Wednesday 26 April 2023

অনির ডাইরি ২৬শে এপ্রিল, ২০২৩


 

#অনিরডাইরি #হাওড়ারগপ্প 


আমার জন্ম সুদূর মুর্শিদাবাদের এক প্রত্যন্ত গ্রামে হলেও, বেড়ে ওঠা পুরোপুরিই হাওড়া শহরে। ৫০০ বছরের বুড়ি, 'কুলিকামিন'দের শহর। ধনী দক্ষিণ ছাড়ুন, বনেদি উত্তর কলকাতা, মায় সিঁথি-বরানগর অধিবাসী জনগণও,"মফঃ" বলে আওয়াজ দিত। মফঃ অর্থাৎ মফস্বলী। PIN লিখতে গিয়ে ওরা কলকাতা লিখত যে, আর আমরা লিখতাম হাওড়া ৭১১১০১।


 মহানগরের ঘনিষ্টতম প্রতিবেশী হওয়া সত্ত্বেও, স্বকীয়তা বজায় রেখেছিল আমার শহর। ,"মফঃ" বলে তাচ্ছিল্য করা জনগণের থেকে বেশ অনেকটাই আলাদা, স্বতন্ত্র ছিল আমাদের মেয়েবেলা। যেখানে জর্জিয়ান ক্যালেন্ডারের সাথে সমানে সমানে টক্কর দিত বাংলা ক্যালেন্ডার আর পাঁজি। পাঁজি বস্তুটার মাথামুণ্ডু ঐ বয়সে না বুঝলেও এক দুর্বোধ্য আকর্ষণ ছিল পাঁজির বিজ্ঞাপনগুলির প্রতি। কৈশোরের অলস দুপুরে লুকিয়ে পাঁজির বাংলা বিজ্ঞাপন পড়ার যে কি সাংঘাতিক রোমাঞ্চ। 


বাংলা ক্যালেন্ডার এবং পাঁজির সৌজন্যে রইরই করে টিকে ছিল বাঙালির বারো মাসের ১৩ পার্বণ। মিহিদানা আর গজায় মাখামাখি হয়ে আসত নববর্ষ আর অক্ষয়তৃতীয়ার হালখাতা। আমাদের ক্ষীরেরতলা গলির কালিবাড়িতে অক্ষয়তৃতীয়ার দিন আবার পাঁঠা বলি হত। জ্যাঠাইমার পিত্রালয় হবার সৌজন্যে ফি বছর নিমন্ত্রণ থাকলেও, সজ্ঞানে বলি হতে কেবল একবারই দেখেছি। ছাগ বলির নিয়মকানুন ছিল বেশ কঠোর। ওই সময় ভয় পেলেও চোখ বন্ধ করা যেত না, এমনকি কাউকে জড়িয়ে ধরাও যেত না। অক্ষয়তৃতীয়ায় কতজন যে দণ্ডী খাটত আমাদের পাড়ায়। কে জানে, কি মনস্কামনা পূরণ করতেন দেবী, যে বৈশাখের তীব্র দাবদাহে মাটিতে গড়াগড়ি খেতে খেতে তাঁর পদতলে গিয়ে পড়ত মানুষ। তেমন তেমন মানত পূরণ হলে বুক চিরে রক্তও দিতে দেখেছি। 


বৈশাখের শনিবার গুলি দখল করতে আসতেন রক্ষাকালী মাতা। প্রায় প্রতিটি রাস্তার মোড়ে পূজিত হতেন খর্বকায়া, ঘোর কৃষ্ণবর্ণা, রক্তচক্ষু, লোলজিহ্বা দেবী। চাঁদা যেমন উঠত, দেবীর উচ্চতাও সমানুপাতিক হারে বাড়ত বা কমত। চাঁদা তোলার ভার থাকত পাড়ার পুঁচকেগুলোর উপর। মাটির সরা হাতে, হাফ প্যান্ট সামলে, কুঁচোকাচারা দৌড়ত  পথচারীদের পিছন পিছন, চাঁদা তুলবে বলে। "ও কাকু/ ও জেঠু, একটা টাকা দিয়ে যাও না।" " ও ঠাকমা/পিসিমা/কাকিমা, রক্ষাকালী পুজো হবে দুটো টাকা চাঁদা দিয়ে যাও না গো।" সস্তা গণ্ডার দিনকাল ছিল। এক টাকা চাইলে, চার বা আট আনা দিত লোকজন। পাঁচ- দশ পয়সাও চাঁদা দিতে দেখেছি আমি। অনেকে তো দিতেনই না। কতবার দেবে আর কতজনকেই বা দেবে। প্রত্যেক গলির মুখেই তো ছেঁকে ধরত কচিকাঁচাদের দল। 


চাঁদা যা উঠত, তাই দিয়েই ধুমধাম করে মাইক বাজিয়ে "রক্ষাকালী মাঈ কি জয়" হত। সেখান থেকেও পয়সা বাঁচিয়ে প্রাপ্তবয়স্ক ভক্তবৃন্দের ইয়ে সেবনের ব্যবস্থা হত। তবে সে সবই হত মধ্যরাত্রে। সকালে উঠে দেখতাম শূন্য মণ্ডপ ফেলে বিসর্জন গিয়েছেন মা। নিরুদ্দেশ মায়ের কারণসেবী বাছারা। পাড়ার কুকুরগুলো কেবল সেদিন একটু বেশি ঘুমাত। বাবা বলত,মাত্রাতিরিক্ত মায়ের প্রসাদ গ্রহণ করে  ভক্তবৃন্দ বমি করেছে, আর সেই বমি ভক্ষণ করে মাতাল হয়েছে পাড়ার সারমেয় কুল।


জ্যৈষ্ঠ মাস মানেই জয় মঙ্গলবার আর দুধ- চিড়ে- মুড়কি-আম -কলার ফলার। পরিবার ভেদে তারতম্য ছিল জয় মঙ্গলবারের সংখ্যায়। আমাদের চাটুজ্জে বংশে যেমন ছিল দুটো আর দিদিভাইদের বাঁড়ুজ্জে বংশে চারটে। আষাঢ়ে রথের পাশাপাশি অম্বুবাচী আর দশহরা। অম্বুবাচীতে ঋতুমতী হতেন বসুন্ধরা। তিনি সুস্থ না হয়ে ওঠা অবধি একাহারী থাকতেন পিতমহী। চার দিন অন্ন গ্রহণ করতেন না বলে থরে থরে ফল আর মিষ্টি দিয়ে যেত সবাই। ঠাকুমা স্বয়ং খেতেন না প্রায় কিছুই, ফল কেটে, মিষ্টি সাজিয়ে ছেলেপুলে, নাতিনাতনিদের মুখের সামনে ধরতেন তিন বেলা। 


দশহরায় ঘুম ভাঙিয়ে কাঁচা দুধ আর কাঁচা উচ্ছে, চিবাতে বাধ্য করত পিসি। নাহলে নাকি মা মনসা ক্রুদ্ধ হন। দশহরার দিন বৃষ্টি হবার প্রতীক্ষায় বসে থাকতাম আমরা, পিসি বলত দশহরা দিন যদি বৃষ্টি না হয় তাহলে সাপের বিষ নাকি ১০ গুন চড়ে যায়। 

আসত যেত বিপত্তারিণীর পুজো, ঠান্ডা উপোস। ভাদ্র মাসে জন্মাষ্টমী, রান্না পুজো, বিশ্বকর্মা পুজো, চাপড়া ষষ্ঠী। মা ষষ্ঠীর প্রতীক হিসেবে, বাটনা বাটার শিলের উপাসনা হত সেদিন। চাপড়া ষষ্ঠী থেকে দিন গোনা শুরু করতাম আমরা। ঠিক এক মাস পরের ষষ্ঠীটা যে দুর্গা ষষ্ঠী। 


আশ্বিন কার্তিক জুড়ে রাজত্ব করতেন দুই দেবী। লুকিয়ে লুকিয়ে আসতেন কার্তিক চন্দর। বুক কাঁপত নববিবাহিত দম্পতিদের, এই বুঝি বাড়ির সামনে কার্তিক ফেলে গেল কেউ। অগ্রহায়ণ মাসে হত নবান্ন, ইতু পুজো। মাটির সরার উপর কয়েকটি ছোট ছোট ঘট বসিয়ে ইতুর উপাসনা হত। রবিবার -রবিবার শাঁখ ঘন্টা বাজিয়ে পুজো করত জেঠু নিজে। একবার ছোটবেলায় খেলতে খেলতে ঐ ইতু পুজোর ঘট দিয়ে সটান আমার নাকে মেরেছিল এক তুতো ভাই। সে কি রক্তারক্তি কাণ্ড। 


পৌষে হত বাউনি, পুলি পিঠে,মাঘে বাগদেবীর আরাধনা,শীতল ষষ্ঠী। ফাল্গুনের দোল, ঘেটু পুজো। ছোট ছোট ছেলে মেয়েরা সং সেজে চাল -আলু আর পয়সা যাচ্ঞা করত।  চৈত্র মাসে বাসন্তী পুজো,অন্নপূর্ণা পূজা, অশোক ষষ্ঠী, রামনবমী আর নীল ষষ্ঠী।


চৈত্র মাসের সংক্রান্তির আগের দিন নীল। নীল অর্থাৎ মহাদেব, তাঁর পাশাপাশি ঐ দিন আমাদের মধ্য হাওড়ায় মা ষষ্ঠীরও উপাসনা করা হয়। আমরা ছোট থেকে দিনটাকে নীল ষষ্ঠী বলেই জানি। ঠাকুমা-পিসি-জ্যাঠাইমা-মা-কাকীমাকে দেখতাম নিরম্বু উপবাস করত নীলের দিন। তবে উপবাসের স্থায়িত্ব ছিল মধ্যাহ্ন অবধি। সূর্য মধ্যগগনে পৌঁছালেই শিবের মাথায় জল ঢালার জন্য হুড়োহুড়ি পড়ে যেত। 


আমাদের ক্ষীরেরতলা মাঠের বুড়ো শিবের সেদিন যে কি খাতির! আজও নীলের দিন মন্দির উপচে পড়ে বিভিন্ন বয়সের সুন্দরী সুসজ্জিতা রমণীতে।  সবার আগে কাঁচা দুধ আর গঙ্গা জলে স্নান করানো হয় বৃদ্ধকে। গলায় পরানো হয় আকন্দ ফুলের মালা। পিনেটের ওপর রাখা হয় বেল সহ পাঁচটা গোটা ফল। কাঁটাওয়ালা ধুঁতরো ফল দেওয়া হয়। ওটা নিয়ে ভোলে বাবা কি করেন উনিই জানেন। এছাড়াও দেওয়া হয় সিদ্ধি পাতা, সন্দেশ, পৈতে ইত্যাদি। ধূপ আর দীপ ও থাকে। যদিও ওগুলো মন্দিরে জ্বালানোর অনুমতি নেই। 


ঠাকুমা কোনদিন মন্দিরে যেত না। বাড়ির পঞ্চাননের মাথায় জল ঢেলেই পূজা সমাপন করত। তারপর লাইন দিয়ে বাতি জ্বালাত। সন্তান - সন্ততি, জামাতা, নাতি-নাতনীদের নামে। একতলার ঠাকুর ঘরটা সেদিন আলোয় আলো। 


সেই হিসেবে মায়ের শুধু আমার নামে বাতি জ্বালানোর কথা। কিন্তু ছোট থেকে মাকে দেখেছি আমার পাশাপাশি বাবার নামে, দাদাদের নামে, দিদিভাই, জামাইবাবু  ইত্যাদি মায়ের যতজন স্নেহভাজন পুত্রকন্যা সমতুল্য লোক আছে মা তাদের সবার নামে বাতি দিত। বাবা মাঝে মাঝে মস্করা করে বলত, "ষষ্ঠীর দিন তুমি খামোখা আমার নামে বাতি জ্বালাও কেন? আমি কি তোমার ষষ্ঠীর বাছা?" বললেই নীল আর ষষ্ঠীর কি একটা জটিল তত্ত্ব শোনাত মা। মোদ্দা কোথায় দেব এবং দেবীর এই বিশেষ দিনে মহাদেবের চরণে সমস্ত প্রিয়জনের নামেই বাতি জ্বালানো যায়।


কত বছর আগে পেরিয়ে এসেছি সেই সব দিন। ভুলে গেছি কত কি। কত দূরে সরে এসেছি নিজের জেলা আর শহর থেকে। আজকাল আর কেউ মফঃ বলে সম্বোধন করার সাহস পায় না। কিন্তু ভিতরে, ভিতরে আজও সেই হাওড়ার মফঃ মেয়েটাই আছি।একদম মায়ের মতই ছটা ষষ্ঠী করি গুনেগুনে। পেশাগত ব্যস্ততার জন্য নীলের দিন মধ্যাহ্ন অবধি নিরম্বু উপবাস করতে পারি না বটে, যত ক্ষণ পারি করি। আর অবশ্যই অবশ্যই বাতি জ্বালাই। প্রচুর বাতি জ্বালাই। সব প্রিয়জনের নামে জ্বালাই। যাদের মধ্যে মা আর পিসিও থাকে। আহাঃ কেউ কোনদিন জ্বালায়নি যে ওদের নামে। প্রতি বছর চিৎকার করে মা আর পিসি, "তিনকাল গিয়ে এককালে ঠেকা এই বুড়ি গুলোর নামে আর বাতি জ্বালাস না বাপু। আর বাঁচতে চাই না।" সে ওরা না চাইতেই পারে, আমি তো চাই। আমার মাথার ওপর ছাতা গুলো আরো বহু বহু বছর টিকে থাকুক। 


আমার বাতিমালায় এবছর একখান বাতি বেড়েছে। শ্রীমতী ফুলঝুরি ধরা ধামে অবতীর্ণ হয়েছেন কি না। বাকিদের জন্য অনেক কিছু প্রার্থনা করলেও এই গুড়গুড়িটার জন্য কি চাই ঠাকুরের কাছে। বড্ড ছোট যে। ভালো থাকুক, সুস্থ থাকুক এটা তো দৈনন্দিন প্রার্থনা। এছাড়াও কিছু তো স্পেশাল চাইতে হয় আজকের দিনে। তাই ভোলে বাবাকে বললাম, সারা বছর আমাদের ফুলু যেন আশ মিটিয়ে দুষ্টুমি করতে পারে। উত্তরোত্তর ডানপিটে হয়। হনুমান যেমন ন্যাজে আগুন দিয়ে লঙ্কা দহন করেছিলেন, ফুলু যেন তেমনি সবার ইয়েতে আগুন ধরিয়ে দিতে পারে।


আজ সকালে, এটা পাঠিয়েছে উমা, "এই যে জেম্মা, দেখো, কি করছে তোমার ফুলঝুরি।সাইকেলের মালকিনকে জোর করে নামিয়ে দিয়ে নিজে কেত দেখাচ্ছে। তোমার বাণী অক্ষরে অক্ষরে মিলে যাচ্ছে, খুশি হও আর কি!" আহা সবই বাবার মহিমা বাবা🙏🏼😝।

অনির ডায়েরি ২০শে এপ্রিল, ২০২৩

 


#অনিরডাইরি #তাম্রলিপ্তকড়চা 

গত বছরেও তো পরিস্থিতি এমন ছিল না। গত বছরেও তো জানতাম না, যে বিধর্মীদের ইফতার দেবার বা ইফতারে অংশগ্রহণ করা অনুচিত। গত বছরেও জানতাম না, যে যারা রোজা রাখে না তাদের জন্য ঈদ মোটেই খুশির উৎসব নয়। তাদের ঈদের খুশিতে শামিল হওয়াও ধর্মীয় অনুশাসন বিরোধী।

আমি বর্ণ হিন্দু, কিন্তু রমজান মাস বা ঈদ আমার কাছেও খুশির উৎসব। ছোটবেলায় মায়ের সহকর্মীদের বাড়ি থেকে আসত ঈদের পাকোয়ান। থাকত ঈদের নিমন্ত্রণ। বড় হয়ে দুই বয়োজ্যেষ্ঠ মুসলিম সহকর্মী পেলাম। তাদের সৌজন্যে আর সংস্পর্শে চার্চ লেনের মাহে রমজানে লাগত সত্যিই চাঁদের ছোঁয়া।

আপিসে নিত্য আলোচ্য ছিল, কে কি সেহেরী খেলেন, রাতের জন্য কার বাড়িতে কি রান্না হচ্ছে, কে কত টাকার ফল কিনলেন, কি কি উপহার কিনলেন ইত্যাদি। উফ কি আনন্দ নিয়েই না আসতো ঈদের সকাল। ঈদের নামাজ পড়েই ফোন করতেন দুই প্রৌঢ়, " ঈদ মোবারক, অনিন্দিতা।" ঈদের পর অফিস খুললেই চলে আসত, নাজিম সাহেবের গিন্নীর হাতে বানানো ঘিয়ে ভাজা মিষ্টি পরোটা আর শাহী চিকেন। সাথে কাজু কিশমিশে লটপট সুতোর থেকেও সরু শিমাই।  পেট ভরে খেয়ে, কৌটো ভরে বাড়ি আনতাম। বিজয়ার দিন তেমনি ঠাকুর জলে পড়লেই ফোন করতে হত আমাকে। বেশি দেরি করলে গোঁসা করতেন নজরুল সাহেব, মুঠো ফোনের ভিতর থেকে ভেসে আসত অভিমানী কণ্ঠস্বর, " ভাবলাম তুমি ভুলেই গেছো বোধহয়।"

লেবার কমিশনারেটের মস্ত বড় অফিসের কোন এক উপেক্ষিত কোণায় বসতাম আমরা তিনজন, ভিন্ন বয়সের, ভিন্ন ধর্মের তিন অভিন্ন হৃদয় বন্ধু। খুব খুব ইচ্ছে করত ওনাদের ইফতার দেবার। না না কারণে আর হয়ে ওঠেনি। সেই অপূর্ণ সাধ মিটিয়েছিলাম তাম্রলিপ্ত নগরীতে এসে।


হক বাবুর জন্য ইফতার আয়োজন করে, আমরা যতটা খুশি হয়েছিলাম, ততোটাই খুশি হয়েছিলেন হক বাবু নিজেও। সকলের অগোচরে বলেই ফেলেছিলেন," ম্যাডাম কোনদিন ভাবিনি, অফিস আমাকে ইফতার দেবে। আজ আমি খুব খুশি।"

এবারেও রমজান মাস পড়তেই শুরু হয়ে গিয়েছিল আমাদের ইফতার পার্টির পরিকল্পনা। তিন নবীন ইন্সপেক্টর সন্দীপ-মনীশ আর শান্তনুর ওপর অর্পিত হয়েছিল ইফতার পার্টি আয়োজনের দায়িত্ব। যদিও অনভিজ্ঞতাবশতঃ শেষ পর্যন্ত প্রায় ম্যাচ ঝুলিয়েই দিয়েছিল ব্যাটারা। ভাগ্যে শ্লগ ওভারে শুভাশিস আর অরূপ ব্যাট করতে নেমেছিল।


যাই হোক আমাদের ইফতার পার্টির দিনক্ষণ স্থির হবার সাথে সাথেই বিভিন্ন মাধ্যমে ভেসে আসতে লাগল একের পর এক বিদগ্ধ মানুষের কলমের অগ্নিবান। ইফতার দেবার অধিকার নাকি আমার নেই। ঈদের খুশিও নাকি আমার জন্য নয়। কোন অ বা অর্ধশিক্ষিত মানুষ বললে হয়তো আমি ভ্রূক্ষেপও করতাম না, কিন্তু ইসলামী শাস্ত্রে পণ্ডিত মানুষজনের বক্তব্য ফেলি কি করে? 


ভীষণ মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল, জানেন। থাকতে না পেরে একদিন অফিস টাইমে জনৈক বিদগ্ধ ব্যক্তিকে ফোনই করে ফেললাম, " স্যার আমাদের এক রোজাদার সহকর্মীর জন্য আমরা সামান্য ফলজলের ব্যবস্থা করতে চাই। সেটাও কি ধর্ম বা নীতিবিরুদ্ধ হবে?" সরাসরি না বললেও প্রশ্নটা যে ওনার খুব একটা মনঃপুত হয়নি বেশ বুঝতে পারলাম। বললেন অভুক্ত সহকর্মীর জন্য ফল - জলের আয়োজন করতেই পারি,তবে তাকে ইফতার নাম না দেওয়াই বাঞ্ছনীয়। 


অনেক ভেবে চিন্তে শেষে হক বাবুকেই একদিন শুধালাম, "হক বাবু এবারেও যদি আমরা আপনার জন্য ইফতার পার্টি থুড়ি সামান্য ফলজলের আয়োজন করি, আপনার আপত্তি নেই তো?" হক বাবু বিস্তর লজ্জা পেয়ে, আসন্ন ঈদ উপলক্ষে সুন্দর টেরি কাটা চুলে বার কয়েক হাত বুলিয়ে বললেন, "আজ্ঞে ম্যাডাম আপনি যা ভালো বোঝেন। তবে নামাজের ওয়াক্ত আজই বিকাল ৫ টা ৫২। বেলা যে রেটে বাড়ছে যেদিন আয়োজন করবেন সেদিন হয়তো নামাজ পড়তে পড়তেই সন্ধ্যে ছটা সোয়া ছটা বেজে যাবে। আপনারা সকলেই অনেক দূরে দূরে ফিরবেন। আমার জন্য সবার বাড়ি ফিরতে রাত হয়ে যাবে, এই আর কি-"।

এ আবার কেমন কথা, আমাদের হক বাবুর জন্য আমরা একটা দিন দেরি করে বাড়ি ফিরতে পারবো না?

হাতে সময় ছিল খুব অল্প। রাত পোহালেই হয়তো দেখা যাবে ঈদের চাঁদ। সাধারণত ঈদের আগের দিনটা ছুটি নেন হক বাবু, কি ভাগ্যি এবারে নেন নি। আমাদের হক বাবুর জন্য, ঝটপট রাধামণি বাজার থেকে বেছে বেছে ফল কিনে আনল অরূপ।  আনা হল কুচানো আদা আর ভিজে ছোলা। নিচের ক্যান্টিন থেকে আনানো হল, টক দইয়ের সাথে কুচানো বাদাম আর মরিচ গুঁড়ো মেশানো ওদের সেই বিখ্যাত লস্যি। গত বার বিদ্যুৎ বেকারি থেকে আনা হয়েছিল পুদিনা দেওয়া আলুভাজা আর কাঠি কাবাব। কিন্তু আপাতত জেলাধীশের নির্দেশে, নিমতৌড়ির এই প্রশাসনিক চত্বর থেকে পাততাড়ি গোটাতে হয়েছে বিদ্যুৎ বেকারিকে। ফলে লোকাল দোকানের এগ চিকেন রোল আর চিকেন পকোড়াই জোগাড় করতে পেরেছিলাম আমরা। আয়োজন হয়তো খুবই সামান্য, কিন্তু উৎসাহ, আন্তরিকতা, ভালোলাগা আর ভালোবাসাটুকু ছিল একেবারে নিখাদ।


 জানিনা ধর্মীয় অনুশাসন অনুযায়ী কোনটা সঠিক, কোনটা বেঠিক। স্বধর্ম বা পরধর্ম কারো বিন্দুমাত্র অসম্মান করার ইচ্ছা বা সামর্থ্য কোনটাই আমার নেই। আমি শুধু জানি জীবন বড় সংক্ষিপ্ত। আজ টক্কা, তো কাল সব ফক্কা। যে কয়দিন থাকি, যেখানেই থাকি কিছু ভালো স্মৃতি তো রেখে যাই।

Friday 14 April 2023

অনির ডাইরি ১৩ই এপ্রিল, ২০২৩

 

#অনিরডাইরি 

 আর পারি না গুরু, সেই নার্সারি থেকে শুরু। " খাওয়া কমাও, এক্সারসাইজ করো। রোগা হও,ওজন কমাও।" প্রথমে ছিল, রোগা না হলে বিয়ে হবে না। জিভ সুড়সুড় করত মাইরি, বলার জন্য, " আমার বিয়ে হবে, কি হবে না, তাতে তোমার বাবার কি?" নেহাৎ আমার মায়ের shoe- শিক্ষার ভয়ে বলতে পারতাম না। একবার ছেড়ে দুই -দুই বার বিয়ে হল। হ্যাঁ বলতে পারেন পাত্র একটাই ছিল।সেটা শৌভিকের কপাল। দ্বিতীয় বিয়ের ফুলশয্যার আগেই বাবাকে শোনানো হল, "ওজন টা বড় বেশি। কনসিভ করতে সমস্যা হবে।" কি ভাবছেন,শ্বশুর বাড়ির কেউ বলেছিল? আজ্ঞে না। নিকটাত্মীয় শুভাকাঙ্ক্ষীরাই শুনিয়েছিল। ধুমসি মেয়েকে নিজের ঘাড় থেকে নামিয়ে, শৌভিক এর মাথায় চাপিয়ে কোথায় বাবা একটু স্বস্তির নিশ্বাস নেবে, তা নয়, গেল সব শান্তি চটকে। 

চিরকেলে নাস্তিক লোকটা, মাথা নত করল সর্ব শক্তিমানের সামনে। নাস্তিকদের ভগবান বোধহয় একটু বেশিই ভালোবাসেন। এত দ্রুত ফল দিলেন, যে খবরটা পেয়ে শৌভিক আর আমি স্তব্ধ হয়ে গেলেও, বেতো হাঁটু নিয়ে কি নাচটাই না নেছেছিল বাবা। তার নজদগজনী (জগজ্জননীর অপভ্রংশ) আসছে। 


যাক, বিয়ে হল। মেয়ে হল। মোটা হলে ওই সব হয় না, বলে কেউ আর খোঁচাতে পারল না। রাস্তা বদলে তাঁরা বলতে লাগলেন, "ওজন না কমালে, বয়স হলে কষ্ট হবে। শরীরে বাসা বাঁধবে নানা রোগ আর ব্যাধি। তাই খাওয়া কমাও। এক্সারসাইজ করো। " যাঁরা বলতেন তাদের মধ্যে যেমন আত্মীয় স্বজন ছিল, তেমনি ছিল বন্ধুবান্ধব, সহকর্মী, এমনকি জনা কয়েক ডাক্তার বাবু ও। দশ থেকে বিশ হলাম, বিশ থেকে তিরিশ হয়ে চল্লিশ ও পেরিয়ে গেলাম। যাঁরা বলতেন, তাঁরা যে সবাই তন্বী বা সুঠাম ছিলেন তা কিন্তু ভাববেন নি। তো যাই হোক, আজকাল তেনাদের যার সঙ্গেই দেখা হোক না কেন, দেখি তিনিই ঘায়েল। সুগার, প্রেশার, কোলেস্টরেল, গেঁটে বাত, বগলে ফোঁড়া, অস্থানে অর্শ, ভগন্দর (যদিও জানিনা বস্তুটি কি। ইয়ে জানতেও চাই না) নিয়ে কাবু। কয়েকজন তো ইহলোক ত্যাগই করেছেন। বাকিরা হোটেলে খান না, মদ খান না, গাঁজা খান না, লাল মাংস খান না, তেল খান না, মশলা খান না, ভাজাভুজি খান না,মিষ্টি খান না। ভগবান জানেন কি খান। আমি কিন্তু ঈশ্বরের আশীর্বাদে একই আছি।


 তাই বলে অজর নই। বয়স বাড়ার সাথে সাথে সবথেকে তন্বী বন্ধুটির দেহেও যেমন অলক্ষে বাসা বাঁধছে জরা, আমারও তেমনি। মোটা বলে গুণোত্তর প্রগতিতে কিন্তু কিছু হচ্ছেনা।  তাই মাঝে মাঝে রাগ হয় জানেন, প্রচুর রাগ হয়। আর মনে মনে ভাবি, যাঁরা এককালে আমাকে কম খেতে বা তেল মশলা, ভাজাভুজি, মিষ্টান্ন ইত্যাদি খেতে নিষেধ করতেন, বা এখনও সুযোগ পেলেই করতে চান, তাদের সামনে, তাদের দেখিয়ে দেখিয়ে একদিন স্বর্গীয় বনফুলের প্রিয় খাবারটা খাব।  বিশেষ কিছু না, হাঁসের ডিমের তেল গরগরে কষা। রেওয়াজি খাসির মাংসের তেল ঝাল। যাতে এক ফোঁটাও তে জল থাকবে না। কেবল তেল আর কাঁচা এবং শুকনো লঙ্কার ঝাল। সঙ্গে গোটা আষ্টেক মুচমুচে আটার পরোটা। আর শেষ পাতে চার খানা রাজভোগ। তারপর মরি তো মরব, সে মরণ ও হবে স্বর্গ সমান।

Tuesday 11 April 2023

অনির ডায়েরি ১১ই এপ্রিল, ২০২৩

 

#অনিরডাইরি #তাম্রলিপ্তকড়চা 


মাঝে মাঝে ভাবি এই চাকরিটা যদি না পেতাম কি আলুনিই না হত আমার জীবনটা। কত অভিজ্ঞতা থেকেই না বঞ্চিত হতাম। স্কুল কলেজ জীবনের মতো কুয়োর ব্যাঙ হয়েই থেকে যেতাম হয়তো।

              সেদিন তিরিশে মার্চ, অফিসে সাজো সাজো রব। পরের দিন শেষ হচ্ছে অর্থ বর্ষ। আর ঠিক তার পরের দিনই শুরু হতে চলেছে দুয়ারে সরকার। এরই মধ্যে গুচ্ছ গুচ্ছ নালিশের ডালি নামিয়ে দিয়েছে মহানগর। যার অধিকাংশই শ্রম দপ্তরের সঙ্গে সম্পর্ক বিহিত। জনে জনে ফোন করা এবং তথ্য নথিভুক্ত করার কাজ চলছে পুরো দমে। সবার উপর মহড়া চলছে আমাদের নাটকের। 


সেদিনই অপরাহ্নে তমলুক ব্লকের ভুবনকালুয়া প্রাথমিক স্কুলে শ দুয়েক বাচ্ছার সামনে মঞ্চস্থ হতে চলেছে, আমাদের শিশু শ্রমিক বিরোধী নাটক,'সেই সব ফুলেরা'। বড় সাহেব জানিয়েছেন হাজির থাকবেন তিনিও। ফলে আক্ষরিক অর্থেই উত্তেজনার পারদ ঊর্ধ্বগামী।


এরই মধ্যে সঞ্জয় এসে খবর দিল,' ম্যাডাম একটা খুব খারাপ খবর আছে।' আপাতত সারা বিশ্ব জুড়ে সর্বত্র তো খারাপই খবর, ভালো আর কোথায় পাই। তবুও দম চেপে বললাম, বলে ফেলো। সঞ্জয় জানাল, অমুকের পিতৃবিয়োগ হয়েছে। বড় ব্যক্তিগত ব্যাপার, তাই নামটা উহ্যই থাকুক ছেলেটার। সঞ্জয় আরো বলল, "আপনাকে বা অফিসে কাউকে বলতে নিষেধ করেছে। বলেছে সবাই এত চাপের মধ্যে আছে, নাটক পর্ব মিটুক তারপর বলো।,"

সে কি! কালই তো একসাথে ফিরলাম তিন জনে, আমি, উত্তমকুমার আর সে। গোটা রাস্তা পুকুর মারার গল্প শোনাতে শোনাতে নিয়ে গেল উত্তমকুমার। জল কমে গেলে, কৈ মাছের দল কেমন করে পুকুর ছেড়ে গুড়গুড় করে পালিয়ে যায়, শোল মাছ কেমন করে লাফায়, আরো কত কি শিখলাম দুজনের থেকে। ছেলেটা আমায় আমচুর বানানো আর তেল বিহীন মুরগীর মাংস রান্নার রেসিপি শেখাল। এত খাবারদাবারের গল্প শুনে ক্ষিদে পেয়ে যাওয়ায়, মারিশদায় গাড়ি থামিয়ে চপ কেনা হল। আর রাত না পোহাতেই এত বড় অঘটন।


এসব খবর কি আর গোপন রাখা যায়। সঞ্জয় আমাকে বলল, আমি প্রথমে বললাম সৌরভকে, তারপর শুভাশিসকে, তারপর সেকশনে গিয়ে সবাইকে। জনে জনে বলি, আর বলি, "বিকালের আগে কাউকে বলো না যেন।"


দুপুর গড়িয়ে বিকেল, বিকেল ঢলে সন্ধ্যায়। নাটক শেষে, অফিসের পাট চুকিয়ে, বাড়ির পথ ধরি আমি। মনটা খচখচ করে, এমন দিনে পাশে দাঁড়াতে হয়। গিয়ে দাঁড়াতে না পারি একটা ফোন তো করা উচিৎ। ফোন করলাম, ওপাশ থেকে ছেলেটির দিদি ধরে বলল, এখনো অন্তিম সংস্কার মিটিয়ে ফিরতে পারেনি ছেলেটি।


কি সব ধুমধাড়াক্কা গান শুনছিল উত্তমকুমার, বললাম, জানো অমুকের পিতৃবিয়োগ হয়েছে। স্বভাব সিদ্ধ হড়বড় করে উত্তমকুমার বলল, "হায় যা! মারা গেছেন?" তারপর বলল, " তা ওরা দাহ করে নাকি, গোর দেয়?" ক্ষুব্ধ ভাবে বলি, ধ্যাৎ হিন্দুদের গোর দেয় নাকি। উত্তমকুমার জোর গলায় বলে, " হ্যাঁ। ওরা দাস তো। দাস মানেই বোষ্টম। বোষ্টমদের কেউ মারা গেলে মাটিচাপা দেয়। হায়, অমিয়দা দিয়েছেননি। বাড়ির পাশেই ওদের একটুকরো জায়গা আছে, ওখানেই ওর ঠাকুরদা, ঠাকুমা আর দাদাকে মাটি চাপা দিয়ে রেখেছে।"

অমিয় বাবু আমাদের গাড়ি মালিক। যার সাথে বিল নিয়ে নিত্য ঝগড়া আমাদের। মাঝে মাঝেই ডেকে চমকাই, এত বিল কেন উঠলো, টাকা দেবো কোথা থেকে? ৩১শে মার্চ ছিল তেমনি একটা দিন। অমিয় বাবুর বকা খাবার দিন। শুকনো মুখে যেই অমিয় বাবু এসে বসলেন, অন্যান্য বারের মতোই ধমকাতে গিয়ে থেমে গেলাম। "এই আপনাদের কবর দেয়?" উনি জিভ কেটে, কান ছুঁয়ে বললেন, "কবর নয়, সমাধি। আমরা বৈষ্ণব তো, মৃত্যুর পর আমাদের সমাধি দিতে হয়। তারওপর মন্দির করা হয়। তুলসী গাছ লাগানো হয়। নিত্য ফুল,জল,ধূপ পড়ে। মৃত্যুবার্ষিকীর দিন হরিনাম সংকীর্তন হয়।" 


দুয়ারে সরকারের প্রাথমিক ধাক্কাটা সামলে, একদিন সন্ধ্যায় ছেলেটার বাড়ি গিয়ে হাজির হলাম উত্তমকুমার আর আমি। তমলুক ছেড়ে বেরোনোর আগেই ফোন করে ঠিকানা জোগাড় করে নিয়েছিল উত্তম। কাঁথি বাজার থেকে বাইকে আরো মিনিট বিশেক লাগে। কাছাকাছি পৌঁছে ফোন করে দিলে, বাইক নিয়ে নিতে আসবে ছেলেটি।

ঠিক ছিল দুপুর দুপুর বেরোব। সঞ্জয় আর রঞ্জিত ও সঙ্গে যাবে। শেষ বেলায় ভিসির দাপটে তা আর হল না। অফিস ছেড়ে বেরোতে ঘনিয়ে গেল সন্ধ্যা, এমনকি রাত্রিও। একা যাওয়া নিয়ে সামান্য দোনামোনা ছিল। উত্তম বলল, " চলেন ম্যাডাম আমরাই ঘুরে আসি। অন্য স্যারদের এখন সময় বার করা চাপ। আর কবে যাবেন, কাজ তো এসেই গেল দেখতে দেখতে।"

পথে গল্প শোনাতে শোনাতে নিয়ে গেল উত্তমকুমার, ওরাও আদতে বৈষ্ণব। যদিও দাস নয় এবং উত্তম সর্বভূক। ওরও প্রপিতামহ, প্রপিতামহী এবং ঠাকুমাকে সমাধি দেওয়া হয়েছে। তার ওপর মন্দির বানিয়ে নিত্য ধূপধূনা পড়ে ইত্যাদি, সেই জমিটা ওদেরই ভাগে পড়েছে। ইদানিং কেউ মারা গেলে আর সমাধি দেওয়া হয় না। একে তো জায়গা মেলে না, তার ওপর গ্রামের মানুষও আপত্তি করে। আপত্তি করে পঞ্চায়েত ও।


রাত ঘন হয়। ছেলেটা ফোন করে বার কতক। কে, কে আসছে, কতদূর পৌছালাম। রূপসী মোড় পৌঁছে যেন অবশ্যই ফোন করে দেয় উত্তম। রাত হয়ে গেছে বলে ছেলেটা বের হতে পারবে না। কাউকে পাঠিয়ে দেবে। শুনতে শুনতে অপরাধবোধ হয়। খামোখা সামাজিকতার নামে অত্যাচার করতে চলেছি আমরা। বলি আসার দরকার কি? লোকেশনটা পাঠিয়ে দিলেই তো পারে। উত্তমকুমার ধাঁইধাপ্পড় গান বন্ধ করে বলে," যেতে পারবেননি ম্যাডাম। গাড়ি যাবেনি। গেরামের ঢালাই রাস্তা। এদিক ওদিক বাঁকতে হয়। এই অন্ধকারে গাড়ি নিয়ে যাওয়া যাবেনি। টোটো ধরতে হবে।''


শহর ছেড়ে পঞ্চায়েত এলাকায় ঢুকি আমরা। স্থানীয় বাজার থেকে, বাইক নিয়ে এক ভদ্রলোক পথ দেখিয়ে নিয়ে যান আমাদের। ঢালাই রাস্তার সামনে গাড়ি রেখে, টোটোয় চাপি উত্তম কুমার আর আমি। দুদিকে অন্ধকার মাঠ, মাঝখান দিয়ে সাপের মতন আঁকাবাঁকা রাস্তা। মাঠ থেকে উঠে আসছে প্রাণ জুড়ানো শীতল হাওয়া। বৃদ্ধ টোটোওলা রেসিং কারের মতো চালাচ্ছেন, ঝাঁ করে এই বাঁদিকে বাঁকল, তো এই ডান দিকে বাঁক। "ও মা গো" চিৎকার করে উঠলো উত্তম। বেটা নিজে স্পাইডারম্যানের মতন চালায়, আর অন্য লোকের হাতে স্টিয়ারিং থাকলেই ভয় পায়।


বিশাল বাগান দিয়ে ঘেরা একতলা বাংলো প্যাটার্নের বাড়ি। টোটো থেকে নেমে,বাগানের মধ্যে দিয়ে হেঁটে যেতে হয় বাড়ি অবধি। রোয়াকে আলো জ্বলছে, সেই আলো বাগানের পায়ে চলা পথে তৈরি করেছে আজব আলোছায়ার নক্সা। কাছা গলায়, ছেলেটি এগিয়ে এলো, " আসুন। আসুন।আমিই যেতাম। রাত হয়ে গেছে, বেরোনোর নিয়ম নেই, তাই দাদাকে পাঠালাম। উনি আমার দিদির দেওর। বহু বছরের আত্মীয়তা। বাড়ির আরেকটা ছেলে বলতে পারেন। আমাদের তো আর কেউ নেই।" 


বলল বটে, কেউ নেই, বাড়ির ভিতরে ঢুকে ছেলেটি, তার সুন্দরী গিন্নি, পুচকে মামনি ছাড়াও পেলাম কাকা, কাকিমা, খুড়তুতো ভাই এবং তার পরিবারকে। ভাইটিও কাছা নিয়েছে। এছাড়াও দিদি-জামাইবাবু- ভাগ্না- ভাগ্নীরা আছে। যদিও তাঁরা সেই মুহূর্তে ওই বাড়িতে নাই, তাও আছে তো। এত লোকবল আজকালকার দিনে কটা লোকের থাকে বাপু।তীব্র শোক মানুষকে বড় নিঃসঙ্গ আর বিপন্ন করে তোলে।


আমরাও মার্জনা চাইলাম, এসে বোধ হয় আতান্তরে ফেলেছি ছেলেটাকে। বেশ খানিকক্ষণ বসলাম। ছেলেটির শোকসন্তপ্ত মায়ের সাথে দুটি কথা হল। কথায় কথায় চোখ ছাপিয়ে যাচ্ছে ওনার। নাহলে নীরব, আনমনা হয়ে পড়ছেন। তারই মধ্যে কথা প্রসঙ্গে জানালেন, ওনারা সত্যিই বৈষ্ণব। আদতে ছিলেন সামন্ত। ঊর্ধ্বতন কত নম্বর পুরুষ যেন মহাপ্রভুর শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন।দাস বংশে সরাসরি সমাধি হয়না। দাহ হয়। তারপর সেই দেহাবশেষের কিছুটা অংশ রূপার কৌটো করে সমাধি দেওয়া হয় আর বাকিটা গঙ্গায় বিসর্জন।


বেরিয়ে আসার সময়, ভদ্রমহিলা হাত ধরে বললেন, "এসো কিন্ত,  কাজের দিনে।" যাব বলে তো এলাম, কিন্তু যাই কি করে? এই গা জ্বালানো গরমে ইন্সপেক্টর সাহেবরা সবাই তো দুয়ারে সরকারের স্ট্যাটিক আর মোবাইল ক্যাম্প পরিদর্শনে ব্যতিব্যস্ত। ফাঁকা নেই একটাও সিকেসিও। শেষ পর্যন্ত অবশ্য তড়িঘড়ি ক্যাম্প গুটিয়ে সঙ্গী হল সঞ্জয় আর রঞ্জিৎ। আর গেল অরূপ। এবার বেলাবেলি আমরা গিয়ে পৌঁছলাম সেই ঢালাই রাস্তার ধারে। আগের বারের মতোই দাঁড়িয়ে ছিল টোটো। ছুটল সরু আঁকাবাঁকা সরণী ধরে। দুদিকে যতদূর চোখ যায় ফসল তুলে নেওয়া ধুধু মাঠ আর শুকিয়ে আসা পুকুর।

সেই মস্ত বাগান ঘেরা একতলা বাংলো প্যাটার্নের বাড়ি। আজ যদিও মোড়া সামিয়ানা আর রঙিন কাপড়ে। একদিকে চলছে শোক সভা। একটি দেব মূর্তি দাঁড় করানো আছে। উত্তম বলল, " গৌরাঙ্গ ঠাকুর"। অষ্ট প্রহর হরিনাম সংকীর্তন হয়েছে। বর্তমানে চলছে স্মৃতিচারণার পালা। স্বর্গীয় ভদ্রলোকের পরিচিত পরিজন বন্ধু-বান্ধব শুভানুধ্যায়ীরা সোচ্চারে বলে চলেছেন তাঁর সঙ্গে কাটানো বিভিন্ন অমূল্য মুহূর্তের কথা। ছেলেটির মা বসে আছেন এক্কেবারে সামনের আসনে। গালে হাত দিয়ে শুনছেন পরলোকগত স্বামীর স্মৃতিচারণ। ছেলেটি বলল একটু বাদে ভিড় আরো বাড়বে। স্কুলের পরীক্ষা শেষ হলেই এসে হাজির হবে স্থানীয় স্কুলের শিক্ষকবৃন্দ। 


শোকসভা থেকে বেশ খানিকটা দূরে বাড়ির ভিতরে বসলাম আমরা। বাড়ি ভর্তি নিমন্ত্রিত, তাও বারবার এসে তত্ত্বতলাশ করে যাচ্ছেন জনে জনে। তিন রকম ঠান্ডা পানীয়র গ্লাস ধরা হল প্রত্যেকের মুখের সামনে। ছেলেটি বারংবার ক্ষমা চাইছিল, গরমটা বড্ড বেশি বলে। গরম সত্যিই, কিন্তু এত খোলামেলা বাড়ি, চারিদিকে যতদূর চোখ যায় গাছপালা আর পুকুর, ফলে আমার কিন্তু সত্যিই গরম লাগছিল না।


ছেলেটা বলতে গেলে আমাদের ছেড়ে নড়লই না। রকমারি ব্যাপারে কথা বলছিলাম আমরা, ইতিমধ্যে কেউ মেসেজ পাঠাল জায়গা খালি। প্রায় তাড়িয়ে নিয়ে গিয়ে খেতে বসালো ছেলেটি আর তার সুন্দরী সহধর্মিণী। বাগানের মধ্যেই বিশাল ম্যারাপ বাঁধা। সারি সারি পাখা ঘুরছে। এক লপ্তে অন্তত ৬০ জন একসাথে খেতে বসতে পারে। ঘুরন্ত পাখার তলায় জায়গা রাখা ছিল আমাদের।ছেলেটি, ওর গিন্নি,তুতো দাদা, ভাগ্নে সবাই মিলে চক্রবুহ্যের মত ঘিরে ধরে আকণ্ঠ খাওয়ালো আমাদের।


 বৈষ্ণব বাড়ির শ্রাদ্ধ বাসর, সবটুকুই নিরামিষ এবং সবটুকুই স্বাদে এবং গন্ধে অমৃত। প্রথমে এল ভাজা পিঠের মাপের পকোড়া। তারপর ঘি চপচপে পোলাও, কাজু আর কিশমিশে লটপট। মাখন মাখন গন্ধওয়ালা পনীরের কারি।কচি কাঁচকলা, বড়ি আর সজনে ডাঁটা দেওয়া মিষ্টি মিষ্টি শুক্তো। গরম গরম সুগন্ধী চালের ভাত, পরিবেশনকারীর ভাষায়," অন্ন"। অসম্ভব গরম এবং ততোধিক সুগন্ধি মুগের ডাল। পোস্ত মাখানো মুচমুচে আলুভাজা। আলুগুলি গোল বা লম্বা নয় বরং ছোটছোট চৌকো -চৌকো করে কাটা। এঁচোড়ের তরকারি। ধোঁকার ডালনা। মুখে দিতেই মিলিয়ে গেল ধোঁকাটা। এক পলকে ফিরে গেলাম নিজের মেয়েবেলায়। এত আমার জ্যাঠাইমার হাতের ধোঁকা। অবিকল এমন ধোঁকা বানাতেন স্বর্গীয়া কল্পনা চট্টোপাধ্যায় ওরফে ডলু ওরফে আমার জ্যাঠাইমা। বাইরে থেকে মুচমুচে, অথচ মুখে দিলেই মাখন। জ্যাঠাইমা চলে যাবার পর, এত ভালো ধোঁকা আর খাইনি। পেটে যদি জায়গা থাকতো তাহলে অন্য কিছু না খেয়ে শুধু ধোঁকাই খেতাম আশ মিটিয়ে। 


ধোঁকা পর আমের চাটনি। এই জেলার লোকেদের বিশেষত কাথি মহকুমার বাসিন্দাদের টকের প্রতি প্রবল আসক্তি। মিষ্টি চাটনি বেশ দুর্লভ এখানে। কিন্তু এই চাটনিটা দেখলাম বেশ মুখরোচক মিষ্টি। সাথে পাঁপড়। তারপর পরমান্ন। পায়েস ব্যাপারটা আমি রাঁধতে ভালোবাসলেও, খেতে মোটেই পছন্দ করি না। কিন্তু এই পায়েসটা অতুলনীয়। ভালো পায়েসের প্রথম এবং প্রধান শর্ত হল দুধ এবং চালের অনুপাত। দুধ বেশি, চাল কম। সেই সূত্র অনুসারে বলতে হয় এই পায়েসটাতে কেবল দুধই ছিল। চাল নামমাত্র। চিনির পরিমাণ প্রায় শূণ্য। ঘন দুধের স্বাভাবিক মিষ্টত্বতেই হয়ে উঠেছে, পরম অন্ন। 


খেয়ে, হাত ধুয়ে, টোটোর সওয়ারি করে উত্তমকুমারের গাড়িতে উঠে পড়লাম, তাও কাটল না, পায়েসের খোয়ারি। আহা কি খাইলাম। গ্রামের খাঁটি গরুর দুধের পায়েস কিনা। ফুল ক্রিম মিল্ক বলেই নির্ঘাত এত সোয়াদ। খোয়ারি কাটল উত্তমকুমারের বচন শুনে, ‘গরুর দুধ কোথায় পেলেন ম্যাডাম? গাঁ গেরামে যত গরু আছে সবার কোন না কোন মিষ্টির দোকানর সাথে লাইন করা আছে জানেন নি? দুধ ওই দোকানকেই দিতে হবে।না দিলে তারা মিষ্টি বানাতেই পারবেনি। এর বাইরে দু চার কেজি দুধ হয়তো বলে রাখলে এদিক উদিক পেতে পারেন। এত দুধ আবার হয় নাকি? ও দেখেন গে আমূল দুধ দে’ই বানিয়েছে।’ তাজ্জব হয়ে গেলাম, গ্রামে আজকাল আর দুধ মেলে না? সেখানেও কব্জা জমিয়েছে আমূল? আর গরু গুলো লাইন মারতে যায় মিষ্টির দোকানে! নাহ্ মশাই, এই বদলির চাকরি যদি না করতাম, জেলায় জেলায় না ঘুরতাম, কত অভিজ্ঞতা থেকেই না বঞ্চিত হতাম। কি আলুনিই না হত জীবনটা।

Sunday 9 April 2023

অনির ডায়েরি ৮ই এপ্রিল, ২০২৩

 

#অনিরডাইরি #হাওড়ারকথা




মনস্থ করেই বেরিয়েছি, আজ হাওড়া যাবই। পৃথিবী উল্টে গেলেও যাব। আমি না গেলে পেনশনটাও তুলতে পারেনা মা আজকাল। সংসার চলবে কি করে? বয়স বাড়ার সমানুপাতিক হারে কমেছে দৈহিক শক্তি আর গুনোত্তর প্রগতিতে কমেছে মানসিক জোর। সবকিছুতেই আজকাল, "অ্যাই মানা-", বলে বসে থাকে মা। মানা আমার বাবামায়ের দেওয়া সাধের ডাক নাম।

 

গতবার মাকে নিয়ে পেনশন তুলতে গিয়ে যা কাণ্ড হল। আধ বেলা ছুটি নিয়ে গিয়েছিলাম।ভেবেছিলাম মাকে নিয়ে গিয়ে পেনশন তুলে বেলা বারোটার মধ্যে বাড়ি ফিরে আসতে পারব। সাড়ে বারোটা নাগাদ যদি বেরোই রাস্তাটাও ফাঁকা পাব। দুটোর মধ্যেই পৌঁছে যাব অফিস।


সেই মতো ভোর ভোর উঠে, স্নানাদি সেরে, আমরা তো বেলা সাড়ে দশটার মধ্যে রেডি, বিশ্বাসঘাতকতা করল রিক্সাটা। আমাদের মধ্য হাওড়ায় ইদানিং টোটোর দাক্ষিণ্যে রিক্সা বড় দুর্লভ। দশ টাকা টোটো ভাড়া দিয়ে যেখানে ঘোরা যায়, কেন লোকে ৪০/৫০ টাকা রিক্সা ভাড়া দেবে?


তাও ছিল মায়ের "কাশী"। আমার থেকে একটু বড় একটা লোক, ফোন করলেই চলে আসত, যতক্ষণ দাঁড় করিয়ে রাখত বাবা বা মা দাঁড়াতো, একদম ঘরের সামনে থেকে তুলত এবং নামাত। দরকারে বাবার হাত থেকে বাজার ব্যাগটা নিয়ে নিজেই বাড়ি পৌঁছে দিত। জীবনেও মুখ ফুটে ভাড়া চাইত না। যা দিত বাবা বা মা এমনকি আমিও,  কপালে ঠেকিয়ে বলত, " এত দিলে কেন?"


কাশী থাকতে অফিস ফেলে ছুটতে হত না আমায়। মা আর গুটি কয়েক স্কুলের বাচ্ছা ছাড়া ইদানিং তেমন ভাড়া জুটত না বলে, সম্প্রতি রিক্সা চালানো ছেড়ে কারখানায় কাজে লেগেছে কাশী। ফলে মা পড়েছে আতান্তরে। অগত্যা সবেতেই, "অ্যাই মানা-"।


আমার ছোট্টবেলার এক পাড়াতুতো বন্ধুকে, অবশ্য খুঁজে বার করেছে বাবা।সে এখনও রিক্সা টানে। তবে যাত্রী বহন করে না। স্থানীয় কারখানার মালমশলা দেওয়া নেওয়া হয় তার রিক্সায়। আগেভাগে জানিয়ে রাখলে, ফাঁকেফোকরে মায়ের কাজটাও করে দেয় সে। এই আগে জানানোটাই হয়নি সেবার মায়ের। দোষ অবশ্য পুরোপুরি মায়ের নয়। ইদানিং সরকারি দপ্তর গুলির ওপর এমন হঠাৎ হঠাৎ বেমক্কা চাপ চলে আসছে, আমি নিজেই জানতাম না কবে যেতে পারব। হুট করেই গিয়ে পৌঁছেছিলাম আগের দিন সন্ধ্যায়। দীর্ঘদিন বাদে একমাত্র দুহিতাকে কাছে পেয়ে, ফোন করার কথা মনে ছিল না মায়ের। আমারও ছিল কি?


সেদিন সকাল দশটা নাগাদ যখন ফোন করেছে মা,  বন্ধুবর বলল, " ইশ্ জেঠিমা, তুমি আগে বলোনি! আমি তো মাল নিয়ে বালটিকুরি চলে এসেছি গো। কাল নিয়ে যাব পাক্কা। আজকের দিন টা একটু ক্ষমা ঘেন্না করে দাও প্লিজ-"। 


সকাতর দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে ছিল মা, যদি পিছানো যায় আজকের অ্যাডভেঞ্চার থুড়ি পেনশন তোলা।  আমিও নিরূপায়। জনমানসে সরকারি দপ্তর বা সরকারি কর্মচারীদের যে চিত্রই থাকুক না কেন, বাস্তব বড়ই নিঠুর। বিশেষতঃ ফিল্ডঅফিস গুলোতে, সুস্থ শরীরে পরপর দুইদিন অফিস কামাই করা আপাতত অসম্ভব। বললাম, "চলো না। গলির মুখ থেকে হাজার হাজার টোটো পাব।" সেটা মার্চ মাস। গরমটাও এমন তীব্র নয়, ঠিক পারবে মা।

ভোকাল টনিক খাইয়ে রাস্তায় তো বার করলাম, মা আর নড়তেই পারে না। সদর দরজা থেকে বেরিয়ে গলিপথ ধরে এক মিনিট লাগে চওড়া রাস্তায় পৌঁছতে, শেখান থেকে তিন মিনিট হাঁটলেই রাজপথ। সেখানে বসে টোটোর মেলা। এক মিনিটের পথটাই মা নিলো পাক্কা তিন থেকে চার মিনিট। 


মাঝারি রাস্তায় উঠে লোলুপ দৃষ্টিতে এদিক ওদিক তাকায় মা, একটাও রিক্সা গোচর হয় না।" উরি, উরি বাবা" করতে করতে আরো খানিক এগোই দোঁহে। ক্ষীরেরতলা মাঠের বুড়ো শিবের মন্দিরের উল্টোদিকে, আচমকা হয়তো দেবাদিদেবের মহিমায় আবির্ভূত হয় একখানি টোটো। ঠেলে দেয় মা। "যা গিয়ে দেখ, কদমতলা পোস্টঅফিস যাবে কিনা!" 


বাধ্য ছাত্রীর মত এগিয়ে যাই আমি। কটকটে লাল পোলো নেক গেঞ্জি পরে, ঘোর কৃষ্ণ বর্ণ, থলথলে টোটোওয়ালা আমাকে এগিয়ে আসতে দেখে সোজা হয়ে বসে। পোস্টঅফিস বললে নির্ঘাত যাবে না, তাই বলি, "কদমতলা বাজার যাবে, ভাই?" ছেলেটি মিষ্টি করে হেসে বলে, " ভাড়া আছে গো দিদি। দুটো বাচ্ছাকে নিয়ে যাব।" তারপর খানিক কি ভেবে বলে, " আচ্ছা চলো, একটু ঘুরে যেতে হবে কিন্তু।"


এই মুহূর্তে অস্ট্রেলিয়া ঘুরে যেতে বললেও নির্ঘাত রাজি হয়ে যাবে মা। ইশারায় ডাকি মাকে। ৩২ টা বাঁধানো দাঁত বার করে (এটা লেখার জন্য, নির্ঘাত এই বুড়ো বয়সে চপেটাঘাত প্রাপ্য আমার) দৌড়ে আসতে চায় মা। বাস্তবে যদিও সামান্য নড়ে মা। হাত ধরে টেনে আনবো বলে এগিয়ে যাচ্ছি, টোটোওয়ালা ছেলেটি জানতে চায়, " মা?"  সম্মতি পেয়ে বলে, " দাঁড়াতে বলো। দাঁড়াতে বলো। আমি আসছি।" টোটো এগিয়ে আসে, উল্টোদিক থেকে ছুটে আসেন দুটি ফুটফুটে বাচ্ছা সমেত দুই মা। আমরা একটু থতমত খাই, আমরা একটু অপ্রস্তুত হই। বোকার মত হাসি। টোটোটা তো ওঁরাই বুক করিয়েছিলেন, আমরাই উটকো আপদ। ভালো চওড়া সিটটা ওদের জন্য ছেড়ে, ড্রাইভারের পিছনের অপেক্ষাকৃত সরু সিটটায় বসতে উদ্যত হয় মা।


হাঁ হাঁ করে ওঠে দুজনে,"জেঠিমা, আপনার এদিকে বসতে কষ্ট হবে। আপনি ওটায় বসুন"।  কৃতজ্ঞ চিত্তে উঠতে চেষ্টা করে মা, অসফল হয়। টোটোগুলো বড় উঁচু। ঠেলি আমি, টোটোওয়ালা নেমে এসে ধমকায়,' তুমি কেন এগিয়ে এলে মাসি! তোমাকে হাত দেখিয়ে বললাম, দাঁড়াও ওই সিঁড়িওলা বাড়িটার সামনে যাচ্ছি। সিঁড়ি থেকে তোমার উঠতে সুবিধা হত গো।" 


টোটোয় উঠে বসি মোরা দুজনে। ছুটে চলে টোটো, পাঁচশ বছরের বুড়ি শহরের গলি পথ ধরে। আমাদের ক্ষীরেরতলা গলির ও মাথা দিয়ে বেরিয়ে, বেলিলিয়াস রোড ধরে কদমতলা বাজার। বাজারেই নামব বলেছি আমি, দুশ্চিন্তা বাড়ছে এই ভিড়ে ভরা বাজার পথ ধরে মাকে হাঁটাব কেমন করে? এমন সময় ছেলেটি ঘাড় ঘুরিয়ে জানতে চায়," বাজারে কোথায় নামবে মাসি?" মা বলে,"কদমতলা পোস্ট অফিসে নামিয়ে দিবি বাবা? খুব ভালো ছেলে তুই। সোনা ছেলে" ইত্যাদি প্রভৃতি। মা ঐ রকমই করেই কথা বলে, সবাইকে কথায় কথায় আদর আর প্রশংসায় ভরিয়ে দেয়।


আমার মায়ের আদরে ভাসতে ভাসতে আব্দেরে টোটোওয়ালা বাজারের মধ্যে, ভিড়ে ভরা পোস্ট অফিসের সামনে বাহন থামায়। মা আবার নামার চেষ্টা করে। আমি আবার টানাটানি করি। পিছনের গাড়ি ভোঁপু বাজাতেই থাকে। আর এইসবের মধ্যে ছেলেটা আবার নেমে আসে।" কই মাসি দেখিতো-" বলে সটান চাগিয়ে নামিয়ে দেয় মাকে। 


"বেঁচে থাক বাবা" বলে ছেলেটার থুতনিতে আঙুল ছুঁইয়ে চুম্বন করে মা। ভাড়া চুকিয়ে পোস্ট অফিসে ঢুকছি আমরা, ছেলেটি প্রশ্ন করে, "তোমার কতক্ষণ লাগবে মাসি?" মা বলে," কতক্ষণ আর, আধঘন্টা চল্লিশ মিনিট বড় জোর। তুই দাঁড়াবি বাবা?" ছেলেটা বলে," আমি একবার দাশনগর যাব। কিছু মাল নামাতে হবে। ফিরে আসতে পারব মনে হয়, সময়মত।"


পেনশন তোলা ছাড়াও আরো কিছু টুকিটাকি কাজ ছিল। বাস্তবে তাই পোস্ট অফিসের পাট চুকিয়ে বেরোতে লাগলো ঘন্টা দুই। পনেরো বছর আগে রিটায়ার করেছে মা, মায়ের সমসাময়িক কেউই আর নেই এই পোস্ট অফিসে। তাও যা খাতির পেল মা, বলার নয়। বাইরের দরজা থেকে হাত ধরে ভিতরে কাউন্টারের পিছনে নিয়ে গেল কেউ। চেয়ার এগিয়ে দিল কেউ। চা দিয়ে গেল কেউ। খোশগল্প করে গেল না জানি কত জনায়।


পোস্টমাস্টার মশাই নিজে এসে পেনশন তোলার ফর্ম দিয়ে গেলেন। পাশবই চেয়ে নিয়ে আপডেট করে দিয়ে গেলেন। আমাকেও একজন চা দিতে এলেন, না বলায় বেজায় অখুশি হলেন প্রৌঢ়। মা বসে বসে কুশল বিনিময় করছে, মায়ের পেনশন তোলার ফর্ম ফিলাপ করে দিচ্ছে অন্য কেউ। ফিসফিস করে মাকে বললাম, " তোমার এখনও কি খাতির গো!"  ফর্মে সই করতে করতে মা বলল, "দেখছিস তো, ব্যবহারটাই আসল। ব্যবহারটাই থেকে যায়।"


সত্যিই হয়তো তাই, বেলা দুটোর প্রখর রৌদ্রে আমরা যখন পোস্ট অফিস থেকে বেরোলাম, রাস্তা শুনশান। দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে মা বলল, " টোটোওয়ালাটা নেই না?" আমি হ্যাঁ বা না বলার আগেই এসে দাঁড়ালো টোটোটা। পাশের গলিতে ছায়ায় এতক্ষণ বসে ছিল ছেলেটা। না বলতেই নেমে এসে সাহায্য করল মাকে তুলে দিতে। বাকিটা তো দশ পনেরো মিনিটের রাস্তা। এবারে আর মাঝারি রাস্তা বা গলির মুখ নয় সোজা বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালো মায়ের টোটো। এতক্ষণ দাঁড়িয়েছে বলে, একটু বেশি ভাড়া দিলাম ছেলেটাকে। ছেলেটা কুড়ি টাকা কেটে বাকিটা ফেরৎ দিতে এলো।


আমিও নেব না, ছেলেটাও শুনবে না। "এটা তুমি ঠিক করছো না মাসি, আমার খারাপ লাগছে। আমার কষ্ট হচ্ছে। কেন বেশি দিচ্ছ?"  ছেলেটার ঘেমো মাথায়, পিঠে হাত বুলিয়ে মা বলল," নে বাবা। মাসির আশীর্বাদ হিসেবে নে। খুব ভালো ছেলে তুই। সোনা ছেলে তুই। তোর অনেক অনেক ভালো হোক।" থুতনিতে আঙুল ঠেকিয়ে আবার চুমু খেলো মা।


ছেলেটা এক গাল হেসে বলল," আচ্ছা নিলাম। তোমার মন রাখতে, এবারের মত। এবার তুমি আমার ফোন নম্বরটা নাও। যখনই দরকার পড়বে ডেকে নেবে।"


ফোন নম্বর সেভ করে, নড়তে নড়তে দেড়শো বছরের বুড়ো সদর দরজার দিকে যখন এগিয়ে যাচ্ছিল মা, ভাবছিলাম সরল সাদাসিধে, গ্রাম্য, প্রাণ খোলা কথাবার্তার জন্য, কোথায় না অসম্মানিত অপমানিত হয়েছে আমার মা। কত লোক তাচ্ছিল্য করেছে। প্রাপ্ত বয়স্ক হবার পর, মায়ের অপমানে ফুঁসে উঠেছি আমি। মা কিন্তু সয়েই গেছে। প্রতিবাদ করার মতো বুদ্ধি বা সাহস হয়তো মায়ের ছিলও না। ঠাকুর রামকৃষ্ণ দেবের কথা অনুসারে, সয়ে গেছে বলেই হয়তো, রয়ে গেছে আমার মা। ঠিকই তো বলে বৃদ্ধা, কিছুই থাকে না, অর্থ, প্রতিপত্তি, রূপ,যৌবন  সবকিছু গিলে খেয়ে নেয় সময়। কেবল ভদ্র ব্যবহারটুকুই থেকে যায়।

অনির ডাইরি ৬ই এপ্রিল, ২০২৩

 


#গুরুচণ্ডালী #তাম্রলিপ্তকড়চা 


মাননীয় মুখ্যসচীব যে ৪ তারিখে দুয়ারে সরকারের শিবির পরিদর্শন করতে চলেছেন, এ তথ্য আগেই পেয়েছিলাম। অনুগ্রহ পূর্বক সূত্র শুধাইয়া, লজ্জা দিবেন নি। বিগত দিন দুয়েক ধরে গৃহকর্তাকে মণ মণ তৈল মর্দন করিয়া, এইটুকু তথ্য কেবল উদ্ধার করিতে সক্ষম হই, যে তিনি দীঘা হইতে কলিকাতা যাইবার পথে বেশ কয়েকটি শিবির পরিদর্শন করিতে ইচ্ছুক।


দীঘা হইতে কলিকাতার মধ্যে যেমন কাঁথি পড়ে, তেমনি পড়ে মোদের তমলুক মহকুমা। মাননীয় মুখ্য সচীবের গন্তব্য সম্পর্কে অবহিত হইবার সাথে সাথেই আমার ইন্সপেক্টর বর্গকে সচেতন করি। ভাই সব/ বাবারা রেডি হইয়া যাও, কাহার কাহার এমন ক্যাম্প আছে, যেগুলি পাকা সড়কের ধারে, যেখানে স্বচ্ছন্দে বড় গাড়ির কনভয় পৌঁছাইতে পারে?


নন্দকুমার হইতে রঞ্জিৎ হাত তোলে, তমলুক ব্লক হতে যোশুয়া আর হাত তুলে চণ্ডীপুরের শান্তনু। শ্রী শান্তনু কয়াল, আমার তিন নবীন ইন্সপেক্টরের মধ্যে নবীনতম। এখনো বছর ঘুরেনি চাকরির।পুঁচকে, অনভিজ্ঞ, গোবলু ছেলেটির গায়ে এখনও মাখামাখি হয়ে আছে বিদ্যালয়ের সৌরভ। নার্ভাস হলেই হাসে, বকাবকি করলে এমন প্রবল বেগে হাত কচলায় যে যুগপৎ মায়াও লাগে আবার হাসিও পায়। পাছে ভয় পায়, তাই বলি, একটু অগ্রিম প্রস্তুতি নিয়ে রাখো বাবু । সিনিয়র দাদাদের সাথে একটু কথা বলে নিও। একটু পড়াশোনা ঝালিয়ে রাখো। আর ফর্ম, রেজিস্টার গুলি কিঞ্চিৎ গোচগাছ করে রাখো, বলা তো যায় না, কি দেখতে মর্জি হয় তাঁর। কাছাকাছি থাকে এমন কয়েকজন  মিষ্ট ভাষী বেনিফিশিয়ারিকে ঠিক করে রেখো, যাদের হাতে শুভেচ্ছা বার্তা তুলে দেওয়া যায়। আর হ্যাঁ, শুভেচ্ছা বার্তা গুলি যেন অবশ্যই রঙ্গিন হয়। সাদাকালো শুভেচ্ছা বার্তা আবার আমাদের বড় সাহেবের দুই চক্ষের বিষ।


গতকাল সন্ধ্যায় খবর আইল, যেখানে বাঘের ভয় সেখানেই ঘনাইতে চলিয়াছে সন্ধ্যা। তিনি চণ্ডীপুরেই যাইবেন। হলদি নদীর অদূরে, নরঘাট মাদ্রাসায় বসিবে দুয়ারে সরকারের শিবির। আর সেখানেই পড়িতে চলিয়াছে মাননীয় মুখ্য সচীবের পদধূলি। তিনি তো আর একা আসিবেন না, সঙ্গে নির্ঘাত আসিবেন মাননীয় জেলাশাসক, অতিরিক্ত জেলা শাসকগণ। এমনকি সঙ্গ দিতে পারেন অন্যান্য দপ্তরের সচীববৃন্দও।


শান্তনুকে ফোনে জানিয়ে দিলাম, চিন্তার কোন সম্যক কারণ নাই। আমিও থাকব তোমার সাথে, তোমার পাশে। ঝড়-ঝাড়-ঝঞ্ঝা যা আসবে, ভাগ করে খাওয়া যাবে খন। শান্তনু উৎসাহিত হয়ে বলল," হ্যাঁ ম্যাডাম। হ্যাঁ ম্যাডাম। এইতো আমি মিনিমাম ওয়েজেস অ্যক্ট পড়তে বসেছি। আর কোন কোন আইন পড়ব যদি একটু বলে দেন।"

হাসি চেপে বললাম, "অতো পড়তে হবে না বাপ। উনি তোমাকে আইনকানুন শুধাবেন না কো। বরং প্রকল্পটি সম্পর্কে একটু ভালো করে পড়ে রাখ। বিশেষতঃ ঐ যে ৪৬ টি অসংগঠিত শিল্প আর ১৫ টি স্বনিযুক্তি পেশার নাম, ঐগুলি বড় গুলাই আমি।" এছাড়া কোন প্রকল্পে কত পেনশন দেওয়া হয়, কি কাগজ পত্র লাগে এই ধরনের টুকটাক, খুঁটিনাটি। বেশি চাপ নিও না, বাকিটা তোমার বিডিও সাহেব বলেই দিবেন।


আজ সকাল ঠিক দশটায় মেসেজ পাঠালো শান্তনু, " ম্যাডাম আমরা সদলবলে ক্যাম্পে উপস্থিত হইয়াছি। মোরা এক্কেবারে রেডি।" আমি যখন গিয়া হাজির হইলাম তখন সূর্য মধ্যগগনে দেদীপ্যমান। বিডিও সাহেব স্বয়ং উপস্থিত রয়েছেন ক্যাম্পে। শান্তনু এসে নিয়ে গেল আমাদের স্টলে। মন খারাপ হয়ে গেল সামান্য। দুই তলার সদ্য নির্মিত ফাঁকা ক্লাস রুম খানি বরাদ্দ হইয়াছে মোদের জন্য। এমনিতে মন্দ নহে তবে বড্ড, বেপট গরম। মাননীয় মুখ্য সচীব কি আদৌ দোতলায় উঠবেন? কেউই তো উঠেনা সাধারণত।


বাচ্ছাদের স্কুলের বেঞ্চির একদিকে বসেছেন আমাদের এসএলও শ্রী স্বপন কুমার মান্না অন্যদিকে কমলেশ সাহু। মাঝে আমাদের শান্তনু আর তার ল্যাপটপ। ল্যাপটপটার ওপর ইড়িংবিড়িং স্টিকার মারা। DS নম্বর ফেলছিল শান্তনু। আমার জন্য কাজ ফেলে, কোথা থেকে একটা প্লাস্টিকের চেয়ার টেনে আনলো ছেলেটা। " ম্যাডাম আপনি বসুন।" বাক্যব্যয় না করে বসে পড়লাম, বসে বসে পড়াশোনা করতে লাগলাম। এই পেশা আর কাজের লিস্ট আমার জীবনে মুখস্ত হয় না। হাতে গুনে পাঁচটা করে টুকে মায়ের whatsapp নম্বরে পাঠিয়ে রাখলাম। আমার যাবতীয় গূঢ় তথ্য এই একজনকেই তো পাঠাই। মা কোনদিন খুলেও দেখে না। খোলে কেবল তুত্তুরী, যখন তিনি হাওড়া যান।


কাঁথির এএলসি সাহেবকে বলে রেখেছিলাম, আগে উনি আপনার ওখানে যাবেন, কি পড়া ধরছেন বিশদে জানাবেন কিন্তু।  আর কাঁথির এসডিওকে বলে রেখেছিলাম, ভাই উনি বেরোলেই জানাবি কিন্তু। সাড়ে বারোটা নাগাদ মহকুমা শাসকের ফোন, " এই বেরোলেন রামনগর থেকে-"। হিসেব করলাম তার মানে আর বড়জোর ঘন্টা- সোয়া ঘন্টার ব্যাপার। 


বিডিও সাহেব এবং এসডিও সাহেব (তমলুক) এসে ঘুরে গেলেন প্রতিটা স্টল। দিয়ে গেলেন শেষ মুহূর্তের প্রয়োজনীয় নির্দেশাবলী। খানিক বাদে এক ভদ্রলোক এসে হুকুম করলেন," আসুন "। প্রশ্ন করলাম কোথায় যাব? জবাব এলো," আসুন"। বাধ্য ছাত্রীর মত, শান্তনুদের দোতলায় ফেলে, তাঁকে অনুসরণ করে নীচের একটি ফাঁকা কক্ষে গিয়ে হাজির হলাম। বুঝলাম এটি অফিস ঘর। বেশ ঠান্ডা, মাথার উপর ফ্যানের হাওয়াটি বড়ই মধুর। গরমে কষ্ট পাচ্ছি দেখে বিডিও সাহেবের নির্দেশেই যে এই ঘরে বসতে দেওয়া হল, তা অনুধাবন করতে সময় লাগল না। 


বসে আছি তো বসেই আছি। সময় যেন  কাটতে চাইছে না। ব্লকের জনৈক স্টাফ এসে চা আর জল দিয়ে গেল। আরো বার তিনেক সেধে গেল চা খাবার জন্য। এক গাল হাসি নিয়ে এক ভদ্রলোক এসে পরিচয় জেনে গেলেন- বাড়ি কোথায়, কি করি, আমার বর কি করে, ছানাপোনা আছে কিনা, শ্রীমতী তুত্তুরী কোন ইস্কুলে পড়েন, কোন ক্লাসে পড়েন ইত্যাদি। দুই মহিলা নবজাতক শিশু সন্তান সহ এসে স্তন্যপান করিয়ে গেলেন। কয়েকটি দুরন্ত বাচ্ছাকে আমার পাশে বসিয়ে বিভিন্ন  ফর্ম তুলতে গেল কয়েকজন মহিলা।তাদের মধ্যে একটি আবার, আমাকে, 'আপ আপ' করে প্রবল ধমকও দিয়ে গেল।


পাখির চোখের মতোই আমার দৃষ্টি কেবল বিডিও আর এসডিও সাহেবের দিকে। ওনারা ঘুরছেন, ফিরছেন, তদারকি করছেন তো আমিও নিশ্চিন্তে বসে আছি। দৃষ্টির অগোচর হলেই উঠে দাঁড়াচ্ছি, কোথায় গেল? তিনি এসে গেলেন নাকি? বেলা গড়ায়, আসর জমায় তথ্য ও সংস্কৃতি দপ্তরের বাউলের দল। খানিক পরে বন্ধ হয়ে যায় গান। মাইক ধরেন বিডিও সাহেব স্বয়ং। ঘাম মুছতে মুছতে, ঘোষণা করতে থাকেন, "এই মুহূর্তে কেউ প্লিজ সিট ছেড়ে নড়বেন না।" " কাউন্টারের সামনে অকারণ ভিড় করবেন না," ইত্যাদি।  বুঝতে পারি তিনি আর বেশি দূরে নেই।


অবশেষে তিনি এলেন, আমার অঙ্ক যথার্থ প্রমাণ করে, মুখ্য দ্বারের দিকে যুগলে এগিয়ে গেলেন মাননীয় সমষ্টি উন্নয়ন আধিকারিক এবং মহকুমা শাসক মহোদয়। আমিও গেলাম গুটি গুটি পায়ে, তবে উল্টো দিকে। দোতলায় আমার টিমের কাছে। তখনও ডিএস ফেলেই যাচ্ছে শান্তনু। লোকজন আসছে, যাচ্ছে। " আরে, আমারটা আগে করে দাওনি", বলে হল্লা করছে। জানতে চাইলাম পাশবই/শুভেচ্ছা বার্তা  তুলে দেবার মত কেউ আছে তো শান্তনু?  "এই যে ম্যাডাম এনাদের অনুরোধ করেছি। একটু দাঁড়িয়ে যাবার জন্য"।  ফিসফিস করে জানতে চাই, " বেশি ক্ষণ দাঁড় করিয়ে রাখোনি তো? এনারা খুশি তো? উল্টোপাল্টা নালিশ জুড়বেন না তো?"  সম্প্রতি এই নালিশের জ্বালায় অতিষ্ট হয়ে উঠেছি আমরা। যে নালিশের অধিকাংশই আমাদের দপ্তরের সঙ্গে সংসর্গ রহিত।


শান্তনু, কমলেশ আর স্বপন বাবুকে কাজ করতে দিয়ে, দোতলার বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াই। নীচে প্রশস্ত উঠানের মাথায় খাটানো হয়েছে বিশাল সামিয়ানা। সামিয়ানার তলে, বর্গক্ষেত্রের আকারে বসেছে বিভিন্ন দপ্তরের স্টল। সামিয়ানার ফাঁকফোঁকর দিয়ে দেখা যাচ্ছে, মাননীয় মুখ্য সচীব ঘুরছেন, ফিরছেন, কথা বলছেন বিভিন্ন স্টলে গিয়ে। হাত মিলাচ্ছেন, ফর্ম দেখছেন, শুভেচ্ছা বার্তা তুলে দিচ্ছেন উপভোক্তাদের হাতে। ফটাফট হাততালি পড়ছে , পটাপট ছবি উঠছে। ততো খারাপ হয়ে যাচ্ছে মন। ইশ আমাদেরও যদি নীচে সামান্য ঠাঁই জুটত। 


"সিএস স্যার বোধহয় আর আসবেন না, তাহলে DS ফেলতে যাই ম্যাডাম?" মন খারাপের সুরে প্রশ্ন করে শান্তনু। আমাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে,কাজ ফেলে উঠে এসেছিল ছেলেটা। ওকে ফেরৎ পাঠিয়ে দূরে রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকি, এবার বোধহয় বিদায় নেবার পালা। মাননীয় অতিথিবর্গ বিদায় নিলেই, বেরিয়ে পড়বো আমি। সব অঙ্ক, সব হিসেব গুলিয়ে দিয়ে আচমকা সিঁড়ি দিয়ে উঠে আসেন বিডিও সাহেব। ইঙ্গিত ধরতে অসুবিধে হয় না। দৌড়ে চলে যাই নিজেদের  কাউন্টারে। শান্তনুকে শুধাই শেষবারের মতো, " রেডি তো?" আত্মবিশ্বাসী জবাব আসে, "হ্যাঁ ম্যাডাম।"


মাননীয় মুখ্য সচিব আসেন, উপস্থিত শ্রমিকদের সাথে বাক্যালাপ করেন। উল্টেপাল্টে দেখেন ফর্ম, বেনিফিশিয়ারির কাছ থেকে চেয়ে নিয়ে পাতা উল্টে দেখেন পাশবই।  আলগা দু-চারটে প্রশ্ন করেন। ঋণাত্মক জবাব দেয় না কেউই। আবার নকল হাসিতেও গলে পড়ে না কেউ। সাহস সঞ্চয় করে শান্তনুর আর আমার পরিচয় দিই আমি। অনুরোধ করি দুটি পাস বই আর শুভেচ্ছা বার্তা যদি প্রদান করে বাধিত করেন। ব্যাপারটা অত্যন্ত গর্বের হয় আমাদের পক্ষে। সানন্দে সম্মতি জানান উনি। শান্তনুর সাথে, ফাঁকে ফাঁকে খানিক খোশ গল্পও করে নেন। চাকুরী জীবনের বছর ঘোরার আগেই মাননীয় মুখ্য সচিবের সঙ্গে খোশ গল্প করা কতজনের ভাগ্যে জোটে মশাই! ছেলেটা তো যাকে বলে মন্ত্রমুগ্ধ। 


 চাকরী জীবনের শুরুতে এমন কিছু মানুষের সংস্পর্শ পেয়েছিলাম, আজও তাঁরা মাঝে মাঝে স্বপ্নে এসে কাঁপিয়ে দিয়ে যান। ছেনি হাতুড়ি দিয়ে মগজ প্রক্ষালন পূর্বক এনারা শেখাতে চেয়েছিলেন, বড় সাহেব/ মেম সাহেবের উপস্থিতিতে তাঁর থেকে বড় সাহেব/মেম সাহেবের সামনে মুখ খোলা, এমন কি ক্ষেত্রবিশেষে মুখ দেখানোও ঘোরতর দণ্ডনীয় অপরাধ। আর এ ছোকরা তো, আমার পাশে দাঁড়িয়ে দিব্য খোশ গল্প করল মশাই, তাও কেন যে গোঁসা না হয়ে এত আনন্দ আর গর্ব হচ্ছে কে জানে। নাহ্ যা দেখছি,আমি দেখি মোটেই ভালো ছাত্রী হতে পারিনি।

অনির ডাইরি ৩০শে মার্চ, ২০২৩

 


#অনিরডাইরি #তাম্রলিপ্তকড়চা 

অর্থ বর্ষ প্রায় শেষ। "সেই ট্রাডিশন সমানে চলছে"র ধারাকে অব্যাহত রেখে, শেষ মুহূর্তে হুড়মুড়িয়ে ডুকছে অ্যালটমেন্ট। আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে এই অর্থবর্ষটা আমরা বুঝি ধারহীন ভাবেই শেষ করতে পারব।

নূতন করে ধার করার তোড়জোড় শুরু করে দিয়েছি। কম্পিউটার সারায় যে ছেলেটি, তাকে বলেই দিয়েছি, এপ্রিল পড়লেই আর একবার চেক করে নেবে আমাদের সব কম্পিউটার গুলো। অ্যান্টিভাইরাস গুলো, সময় শেষের রক্তচক্ষু দেখাচ্ছে। ওগুলোকেও একটু বদলে দাও। ইলেকট্রিকের কাজ করে যে ছেলেটি, তাকে বলা হয়েছে, একটু ফ্যানগুলো ছেড়ে দিয়ে যা বাবা।


এরই মধ্যে ঘোষিত হয়েছে দুয়ারে সরকার। বাতাসে ফিসফিসে খবর, উচ্চ মাধ্যমিক মিটলেই জেলা শহরে আসতে চলেছেন মাননীয়া। সদর দপ্তর থেকে নামানো হয়েছে বেশ কিছু নালিশের ডালি। জনে জনে ফোন করে শুধাতে হচ্ছে, " দাদা/দিদি বলুন কি আপনার অভিযোগ/অনুযোগ…"


অধিকাংশই  শ্রম দপ্তর সংক্রান্ত নয়। তাদেরকেও দিশাহীন ভাবে ছাড়া যাচ্ছে না। বলে দিতে হচ্ছে, একটু অমুক দপ্তরে কথা বলে দেখুন, কেমন। মাঝে মাঝে ঘটছে মজার মজার ঘটনা, যেমন জনৈক নালিশকারী ঘুরিয়ে আমাদের শান্তনুকে বলেছে, " আপনি কে? কোথা থেকে বলছেন আগে বলুন। অফিসের ঠিকানা দিন। আমি গিয়ে কথা বলব।" আজ্ঞে তাই সই, বলে পথনির্দেশ দেওয়া হল। ভদ্রলোক এসে পৌঁছালেন যখন, সূর্য ডুবু ডুবু। ধোপদুরস্ত পোষাক-পরিচ্ছদ, পেশায় জানালেন শিক্ষক। শ্রম দপ্তর কি, কি কাজ করে ইত্যাদি আলোচনা অন্তে, অফিস পর্যবেক্ষণ পূর্বক, জহর বাবুর হাতের এক কাপ অমৃত চা সেবন করিয়া, মহাশয় জানাইলেন, "আসলে আমার কোন নালিশ নাই বুঝলেন। দেখছিলাম সত্যি নালিশ করলে কেউ শোনে কিনা।"


এ তো তাও ভালো, শুভদীপ্তকে তো একজন বেদম বকুনি দিল, " আবাস যোজনায় বাড়ি দিলেনি, এখন আবার ফোন করে আদিখ্যেতা করতে এয়েছো?' আবাস যোজনার কয়েক সহস্র যোজনের মধ্যেও পড়ে না শ্রম দপ্তর। তবুও নালিশের উপর জ্বলজ্বল করছে আমাদের দপ্তরের নাম। শুভদীপ্ত খানিক দম নিয়ে আবার প্রশ্ন করল, "BMSSY এর বই আছে আপনার? ওই যে ২৫ টাকার বই গুলো-।" ঘুরিয়ে জবাব এল, ' আমার কি আছে, না আছে, তা তোমাকে বলতে যাব কেন? জানো আমার খুড়শ্বশুরের পিসতুতো ভাইপো কে, জানো আমার মামাদাদু কোথায় চাকরি করেন?' আর কথা বাড়ানো সমীচীন বোধ করেনি, শুভদীপ্ত। 


একই কথা নন্দন শুনল বটে, তবে এক্ষেত্রে বাড়ি নয় হাগুখানা। হক বাবুকে একজন তো রীতিমত চমকালো, " নির্বাচনটা আসতে দিন।" সুরজিৎকে আবার উল্টো কথা শোনালো আর একজন, " না না, সরকারের বিরুদ্ধে আমার কোন নালিশ নেই। খুব ভালো কাজ করছে আমাদের সরকার।"  বেদজ্যোতিকে একজন বলল, "প্যানকার্ড পাইনি"। যোশুয়াকে একজন বলল," বউ পালিয়ে গেছে মূল্যবান ডকুমেন্ট নিয়ে। কি করা যায় বলুন দিকি?" কোলাঘাটের শান্তনু আর তমলুকের বিল্বমঙ্গল কে কারা যেন দুপুরের ঘুম ভাঙ্গিয়েছে বলে উদোম খিস্তি মারল। মনীষকে কে যেন ষড়যন্ত্র তত্ত্ব শোনালো, "আমি করিনি সার। মা কালীর দিব্যি। বুইলেন কিনা, আমার অনেক শত্তুর আছে, তারাই কেউ করছে নির্ঘাত। আপনি একবার বলুন সার, আমি নিজে গিয়ে সই করে দুব যে আমার কোন নালিশ নেই।


এছাড়াও নালিশ পাওয়া গেল, "রাস্তা চাই", ডিজিটাল রেশন কার্ড, জমি বিবাদ সংক্রান্ত, চাকরি চাইলেন কেউ কেউ, পাড়ায় কেউ বিরক্ত করছে বলে নালিশ করেছেন কয়েকজন, এমনকি পঞ্চায়েত ভোটের টিকিট ও চাইলো জনা কয়েক। কথা বলতে গিয়ে বোঝাই যায়, অধিকাংশই সাদাসিদা গাঁয়ের মানুষ।


একদল ফোন করছে, একদল এন্ট্রি করছে, এক নজরে মনে হবে এটা যেন সরকারি অফিস নয়, কোন কল সেন্টার বুঝি। আর এই সমস্ত নালিশ সংক্রান্ত কাজের তদারকি করছে, আমাদের পাঁশকুড়া পুরসভার ইন্সপেক্টর শ্রী সঞ্জয় কুমার টুডু। এখন কথা হল, এতগুলো ছেলে যে বিভিন্ন ব্লক পুরসভা থেকে এসে এই কাজ করছে তাদের চাট্টি মুড়ি জলের ব্যবস্থা তো করা উচিত। মানছি ধারেনগদে চলে আমাদের,  কিন্তু মার্চ মাস বলে কথা, সেই বিলগুলি তো মেটাতে হবে এবার। জল মুড়ির টাকা দিবে কি মহানগর? 


যাকে প্রশ্নটা করলাম, তিনি এমন হাসলেন, হাসতে হাসতে গড়িয়েই পড়লেন। শেষে অতি কষ্টে হাসি থামিয়ে, চোখ মুছে, নাক ঝেড়ে, গলা খাঁকরে বললেন, " চাও না, চাও। নজির সৃষ্টি করো।" ধারের জ্বালা এবং নজির সৃষ্টি করার সুপ্ত বাসনা নিয়ে ফোন করলাম মহানগর তুতো এক দাদাকে। যাকে ফোনালাম, তিনি ছদ্ম মাতব্ব্বরীর ঢঙ্গে বললেন, " টাকা চাই? বেশ তো। একদিনের উইমেন এমপাওয়ারমেন্ট প্রোগ্রাম নামিয়ে ফেল, কিছু টাকা পাবি।"


ও হরি! ওই প্রোগ্রাম তো আমি  স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে নারী দিবসের পরের দিনই করে ফেলেছি। সেই যে তানিয়া দি এসে ক্লাস নিয়ে গেল, আবার কি করব? আর এই কর্মযজ্ঞে এই মুহূর্তে একটিও মেয়েকে জুড়িনি আমরা। এমনকি আমি নিজেও ফোন করিনি। একটাও না। চুঁচুড়ায় থাকতে একবার এই রকম ফোন করতে বাধ্য হয়েছিলাম, যা শিক্ষা হয়েছে, বাপরে! ফোনে অচেনা মেয়ের গলা শুনলেই, লোকজনের সব সমস্যা দূরীভূত হয়ে প্রবল প্রেমের উদ্রেক হয়। 


দাদা বললেন, "প্রোগ্রাম করেছিস, তাতে কি হয়েছে? আবার কর। তবে একটা কথা বলতো, তোকে এত দেরিতে টাকা দিলে তুই খরচা করতে পারবি তো? নাহলে কিন্তু মুখ পুড়বে।"  মুখে তো বললাম, হ্যাঁ হ্যাঁ তিরিশে দিলেও, একত্রিশে প্রোগ্রাম নামিয়ে দেব। কার্যক্ষেত্রে ব্যাপারটা অত সহজও ছিল না।


 প্রথমতঃ ডাকবো কাদের? আমাদের মেয়ে এসএলও এবং কালেক্টিং এজেন্টদের সাথে তো ইতিমধ্যেই করে নিয়েছি এই কর্মশালা। এমতবস্থায় চল্লিশ জন মহিলা পাই কোথায়? শুভাশিসই বুদ্ধি দিল, "ম্যাডাম বাথরুম সাফ করে যে দিদিগুলা, ওদের ডাকলে হয় না?" দারুণ প্রস্তাব, লুফে নিলাম এক কথায়। নেভি নীল পাড়ওয়ালা,সাদা সিনথেটিক শাড়ি পরিহিতা একদল অল্পবয়সী মেয়ে, ইদানিং কাজ করে এই কমপ্লেক্সে। ওরা ঝাঁট দেয়, বাথরুম সাফ করে। ওদের দয়াতেই নিশ্চিন্তে শৌচাগারে যেতে পারি আমরা। ওদের নিয়োগের পূর্বে শৌচাগার গুলির যে হাল ছিল, তা অকহতব্য। একবার গেলে দুঃস্বপ্ন আসতো অন্তত তিন দিন।


শুধু সুইপার দিদিদের দিয়ে হল ভরল না। পি ডব্লিউ ডির যে অধিকর্তা এই দিদিদের দেখভাল করেন, উনিই জোগাড় করে দিলেন অন্য একটি সেল্ফ হেল্প গ্রুপের মেয়েদের। এরাও পাশেই কাজ করে। ইতিপূর্বে এমন কর্মশালায় অংশ গ্রহণ করেনি কেউই। তাই সকলের উৎসাহ ছিল দেখার মত।অংশগ্রহণকারী তো পেলাম, এবার এদের শেখাবে পড়াবে কে? সময় বড় স্বল্প। সাম্মানিক বড়ই কম। আবার তানি দিকে ডাকলে, নির্ঘাত কান মূলে দেবে। আমার মতোই ব্যস্ত সেও এই মুহূর্তে, হয়তো আমার থেকেও বেশি।


জেলা আইনি পরিষেবা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করা হল। অতিমারি পূর্ববর্তী সময়ে, হুগলীতে, এনাদের সাথে বেশ সুসম্পর্ক ছিল আমাদের। সমস্ত অনুষ্ঠানে আমরা ডাকতাম ওনাদের আর ওঁরা ডাকতেন আমাদের। আইন নিয়ে কাজ করার অবসর এবং পরিসর এই মুহূর্তে আমাদের ক্রম সংকুচিত হলেও, ওনারা পূর্ণ বিক্রমে বিদ্যমান। মাননীয় সচীব মহাশয় রাজি হয়ে গেলেন এক কথাতেই। জানালেন চারটি আইন নিয়ে কথা বলবেন। খুব সহজ সরল ভাষায়। আইন গুলি হল-  কন্যা ভ্রুণ হত্যা আইন ১৯৯৪, যৌন অপরাধ থেকে শিশুদের সুরক্ষা আইন ২০১২, কর্মক্ষেত্রে যৌন হেনস্থা প্রতিরোধ আইন ২০১৩ এবং গার্হস্থ হিংসা প্রতিরোধ আইন ২০০৫।


প্রথমার্ধ মিটলো, এবার দ্বিতীয়ার্ধের পালা।  দ্বিতীয়ার্ধে কাদের ডাকব, সেই নিয়ে ছিটেফোঁটাও সংশয় ছিল না আমার। শ্রীমতী অঞ্চিতা ঘটকের এনজিও পরিচিতির সাথে আমার আলাপ চন্দননগরের বড় সাহেবের সৌজন্যে। স্যারের উৎসাহে, গৃহ শ্রমিকদের নিয়ে একটা কর্মশালা করেছিলাম আমরা। সেখানেই অঞ্চিতা দি এবং পারমিতার সঙ্গে আলাপ। কথায় কথায় জানতে পারি, ওনারা জেন্ডার ইস্যু এবং জেন্ডার ভায়োলেন্স নিয়ে সিরিয়াস কাজকর্ম করেন। গার্হস্থ্য হিংসার শিকার মহিলাদের পাশে দাঁড়ান। অঞ্চিতাদির ভাষায়,“ যতক্ষণ মেয়েটি লড়বে, আমরা লড়ব। ”


কথাটা যে কতখানি সত্যি, প্রমাণ পেয়েছিলাম, যখন আমার প্রাক্তণ ড্রাইভারের গর্ভবতী স্ত্রীকে আড়ং ধোলাই দিয়েছিল তার মা-মাসি আর মাসতুতো ভাই। মেরেধরে, মাথার চুল খানিক খামচে ছিঁড়ে দিয়েছিল। তখন লকডাউন। সারা রাত শোবার ঘরের দরজা বন্ধ করে অশ্রুপাত করেছিল যুগলে। সকালে আমায় নিতে এসে খুলে বলে ছেলেটি। থানায় পাঠাই। সে অভিজ্ঞতা আর লিখছি না। কাজ তো হয় অষ্টরম্ভা। উল্টে মেয়েটিকে দুপুর বেলা একলা কোয়ার্টারে ডেকে পাঠায় মেজবাবু। আবার ছুটে আসে স্বামী স্ত্রী আমার কাছে। অসহায় হয়ে পরিচিতির শরণাপন্ন হই আমি। 


লক ডাউনের মধ্যেই ছুটে আসে কাকলী আর শুভ্রা। আগে কথা বলে যুগলের সাথে। কাউন্সেলিং করা হয় দুজনের। তারপর নিয়ে যাওয়া হয় থানায়। চাপ দেওয়া হয় এদিক,ওদিক,সেদিক দিয়ে। শেষ পর্যন্ত কেস নিতে বাধ্য হয় পুলিশ। ধাতানি দেওয়া হয় শাশুড়ী মাতা ইত্যাদিকে। পরিচিতির সহায়তায় পরিস্থিতির উন্নতি হবার পর যেটা হয়, তা হল বিস্তর কুম্ভীরাশ্রু সহ একরাশ কৃতজ্ঞতা জানিয়ে, ছেলেটি আমার গাড়ি ছেড়ে অন্য অফিসারের গাড়ি ধরে নেয়। যেখানে গাড়ির টাকা আমাদের মত গোনাগুনতি নয়। মালিকের ভাষায়, তেল চুরির সুযোগ ও অঢেল। যাই হোক, সে অন্য গল্প। মেয়েটি যে সমস্যা মুক্ত হয়, সেটাই আসল। 


দ্বিতীয়ার্ধের জন্য তাই পারমিতার মাধ্যমে পরিচিতিকেই ধরলাম। সুদূর দক্ষিণ কলকাতা থেকে তমলুক এসে দুর্ধর্ষ সেশন নিয়ে গেল কাকলী আর শুভ্রা। দারুণ উপভোগ করল আমাদের মেয়েগুলো। অনুষ্ঠান শেষে সবাইকে দেওয়া হল একখান করে শংসা পত্র। আমার আর সৌম্যজিতের সই করা, পাতি কালার প্রিন্টারে প্রিন্ট করা, এক টুকরো মোটা কাগজ, যাতে লেখা শ্রীমতি অমুক, এই তারিখে, এই স্থানে, এই কর্মশালায় অংশগ্রহণ করেছিলেন। তার ভবিষ্যতের যাবতীয় কর্মকাণ্ডের জন্য আমাদের তরফ থেকে রইল এক চুপড়ি শুভেচ্ছা। 


 শংসাপত্র দেবার সময় জানতাম না যে, এমন গোল বাঁধবে। আজ বিকালে হঠাৎ ধরলেন জহর বাবু, "ম্যাডাম, আমাকেও ওরকম একটা শংসাপত্র দ্যান"। ইতিমধ্যে কেটে গেছে দিন দুয়েক, আর পাঁচটা কাজে, মাথা থেকে বেরিয়ে গেছে কিসের শংসাপত্র। অবাক হয়ে জানতে চাইলাম, 'কি চাইছেন? বুঝলাম না।' উনি বললেন, " ওই যে, পুতুল মনিকে যেরম দিইছেন।"  জহর বাবুর পুতুল মনি হল আমাদের সুইপার মাসি। পাকেচক্রে তিনিও ওই কর্মশালায় উপস্থিত ছিলেন বটে এবং আর অন্যান্যদের সাথে সাথে তার ভাগ্যেও একটি শংসাপত্র জুটেছে। সেটা নিয়ে মাসি চুপচাপ কেটে পড়লে কোন সমস্যা হত না। কিন্তু তিনি সেইটি জহর বাবুকে দেখিয়েই বিপদ ডেকে এনেছেন। অন্যের দেখে ছোট্ট বাচ্চারা যেমন বল বা খেলনার বায়না করে, ঠিক তেমনি একখানি শংসাপত্রের বায়না জুড়েছেন জহর বাবু। যত বোঝাই ওটা একটা পাতি কাগজ বই কিছু না। কিন্তু জহর বাবুর বক্তব্য হল যেহেতু আমার সই করা কাগজ নিশ্চয়ই ওইটা দিয়ে বিরাট কিছু আদায় করতে পারবে মাসি। তাই ওনারও ঐটি চাই। কি জ্বালায় যে পড়েছি। ভাবছি একখানা শংসাপত্র লিখেই ফেলব বুড়ার জন্য। কি লিখবো সেটা অবশ্য ভাবার বিষয়। এত খেয়াল রাখে বৃদ্ধ আমার, অফিসে ঢোকার সাথে সাথেই গুড মর্নিং সম্ভাষণপূর্বক দরজা খুলে দেয়, দরজা ভেজিয়ে দেয়, জানলা খুলে/ বন্ধ করে দেয়, পর্দা সরিয়ে/টেনে দেয়, আলো জ্বালিয়ে দেয়, পাখা চালিয়ে দেয়, আবার না বলতেই এসে পাখার স্পিড বাড়িয়ে বা কমিয়ে দিয়ে যায়, বাতানুকূল যন্ত্রের সুইচ অন করে, রিমোট খানা হাতের কাছে দিয়ে যায়, না বলতেই চায়ের কাপ এনে ধরে মুখের কাছে, দশবার খোঁজ নেয় টিফিন খেয়েছি কিনা। এহেন বৃদ্ধের শংসাপত্র কি অমন হুট কথায় লেখা যায়? সময় লাগবে নি? সে কথাই বললাম জহর বাবুকে, একটু ভাবতে তো দিবেন। দাঁড়ান ভাবি, তারপরে জম্পেশ করে লিখব খন আপনার প্রশংসা পত্র। যাই বলুন না কেন, মেয়েদের যেমন empowerment লাগে পুরুষদেরও তেমনি pampering লাগে মশাই। ওরা স্বীকার করে না বা মুখ ফুটে বলতে পারে না, তাই বলে কি আমরা বুঝি না?