Wednesday 25 March 2020

অনির ডাইরি ২৫শে মার্চ, ২০২০


সেই বউটার কথা খুব মনে পড়ছে। নাঃ আমার সাথে প্রত্যক্ষ আলাপ নেই। আমি তার গল্প শুনেছি। শিয়ালদা মেন লাইনের কোন প্রত্যন্ত স্টেশনে বাড়ি মেয়েটার।  ঘরে অসুস্থ স্বামী। ছোট বাচ্ছা। স্বামী হঠাৎ শয্যাশায়ী হয়ে পড়ায়, অকস্মাৎ পেটের ধান্ধায় বেরিয়ে পড়েছিল মেয়েটা। রাজমিস্ত্রির  জোগাড়ের কাজ করে। সকাল সকাল রান্না সেরে,বর-বাচ্ছার খাবার গুছিয়ে বেরিয়ে পড়ে। গন্তব্য- বিধাননগর রোড স্টেশন। স্টেশনের আসেপাশেই, পুরুষ-নারী নির্বিশেষে জমায়েত হয়, এই রকম কাজের ধান্ধায় ঘোরা অদক্ষ শ্রমিকের দল। ঘোরে কন্ট্রাক্টরের লোকজন। পুরুষদের কাজও বেশী আর রোজও। মেয়েদের কাজ পেতে গেলে চুকাতে হয় অন্য মূল্য। অভ্যাস হয়ে গেছে মেয়েটার। ওর ভাষায়, “কাজ পেতে গেলে কাপড় খুলতে হবে। ” কোনদিন দেরী হয়ে যায়। ট্রেন মিস করে। দৌড়ে এসে দেখে, ময়দান শুনশান। কাজে চলে গেছে সব। প্রথম প্রথম ভেঙে পড়ত মেয়েটা। টাকা না নিয়ে বাড়ি গেলে খাবে কি? ঘরে ফেরার ট্রেন থেকে নেমেই বাজার করতে দৌড়য় মেয়েটা। দরদস্তুর করে বাজার করে নিয়ে যায়,তবে তো হাঁড়ি চড়ে। এখন আর ভাঙে না। জানে ফাঁকা ময়দানে ঘোরে আড়কাঠি। কখনও কখনও খরিদ্দার সোজাসুজি কথা বলে নিয়ে যায়। প্রশ্নকর্তা জিজ্ঞাসা করেছিল, এই ভাবে প্রত্যক্ষ দেহব্যবসা করতে সঙ্কোচ বা  লজ্জা বোধহয় কি না। মেয়েটা একই কথা বলেছিল, হিসাব খুব সোজা, একজন অদক্ষ মহিলা শ্রমিককে কাজ পেতে গেলে কাপড় খুলতেই হবে। সংসারটাতো চলছে-।
এখন কি করছে মেয়েটা কে জানে? কেই বা ভাবে ও বা ওদের মত মেয়েদের কথা। গোটা দেশ আপাততঃ মত্ত কোভিড আর করোণাকে নিয়ে। ব্যস্ত সোশাল ডিসট্যান্সিং আর “সমাজ কে দুশমন” ঠেকবাজদের নিয়ে। আপনি বাঁচলে বাপের নাম, একটু খারাপই না হয় থাকুক, খারাপ মেয়েরা। 

তুত্তুরী উবাচ, ২৫শে মার্চ, ২০২০

  তুত্তুরী উবাচ, ২৫শে মার্চ, ২০২০
 🧔🏻-এই! সক্কাল সক্কাল প্যাঁ-পো, প্যাঁ-পো বন্ধ কর।
🙍🏻‍♀️- তাহলে ও কি করবে? পরীক্ষা শেষ। সারাদিন ঘরে বসে আছে। একটু বাঁশিও বাজাতে পারবে না? যা বাবু বারন্দায় গিয়ে বাজা। সারা বিল্ডিংএর লোককে উত্যক্ত  কর।
👧🏻-(বারন্দায় গিয়ে বেশ খানিক প্যাঁ-পো করার পর) মা। মা। কুকুরটা- 🐕
🙍🏻‍♀️-(প্রবল হাসি চেপে) কুকুরটা তোর বাঁশি শুনে কি বলল?😝
👧🏻-  কেলেটাতো🐕 শুয়েই রইল। নড়লই না। লেলেটা🐩 এল বটে, তবে আমার বাঁশি শুনল না। (প্রসঙ্গতঃ আপাতত আমাদের কোঅপারেটিভে দুইটি নেড়িই রাজত্ব করে। একটির গাত্র বর্ণ কালো। তাই তার নাম কেলে🐕। আরেকটির পাঁশুটে লাল।🐩 তিনি লেলে। তুত্তুরীর মতে কেলে আর লেলে স্বামী-স্ত্রী। লেলেটা রীতিমত খাণ্ডারনি। কেলেটাকে দেখলেই চমকায়। আর কেলেটা অশান্তি এড়াতে, সিকিউরিটির ঘরের পিছনে মনখারাপ করে শুয়ে থাকে। আজও যেমন তুত্তুরীর বাঁশি শুনেও নড়েনি।) জানো মা, লেলেটা না নিজের তলার লোকটাকে খুব ভালোবাসে। একজায়গায় দেখলাম ওরা ময়লা জমিয়ে রেখেছিল, লেলেটা খুঁজে খুঁজে প্লাস্টিক এনে ওখানে জমা করছে। আমি ধমকালাম, “এই কি করছিস?” তখন আমার দিকে তাকিয়ে, বসে পড়ে একটা প্লাস্টিককে ছিঁড়তে লাগল। ও খুব বাজে- 🐕‍😔

Monday 23 March 2020

অনির ডাইরি ২৩শে মার্চ, ২০২০


বাপরে কি ডানপিটে বুড়ো। গোটা দেশ ভয়ে জড়সড়, অাকাল লেগেছে বাজারে। জনতা কার্ফুর মধ্যেই বিশাল তালিকা নিয়ে প্রস্তুত ঝানু বাজারুরা, আর আমার বৃদ্ধ বলে কি না, “আমার কিসের অভাব?” লকডাউনকে থোড়াই ডরায় আমার বাবা। যৌবনে লড়াই করেছিল সম্পদের সমবন্টনের দাবীতে, অপ্রয়োজনে দ্রব্যসামগ্রী গুদামজাত করাকে ততোটাই ঘৃণা করে, যতটা কালোবাজারী। যে কোন সমস্যার সরল সমাধান মজুত আছে আমার বৃদ্ধের কাছে, “থাকলে ভাত খাব। না থাকলে ফ্যান খেয়ে থাকব-”। 
ইশ এই উদ্দামতা বা দুঃসাহস যদি আমার থাকত-। নেই যখন, তখন বাধ্য হই আঙুল বেঁকাতে। কথায় কথায় জানতে পারি,ফুরিয়েছে চায়ের ব্যাগ, দুধওয়ালা বলেছে আগামী সাতদিনের জন্য গৃহবন্দী থাকবে সে ও। তুলনায় শ্বশুরমশাই বরাবরই স্পষ্টবক্তা এবং বাস্তববাদী। অনেক ভেবে চিন্তে তাঁর আব্দার একটাই, চিনি ছাড়া গুঁড়ো চিনি। “যদি পারিস। তোর মা দই দিয়ে মেখে খেতে বড় ভালোবাসে-”। অধৈর্য হয়ে ওঠে শৌভিক, আর কিছু না? চাল-ডাল- আনাজপাতি- তেল- সাবান? ফেলু মিত্তির-তপসে মিত্তির হয়ে কৌটো-চুপড়ি হাঁটকে দেখা যায়, মার্চ মাসের সাথে সাথেই ফুরিয়ে এসেছে অনেক খাদ্যসামগ্রীই। গুছিয়ে বলতে পারে না, শৌভিকের বৃদ্ধ-বৃদ্ধা। থতমত খায়। বয়স নুইয়ে দেয় ঋজুতম শিরদাঁড়াকেও।
জনতা কার্ফু কাটতেই, দুটো ছালা নিয়ে বাজারে যাই আমরা। ভালো করে তখনও ফোটে না আলো। বাজারে লেগেছে আকাল। গরুড়ের মত মাস্ক পরা নরনারীর দল, বিধিনিষেধ ভুলে ঝাঁপিয়ে পড়তে চায়-।  আমাদের যে ফিরিস্তি অনেক লম্বা। তিন-তিনখানা পরিবারের প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি খুব কম কিছু তো নয়। বুড়ো অবাঙালী দোকানী ফুটিয়ে দেয় অনিয়মিত খরিদ্দারদের। শৌভিক তার নয়নমণি, রোজই অফিস ফেরৎ ঢুঁ মারে যে। আর আমি? নয়নকাঁটা বলতে পারেন। যেটাই আমি চাই, গম্ভীর মুখে শুনি, “নাই, নাই।” ওকে ছেড়ে বিগ বাস্কেট ধরেছিলাম যে। বেইমান অনলাইন শপিং সাইটের দল, অর্ডার তো নেবে। কবে দেবে প্রশ্ন করলেই জুটছে  --।
এবার যাত্রা আপিস পথে- নইলে আক্ষরিক অর্থেই বেতন পাবে না কেউ। সই হয়নি যে বেতনের বিল। পথে আসে না না ফোন। “আমরা কেন বন্ধ করব এজ্ঞে? অমুক সাহেব আমার মামা হয়-”।  অথবা, “ম্যাডাম, মালিক কারখানা বন্ধ করবে না বলছে। আমাদের কি করোণা হতে পারে না? বন্ধ করান আইজ্ঞা-”।  কাউকে নরম ভাবে বোঝাতে হয়, “ আপনাদের কারখানার ছাড় আছে মশাই। আমি নিরুপায়।” কাউকে বা দেখাতে হয় ভয়। বন্ধ করবেন না বলব বড় সাহেবকে? পাঠাব নাকি ইন্সপেক্টর?
ফাঁকা পথ। রেললাইনের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা মৃত ট্রেনের দেহাংশ। বন্ধ সারি সারি দোকানপাট। আগল খোলা দোকানে ভিড় জমানো মানুষ। ছোট্ট বাজার ব্যাগ হাতে নিঃসঙ্গ বৃদ্ধ বা বৃদ্ধা। কারো মুখ মাস্কে ঢাকা। কারো তাও নয়। সদ্য হাঁটতে শেখা বাচ্ছার মুখে মাস্ক লাগিয়ে, হাত ধরে বাজারে বেরিয়েছে মা। মাস্ক পরা চাওয়ালা। মাস্ক নামানো খরিদ্দার। 
হাতে সাবান দিয়ে ঢুকতে হয় জেলাশাসকের করণে। ভেজা তোয়ালে এগিয়ে দেয় জনৈক অস্থায়ী কর্মী। পাগল নাকি? ঐতে হাত মুছি, আর ইয়ে হোক আমার। মন খারাপ হয়ে যায় অলিন্দে লাগানো সাধের গাছগুলোকে দেখে। লকডাউনে কে জল দেবে এদের?
অজিত দা নাকি আসবে। অাপিসই অজিত দার ঘরবাড়ি। গোটা চাকরী জীবনে চারদিন মাত্র ছুটি নিয়ে ছিলেন, দুদিন নিজের বিয়ের জন্য আর একটা করে দুই মেয়ের বিয়ের দিন। কালেক্টরেট অচল এই কর্মঠ বৃদ্ধকে ছাড়া। রীতিমত মাস্ক পরে, পকেটে স্যানিটাইজার নিয়ে টার্মিনেটর সেজে দৌড়ন অজিত দা। নজর রাখেন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে। নজর রাখি আমরাও। কত হল? গতকাল রাতেও আক্রান্তের সংখ্যা ছিল ৩৬৫। এখন কত? ৪০০?৪৩৫? এই দোদুল্যমানতার মধ্যেই শেষ হয় দিনটা। ফোন করে তুত্তুরী, “বাড়ি এস মা।” আকাশ ভেঙে তখন শিলাবৃষ্টি।

Sunday 22 March 2020

বেণী ও সখা



-নমস্কার  স্যার।
-আবার তুমি?
-আজ্ঞে।
- দেখ বাপু, তুমি যা চাও তা অসম্ভব। দিব্য তো আছো, খাচ্ছো,দাচ্ছো, ঘুরে বেড়াচ্ছ-- তোমার মনের মত মরসুম এখানে। আজ তো দেখছি সকাল থেকে ঘুড়ি ওড়াচ্ছিলে, বেশ তো আছো, তা এই বদ খেয়ালটা কি মাথায় না এলেই নয়????
-ভাল আছি স্যার। এটা হক কথা। যেদিন যা খেতে চাই খেতে পাই। যা পড়তে ইচ্ছে হয় পড়তে পারি। যেমন আজ এই রেড ইন্ডিয়ান ওয়ার বনেটটা পড়েছি---
-ঐ ভয়ানক দর্শন জিনিসটার নাম ওয়ার বনেট নাকি?
-হ্যাঁ স্যার।  রঙ বেরঙের পাখির পালক দিয়ে--
-তা এ তোমার কি সাজ বাপু? খালি গায়ে ধুতিটাকে লুঙ্গির মত পড়ে মাথায় ঐ কিম্ভুতকিমাকার টুপি পরে ঘুড়ি ওড়াচ্ছ?
- ভালো লাগে না স্যার।  কিছু ভালো লাগে না।
- একা লাগে বুঝি? তা আসে পাশের লোকজনের ওখান থেকে তো একটু আধটু ঘুরে আসতে পারো।
-  কি হবে স্যার? সেদিন গিয়েছিলাম প্রমথেশ বড়ুয়া  সাহেবের ওখানে। গোটাটাই সেট। উনি একাই অভিনয় করে যাচ্ছেন।  মাঝে মাঝে নিজে নিজেই ডাইরেক্টর হয়ে যাচ্ছেন। ক্যামেরার পিছনরথেকে প্রচণ্ড ধমক দিচ্ছেন নিজেকে---আবার কখনও গান গাইছেন-কাল্পনিক নায়িকার হাত ধরে। ওনার গলায় খেলা ভাঙার খেলা গানটা আমার খুউউউব পছন্দের--- কত অনুরোধ করলাম দেখলেনই না।
-হুঁ। প্রমথেশের স্বর্গ ঐ রকমই। সিনেমা আর গানই তো ছিল ওর জীবন। আর একটা জিনিসও ছিল অবশ্য। তবে এখানে ওসব খেলে কিছু হয় না, যতক্ষণ  না তুমি নিজে মদমত্ত হতে চাইছ।
-স্যার আমার অনুরোধটা একবার বিবেচনা করে দেখুন স্যার-প্লিইইইইজজজ।
-আরে ধুৎ। মানুষ নীচে থেকে ওপরে আসে--, যে যা করেছে সেই হিসেবে।  কিন্তু ওপর থেকে কেউ নীচে যায়? কেউ গেছে কোনদিনও?
-স্যার। প্লিজ। আপনি চাইলেই পারেন---
-পারি না রে বাবা। এখানে সব নিয়মে চলে। আমিও। ব্যতিক্রম মানেই প্রলয়-- ওটা শিউজীর জুরিসডিক্সন। আমার নয়।
-স্যার, আমি জানি, মা বলত- কলি যুগের শেষে আপনি পৃথিবীতে যাবেন, কালো ঘোড়ায় চেপে হাতে তরবারি নিয়ে---
-কালো ঘোড়া? তাই কি? সাদা শুনেছিলাম যেন? নাকি বাদামি?যাই হোক,কলি তো এখনও শেষ হয়নি বাবা।  সব পারমানবিক বোমা গুলো আগে তোমরা দমাদ্দম ফাটাও, আর আমাকেও মানুষ হয়ে জন্মাতে হবে। আমার মায়ের নাম হবে সুমতি--হেঃ হেঃ দেখছ বাপু সব মনে আছে। তুমি আবার জন্ম নিতেও তো চাও না?
-না স্যার।  না । আমাকে এই অবস্থায় পাঠান স্যার। কিছু কাজ বাকি রয়ে গেছে--_কিছু হিসাব চোকাতে হবে।
-জানো দেবদূতেরা তোমাদের কি বলে? রোমহীন বাঁদরের দল। মরা লোকের আবার হিসেব নিকেশ। ও সব চিত্রর হাতে ছেড়ে দাও। ও সবার সব হিসাব রাখে। সেই মোতাবেক নোটশীট দেয়, ফাইল তোলে। যেমন তুমি--তোমার ফাইল আমায় দিল। কিন্তু তোমায় তো কিছুতেই খুশি করা যায় না বাপু। সুচরিতার মত সুন্দরী অপ্সরাকেও তুমি দিদি বলে ভয় দেখিয়েছো।
-স্যার। প্লিজ। একবার যেতে দিন। একটিবার স্যার। আপনিও তো কাউকে ভালবেসেছিলেন---
-কাউকে কি হে?বল কাকে নয়? দেবী,দেবদূতী,অপ্সরা-- কে নেই। আমি হলাম দ্বাপরের কেষ্ট। কলির নয়।
-আর শ্রীরাধিকা?কি হল স্যার?গম্ভীর হয়ে গেলেন যে? মনে পড়ে তার কথা? যদি তাকে আপনার কাছে থেকে বলপূর্বক  সরিয়ে নেয় কেউ? তার সামনে আপনাকে পিটিয়ে থেঁতলে খুন করে? আর মরার আগে দেখেন যে কেউ তাকে জবরদস্তি ----তিষ্ট প্রভু তিষ্ট। যা শুনেই আপনার এই অবস্থা, আমি তা সয়েই এখানে এসেছি। আমায় যেতে দিন প্রভু। যেতে দিন।
-বেশ। দিলাম। কিন্তু এখানকার নিয়ম বড় কড়া। তোমাকে আমার মধ্যে বিলীন হতে হবে। আমি মর্তে পৌছলে তবে তুমি মুক্ত হতে পারবে। শুধু মনে রেখ মর্তে আমি তোমার কোন কাজে আসব না। কারণ আমার দৈব শক্তি ত্যাগ করে তবেই যেতে পারব। যা করবে, তোমাকে নিজের জোরেই করতে হবে। রাজি?
-রাজি প্রভু। রাজি।
-দয়া করে আবার মরো না। মরলেই লাইনে দাঁড়াতে হবে, চিত্রগুপ্তর সামনে আসতে হবে। আর চিত্রটা মহা হারামজাদা।
বেণী ও সখা- (part 2)
বিশাল শুষ্ক উপকূল।   রূপালী বালি মোড়া। সময়টা সন্ধ্যার কিছু আগে, সূর্য সদ্য অস্ত গেছে আবার সন্ধ্যার অন্ধকার ও নামেনি। জনা চার পাঁচ জেলে তাদের জেলে ডিঙি গুলিকে নিরাপদ স্থানে রেখে পাশে বসে বিড়ির ধোঁয়া সহ দুদণ্ড জিরিয়ে নিচ্ছে। হঠাৎ একজন চিৎকার করে উঠল, সমুদ্রের বুক থেকে উঠে আসছে এক ছায়া মূর্তি। আবছায়া তেও স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে সে দীর্ঘ দেহী। ঋজু টানটান চেহারা। মাথায় বেশ লম্বা, ভেজা চুল, কাঁধের ওপর লেপ্টে আছে। ওরা দৌড়ে গেল। আগন্তক বেশ কালো। শ্যাম বর্ণ যাকে বলে। পাথরে কোঁদা চোখ, নাক, চেহারা। পরনে মালকোঁচা মেরে পড়া ধুতি। কানে সোনার মাকড়ি। কোমরে একটা বাঁশি। ডান বাহুতে একটি বিশাল ময়ূরের পালকের উল্কি। যা ঐ প্রায়ান্ধকারেও জ্বলমান । আগন্তুক হাসল। দুই গালে গভীর টোল পড়ল। পুরুষ মানুষ এত সুদর্শন  এত মোহময় হতে পারে? বাকরুদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়েছিল ওরা। হঠাৎ  আগন্তক এক জনের দিকে ভিজে আঙুল তুলে বলল,“তুমি। দূরে থাক। স্বাদবদলের কোন শখ নেই বৎস ইয়ে মানে বাছাধন। ”লোকটি ভূত দেখার মত চমকে গেল, তারপর ছুটে পালিয়ে গেল। বাকিরা তখনও মন্ত্রমুগ্ধ । আগন্তুক একটি ধারালো ছুরি চাইল আর জানতে চাইল, “ রণছোড়দাসের বড় মন্দিরটা কতদূর?”

বেশ কয়েকঘন্টা পর, রাত গাঢ় হয়ে এসেছে, হু হু হাওয়া দিচ্ছে, লোকগুলি চলে গেছে, আগন্তুক ধারালো ছুরি দিয়ে নিজের বাঁ হাতের ওপর এক গভীর দাগ কাটল। জ্বলন্ত লাভার মত উজ্জ্বল লালচে সোনালী রক্ত ফিনকি দিয়ে বেরিয়ে নীচে বালিতে পড়তে লাগল। মুহূর্তমধ্যে  দেখা গেল এক মাঝারি উচ্চতার সাদামাটা দেখতে বছর তিরিশের ছেলে আগন্তুকের পায়ের কাছে হাত জোড় করে বসে আছে। “প্রভু। ”
“বেণী”।
“ধন্যবাদ স্যার। ”
“কিসের ধন্যবাদ হে? তোমার বাড়ি তো সেই সুদূর বাংলা। এটা যে গুজরাত সে খেয়াল আছে? ”
“গুজরাত?কেন প্রভু?”
“এটা, বন্ধ কর। হয় প্রভু বল। নয় স্যার। নয় তো আমার এত নাম, তার একটা ধরে ডাকো।”
“গুজরাত কেন দীনু?”
“দীনু? দীনবন্ধু?ওটা তো তেত্রিশ কোটির যে কোন কাউকেই বলা যায় রে ভাই? আর গুজরাত হবে নাতো কোথায় হবে? আমার বাড়িই তো ছিল এখানে। দ্বারকা?সমুদ্র বেটা হিংসুটে । কতবার যে গিলে নিয়েছে আমার শহর, কিন্তু আবার গজিয়ে উঠেছে--- আমার দ্বারকা। তাই আর কি--”
“সেন্টু দিও না সখা। এবার আমি বাংলায় ফিরব কি করে শুনি? কপর্দকশূন্য অবস্থায়?

“উড়োজাহাজে করে। আর সখা বলেই ডাক। দীনু কেমন যেন বুড়োটে নাম। ”
“হাওয়াই জাহাজের পয়সা কি আমার বাপ দেবে? তোমায় তো উল্টো করে ঝাড়লেও কিছু বেরোবে না। ”
“তোমার বাপ একটা ছিঁচকে কালোবাজারী চোর ছিল। এখন নরকে পচছে। তার ভরসা করে লাভ নেই। কে বলল আমার টাকা নেই? এত যে মন্দির আমার জন্য, এতটাকা ভেট পরে সেসব কার?”
“সেগুলো তোমার জন্য ওরা সাজিয়ে রেখেছে-চল নি। ”
“ব্যঙ্গ করছ? চল। কোথায় কোন মন্দিরের কোন গর্ভগৃহে কি লুকোন আছে তুমি জানো না বেণী। আমি জানি। কোন মহন্তের কোন বাড়ির কোন সিন্দুকে আমাকে দেওয়া কোন জিনিস লুকোন আছে তুমি জানো না---। কি যেন বলে আগে আগে দেখো কি খেলা দেখাই---কোন খেলা যে খেলব কখন-- ”

বেণী ও সখা (পর্ব ৩) -
রাডিশন ব্লু হোটেল, দ্বারকা। দরজায় খটখট করল বেণী। তারপর ইতস্ততঃ করে নব ঘুরিয়ে প্রবেশ করল,“সখা?”
 “হুঁ?” অন্যমনস্ক ভাবে জবাব দিল সখা। হাতে একটা ঝাঁ চকচকে আই প্যাড।পাশে খুলে রাখা ল্যাপটপ, তার পাশে মূল্যবান মোবাইল ফোন। সখার  পরনে ব্রান্ডেড্ ঢোলা পাজামা আর গোল গলা টি শার্ট। খাটের সামনে দুটো তুলতুলে নরম জুতো খোলা আছে। ঢলঢলে পোশাক ভেদ করে ভিতরের পেশীবহুল সুগঠিত শরীরের প্রতিটি বিভঙ্গ বেশ সুস্পষ্ট । এক মাথা ঝাঁকড়া অবাধ্য চুল, মুখে চোখে ঝাঁপিয়ে পড়ছে, ঋজু চৌকো  চোয়াল, হাসলে গালে টোল পড়ে, সখা যে এত রূপবান তা আজ বেণী প্রথম খেয়াল করল। সাধে শ্রীচৈতন্যদেব সখার প্রেমে উন্মাদী হয়েছিলেন? বেণীর মনে হল, সে ও সখার প্রেমে পড়েছে। এ অন্য প্রেম, কাম বিবর্জিত। এ প্রেমে মানুষ হারিয়ে যেতে চায়, মিশে যেতে চায় দয়িতের সঙ্গে। বেণীর ইচ্ছে করছে সখার পদতলে গিয়ে বসে, আলতো করে মাথাটা নামিয়ে আনে সখার শ্রীচরণে। বেণী শুধু বলল,“আই লাভ ইউ । ”
সখা করুণ হেসে বলল,“বেসো না। আমি বড় অপয়া সখা। যে যখন আমায় ভালবেসেছে শুধু কষ্টই পেয়েছে। রাধা-রুক্ষ্মিণী-অর্জুন-অভিমন্যু-মীরা এমন কি হালের শ্রীচৈতন্য অবধি। আমাকে ভালবেসে নিজেদের বিকিয়ে দিয়েছে এরা,অথচ আমি এদের জন্য কিছুই করতে পারিনি। আমি বড় সাধারণ দেবতা হে। ভালবাসা ছাড়া আর কিছুই পারি না। যুদ্ধ, কলহ-দ্বেষ, অশান্তি আমি নিতে পারি না। যদি পারতাম, আমার একমাত্র ভাগ্নেকে ওরা ঐ ভাবে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মারতে পারত না। ”

অখণ্ড নীরবতা গ্রাস করল ঘরটাকে। দুজনেই চুপ, তারপর সখা উৎফুল্ল হয়ে বলে উঠল “বুঝেছি। এমন কিছু শক্ত নয় হে-। এটা উয়িন্ডোজ, এটা অ্যান্ড্রয়েড আর এটা হল আইওএস। ” মৃদু মোহক হেসে বলল সখা। “ নির্লোম বাঁদরের দল কিন্তু বেশ বুদ্ধিমান। একথা মানতেই হয়। ”
নরম সোফায় পশ্চাদ্দেশ ঠেকাতেই অর্ধেক ডুবে গেল বেণী। হ্যাঁচোরপ্যাঁচোর করে উঠে বসল একটি অপেক্ষাকৃত শক্ত চেয়ারে। “সখা এবার আমায় বিদায় দাও--”।
ভ্রু কুঞ্চিত করে সখা বলল,“এখুনি?আচ্ছা বলে দেখছি কাল সকালের ফ্লাইট কিছু আছে কি না?”
“ফ্লাইট লাগবে না সখা। আহমেদাবাদ থেকে ট্রেন--। ” 
“না।  প্লেন। ”দৃঢ় ভাবে বলল সখা।
বেণীও ততোধিক ঋজু হয়ে বলল,“না প্রভু। এটাকা আপনার। লোকে আপনার উদ্দেশ্যে ভেট করেছে। এর ওপর অধমের কোন অধিকার নেই। আর তাছাড়া আপনি যে হারে খরচ করছেন---কুবেরের ঐশ্বর্য্যও জলদি ফুরিয়ে যাবে। ”
“ফুঃ।” বলে একটুকরো পিৎজা মুখে দিল সখা। চোখ বুজে এল আবেশে। “চিজ্। আঃ কি জিনিস বানিয়েছো গুরু।  চিজ্, আইসক্রীম, চকলেট। নাহে পৃথিবী বেশ মজার জায়গা। আর কি বলছিলে, ঐশ্বর্য্য ফুরিয়ে যাবে? আরেঃ লোকে আজ পর্যন্ত যত  আমায়  হাতি দান করেছে, তাদের দাঁত বেচেই-”

মাস তিনেক পরের কথা, হ্যাভেলকের ব্যয় বহুল হোটেলের নিজস্ব নির্জন বীচে বসে, ডুবন্ত সূর্যের কমলা আলোয়  বঙ্গোপসাগরের শোভা দেখতে দেখতে ডাবের জল খাচ্ছিল সখা। হঠাৎ ফোনটা জোরে জোরে কাঁপতে লাগল। প্রতিবার ফোন এলেই সখার মনে হয় বেণী। কিন্তু এই তিন মাসে বেণী একটিবার ও ফোন করেনি। আজো অচেনা নম্বর।
“হেলোঃ। ”
“সখা?” কাঁপা কাঁপা গলা ভেসে এল বহুদূর থেকে।
“বেণী?” করে উঠল সখা। ডুবন্ত সূর্য চমকে উঠল। মুহূর্তের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেল সমুদ্র। “কি হয়েছে? তোমার ফোন কোথায়?এটা কার নম্বর? কোথায় তুমি?ঠিক আছো তো”
“তিষ্ট প্রভু। তিষ্ট। আমি কথা রাখতে পারিনি প্রভু।  আমি আহত। মরণাপন্ন। আমার মোবাইল  পুলিশের হেফাজতে। নার্স দিদির থেকে ফোন চেয়ে লুকিয়ে ফোন করছি। আমায় পারলে ক্ষমা কোর সখা---”
“মানে?মরণাপন্ন? পুলিশ?তুমি কোথায়? আমি আসছি। আর সিম গুলো পুলিশের হাতে গেল কি করে? ও গুলো তো পারভেজের আধার কার্ড দিয়ে কেনা। কি করেছ?  মোটা ভাল ছেলেটা ফেঁসে যাবে যে?”
“এত প্রশ্নের জবাব দেবার ক্ষমতা নেই সখা। আমি খুন করেছি। চারজনকে। একা চারজনের সাথে লড়ে গেছি, ফলে আমার অবস্থা বুঝতেই পারছ। দুটো আঙুল নেই। হাত পা পাঁজর ভাঙা। আর প্রচুর রক্তক্ষরণের ফলে রক্তাল্পতায় ভুগছি। বাইরে পুলিশ পাহারায় আছে। মরলে ভাল। নইলে ফাঁসি। ”
“কোথায় আছো তুমি?”চিৎকার  করে উঠল সখা। এতক্ষণ স্তব্ধ থাকার পর গর্জন  করে উঠল সমুদ্র। ভয়ে ঝুপ করে ডুবে গেল সূর্য ।

পরদিন রাত এগারোটা। আসানসোল জেলা হসপিটালের ঘুমন্ত করিডরে হেঁটে যাচ্ছে এক আগন্তুক। পরনে নীল জিন্স আর হাল্কা সবুজ টি শার্ট। একটা ঘরের বন্ধ দরজার বাইরে এক হাবিলদার বসে ঢুলছিল। আগন্তুক নিঃশব্দে দরজা খুলে ঢুকে গেল ঘরের মধ্যে। খাটে শুয়ে আছে বেণী। একি চেহারা বেণীর। এক মুখ দাড়ি। কোটরগত চোখ। আগন্তুুকের জন্যই যেন প্রতীক্ষা করছিল বেণী। অস্ফুটে বলল,“ সখা তুমি এলে। এবার আমি শান্তিতে-”।
শশশশশ্। আওয়াজ করল আগন্তুক। বেণীর কপালে দুটো আঙুল ঠেকালো সখা, মুহূর্তের মধ্যে সমস্ত কাটা দাগ, ক্ষত মিলিয়ে গেল। আগন্তুকের আঙুল স্পর্শ করল বেণীর হাত, কড়কড় করে ভেঙে গেল প্লাস্টার। অবাক বিস্ময়ে বেণী দেখল দুটো হারিয়ে যাওয়া আঙুল আবার গজিয়ে গেছে। সখার আঙুল স্পর্শ করল পাঁজর---
বেণী ও সখা (part 4)
বেণী শুধু অস্ফুটে বলল,“কেন প্রভু? কেন এলে তুমি? এঘরে করিডরে সিসিটিভি ক্যামেরা লাগানো আছে। ওরা তোমায়ও অপরাধী ভাববে-”।  ফোৎ করে  তাচ্ছিল্যপূর্ণ ভাবে একটা নিশ্বাস ছেড়ে ব্যাগ থেকে এক সেট জামাকাপড় বার করে বেণীর হাতে দিল সখা। “ওহে নির্লোম বাঁদরের দল, ইএমএফ কি বোঝ? তোমাদের ঐ ক্যামেরার সাধ্য কি আমায় দেখে? আমার গা থেকে যে ই এমএফ বেরোয় তা ঐ ক্যামেরার কি যেন বলে ট্রান্সমিশন বোধহয়, ঐটাতে বাধা দেয়। যখনই আমায় দেখার চেষ্টা করবে শুধু অস্পষ্ট ঝিরিঝিরি একটা অবয়ব দেখতে পাবে। এমন কি আমার সংস্পর্শে  থাকলে তোমায় ও স্পষ্ট দেগতে পাবে না। ইএমএফ ডিস্টার্বেন্স এর জন্য। এবার চটপট চেন্জ করে নাও। ”
পোশাক পাল্টে বেণী আর সখা বেরোতে যাবে,  কর্তব্যরত নার্স ট্রে নিয়ে ঘরে ঢুকল। প্রথমেই বেণীকে থেকে ভ্রু কুঁচকে গেল,“ একি!একি! আপনি কোথায় যাচ্ছেন? প্লাস্টার কাটল কে?” পাশ থেকে সখা এগিয়ে এসে মৃদু হেসে নার্সের চোখে চোখ রেখে বলল,“আমি। ”
কুঞ্চিত ভ্রু মুহূর্তে সোজা হয়ে গেল। আবিষ্ট মোহক ঘণ দৃষ্টিতে সখার দিকে তাকিয়ে রইল নার্স কিছুক্ষণ । তারপর শুধু ঠোঁট দুটো নড়ল,“আই লাভ ইউ”।  সখাও হাসল। সম্মোহনকারী হাসি, তারপর বাঁশির মত সুরেলা সুরে বলল,“ আই নো। কিন্তু এখন যে বড় ব্যস্ত সখী। একটু পথ দেখিয়ে বার করে দাও আমাদের। ”
 নার্সের পিছন পিছন ঘর থেকে বেরোতেই, বাইরের ঢুলন্ত রক্ষী সটান উঠে দাঁড়ালো। “ইয়ে ক্যায়া চল রাহা হ্যায়? কোথায় নিয়ে যাচ্ছো আসামীকে?” বেণী এবং নার্সের মুখ এবং গলা শুকিয়ে গেল। সখা দুহাতে দুজনের কাঁধ স্পর্শ করে আশ্বস্ত করল। তারপর পিছন ফিরে রক্ষীর দিকে তাকাল সখা। সেই সম্মোহক হাসি। সেই একই প্রতিক্রিয়া , “ভালবাসি তোমায়। ”সত্যি সখাকে কি ভাল না বেসে থাকা যায়? গাড়িতে তুলে দিল ওরা। গাড়ি ছাড়ার আগে, সখা ডান হাতের তর্জনী আর মধ্যমা দুজনেরই কপালে ঠেকালো, মৃদু আচ্ছন্নতা গ্রাস করল দুজনকেই। আস্তে আস্তে মাটিতে শুয়ে পড়ল দুজনে, গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল ক্ষণেকের মধ্যে। বেণী আতঙ্কিত হয়ে বলল, “সখা!!একি করলে?ওদের মেরে ফেললে নাকি?” সখা ঠোঁট উল্টে বলল,“আমি শুধু ভালবাসতে পারি বেণী। রক্তপাত আমার দপ্তর নয়। ওরা আমায় ভালবাসল, ওদের জন্য আমারও তো কিছু করার আছে। এই ভাবে চলে গেলে ওরা বিপদে পড়ত না? তাই ওদের স্মৃতিটা একটু পাল্টে দিলাম। আমার কথা ওদের আর মনে থাকবে না।  চেতনা এলে ওরা বলবে, ওদের পিঠে বন্দুক ঠেকিয়ে তোমায় ছাড়িয়ে নিয়ে গেছি আমি। যাবার সময়, কোন ওষুধ স্প্রে করাতে ওরা বেঁহুশ হয়ে গিয়েছিল। ”
বেণী শুধু আবেগ বিহ্বল কণ্ঠে বলল,“এত ভাবো সখা? এত ভাবো আমাদের জন্য?”
সখা জবাব না দিয়ে বলল,“পারভেজ গাড়ি চালাও। ”
“পারভেজ?পারভেজ আপনাকে নিয়ে এসেছে?”
“হুঁঁ। ” অবাক স্বরে বলল সখা। “ওর আধার দিয়ে পাওয়া সিম পুলিশের হাতে তুলে দিয়ে যে ঝামেলা তুমি পাকিয়েছ, তা সামলাবে কে? তাছাড়া পারভেজ আমার বয়স্য। যেমন রাম আর হনুমান। নির্লোম বাঁদরদের নিয়মকানুন তো পারভেজই আমায় শেখায় হে। ”
একমুখ পান চিবোতে চিবোতে হোৎকা ঘাড়ে গর্দানে পারভেজ একগাল হেসে বলল,“আই লাভ ইউ সার”। বেণী রাগে গরগর করতে করতে শুধু বলল,“শালা গুজ্জুর আবার ভালবাসা। তোমায় নয় তোমার টাকাকে ভালোবাসে ও। ” সখা জবাব দিল না। হুশ করে আসানসোল ছাড়িয়ে গাড়ি ছুটল ঝাড়খণ্ডের দিকে। মাঝপথে গাড়ি থামিয়ে একবার নম্বর প্লেট বদল করল পারভেজ।

শিমূলতলা। সময়টা এপ্রিলের শেষ, তাই পর্যটকদের ভিড় প্রায় নেই বললেই চলে।অবশ্য আজকাল এমনিতেই কম লোকজন আসে এদিকে।  শিমূলতলার সেই গৌরব আর নেই। আগে  যারা আসত তাদের গরিষ্ঠাংশই ছিল বাঙালি। বাঙালিদের প্রিয় স্বাস্থ্যোদ্ধারের জায়গা ছিল শিমূলতলা। কত নামি অনামি লোক যে এককালে এখানে এসেছে, তারপর শিমুলতলার মোহে আবদ্ধ হয়ে থেকে গেছে তার ইয়ত্তা নেই।  তারপর একদিন আচমকাই স্থানীয় অধিবাসীদের মনে হল,“ এরা কারা? হাভাতে বাঙালীগুলো এখানে কি করছে? ভাগাও এদের। ” শুরু হল বাঙালীদের এক্সোডাস। আজকাল শিমুলতলার বেহাল দশা। হৃত যৌবনা সুন্দরীর মত, আজোও রূপচর্চা করে বটে, কিন্তু আদতে ঔজ্জ্বল্যহীন।   শিমুলতলার জনবহূল এলাকার বাইরে একটা লাল সিমেন্টের  দোতলা বাড়িতে আপাততঃ আস্তানা বেণী ও সখার। কড়ি বরগাওলা সাবেকী বাঙালি বাড়ি। বড় বড় ঘর। ঘরে বিশাল বিশাল কালো সেগুন কাঠের খাট, দেরাজ, দেরাজের গায়ে বিবর্ণ হলেও হিরের মত দ্যুতিময় বেলজিয়াম গ্লাসের আয়না। পারভেজ গেছে গাড়িটা বদলে আনতে। সখার ইচ্ছা ওরা কলকাতা হয়ে আহমেদাবাদে ফিরে যায়। নাহলে অন্তত গোয়া। বেণীর জেদ ও যাবে না। “কেন?” হতাশ স্বরে বলল সখা। প্রতিশোধ তো নিয়ে নিয়েছ? চার চারটে লোককে খুন করেছ! আর কি?এবার গোয়ায় কটা  দিন কাটিয়ে ফিরে যাই চল। ”
“নাঃ”দৃঢ় স্বরে বলল বেণী। “ওরা ছিল নিছক পেয়াদা। আমার রাজাকে চাই। যাকে এককালে নিজের বড় দাদা, বাবা এমনকি ঈশ্বরের মত শ্রদ্ধা করতাম। নিজের হাতে সব শিখিয়েছিল-- কি ভাবে অপারেশন চালাতে হয়।”
“অপারেশন মানে কাটাকুটি ?”
“না সখা। তোলাবাজি, মস্তানি। প্রয়োজনে -”
“কি? খুন? এঃ। তুমি স্বর্গে ঢুকলে কি করে? আর আমি তোমার ফাইল না পড়েই তোমাকে আজাদী দিলাম। রাধার নাম করলে আর আমি ও গলে গেলাম। না হে। আর কোন মানুষ খুন করতে আমি দেব না। চল ফিরে চল। ”
(চলবে)

Friday 20 March 2020

গুলমোহর ( বসন্তপূর্ণিমা -২০১৯)


কখন থেকে রাস্তা পার হবে বলে দাঁড়িয়ে আছে এলা, মুখ পোড়া সিগনাল আর লাল হয়ই না। চোখের সামনে দিয়ে একের পর এক বাস বেরিয়ে যাচ্ছে। মনটা আচমকা খারাপ হয়ে গেল এলার। মহানগরে বসন্ত এসেছে। হাওয়ায় অদ্ভুত মাদকতাময় এক উষ্ণতা। কর্মক্লান্ত ঘেমো শহরের মসৃণ পথে লুটিয়ে পড়েছে সোহাগী লালচে সোনালী নিয়ন আলো। বাতাসে ভেসে আসছে আজব মিষ্টি একটা ফুলের সুবাস। বড় মন কেমনিয়া সে গন্ধ। প্রশ্বাসের সাথে সাথে ফুসফুসে ভরে যাচ্ছে এক হাহাকার। প্রেমহীনতার হাহাকার। এমন দিনে  বড় ইচ্ছে করে, এলার খসখসে হাতটা কেউ চেপে ধরুক। 

বড় মনোরম এই এলাকা, পথের পাশের নয়ানজুলিতে টলটল করছে জল, সেই জলের ধার বরাবর কেয়ারী করা বৃক্ষের দল। নিম- অশ্বত্থ- অর্জুন- জারুল- অমলতাস। দিনের বেলা রাস্তার দুধারে হোলি খেলে পলাশ আর রাধা-কৃষ্ণচূড়ার দল। ডিভাইভার বরাবর জমিয়ে আড্ডা দেয় টগর আর করবী। মাঝে মাঝে দু একটা পুষ্পশোভিত স্থলপদ্ম গাছ যেন আরো বাড়িয়ে তোলে শোভা।  আরও যে কত রঙবেরঙের গাছ। কটা গাছের নামই বা এলা জানে। শুভ্র বটানির ছাত্র ছিল, অনেক গাছ চিনিয়েছিল। গুলমোহর মানে যে কৃষ্ণচূড়া শুভ্রর মুখেই প্রথম শোনে এলা।

শুভ্র চলে গেছে আজ কতদিন হল, গাছের প্রতি প্রেম তাও কমেনি এলার। ডিউটি যাবার পথে, ভোর বেলায় ফাঁকা রাস্তা দিয়ে যখন হুহু করে দৌড়য় বাস, সূর্যের সোনালি আলোয় স্নান করে সদ্য ঘুম ভাঙা  কুসুমের দল, অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে এলা, বড় ভালো লাগে। পঞ্চ ইন্দ্রিয় দিয়ে শুষে নেয় সবটুকু রঙ, বিবর্ণ দীন জীবন যেন সাময়িক ভাবে ঝলমলিয়ে ওঠে।গালের মেচেতা-চোখের কালি, মাথা ভর্তি পাকা চুল, ফাটা গোড়ালী মুহূর্তে মুছে যায়। এলা ফিরে যায় তার শেষ কৈশোরে।যখন জীবন ঘুরত শুভ্রকে কেন্দ্র করে।

  ইশ্ এলা যদি এখানেই  থেকে যেতে পারত, রোজ সকালে এই কথাটা মনে হয়, আর তখনি ঝাঁকুনি খেয়ে সিগন্যালে দাঁড়িয়ে যায় বাস। বাস্তবের মাটিতে আছড়ে পড়ে এলারাণী দাস।

রাস্তার ওপারে একটা লোক বেশ অনেকক্ষণ ধরে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে, বছর দশেক আগে হলেও ভয় পেত এলা, আজকাল আর পায় না। পরণে সস্তা সিন্থেটিক শাড়ি, পায়ে রবারের চপ্পল, কাঁধে ট্রেন থেকে কেনা দুশ টাকার নকল চামড়ার ঢাউস ব্যাগ, মাথায় হাত খোঁপা। ছিটেফোঁটা প্রসাধন নেই। ডিউটির পরও গায়ে লেগে থাকে নার্সিং হোমের ব্লিচিং,  ফিনাইল আর মেডিকেটেড সাবানের গন্ধ। এলারাণী দাস ডাকসাইটে আয়ামাসি, এমন মেয়েদের প্রতি না তো কারো প্রেম জাগে, নাই কামনা। নির্ঘাত বাড়িতে কোন রুগী আছে, আয়া লাগবে। ভাবতে ভাবতে মনটা কেমন ভারি হয়ে গেল এলার। নাঃ যে যায় সে আর ফিরে আসে না। আঠারো বছরেও ফিরে আসেনি শুভ্র।  আর ফিরবে না প্রেম। এভাবেই একদিন হারিয়ে যাবে, ঝরে-মরে মাটিতে মিশে যাবে সোদপুরের এলারাণী দাস।

দূরের লোকটার অবয়ব কেমন যেন বহু বহু বছর আগে দেখা একজনের সাথে বড় মিলে যায়। অথবা সব অচেনা লোকের মধ্যেই তাকে খুঁজতে চায় এলা। দুজনের বাঁধানো সেই ছবিটা। বিয়ের পর প্রথম এবং শেষ ছবি। মিন্টির বাবার একমাত্র ছবি। মিন্টি এখনও লুকিয়ে দেখে। মায়ের সামনে দেখে না,পাছে মা কষ্ট পায়। ছোট বেলায় বলত,“বাবা কি আর ফিরে আসবে না মা? তুমি কি আর এমন সুন্দর করে সাজবে না মা?” আজকাল আর বলে না। শুধু মাঝে মাঝে অন্ধকার ঘরে, একে অপরকে জড়িয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে মা-মেয়ে। মিন্টি বলে,“ আমাদেররআর কেউ নেই, বলো মা। আমাদের আর কাউকে দরকার নেই বলো মা। ” এলা কিছুই বলে না। সেদিনও চুপ করে থাকত, আজও তাই থাকে। নীরবে অভিনয় করে চলে মা আর মেয়ে। দুজনেই অভিনেত্রী আবার দুজনেই দর্শক। দুজনেই চেষ্টা করে একে অপরকে টেক্কা দিতে।

অভাব যখন ঘাড়ে চাপে,প্রেম পালায় জানলা গলে। আর অভাব কাকে বলে হাড়ে হাড়ে বোঝে এলা আর মিন্টি। সেই কোন ছোট্ট বেলা থেকে মিন্টিকে মায়ের কাছে রেখে কাজে বের হয় এলা। ভাই-ভাইবউদের অশান্তির ভয়ে, বাপের বাড়ি থাকেনি। মিন্টির যখন আড়াই বছর বয়স, বাপের বাড়ির কাছেই এক কামরার বাড়ি ভাড়া নিয়েছিল এলা। এখনও সেখানেই আছে। বারো ঘর, এক উঠোন। ভাগের বাথরুম পায়খানা। সেখানে মেয়েকে রেখে যেতে সাহস হত না, মাও দুহাত বাড়িয়ে আঁকড়ে ধরেছিল মিন্টিকে। দিদাই ছিল মিন্টির জীবন। দিদার ঘরেই থাকত, পড়াশোনা করত মিন্টি। রাতে মা ফিরলে, মায়ের হাত ধরে বাড়ি ফিরে আসত মিন্টি। দিদা হাজার সাধলেও দিদার কাছে খেত না। পাছে মাকে কথা শুনতে হয়, পাছে মামারা হ্যাংলা ভাবে-। ছোট্ট থেকেই খুব সমজদার এলার মেয়ে।

সেরাতেও তাই করেছিল। স্কুলের বইখাতা- ইউনিফর্ম সব রেখে এসেছিল দিদার কাছে। অন্যদিনের মত সকালবেলা নাকেমুখে গুঁজে, মেয়ের খাবার গুছিয়ে মেয়েকে নিয়ে বাপের বাড়ি গিয়েছিল  এলা। সেদিন আর “মিন্টি এলি ” বলে দরজা খোলেনি কেউ। ঘুমের মধ্যেই চলে গিয়েছিল এলার মা।

মা চলে যাবার শোক অসহায়তা ছাপিয়ে এলাকে কাঁপিয়ে দিয়েছিল দাদাদের নিষ্ঠুরতা।বডি বের হতেই মায়ের ঘরের দরজায় তালা মেরে দিয়েছিল বড়দা আর ছোটদা। এলা-মিন্টির শত কাকুতি-মিনতিতেও খোলেনি ঘরের তালা। মিন্টির বারো ক্লাশের সব বই, নোট সব হারিয়ে গেল একরাতের মধ্যে। উঠোনে আছড়ে পড়ে কেঁদেছিল মেয়েটা। “ও বড়মামা, আমার বইগুলো শুধু দাও। ও ছোটমামা আমার যে এইচএস পরীক্ষা। বইগুলো দিয়ে দাও গো। ”
পাষাণ। পাষাণ। ভাবতে ভাবতে টপটপ করে দু ফোঁটা জল ঝরে পড়ল এলার গালে।উল্টোদিকের লোকটা কি ভাবল কে জানে? এলার কিছু যায় আসে না।  এত কষ্ট করেছে জীবনে, যাতে মেয়েটা ভালো থাকতে পারে, তাও হল না। তাও পারল না এলা। ঠিক যেভাবে আঠারো বছর আগে পূর্ণ গর্ভবতী এলা আছড়ে পড়ে কেঁদেছিল, তেমন করেই কাঁদতে হল মিন্টিকে। মেয়ের শোক দেখে তাও তো এলা বলতে পারেনি,মায়ের ঘরে ওর জমানো হাজার দশেক টাকা ছিল। তিলতিল করে জমিয়েছিল, মিন্টির বিয়ের কথা ভেবে।
প্রেম!এই প্রেমই যত নষ্টের মূলে। কেন যে শুভ্রর প্রেমে  পড়েছিল এলা। বামন হয়ে কেন হাত বাড়িয়েছিল চাঁদের দিকে? দশক্লাস পাশ করে, ভর্তি হয়েছিল কোচিংএ। দাদারা তো কেন পড়াশোনা করল না।লোহার  কারখানায় কাজ করতে ঢুকে গেল, বাবা ছিল রঙ মিস্ত্রী। রোজগারপাতি মন্দ ছিল না, তাই মেয়েকে পড়াশোনা শেখানোর সব ব্যবস্থা করেছিল বাবা। নাহলে এলার পিসিরা তো নাম সই করতে পারে মাত্র। কোচিং এ পড়াত শুভ্র। সদ্য এমএ পরীক্ষা দিয়ে পড়াতে এসেছিল শুভ্র। কে জানে কি মাস ছিল সেদিন? কে জানে কার চোখে কে দেখেছিল সর্বনাশ-

এগারো ক্লাশের পরীক্ষাটা আর দেওয়া হয়নি এলার। তার আগেই পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করে দুজনে। সবথেকে ভালো সালোয়ার কামিজটা পরে পালিয়ে  ছিল এলা। যদিও ওর না পালালেও চলত, শুভ্রর মত জামাই ওর বাবা অনেক খুঁজেও জোটাতে পারত না। ওদের বিয়ে খবরটা শুনে শুধু মা বলেছিল,“কয়টা বছর অপেক্ষা করলেই তো পারতিস মানু। তোর বাপের এত শখ ছিল, তুই হবি বংশের প্রথম গ্রাজুয়েট। তোর দাদারা তো কেউ ল্যাখাপড়া করল না- বড় আশা ছেল তোর ওপর। ” বিয়ে মানে তো মন্দিরে গিয়ে সিঁদুর তোলা। বিয়ের পর শ্বশুরবাড়ি যায়নি এলা। শুভ্রর সাহস হয়নি, সস্ত্রীক বাবা-মায়ের সামনে গিয়ে দাঁড়াতে। মন্দিরের কাছেই একটা পিসিও থেকে ফোন করেছিল মাকে, কি কথা হয়েছিল এলা শুনতে পায়নি। কাঁচের ঘরের বাইরে ওকে দাঁড় করিয়ে রেখেছিল শুভ্র। শুভ্রর ধারণা ছিল, একবার বিয়ে করে গিয়ে দাঁড়ালে ফেলতে পারবে না। হাজার হোক বাবা-মায়ের একমাত্র সন্তান ছিল শুভ্র। ওর মা যদিও স্পষ্ট জানিয়ে দেন, শুভ্র যখন খুশি বাড়ি ফিরতে পারে। তবে একাকী। এই বিয়ে ওণারা মানেন না। এলাকে গ্রহণ করার কোন প্রশ্নই তাই ওঠে না।
এলার বাপের বাড়ি থেকে বেশ খানিকটা দূরে, বাড়ি ভাড়া নিয়ে সংসার পাতে শুভ্র আর এলা। শুভ্রর টুকটাক উপার্জন, টিউশ্যনি আর ওর নামে ফিক্সড্ করা কিছু টাকা পয়সা ভেঙে গড়ে ওঠে এলা আর শুভ্রর সংসার। খুব সামান্য উপকরণ, খাট কেনার সামর্থ্য ছিল না তাই তক্তাপোশ, একটা সস্তা কাঠের আলনা আর একটা আয়না। একটা অনামি ব্রাণ্ডের স্টিলের আলমারি দিয়েছিল এলার বাবা-মা। এলার দাদার এক বন্ধু বানাত। খুব মজবুত। আজও টিকে আছে এলা আর মিন্টির ঘরে।
গ্যাস নেবার ক্ষমতা ছিল না, তাই পাম্প স্টোভ। প্রেশার  কুকার, হাড়িকুড়ি, শিলনোড়া, চাকিবেলুন,কৌটোবাটা বড় যত্ন করে ঘুরে ঘুরে কিনেছিল এলা আর শুভ্র। বড় সুখের ছিল সেসব দিন। লোহার বাসরঘরে নিদ্রামগ্ন লখিন্দর বেহুলার মত শুভ্র আর এলাও বোঝেনি কালনাগিনী ঢোকার ফুটোটা ঠিক কখন তৈরি হয়েছিল।

সচ্ছলতা তেমন ছিল না। হিসাব করে চলতে হত। দুজনেরই অল্পবয়স,শখসাধও ছিল প্রচুর। এলা আশৈশব টানাটানির সাথে পরিচিত হলেও, শুভ্রর তেমন আলাপ ছিল না। উচ্চমধ্যবিত্তের আদরের দুলাল, স্বল্পতা নিয়ে বিস্তর অনুযোগ করত শুভ্র।যেন এলা ইচ্ছে করে তৈরি করে অভাব আর টানাটানির নাটক।  দুজন মানুষ বলে কেন দুটুকরো মাছই এলা রান্না করে,বেশী হয় না কেন? রোজ মাছমাংস কেন হবে না? মাসের শেষে কেন বাইরে খাওয়া নিষেধ- কেন যখন খুশি বন্ধুদের নিমন্ত্রণ করা যাবে না- ইত্যাদি প্রভৃতি ছেলেমানুষি অনুযোগ করত শুভ্র।

খেপে গেলে প্রায়ই বন্ধুদের উচ্চশিক্ষিত সুন্দরী গার্লফ্রেণ্ড বা হবু স্ত্রীদের সাথে এলার তুলনা টানত শুভ্র।মাথা ঠান্ডা হলে যদিও ক্ষমা চাইত, আদরে সোহাগে ভরিয়ে দিতে চাইত এলাকে। ক্ষমা চাইবার অছিলায় কিনে আনত কোন দামি উপহার, তাই নিয়ে আবার বাঁধত অশান্তি। 

তারপর এল সেই দিন, শরীর জুড়ে নামল অসীম ক্লান্তি। তারসাথে গা গুলিয়ে তীব্র বমি। খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিল শুভ্র। দৌড়ে গিয়ে বমির ওষুধ কিনে এনেছিল। নিজে হাতে গুলে দিয়েছিল ওআরএস।  তাও মাথা তুলতে পারছিল না এলা। এদিকে ডাক্তারও ডাকতে দেবে না। বাড়ি এলেই এককাড়ি টাকা নষ্ট। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবার মুহূর্তে, নীচে থেকে বাড়িউলি কাকিমাকে দৌড়ে ডেকে এনেছিল শুভ্র। তখনও শুভ্রর দুচোখে ছিল নিছক উদ্বেগ আর নির্ভরশীলতা। সেদিনের শুভ্রর দুই চোখের কথা বিগত আঠারো উনিশ বছর ধরে প্রায় ভাবে এলা। প্রিয়তম পুরুষের ভালোবাসায় মাখামাখি দুই চোখ। ভাবলেই নাকে ভেসে আসে শুভ্রর গায়ের গন্ধ।

বাড়িওয়ালি কাকিমার কাছে অবশ্য এসব লক্ষণ ছিল খুবই চেনা। কাকিমার ছদ্ম হুকুম মেশানো আব্দার,“ মিষ্টি কই শুভ্র?” লজ্জায় শুভ্রর দিকে তাকাতে পারেনি এলা। ঝিম ধরে বসেছিল দুজনেই। বাইরে রাস্তার আওয়াজও যেন বিনা অনুমতিতে সেদিন ঢোকেনি শুভ্র আর এলার সংসারে। হঠাৎ শুভ্র বলল,“একটু আসছি। ” কোথায়? প্রশ্ন করতে গিয়েও করেনি এলা। বুঝতে পেরেছিল। শুভ্র যাচ্ছে ওর মাকে ফোন করতে। এতবড় খবরটা মাকে না জানালে চলে? ভিতরে ভিতরে অচেনা এক খুশি থিরথির করে কাঁপছিল যেন।  এবার হয়তো ঠিক হয়ে যাবে সবকিছু। পুত্রবধূকে না মেনে নিতে পারলেও হবু নাতি বা নাতনিকে নির্ঘাত-

প্রতীক্ষা করেছিল এলা। প্রতীক্ষা ছিল ঋতুরাজ বসন্তের। পরিবর্তে নেমে এসেছিল অনন্ত তুষার যুগ।প্রথমে নেমেছিল, ঘণ কুয়াশা। দমবন্ধ করা কুৎসিৎ কালো ধোঁয়ায় ভরে গিয়েছিল চরাচর। তারপর শুরু হয়েছিল তুষারপাত। আজও যা হয়ে চলেছে অবিশ্রাম। আর এই তুষারের তলায় কোথায় মরে জমে পাথর হয়ে গিয়েছিল এলা, সোদপুরের এলারাণী দাস।
এক একটা মুহূর্ত যেন এক একটা যুগ। কোথায় গেল শুভ্র? প্রতীক্ষার প্রহর ক্রমেই লম্বা হচ্ছিল। সূর্যদেব বসলেন পাটে।ভাড়া বাড়ির দোতলায় হুড়মুড় করে নামল সন্ধ্যা। আলো জ্বালাবার ক্ষমতাও ছিল না এলার সেদিন। হৃদপিণ্ড বিদীর্ণ করে উঠে আসছিল দমচাপা কান্নার তুফান। কতক্ষণ ঐ ভাবে পড়ে ছিল জানে না।  সন্ধ্যা নেমে বুড়ো হয়ে,মহানগরের বুকে  নেমেছে রাত। ক্রমশঃ গভীর হয়েছে সে রাত। ফেরেনি শুভ্র। আজও এলার মনে হয় ও আটকে আছে ঐ রাতেই। কোনদিনও কাটবে না সেই কালরাত্রি যেন।

কি অপরিসীম অসহায়তা গ্রাস করেছিল সেদিনের এলাকে ভাবতে বসলে আজও কান্না পায়। ঘড়ির কাঁটা মধ্যরাতের কাছাকাছি পৌঁছতে আর থাকতে পারেনি এলা।  সকাল থেকে অনাহারে দুর্বল শরীরটাকে টেনে হিঁছড়ে নিয়ে গিয়োছিল বাপের বাড়ির দোরগোড়ায়।তিনকুলে কে আছে ওর মা- বাবা আর দাদারা ছাড়া। আগে তারা তবু আসত, খবরাখবর  নিত। শুভ্রর ঘোরতর অপছন্দ বলে আজকাল আর আসে না।কাঁদতে কাঁদতে উন্মাদিনীর মত যখন কড়া নেড়েছিল এলা,তখন গভীর রাত।

শুভ্রকে খুঁজতে কসুর রাখেনি দাদারা। বড়বৌদি যদিও শুনেই বলেছিল,“দ্যাখো গে বাপের বাড়ি ফিরে গেছে। এসব বড়লোকের ছেলেরা এমনই করে। বিয়ের নাম করে ভোগদখল করে, তারপর পেট বাঁধলেই কেটে পড়ে ।”
রাত একটা-দেড়টা নাগাদ ফিরেছিল ছোটদা। আন্দাজে খবরাখবর নিতে নিতে হাজির হয়েছিল শুভ্রদের বাড়ির সদর দরজায়।ছোটদার বয়ান মোতাবেক বাড়ি ফিরে দিব্যি খেয়েদেয়ে ঘুমোচ্ছিল শুভ্র। ওদের সাথে দেখাও করেনি। ওর মা-বাবা স্পষ্ট করে জানিয়ে দিয়েছেন, ওটা ভদ্রলোকের পাড়া। অসভ্যতা করো লাভ নেই। এলা ওদের চোখে “লাইনের মেয়ে”। এলা ও বাড়ির চৌকাঠ ডিঙোবার সাহস যেন না দেখায়। তাহলে ঝেঁটিয়ে বিদেয় করবেন ওণারা।
অনেক অশান্তি হয় দুই পরিবারের,অনেক বাদ-বিবাদ। শেষে আইন মেনে বিবাহ বিচ্ছেদের মামলা করে শুভ্র। ওদের দামি উকিলের বিপক্ষে দাঁড়াবার মত উকিল রাখার সামর্থ্য ছিল না এলাদের বলাইবাহুল্য। তাই শান্তিপূর্ণ  ভাবে আদালতের বাইরেই মিটমাট করে নেয় দুই পরিবার। এলার জীবন এবং যৌবনের দাম ধার্য হয় চল্লিশ হাজার টাকা। চল্লিশ হাজার টাকা দিয়ে,“লাইনের মেয়ে”টাকে ঘাড় থেকে নামায় শুভ্রদের পরিবার। 

এলার মতামত- ওজর আপত্তির কেউ মর্যাদা রাখেনি। আর রাখলেই বা কি হত, শুভ্রর প্রেম যে মৃত সেটা বুঝতে এলার অসুবিধে হয়নি।  জবরদস্তি মৃত সম্পর্ককে আঁকড়ে থাকলে, বাড়ত শুধু যন্ত্রনা।

সাজানো সংসারের মালপত্র কিছুই ফেরত চায়নি শুভ্রর পরিবার। ঐদিনগুলোকে ওরা মুছে ফেলতে চেয়েছিল। এলার জিনিসপত্র গুলো অবশ্য কড়ায় গণ্ডায় বুঝে নেয় ওর দাদারা। ঠেলা গাড়িতে চাপিয়ে যেদিন বিয়ের আলমারিটা ফেরত নিয়ে এসেছিল বড়দা, হাউমাউ  করে কান্নায় ভেঙে পড়েছিল এলা।

মিন্টির জন্মের পর এক অদ্ভুত আশায় বুক বেঁধেছিল এলা। হাজার হোক বাবা তো, খবরটা পেলে নিশ্চয় দৌড়ে আসবে। শুভ্র আসেনি।  হয়তো খবর পায়নি, লুকিয়ে বেপাড়ার পিসিও থেকে বেনামে ফোন করে খোদ খবর দিয়েছিল এলা, তাও আসেনি। কেউ আসেনি। কোনদিন আসেনি। আর আসবেও না। জানে এলা। এভাবে সবার অলক্ষে অনাদরে একদিন ঝরে যাবে এলা,যেমন ঝরে গেছে এলার যৌবন।

সিগন্যাল লাল হয়েছে, চোখ মুছে রাস্তা পেরোতে উদ্যত হল এলা। চোখের জল চিরকালই বড় অবাধ্য,বড় লজ্জায় ফেলে দেয়।একা থাকলেই পিছু ফিরে তাকায় এলা, আঠারো বছর আগের কটা দিনের কথা বারবার রিপিট টেলিকাস্ট এর মত চলতে থাকে মাথার মধ্যে। শুভ্র যেদিন ছেড়ে গিয়েছিল সেই রাতের অসহায়তার কথা যতবার ভাবে, ডাক ছেড়ে কাঁদতে ইচ্ছে হয়। কতবার বাসে ট্রেনে ভিড়ের মাঝে চোখে আঁচল চেপে বসে থেকেছে এলা।কান্নার দমকে  উঠে আসা হেঁচকিকে দমন তথা শাসন করেছে কঠোর হাতে।আজ অবশ্য তা করতে হয়নি, শুধু কয়েকবার মুছতে হয়েছে ভরে আসা চোখ, এই যা। এই হাক্লান্ত বসন্তের রাতে, ব্যস্ত মহানগরে কেউ দেখেনি আশা করি।
রাস্তা পেরোতে পেরোতে আবার দেখতে পেল, ওপাড়ের লোকটা বড় উদ্বেল হয়ে তাকিয়ে আছে এলার দিকে। অবয়বটা বড় চেনা। ধুর। সে কেন হবে? বিগত আঠারো বছরে কখনও দেখেনি তাকে,নিশ্চয় অনেক পাল্টে গেছে সেও। আর এলাও তো পাল্টেছে। এলা যদিও তাকে চিনতে পারে,সে এলাকে কোনদিনই চিনতে পারবে না।
অচেনা অস্বস্তি নিয়ে মাথা নীচু করে রাস্তা পের হল এলা। এত বছরে কখনও এমন উটকো অস্বস্তি হয়নি এলার। কখনও কেউ এভাবে তাকিয়েছে কিনা খেয়ালও করেনি এলা। আজ যে কেন উল্টে পাল্টে যাচ্ছে সব হিসেব।
ফুটপাতের ধার ঘেঁষে দাঁড়িয়ে আড়চোখে দেখতে পেল এলা,সে এগিয়ে আসছে পায়ে পায়ে। নিজেকে এত দীন বহুদিন বোধ হয়নি এলার। ইশ্ এভাবে এলাকে দেখবে সে? এই সস্তা সিন্থেটিক শাড়ি আর রবারের চপ্পলে? মাথায় হাত খোঁপা আর সস্তা ঢাউস ব্যাগে, যার একটা চেনের জিপার উড়ে গেছে বলে সেফটিপিন লাগিয়েছে এলা। যে মুখশ্রীর প্রেমে পড়েছিল সে,সেখানে আজ কালো দাগছোপ আর মেচেতাদের সাম্রাজ্য। হাতের ক্ষয়া নখগুলো, নেলপলিশহীন পায়ের পাতায় আঁকিবুকি কেটেছে সূর্য। আর গোড়ালির ফাটলে তো গজাতে পারে বটের চারা। হে ঈশ্বর, এলার যেন ভুল হয়। আর না হলে দ্বিধা হও ধরণী।
লোকটা কয়েকহাতের মধ্যে এসে গেছে,দমবন্ধ করে অপেক্ষা করছে এলা, কতবার মরতে হয় একটা জীবনে? যদি চিনতে পেরেও থাকে কেন আসছে এগিয়ে? যেদিন থেকে নিভেছে এলার জীবনের সব আলো, গভীর আঁধারে নিদ্রিত কন্যাকে বুকে জড়িয়ে শুধু এইদিনটারই স্বপ্ন দেখে গেছে এলা, একদিন সে ফিরে আসবে। হঠাৎ দেখা হয়ে যাবে কোথাও আর এলাকে দেখে হুড়মুড় করে ভেঙে পড়বে শুভ্র হৃদয়ের সব প্রাচীর।
সে হাত তুলে ডাকতেই যাবে, আচমকা দুজনের মাঝে এসে দাঁড়াল এক দুধ সাদা অ্যাম্বুলেন্স। ঘটাং করে দরজা খুলে দিয়ে চিৎকার করে উঠল রাজীবদা,“রাস্তায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাঁদছ? বোকা মেয়ে।  উঠে এসো, তোমাদের ওদিকেই যাচ্ছি পেশেন্ট তুলতে।” এভাবে এ নাটকের যবনিকা পতনে থতমত খেয়ে গেল এলা। কি করব? আর মাত্র কয়েকটা মুহূর্ত অপেক্ষা করলেই এসে পড়বে এলার জীবনের মাহেন্দ্রক্ষণ। নাকি সাড়া দেবে রাজীবদার ডাকে?

রাজীবদা এই নার্সিংহোমে  অ্যাম্বুলেন্স চালায়।এছাড়াও টুকটাক নানা কাজ করে, সর্ব ঘটে কাঁঠালি কলা মার্কা।  বিপত্নীক। সন্তানের জন্ম দিতে নাকি মারা যান ওণার স্ত্রী। বিগত আট দশ বছর ধরে ওরা সহকর্মী। এলা কারো সাথে তেমন মিশত না,পুরুষ সহকর্মীদের থেকে তো দশহাত দূরত্ব বজায় রাখত বরাবর। ওর দুর্ভাগ্যের কথা যত কম লোক জানে, ততোই ভাল। মানুষের অনাবশ্যক কৌতুহল বড়ই অবাঞ্ছনীয় এবং অসহনীয়ও বটে। 
মিন্টির মাধ্যমেই রাজীবদার সাথে আলাপ এবং কিছুটা হৃদ্যতা। মিন্টির বড় প্রিয় রাজীব মামা। মায়ের সাথে সমস্যা হলে,বা মায়ের শরীর খারাপ থাকলে মাঝে মাঝে মিন্টিকে নিয়েই ডিউটিতে আসত এলা।সারাদিন ঘুরে ঘুরে সবার সাথে ভাব জমাত মিন্টি।  মিন্টির ভালো নাম গুলমোহর শুনে অবাক হয়ে গিয়েছিল রাজীব। “ওরকম নাম কেন?মোহর শুনেছি। গুল-মোহর, তুই খুব গুল মারিস বুঝি?” রাজীবের সিরিয়াস মুখে প্রশ্ন শুনে হো হো করে হেসে উঠেছিল মিন্টি। তারপর পাকা বুড়িদের মত বলেছিল, “গুলমোহর হল তোমাদের কৃষ্ণচূড়া। আমার জন্মের আগেই মা ঠিক করেছিল,ছেলে হলে নাম রাখবে অমলতাস। আর মেয়ে হলে-”। এলা অবশ্য আগ বাড়িয়ে কখনই কথা বলত না রাজীবের সাথে, ওই বলত। খোঁজখবর নিত মিন্টির। এলার অনুমতি নিয়ে মিন্টিকে আইসক্রীম খাওয়ানো,টুকটাক গল্পের বই কিনে দেওয়া এইভাবে বেড়েছে পরিচয়। দামি উপহার অবশ্য কখনও দেয়নি, দিলেও এলা নিত না। পৃথিবীতে বন্ধু বা হৈতেষী বলতে বোধহয় শুধু রাজীবমামাই আছে মিন্টির।রাজীবই জানিয়েছিল, মিন্টি লুকিয়ে লুকিয়ে ওদের বিয়ের ছবিতে নিজের বাবাকে খোঁজে না,খোঁজে নিজের হাসিখুশি সুন্দরী মাকে। এলার কষ্ট,এলার চোখের জল সইতে পারেনা মিন্টি। ঠিক যেমন এলা পারে না মিন্টির দুঃখ সইতে।   দাদারা যখন বইখাতা আটকে দিল,কাঁদতে কাঁদতে নাকি রাজীবমামাকেই ফোন করেছিল মিন্টি। এলা জানেও না কখন।মিন্টি বলেছিল ও ছেড়ে দেবে পড়াশোনা। রাজীব নাকি সেই শুনে এমন গালমন্দ করেছিল, যে মিন্টি ভয়ে আর পড়া ছাড়ার কথা ভাবেনি। স্যার ম্যাডামদের কাছে গিয়ে নিজের সমস্যা খুলে বলার পরামর্শ ও রাজীব দিয়েছিল। বন্ধুরাও হেল্প করেছে মিন্টিকে। সব নোট নতুন করে যোগাড় হয়েছে। এলা আর মিন্টির দুঃসময়ে নিজে অবশ্য আসতে পারেনি রাজীব। কারণ এলার বাপের বাড়ির লোকজন বা ভাড়া বাড়ির প্রতিবেশীরা কি ভাববে। এমনিতেই এ সমাজ নারীদের চরিত্রহননে সদা প্রস্তত। আর তাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকাও নেয় নারীরা। এই আতঙ্কে কর্মস্থলেও বেশী বাক্যালাপ করে না এলা । রাজীবই গায়ে পড়ে কথা বলে। খোঁজখবর নেয়।  গোটা চারেক বইও রাজীবই কিনে দিয়েছে।এই নিয়ে খুব রাগ দেখিয়েছে এলা, কারো দয়ায় বাঁচতে চায় না ওরা। বইয়ের দামটা ও ধার হিসেবেই নিয়েছে, সময়মত শোধ করে দেবে। সেটা জানিয়েও দিয়েছিল চাঁচাছোলা ভাষায়।  পরে হাল্কা খারাপ লেগেছিল যদিও, মানুষটার তিনকূলে কেউ নেই। হৃদয় ভরা স্নেহের ভাণ্ডারের কিছুটা ভাগ মিন্টি পেয়ে ধন্য হয়ে গেছে। কোন পুরুষ মানুষের স্নেহ বা দুটো মিষ্টি ভরসা দেওয়া কথাও কোনদিন শোনেনি মেয়েটা। তবে এলা অকারণ জটিলতা পছন্দ করে না। এভাবেই মানিয়ে চলতে হবে মিন্টিকে। 
অ্যাম্বুলেন্সের জানলা দিয়ে হু হু করে ঢুকছে বসন্তের ঈষৎ  উষ্ণ নোনতা মাতাল হাওয়া। দূষিত মহানগরের ধোঁয়া ছাপিয়ে কোথা থেকে যেন ভেসে আসছে হাসনুহানা আর কাঁঠালিচাঁপার মিলিত সৌরভ। বুক ভরে নিশ্বাস নিয়ে আড় চোখে তাকাতে গিয়ে ধরা পড়ে গেল এলা। রাজীব এতক্ষণ ওকেই দেখছিল।

এই বাসন্তী নিয়নের আলোয় বড় মায়াময় লাগছে রাজীবকে, গালের না কামানো দাড়ি, কানের পাশের পাকাচুল, চোখের চশমা, কপালে উড়ে আসা চুলের গোছা সবই যেন বড়ই মনমোহন।
পাশের আয়নায় নিজের দিকে তাকিয়ে হঠাতই মুগ্ধ হয়ে গেল এলা, এখনও মসৃণ মুখের ত্বকে ঝিলিক মারছে রাস্তার লালচে সোনা আলো।সাদা আর সিমপাতা রঙের সিন্থেটিক শাড়ি আর সবুজ ব্লাউজটাও ততোটা খারাপ নয়,বরং বেশ ভালোই মানিয়েছে এলাকে।  ঘাড়ে আলগা নেতিয়ে থাকা মোটাসোটা হাত খোঁপায় যেন আরো মিষ্টি লাগছে ওকে, প্রবল হাওয়ায় দুটো চারটে পাকা চুল এদিকে ওদিকে উঁকি মারছে বটে,তাতে যোগ হচ্ছে এক অন্য মাত্রা।গালের গুটিকয় মেচেতা আর চোখের তলার হাল্কা কালি যেন সদম্ভে ঘোষণা করছে এ নারী সাধারণ না। এ নারী বড় মোহময়ী, এর পরতে পরতে রহস্য। সেদিনের ভীতু বছর সতেরো- আঠারোর লজ্জাশীলা কিশোরীর খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসা এ নারী জীবন যুদ্ধের এক অদম্য  সৈনিক। জীবন একে নিয়ে না,বরং জীবনকে নিয়ে ছিনিমিনি খেলে এ নারী আজ বড় পরিণত। এর আগে তো কখনও এসব মনে হয়নি এলার। আজ তবে কেন?
আড়চোখে তাকাতে গিয়ে আবার মিলন হল চার চক্ষুর। ধুর কি যে সব হচ্ছে, সব হিসেব কেন যে গড়বড় হয়ে যাচ্ছে আজ। ফোন এল রাজীবের, স্ক্রীনে ফুটে উঠল- গুলমোহর। মিন্টি ফোন করছে?এলা কিছু বলার আগেই,  গাড়ি চালাতে চালাতেই ফোন ধরল রাজীব, “হ্যাঁ গুলু,নিয়ে যাচ্ছি তোর মাকে। রাস্তায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাঁদছিল, এত বড় ধেড়ে মেয়ে। খুব করে শাসন করে দিস  তো মা। কিচ্ছু বোঝে না তোর মাটা। এক্কেবারে হাঁদাগঙ্গারাম যাকে বলে-”। ফোনের ওপাড়ে খিলখিলিয়ে হেসে উঠল গুলমোহর, এলার একান্ত আপন কৃষ্ণচূড়া, ফোন ছাপিয়ে যেন গাড়িতে ছড়িয়ে পড়ল বাসন্তী ফাগ- গাড়ি ছাপিয়ে তা ছড়িয়ে পড়ছে শহরে। এলা-রাজীবের গালেও কি লাগল সে ফাগের ছোঁয়া? কে জানে? আকাশে তখন স্বমহিমায় দেদীপ্যমান সোনার থালার মত বসন্তপূর্ণিমার পূর্ণচন্দ্র।
(শেষ)