Sunday 26 June 2022

অনির ডাইরি ২৫শে জুন,২০২২




ঠিক নটায় বেরোই আমরা। যদিও রিপোর্টিং টাইম নটা চল্লিশ আর গাড়িতে যেতে সময় লাগে মাত্র বিশ মিনিট, তবুও একটু আগেভাগেই বেরোই আমরা। রাস্তাটা বেশ ফাঁকা থাকে, মাত্র পাঁচ মিনিট দেরী হলেই প্রায় একসাথে হুড়মুড় করে এসে হাজির হয় গোটা বারো ইস্কুল বাস, একগাদা গাড়ি, কয়েকশ বাইক আর বোধহয় কয়েক হাজার টোটো। পরিণামে গাড়িওয়ালাদের উত্তপ্ত বাদানুবাদ ছাড়া সাময়িক ভাবে স্তব্ধ হয়ে যায় জীবন। তখন ভারী স্কুলের বস্তা সহ মেয়ের হাত ধরে দৌড়তে হয় প্রায় হাফ কিলোমিটার। 


তাই একটু আগেভাগেই বেরোই আমরা। গাড়ির চাকা বাড়ির সীমানা ছাড়ালেই মায়ের মুঠো ফোনের জন্য হাত বাড়ায় তুত্তুরী। ওদিকেও ঠিক নটা বাজলেই তুত্তুরীর ভিডিও কলের জন্য মুখিয়ে থাকে বাবা। প্রতিদিন কল কানেক্ট হলে একই দৃশ্য দেখি আমরা, একহাতে  জ্বলন্ত সিগারেট, অন্য হাতে আমার মায়ের মুঠো ফোনটা নিয়ে আয়েস করে সোফায় বসছে বাবা। এবং প্রথম সংলাপটাও রোজই মোটামুটি একই থাকে, ধোঁয়া ছেড়ে উদাত্ত কণ্ঠে জানতে চায় বাবা, ‘তুত্তুউউরী বেরিয়ে পড়েছ? সঙ্গে কে যাচ্ছে?’ মোবাইল ক্যামেরা ঘুরিয়ে আমায় দেখায় তুত্তুরী। ক্যামেরা আবার তুত্তুরীর দিকে ঘুরে যায়।  বাবা বলে,“ বাঃ! গাড়িতে যাচ্ছ। ‘গাড়ি চালায় বংশীবদন, সঙ্গে যে যায়  ভাগ্নে মদন-’।” ড্রাইভার পলাশ শুনতে পাবে ভেবে মৃদু ধমকায় তুত্তুরী। নাতনীর ধমক খেয়ে, সিগারেটে একটা লম্বা টান মারে বাবা, অতঃপর বলে, ‘আচ্ছা তুত্তুরী, তোমার যেমন একটা পলাশ কাকু আছে, তেমনি কোন শিমূল কাকু নেই?’ দাদুর উৎপটাং কথায় হেসে গড়িয়ে পড়ে তুত্তুরী। নিমতৌড়ির সরকারী আপিস আর আবাসনে ঘেরা এলাকা ছাড়িয়ে গাড়ির চাকা গড়ায় রেলগেটের দিকে। দুদিকে ছাড়া ছাড়া এক দুতলা বাড়ি আর তাদের ফাঁক দিয়ে চোখে পড়ে পিছনের ঘন সবুজ ক্ষেত, পুঁচকে দীঘি, আল বরাবর তাল আর নারকেল গাছের সারি। এখানে এলেই ক্যামেরাটা জানলার দিকে ঘুরিয়ে দেয় তুত্তুরী। দাদুকে চেনাতে চেনাতে নিয়ে চলে পথঘাট। দাদু কিন্তু আটকে থাকে শিমূল আর পলাশের জঙ্গলে। ‘জানো তো তুত্তুরী, পলাশ কাঠের ধোঁয়ায় ভূত পালায়।’ ধ্যাৎ বলে হেসে ফেলে তুত্তুরী। দাদু গল্প শোনায়, কাদের বাড়িতে যেন ভয়ানক ভূতের উপদ্রব হয়েছিল, ওঝা বলেছিল ভূত তাড়াতে মস্ত হোম করতে হবে। তবে বেল কাঠ নয়, হোম হবে পলাশ কাঠে। বড় জেঠু তখন হাজারিবাগে পোস্টেড। কিভাবে যেন বড়জেঠুকে ধরে কয়েক কেজি পলাশকাঠ যোগাড় করে দিয়েছিল বাবা, সেই গল্প চলে। 


রেল ক্রশিং এ আটকে পড়ি আমরা। ডান দিকে দাঁড়িয়ে আছেন স্বামী বিবেকানন্দ। তাঁর পিছনে দাঁত বার করে দাঁড়িয়ে  বিরাট একটা ডাইনোসরাস। খামোখা স্বামীজীর পিছনে ডাইনো ছাড়ার কি মানে ভগবান জানে। রোজ এইটা নিয়ে এক প্রস্থ চর্চা করি আমরা বাপ-মেয়ে আর নাতনীতে। 


রেল ক্রশিং পেরিয়ে গাড়ি গড়ায় হসপিটাল মোড়ের দিকে। হসপিটাল মোড়ের ক্রশিংয়ে ধুতি পাঞ্জাবি পরে দাঁড়িয়ে আছেন শহীদ ক্ষুদিরাম। আমাদের তমলুকের হ্যামিলটন স্কুলের প্রাক্তন ছাত্র। দাদু আর নাতনী আদর করে তাঁর নাম দিয়েছে,‘ছোকরা বা বুক ফুলিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ছোকরা।’ রেল গেট পেরোলেই ছোকরাকে দেখার বায়না করে দাদু। আর তুত্তুরী বায়না করে গল্প শোনার। 


নাতনীর আব্দারে, সাতসকালে "দাদুর ঝুলি" খুলে বসে বাবা। ‘ তোমাদের তুলনায় আমাদের ছোটবেলাটা ছিল অনেক সাদামাটা, আড়ম্বর বিহীন। আমাদের ছেলেবেলায় বিনোদন বলতে ছিল বাঁদর নাচ,ভাল্লুক নাচ, জাদুর খেলা আর নররক্ষস"। বাঁদর নাচ- ভাল্লুক নাচের গল্প চলে কিয়ৎক্ষণ, অতঃপর জানতে চায় বাবা, " তুত্তুরী তুমি পিসি সরকারের নাম শুনেছ?’ শুনেছে তুত্তুরী। বিখ্যাত যাদুকর। ঘাড় নাড়ে দাদু, বলে, তাঁর ছোটবেলায় জাদুর দুনিয়া যিনি কাঁপাতেন তিনি হলেন পিসি সরকার সিনিয়র। বছরে আটমাসই তিনি বিদেশে শো করে বেড়াতেন আর দিশি কাগজে ফলাও করে বেরোত পিসি সরকার সিনিয়রের অলৌকিক সব কাণ্ড কারখানা। সাধারণ পাঠক পড়ত, আর তাদের মনে হত, তিনি নিছক সাধারণ মানুষ নন, তাঁর যাদু নিছক চোখের ধাঁধা নয়। ‘উইজার্ড ছিলেন নাকি?’ ফস্ করে বলে ওঠে তুত্তুরী। সামান্য বিরক্ত হয় দাদু। তারপর বলে, 'নাঃ তা ছিলেন না। তবে সেটা তাঁর জীবদ্দশায় কেউ বুঝতে পারেনি। উনি মারা যাবার বহু বছর পরে, তোমার মায়েদের ছোটবেলায় ওণার পুত্র, জুনিয়র পিসি সরকার তাঁর বাবাকে নিয়ে এক মর্মস্পর্শী লেখা লেখেন। তাতে সেই সময় প্রচলিত অনেক গুজবের আসল কারণ ব্যাখ্যা করেন।’ 


‘দাদু তোমার ছোকরা এসে গেছে’, বলে কাঁচ নামায় তুত্তুরী। ছোকরাকে ঘিরে গোল করে ঘুরে যাই আমরা। পরবর্তী গন্তব্য, ‘বৃদ্ধা বা ঝান্ডা কাঁধে বৃদ্ধা।’ বুঝতেই পারছেন, পূব মেদিনীপুরের ঘরের মেয়ে। গান্ধী বুড়ি। আবার কাঁচ তুলে দেয় তুত্তুরী। দাদু আরেকটা সিগারেট ধরায়, অতঃপর আবার দোঁহে ফিরে যায় দাদুর শৈশবে। সদ্য স্বাধীন ভারতবর্ষে। উপর্যুপরি দেশ ভাগ এবং কয়েক বছর আগের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অভিঘাতে ধুঁকছে বঙ্গদেশ। পিসি সরকার সিনিয়রের যাদু দেখার ক্ষমতা হাওড়া শহরের খুব কম লোকেরই ছিল। মধ্য হাওড়া বাসীদের জন্য ছিলেন স্থানীয় ছোট খাট যাদুকর তথা নররাক্ষস। “নররাক্ষস” শুনে নড়ে চড়ে বসে তুত্তুরী। 


দাদু বলে চলে,“হ্যাঁ। মধ্য হাওড়ার বিভিন্ন জমিদার বাড়িগুলোতে বসত যাদুকর আর নররাক্ষসের খেলা। আমাদের মামার বাড়ির বাগানেও একবার হয়েছিল। দাদুর অনুমতি নিয়ে পড়েছিল তাঁবু।  টিকিটের দাম একআনা। খেলার সাত দিন আগে থেকে যাদুকরের লোকজন রিক্সা চেপে মাইক নিয়ে প্রচার করত পাড়ায় পাড়ায়। মাইক মানে তোমাদের এখনকার মত না। নিছক টিনের চোঙা। তাই মুখে নিয়ে চিৎকার করত। আবার কখনও কখনও ঘোড়ায় টানা গাড়িতে ব্যাণ্ডপার্টি নিয়েও চলত যাদু খেলা আর নররাক্ষসের প্রচার। ব্যাণ্ডপার্টির গদাগুম গদাগুম বাজনা শুনে ছুটে যেতাম আমরা। তখন যাদুকরের অ্যাসিস্টান্ট কোচোয়ানের পাশে দাঁড়িয়ে চোঙা নিয়ে চিৎকার করত। 


সাধারণতঃ রবিবার বা ছুটির দিনে খেলা হত। এক আনা পয়সা দিলে ছোট্ট এক টুকরো কাগজে রাবার স্ট্যাম্প মেরে দিয়ে দিত আমাদের। ওটাই টিকিট। সে যে কি উত্তেজনা তুত্তুরী। টিকিট কাটার পর থেকে উত্তেজনায় রাতে ঘুম আসত না আমাদের। 


আগে হত যাদুর খেলা। পিসি সরকারের মত নয়। ছোট খাট যাদু দেখাতেন যাদুকর। তাসের খেলা। কান মুলে পিছন দিয়ে আমেরিকান ডেলের বড়া বার করা-”। 


“কিঃ” বলে হেসে গড়িয়ে পড়ে তুত্তুরী। হেসে ফেলি আমিও। অতি কষ্টে হাসি চাপে পলাশ। বাবা বলে,“দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের জন্য বৃটিশ সরকার যে শুধু চাল গুদামজাত করেছিল তাই নয়, সেপাইদের জন্য তুলে নেওয়া হয়েছিল ডালও। ফলে বাজারে সে কি হাহাকার। ডালের বদলে আমেরিকা থেকে রপ্তানি করা হয়েছিল কোন এক বিশেষ ধরণের সিরিয়াল। লোকে বলত,‘আমেরিকান ডেল’। উপস্থিত দর্শকদের মধ্যে থেকে এক জন ভলান্টিয়ার চাইত যাদুকর। যে ছেলেটা উঠে যেত, তার বুক পকেটে একটা আমেরিকান ডেলের বড়া রেখে, কি সব অং বং মন্ত্র পড়ত যাদুকর। অতঃপর দেখা যেত ছেলেটার বুক পকেট ফক্কা। কোথায় গেল আমেরিকান ডেলের বড়া। সেই ডেলের বড়া যাদুকর বার করত, ছেলেটার পিছন থেকে।


সবশেষ খেলা ছিল নররাক্ষস। বাগানে একটা কবরের মত গর্ত খোঁড়া থাকত। যাদুকর তাঁবুর ভিতর গিয়ে পোশাক বদলে এসে সেই গর্তে শুয়ে পড়ত। গর্তের মুখটা ঢেকে দেওয়া হত একটা মস্ত কাঠের পাটাতন দিয়ে। তারওপর আবার মাটি চাপা দেওয়া হত। এগুলো করত স্থানীয় ছেলেরা। যাদুকর মাটির তলায় কিভাবে শ্বাস নিত কে জানে? তারপর ক্ষণিক অপেক্ষা। সেকি উত্তেজনা। গোটা তাঁবু জুড়ে সবাই ভয়ে জড়সড়। একটা পিন পড়লেও যেন শব্দ হয়।”


গাড়ির ভিতরেও প্রায় পিন পড়ার শব্দ শোনা যায়, বাঁহাতের শটকার্ট রাস্তাটা ধরতে গিয়েও ধরে না পলাশ। দাদু-নাতনীর প্রিয় বৃদ্ধার মূর্তির দিকে গড়ায় গাড়ির চাকা। বেশ কয়েকবার সিগারেটে টান দিয়ে, গলা ঝেড়ে আবার গল্প শুরু করে বাবা,‘তারপর, বেশ অনেকক্ষণ কেটে যায়। উদ্যোক্তরা ছেলেরা, যারা অধিকাংশই দাদা মানে তোমার বড়দাদুর বন্ধু ছিল, মাটি খুঁড়ে,পাটাতন সরিয়ে যাদুকরকে বার করে আনে। সে ততোক্ষণে যাদুকর থেকে নররাক্ষসে পরিণত। তার তখন সে কি ভয়ানক রূপ। উস্কোখুস্কো চুল, লাল ভাঁটার মত চোখ। সে তখন উন্মাদের মত ঝাঁপিয়ে পড়তে চায় সামনে উপস্থিত কচিকাচা দর্শকদের ওপর। নররাক্ষসের কোমরে মোটা করে দড়ি বেঁধে দুদিক থেকে দুতিন জনে মিলে ধরে রাখে, তাও পারে না। নররাক্ষস,‘হাউ মাউ খাঁউ, মানুষের গন্ধ পাঁউ’ করতেই থাকে। শেষে কেউ একজন একটা জ্যান্ত মুর্গি ছুঁড়ে দেয় নররাক্ষসের দিকে। ঝাঁপিয়ে পড়ে সেই মুর্গিটাকে ধরে নেয় নররাক্ষস, তারপর সবার সামনে তার ঘাড় মটকে, পালক ছিঁড়ে, ছাল ছাড়িয়ে তাকে খেতে থাকে। সে কি ভয়ানক দৃশ্য তুত্তুরী। খেলা শেষ হয়ে যাবার বেশ কিছুদিন পরও আমাদের থেকে ছোট বাচ্ছা যারা ছিল, এই ধর তোমরা ছোটদাদুর বয়সী, তারা একা ঘুমাতে পারত না রাতে। মায়ের বুকের কাছে শুয়ে ভয়ে কাঁপত। মাংস খাওয়া শেষ হলে, নররাক্ষস আবার মানুষ হয়ে যেত। বুঝলে তুত্তুরী, তখন না বুঝলেও, বড় হয়ে বুঝেছিলাম, নিছক দুটো পয়সা রোজগারের ধান্ধায় জ্যান্ত মুরগি খেত লোকটা। পেটের দায়ে মানুষকে কি না করতে হয়।’ 


শহীদ মাতঙ্গিনীর পাশ দিয়ে নীরবে বেঁকে যায় গাড়ি, অভাবী নররাক্ষসের জন্য গাড়িতে বিরাজ করে এক মনখারাপি নীরবতা। কখন যেন এসে পড়ে তুত্তুরীর স্কুল। ফোন কেটে দেয় তুত্তুরী। আজ সকালের উপাখ্যান শেষ হয় এখানেই। কাল আবার হবে নতুন কোন গল্প। যার সাক্ষী থাকবে বিবেকানন্দ-ডাইনো-ছোকরা আর বৃদ্ধা। কে জানে কাল কার পালা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর পরাধীন বা স্বাধীন ভারতের ইতিহাসের পাতা থেকে উঠে আসবে হয়তো আবার কোন অনামী চরিত্র, যারা নীরবে বেঁচে, নীরবেই ঝরে গেছে কালের লিখনে,  রেখে গেছে শুধু এক ঝাঁক স্মৃতি।


*বিধিসন্মত সতর্কীকরণ*- আমার সাদামাটা জীবনের সাদামাটা দিনপঞ্জি। 'মশা মারতে কামান দাগা' বা পাঠকের মূল্যবান সময় অপচয় করা কোনটাই অধমের অভিপ্রায় নয়। অজান্তে যদি করে থাকি নিজগুণে মার্জনা করবেন। আমার আপাতঃ সুখী সুখী দিনপঞ্জি যদি আপনার নিছক ন্যাকা লাগে,  বিবমিষা উদ্রেক থাকে তারজন্যও করজোড়ে মার্জনা ভিক্ষা করি। জোর করে অসুখী, আঁতেল মার্কা লেখা কি করে লিখি বলুন দিকি? দুঃখ যে বড় ব্যক্তিগত অনুভূতি, তাকে কি সবার সামনে বিবস্ত্র করা যায়? মুস্কিল হল আপনি যদি আমার সামান্য সুখের মুহূর্তটাকেই না হজম করতে পারেন, আমার দুঃখটা কি আদৌ আপনার গলা দিয়ে নামবে? সন্তান গরবে গরবিনী বলেও খোঁটা দিল সেদিন কেউ, কি করি বলুন তো, আমি যে নিজেও ঐ শিক্ষায়, ঐ প্রশ্রয়ে বড় হয়ে উঠেছি গো। যেদিন অপরিচিত ছিল শৌভিক, যেদিন পকেট ছিল গড়ের মাঠ, যেদিন চেহারা ছিল নিছক ভিড়ে মিশে থাকা অপাংক্তেয়, সেদিনও যে আমাকে নিয়ে আমার বাবার গরবে মাটিতে পা পড়ত না। আজও বৃদ্ধকে একবার জিজ্ঞাসা করুন দিকি, এই পৃথিবীর সেরা কন্যে কে?দেখবেন তুত্তুরীকেও দ্বিতীয় স্থানে রাখবে বৃদ্ধ। বাবা-মা হয়ে যদি সন্তানের যোগ্যতা আর সাফল্য দেখতে বসি,তাহলে সমাজ দেখবে কি?  আর রইল সময়ের কথা, আমার হাতে অঢেল সময়ের খোঁচা মাঝেমধ্যেই শুনতে হয় আমাকে, বিশ্বাস করুন আমার দিনও কিন্তু মাত্র ২৪ ঘন্টাতেই শেষ হয়ে যায়। তারই মধ্যে কি ভাবে নিজের জন্য তথা লেখালিখির জন্য  সময় বার করি? ওটাকে বলে টাইম ম্যানেজমেন্ট।

অনির ডাইরি ২১শে জুন, ২০২২


 

#তাম্রলিপ্তকড়চা 


রোজই অফিসে ঢোকা-বেরানোর পথে দেখা হয় বয়স্ক ভদ্রলোকের সঙ্গে। পরণে একই নীল সাদা বিবর্ণ টিশার্ট, আর জরাজীর্ণ প্যান্ট। দুহাতে দুটো মস্ত বাজার ব্যাগ নিয়ে চা বিক্রি করেন।একটায় থাকে ফ্লাস্ক ভর্তি চা, অপরটায় কাগজের কাপ, প্লাস্টিকের গ্লাস,প্লাস্টিকের বয়াম ভর্তি সস্তা অনামী ব্র্যান্ডের মারি, ক্রিম ক্রাকার, লোকাল বেকারির বিস্কুট ইত্যাদি। দেখা হলেই ভদ্রলোক জিজ্ঞাসা করেন, ‘ম্যাডাম, ভালো আছেন?’ প্রায় রোজই করেন। তাড়াহুড়োর সময় কুশল সংবাদ জানতে চাইলে যে ভাবে উত্তর দেয় মানুষ,সেভাবেই জবাব দিই আমি,‘হ্যাঁ ভালো আছি। আপনি ভালো তো?’ জবাবও আসে আশানুরূপ, উত্তর আসার আগেই কখনও বন্ধ হয়ে যায় আমার লিফটের দরজা, কখনও বা কেজো হুঁ বলে এগিয়ে যান উনি। আজ একটু বেশিই তাড়ায় ছিলাম, মিটিং এ লেট হয়ে গেছি। লিফটে ওঠার মুখে আবার ওণার সঙ্গে দেখা, আবার,‘ম্যাডাম ভালো আছেন-?’আজ কেন জানি না মনে হল আমার জবাবটা একটু ঘুরিয়ে দিই,  আমি দিব্যি আছি জানিয়ে জানতে চাইলাম, ‘আপনি কেমন আছেন?’ কেজো ব্যস্ত হুঁ আজ আর ফেরৎ এল না। ব্যাগ দুটো মাটিতে নামিয়ে, কপালের ঘাম মুছে বললেন, ‘ভালোই আছি ম্যাডাম। কদিন আগে একটু জ্বর এয়েছিল। বৃষ্টিতে ভিজতেছিলাম কি না তাই। এখনও গা ম্যাজম্যাজাইচ্ছে।’ এবার আমার পালা, কেজো আচ্ছা বলে বলে পাশ কাটিয়ে লিফটে ওঠার। বোতাম টিপতে যাব, উনি আবার বললেন,‘ও ম্যাডাম শোনেন না, আপনি আসছে রবিবার আসবেন?’ কোথায়, প্রশ্নটা বোধহয় আমার চোখে মুখে ফুটে উঠেছিল, উনি ব্যাগ দুটো আবার হাতে তুলে নিয়ে বললেন, ‘আমাদের গাঁয়ে নারান মন্দিরের হইতেছে কিনা, রবিবার তার শুভ উদ্বোধন।মন্দিরটাকে সুন্দর বানাতে অনেক খাটছি আমরা। সবাই চাঁদা তুলে বানাইছি তো। ঠাকুরটা আমি দিইছি। দুদিন ধরে নামগান হবে। সারা গাঁয়ের লোক খাবে। আপনিও আসবেন ম্যাডাম কেমন? খোকাকেও আনবেন, খুব ভালো লাগবে, -’। ওণার সনির্বন্ধ অনুরোধের মধ্যেই বন্ধ হয়ে গেল লিফটের দরজা। আমি না, অন্য কোন তলায় কেউ বোতাম টিপেছে নির্ঘাত। উনি তখনও বিড়বিড় করে ঠিকানাটা বলছিলেন, কোন গাঁ, কোন পুকুরের পাশ দিয়ে, কটা ল্যাম্পপোস্টকে ডাঁয়ে আর বাঁয়ে রেখে ইত্যাদি প্রভৃতি। ক্ষীণ হতে হতে এক সময় হারিয়ে গেল ওণার কণ্ঠ। বন্ধ লিফটের মধ্যে খুব হাসলাম একচোট একাকী। প্রথমতঃ শ্রীমতী তুত্তুরীকে খোকা বলার জন্য আর দ্বিতীয়তঃ ভদ্র ভাবে দুটো কথা বললেই আজও কেমন পলকে আপন হয়ে যায় অপরিচিত মানুষজন।

অনির ডাইরি ১৯শে জুন, ২০২২

 



রবিবার যে ফাদার্স ডে,সেটা মোটামুটি বুধবার দুপুর থেকেই টের পাচ্ছিলাম। গোছা গোছা নোটিফিকেশন আসছিল আমাজন, নায়িকা, মিন্ত্রার মত ই-কমার্স ওয়বসাইট থেকে। বক্তব্য একটাই, ‘স্পেশাল দিনে বাবাকে ইস্পেশাল কিছু কিনে দাও না-’। অনেক  ভাবলাম বৃদ্ধকে একটা টিভি কিনে দিই বরং। বর্তমান টিভিটা আমিই  কিনে দিয়েছিলাম, প্রায় জবরদস্তি করে, এলসিডি বটে, তবে বয়সে তুত্তুরীর থেকেও বড়। মাঝেমাঝেই গোলমাল পাকায়, কিছুদিন আগেই দুটো স্পিকার পাল্টাতে হয়েছে বাবাকে। আরও কি সব খোলনলচে বদলে বর্তমানে দিব্যি চলছে বটে, তবুও-। গ্রেট ইস্টার্ন থেকে কিসব অফার ওয়ালা মেলও এসেছিল, প্রায় কিনেই ফেলতাম, তার আগে ভাবলাম একবার জিজ্ঞাসা করেনি, যা বদমেজাজী বৃদ্ধ, না বলে কিনে দিলে হয়তো সটান ফেরৎ পাঠাবে। 


বেলা চারটে নাগাদ ফোন করতেই খ্যাঁক করে উঠল বৃদ্ধ। বৃদ্ধ-বৃদ্ধার সাধের দ্বিপ্রাহরিক নিদ্রা ভঙ্গের জন্য একরাশ বিরক্তি তো ছিলই, তার থেকে বড় কথা হল, ‘আমার পুরাণ টিভিটার কি হবে-’? বললাম,ফেলে দাও। একযুগ পুরাণ টিভি, কেউ পাঁচশ টাকা দিয়েও কিনতে যাবে না। বলেই প্রমাদ গুণলাম। ধেয়ে এল বাবার শাণিত জিহ্বা,‘ তাহলে, তোমার মাকে নিয়ে কি করব? কাল তো বলবে, আমার বউটাও পুরাণ হয়ে গেছে, একেও ফেলে দিতে।’ বাবার কোলের কাছে গুটিসুটি হয়ে নিদ্রা দেবীর আরাধনা করা মা এটা শুনে কতটা খুশি হল জানি না, আমি হতোদ্যম হয়ে ফোন রেখে দিলাম। 

পুরাণ জিনিসপত্রের প্রতি চাটুজ্জে বাড়ির  দরদ প্রায় প্রবাদপ্রতিম। কিছুই ফেলা হয় না আমাদের বাড়িতে। চাকরী পাওয়া ইস্তক উপহার দেওয়া প্রতিটা শাড়ি, জামা, পাঞ্জাবি,বিছানার চাদর মায় খারাপ হয়ে যাওয়া ইনভার্টারটাও বাবা যত্ন করে রেখে দিয়েছে। শুধু কি আমি, কবে অবসর নেওয়া ছোটমাসি চাকরী পেয়ে প্রথম মাসের মাইনে থেকে একটা ১৮টাকার প্যান্ট উপহার দিয়েছিল বাবাকে সেটাও রাখা আছে নিঁভাজ পাট করে। বাবার জামাকাপড়ের বেহাল দশা দেখে কবে সদ্য বিবাহিত মা কার থেকে যেন কিছু টাকা ধার করে কিনে দিয়েছিল তিনটে শার্ট। আজও গোছানো আছে তা। সেজ-ছোট মাসির বুনে দেওয়া সেই আশি নব্বইয়ের দশকের ফুটো হয়ে যাওয়া সোয়েটার, আছে তাও। বাবা কিছু ফেলে না। মাও না। শুধু আমি কিছু দিতে গেলেই হাড় জ্বলে যায় ওদের। যাই দিতে চাই, তাই নাকি অপ্রয়োজনীয় এবং বাহুল্য বিশেষ। বাড়িতে রাখার জায়গা নেই। স্বাভাবিক, পুরাণ দ্রব্যাদি গুদামজাত করে রাখলে, নতুন জিনিসপত্র রাখবে কোথায়-


বাড়ি ফিরে চায়ের কাপে সেই গল্পই শোনাচ্ছিলাম তুত্তুরীকে। ‘কিন্তু ওরা যখন চাইছেই না, তুমি অকারণ জোর করছ কেন?’ দাদুর ওপর চটে গিয়ে বিরক্ত স্বরে প্রশ্ন করে তুত্তুরী। জবাব একটাই, আমার বাবাটা যে পৃথিবীর সেরা বাবা, তাই না চাইতেই সবকিছু দিতে চাই বৃদ্ধকে। বৃদ্ধ সেটা শুনলে বা বুঝলে তো। 


স্বাভাবিক ভাবেই তুত্তুরীর কাছে তার বাবাটা সেরা, আমার বাবাটাও সেরা বটে, নিঃসন্দেহে সেরা। তবে দাদু হিসেবে। কার বাপটা বেশি ভালো এই নিয়ে মাঝে মধ্যেই কোঁদল করি আমরা মা-মেয়েতে। এবারের কোঁন্দলটা যদিও তেমন জমল না। তর্ক যুদ্ধের মাঝপথে হঠাৎ অস্ত্র ত্যাগ করল তুত্তুরী । অতঃপর চিন্তিত স্বরে,‘ এই মা, ফাদার্স ডে তে আমি কি দেব আমার বাবাকে?’ বললাম কিছু কিনে দিই। তুত্তুরীর বাবাকে নিয়ে তো কোন চিন্তা নেই,পুরাতন জামাকাপড়  জমিয়ে রাখার বদভ্যাসটা তারও ঘোরতর আছে বটে, তবে নতুন কিছু দিলে আপত্তি খুব একটা করে না। বড়জোর মৃদু স্বরে বলে ওসব ‘উস্টুমধুস্টুম’ উপহার না দিয়ে, মূল্য ধরে দিলে বেশী খুশি হত। এই আর কি। 


প্রস্তাবটা পছন্দ হয় না শ্রীমতী তুত্তুরীর। ‘তুমি কিনে দিলে,সেটা তো তোমার দেওয়া হবে।’ যুক্তি অকাট্য। তাহলে? দীর্ঘ মস্তিষ্ক প্রক্ষালন তথা দুধের কাপে ঝড় তুলে অবশেষে উপায় বার করে তুত্তুরী, কোন সিনেমা বা ভিডিওতে দেখা রণবীর কাপুরের মত সারপ্রাইজ স্পেশাল ব্রেকফাস্ট বানিয়ে খাওয়াবে বাবাকে। সাথে থাকবে একটা ছোট্ট বার্তা, ফাদার্স ডে স্পেশাল। 


ব্যাপারটা ভাবা যতটা সহজ, বাস্তব রূপায়ন ততোটাই দুরূহ। লুচি পরোটার মত শৌভিকের প্রিয় প্রাতরাশ বানানো তুত্তুরীর পক্ষে অসম্ভব। তার ওপরে এখানকার গ্যাসের টেবিলটা যা উঁচু। কড়া বসালে রীতিমত লেঙচে দেখতে হবে শ্রীমতী তুত্তুরীকে।  কাজেই ওসব বাদ। তাহলে কি ম্যাগি? শনিবার সকালে ফিল্ড ভিজিটে বেরানোর সময় আমার হাতের স্পেশ্যাল চিলি গার্লিক ম্যাগি খেয়ে বেরিয়েছে শৌভিক। কাজেই ম্যাগিও বাতিল। তাহলে? সারাদিন ধরে ইউটিউবে ফাদার্স ডে স্পেশাল ব্রেকফাস্টের রেসিপি ঘাঁটে শ্রীমতী তুত্তুরী। এমন কিছু যা মূলতঃ মাইক্রোওয়েভেই বানানো যাবে। শুধু তাই নয়, যা ঝটপট বানানো যাবে এবং যার সমস্ত উপকরণ মজুত আছে বাড়িতেই। 


সক্কাল সক্কাল ঘুম থেকে উঠে, স্নান সেরে কাচা তথা ভালো জামা পরে  যখন আমার ঘুম ভাঙাল তুত্তুরী ঘড়ি বলছে সবে সকাল সাতটা। ‘ও এত সকাল সকাল তোকে ডাকছে কেন?’ পাশ থেকে নিদ্রালু স্বরে জানতে চায় শৌভিক। কি বলি, ফেলুদা আর শার্লক গুলে খাওয়া এই লোকটার থেকে কোন কিছু গোপন রাখা বেশ দুষ্কর। তবুও বলি,ও কিছু না। তুত্তুরীর কিছু কাজ করে দিতে আমায়, তাই ডাকছে। সকালের কফি তৈরি হবার আগেই তৈরি হয়ে যায় আমাদের কেক মিক্স, এবার শুধু ফেটানোটাই যা বাকি। শৌভিক কফি খেতে নামে, রোজকার মত গোবেচারা মুখে দুধ আর চায়ের কাপ নিয়ে বসে আমরাও। আলোচনা করি উল্টোপাল্টা অপ্রাসঙ্গিক ব্যাপারস্যাপার নিয়ে। দিব্যি কফি খেয়ে, খবরের কাগজের পাতা উল্টে দোতলার সিঁড়িতে পা রাখে শৌভিক, আচমকা শ্রীমতী তুত্তুরী ঘাবড়ে গিয়ে বলে বসে,‘হ্যাঁ। হ্যাঁ। যাও যাও। আমরা কিচ্ছু করছি না।’ পটাং করে পিছন দিকে ঘুরে যায় শৌভক, সার্চলাইট ফেলার মত করে নজরদারি চালায় মা মেয়ের ওপর। অতঃপর, ‘হুঃ। তারমানে কিছু একটা অপাট করছিস তোরা দুটোতে মিলে-’।  


সেযাত্রা বাবা বাছা বলে দোতলায় পাঠাতে পারলেও, চাদর কাচতে দেবার অছিলায় আবার নেমে আসে শৌভিক এবং এবার একেবারে আমাদের অজ্ঞাতসারে। রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে কেকের ব্যাটার ফেটাতে শেখাচ্ছিলাম মেয়েকে, আচমকা,‘তার মানে আজ কেক বানানো হচ্ছে। যেটা বড়টা বানাবে আর ছোটটা দাবী করবে যে  ও বানিয়েছে।’ পলকে ফুলে ওঠে তুত্তুরীর ঠোঁট। হ্যাঁ আমি দেখিয়ে দিয়েছি বটে, প্রয়োজনে ডিমও ফাটিয়ে দিয়েছি, মিক্সির কন্টেনারটা ঠিক করে বসিয়ে দিয়েছি যাতে বিপদ না বাঁধায়,স্যান্ডউইচের পেঁয়াজ-শসা- গাজর কেটে দিয়েছি ইত্যাদি প্রভৃতি কিন্তু আসল মেহনত তো শ্রীমতী তুত্তুরীই।


সেসব বলতে, বোঝাতে গেলে এখন ধরা পড়ে যাবে পুরো পরিকল্পনাটাই। তাই লাস্যময়ী হয়ে বললাম,‘ঠিক ধরেছ। শোন না কেক হলে আমরা ডাকব বরং, তুমি এখন ওপরেই থাকো। বড্ড বিরক্ত করছ।’ 


ফেটানো কেকের ব্যাটার ঢালা হয় চায়ের কাপে, কাপ ঢোকে মাইক্রোওভেনে। তুত্তুরী দৌড়য় বাবার জন্য একগোছা ফুল তুলতে। রণবীর কাপুরের মত করে ট্রেটা সাজাতে হবে তো। কদিন আগেই বাগানে আবিষ্কৃত হয়েছে গর্ত সমেত সাপ। তিনি আবার এত দুঃসাহসী যে আমরাও যেমন তাঁকে দেখতে দৌড়েছিলাম, তিনিও তেমনি গর্ত থেকে মুখ বার করে দেখছিলেন আমাদের। তাঁর ভয়েই বোধহয় তুত্তুরীর পিছন পিছন দৌড়য় বাগানে কাজ করতে আসা মাসি আর সিকিউরিটি ছেলেটা। 


মস্ত ট্রে তে গরম গরম চকোলেট কাপকেক আর সদ্য তুলে আনা সূর্যমুখী ফুল রেখে সবে স্যান্ডউইচ বানানোতে হাত লাগিয়েছে তুত্তুরী , এমন সময় সিঁড়ির রেলিং এর ফাঁক থেকে ভেসে আসে শৌভিক বাণী, ‘আচ্ছা, কেকটাকে আবার সাজানোও হচ্ছে দেখি। পাঁউরুটি দিয়েও কিসব বানানো হচ্ছে-’। এইভাবে সারপ্রাইজ ব্রেকফাস্ট হয় মাইরি? 


 শেষ পর্যন্ত তুত্তুরী যা বানাতে পেরেছিল ,নীচে রইল তার ছবি। হাবেভাবে প্রকাশ না করলেও ভয়ানক খুশি হয়েছে শৌভিক বেশ বুঝতে পারলাম আমি, কারণ এতকিছুর মধ্যে তুত্তুরীর বার্তা থেকে কেবল একটা গ্রামাটিক্যাল এরর ধরেছে শৌভিক, আর একবার শুধু বলেছে ‘ফুলটা কিন্তু আমি খাব না।’ ওটুকু প্রত্যাশিত।  এমনি ভাবেই ভালো থাকুক পৃথিবীর সব বাবারা, এমনি হাসিখুশি আর ভালোবাসায় জবজবে থাকুক সব সম্পর্ক, বছরের সবকটা দিন। এমনিতেও প্রতিটা মেয়ের সারা জীবনের প্রতিটা মুহূর্ত জুড়ে একছত্র রাজত্ব চালায় যে লোকটা, তার জন্য কি মাত্র একটা দিনে পোষায়। অন্তত আমার আর তুত্তুরীর জন্য,  রোজই তো বাবা দিবস

অনির ডাইরি১লা জুন, ২০২২


 


মাঝে মাঝে মনে হয়, যে আমরা নিজেরা যতটা নিজেদের আহত করি, ততোটা আঘাত বোধহয় আর কারো পক্ষে করা সম্ভব নয়। চোখ বুজলে আজও দেখতে পাই সেই দিনটাকে, নব্বইয়ের দশকের শেষ ভাগ,খবরের কাগজ জোড়া পেজারের বিজ্ঞাপন থাকলেও মুঠোফোন ছিল কেবল মাত্র সাইন্স মিউজিয়ামে দেখানো এক কল্পবিজ্ঞান মাত্র। মধ্যবিত্তের যোগাযোগের মাধ্যম বলতে হয় চিঠি নয়তো চাকা ঘোরানো ল্যাণ্ডফোন। তাই বা কটা বাড়িতে ছিল? একটা ফোন করতে হলে হেঁটে যেত হত পাড়ার স্যাকরার দোকানে বা বড় রাস্তা পেরিয়ে উল্টোফুটের পিসিওতে। তিন মিনিট, তিনটি টাকা। তিন মিনিটের পর এক সেকেণ্ড হলেও গুণতে হত পাক্কা ছ-ছটাকার গুণাগার। 


কি যেন দরকারে মেজদাকে ফোন করেছিলাম সেদিন। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতে বসেছিল, স্যাকরার দোকানের ঝাঁপ বন্ধ, অগত্যা গলির মোড়ের পিসিও। কাঁচের ঘরের মধ্যে রাখা বোতাম টেপা ফোন, প্রাইভেসি একটু বেশী বলে পাড়ার উঠতি কপোত-কপোতীদের প্রিয় ফোন করার জায়গা। প্রথম বুথে তেমনি ঢুকেছিল কেউ, দ্বিতীয় বুথ থেকে মেজদার সঙ্গে কেজো কথা সেরে ফোন রাখতে যাচ্ছি, ওপাশ থেকে ভেসে এল মেজদার তরল কণ্ঠ,‘ দাঁড়া ছাড়িস না। তোর সাথে কথা বলবে বলে দিদা ছুটে আসছে -’। 


যুগপৎ দাদুর অকাল মৃত্যু এবং চাকরির সন্ধানে মা ও মাসিদের গ্রাম ছেড়ে মহানগরে চলে আসার পর দীর্ঘদিন উত্তরবঙ্গের সীমানা ঘেঁষা এক অজ গাঁয়ে একাই থাকত দিদা। আমাদের সাথে যোগাযোগের মাধ্যম বলতে ছিল হাতে লেখা চিঠি। পত্রলেখা বড় দীর্ঘসুত্রী, মেয়ে- জামাই- নাতি- নাতনীকে এক ঝলক দেখা বা সামান্য দুটো কথা বলার জন্য তৃষিতের মত অপেক্ষা করে থাকত দিদা। তাই বোধহয় দূরভাষ যন্ত্রটা এত প্রিয় ছিল বৃদ্ধার। ফোনের ঘন্টা বাজলে শিশু সুলভ উচ্ছ্বাসে উথলে উঠত দিদা। শিশুদের মতই ঘুরঘুর করত ফোনের আসেপাশে দুটো কথা বলা বা শোনার লোভে। সেদিনও তার ব্যতিক্রম হয়নি,আদরের ঝুমির সাথে দুটো কথা বলার জন্য ছুটে আসছিল দিদা, কিন্তু পিসিওর ঘড়ি যে বলছিল তিন মিনিট হতে আর কটাই সেকেণ্ড বাকি। তাই তড়িঘড়ি ফোন রেখে দিলাম আমি, বললাম, যাবই তো বাবা মায়ের সঙ্গে সপ্তাহান্তে,  আর কদিন পরে, তখন কথা হবে দিদার সাথে। 


গিয়েওছিলাম, বাবা-মায়ের হাত ধরে। মাত্র এক বেলায় ওলটপালট হয়ে গিয়েছিল আমাদের দুনিয়া। সারা দিন কিচ্ছু খায়নি মা, আইসিইউ এর কাঁচের জানলার এপাশ থেকে, ওপাশে সংজ্ঞাহীন দিদার দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে কেঁদে কেঁদে ফুলিয়ে ফেলেছিল চোখ। হাসপাতাল থেকে কয়েক মুহূর্তের জন্য বাড়ি ফিরেছিল শুধু আমায় নিয়ে বড়মাসির বাড়ি যাবে বলে। বাড়ি ফিরতেই জোর করে কয়েক গাল ভাত খাইয়েছিল জ্যাঠাইমা, মায়ের অজ্ঞাতে আমাকে ফিসফিস করে বলেছিল, ' মায়ের দিকে একটু নজর রাখিস।' ভাত মেখে মুখে ঢুকিয়ে দেওয়া সত্ত্বেও খেতে পারছিল না মা, কেঁদেই যাচ্ছিল ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে। 


বড়মাসির বাড়ি যখন পৌঁছালাম ঘড়ি বলছে রাত সাড়ে আটটা। চারদাদার সৌজন্যে অন্যান্য দিন গমগম করত যে বাড়ি, সে বাড়িতে সেদিন শুধুই চাপচাপ মনখারাপ। কেউ কথা বলছিল না ভালো করে। বড়দা আর সেজদা সম্ভবতঃ হাসপাতালে ছিল, চির ফাজিল ছোটদাও যেন কেমন গুম মেরে গিয়েছিল সেদিন। পরিস্থিতি তরল করতে মেজদা কেবল বারেবারে সবাইকে আশ্বস্ত করছিল, ‘চিন্তার কোন কারণ নেই, ও বুড়ি ঠিক ফিরে আসবে।’ 


ফিরে এসেছিল তো দিদা। রাত তখন এগারোটা। বাইরের ঘরে লম্বা বিছানা করে সদ্য শুয়েছি মা, সেজ মাসি, ছোট মাসি আর আমি। ঘুম নেই কারো চোখে। হঠাৎ বেজে উঠল কলিং বেল। তড়িঘড়ি দরজা খুলে দেখি শুকনো মুখে বড়দা দাঁড়িয়ে। ‘কি হয়েছে দাদা? দিদা সুস্থ হয়ে গেছে? তাই বোধহয় ফিরে এসেছ তুমি?’ বড়দা গলা ঝেড়ে বলল, ‘বাবাকে ডাক।’ বাবা মানে বড় মেসোমশাই। ততোক্ষণে পটপট জ্বলে গেছে সব আলো। মশারি খুলে গুটিয়ে ফেলা হয়েছে বিছানা। কোথা থেকে যেন খবর পেয়ে জড় হয়ে গেছে চার দাদার অগণিত বন্ধু। তাদেরই কাঁধে চেপে এল দিদা। বন্ধ দুই চোখ,মুখে অসীম প্রশান্তি। ঠিক যেন ঘুমোচ্ছে। 


বড়মাসির গাম্ভীর্যপুর্ণ নিয়ন্ত্রিত শোক, দিদার মুখের ওপর ঝুঁকে পড়ে মায়ের গুমরে গুমরে কান্না, সেজ মাসির বুক ফাটানো বিলাপ, ছোট মাসির ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কান্না, দাদাদের ভিজে চোখ আর সবকিছু ঝাপিয়ে আমার চরম অপরাধবোধ,তিনটে টাকা, মাত্র তিনটে টাকার জন্য আমার সাথে কথা না বলেই চলে গেল দিদা। 


প্রায় সিকি শতাব্দী আগে চলে যাওয়া দিদা, যেতে যেতে এক অমোঘ শিক্ষা দিয়ে গিয়েছিল, টেলিফোনে কখনও কোন বার্তালাপ আধখেঁচড়া ছাড়ি না আমি। পারতপক্ষে দূরভাষে কোন মতান্তরে যাই না আমি, অবশ্য যদি উল্টো দিকের লোকটা আমার প্রিয় পাত্র হন। ক্ষণিকের উত্তজনায় কদাচিৎ যদি তাদের সাথে কোন উত্তপ্ত  বাক্য বিনিময় হয়েও যায়, মাথা ঠাণ্ডা হবার সাথে সাথেই তাকে ফোন করে মিটিয়ে নিই আমি। দেরী করে লাভ কি, কে জানে কি লুকিয়ে আছে কালের গহ্বরে। বিশ্বাস করুন অসমাপ্ত সংলাপ আর শেষ না হওয়া কথাগুলো বড় কশাঘাত করে, করতেই থাকে, অকারণেই ভিজিয়ে দেয় চোখের কোণ,যখন তখন, হয়তো জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত।

Wednesday 8 June 2022

ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি, ৭ই জুন, ২০২২

 


👩🏻-ম্যাম এসে বসে আছেন তো, এতক্ষণ ধরে ওপরে কি করছ?

👧🏻- (বইয়েরওপর ঝুঁকে পড়ে, অন্যমনস্ক ভাবে) হুঁ। 


👩🏻-(সামান্য অধৈর্য হয়ে) এখন হোমওয়ার্ক করছ? সারাদিন কি করেছ? শুধু বম্ বম্ করে ঘুরে বেরিয়েছ?

👧🏻-(আশ্বস্ত করার ঢঙে) না, না, হোমওয়ার্ক হয়ে গেছে। একটা জিনিস লিখে ফেলেছিলাম সেটাই মুচছি। 

👩🏻-(তরল গলায়) কি লিখেছিলি, ‘আই লাভ শাহরুখ?’

👧🏻-(হেসে ফেলে) নাঃ। লিখেছিলাম,‘আই লাভ ভিকি।’

👩🏻- (হতভম্ব হয়ে) অ্যাঁ, এই ভিকিটা আবার কে?


👧🏻-(চোখ গোলগোল করে) উফ্ মা। ভিকি কৌশল?

👩🏻-(বোকা বনে) ও হো,তাও তো-। শোন বাবু যেখানে খুশি লেখ শুধু পড়ার বইতে লিখিস না, কেমন?

👧🏻-(হেসে ফেলে) লিখিনি। শুধু আই লাভ লিখে ছেড়ে দিয়েছিলাম। তুমি আমাকে ভীষণ ভালো বোঝ মা। 

👩🏻-(দীর্ঘশ্বাস ফেলে) হ্যাঁ। কারণ আমিও তো, ক্লাস সিক্সেই, প্রথমবার (ঢোঁক গিলে), ঘরের দেওয়াল পেন্সিল দিয়ে লিখেছিলাম,‘ আই লাভ মাই রুম।’ সলমান খান লেখার সাহস হয়নি কি না।

Saturday 4 June 2022

অনির ডাইরি ২৪শে মে, ২০২২

 



বিয়েটা সপ্তাহান্তে করলেও, বিবাহবার্ষিকীটা কেন যে ঘুরে ফিরে সেই কাজের দিনেই পড়ে-। এ কথা অনস্বীকার্য যে প্রথম বিবাহবার্ষিকীর উন্মাদনা ত্রয়োদশ বরষে থাকে না। আর আমাদের প্রথম বিবাহবার্ষিকীটাও যা কেটেছিল, আহাঃ-। স্বপাকে বানানো ডাল- ভাত, বেগুন ভাজা আর ডিমের ঝোল খেয়ে দিব্যি ক্ষুদিরাম হয়ে আপিস গিয়েছিলাম দোঁহে। বেলা আড়াইটে নাগাদ, শৌভিক ফোন করে বলেছিল, ‘ধুৎ কিচ্ছু ভালো লাগছে না। কোথাও ঘুরতে যাবি?’


 অতঃপর খড়্গপুর ২নং ব্লকের সমষ্টি উন্নয়ন আধিকারিকের সাদা অ্যাম্বাসাডরে চেপে, ধূধূ ফাঁকা রাস্তা বরাবর হারিয়ে যাওয়া। নামানো কাঁচের ফাঁক দিয়ে ছুটে আসছিল দম বন্ধ করা হুহু হাওয়া। দুপাশে যতদূর দুচোখ যায়, আঁকাবাঁকা লাল মোরাম বিছানো নিঃসঙ্গ পথ আর নয়ানজুলি, নিরিবিলি ঝাউ আর ইউক্যালিপটাসের জঙ্গল। মাঝে মাঝে উচ্চাবচ কালভার্টে ঝাঁকুনি খাচ্ছিল গাড়িটা। গন্তব্য ছিল গড়বেতা স্থিত তৎকালীন মেদিনীপুরের সবথেকে বড় এবং জনপ্রিয় পার্ক, নাম ঝিলমিল নাকি নির্মলকানন। জঙ্গলমহল তখন আক্ষরিক অর্থেই মুক্তাঞ্চল, তারই মধ্যে স্থানীয় কপোতকপোতীদের প্রিয়তম তথা রোমান্টিকতম ডেসটিনেশন। তাই বলে সেন্ট্রাল পার্ক সুলভ কিছু ভেবে টেবে বসবেননি আবার। আসলে ড্রাইভার শৈবালদাকে বলা হয়েছিল, নব দম্পতির বিবাহবার্ষিকী পালনের জন্য একটা জম্পেশ জায়গায় নিয়ে যেতে। উনিও তাই মাথা খাটিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। অথচ পৌঁছে আর কিছুতেই নামতে চায়নি  শৌভিক। বেচারা হতভম্ব শৈবাল দার মুখের অবস্থা ছিল দেখার মত। এমন সুন্দর পার্ক ও শেষে সাহেবের নাপসন্দ? এ ব্যাটারা চায় কি?  

 

নাঃ তেমন কিছুই চাই না আমরা, একটু বেলা করে ঘুম থেকে ওঠা, একটু বেশি উদরপূর্তি, কাছে পিঠে কোথাও ঘুরে আসা আর একরাশ স্মৃতি রোমন্থন,ব্যাস,এই তো -- "একটু খানি চাওয়া আর একটু খানি পাওয়া, এই আবেশেই হোক না মধুর আমার এ গান গাওয়া।’


  পিছন ফিরে তাকালে কম পথ তো হাঁটিনি মোরা এক সাথে-। সেই যে মাদপুরে আমাদের ছোট্ট সংসার। আপিস থেকে কোয়ার্টারে ফিরেই ফোন করতাম,‘ আমি কিন্তু এসে গেছি।’ অমনি ডাক ফাইল বগলে বাড়ি চলে আসত শৌভিক।কোয়ার্টারেই আনিয়ে নিত বাকি ফাইলপত্র। ডাইনিং টেবলে বসে ফাইল সই করত একজন, অপরজন কাটতে বসত সব্জিপাতি। একবার আমার পটল ভাজার তপ্ত কড়াইয়ে পড়ে ভাজা হয়ে গিয়েছিল একটা মথ। আমি তো ভয়ে ঘেন্নায় কেঁদেই আকুল। ফাইল ফেলে ঝাঁজরি হাতা দিয়ে তেলে ভাজা মথ তুলতে দৌড়েছিল শৌভিক। 


আর সেই সপ্তাহান্তে খড়্গপুরের সেই ঝিমুনি ধরা সন্ধ্যাগুলো যখন একলা অন্ধকার গাড়িতে বসে মশার কামড় খেতাম শুধুই তার প্রতীক্ষায়। অনেক অঙ্ক টঙ্ক কষে, ব্যাগপত্তর গুছিয়ে ঠিক সাড়ে পাঁচটা নাগাদ ঢুকতাম আমরা খড়্গপুরের মহকুমা শাসকের দপ্তরে। পরিকল্পনা থাকত যে দুটো আপাত গুরুগম্ভীর ফাইল নিয়ে শৌভিক ঢুকবে বড় সাহেবের চেম্বারে, চুপচাপ গাড়িতে বসে থাকব আমি। তারপর সুযোগ বুঝে বাড়ি ফেরার কথাটা পাড়বে শৌভিক। ফিরিস্তি দেবে শেষ কবে বাড়ি ফিরেছিলাম দোঁহে। সামনাসামনি অনুরোধ করলে নির্ঘাত না বলতে পারবেন না বড় সাহেব। আর বললে, আবার ফিরে গিয়ে ভাত চাপাব আমরা। 


খড়গপুর থেকে হাওড়া, তাও গাড়ি করে আসার সাহস ছিল না আমাদের। গাড়ি যেত কেবল মাদপুর থেকে খড়্গপুর স্টেশন অবধি। তারপর ট্রেন, তারপর রিক্সা। 


তৃষিতের মত মহকুমা শাসকের চেম্বারের দরজার দিকে তাকিয়ে থাকতাম, তার প্রতীক্ষায়। গাড়িতে লাগানো ছিল একটা পুঁচকে ফ্যান, তবে তা চলত কেবল যখন গাড়ি দৌড়ত। গাড়ি বন্ধ তো তিনিও নিদ্রিত। সুযোগ বুঝে ঝাঁপিয়ে পড়ত মশার পাল।  আজকের তুলনায় নেহাৎ সস্তার নোকিয়া ফোন, মাত্র এক জিবির মেমারি কার্ড। তাতে সম্বল বলতে সাকুল্যে গুটি বিশেক গান। অন্ধকারে মশা মারার ব্যর্থ প্রচেষ্টার ফাঁকেফোকরে তাই বসে বসে শুনতাম, বার বার। 


সাড়ে ছটা নাগাদ হাসি মুখে বেরিয়ে আসত শৌভিক। অতঃপর ভিড়ে ঠাসা ইস্পাত বা ধৌলি। আরেকটু রাত হলে রূপসী বাংলা। ইস্পাত বা ধৌলিতে বসার জায়গা পাওয়া ছিল নিছক কষ্টকল্পনা। দরজার কাছে জড়সড় হয়ে দাঁড়াতাম দোঁহে। এই ভাবেই কবে যেন দুই থেকে আড়াই হয়ে গেলাম আমরা। 


খড়্গপুরের পর ট্রেন থামত সাঁতরাগাছি, আমরাও তো ওখানেই নামব, ফলে সিট পাবার প্রশ্ন উঠত না। ধেড়ে তুত্তুরীকে উদরে নিয়ে,একে অপরের হাত ধরে ভালোয় ভালোয় নামতে পারলেই বাঁচতাম দুজনে। তারপর সাঁতরাগাছি স্টেশনে মাটির ভাঁড়ে চা আর কেক খেয়ে পরের লোকাল ধরে দাশনগর। অতঃপর রিক্সা। ভাড়া এমনিতে কুড়ি হলেও, রাত বাড়লেই হয়ে যেত পঁচিশ।  


 জন্মের পর, সারা দিন ঘুমাত, সারা রাত জাগত তুত্তুরী। সে যে কি অসহনীয় যাতনা। অন্য দিন গুলো একসাথেই রাত জাগতাম তুত্তুরী, মা আর আমি।  সপ্তাহান্তে একটা রাতের জন্য বাড়ি ফিরত শৌভিক, সেই রাত গুলোয় মাকে রেস্ট দিয়ে তিনজনে মিলে রাত জাগতাম আমরা। অরকুটে একটা ছবি ছিল, যার ক্যাপশনই ছিল, ‘উই থ্রি, অ্যাট থ্রি।’ রাত তিনটেয়, মোরা তিনজন। 


মাঝে মাঝে আর সহ্য হত না এই রাত জাগার অত্যাচার, প্রচণ্ড বকতাম ছোট্ট তুত্তুরীকে। ঠোঁট ফোলাত তার বাবা ,‘ ও কিন্তু খুব অসহায়। আমরা ছাড়া ওর কেউ নেই-’। বয়স বাড়ার সাথে সাথে বুলি ফুটল তুত্তুরীর, শৌভিক বাড়ি ফিরলেই, ভেসে আসত আধো আধো বুলি ‘বাবা এলি? একবার এলি, দুবার এলি? কফি খাবি?’ 


 কবে যে আমাদের সম্পর্কের মধ্যে ঢুকে ঠেলেঠুলে জায়গা করে নিল মেয়েটা, কবে যে আলাদা দল গড়ে ফেলল বাপ-মেয়েতে আমি বুঝতেই পারলাম না।  একজনকে বকলে কোমর বেঁধে ঝগড়া করতে আসে আরেকজন। গাড়িতে উঠলেই বমি করত তুত্তুরী এবং কাকতালীয় ভাবে প্রতিবারই বমি করত শৌভিকের গায়ে। গাড়িতে উঠেই দুহাত বাড়িয়ে বলত,‘ বাবা নেঃ।’ যেই শৌভিক কোলে নিত,অমনি ওয়াক। কয়েক হাজার বার শৌভিকের গায়ে বমি করেছে মেয়েটা, অথচ সেসব কথা কেউ তোলে না এ বাড়িতে। বমির প্রসঙ্গ উঠলেই কেবল দোষী সাব্যস্ত হই আমি। সেই যে সেবার দিল্লী থেকে সিমলা যাবার পথে বমি করেছিলাম আমি, আজও রসিয়ে রসিয়ে সেই চর্চা করে বাপ আর মেয়েতে। গোটা ভলভো বাসের সব বমির প্যাকেট নাকি আমি একাই শেষ করে দিয়েছিলাম। এরকম আরো যে কত অপবাদ দেওয়া হয় আমার নামে। আমার যাবতীয় ইচ্ছে-অনিচ্ছে, পছন্দ-অপছন্দ, ভালো লাগা-মন্দ লাগার বিরুদ্ধাচারণ করাটাই এদের বাপ মেয়ের নৈমিত্তিক কর্তব্য। 


যেমন ধরুন, আজ আমাদের বিয়ের দিন, কোথায় একটু বেলা করে ঘুম থেকে উঠব, আজকেই নাকি গোটা বাড়ির সব বিছানার চাদর আর বালিশের ওয়াড় কাচতে হবে এদের। আজ দুপুরে দীঘায়  মিটিং আছে শৌভিকের, কখন ফিরবে কে জানে? বললাম একটু বেলা করে আপিস যা তাহলে,অথবা আজ আপিস না গেলেও তো হয়? অফিসে নাকি এত ফাইল জমে আছে, যে সময় মত না গেলেই নয়। ভেবেছিলাম ছুটি নেব আজ, সপ্তাহের মাঝে বাইরে খাওয়াতে নিয়ে যাবার আব্দার তো আর করতে পারি না, তাই বাড়িতেই রান্না করব কিছু টুকটাক। আচমকা ঠিক হওয়া দীঘার মিটিংটা দিল সব পণ্ড করে। আড়াইটে থেকে মিটিং, কে জানে কতক্ষণ চলবে। তারপর ফিরতেও আরও ঘন্টা দুই, জ্যামে পড়লে আড়াই-।  গেল এ বছরের বিবাহবার্ষিকী। 


শৌভিক যদিও অনেক সান্ত্বনা দিয়ে গেল, কথা দিয়ে গেল সাড়ে চারটের মধ্যে পাক্কা বেরিয়ে পড়বে সমুদ্র সুন্দরীর গাঁটছড়া খুলে, ওসব নিছক কথার কথা।  মনখারাপ করে ঘুরে এলাম গোটা কয়েক দুয়ারে সরকারের ক্যাম্প থেকে, আপিসে আজ আর ঢুকলাম না। অন্যান্য বার যাঁরা ফোন করে শুভেচ্ছা জানান, এ বার বোধহয় তাঁদেরও মাথা থেকে বেরিয়ে গেছে দিনটার কথা। বললেই শৌভিক বলে,‘কেন করবে? কি এমন স্পেশাল আমরা।’ তা বটে, তবুও বিশেষ বিশেষ দিনে আপনজনদের কাছে এই অন্তঃসলিলা দাবীটা আমার থেকেই যায়, বিশেষতঃ যাঁরা এত ভালোবাসেন আমাদের। 


বিকাল সাড়ে চারটে নাগাদ ফোন করল জনৈক বন্ধু,নিছক কাজের ফোন। আগ বাড়িয়ে তাকেই বললাম,‘জানিস আজ আমাদের বিবাহবার্ষিকী। এমন দিনে দীঘা  গেছে শৌভিক, আমাদের নিয়ে যায়নি।’ ভেবেছিলাম সমব্যথী হবে, দুটো সান্ত্বনার কথা বলবে। উল্টে সুহৃদ বলল,‘ভালো হয়েছে তোকে নিয়ে যায়নি। গেলেই শালা দুটো ছবি লাগাতিস, আর  আমার বউ আমার মাথা খারাপ করে দিত। তুই রবিবার ক্যাম্পে গিয়েছিলি, তাই নিয়েই আমায় চারটে কথা শোনাল, তুই গেছিস, আমি কেন যাইনি? বললাম অনিন্দিতাও যায়নি, পুরাণ ছবি পোস্ট করছে, তাই নিয়ে কি বাওয়াল।’  সাধে রাষ্ট্র ভাষায় বলে মাইরি, এমন বন্ধু থাকতে, শত্রুর কি প্রয়োজন? এই জন্যই অপদার্থ বন্ধুটির থেকে ওর বউকে আমি বেশি ভালোবাসি। 


বন্ধুর সাথে তরল বাক্য বিনিময়ের মাঝেই, শৌভিকের কল ওয়েটিং, তড়িঘড়ি ফোন কেটে ফোন করলাম। নির্ঘাত বলবে, রাতে খেয়েই ফিরবে আজ। ওদিক থেকে ভেসে এল, আবেগ মথিত বাক্যবাণ,‘হুঁ, বেরিয়ে পড়েছি। রান্না বসিয়েছিস তো?এক কাপ চা ছাড়া কিছুই খাইনি মিটিং এ।’ ঘড়িতে পৌনে পাঁচ। শৌভিকের জলদি বাড়ি ফেরার পুলক ছাপিয়ে উঠে এল একরাশ উৎকণ্ঠা। সর্বনাশ, মনের দুঃখে আমি যে রুটি আর কুমড়োর ঘ্যাঁট বানাতে বলেছি গো। 


পুনশ্চঃ শেষ পর্যন্ত শৌভিক বাড়ি ফিরেছিল সাড়ে সাতটা নাগাদ। তড়িঘড়ি যা বানাতে পেরেছিলাম -বাপমেয়ের ভয়ানক প্রিয় মেয়োনিজ সহ ফ্রেঞ্চ ফ্রাই, কসুরি মেথি গন্ধী মালাই পনির, গোটা মশলা দেওয়া কষা মাংস,লাল-লাল চাপ চাপ পায়েস আর ইয়ে পরোটা। সত্যি বলতে কি, বানাতে তো গিয়েছিলাম লাচ্ছা পরোটা, দ্বিতীয় দফা বেলার পর আর ভাঁজ গুলো খুঁজে পেলাম না। ভয়ানক মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল মাইরি, শৌভিক যদিও বলল, এটাই বেশি ভালো হয়েছে। ও নাকি লাচ্ছা পরোটা দুচক্ষে দেখতে পারে না। সে তো ও আমার সব কিছুকেই ভালো দেখে, তাই ওর কথায় আর কে বিশ্বাস করে?