Monday 25 February 2019


তুত্তুরীর বুজু সরস্বতী পুজো হবে, তানিয়া মাসি আর রমেশ মামা মিলে অনেক ঝাড়াই বাছাই করে প্রকাণ্ড দর দস্তুর করে কিনে তো দিল।গাড়িতে তোলার সময় রমেশ বলেও দিল পইপই করে,“ম্যাডাম ওকে ভালো করে কোলের কাছে নিয়ে বসুন। পড়ে না যায়। ” বুজু সরস্বতী বলে কথা, বাবা! বড় ছটপটে।
গাড়ি যায়, গাড়ি যায়, আচমকা কোথা থেকে যে এক লক্কড় মার্কা বাইকওলা গাড়ির সামনে এসে উদয় হল, ঘচাং করে ব্রেক কষল আমাদের সুশান্ত। যাকে আমি বিগত কয়েক মাস ধরে প্রশান্ত বলে ডেকে আসছি, এবং সেও বিনা আপত্তিতে “হ্যাঁ ম্যাডাম” বলে সাড়া দিয়ে আসছে।
কৃতঘ্ন বাইকওলা প্রাণ বাঁচানোর জন্য ধন্যবাদ দূরে থাকুক, চারটি গালাগাল দিয়ে পগার পার। সুশান্ত সম্প্রদায়গত ভাবে  সাঁওতাল,এবং জাতবৈশিষ্ট্য বজায় রেখে নিখাদ সরল এবং সাদাসিধে। এই যদি আমাদের পুরানো ড্রাইভার রাজীব বা বিপ্লব হত, বাইকওলার কপালে দুঃখ ছিল।
যাক বাইকওলা তো পগারপার, সুশান্ত এবং আমি হতভম্ব আর বুজু সরস্বতীর সুউচ্চ চালচিত্র, ঠিক চায়ে ডোবাতে যাওয়া মারি বিস্কুটের মত দুখণ্ড। কি হবে এবার? ভাঙা ঠাকুরে কি পুজো হয়?
 গাড়ি তখন নিবেদিতা সেতুতে। একবার ভাবলাম দিই গঙ্গায় ভাসিয়ে। বাড়ির পাশের বাজার থেকে কিনে নেব খন একটা। শ আড়াই টাকা জলে গেল, এই যা দুঃখের। ভাবলাম বটে, কিন্তু ফেলতে পারলাম না। কেমন কোল ঘেঁষে বসে আছে দেখ, যেন একটা ছোট্ট মানুষ। মায়ের ওমে খুঁজছে নিরাপত্তার আশ্বাস। কি করি?
আমার থেকে মন খারাপ সুশান্তর,“কি হবে ম্যাডাম? আমার গাড়িতে ভেঙে গেল ঠাকুরটা?ইশ্। ” বেচারার কষ্ট দেখে ফোন করলাম আমার বুড়োকে, বৃদ্ধ যদিও নাস্তিক, তবে কন্যার জন্য, রামকৃষ্ণ দেবের ভাষায়, “ দুগ্ধ এবং তামাক” উভয়ই সেবনে সক্ষম। মায়ের হাতে বাননো এক কাপ গরম চায়ে, পরম তৃপ্তির চুমুক মেরে বলল, “ধুর!ধুর! ফেলে দিবি কেন? মনে নেই, রাণী রাসমনিকে কি বলেছিলেন রামকৃষ্ণদেব? পরিবারের কারো হাত-পা ভাঙলে তাকে ফেলে দিবি? ফেভিকুইক দিয়ে জুড়ে দে না। ”
সুশান্তর যেন ধড়ে প্রাণ এল,“গাড়িতে একটা ফেভিকুইক আছে ম্যাডাম। কিনেছিলুম। আপনি নিন।” তাই করলাম। কি গন্ধ বাপস্। চোখে জল এল। কিন্তু বুজু সরস্বতীর চালচিত্র তো জুড়ল না বাপু। সুশান্ত কাতর স্বরে বলল,“ম্যাডাম, ওকে কোলে নিয়ে বসুন। শুকনো মাটি তো তাই হুহু করে আঠা টেনে নিচ্ছে। আপনাদের বাড়িতে মাটি নেই ম্যাডাম? একটু এঁটেল মাটি ডেলা করে জুড়ে দিলেই আটকে যাবে। ” শহুরে আবাসনে বিশাল বাগান, প্রচুর গাছ, কিন্তু মাটি কোথায় পাই?
সুশান্তর বিশ্বাস হয় না। ম্যাডামের বাড়ি মাটি নেই? শেষে বলে “আপনি দুঃখ করবেন না ম্যাডাম, একটা দোকান দেখে দাঁড়াব, আর একটা ফেভি কুইক কিনে দেখা যাক না?” বেলঘড়িয়া এক্সপ্রেস ওয়েতে কোথায় ফেভি কুইক পাবি বাবা? খানিক গিয়ে ঘচাং করে গাড়ি দাঁড়িয়ে গেল। সামনে একটা মার্বেলের মূর্তির দোকান,“একটু বলে দেখব ম্যাডাম? যদি ওরা জুড়ে দেয়?” কাল বাদে পরশু সরস্বতী পুজো, অনেকে তিথিগত ভাবে কালই করবে, এখন কার দায় পড়েছে, সুশান্তর ম্যাডামের মেয়ের বুজু সরস্বতীর চালচিত্র জুড়তে বসবে। ছেলেটা শুনলে তো?
কি বলল, কি শুনল কে জানে, ফিরে এসে বলল, “দিন ম্যাডাম, ওরা দেখতে চাইছে।” কোলে করে নবজাতকের মত বুজু সরস্বতীকে নিয়ে গেল হাইওয়ের পাশের ঢালে। কালো প্লাস্টিক টাঙানো দোকানে থরে থরে দাঁড়িয়ে আছেন নানা দেবদেবী- মহাপুরুষের দল। সময় আর কাটে না। বেলঘড়িয়ার নচ্ছার মশার দল বার কয়েক আক্রমণ করে হাফ লিটার রক্ত শুষে নিল। তারপর দেখি সুশান্ত আসছে, কোলে বুজু সরস্বতী।পিছন পিছন দোকানের মালিকও উঠে এসেছে। “মার্বেলের গুঁড়ো দিয়ে জুড়ে দিয়েছি দিদি। চিন্তা নেই। ” সুশান্ত বলল,“ম্যাডাম ওরা কিছু চায়নি, কিন্তু ২০-৩০টা টাকা দেবেন?” দিতে গেলাম-কিছুতেই নেবে না। কে বলে ভালো মানুষ নেই? শেষে সুশান্ত করজোড়ে বলল,“নিন না দাদা,ম্যাডাম ভালোবেসে দিচ্ছেন, চা খাবেন খন। নাহলে ম্যাডাম দুঃখু পাবে। ”
গাড়ি গড়াল। খুব লজ্জা লাগছিল, দিন কয়েক আগেই সুশান্তকে বলা হয়েছে মার্চ মাস থেকে অন্য গাড়ি নেব আমরা। ঝাঁ চকচকে নতুন গাড়ি। বাতাসে সাথে কথা বলে- তার আগে জিজ্ঞাসা করেছিলাম বটে,“সুশান্ত তোমার আপত্তি নেই তো?” সরকারি রেটে ভালো গাড়ি পাওয়া যায় না। এত ভালো গাড়ি কি ছাড়া যায়? অরিন্দম বাবু বললেন,“সুশান্ত ম্যাডামকে বলো, না ম্যাডাম আমিই থাকব। ” সাঁওতালরা কবে আবার মনের কথা খুলে বলতে পারে? মাথা নত করে সুশান্ত বলেছিল,“ম্যাডামের যাতে সুবিধা হয়। ” আর আজ ছেলেটা আমার মেয়ের শখের ঠাকুরের জন্য এতখানি দৌড়দৌড়ি করল। আমার বাড়ি ঢুকতে রাত নটা বাজবে। ও কটায় পৌঁছবে কে জানে?
 মনস্থির করে নিলাম, জন্মগত ভাবে আমি চাটুজ্জে, আর চাটুজ্জেরা স্বভাবতঃ  আবেগপ্রবণ। এতখানি শ্রদ্ধা আর ভালোবাসার সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিততে পারে এমন দামী গাড়ি কেউ বানাতে পারে নাকি? বললাম,“সুশান্ত,খুব দুঃখ হয়েছে বাবা?ম্যাডাম ছেড়ে দেবে বলেছে বলে?” খোলা জানলা দিয়ে হুহু করে ঢুকছে হাওয়া, সুশান্ত বেশ খানিকক্ষণ চুপ থেকে বলল,“হ্যাঁ ম্যাডাম। বড় বাজে সময়ের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি। আপনার ঐ গাড়িটা পছন্দ ম্যাডাম? একটু সময় দিন। দরকার হলে এটা বেচে ঐ গাড়িটা কিনব। আপনি লোনের ব্যবস্থাটা একটু করে দেবেন শুধু। ” প্রসঙ্গতঃ লোন মানে গতিধারা।
কবে গাছে কাঁঠাল পাকবে সেই আশায় আমরা এএলসি আর ড্রাইভার গোঁফে তেল মাখতে মাখতে বাড়ি ফিরলাম। শৌভিককে বলা ছিল, নীচে গেটের কাছে দাঁড়িয়ে ছিল বুজু সরস্বতীকে কোলে করে ওপরে নিয়ে যাবে বলে। সুশান্তর কিছুতেই ভরসা হয় না। “ম্যাডাম আমি বরং দিয়ে আসি। ” বললাম তুই বাড়ি যা বাবা। যাবার আগে, কান চুলকে বলল,“ম্যাডাম আমাদের গ্রাম পঞ্চায়েতে একটা ক্যাম্প করবেন? আমাদের লোকগুলো ভালো জানে না,সামাজিক সুরক্ষা যোজনা সম্পর্কে। আমাদের বাড়ির মেয়ে-ছেলে গুলোও একবার আপনাকে আর স্যারকে(সুখেন বর্মন) দেখতে চায়।যাবেন ম্যাডাম?” এ আর এমন কি? গিয়েছিলাম আজ পাণ্ডুয়ার শিখিরা-চাঁম্পতা গ্রাম পঞ্চায়েতে। অজ গ্রাম যাকে বলে। সবুজ ধান ক্ষেত, পেকে ওঠা আলু ক্ষেত, বকুলের ভারে নুয়ে পড়া আমগাছ, তেঁতুল গাছ, ডোবায় চরে বেড়ানো হাঁস, অযতনে বেড়ে ওঠা, পুকুর পাড়ের রক্তজবা  দেখে মোহিত হয়ে গেলাম। ৩৫০ফর্ম পড়ল পটাপট। আরো জমা পড়ছে,আমরা বেরিয়ে এলাম।অনেকটা চলে আসার পর সুশান্ত বেজায় ঢোঁক গিলে বলল,“বাড়ির মেয়েছেলে গুলো সেজে গুজে বসেছিল ম্যাডাম।আপনি যাবেন বলে। এখন হল্লা করছে। ” তো আগে বলবি তো বাবা। জবাব পেলাম,“আপনি ব্যস্ত ছিলেন না ম্যাডাম-”। এই না হলে আমাদের সুশান্ত!