Wednesday 10 April 2024

অনির ডাইরি এপ্রিল, ২০২৪

অনির ডাইরি ২৮শে এপ্রিল, ২০২৪

#অনিরডাইরি 



বাড়ি তো নয়, সাপেদের বারোয়ারি বৈঠক খানা যেন। তদসত্ত্বেও আলো না জ্বেলে, খালি পায়ে, প্রাণের ভয়কে তুচ্ছ করে, পা টিপে টিপে এসে যতটা সম্ভব নীরবে ফ্রিজের দরজা খুলে সবে কেকে এক কামড় দিয়েছি--- পিছন থেকে ভেসে এল শৌভিকের জলদগম্ভীর কণ্ঠস্বর, “কি করছিস?” একেই বোধহয় বলে, 'যেখানে বাঘের ভয়, সেখানেই -'। বাইরের ঘর থেকে এখনও ভেসে আসছে সুরের তীব্র মূর্ছনা, তার মধ্যেও টের পেয়েছে মাইরি। 


খট করে আলো জ্বালাল শৌভিক, কঠিন ভর্ৎসনার সুরে বলল, “এই তুই নাকি রোগা হবি? তোকে কতবার বলেছি, দরকার হলে রাতে একটা রুটি বেশী খাবি, কিন্তু মাঝরাতে উঠে চোরের মত ওই সব খাবি না। রাখ - ”। দুহাতে দুই স্লাইস, মুখ ভর্তি কেক, কি আর জবাব দি। ফোলা গাল নিয়ে চোরের মত মাথা নীচু করে দাঁড়িয়ে রইলাম। খানিকক্ষণ তিরস্কারের দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকার পর, একটু নরম হল মুখের রেখা গুলো। গলাটাও যেন সামান্য মোলায়েম হল, তিনি বললেন, “যেটা মুখে পুরেছিস, ওটা খা। বাকিগুলো ফ্রিজে রেখে বাইরের ঘরে আয়, তোকে একটা মজার গল্প বলার আছে।”


এই মজার গল্পটা সেই সকাল থেকে চলছে। অফিস টাইমে প্রথম ফোন করে বলেছিল, একটা দারুণ মজার কি যেন ঘটেছে, বাড়ি এলেই বলবে। বাড়ি এসে যখন মনে করে শুধালাম, বলল, রাতে খাবার পর বলবে। নৈশ ভোজের পর যখন জানতে চাইলাম, বলল, " এখন ভালো লাগছে না

 একটু গান শুনি, কাল বলব।" এখন আবার বলছে, এখুনি বলবে, এক মুখে যে কত কথা বলে লোকটা। 


গম্ভীর মুখে সোফায় গিয়ে বসলাম, শৌভিক বলল, “ শোন আজ দুপুরে একটা ফোন এসেছিল। অচেনা নম্বর। আমি “হ্যালো” বলতে ওপাশ থেকে এক অপরিচিত পুরুষ কণ্ঠ বলল, “আচ্ছা এটা কি কাঁথি মহকুমা শাসকের দপ্তর?” হ্যাঁ বলাতে বলল, আচ্ছা এসডিও সাহেবের নাম কি শৌভিক ভট্টাচার্য? বললাম হুঁ, তো বলল, “ওনার সাথে একটু কথা বলা যাবে?” অসহিষ্ণু হয়ে বললাম, বলছি তো, বলুন। 


ওদিকের কন্ঠস্বরে পলকে নেমে এল সম্ভ্রমের পর্দা, ভদ্রলোক অত্যন্ত বিনীত ভাবে নিজের পরিচয় দিলেন, জানলাম ভদ্রলোক বিধাননগর পুলিশ কমিশনারেটের একজন পদস্থ আধিকারিক। অতঃপর তিনি বললেন, "স্যার যদি কিছু মনে না করেন, তো একটা প্রশ্ন করি।" অনুমতি পেয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, " আচ্ছা স্যার, আপনি কি গত বৃহস্পতিবার কোন ভাবে সল্টলেকে এসেছিলেন?" 


হেসে বললাম, আমি বিগত পাঁচ মাসে একবারও কলকাতা যাইনি। আর যেদিনকার কথা বলছেন, সেদিন তো এখানে পুরোদমে ইলেকশনের কাজ চলছিল। ভদ্রলোক শুনে আশ্বস্ত হলেন, তারপর যেটা বললেন সেটাই মজার। বললেন, " স্যার, গত বৃহস্পতিবার,দুপুর বেলা, সল্টলেকে অমুক জায়গায় ট্রাফিক পুলিশ একটা গাড়িকে, ট্রাফিক নিয়ম ভঙ্গের জন্য আটকায়। আটকানোর সঙ্গে সঙ্গে গাড়ি থেকে একটি লোক নেমে আসে এবং সটান ট্রাফিক পুলিশের কলার চেপে ধরে। সাথে উদ্দাম খিস্তিখেউর। যার সারাংশ হল, " তুই জানিস, আমি কে? তুই জানিস, তুই কার গাড়ি আটকেছিস? আমি সায়ন মান্না, SDO কন্টাই"।" 


কি বলব,বুঝে উঠতে পারি না। কোন মতে বলি, সে আবার কে?বললেই হল, পুলিশ আই কার্ড দেখতে চায়নি? 


শৌভিক বলে, "আমিও তাই বললাম। SDO কন্টাই হলেও তো তার ট্রাফিক নিয়ম ভাঙার কোন অধিকার নেই। পুলিশ আইনানুগ ব্যবস্থা নিল না কেন? ভদ্রলোক বললেন, " কি আর বলব স্যার, ছেলেটি নতুন। সে ভয় পেয়ে গাড়িটাকে ছেড়ে দেয়। তারপরই স্থানীয় লোকজন, অন্যান্য গাড়িওয়ালারা ছেলেটির ওপর চড়াও হয়।" বাঃ অফিসারের গাড়ি বলে বেশ তো ছেড়ে দিলে -"। এই জল অনেকদূর গড়ায়, কমিশনারেটের মধ্যেও উত্তেজনা দেখা দেয়, এমন ভাবে কর্তব্যরত পুলিশের গায়ে হাত তোলা, গাল মন্দ করাটা কেউই ভালো ভাবে নিতে পারেনি। 


 কাঁথির মহকুমা শাসকের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার দিকে প্রথম পা বাড়াতেই ধরা পড়ে, যে কাঁথির মহকুমা শাসকের নাম মোটেই সায়ন মান্না নয়। অন্তত এখনও নয়। আর ভিডিও ফুটেজে যে লোকটির ছবি উঠেছে, তাকে মোটেই আমার মত দেখতে নয়। তারপরই ওরা ঘটনাটা আমাকে জানাতে ফোন করে।" 


সাগ্রহে জানতে চাই,ওরা ওর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে তো নাকি? শৌভিক কাঁধ ঝাঁকিয়ে নিরুৎসুক ভাবে বলে, " নেবেই তো বলল। বলল দরকারে আপনারও সাক্ষ্য লাগবে স্যার।" বুঝতে পারলাম, মজার গল্প এখানেই শেষ। কিন্তু আমার মাথায় ঘুরতে থাকে হাজার গণ্ডা প্রশ্ন। কে এই মহাশয়? আর এত মহকুমা থাকতে কাঁথি কেন রে বাবা? কত আজব ঘটনাই যে নিত্য ঘটে চলেছে আমাদের আশেপাশে। নাহ্ লালমোহন বাবু ঠিকই কয়ে গেছেন, "ট্রুথ ইজ স্ট্রংগার দ্যান ফিকশন"।

অনির ডাইরি ২৩শে এপ্রিল, ২৯২৪ 

#অনিরডাইরি #কাঁথিরকিস্যা 



সদ্য বিদেয় নিয়েছে শীত, বাতাসে লেগেছে সামান্য উষ্ণতার ছোঁয়া। এই সময়, প্রভাতী সূর্যের আলো মেখে হাঁটতে দারুণ লাগে। ভোর ভোর শ্রীমতী তুত্তুরীকে স্কুলে নামিয়ে, বাগানেই হাঁটছিলাম। হঠাৎ ডাকল শৌভিক, "জলদি একবার ভিতরে আয় -"। 


এই সময়টা সাধারণত স্নানে যায় শৌভিক, আজ আবার কি হল? স্নান না করে, ডাকাডাকি মানেই কিছু অপাট করেছি আমি। কি করলাম রে বাবা, ভাবতে ভাবতে বাড়ির ভিতরে ঢুকে দেখি, বাংলো চেম্বারের লাগোয়া বাথরুমের সামনে কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আমার বর। মুখে ভেবলে যাওয়া হাসি। নিশ্চিন্ত হলাম, হাসি মুখ যখন,তাহলে ফাঁসি দিবে নি। তবে সেই নিশ্চিন্ত ভাব বেশী ক্ষণ টিকল কই? 


বাথরুমের প্লাস্টিকের দরজাটা বাইরে থেকে বন্ধ, ভিতর থেকে প্রবল দুম - দুম, খচ মচ আওয়াজ আসছে। লতাদি ব্যবহার করে এই বাথরুম টা, হতবাক হয়ে বললাম, "সাত সকালে লতাদিকে বাথরুমে বন্ধ করে দিয়েছিস?" শৌভিকের হাসিটা যেন রবার দিয়ে কেউ মুছে দিল,কপালে পটপট করে পড়ে গেল অনেকগুলো ভাঁজ, নেহাৎ, কলিযুগ - নইলে ভস্ম হয়ে যেতাম নির্ঘাত। 


পিছন থেকে লতা দির গলা ভেসে এল, " আরে আমাকে কেন বন্ধ করবে? বাথরুমে গোসাপ ঢুকছে -"। অ্যাঁ! গোসাপ, আমাদের হাওড়ার ভাষায় গোহাড়গিলে। আছে বটে কয়েকখানা,মাঝে মধ্যে বাগানের পাঁচিল বরাবর গুটগুট করে হেঁটে যায়।  ছাতের জল যাবার নর্দমায় জমিয়ে বসে, ল্যাজ নেড়ে নেড়ে ঝগড়াও করে। কিন্তু বিগত এক দেড় বছরে কোনদিন বাংলোর ভিতরে ঢোকার ধৃষ্টতা দেখায়নি। 


শৌভিক বলল, " চান করতে যাবার আগে ভাবলাম ওয়াশিং মেশিন টা চালিয়ে দিয়ে যাই। জল বেরোনোর পাইপটা বাথরুমে ঢোকাতে দরজা খুলেছি,দেখি কোণাকুণি উল্টো দিকে বসে তিনি ঝিমোচ্ছেন। কাল রাতে বোধহয়, সান শেডের ওপর উঠেছিল পাখি বা কাঠবিড়ালির ছানা খেতে। তাল সামলাতে না পেরে বাথরুমের জানলার খড়খড়ি গলে ভেতরে পড়ে গেছে।" 


বুঝলাম যে পথ দিয়ে পড়েছে, সে পথ আর খুঁজে পায়নি।টাইলস লাগানো দেওয়াল বেয়ে প্রায় সাত ফুট চড়া, ওই ধুমসোর পক্ষে অসম্ভব। সারা রাত চেষ্টা করেছে নির্ঘাত। তারপর ক্লান্ত হয়ে যখন ঘুমাতে গেছে, তখনই আমার বর দরজা খুলে তাকে নতুন আলোর পথ দেখিয়েছে। তিনি আপাতত পূর্ণ বিক্রমে দরজা ভেঙে বেরিয়ে আসতে চাইছেন। যে হারে ধুপধাপ করছেন, এই মান্ধাতার আমলের ফাইবারের দরজা কতক্ষণ টিকবে কে জানে। এক ধমক মেরে আগে তাকে শান্ত করলাম। 


ওনার আব্দার মত দরজা খুলে দিলেও জ্বালা।চৌকাঠ ডিঙালেই শ্যাম বাজারের মত পাঁচ মাথার মোড়ে গিয়ে পড়বে। যার  কোন দিকের রাস্তা গিয়েছে রান্না ঘর, খাবার ঘর, ভাঁড়ার ঘরের দিকে। তো কোনটা শৌভিকের বাংলো চেম্বারের দিকে। অবশিষ্ট পথ বেঁকে গেছে তুত্তুরী আর আমাদের শয়ন কক্ষের দিকে। কোন পথ যে তিনি ধরবেন, কে বলতে পারে। 


জানতে চাইলাম, বন দপ্তরকে খবর দিয়েছ? শৌভিক খানিক মাথা আর দাড়ি চুলকে, কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, " নাহ, সামান্য একটা গোহাড়গিলের জন্য কেন শুধু শুধু আর ওদের জ্বালাব। নীলোৎপল বলেছে, ' স্যার আপনারা বেরিয়ে গেলে,আমি ওকে ঠিক বার করে দুব।" 


 এই না হলে আমার বরের বুদ্ধি। নীলোৎপল বলল, আর উনিও বিশ্বাস করলেন। নীলোৎপল বাংলোর যাবতীয় ঝাড়পোঁচ, বাগান ঝাঁট দেওয়ার কাজ করে। যাই বলা হয় খুব নিষ্ঠা ভরে করে, তাই বলে এই ধুমসো গোসাপকে বার করতে পারে কখনও। ওজনে নীলোৎপলের অর্ধেক হবে ব্যাটা। আপাতত আমার ধমক খেয়ে শান্ত হলেও, একটু আগে যে হারে গজরাচ্ছিল। 


রেগে গিয়ে বললাম, তুমি বন দপ্তরের আধিকারিককে ফোন করবে? নাকি আমি সুকন্যাকে ফোন করব? সুকন্যা বনবিবি কিনা,  বন দপ্তরের সঙ্গেই সহবাস করে। এইসব সমস্যায় আমার নির্ভরযোগ্য ঠিকানা।  আঁতে ঘা লাগল বোধহয় বাবুর, ফোন করলেন স্থানীয় আধিকারিককে, জানা গেল তিনি বদলী হয়ে গেছেন। তবে নতুন আধিকারিকের নম্বরটা দিয়ে দিলেন। তাঁকে মুঠো ফোনে ধরে,নিজের পরিচয় দিয়ে, অতিথির আগমন সমাচার দিতেই, তাঁর প্রথম প্রতিক্রিয়া হল, " ওটাকে রেসকিউ করতে হবে। ওটাকে রেসকিউ করতে হবে। মারবেন না যেন প্লিজ -"। 


মারব কি, আমরা তো শুধু ব্যাটাকে বাথরুম থেকে বার করে বাগানে ছেড়ে দিতে চাই। নেহাৎ নিজেদের সাহসে কুলোচ্ছে না। কে বলে সরকারি দপ্তর নড়ে না, আধা ঘন্টার মধ্যেই বন দপ্তরের লোকজন এত্ত বড় একটা সাঁড়াশি নিয়ে এল, দরজা খুলল, খপ করে ধরে একটা হাতখাঁচায় পুরে নিল। তিনি তখনও আমার ধমক খেয়ে নীরব। জুলজুল করে তাকিয়ে দেখছিল চারিধার। 


বন দপ্তরের লোকজন জানতে চাইল, " স্যার এটাকে নিয়ে কি করব?" আমরা দুজনেই কইলাম,বাগানে ছেড়ে দিতে। কিন্তু কি মনে করে,ওনারা বললেন, "দরকার নেই স্যার, আবার যদি ঢুকে পড়ে। সামনের রাস্তায় ছেড়ে দিচ্ছি, আসে পাশে এত ফাঁকা জায়গা আছে, চলে যাবে।" 


আমাদের চোখের সামনে দিয়ে চলে গেলেন তিনি।  আমরা যুগলে নিঃসন্দেহ ছিলাম, রাস্তায় ছেড়ে দেবার সাথে সাথেই খোকা বাবুর ( নাকি খুকি বিবি) প্রত্যাবর্তন হবে। কিন্তু আমাদের বিশ্বাসকে চূর্ণ বিচূর্ণ করে, তিনি আর ফিরে এলেন নি। শুনেছিলাম গোসাপ থাকলে নাকি সাপ আসে না। কথাটা যে কতবড় সত্যি টের পেলাম কিছু দিনের মধ্যেই। বার তিনেক দেখা মিলল, মাননীয় পন্নগ মহোদয়ের। বুড়ো থপথপে গোহাড়গিলের মত তাঁরা সটাং শৌচাগারে সেঁধালেন না,বরং উঁকি ঝুঁকি মারতে লাগলেন শয়ন কক্ষে। আমার প্রবল বুদ্ধিমতী কন্যা তো, ফালতু তার মনে করে ওমন এক ফণাধরকে টান মেরে ফেলেই দিচ্ছিলেন সম্প্রতি। নেহাৎ অন্তিম মুহূর্তে তিনি চিড়িক করে একটু জিভ বার করেছিলেন,নাহলে যে কি হত, ভেবে আমার মা, পিসি, শাশুড়ির এখনও হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে যায়। 


ব্লিচিং, কার্বলিক অ্যাসিড যাই দাও,ব্যাটাদের ওপর কোন প্রভাব পড়ে না। এই ভাবেই চলছিল, সাপের সাথে লুকোচুরি। হঠাৎ করে আজ সকালে এসে উদয় হলেন ইনি। এবার ইনি যে তিনিই তার কোন প্রত্যক্ষ প্রমাণ নেই। DNA টেস্ট তো আর করিনি রে বাপু, তবে ওই আরকি, শিবরাম চক্রবর্তীর "হর্ষবর্ধন-গোবর্ধন" সিরিজ পড়ে বড় হওয়া আমাদের মন, কেবলই বলে চলছে,  " আবার সে এসেছে ফিরিয়া।"অনির ডাইরি ২৩শে এপ্রিল, ২৯২৪ 

#অনিরডাইরি #কাঁথিরকিস্যা 


সদ্য বিদেয় নিয়েছে শীত, বাতাসে লেগেছে সামান্য উষ্ণতার ছোঁয়া। এই সময়, প্রভাতী সূর্যের আলো মেখে হাঁটতে দারুণ লাগে। ভোর ভোর শ্রীমতী তুত্তুরীকে স্কুলে নামিয়ে, বাগানেই হাঁটছিলাম। হঠাৎ ডাকল শৌভিক, "জলদি একবার ভিতরে আয় -"। 


এই সময়টা সাধারণত স্নানে যায় শৌভিক, আজ আবার কি হল? স্নান না করে, ডাকাডাকি মানেই কিছু অপাট করেছি আমি। কি করলাম রে বাবা, ভাবতে ভাবতে বাড়ির ভিতরে ঢুকে দেখি, বাংলো চেম্বারের লাগোয়া বাথরুমের সামনে কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে আমার বর। মুখে ভেবলে যাওয়া হাসি। নিশ্চিন্ত হলাম, হাসি মুখ যখন,তাহলে ফাঁসি দিবে নি। তবে সেই নিশ্চিন্ত ভাব বেশী ক্ষণ টিকল কই? 


বাথরুমের প্লাস্টিকের দরজাটা বাইরে থেকে বন্ধ, ভিতর থেকে প্রবল দুম - দুম, খচ মচ আওয়াজ আসছে। লতাদি ব্যবহার করে এই বাথরুম টা, হতবাক হয়ে বললাম, "সাত সকালে লতাদিকে বাথরুমে বন্ধ করে দিয়েছিস?" শৌভিকের হাসিটা যেন রবার দিয়ে কেউ মুছে দিল,কপালে পটপট করে পড়ে গেল অনেকগুলো ভাঁজ, নেহাৎ, কলিযুগ - নইলে ভস্ম হয়ে যেতাম নির্ঘাত। 


পিছন থেকে লতা দির গলা ভেসে এল, " আরে আমাকে কেন বন্ধ করবে? বাথরুমে গোসাপ ঢুকছে -"। অ্যাঁ! গোসাপ, আমাদের হাওড়ার ভাষায় গোহাড়গিলে। আছে বটে কয়েকখানা,মাঝে মধ্যে বাগানের পাঁচিল বরাবর গুটগুট করে হেঁটে যায়।  ছাতের জল যাবার নর্দমায় জমিয়ে বসে, ল্যাজ নেড়ে নেড়ে ঝগড়াও করে। কিন্তু বিগত এক দেড় বছরে কোনদিন বাংলোর ভিতরে ঢোকার ধৃষ্টতা দেখায়নি। 


শৌভিক বলল, " চান করতে যাবার আগে ভাবলাম ওয়াশিং মেশিন টা চালিয়ে দিয়ে যাই। জল বেরোনোর পাইপটা বাথরুমে ঢোকাতে দরজা খুলেছি,দেখি কোণাকুণি উল্টো দিকে বসে তিনি ঝিমোচ্ছেন। কাল রাতে বোধহয়, সান শেডের ওপর উঠেছিল পাখি বা কাঠবিড়ালির ছানা খেতে। তাল সামলাতে না পেরে বাথরুমের জানলার খড়খড়ি গলে ভেতরে পড়ে গেছে।" 


বুঝলাম যে পথ দিয়ে পড়েছে, সে পথ আর খুঁজে পায়নি।টাইলস লাগানো দেওয়াল বেয়ে প্রায় সাত ফুট চড়া, ওই ধুমসোর পক্ষে অসম্ভব। সারা রাত চেষ্টা করেছে নির্ঘাত। তারপর ক্লান্ত হয়ে যখন ঘুমাতে গেছে, তখনই আমার বর দরজা খুলে তাকে নতুন আলোর পথ দেখিয়েছে। তিনি আপাতত পূর্ণ বিক্রমে দরজা ভেঙে বেরিয়ে আসতে চাইছেন। যে হারে ধুপধাপ করছেন, এই মান্ধাতার আমলের ফাইবারের দরজা কতক্ষণ টিকবে কে জানে। এক ধমক মেরে আগে তাকে শান্ত করলাম। 


ওনার আব্দার মত দরজা খুলে দিলেও জ্বালা।চৌকাঠ ডিঙালেই শ্যাম বাজারের মত পাঁচ মাথার মোড়ে গিয়ে পড়বে। যার  কোন দিকের রাস্তা গিয়েছে রান্না ঘর, খাবার ঘর, ভাঁড়ার ঘরের দিকে। তো কোনটা শৌভিকের বাংলো চেম্বারের দিকে। অবশিষ্ট পথ বেঁকে গেছে তুত্তুরী আর আমাদের শয়ন কক্ষের দিকে। কোন পথ যে তিনি ধরবেন, কে বলতে পারে। 


জানতে চাইলাম, বন দপ্তরকে খবর দিয়েছ? শৌভিক খানিক মাথা আর দাড়ি চুলকে, কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল, " নাহ, সামান্য একটা গোহাড়গিলের জন্য কেন শুধু শুধু আর ওদের জ্বালাব। নীলোৎপল বলেছে, ' স্যার আপনারা বেরিয়ে গেলে,আমি ওকে ঠিক বার করে দুব।" 


 এই না হলে আমার বরের বুদ্ধি। নীলোৎপল বলল, আর উনিও বিশ্বাস করলেন। নীলোৎপল বাংলোর যাবতীয় ঝাড়পোঁচ, বাগান ঝাঁট দেওয়ার কাজ করে। যাই বলা হয় খুব নিষ্ঠা ভরে করে, তাই বলে এই ধুমসো গোসাপকে বার করতে পারে কখনও। ওজনে নীলোৎপলের অর্ধেক হবে ব্যাটা। আপাতত আমার ধমক খেয়ে শান্ত হলেও, একটু আগে যে হারে গজরাচ্ছিল। 


রেগে গিয়ে বললাম, তুমি বন দপ্তরের আধিকারিককে ফোন করবে? নাকি আমি সুকন্যাকে ফোন করব? সুকন্যা বনবিবি কিনা,  বন দপ্তরের সঙ্গেই সহবাস করে। এইসব সমস্যায় আমার নির্ভরযোগ্য ঠিকানা।  আঁতে ঘা লাগল বোধহয় বাবুর, ফোন করলেন স্থানীয় আধিকারিককে, জানা গেল তিনি বদলী হয়ে গেছেন। তবে নতুন আধিকারিকের নম্বরটা দিয়ে দিলেন। তাঁকে মুঠো ফোনে ধরে,নিজের পরিচয় দিয়ে, অতিথির আগমন সমাচার দিতেই, তাঁর প্রথম প্রতিক্রিয়া হল, " ওটাকে রেসকিউ করতে হবে। ওটাকে রেসকিউ করতে হবে। মারবেন না যেন প্লিজ -"। 


মারব কি, আমরা তো শুধু ব্যাটাকে বাথরুম থেকে বার করে বাগানে ছেড়ে দিতে চাই। নেহাৎ নিজেদের সাহসে কুলোচ্ছে না। কে বলে সরকারি দপ্তর নড়ে না, আধা ঘন্টার মধ্যেই বন দপ্তরের লোকজন এত্ত বড় একটা সাঁড়াশি নিয়ে এল, দরজা খুলল, খপ করে ধরে একটা হাতখাঁচায় পুরে নিল। তিনি তখনও আমার ধমক খেয়ে নীরব। জুলজুল করে তাকিয়ে দেখছিল চারিধার। 


বন দপ্তরের লোকজন জানতে চাইল, " স্যার এটাকে নিয়ে কি করব?" আমরা দুজনেই কইলাম,বাগানে ছেড়ে দিতে। কিন্তু কি মনে করে,ওনারা বললেন, "দরকার নেই স্যার, আবার যদি ঢুকে পড়ে। সামনের রাস্তায় ছেড়ে দিচ্ছি, আসে পাশে এত ফাঁকা জায়গা আছে, চলে যাবে।" 


আমাদের চোখের সামনে দিয়ে চলে গেলেন তিনি।  আমরা যুগলে নিঃসন্দেহ ছিলাম, রাস্তায় ছেড়ে দেবার সাথে সাথেই খোকা বাবুর ( নাকি খুকি বিবি) প্রত্যাবর্তন হবে। কিন্তু আমাদের বিশ্বাসকে চূর্ণ বিচূর্ণ করে, তিনি আর ফিরে এলেন নি। শুনেছিলাম গোসাপ থাকলে নাকি সাপ আসে না। কথাটা যে কতবড় সত্যি টের পেলাম কিছু দিনের মধ্যেই। বার তিনেক দেখা মিলল, মাননীয় পন্নগ মহোদয়ের। বুড়ো থপথপে গোহাড়গিলের মত তাঁরা সটাং শৌচাগারে সেঁধালেন না,বরং উঁকি ঝুঁকি মারতে লাগলেন শয়ন কক্ষে। আমার প্রবল বুদ্ধিমতী কন্যা তো, ফালতু তার মনে করে ওমন এক ফণাধরকে টান মেরে ফেলেই দিচ্ছিলেন সম্প্রতি। নেহাৎ অন্তিম মুহূর্তে তিনি চিড়িক করে একটু জিভ বার করেছিলেন,নাহলে যে কি হত, ভেবে আমার মা, পিসি, শাশুড়ির এখনও হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে যায়। 


ব্লিচিং, কার্বলিক অ্যাসিড যাই দাও,ব্যাটাদের ওপর কোন প্রভাব পড়ে না। এই ভাবেই চলছিল, সাপের সাথে লুকোচুরি। হঠাৎ করে আজ সকালে এসে উদয় হলেন ইনি। এবার ইনি যে তিনিই তার কোন প্রত্যক্ষ প্রমাণ নেই। DNA টেস্ট তো আর করিনি রে বাপু, তবে ওই আরকি, শিবরাম চক্রবর্তীর "হর্ষবর্ধন-গোবর্ধন" সিরিজ পড়ে বড় হওয়া আমাদের মন, কেবলই বলে চলছে,  " আবার সে এসেছে ফিরিয়া।"


অনির ডাইরি ১৯শে এপ্রিল, ২০২৪

#অনিরডাইরি #তাম্রলিপ্তকড়চা 



 " কঁহি তো ইয়ে দিল কভি মিল নেহি পাতে, কঁহি সে নিকল আয়ে জন্মোঁ কে নাতে -"। নবুর আর আমার ক্ষেত্রে এই লাইনটা অব্যর্থ। আমি হাওড়ার মেয়ে, নবুর বাড়ি তমলুক। আর দুজনের দেখা হল কিনা, ভরা গ্রীষ্মে, তৎকালীন ভারতের দীর্ঘতম প্ল্যাটফর্মে। 


বছর সতেরো আগের কথা, আমার চাকরী জীবনের প্রথম পোস্টিং। পেশাদারী মনোভাব আসতে তখনও বাকি বেশ কিছু সময়। একদম ভালো লাগত না চাকরি করতে। প্ল্যাটফর্মে পা রাখলেই মনে হত ফিরতি ট্রেন ধরে বাড়ি ফিরে যাই। হয়তো স্বভাব, অথবা আমার পেশাদারিত্বের অভাব, যে কোন কারণেই হোক, তৎকালীন বড় সাহেব কোন কাজেরই যোগ্য মনে করলেন না আমায়। সকাল থেকে বিকেল গালে হাত দিয়ে বসে থাকি, একটা অপরিচ্ছন্ন, আধা অন্ধকার স্যাঁতস্যাতে ঘরে। যার গাল ভরা নাম, "চেম্বার"। যাবার সময় দাশনগর থেকে একটা টাইমস অফ ইন্ডিয়া কিনে নিয়ে যাই, সারাদিন তাই মুখস্থ করি। এর জন্য দৈনন্দিন সাত আট ঘণ্টার জার্নি, কার পোষায়? 


আমার কম্পিউটার ইন্টারনেট কিচ্ছু নেই, আমার মোবাইল বলতে বোতাম টেপা পুঁচকে রিলায়েন্সের CDMA ফোন। রেডিও চলত বটে কিন্তু মেরেকেটে উলুবেড়িয়া পর্যন্ত। কি যে অপরিসীম যাতনায় কাটছিল দিনগুলো।  তারওপর লোকাল ট্রেনে নিত্য যাত্রা। "একটু সরে বসুন" বলতেও গলা শুকিয়ে যায়। যাতায়াত শুরু করার দিন দুই তিনের মধ্যেই প্রত্যক্ষ করলাম, এই সরে-নড়ে বসাকে কেন্দ্র করে এক মাঝবয়সী নিত্যযাত্রিনী সপাটে চড় কষালেন একটি অল্পবয়সী মেয়ের গালে। বাবা গো!


আরো কুঁকড়ে গেলাম আমি। আরো নত হল শির, আরো বেঁকলো শিরদাঁড়া। এমনি এক আঁকাবাঁকা দিনে হঠাৎ করে গায়ে পড়েই ভাব জমালো নবু। দিন দুয়েক ধরে লক্ষ্য করছিলাম বটে, লেডিজ কামরায় এক নতুন মুখ, কিন্তু ভাব জমানোর দুঃসাহস হয়নি। আলাপ হতে দেখলাম মেয়েটা মন্দ নয়। বরং বেশ ভালোই। দেখলাম প্রায় সব ব্যাপারেই দুজনে মোটামুটি সম মানসিকতাসম্পন্ন। দেখলাম একই ট্রেনে যাতায়াত করি দুজনে, এমনকি দুজনের কর্মস্থল ও পাশাপাশি।চেহারাও দুজনের গোলগাল, দুজনেই ভোজন বিলাসী,  দুজনেই বকবক করতে ভালোবাসি, সবথেকে বড় কথা দুজনেই নতুন এই শহরে। 


ভাব জমতে দেরী হল না। বিভীষিকার ট্রেন যাত্রা দেখতে দেখতে হয়ে উঠল চূড়ান্ত মনোরঞ্জক। ওই যে বললাম, উভয়েই খাদ্যরসিক, আমরা যেন ট্রেনে উঠতামই খাবার জন্য। মুখ না চললে আড্ডা জমে নাকি? মায়েরা এদিকে ভরপেট ডাল ভাত খাইয়ে পাঠাত, ব্যাগে ভর্তি টিফিন, ফল দিত, তাতে কি? ওগুলো আবার মানুষেখায়? টিফিন ফেলে, আমরা খুঁজতাম দশ টাকায় দশটা পুঁচকে মুসম্বি, মরশুমের সবেদা, জালে বাঁধা নারকেল কুল, ডাব, ঝালমুড়ি, কাঠি গজা, কুচো গজা,  কুচো পান্তুয়া, দিলখুশ, বাদাম চাক,মদন কটকটি, পাশকুড়ার চপ এবং  চা। অচীরেই আরও দুজন বাড়ল আমাদের টিমে, নিয়তি কাকিমা আর নন্দিতা দি। দুই চূড়ান্ত বর্ণময় চরিত্র। 


প্রসঙ্গত নিয়তি কাকিমাই হলেন সেই থাপ্পড় কষানো মহিলা। সামান্য রগচটা ছিলেন বটে, কি ভাবে যেন আমাদের দুজনকে অন্ধের মত ভালোবেসে ফেললেন। BSNL এ চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী ছিলেন কাকিমা, যে কোন দপ্তরী বিষয়ে ওনার জ্ঞান ছিল বাঁধিয়ে রাখার মত। একবার কি কারণে যেন ট্রেন ভয়াবহ লেট। সবাই অফিস পৌঁছলাম সাড়ে বারোটার পর। সবাইকে হাফ সিএল আবেদন করতে হল। বাকি অর্ধেক দিবস অফিস করে, নবু, আমি, নন্দিতা দি তো জমায়েত হলাম খড়গপুর স্টেশনে, কাকিমার পাত্তা নেই। ফোন ও লাগে না। শেষে বাধ্য হয়ে ওকে ছাড়াই রওনা দিলাম আমরা। পরদিন যাবার ট্রেনে আবার কাকিমার সাথে দেখা, আমরা হই হই করে উঠলাম, কাল কোথায় ছিলে? কোন ট্রেন ধরলে? অফিসে কি খুব বকা খেলে ইত্যাদি প্রভৃতি। জুত করে বসে কাকিমা বললেন," আর বলিস নি। নতুন সাহেব হেব্বি কড়া।  আপিসে ঢুকতেই বলল, এটা অফিস আসার সময়? যান হাফ সিএল এর আবেদন করুন।  তাই করলাম। হাফ সিএল দিয়ে বেরিয়ে পড়লাম।" 


মাঝে মাঝে কাকিমা খাওয়াত। শুধু আমাদের নয়, প্রায় অর্ধেক লেডিজ কামরাকে। সবাই দীর্ঘ দিনের নিত্য যাত্রী,সবাই পুরাণ বন্ধু। সবাই টুকটাক খাওয়াত। কাকিমা যেদিন খাওয়াতেন, সবার জন্য মোচার চপ,আমাদের জন্য ডিমের চপ। কিন্তু সেটা বাকিদের বলাও যাবে না,দেখানো ও যাবে না। ডিম দেখা গেলেই কাকিমার রক্ত চক্ষু দেখতে হবে। সর্বোপরি বাকিরা কি ভাববে, ভয়ে গরম গোটা ডিমটা গালে পুরে বসে থাকতাম আমরা। 


আর নন্দিতাদির কথা যে কি বলি, প্রায় পাহাড়ের মত চেহারা ছিল নন্দিতাদির। চাঁদ পানা মুখ, বড় বড় এক জোড়া চোখ, মাছি বসলে পিছলে যায় এমন মসৃণ ত্বক। কাঁধ পর্যন্ত ছাঁটা রেশমী কালো চুল। সকালের ট্রেন পাঁশকুড়া ছাড়ালেই লেডিজ কামরা ফাঁকা হয়ে যেত, তখন সিটের ওপর পা মুড়ে বসে বাবা রামদেবের শেখানো প্রাণায়াম শুরু করতো নন্দিতাদি। বলতো রোজ নাকি ২৫ গ্রাম করে ওজন কমছে। দেখতে দেখতে শিল্পা শেট্টির মত হয়ে যাবে নন্দিতা দি। 


কেন যে শিল্পা হতে চাইত কে জানে। কে বলে মোটা মেয়েদের কোন আবেদন থাকে না? বিশাল মোটা হওয়া সত্ত্বেও নন্দিতাদির যে কত, কত শত অনুরাগী ছিল তার ইয়াত্তা নেই। কেউ ব্যাগ বয়ে দেয়, তো কেউ বাতাস করে। কেউ জুস খাওয়ায়, তো কেউ চা। লোকালের লেডিজ কামরায় অতটা খেলতে পারত না নন্দিনী দি। কিন্তু আরণ্যকে যেদিন ফিরতাম আমরা, মাঝে মাঝেই আধ গ্লাস চা খেয়ে বলতো, "এই সুজন খাবে?" সুজন নাম্নী ভদ্রলোক বিনা আপত্তিতে ওই আধ গ্লাস চা নিত আর খেয়েও ফেলত। কাকিমা দাঁত কিড়মিড় করে বলতো, " মরণ" আর নবু বলতো, "ওয়াক"। 


নিন্দুকে  বলত নন্দিতাদির হাতের মোটা সোনার বালাটা ওমনি কোন স্তাবকের দেওয়া উপহার।  প্রসঙ্গত এক্ষেত্রে নিন্দুক অর্থাৎ নিয়তি কাকিমা খোদ। কাকিমা এবং নন্দিতাদি কেউই কাউকে সহ্য করতে পারত না। দুজনেই একে অপরের অসাক্ষাতে, বিষ উগরে দিত অন্যজনের নামে। আর সাক্ষাতে গলা জড়াজড়ি করে গান গাইত, " -আবার দেখা যদি হল সখা, প্রাণের মাঝে আয়।"  কপাল চাপড়ে  বিড়বিড় করত নবু, " ওরে তোদের কি প্রেম রে" । 


 ভালো সময় কেন যে এত স্বল্প স্থায়ী হয়। আমাদের দৈনন্দিন অফিস যাওয়া,আমাদের অনন্ত আড্ডা, একসাথে ইমেল আইডি, অরকুট একাউন্ট খোলা, কাকিমার কাছে ঝগড়া, নন্দিতাদির কাছে বাৎস্যায়ন শিক্ষা, আমাদের  পার্ক হোটেলে আড্ডা, পুরাতন বাজারের নিউ রেস্টুরেন্টের ২৫ টাকায় আট পিস মাটন ( খেয়ে বেরিয়ে নিয়তি কাকিমা বলতো নির্ঘাত পাঁঠি খাইয়েছে),বোগদার বিস্কুটের মত ভাজা মোগলাই পরোটা, সকাল বাজারের ঘন বাদাম লস্যি, রেলওয়ে পার্কের পিকনিক- সব ফেলে  একদিন বিয়ে করে চেন্নাই চলে গেল নবু। জীবন হয়ে পড়ল আবার বিবর্ণ।ফাঁকা হয়ে গেল আমাদের লেডিজ কামরা, আরো ধুলি মলিন হয়ে পড়ল শহরটা, আরো অসহ্য হয়ে উঠল অফিসটা।


"এতো আকছার ঘটে, সাদা কালো লং শটে- "। এমনই ভেবে নিয়েছিলাম আমি। আমাকে তো আসতেই হবে এ পথে, পেয়ে যাব আবার নবুর মতই কাউকে। জমে উঠবে আবার আমাদের আড্ডা।অতই যদি সহজ হত জীবন। আরো আড়াই বছর থাকতে হয়েছিল ওই আপিসে, যাতায়াত করতে হয়েছিল ওই পথেই, কাউকে পাইনি নবুর মত। হয়তো নবুও কাউকে পায়নি আমার মতো। তাই না এত বছর বাদেও এত দূরে থেকেও মানসিক ভাবে এতটা বেঁধে আছি আমরা। আজও পাশাপাশি বসলে মনে হয়, কই সময় তো এগোয়নি। এই তো এখুনি এসে হাজির হবে কাকিমা, তার পিছু পিছু নন্দিতা দি। তারপরই জমে উঠবে আমাদের আড্ডা। ঠিক সতেরো বছর আগের মত। কে জানে, দৈনিক ২৫ গ্রাম করে কমতে কমতে, এতদিনে হয়তো সত্যিই শিল্পা শেঠি হয়ে গেছে নন্দিতা দি। বললেই হেসে গড়িয়ে পড়ে নবু, তারপর মুখ ঝামটে বলে, " তুই থাম।"

অনির ডাইরি ১৩ই এপ্রিল, ২০২৪ 

#অনিরডাইরি 



জানলার বাইরে নিকষ আঁধার। দূরে নিম গাছের মাথার ওপর জ্বলজ্বল করছে ঈদের বাঁকা চাঁদ। দূরে কোথাও বৃষ্টি হয়েছে নির্ঘাত, বাতাসে কেমন যেন হালকা হিমেল আমেজ। আশ মিটিয়ে ফুটেছে বেল আর কামিনী। খোলা জানলার ফাঁক গলে আসা হাওয়ায় চড়া ফুলেল সৌরভ। এই জন্যই বোধহয় বাতাসের আরেক নাম গন্ধবহ। 


এত সুন্দর পরিবেশ আর এমন মোহক প্রকৃতি, কিন্তু কিছুই যেন স্পর্শ করছে না আমায়। হৃদয় জুড়ে বিষাদের অন্ধকূপ। সদ্য মাতৃহারা হয়েছে জনৈক সহেলী। “মা চলে গেল রে---- আমার সব শেষ হয়ে গেল অনি-”-কয়েক ঘণ্টা আগে শোনা প্রিয়বন্ধুর মর্মান্তিক বিলাপ কিছুতেই ভুলতে পারছি না যেন। 


"কি রে, ঘর অন্ধকার করে ভূতের মত বসে আছিস কেন?" শৌভিকের কণ্ঠস্বরে চমকে উঠি, বেদনার কারণ ওর অজ্ঞাত নয়। তবে ছেলেদের শোকের প্রকাশ বড় কম। সমাজ সেটাই শেখায় যে। পুরুষ মানে সিংহ। হৃদয় বিদীর্ণ হোক, দায়িত্ব পালনে যেন কোন ত্রুটি না হয়। আলো না জ্বালিয়ে মিনিট দুয়েক পায়চারি করল শৌভিক, তারপর শুধাল, " গান শুনবি?" কয়েক মুহূর্তের মধ্যে ঘর ভেসে গেল এলভিসের মধু ঢালা কণ্ঠ, " As the river flows, surely to the sea-"। আমাদের বিয়ের আগের রাতে এই গানের কয়েকটা লাইন লিখে পাঠিয়েছিল শৌভিক। আমি এমন পণ্ডিত, যে ভেবেছিলাম ওগুলো বুঝি আমার জন্যই লেখা। 


চুপচাপ শুনছিলাম দুজনে, হঠাৎ শৌভিক বলল, " মিক জ্যাগার মানে স্যার মিক জ্যাগার, একবার বলেছিলেন, ' ঈশ্বর যদি কখনও আমাদের সাথে কথা বলেন, তাহলে নির্ঘাত তাঁর কন্ঠস্বর এলভিসের মতোই হবে।' অথচ এই লোকটা মাত্র ৪২ বছর বয়সে কি মর্মান্তিক ভাবেই না মারা যায়। এমনিতেই শেষের দিকে মানসিক অবসাদে ভুগতেন। একে বিটলসের উত্থান, তারপর বব ডিলান তো ছিলেনই। একদিন পড়ে গেলেন বাথ রুমে। মাথায় এমন চোট লাগল, যে মাথার বেশ কিছু টিস্যু আলাদা হয়ে গেল। তারপর থেকে কি যে হল, শরীরের সব অঙ্গ প্রত্যঙ্গ ফুলে যেতে লাগল। চরম অনাচার ও করতেন। প্রাসাদোপম বাড়ি গ্রেসল্যান্ড, একাই থাকতেন, খেতেন কেবল চীজ বার্গার আর কোক। আর কিচ্ছু না। পড়েও ছিল এমন এক ডাক্তারের পাল্লায় যে ওনার মৃত্যুর আগের সাত মাসে ৭৫৬টা ইনজেকশন আর ৫৩০০ বড়ি প্রেসক্রাইব করেছিল।" 


আঁতকে উঠি আমি, " এতো জীবন্ত গিনিপিগ বানিয়ে ফেলেছিল লোকটাকে।" বিষণ্ন ভাবে মাথা নাড়ে শৌভিক। বলে, "এর ফলে ওনার মারাত্মক কোষ্ঠ কাঠিন্য হয়। মলত্যাগ করতে বসে এমন চাপ দেন, যে হার্ট ফেল করে যায়। মারা যাবার অনেক পরে he was discovered with his pants down." এতক্ষণের পাথর চাপা বেদনা, হৃদপিণ্ডের ভালভ ঠেলে উঠে আসতে চায় গলার কাছে। অসহ্য বেদনায় শিউরে ওঠে স্বর তন্ত্রী। অন্য কি যেন গান চালায় শৌভিক। 


অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলাম, গায়ে হাত দিয়ে ডাকল শৌভিক," তুই তারাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা পড়ছিলি না, কদিন আগে?" পড়ছিলাম বটে। পড়তে দিয়েছিল সুকন্যা। জোর করে ব্যাগে ভরে দিয়েছিল আগের বার যখন কলকাতা গিয়েছিলাম। এই কিন্ডলের যুগেও, বই চালাচালি আমাদের প্রায়ই হয়। শৌভিক বলে চলে, "কাকতালীয়ই বটে, আজকালের মধ্যেই তারাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়কে নিয়ে একটা লেখা পড়লাম। আমাদের সার্ভিসেরই এক অবসর প্রাপ্ত ভদ্রলোকের লেখা। উনি যখন ব্যারাকপুরে পোস্টেড ছিলেন, তারাদাস বাবুর সাথে অত্যন্ত সুসম্পর্ক ছিল। প্রায়ই আড্ডা দিতেন দুজনে। এমনি এক আড্ডায় তারাদাস বাবু বলেছিলেন, ' জানেন, বাবা (বিভূতিভূষণ) যখন মারা যান, আমার বয়স তিন বছর।' 


শৌভিককে থামিয়ে বলে উঠি, তাই বোধহয় যে কটা গল্প পড়লাম, কোন গল্পেই বাবার কথা নেই। কোন চরিত্রেরই বাবাকে নিয়ে তেমন কিছু লেখেননি। " হবে হয়তো," বলে শৌভিক, তারাদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের জবানীতে ফিরে যায়, " বাবা যখন মারা যাচ্ছে, মানে আমার তো কিছু মনে নেই, শুনেছি আর কি, যে মা বাবাকে জিজ্ঞাসা করেছিল, ' হ্যাঁ গো, তুমি চলে গেলে, আমাদের চলবে কি করে? আমরা খাব কি?' বাবা মৃত্যু শয্যায় বলেছিল, ' কেন তোমার বড় ছেলেকে রেখে গেলাম যে। ওই তোমাকে দেখবে।' মা তাজ্জব হয়ে বলেছিল, "বড় ছোট কি? আমার তো একটাই ছেলে, তার বয়স সবে তিন। সে কি করে সংসার টানবে?" বাবা হেসে বলেছিল, " কেন? অপূর্ব রইল তো।" বিশ্বাস করুন,বাবা মারা যাবার পর থেকেই ধীরে ধীরে পথের পাঁচালীর বিক্রি বাড়তে লাগল। পরে মাণিক বাবু যখন পথের পাঁচালী বানালেন বিক্রি আরও বেড়ে গেল। মাণিক বাবুর সৌজন্যে যেটা হল, পথের পাঁচালীর পাশাপাশি অপরাজিতও লোকে পড়তে লাগল। ফলে ওটারও বিক্রি বাড়ল। ওর জন্য দেখতে দেখতে আরণ্যক, দেবযান ইত্যাদি বইয়েরও বিক্রি বেড়ে গেল। রয়ালটির পয়সাতেই দিব্য চলে গেল আমাদের। কিভাবে বলেছিল জানি না, কিন্তু অপূর্ব একাই প্রায় ২৫/২৬ বছর আমাদের সংসারটা টেনে দিল, সত্যিই বাবার বড় ছেলে হয়ে -। " 


এতক্ষণ গলার কাছে জমাট বাঁধা ব্যথা ঝরঝর করে ঝরে পড়ল দুই চোখ, দুই গাল বেয়ে। জোরে জোরে ফোঁপাতে লাগলাম আমি, চোখের সামনে ভেসে ভেসে যেতে লাগলেন ফোকলা নুয়ে পড়া ইন্দির ঠাকরুন, হরিহর, সর্বজয়া, দুর্গা, অপু আর নিশ্চিন্দিপুরের খেলার মাঠ। যেখানে থোকা থোকা কাশ ফোটে। আর সেই কাশের বুক চিরে এক রাশ মেঘের মত ধোঁয়া ছেড়ে কু ঝিকঝিক করতে করতে ছুটে যায় স্বপ্নের রেলগাড়ি। 


মুখ ঝামটে বললাম, শত্তুর, শত্তুর! দিব্য একা একা কষ্ট পাচ্ছিলাম, তাও তো সহনীয় ছিল। গান শোনাতে ডেকে, সে কষ্ট বহুগুণ বাড়িয়ে দিল। ইচ্ছে করে, খুঁজে খুঁজে এই সব গল্প বলছে, যাতে কষ্ট বাড়ে। টকের জ্বালায় পালিয়ে এসে, তেঁতুল তলায় বাস করা হয়ে গেল আমার। উঠে চলে যাব বলে দরজা অবধি গেলাম ও, ওদিকে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় গান ধরলেন, " চৈত্রপবনে মম চিত্তবনে বাণীমঞ্জরী সঞ্চলিতা- ওগো ললিতা"। শৌভিক বলল "নাহ্ জমছে না। বড় বাবুরটা চালাই বরং।" শৌভিক বলল, "এই গানটা শুনে যা - ।"


গান ধরলেন দেবব্রত বিশ্বাস। একই সুর, একই কথা, একই গান। তবু যেন আলাদা। তবু যেন ব্যতিক্রম। এতক্ষণের উগ্র শোকের ওপর সামান্য হলেও যেন পড়ল যতি চিহ্ন। মুঠো ফোনটা আমার হাতে দিয়ে শৌভিক দেখাল, "দেখ একাই গাইছেন, বাড়িতে হারমোনিয়াম বাজিয়ে।" অবাক হয়ে ভাবি, কে রেকর্ড করেছিল, কিভাবেই বা করেছিল। তখন তো মোবাইল ক্যামেরার যুগ ছিল না, যে সবাই ডিজিটাল ক্রিয়েটর।


ভাবতে ভাবতে কি মনে হয়, জিজ্ঞাসা করি, রবি ঠাকুর ওনার গান শুনে গিয়েছিলেন। শৌভিক কি যেন ভাবে তারপর বলে, " এটা নিয়ে একটা মজার গল্প পড়েছিলাম। বোস বলছি। একবার ওনাকে, মানে দেবব্রত বিশ্বাসকে নাগরিক সম্বর্ধনা দেওয়া হয়েছিল। তাতে ওনার হাতে মানপত্র তুলে দেন হেমন্ত মুখোপাধ্যায় খোদ। সেই সভায় দেবব্রত বিশ্বাস বলেন, যে উনি রবীন্দ্রনাথকে চিনতেন ব্রাহ্ম সমাজের 'রবি বাবু' বলে। ওনার জবানিতে, " মাঝে মাঝে রবি বাবু আসতেন আমাদের সমাজের সভায়। এসে কি যে গাইতেন,ঘুম পেয়ে যেত। তো একবার হয়েছে কি, আমার এক বন্ধু বলল, ' চলো শান্তিনিকেতনের বসন্তোৎসব দেখে আসি। সে বিশ্বভারতীরই ছাত্র।গেলাম তার সাথে। প্রার্থনার জন্য উপাসনা গৃহে সমবেত হয়েছি সবাই, দেখি ভিড়ের মধ্যে রবি বাবুও রয়েছেন। বললাম বন্ধুকে, ' আরে আমাদের সমাজের রবিবাবুও এসেছেন দেখি।" বন্ধু তো ভিরমি খাবার যোগাড়। বলে, "আরে গোটা বিশ্বভারতীই তো ওনার। উনিই তো রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।"


সেই রবীন্দ্র সঙ্গীতের সাথে আমার পরিচয়। তারপর গান শিখতে গেলাম ইন্দিরা দেবী চৌধুরাণীর কাছে। তিনি দুটি গান শিখিয়েছিলেন, একটা কি ভুলে গেছি, অন্যটা "সংকোচের এই বিহ্বলতা"। সংকোচের এই বিহ্বলতা খারাপ লাগেনি। বেশ একটা মার্চিং টিউনের মত লেগেছিল। প্রথম রেকর্ড ওটাই করি। তবে রবীন্দ্র সঙ্গীতের সাথে আমার গাঁটছড়া বেঁধে দিলেন আমার দুই ঈশ্বর, পঙ্কজ মল্লিক আর কানন বালা।" 


শুনতে শুনতে কখন যেন প্রলেপ পড়েছে ক্ষতের ওপর। শুকিয়ে গেছে চোখের জলও। থেমে গেছেন দেবব্রত বিশ্বাস ও। কানায় কানায় পূর্ণ হয়েছে হৃদয়ের ডালি। 'ব্রাহ্ম সমাজের রবি বাবু'র কথা ভেবে অধরের কোণে ফুটে উঠেছে একফালি হাসিও। দম ফেলে শৌভিক বলল, " আর গান না শুনলেও হয়। সিনেমা দেখবি? কাল তো তুত্তুরীর স্কুল ছুটি। ভোরে ওঠার তাড়া নেই।" গররাজি হয়ে জানতে চাই কি সিনেমা, জবাব আসে, " শ্রী স্বপন কুমারের বাদামী হায়নার কবলে।" এরপরের সময়টুকু শুধুই আফশোস আর হাত কামড়ানোর। কেন যে রাজি হলাম সিনেমাটা দেখতে। তবে সে তো অন্য গল্প।

অনির ডাইরি ৯ই এপ্রিল, ২০২৪

#অনিরডাইরি #তাম্রলিপ্তকড়চা 



ইফতার শব্দটা আজকাল লিখতে বড় ভয় লাগে। কে জানে কার কোন ভাবাবেগে আঘাত লাগে। বড় বেশি যেন আঞ্চলিক- সাম্প্রদায়িক হয়ে পড়েছি আমরা। কেউ যেন কাউকে দেখতে পারি না। সোশ্যাল মিডিয়া খুললেই কেবল কাদা ছোঁড়াছুঁড়ি, দম বন্ধ হয়ে আসে। কত যে অঢেল সময় এই নেটিজেনদের হাতে। 


মোরা ছাপোষা লেবার। এত জটিলতা কি আর মোদের মাথায় ঢোকে। আমরা তো বসে থাকি, কবে মাহে রমজান আসে আর হক বাবু রোজা রাখা শুরু করেন। আর আমরা শুরু করি মোদের ইফতার থুড়ি জলযোগের পরিকল্পনা। হক বাবু নিজেই নিরস্ত করেন, "একটু শেষের দিকে করুন ম্যাডাম, ফলের দামটাও একটু কমবে।" বেশ, শেষের দিকেই সই, কিন্তু মুস্কিল হল, মাস শেষ হবার আগেই যে নির্বাচনী নির্ঘণ্ট ঘোষণা হয়ে গেল। সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়ল নির্বাচনী নিত্যকর্মে। তাহলে কি এবার আর আমাদের ইফতার পার্টি হবে নি?


তা আবার হয় নাকি। আমাদের সবার সব অনুষ্ঠানে সবার আগে অংশ নেন হক বাবু। সে যোশুয়ার ক্রিসমাস হোক বা আমাদের দীপাবলী। এই তো সেদিন আমাদের বসন্তোৎসব ছিল, বারবার বলা হল এবার আর আপনাকে থাকতে হবে নি। কি প্রাণান্তকর গরমটাই না পড়েছে, "তিনটে বাজলে বাড়ি চলে যান হক বাবু।" গেলেন কেমন? শেষ মুহূর্ত অবধি সব কিছুর তদারক করে গেলেন। সবার হাতে সিন্নির বাটি, ঘোলের গ্লাস তুলে দিলেন। যারা যারা ভালোবেসে রং মাখাতে গেল, কাউকে নিরস্ত করলেন না। শেষে থাকতে না পেরে পৌনে ছটার সময় আমি জিজ্ঞাসা করেই ফেললাম, আজ রোজা রাখেননি নাকি হক বাবু? জবাব এল, "রেখেছি তো ম্যাডাম। এই বেরোব। রাস্তায় রোজা ভেঙে নেব ক্ষণ।"


এহেন হক বাবুর ইফতার কি আর ছোটখাট ভাবে হয়। মুস্কিল হল অন্যান্য অনুষ্ঠানে বাজার করার কাজটাও হকবাবু নিজেই করেন, এবার তো আর ওণাকে বলা যায় না। ইন্সপেক্টররাও সব ব্লকে। টিফিন টাইমে অরূপকে নিয়ে ফল কিনতে বেরোল রবি। অবস্থা দেখে হক বাবু বললেন," ম্যাডাম আমিও যাই। ওরা যে কি কিনবে-"।


ইফতার মানে তো শুধু ফল নয়, যতদূর জানি কিছু ভাজাভুজি ও থাকে। থাকে আদা আর ছোলাও। কে যেন বলল," একটু আখের গুড় ও আনব ম্যাডাম?" কেন রে বাবা হক বাবু মুগুর ভাঁজবেন নাকি? বুঝলাম কেন ফল কিনতে হক বাবু খোদ গেলেন। সাড়ে পাঁচটার ঘন্টা পড়ার সাথে সাথে‌ শুরু হয়ে গেল ফল কাটা। প্লাস্টিকের বালতিতে ঘোল বানাতে বসল বেদজ্যোতি। দই, কাজু, কিশমিশ মেশানো অমৃত। ৪০ টাকা দিয়ে এক চাঁই বরফ কিনে নিয়ে এল শান্তনু।নিখুঁত হাতে সব কিছু মিশিয়ে ওপর থেকে হালকা করে কোকো পাউডার ছড়িয়ে দিল বেদজ্যোতি। লস্যিতে কোকো? প্রথমে নাক সিঁটকালেও, শেষ হয়ে যাবার পর হেব্বি দুঃখ হচ্ছিল। গেলাম ও কাগজের গ্লাস হাতে যদি আরো খানেক পাওয়া যায়, দেখি বালতি উল্টে খেয়ে নিয়েছে ব্যাটারা। 


সন্ধ্যা গাঢ় হবার সাথে সাথেই বিভিন্ন ব্লক থেকে একে একে এসে উপস্থিত হতে লাগল ইন্সপেক্টর - CKCO রা।  এসে গেলেন আমাদের বড় সাহেবও। ততক্ষণে পোশাক বদলে ফেলেছেন হক বাবু। স্যারকে দেখে বিগলিত হয়ে বললেন, " স্যার আপনি আসায় আমি যে কি খুশি হয়েছি -"। খুশি আমরাও, এবার প্রতীক্ষা সেই মাহেন্দ্রক্ষণের, কখন রোজা ভাববেন হক বাবু। তার আগে নতজানু হয়ে প্রার্থনা করবেন হক বাবু। সেই প্রার্থনায় যেমন থাকবে ওনার পরিবার - প্রিয়জন, তেমনি থাকবে এই আপিস আর আপিসের লোকজনও। থাকবে এই পোড়া দেশও। আহা বড় জ্বালা এই দেশের, পদে পদে বৈচিত্র্য। এত রকম বিবিধতা নিয়ে পথ চলা কি মুখের কথা। তাও যে টিকে আছে, সে কেবল আমাদের দেশ বলেই না। বড় উর্বর এই দেশের মাটি, আবাদ করলেই সোনা ফলে। তার সুযোগ নিয়েই ঘৃণা চাষ করতে নেমেছে একদল মানুষ, যাদের কেউ স্বদেশী, কেউ বা বিদেশী। ওরা জানে না, ওরা বোঝে না, ঘৃণার চাষ আগেও করার চেষ্টা করেছিল যেন কারা। গাল ভরা নাম দিয়েছিল, " divide and rule",  তখন তাদের সাম্রাজ্যে সূর্য অস্ত যেত না, আজ সে সাম্রাজ্য খুঁজতে অনুবীক্ষণ যন্ত্র লাগে।

অনির ডাইরি ৮ই এপ্রিল, ২০২৪

#অনিরডাইরি #কাঁথিরকিস্যা 



মিটিংয়ের মাঝে হঠাৎ তেনার ফোন,একরাশ উত্তেজনা গিলে তিনি কইলেন,‘ হ্যালো মা! ব্যস্ত আছ?“ কাজের কথা শেষ হয়ে গেছে একটু আগেই, এখন আসন্ন নির্বাচন নিয়ে উত্তপ্ত বাদানুবাদ চলছে, সেটাই গোগ্রাসে গিলছিলাম। তবু মেয়ের ফোন বলে কথা, আর তিনি তো সচরাচর আপিস টাইমে ফোন করেন না। নির্ঘাত গুরুতর কিছু, তাই বললাম,‘ তেমন না। বল-। ’


প্রায় লাফাতে লাফাতে তিনি বললেন,‘জানো আমার ঘরে সাপ ঢুকেছিল!’ শুনে এমন ‘অ্যাঁ’ বলে চিৎকার করলাম আমি, সম্মুখের যুযুধান সব পক্ষ সাময়িক ভাবে ঘাবড়ে চুপ করে গেল। শ্রীমতী তুত্তুরী অবশ্য সরব রইলেন,‘ হ্যাঁ গো মা। আমি স্কুল থেকে ফিরে পোশাক বদলাব বলে জানলা বন্ধ করতে গেছি, দেখি বাইরে থেকে একটা তার ভিতরে ঢুকে ঝুলছে। আমি চিৎকার করে মাসিকে জিজ্ঞাসা করলাম, জানলায় কোন কাজ হয়েছে কিনা। মাসি তখন আমার জন্য ঘোল বানাচ্ছিল, শুনতে পেল না বোধহয়। ভাবলাম তারটাকে জানলা দিয়ে বাইরে বার করে দি। ওমা যেই হাত দিতে গেছি অমনি চিড়িক করে জিভ বার করেছে। আমি তো সঙ্গে সঙ্গে বাবা গো বলে এক লাফ -।”


 এই অবধি শুনে আমার হৃদপিণ্ডটাই প্রায় গলার কাছে উঠে এল বুঝি। কন্যা যথারীতি অদম্য, তিনি বলে চলেন,‘ আমার চিৎকার শুনে মাসি আর শঙ্কর কাকু( কেয়ারটেকার) দৌড়ে এল। ওরা কত খটখট, হ্যাটহ্যাট,ভাগভাগ করল সে ব্যাটা আর নড়েই না। শেষে বাবাকে ফোন করলাম। বাবা বলল, ‘একটু অপেক্ষা করে দেখ, নিজেই সটকে পড়বে।’ আরও পনেরো বিশ মিনিট ধরে সম্মিলিত চিৎকারেও যখন কিছু হল না। তখন বাবাকে বললাম এবার কি একটু বন দপ্তরকে খবর দেবে? মিনিট দশেকের মধ্যেই ওণারা এলেন এই এত্তবড় সাঁড়াশির মত একটা যন্ত্র নিয়ে আর ওটাকে ধরে নিয়ে চলে গেল।’ 


ঘাম দিয়ে জ্বর ছাড়ল, বললাম,‘ যাক শান্তি।’ মেয়েটা যে ঐ পরিস্থিতিতেও মাথা ঠাণ্ডা রেখে সর্প কাণ্ড সামলাতে পেরেছে তার জন্য অভিনন্দন জানাতে গেলাম, তিনি দুঃখী দুঃখী স্বরে বললেন,‘ কিন্তু আমার জন্য ও বাস্তুচ্যুত  হল মমি -’।