Saturday 17 February 2024

অনির ডাইরি ফেব্রুয়ারি, ২০২৪

 

অনির ডাইরি ২৫শে ফেব্রুয়ারি, ২০২৪

#অনিরডাইরি 



সদ্য বিয়ে হয়েছে কয়েকমাস হল। কর্মসুত্রে সে আলিপুর আর আমি, খড়গপুর। আলাদা-আলাদা থাকি সপ্তাহভর, দেখা হয় সেই সপ্তাহান্তে। শৌভিকের তৎকালীন সহকর্মীদের ভাষায় আমারা, “weekdays bachelor, weekend married”।


 তো এমনিই এক কর্মব্যস্ত দিনের সকালে বরের ফোন, “আজ কোন ভাবেই এদিকে আসা যাবে না, না?” অবাক হলাম, সবে তো মঙ্গল বার, গতকাল ভোরেই তো, আসছে শুক্রবার আবার দেখা হবে, বলে ট্যাক্সিতে তুলে দিল শৌভিক। ২৪ ঘণ্টার মধ্যে কি আবার বাঁধাল? একরাশ উদ্বেগ নিয়ে জানতে চাইলাম, সব ঠিক আছে তো? ফোনের ওপার থেকে ভেসে এল, অসুস্থ উদাস কণ্ঠধ্বনি, “হ্যাঁ--- সব ঠিকই আছে। ঐ আর কি, কাল রাত থেকে সামান্য জ্বরজ্বর ভাব। ও কিছু না। তুমি অফিস যাও। আমি দেখি, একটা প্যারাসিটামল খাই-।”

আমাকে কিংকর্তব্যবিমুঢ় অবস্থায় ফেলে, ফোন কেটে দিলেন তিনি। এবার আমি যে কি করি?


 আমি তখন ট্রেনে, ৮টা ১৩র মেদিনীপুর লোকাল গড়াতে গড়াতে সবে উলুবেড়িয়া ঢুকছে, নেমেই পড়লাম ট্রেন থেকে। কি যে হয়েছে আজ কে জানে, সব কটা স্টেশনে থিকথিক করছে ভিড়। আমাদের ট্রেনটা মোটামুটি ফাঁকা এলেও, উল্টোদিকের ট্রেন গুলোতে সূচ গলবে না এমন ভিড়। তাও উঠেই পড়লাম কুস্তি করে। হাওড়া স্টেশনে পৌঁছে দেখি, অবস্থা আরো সঙ্গিন। গোটা স্টেশন চত্বর লোকে লোকারণ্য। পা ফেলা দায়। একেকটা ট্রেন ঢুকছে, আর বিশেষ একটি রাজনৈতিক দলের পতাকা হাতে পিলপিল করে নামছে মানুষ। 

 

রাস্তা খুঁজতে হল না, জনস্রোতই ভাসিয়ে নিয়ে এল স্টেশনের বাইরে। সুযোগ বুঝে, স্রোতের অভিমুখ থেকে টুক করে সরে গিয়ে বাসস্ট্যান্ডে গিয়ে হাজির হলাম, বাসও পেয়ে গেলাম ফাঁকা। আমি ছাড়া সাকুল্যে চার জন যাত্রী। অসম সাহসী বাস, তাই নিয়েই গড়াল। কিন্তু হাওড়া ব্রিজের মুখে পৌঁছতেই আটকে দিল পুলিশ, না আটকালেও কোন লাভ হত না। গোটা হাওড়া ব্রিজ জুড়ে, বন্যার জলের মত মানুষের ঢল। 

প্রায় আধ ঘণ্টা স্টিয়ারিং ধরে বসে থেকে, শেষে ধুত্তোর বলে নেমে গেলেন ড্রাইভার দাদা। কন্ডাক্টর তো বহু ক্ষণ আগে থেকেই বেপাত্তা। জনগর্জনে কান পাতা দায়। কত ক্ষণ আর একলা বসে থাকা যায়, যাবতীয় সাহস সঞ্চয় করে নেমেই পড়লাম বাস থেকে। মিশে গেলাম জন স্রোতে। হাঁটতে হাঁটতে হাওড়া ব্রিজ পেরোচ্ছি, চতুর্দিকে সরকার বিরোধী শ্লোগানে কান পাতা দায়।


 আমার জিন্স, কুর্তি, স্নিকার্স পরা চেহারা, আমার কাঁধে, গায়ে হলুদের তত্ত্বে পাওয়া মূল্যবান চামড়ার ব্যাগ, আমার হাতের চটের টিফিন ব্যাগ সোচ্চারে ঘোষণা করছে আমি ব্রিগেড অভিমুখে হাঁটছি না। বেশ কয়েকজন সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকাচ্ছেও, আচমকা সবাইকে ছত্রভঙ্গ করে এগিয়ে এল এক বিশাল ঘণ্টা। একটা হাতে ঠ্যালা গাড়ির ওপর বসানো আছে ঘণ্টাটা, আসল ঘণ্টা নয়, নকলই হবে। যারা ঘণ্টার গাড়িটা ঠেলছে, তাদেরই কেউ না কেউ মাঝে মাঝে হাত দিয়ে দুলিয়ে দিচ্ছে ঘণ্টাটাকে, ওমনি ঢং ঢং করে রেকর্ডেড শব্দ ভেসে আসছে, সাথে সাথে সম্মিলিত চিৎকার, "অমুক সরকারের মৃত্যু ঘণ্টা বেজে গেছে।" 


কোন মতে ইষ্ট নাম জপতে জপতে ব্রিজ তো টপকালাম, শুরু হল বৃষ্টি। প্রথমে টুপটাপ, তারপর ঝিরিঝিরি। জনস্রোতের অভিমুখ ব্রেবোর্ন রোডের দিকে, সুযোগ বুঝে বাম দিকে বেঁকে গেলাম। হাঁটতে হাঁটতে পোস্তা। অন্যান্য দিন মানুষ, ঠ্যালা, লরির ভিড়ে গমগম করে যে অঞ্চল, আজ সেখানে কবর খানার নৈঃশব্দ। কে বলবে কয়েক হাত দূর দিয়েই বইছে জনজোয়ার। একটা বাস নেই, ট্যাক্সি তো দূরের কথা। প্রায় গ্রে স্ট্রিটের মুখ অবধি ছাতা খুলে আধ ভেজা হয়ে হাঁটতে হাঁটতে গিয়ে অবশেষে একটা ট্যাক্সি পেলাম। 


শ্বশুরবাড়ি গিয়ে যখন পৌঁছালাম, অর্ধ দিবস অতিক্রান্ত। মধ্যাহ্ন ভোজ সেরে শ্বশুর শাশুড়ি জম্পেশ করে ব্রিগেডের সভার লাইভ দেখতে বসেছেন। আমায় দেখে তো রীতিমত শোরগোল পড়ে গেল। হইচই শুনে উঠে এল শৌভিক, চোখ লাল, মুখ শুকনো, চুল উস্কখুস্ক। বুঝলাম, ভালোই জ্বর বাঁধিয়েছে। চটজলদি পুত্রবধূর জন্য মাখন পাউরুটি, ধোঁয়া ওঠা দুধ কফি বানিয়ে আনলেন শাশুড়ি মা। ভেজা জামাকাপড় বদলে, মুখহাত ধুয়ে, খাওয়ার টেবিলে বসে শোনাতে হল সারাদিনের অ্যাডভেঞ্চারের পুঙ্খনাপুঙ্খ বিবরণ। গোগ্রাসে গিললেন বৃদ্ধ, বৃদ্ধা আর তাঁদের জ্যেষ্ঠ পুত্র। সব শুনে শ্বশুরমশাই বলেছিলেন, “বাবা রে, তুমি তো যুদ্ধ জয় করে এলে।”


যুদ্ধই বটে, সেদিনও তো যুদ্ধই করছিলাম, যেদিন আমার বিধাননগর আর শৌভিকের তমলুক হল। কি রাগারাগিই না করছিল শৌভিক, “বিধাননগর ছেড়ে তমলুক আসবি? লোকে তোকে পাগল বলবে রে। তার থেকে তুই থেকে যা, প্রতি সপ্তাহে হয়তো ফিরতে পারব না, অল্টারনেট উইকেন্ডে তো ফিরবই।" কিন্তু আমার কানে কেবল বাজছিল, মাস কয়েক আগে মহকুমা শাসক হওয়া শৌভিকেরই এক বন্ধুর গলা, “ শনিবার - রবিবার - পরিবার কিচ্ছু নেই আমার। এত কাজের চাপ, বাড়ি ফিরতেই পারি না। প্রতিটা শনি-রবিই কিছু না কিছুতে খেয়ে নেয়। পরিবারকে কাছে এনে রাখতেই পারি, তাতে অশান্তি বাড়ে। এখানে থাকলেও বা কতটুকু সময় দিতে পারি? রাতে যখন বাংলোয় ফিরি, কি যে নিঃসঙ্গ লাগে -”। জানতাম একই অবস্থা আমাদেরও হতে চলেছে। ওই দাদা এবং তাঁর পরিবার অনেক শক্তপোক্ত, তাই যাবতীয় ঝঞ্ঝা সয়েও টিকে গেছেন। আমরা পারব না। শনিবার - রবিবার না হয় নাই থাক, পরিবার ছাড়া জীবন চলে নাকি?

অনির ডাইরি ২৪শে ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ 

#অনিরডাইরি 


শাড়ি গুলো নিছক শাড়ি নয়, প্রতিটা শাড়ি আসলে একেকটা গল্প। সুখের গল্প, দুখের গল্প, ভাললাগা আর ভালবাসার গল্প, বন্ধুত্ব আর নির্ভরশীলতার গল্প, অপমান আর বিশ্বাসভঙ্গের গল্প। যেমন তুত্তুরীর শাড়িটা। কত বয়স হবে বলুন তো শাড়িটার? পাক্কা পঁচিশ বছর। বড়দার বিয়েতে পাওয়া, জীবনের প্রথম “ননদ-পুঁটলি”। 


আমার স্বর্গীয় মাতামহীর চার কন্যা এবং পাঁচ নাতিনাতনী। যার মধ্যে আমি একলা একেশ্বরী, চার দাদার একমাত্র বোন। আমাদের মধ্যে “মাসতুতো” শব্দটা কোনদিনই প্রবেশ করার সাহস পায়নি। আর বড়দা তো শুধু দাদা নয়, বড়দা আমার গুরুও বটে। ষষ্ঠ থেকে দ্বাদশ, নিজে হাতে বেত পিটিয়ে লেখাপড়া শিখিয়েছে। যদিও এক ঘা বেতও আমার পিঠে কোনদিন পড়েনি। সপাৎ সপাৎ করে বেত চালাত বড়দা, আমার ভুলের, আমার ফাঁকিবাজির মাসুল গুনত বেচারি পড়ার ডেস্ক, বিছানা, বালিশ, পাশ বালিশের দল। “ঝি’কে মেরে বউকে শেখানোর মত, বালিশ পিটিয়ে বোনকে শিক্ষা দিত বড়দা।


এহেন বড়দার যখন বিয়ে পাকা হল, আক্ষরিক অর্থেই আমার “ আজকাল পাঁ’ও জমি পে নেহি পড়তে মেরে-” অবস্থা। সদ্য স্কুলের গণ্ডি পেরিয়ে কলেজে উঠেছি। সাজগোজ সম্পর্কে তৈরি হচ্ছে, ধ্যানধারণা। জ্যাঠাইমার ভাষায়, “পিপুল পাকছে।” পারিবারিক কড়া শাসনের বজ্র আঁটুনিটাও যেন কেমন শিথিল হয়ে আসছে। দাদার আইবুড়ো ভাতের সকাল থেকে বৌভাতের রাত, কোনদিন কি পরব, কি ভাবে সাজব তাই নিয়ে মস্তিষ্কে উঠছে তুফান। সাধ যতটা, সাধ্য যে তার তুলনায় নিছক সীমিত। একে তো বাপের ঘাড়ে বসে অন্নধংস করছি, তারওপর শখপূরণের জন্যও হাত পাততে হেব্বি লজ্জা লাগত। একটা টিউশনিও জোটে না ছাই। নির্দয়ের মত ব্যয়সঙ্কোচ করে, রাহাখরচ থেকে একটি একটি করে টাকা জমিয়ে, প্রচুর ঘুরে ঘুরে, গলা ফাটিয়ে দর করে নিউ মার্কেট থেকে কিনে ফেললাম দুটো ঝক্কাস ঝুটো গয়নার সেট। দেখে বাবার সে কি দুঃখ, “ সোনারূপো কি কিছুই নেই যে ঝুটো গয়না পরবি?” ধুর, বাবা ফ্যাশন বা গয়নার কি বোঝে। রুপালী পর্দা তখনও কাঁপছে দিল তো পাগল হ্যায় এর মাধুরীর, পরদেশের মহিমা আর কুছ কুছ হোতা হ্যায়ের জোড়া বাঙালি কন্যার অভিঘাতে। অনুপ্রাণিত হয়ে ওদের মতোই শাড়ির সাথে ম্যাচ করে কাঁচের চুড়িও কিনে ফেললাম, দাদার বিয়ে বলে কথা। “বোলো দেখা হ্যায় কভি, তুমনে মুঝে উড়তে হুয়ে।”


উড়তে গিয়ে যে এমন ধপাস করে মাটিতে আছড়ে পড়ব, কে জানত। বিয়ের ঠিক উনিশ দিন আগে, “অগ্নিকাণ্ড” ঘটে গেল আমার জীবনে। একাকী জ্বলন্ত মোমবাতির ওপর ঝুঁকে কি যেন করছিলাম, মাথার উড়ো চুলগুলো কখন যে ঝাঁপিয়ে জহর ব্রত করতে গেছে বুঝতেই পারিনি। সামনেই একটা ডিম্বাকৃতি আয়না ছিল, আয়নার দিকে তাকিয়ে স্তম্বিত হয়ে গেলাম, আমার মাথার ওপর যেন বিরাট একটা আগুনের মুকুট। বাবা- মা দুজনেই অফিসে, বাড়িতে মানুষ বলতে অবসরপ্রাপ্ত জেঠু, বৃদ্ধা ঠাকুমা আর প্রৌঢ়া পিসি। যারা সকলেই তখন একতলায়। আমার হাঁক শুনে ছুটে আসতে আসতে পুড়ে কাঠকয়লা হয়ে যাব আমি। 


আসেপাশে কেউ না থাকলেও, কেউ নিশ্চয়ই ছিলেন। যাকে হয়তো চোখে দেখা যায় না, কিন্তু তিনি যে সর্বদাই থাকেন সেদিন হাতেনাতে প্রমাণ পেলাম। তাঁর দয়াতেই ঘরে মজুত খাবার জলের পাত্র উপুড় করে অগ্নি নির্বাপণে সফল হয়েছিলাম সেদিন। ভাগ্যে আজকালকার মত পেট বটলে জল রাখা হত না তখন। আগুন তো নিভল, তবে গোটা ঘর ভেসে গেল পোড়া চুলে। অর্ধেক মাথার চুল যেন রবার দিয়ে ঘষে মুছে দিল কেউ। তবে সে তো কিছুই না, আগুন নেভানোর উত্তেজনা থিতিয়ে আসতেই শুরু হল জ্বালা। সে যে কি তীব্র দহন জ্বালা ভাষায় অপ্রকাশ্য। মাথার সামনেটা, কপাল আর একটা কান পুড়ে দগদগে হয়ে গেছে। 

পরের ১৮-১৯ দিন আর বিয়ের তিন চারদিন যে কি অসীম মানসিক যাতনার মধ্যে কেটেছিল, কেটেছিল অন্যান্য সুন্দরীদের পিছনে আত্মগোপন করে, নিজের সীমাহীন নির্বুদ্ধিতার জন্য অশ্রুমোচন করে। আমি ছাড়া সকলকে কি সুন্দরই না লাগছিল বিয়েতে। বিগত ১৯ দিন ধরে পরম মমতায় কোলে মাথা রেখে শুইয়ে দুবেলা সোপ্রামাইসিন লাগিয়ে দিয়েছে বাবা, তুলে দিয়েছে একটা একটা করে মামড়ি (শুকিয়ে যাওয়া পোড়া চামড়া), তাও হয়নি শেষ রক্ষা। 


তবে এসব ব্যথা বেদনা তো কিছুই নয়, আইবুড়ো ভাত থেকে বৌভাত পর্যন্ত আমি ছিলাম বর বা বউয়ের পর সবথেকে বড় দ্রষ্টব্য, সবথেকে বড় আলোচ্য। লোকজন খুঁজে খুঁজে আমায় বার করছিল মাইরি, পারলে ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখছিল প্রতিটা ফোস্কা, বিস্তারিত গল্প শুনছিল মা- মাসিদের মুখে, কেমন করে বাবামায়ের অনুপস্থিতির সুযোগে আগুন নিয়ে খেলতে গিয়ে লঙ্কা কাণ্ড বাঁধিয়েছি আমি। হনুমানের ল্যাজে আগুন লাগানো হয়েছিল, আমি আমার মাথায়, এই যা তফাৎ। বড়দার দু চারজন বন্ধুপত্নী, বৌদির বাপের বাড়ির কয়েকজন তরুণী জননী তো নিজেদের ছানাপোনা গুলোকে ধরে এনে আমাকে দেখাল, “দেখেছ, মায়ের কথা না শুনলে কি হয়-।”নিজেকে এক্কেরে চিড়িয়াখানার শিম্পাঞ্জি মনে হচ্ছিল মাইরি বলছি। 


বৌভাত শেষ হতে হতে গড়িয়ে গেল মধ্য রাত। এবার ফুলশয্যার পালা, সেখানে কোন রকম পাকামি করার দুঃসাহস আমার নেই, অগত্যা নবদম্পতিকে শুভরাত্রি জানিয়ে, এবার বাড়ি ফেরার পালা। আচমকা বৌদি ডাকল, “ এই ঝুনু শোন- ”। দৌড়ে গিয়ে দেখি, বৌদির হাতে একটা সুসজ্জিত শোলার ট্রে, ট্রের ওপর সোনালি সেলোফেন কাগজে মোড়া আমার তৎকালীন প্রিয়তম রঙের একটা শাড়ি। শুধু কি শাড়ি, আরও কত যে প্রসাধন দ্রব্য। হাতে ধড়াম করে ধরিয়ে দিয়ে, প্রবল জোরে গাল টিপে বৌদি বলল, “আমার সাজুনি ননদের জন্য।” কয়েক মুহূর্ত সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকিয়ে প্রশ্ন করলাম, “আমার? সব আমার?” গুণে গুণে ৩২ টা দাঁত বার করে বৌদি বলেছিল, “নয়তো কি আমার?” অতঃপর বুঝতেই পারছেন, “আজকাল পাঁ’ও জমি পে নেহি পড়তে মেরে-”। 


আর আমার শাড়িটা? ওটার বয়স অত নয়। নেহাৎই অর্বাচীন, আড়াই-তিন মাস ধরুন। খাস বাংলাদেশী জামদানি। ওপাড়ের শাড়ির প্রতি প্রেমটা উস্কে দিয়েছে আমার সহকর্মী তথা সহচরী সঙ্গীতা। সেই কবে থেকে অক্লান্ত ভাবে খুঁচিয়েই গেছে, “ও সুকন্যাদি, ও অনিন্দিতা দি একটা বাংলাদেশী ঢাকাই কেন না গো।” কিনব যে, কি দাম বাপরে বাপ। আমাদের দৈনন্দিন কর্মব্যস্ত জীবনে অত দামী শাড়ি পরার সুযোগ কোথায়। বলি বটে, তাও হ্যাংলার মত বাংলাদেশী জামদানি শাড়ির পেজ গুলোতে ঘুরে বেড়াই তিনজনে। দাম জিজ্ঞেস করি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে। দীর্ঘশ্বাস ফেলি সম্মিলিত ভাবে, প্রতিজ্ঞা বদ্ধ হই আর যাব না ওসব বড়লোকের পেজে। পরদিন সকাল থেকে আবার শুরু হয় হ্যাংলামো। 


বোধহয় দীপাবলির আগে পরে এমনিই এক পেজের মালকিন লিখলেন, আসন্ন শীতে কি যেন মেলা উপলক্ষে তিনি কলকাতা আসছেন, সঙ্গে আনছেন শাড়ির ডালি। খুশির চোটে ঝাঁপিয়ে পড়ল কলকাতার সুন্দরীরা। পিছিয়ে রইলেন না উত্তরবঙ্গ এমনকি রাঢ় বাংলার রূপসীরাও। অনেকে তো ঘোষণাই করে দিলেন, ডেট জানালেই কেউ ট্রেনের টিকিট কাটবেন তো কেউ প্লেনের। এরই মধ্যে আমার মত মানসিকতারই কেউ বোধহয় জানতে চাইলেন, “শাড়ির দাম কত রাখছেন আপু?” জবাব এল দুই- আড়াই থেকে শুরু। 


খুশির চোটে স্ক্রিনশটই পাঠিয়ে দিলাম সঙ্গীতাকে, “যা আর কেন।” সঙ্গীতা হাফ ডজন দুঃখী ইমোজি পাঠিয়ে লিখল, "আর শাড়ি কিনলে, মা তাড়িয়ে দেবে অনিন্দিতা দি। তবে তুমি যদি কেন, আমি তোমার সঙ্গে যেতে পারি।” ধুর, মেলা চলাকালীন যে কলকাতা যেতে পারব তার স্থিরতা কোথায়? তাছাড়া রোজের এই ১৫০ কিমি যাতায়াত, কেমন যেন ফোঁপরা করে দিচ্ছে আমায়। কেবল ঘুম পায়। এরপর সপ্তাহান্তে শাড়ি কিনতে যাবার জন্য মহানগর যাবার কথা ভাবলেও ক্লান্তিতে মুচড়ে ওঠে দেহ। আর থেকে থাক, দরকার নেই।

 

আমি থাক, ছাড়, যাই বলি, কমলি শুনলে তো। সঙ্গীতা অপ্রতিরোধ্য, “তোমাকে আসতে হবে না অত দূর থেকে। আমি যাব তোমার শাড়ি কিনতে। ওখান থেকে তোমায় ভিডিও কল করে দেখাব।” কি যেন দপ্তরী জটিলতায় সেদিন বেজায় উত্তপ্ত ছিল সুকন্যার মন আর মাথা। ঠাণ্ডা করতে বললাম, “ একা যাবি কেন সঙ্গীতা, ওটাকেও ধরে নিয়ে যা।” “অত দামী শাড়ি আমি কিনব না” বুলেটের মত ভেসে এল সুকন্যার জবাব, এবং “ তবে যাব অবশ্যই, তোমার জন্য।”


এসব কথাবার্তার পর কেটে গেছে বেশ কিছুদিন। বদলে গেছে এপার বাংলা- ওপার বাংলার ঋতু। আমিও ভুলে গেছি সাধের বাংলাদেশী জামদানির কথা। দীর্ঘ দিন পর, বড় সাহেবের অনুমতি নিয়ে বাড়ি ফিরেছি দোঁহে, পাক্কা তিনদিন শীতের কলকাতাকে উপভোগ করতে। রন্ধ্রে রন্ধ্রে ভরে নিতে বুড়ি শহরটার উত্তাপ। সারা সকাল ঘর সাফাই করে, এক পেট মোমো,থুকপা আর বাও দিয়ে ভুঁড়ি ভোজ সেরে প্রগাঢ় দিবানিদ্রায় আচ্ছন্ন হয়েছি, সুকন্যার ফোন, “ওরে কুম্ভকর্ণ ওঠ রে। মেমসাহেব কলকাতায় এসে নাক ডাকাচ্ছেন, আর আমরা ওনার জন্য শাড়ি কিনতে দৌড়চ্ছি।” সুকন্যার ধ্যাতানি খেয়ে ধড়মড় করে উঠে বসি, সুকন্যা ওদিকে তখনও গলা ফাটিয়ে চেঁচাচ্ছে, “ হ্যালো- হ্যালো- হ্যালো, এখানে একদম টাওয়ার নেই। তোমাকে বেশ কয়েকটা ছবি পাঠিয়েছে সঙ্গীতা, দাম সবকটার সাধ্যের মধ্যে, দেখে ঝটপট বলো। এখানে এবার মারপিট লাগবে, তোমার পছন্দ সই রঙের যেটাতেই হাত দিচ্ছি সঙ্গীতা আর আমি, আরো চারজন ঝাঁপিয়ে পড়ছে।” 


শুনতে শুনতে কেমন যেন বিমোহিত হয়ে গেলাম, আমার দুই সহচরী, কেবল আমার জন্য সপ্তাহান্তের বিশ্রাম ফেলে ঠেঙ্গিয়ে অত দূর গেছে, আমার মনের মত দামে, আমার পছন্দসই একটা শাড়ি কিনতে! এরপর তো প্রশ্ন করতেই হয়, “বোলো দেখা হ্যায়  হয় কভি, তুমনে মুঝে উড়তে হুয়ে?”

অনির ডাইরি ১৬ই ফেব্রুয়ারি, ২০২৪

#অনিরডাইরি #তাম্রলিপ্তকড়চা 


#শ্রমছন্দে_ক্রীড়ানন্দে পর্ব - ১


“ম্যাডাম, এই বার ঐ খেলাটা হবে তো?” শীত পড়ার আগে থেকেই আমার সহকর্মীদের মুখে একটাই কথা। গত বছর তমলুক মহকুমার সাতটি ব্লক আর দুটি পুরসভা মিলিয়ে একটা বড় ক্যাম্প করেছিলাম আমরা, লক্ষ্য ছিল শ্রম দপ্তরের কল্যাণমূলক প্রকল্প গুলি সম্পর্কে জনচেতনা বৃদ্ধি, অসংগঠিত শ্রমিকদের নাম নথিভুক্তিকরণ, জনসমক্ষে কিছু অনুদান প্রদান ইত্যাদি প্রভৃতি। গতানুগতিক কাজ, বৈশিষ্ট্য কেবল একটাই, সমগ্র ব্যাপারটা হয়েছিল খেলার মাধ্যমে। 


খেলা বলতে ছেলেদের ক্রিকেট আর মেয়েদের ১০০ মিটার দৌড়, মিউজিক্যাল চেয়ার আর দড়ি টানাটানি। আধিকারিক থেকে ইন্সপেক্টর, সিকেসিও থেকে করণিক, চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী থেকে কালেক্টিং এজেন্ট,এসএলও, আমাদের অসংগঠিত শ্রমিককুল সবাই এক সাথে, এক মাঠে। দপ্তরী কাজও যে এত রঙিন, এত চিত্তাকর্ষক হতে পারে কেউ অনুভব করিনি তার আগে। 


তবে সে তো ছিল গেল বছরের কথা। এ বছর তো একে রীতিমত ভাঁড়ে মা ভবাণী অবস্থা আমাদের। তার ওপর পরপর চলতে থাকা দুয়ারে সরকার, স্পেশাল ড্রাইভ, জন সংযোগ। সবাই যে একত্রিত হয়ে একটা দিন অন্যরকম কিছু করব, তার সুযোগ কোথায়? এদিকে বিদায় নিচ্ছে শীত, বাতাসে লাগছে উষ্ণতার ছোঁয়া, বাড়ছে রোদের তেজ। তার সাথে সাথে বাড়ছে পাঁশকুড়ার ইন্সপেক্টর সন্দীপের ঘ্যানঘ্যানানি। “এবার কি তাহলে খেলা হবে না? আর কবে খেলব?” একে রামে রক্ষে নেই, সাথে দোসর যোগাড় করে, কাঁথির ইন্সপেক্টর দীপঙ্করকে। যাকে ফেবুর আপামর জনগণ 'রোনাল্ডো দীপঙ্কর' বা "রোনাল্ডো" নামেই চেনে।


 রোনাল্ডো শুধু খেলা পাগলই নয়, বদ্ধ পাগল। না হলে আমার কাছে কেউ জেলাস্তরীয় এমন ক্যাম্প করার আব্দার করে? জেলা কি আমার? জেলা তো বড় সাহেবের। আমার দৌড় তো কেবল তমলুক মহকুমার চার দেওয়ালের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। 


তাই বলে রোনাল্ডোকে দমায় কে? উৎসাহের আতিশয্যে তিনি ফোন করে বসেন খোদ কাঁথির মহকুমা শাসককে। জানুয়ারি মাস, ভালো মত বইছে শৈত্য প্রবাহ, সন্ধ্যা বেলা অফিস থেকে ফিরে নৈশ ভ্রমণে বেরিয়েছি দোঁহে, শৌভিক বলল, “আজ রোনাল্ডোকে খুব বকেছি। অফিস টাইম, কেসের হিয়ারিং নিচ্ছি, তারই মধ্যে ফোন করে বলে, ‘স্যার আমি আইএমডব্লিউ বলছি, অরবিন্দ স্টেডিয়ামটা একটু দিন না, খেলব।‘ আমি তো ব্যাপারটা বুঝতেই পারিনি প্রথমে। তারপর বুঝে বললাম, ২৬ শে জানুয়ারির পারেডের আগে তো দেওয়া যাবে না, তোমরা একটা চিঠি দাও, দেখছি। সামান্য ফি লাগে, তবে সরকারী অনুষ্ঠান হলে তা মুকুব হয়ে যায়। তারপর বলে, ‘স্যার কিছু তো জার্সি বানাতে হবে, বেশি না, চার পাঁচ হাজারের মত পড়বে, আপনাকেও ব্যাট হাতে নামাব স্যার। আপনি খেললে দারুণ হবে।‘ হিয়ারিং এর মাঝে এত খেজুর শোনা যায়? দিলাম ধমক, ধুৎ তুমি ফোন রাখো তো।“


রোনাল্ডো আর শৌভিকের ধমকধামকের ইতিহাস অবশ্য আজকের নয়। এর আগেও হয়েছে। মহকুমা শাসক দুয়ারে সরকারের শিবির পরিদর্শনে এলেই সেলফি তোলার আব্দার করে রোনাল্ডো। প্রথম বার সেই আব্দার পূরণ করলেও, দ্বিতীয় বার তাড়া করেছিল শৌভিক। এতদসত্ত্বেও কি ভাবে যেন ঠিক একটা সেলফি তুলেই নেয় রোনাল্ডো, এবং মহকুমা শাসক শিবির ত্যাগ করার সাথে সাথেই তা আমাকে পাঠিয়ে জানতে চায়, “স্যারের সাথে এই ছবিটা কি ফেসবুকে দেব?” ঘটনা প্রবাহ সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞ আমি, আকাশ থেকে পড়ে জবাব দিই, তোমার অ্যাকাউন্ট, তুমি যার সাথে ইচ্ছে ছবি পোস্ট কর। এবারেও তাই করে রোনাল্ডো, এসডিও সাহেবের বকুনি খেয়েই আমাকে ফোন করে, “ম্যাডাম পারলে আপনিই পারবেন।“ 

রোনাল্ডোর আশা ভরসা অসীম হলেও, বাস্তব যে বড় রূঢ়। ফান্ডের অভাবে এবছর আর “খেলা হবে” না, বলেই সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললাম আমরা। আচমকা সবাইকে হকচকিয়ে কিছু অ্যাল্লটমেন্ট এসে ঢুকল কলকাতা থেকে, কায়মনোবাক্যে চিনি চাইলে বোধহয় ঠিক জুটিয়েই দেন চিন্তামণি।


অনির ডাইরি ১৬ই ফেব্রুয়ারি, ২০২৪

#অনিরডাইরি #তাম্রলিপ্তকড়চা 

#শ্রমছন্দে_ক্রীড়ানন্দে পর্ব - ২


 ফান্ড তো এল, কিন্তু হাতে সময় যে একদমই নেই। দুয়ারে সরকারের সার্ভিস ডেলিভারি মিটতে না মিটতেই এসে পড়ল জনসংযোগ। জনসংযোগ কার্যকলাপ শেষ হতেই সরস্বতী পুজো। তারপর উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা, পরীক্ষা মিটলেই আসন্ন সংসদীয় নির্বাচনের অবশ্যম্ভাবী ঘোষণা।


 তড়িঘড়ি করে গুগল শিট ভাসায় সিকেসিও শান্তনু। বিভিন্ন ব্লক, পুরসভার ইন্সপেক্টরদের বলা হয়, নাম তোল। ছেলে এবং মেয়ে, যে যে খেলা খেলতে ইচ্ছুক, তাতেই নাম দিক। 


ছেলেরা সংখ্যাগুরু, তাই ক্রিকেট নিয়ে উচ্ছ্বাস সব থেকে বেশি। বিজয়ী টিমকে ট্রফিও যে দেব আমরা। গাল ভরা নাম, BMSSY Cup। গত বার ব্লক-পুরসভা ধরে টিম গড়তে গিয়ে হেব্বি নাকাল হয়েছিলাম আমরা। দেখা গিয়েছিল দুই পুরসভা আর শহীদ মাতঙ্গিনী ব্লকের কোন টিমই তৈরি হচ্ছে না। পরিস্থিতি সামলাতে সাতটা ব্লক আর দুটো পুরসভাকে দুই-দুই করে ভাগ করে বানানো হয় চারটে টিম। আর টিম গুলোর নাম রাখা হয় পূর্ব মেদিনীপুরের চার ভুমি পুত্র- কন্যার নামে। যথা- শহীদ মাতঙ্গিনী একাদশ, অজয় মুখার্জি একাদশ, সতীশ সামন্ত একাদশ এবং সুশীল ধাড়া একাদশ। 


কিন্তু তাতেও ঠিক সুষম হয়নি টিম গঠন। শহীদ মাতঙ্গিনী ব্লকের ইন্সপেক্টর তথা শহীদ মাতঙ্গিনী একাদশের সেবারের ক্যাপ্টেন, মণীশ আজও গরগর করে, “আমার কোন টিমই ছিল না ম্যাডাম। সব দলের উদ্বৃত্ত লোকগুলোকে মেগে মেগে টিম বানিয়েছিলাম আমি। এবারে ওরকম করলে খেলব নি।” মণীশ সব বলে, কেবল এটা বলে না যে ঐ ভাবে গঠিত টিম নিয়েও ফাইনালে উঠেছিল মণীশের টিম। ফাইনালে সতীশ সামন্ত একাদশের কাছে খেলায় পরাস্ত হলেও স্লেজিং এ জিতেছিল মণীশের টিমই। যোশুয়া, বেদজ্যোতি আর সন্দীপকে কি আওয়াজই না দিয়েছিল জয়ন্ত রাণা, “লজ্জা করে না, তিনটে ঝানু ইন্সপেক্টর একদিকে আর একটা বাচ্ছা ইন্সপেক্টর (মণীশ) একদিকে।”


এবারে কিভাবে টিম গঠন হবে, তাই নিয়ে বেশ খানিক তর্ক বিবাদ করে জনগণ। বেদজ্যোতি প্রস্তাব দেয় নিলাম হোক, আইপিএল এর মত। তাতে আমার আর সিকেসিও শান্তনুর উল্লাসের আর শেষ থাকে না। তোল ব্যাটাদের নিলামে, যে টাকা উঠবে, তাতে রোল- চাউমিন-মোমো কিছু তো হবে। আহাঃ। গুগল শিটে নাম তোলার সময় বলা হয়, মেয়েদের ক্ষেত্রে বিশদে লিখতে কি খেলতে চায়, আর ছেলেদের ক্ষেত্রে কি করতে ইচ্ছুক ব্যাটিং, বোলিং নাকি উইকেট কিপিং। 


কে যেন প্রস্তাব দেয়, গেল বার বগলে হেব্বি ব্যথা হয়েছিল, এবার বরং বল ছোঁড়া হোক। হক বাবু তাকে ধমকে ভাগিয়েই দিলেন আমার চেম্বার থেকে, “না ম্যাডাম, খেললে ঠিকঠাক খেলব।” গুগল শিট উপচে গেল অচিরেই। এবার টিম নির্বাচনের পালা। তবে তারও আগে দরকার ক্যাপ্টেন নির্বাচন। গেল বার সৌম্য- শান্তনু- মণীশ আর সন্দীপ চার নবীন ইন্সপেক্টর ক্যাপ্টেন হয়েছিল। এবার ওরা বাদ, বাকিদের মধ্যে থেকে কেউ ক্যাপ্টেন হোক। যোশুয়া–বেদজ্যোতি এক কথায় রাজি। বাকি দুটো টিমের ক্যাপ্টেন্সি নিয়ে সামান্য দ্বিধা গ্রস্ত ছিলেন হক বাবু আর শুভাশিস, ইন্সপেক্টর সাহেবরা থাকতে আমরা কেন। ধমকে সব সঙ্কোচ ভাগানো হল। খেলা মানে খেলা, সেখানে আবার আধিকারিক আর করণিক কিসের।  


জার্সি তো আমাদের কেনাই ছিল, সবুজ- নীল- সাদা- হলুদ জার্সি। গেল বার খেলা শেষে খুঁজে, খুঁজে সবার গা থেকে ঘেমো জার্সি খুলিয়েছিলেন হক বাবু। শুধু কি জার্সি- আম্পায়ারের টুপি, রেফারির হুইসল পর্যন্ত সব কেচে- সাফ করে গুছিয়ে রেখেছিলেন। ভাগ্যে রেখেছিলেন। সবুজ জার্সি পেল বেদজ্যোতির সতীশ সামন্ত একাদশ, হলুদ পেল যোশুয়া মুর্মুর অজয় মুখার্জি একাদশ, সাদা পেলেন হক বাবুর শহীদ মাতঙ্গিনী একাদশ আর নীল পেল শুভাশিস ধাড়ার সুশীল ধাড়া একাদশ।  


ক্যাপ্টেন নির্বাচনের পর, এবার টিম নির্বাচনের পালা। মোমো- চাউমিনের ওপর জল ঢেলে চার ক্যাপ্টেন ঘোষণা করল, নিলাম হবেনি। টিম হবে লটারির ভিত্তিতে। সব থেকে জবরদস্ত টিম হল, যোশুয়ার। সেরা প্লেয়ার গুলো অজয় মুখার্জি একাদশের ভাগ্যেই পড়ল। বেদজ্যোতির মোটামুটি। বাকি দুটো টিমের ক্যাপ্টেন তো কেঁদেই আকুল। শুভাশিস তো রীতিমত পিছন পিছন ঘুরতে লাগল, “ও যোশুয়া স্যার, আমার টিমের অবস্থা দেখতেছেন? আমায় কটা প্লেয়ার দ্যান।” হক বাবু হাত কচলান আর বলেন, “আমার তো বোলার-ব্যাটার কিছুই নাই। খেলবে কেমনে?” 


তখনও আমরা কেউ জানি না, যে খেলার ঠিক চার দিন আগে যোশুয়াকে বিদায় জানাতে হবে আমাদের। গোটা টিমের সে কি মন খারাপ। অরূপ বারবার বলতে থাকে, “যোশুয়া স্যার না এলে কি করে হবে? গেল বার তো যোশুয়া স্যারের ব্যাট, উইকেটেই খেলা হয়েছিল।” তমলুকের শেষ দিনেও যোশুয়া আশ্বস্ত করতে থাকে, “আমি আসব ম্যাডাম। আমি ঠিক আসব।” কে জানে আসতে পারবে কি না, আর তো যোশুয়ার ওপর আমাদের কোন অধিকার নেই। যার ওপর আছে, দেখা যাক সে খেলতে পারে কি না। বেদজ্যোতিকে বলি, মুকুলকে ধর তো, দেখ ও খেলে কিনা। আর সৌম্য রেডি হয়ে যাও, ভাইস ক্যাপ্টেন থেকে ক্যাপ্টেন্সি করার জন্য। যতই মন খারাপ হোক, হতোদ্যম হলে চলবেনি। তিনি বলে গেছেন না, " The show must go on."





অনির ডাইরি ১৬ই ফেব্রুয়ারি, ২০২৪ 

#শ্রমছন্দে_ক্রীড়ানন্দে পর্ব -৩ 

#অনিরডাইরি #তাম্রলিপ্তকড়চা 

রোনাল্ডোর ক্রীড়া প্রেম এতই প্রখর, যে বিগত কয়েক মাসে যখনই কোন কাজে ডিএম অফিসে এসেছে, আমার কাছে দরবার করে গেছে, গেল বারের মত, যদি এবারেও আমরা “শ্রমছন্দে ক্রীড়ানন্দে” আয়োজন করি, তাহলে এবারে কিন্তু ও খেলবে, বিগত বারের মতো নিছক আম্পায়ারিং এ সন্তুষ্ট থাকবে না।শুধু ও একা খেলবে না, কাঁথি–এগরা মিলিয়ে আরও জনা চারেক তরুণ ইন্সপেক্টরও নাকি খেলতে ইচ্ছুক। শুধু একবার হাঁক পাড়ার অপেক্ষা। 


কথা নেই, বার্তা নেই, অন্য আপিসের ইন্সপেক্টরদের অমন ডাকা যায় নাকি? তাদের বড় সাহেবরা রেগে যাবেননি? তাছাড়া আমার বড় সাহেবই বা কি কইবেন, অনিন্দিতা তুমি পুরো জেলাটাকেই নাচাচ্ছ? অনেক বাধাবিঘ্ন পেরিয়ে যখন অবশেষে আমাদের “শ্রমছন্দে ক্রীড়ানন্দে”র দিনক্ষণ নির্ধারিত হল, আমি হুলিয়া জারি করলাম, “রোনাল্ডোকে যে খবর দেবে, তাকে আমি বল বয় বানিয়ে, তার জায়গায় ওকে খেলতে নেব।“ 


এতদসত্ত্বেও যে খবরটা রোনাল্ডোর কানে পৌঁছেছে, বিলক্ষণ বুঝতে পারলাম, যখন রোনাল্ডো আমাকে, কয়েক ডজন ক্রন্দনোন্মুখ ইমোজী সহ ব্যক্তিগত মেসেজ পাঠালো, “এই মরশুমে একটাও ম্যাচ খেলতে পারিনি ম্যাডাম, বেঁচে থেকে আর লাভ নেই।“ এর জবাবে আর কিই বা বলার থাকে, “আচ্ছা বাবা বেঁচে বর্তে থাক, তোমাকে একটা ম্যাচ খেলার সুযোগ আমি করে দিতে পারব, আশা করছি” ছাড়া। 


পরদিন অফিসে এসে প্রস্তাব রাখলাম, যে কড়কড়ে পাঁচশ টাকা ফেলবে, রোনাল্ডো তার। কেউ পাত্তাও দিলো নি। নামতে নামতে এক প্লেট মোমো অবধি নামলাম, তাও না। শেষ পর্যন্ত লটারি হল, এবং বেদজ্যোতিই পেল রোনাল্ডোকে। চোর পালালে বুদ্ধি বাড়ে, খেলার মাঠে বসে মনে হল, মস্ত ভুল হয়ে গেছে। মোমোটা তো রোনাল্ডোর কাছে চাইতে হত 👹-




অনির ডাইরি ১৩ই ফেব্রুয়ারি, ২০২৪

#অনিরডাইরি #তাম্রলিপ্তকড়চা



তমলুকে এসে একটা জিনিস আবিষ্কার করলাম, যে এখানে যখনই কোন সদস্যের বিদায়ী নির্ঘোষ ভেসে আসে, তাকে বিদায় সম্বর্ধনা তো জানানো হয়, কিন্তু তা কখনই সম্মিলিত ভাবে নয়। অফিস, অফিসের মত স্মৃতিচারণা পূর্বক পুষ্পস্তবক, মিষ্টি, উপহার সামগ্রী তুলে দেয় বিদায়ী সদস্যের হাতে। বিভিন্ন ব্লক, পুরসভা থেকে এসএলওরা আসে সাধ্যমত উপহার নিয়ে, দুদণ্ড কথা বলে বিদায় নেয়। সবই হয়, কিন্তু কোথাও যেন কেটে যায় সুর।


চুঁচুড়ায় তো এমন হত না। আমরা সবাই সম্মিলিত ভাবে স্বাগত/ বিদায় জানাতাম। প্রায় সন্ধ্যা ছটায় শুরু হয়েছিল আমার ফেয়ারয়েল। তার আগে সময় দিতে পারিনি আমি। আমার সহকর্মীদের পাশাপাশি প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে আসা এসএলও–কালেক্টিং এজেন্টরাও বসেছিলেন ধৈর্য ধরে। সত্যি কথা বলতে কি, আমরা যে বয়সে এসে উপনীত হয়েছি, বিদায়বেলায় মুল্যবান উপহারের থেকেও একত্রিত হয়ে স্মৃতিচারণ আমাদের কাছে বেশি প্রিয়।আসন্ন নির্বাচনী গুঁতোয় যখন আমাদের তমলুক ব্লকের ইন্সপেক্টর যোশুয়া মুর্মুর বিদায় পাকা হল, প্রস্তাব রাখলাম, এবার না হয় ফেয়ারয়েল একটাই হোক। 


কাল ছিল জন সংযোগের অন্তিম দিন। মাননীয়ার নির্দেশ মোতাবেক বুথে বুথে চলছে ক্যাম্প। যা চলবে, পাক্কা সাড়ে পাঁচটা পর্যন্ত। ক্যাম্প মিটিয়ে সকলে যখন জমায়েত হল, ততোক্ষণে প্রায় জনশূন্য নিমতৌড়ির নব্য প্রশাসনিক চত্বর। বাইরের হল ঘরে, দুটো লোহার ডেস্ক পাশাপাশি জুড়ে তৈরি করা হল মঞ্চ। সব মিলিয়ে প্রায় পঞ্চাশ জন আমরা, অফিসের সব চেয়ার জুড়েও বসার সুযোগ হল না সকলের। সঙ্কোচে বসতেই চাইছিল না যোশুয়া, ডেকে ধমকে বসালাম আমার পাশে। আজ তো তোমারই দিন, আজ তোমার জন্যই ছুটে এসেছে প্রতিটা ইন্সপেক্টর থেকে সিকেসিও, এসএলও এমনকি বয়োজ্যেষ্ঠ কালেক্টিং এজেন্টও। 

এবার স্মৃতিচারণের পালা। ভেবেছিলাম লিখে আনব, প্রায় দু বছর তিনমাস একসাথে কাজ করেছি, স্মৃতি অগণিত। সময়াভাবে আর লিখে উঠতে পারিনি, ভাবনা গুলোও গুছিয়ে উঠতে পারিনি সেই ভাবে। পরিস্থিতি সামলাতে ঘোষণা করলাম, সবার শেষে বলব আমার মনের কথা। সবার আগে বলুক, আমার সিনিয়র মোস্ট ইন্সপেক্টর। সেটা কে? সে তো যোশুয়া মুর্মু স্বয়ং। আর তার অবর্তমানে? 


দাঁত কিড়মিড় করতে করতে বক্তব্য রাখতে উঠল সৌম্য। আমার এই চূড়ান্ত নাটুকে ইন্সপেক্টরটি অসম্ভব সুবক্তাও বটে। সারা দিন ক্যাম্প, ইন্সপেকশন ইত্যাদি সেরে ছুটে এসেছে, আমার মতোই অগোছাল স্মৃতিগুলো। খানিক গাইগুঁই করল বটে, তারপর বরাবরের মতোই অসাধারণ বক্তব্য রাখল। তারপর রঞ্জিত, সৌরভ, বেদজ্যোতি, তারপর আমার তিন নবীন ইন্সপেক্টর। যাদের বয়স প্রায় দুই হতে চলল, তাও আমি “বেবি ইন্সপেক্টর” বলা আর ছাড়লাম না। প্রায়শই বলি, আমার তিনটে বেবি। বেবি গুলো বড়ই হয়েছে যোশুয়া-সঞ্জয়-সৌরভ-বেদজ্যোতিদের হাত ধরে। হাতে করে কাজ শিখিয়েছে সিনিয়র ইন্সপেক্টররা ওদের। বেবি ইন্সপেক্টর গুলোও সিনিয়র দাদাদের গুরু বলেই মানে। দিনে দশবার ফোন করে, সমস্যায় পড়লেই একে অপরের দিকে বাড়িয়ে দেয় নির্ভরশীলতার হাত। আমার অফিসে কোন ইগো নেই, নেই কোন মাতব্বরী। সেই সব কথা বলতে বলতে কারো ছলছলিয়ে আসে চোখ, কারো বা ধরে আসে গলা, কারো বা লাল হয়ে ওঠে মুখ।


ইন্সপেক্টরদের পর সিকেসিওদের পালা। শুভাশিস, শুভদীপ্ত, নন্দন, সৌমেন এবং শান্তনু। শান্তনুর অবস্থা দেখে সকাল থেকে বলে আসছি, একদম কাঁদবে না, কাঁদলেই ঠ্যাঙাব। চোখের জলে নয়, বরং হাসি মুখে বিদায় জানাব আমাদের যোশুয়াকে। ঠ্যাঙানির ভয়ে শান্তনু না কাঁদলেও পুষিয়ে দিলেন আমাদের এসএলও জয়ন্ত রাণা। চোখের জল বড় ছোঁয়াচে জানেন, এতক্ষণের জমে থাকা বেদনা হুহু করে বেরিয়ে এল বাঁধ ছাপিয়ে। কাকে ছেড়ে, কাকে সামলাই।

 

এই শোকাকুল পরিস্থিতির মধ্যে বক্তব্য রাখতে গিয়ে বড় রাগ হচ্ছিল নিজের ওপর, আগে বলে নিলেই হত। গলা ঝেড়ে বললাম, যোশুয়ার নাম আমি প্রথম শুনি আমার প্রাক্তন আরএলও ইন্সপেক্টরের মুখে। ২০২১ এর পুজোর ছুটি পড়ার দিন সন্ধ্যা বেলায় বেরোল ট্রান্সফার অর্ডার, বাবা হাসপাতালে, মন মেজাজ হাকুচ তেঁতো, তারই মধ্যে কৌশিক ফোন করে বলল, “ আমি সব খবর নিয়ে নিয়েছি ম্যাডাম। ওখানে আমার ব্যাচমেট আছে, যোশুয়া মুর্মু, আপনার কোন চিন্তা নেই।“ হাসি চেপে জানতে চেয়েছিলাম, আমার চিন্তা নেই, না যোশুয়া মুর্মুর চিন্তা নেই? কৌশিক জোর গলায় বলেছিল, “ওর তো নেইই, আপনারও নেই।“


যোশুয়ার নাম দ্বিতীয় বার শুনলাম আমার পূর্বসূরির মুখে। নতুন অফিসের দায়িত্বভার নেবার আগে যেমন হয় আর কি, জানতে ফোন করেছিলাম, কেমন অফিস, কেমন চাপ? লোকজন আদৌ আছে কি? থাকলে তারা কেমন? কুন্তল জোর গলায় বলেছিল, “ভীষণ কাজের ছেলে। যত চাপই আসুক, ঠিক সামলে দেবে।“ 


তমলুকে এলাম, চার্জ নিলাম, খোলা হল টিম তাম্রলিপ্তের অফিশিয়াল গ্রুপ। আমি সাধারণত মাতৃভাষাতেই মেসেজ করতে স্বচ্ছন্দ বোধ করি, যোশুয়াকে যখনই কোন উপদেশ/নির্দেশ বা অনুরোধ করি, জি বোর্ড মুড অনুযায়ী একেক দিন, একেক রকম বানান লেখে। কখনও জশুয়া, কখনও বা জসুয়া বা যশুয়া। কোন এক আড্ডায় কি যেন কথা প্রসঙ্গে জনৈক বন্ধু একদিন বলল, “ নাম হল প্রপার নাউন। যে, যা বানান লেখে, তাকে সেইভাবে লেখাই যুক্তিযুক্ত।“ শুনে গেল পিলে চমকে। বাবা গো, যোশুয়া কি বানান লেখে? উত্তর পেয়ে বুঝলাম, বাংলা ইংরেজি দুটোতেই আমি ডাহা ফেল। 


যোশুয়ার কথা বলতে গেলে এরপরই বলতে হয় যোশুয়ার ট্রান্সফারের কথা। এটা নয়, এর আগের ট্রান্সফার। সেদিন ছুটি নিয়ে আমি কলকাতায়, এক যুগ পর গেছি পার্লারে, আধ শোয়া হয়ে শাম্পু করছি সৌরভের, ফোন “আইএমডব্লিউদের ট্রান্সফার অর্ডার বেরিয়েছে ম্যাডাম।“ বাঃ। এতো ভালো খবর, আমরা পাচ্ছি কটা? সৌরভ বলল, “একটা ম্যাডাম।“ মাত্র একটা? কি আর করা যাবে। যাক তা আমাদের কাউকে তোলেনি তো? “হ্যাঁ ম্যাডাম তুলেছে তো। চার জনকে তুলেছে?” মানে? আমার চারটে ছেলেকে তুলে কেবল একটা দিয়েছে? “আজ্ঞে হ্যাঁ ম্যাডাম।“ ঐ অবস্থায় যতজনকে নালিশ করা যায় করলাম, যত জনের সাথে ঝগড়া করা যায় করে ফেললাম। যোগাড় করে ফেললাম সম্মিলিত আশ্বাস, অনেকগুলো নতুন ছেলেমেয়ে জয়েন করবে শীঘ্রই, তখন পূরণ করা হবে আমার ভাণ্ডার।  দুঃখী চিত্তেই অভিনন্দন জানালাম আসন্ন বিদায়ী ইন্সপেক্টরদের, সান্ত্বনা একটাই যে তৎকালীন শ্রম মন্ত্রীর নির্দেশে সকলকেই বাড়ির কাছাকাছি পোস্টিং দেওয়া হয়েছে। সেটা লিখতেই যোশুয়ার মেসেজ, “অমুক ব্লকটা যেন কোথায় ম্যাডাম? দক্ষিণ দিনাজপুরে বোধহয়। আমার বাড়ি থেকে পাক্কা পাঁচশ কিলোমিটার।“ ব্যাপারটা মহানগরের গোচরে এনে, কি ভাবে সে যাত্রা যোশুয়ার বদলী রুখে দেওয়া যায় তা ওপরওয়ালারাই জানেন। সামান্য ঘ্যানঘ্যান আর সুকন্যার মাথা চিবানো ছাড়া আর কিছুই করিনি আমি, তবে ঐ যে ঝড়ে কাক মরলেও ফকিরের কেরামতি বাড়ে, তারপর থেকে কতজন যে বদলীর জন্য আমার কাছে দরবার করেছে তার ইয়ত্তা নেই। “প্লিজ ম্যাডাম, আপনি একবার সুকন্যা ম্যাডামকে বলুন।“ মাঝে মাঝে ভাবি, সুকন্যার নাম করে কিছু তোলা তুলে নিলে মন্দ হয় না, নানা ট্যাকা পুইসা নয়, খাসি বা মুরগি তো চাইতেই পারি?”সুকন্যা না জানলেই তো হল 😉।


বলতে বলতে খানিক থামি আমি, কিঞ্চিৎ দম নিই আমি। সামনে রাখা, প্রায় ঠাণ্ডা হতে বসা সিঙাড়ায় কামড় বসাই। ফান্ড-এ্যালটমেন্টের হাল, বিদায়ী ভোজ বলতে চা, সিঙারা, গজা আর অমৃতিই ভরসা। শ্রোতাদের দিকে তাকিয়ে দেখি, চোখের জল শুকিয়েছে, অনেকেরই মুখে হাসি ফুটছে, বাকিদের ফুটি ফুটি করছে। 


ফিরে যাই আমার গল্পে, সেই বর্ষায় আমি বললাম, চল ইলিশ পিকনিক করি। এই গরমে পিকনিক? তাও আবার ফ্যামিলি সহ? ততোদিনে আমার ছিট পাগলামোর সাথে জুড়ে গেছে সবাই, ফলে সাগ্রহে রাজি হয়ে গেল সকলে। শুভাশিস আর উত্তম সকাল সকাল কিনে আনল এত্ত বড় বড় ইলিশ। সর্ষে ইলিশ আর কালো জিরে,কাঁচা লঙ্কা বেগুন দিয়ে ইলিশ, সাথে কচু শাক ( ছিল কি?)। জম্পেশ হবে মধ্যাহ্ন ভোজ, তার আগে সামান্য গান বাজনা হবে নি? প্রথম চোটে না না করলেও ধীরে ধীরে গলা খুলল সকলে। প্লাস্টিকের চেয়ার বাজিয়ে গান ধরল যোশুয়া আর সিকেসিও শান্তনু, “দেখা না হায় রে, শোচা না হায়রে –।“ দু চক্ষে দেখতে পারতাম না গানটাকে, সহ্যই হতো না যেন। একদিনে, এক পারফরম্যান্সে ভালো লেগে গেল গানটা। আর একটা জিনিসও হল, বেতাল যেমন বিক্রমের ঘাড়ে চেপেছিল, আমিও এই দুই মক্কেলের মাথায় চাপলাম। তারপর থেকে অফিসে যাই হত, যোশুয়াকে গান গাইতেই হত। আর শান্তনুকে সঙ্গত দিতেই হত। 

শুধু কি গান? শ্রুতিনাটক নয়? অভিনয় নয়? মার্চ শেষে আচমকা কিছু টাকা দেওয়া হল, শিশু শ্রম বিরোধী জনচেতনা বৃদ্ধির জন্য। এত অল্প সময়ে কি করা যায়? মাত্র পনেরো মিনিটে ছিমছাম একটা নাটক লিখে ফেলল সৌম্য। মাত্র চার পাঁচ দিনের রিহার্সালে এক স্কুল বাচ্ছার সামনে নামিয়ে দিল আমার টিম। আমার বেবিতম ইন্সপেক্টর মণীশ সাজল শিশু শ্রমিক, আরেক বেবি ইন্সপেক্টর শান্তনু সাজল শিশু শ্রমিক নিয়োগকারী ময়রা মশাই আর যোশুয়া, মিনিমাম ওয়েজেস ইন্সপেক্টর। ময়রা মশাই আর তাঁর সহকারী হরিপদ যখন বাসন মাজতে অনিচ্ছুক শিশু শ্রমিককে উদোম পিটতে যাচ্ছেন, একদম দিওয়ারের অমিতাভ বচ্চনের মত, “অ্যাই, এসব কি করছেন আপনারা!” বলে হাতা গুটিয়ে মঞ্চ থুড়ি ক্লাশ রুমে ঢুকে এল যোশুয়া। আমার পাশে বসা হলদিয়ার বড় সাহেব সহর্ষে বলে উঠলেন, “সাবাস!” আর ক্লাশ ফেটে পড়ল কুচোকাঁচাদের করতালিতে। তারপর থেকে বেশ কিছুদিন পর্যন্ত যোশুয়াকে আমরা “এ্যাংরি ইয়ং ম্যান” বলেই ডাকতাম। 


রাত গড়াচ্ছে, সবাইকে বাড়ি ফিরতে হবে, এবার শেষ করা জরুরি। এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না, আজকের পর আর ফিরে আসবে না যোশুয়া।সরস্বতী পুজোর পর যেদিন অফিস খুলবে, হাজিরা খাতায় যোশুয়ার নামের পাশে লম্বা লাইন টেনে হক বাবু লিখবেন, transferred। এই তো জীবন কালিদা। আমরা হলাম পরিযায়ী পাখি, আজ এখানে, কাল না জানে কোথায়। সেটা আপাতদৃষ্টিতে বেশ কষ্টকর হলেও, সেটাই তো এই চাকরির মজা। আমরা হলাম বহতা নদী, এই বদলিটাই যে আমাদের শ্যাওলা পড়া থেকে বাঁচায়। যেখানেই যাচ্ছে যোশুয়া, সেখানেই খুব ভালো থাক, সুনাম অক্ষুণ্ণ থাকুক, বাকি এইটুকু তো রাজ্য আমাদের, এই কটা তো জেলা, আবার কখনও না কখনও কোথাও না কোথাও মোলাকাত তো হবেই।