#অনিরডাইরি #কাঁথিরকিস্যা
"আমার নতুন PT ড্রেস লাগবে, বাবা," কোন একদিন বলেছিল তুত্তুরী। তখন সদ্য শেষ হয়েছে বার্ষিক পরীক্ষা, স্কুল বন্ধ। শৌভিক উড়িয়েই দিল দাবিটা, "আগে পাশ কর, নতুন ক্লাসে ওঠ, তবে না পিটি ড্রেস।"
মেনে নিল, বেশ কিছুদিন নির্বাক রইল তুত্তুরী। কাউকে আর কিছু বলল না, তারপর এল সেই দিন, পরীক্ষার ফলাফল ঘোষিত হলো এবং আমাদের যাবতীয় আশঙ্কা সমূলে বিনষ্ট করে দেখা গেল, সসম্মানেই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন শ্রীমতী তুত্তুরী। অতঃপর তিনি পুনরায় দাবি তুললেন, " মা, এবার আমায় পিটি ড্রেস কিনে দাও।"
এবার আমার জবাব দেবার পালা। বললাম, " আগে স্কুল খুলুক গিয়ে দেখ কি বলে, তবে না-। গিয়ে হয়তো দেখলি, যে পিটি ড্রেস আবার বদলে গেছে। অথবা একদমই বদলায়নি, গত ক্লাসেরটাই আবার পরতে বলছে। তাই না, হতে পারে তো-"।
স্কুল খুলল কোন এক বৃহস্পতিবার এবং যেখানে বাঘের ভয়, সেখানেই ঘনিয়ে এলো সন্ধ্যা। নতুন রুটিন অনুযায়ী দেখা গেল, শুক্রবারই PT ক্লাশ পড়েছে। অফিস থেকে ফিরে দেখি মেয়ের মুখে জমেছে বাদল। ড্রেস ওই একই আছে এবং সবাই তা পরেছিল। "সবাই আমাকে দেখে হাসছিল। বলল তোর ড্রেস কই? সবাই সালোয়ার পরে কি সুন্দর দৌড়াদৌড়ি করল, আর আমায় স্কার্ট পরে ওদের পিছন পিছন ছুটতে হলো"- স্ফুরিত অধরে, জানালেন শ্রীমতী তুত্তুরী।
তাজ্জব হয়ে জানতে চাইলাম, তা তুই খামোকা স্কার্ট পরলি কেন? আগের বছরের পিটি ড্রেস দুটো তো নতুনই আছে। যাঁরা জানেন না তাঁদের অবগতির জন্য বলি, বিগত বৎসরে দুবার স্কুল বদল হয়েছে শ্রীমতী তুত্তুরীর। একবার এপ্রিল মাসে মহানগর থেকে তাম্রলিপ্ত। আর একবার মধ্য নভেম্বরে তাম্রলিপ্ত থেকে কাঁথি। তাম্রলিপ্ত স্কুলেরটা পরতে বলছি না, কিন্তু এই স্কুলেরটা তো পরতেই পারতিস।
বাবাও সম্মতি দিল পাশ থেকে,'এক্কেবারে ভোম্বল।' শ্রীমতী তুত্তুরী চোখ বড় বড় করে বললেন, "এই না না। একদম নয়, হয় নতুন পিটি ড্রেস নয়তো নরমাল স্কুল ইউনিফর্ম, না হলে ঢুকতেই দেবে না-'। অতঃপর বাবার কানে সুড়সুড়ি দিতে দিতে, গদগদ কণ্ঠে কইলেন, " বা-আ-বা-আ, PT ড্রেস কিনে দাও না, বাবা।" সুড়সুড়ির আমেজে চোখ বন্ধ করে, ইশারায় মাথাটা দেখিয়ে, ওখানে বিলি কাটতে বলে, বাবা বললেন, " হ্যাঁ, দেবো তো। মা কিনে দেবে।"
ছাই ফেলতে ভাঙ্গা কুলো আমি, সোমবার কাক ভোরে মেয়েকে স্কুলে ছাড়তে গিয়ে, স্কুলের উল্টোদিকের সদা হাস্যময়ী সেলাই মাসিকে বলে এলাম, " ও দিদি, মেয়ের পিটি ড্রেস লাগবে যে। আসছে শুক্রবারের মধ্যে দিতে পারবেন? না হলে আবার স্কুল কামাই করতে হবে মেয়েকে।" মাসি এক গাল হেসে বাড়ি পাঠালেন।
প্রতিশ্রুতি মোতাবেক বুধবারের মধ্যেই নূপুর বাবু (মহকুমা শাসকের ড্রাইভার) গিয়ে নিয়ে এলেন নতুন জামা। বিলটা দেখেই বুঝলাম, যে কেন বাবা বলেছিল, ওটা মা দেবে। যাই হোক, ভাবলাম পকেটে আগুন লাগলো বটে, ঝামেলাটা অন্তত মিটলো। হরি হরি! বাড়ি ঢুকতেই লাফাতে লাফাতে এগিয়ে এলেন শ্রীমতী তুত্তুরী, " মা তোমার হলুদ ওড়না আছে?"
ঋণাত্মক জবাব পেয়ে ঘাবড়ে গেলেন তিনি। ভীত সন্ত্রস্ত স্বরে জানতে চাইলেন, "তাহলে কি হবে মা? ওড়না ছাড়া তো ঢুকতে দেবে না। তুমি আমায় একটা হলুদ ওড়না কিনে দাও-"। ভাবলাম বলি, ওটা বাবা দেবে। বললাম না কারণ জানি, বিস্তর ফাইল চালাচালির পরেও ওটা আমারই ঘাড়ে চাপাবে শৌভিক। অতি কষ্টে ও ব্যাটাকে ওড়না এবং হলুদ রং যদিও বা বোঝাতে পারি, দোকানের হাল হকিকৎ বোঝাতে আমার জান বেরিয়ে যাবে।
সত্যি কথা বলতে কি, কোন দোকানে পাওয়া যায়, এই শহরে, তা তো আমি নিজেই জানিনা। ভাগ্যে বন্ধুদের থেকে দোকানের নামটা জেনে এসেছিল তুত্তুরী। কাঁথি শহরের জমজমাট বাজারের মধ্যে,বেশ নামী এবং বড় দোকান। আসন্ন চৈত্র সেলের বিস্তর ভিড় আর টোটোওয়ালাদের সাথে রীতিমতো মল্লযুদ্ধ করে, বিগত বছরের PT ইউনিফর্ম (হাউস) রং মিলিয়ে যখন কিনে নিয়ে এলাম হলুদ ওড়না, আক্ষরিক অর্থেই শ্রীমতী তুত্তুরীর তখন খুশির সীমা নাই। কেবল বাবাকে বা মাসিকে দেখিয়ে স্বাদ মিটলো না, উল্লাসের চোটে হাওড়ায় ফোন করে দাদু দিদাকেও সবিস্তারে শোনালো সব গল্প।
আজ সকালেও প্রত্যক্ষ করলাম তার অপরিসীম আনন্দ। সময়ের বেশ খানিক আগে উঠে পড়ে, তৈরি হয়ে নিয়েছেন একা একাই। সুপ্ত বাপকে ঠেলে তুলে আহ্লাদী হয়ে দেখালেন, " বাবা, বাবা। দেখো বাবা আমায় নতুন PT ড্রেস।" বাপ মেয়েতে যখন এই নিয়ে খুনসুটি আর আহ্লাদ করছে, আমার মনে পড়ছিল প্রায় এক যুগ আগে, এক বৃদ্ধের উপদেশ-।
তখন তুত্তুরী আড়াই বা তিন মাসের ছোট্ট বেবি। কন্যা সমেত আমি তখনও পিত্রালয়ে বসবাস করি। সপ্তাহান্তে শ্বশুরমশাই স্বয়ং এসেছেন পুত্রবধূ আর নাতনিকে বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে যাবার জন্য। শৌভিক তখন খড়গপুর ২ নম্বর ব্লকের বিডি ও। বাড়ি ফিরছে সেও। দীর্ঘদিন বাদে একত্রিত হতে চলেছে গোটা ভট্টাচার্য পরিবার। গিরিশ পার্ক ফ্লাইওভার তখনও কিছু গর্ত আর লোহার ছড়ের সমষ্টি। তাও প্রবল ট্রাফিক জ্যামে অচল গণেশ টকিজের মোড়। জানলা দিয়ে বাইরের বড় বড় বিজ্ঞাপনের হোর্ডিং দেখছিলাম আমি, দাদুর কোলে অকাতরে ঘুমাচ্ছে সেদিনের ছোট্ট তুত্তুরী ।বেবি পাউডারে প্রায় সাদা, কপালে কাজলের ধ্যাবড়া টিপ।
নিদ্রিত নাতনির পায়ের আঙুল টেনেটেনে খেলা করছিলেন শ্বশুরমশাই।আচমকা বললেন, " তোমায় একটা কথা বলব, দুঃখ পেয়ো না। এ যা চাইবে সঙ্গে সঙ্গে দেবে না।" অতঃপর একটু থেমে, একটু হেসে বললেন, "সামান্য হলেও অভাব বোধ থাকাটা বড্ড দরকার। না হলে ভালো মানুষ হওয়া যায় না।"
বৃদ্ধের নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে মানি আমরা। মুখ খুলতেই কক্ষনো কিছু পেয়ে যায় না শ্রীমতী তুত্তুরী। মাসকাবার কাকে বলে তাও জানে এবং বোঝে তুত্তুরী। কোন জিনিস চেয়ে ফেলেও, দাম দেখে পিছিয়ে যায় তুত্তুরী। আশার বাইরে সামান্য কিছু পেয়ে গেলে এত্ত, এত্ত খুশি হয় তুত্তুরী। সময় বড় নির্দয়। বাবার শেখানো নেতির নেতিকরণ তত্ত্ব অনুসারে, আজ যা স্বাভাবিক, কাল তাই অস্বাভাবিক। আজ যা সাদা, কাল তাই ঘোর মসীবর্ণ। সময়ের অমোঘ নিয়মে বদলে যাবেন হয়তো ইনিও, না বদলে যাওয়াটাই অস্বাভাবিক। আজকের সবটুকুই থেকে যাবে স্মৃতিতে। তবুও এই সান্তনা টুকু তো থেকে যাবে, যে আমরা চেষ্টা করেছিলাম।
No comments:
Post a Comment