Sunday 31 October 2021

অনির ডাইরি ২৫শে অক্টোবর, ২০২১

 

আমরা যারা সরকারী চাকরি করি, পরিযায়ী পাখির মত বাঁচি, তাদের বদলীর সময় এলেই দুটি চিন্তা ভ্রমরের মত গুঞ্জরিত হয় মাথায়, প্রথমতঃ অবশ্যই আমার কোথায় হবে আর দ্বিতীয়তঃ আমার  জায়গায় কে আসবে? কার হাতে তুলে দিয়ে যাব আমার দলবলকে, কেমন মানুষ সে? যখন দুটি প্রশ্নের উত্তরই হয় মনোমত তখন আর চিন্তা কি? 


একে তো যেখানে যাচ্ছি, চেয়ে চিন্তেই যাচ্ছি, তারওপর উত্তরসুরি আবার পরম সুহৃদ। ফলতঃ 'আমার মত সুখী কে আছে'?অন্তত আজকের দিনটায়। বাকি থাকে কেবল বড়দি, অর্থাৎ উপরওয়ালীর মৌখিক সম্মতি। এমনিতে বড়দি নির্ঝঞ্ঝাট, প্রথম দিনেই বলেছিলেন, ম্যাডাম আর আপনি বলে সম্বোধন করলেই ঠ্যাঙাবেন। যেমন দিদিগিরি চলত, তেমনিই যেন চলে। তা এহেন বড়দি যদি অনুমতি দেন তো 'রইল ঝোলা, চলল ভোলা' করে গুটি গুটি রওণা দিই আর কি। বড়দি যে খুব একটা খুশি খুশি, ‘ আচ্ছা তাহলে পাততাড়ি গুটাও’ বললেন তাও না, বরং মৃদু অনুযোগের সুরেই বললেন,‘ এত তাড়া কিসের তোমার?’ বলবেন নাই বা কেন, একই অর্ডারে নাম ছেপে বের হওয়া কেউই যে এখনও অব্যাহতি পায়নি দায়ভার থেকে


শেষ পর্যন্ত অবশ্য বড়দিকে পটিয়ে, কাগজপত্র গুছিয়ে রেডি হয়ে গেলাম, বেশ একটা,‘ পেয়েছি ছুটি, বিদায় দেহ ভাই, সবারে আমি প্রণাম করে যাই’ মার্কা ফুরফুরে অনুভূতি নিয়ে শেষ করলাম সোমবারটা। মাঝখান থেকে ত্রিপাক্ষিক এগ্রিমেন্টটাও সই হয়ে গেল মালিক আর শ্রমিকপক্ষের মধ্যে। সব পক্ষের আনা মিষ্টির বন্যা বয়ে গেল আপিসে। মাথা পিছু তিন চারখানা মিষ্টি সাঁটিয়েও শেষ হল না। ধীমান বিরক্ত হয়ে বলল,‘ এই বাক্সটা বাড়ি নিয়ে যান। আর কেউ খেতে চাইছে না। ’  


মেশিন বন্ধ করে উঠতে যাচ্ছি, কৌশিক বলল,‘ ম্যাডাম একটু সার্কিট হাউসটা যদি-’। বুক করাব? কেন? কেউ থাকবে নাকি রাতে? ঘাড় মাথা চুলকে যা বলল, বুঝলাম সার্কিট হাউসের মিটিং হলে ফেয়ারওয়েল দিতে চায় ওরা আমায়। ধীমান এমনিতেই খবর নিয়ে এসেছে, ফাঁকাই আছে মিটিং হলখানা।  নাজিরের সাথে কথা বলে হাতে লিখেও দিয়ে এসেছে, শুধু একটা চিঠি যদি করে দি, আরো পোক্ত হয় ব্যাপারটা।  নিজের ফেয়ারওয়েলের জন্য নিজেই চিঠি করলাম, একটু নজ্জা নজ্জা করছিল যদিও। 


বাড়ি ফিরছি, সঞ্চিতার ফোন, ‘টিফিন আনবেন না। লাঞ্চের সামান্য ব্যবস্থা করেছি আমরা।তুত্তুরীকে অবশ্যই আনবেন। ওকেও ধরা হয়েছে-। ’ লজ্জায় আর বলতে পারলাম না, ওকে তো আনতেই হবে। প্রথমতঃ আমার বদলীর খবর আসা ইস্তক চুঁচুড়া আর তার মানুষগুলোর জন্য বিলাপ করে চলেছেন শ্রীমতী তুত্তুরী। বিগত পাঁচ বছরে বেশ অনেক বারই এসেছে কিনা, পিকনিক থেকে মেলা সবেতেই উপস্থিত ছিলেন তিনি। প্রথম দিকে রমেশ আর প্রীতিই ছিল তাঁর প্রিয় বন্ধু, এখন আরো অনেকের সাথে দোস্তি হয়েছে তাঁর। আমার সাথে সাথে এই মানুষগুলোকে বিদায় জানাবার প্রবল আকাঙ্ক্ষা তাঁরও।  


তবে শুধু এই জন্যই নয়, তুত্তুরীকে আনব, কারণ তেমনিই মানত করেছিলাম দেবী হংসেশ্বরীর কাছে। মানত করেছিলাম সেই বিগত জানুয়ারীতে। তারপর আর সেই মানত পুরো করা হয়ে ওঠেনি। এমনিই হয় আমার। প্রতিবছর মেলার আগে মানত করি, ঘাড় ধরে যখন বাঁশবেড়িয়াতেই টেনে আনো বারবার, তখন নির্বিঘ্নে মেলা মেটানোর দায় আমার পাশাপাশি তোমারও। তুমি এইবারটি করে দাও, তারপরই আমি এসে পুজো দিয়ে যাব। বলি বটে, তবে পুজো দিতে দিতে এসে পড়ে পরের বছরের মেলা। বাঁধে তুমুল গণ্ডগোল,দেখাদেয় উটকো সমস্যা, কিছুই হয় না ঠিকঠাক। তখন মনে পড়ে,হায় মা, তোর পুজোটা তো বাকি রয়ে গেছে। আসছি মা, আসছি, আর সমস্যা সৃষ্টি করিস না। অতঃপর চূড়ান্ত ব্যস্ত নির্মলকে হিড়হিড় করে টানতে টানতে নিয়ে যাই মন্দির, চল বাবা চল। মিষ্টি ফুল যা যা লাগবে যোগাড় করে পুজো দিই। নাহলে তোর আর আমার মাথাটাই খারাপ করে দেবেন এই নীলবর্ণা ভদ্রমহিলা থুড়ি দেবী। 


২০২১এর মেলায় জনৈক রাজনৈতিক দল এমন সমস্যা করছিল বলার নয়।ডেপুটেশন, মেলার বাইরে কালো পোস্টার, টুকটাক হুমকি। তারওপর অরাজনৈতিক একচোট মারামারি, জনৈক প্রভাবশালী ব্যক্তির ভিআইপি টিফিনে তুলতুলে খাসির মাংসের আব্দার- সব মিলিয়ে মনে হচ্ছিল পাগলই হয়ে যাব। দুচারটে লোককে কামড়ে দিলে যদি মেটে কিছু সমস্যা। একমুঠো বাজেটে খাওয়াব কি আর সাজাব কি? নিজেদের খাবার বলতেই তো ডিম ভাত, তৎকালীন বড়সাহেব বলেছিলেন দুটো ডিম যদি দেওয়া যায়, ওসি ফুড চঞ্চল হাত জোড় করে মার্জনা চেয়েছিল। ভিআইপি প্যাকেট নিয়ে স্যার-চঞ্চল-কেটারার আর আমি রীতিমত গবেষণা করেছিলাম সবথেকে সস্তায় সবথেকে বড় প্যাকেট কি হতে পারে, যা নাড়াচাড়া হলে ঠং ঠং করবে না। সেখানে খাসি আনব কোথা থেকে? তা যাও বা ম্যানেজ হল, এল নতুন ফর্মান, গান শোনাতে হবে। আমায় নয়, কোন ভাড়া করা সুগায়িকাকে দিয়ে। 


আধপাগল  থেকে পৌনেপাগল হয়ে মনে পড়ল, যাঃ বিগত বছরের পুজোটা তো রয়ে গেছে বাকি। বিশ্বাস করবেন না, পুজো দিয়ে আসার সাথেসাথেই কি ভাবে যেন মিটে গেল সমস্যা গুলো। ঝামেলা বাঁধানো রাজনৈতিক দলের জনৈক নেতা, স্বয়ং ফোন করে আশ্বস্ত করলেন,‘ আমাদের নিয়ে একদম টেনশন করবেন না। এটা রাজ্যব্যাপী কর্মসূচী, আমাদের তাই করতেই হবে। তবে এই আপিসের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক এত ভালো, গেলে আপনারা বসান, চা খাওয়ান। দাবীদাওয়া শোনেন, দরকারে কলকাতায় পাঠান লোকজনকে তত্বাবধান করতে। আপনাদের কোন ভাবে বিপদে বা অস্বস্তিতে ফেলব না আমরা। ’ অতঃপর তিনি বিশদে জানালেন, কোথায় জমায়েত হবেন তাঁরা, কোথা থেকে রওণা হবে ডেপুটেশনের মিছিল। এজেন্ডা কি ইত্যাদি। এবং পরিশেষে কোথায় তাঁদের আটকালে বাঁচবে তাঁদের মুখ আর আমাদের মেলা। অমুক বাবু, আমি জানি আপনি স্বনামে ফেসবুকে নেই, কিন্তু এটাও জানি আমাদের যাবতীয় ব্যাপারস্যাপার শ্যেন দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করেন আপনারা। কথাপ্রসঙ্গে দু চারটে লোপ্পা বল আপনি বা আপনার দলবল স্বয়ং তুলে দিয়েছিল আমার হাতে। মুস্কিল হল, আমাকে দেখে যতটা গাম্বাট হোঁদলু মনে হয়, আসলে ততোটা নই। যাই হোক, এটাও নির্ঘাত অচীরেই আপনার দৃষ্টিগোচর হবে, তাই আগেভাগেই  বলে রাখি, বিশ্বাস করুন, আপনার সেদিনের উপকার আমি জীবনে ভুলব না। আর একটা কথা আপনার নাম আমি আমার বর( যিনি আমার কোন বক্তব্যই হয় কান দিয়ে শোনেন না অথবা শুনলেও অন্য কান দিয়ে বার করে দেন) ছাড়া আর কারো কাছে আজ অবধি প্রকাশ করিনি। এমনকি বড়সাহেবের কাছেও নয়। সবাই তাজ্জব হয়ে গিয়েছিল আমার তথ্য শুনে। রাত এগারোটা অবধি থানায় বসে,রিহার্সাল হয়েছিল পুরো নাটকটা।তারপর আর কোথাও কোন সমস্যা হয়নি। 


মোদ্দা কথা পুজো দিয়ে আসার সাথেসাথেই সবকিছু সাল্টে দিয়েছিলেন, নীলবর্ণা দেবী। বদলে মানত ছিল, 'মেলা উৎরে দাও মা, মেয়েটাকে সমেত ধরে এনে পুজো দেব।' তাই আনতেই হবে শ্রীমতী তুত্তুরীকে। ফোনটা রেখে, জানলার বাইরে ছুটে চলা আলোর শহর আর ছায়া মানুষ গুলোকে দেখতে দেখতে এই প্রথম উপলবব্ধি হল, চার বছর দশ মাস কাটানো শহর, থেকে তাহলে সত্যি সত্যিই এবার গোটাতে হবে পাততাড়ি।

Saturday 30 October 2021

অনির ডাইরি, ২২শে জুলাই ২০১৯ (এটিআই এর গপ্প)

 

(এটিআই এর গপ্প, দিবস-১)

পকেটের মধ্যে মোবাইলটা আছে, কিন্তু আর বার করতে ইচ্ছে করছে না। কত রাত হবে? খুব বেশী হলে রাত দশটা। অথচ মনে হচ্ছে মধ্যরাত। চতুর্দিক নিশুতি। সল্টলেক এটিআই এর সুবিশাল প্রান্তরে গুটি কয় টিমটিমে লালচে নিয়ন আলো তৈরি করছে কেমন যেন ধোঁয়াশা। মাইরি বলছি, পেটে মুশুর ডাল,রুটি, আলু ঢ্যাঁড়শের ঘ্যাঁট আর কাতলার পেটি ছাড়া কিচ্ছু পড়েনি কো। ঢ্যাঁড়শটায় কি মিশিয়েছিল কে জানে, আচারের মত টকটক। তিন বার নিলাম। কল্লোলদা আর রথীনদার খেতে আসতে দেরী হয়ে গিয়েছিল, পরিমাণে বোধহয় কম পড়ল। কল্লোলদা যদিও বলল,“ভাগ্ তো।”অঙ্কন আবার নিরামিষ। সকালে বেচারা শুধু ডাল ভাত আলুপটলকুমড়োর ছক্কা আর কাঁকড়োল ভাজা দিয়ে ভাত খেয়েছে। দেখিয়ে দেখিয়ে মুর্গীর ঠ্যাং চিবোতে হেব্বি দুঃখ হচ্ছিল মাইরি। ঝোলটাও এত ভাল করেছিল। চামচে করে খাচ্ছি দেখে, রথীনদা বলেই ফেলল,“অ তুই ও চামচ পার্টি। যা অয় টেবিলে বস গিয়া। ” যাই হোক, পরে শুনলাম অঙ্কন ওসব দেখেনি।অঙ্কন ওসব দেখে না। লাঞ্চের  পর পার্থদা হেব্বি পিছনে লাগল, “ডালটা যে খেলি, ওতে পেঁয়াজ রসুন নেই বলছিস?” রথীনদা ঢুলতে ঢুলতে বলল,“হঃ। ভাতেও রসুন দিয়াছিল। ” বেচারা অঙ্কন। বিকালে দু্টো আলুর চপ আর চা। সাড়ে আটটায় ডিনার দেবে। হজম হলে বাঁচি, করতে করতে তুহিন টপ করে একটা প্যান ফর্টি গিলে নিল। ক্লাশ শেষ হতে হতে ঘড়ির কাঁটা সাতটা পার। সুকন্যার কি শখ মাইরি, সাড়ে সাতটার পর গেল মাথা ধুতে। বাথরুমে নয় রে বাবা, পার্লারে।

 

মাকে ভিডিও কল করতে ব্যালকনিতে এসে দেখি,কি দম বন্ধ করা সাংঘাতিক পোড়া পোড়া গন্ধ। এতো তার পুড়ছে মনে হয়।আমার ঘরের এসিটা পুড়ছে না তো।  ফোন রেখে ঘরের দরজা খুলে দেখি করিডরেও তিতকুটে গন্ধ ম ম করছে। বারন্দার রেলিংএ ডিসপেনসারের ওপর ওল্টানো আছে ভারি জলের ড্রাম। ত্রিদিবেশদা নবেন্দুকে সাবধান করছে,“দেখিস উল্টে নীচে ফেলে দিস না যেন। ” কেয়ারটেকারকে ধরে আনা হল, কি যে দেখল কে জানে? গন্ধ তো কমেই না।  তুহিন,নবেন্দু আর আমি বিল্ডিং থেকে নেমে গিয়ে গোল গোল চক্কর কাটলাম বার কয়েক। এটিআইয়ের কোন গেটটা দিয়ে বেরিয়ে কোনটা দিয়ে ঢুকলাম, রীতিমত আলোআঁধারির গোলকধাঁধা। নটা নাগাদ সুকন্যা খবর আনল,বাইরে কোথাও আগুন লেগেছে। 

কখন খাওয়া মিটে গেছে। তুহিন,সুকন্যা, অঙ্কন,হীরা আর আমি ছাঁটাই করা সবুজ ঘাসের চাতালে পা ঝুলিয়ে বসেছি। মুর্শিদাবাদ আর দক্ষিণ ২৪পরগণা কাজের কথা শুরু করেছিল বটে, জলপাইগুড়ি,পুরুলিয়া আর হুগলীর, রণং দেহী মূর্তি দেখে ক্ষান্ত দিয়েছে। কাল করবে বলছে। কাল আবার সাতসকালে যোগাভ্যাস আছে। রথীনদা তিনবার বলল,“যোগায় হব না। তুই জিমে যা। ”নেহাৎ সিনিয়র। তাই ফোটো তো বলেই বাকিটা হজম করলাম। যা হবে দেখা যাবে কাল, আপাততঃ আমরা হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ছি। আপনাদের মধ্যে যে বা যাঁরা আজ বিষম খেয়েছেন, জানবেন এই পাঁচ মূর্তিই দায়ী। চুপি চুপি একটা কথা বলি, আমরা কেবল তাদের নিয়েই হাসাহাসি করছিলাম, যাদের আমরা ঘোরতর পছন্দ করি-


অনির ডাইরি ২৪শে জুলাই, ২০১৯

(এটিআই এর গপ্প, দিবস- ৪)

ক্লাশ শেষে কদম ইয়ে বাতাবি লেবু তলায়-

তৃতীয় দিনের উপান্তে। ভোর ছটায় অ্যালর্ম দিয়ে উঠে, রুমে রাখা কেটলিতে চা/কফি বানিয়ে, দু চুমুক টেনেই দৌড়।একটু দেরী হলেই দমাদ্দুম দরজা পেটায় আপদ গুলো।  হীরার, যে কি না ইমোশনাল ইনটেলিজেন্সের ক্লাশে পরিচয় দিল,“রিলাক্সিং হীরালাল” বলে, উৎসাহ সব থেকে বেশী। দাঁড়া বাপ, ঘরে চাবিটাতো লাগাতে দিবি। ল্যাপটপ-মোবাইল-মানি ব্যাগ সব ছড়িয়ে আছে, পুঁচকে স্টাডি টেবলে। বাতানুকূল যন্ত্রটাতো বন্ধ করতে হবে। যেটার দৌলতে বিগত দুরাত ভালো ঘুমই হয়নি। হয় কাঁপিয়ে মেরেছে নয়তো ঘামিয়ে ছেড়েছে। তারওপর তেনাদের ভয় তো আছেই। আতঙ্কে টিউবলাইট জ্বালিয়ে ঘুমিয়েছি। পাশের ঘরেই সুকন্যা, মাঝে মাঝেই প্রবল উদ্গত ইচ্ছা দরজা পেটানোর। কোন মতে দমন করেছি। যদিও সুকন্যা খোলাখুলি অনুমতি দিয়েই রেখেছে,ভয় পেলেই চলে যেতে। একই ডালের পাখি কি না, কেন যে আমরা ভূতের গল্প পড়ি বা সিনেমা দেখি কে জানে?


গুরুজী শ্রী বিন্দু চৈতন্য, সাড়ে ছটার আগেই চলে আসেন। নতুন হস্টেল থেকে বেরিয়ে, বকুল বীথি টপকে দূরে সাততলা নব্য বিল্ডিংএর তিনতলায় সুবিশাল বাতানুকূল ঘরে সাজানো আছে রঙবরঙের যোগা ম্যাট। সিনিয়র দাদারা বদমাশী করে সামনের ম্যাট গুলো ফাঁকা রাখেন। বাইরে জুতো খুলে দরজা ঠেলে ঢুকলেই, পার্থদা চিৎকার জোড়েন,‘এই আমি সাড়ে ছটায় এসেই অ্যাটেন্ডেন্স নিয়ে নিয়েছি। এত দেরী কেন?দেরী করেছিস। সামনে বস। ” ঠিক যেমন আমি আর সুকন্যা আমাদের জুনিয়র চেওয়াংকে বলি,“এই তুই সামনে যা। পিছন দিকের ম্যাটটা ছাড়। ” কে সামনে বসে মুর্গী হবে? গুরুজী এসেই শুরু করেন,“ সারি তানাও, সারে স্ট্রেস তো ভুল যাইয়ে। আপনি সারে মাসলস্ কো ঢিলা ছোড়িয়ে। কহি কোই দাবাও নেহি। কোন তানাও নেই।  ওম শান্তি। আঁখে বন্ধ করলিজিয়ে ” দুচোখ বন্ধ করে, কানে বাজে গুরুজীর মৃদুমন্দ সুরেলা কণ্ঠধ্বনি- পায়ের পেশী ঢিলা করুন। হাঁটু। কোমর। পিঠ। মুখের পেশী ঢিলা করুন। নিজেদের শ্বাস-প্রশ্বাসের ওপর ধ্যান দিন। চোখ খুলবেন না। একাগ্রচিত্তে শোনার চেষ্টা করুন,দূর থেকে ভেসে আসা সুক্ষ ধ্বনি। 


ধ্যান উপান্তে, একঘন্টা যোগ ব্যায়াম আর মিনিট পনেরোর প্রাণায়ামের পর ছুটি। গতকাল মাত্রাতিরিক্ত অনুপ্রাণিত হয়ে আমরা ঢুঁ মেরেছিলাম জিমে। ট্রেড মিলে সকাল সন্ধ্যা হাঁটা আর ক্লাশ শেষে বেশ কয়েকবার এটিআইয়ে চক্কর কাটার পরিণাম, গতকাল থেকে আর ঘুম ছাড়ছেই না। 


ঠিক সাড়ে আটটায় প্রাতঃরাশ সেরে, দৌড়তে হয়, যে যার ঘরে। স্নান টান করে ফুল বাবু সেজে দশটার মধ্যে ক্লাশে। আজ মিনিট দশেক দেরী হয়ে গিয়েছিল। যেখানে বাঘের ভয়,সেখানেই সন্ধ্যা হয়। বাইরেই টহল দিচ্ছিলেন কোর্স কোঅর্ডিনেটর স্বয়ং।  যেতেই ক্যাঁক করে পাকড়াও করল সুমিতাদি, দশ মিনিট লেট? দেখ আজ তোদের সবকিছুই পিছিয়ে যাবে। টানা সাড়ে পাঁচটা অবধি ক্লাশ,মাঝে দুবার চা আর একবার লাঞ্চের বিরতির পর, শেষ বিকালে প্রজাপিতা ব্রহ্মকুমারীরা যখন স্ট্রেস ম্যানেজ করার কলাকৌশল শিখিয়ে বিদায় নিলেন, কতজনের হৃদয়ে যে ডানা মেলছিল প্রজাপতির দঙ্গল। বাইরের খোলা হাওয়া, আর ইতিউতি জটলা পাকিয়ে আড্ডাটাই তখন অক্সিজেন। বিগত তিন দিন ভেঙে গড়ে দিয়েছে অনেক বরফের প্রাচীর। সিনিয়র-জুনিয়র বিভেদ ভেঙেচুরে তাই তো আমরা প্রবল চিৎকার জুড়ি,“ও রথীনদা। কোথা যাও? নবা, ক্লাশ শেষ বাপ। এবার হোস্টেলে ফের। কোথা যাস?হোস্টেলের পথ ওটা নয়।” তুহীন ছবিগুলো তুলে দিল বটে, ক্যামেরার সামনে দাঁড়াতে সম্মত হলনা। তিনদিন একই জামা পরে কেউ ছবি তোলে নাকি?

Tuesday 26 October 2021

অনির ডাইরি ২৬শে অক্টোবর, ২০২১

 অনির ডাইরি ২৬শে অক্টোবর, ২০২১


‘নমস্কার, আমি প্রদীপ ব্যানার্জী বলছি, INTTUC থেকে-’ জনৈক বৃদ্ধের গমগমে কণ্ঠস্বর ভেসে এল মুঠো ফোনের ওপার হতে। ‘শুনলাম আপনার ট্রেন অবরোধে আটকে আছে, আমরা অপেক্ষা করছি, আপনার জন্য-’।  


সেই সকাল সাড়ে নটা থেকে আটকে আছে আমার ট্রেন, এখন পাক্কা সাড়ে এগারো। সহযাত্রী শিক্ষিকাদের মুঠোফোনে ভেসে আসা ছুটকোছাটকা খবর জানিয়ে যাচ্ছে পরিস্থিতি বেশ জটিল। জব্বর হাঙ্গামা বেঁধেছে সোদপুর স্টেশনে। হাতাহাতি-লাথালাথি-পেটাপিটি সবই চলছে, চলছে না শুধু হতভাগা ট্রেনটা। সাড়ে এগারোটা থেকেই ডেকেছিলাম মিটিংটা। কখন পৌঁছাব কে জানে?


সাল ২০১৭। মাসটা বোধহয় জুলাই বা আগস্ট।কামরার বাইরে চোখ ঝলসানো রোদ। আর ভিতরে বইছে ঘামের বন্যা। তেমনি দমচাপা ভিড়। আপদের দল, অবরোধকারীগুলোর জন্য মানসম্মান আর রইল না। এমনিতেই আমার কাছে মিটিং করায় আপত্তি ছিল ওদের, বরাবরই এই মিটিং নাকি চন্দননগর আপিসে হয়। আমার স্তরে নয়, বড় সাহেবের টেবিলে হয় ওদের যাবতীয় বিবাদের মিমাংসা। এটাই নাকি এখানকার দস্তুর, আমার আপিসের কাজ শুধু ফাইলটা তোলা। আর এখানেই ঘোর আপত্তি আমার। আমার এলাকার সামান্যতম সমস্যা নিয়ে কেন সবকথায় ওপরওয়ালাকে বিব্রত করব? চেষ্টা তো করে দেখি, নাহলে তো বড় সাহেব আছেনই। মিটিং ডাকার দিনই শুনেছিলাম,জনৈক প্রদীপ বাবু আসবেন নাকি মিটিং করতে, সেই ভদ্রলোকই ফোন করেছিলেন একটু আগে। 


আপিস ঢুকতে সাড়ে বারোটা পার, ঢুকে দেখি চেম্বারের বাইরে বা বলা যেতে পারে, বুড়ো কালেক্টরেটের বারন্দায় পেতে রাখা চেয়ারে শ্রমিক পরিবৃত হয়ে বসে আছেন জনৈক কৃশকায় বৃদ্ধ। টকটকে ফর্সা রঙ, রোদে পুড়ে তামাটে, প্রশস্ত কপাল, খড়্গনাসা। পরনে খদ্দরের পাঞ্জাবি-পায়জামা, কাঁধে শান্তিনিকেতনী ঝোলা ব্যাগ। একেবারে যেন নমকহালাল সিনেমার ডাকসাইটে ট্রেড ইউনিয়ন নেতা। 


মিটিং শুরু হতেই বুঝলাম, চেহারা যতই সিড়িঙ্গে হোক, বৃদ্ধের দাপট প্রবল। হাতে অদৃশ্য ছড়ি নিয়ে ঘোরেন বৃদ্ধ, যা সমানতালে বর্ষিত হয় কখনও মালিকপক্ষ, কখনও বা শ্রমিকপক্ষের মাথায়। উনিই বিচারক, উনিই জুরি এবং উনিই ফাঁসুড়ে। আর একটা জিনিস প্রত্যক্ষ করলাম, আমার মাথার ওপর ছড়ি মারার বা ছড়ি ঘোরানোর কোন চেষ্টা করলেন না। বরং আমার মতামত যথোচিত গুরুত্ব সহকারে শুনলেন এবং ক্ষেত্র বিশেষে মেনেও নিলেন। 


মিটিং চলাকালীনই বুঝতে বাকি রইল না যে, এই বিবাদ মিটলে আমার ঘরেই মিটবে। সময় হয়তো লাগবে, তবে মিটে যাবে। সে তো সব শ্রমিক বিক্ষোভ মিটতেই সময় লাগে। মিটিং শেষের চায়ের সাথে টুকটাক খেজুরে গল্প হল, দেখলাম উনি আমাদের দপ্তর সম্পর্কে সম্পূর্ণ ওয়াকিবহাল। দপ্তর মানে আমার ক্ষুদ্র চুঁচুড়া নয়, সমগ্র শ্রম কমিশনারেট সম্পর্কেই উনি সচেতন। অনেক সিনিয়র স্যার/ম্যাডামদের উনি নামে চেনেন এবং নাম ধরে ডাকেন। নাঃ নেতাসুলভ তাচ্ছিল্য নয়, বরং সহকর্মী সুলভ অধিকারবোধ থেকে নাম করছেন উনি, শুনতে শুনতে ভির্মি খেলাম,সর্বনাশ ইনি কি আমাদের অসংগঠিত শ্রমিক কল্যাণ পর্ষদের চেয়ারম্যান প্রদীপ ব্যানার্জী নাকি? যাঁর বোর্ডের টাকায় আমাদের এত রমরমা? প্রতিবছর মেলার কার্ডে ছাপা হয় যাঁর নাম। তাহলে তো তাঁর মর্যাদা যে কোন রাষ্ট্র মন্ত্রীর সমতুল। অন্য এক বোর্ডের চেয়ারম্যান বিগত মেলায় খুব ক্ষুণ্ণ হয়েছিলেন, কার্ডে ওণার নাম স্থানীয় বিধায়কের নামে নীচে লেখাতে।


 ইনি যদি সত্যিই সেই প্রদীপ ব্যানার্জী হন, তাহলে তো এণার যথোপযুক্ত  খাতির করিনি আমি। কথাটা বলাতে দেখলাম প্রভূত আমোদিত হলেন বৃদ্ধ। সেই শুরু, এরপরও বিগত বছর পাঁচেকে অগণিত বার এসেছেন বৃদ্ধ, মিটিং শেষে বসেছে জমাটি আড্ডা। শুনিয়েছেন নকশাল জীবনের কথা, যথার্থই তৃণমূল স্তর থেকে শ্রমিক রাজনীতি করে আসছেন ভদ্রলোক। প্রথম জীবনে এয়ারফোর্সে পাইলটের চাকরী পেয়েও ছেড়ে দেন। জানিয়েছেন আগুনে সত্তরের অত্যাচার কি ভাবে ভেঙেছে ওণার স্বাস্থ্য। কিছুদিন আগেও নাকমুখ দিয়ে রক্ত বেরিয়েছে, ডাক্তার বলেছেন বিশ্রাম নিতে, নেননি উনি। শোনেননি কারো কথা। শুধু নিজ স্ত্রীকে সামান্য ভয় পান বৃদ্ধ। সে আর কে না পায়?


 ২০২০র  লকডাউন সবে আংশিক উঠেছে, দীর্ঘদিন বন্ধ থাকা বয়লার পরিষ্কার করতে গিয়ে মারা গেল এক শ্রমিক, আহত জনা চার।কারখানার গেটে ঝুলল বিশাল তালা। প্রদীপ বাবুর উপস্থিতিতে আমার চেম্বারে ঘন্টার পর ঘন্টা চলল মিটিং, বয়লার আধিকারিককে দিয়ে চেক করিয়ে, বয়লার সারিয়ে, পুলিশ তথা জেলা প্রশাসনের অনুমতি নিয়ে, ভীত ক্ষুব্ধ শ্রমিকদের বুঝিয়ে, মালিককে চমকে, মৃতের পরিবারকে মোটা অঙ্কের ক্ষতিপূরণ, আহতদের চিকিৎসার যাবতীয় ব্যয়ভার এবং ক্ষতিপূরণ, পদোন্নতির ব্যবস্থা করিয়ে খোলা হল সেই কোম্পানি। একাই বল-ব্যাট-ফিল্ডিং করে গেলেন প্রদীপ বাবু। মাঝে মাঝে মুখখোলা ছাড়া কিছু করতেই হল না আমায়- 


কারখানা খোলার মিষ্টি দিতে আসার সাথে সাথে নতুন দাবী সনদ দিয়ে গেল শ্রমিকপক্ষ। আমার ঘরে স্বাক্ষর হওয়া সেই দাবীপত্রের পূর্ণ হয়েছে তিনটি বৎসর। এবার নতুন চার্টার অব ডিমান্ডের পালা। ভাবলাম এ আর এমন কি কথা, প্রদীপ বাবু আছেন তো। বললামও সে কথা। উনি জানালেন, ‘দাঁড়ান আগে নির্বাচনটা মিটতে দিন।’ শুনলাম বেশ কয়েকটা গুরুত্বপূর্ণ জেলায় প্রচারের দায়িত্ব পড়েছে ওণার। বেশ তাই হোক। 


নির্বাচন মিটল,ক্ষমতায় ফিরল ওণার দল। শুধু ফিরলেন না প্রদীপ বাবু। রাতারাতি শেষ হয়ে গেল সব। হাহাকার ভরা সুরে ফোন করে শ্রমিক থেকে মালিকপক্ষ, ‘শুনেছেন ম্যাডাম। আমাদের প্রদীপ বাবু চলে গেলেন’। 


দিন যায়, সপ্তাহ গড়ায়। শৌভিকের বদলীর খবর আসে, আমাদের পুরাতন বদলীর নির্দেশনামা বাতিল হয়ে নতুন অর্ডার মক্সো হয়। বন্দরের কাল হয়ে আসে শেষ। এমন সময় এসে হাজির হয় গুটি কয়েক শ্রমিক, ‘যাবার আগে আমাদের কেসটা মিটিয়ে দিয়ে যান ম্যাডাম।’ ফোন করেন মালিকও,‘শুনলাম আপনিও চলে যাবেন। প্রদীপবাবুও নেই। একটু ঝামেলাটা মিটিয়ে দিয়ে যান ম্যাডাম-’। 


বেশ বসলাম ঝামেলা মেটাতে। গড়ালো আলোচনা,হল তর্কবিবাদ। শুনতে শুনতে, বকতে-বকতে বারবার চোখ চলে যাচ্ছিল আমার পাশে রাখা তোয়ালে ঢাকা ফাঁকা চেয়ারটায়। প্রদীপ বাবুর ঢঙে ছড়ি ঘোরানো, ছড়ি পেটানোর চেষ্টা করলাম, বার তিনেক হুমকিও দিলাম, ‘সবকটাকে দূর করে দেব আমার চেম্বার থেকে। ’ একটা কথাও শুনল না কেউ।  উল্টে জনৈক রগচটা শ্রমিক, ৩২পাটি দেখিয়ে বলল, ‘বের করে দিলেও যাব নাকো। এই আপনার ঘরের বাইরেই বসে থাকব। ’ 


যাই হোক, শেষ পর্যন্ত প্রদীপ বাবুর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধাবনত হয়ে, এবারেও মীমাংসা হল আমার টেবিলেই। সাক্ষরিত হল ত্রিপাক্ষিক চুক্তিপত্র। যা বলবৎ থাকবে আগামী তিনটি বছর।  শতকরা ১১শতাংশ হারে মাইনে বাড়ল সবার, এরওপর আরও ৮৫০টাকা করে মাইনে বাড়বে প্রতিবছর, পরবর্তী দাবীসনদ না পেশ করা পর্যন্ত। বাড়িভাড়া ভাতা বাড়ল শতকরা ২ শতাংশ হারে।  ক্যাজুয়াল কর্মীদের একাংশকে পার্মানেন্ট করার লিখিত প্রতিশ্রুতিও দিল মালিকপক্ষ। আজ চুঁচুড়া ছেড়ে যাবার আগের দিন, প্রদীপবাবুর নিজের হাতে বানানো, দাবীসনদ, কার্যকর করার মাধ্যমেই আমরা শ্রদ্ধা জানালাম ওণার স্মৃতির প্রতি। যেখানেই থাকুন, ভালো থাকুন প্রদীপবাবু। শ্রম দপ্তরের দীর্ঘ পনেরো বছরের চাকরী জীবনে আপনার মত নেতা আমি দ্বিতীয় কাউকে পাইনি।

Friday 22 October 2021

অনির ডাইরি ৫ই অক্টোবর,১৯৯২

 

‘তোমরা সবাই পান্তা খাবে, আর আমার জন্য লুচি?’ যাকে প্রশ্নটা করল ঝুমি, তাঁর পরণে সাদা থান, মাথায় ঘোমটা, আর মুখে একগাল অমায়িক হাসি।পুরী লেখা অ্যালুমিনিয়ামের হাঁড়িতে গতরাত থেকে ভেজানো আছে লাল চালের ভাত। সামান্য ঝাঁঝালো গন্ধ বেরোচ্ছে নির্ঘাত আজ তা থেকে। খেলে দারুণ ভালো ঘুম হয় বলে শুনেছি। গাঁয়ের লোক এমন এক থাল ভাত খেয়ে বেরিয়ে পড়ে মাঠে চাষ করতে বা চাষবাসের তত্ত্বাবধান করতে। এখুনি অ্যালুমিনিয়ামের শানকিগুলোতে ভাগাভাগি হয়ে যাবে জল সমেত অমৃত। তার সাথে মিশবে ঝাঁঝালো গন্ধওয়ালা ঘানিভাঙা সর্ষের তেল, আধখানা বা চারটুকরো করা পেঁয়াজ, মটমটে কাঁচালঙ্কা। নিকানো উঠোনের তুলসী তলায় হয়ে আছে পুঁচকে লঙ্কা গাছ, লাল সবুজ একরাশ লঙ্কার চাপে নুয়ে পড়েছেন তিনি। তার থেকে ভেঙে অানা হবে দুচারটে। মিশবে খেতের ছোলা ভাঙানো ছাতু, ঘরে ভাজা আউশ চালের মুড়ি। আর মিশবে নরম নরম মুসুর ডালের বড়া। ছোট ছোট দানার আধকুটো করা ঘরের খেতের ডাল, জলে ভিজিয়ে রাখা আছে, উনুন পাড়ে শিল পেতে বাটা হবে। একটু জলজলে করে বেটে তার সাথে পেঁয়াজ, লঙ্কাকুচি মিশিয়ে চাপড়া করে ঢেলে দেওয়া হবে গরম তেলে। পুড়তে থাকা পাটকাঠির ধিকি ধিকি আগুনে লোহার কড়ায় ভাজা সে বড়ার সোয়াদ আর গন্ধ অতুলনীয়। ওপরটা মুচমুচে আর ভিতরটা নরম তুলতুলে। 


এইসব মিশিয়ে যে সুখাদ্যটি প্রস্তুত হবে তাই দিয়েই প্রাতঃরাশ সারবে এই বাড়ির ছেলেমেয়েরা। শুধু কলকাতা থেকে আগত জামাই আর নাতিনাতনীদের জন্যই তৈরী হয়েছে ফুলকো লুচি আর আলুর তরকারী। সাথে গঙ্গাপাড়ের নারান দাসের দোকানের রসগোল্লা। মনখারাপ করে বারান্দায় এসে বসলাম। বারান্দা নামে পরিচিত হলেও আসলে দাওয়া বা রোয়াক। দোতলা মাটির বাড়ির বাইরের দিকের দাওয়াটাকে এরা বলে বারান্দা। বারান্দায় এসে বসলেই মনটা ভালো হয়ে যায়, বারন্দার একদিকে দাঁড়িয়ে আছে দুটো নারকেল গাছ। ফি বছর ঝড়ে তাঁরা টালি ভাঙেন। 


অপরদিকে বিশাল বাগান। বাগান ভর্তি কত যে গাছ, সব দিদার নিজের হাতে লাগানো। মুর্শিদাবাদের উর্বর মাটিতে বড় জলদি বাড়ে গাছপালা। মস্ত পিটুলি গাছটা ডালপালা ছড়িয়ে উঠে গেছে প্রায় চারতলা বাড়ির সমান, পাশেই একখান সজনে ডাঁটার গাছ, বেঁটে বেঁটে গোটা কয়েক নারকেল গাছ, সুবিশাল একটা জাম গাছ, যা হয়তো লম্বায় আর কিছুদিনের মধ্যেই ছাড়িয়ে যাবে পিটুলি গাছটাকে। তবে আড়ে পিটুলি গাছটাকে ধরতে লাগবে আরো অনেকদিন। হনুমানদের আড্ডাখানা এই গাছটা। পাকা জামের লোভে আসেন তেনারা। জাম খান আর বীজগুলো ছুঁড়ে ছুঁড়ে ফেলেন দিদার বাগানে। এছাড়াও আছে কাগজি লেবুর গাছ, অনেকগুলো পেঁপে গাছ,হলুদ কল্কে আর সাদা টগর ফুলের গাছ আর বাগানের সীমানা বরাবর বাসক ফুলের গাছ।


 বাসক ফুল ফোটে ঝুড়িঝুড়ি, কে যেন শিখিয়েছিল সম্ভবতঃ মায়ের কোন তুতো বোন, ফুটে থাকা বাসক ফুল তুলে, সবুজ বৃতিটা ছিঁড়ে ফেলে দলমণ্ডলের পিছনের অংশটা মুখে পুরে সুড়ুৎ করে টানলেই মুখ ভরে যায় মিষ্টি বাসক ফুলের মধুতে। ওটা যে মধু নয় মকরন্দ বা নেক্টার তা শিখতে তখনও বাকি অনেকদিন। কল্কে ফুলের মকরন্দও দারুণ খেতে তবে লাল পিঁপড়েদের সাথে লড়াই করে উদ্ধার করতে হয় তা। গাছ থেকে ঝড়ে পড়া কল্কে ফুলের মকরন্দ চুষতে গিয়ে একে তো লাল পিঁপড়ের কামড়ে ঠোঁট ফুলিয়েছি তারওপর উদোম কানমলা খেয়েছি বড়দার কাছে। একটাই ভালো কথা যে রামনগরে এসে মা কিছু বলে না, সারাদিন কি করছি, কি খাচ্ছি, কার সাথে কোথায় যে ঘুরছি হদিশই রাখে না মা। বছর ঘুরলে একবার বাপের বাড়ি আসে কি না, চুটিয়ে উপভোগ করে, রন্ধ্রে রন্ধ্রে ভরে নেয় গ্রামবাংলার যাবতীয় রূপরস গন্ধ। 


এবছর বড়দা ছাড়া বাকি দাদারা কেউ আসেনি। ফলে পুজোটা বেশ নিস্তরঙ্গ কাটছে আমার। গল্প করার, খুনসুটি করার, হাতাহাতি করার কেউ নেই। বড়রা ব্যস্ত তাদের জগতে। শহরের পুজো আর জাঁকজমক ফেলে এই নিবান্দা নিস্তব্ধপুরীতে আসতে কারো ভালো লাগে? তারওপর এরা আমায় পান্তাও খেতে দেয় না। শুকনো মুখে লুচি চিবাচ্ছি, গায়ে একটা নরম স্পর্শ হয়ে লাগল, নাকে তামুক পাতার হাল্কা সৌরভ। একটা ছোট বাটিতে চাট্টি মুড়ি নিয়ে এসেছে দিদা, ভুলে গিয়েছিলাম দিদা তো পান্তা খাবে না। কায়স্থ বাড়ির বিধবা বড়গিন্নী, নিরামিষাশী তো বটেই ভাতও দিনে একবেলা কেবল খায় দিদা। মায়ের মুখে শোনা, কোনদিনই তেমন আমিশাষী ছিল না দিদা, তবে পেঁয়াজ খেতে বড় ভালোবাসত। ভাতের সাথে একটুকরো পেঁয়াজ থাকলেই খাওয়া হয়ে যেত দিদার। ছোটদাটা ঠিক দিদার মতই হয়েছে, সকাল বিকেল একটুকরো পেঁয়াজ চাইই ওর। মাঝে প্রোটিনের অভাবে ঘোরতর অসুস্থ হয়ে পড়েছিল দিদা, মরেই যেত যদি না ডাক্তারের পরামর্শে প্রোটিনেক্স খাওয়ানো হত। দিদার মশলার আলমারি ভর্তি নতুন পুরাতন এমনকি মরচে ধরে যাওয়া প্রোটিনেক্সের টিন। যে জিনিসটা দুধে গুললে এমন অমৃত,সেটা একবার লুকিয়ে কাঁচা খেতে গিয়েছিলাম আমি। কি তেঁতো, বাপস্।  উচ্ছে করলাও ওর থেকে কম তেঁতো হয়। 


আমি লুচি খাচ্ছি, পাশে বসে মুড়ি চিবোচ্ছে দিদা, মাঝে মাঝে বলছে, ‘চাট্টি মুড়ি খাবে? ও ঝুমি? খাও না? ’ দিদারা বোধহয় এমনিই হয়। এত ভালো,এমন মিষ্টি, নরম তুলোর বলের মত-- শুধু বড্ড তাড়াতাড়ি হারিয়ে যায় আর যাবার সময় রেখে যায় একরাশ দমচাপা কষ্ট, আর উপলব্ধি, ‘আর কেউ কখনও এমন ভালোবাসবে না। আর কেউ কখনও কেউ এমন রসোগোল্লার রসে চুবিয়ে ডাকবে না, 'ঝুমি'।


 দাও তোমার থেকে একগাল মুড়িই খাই দিদা, তবে দুটো শর্ত আছে তোমাকেও কিন্তু আমার থেকে দু-একটা লুচি খেতে হবে।তারজন্য অম্বল বাঁধালে বা এঁটো খাইয়েছি বলে মা এসে চিৎকার করলে বা ঠ্যাঙাতে এলে বাঁচাতেও হবে তোমায়। আর হ্যাঁ আরো অনেকদিন থাকতে হবে আমার সাথে-  অনেএএএএএএএএএএক অনেএএএএএএএএএক দিন। ইলেক্ট্রিকের তারে বসা ফিঙের মত ফুড়ুৎ করে পালিয়ে যেও না যেন- প্লিজ।

Thursday 21 October 2021

অনির পুজোর ডাইরি ১৩ই অক্টোবর, ২০২১

 

শুভ অষ্টমী


সবার রঙবেরঙের ছবির পাশে বড়ই সাটামাটা, বড়ই ম্যাড়মেড়ে এবছর আমার অষ্টমী। নাঃ আমি অঞ্জলি দিইনি। আনন্দময়ীর ওপর অভিমান করেছিলাম যে, এমন দিনে যদি ঘরের লোকটা হাসপাতালে শুয়ে থাকে, কার মন ভালো থাকে? আমার জীবনের দুই পুরুষের একজন আজ নয় দিন ধরে বন্দী হাসপাতালে আর অপরজন জড়িয়ে আছে 'তোমার ছুটি, আমার নয়' মার্কা দপ্তরী কর্তব্যের ফাঁকফোকরে। একাহাতে দশদিক সামলাতে গিয়ে রীতিমত বেরিয়ে আসছে জিভ, অকারণেই ছলছলিয়ে উঠছে আঁখি আর সপ্তমে চড়ছে মেজাজ।


সবথেকে বেশী দুঃখ হচ্ছে আমার মেয়েটার জন্য, সারা বছর এই কটা দিনের দিকে তাকিয়ে বসে থাকে মেয়েটা। আর এবছর এমন নাকানিচোবানি খাওয়াচ্ছে জীবন আমায়,যে দুটো ঠাকুরও দেখাতে পারিনি মেয়েটাকে। ঠাকুর দেখা বলতে, বাড়ি থেকে হাসপাতাল যাবার পথে যেকটা পড়ে অথবা হাসপাতাল থেকে বাজার যাবার পথে যাঁদের অধিষ্ঠান। ঐ আর কি-


তাই বলে কি ভাবছেন, ঠাকুর দেখতে পায়নি, শ্রীমতী তুত্তুরী। ভুল ভাবছেন মশাই। তুত্তুরীর বড়মামা আছে না। ষষ্ঠীর বিকেলে বুল্লু বাবু সমেত তুত্তুরীকে নিয়ে দেখিয়ে এনেছে হাওড়ার যাবতীয় ঠাকুর। শুধু হাওড়া নয়, সপ্তমীর দিন তো তিন মুণ্ডু এক হয়ে পাড়ি দিয়েছিল উত্তর কলিকাতা। শৈশবের মহম্মদ আলি পার্ক হয়ে কলেজ স্কোয়ার আরোও কত কি। এমন কি কফি হাউসেও ঢুঁ মেরেছিল তিন জনে। কফি হাউসের কাটলেট আর কোল্ড কফির ছবি সেবন রত তিন মূর্তির নিজস্বী এখনও ভাস্বর আমার মুঠো ফোনে।


বাবার জন্য, আমার থেকেও বেশী যাদের মন উতলা, তাঁরা হলেন আমার মা আর পিসি। একটাও নতুন পোশাক ভাঙেনি ওরা এবার। পিসির আদরের তিন ভাইয়ের মধ্যে অবশিষ্ট আছে শুধু বাবা, পিসি বলে, ‘আমার শিবরাত্রির সলতে। ’ আর মায়ের তো গোটা জীবনটাই আবর্তিত হয় বাবাকে ঘিরে। যখনই এককাট্টা হয় দুই বৃদ্ধা, বয়ে যায় বিলাপের নদী। আবার কখনও দেখি, উভয়কে ঘিরে বয়ে যাচ্ছে অখণ্ড নীরবতার হিমবাহ। থেকে থেকে উপচে ওঠে দুজনেরই আঁখি। ভিজে যায় আটপৌড়ে শাড়ির বিবর্ণ আঁচল। 


 আজ সকালটাও এমনি কাটছিল। হয়তো সারাদিনটাই এমনি কুয়াশাঘণ কেটে যেত, যদি না  জবরদস্তি দুটো শাড়ি ভাঙাতাম আমি।  বাবার জীবনের প্রিয়তমা দুই নারী যদি বাঙালীর জীবনের শ্রেষ্ঠ উৎসবের দিনে এমনি রঙচটা বিবর্ণ পোশাকে, আলুথালু চুলে অধোবদনে বসে থাকে বাবার ভালো লাগবে কি? রীতিমত সেন্টু দিয়ে, সাজিয়ে গুজিয়ে ছবি তুলে, মুঠো ফোন বন্দি করে নিয়ে গেলাম বৃদ্ধের কাছে। কাঁপা হাতে, ফোনটা ধরে ছবি গুলো দেখতে দেখতে কি জানি কি রোদ্দুর আর মেঘের লুকোচুরি চলছিল বৃদ্ধের হৃদয়ে, কে জানে কেমন লাগছিল বাবার, তবে ফিরে আসার সময়, অন্যদিনের মত,‘তোদের পুজোটা আমিই বরবাদ করে দিলাম,’ এই আক্ষেপটা আর আজ শুনতে হয়নি। মহাষ্টমীর দিনে এটাই বা কম পাওয়া কি?

 অনির ডাইরি ৪ঠা অক্টোবর, ২০২১

সময় রাত দশটা


কবে থেকে ঘন্টা গুনছি আমরা। আর মাত্র বাইশ ঘন্টা পর বাড়ি ফিরবে শৌভিক। ঘুম ভাঙা ভোরে, সোনালী রোদের চাদর মুড়ি দিয়ে মাংস কিনে এনেছি আমি, আজ রাতে তিনি টক দই আর বিরিয়ানি মশলা মেখে জারিত হোন হিম আলমারিতে, কাল সকালে আপিস যাবার আগে, সামান্য কষে বেরোব। একটু দেরীতে ঢুকব আপিসে, বড়দিকে বলেই রেখেছি, যেতামই না ব্যাটা, যদি না একখান বোনাসের ডিসপিউট টেবিল থেকে প্যাঁট প্যাঁট করে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে না থাকত, আর কিছু বিল ছাড়ার জন্য কৌশিক আর শুভজিৎ ঝুলোঝুলি না করত।  

গোটা পুজোটা অনেক আগে থেকেই প্ল্যান করে রেখেছি আমরা। প্রতিপদের সকালেই শৌভিকের সাথে তমলুক রওণা দেব আমি। দ্বিতীয়াটা ওখান থেকেই যাতায়াত করে নেব, তৃতীয়া প্রভাতে এসে হাজির হবে একদল পরমপ্রিয় সুহৃদ। চতুর্থীর দুপুরে তাদের ট্রেনে তুলে দিয়ে,পঞ্চমীর সন্ধ্যায় মহকুমার শাসকের সাথে গুটি কয়েক পুজোর উদ্বোধনের সাক্ষী হতে যাব আমরা। বাবা পুজো উদ্বোধন করবে, জানার পর থেকে তুত্তুরীর পা আর মাটিতে পড়ছে কই? প্রথমে ঠিক ছিল সপ্তমীর সকালে হাওড়া ফিরব আমরা, উদ্দেশ্য অষ্টমীর অঞ্জলি দেওয়া। পরিকল্পনা সামান্য পাল্টে ষষ্ঠীতেই হাওড়া ফিরব আমরা মা আর মেয়ে। সৌজন্য আমার পিসির অন্তহীন বিলাপ, খুড়তুতো ভাইদের তথা ভাইবউয়ের অনুরোধ উপরোধ আর আমার স্কুলের বন্ধুদের নিরন্তর খিস্তিখেউড়। ‘কি রে শালা, পুজোয় একটা সন্ধ্যাও আমাদের সাথে কাটাবি না? এত বছর তো কাটালি বরের সাথে, এত আঠা কিসের?’ 


ষষ্ঠীর সন্ধ্যা হালদার পাড়ার পুজামণ্ডপে জমিয়ে আড্ডা,সপ্তমীতে পায়ে হেঁটে হাওড়ার ঠাকুর দেখা, সুকন্যা যদি তখনও কলকাতায় থাকে তাহলে উত্তর কলকাতাতেও ঘোরা যায়। উটোবাবুর অনেকদিনের শখ, অনি মাসি আর তু্ত্তুরীর সাথে ঠাকুর দেখবে-। ফেরার পথে অষ্টমীর আট ফল,ঠাকুরের শাড়ি, শিব ঠাকুরের ধুতি, সিঁদুর, আলতা, ধূপ, চন্দ্রপুলি ইত্যাদি কিনে আনা। অষ্টমীর সকালে অঞ্জলি দিয়ে, লুচি আর  ছোলার ডাল খেয়ে এসডিও সাহেবের গাড়িতে চেপে আবার তমলুক ফিরে যাওয়া। নবমীর সকালে আসবে পিসিমণি আর পিসেমশাই, যতই কুমড়োর ঘ্যাঁট আর উচ্ছেচচ্চড়ি খাওয়া ভেতো বাঙালী হোক, শিরায় তো বইছে রাজপুত খুন। তার জন্য তেহরী রান্না শিখলাম আমি, প্রভাতীর থেকে রসুনের আর আমের আচার কিনলাম আমি। আহাঃ ছাতুর পরোটা আর আচার না খাইয়ে ছাড়ব নাকি? ফোনে সেটা শুনিয়েও দিয়েছি পিসশ্বশুরকে। তিনি যদিও প্রবল আপত্তি জানিয়ে রেখেছেন, ‘ওরে আমি আচার খাই না রে-’। ওসব বললে হবে? ভট্টাচার্য বাড়ির সোনার টুকরো জামাতা, তার খাতির না করলে পোষায়? 


দশমীতে ওণারা ফিরে যাবেন, দ্বাদশীর দিন বেরিয়ে ছোট্ট করে কোথাও ঘুরে আসব আমরা। জেলাশাসকের অনুমতি নিয়ে বুকিংও করে ফেলেছে শৌভিক।লক্ষ্মীপুজোর পরদিন আবার ফিরে আসব তাম্রলিপ্ত। 


 বাড়ি ফেরার বাইশ ঘন্টা আগে দাম্পত্যালাপের ফাঁকে, গোটা পুজোপরিকল্পনা আওড়াতে আওড়াতে ক্লান্ত হয়ে পড়লাম দোঁহে। কি ব্যস্ততায় কাটবে রে ভাই আমাদের পুজোটা। অবকাশের কোন গল্পই নেই, এই পুজোয়। ফোন রেখে, বিছানার ওপর পাতা ভারি বেড কভারটা তুলতে তুলতে তুত্তুরীকে শুধাই, দাদু-মামমাম(দিদা)র সাথে কথা হয়েছে কি না? আপন খেয়ালে বকবক করতে করতে অপ্রস্তুত হয়ে জবাব দেয় তুত্তুরী, আজ সারাদিনে একটি বারও ফোন করার সময় পাননি নাকি তিনি। এরপরের ঝাড়টা না হয় উহ্যই থাকুক সোশ্যাল মিডিয়ায়। অত্যন্ত পরিশীলিত ভাষায় বললে বলতে হয়, সেন্টুর নদী বয়ে গেল আমাদের তিন কামরার ফ্ল্যাটে। কি সাংঘাতিক আত্মকেন্দ্রিক হয়ে গেছিস তুই তু্ত্তুরী, যে মানুষ দুটো বুকে করে মানুষ করল,তাদের জন্য সারাদিনে মাত্র দশটা মিনিট দিতে পারো না তুমি?কাল যদি না থাকেন তাঁরা, কি বলবে নিজেকে তুত্তুরী-।


প্রবল ঝাড়ের মুখে উড়ে যাওয়া খড়কুটোর মত ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে দাদুকে ফোন করল তুত্তুরী, ‘হ্যালো দাদু, সরি আজ ফোন করিনি। মা খুব বকছে। তুমি যেন দুঃখ পেও না--’। অন্যদিন এই ইমোশনাল ন্যাকামো আরো অনেকক্ষণ চলে, ফোনের ওপার থেকে সেন্টুর নদী বইয়ে দেয় দাদুও। কিন্তু আজ যেন কোথাও তাল কেটে গেল দাদু আর তার সোনার তুত্তুরীর আবেগপূর্ণ সংলাপের। পাশের ঘরে গিয়েছিলাম কি যেন আনতে, ছুটতে ছুটতে ফোনটা এনে আমার হাতে ধরিয়ে দিল তুত্তুরী। ‘মা দাদু আর কথা বলতে চাইছে না। বলছে দাদুর খুব শরীর খারাপ।’ 


মায়ের শরীর তথা মন বিগড়ানো আমার নৈমিত্তিক সমস্যা। কিন্তু বাবার তো কিছু হয় না সাধারণত। কি আবার হল? শুনলাম পেট ব্যথা। রীতিমত বেদনায় চিঁচিঁ করছে বাবা। জানাল কাজের মাসিকে দিয়ে ডিকোলিক আনিয়ে খেয়েছে বাবা। তাতেও কমেনি। বসার ঘর থেকে ভেসে আসছে দুই খুড়তুতো ভাই, ভাই বউ, ভাইপো, পিসির উত্তেজিত সংলাপ। চলছে  পেটে তেল জল দেবার পর্ব। বড়ভাই শ্রীমান অয়ন ফোনটা কেড়ে নিয়ে জানাল, আরো দুটো ওষুধ খাওয়ানো হবে বাবাকে। তারপর দরকার হলে কাল কাউকে ডেকে হবে অ্যানিমা দেওয়া। ‘আরেঃ তুই চিন্তা করিস না। বড়দাদার মাঝে মাঝে হত না,কোষ্ঠকাঠিন্য। তেমনি হয়েছে মনে হয়। পেটটা ফুলেও আছে। কালকের মধ্যে ঠিক হয়ে যাবে। ’বড়দাদা অর্থাৎ স্বর্গীয় বড়জেঠু আর তাঁর কোষ্ঠ সাফ না হওয়া নিয়ে বানানো যায় পিকুর মত গুটি পাঁচেক সিনেমা। শেষের দিকে জেঠু আর জ্যাঠাইমার দাম্পত্যালাপের অধিকাংশ জুড়েই থাকত জেঠুর কোষ্ঠ সাফ হওয়া আর না হওয়া।  মনে মনে ভাবলাম তাই যেন হয় বাবা।সামনেই পুজো, পুজোটা যেন সবার ভালো কাটে। আমার সমস্ত আপনজন, তাদের সমস্ত প্রিয়জন সব্বাই যেন ভালো থাকে। কতদিন পর পিত্রালয়ে ফিরবে উমা, আনন্দে ভরে উঠুক ভুবন। 

অনির ডাইরি ৫ই অক্টোবর,২০২১


সকাল ৭টা

আগামী কাল মহালয়া। গৃহকর্তার সাথে দেখা হতে আর বড় জোর ঘন্টা বিশেক। যদিও তিনি বারংবার বলছেন, যে এক মাস পর বাড়ি ফিরবেন, তাই মাননীয় জেলাশাসককে বলে বেলা তিনটের মধ্যেই বেরিয়ে পড়বেন আপিস থেকে। ওসব কথায় বিশ্বাস করি না আমি। সাড়ে পাঁচটা-ছটার আগে মোটেই পার করবে না আপিসের চৌকাঠ। পারবেই না। 


 ভোরের যাবতীয় আমেজকে পলকে চটকে, ঝনঝনিয়ে বেজে উঠল মুঠো ফোনে। ফোনের ওপারে মায়ের আদ্র দুঃশ্চিন্তা মাখা কণ্ঠস্বর, বাবা ভালো নেই। সারারাত ছটফট করেছে বেদনায়, ভোরের আলো ফুটতে না ফুটতেই তপনকে ফোন করেছে মা। । তপনের সাথে আমার মা-বাবার সম্পর্ক বরাবরই সুমিষ্ট, কারণ প্রায় দেড় দশক ধরে বাবামায়ের সুগার চেক করে আসছে তপন। প্রথম এসেছিল এক ফচকে ছোকরা, গলির মুখের ডায়গনস্টিক সেন্টার থেকে ব্লাডের স্যাম্পল কালেক্ট করতে- দুচারটে সুখদুখের কথা, সামান্য সহমর্মিতা  কবে যে তাকে ঘরের ছেলে বানিয়ে দিয়েছে আমরা জানি না। বর্তমানে স্যাম্পল কালেকশনের কাজ আর করে না তপন, তবে জড়িত আছে স্বাস্থ্য সংক্রান্ত নানা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে। মধ্য হাওড়ার যাবতীয় নামী এবং দামী চিকিৎসকের সঙ্গে অসম্ভব সুসম্পর্ক তপনের-  বাবা-মায়ের যাবতীয় শারীরিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা, ডাক্তারের সাথে অ্যাপয়েন্টমেন্ট বুক করা, এমনকি বৃদ্ধ-বৃদ্ধা যাতে নিরাপদে ডাক্তারখানা ঘুরে আবার বাড়ি ফিরে আসতে পারে তার জন্য বাড়ির দরজায় টোটোও পাঠিয়ে দেয় তপন। 


মা জানাল, তপন আশ্বস্ত করেছে মাকে, এখুনি একজন নার্স পাঠাচ্ছে যিনি অ্যানিমা দিতে পারেন। কোষ্ঠ সাফ হয়ে গেলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। তবুও শান্ত হয়নি মায়ের মন, বাবার তীব্র আপত্তি সত্ত্বেও ফোন করে বসেছে আমায়। বাবার এই আপত্তির কারণ একটাই, শুনলেই ছুটে যাব আমি, কেন শুধু শুধু আমাকে বিব্রত করা। তারওপর আজ শৌভিক আসবে এক মাস পর- এমন দিনে আমায় বিব্রত করার থেকে খানিক যাতনা সয়ে নিতেও প্রস্তুত আমার বাবা। 


সকাল নটা নাগাদ ওলায় উঠে যখন আমি ফোন করলাম মাকে, তখনও ছটফটাচ্ছে বাবা। মায়ের হাত থেকে ফোন কেড়ে নার্স দিদি জানালেন, অ্যানিমা দিয়ে কোন লাভ হয়নি। কোষ্ঠ সাফই ছিল। উনি চিন্তিত স্বরে বললেন, ‘দেখুন দিদিভাই, ওণার ওপর পেটটা অসম্ভব ফুলে আছে।গা বমি ভাব। আমি আপনাদের বাড়ির ডাক্তারকে ফোন করে, ওণার অনুমতি নিয়ে ডিকলিক আর জোফার ইঞ্জেকশন দিয়েছি। এবার মনে হয় কমে যাবে।’ তাই যেন হয় ঠাকুর। 


আপিস টাইমের কলকাতার জ্যাম কাটিয়ে, হাওড়া ময়দান থেকে গাড়ি যখন বাঁকল পঞ্চাননতলা  রোডের দিকে, মুঠো ফোনে ফুটে উঠল বড়দার নম্বর। মায়েরা চার বোন, চার বোনের পাঁচ পুত্রকন্যা। চার দাদার একমাত্র আদরের বোন আমি, বয়স যতই গাছ আর পাথর বিস্তার করুক, দাদাদের কাছে আমি আজও সেদিনের ছোট্টই আছি। চার দাদার মধ্যে বড়দা আবার আমার শিক্ষাগুরুও বটে। সেই ষষ্ঠ শ্রেণী থেকে দ্বাদশ অবধি দাদার কাছেই লেখাপড়া করেছি আমি। কি ভয় পেতাম ভদ্রলোককে। রেলে চাকরী করত বড়দা, এখনও করেন, আপিস ফেরৎ দাদার একটাই হবি ছিল আমাকে পড়াতে আসা। সোম বুধ শনি তিন দিন সন্ধ্যা ঘনালেই পড়াতে আসত দাদা,কখনও কখনও রবিও। ইংরেজি আর বাংলা (ওটা বাবার দপ্তর ছিল কি না) বাদে সব সাবজেক্ট পড়াত দাদা, কোনদিন তার জন্য দাদাকে দেওয়া হয়নি কোন পারিশ্রমিক, প্রথম দিকে তাও কিছু ভালোমন্দ টিফিন বানিয়ে বা কিনে আনত মা, বড়মাসি অর্থাৎ বড়দার মা জননীর ধমক খেয়ে তাও বন্ধ হয়ে যায় কিছুদিনের মধ্যে। 


 ‘হুটপাট করে আসার দরকার নেই, আস্তেসুস্থে আয়, আমি পৌঁছে গেছি-’। তুমি পৌঁছালে কেন রে বাবা? সেই নব্বইয়ের দশক তো আর নেই, সেদিনের বেকার অবিবাহিত বড়দার বিয়ের পর কেটে গেছে দুই দশকেরও বেশী। ঘর আলো করে বেড়েছে আমার দুই ভাইপো ভাইঝি। চাকরীতে হয়েছে পদোন্নতি, ভয়ানক ব্যস্ত থাকে বড়দা আজকাল। খামোখা সেই মানুষটাকে কেন খবর দিয়েছে মা? একটু রেস্ট নেবার সময় পায় না যে লোকটা, তাকে মামুলী পেট ব্যথা আর কোষ্ঠকাঠিন্যের জন্য কেউ খবর দেয়? আমি তো আসছি নাকি?


বাড়ি গিয়ে মাকে ধমকে, বড়দার কাছে প্রবল কানমোলা খেলাম এই ধেড়ে বয়সে। দাদা বোনের খুনসুটি তো চলতেই পারত আরো খানিকক্ষণ, কিন্তু বাবার অবস্থা মোটেই ভালো নয়। ছিঁটেফোঁটাও কমেনি পেট ব্যথা। সাথে প্রবল বমি ভাব। ডাক্তারকে ফোন করতে উনি নির্দেশ দিলেন, হাসপাতালে ভর্তি করার। ঠিক এই ভয়টাই পেতে পেতে আসছিলাম আমি গোটা রাস্তা। এই সদ্য জুলাই মাসে মাকে নিয়ে হাসপাতাল ঘর করতে করতে জেরবার হয়ে গিয়েছিলাম আমি, আবার সেই চক্করেই ফেললে প্রভু। আর কাল যে মহালয়া- । খুড়তুতো দুই ভাই দপ্তরী কাজে রাস্তায়, ওরাও কর্ম সূত্রে ওষুধ আর ডাক্তারদের সাথেই যুক্ত। বড়কে ফোন করলাম, যদি অন্য কোন ডাক্তার দেখানো যায়, যদি তিনি একটি বার এসে, রুগীর নাড়ি দেখে দিতে পারেন কোন বিশল্যকরণীর হদিস। পথের মাঝে বাইক থামিয়ে ভাই বলল, 'সময় নষ্ট করিস না। হাসপাতালে নিয়ে যা।' 


বাড়ির কাছের নার্সিং হোমেই বাবাকে নিয়ে গেলাম বড়দা আর আমি। রেসিডেন্ট ডাক্তার এসে দেখে গেলেন, কোভিড টেস্টের জন্য পাঠালাম আধারকার্ডের ডিটেইলস্। জানালাম ডবল ডোজ ভ্যাকসিন হয়ে গিয়েছে অনেক আগেই। বর্তমান প্রটোকল মেনে আইসোলেশন ওয়ার্ডে পাঠানো হল বাবাকে। এবার পালা সইসাবুদ- টাকা পয়সা জমা করার, সবসময় আমার ছায়াসঙ্গী আমার বড়দা। টাকা জমা করার ঠিক আগের মুহূর্তে ঘোষণা হল, ‘অলোক চ্যাটার্জীর বাড়ির লোক, এই মুহূর্তে আইসোলেশন ওয়ার্ডে আসুন। ’ একজনকেই যাবার অনুমতি দেবে এরা, ব্যাগপত্র দাদাকে ধরিয়ে, উঠে গেলাম আমি। আইসোলেশন ওয়ার্ডে শুয়ে আছে বাবা, নাকে রাইসটিউব পড়ানো, আমি ঢুকতেই আমাকে একজন বললেন, ‘দেখুন ওণার পেট থেকে কি বেরোচ্ছে-’। ঘণ কৃষ্ণ বর্ণ তরল, হুড়মুড় করে বেরিয়ে আসছে নাকের নল দিয়ে। নলের অপর প্রান্ত ডোবানো অাছে, একটি দুলিটারের বোতলে, যার অর্ধেক ততোক্ষণে ভরে উঠেছে কালো তরলে-। কি এটা? রক্ত ? রেসিডেন্ট ডাক্তার গম্ভীর মুখে জানালেন, ‘হতেও পারে। ’ 

(চলবে)

Monday 11 October 2021

অনির ডাইরি ২৯শে সেপ্টেম্বর, ২০২১

 


বুড়ো কালেক্টরেটের সামনে গাড়ি থামতেই ওণারা এগিয়ে এলেন, এক মেটে সিঁদুরের টপ্পা পরা দোহারা চেহারার মধ্যবয়সী ভদ্রলোক, সঙ্গে এক বছর চল্লিশ বিয়াল্লিশের ঘোর কৃষ্ণবর্ণা নারী। পরণে সস্তা সিন্থেটিক শাড়ি। সিঁথিতে ডগডগে সিঁদুর। উভয়েরই মুখ মাস্কে ঢাকা। মহিলার হাত ধরে আছে এক অবোধ বালিকা। 


জানতাম ওঁরা আজ আমার কাছে আসবে। কালকেই জানিয়েছিল আপিসের ড্রাইভার রঞ্জিৎ। ‘ম্যাডাম একটু উপকার করবেন?’ উপকার বলতে প্রিয়জন পরিত্যক্তা একটি সাড়ে তিন বছরের শিশকন্যাকে কোন হোমে রাখার ব্যবস্থা করা। বলতেই পারতাম, এটা আমার কাজ নয়। এমনকি এটা শ্রমদপ্তরেরও কাজ নয়- বলতে পারলাম কই? বলতে ইচ্ছে করে কই? 


রঞ্জিতের মুখে শুনে, বা ফোনে ঠিক বুঝতে পারছিলাম না, তাই জানিয়েছিলাম, কেউ যদি এসে একটু সামনাসামনি কথা বলে, খুব ভালো হয়। সেই মোতাবেক চাইল্ডলাইন মারফৎ জেলা চাইল্ড প্রোটেকশন সেলের যে আধিকারিক এই ব্যাপারটা দেখেন তাঁর সাথে কথাও বলে রেখেছিলাম। এঁরা এলেই তাঁকে ডেকে পাঠাব। বা তাঁর কাছে এঁদের পাঠিয়ে দেব। তবে ভাবিনি এইভাবে বাচ্ছা সমেত এসে উপস্থিত হবেন।  


সসঙ্কোচে আমার চেম্বারে প্রবেশ করে, গুছিয়ে বসে ভদ্রমহিলা জানালেন, তিনি ঐ শিশুকন্যার দিদিমা। এত অল্পবয়সী দিদিমা আমি এই প্রথম দেখলাম। শুনে উনি নার্ভাসভাবে  একটু হাসলেন। তারপর জানালেন,‘আমার খুব অল্পবয়সে বিয়ে হয়েছিল তো দিদি, ইয়ে ম্যাডাম। গাঁয়ের মেয়ে ছিলুম। বর নেয়নি। দুটো ছেলেমেয়ের হাত ধরে পথে বসিয়ে দিয়ে চলে গেল। লোকের বাড়ি আয়াগিরি করে ছেলেমেয়েকে বড় কচ্ছিলুম। এমন কপাল, মেয়েটা কেলাশ ফাইভে পড়তে পড়তে পালিয়ে গেল। যার সাথে পালাল, সে একটা থাড কেলাশ ছেলে দি ইয়ে ম্যাডাম। মদ খায়। বউয়ের গায়ে হাত তোলে।’ বলতে বলতে সস্তা সিন্থেটিক শাড়ির আঁচলে চোখটা মুছে নিলেন ভদ্রমহিলা। 


সামান্য ধরা গলায় বললেন,‘ আমার মেয়েটার বয়স ঐ ধরুন না বছর পঁচিশ-ছাব্বিশ। এরই মধ্যে দু-দুটো মেয়ের জন্ম দিয়েছে। বরের তো ঐ ছিরি।’ বুঝলাম এণারা প্রজন্মের পর প্রজন্ম স্বামী পরিত্যক্তা। কিন্তু তবুও তাঁর মঙ্গলাকাঙ্খায় সীমন্তে ডগমগ করে সিঁদুর। আরো বুঝলাম, মেয়েটি জন্ম তো দিয়েছে কিন্তু মায়ের দায়িত্ব পালনে অপারগ। দুটি শিশুকন্যাকে মায়ের বাড়ির গলির মুখে নামিয়ে দিয়ে নিরুদ্দেশ-। ভদ্রমহিলার ভাষায়, ‘আমি ডিউটিতে বেরুচ্ছিলুম দিদি, হঠাৎ দেখি এরা ঢুকছে, ‘দিদা-দিদা’ করতে করতে। তো আমি জানতে চাইলুম, হ্যাঁরে তোরা একা? মা কই? তো বলে, মা আমাদের টোটো থেকে নামিয়ে দিয়ে চলে গেল-। তখুনি বুঝিচি।’


মাঝপথে কথা থামিয়ে জানতে চাই, বাচ্ছাটা কিছু খেয়েছে কি না। ব্যাগে তো কিছুই নেই। এত সকালে আর এই আবহাওয়ায় কালেক্টরেটেও মিলবে না কিছু। যদি দুটো বিস্কুট খায়-। অবোধ শিশু বড় লক্ষ্মী মেয়ে। দিদার দুই পায়ের ফাঁকে দাঁড়িয়ে আপনমনে কি সব বিড়বিড় করছে, আঙুল চুষছে আর মাঝে মাঝে উৎসুক চোখে আমায় দেখছে। দিদা শশব্যস্ত হয়ে জানাল,‘চাট্টি দুদরুটি খাইয়ে এনিছি। আর চা বিস্কুট আমরা নীচে থেকে খেয়েই এসিছি। ’ আমরা বলতে মনে পড়ল, সাথে আসা টপ্পা পরা আগন্তুকের কথা। আমি জানতে চাইবার আগেই প্রশ্নটা করলেন, চাইল্ড প্রোটেকশন সেলের সূর্যনারায়ণ বাবু। ‘ আপনি কে?’ লোকটা দেঁতো হেসে বলল,‘জী, আমি ওদের পড়োশী। দিদি খুব বিপদে পড়ে গেছেন, তাই হামিই রঞ্জিৎকে বললাম। রঞ্জিৎ হামার দোস্ত কি না-’।  


ভদ্রমহিলা আবার তাঁর বক্তব্য রাখতে যাচ্ছিলেন, তাঁর আগেই জানতে চাইলাম, বারবার দুটো মেয়ের কথা উঠছে,আরেকজন কোথায়? জবাবে দিদিমা বলল, ‘ওকে একটা হোমে দিইছি দিদি। এই তো চন্দননগরে।’ জানলাম তার বয়স আট। ঐ হোমে সাত-আট বছরের নীচে শিশু নেয় না  বলেই দিদা তাঁর কনিষ্ঠ নাতনীকে নিয়ে আমাদের দ্বারস্থ। 


হোম আর উঠতি বয়সী মেয়ে শুনলেই কেমন আতঙ্ক হয়। সূর্যনারায়ণ বাবুকে আস্তে আস্তে প্রশ্ন করলাম, যে হোমে দিয়েছে বলছে সেটা কেমন? উনি আশ্বস্ত করলেন যে সমাজকল্যাণ দপ্তরে নথিভুক্ত ভালো হোমেই দিয়েছে। কিন্তু হোমটা তো এখন বন্ধ। তাহলে বাচ্ছাটা গেল কোথায়?প্রশ্ন করাতে দিদা ছলছল চোখে জানাল, ‘আমার পিসতুতো বোনের কাছে কদিনের জন্য রেখে আসতে বাধ্য হইছি। বাড়ির মালকিন খুব অশান্তি করছিল। বলছিল, ‘তোমায় বাড়ি দিইছিলাম, এসব বাচ্ছাকাচ্ছা নিয়ে এখেনে থাকা যাবে না। বলছে বাড়ি ছেড়ে দিতে। ইলেকট্রিক লাইনটাও কেটে দিয়েছে-’।  ক্ষণিক থেমে বললেন, ‘আসলে ভাড়াও খানিক বাকি তো। লকডাউনে কাজ পাইনি তো, তাই। আমি বলিছি, একটু একটু করে শুধে দেব। দিচ্ছিলামও।’ 


সমাজকল্যাণ দপ্তরের সূর্যনারায়ণ বাবু দেখলাম ভীষণ পরিপক্ক এবং দক্ষ। আমার মত আবেগ তাড়িত নয়। উনি খুব ধীরে ধীরে ঠাণ্ডা মাথায় বোঝালেন, ওণাদের সামনে দুটি পথ খোলা, এক যদি ওণারা বাচ্ছাটিকে পাকাপাকি ভাবে হস্তান্তর করতে চান, সে ব্যবস্থা হয়ে যাবে। তবে তারপর বাচ্ছা অ্যাডপশনে চলে যাবে। তার ওপর এণাদের থাকবে না আর কোন অধিকার। দিদার আঁচলের খুঁট করে খেলা করা মেয়েটার থেকে চোখ সরিয়ে নিলাম। নিশ্বাস নিতে কেন যে এত কষ্ট হচ্ছে বুঝতে পারছি না। একবার সূর্যনারায়ণ বাবু আর একবার আমার মুখের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকাচ্ছে দিদা। 


সূর্যনারায়ণ বাবু কেজো অথচ দরদী গলায় জানালেন, আর একটা উপায় হল, বাচ্ছাটাকে কোন শেল্টারে রাখা। যেখানে চাইলে গিয়ে দেখেও আসতে পারবে বাড়ির লোক। আর একটা নির্দিষ্ট বয়সে পৌঁছালে আবার ফিরিয়েও আনতে পারবে। হাতে চাঁদ পেলাম মনে হল। দিদার হয়ে আমিই বলে উঠলাম, এটাই বোধহয় ভালো। আজ না হলে কাল আবার দেখতে তো পাবে প্রিয়জনদের। 


সূর্যনারায়ণ বাবু অভিজ্ঞ সুরে জানালেন, সিদ্ধান্ত নিতে হবে পরিবারবর্গকেই। যদি পূর্ণ হস্তান্তর করতে হয়, তাহলে ইন্সপেকশন হবে, কাউন্সেলিং হবে আর প্রয়োজন পড়বে শিশুর পিতামাতার হস্তাক্ষরের। তাঁদের লিখিত অনুমতি ব্যতীত এটা অসম্ভব। শুনেই ঢোঁক গিললেন দিদা। সেটা কি করে সম্ভব। উভয়েই তো নিরুদ্দেশ। 


‘তাহলে ও প্রসঙ্গ ছাড়ুন। এমনি হোমে ওকে রাখাটাও  কিন্তু আপনার এক্তিয়ার বহির্ভূত। আপনার কন্যা যে নিঁখোজ আপনি মিসিং ডায়েরি করিয়েছেন?’ জানতে চান সূর্যবাবু। ভদ্রমহিলার দেহের ভাষা সুস্পষ্ট ভাবে জানায়,ওণারা করেননি। মাথাতেও আসেনি ওণাদের।  কেন, এই প্রশ্নের উত্তরে জানান, ‘আজ্ঞে, এর আগেও একবার ছেড়ে চলে গিয়েছিল, ছদিনের জন্য। আবার ফিরেও এসেছিল। হাজার হোক মা তো। আর আমিও তো তার মা। তাই ভেবেছিলুম হয়তো এযাত্রাও-’। বাকি কথাটা অনুক্তই থেকে যায়। 


উনি নিজে দেখবেন, প্রয়োজনে পুলিশ দিয়ে বাড়িওয়ালীকে কড়কানি দেবেন আর যা যা প্রয়োজন সব করবেন এই আশ্বাস দিয়ে সূর্যবাবু নিয়ে যান ওদের। আজ শুনলাম পুলিশে জিডি করা হয়েছে বাড়িওয়ালীর নামে। মিসিং ডায়েরিও হয়েছে মা’টার নামে। সেই ডায়েরীর কপি দিয়ে শিশুটিকে হোমে রাখার লিখিত আবেদনও করেছেন দিদা। তবে সময় লাগবে কিছুদিন।এনকোয়ারি হবে। পুজোর আগে হবে না। পুজোর আর বাকিই বা কটা দিন। সবাই আমরা ব্যস্ত আসন্ন শারদীয়ার শেষ মূহূর্তের প্রস্তুতিতে। জামাকাপড়- জুতো- মেকআপ- অ্যাকসেসারিজ আরো না জানি কত কি। বৎসর ঘুরে একরাশ আনন্দ নিয়ে ঘরে ফিরছেন আনন্দময়ী, সেই আনন্দের ছিটেফোঁটাও যদি পৌঁছায় এক লাইন কেটে দেওয়া অন্ধকার এককামরার ঘরে- যেখানে কাজ হারানো দিদার আঁচল নিয়ে খেলে দুই অবোধ বালিকা। খুশি হবার অধিকার তো ওদেরও আছে-

অনির ডাইরি, ২৯শে সেপ্টেম্বর, ২০২১

 


ফোনটা যখন এল , তখন আমি বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মত একাকী জলমগ্ন ফুটপাথে দাঁড়িয়ে। শাশুড়ি মা যথার্থই বলেন, মা গো, এমন কুচ্ছিৎ জায়গায় মানুষ থাকে? এক পশলা বৃষ্টি মানেই এক হাঁটু জল। মুঠো ফোন বলছে, সবে রাত সাতটা বাহান্ন, আমার পিছনে জলের তোড়কে উপেক্ষা করে দৌড়চ্ছে মহানগর, আর আমার সামনে অখণ্ড নিস্তব্ধতা আর ঘন কালো টলটলে জল। কে বলবে আজ সকালেও হেঁটে নয়, রীতিমত দৌড়ে পেরিয়েছি এই একফালি রাস্তা। আপাততঃ জনবিহীন। আমার সাথে যে কয়জন হতভাগ্য এপাড়ে এসেছিল, সকলে হাঁটুর ওপর প্যান্ট গুটিয়ে ঝপাং করে জলে নেমে রাস্তা পার হয়ে গেছেন। ভোম্বলের মত দাঁড়িয়ে আছি আমি একাই। পায়ে তিন/চার ইঞ্চি হিলের মহার্ঘ চপ্পল, আগের দিনের বৃষ্টি আর জমা জল কোতল করেছে আমার সাধের দুগ্ধফেননিভ স্নিকার জোড়াকে। এদের অপমৃত্যু প্রাণে ধরে সইতে পারব না। আর খালি পায়ে এই রাস্তায় এত জল ঠেলে হাঁটতেও পারব না। ভেসেই যাব নির্ঘাত। ডুবেও যেতে পারি। জনৈক রিক্সাওয়ালা আশ্বস্ত করে গেছেন, সোয়ারী নামিয়েই ফিরে আসবেন আমার তরে, তাঁরই প্রতীক্ষায় মুহূর্ত গুনছিলাম আর কি। 


ফোনের ওপার থেকে পণ্ডিতের উদ্বিগ্ন স্বর ভেসে এল, ' এই আমাদের কেয়ারটেকারকে সাপে কামড়েছে-'। পণ্ডিতে পুরো নাম না হয় উহ্যই থাকুক, শুধু এইটুকু বলি যে কোন এক মান্ধাতার আমলে তিনি এই অধমের অপরূপা সহপাঠিনী ছিলেন। আপাততঃ দক্ষিণ কলকাতার বিরাট বনেদি বাড়ির জাঁদরেল গৃহকত্রী। কেয়ারটেকারকে সাপে কামড়ানোর খবরটা শুনে রীতিমত কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে বললাম, 'হাসপাতালে নিয়ে যা। ইঞ্জেকশন দিতে হবে।' আমার জ্ঞানের পরিধি অতটুকুই। ওপাশ থেকে ভেসে এল, জাঁদরেল গিন্নীর মৃদু ধমক, 'হাসপাতালে ভর্তি করিয়েছি। এবার বল সাপটাকে কি করব?' 


আমি জন্মসূত্রে চাটুজ্জে, কাশ্যপ গোত্র। নিজেকে কাশ্যপ মুনির বংশধর হিসেবে ধরলে, কদ্রু দেবীর পুত্রকন্যাগণ নির্ঘাত তুতো ভাইবোন, নিদেনপক্ষে খুড়োজেঠা তো হবেনই। তা সত্ত্বেও কেন যে ওণাদের প্রতি বিন্দুমাত্র আত্মীয়তা অনুভব করি না। বরং উগ্র বিরাগ আমার। 


অকপটে মনোভাব ব্যক্ত না করলেও, এমনি কিছু বলাতে, আরেক চোট ধমক খেলাম। সাপ না লুপ্তপ্রায় জীব। সংখ্যায় নগন্য। আর এই মহানগরে, বিশেষতঃ নিউআলিপুরের মত ধনাঢ্য এলাকায় সাপ তো রীতিমত দুর্লভ। অসহিষ্ণু কণ্ঠে ধমকায় পণ্ডিত, ‘ আরেঃ তুই কি সরকারী চাকরী করিস রে? শীঘ্রি বল, ফরেস্ট ডিপার্মেন্টের কোন হেল্পলাইন আছে কি না? কাকে ফোন করব? সাপটা বাথরুমের দরজা থেকে রীতিমত টারজানের মত ঝুলছে।’


অজ্ঞতা স্বীকার করে নিলাম,যে বনদপ্তরের কোন সহায়িকা নম্বর আছে কি না আমার বাপও জানে না। আমি তো কোন ছাড়? বনদপ্তরের সাথে আমার একটাই ক্ষীণ যোগাযোগ আছ, ওদের জনৈক আধিকারিকের গিন্নী আমার যাকে বলে বেস্ট ফেরেন্ড। চেনা বামনির পৈতে লাগে না,তাই তাঁর নামটাও না হয় উহ্যই থাকুক।  সবাই তারে এমনিতেই এক ডাকে চিনে- তাকে বলাই যায়। কোষ্ঠকাঠিন্য থেকে পাতলা দাস্ত সককথাই তো বলি আমরা একে অপরকে। মাঝে মাঝে তো আমাদের বাক্যালাপ শুনে চমকে ওঠে আমাদের বরেরাও-' আচ্ছা এটাও কি অমুককে বলার দরকার ছিল?' কি করব! আমরা ওমনিই। 


সমস্যা সেটা নয়,সমস্যা হল, এই যে মাত্র এক মাস আগেই আমি প্রতিজ্ঞা করেছিলাম, আর কারো জন্য কারোকে বলব না। অন্য এক বন্ধুর জন্য ফোন করেছিলাম জনৈক আধিকারিককে। এমন কিছুই দাবী ছিল না, সামান্য দু মিনিট সময় চেয়েছিল প্রবাসী বন্ধুটি। টাটা কোম্পানিতে বড় চাকরি করে ছেলেটি, বিশেষ কোন লাইসেন্সের জন্য কিছু টাকা সিকিউরিটি ডিপোজিট জমা করেছিল টাটারা। কাজ মিটে যাবার পর টাকা ফেরৎ চেয়ে আবেদন করেন, তারপর কেটে গেছে সাত আটটা বছর। বন্ধু বলল, 'ও টাকা ফেরৎ না পেলেও কোন সমস্যা নেই। তবে বাড়ি ফিরছিই যখন, আমাকে বলা হয়েছে একবার তদারকি করে আসতে।তুমি তো চিনবেই ওই অফসরকে। একটু বলবে, আমি জাস্ট দুমিনিট নেব ওনার।' বেশ তো। এ আর এমন কি? জানতে চাইলাম কত টাকা? উত্তর যা পেলাম  শুনে চমকে উঠলাম।গরিব দপ্তরের পক্ষে এটা অনেক টাকা। ফেরৎ তো পাওয়াই উচিৎ। আশ্বস্ত করলাম, বর্তমানে ওই দপ্তরের আধিকারিক আমার পরিচিত। বললে নিশ্চয় উনি কিছু একটা ব্যবস্থা করে দেবেন। 


আশ্বস্ত তো করলাম। নিজে আশ্বস্ত হলাম কি? ফোন করতেই এমন ভয়ানক তাচ্ছিল্যের সাথে জবাব এল, যে মনে হল অনেক হয়েছে, আমার আর এগিয়ে দরকার নেই। কার টাকা কে ফেরৎ পায়, বা না পায় শুধু শুধু আমার অপমানিত হওয়া নিরর্থক। পরোপকারের পোকার কামড় এমনি, যে তা সত্ত্বেও রীতিমত করুণাভিক্ষার সুরে বললাম, ' দেখো ভাই আমার নিজের প্রয়োজনে তো বলছি না। আশ্বস্ত থাকো যে আমার ব্যক্তিগত প্রয়োজনে আমি কখনোই তোমাকে বলব না। কিন্তু বন্ধুবান্ধব অনুরোধ করলে-। আর ও শুধু দুটো মিনিট কথা বলতে চায়।' 


'আরে না, না এরকম বলছ কেন? তুমি পাঠাও না।দেখছি কি করতে পারি।' এই শুনে বন্ধুটিকে তো পাঠালাম। পরিণাম এটা হল যে তাকে বসিয়ে রাখা বেলা বারোটা থেকে বিকাল সাড়ে চারটে অবধি। অবশেষে ঘর ফাঁকা দেখে যখন সাহস করে প্রবেশের সুযোগ পেল ছেলেটি, সাক্ষাতের মেয়াদ দাঁড়াল দুমিনিট এর জায়গায় মাত্র তিরিশ সেকেন্ডে। আর আমার নাম করতেই বলা হল, 'বাইরে যান।বাইরে গিয়ে বসে থাকুন।' পাঁচটার সময় আমিই ফোন করে একরাশ ক্ষমা চেয়ে বললাম, ভাই তুই বাড়ি ফিরে যা।  


ন্যাড়া বেলতলায় আর কবার যায়? জানি না, তবে রিক্সায় উঠে প্রিয় বান্ধবীকে ধরলাম। আর যাই হোক, এ অমন তাচ্ছিল্য দেখাবে না। এটা নিশ্চিত। পরের ধাপে দেখা যাবে। বন দপ্তরীয় আধিকারিকের গৃহিনী, বনজঙ্গল  তথা জীবজন্তু-সাপখোপের ওপর তাঁর কি অকাট্য প্রেম, সর্পনন্দন টারজানের মত ঝুলঝুল করে ঝুলছে শুনে প্রথম চোটে তার কি হাসি। অতঃপর যখন বললাম, যে বেচারী কেয়ারটেকার ইতিমধ্যে সর্পদ্রষ্ট এবং আমাদের পণ্ডিত  দু-বগলে  ছানা এবং পোনাকে আঁকড়ে ঠকঠক করে কাঁপছে (জানতে পারলে পণ্ডিত নির্ঘাত আমায় কোতল করবে। তবে কি না গল্পে রঙ চড়াতে ওসব বলতে হয়), বন্ধু ঘচ্ করে ফোন কেটে দৌড়ল। ফোনের এপার থেকে শুনতে পেলাম বন্ধুর আতঙ্কিত কণ্ঠস্বর, ‘ও গোওওওও শুনছোওওওও-----’।  


ফ্ল্যাটের বেল বাজাতে না বাজাতেই ঢং করে ঢুকল মেসেজ, দক্ষিণ ২৪ পরগণার বন দপ্তরের আধিকারিকের নাম আর নম্বর। তৎক্ষণাৎ পাঠিয়ে দিলাম পণ্ডিতকে। সাথে সাথে বিধিবদ্ধ সতর্কবাণীও দিলাম, ভাই, নম্বর না হয় যোগান দেওয়া গেল, কিন্তু এত রাতে তিনি ফোন ধরবেন কি না বা আদৌ কোন ব্যবস্থা নিতে পারবেন কি না, দায়িত্ব নিয়ে বলতে পারছি না। ছিমতী পণ্ডিত, যাকে আমাদের চৈ ওরফে চৈতালী এই সেদিন অবধি সুযোগ পেলেই, ‘শেয়াল পণ্ডিত’ বলে খ্যাপাত, বাস্তবিক পণ্ডিতের মতই বলল, ‘জানি রে। এত বৃষ্টি হচ্ছে ও বেচারাই বা কি করবে, আর বনদপ্তরই বা কি করবে? ভাব নিউ আলিপুরে সাপ বেরোচ্ছে, কি দিনকাল পড়ল বাপু।এবার বাঘটা বেরোলেই একেবারে ১৬ কলা পূর্ণ হবে। ’ 


আশার বাণী আমি শোনাতে না পারলেও, রাত নটা নাগাদ পণ্ডিত শোনাল বটে, ‘ফোন ধরেছেন রে। এবং জানিয়েছেন ব্যবস্থা নিচ্ছেন। আমি যেন ধৈর্য না হারাই।’ জানতে চাইলাম, তিনি কি এখনও ঝুলছেন? জবাব পেলাম, তিনি এখনও টারজান মোডেই বিদ্যমান। 


রাত গড়ায়। নানা নৈমিত্তিক কাজের ফাঁকে মন পড়ে থাকে শৈশবের বান্ধবীর কাছে। কি করছে তারা, কোন মেসেজও তো আসে না ছাই। অবশেষে রাত সোয়া দশটায় ঢুকল মেসেজ, ‘নিয়ে গেছে রে বাবু। থ্যাঙ্কু। তোর জন্য ছবিটা পাঠালাম।’ 


 ছবি দেখে ভদ্রলোককে চিনতে পারব, এত বড় সর্পবিশারদ আমি নই। চিনতে যে খুব একটা উৎসুক তাও নই। বিন্দুমাত্র আত্মীয়তা বোধ এখনও আমার মধ্যে জাগেনি। তবে বেচারা অবোলা জীব, নিছক গণঠ্যাঙানিতে প্রাণ না হারিয়ে, বনদপ্তরের তত্ত্বাবধানে থাকবে ব্যাপারখানা মন্দ নয়। আমাদের পণ্ডিত আর তার শিশুরা নিরাপদে আছে এটাই আমার কাছে একমাত্র স্বস্তির কারণ। তবে সবথেকে যেটা ভালো লাগল, প্রথম অভিজ্ঞতার সময় চেনা মানুষও বাড়িয়ে দেয়নি ন্যূনতম সহযোগিতার হাত, আর এখানে আলিপুরের বনদপ্তরীয় আধিকারিককে না আমি ব্যক্তিগত ভাবে চিনি, না আমার প্রিয়তমা বান্ধবী,  উনিও নির্ঘাত অজ্ঞাত আমাদের অস্তিত্ব সম্পর্কে, এতদসত্ত্বেও এমন বর্ষণমুখর রাতে, যেখানে অর্ধেক কলকাতা জল অবরুদ্ধ, নিছক দূরভাষে ভেসে আসা এক অজ্ঞাত পরিচয় জননীর সামান্য অনুরোধের ভিত্তিতে তাঁর টিমকে পাঠালেন এবং তারাও যেভাবে দায়িত্ব সহকারে এসে নিজ কর্তব্য পালন করল কোন প্রশংসাই তার জন্য যথেষ্ট নয়। এদের  জন্যই মনে হয়, সত্যি সত্যিই বোধহয় মানুষের ওপর বিশ্বাস হারানো পাপ।


অনির পুজোর ডাইরি ৬ই অক্টোবর, ২০২১

 অনির পুজোর ডাইরি ৬ই অক্টোবর, ২০২১

(পর্ব-২) 

যাই লিখি, খুঁটিয়ে পড়ে লোকটা। দেয় সুচিন্তিত মতামত। ছবিগুলোও দেখে, শুধু আমারই নয়, আমার স্কুলের বন্ধুদেরও। সেই ছোট্ট থেকে দেখে আসছে তো-। ফেসবুকে ওদের দেওয়া সব ঘটনাবলী, তথ্য নখদর্পনে থাকে লোকটার। সারাদিনে কত বার যে চা খায় লোকটা।  আর সিগারেট? উফঃ তিতিবিরক্ত হয়ে ওঠে বাড়ির লোক। সবসময় বসার ঘরে ফ্লেক্সের কড়া গন্ধ। একবার প্রশ্ন করেছিলাম,গোল্ড ফ্লেক্স খাওয়া না কেন? ওটা নির্ঘাত আরো ভালো। লোকটা বলেছিল, ‘দামটা একটু বেশী। চিরকাল তো চারমিনার খেয়েই এসেছি।’ তারপর স্বভাবসিদ্ধ কৌতুকের সুরে বলেছিল, ‘কেন গরিব বাপ পাতি ফ্লেক্স খেলে কি তোমার সম্মানে লাগে?’ কি প্রশ্নের কি উত্তর মাইরি। 


দেরী হয়ে যাচ্ছে। পরপর তিনটে ওলা ক্যান্সেল হল। সম্ভবতঃ রক্তদান শিবির চলছে, শ্রীভূমির ওদিকে, তাই প্রচণ্ড জ্যাম রাস্তায়। ফোন করলেই, উল্টোদিকের ড্রাইভার জানতে চাইছে, ‘কোথায় যাবেন দিদি,’ যেই বলছি হাওড়া, অমনি ঘচ্ করে বুকিং ক্যান্সেলের মেসেজ ঢুকছে। এতো মহা জ্বালা। বাইক ধরব কি? এয়ারপোর্ট থেকে হাওড়া গাড়িতে যেখানে এই মুহূর্তে ৫৬৬টাকা, বাইকে মাত্র ১৯২। কিন্তু অনাত্মীয় ব্যক্তির বাইকে চড়া যে ভয়ানক অপছন্দ লোকটার। 


কি যে অসম্ভব মনের জোর লোকটার, বয়সের ভারে হয়তো এসেছে কিঞ্চিৎ নুব্জতা, স্বল্প স্থবিরতা। সেই ঘাটতি মিটিয়ে দেয় বিক্রম আর মনের জোর। পরিস্থিতি প্রতিকূল হলে আজও আমি অপেক্ষা করে থাকি,লোকটার অমোঘ বাণীর,‘ আরে সব ঠিক হয়ে যাবে। ঘাবড়াস না। ’ লোকটার মুখের কথা খসার সাথে সাথেই, সত্যিই সব যে কি ভাবে ঠিক হয়ে যায়, তা আজও এক দুর্ভেদ্য রহস্য আমার কাছে। লোকটা প্রায়ই বলে, জন্মলগ্ন থেকেই নাকি আমি তার জীবনের সূর্য। আমাকে ঘিরেই নানা কক্ষপথে ঘুরে বেড়ায় লোকটা। আমার সামান্য সময়, অল্প একটু মনোযোগের জন্য হ্যাংলার মত বসে থাকে লোকটা। জীবনেও আমার কোন দোষ,কোন খুঁত খুঁজে পায় না লোকটা। তাই না বড় সাধ করে আমার নাম রেখেছে, ‘অনিন্দিতা’। 


লোকটার আপত্তি অগ্রাহ্য করে বাইকই ধরলাম। মাথায় ফেট্টি বাঁধা একটি অবাঙালি ছেলে আর তার ধুলো পড়া কেলে অ্যাভেঞ্জারই আপাততঃ আমার পরিত্রাতা। মাথায় একখান জব্বর হেলমেট চেপেছে, যার ভারে মাথা আমার নুইয়ে এসেছে। পরার ইচ্ছে ছিল না মোটেই, আমার সামনে হেলমেট উল্টে জল ঝাড়ছিল ছেলেটা, আমি ঘাবড়ে গিয়ে ভেবেছিলাম নির্ঘাত আগের সোয়ারীর ঘাম হবে, যা গরম আজ। ছেলেটা মা-বাপ- আল্লার কিরে করে বলল, ‘ইটা জোল দিদি। জোল। পানি। বিষ্টির পানি। আমিও ভিগে গিছি দেখেন। ’ 


এহেন লোকটা, ঠিক পুজোর আগেই যে কি বাঁধিয়ে বসল-। এই প্রথম মহালয়ার চণ্ডীপাঠ ধ্বনিত হল না আমাদের বাড়ি। প্রতি বছর ভোর চারটেয় ঠিক আমাকে ফোন করে লোকটা, অথবা আমি করি, ‘ওঠো,ওঠো মহালয়া শুরু হয়ে যায়-’। মহালয়া শেষ হয়ে গেলে আবার ফোন করে লোকটা,শোনায় তার ছেলেবেলার আগমনী গপ্প। বিশাল সাবেকী রেডিওতে গমগমে বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্রের কণ্ঠস্বর। ভোর বেলা বাবলু পিসির শিউলি ফুল কুড়িয়ে আনার মনকেমন করা গল্প। আগুনে পুড়ে মারা যায় বাবলু পিসি। আমি তখন চতুর্থ শ্রেণী। 


ঠিকঠাক রাস্তা চেনো তো, ভয়ে ভয়ে প্রশ্ন করি আমি। কি জোরে চালাচ্ছে রে বাবা ছেলেটা। বেলঘড়িয়া এক্সপ্রেস ওয়ে জুড়ে এক মানুষ গভীর গর্ত। ইতিউতি জমে আছে শারদীয়া বৃষ্টির জল। ছিটে এসে লাগছে প্যান্টে। আকাশের মুখ এই গোমড়া তো এই হাসিখুশি। আচমকা বৃষ্টি নামলে কি যে হবে-। দক্ষিণেশ্বর ব্রীজ পেরিয়ে, বালি হয়ে,বেলুড়মঠ, লিলুয়া পেরিয়ে শালকিয়া চৌরাস্তায় পড়তেই খপ করে ধরল পুলিশ। ‘এই ব্যাটা এটা না ওয়ানওয়ে,  নাম। লাইসেন্স দেখা। ’ প্রায় দশ মিনিট হল ছেলেটা লাইসেন্স দেখাতে আর চালান কাটতে গেছে, বোকার মত বাইকে বসে আছি আমি। পাশ দিয়ে হাওড়া-হাওড়া হেঁকে চলে যাচ্ছে অটো। 


পরশুরাতেই ধমকে ছিলাম তুত্তুরীকে, সারাদিনে একটি বার ফোনও করেনি বুড়োবুড়িকে? কি এমন রাজকার্য করেছে তাহলে? ধমক খেয়ে রাত এগারোটায় করা ফোনে প্রথম জানতে পারলাম সন্ধ্যে থেকে অসহ্য পেটের ব্যথায় কাহিল লোকটা। ফোনের ওপার থেকে চিঁচিঁ করে বলল, ‘ডিকলিক খেয়েছি। কমে যাবে। তোকে অকারণ আর বিরক্ত করিনি। ’ পরদিন কাক ভোরে বৃদ্ধার ফোন, সারা রাত যাতনায় ছটফটিয়ে নেতিয়ে পড়ছে বৃদ্ধ। বাড়ির ডাক্তারকে খবর দিয়ে, তাঁর পরামর্শ মত দেওয়া হয়েছে অ্যানিমা, ফোটানো হয়েছে একাধিক ইঞ্জেকশন। পরবর্তী পদক্ষেপ হল হাসপাতালে ভর্তি করা। 


ট্রাফিক পুলিশের গুষ্টি উদ্ধার করতে করতে ফিরে এল ছেলেটা। সরি দিদি। ‘আপনার জন্য কিছু বললাম না,না হলে দিখাতাম মজা। ’ কাতর স্বরে জানালাম,ভাই, আমার এমনিতেই মজার শেষ নেই, তাই আমায় দয়া করে হাসপাতালে সময় মত পৌঁছিয়ে দে। যেখানে আইসিইউ এর দরজার দিকে ব্যগ্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে প্রতীক্ষা করছে এক বৃদ্ধ। শুধু আমার তরে, আমিই যে তার জীবনের সূর্য। আর সে আমার ধ্রুব তারা।  উৎসবও যে মাঝে মাঝে কেন এমন বেদনার হয়-  জলদি সেরে ওঠো বাবা।

অনির পুজোর ডাইরি ৮ই অক্টোবর, ২০২১

 

(পর্ব-৩) 

শুভ প্রতিপদ


কাকডাকা ভোরে ঘুম ভাঙালো মা,‘দরজাটা একটু খুলে দিবি? তোর বাবা'ই তো দিত-’। সেন্টু দিতে কিছু জানে বটে আমার গর্ভধারিণী। দরজা,অর্থাৎ চাটুজ্জে বাড়ির সিংহ দরজা। যাকে আমরা তিন প্রজন্ম সোহাগ করে ডাকি, সদর দরজা বলে। কাক ডাকা ভোরে, ঘুম ভেঙে উঠেই বাবা ছুটত সদর দরজা খুলতে।  বাবা খুলত বলেই, আর কেউ অতটা গা করত না। বাবা হাসপাতালে ভর্তি হবার সাথে সাথেই, মায়ের প্রধান মাথা ব্যথা হয়ে দাঁড়িয়েছে এই সদর দরজা খোলা। কাল রাত সাড়ে এগারোটায়, জবরদস্ত পারিবারিক আড্ডার মাঝেও মনে করিয়ে দিয়েছে আমার খুড়তুতো ভাই অয়নকে। ‘দরজাটা একটু মনে করে খুলে দিস বাবা। দুধ- কাগজ সব ফিরে যাবে নইলে। ’ 


 জমাটি আড্ডার ফাঁকে, অয়ন আশ্বস্তও করেছিল, ‘তুমি চিন্তা করছ কেন? ও চৈতি ঠিক খুলে দেবে। ’ চৈতি অর্থাৎ চাটুজ্জে বাড়ির বর্তমান প্রজন্মের জ্যেষ্ঠ কুলবধূ। এবাড়িতে সব সমস্যার একজনই মুস্কিল আসান, শ্রীমতী চৈতি। প্রত্যহ প্রাতে বাবার পরই যদি এবাড়িতে কেউ শয্যা ত্যাগ করে তবে তিনি চৈতি। এহেন চৈতি দায়িত্ব নেওয়া মানে, সে কাজ হবেই।  


তবুও ঘুম চোখে, বাসি মুখে অন্ধকার দালান টপকে,  দরজার খিল খুলে, লাল রোয়াক পেরিয়ে, তিন ধাপ সিঁড়ি নেমে, সাবেকী উঠোনের পড়ে থাকা ভগ্নাংশকে আড়াআড়ি পেরিয়ে দিলাম দরজা খুলে। পূব আকাশে তখন এক মুঠো আবির ছড়িয়েছে কে যেন।বইছে মৃদু ঠান্ডা হাওয়া। মনে পড়ে গেল বৃদ্ধ এরপর-পরই পাম্প চালাতে যেত। দিলাম পাম্পটা চালিয়ে-। নিঝুম বাড়িতে গুনগুন করে চলা জলের পাম্পের আওয়াজ বড় ঘুম পাড়ানিয়া, হাই তুলে চালিয়ে দিলাম রেডিও- রফি সাহাবের মধু ঢালা কণ্ঠ পলকে গুঞ্জরিত হল সমগ্র বৈঠক খানা জুড়ে, "ওয়াক্ত ইন্সান পে এয়সা ভি কভি আতা হ্যায়- রাহ মে ছোড়কে সায়া ভি চলা যাতা হ্যায়। দিন ভি নিকলে গা কভি, রাত কে আনে পে না যা, মেরি নজরো কে তরফ দেখ, জমানে ফে না যা।" আমরা বাপ-মেয়ে দোঁহে রফি সাহেবের বড় অনুরাগী। শৌভিক আবার টিম কিশোর কুমার। মা মুকেশ আর শ্রীমতী তুত্তুরী অরিজিৎ সিং।  


জল উঠতে, উঠতে নেলপালিশ লাগিয়ে নিলাম হাতে-পায়ে। সময় বড়ই মূল্যবান আমার জীবনে, নিছক অবকাশ পেলেই টুকটাক কাজ সেরে নি আমি। 


আপিস ঢুকতে সামান্য বেলা হল, একদল লোক অপেক্ষা করে বসেছিল শুধু আমারই তরে। সকাল বেলাই ফোন করেছিল পালের গোদা থুড়ি নেতা, ‘ম্যাডাম আপনার বাবা কেমন আছেন? সেরকম হলে দুদিন না হয় পিছিয়ে দিন মিটিংটা-। পুজোর আগেই মিটে গেলে ভালো হয়,তবে আপনার অসুবিধা থাকলে পুজোর পরই বসব আমরা।' আশ্বস্ত করে জানিয়েছিলাম, আজ আসব তো বটেই, তবে হয়তো বড়জোর আর এক বা দুদিনই যাব চুঁচুড়া, বদলী হয়ে গেছি আমি। এবার সিদ্ধান্ত আপনাদের, যদি আসতে চান, আমার সাথেই বসে মিটিয়ে নিতে চান আপনাদের দাবীসনদ, তো সুস্বাগতম, না হলে আমার  সুযোগ্য উত্তরাধিকারী তো রইলেনই। তা সত্ত্বেও এসেছে ব্যাটারা। মালিক এবং শ্রমিক উভয়পক্ষই। 


বেলা তিনটে পর্যন্ত ধস্তাধস্তি করে,কখনও প্রবল হুমকি, কখনও সেন্টু, কখনও নিছক দর কষাকষি করে নোটশিটে নামল সেটেলমেন্ট। শেষ দিনে এসে সই করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে উভয়পক্ষকে বিদায় জানিয়ে, পড়ে থাকা ফাইলপত্রে সইসাবুদ করে, বেঁচে থাকা বিল ভাউচার ছেড়ে যখন গাড়িতে উঠলাম, ভিজিটিং আওয়ার শুরু হতে বাকি মাত্র সোয়া একটি ঘন্টা। একঘন্টায় কি পৌঁছাতে পারব চুঁচুড়া থেকে হাওড়া? আপদ নার্সিংহোম, ইনটেনসিভ কেয়ারের রুগীকে দেখার সময় নির্দিষ্ট করেছে মাত্রই আধটা ঘন্টা। কালও দেরী হয়েছে মিনিট সাতেক, আজ যে কি হবে- 


ও রঞ্জিৎ, একটু জোরে চালাও বাপু। কেন যে আজই এত জ্যাম, দিল্লী রোড জুড়ে। সোয়া পাঁচটা নাগাদ ঝড়ের মত ঢুকলাম ইন্টেনসিভ কেয়ারে। নিদ্রিত বাবার হাতটা ধরতে গিয়ে মনে পড়ল, স্যানিটাইজ করা হয়নি তো। ভিজে হাতে হাতটা ধরতেই চোখ খুলল বাবা, সুপ্তোত্থিত পিতার মুখমণ্ডলে কেন জানি না, নিজের শিশুকন্যার মুখাবয়ব প্রত্যক্ষ করলাম আমি। ঠিক এই ভাবেই ঘুম ভাঙলে আড়ামোড়া ভাঙে তুত্তুরী। মুখটা ঠিক এই রকমই রক্তিম বর্ণ ধারণ করে পলকের তরে। 


‘অফিস যাসনি?’  প্রশ্ন করে বৃদ্ধ। জবাবে জানাই, আপিস ফেরতাই তো এসেছি। তাই না পরণে শাড়ি, উন্মুক্ত কেশদাম। চোখের পাতায় কাজলের হাল্কা ছোঁয়া। লিপস্টিক অবশ্যি খেয়ে নিয়েছি অনেক আগেই, মিটিং এর ফাঁকেফোকরে। অপলক দৃষ্টিতে খানিক তাকিয়ে থাকে বৃদ্ধ, তারপর বলে, ‘বাইরে নিশ্চয়ই খুব ভিড়, নারে? আমার জন্যই তোদের পুজোটা ঘেঁটে গেল নারে?’ হাসি চেপে জবাব দিই, পাগল নাকি, বছর ঘুরে মা আসছে, আর বৃদ্ধের কন্যার মনে পুলক জাগবে না তা আবার হয় নাকি? যতই প্রতিকূল হোক পরিস্থিতি, ঠিক ফাঁকফোকর খুঁজে আনন্দ করে নেব আমি।  আর এসব কথা উঠছেই বা কেন, এটা যদি উল্টো হত, আমি শুয়ে থাকতাম ঐ দুধসাদা বিছানায়, আর এপারে দাঁড়িয়ে থাকত বৃদ্ধ, তাহলে সে কি একটি বারও ভাবত যে নষ্ট হয়ে গেল তার পুজো? আমি হয়তো অতটা মহান নই, প্রাথমিক ভাবে ভেঙে পড়েছিলাম খানিকটা, ঘেঁটে গিয়েছিলাম পুরোপুরি, তারপর তো দিব্যি সামলে নিয়েছি নিজেকে। সামলাতে তো হতোই। সবাই সামলে নেয়। বৃদ্ধের সাথে দেখা করে,রিশেপসনে গিয়ে বসে থাকব এবার, ডাক্তার আসতে আরো ঘন্টা দেড়েক। তাঁর সাথে কথা বলে, ‘ছেড়ে দিন না ডাক্তারবাবু’র বৃথা অনুরোধ করর রোজকার মত। অতঃপর ডাক্তারের অনুমতি সাপেক্ষে ভিডিও কলে সংযুক্ত করব বৃদ্ধ আর তাঁর পক্ককেশ প্রেয়সীকে। ফাঁক দিয়ে দু একটা কথা বলে নেবে পিসিও। কথা বলতে বিবর্ণ শাড়ির আঁচলে মুছবে ভিজে চোখ। পিছন থেকে নানা মুখ ভঙ্গী করবেন ছিমতী তুত্তুরী। 


তারপর যাব বাজার। আঁকাবাঁকা হস্তাক্ষরে লম্বা ফর্দ পাঠিয়েছেন শ্রীমতী তু্ত্তুরী। সারাদিন ধরে আমার মা যা যা বলেছে,আমার কন্যা তাই বাংলায় লিখে এবং স্ক্যান করে পাঠিয়েছে আমায়। ফেরার পথে ভাবছি একবার ঢুঁ মারব সুবল স্মৃতির মণ্ডপেও। তুলে  নিয়ে যাব আনন্দময়ীর ছবি, গৃহবন্দী জননী আর কন্যার জন্য। আমাদের যে ভালো থাকতেই হবে। আমরা ভালো না থাকলে বাবা ভালো থাকবে কি করে? আর ভালো হবেই বা কি করে?

অনির পুজোর ডাইরি ১০ই অক্টোবর, ২০২১

 অনির পুজোর ডাইরি ১০ই অক্টোবর, ২০২১

শুভ পঞ্চমী


'মা, মা একটা খেলা খেলবে?' দিন দুয়েক ধরে বলে যাচ্ছে তুত্তুরী। একাধিক চরিত্রে নাম ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হতে, কোথাও যেন সবথেকে বেশী অবহেলিত থেকে যায়, মায়ের ভূমিকাটাই। এই উৎসবের দিনেও শুকনো মুখে ঘরে বসে রয়েছে মেয়েটা। কাল সন্ধ্যে থেকে সামান্য জ্বর জ্বর ভাব। মধ্যরাতে ঘুমের আশ্লেষে একে অপরকে জড়িয়ে ফিসফিস করে কথা বলি আমরা, ‘বাবু, তুই যেন আমায় আর বিপদে ফেলিস না।’ ‘কাল ঠিক, ঠিক হয়ে যাব। তুমি দেখো। ’ ঘুমের ঘোরে বিড়বিড় করে তুত্তরী। 


বোধহয় দরজার বাইরে হলেও কান পেতে শোনেন আনন্দময়ী। আজ সকাল থেকে সত্যিই উধাও হয়ে যায় জ্বর। নাকটানা আর কাশি অবশ্য বিদ্যমান। তবে ও যৎসামান্য। প্যারাসিটামলের পাহাড় উপুড় করে দিয়েছে বড় মামা। কত খাবি খা। শুধু সুস্থ থাক পুতু। এবাড়ি আর কোন মনোবেদনা সহ্য করার মত অবস্থায় নেই এই মুহূর্তে।  


যাই হোক, এরপর তো তুত্তুরীর আবেদন অগ্রাহ্য করা যায় না। খেলতেই হয়। তবে খেলার শর্ত হচ্ছে, গায়ে চাদর মুড়ি দিয়ে বিছানায় শুয়ে খেলতে হবে। আতঙ্কে এসির রিমোট লুকিয়ে রেখেছে মামমাম(থুড়ি দিদা)। কমানো সব পাখার রেগুলেটর। খেলা বলতে একটি পাতায় লিস্ট বানাতে হবে গোটা পনেরো প্রিয় গানের। কেউ কারো লিস্ট দেখতে পারব না আমরা। তারপর যখন তৈরি হয়ে যাবে লিস্টি, তখন আমরা মিলিয়ে দেখব কতগুলি গান পছন্দ দোঁহের। তবে শর্ত একটাই যে এই খেলায় জড়ানো যাবে না দাড়ি বুড়োকে।  তাঁর লেখা গান যেহেতু দুজনেরই পরম প্রিয়। 


বেশ তো, তৈরী হল লিস্টি-

এই মুহূর্তে তুত্তুরীর সেরা -১৫

১। নোকঝোক(ছপাক)

২। টু লেট টু টার্ন ব্যাক নাউ

৩। কভিরা✔️

৪। রাধারাণী লাগে✔️

৫। ঘর মোরে পরদেশীয়াঁ ✔️

৬। কলঙ্ক (টাইটেল ট্রাক)

৭। কানহা শো যা যারা

৮। চিডিয়া

৯। লগনলাগি রে

১০। এয় ওয়াতন (মেল ভার্সন)✔️

১১। ভারত✔️

১২। ভারত কি বেটি

১৩। আশমাঁ দি পরী

১৪। রাঞঝা(শেরশাহ)✔️

১৫। মন ভরেয়া ২.০


এবার আমার পালা, লিখতে বসে যত গানের কলি মাথায় আসে সবই তো দাড়ি বুড়োর লেখা। ধুৎ তেরী, যাই হোক, তাঁকে বাদ দিয়ে যে কটি গানের কলি মাথায় এল,তাই লিপিবদ্ধ করলুম শেষে-


১। দিল কি আওয়াজ ভি শুন, মেরে ফ্যসানে পে না যা ( আহাঃ পরম পূজনীয় রফি সাহেব)✔️

২। ও মেহবুবা (রাজ কাপুর আর মুকেশ জী। পিওর লাভ)

৩। রাঞ্জনা হুয়া ম্যায় তেরা, কওন তেরে বিন মেরা (ধনুষ)✔️

৪। ফুলোঁ কে রঙ সে, দিল কি কলম সে✔️ (কিশোরকুমারকে ছাড়া আবার লিস্টি হয় নাকি?)

৫। আজিব দাস্তান হ্যায় ইয়ে, কাঁহা শুরু কাঁহা খতম( আহাঃ লতাজী)✔️

৬। কুছ না কহো ( রাহুল দেববর্মন আর কুমার শানু❤️)

৭। ওঠো গো ভারতলক্ষ্মী✔️

৮। আজি এসেছি,আজি এসেছি নিয়ে এই হাসি- রূপ-গান✔️ (এই গানটি দেখে শ্রীমতী তু্ত্তুরী ভয়ানক রাগ করেছিলেন, ‘বলেছিলাম না তোমায়,রবীন্দ্র সঙ্গীত রাখবে না’। স্বর্গীয় ডি এল রায় সাহেব, অনুগ্রহ করে আমার গণ্ডমূর্খ কন্যাটিকে মার্জনা করিবেন) 


৯। প্যার হুয়া হ্যায় জব সে, মুঝকো নেহি চ্যায়ন আতা (শৌভিকের প্রিয় জুটি লতা জী আর কিশোরকুমার)

১০। ম্যায়নে প্যার কিয়া (এস পি বালাসুব্রহ্মমণিয়ামের কণ্ঠ আমার শৈশবের প্রেম) 

১১। তারে বলে দিও, সে যেন আসে না আমার দ্বারে✔️ (চিরন্তন হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ❤️আর উত্তমকুমার ❤️)

১২। নিশিরাত বাঁকাচাঁদ আকাশে ✔️(গীতা দত্ত❤️)

১৩। এয় দিল মুঝে বতা দে, তু কিসপে আগয়া হ্যায় (গীতা দত্ত❤️)✔️

১৪। আকাশ কেন ডাকে,মন ছুটি চায়✔️

১৫। বদনাম হবে জেনেও ভালোবেসেছিলাম


খেলা শেষে মেলাতে বসে দেখা গেল, ছিমতী তুত্তুরীর ১৫টা গানের মধ্যে ৬টা আমার মনোমত। যেগুলির পাশে ✔️ দেওয়া আর কি। আর আমার ১৫র মধ্যে ১০টাই ভীঈঈঈষণ প্রিয় তুত্তুরীর। ফলতঃ আমি বিজয়ী হইলাম এবং গতরাতে চাটুজ্জে বাড়ির বড় তরফের রাজাদার কাছ থেকে উপহার পাওয়া বিশাল বড় সিল্ক আর ক্যাডবেরী ফ্রুট এন্ড না্ট দুটোর ওপরেই আমার অধিকার স্বীকৃত হল। তবে জিতেও শান্তি নেই, তুত্তরী তালিকার বাকি ৯টা গান এবার আমায় শুনতে হবে এবং বিশদে বোঝাতে হবে কেন আর  দ্বিতীয়বার শুনতে আমি আগ্রহী নই👺👹👹। মা হওয়া কি মুখের কথা।😡😡