Sunday 30 May 2021

অনির ডাইরি ২৯শে মে, ২০২১

 



তুত্তুরীর টিন এজটাকে বড় ভয় আমার। কে জানে কেমন হবে তখন মেয়েটা।  কতটা বনবে আমার সাথে। এখনও যে খুব একটা বনে তা নয়। অবশ্য তাতে আমার অবদানও খুব একটা কম কিছু নয়।  যেমন আজ সকালে, কি যে আজব ভাষায় গান গাইছিল  মেয়েটা। যার না আছে মাথা না মুণ্ড। 'আ লাড়ুম। ইরঙ্গল তুনিড়োরে, পাদঙ্গল তিমিরোড়ে, সি রঙ্ঘলওয়া‘ রঙ্গলওয়া, রঙ্গলওয়া। ভূরি। কড়াঙ্গল দিদু উঙ্গল, কালাম্বিনী মেদুনি আপ্পা, বিদপো, ভিদমনি-’।’ 


 সাধ করে বাংলা তর্জমা করেদিলাম, ‘আয় নাড়ু। আকাশে তিমি ওড়ে, দঙ্গল বেঁধে তিমি ওড়ে। কড়ে আঙুলে দিদু ওড়ে। সি মঙ্গলবার, বুধবার, বিষ্যুৎবার। ভুঁড়ি। ’ ভেবেছিলাম খুশি হবে, খুশি তো হলেই না, উল্টে রণে ভঙ্গ দিয়ে বাবার কাছে নালিশ করতে দৌড়ল শ্রীমতী তুত্তুরী। এরা বাপ-মেয়েতে যে তলে তলে যুক্ত ফ্রন্ট খুলেছে তা আমি দিব্য বুঝতে পারি। কাল যখন মনের ভুলে, নুনের কৌটো ফ্রিজে তুলে সারা বাড়ি তোলপাড় করছিলাম আমি, তখনও এরা খুঁজে দেবার বিন্দুমাত্র চেষ্টা না করে, দল বেঁধে আওয়াজ দিচ্ছিল। 


 এই তো সেদিন পর্যন্তও মেয়েটা বলত,  ‘আমি দিদিকে বিয়ে করব।’ দিদি অর্থাৎ আমার বাবার দিদি। এষার সাথে আলাপ হওয়ার পর, ঠিক করেছিল এষা পিসিকেই বিয়ে করবে। উমা বিয়ে হয়ে আসার পর, এষা পিসিকে ত্যাগ করল না বটে, তবে কাকিমা এবং এষা পিসির মধ্যে রইল দোদুল্যমান হয়ে। প্রায়ই প্রশ্ন করত, দুটো বিয়ে কি একেবারেই করা যাবে না?  তাহলে বিয়েটা ঠিক কাকে করবে? নাকি বড় মামিকেই শেষ পর্যন্ত? বর্তমানে পাত্র হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন কেবল বাবা। দিনান্তে বাবার কান মুলতে মুলতে বা চুল টানতে টানতে, আব্দেরে গলায় ফরমাইশ করে তুত্তুরী, ‘বাবা, আমি কিন্তু তোমাকেই বিয়ে করব, কেমন?’ 


একই দাবী অবশ্য আমিও করতাম। কোন প্রাগৈতিহাসিক যুগে, ঘুম পাড়াতে উদ্যত মায়ের গলা জড়িয়ে একই রকম আব্দেরে সুরে বলতাম, ‘মা, আমি কিন্তু তোমাকেই বিয়ে করব। ’ মা হবার বোধহয় এটাই সবথেকে বড় মজা, আরেকবার ফিরে যাওয়া যায় নিজের শৈশবে। কে জানে হয়তো একই অনুভূতি অনুভব করে বাবারাও। বারো বছরের দাম্পত্যের উপান্তে এসে তাই বুঝি মাঝেমাঝেই  বড় বেশী বাবা-মা হয়ে উঠি আমরা। তক্কে তক্কে থাকা, চুরি করে পাওয়া, হাতে গোণা একান্ত নিভৃত মুহূর্তে আলোচনা না করার প্রতিশ্রুতি দিয়েও আলোচনা করে ফেলি তাঁরই কথা। দেশ-দুনিয়ার রাজনীতি, অতিমারি, বই, সিনেমা, অ্যামাজন-না নেটফ্লিক্স ইত্যাদি গুরুগম্ভীর তত্ত্বালোচনা বা নিছক দ্বৈরথের মধ্যেও অনায়াসে ঢুকে পড়েন তিনি। এমনকি কথাবার্তাও তাঁরই ভাষাতেই বলি  আজকাল আমরা। যেমন সেদিন আমার জন্মদিনে উপহার পাওয়া কাঠের যোগাভ্যাসরতা কন্যাটিকে খণ্ডবিখণ্ড করার পর তিনি কাঁদোকাঁদো হয়ে বললেন, ‘লেলেং গঙ্গা হয়ে গেছে’। তারপর থেকে যেকোন জিনিস ধ্বংস হয়ে গেলে, নষ্ট হয়ে গেলে, বরবাদ হয়ে গেলে আমরা বলি, ‘ওটা লেলেং গঙ্গা হয়ে গেছে। ’  যেমন রেগে গেলে তিনি বলেন ,' গররর্'। একটু আগে, ‘এনে ভুঁড়ি’ গেয়ে তুত্তুরীকে বিরক্ত করার পর শৌভিকও এসে বলে গেল, ‘গররর্’।


 কাল পর্যন্ত আমার সামান্য স্পর্শ, একটু সময় আর একটা আলগা চুম্বনের জন্য তৃষিতের মত প্রতীক্ষা করা বাচ্ছা মেয়েটা, আজকাল বড় বেশি বাবার অনুরাগিনী। বাপ-মেয়ের এই সখ্যের দাপটে মাঝেমাঝেই প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়ে যায় আমার। প্রায় সমবয়সী দম্পতি আমরা, খুনসুটি থেকে বালিশ নিয়ে উদোম ঝাড়পিটে লুকিয়ে বাড়ে প্রেম। মুস্কিল হচ্ছে আজকাল শৌভিকের সাথে তর্কাতর্কি হলেই, কোমর বেঁধে ঝগড়া করতে আসেন তিনি। বাবার সাথে ঝাড়পিটের মধ্যে কামড়েও দেন ঘ্যাঁক করে। কবে যে মেয়েটা বাবাকে তার রোল মডেল ঠাওরাল ভাবতে বসে তাজ্জব হয়ে যাই আমি।  মাঝে মধ্যে তীব্র অভিমানে ছলছলিয়ে ওঠে আঁখি। পরমুহূর্তেই উপলব্ধি করি, এটাই তো হবার ছিল। এটাই তো আমার কর্মফল। জ্ঞান হওয়া ইস্তক বাবার মেয়ে ছিলাম আমি। কবে কোন দাম্পত্যকলহে মাকে সমর্থন করেছি মনেই পড়ে না। বাবা মানে অগাদ প্রশ্রয়। বাবা মানে জীবনের একমাত্র পুরুষ, যার চোখে আমি যথার্থই অনিন্দিতা। আর মা মানে, এক অনন্ত শিক্ষয়িত্রী। বেশ জাঁদরেল  ব্যপারসাপার। কেবলই শিক্ষা দিত মা। ‘ তরকারি থেকে বেছে বেছে কুমড়োগুলো ফেললে কেন? অত জোরে হাসবে না। অত বেশি টিভি দেখবে না। অমন ধড়াম করে দরজা বন্ধ করবে না। রাগ হলে অমন দুমদাম করে চলবে না। মুখে মুখে চোপা কাটবে না। বেলা করে ঘুম থেকে উঠবে না। ’ সর্বোপরি 'পড়তে বসো, পড়তে বসো এবং পড়তে বসো।'  এগুলো কে বলত? এগুলো কে বলে? মা না আমি? তারুণ্যে সবথেকে কঠোর সমালোচক ছিলাম যার, তবে কি, ঠিক তারই মত হয়ে উঠছি আমি? 


 আজ সকাল থেকে বায়না জুড়েছেন,  রান্না করতে চান শ্রীমতী তুত্তুরী। নাঃ মোটেই গরম জলে ম্যাগি দেবার মত, বা গলে যাওয়া মাখনে পোচ বানানোর মত সহজসরল কোন রান্না নয়, জম্পেশ করে কোন পদ বানাতে চায় তুত্তুরী। ঠিক যেমন ঐ দাদাটা বানিয়েছে। দাদাটার নামটা না হয় উহ্যই থাকুক, তার মা কোন এক প্রাগৈতিহাসিক যুগে আমার সহপাঠিনী ছিল। যেমন অতুলনীয়া গুণবতী জননী, তেমনি তাঁর সুযোগ্য পুত্র। মা রন্ধনে দ্রৌপদী, পুত্রও তাই। কতই বা বড় হবে ছেলেটা, তুত্তুরীর থেকে বছর দুই? নাকি তাও নয়। এইটুকু পুঁচকে একটা ছেলে, নাক টিপলে দুধ বেরোয়, সে তার মায়ের জন্মদিনে উপলক্ষে যে সব পদ বানিয়েছিল,তা দেখে আমাদেরই চক্ষুচড়কগাছ তো তুত্তরী তো নেহাত ছেলেমানুষ। 


সেই থেকে বায়না জুড়েছে তুত্তরী, জমিয়ে কিছু রান্না করবেন তিনিও। শুধু গ্যাস জ্বালিয়ে দেওয়া ছাড়া যেখানে থাকবে না আমার কোনই ভূমিকা। এতো বেশ আনন্দের কথা। তা রাঁধুক না, আমি নাহয় দাঁড়িয়ে থাকব, চৌকাঠের এপারে। আধ ঘন্টার তীব্র হুমহাম (চিন্তান্বিত মুখে পায়চারি করাকে শাশুড়ি মাতা যে নামে সম্বোধন করেন আর কি) অন্তে করুণ সুরে এসে জানাল তুত্তরী, 'মা কি রাঁধব একটু বলে দাও না।' 


সত্যি কথা বলতে কি,  কালিয়া-কাবাব বানাতে যে সব সামগ্রী লাগে, তাদের লিস্ট একখান যোগাড় করেছি বটে, তবে হাতের কাছে সামান্য গরম মশলা ছাড়া নেই প্রায় কোন উপকরণই। 


তখনই মনে পড়ল পালং চিংড়ির কথা। কোন একটা গ্রুপে পড়েছিলাম। রান্না করাও সহজ, লাগেও যৎসামান্য উপকরণ, আর তা মজুতও আছে ঘরে।  পালং শাককে সামান্য নুন দিয়ে সিদ্ধ করে মিক্সিতে বেটে নিতে হয়। বাটার সময় তার সাথেই পরিমাণ বুঝে একখান মাঝারি বা বড় পেঁয়াজ, গোটা তিন/চার কোয়া রসুন, সামান্য আদা, গোটা দুয়েক কাঁচা লঙ্কা বেটে নিতে হয়। এই বাটা মসলাটাই এত সুগন্ধি হয়, যে মনে হয়, শুধু ওটা দিয়েই খেয়ে নেওয়া যায়, এক থালা ভাত।  


ভাজার আগে, সামান্য নুন-হলুদ জলে ভাপিয়ে নিতে হয় চিংড়ি মাছগুলি। না হলে তেলে দিলেই বড় শক্ত হয়ে যায়। গরম তেলে, ভাপানো মাছগুলো অল্প নাড়াচাড়া করে তুলে নিয়ে, ঐ তেলেই পাঁচফোড়ন, ২টি শুকনো লঙ্কা, তেজ পাতা ফোড়ন সহ শাক বাটাটা দিয়ে কিছুক্ষণ ভাজা ভাজা করে, তাতে হলুদ গুঁড়ো, সামান্য লঙ্কা গুঁড়ো, টমেটোর রস, একটু জিরে গুঁড়ো মিশিয়ে  কষতে কষতে তেল ছাড়লে, ভাজা চিংড়ি মাছ গুলি দিয়ে, পরিমাণ মত নুন-মিষ্টি চেখে, সামান্য ফুটিয়ে নামিয়ে নিতে হয়। জল দিতে নেই। মানে দেওয়াই যায়, দিলে বড় তরল হয়ে যায় ব্যাপারখানা। নামানোর একটু আগে অল্প কসুরি মেথি ছড়িয়ে দিলে এমনিই সৌরভে মথিত হয় গোটা বাড়ি।


বলা যত সহজ, ব্যাপারটা মোটেই অত সহজ হয়নি শ্রীমতী তুত্তুরীর পক্ষে। প্রথমতঃ কাঁচা মাছের আঁশটে গন্ধেই তিনি ছুট্টে পগার পার। শাক সিদ্ধ এবং বাটার পর যখন পুনরায় মঞ্চে প্রবিষ্ট হলেন, গরম তেলে মাছ ছাড়তে গিয়ে আবার ধাক্কা খেলেন তিনি। যত বলি, হাত নামিয়ে তেলের কাছে এনে টুপ করে ছাড় মাছটা, ততো ভয়ে থরথর করেন তিনি। ছপাৎ করে একখান ছাড়লেন বটে, খানিক তেল গিয়ে পড়ল পাশে রাখা নুনের কৌটোর ঢাকায়।


অগত্যা বলতেই হল, ঢের হয়েছে মা, এবার ক্ষ্যামা দাও।  তুমি বরং তোমার ঐ গানটাই গাও। আমি আর বাংলা তর্জমা করব না। আর আমায় শান্তিতে রাঁধতে দাও। যার কাজ তাকেই সাজে। বলতে গিয়ে মনে হল,  এর আগেও কোথায় যেন শুনেছি কথাটা, অন্য কোন সাদাকালো দশকে, জনৈকা জাঁদরেল ভদ্রমহিলার মুখে।  এই রে, আমি সত্যিসত্যিই ‘মা’ হয়ে উঠছি- সামনে তাহলে বাকি এখনও বহু যুদ্ধ।

Wednesday 26 May 2021

অনির ডাইরি ২৪শে মে, ২০২১

 

'I set out on a narrow way many years ago,

Hoping I would find true love along the broken road.

But I got lost a time or two,

Wiped my brow and kept pushing through.

I couldn't see how every sign pointed straight to you'


আজ আমার বিয়ের দিন। ধুর কি ভুলভাল বকছি, বিয়ে তো হয়ে গেছে মাস তিনেক আগেই, সরকার বাহাদুরের ছাপ মারা, আগমার্কা বিয়ে। আজকেরটা তো বাবার মন রাখতে নিছক লোকাচার। গতপরশু থেকে গমগম করছে বাড়িটা, রান্নাঘরে দাঁড়িয়ে কাপের পর কাপ চা করেই চলেছে সেজোমাসি। অকারণে সারা বাড়ি চরকি পাক খাচ্ছে জ্যাঠাইমা। ভাঁড়ার সামলাচ্ছে বড়মাসি। অগোছালো বাড়িটা গুছিয়ে গুছিয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়ছে ছোটমাসি, দীপু আর ছুটকি। বাবাকে এক মুহূর্তের জন্য ছাড়ছে না টুলটুল দাদা, খালি ‘কাকা এটা একবার দেখে নিন। ওটা একবার দেখে নিন’ করে করে পাগল করে ছাড়ল লোকটা।  কোন বাড়ির বড় জামাই, তার খুড়তুতো শালির বিয়েতে এমন কুলিকামিনের মত কোমর বেঁধে খাটে শুনি? 


কাক না ডাকা ভোরে ঘুম থেকে তুলে দিয়েছে কণিকা মাসি।আলো ফোটার আগেই খেয়ে নিতে হবে দধিকর্মা। হাতে বোনা আসনে বসে আধঘুমন্ত অবস্থায় কি যে খেলুম,মনে নেই। জ্যাঠাইমা তো কেঁদেই হাট করল। মা আর জ্যাঠাইমা গতকাল থেকেই কেঁদে হাট করছে।  আগের দিন সন্ধ্যাবেলা যখন কদমতলা বাজার থেকে দুহাত ভর্তি শাঁখা-পলা আর লোহার কড় পরিয়ে নিয়েএল দিদিভাই, উঠোন পেরিয়ে লাল রোয়াকে পা রাখতেই  হু হু করে কেঁদে ভাসিয়েছিল জ্যাঠাইমা। দিদিভাইয়ের বিয়ের পর, আমাকে নিয়েই ভুলে ছিল, এবার যে আমার যাবার পালা।   


নীলপাড় হলুদ রঙের হলহলে একটা সিল্ক পরে একা বসে আছি ঘরে। গায়ে হলুদ এসেছে। জানি সঙ্গে এসেছে আমার দুই দেওর, এক ননদ, আর শৌভিকের পিসেমশাই। কি পাঠিয়েছে তাও জানি। নিজেরাই ঘুরে ফিরে পছন্দ করে কিনেছি যে। যা চেয়েছি, যা ভালো লেগেছে অকাতরে কিনে দিয়েছেন শ্বশুরমশাই। শুধু সাজানোটা দেখিনি। শৌভিকের পিসির ননদ, নাকি অতি যত্ন করে অতি উত্তম রূপে সাজিয়েছেন সবকিছু। সেটাও দেখেই ফেলতাম, যদি বিয়ের দিন চারেক আগে উত্তমমধ্যম ঝগড়াটা না হত। 


তত্ত্ব দেখে সবাই  উচ্ছ্বসিত। আমি ঘরে বন্দী। ওরে আমাকেও কেউ ডেকে দেখা রে বাপ। আমার দুই প্রাণাধিকা সহচরী সঞ্চিতা আর পম্পা একবার ঘরে ঢুকছে, একবার বেরোচ্ছে। কিন্তু আমার এখনও মঞ্চে প্রবেশের সময় হয়নি। দিদিভাই এসে ধরে নিয়ে গেল,ফিসফিস করে বলল, একটু লাজুকলতা হতে।হ্যাংলার মত যেন তত্ত্ব আর মিষ্টি দেখতে না বসে যাই। সাজিয়ে রাখা চেয়ারে ধপ করে বসতে গিয়েও, অতি সন্তর্পণে, অতি যতনে বসার চেষ্টা করলাম। সামনে একটি লাজুক লাজুক পুঁচকে মেয়ে। তারপাশে ভয়ানক গাম্ভীর্য নিয়ে আমাদের উমার ভাবী বর, শ্রীমান টুকলু অর্থাৎ শৌভিকের সহোদর। তার পাশে বিগলিত মুখে আরেক দেওর শ্রীমান সুশান্ত। তারপাশে এক ভয়ানক সুদর্শন ব্যক্তি। তিনি ঠিক কোন পক্ষের লোক বলা মুস্কিল, দিব্যি একহাতে আমার বাবা অপরহাতে আমার মাকে বগলদাবা করে  বলছেন, ‘আমি তো এবাড়ির লোক। কি করতে হবে বলুন শুধু,ব্যাস। ’ এটা আবার কে? আর পিসেমশাইটা গেল কোথায়? যাকে শৌভিকরা ডাকে ছোটেকাকা? বাঙালী বাড়ির বিখ্যাত অবাঙালী জামাই। 

গোটা বাড়ির লোকের সাথে গপ্প করে বরের বাড়ির লোকজন বিদেয় হল।  এবার গায়ে হলুদের পালা। আমার  বৌদিরা এখনও এল না। উফঃ কথাই বলব না আজ ব্যাটাদের সাথে। মানছি দুটো বাচ্ছা নিয়ে নাজেহাল, তাই বলে একমাত্র ননদের বিয়েতে এত দেরী কেউ? ওদের বিয়ের সময় ১০সেকেণ্ডের জন্যও ওদের একলা ছেড়েছি আমি? উফঃ আর কি সেজেগুজে এসেছে মাইরি। বিয়েটা কার? ভাবছে, সরি বললে, আর জড়িয়ে ধরলেই গলে যাব বুঝি। এত সহজে রাগ কমে নাকি? 


এক গা হলুদ মেখে স্নানে ঢুকেছি, জল চলে গেল। কি জ্বালা রে ভাই। সমানে দরজা পিটছে ছোটমাসি,‘বেরো রে। কতক্ষণ ধরে চান করবি?’ জল না এলে কি করব? স্নান না করেই বেরিয়ে যাই? ‘অ্যাই’ ধমকে উঠল ছোট। নতুন বউকে অমন কটকট করে কথা বলতে নেই। 


ঘরের দরজা বন্ধ করে জবরদস্তি চারটে লুচি তরকারী মুখে ঠুসে দিল দিদিভাই। সেই মধ্যরাতের আগে আর খেতে পাব না। পেটে না ঢুকলেও খেতে হবে। এবার সাজার পালা। কনে সাজাতে নাকি অনেকক্ষণ লাগে। ছোটমাসি পইপই করে বলে দিল, বেশী সাজের দরকার নেই।  বিকাল বিকাল যেন পৌঁছে যাই দেবকন্যায়। বড় ব্যাগে বেনারসী, আর গয়নাগাঁটি ভরে টুলটুল দাদার সাথে রওণা দিলাম দিদিভাইয়ের বাড়ি। যেবাড়িতে একদিন কনে সেজে ঢুকেছিল চাটুজ্জে বাড়ির বড় মেয়ে,সেখান থেকেই আজ কনের সাজে বের হবে ছোট মেয়ে।  


আমার সাজ শুরু হবার আগেই ধুতি, গিলে করা পাঞ্জাবি আর সোনার চেনে সেজে গুজে প্রস্তুত দাদাভাই। টুলটুল দাদার দাদা, দিদিভাইয়ের ভাসুর যাবে আমার বর আনতে। গুচ্ছ গুচ্ছ ফুলের বুকে গায়ে প্রস্তুত মস্ত বড় কালো টয়োটা কোয়ালিস। সময় গড়াচ্ছে, বাইরে জমছে মেঘের পর মেঘ।  কি যেন একটা ঝড় আসবে, নাম তার আইলা। 


বাবার ধমক খেতে খেতে যখন দেবকন্যায় এসে নামলাম, জড়ো হয়েছেন বেশ কিছু অতিথি। রবিবার হওয়া সত্ত্বেও দল বেঁধে হাজির আমার ব্যাচমেটরা।  দেবু-সুকন্যা-সঞ্জয়-সজল। উপস্থিত খড়্গপুরের আমার তৎকালীন ইন্সপেক্টর আর স্টাফের দল। ধীরে ধীরে বাড়ছে লোক সমাগম। পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ঝড়ের দাপট। 


অঝোর বৃষ্টি মাথায় নিয়ে নামল শৌভিক। কেলেঙ্কারির একশেষ, উল্টো ধুতি পরে বসেছিল ভুল করে, ভাগ্যিস দাদাভাই গিয়েছিল বর আনতে। তাই না আবার খুলিয়ে পরিয়েছে। বৃষ্টি মাথায় বরণ করতে ছুটল জ্যাঠাইমা। পিছনে চোরের মত মা। হবু জামাইকে বরণ করার সুপ্ত ইচ্ছে নিয়ে-। মাথার ওপর বড়দার ধরে মস্ত ছাতা, চূড়ান্ত নার্ভাস মুখে ধুতি সামলাতে সামলাতে স্কুলবয়ের মত ঢুকল শৌভিক। 


পিঁড়িতে বসে, লাল সিঁদুরকৌঠো হাতে, জোড়া পানপাতায় মুখ ঢেকে বরকে প্রদক্ষিণ, শুভদৃষ্টি, মাল্যদান আরো কত কি অনুষ্ঠান ঘটে চলে একের পর এক। ‘ছাউনি নাড়া ফুল’ নিয়ে পাগল হয়ে ওঠে জ্যাঠাইমা। খুব যত্ন করে রাখতে হয় নাকি ঐ ফুল, তারপর খুব বিশ্বস্ত কারো হাত দিয়ে তাকে বিসর্জন দিতে হয় গঙ্গায়। হেসে উঠতে গিয়ে ধমক খেলাম বেজায়। অথচ শৌভিককে কেউ বকছে না কেন? একটাও মন্ত্র পড়ছে না ব্যাটা। কেবল ফিসফিস করে গল্প করে চলেছে আমার সাথে। দুবার ধরিয়ে দিল বড়বৌদি, দুমিনিট গম্ভীর ভাবে মাথাও নাড়ল শৌভিক, তারপর আবার যেই কে সেই। কি দারুণ মেরুন রঙের ধুতি পরে রাজার মত বসে আছে টুকলু।পাশেই লাঠি হাতে, ধপধপে সাদা ধুতি, পাঞ্জাবি, চাদর কাঁধে বসে আছে আমার বড় জেঠু। রূপে আলোকিত গোটা মণ্ডপ। রাজার রাজা। একমনে পর্যবেক্ষণ করছে প্রতিটা লোকাচার। 


সঞ্চিতার পা মচকেছে, এবেলা আর আসতে পারেনি। কাকুকাকিমা এসে আশীর্বাদ করে গেলেন। রূপালী পাড় কাঁচা হলুদ রঙা তাঁত বেনারসি দিয়ে। রাত বাড়ছে, ঝড় বাড়ছে। দেবকন্যা থেকে আবার ব্যাঁটরার চাটুজ্জে বাড়ি।  বাসর ঘরে গান ধরল খুড়তুতো ভাই অয়ন। কি যে ভালো গায় ছেলেটা। খালি গলাতেই মাত। দুচারটে ছুটকো মস্করা করার চেষ্টা করল কারা যেন। কি গম্ভীর বর বাপরেঃ। তেমনি তার দুই বন্ধু। তিনটে আপদে মাটি করল আমার বাসর। 


রাত অনেক, বাইরে ফুঁসছে ঝড়। জানলার কাঁচে আছড়ে পড়ছে বারি ধারা। কাল আয়লা আসবে যে-। অঘোর ঘুমে তলিয়ে গেছে বাসরতুলুনির দল। নিদ্রাহীন শুধু দুটি প্রাণ। এ রাত যে শুধুই কানাকানির। এ রাত যে অাঙুলে আঙুল জড়িয়ে, কানে কানে  বলার- ‘ every long lost dream led me to where you are-/ Others who broke my heart, they were like Northern stars,

Pointing me on my way into your loving arms/This much I know is true

That God blessed the broken road

That led me straight to you.'

Wednesday 19 May 2021

অনির ডাইরি ১৯শে মে, ২০২১

 

অগ্নিসাক্ষী করে বিয়েটা হয়েছিল নিছক বাবার শখে। মাত্র মাস সাত আট আগেই মস্ত বড় অপারেশন হয়েছিল শ্বশুরমশাইয়ের। বাদ গিয়েছিল খানিকটা পাকস্থলী, তারওপর পর পর তিন-তিনটে কেমো। এমতাবস্থায় লোকাচার মেনে জ্যেষ্ঠপুত্রের বিবাহ দেওয়ার ধকলটা ওণাদের পক্ষে ছিল অসম্ভব। যদি না, আমার কাকা-পিসে শ্বশুর আর শাশুড়ি মাতারা সবাই মিলে বাড়ির ছেলের বিয়ে বলে ঝাঁপিয়ে পড়তেন। এত গূঢ় তথ্য অবশ্য জানত না বাবা।


যাই হোক অগ্নিসাক্ষীর বিয়ে নিয়ে শৌভিকের সবথেকে বড় টেনশন ছিল ধুতি পরা। আর আমার? পিঁড়িতে চেপে শৌভিককে প্রদক্ষিণ করা। কে চাগিয়ে তুলবে আমায়? তার থেকে না হয় আমি এমনি পায়ে হেঁটেই--। ছিঃ আমরা না এদেশীয়, পিঁড়িতে চেপে, পান পাতায় মুখ ঢেকে মণ্ডপে প্রবিষ্ট হয় আমাদের বাড়ির মেয়েরা। বিয়ের দিন, আকাশ ভেঙে নেমেছিল বৃষ্টি, পরদিন আসার কথা আয়লার। ওই দুর্যোগ মাথায় নিয়েও কোথা থেকে যে জড় হয়েছিল, এতজন ভাই, দাদা আর মামা। গোলাপি চেলি পরে, পান পাতার আবরণে মুখ ঢেকে পিঁড়িতে চেপে দিব্যি বনবন করে ঘুরলাম শৌভিককে মাঝে রেখে। শূণ্যে দুলতে দুলতেই, নির্দেশমত পান পাতা সরালাম মুখের ওপর থেকে। বিয়েবাড়ির রোশনাই, সানাই, ফুল আর পারফিউমের তীব্র  সুগন্ধ  ছাপিয়ে, সার্চ লাইটের মত আছড়ে পড়ল একজোড়া পরিচিত চোখের খর দৃষ্টি। চারচক্ষুর মিলনে কতটা পুলক জেগেছিল আজ আর মনে নেই, তবে মণ্ডপে উপস্থিত নরনারীগণ যে আমোদে উছলে উঠেছিল তা সম্মিলিত তরল হাসি আর উলুধ্বনির প্রাবল্যে বেশ বুঝতে পারছিলাম।


 এবার মালা বদলের পালা। বিকেল বিকেল সেজেগুজে সিংহাসনে বসার আগে, শালপাতার ডালা খুলে মালাটা সুকন্যাই পরিয়েছিল আমায়। শৌভিককে কে পরিয়েছিল জানি না। জিজ্ঞাসা করলেই শৌভিক বলে, ‘নিজের বিয়ের কথা কারো এত মনে থাকে?’ 


যাই হোক এবার আমায় মালা পরানোর পালা। বর এবং কনে পক্ষের মধ্যে এইসময় মোহনবাগান- ইস্টবেঙ্গল মার্কা বৈরিতা প্রকট হয়ে ওঠে। ছড়া কাটে নাপিত। সম্ভবতঃ মেজদা চমকে রেখেছিল আমাদের তরফের নাপিতকে, 'এই ব্যাটা অশ্লীল ছড়া কাটলেই পেটাবো।'  আমার কয়েক মাসের আইনসিদ্ধ বাসী  বর, তাও এত সহজে মালা পরাতে দেবে নাকি, আমাদের বাড়ির লোকেরা। মালা নিয়ে শৌভিক এগোতেই, সটান শূণ্যে তুলে ধরা হল আমায়। সবার মাথার ওপর উঠতে গিয়ে, এমনআর একটু হলেই,  ঝপাং করে গড়িয়ে পড়তাম শৌভিকের ঘাড়ে। হৈচৈ এর মধ্যেই কোনমতে সামলে বসছি পিঁড়ির ওপর, শৌভিক বিড়বিড় করে বলল, ‘এত গুলো আইবুড়ো ভাত!’। 


আমার আইবুড়ো ভাত খাওয়া নিয়ে বরাবরই স্পর্শকাতর শৌভিক। সত্যিই কতগুলো যে আইবুড়ো ভাত খেয়েছিলাম, আজ আর মনেও পড়ে না। প্রতিটা নিমন্ত্রণের পর, কি খেলাম তার পুঙ্খনাপুঙ্খ বিবরণ দিতাম হবু বরকে, আর শৌভিক বলতো, ‘পরেরটায় আর যেতে হবে না। এই গরমে শেষে বিয়ের দিন পেটখারাপ বাঁধিয়ে বিয়েটাই পণ্ড করবি তুই।' 


 বেশীর ভাগ নিমন্ত্রণই থাকত দিনের বেলা। শুধু দিদিভাইদের বাড়িতে নিমন্ত্রণ ছিল সন্ধ্যাবেলা।২০০৯ সালের মে মাস। গরম পড়েছে ফাটিয়ে, তার ওপর আগের রাত থেকে বিদ্যুৎ বিহীন হাওড়া নগরী। অনুরোধ করেছিলাম, যদি পিছিয়ে দেওয়া যায় ব্যাপারটা। এই গরমে খাবার কি আর গলা দিয়ে নামবে? শুনেই এমন ধমক মারল টুলটুল দাদা। দিদিভাইয়ের যখন বিয়ে হয়, আমি তিন পেরিয়ে চারের পথে। ফলে জামাইবাবু থুড়ি টুলটুল দাদার চোখে আমি শালী নই, কন্যাসমা। একে টুলটুল দাদায় রক্ষে নেই, আছে তাঁরও দাদা। আমাদের দাদাভাই। সকাল থেকে দুইভাই মিলে বাজার করেছে আর দুই বউ রান্না করেছে, এরপরও যদি না যাই, তাহলে যে কুরুক্ষেত্র বাঁধবে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।  


সন্ধ্যে সাতটা নাগাদ যখন বেরোলাম আমি আর ছুটকি, পথঘাট তখন ঘুটঘুটে অন্ধকার। ছুটকির পরিচয় দিতে গেলে যে বিশেষ্য প্রয়োগ করতে হয়, সম্পর্কটা ছিল তার থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। তুচ্ছ গৃহশ্রমিক নয়, ছুটকি ছিল আমার ছোটবোনের মত। যতটা ভালোবাসতাম, তার থেকে অনেক বেশী ভালোবাসত মেয়েটা আমাকে।  


যাইহোক, বেরোবার সময় জ্যাঠাইমা পইপই করে বলে দিল,গলি নয় বড় রাস্তা ধরতে। আমাদের হাওড়ার গলি বিখ্যাত। ধুর কে আর রাজপথ ধরছে।   এই অন্ধকারে রাজপথও যা আর গলিও তাই। উল্টে গলি দিয়ে পৌঁছান যাবে চটজলদি।  টর্চওলা মোবাইল তখনও স্বপ্ন, হাতে বাবার দুব্যাটারির সরু টর্চ নিয়ে সৎসঙ্গের পাশ দিয়ে, গয়লাপাড়ার ভিতরের সরু গলি দিয়ে কালিপ্রসাদ ব্যানার্জী লেন।কেষ্ট কাকুর দোকান ছাড়িয়ে, প্রাক্তণ এমএলএ যুগল মণ্ডলের বাড়ির পাশ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে কদমতলা বাজার। ঘুটঘুটে অন্ধকার পথঘাট, মাঝে মাঝে উল্টো দিক থেকে আসা বাইকের উজ্জ্বল আলো, আর রাস্তার ধারের দোকানগুলোতে জ্বলতে থাকা দেওয়াল গিরির আলোআঁধারীতে পথঘাট কেমন যেন থমথমে রহস্যময়। সমস্ত বাড়ির জানলা খোলা, সমস্ত রোয়াকে, বারান্দায় বসেছে জমজমাট আড্ডা। প্রতিটা বাড়ির ছাদে চক্কর কাটছে প্রমিলাবাহিনী। 


দিদিভাইদের বাড়িতে প্রবেশ করার অনেক গুলো দরজা। বিশাল জমির উপর সুদৃশ্য বাংলো প্যাটার্নের একতলা বাড়ি। বাড়ি নয়তো হাওয়ামহল। চতুর্দিকে গুচ্ছগুচ্ছ জানলা আর দরজা। ইমার্জেন্সি লাইট গুলোর চার্জ প্রায় তলানিতে, যেটুকু আছে শুধু আমাদের খাবার জন্য রেখে, সারা বাড়িতে গুটি কয়েক মোমবাতি জ্বালিয়ে সবাই বসেছিল আমাদের প্রতীক্ষায়।


ও বাড়ির আতিথেয়তা প্রায় প্রবাদপ্রতিম।  কত যে ব্যঞ্জন বানিয়েছিল দিদিভাই আর সোমাদি তার ইয়ত্তা নেই। পোলাও, এই দামড়া ফিশফ্রাই, ইয়া বড় বড় চিংড়ি, খাসির মাংস আর কি কি ছিল আজ আর মনে নেই। তবে ভুরিভোজের থেকেও বেশী জমজমাট হয়েছিল, টিমটিমে মোমবাতির আলোয় গা ছমছমে ভূতের গপ্প। দেশভাগের আগুনে বলি হওয়া বহু মানুষের শেষ আশ্রয় স্থল নাকি ছিল, অদূরের মজে যাওয়া ডোবাটা। তাদের কারো কারো অস্তিত্ব নাকি  টের পাওয়া যায় গভীর রাতে। বাড়ি ভর্তি জাঁদরেল সারমেয়র দল, কিন্তু সন্ধ্যা ঘনালেই আর ছাতে থাকতে চায়না কেউ। বেঁধে রেখে আসলেও হু হু করে কাঁদে আর কাকুতি-মিনতি করে নীচে নিয়ে যাবার জন্য।  


কোনটা সত্যি, কোনটা নিছক গল্প, আজ সবই কেমন যেন আলোআঁধারিতে ঢাকা। সেই বাঙলো প্যাটার্নের ছিমছাম বাড়িটাও আজ আর নেই। হয়তো নেই তেনারাও। অথবা আছেন। ভুরিভোজ সেরে হলুদ পিওর সিল্কের শাড়ি বগলে আবার সেই অন্ধকার গলিঘুঁজি দিয়ে ফেরা। আজ এই প্রায় গৃহবন্দী দশায় ভাবতে বসলে তাজ্জব লাগে, কতটা খোলামেলা, কতটা নিরাপদ, কতটা ঘরোয়া ছিল আমাদের শহরটা।  অতরাতে ঘুটঘুটে অন্ধকার গলিপথ দিয়ে বাড়ি ফিরছিল দুটি অল্পবয়সী মেয়ে, এক পলকের জন্যও হয়নি কোন অস্বস্তি, লাগেনি কোন ভয়। বাড়ি ফিরলাম যখন, রাত তখন দশটা। অন্ধকার রোয়াকে চেয়ার পেতে উদ্বিগ্ন হয়ে বসে আছে জ্যাঠাইমা। অদূরে আরেকটি চেয়ারে রাজার মত বসে বড় জেঠু।  একতলার বসার ঘরে মোমবাতির আলোয় কি যেন লেখাপড়া করছে বাবা আর উল্টোদিকে গালে হাত দিয়ে বসা মা- সবাই কেবল আমারই প্রতীক্ষায়।  


খুঁটিয়ে বলতে হল সবার সামনে, কি খেলাম, কি পেলাম, কেন মা এবং জ্যাঠাইমার যুগপৎ নিষেধ সত্ত্বেও ছাঁদা বেঁধে আনলাম। যেন আমি আনব না বললেই দিদিভাই ছেড়ে দিত। গলা অবধি খাইয়ে,বাড়ির সবার জন্য বেঁধে দেওয়া যে ঐ বাড়ির ট্রাডিশন সবাই জানে, তবুও দফায় দফায় ঝাড় খেয়ে যখন শুতে গেলাম ঘড়ি বলছে রাত এগারোটা। তখনও নিষ্প্রদীপ হাওড়া নগরী। পাওয়ার হাউস থেকে পাওয়া শেষ খবর অনুসারে, আজ রাতেও ফিরবে না বিদ্যুৎ। লাল মেঝেতে জলের ছিটে দিয়ে, তার ওপর বালিশ নিয়ে শুয়ে মোবাইলের কষ্ট করে বাঁচিয়ে রাখা শেষ ১৫-১৭ শতাংশ চার্জটুকুর সদ্ব্যবহার করব এবার। সারাদিন কথা হয়নি তেমন। ঝটপট করে শোনালাম কি খেলাম, কি পেলাম, কি কি গল্প শুনলাম।খুকিখুকি নাকে কান্নাটা সবার শেষে। কারেন্ট না এলে, ঘুমোব কি করে। উফঃ কি গরম। বাপরে। ফোনের ওপার থেকে ভেসে এল অমৃতবাণী,‘এখুনি চলে আসবে কারেন্ট দেখ না।’ হ্যাঃ কচু আসবে। কতবার যে বাবা ফোন করেছে সিইএসসি দপ্তরে, বারবার শুনতে হয়েছে একই কথা।  আজ আর আসবে না। বলতে না বলতেই, ঘটঘট করে উঠল মাথার ওপরের পাখা। হো-হো রব ভেসে এল চারিদিক থেকে- বাবা আর ছোটকাকু উল্লাসে একসাথে চিৎকার করে উঠল, ‘ওরে এসেছে রে। এসেছে। ’ একই কথার উল্লাসিত প্রতিধ্বনি ভেসে এল আসেপাশের বাড়ির ছাত থেকে। আর ফোনের ওপারে মৃদু হাসি, ‘বলছিলাম না। ’

Friday 14 May 2021

অনির ডাইরি ৯ই এপ্রিল, ২০২১

 


‘কে রে? পুতু এলি?’ দোতলার বারন্দায় কাপড় মেলতে মেলতে প্রশ্ন করে চৈতি। পুতু বা সময়বিশেষে পুটু ওরফে শ্রীমতী তুত্তুরী  জবাব না দিয়ে গম্ভীর মুখে 'তুত্তুরী ভিলা’য় সেঁদিয়ে গেল। ভাগের বাড়িটার নাম বাবা রেখেছে ‘তুত্তুরী ভিলা’। গাড়িতে আনতে আনতে পইপই করে বুঝিয়েছি, একটু ভদ্র সভ্য হয়ে থাকিস বাবু। এক আধবেলা তো নয়, পাক্কা পাঁচরাত ছয়দিন আমাকে/আমাদেরকে ছেড়ে থাকবে মেয়েটা। 


হাওড়ায় নামলেই সাপের পঞ্চম পা দেখে মেয়েটা। তুত্তুরী ভিলায় পা দিলেই আরো দুই জোড়া হাত পা গজায় বোধহয়। সারাদিন দস্যিবৃত্তি করে বেড়ায় বুল্লুর সাথে। শ্রীমতী তুত্তুরীর না হয় সদ্য কেঁদে ককিয়ে পঞ্চম শ্রেণী। বুল্লু বাবুর তো নয়। আর বছর দুয়েক বাদে মাধ্যমিক দেবে ছেলেটা।  দাদার পড়ায় ব্যাঘাত ঘটালে বা মামীকে বেশী জ্বালাতন করলে বা মামমাম (দিদা) এর সমস্ত ডেটা খরচ করে দিলে যে পিঠের চামড়া আস্ত থাকবে না, তা বুঝিয়ে শুনিয়েই এনেছিলাম। মাইরি বলছি, তাই বলে  বড়মামীর সাথে সম্পূর্ণ বাক্যালাপ বন্ধ করতে শেখাইনি। 


লজ্জায় অধোবদন হয়ে মেয়েটাকে যে দুটো কটু কথা শোনাব তারও উপায় নেই।  তুত্তুরী ভিলায় পদার্পন করার সাথে সাথেই কন্যাকে শাসন করার অধিকার হারাই আমি। আদরের পুতু পাত্তা না দিলেও, নিজেই নেমে এল বড়মামি। আদর সম্ভাষণ শুরু করেছে সদ্য এমন সময়, আমার কন্যা সটান গিয়ে তার গা শুঁকতে লাগল। এই মেয়েটার জন্য কারো সামনে মুখ দেখানো যাবে না, যা দেখি। ধমকানির আগেই সোল্লাসে বলে উঠল তুত্তুরী, ‘বড়মামি, তোমার গায়ে কিসের যেন গন্ধ? তুমি চাউমিন করেছ বোধহয়। ’ হাওড়ায় মেয়েকে গচ্ছিত রেখে চুঁচুড়া যাব, নির্বাচনী কর্তব্য সারতে, তাই সক্কাল সক্কাল ভরপেট ভাত খাইয়েই এনেছিলাম মেয়েটাকে। একপেট ভাত খেয়েও যে কেউ এইভাবে হ্যাঙলা ইয়ের মত চাউমিনের গন্ধ শুঁকে বেড়ায়, এ আমি বাপের জন্মেও দেখিনি। চৈতির অবশ্য বিকার নেই, পরম হর্ষে তার পুতুকে আলিঙ্গনাবদ্ধ করেছে, ‘করেছি তো। চল তুই আর দাদা খাবি। তার আগে দাদাকে ঘুম থেকে টেনে তুলবি চল।’


মানে মানে কেটে পড়লাম হাওড়া থেকে। দিন পাঁচেক পর এসে সবাইকে সুস্থ দেখলে হয়। চুঁচুড়ায় পৌঁছে ফোনে জানতে চাইলাম কি করছে মেয়েটা। জবাব পেলাম, ‘দাদার সাথে ক্রিকেট খেলছি মা। স্মাইলি বল দিয়ে ক্রিকেট। ’  বুঝতে পারলাম স্বর্গীয় ছোটকাকুর সাধের বৈঠকখানায় এখন চলছে জমজমাট ক্রিকেট ম্যাচ। বোঝাতে গেলাম হোক স্মাইলি বল, তবু সাবধানে খেলো বাবু, অনেক মূল্যবান ছবি আছে ঐ ঘরটায়। অতীতে মাখামাখি এমন কিছু সাদাকালো আর রঙীন ছবি, যেখানে থমকে আছে সময়। ঘুরিয়ে জবাব পেলাম, না ছবিতে বল লাগেনি বটে, তবে প্রথম শটেই বড়মামার দাড়ি কামানোর গ্লাসের জলে বল ফেলেছিল তুত্তুরী। তখন ক্রিকেট চলছিল দোতলায়। 


ওই ম্যাচ পণ্ড হবার পর, পরের ম্যাচ বৈঠকখানায় শুরু হতে না হতেই  বড়মামির পেটে শট মেরেছে তুত্তুরী। কি যেন কাজে ঘরে ঢুকেছিল বড়মামী। দাদা অর্থাৎ বুল্লু বলছে, মায়ের পেটে বল মারতে পারা মানে চার, তুত্তুরীর দাবী ছয় রান তো দিতেই হবে।   


দপ্তরী কাজের ব্যস্ততার ফাঁকে মায়ের ফোন। তুলতেই ওপাশ থেকে তুত্তুরীর অভিমানী গলা, ‘মা বড়মামী খুব বাজে। খালি কাজই করে চলেছে। একটুও সময় দিচ্ছে না আমায়। এদিকে মামমামের ফোনের সব ডেটাও যেন কিভাবে শেষ করে ফেলেছে মামমাম।  তুমি একটু কাকিমার নম্বরটা দাও তো। একটু কাকিমার সাথে কথা বলি। ’ পেটে বলের গুঁতো খাবার পরও যে বড়মামি,তুত্তুরীর সাথে সম্পর্ক রেখেছে এতেই আমি কৃতার্থ, তারপর আবার সময় কেন দেবে বুঝতে পারলাম না। আর  মামমাম বেচারা শুধু ফোন করতে পারে, কষ্টেসৃষ্টে ধরতে পারে আর ফেসবুক খুলতে পারে। আর কিছুই তেমন পারে না। তিনি কিভাবে দেড় জিবি ডেটা শেষ করলেন, এটা আর কেউ না বুঝতে পারলেও তুত্তুরীর মা বেমালুম বোঝে। 


বেলা বাড়ে, পশ্চিম আকাশে এক মুঠো লাল আবির ছড়িয়ে পাটে বসেন সূর্য দেব। কর্মব্যস্ততার ফাঁকেও মেয়ের  জন্য  টনটন করে হৃদয়। কেমন আছে মেয়েটা?  কি করছে মেয়েটা?ফোন করলাম মেয়েটাকে, প্রফুল্ল হয়ে শ্রীমতী তুত্তুরী জানায়, ‘দিদির গলা টিপছি মা। ’ দিদি অর্থাৎ আমার আদরের একমাত্র পিসি। হায় হায়! দিদির গলা টিপছ কেন? জবাবে বুঝলাম, বড়মামা হল আসল কালপ্রিট। বড়মামা অর্থাৎ শ্রীমান অয়ন খেলাচ্ছলে দিদিকে জিজ্ঞাসা করেছিল, ‘তোমার কোথায় ব্যথা দিদি?’  দিদি সরল ভাবে জানিয়েছে, আপাততঃ গলা ছাড়া আর কোথাও তেমন ব্যথা নেই। অতঃপর দিদির প্রবল আপত্তি সত্ত্বেও দুই ভাইবোন এবং ধেড়ে মামার গলা টেপা এবং তদজনিত সুড়সুড়ি এবং তদজনিত সম্মিলিত অট্টাহাস্যে বেশ বুঝতে পারলাম, ভালোই আছে মেয়েটা।  


রাতের মত কাজ মিটিয়ে হোটেলে ঢুকেলাম, কাল সূর্যোদয়ের আগেই পৌঁছাতে হবে কন্ট্রোল রুমে। নৈশাহার সেরে সবে শুয়েছি, টং করে চৈতির মেসেজ। ‘দেখো পুতু আমায় কেমন সাজিয়েছে-’। চৈতির ফটফটে মুখ, কালিঝুলি মাখা চোখ, ঘেঁটে যাওয়া লিপস্টিক দেখে প্রথম চোটে আঁতকে উঠতে হয়। স্বীয় কন্যার বাঁদরামিতে যৎপরনাস্তি লজ্জিত হয়ে লিখলাম, ‘আমি ভীষণ ভাবে দুঃখিত। গিয়েই উদোম ঠ্যাঙাব ব্যাটাকে। ’ 


সঙ্গে সঙ্গে চৈতির উত্তর, ‘কেন গো? ওর কি দোষ? আমরা সবাই মিলে খুব মজা করছি। ’ যেমন পুতু তেমনি তার বড়মামী। যা পারে করুক গে- 


 কয়েকটা ঘন্টাই তো কেবল ঘুমাব, অর্ধ তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে পড়েছি, বড়মামা ওরফে অয়নের ফোন। ফোনের ওপাশ থেকে তুত্তুরীর আর্ত চিৎকার, ‘আমি না। আমি না। বড়মামা, প্লিজ তুমি কথা বল। মা নাহলে ফোনের ওপাশ থেকেই ঠাস করে চড় মারবে আমায়। হ্যাঁ গো। মা সব পারে-’।  

চৈতি, অয়ন এবং তুত্তুরীর সম্মিলিত জবানবন্দি থেকে যা বুঝলাম, সকাল থেকেই প্রতিশ্রুতি বদ্ধ ছিল বড়মামী। দিনের বেলাটা গৃহকর্মে ব্যাপৃত থাকলেও সন্ধ্যাটা শুধু পুতু আর তার বড়মামীর। সন্ধ্যা নামতেই হিসেব বুঝে নিতে হাজির হয়েছে তুত্তুরী। প্রথম আব্দার, বড়মামী তোমার গয়না দেখাও। বড়মামী কোন গয়নাই পরে না, কিন্তু যত্ন করে সাজিয়ে রাখে কঁচের চুড়ি, ঝুটো গয়নার ডালি। ঐ ডালির প্রতি ভয়ানক লোভ তুত্তুরীর।  চৈতির যাবতীয় গয়নার খুঁটিনাটিও ঠোঁটস্থ মেয়েটার। চৈতির কৈশোর তথা তরুণী বয়সের বেশ কিছু গয়না বগলদাবাও করেছে মেয়েটা। 


পুতুর আব্দার ফেলতে না পেরে নতুন করে গয়নার ডালি নিয়ে বসেছিল মামী আর তুত্তুরী। গয়নার পর পাড়া হয় মামীর অন্যান্য সাজুগুজুর জিনিস। মামীর লিপস্টিক, কাজল, কমপ্যাক্ট। বড়ই অল্প প্রসাধন করে চৈতি। সাংসারিক চাপে সময় পায় কোথায়? তাও যা শখ করে কেনে পড়েই থাকে। 

ডেট এক্সপায়র হতে বসা এমনি একরাশ প্রসাধন দ্রব্য দিয়ে মামীকে সাজিয়েছে তুত্তুরী। কি সাজাচ্ছে তা শুধু মামী জানত আর তার পুতু। বড়মামা শুদ্ধ মাঝপথে ঘাবড়ে গিয়ে প্রশ্ন করেছে, ‘হ্যাঁরে তুই কি মামীকে মা তারা সাজাচ্ছিস?’ জবাব এসেছে, ‘না গো। রক্তখেগো শাঁকচুন্নি সাজাচ্ছি। ’


প্রশ্ন ভেসে আসে, কেমন লাগছে, তুত্তরী 'শাঁখচুন্নি ম্যাডামকে'? রাগব না হাসব বুঝতে পারলাম না। ফোনের ওপাশে সম্মিলিত হর্ষধ্বনি আর থামছেই না। অয়ন বলছে, ‘ন্যায্য  কথা। শাঁখচুন্নি ম্যাডামই বটে। দেখ না রক্ত খেয়ে কেমন রোগা করে দিয়েছে আমায়। ’ আমি প্রতিবাদ করার আগেই লাফিয়ে ওঠে চৈতির পুতু, ‘হ্যাঁ তাই তো। একদম মায়ের মত রোগা হয়ে গেছ তুমি বড়মামা। ’ ' হ্যাঁ রে, তুই কার ভাগ্নি রে?' কোমর বেঁধে ঝগড়া করতে নামে তুত্তুরীর বড়মামা।  কি বলব বুঝতে পারলাম না। নিজেদের মধ্যেই ঝগড়ায় ব্যাপৃত সব, একবার ভাবলাম ফোন কেটে দি, একবার ভাবলাম বলি, আপদগুলো নিজেরা শাঁখচুন্নি, বেহ্মদত্যি, খোক্ষস যা খুশি সাজ না বাপ, খামোকা আমায় ধরে কেন টানাটানি। বললাম না, থাক, আরো খানিক নীরবে শুনি ওদের খুনসুঁটি। তারপর না হয়, ঘুমোব। বড় জব্বর ঘুম আসবে আজ। ঘুমের মধ্যে ঘুরে ফিরে আসবে রামধনু রঙা একরাশ স্বপ্ন। গুলিয়ে যাবে, মিলেমিশে একাকার হয়ে যাবে আমার ছেলেবেলা আর তুত্তুরীর মেয়েবেলা। মা হওয়ার এটাই তো মজা-

Monday 10 May 2021

অনির ডাইরি ৯ই মে, ২০২১

 

আজকের দিনে মায়ের সঙ্গে একখান ছবি না দিলে কি এ সমাজ আমায় মেনে নেবে? মুস্কিল হচ্ছে মায়ের সঙ্গে আমার একাকী ছবি খুব বেশী নেই। যা আছে সেসবই আমার বিয়ের আগে পরে তোলা। তখন অত ছবিই বা কোথায় তোলা হত। সবথেকে দামী মোবাইলের ক্যামেরাও হত মেরেকেটে ১.৩ মেগাপিক্সেল।  তাও ছবিটবি যা তুলতাম, তাতে থাকতে মোটেই আগ্রহী ছিল না মা। অন্তঃপুরবাসিনী বা হলেও অন্তরালে থাকতেই বরাবর ভালোবাসে মা। 


বিগত সপ্তাহদুয়েক ধরেই ভাবছি কি উপহার দেব মাকে? শাড়ি দেবো কি? শাড়ি রাখার জায়গা নেই মায়ের আলমারিতে। পুজো, নববর্ষ বা জামাইষষ্ঠী মার্কা অনুষ্ঠানে শাড়ি কেনা যেখানে বাধ্যতামূলক, মা ফরমান জারি করে, কিনলেও তার জন্য যেন ছাপা শাড়ি কেনা হয়। ভালো শাড়ি, ভারী শাড়ি মা পরবে কোথায়? যখন শখ ছিল তখন সাধ্য ছিল না।  আর যখন সাধ্য উপচে গেল, মায়ের আর কোন শখ নেই।  


গয়না কিনে দেব কি? এককালে গয়নার প্রতি বড় লোভ ছিল মায়ের। খুব একটা তো ছিল না। যা ছিল তাও, যৌথ পরিবারের ঝড়ঝাপটায়, বাবার পাশে দাঁড়াতে অকাতরে খুলে দিয়েছে মা। চাকরী পেয়ে দিয়েছিলাম টুকটাক কিছু, যার মধ্যে একটা সেট ছিল খোদ পিসি চন্দ্র থেকে কেনা। মায়ের স্বপ্নের দোকান। বাবা-মায়েদের স্বপ্নপূরণের জন্যই তো আমাদের বড় হয়ে ওঠা। মুস্কিল হল, একটি বারও পরেনি মা। যত্ন করে তুলে রেখেছে ব্যাঙ্কের গোপন লকারে। ঝুটো সিটি গোল্ড পরে ঘোরে আজকাল। 


এটাই আমার মা। যা চায়, তা ভুল করে চায়।  আর যা পায়, তা মোটেই চায় না।  কি যে চায় মা। ভালো খাবার দাবার অর্ডার করে পাঠাব কি? বিরিয়ানি খেতে বড় ভালোবাসে মা। ভালোবাসে আমার হাতের পায়েস। তাতেও ঘোর আপত্তি মায়ের। চিরকালই পেটের রোগে ভোগা বাঙালী, গল ব্লাডার হারিয়ে এখন তো হজমশক্তি আরো ক্ষীণ। তাহলে চকলেট,কেক বা মিষ্টি? চকলেট বস্তুটার প্রতি তেমন আকর্ষণ কোনদিনই বোধ করেনি মা। মিষ্টি গোটা কোনদিন খেতে পারে না মা। কোনা ভেঙে একটুকরো বড়জোর।  


তাহলে কি কোন শোপিস অর্ডার দেবো? বা বাঁধিয়ে পাঠাব কোন স্মৃতি বিজড়িত ছবি। শোপিস পেলেই শোকেসে গুদামজাত করবে মা। আঃ বাইরে থাকলে ধুলো পড়বে যে। পুরুলিয়া থেকে কিনে আনা অমন সুন্দর ছৌ নাচের মুখোশকে প্লাস্টিকে মুড়ে কোন সিন্দুকে তুলেছে আর মনেই করতে পারেন না তিনি।  ফুল পাঠাব? এই তো সেদিন বিবাহবার্ষিকীতে পাঠালাম, একরাশ তাজা রক্তগোলাপ।এখনও সপ্তাহ ঘোরেনি তার।


ইন্সটলমেন্টে একটা টিভি কিনে দেবো কি? বাড়ির টিভিটা এলইডি নয়। তুত্তুরীর থেকেও বুড়ো এলসিডি। মাঝে মাঝেই ক্ষীণ হয়ে আসে, বন্ধ হয়ে যায় আওয়াজ। মিস্ত্রি দিয়ে সদ্য তার স্পিকার বদলেছে বাবা। এখন নতুন টিভি কিনে দিলে ক্রুদ্ধ বৃদ্ধের দাপটে টলে উঠবে মেদিনী। তাহলে ফ্রিজ? বাড়ির ফ্রিজটা সেই সাবেকী ১৬৫লিটারের ওয়ালপুল। যখন কেনা হয়েছিল তখনও আসেনি বর্তমান সহস্রাব্দ। ভিতরে মালপত্র ঠেসে রাখে মা। সপ্তাহে একদিন মনে করে ডিফ্রস্ট করে বাবা। বিবর্ণ হয়ে গা থেকে খুলে আসছে রঙ। বার দুয়েক আলো বদলানো আর গ্যাস ভরা ছাড়া আজ অবধি সার্ভিস করতে হয়নি তাকে। কষ্টার্জিত অর্থে কেনা ফ্রিজটার প্রতি বাবার টান সন্তানস্নেহের মতই। ওকে পাল্টে ফেলতে চাইলেই হাঁ হাঁ করে উঠবে বৃদ্ধ। হয়তো মাও। 


তবে কি ওয়াশিং মেসিনটা বদলে দেব? সেটাও প্রাপ্তবয়স্ক হয়েছে বিগত বছর। বছরে একবার আখতার মিস্ত্রি এসে স্ক্রু দিয়ে কি সব এঁটে যায়, আর বাকি বছরটা দিব্য ঘোরে ব্যাটা। দিনে দুই থেকে তিনবার কাপড়কাচা হয় আমাদের বাড়িতে। মায়ের ঘরের কাপড় সাতসকালে মা নিজে কাচে। আর বাবার পোশাক বাবা। ভালো পোশাক যদি কেউ পরে,সেগুলো অবশ্য একসাথেই কাচে বাবা। অবসর নেবার সময় পাওয়া অর্থে কষ্টেসৃষ্টে  কেনা, তাই ওর ওপর ভয়ানক টান বাবার। 


অনেক ভেবেচিন্তে একটা সিংগোনিয়াম গাছই পাঠালাম মাকে। একঝলক টাটকা বাতাস। সুদৃশ্য পোর্সিলিন প্ল্যান্টারে বসানো। প্ল্যান্টারের গায়ে মায়ের আর আমার ছবি দেওয়া। সব ব্যবস্থা ওয়েবসাইটই করে দিল। পার্সোনাল মেসেজটাও ডেলিভার করবে ওরা সুদৃশ্য কার্ডে ভরে। মাদার্স ডের দিন দুয়েক আগেই পৌঁছে যাবে মায়ের উপহার। 


বিবাহবার্ষিকীর দিন এক কেলো বাঁধিয়োছিল বাবা।  সারপ্রাইজ দেব বলে জানাইনি কেক আর ফুল পাঠিয়েছি ক্যুরিয়র মারফৎ। যোগাযোগ করার জন্য দিয়োছিলাম বাবার মোবাইল নম্বর। শর্ত ছিল,কোন কারণে ডেলিভারি ফেল হলে টাকা ফেরৎ দেবে না ওয়েবসাইট। সকাল থেকে ফোন করিনি। প্রতি মুহূর্তে ভাবছি এই বুঝি ডেলিভার হল উপহার আর খুশি খুশি কণ্ঠে ফোন করল বাবা বা মা। ফোন আর আসেই না। শেষে ধুত্তোর বলে ফোন করেই ফেলল তুত্তুরী। ভাগ্যিস করল, ঠিক সেই সময়ই ফোন করেছিল ক্যুরিয়রের ছেলেটা আর বাবা অত্যন্ত আত্মবিশ্বাস নিয়ে তাকে ভাগিয়ে দিচ্ছিল। ‘আরেঃ হাম ও অলোক চ্যাটার্জি নেহি হ্যায়। হাম কুচ অর্ডার নেহি দিয়া। ’ 


আবার যাতে কেলো না বাঁধায়, ভোর ভোর বাবাকে জানিয়ে রাখলাম,মায়ের জন্য কিছু পাঠাচ্ছি। বলো না যেন। কি পাঠাচ্ছি, কেন পাঠাচ্ছি কিচ্ছু বললাম না যদিও। আপিস পৌঁছে যখন নৈমিত্তিক খবর দিচ্ছি, ‘জ্যান্ত পৌঁছেছি মা।’ ক্যাঁক করে চেপে ধরল মা, ‘ কি পাঠালি? কেন পাঠালি?’ বৃদ্ধের পেটে যদি কোন কথা থাকে। 


সারাদিন ওয়েবসাইটে অর্ডার ট্রাক করেই কাটল। দে রে ভাই ডেলিভারি। এরমধ্যে দুবার ফোন করল বাবা, স্নান করতে আর ইয়ে করতে যাবে কি না। যদি এসে পড়ে ডেলিভারি বয়। এমন ফাজলামির কোন মানে আছে? 


সাতবার মেল করলাম, ‘পাঠা বাপ। পাঠা। বৃদ্ধ বৃদ্ধা বড়ই অসহিষ্ণু হয়ে উঠছে। ’ অবশেষে বেলা তিনটের সময় ভিডিও কল, ‘মানা। এসেছে তোমার উপহার। এই দেখো আমি আনপ্যাক করছি। মা মোবাইল ধরল আয় বিশ্বকর্মার মত ছুরি আর কাঁচি দিয়ে কাটতে বসল বাবা। সুদূর দিল্লী থেকে পার্সেল হয়ে আসা গাছ, ঈশ্বরের কৃপায় তখনও ঝকঝকে। কাঁচি দিয়ে টেপ গুলো কাটতে আসতে আসতে দৃশ্যমান হচ্ছে পোর্সিলিন প্ল্যান্টার আর তাতে লেখা আই লাভ ইউ মা। উৎসাহের চোটে থিরথির করে কাঁপছে মায়ের হাতের ক্যামেরা ফোন। ধমকাচ্ছে বাবা, ‘আঃ ঠিক করে ধরো। ’ এবার বেরোচ্ছে মায়ের আর আমার ছবি। উল্লাসে সুড়ুৎ করে উঠল মা, ‘সন্তুর আর আমার ছবি দেওয়া কাপ। ’ সব উৎসাহে একরাশ ঠাণ্ডা জল ঢেলে দিল কেউ। সন্তু অর্থাৎ তুত্তুরীর সঙ্গে আমার মায়ের আর মাদার্স ডের কি সম্পর্ক রে ভাই? মা টা তো আমারই নাকি। ভাগো এখান থেকে বলে ধমকে উঠতে গিয়েও সামলে নিলাম নিজেকে, মাকে সেরা উপহার তো দিয়েই দিয়েছি আমি এক দশক আগে। জীবনের বদলে জীবন। আর সেই নতুন জীবনকে ঘিরেই নতুন করে বাঁচুক মা। সন্তু অর্থাৎ তুত্তুরীকে আঁকড়ে নতুন করে শিকড় ছড়াও মা। হ্যাপি মাদার্স ডে।

অনির ডাইরি ৮ই মে, ২০২১

 



বলতেই পারেন, সুখের অসুখ। মাথার ওপর ছাত আছে, থালা ভরা গরম ভাত আছে, প্রিয়সান্নিধ্য আছে, তুত্তুরীর বকবকম আছে, হাত বাড়ালেই বন্ধু আছে, তবুও কেন জানি না দম বন্ধ হয়ে আসে কেবল। 


নৈমিত্তিক ব্যস্ত জীবন, দুরন্ত বেগে ছুটে চলা সময় আচমকা স্তব্ধ হয়ে গেলে বোধহয় এমনি হয়। অজান্তেই তৈরি হয়ে যায় অনন্ত, ঘোর কৃষ্ণগহ্বর। অসুস্থ পৃথিবীর গর্ভ থেকে উঠে আসে এক তীব্র ভালো না লাগা, ভালো না থাকার বিষবাষ্প। যাতে ক্রমশঃ আক্রান্ত হয় হৃদয়। ভালো লাগছে না। কিছুই যেন, কিছুই কেন ভালোলাগছে না? 


ভালোলাগে বৈকি, ভালোলাগে ভোরের কাঁচা রোদ মাখা, পেলমেট থেকে ঝুলন্ত আমার সোনা রঙ ঝুমকো লতার দিকে তাকিয়ে থাকতে। ভোরের আলো মেখে আলতো করে কেমন ছুঁয়ে দিয়ে দিল কোণার টবে রাখা মাকড়সা গাছের হাত। বারন্দার একটেরে জানলা গলে যখন মুখ বাড়ায়, একটি দুটি লালচে গোলাপী রঙা নয়নতারা তখন তো দিব্য ভালোলাগে। শিরা-উপশিরা-রক্তজালক থেকে হৃদয়ে সঞ্চারিত হয় গভীর ভালোলাগা-ভালোবাসার তরঙ্গ। ভরে ওঠে মন। ভালোলাগে ঝাঁকড়া অপরাজিতার শাখে শাখে হন্যে হয়ে কুঁড়ি খুঁজে বেড়াতে। ‘ফুল ফোটাবি কি না বল, নইলে ছেঁটেই দেব ব্যাটা তোদের আজ’। এমনকি ভালো লাগে ভোর ভোর রোদে দিতে গিয়ে ক্যাকটাসের কাঁটার খোঁচা খেতেও-  বাকিটা সবটুকুই কেমন যেন নিকষ দমবন্ধ করা আঁধার।


ভাবছি পালিয়েই যাব। মহানগর থেকে অনেকদূর।  ভাবছি মোজাম্মেল সাহেবকে ধরব। একখান চাকরী দেবেন আমায়? ভদ্রলোক আমাদের দপ্তরেরই মজুরী পরিদর্শক ছিলেন, অবসর নেবার পর গ্রামের পৈত্রিক ভিটেতে একখান নার্সারি বানিয়েছেন। যতবার গেছি, একরাশ চারার সাথে সাথে এক অদ্ভূত প্রশান্তি মেখে ফিরেছি নিজ গৃহে। 


 অজগাঁ, চতুর্দিকে ঘন আমবাগানের ভিতর দিয়ে টলটল করতে করতে এগোয় গাড়ি। দিনের বেলাও কেমন যেন ছায়াচ্ছন্ন পথঘাট। আমবাগানে গাড়ি রেখে পায়ে হেঁটে বড় গ্রীলের দরজা ঠেলে ঢুকতে হয়। ঢুকতেই বাঁদিকে একখান অতিকায় লিচু গাছ। বয়স তার সত্তর। তিনতলার ছাতে মাথা ঠেকিয়ে দুদণ্ড জিরিয়ে নিচ্ছে বোধধয়। সীমানা বরাবর পাহারা রত মহীরুহের দল আর তাদের মাঝে যতদূর চোখ যায় শুধু গাছ আর গাছ। হরেক রকম পাতাবাহারের গাছ, মরসুমি ফুলের গাছ, বারোমেসে ফুলের গাছ, ফলের গাছ, ত্রিপল আর জাল টাঙিয়ে গুচ্ছ খানেক ক্যাকটাস আর সাক্যুলেন্ট, শ্যাওলা ধরা চৌবাচ্ছায় ঢলঢল পদ্ম-শালুক, কি নেই? কে নেই? 


 অফিস ফেরৎ পড়ন্ত বিকেলে যখন গেছি, তখন গাছে জল দেবার সময়। কান পাতলেই শোনা যায় সদ্যসিক্ত গাছের পাতা থেকে কেমন টুপ করে খসে পড়ে মুক্তোর দানার মত জলকণা। কেমন সোঁদা সোঁদা গন্ধ ছড়ায় গ্রীষ্মের ভিজে মাটি।  


ভালো লাগে না বললে তো আর জীবন শোনে না। কৃষ্ণগহ্বরের মধ্যেও ঠিক পথ খুঁজে নেয় জীবন।  ভালো লাগিয়ে নিতে হয়। দেহের সাথে সাথে যত্নআত্তি  করতে হয়, খাতির করতে হয় মনটাকেও।  মনকে সেলাম জানিয়ে, মনের যত্ন নিতেই ঠিক করলাম আজ বিরিয়ানি রাঁধব। রাঁধব বললেই তো আর রান্না হয়ে যায় না, বিশেষতঃ এমন বাদশাহী খানা। তার জন্য লাগে সহস্র উপকরণ।  মিটশেফ ঘেঁটে পেলাম আধ প্যাকেট বাসমতী চাল, হাফ বোতল করে গোলাপ আর কেওড়ার জল। সুগন্ধী আতর ভেবে যেটা বেরোল, ভালো করে শুঁকে দেখলাম ঐটি নিম তেল। গাছের পোকা মারতে কিনে এনেছিলাম কবে যেন। 


একখান প্লাস্টিকের কৌটোয় বিরিয়ানি মশলা খানা বানিয়ে রেখেছিলাম, তা হল বেশ কিছুদিন। কিন্তু সে ব্যাটা লুকালো কোথায়। আবাসনে একখান বিশেষ দোকান আছে, তাকে বিরিয়ানী মশলা বললেই, নিঁখুত ভাবে ওজন করে একরাশ গোটা মশলা গছিয়ে দেবে। কি থাকে না তাতে? বড় এলাচ,ছোট এলাচ, লবঙ্গ, দারুচিনি, জায়ফল, জয়িত্রি, শুকনো লঙ্কা, তেজপাতা, কাবাবচিনি, সাজিরা,সামরিচ আর কি যেন একটা ধুলো-ধুলো ঝুরো ঝুরো পাতা। সবটুকু মশলা চাটুতে নেড়ে,শিলে বেটে গুঁড়ো করে রাখতে হয়। চলেও অনেকদিন। বিগত পুজোয় বানিয়েছিলাম, গেল কোথায় ব্যাটা। কৌটো খুঁজে ঢাকা খুলতেই মন মাতানো সুবাসে ভরে উঠল রান্নাঘর। 


মাস্ক পরে আতর কিনতে নামলাম বটে, আতর শুনলাম মার্কেট থেকে বেপাত্তা। অন্য দোকান থেকে একটা আতর আনিয়ে দিল বটে দোকানি, কিন্তু সাবধান করে দিল, ‘খুব অল্প দেবেন ম্যাডাম। এটা সস্তা আতর, বেশী দিলে গা গুলোবে। ’ 


মশলা তো হল। চালও হল। এবার মাংসের পালা। বিরিয়ানি যে রাঁধব, সে তো বেলা সাড়ে নটায় সিদ্ধান্ত নিলাম। ততোক্ষণে বাজার দোকান সেরে স্নান করতে গেছে শৌভিক। মাংস এনেছে বটে, কিন্তু তা গরগরে ঝোলের মাংস। মাংস আনলেই আলু দিয়ে লম্বা ঝোল করতে বলে শৌভিক, এমন ঝোল যাতে চলে যাবে দুইবেলা।  বাবার ভাষায় এমন ঝোল যাতে গামছা পরে নেমে তুলে আনা যায় মাংসের টুকরো বা হাড়। স্নান করতে যাবার আগে ফরমাইশ ও জানিয়ে গেছে ছাপোষা উচ্ছে আলু ভাতে আর মাংসের ঝোল রাঁধলেই চলবে। পরিশ্রমও কম হবে, আবার বাসনও পড়বে কম। যে বাড়িতে সবাই এত আমার কথা ভাবে, সেই বাড়িতে কি আদৌ মন খারাপ করে থাকা যায়? 


খানিক মাংস তুলে রাখলাম। পরে স্ট্যু বানিয়ে দেবো ক্ষণ। বড় ভালেবাসে এরা মাখন আর চিজ দেওয়া আমার হাতের চিকেন স্ট্যু। বাকি মাংসে তিন টেবল চামচ টক দই, এক চামচ লেবুর রস, নুন,লঙ্কা গুঁড়ো, হলুদ গুঁড়ো, পরিমাণ মত মধু, রসুন বাটা, অল্প আদা বাটা আর বিরিয়ানি মশলা ভালো করে মাখিয়ে বেশটি করে চটকে মেখে রেখে দিলাম। 


থাকুক ঘন্টা খানেক ব্যাটারা অমনি ভাবে। বাসমতী চালকে তিনবার ধুয়ে, ভিজিয়ে রাখলাম। ওরাও থাকুক। হায়দ্রাবাদি বিরিয়ানি আমার সবথেকে ভালো লাগে। আলু থাকে না বটে, তবে ঐ যে বেরেস্তা ছড়ায়, প্রতি গরাসে সুবাসি ভাতের সাথে টুকরো মাংস আর ভাজা পেঁয়াজের তরজা কেমন যেন নবাবী অনুভূতি জাগায়। তবে এ বাড়িতে মাংসের সাথে আলুর যা নিবিড় যোগাযোগ। বিরিয়ানিতে আলু না দিলে ছোটটা কিছু বলবে না হয়তো, বড়টা বড়ই বিমর্ষ হয়ে পড়বে।  অগত্যা- 


সবার আগে খোসা ছাড়ানো গোটা আলুগুলো নুন হলুদ মাখিয়ে সর্ষের তেলে ভেজে, অল্প সিদ্ধ করে তুলে রেখে, ঐ তেলেই গোটা দুই চামচ ঘি, অল্প জিরে, শুকনো লঙ্কা, তেজপাতা আর সামান্য গোটা গরম মশলা দিয়ে কুচানো পেঁয়াজ গুলো ভাজতে দিলাম। প্রাণে ধরে সবটুকু পেঁয়াজ দিতে পারলাম কই, বেরেস্তা বানাব থাক। বেরেস্তাই তো এই বিরিয়ানির প্রাণ। 


পেঁয়াজে রঙ সোনালী হলে মাখিয়ে রাখা মাংস গুলো ঢেলে কষতে হয়, বিরিয়ানি মশলা, টকদই, রসুন আর লঙ্কাগুঁড়োর সংমিশ্রণে ছড়ানো সুবাস, কানে কানে বলে যায়, পথটা ঠিকই ধরেছ যে । আদা বস্তুটা এরা মোটেই দেখতে পারে না, তবুও আরো একছটাক আদা না দিলে কেমন মন কেমন করে যেন। কষা শেষ হয়ে আসলে সামান্য ফেটানো টক দই, আরো খানিক বিরিয়ানি মশলা, অল্প লঙ্কা গুঁড়ো মেশাতে হয় মাংসে।  কষতে কষতে যখন মাংস ফেলে বুড়বুড়ি কেটে লাফিয়ে ওঠে শুধুই তেল, তখন ভেজানো বাসমতী চাল সাবধানে ছড়িয়ে দিতে হয় মাংসের ওপর। হাতা বা ছোট বাটি দিয়ে চেপে চেপে সমান করে দিতে হয় চাল। তারপর ঢালতে হয় নুন মেশানো জল। এই জল ঢালাটাই সবথেকে চাপের ব্যাপার। জল এমন হবে যাতে চাল হবে সুসিদ্ধ, কিন্তু বিরিয়ানি হবে ঝরঝরে। আমার নিজের হিসেব যতকাপ চাল তার থেকে ঠিক এক থেকে দেড় কাপ বেশী জল। 


জল গরম-ঠান্ডা যাই দেওয়া হোক কিছু যায় আসে না। শুধু নুনটা ঠিকমত হয়েছে কিনা দেখে, পাত্র ঢেকে মাঝারি গ্যাসে বেশ কিছুক্ষণ বসিয়ে রাখা। মাঝে মাঝে ঢাকা খুলে দেখে নেওয়া লবণ কম হয়ে গেল নাতো। যখন ঢাকা খোলা হবে তখন অল্প করে দুধে গোলা জয়িত্রি বা কেশর, আর অল্প বেরেস্তা ছড়িয়ে দেওয়া। যেহেতু চাল হাফ সিদ্ধ, তাই খুন্তি দিয়ে সাবধানে সামান্য নাড়াচাড়া করে নিলেও কোন সমস্যা হয় না। বরং দেখে নেওয়াই ভালো, তলাটা ধরে গেলে গ্যাস কমিয়ে দেওয়া যায় যাতে। বেরেস্তা মেশানো হয়ে গেলে, ভাতও ঝরঝরে হয়ে আসবে, তখন সামান্য গোলাপ আর কেওড়ার জলের সাথে দু-চার ফোঁটা বিরিয়ানির আতর মিশিয়ে দিলেই হবে। চাল সামান্য শক্ত থাকতে থাকতে গ্যাস অফ করে ঢাকা দিয়ে দিতে দিলেই ব্যাস্ প্রায় অনায়াসেই তৈরি হয়ে এক কড়া বিরিয়ানি। 


দেখতে শুনতে তো বেশ ভালোই হয়েছিল, স্বাদেও অতি চমৎকার। অন্তত জনগণ তাই বলল, অবশ্যি ছিঁচকাঁদুনে  বলে এরা যে হারে আমায় প্যাম্পার করে, এদের কথায় না বিশ্বাস করাই ভালো। তবে খেতে বসে পুনরায় অনুধাবন করলাম উদরের সাথে হৃদয়ের সম্পর্ক বড়ই রগরগে মাইরি। সেই যে মা বলতো না, ‘ভুঁড়ি ঠাণ্ডা তো মুড়ি ঠাণ্ডা’। দেহের বয়স বাড়লেও জীবন হাতেনাতে শিখিয়ে দেয়, মনের বয়স আজো আটকে আছে সেই মায়ের হলুদের গন্ধ মাখা আঁচলের তলে।

Saturday 1 May 2021

অনির ডাইরি ১লা মে, ২০২১

 অনির ডাইরি ১লা মে, ২০২১

তখন অনেক রাত। দেওয়াল ঘড়ির বড় আর ছোট কাঁটা এক হয়েও পুনরায় বিচ্ছিন্ন।  পাশের ঘরে ফুললতা আঁকা মিটমিটে ল্যাম্পের আলোয় মোৎজার্টের কত নম্বর যেন সুরের মূর্ছনায় মোহিত শৌভিক। আধা ঘুমন্ত তুত্তুরীকে ঠেলে তুলে কানে ফোন চেপে ধরল তুত্তুরীর মা। ‘আঃ এখন কেন? যখন ওরা বিয়ে করেছিল তখন শুভেচ্ছা জানাব। ’ গত বছরেও এসব কথা বলত না মেয়েটা।  ইদানিং জ্যাঠাইমার ভাষায় পিপুল পাকছে।  সব বিষয়েই সুচিন্তিত মতামত দেয়, না চাইলেও। যার অধিকাংশই বাবার রঙে রঞ্জিত।  তা হোক। যত বয়স বাড়বে মায়ের সাথে শত্রুতা ততো বাড়বে আমি জানি। কারণ শাসন করার তিক্ত দায়িত্ব যে শুধু মায়ের। বাবা মানে তো অখণ্ড প্রশ্রয় আর অনাবিল বন্ধুত্ব।  


জোর করেই মেয়ের কানে ফোনটা ধরলাম। প্রিয় সম্পর্কের ক্ষেত্রে কখনও পরে বা কাল থাকতে নেই।  কে জানে কাল কি হয়। বিরক্ত হয়ে শুভ বিবাহবার্ষিকীর শুভেচ্ছা জানাল তুত্তুরী। মা অবশ্য তাতেই বিগলিত। বাবাও কিছু মনে করল না দেখি, তবুও অর্বাচীন সন্তানের জননী হিসেবে মার্জনা চাইলাম উভয়ের কাছে। বড্ড বদমেজাজী মেয়েটা আমার। অবশ্য ঐ বয়সে আমিও তাই ছিলাম। ভয়ানক অমিশুক এবং উন্নাসিক। 


ফোনের ওপার থেকে ভেসে এল বাবার গমগমে গলার ধমক, ‘ নাঃ ও বদমেজাজি নয়। ও ঠিক আমার মতই অভিমানী। তুমি কি জানো আমি ওর বয়সে কি সাংঘাতিক কাণ্ড ঘটিয়েছিলাম?’ এতরাতে বৃদ্ধবৃদ্ধার ঘুম ভাঙিয়ে শুভেচ্ছা জানাচ্ছি জানলে তুলকালাম করবে শৌভিক। এখনও নেভেনি অবশ্য পাশের ঘরের আলো, কি যেন একখান আফ্রিকান গান চালালো শৌভিক। মাঝে মাঝে আমাকেও ডেকে শোনায়। যাই হোক তার মানে শুতে আসতে দেরী আছে আরো কিছুক্ষণ। 


বলো না বাবা গল্পটা। বেশী পিড়াপিড়ি করতে হল না, বৃদ্ধ বলবে বলেই উঠে এসে বসল ডাইনিং টেবিলে, ‘দাঁড়াও একটা ধূম খাই। ’ ধূম অর্থাৎ সিগারেট। ধোঁয়া ছেড়ে গল্প শুরু করল বাবা, ‘আমি তখন বছর নয়েক।  আমি তখন চতুর্থ শ্রেণী। কি কারণে যেন ভীষণ অভিমান হয়েছিল, সম্ভবতঃ ছোটকাকার কাছে প্যাঁদানি খেয়েছিলাম। তোমাকে তো বলেছি, আড়ালে ছোটকাকাকে আমরা চোরা (মহিষাসুর) বলে ডাকতাম। তেমনি চেহারা ছিল। নিয়মিত মুগুর ভাঁজত। ইয়া বড় বড় ছিল হাতের গুলি। ’ আঃ বাবা, প্রসঙ্গান্তরে যেও না। ‘না। না। তো সুযোগ পেলেই শাসন করত ছোটকাকা। বকা, কানমলা, ঠ্যাঙানি। বাবা-মা কিছুই বলত না। তো সেদিনও তেমন কিছু হয়েছিল বোধহয়। এত অভিমান হল, ভাবলাম গৃহত্যাগ করব। সকাল নটা নাগাদ বেরোলাম স্কুলে যাব বলে। মোড়ের মাথায় গিয়ে দাঁড়িয়ে আছি দেখি একটা ফাঁকা ঘোড়ার গাড়ি। তখনও পঞ্চানন তলা রোড দিয়ে ঘোড়ার গাড়ি চলত।


গাড়ির পিছনে উঠে বসলাম। গাড়োয়ান গুলো করত কি, মাঝে মাঝে পিছন দিকে ছিপটি গুলো ঘোরাত, যাতে কোন দুষ্টু ছেলে যদি উঠে বসে তার গায়ে লাগবে সপাৎ করে। যতবার গাড়ি আস্তে হয় আমি টুক করে নেমে পড়ি, সপাং করে ছিপটি ঘুরিয়ে যেই গাড়ি স্পিড তোলে, আমিও লাফিয়ে উঠি। এইভাবে কতদূর গেলাম জানি না, হঠাৎ গাড়িটা থেমে গেল। গাড়োয়ানটা বোধহয় চা খেতে গেল, আমি নেমে রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে আছি, দেখি একদল লোক এসে বসল গাড়িটায়, গাড়িটাও অমনি তাদের নিয়ে ছেড়ে দিল। 


আমি তো বেকুবের মত দাঁড়িয়ে আছি। দেখি সেটা একটা রেল স্টেশন। সামনের সরু সুড়ঙ্গ দিয়ে মানুষ ওঠা নামা করছে, আমি নেমে ওপাশে উঠে দেখি শ্রীরামপুর স্টেশনে আছি। একটা ট্রেন দাঁড়িয়েছিল, চুপচাপ উঠে পড়লাম। উঠে বসে আছি, তো বসেই আছি। ট্রেন ছুটছে, আচমকা অণ্ডাল স্টেশনে আমায় চেকার ধরল-’। 


অণ্ডাল? সে তো অনেকদূর গো বাবা। তুমি অত দূর চলে গেলে ন- দশ বছর বয়সে? ‘হ্যাঁ। তবে আর বলছি কি। চেকার বলল, টিকিট দেখা। বললাম নেই। সে তো মহা হম্বিতম্বি করে, কান ধরে নামিয়ে স্টেশন মাস্টারের ঘরে নিয়ে গেল। দেখলাম ঘোর কৃষ্ণবর্ণ, অনেকটা তুলসি চক্রবর্তীর মত দেখতে, ধুতি পরা একটা লোক খালি গায়ে  বসে বসে কি সব কাজ করছে। চেকার বলল, ‘এই দেখুন মাস্টারমশাই, এ হারামজাদা এই বয়স থেকেই  বিনা টিকিটে যাত্রা করছে। ’ মাস্টারমশাই, মাথা তুলে ইশারায় কি বলল, চেকার আমায় দাঁড় করিয়ে রেখে চলে গেল। 


আমি বোকার মত দাঁড়িয়ে আছি তো দাঁড়িয়েই আছি। আচমকা লোকটা মুখ তুলে আমার খেঁকিয়ে উঠল, ‘অ্যাই হতভাগা দাঁড়িয়ে আছিস কেন? হাতপাখাটা দেখতে পাচ্ছিস না? বাতাস কর।’  লোকটার মাথার ওপর একটা বোধহয় বৃটিশ আমলের ডিসি পাখা ঘটাং ঘটাং করে ঘুরছিল। তাও দরদর করে ঘামছিল লোকটা। আমি ভয়ে ভয়ে হাতপাখাটা দিয়ে বাতাস করতে লাগলাম।  


বেশ অনেকক্ষণ পর, লোকটার হিসেব বোধহয় মিলল, মুখ তুলে আমার দিকে তাকিয়ে জানতে চাইল, ‘তুই কে? বাড়ি কোথায়? পালিয়েছিস?’ আমি ভয়ে ভয়ে সব সত্যি কথাই বললাম, তখন লোকটা আমায় নিয়ে গিয়ে পেট ভরে খাইয়ে পরের ট্রেনে গার্ডের কামরায় তুলে দিল। তুলে দেবার সময় জিজ্ঞাসা করল, ‘তোকে হাওড়ায় নামিয়ে দিলে বাড়ি যেতে পারবি?’ আমি ঘাড় নেড়ে জানালাম পারব। তখন জানতে চাইল ,‘কি ভাবে যাবি?’ আমি বললাম, বেরিয়ে ৫৩নম্বর বাস ধরে চলে যাব। লোকটা আবার প্রশ্ন করল, ‘ভাড়া কত জানিস?’ বললাম এক আনা। লোকটা পকেট থেকে একটা গোটা টাকা আর একটা আনি বার করে আমায় দিয়ে বলল, ‘সাবধানে বাড়ি চলে যাস। আর কোথাও পালাস না বাপ। ’ আর গার্ডকে বলল, ‘এর কাছে টিকিট নেই।  হারামজাদাকে হাওড়া স্টেশন থেকে বার করে ৫৩ নম্বর বাসে তুলে দিয়ে কন্ডাক্টরকে একটু বলে দেবেন ক্ষীরেরতলা স্টপে যেন নামিয়ে দেয়। ছোঁড়া মহা বিচ্ছু। ’ গার্ড আমায় এনে ৫৩নম্বর বাসে তুলে দিল, আমি যখন নাচতে নাচতে বাড়ি ঢুকলাম, তখন সন্ধ্যে ছটা বেজে গেছে। আমার পকেটে তখনও ঠংঠং করছে একটা গোটা টাকা-’।  


এই দুর্ধর্ষ ভদ্রলোকের সঙ্গে প্রায় অর্ধশতাব্দী যে কি ভাবে ঘর করেছে মা তা বোধহয় কেবল মাই জানে। আজ এঁণাদের বিবাহের পাক্কা ৪৭ বছর পুরো হল। পরিকল্পনা তো ছিল অনেক, থাক না হয় অন্য কখনও হবে। আপাততঃ সুস্থ হয়ে উঠুক পৃথিবী। ততোদিনে আরো গভীর হোক এঁদের প্রেম, আরো মধুর হোক দাম্পত্য। কাটুক মায়ের মনের যাবতীয় মেঘ, সিগারেট ছাড়ুক বাবা, আর পারলে মিষ্টিটাও। বড্ড মিষ্টি খাও মাইরি বাবা তুমি, বললেই অবশ্য গোঁসা হবে তোমার- তা হোক তবুও বলি যেমন আছো তেমনি থাকো তোমরা শুধু সিগারেট আর মিষ্টিটাকে মারো গুলি।