাসব না স্যারিডন খাব বুঝতে পারি না। তবুও বোঝাই, বসার চেয়ার নয়,ধরার রডটা বেশী বিপজ্জনক ইত্যাদি,প্রভৃতি। 

নাগরদোলা বাদ গেল বটে, টিকে রইল বেলুন। ষড়যন্ত্রের সুরে, “দাদার থেকে, আমার বেলুনটা যেন বড় হয়-”। দাদা অর্থাৎ বুল্লু বাবু, আগামী নভেম্বরে টিন এজে পদার্পণ করবেন। বয়সের তুলনায়, তিনি ভয়ানক সাদাসিধে, হাবলা-গোবলা বটে,তবে বেলুনে তাঁর ছিঁটেফোঁটাও উৎসাহ নেই। তবুও- 


নাগরদোলা-বেলুনের পর শুরু হল, প্রস্তাবিত খাদ্যতালিকা, যা দুই ভাইবোনকে খাওয়াতে হবে, সূত্রপাত হল, বুড়ির মাথার পাকা চুল দিয়ে। চিনতে পারলেন না তো। যাকে পরিশীলিত ফিরিঙ্গী ভাষায় কয়, কটন ক্যাণ্ডি বা ক্যাণ্ডি ফ্লজ। আচ্ছা এরপর পর্যায়ক্রমে আসছে ফুচকা, চটপটি, এগ এবং চিকেন রোল, হাওড়া ময়দানের মাটির ভাঁড়ে পুরু মালাই দেওয়া লস্যি, মামমাম (দিদা) এর হাতে বানানো চাম্মিন (চাউমিন), কস্তুরীর লাল ক্ষীরের মত দই, চাউমিন এর পুর দেওয়া সিঙারা, শেঠ সুইটসের কালো গজা, অন্নপূর্ণার কেঁদো কেঁদো জিলিপি- 


ফর্দ শেষ হতে বোধহয় আরো সময় লাগত, যদি না, মোক্ষম সময়ে, শৌভিক তার মোবাইলটা না বাড়িয়ে দিত, “দ্যাখ, বুজুর জন্য আমার ভিডিও সাজেশনে কি এসেছে-”। 

এই ব্যাপারটা নিয়ে প্রায়শই ঘ্যানঘ্যান করে আমার বর। বাপ-মেয়ে দুজনেই ইউটিউবের চরম অনুরাগী। আমার ফোন নিয়ে পড়াশোনা চালায় বটে, মাঝেসাঝে বন্ধুরা ভিডিওকল করলে,উৎফুল্ল চিত্তে বার্তালাপও করে, তবে এসব আব্দার আমার কাছে চলে না। বাবুজী স্বয়ং সোহাগ করে ফোনটা তুলে দেয় মেয়ের হাতে, তারপর শুরু হয় ঘ্যানঘ্যান- “আর আমি কোনদিন ওকে মোবাইল দেব না। কি সব দেখে বেড়ায়, উল্টোপাল্টা চ্যানেল সাবস্ক্রাইব করে। তারপর সেগুলো আমার সাজেশনে আসতে থাকে।” 


খুব বেশী উল্টোপাল্টা দেখে না তুত্তুরী, জনৈক প্যারট দীপঙ্করের বিরাট অনুরাগী। মাঙ্কা বলে এক বকবকে কাকাতুয়া আছে, প্যারট দীপঙ্করের, ভারী দাম্ভিক। নিজের নাম ছাড়া আর কিছুই বলে না সে, তবুও তুত্তুরী তার জন্য পাগলপারা। সারাদিন “মাঙ্কা-মাঙ্কা” করে মাঙ্কার ভাষায় কথা বলে চলে। 


এছাড়া জনৈক ’গ্রাণ্ডপা‘র প্রতিও অনুরাগ জন্মেছে তুত্তুরীর। গ্রাণ্ডপা অবশ্য মারা গেছেন, তবে তাঁর চ্যানেলটি আছে। তিনি জীবিত অবস্থায়, স্বহস্তে রেঁধে পথশিশুদের নানা সুখাদ্য ভক্ষণ করাতেন। আধো আধো স্বরে জানাতেন কি ভাবে রাঁধছেন- তিনি মারা যেতে বেশ কিছুদিন কেঁদেছিল তুত্তুরী। বারবার বুড়ো বুড়ো উচ্ছারণে আধো আধো ইংলিশে গ্রাণ্ডপাকে নকল করে দেখাত, “লাভিং-শেয়ারিং-কেয়ারিং- দিজ ইজ মাই ফ্যামিলি।” গ্রাণ্ডপার তনয় সম্প্রতি চ্যানেলটি নতুন করে চালাচ্ছে। 

এছাড়া তুত্তুরী দেখে খুচখাচ কার্টুন আর চরম বোকাবোকা ধাঁধা। যেমন পাঁচটা বাচ্ছা বা গর্ভবতী মহিলার ছবি দেওয়া থাকে, তার তলায় লেখা থাকে, “এদের মধ্যে কে ভূত?” লোভে পড়ে আমি একবার দেখেছিলাম, যার ছাওয়া পড়ছে না, সেই ভূত বলে,হো হো করে হেসেছিল ভাষ্যকার। এত রাগ হয়েছিল- 


তুত্তুরী শুধু দেখে তাই নয়, শৌভিকের চরম বিরাগজনক হওয়া সত্ত্বেও এই সাংঘাতিক বোকা বোকা জিনিসগুলো লাইক করে। মাঝেসাঝে, ধাঁধার উত্তরগুলি কমেন্টও করে। এই নিয়ে নিত্য চুলোচুলি  আমাদের সংসারে। তবে আজকে স্ক্রীণে যা দেখলাম, কয়েক মুহূর্তের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেল হৃদয়। এসব কি দেখছে আজকাল? 

আমার হতভম্ব দশা থেকে ফুলে ফুলে হাসছে শৌভিক, আর তুত্তুরী ভ্যাবলার মত তাকিয়ে আছে দুজনের দিকে। কি? কি এসেছে বাবার ভিডিও সাজেশনে। বেশ খানিকক্ষণ ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আর শৌভিকের হাসি দেখে বুঝলাম, ওটি  আদতে, “গর্ভবতী চুড়েল”। যিনিই বঙ্গানুবাদ করেছেন, তাঁর খুরে খুরে নমস্কার। হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মরলে আপনার কোমরে দড়ি পড়ত- উফঃ। যত্ত আপদের দল। 

পুনশ্চ তুত্তুরী দেখে-টেখে জানাল, যে ওগুলো ও ছোটবেলায় দেখত। এখন আর দেখে না। আপাততঃ শুধুই “মাঙ্কা-মাঙ্কা”।