Sunday, 26 March 2023

অনির ডাইরি ৭ই মার্চ ২০২৩

 


 আজ মায়ের জন্মদিন।  কাগজে কলমে কিন্তু আজ না, জানুয়ারী মাসের তিরিশ তারিখে মায়ের জন্মদিন। এরকম কেন? প্রশ্ন করলেই মা বলে,“ভূতের আবার জম্মবার। ” ভূত অর্থাৎ অদৃশ্য কোন জীব, হ্যাঁ তাই তো থেকেছে মা বরাবর, অদৃশ্য,আত্মগোপনকারী, পিছনের সারিতে মুখ লুকিয়ে বসা আনস্মার্ট চাকচিক্যহীন প্রাণী। যাদের কেউ হিসেবে ধরে না। যারা স্বপ্নেও আশা করেন না, ঝকমকে লাইমলাইট কখনও এসে পড়বে তাঁদেরও ওপর। অথচ তাঁদের জীবন নিয়েই রচিত হয় আধুনিক রূপকথা। 


আপাতদৃষ্টিতে মায়ের গল্পের শুরুতে নতুনত্ব তেমন কিছুই নেই, সদ্য বিভক্ত- দাঙ্গা বিধ্বস্ত স্বাধীন ভারতবর্ষে জন্মানো, ৫০-৬০এর দশকে বড় হওয়া আর পাঁচটা মেয়ের মতই একই গতানুগতিক ছন্দে বাঁধা শৈশব। সুদূর মুর্শিদাবাদে দুকূল ছাপানো ভাগীরথীর তীরে, ঘন সবুজ ধান-পাট-মুসুরি খেত আর ঐতিহাসিক আমবাগানে ঘেরা গণ্ডগ্রাম রামনগর। 


সেখানে ঘোষেদের বিশাল যৌথ পরিবার, পরিবারের মাথা, মায়ের ঠাকুমা হরিমতী দেবী ছিলেন বড়ই জাঁদরেল। দাদু এবং দিদা, হরিমতী দেবীর আতঙ্কে থরহরি কম্প। দাদু থাকতেন কলকাতার মেসে। সপ্তাহান্তে ট্রাঙ্ক হাতে পাড়ি দিতেন দেশে। বাড়ি যখন ঢুকতেন তখন আমবাগানের মাথার ওপর জ্বলজ্বল করত রামনগরের চাঁদ। ঝিঁঝি পোকাদের কলতানে দূর থেকে সানন্দে যোগদান করত শৃগালের দল। সেই শুনে খ্যাঁকখ্যাঁক করে উঠত স্থানীয় সারমেয় কুল। অকুল আঁধারে টেমটেমির আলো জ্বেলে বসে ঢুলত অভুক্ত দিদা। মেয়েরা কখন ঘুমিয়ে কাদা।দাদুর বড় দুঃখ হত। কেন জেগে থাকে না মেয়েরা? কি করে জাগিয়ে রাখা যায় চার কন্যাকে?


 দাদু অঙ্কে ছিলেন মাত্রাতিরিক্ত দক্ষ, দশ ক্লাশের পরীক্ষায় পাওয়া শংসা পত্র, যত্ন করে রেখেছিল দিদা অনেকদিন। জীবনের অঙ্কে অবশ্য দাদু ছিল বরাবর কাঁচা। না হলে,৬০এর দশকে নিছক মায়ের(হরিমতী দেবী) শখ মেটাতে কেউ কষ্টার্জিত অর্থ ব্যয় করে বানায় দোতলা মাটির কেল্লা? 

তো যাই হোক বড় দুঃখ দাদুর, মানসিক অঙ্ক করেই চলেন, কি করে জাগিয়ে রাখা যায়, মেয়েদের?শেষে দিদার কাছে আব্দার  করলেন, যেদিন উনি আসবেন, সেদিন কিছু যেন স্পেশাল রান্না করে দিদা, গভীর রাতে ক্লান্ত দেহে এমন বেঢপ আব্দার শুনে মুখ ঝামটাতেন আমার সাধাসিধে নিরীহ দিদা। মধ্যবিত্তের আবার ইসপেশাল কি হয়? রোজই তো থোড়-বড়ি-খাড়া। হোক না তবুও কিছু-। দাদু বলতেন,“আমি যেদিন আসব, তুমি বরং শুধু সেদিনই ডাল রেঁধো। তাহলে মেয়েরা ভাববে, আজ বাবা আসবে, আজ ডাল হবে!” বলেছিলাম না,বড় সরল,  জীবনের অঙ্কে বড় কাঁচা ছিলেন দাদু। 


মায়ের ভয়ে কোনদিন বউ মেয়েদের কোথাও ঘুরতে নিয়ে যাননি। বড় বেড়ানোর শখ ছিল দিদার। মাথায় ছোট্ট খাট্টো দিদা আর তালগাছের মত ঢ্যাঙা দাদুর ভাঙা ঘরে চাঁদের আলো। হঠাৎ একদিন সাহস করে পুরীর টিকিট কেটেই ফেললেন দাদু। ভয়ে ভয়ে সপ্তাহান্তে বাড়ি ফিরে হরিমতী দেবীকে বললেন,“শীলু খুব বায়না করছিল। ঐ টাকা জমিয়েছিল। ” শীলু অর্থৎ শিউলি অর্থাৎ আমার মা। বয়স— বছর বারো। সেই বোধহয় প্রথম এবং শেষ বার দাদুর মিথ্যা বলা। অতঃপর? হাওড়া ইস্টিশন থেকে কু ঝিকঝিক-দৌড়াল স্বপ্নের রেল। শ্রীক্ষেত্রে পদার্পণ করলেন সবৎসা সদানন্দ এবং সুনীতি রাণী ঘোষ। প্রথম সমুদ্র দেখা। প্রথম বাঁধন ছেঁড়া খুশি ভাসিয়ে নিয়ে গেল মা-মাসিদের শৈশব। 


স্থায়ী হল কোথায়? টুক্ করে একদিন চলে গেলেন দাদু। একটা ছোট্ট স্ট্রোক বদলে দিল জীবন। মা তখন নবম শ্রেণী, মায়ের সদ্য শাড়ি।  

 বড় মাসির বাড়িতে একটা বাঁধানো সাদাকালো ছবি ছিল,ফুলে ঢাকা দাদুর শরীর ঘিরে দাঁড়িয়ে-বসে দিদা আর তার চার মেয়ে আর একমাত্র জামাই,আমার বড় মেসোমশাই। সকলের চোখে অসীম শূণ্যতা আর অসহায়তা।থমথম করছে শোক। ব্যতিক্রম শুধু ছোট মাসি। আহাঃ বড়ই ছোট ছিল গো। দিদার কোল থেকে নামতে চাইত না। তখন ঐ ধরণের ছবি তোলার রেওয়াজ ছিল। 


সাদা থান পরা দিদাকে দেখে, জনৈক আত্মীয় নাকি বলছিলেন,“তোমায় খারাপ লাগছে না, বুঝলে। ” হাউহাউ করে কেঁদে উঠেছিল সেদিন কিশোরী মা আর মাসিরা। সদ্য সাদা শাড়িপরা মা, যে কোন সন্তানের কাছে বিভীষিকা। এই চূড়ান্ত অসময়ে কি বলছে এরা? সমাজ এত নিষ্ঠুর? 

চোখ মুছে আমার স্বল্প শিক্ষিত, সাড়ে চারফুটের দিদা তার পিতৃহারা মেয়েদের বলেছিল,“একদম কাঁদবি না। আজ থেকে আমিই তোদের মা- আমিই বাবা। আমি যতদিন না মরছি, কেউ কাঁদবি না। ” 


বিমুখ-লোলুপ-পলায়নপর আত্মীয়গোষ্ঠীর ভিড়ে একা প্রহ্লাদ ছিলেন আমার বড় মেশোমশাই স্বর্গীয় অজিত সিংহ। জন্মসূত্রে বিদ্যাসাগরের দেশ ঘাটালের অধিবাসী। স্বভাবেও অনেকটা একই। বাহ্যিক আবেগ ছিটেফোঁটাও ছিল না,ছিল শুধু অটল কর্তব্যপরায়ণতা। অন্তরে, স্নেহের কাঙাল ছিলেন “মেশোই”।  এই নামেই ডাকতাম। আরএমএস এর ছাপোষা বেতনে হাওড়া শহরে বাসা ভাড়া করে পরিবার পালন করতে দম বেরিয়ে যেত- তবু পিছপা হননি দায়িত্ব নিতে। মেশোই এর নির্দেশে একাকী পলাশী স্টেশন থেকে লালগোলা এক্সপ্রেসে হাওড়া পাড়ি দিল সেদিন কিশোরী মা। শিয়ালদায় প্রতীক্ষারত মেশোই, মায়ের ভাষায় দু নম্বর বাবা। সত্যজিৎ রায় বা মৃণাল সেনের সাদাকালো ছবির মত, কয়লার ইঞ্জিনে টানা ট্রেন একরাশ ধোঁয়া উড়িয়ে পৌঁছাল মহানগরে। মেশোই বলল,“এসেছিস! চা খাবি?” “হ্যাঁ জামাইবাবু। ” মাটির খুড়িতে চা খেতে খেতে মেশোই বলল,“চাটা পুড়ে গেছে বল? কেমন যেন পোড়া পোড়া গন্ধ। ” আবার মাথা নাড়ল মা,“হ্যাঁ জামাইবাবু। আপনাকে ঠকিয়েছে। পোড়া চা। ” ঠকাস্ করে পড়ল গাঁট্টা,“ভজহরি! এটাকে বলে কফি। বুঝেছিস। ”মেশোইয়ের প্রিয় শব্দ ভজহরি। সকলেই ভজহরি। যেমন আমি বলি অপদার্থ। 


এরপর শুরু হল আসল জীবন সংগ্রাম। অন্নচিন্তা চমৎকারা। মা এবং তার বোনেদের জীবন চরিত নিয়ে তিনখানা উপন্যাস লেখা যায়। একজোড়া শাড়ি আর এক জোড়া চপ্পল নিয়ে যুদ্ধ জয় করেছে আমার দিদার মেয়েরা। উপার্জনের জন্য মধ্য হাওড়া থেকে হাঁটতে হাঁটতে বড় বাজার গেছে টিউশ্যনি করতে, শিখেছে হিন্দি টাইপ। পাঁচ দশ পয়সার বিনিময়ে পোস্ট অফিসের বাইরে বসে খাম পোস্টকার্ড- মানি অর্ডার লিখেছে তবু হাল ছাড়েনি সদানন্দ ঘোষের মেয়েরা। এক্সট্রা ডিপার্টমেন্টাল হয়ে পোস্ট অফিসে ঢুকে নিরন্তর পড়াশোনা আর পরীক্ষা দিয়ে নিজস্ব শিক্ষাগত যোগ্যতার সেরা পদে উঠে সসম্মানে অবসর নিয়েছে মা। তাও আজ বারো বছর হয়ে গেল। পেয়েছে অগণিত মানুষের ভালোবাসা। যৌথ চাটুজ্জে পরিবারের মেজ বউ হয়ে, কোমর বেঁধে সামলেছে যাবতীয় দায়দায়িত্ব কর্তব্য। 

কি অমানুষিক পরিশ্রম করত মা, ভোর পাঁচটা থেকে রাত এগারোটা সাড়ে এগারোটা অবধি ছুটেই যেত মা। 

শরীর ভাঙছিল অনেকদিন ধরেই। অম্বল- গরহজম-থাইরয়েড-প্রেশার- হাড় ক্ষয়ে যাওয়ার ব্যামোর পাশাপাশি, ২০১৩ সালে যুক্ত হল লো সোডিয়াম আর অ্যাকিউট ডিপ্রেশন। বেশ কটাদিন হাসপাতালে কাটিয়ে যখন বাড়ি ফিরল মা, ততোদিনে  ভুলে গেছে সবকিছু, চিনতে পারছিল না সেই পাঁচদিন বয়স থেকে বুকে করে মানুষ করা প্রাণাধিকা তুত্তুরীকে, তখনও মা ভোলেনি, মায়ের গায়ের রঙ কালো। মা ভোলেনি, কালো মেয়ে মানেই অসুন্দর, ভোলেনি গাঁয়ের মেয়ে মানেই আনস্মার্ট আর গাঁইয়া, ভোলেনি চাকরী করা মেয়ে মানেই গৃহকর্মে ঢ্যাঁড়শ। 


  কিছু কিছু ক্ষত বোধহয় এমন গভীর হয়, যা কখনও সারে না। সেদিনের দামী হাসপাতালের নামী মানসিক রোগবিশেষজ্ঞ বলেছিলেন,“ব্রেনের কিছু সেল শুকিয়ে আসছে। ওষুধে আপাতঃ  সারলেও ধীরে ধীরে বাড়বে এই  ভুলে যাবার প্রবণতা। ধীরে ধীরে আক্রমণ করবে অ্যালঝাইমার্স। ভুলে যাবেন সবকিছুই। ” 

ডাক্তারের ভবিষ্যৎ বাণীকে ভুল প্রমাণ করে আজ দশ বছর বাদেও দিব্যি আছে মা। হ্যাঁ ভুলে যায় খুবই, আমরা কাছাকাছি থাকি না বলে ভোগে চূড়ান্ত নিরাপত্তাহীনতায়। 


এই নিরাপত্তাহীনতার জন্যই ২০২১ সালে মস্ত বড় বিপদ বাঁধিয়েছিল মা, ঈশ্বরের অশেষ আশীর্বাদ যে সেই বিপদ থেকে মাকে আমি বার করে আনতে পেরেছি। বাকি জীবনটুকুও যাতে মাকে ভালো রাখতে পারি, এটাই আপাতত ঈশ্বরের কাছে আমার একমাত্র প্রার্থনা। প্রতিটা সফল পুরুষের পিছনে যেমন থাকেন একজন অবগুণ্ঠনবতী, তেমনি প্রতিটি নারীর সফল হয়ে ওঠার পিছনেও থাকে একাধিক পুরুষের অবদান। মায়ের জীবনের প্রথম পুরুষ, আমার স্বর্গীয় বড় মেসোমশাই। দ্বিতীয় পুরুষ আমার বাবা, তৃতীয় পুরুষ, যেন আমি হয়ে উঠতে পারি।

No comments:

Post a Comment