Monday 29 June 2020

তুত্তুরী উবাচ ২৯শে জুন, ২০২০


তিনি আজকাল কথায় কথায় বলেন, “বুদ্ধিতে দুর্ভিক্ষ লেগেছে নাকি?” তিনি দাবী করেন, তিনি এক আজব লিপি আবিষ্কার করেছেন, যার জন্য তাঁর নোবেল পাওয়া উচিত। সাক্ষী আমাদের ফ্ল্যাটের দেওয়াল। লিপি তো নয়, এক্কেরে শিলালিপি, স্কচব্রাইট দিয়ে ঘষে ঘষেও তোলা যায় না। তিনি গভীর ঔৎসুক্য নিয়ে লক্ষ্য করেন, বাবা-মায়ের সম্পর্কের জোয়ার-ভাঁটা। অথচ যখন লাগে ষাঁড়াষাড়ি বান, তাঁকে বলা হয় যে কোন একজনের মূখপাত্র হয়ে অপরজনকে ভর্ৎসনা  করতে, ওমনি তিনি ভুলে যান, কি ভাবে যেন ভাজা মাছটা উল্টাতে হয়? তিনি বন্ধ দরজার ওপারে নিঃশব্দ শশকের মত কান খাড়া করে শোনের বাবা-মায়ের দাম্পত্য কলহ এবং অবস্থাবিশেষে বিনানুমতিতেই বিবেকের ভূমিকায় অবতীর্ণ  হন মঞ্চে। মাঝখান থেকে ভুলে যাই আমরা, কি নিয়ে যেন চলছিল কোঁদল পর্ব?
শুধু কি তাই, তিনি নানা বিষয় নিয়ে রীতিমত রসালো আলোচনা করেন বাবার সাথে-যেমন জানতে পারলাম মাসির সাথে খানিকটা দেখলেও গুরুদক্ষিণা সিনেমাটা তেমন পছন্দ হয়নি তাঁর। তবে নায়কের প্রেমে রীতিমত হাবুডুবু। নায়কটা কে ছিল গো বাবা? বাবা রহস্যময় হেসে জানায় নায়কের নাম। তুত্তুরী জানায় তার ওমন গোলুগালু ছোটখাট নায়ক দারুণ পছন্দ। বাবা জানতে চায় সদ্য দেখা রয়াল বেঙ্গল রহস্যের ভাস্কর বন্দোপাধ্যায়কে কেমন লেগেছে? ভালই লেগেছে তাঁর, তবে আপাততঃ তিনি দ্বিধাবিভক্ত  রঞ্জিত মল্লিক আর ভিক্টর ব্যানার্জীর মধ্যে। স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে মা, কিছুদিন ধরেই মায়ের প্রিয় পুরুষদের ওপর নজরদারি চালাচ্ছিলেন তিনি। মাঝে মাঝেই জানতে চাইছিলেন, “তুমি একে বিয়ে করবে?” ইশ্ সত্যিই যদি ক্যারি গ্রান্ট বা স্যার লরেন্স অলিভিয়ার এই প্রশ্নটা করত? নিদেন পক্ষে পিয়ার্স ব্রসনন বা কিল্ট পরা স্যাম হিউয়ান। মায়ের দীর্ঘশ্বাসকে বিশেষ পাত্তা না দিয়ে বাবা জানতে চায় আর আবির? আবিরকে কেমন লাগে তাঁর? আর প্রসেনজিৎ?
গল্পে গল্পে গড়িয়ে যায় রাত। আবির-প্রসেনজিৎ এর জায়গা দখল করে দীনু  খুড়োর পোষ্যপুত্র  বাঁটুল চন্দ্র। তাঁর এবং তাঁর পিতার আব্দারে বাঁটুলের ফটোল্যাব করা হয়, দুঃখের কথা কি আর বলি, আপদ ফটোল্যাব বাঁটুল বাবুর ছবি থেকে কোন ফেসই ডিটেকশন করতে পারে না। আরেঃ ভাই, জলজ্যান্ত বাঁটুল চন্দর বসে অাছে, তাও পাচ্ছ না তোমরা? এরপর যদি তিনি ক্রন্দসী হন, তখনও আপনারা বলবেন যে তিনি ছিঁচকাঁদুনে। বহুৎ না ইনসাফি হ্যায়, মাইরি!

Thursday 25 June 2020

ছবি

আমার কাছে কালও ছিল, তোমার রঙীন ছবি-
হাসিখুশি-গোমড়া তুমি, কখনও বা উদাস কবি-কবি।
 যতই গুছিয়ে-লুকিয়ে রাখি, উড়ে বেড়াত রঙীন প্রজাপতি-
আমার কাছে কালও ছিল,তোমার সুগন্ধী কিছু ছবি-।
আজ বুঝি সেই ছবিতে রঙীন অন্য খুশির ঘর,
বুনো কস্তুরীর সৌরভে মাখা অন্য চরাচর-
আমার কাছে কালও ছিল,তোমার মনকেমন করা ছবি-।
রদ্দি দিস্তায় আজ অগোছাল অতীত স্মৃতির রবি-
বেরঙ- বিস্বাদ ধূলোমাখা তোমার যতেক ছবি।

অনির ডাইরি ২৩ই জুন, ২০১৬

অনির ডাইরি ২৩ই জুন, ২০১৬
আমাদের বাড়িটা বেশ পুরানো। বাবার ঠাকুরদা যখন বানিয়েছিলেন তখন বাস্তুভিটা সহ সংলগ্ন জমির পরিমাণ ছিল সাড়ে সাত বিঘা। যার মধ্যে দুটি বিশাল পুকুর ছিল, একটি সর্বসাধারণের জন্য এবং অপরটি বাড়ির মেয়েদের জন্য খিড়কি পুকুর। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধান্তে যখন ভাঙন ধরল, তখন অনেকটা জমিই বিক্রি করে দেওয়া হল। আমাদের জ্ঞানত শুধু বাস্তুভিটাটুকুই ছিল, যার পরিমাণও কিছু কম ছিল না, খাতায় কলমে চোদ্দ কাটা। যদিও পরবর্তীকালে মেপে এগারো কাটা পাওয়া গিয়েছিল, বাকি তিনকাটা জমি কবে যেন চুরি হয়ে যায়।

এতবড় বাড়িতে যত না মানুষ, তার থেকে অনেক বেশী ছিল গাছপালা। সুউচ্চ সদর দরজা দিয়ে ঢুকলে প্রথমেই চোখে পড়ত এক বিশাল কাঁঠাল গাছ। আমাদের বাড়ির নামই ছিল “কাঁঠালগাছওয়ালা বাড়ি”। কাঁঠাল গাছের তলা দিয়ে এগিয়ে এলেই অতিকায় শান বাঁধানো উঠোন। উঠোনের পূর্ব দিকে ছিল একটা আম গাছ, এত মিষ্টি আম আমি জীবনে খাইনি। তার পাশে ছিল একটা নাগকেশর গাছ, উঠোনের পশ্চিম কোনে ছিল বিশাল বেল আর পেয়ারা গাছ। আবার বলছি এত মিষ্টি পেয়ারা খুব কম খেয়েছি। এই আম এবং পেয়ারার লোভে আসত হনুমানের দল। আমাদের বাড়িতে হনুমানের উৎপাত ছিল প্রবাদ প্রতিম।
তখনও চাটুজ্জে বংশের দুর্দিন শুরু হয়নি। দাদু ছিলেন খুব শৌখিন।দোতলার দালানে বিশাল বেলজিয়াম গ্লাসের আয়না ওলা টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে দাড়ি কামাতেন। টেবিল ভর্তি থাকত দামি দামি ফরাসি আফটার শেভ আর পারফিউমের বোতলে। সেসব কাটগ্লাসের বোতলের ভগ্নাংশ মাত্রই আমরা দেখেছি। যাই হোক দোতলার দালান জুড়ে ছিল ৯টা গারদহীন ফ্রেঞ্চ উইন্ডো।  পাশেই ছিল আম গাছটা, একদিন হনুমান ঢুকে দাদুর দামি আফটার শেভ খেয়ে নিয়েছিল। তারপর সেই মাতাল হনুমান নাকি শোলের ধর্মেন্দ্রর মত দোতলার বারন্দা থেকে “সুসাইড” করতে গিয়েছিল। পরিস্থিতি এমন দাঁড়ায় যে মেজদাদু আর ছোটদাদু নীচে শতরঞ্চি নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল সেই মাতাল হনুর মাৎলামির গল্প আমরা রোজ একবার করে ঠাকুমার কাছে শুনতে চাইতাম।
জেঠুর সাথে হনুমান গুলোর ছিল বেজায় দোস্তি। দোতলার বারন্দায় দাঁড়িয়ে, জেঠু উদাত্ত গলায় ডাকত, “আয়-আয়-আয়-আয়-আয়”। অমনি দুদ্দাড় করে ছুটে আসত হনুমানের দল। জেঠু একটা একটা করে কলা বাড়িয়ে দিত, ওরাও লক্ষ্মী ছেলের মত নেমে এসে একে একে নিয়ে যেত। এরকমই একদিন জেঠু হনুমানকে কলা  খাওয়াচ্ছিল, উল্টো দিকে রান্নাঘরের সামনের রোয়াকে বসে বাবা ভাত খাচ্ছিল, পাশে ঠাকুমা বসেছিল। শেষ পাতে দুধভাত খেতে খেতে হঠাৎ কি ভাবল বাবা কে জানে, এক গাল দুধ ভাত নিয়ে ওপর দিকে দেখিয়ে বলল, “খাবি?”হনুমানটা তৎক্ষণাৎ কলার খোসাটা ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে সড়সড় করে নেমে এসে সোজা বাবার কোলে। কোলে বসে হাত বাড়িয়ে দিল, হনুমানের গায়ে নাকি সাংঘাতিক দুর্গন্ধ হয়, বাবার অন্নপ্রাশনের ভাত গলা দিয়ে বেড়িয়ে আসতে চাইছিল, তারওপর হনুমানের বিখ্যাত চড়ের ভয়। ভয়ে বাবার গলা দিয়ে আওয়াজ বের হচ্ছিল না, কোনমতে ঠাকুমাকে জিজ্ঞেস করল, “মা কি করব?” ঠাকুমার বরাবরই ভয়ানক সাহস,  নির্বিকার চিত্তে বলল, “ডেকেছ যখন, ওর হাতে ভাতটা দাও।“একগাল ভাত খেয়েই কিন্তু হনুমানটা বাবার কোল ত্যাগ করে, আর জ্বালায়নি।
আমার মা এবং কাকিমা দুজনেই চাকুরীরতা ছিলেন। আমরা তিন জেঠতুতো খুড়তুতো ভাইবোন ঠাকুমা-পিসির কাছেই মানুষ। তারমধ্যে আমি আর আমার খুড়তুতো ভাই অয়ন হলাম কয়েক মাসের ছোটবড়। দুটো সমবয়সী বাচ্ছার দেখাশোনা করা মোটেই সহজ কাজ ছিল না। বাচ্ছা দেখার কোন লোক ঠাকুমা রাখতে দিত না, বিশাল সংসার এবং দুটো দুধের বাচ্ছার দায়িত্ব একাহাতে সামলাতে হত ঠাকুমা-পিসিকে। দুপুর বেলা খাইয়ে দাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে আমাকে রেখে আসা হত দোতলার উত্তর পশ্চিমের ঘরে, ঠাকুমার বিয়ের বিশাল উঁচু খাটে, চারদিকে বালিশ দিয়ে ঘিরে। আর ভাইকে শোয়ানো হত একতলার দক্ষিণ পশ্চিম দিকের ঘরে একই ভাবে। মাঝে মাঝে পিসি এসে দেখে যেত ঘুম থেকে উঠেছি কি না। একদিন এরকমই দেখতে এসে দেখে দুটি অতিকায় কালো মুখো হনুমান আমার পাশে খাটে বসে আছে। পিসিকে দেখেই দুজনে দাঁত খিঁচিয়ে উঠেছে, ভয়ে পিসি তো প্রবল চিৎকার জুড়ল। কি ভাগ্যি সেদিন ও জেঠু বাড়িতে ছিল, ঝুল ঝাড়া নিয়ে দুটোকে তাড়া না করলে কি হত কে জানে। আমৃত্যু অবশ্য জেঠু আমাকে খেপাত যে আসলে ওটা ছিল হনুমান রুপী রাজপুত্র। জেঠু অবশ্য সর্বত্রই আমার জন্য ছদ্মবেশী রাজপুত্র দেখত। আমাদের একটা বিশাল হুমদো হুলো ছিল। তাকে দেখলেই ভয় করত। নাম ছিল “অমিতাভ”। মাঝে মাঝেই সে চার হাতপা উল্টে মরার ভান করে পড়ে থাকত। গোটা বাড়ির লোক এককাট্টা হয়ে যখন সিদ্ধান্ত নিত, যে এই মরা বিড়ালটাকে কে কোথায় ফেলতে যাবে, অমনি তিনি আড়ামোড়া ভেঙ্গে উঠে বসতেন। যখনি আমি একা দোতলা থেকে একতলায় নামতে যেতাম, ঠিক তখনি তার একতলা থেকে দোতলায় ওঠার প্রয়োজন পড়ত, মাঝপথে দেখা হত দুজনার, অমিতাভ মুচকি হাসত, মানে হাসত কিনা জানি না,মনে হত। আসলে আমি তখন বড়ই ছোট, আমি কিছুতেই  হাসতে পারতাম না, উল্টে চিল চিৎকার জুড়তাম, যতক্ষণ না সকলে লাঠিসোটা নিয়ে দৌড়ে আসত এবং অমিতাভ সিঁড়ির জানলা গলে ফুড়ুৎ হত। প্রতিবারই জেঠু বলত, “এ হে হে, ভয় পেলে হবে? ওটা বেড়াল ছিল না, ওটা ছিল বেড়াল রূপী রাজপুত্র।“ সত্যি কি মিথ্যা অবশ্য শৌভিক ভট্টাচার্যই বলতে পারবে।
(চলবে?)

Tuesday 23 June 2020

অনির ডাইরি ১৯ শে জুন, ২০২০


মনেরও বুঝি মরশুম আছে, কখনও প্রবল সুখেও কেন যে, ঘনিয়ে আসে আষাঢ়ে বাদল? প্রিয়জন সান্নিধ্যে, বাতানুকূল যন্ত্রের সোহাগে, গাল বালিশের আদরে ভিজতে ভিজতে কেন জানি না, মনে পড়ে যায়, কোন এক আত্মঘাতী কিশোরীর কথা। কে জানে, কোন সে সেই বিস্মৃত কালের, কোন অলস দুপুরে, লাল হয়ে আসা কোন এক শারদীয়ার পাতায় আলাপ হয়েছিল তার সাথে। ঝিম ধরা দুই চোখের তারায় উঁকি মেরে যায় সময়, “পারবে না হে, পারবে না। আমায় ধরে রাখতে তুমি পারবে না।“ বারন্দার ওপর থেকে উঁকি মারে এক জোড়া বিষণ্ণ চোখ, “ আমি যাব, তোর কাছে?” ঊর্ধ্বপাণে তাকিয়ে থাকি আমি, কতদিন তোমায় স্পর্শ করিনি দিদি। মুঠোয় ভরা বালির মত ঝরে যাচ্ছে সময়-

সকালের সংবাদপত্র বড় বেশী বাজারু, সীমান্তে বুঝি লাগল আগুন। তেরঙ্গায় মোড়া শবের মিছিল। যেন উন্মাদ হয়ে উঠেছে, নরমাংসভোজী পিশাচের দল, যুদ্ধ চাই যুদ্ধ। বেদনাও এখন পণ্য। স্টিল ফ্রেমে ধরা থাকে মূল্যবান শোক। দুরাভাসের ওপারে গমগমিয়ে ওঠে দীনু খুড়োর মাই ডিয়ার কণ্ঠ, “ কি রে বেটি কি চাস?” প্রদোষ মিত্তিরের যেমন সিধু জেঠা, আমার তেমনি দীনু খুড়ো। হ্যামলিনের বাঁশিওয়ালার সুর, খুড়োর গল্পে। আজ যুদ্ধের গল্প শুনব খুড়ো। আমাদের প্রজন্ম যুদ্ধ দেখেনি। “কেন রে? তোর আপিস নেই বুঝি?” জানতে চায় খুড়ো। আছে তো, এঁকেবেঁকে চলেছি আপিসেরই পথে। নিবেদতা সেতুর মাথার ওপর গহন মেঘের চাঁদোয়া। ফোনের সীমান্ত পেরোলেই খুড়ো আর আমি, বসে আছি বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের জনৈক ছাত্রাবাসের কোন এক নিঝুম কামরায়। সন ১৯৭১।ঘনিয়ে এসেছে রাত্রি, আনমনে রেডিওর নব ঘোরাতে ঘোরাতে আচমকা ধরা পরেছে  পাকিস্তান রেডিও। ওপার থেকে সহর্ষ সংবাদ পাঠক চোস্ত বাংলায় বলে উঠলেন, “খবর পাওয়া যাচ্ছে, এই মাত্র বর্ধমান শহর দখল করেছে ইয়াইয়া খানের সেনাদল। বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যাপক বোমাবাজি এবং অগ্নিসংযোগ।“ কিন্তু? “তবে আর বলছি কি?” অট্টহাস্যে ফেটে পড়ে খুড়ো। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায় বাপি, ম্যাডাম এমন হাসতে হাসতে বিষম খেল কেন?

বড় সাধ করে লাগিয়ে ছিলাম গাছগুলো, বুড়ো কালেক্টরেটের ঝুলবারন্দা জুড়ে, প্রত্যেকের নামে একটা করে গাছ। যেখানে জুঁই গাছের নাম সঞ্চিতা, পাম গাছের নাম কৌশিক। ক্রোটনের নাম নির্মল আর প্রীতির হাজারি গোলাপ। জিজ্ঞাসা করেছিলাম, “আপনার নামে কি গাছ লাগাব স্যার?” চন্দননগরের বড় সাহেব, অনেক ভেবে জানিয়েছিলেন, “একটা লেবু গাছ লাগাতে পারো?  লেবু পাতার গন্ধটা বড় বেশী মনকেমনিয়া।”। শুভজিৎ চেয়েছিল তুলসী গাছ। চুপড়িতে করে নীল রঙের কি যেন ফুলের গাছ এনে বসিয়েছে রমেশ। আপিসের দিনগুলোতে নিয়ম করে জল দেন বর্মণ সাহেব। আর ছুটির দিনে ? কেন, অজিত দা আছে না। অথচ অজিত দার নামেই বসানো হয়নি কোন গাছ। এই শীতে বসাতেই হবে, যদি থাকি। প্রথম বর্ষার দাপটে সব কটা টবে গজিয়ে উঠেছে আগাছা। কম্প্যুটর ছেড়ে উঠে দাঁড়ায় সোমনাথ, “একটা খুরপি লাগবে ম্যাডাম। আর এক প্যাকেট সার।“ “চা পাতা দিয়ে দেব নাকি?” কাঁচের গ্লাসে চা ঢালতে ঢালতে মাতব্বরি ধাঁচে জানতে চান কালেক্টরেটের সুজয় বাবু। আমার জন্য চা আনলেই, কৌশিক দৌড়ে জানতে চায়, “গ্লাস ধুয়ে এনেছেন তো?” বললেই তিড়িং করে চটে যান সুজয় বাবু।
পিছন থেকে ডাকেন অজিত দা, “ম্যাডাম, আপনি কোথায় আগাছা দেখলেন?” প্যারেড করি দুজনায়, সব টব চাঁচাপোঁচা, সদ্য খুঁড়ে দেওয়া হয়েছে সবার মাটি। হেসে উঠি দুজনায়, এই না হলে অজিত দা, বুড়ো হাড়ে এখনও তাক লাগিয়ে দেন। সোমনাথ আর আমার কথোপকথনের মাঝেই সারা সব কাজ। নাঃ দাঁড়ান, এখনও বাকি একটা কাজ, এক লিটার রং এনেছে অমৃতাপতি কৌশিক। করিডরে দু মিটার ছাড়া ছাড়া গোল্লা পাকাতে হবে, বড় ভিড় হচ্ছে আজকাল। পঞ্চাশ টাকারও মেডিক্যাল ক্লেম করছে মানুষ। সেদিন একটা ৪৩টাকার ক্লেম নাকচ করা হয়েছে আপিস থেকে, বিলে নাম বা তারিখ লেখা ছিল না। কাঁচা বিল। আজ একটা ক্লেম পেলাম, বাচ্ছাটা অপুষ্টিতে ভুগছে, দামি হেলথ ড্রিঙ্ক কিনেছে মা। এর ওপর বেতন না পাওয়ার অনুযোগ আসছে ভুরি ভুরি।

মিটিং এর ফাঁকেই ঢলে আসে বেলা। পশ্চিম আকাশে এক রাশ লালিমা ছড়িয়ে অস্ত যায় শুক্রবারের সূর্য। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে যায় বিদ্যুৎ আর রমেশ। স্যার কি এলেন? আর কখন আসবেন রে বাবা? তিনটে নাগাদ কেক কিনে এনেছে ওরা, সাত বার গুণে গুণে ফোন করেছে আমায়, কি লেখা হবে কেক-এ? “হ্যাপ্পি বার্থ ডে জেএলসি স্যার?” এই না, এটা লিখলে হেব্বি খচে যাবেন স্যার। লকডাউনের মাঝেই কেটে গিয়েছিল স্যারের জন্মদিন, সেদিন শুকনো শুভেচ্ছা জানানো ছাড়া করা যায়নি কিছুই। আজ পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক, আপিস তো আসতেই হচ্ছে সকলকে। আর চুঁচুড়া আপিসের একটা দস্তুর তো আছে না কি- 
 তবে কি লেখা হবে? শুধু স্যার? অধৈর্য হয়ে ওঠে ওরা, কেক আসার আগেই যদি স্যার এসে যান তাহলেই কেস জন্ডিস। শুধু কিংশুক? নাকি কিংশুক স্যার? রীতিমত ব্রেন স্টর্মিং করে লেখা হল স্যারের নাম। কেনা হল মোমবাতি। রঙ মশাল গুলো থেকে বড় ঝরে পড়ে বারুদ। নিপুণ হাতে সাজানো হল মোমবাতির চক্রব্যূহ, রাংতায় মোড়া হল টুকটাক উপহার। চন্দননগরের বড় সাহেবকে বড় ভালোবাসে এরা। কেমন মাটির মানুষ। বকাবকি করেন না, উলটে প্রশ্রয় দেন অঢেল। একরাশ শুভেচ্ছার মাঝে, আগে পিছে স্যানিটাইজ করে, বাতি না নিভিয়েই কেক কাটলেন স্যার। বুড়ো অজিতদা নালিশ করে গেল, কাজ বাড়িয়েছে মেয়েগুলো। ছদ্ম বিরক্তি মিশিয়ে, কোথায় কোথায় ক্রিম লাগিয়েছে তার লম্বা ফিরিস্তি দিয়ে গেল অজিত দা, তার মধ্যে ছিল অজিতদার গালও। হাসব না রেগে যাব, এই দোদুল্যমানতার মধ্যেই শেষ হয়ে আসে দিনটা, বুঝতে পারি আবার বদলাচ্ছে মরশুম- মনেরও বুঝি মরশুম থাকে। ভালো থাকতে গেলে, বুঝি ভালো রাখতেও হয়।

Thursday 18 June 2020

অনির ডাইরি ১৮ই জুন ২০১৬

অনির ডাইরি ১৮ই জুন, ২০১৬
(বাবা তোমার জন্য, আরও একবার)
 সালটা সম্ভবত ১৯৫৮। ছেলেটা সবে হাওড়া আইজ্যাক রাফায়েল বেলিলিয়াস স্কুল থেকে স্কুল ফাইনাল পাশ করে নরসিংহ দত্ত কলেজে ভর্তি হয়েছে। আই এস সি ফার্স্ট ইয়ার। মহানগর তখন উত্তাল খাদ্য আন্দোলনে। খাদ্য আন্দোলন ব্যাপারটাযে ঠিক কি, ভালো বোঝে না ছেলেটা। পুজোর আগে প্রতিবছরই খাদ্য আন্দোলন হয়। জন মুখে শোনা কথা, যে অবশ্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির অগ্নিমূল্য বৃদ্ধির প্রতিবাদে, বামপন্থীরা (সিপিআই, ফরোয়ার্ড ব্লক, বলশেভিক পার্টি ইত্যাদির সমষ্টি) প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে সমর্থকদের মিছিল করে কলকাতায় নিয়ে আসে এবং এসপ্ল্যানেডে অবস্থান বিক্ষোভ হয়।

আরো শুনেছে, যে প্রতি দিন ঠিক রাত দশটা বাজার কিছুক্ষণ আগে, পুলিশের কমিশনার সাহেব নিজে আসেন, বিশাল দলবল নিয়ে, এবং মাইকে ঘোষণা করেন, যে ঠিক পাঁচ মিনিট সময় দেওয়া হল, এর মধ্যে অবস্থান বিক্ষোভ না তুললে পুলিশ মেরে তুলে দেবে। ঘোষণা হতে থাকে এক মিনিট- দুই মিনিট-তিন মিনিট-। ইতিপূর্বে নির্বিকল্প রক্তপাত ঘটে গেছে খাদ্য আন্দোলনকে কেন্দ্র করে, “বিমলা-অমিয়া-প্রতিভার” গল্প অন্য একদিন লিখব, যদি সুযোগ পাই। যাই হোক কেউ তার দুঃসাহস দেখাতে সাহস পায় না, তিন, চার মিনিট গোনা হতে না হতেই পার্টির হুলিয়া অগ্রাহ্য করে, পুলিশের ব্যারিকেড ভেঙে সব দৌড়তে থাকে অদুরে দাঁড় করানো গোটা পঞ্চাশ স্টেট বাসের দিকে। গ্রামের গরিব গুর্বো চাষিভুষির দল, পুলিশ গ্রেপ্তার করার আগেই বাসে উঠে বসে পড়ে, যারা সিট পায়না তারা দাঁড়িয়ে বা মেঝেতে বসে পড়ে।পুলিশের বীভৎস মারের হাত থেকে বাঁচতে এভাবেই স্বেচ্ছা গ্রেপ্তার বরণ করে নেয়। তারপর সেই বাস নিয়ে যাওয়া হয় প্রেসিডেন্সী বা দমদম সেন্ট্রাল জেলে।

আটান্ন সালেও এর ব্যতিক্রম হল না। অবস্থান বিক্ষোভ ছত্রভঙ্গ হয়ে যাবার পর পার্টি গুলো সাহায্য চাইল ছাত্রদের কাছে। তখন এসএফআই ছিল না,বামপন্থী ছাত্র সংগঠনের নাম ছিল, এআইএসএফ, তারা ছাত্র আন্দোলনের ডাক দিল। এলিট ছাত্র পরিষদের কিছু ছাত্রও এগিয়ে এল গরিবগুর্বো চাষিভুসি গুলোর সমর্থনে। নরসিংহ দত্ত কলেজকে বলা হত, “হাওড়ার প্রেসিডেন্সী”। ছাত্র রাজনীতিতে বরাবরই অগ্রণী, বিশাল মিছিল বের হল ছাত্রদের। আমাদের সদ্য কলেজে ঢোকা ছেলেটিও যোগ দিল। ব্রেবর্ণ রোড দিয়ে যেতে দিল না এদের, টি বোর্ডের পাশ দিয়ে ডেকার্টস লেন হয়ে বেন্টিঙ্ক স্ট্রীট আটকে দিল আমাদের হাওড়ার ছেলে গুলো। অন্যান্য কলেজ থেকেও ছাত্রদের মিছিল এসে মিলিত হল, স্টেটসম্যানের অফিসের সামনে চলতে লাগল অবস্থান বিক্ষোভ। ঘড়ির কাঁটা সন্ধ্যা পেরিয়ে এগোতে লাগল রাতের দিকে। পৌনে দশটা নাগাদ এলেন কমিশনার সাহেব,পাঁচ মিনিটের ঘোষণাও চলতে লাগল, কিছু ছেলেপুলে পালিয়েও গেল, আমাদের ছেলেটি কিন্তু পালাল না, মানে দৌড়ল, কিন্তু  দাঁড়িয়ে থাকা স্টেটবাস গুলোর দিকে।
ছাত্রদের নিয়ে যাওয়া হল প্রেসিডেন্সী জেলে। ছেলেটির মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল, তার মানে আজ রাতে হাজতবাস? কি হবে? বাড়ির লোক তো কিছুই জানে না? আর জানতে পারলে কি আর বাড়িতে ঢুকতে দেবে? রাতটা যে কি ভাবে কাটল, কে জানে, সকাল বেলায়, সেল থেকে বার করে, খাইয়ে দাইয়ে, খানিকক্ষণ জেল ইয়ার্ডে ঘুরিয়ে আবার সেলে পুরে দেওয়া হল। মন খারাপ করে বসে আছে ছেলেটা, আচমকা শুনতে পেল, অবাঙালি ওয়ার্ডেন সেলের সামনের করিডর বেয়ে ছেলেটির নাম, হাওড়া এবং কলেজের নাম হাঁকতে হাঁকতে যাচ্ছে। পাশ থেকে একজন সিনিয়র বলল, “খবরদার সাড়া দিসনি। বার করে নিয়ে গিয়ে পিটিয়ে মেরে ফেলবে।“ ছেলেটি তো ভয়ে টুঁ শব্দ করেনি, কিন্তু অন্য সেল থেকে পরিচিত ছেলেরা কমরেড, কমরেড করে চিৎকার করতে থাকায়, ছদ্ম বীরত্বের সাথে ষোল সতেরো বছরের ছাতি ফুলিয়ে সাড়া দিতে বাধ্য হল।
ছেলেটিকে বার করে নিয়ে আসা হল, একটি বড় ঘরে, প্রতি মুহূর্তেই ভয় তাকে কাবু করে ফেলছে, আর কোনদিন মায়ের মুখ দেখতে পাবে না, উদ্গত কান্না গিলতে গিলতে গিয়ে হাজির হল একটা সাবেকী সিনেমার কাউন্টারের মত খুপরির সামনে, ওয়ার্ডেন বলল, “লো বাত করো।“ অবাক ছেলেটি তাকিয়ে দেখে খুপরির ওপাশে তার বাবা। এইরে হাত ঢুকিয়ে নির্ঘাত এক চড় মারবে, তারপর বলবে, “তোর মত কুলাঙ্গারের আর বাড়ি ফেরার দরকার নেই। তুই জেলেই পচে মর!!” ওমা ছেলেটির বাবা বরং সোৎসাহে জিজ্ঞাসা করল, “কেমন লাগছে? মারধর খেয়েছিস নাকি?” হতবাক ছেলেটি শুধু বলল, “বাবা? তুমি কি করে জানলে, আমি জেলে?” সৌম্য দর্শন ভদ্রলোক বললেন, “তুই পালাসনি বটে কিন্তু অনেকেই পালিয়ে ছিল, তেমনি একাধিক বন্ধু আজ তোর খবর নিতে আসাতে জানতে পারলাম।“ তখন সরি বলার রেওয়াজ ছিল না, ছেলেটি মাথা নিচু করে বসেছিল। জানলা গলিয়ে বাবা ছ প্যাকেট চারমিনার সিগারেট ছেলেটির হাতে দিলেন। তখন ৭৫ পয়সায় পাঁচ প্যাকেট সিগারেট পাওয়া যেত। ছেলেটি তো অবাক, বাবা সিগারেট কেন দিল? ভদ্রলোক হেসে বললেন, “জেলের নিয়ম তুই জানিস না, এখানে একটু ভদ্র ব্যবহার, এক হাতা বেশী ভাত বা একটু ঘণ ডাল পেতে গেলেও সিগারেট ঘুষ দিতে হয়।আমি চলে গেলেই এরা তোকে হাতড়ে দু প্যাকেট সিগারেট নিয়ে নেবে, বাকি প্যাকেট গুলো সামলে রাখিস, কাজে আসবে। আর একটা প্যাকেটের গায়ে ক্রশ দেওয়া আছে, ওটা লুকিয়ে ফেল, ওতে দশটা টাকা আছে, ছাড়া পেলে বাড়ি ফেরার রাহা খরচ আর যদি কিছু লাগে।সাবধানে ফিরিস, অনেক গল্প করার আছে।“

সেদিনের সেই  ছেলেটি ছিল আমার বাবা, আর সেই ভদ্রলোক? আমার দাদু। আজ সকাল থেকেই কেন জানি না, বাবার মুখে সহস্রবার শোনা দাদুর এই গল্পটাই মনে পড়ছে। হয়তো আজ ফাদার্স ডে তাই। বাবারা তো সত্যিই এ রকমই হয়, পরিস্থিতি যতই নিম্নগামী হোক না কেন, সারা দুনিয়া আপনাকে ভুল বুঝুক না কেন, সবাই, এমনকি আপনার ছায়াও আপনাকে ছেড়ে চলে যাক না কেন, বাবারা সব সময় পাশেই থাকে, নিরন্তর সাহস যুগিয়ে চলেন, “লড়, লড়ে যা। না লড়ে হারিস না। আর যদি হেরেও যাস, তাতে কি? হার জিত তো জীবনেরই অঙ্গ।“ তাই বোধহয় বাবারাই আমাদের প্রকৃত এবং ব্যক্তিগত সুপার হিরো।
 #HappyFathersDay #Makingmemories

Wednesday 17 June 2020

অনির বচন

অনির বচন #৫ ১৬ই জুন, ২০২০
কি খোরাক মাইরি। ঘরে ঘরে বিশেষজ্ঞ। কত রকম থিয়োরি। পাইকারি হারে মনের যত্ন নিন। কত রকমের সদুপদেশ-
১।  চাপ নেবেন না। মনের কথা খুলে বলুন। কাকে মশাই? আপনাকে? আপনি শুনবেন তো? কখনও প্রকৃত মানসিক অবসাদ গ্রস্ত ব্যক্তির সান্নিধ্যে এসেছেন? না না, ব্যর্থ প্রেম বা পেশাগত ব্যর্থতা বা প্রিয়জন বিরহে সাময়িক কাতরতা  নয়, আসল হার্ডকোর ডিপ্রেসন- যদি এসে না থাকেন, তাহলে বুঝবেন না, ঐ ভাবে যার তার কাছে প্রাণ খুলে কথা  বলাটা ওণাদের পক্ষে কতটা দুরূহ। আরেঃ ওণারা তো জানেনই না যে ওণারা মানসিক অবসাদের শিকার। এত জোর গলায় কি করে বলছি? তাহলে শুনুন, জনৈক পরিচিত ব্যক্তি একদিন আচমকা অন্ধ হয়ে গেলেন। হাতড়ে হাতড়ে সারা বাড়ি ঘুরতে লাগলেন আর বারংবার বলতে লাগলেন, “আমি তো চোখে দেখতে পাচ্ছি না। কি হবে? হে প্রভু আমায় কানা করে দিলে?” অথচ দূরে দেওয়াল ঘড়িতে কটা বাজছে উনি দিব্যি বলে দিচ্ছেন, বাড়ির লোক বারবার বোঝাল, কোন লাভ নেই। সকাল দুপুর রাত শুধু একই বচন- পরিশেষে নিয়ে যাওয়া হল ডাক্তারবাবুর কাছে, তিনি রায় দিলেন ভদ্রলোক মানসিক অবসাদ গ্রস্ত। সুপার স্পেশিয়ালিটি হাসপাতালের বড় ডিগ্রীওয়ালা মানসিক ডাক্তার (গুগল করা নয়) দেখানো হল, দু এক ডোজ ওষুধ পরার সাথে সাথেই সরে গেল চোখের পর্দা। ভদ্রলোক এখনও নিয়মিত ওষুধ সেবন করে চলেছেন।
তো প্রশ্ন হচ্ছে, দৈনন্দিন কর্মব্যস্ত জীবনে একজন মানসিক অবসাদ গ্রস্ত মানুষের একঘেয়ে ঘ্যানঘ্যান( সচেতন শব্দপ্রয়োগ) আধ ঘন্টার বেশী সহ্য করতে পারবেন তো? আর মন খুলে যদি উনি আপনাকে ওনার সমস্যা জানানও আপনি কথা দিতে পারেন যে আপনি তা একদম গোপন রাখবেন? দিন বদলের দিনে পরচর্চার আসরে পান আর মৌরি মিশিয়ে পরিবেশন করবেন না গরম-গরম? আরেঃ ঘরের সামনে পরের বাচ্ছাদের কলকাকলিই সহ্য হয় না আমাদের, মাত্রাতিরিক্ত শোরগোলের অপরাধে ক্রন্দনরত দেড় বছরের শিশুকে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া ছাত থেকে, করোণার প্রকোপে সদ্য পিতৃমাতৃহীন অনাথ তরুণী মেয়েটাকে একঘরে করে তার দরজায় সাঁটিয়ে দিই নোটিশ- আর আপনি বুলি কপচাচ্ছেন প্রাণ খুলে কথা বলুন।

২।  আরও কত কি, আইকিউ-ইকিউ- একিউ এর ফাণ্ডা। আমার জনৈকা প্রিয়তম বান্ধবীও দেখলাম এই রকম একখানি জব্বর লেখা শেয়ার করেছে। ও জানে না বুঝলাম, কিন্তু প্রশাসনিক বিভিন্ন ট্রেনিং তথা নানা কর্পোরেট ট্রেনারদের সান্নিধ্যে থাকার দরুন এগুলি আমার অনেকটাই চেনা বুলি। কত রকমের কোশেন্ট হয়, কত রকম ইনটেলিজেন্স হয়- ইমোশনেরও ইন্টেলিজেন্স হয়। বিশাল দামী ট্রেনার এসে ঠাণ্ডা ঘরে, মস্ত বোর্ডে পিপিটি বা ভিডিও চালিয়ে, অথবা সাজানো বাগানে টানা অ্যাক্টিভিটি করাতে করাতে মৃদুমন্দ সুরেলা পেশাদারী স্বরে এসব বলেন- আবার বলি, একজন প্রকৃত অবসাদ গ্রস্ত প্রিয়জনকে এসব বোঝান দিকি। তিনি শুনবেন হয়তো। বুঝবেন কি? তার থেকে বড় কথা হল বোঝার কথা কি? বিশেষ সমস্যাগুলি বিশেষজ্ঞের সাথেই ছেড়ে দিলে ভালো হয় না?

৩। তৃতীয়তঃ যে পয়েন্টটা সবাই লিখেছেন দেখলাম, বাচ্ছাদের চাপ দেবেন না। আরে দূর মশাই, কোন বাবা-মা সচেতন ভাবে বাচ্ছাদের ওপর এমন চাপ দিতে চান বলতে পারেন, যাতে সে মানসিক অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়ে? বাচ্ছার ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত রাখার জন্য তাকে পরীক্ষায় ভালো ফল করতে কি আমাদের বাবা-মা বলেননি? আপনি বলেন না বুঝি?  আর এই যৌথ পরিবার না থাকা বা ইঁদুর দৌড় এসব নিয়ে যদি আপনার আপত্তি থাকে তাহলে বিকল্প ব্যবস্থাটা কি সেটা তো বলুন।

সুশান্তর মৃত্যুটা ভয়ানক বেদনাদায়ক। আমার মতই আপনিও হয়তো ভুগছেন ডিনায়ালে। বাঁধা বুলি কপচে, গর্তের মধ্যে মাথা গুঁজে ভাবছেন খুব সহজ এই সমস্যার সমাধান। একবারও ভাবলেন না, এত যদি সহজ হত, সুশান্ত নিজেই কি করত না তার সুরাহা। বা মানসিক অবসাদে ভোগা সকলেই কমবেশী অবগত আছেন এই বিষয়গুলি নিয়ে। তবুও  হতাশার কোন চরম বিন্দুতে পৌঁছে মানুষ ছেড়ে দেয় জীবনের হাত তা অনুভব করা কি সহজ সহজ? ও পথে বরং না হাঁটাই ভালো।চে জানে, যদি না ফিরে আসা যায়। মোদ্দা কথা, করোনা ক্যান্সার বা এইডসের মত ডিপ্রেশনও এক মারাত্মক ব্যাধি। যার থাবা কতদূর বিস্তৃত কেউ জানি না, এটাই ধ্রুব সত্য আর কিছু না-

Monday 15 June 2020

অনির ডাইরি ১৫ই জুন, ২০২০



আজকাল অনলাইন হাজিরা চালু হয়েছে তুত্তুরীর। সক্কাল সক্কাল উঠেই, বাসি মুখে চোখ কচলাতে কচলাতে টাইপ করতে হয় তুত্তুরী থুড়ি পুরোযা ভট্টাচার্য। সময় মাত্র দশ মিনিট, দশ মিনিটের পরই বন্ধ হয়ে যায় হাজিরা খাতা। অতঃপর আমার ল্যাপটপ আর মোবাইল দখল করে, খেপে- খেপে চলে পড়াশোনা। যতঃক্ষণ না বাজছে আপিসের ভেঁপু। বাকি টাস্ক রাতের বেলা,বাড়ি ফিরলে- বেশ কয়েকবার বলেছে শৌভিক, বাতিল মোবাইলে নতুন একখান সিম্ ভরে দিলেই তো হয়। আমার আপত্তিতেই বাস্তবায়িত হয়নি। জানি ফোন হাতে পেলেই দিনে গুনেগুনে সতেরো বার দাদু- মামমাম আর কাকিমাকে ফোন করবে তুত্তুরী। জবরদস্তি শোনাবে কাল্পনিক গুলগল্প। শুধু কি তাই, ডাউনলোড করবে টম বেড়ালের গুষ্টি। ইতিমধ্যেই আমার মোবাইল আর মাসির মোবাইলে বসতি পেড়েছে টম আর এঞ্জেলা নামক দুই বাচাল বিল্লী। ঘড়ি ধরে চলে তাদের নাওন-খাওন তথা শৌচাগার দর্শনের কাজ। পড়াশোনায় ফাঁকি মারলেই তাদের উড়িয়ে দেওয়ার ভয় দেখাই আমি- ওমনি হাঁ হাঁ করে কান্না জোড়ে তুত্তুরী। মাঝে মাঝে মনে হয় জীবন যেন দাঁড় করিয়ে দিয়েছে আয়নার সামনে, সেদিন কাকে যেন ফোনে বলছিলাম, “সব শুনে ভীষণ গালাগাল দিতে ইচ্ছে করছে-”।  তারপর দুদিন তুত্তুরী আমায় সেধেছিল, “মা প্লিজ একটা গালাগাল দি। ভীষঅঅঅণ ইচ্ছে করছে। ” চৈতালীকে বললাম, “দুঃ শালা। ” কিছুক্ষণ পর শুনতে পেলাম কচি গলায় কে যেন টমকে বলছে, “এই শালা। শালা বলিস না। খারাপ কথা। মা বকবে। ” ছুটির দুপুরে মধ্যাহ্নভোজ চলাকালীন দাম্পত্যালাপের ফাঁকে হয়ত কেউ সান্ধ্য ভাষায় বলে ফেললাম, কোন কুশব্দ, গম্ভীর মুখে খাওয়া থামিয়ে ধমকে ওঠে তুত্তুরী, “ওটার মানে খারাপ কথা। আমি জানি।” রীতিমত তাজ্জব হয়ে যাই আমরা, “তুই জানলি কি করে? আর মানেটাই বা কে বলল? আমরা?” জবাব পাই, “নাঃ। তোমায় জিজ্ঞাসা করেছিলাম, তুমি বলেছিলে,বড় হলে বলবে। তখন দাদুকে জিজ্ঞাসা করলাম। দাদু বলে দিল। দাদু বলেছে, ‘সব শিখে রাখ। সময়মত ঝাড়বে। শুধু বাবার সামনে বলো না। এইরেঃ বাবার সামনে বলে ফেললাম। যাঃ। ”
শুধু কি তাই, যেমন ধরুন শৌভিকের আর আমার দাম্পত্যকলহ নিয়ে অতি ঔৎসুক্যের অপরাধে কখনও হয়তো বলেছিলাম, “ বাবা আর আমার কি কথা হয়েছে সেই কৈফিয়ৎ তোমায় দেব নাকি?” গতরাতে মাসিকে শুনতে হয়েছে, “মা আর আমার কি কথা হয়েছে, সেই কৈফিয়ৎ-”। মাসি অবশ্য গর্হিত অপরাধে অপরাধী। নৈশাহারের পর যখন তুত্তুরী তার ই-বেড়ালিনীকে আদর করতে যায়, ঠিক তখনই খবর দেখছিল মাসি। যুগপৎ দাবী এবং প্রার্থনা করা সত্ত্বেও মোবাইল ছাড়তে রাজি হয়নি মাসি। উল্টে ভয় দেখিয়েছিল, “মাকে বলে দেব দেখবে?” শুধু কি তাই, বরের সাথে কিছু গোপন বার্তালাপ করার জন্য বলেছিলাম, “ বাবু একটু বাইরে গিয়ে টিভি দেখ। একটু পরে আসিস। ” বার্তালাপ অন্তে ঘর থেকে বেরিয়ে দেখি, পাশের ঘরের দরজায় গোল করে কাগজ কেটে সাঁটিয়েছে তুত্তুরী, “বিনা অনুমতিতে প্রবেশ নিষেধ।” দুটি গোল গোল কাগজে “কাম ইন” লেখা টিকিট বানিয়ে, আমাকে দেখিয়ে পর্যায়ক্রমে বাবা এবং মাসিকে দেয়া হল। আর বাবাটাও এত বেইমান যে আমাকে দেখিয়ে দেখিয়ে, টিকিট হাতে, সকন্যা দুয়ারে আগল দিল-
ওদিকে সক্কাল সক্কাল দেখলাম মায়ের ওপর খুব চটেছে বাবা। বাজার যাবার আগে বলে গিয়েছিল, “সোফায় বসে থাক। এসে যেন দেখতে পাই। ” গলির মুখেই সব্জি নিয়ে বসে, ব্যাঙ আর ফড়িং দুই ভাই। মাছ মাংসও ফোনে বললে চলে আসে বাড়ি। তাছাড়া এই শর্মা তো আছেই, তাহলে আবার বাজার যাবার দরকার কি? প্রশ্ন করাতে রীতিমত অগ্নিশর্মা হয়ে ওঠে বৃদ্ধ। গুটি চারেক পুঁচকে কাপড়ের ব্যাগ দেখিয়ে শোনায় ফর্দমালা, মায়ের জন্য ব্যাঙের থেকে টাটকা শসা কিনে (কাজের ফাঁকে কচি শসা কুচকুচ করে চিবোতে ভালোবাসে মা), মোড়ের মাথার মিষ্টির দোকান থেকে টাটকা ছানা কিনে (রাতে শেষ পাতে রুটি দিয়ে খাবে মা), গোটা দুই ক্যাডবেরি কিনে (সন্ধ্যা নামলে মায়ের মনটা মিষ্টি মিষ্টি করে যে), পরের মোড় অবধি হেঁটে গিয়ে মায়ের মনপসন্দ সুগন্ধী পাতা চা কিনে  প্রায় দুকিলোমিটার পথ পরিক্রমাপূর্বক গৃহে প্রত্যাবর্তন করে দেখে শূণ্য সোফা, মা ব্যস্ত অন্য গেরস্থালির কাজে-।

এরপরও গোঁসা হবে না? যার জন্য চুরি করিনু সেই বলে ইয়ে-। দুটো মিষ্টি কথা দূরাস্ত, উল্টে বৃদ্ধের কপালে জুটেছে একরাশ কোভিড সতর্কতা- হাত ধোও, জুতো ধোও, জামা ছাড় ইত্যাদি প্রভৃতি।
গল্পটার অবশ্য অন্য আঙ্গিকও একটা আছে, মায়ের অনুযোগ, এত কিছুর সাথে বৃদ্ধ আর একটি বস্তুও নিয়ে এসেছে খুঁজেপেতে- গুটি কয়েক প্যাকেট ভর্তি সিগারেট। আর ঐ শসা-ছানা-চকলেট আর সুগন্ধী চা? ওতো মানভঞ্জনের জন্য, সে কি মা বোঝে না। গতসন্ধ্যার নিরালায়, বাতানুকূল যন্ত্রের মোহক আবেশে, ধোঁয়া ওঠা চা আর কুড়মুড়ে ব্যাট পাঁপড় সহ দোহে বসেছিল মর্দানী দেখতে। রাণী মুখার্জী দুজনেরই প্রিয়তমা অভিনেত্রী। হেন কালে কোন আপদ যেন মাকে ফোন করে কুশল বিনিময় করতে-।  বেশ বিরক্ত হয়ে বাবা ইশারা করে, জলদি কাটো। অতঃপর টিভিকে বোবা করে, দালান আর বাইরের রোয়াকে চার চক্কর মেরে, ঝিরিঝিরি বৃষ্টির হাওয়ায় এইটি সিগারেট ধ্বংস করে বাবা যখন কক্ষে প্রত্যাবর্তন করে, মা তখনও সহর্ষ বাক্যালাপে মশগুল। দূরদর্শন যন্ত্র তখন দামাল অ্যাকশনে মত্ত দম্পতির হৃদয়ের রাণী, টিভিকে সবাক করে, বাবার ভাষায় মৃদু সুরে (এবং মায়ের ভাষায় দাঁত কিড়মিড় করে) বলে-“ তুমি ঐ ফোন নিয়েই থাক। আমি একাই দেখি। বাকি কথা দালানে গিয়ে বললে ভালো হয়।”এক বুক অভিমান নিয়ে ঘর ছেড়ে চলে যায় মা।  অতঃপর মর্দানী মাথায় ওঠে বৃদ্ধের, সাড়ে দশটা অবধি সাধাসাধি- ডাকাডাকি অবশেষে “মম শিরসি মণ্ডনং, দেহি পদপল্লবমুদারম” করে গিন্নীকে পটাতে সক্ষম হয় বৃদ্ধ। আজ তাই, সূর্যের তেজ বৃদ্ধি পাবার আগেই, মাস্ক পরে বেরিয়ে পড়ে, সীমিত সামর্থে গিন্নীকে খুশি করার অভিপ্রায় নিয়ে- অানরোম্যান্টিক বৃদ্ধা সেই অনুভূতি চিনলে তো।
বৃদ্ধ-বৃদ্ধার কলহ শুনতে শুনতে, বরের ঘরের পিসি আর কনের ঘরের মাসি হতে হতে কখন যেন পৌঁছে গেছি চুঁচুড়া। ফোন রেখে কালেক্টরেটে ঢুকতে যাব, দরজার গোড়ায় যে অল্প বয়সী ছেলেটা স্যানিটাইজার নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে, হাতে ঢালতে ঢালতে আজ একগাল হেসে বলল,“বর্ষা এসে গেছে ম্যাডাম। এবার বড় বড় ইলিশ মাছ পাবেন। ” হাতে ৮০শতাংশ ইথাইল অ্যালকোহল ঘষতে ঘষতে, তাজ্জব হয়ে জানতে চাইলাম, “কেন রে?” জবাব পেলাম, “ঐ যে লকডাউন গেল না। কেউ তো আর ঐ সময় খোকা ইলিশ ধরেনি, বলুন। তাই ভাবছিলাম আর কি!” হাসব না কাঁদব বুঝতে পারলাম না। ছেলেটার লজিকে ভুল নেই। ও যদি এই আকালেও স্বপ্ন দেখে, সেই স্বপ্ন ভাঙার অধিকার আমার নেই। সিঁড়ি ভেঙে উঠতে উঠতে মনটা কেন জানি না বেশ খুশি খুশি হয়ে উঠল, তুল্যমূল্য বিচার করতে বসলে জীবনে অনেক কিছুই অধরা, সব মিলিয়ে বড় বেশী সাধারণ আমি। আর সাধারণত্বই কোথাও না কোথাও আমার সবথেকে বড় প্রাপ্তি। জীবনে এতটা পথ এগিয়ে এসে, একটাই মূল উপলব্ধি করতে পেরেছি, প্রতিটা মুহূর্ত আনন্দ করে বাঁচাটাই জীবনের সবথেকে বড় প্রাপ্তি। মেয়েটাকেও তাই শেখাই, নাঃ ফিরে গিয়ে অন্তত একটা গালাগালি দেবার অনুমতি দিতেই হবে ব্যাটাকে। আর একটা গোল, “কাম ইন” লেখা স্টিকার আমারও চাই। পটাতেই হবে মেয়েটাকে- আমাকে এইভাবে আটকে রাখা বেশ দুষ্করই শুধু নয়- অসম্ভব।

Tuesday 9 June 2020

অনির ডাইরি ৯ই জুন, ২০২০


শত অনুরোধেও আমার কাছে চুল কাটতে রাজি হয়নি শৌভিক। মাঝেমাঝেই সন্দেহ হয়, ছুরিকাঁচি হাতে বোধহয় আমায় তেমন বিশ্বাস করে না আমার বর। ছোট থেকে তুত্তুরীর চুল তো আমিই কাটতাম- তারও আগে আমার কৈশোরে নিজের চুলও কম কাটিনি। গ্রীষ্মের ছুটির দুপুর গুলো কেমন যেন কুহকিনী ছিল, বড়রা সবাই আপিস বেরিয়ে গেলেই যেন ঝিমিয়ে পড়ত, দেড়-দুশো বছরের বুড়ো বাড়িটা।  উত্তরপশ্চিমের ঘরের দেওয়াল জোড়া চার-চারটে সাতফুট লম্বা জানলার কাঠের খড়খড়ির ওপারে দিগন্ত ছোঁয়া ঝকঝকে নীলাকাশ। যেন থমকে দাঁড়াত সময়, বহুপঠিত শিশুসাহিত্য- জ্যাঠাইমার কাঠের তলা থেকে সন্তর্পণে  বার করে আনা লাল হতে বসা আলোকপাত আর বাতায়ন, গোবিন্দা আর মন্দাকিনীর উত্তেজক ছবিওয়ালা হদ্দবুড়ো সিনে অ্যাডভান্স সব যখন মুখস্থ  হয়ে যেত, তখন সময় কাটানোর সেরা মাধ্যম ছিল, নিজের চুল কাটা।

পূবের দেওয়ালে ডিম্বাকার আয়নার সামনে কোন এক সন্ধ্যায় মুনাই আর আমি ব্লাডি মেরি খেলেছিলাম। আজ লিখতে বসে প্রবল হাসি পেলেও, তৎকালে আমাদের গভীর বিশ্বাস ছিল, চুপিচুপি গভীর রাতে, মোমবাতির আলোকে আয়নাটার সামনে দাঁড়িয়ে একটি টুকটুকে লাল আপেলে কামড় মেরে যদি তিনবার, “ব্লাডি মেরি-ব্লাডি মেরি-ব্লাডি মেরি” বলে চিৎকার করা হয়, তাহলে আয়নায় ফুটে উঠবে হবু জীবনসঙ্গীর প্রতিচ্ছবি। গভীর রাতে ফাঁকা ঘরে স্বয়ং জগজ্জননীকেও ডাকার মত সাহস ছিল না আমাদের, অগত্যা গভীর রাতটা নেমে এসেছিল রাত নটায়, একতলায় সবাই তখন মজে ছিল দূরদর্শনে, আমরা দোহে পাড়ি দিয়েছিলাম অভিসারে। বলাইবাহুল্য ব্লাডি মেরি কোন কৃপা করেনি। তবে ডিম আয়নাটার সাথে দোস্তি জমে উঠেছিল ব্যাপক। নিঃসঙ্গ দুপুর গুলোতে আয়নার ওপাশের মেয়েটা কেবল উস্কাত, “একটু খানি। কুচ্ করে। ধরতেও পারবে না, মা। ” কি ভয়ানক মিথ্যে বলত মেয়েটা, মা আপিস থেকে ফিরেই ধরতে পারত এবং গদাগুম গদাগুম-
তুত্তুরী হবার পরও দেড় বছর অপেক্ষা করতে হয়েছিল শাশুড়ী মায়ের নির্দেশে। দেড় বছর পূর্তির দিনই জম্পেশ হেয়ারকাট উপহার দিয়েছিলাম কন্যাকে। তাতে যদিও প্রভূত হাউমাউ  জুড়েছিল আমার মা, জানতাম ওসবে কান দিতে হয় না। প্রচণ্ড গম্ভীর মুখে বাবা শুধু বলেছিল, “অ্যাঃ জেলে এমন ভাবে চুল কেটে দিত আমাদের। খামচা খামচা-”। সেই থেকে তুত্তুরীর হেয়ারকাটটার নামই হয়ে গেল খামচাকাট। বছর দুয়েক অবধি দিব্যি লক্ষ্মী মেয়ে হয়ে কাটত চুল, তারপর গজালো ডানা এবং পাখনা। পর্যায়ক্রমে কন্যা এবং কন্যার দিদিমার। রীতিমত হেঁকে ডেকে বিশেষজ্ঞ আনিয়ে কাটা হত চুল। প্লাস্টিক শিট পরে গুড়িয়া পুতুলের মত চুল কাটতে বসত তুত্তুরী। নেপালী ববি মাসির বাড়িতেও ছিল এমন এক পিস্ স্যাম্পল। আধো আধো বাংলায় সেই ভাইটার গপ্প শোনাত ববি মাসি, যাবার সময়,  বাতিল হয়ে যাওয়া সিলভার ফয়েলের রোল, সেকশন ক্লিপ উপহার দিয়ে যেত তুত্তুরীকে।

ইদানিং তো বাতানুকূল পার্লারে চুল কাটতে যেত তুত্তুরী। কতবার বলতাম, ১৮শতাংশ জিএসটি নেয় ব্যাটারা, আমি কাটলে ঐটা তো -ইয়ে মানে মুকুব-

বলে না, গরীবের কথা বাসি হলে মিষ্টি হয়। লকডাউনে কেমন জঙ্গল বাঁধিয়েছিল তুত্তুরী। ভাগ্যিস এই শর্মা ছিল, আর ভাগ্যিস আমার মা ত্রিসীমানাতেও ছিল না, তাই না-। যেদিন তুত্তুরীর কেশ কর্তন করলাম, তারপর থেকে অন্তত হাজার চারেক বার বলেছি, “আয় তোরটাও-”। আরেঃ ঐ মার্কেটের বিহারী সেলুনওয়ালার থেকে খারাপ তো কাটবই না। বলে না গৃহপালিত মোরগের মাংসের সোয়াদ ডালের মত-
তবে আমার শ্বশুরমশাই সাগ্রহে বাড়িয়ে দিয়েছেন মস্তক। শাশুড়ী মায়ের যদিও দাবী, উনিও সদ্য খোলা সেলুনের দিকেই পা বাড়াচ্ছিলেন, শাশুড়ী মাতার তীব্র ধমকে কিঞ্চিৎ ব্যোমকে গেছেন। একে দু-দুবার ক্যান্সার বিজয়ী, তায় আবার ক্রনিক সিওপিডির রুগী- মোদ্দা কথা ভ্যাকসিন না বেরোলে ওণার সেলুন যাত্রা বন্ধ। সুতরাং চলচ্চিত্র এখনই শেষ নয় বন্ধু, সবে তো শুরু।  মাস দুয়েক বাদে আবার -
ছবিতে টেরি বাগিয়ে দাদু এবং নাতনী, নাতনী তেমন খুশি না হলেও, ঠাম্মা বেজায় খুশি। আর ঠাম্মার খুশিতেই খুশি দাদু- এবার হাওড়ার দাদুর পালা। তিনি অবশ্য আজ থেকেই গান ধরেছেন, “এখন চুল কাটতে গুরুর মানা আছে-”। বলি তোমার আবার গুরু কোথা থেকে এল গো বাবা, অ্যাঁ?

Tuesday 2 June 2020

অনির ডাইরি ১লা জুন, ২০২০



এবছরও নববর্ষের দিন প্রশ্ন করেছিল জ্যাঠাইমা, খুব সাদামাটা প্রশ্ন, জামাইষষ্ঠীতে আসছি কি না। প্রতিবছর মোটামুটি এই সময় থেকেই শুরু হয়ে যায় টুকটাক প্রস্তুতি। প্রথম ধাপে, মা-জ্যাঠাইমা আর পিসির শাড়ি কেনা। ধপধপে শাদা শাড়ি ছাড়া পরে না জ্যাঠাইমা। তাও মোটা বা ভারি না, পাতলা ফিনফিনে। যতদিন জেঠু জীবিত ছিলেন, সাদার মধ্যেই লাল-কমলা আর গোলাপী পাড় খুঁজতাম। বিগত কয়েক বছর, সর্বাগ্রে সরিয়ে রাখি ঐঐ রঙগুলি। পিসিরও চাই হাল্কা শাড়ি, কটন বা লিনেন। তবে রঙ নিয়ে কোন বায়নাক্কা নেই, ক্যাটক্যাটে লাল বা হলুদ রঙের শাড়ি দিলেও পিসি পরমানন্দে গ্রহণ করবে এবং পরবে। সমস্যা হয় মাকে নিয়ে, ঠিক কি যে পছন্দ হয় মায়ের-
নাঃ জ্যাঠাইমা যতই আব্দার করুক এ বছর আর যাইনি। লকডাউন তো ছিলই তদোপরি মনমেজাজও বিশেষ ভালো ছিল না। প্রিয়তম দখিন বঙ্গ আমফানের আক্রমণে পর্যুদস্ত, পশ্চিমভারতে পঙ্গোপালের ঝঁক, উত্তরাঞ্চলে দাবানল, উত্তরপূর্বে সোয়াইন ফ্লু, সর্বোপরি অভূক্ত অর্ধমৃত পরিযায়ী শ্রমিকদের দল। বাড়িতেই ছাপোষা ষষ্ঠীপালন। অভিমানী কন্যার মানভঞ্জনের জন্য, যৎসামান্য উপাচারই সাধ্যমত সাজিয়ে গুছিয়ে পরিবেশন, গৃহকর্তার উপর্যুপরি সাবধান বাণী সত্ত্বেও,নিখাদ সৌন্দর্যায়নের জন্য অতিরিক্ত বাসনের ব্যবহার এবং বর্তনমর্জনের সময় স্বনির্বুদ্ধিতার জন্য কপালে করাঘাত।
সায়াহ্নে গুছিয়ে বসে ফেবু খুলতে গিয়ে রীতিমত তড়িদাহত হলাম, টাইমলাইন জুড়ে শুধুই সুখাদ্যের ছবি। কোথাও শাশুড়ীমাতারা রন্ধন করেছেন জামাতাদের জন্য, কোথাও বা বৌমাষষ্ঠীর নামে সালাঙ্করা পুত্রবধূর সামনে সাজিয়ে রাখা চৌষট্টি ব্যঞ্জন, কোথাও বা নিছক ঘরণীই হয়ে উঠেছেন শাশুড়ী মাতা। জনৈকা মহানগরবাসিনী আমফানের পরদিন প্রভাতে কিছু সুখাদ্যের ছবি পোস্ট করে লিখেছিলেন, “আমি গলিতে থাকি। ঝড়টা ঠিক বুঝতে পারিনি। রান্না করতে ব্যস্ত ছিলাম। কেমন হয়েছে ফ্যান্ডস্?” কি বাছা বাছা গালাগালি দিয়েছিল মহানগরবাসীরা সেদিন, ঘন্টাখানেকের মধ্যে রেকর্ড সংখ্যক গালি খেয়ে পোস্টটা মুছে যায়- জামাইষষ্ঠীর দিন দেখলাম তিনি আবার পোস্টেছেন- কয়েকদিন আগের খিস্তিবাজরা আজ অঢেল প্রশংসায় ভরিয়ে দিয়েছে তাকে। কয়েকজন রূপসী পরপর পোস্ট করেছেন, মোদ্দা কথা মায়ের অবর্তমানে (বালাই ষাট,  লকডাউন জনিত) তাঁরাই ষষ্ঠী করেছেন গৃহকর্তার জন্য, আসন পেতে পিতলের থালাবাটিতে সাজানো হয়েছে গুপিবাঘার ব্যঞ্জন- কি নেই তাতে? সাদা ভাত, পোলাও, মাটন, চিংড়ি,কুমড়ো পাতা মোড়া ভেটকি, দই, পাঁচ রকম মিষ্টি, হরেক রকম ফল- সাথে ডাল, পাঁচরকম ভাজা, শুক্তো, অম্বল। বরের জন্য ষষ্ঠী? ভাগ্যিস ঠাকুমা বেঁচে নেই। যাই হোক এইসব রন্ধনপটিয়সীদের শতকোটি প্রণাম, জৈষ্ঠের এই দাবদাহে এতগুলি পদ রান্না এবং পরিপাটি সাজিয়ে দেওয়া চাট্টিখানি কথা নয়। খাবারের ছবি দেখতে বরাবরই ভালো লাগে, এই লকডাউনে মানসিক অবসাদ কাটাতে অনেকেই ভলোমন্দ দু-এক পদ রাঁধছেন, তাই বলে এত পদ কি আদৌ কোন মানুষের পক্ষে পাচন করা সম্ভব?ঙ বিশেষতঃ যেখানে সংবাদপত্রের প্রথম পাতায় রোজ ভূখা মানুষের মিছিল- 
কয়েকজন সোহাগী পুরুষও দেখলাম সহরষে স্ত্রীর বানানো বিরিয়ানির ছবি পোষ্ট করে লিখেছেন, “আমার গিন্নী বানিয়েছে, লাইকটা দেবেন প্লিজ, নইলে আমার রক্ষে নেই”।  “লাইক হাংগ্রী জেনারেশন”এর আব্দার পড়তে পড়তে জনৈকা বৌদির কথা খুব মনে পড়ছিল। দিন দুয়েক আগেই ফোন করেছিলেন, কিছু টাকা ধার চেয়ে। ওণার আর দোষ কি, লকডাউনের মাঝেই ছাঁটাই হয়েছেন ওণার স্বামী। পাওনাগণ্ডা  সবই মায়ের ভোগে। মালিক ফোনে কুৎসিত ভাষায় জানিয়েছে, “এই লকডাউনের মাঝে তুমি করেছটা কি, যে বেতন চাইছ?” ভদ্রলোকের না আছে নিয়োগপত্র, না স্যালারি স্লিপ। যখন যেমন দিত মালিক, দুহাজার- পাঁচ হাজার- আট হাজার। শ্রমকমিশনার হওয়া সত্ত্বেও কোন কাজে আসতে পারিনি আমি। আরে শ্রমআইনটাই তো তুলে দিচ্ছে সব সরকার। ঠুঁটো জগন্নাথ কমিশনার আর করবেটা কি? পাড়াতুতো বৌদি, প্রায় সহেলী সম্পর্কিত। প্রথম দিকে অনুনয় করত, “দাদাকে একটা চাকরী খুঁজে দাও অনিন্দিতা।” জামাইষষ্ঠীর দিনদুয়েক আগে বলল, “কিছু টাকা ধার দিতে পারো? ছেলেটাকে কদিন ধরে আলুভাতে ভাত ছাড়া কিছু দিতে পারিনি। আমার ভীষণ মরে যেতে ইচ্ছে করছে অনিন্দিতা। ”
তবে এবছরের সুপারহিট পালা বৌমা ষষ্ঠী। শ্বশুরঘরে নির্যাতিতা আমার বেশ কয়েকজন বান্ধবীও শেয়ার করেছে দেখলাম,বৌমা ষষ্ঠী কাণ্ড। ঐ মেয়েটিও শেয়ার করেছে, যাকে আপিস ফেরৎ কদিন আগে নামিয়ে দিয়েছি তার মাসির বাড়ি। নেহাত মুখ চেনার সুবাদে, এক কাপড়ে ঘর ছেড়ে আমার চেম্বারে দৌড়ে এসেছিল অভুক্ত মেয়েটি, পারিবারিক কলহের জোরে, আক্ষরিক অর্থে চুলোচুলি। বৈদ্যবাটির কাছে হাইরোডের ধারে চা খেতে খেতে জানতে চেয়েছিলাম কি হয়েছে। মাথার পিছনে খাবলা খাবলা চুল টেনে ছিঁড়ে নিয়েছে শাশুড়ী আর মাসি শাশুড়ী, জায়গায় জায়গায় ফুলে আছে পটলের মত। জমে আছে রক্ত। “বাপের বাড়ি যাওনি কেন?” “কেউ নেই ম্যাডাম। বাবা চলে গেছে কোন ছেলেবেলা। মা স্থবির প্রায়। ফুসলে সব সম্পত্তি লিখিয়ে নিয়েছে দাদা। বর ছাড়া অামার কেউ নেই ম্যাডাম। ” প্রশ্ন করলাম, তোমার বর কিছু বলেনি? “একমাত্র ছেলে ম্যাডাম। মাকে রাখবে না বৌকে? ঐ বলল, কটা দিন কোথাও চলে যাও। আমার মাসির বাড়ি আপনার বাড়ির কাছে-”। পুলিশে যাওনি কেন? “ঘরের কেচ্ছা না ম্যাডাম-”। আজ বিকালে হাউমাউ করে ফোন করেছিল মেয়েটি, “কাল আপিস যাবেন ম্যাডাম? আমাকে একটু সঙ্গে নেবেন?” শুনলাম মাসিশাশুড়ীর ইন্ধনে, মেয়েটার শাশুড়ী নাকি থানায় নালিশ করেছে, ছেলে আর বৌমার নামে-”।

পুনশ্চঃ- এমন বিষাদকালে, জামাইষষ্ঠীর সামান্য আয়োজন, বাঁদিকে মুগডাল আর সাবুর খিচুড়ির সুবাসে খুঁজেছি ষষ্ঠীর দিন মা আর জ্যাঠাইমার আদর। আর ডানদিকে পাতি বাঙালী গোল পরোটা আর পোস্ত-দীপাবলীতে উপহার পাওয়া অবশিষ্ট গুটি কয় কাঠবাদাম বেটে বানানো আলুর দম। সাজিয়ে দেওয়া শুধু কন্যার জন্য, যিনি ষষ্ঠীর দিন সকালে সামান্য অপাট করার জন্য কঠোরভাবে ভর্ৎসিত হয়েছিলেন।