Tuesday 11 August 2020

শুভ জন্মদিন (জন্মাষ্ঠমী ২০১৯)


শুভ জন্মদিন- 

সারা দেহ জুড়ে এফোঁড়ওফোঁড় হয়ে যাচ্ছে যেন শত সহস্র তপ্ত শলাকা। তীব্র বেদনায় ছটফট করতে করতে চোখ খুললেন তিনি। চোখ খোলা মাত্রই ধড়ফড় করে উঠে বসতে গেলেন কেশব, পারলেন না। পদতল থেকে কোমর পর্যন্ত তীব্র বেদনায় অসাড়। দাঁতে দাঁত চেপে উঠে আসা আর্ত চিৎকারকে পুনরায় গিলে ফেললেন তিনি। যদিও তিনি ক্ষত্রিয় নন, তবে দীর্ঘদিন ক্ষত্রিয় সাহচর্যে থাকার ফলে, তুচ্ছ শারীরিক বেদনায় কাতর হওয়া তাঁর ধাতে নেই। যাতনায় কাতর হয় নারী, পুরুষের পক্ষে তা অত্যন্ত অগৌরবের। পুরুষ তো সিংহ।

পুনরায় শুয়ে পড়ে, কিছুটা ধাতস্ত হয়ে চোখ খুলে হতবাক হয়ে গেলেন কেশব। এ কোথায় শুয়ে আছেন তিনি? কোথায় তাঁর দুগ্ধফেননিভ পুষ্পসুরভিত সুকোমল শয্যা? কোথায় তাঁর অনুপম কারুকার্য খচিত দারুপালঙ্ক? কোথায় শ্বেতশুভ্র স্বচ্ছ চন্দ্রাতপ? কোথায় পটে আঁকা ছবির মত, মাধবীলতা শোভিত বাতায়ন, হুড়মুড় করে ঢুকে আসা সমুদ্র পবন, কোথায়ই দেবী লক্ষ্মীস্বরূপা রাজ্ঞী রুক্ষ্মিণী? বিগত রাতেও তো শুয়েছিলেন পাশাপাশি-  

আর এখন? একাকী শুয়ে আছেন কেশব, চন্দ্রাতপের পরিবর্তে মাথার উপর ঘোলাটে নীল আকাশ, আর বুড়ো বনস্পতির দল। দারুপালঙ্ক তথা সুকোমল শয্যার পরিবর্তে পিঠের তলায় অনুভব করলেন বালি আর কাঁকর। ভয় জাগানো অখণ্ড নীরবতায় আচ্ছন্ন চরাচর। পুনরায় উঠে বসার চেষ্টা করলেন কেশব, উঠতে তাঁকে হবেই, বের হতে হবে এই গভীর অটবী থেকে। ফিরে যেতে হবে প্রিয়জনদের মাঝে, কোন মতে দুই কনুইয়ের ওপর ভর দিয়ে ঘাড়টাকে তুলতে পারলেও, উঠে বসতে পারলেন না তিনি। অসহ্য দৈহিক বেদনায়, মানসিক উদ্বেগে, অজ্ঞাতেই গণ্ড বেয়ে ঝরে পড়ল দুই ফোঁটা অশ্রু।  

“এ কি কেশব, তুমি কাঁদছ?” পেলব রমণী কন্ঠে চমকে উঠলেন কেশব। এদিক ওদিক ঘাড় ঘুরিয়ে দেখার চেষ্টা করলেন, কে? কে ইনি? বড় পরিচিত, বড় সুমধুর এই কণ্ঠস্বর। “দেবী?” কোন মতে হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন কেশব, বাকি কথা বলার আগেই অনুভব করলেন, কপালে কার স্নেহস্পর্শ। জুড়িয়ে গেল, সব বেদনা। তপ্ত শলাকাদের উপর দিয়ে যেন বয়ে গেল হিমশীতল জলধারা। হাঁপাতে হাঁপাতে উঠে বসলেন কেশব।  সম্মুখে এক বয়স্কা অভিজাত নারী। সদ্য প্রস্তুত নবনীর মত গাত্র বর্ণ, আকর্ণবিস্তৃত হাল্কা নীলচে দুই চোখ, খড়গনাসা, তিরতিরে ওষ্ঠাধর। করবিবন্ধিত অযত্নলালিত পক্ক কেশরাজি ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্ত। নিরাভরণ। রঞ্জিত সীমন্ত। নারীর দুই নয়নে মৃদু কৌতুক। করজোড়ে প্রণাম জানালেন কেশব। বড় মোহময়ী এই নারী, বড়ই ব্যক্তিত্বময়ী। “ কে আপনি দেবী?” পুনরায় প্রশ্ন করলেন কেশব।

দুই নীলচে নয়নে উপচে পড়ল চাপা হাসি, “সে কি কেশব? চিনতে পারলে না? কতদিন আর, মাত্র তিন দশক আগেও দেখা হয়েছিল, তোমাতে আমাতে। অবশ্য, এই রূপে, এই গভীর অটবির মাঝে কখনও দেখা হয়নি।“ কেশবের মাথায় নামছে গভীর কুয়াশা। কে এই নারী? তিন দশক আগেও যার সাথে নিয়মিত সাক্ষাৎ হত? রমণী হেসে উঠলেন সশব্দে, “আচ্ছা এবার দেখো তো? চিনতে পারো কি না?” শুভ্র উত্তরীয় থেকে ছিঁড়ে নিলেন খানিকটা বস্ত্রখন্ড, বেঁধে নিলেন দুই পদ্মাক্ষীর উপর, পলকে আঁতকে উঠলেন কেশব, হাত বাড়িয়ে স্পর্শ করতে গেলেন নারীর ধুলিমলিন চরণদ্বয়, হ্যাঁ তিন দশক, তিন দশক আগেই তো দেখা হয়েছিল। দেখা হয়েছিল এক রুধির সিক্ত যুদ্ধক্ষেত্রে। দেখা হয়েছিল অগুনতি প্রজ্বলিত গণচিতার সম্মুখে।যেখানে পচাগলা শবের অধিকার নিয়ে লড়াই করছিল শৃগাল-কুক্কুরদের সাথে শোকাকুলা সদ্য স্বামী-সন্তানহারা ক্রন্দসী রমণীকুল। সেখানেই নিজের অন্ধস্বামীর হাত ধরে, মৃত পুত্র-পৌত্র-দৌহিত্রদের শব খুঁজে বেরাচ্ছিলেন ইনি, চোখ বাঁধা থাকা সত্ত্বেও শুধু স্পর্শ দিয়ে কিভাবে যে ইনি চিনতে পারছিলেন আপন সন্তান-সন্ততিদের, এ এক দুর্বোধ্য রহস্য। ডুকরে ডুকরে কাঁদছিলেন, তারপর অন্ধ স্বামীর হাতটা টেনে স্পর্শ করাচ্ছিলেন শবের গাত্র, দিচ্ছিলেন পরিচয়। ককিয়ে উঠছিলেন বৃদ্ধ রাজা। তৎক্ষণাৎ আলিঙ্গনাবদ্ধ করছিলেন বৃদ্ধকে, দিচ্ছিলেন মৃদু সান্ত্বনা। মৃত্যুর ধ্বংসলীলার মধ্যেও বড় মধুর ছিল সে দৃশ্য। বড় মর্মস্পর্শী।

 স্বস্তির নিশ্বাস বেরিয়ে এল, কেশবের বুক থেকে, দেবী গান্ধারী মারা গেছেন, প্রায় ত্রিশ বৎসর পূর্বে, তাঁর সাথে এই বনানীর মাঝে সাক্ষাৎ হবার অর্থ একটাই, স্বপ্নে আছেন কেশব। আর স্বপ্ন আর কতক্ষণই বা টিকবে, এখুনি আলিঙ্গন করবেন নিদ্রাতুরা দেবী রুক্ষ্মিণী, এখুনি ভাঙবে এই ঘুম। 

হাসি মুখে তাকিয়ে ছিলেন দেবী গান্ধারী, “এটা স্বপ্ন নয় কেশব। এটা ঘোরতর বাস্তব।” হাসি মুখে তাকালেন কেশবও। সেই ভুবনমোহিনী হাসি, যা ভুলিয়ে দেয়, সব ব্যথা, বেদনা, উষ্মা। “সামান্য শারীরিক যাতনা, সামান্য প্রিয়জন বিচ্ছেদেই কাঁদছিলে কেশব? আর আমি যখন সেদিন কাঁদছিলাম, আমি যখন স্পর্শ করছিলাম, একের পর এক মৃত শবের সারি, শিশুর মত কাঁদছিল আমার প্রিয়তম স্বামী, দৌড়ে গিয়েছিলাম তোমার কাছে নালিশ করতে, ‘একটাকে তো ছাড়তে পারতে? নাহয় ভিক্ষাই দিতে অসহায় বৃদ্ধ-বৃদ্ধাকে’ তোমার মনে আছে কেশব? জবাবে কেমন হেসে উঠে ছিলে তুমি? কেন কেশব? কেন হেসেছিলে? সন্তানহারা বৃদ্ধার হাহাকারে কি এমন  কৌতুক ছিল কেশব?” নিরুত্তর রইলেন কেশব, নত হয়ে এল মাথা, আপন মনে বলে উঠলেন, বৃদ্ধা, “বড় ভালবেসেছিলাম তোমায় কেশব, বড় বিশ্বাস করতাম, নির্ভর করতাম। এ যাতনা তোমার থেকে স্বপ্নাতীত-”। 

“ভুল করেছিলেন, জানেন না, ওকে ভালবাসলে যাতনা অবধারিত। কি গোপাল তাই তো?“ বলে উঠলেন আরেক রমণী। বুকের ভিতর তীব্র যন্ত্রণার জলতরঙ্গ উঠল কেশবের, সামনে উবু হয়ে বসলেন যে সজলনয়না রমণী, তাঁর বয়স বেশী না। বর্তমান কেশবের থেকে অনেক অনেক কম। মাঝারী উচ্চতা, মাঝারী গঠন, ঢলঢলে স্নেহমাখা দুই বেদনাতুর চোখ, কপালে অভিমানের গভীর ভাঁজ। এনার সাথে অন্তিম দেখা যেন কবে হয়েছিল? বোধহয় বিগত শতকে, যেদিন চলে আসছিলেন দুই ভাই বৃন্দাবন ছেড়ে, আকুলিবিকুলি কান্না জুড়েছিলেন এই রমণী, “না।না। না। যেতে দেব না। আজ তোমরা বলবে, ও আমার গর্ভজাত সন্তান নয়, আর আমি মেনে নেব? কে বলেছে আমি মৃতবৎসা? ও তো আমারই পুত্র? দেখো? দেখো? অবিকল আমার মত দেখতে, কাল অবধি তো তোমরাই বলতে গো, মাতৃমুখী ছেলে আমার, খুব সুখী হবে, আর আজ বললেই হল না কি? যে আমি ওর পালিকা মাতা? বুকে করে মানুষ করেছি আমি, রাতের পর রাত জেগে কাটিয়েছি, অযথা ওর অমঙ্গল আশঙ্কায় ছটফট করেছি আমি, নিজের মুখের খাবার তুলে দিয়েছি আমার গোপালের মুখে, তখন কোথায় ছিল তোমাদের ঐ রাজকন্যা দেবকী, আর আজ এলেন অধিকার সাব্যস্ত করতে, ওনার ছেলে?” কথা দিয়েছিলেন কেশব, জন্মদাতা মাতাপিতাকে কারাগারের বাঁধন থেকে মুক্ত করেই ফিরে আসবেন, তাঁর আসল মায়ের কোলে। হ্যাঁ আসল মা, আজও দেবী যশোদাকেই আসল মা বলে মনে প্রাণে বিশ্বাস করেন কেশব।


পর্ব-২

কপালে করাঘাত করে কাঁদছেন জননী যশোদা, ঠিক যেমন করে কেঁদেছিলেন, যখন শিশু গোপালকে হত্যা করার চেষ্টা করেছিল, মথুরা থেকে আগতা সুন্দরী দাসী পূতনা। মেরেই ফেলত হয়তো, যদি স্নেহান্ধ মাতা যশোদা দৌড়ে না আসতেন আরেকটি বার প্রাণাধিক গোপালের মস্তকচুম্বন করতে। প্রায়ই এইটা করত মাতা। একা ছাড়তেনই না গোপালকে, পূতনাও জানত, সুযোগের অপেক্ষায় ছিল বহুদিন, তারপর সময়বুঝে আক্রমণ করেছিল নিদ্রিত গোপালকে। দুই হাতে চেপে ধরেছিল কচি শ্বাসনালী, ঘুমের মধ্যেই কেঁদে উঠতে চেয়েছিল গোপাল, পারেনি। গলা দিয়ে একটি শব্দও বেরোয়নি, ক্রমশঃ কমে আসছিল প্রাণশক্তি, নীল হয়ে উঠছিল যশোদার দুলাল। আচমকা চিলের মত ঝাঁপিয়ে পড়েছিল মাতা যশোদা, পূতনা অভিজ্ঞ গুপ্তচর, রীতিমত রণপটীয়সী। ছাপোষা গৃহবধূ যশোদা তার সাথে পারে কখনও? কোনমতে গোপালকে বুকে তুলে নিয়ে ছুটে পালাতে গিয়েছিল মাতা, পিছন থেকে চুলের মুঠি ধরে প্রাকারে মাথা ঠুকে দিয়েছিল পূতনা। একবার নয়। অগুনতি বার। মস্তক থেকে নেমেছিল রুধির ধারা, প্রবেশ করেছিল মাতার দুই চোখে, অর্ধমৃত হয়ে পড়েছিলেন মাতা যশোদা, তাও ছাড়েননি আদরের গোপালকে। জননীর বিকৃত ললাট আজও তার সাক্ষ্য বহন করে। 

   তারপর যতবার হামলা হয়েছে গোপালের ওপর, ললাটে করাঘাত করে, কেঁদে ভাসিয়েছেন জননী যশোদা। পুত্রের মঙ্গলাকাঙ্ক্ষায় কত যে উপবাস করতেন জননী, গোপালের নামে কোন কুকথা সহ্যই হত না জননীর। কোন ব্রজবাসী গোপালের নামে অভিযোগ জানাতে আসত, ঠিক এমনি করেই ললাটে করাঘাত করে কাঁদতেন জননী। “কেউ আমার গোপালকে দেখতে পারে না গো। মিথ্যি মিথ্যি নালিশ করে খালি।” ঠিক এমনি করেই কাঁদছিলেন জননী, যখন মথুরার দিকে গড়িয়ে ছিল গোপালের রথের চাকা। “ও গোপাল, যাস নে বাবা, যাস নে। মোরা ছাপোষা গোপালক, ওরা কুহকিনী। তোর চোখে কেমনি মায়াঞ্জন লাগিয়েছে দেখ-। যাসনে বাপ। যাসনে। আমি যে তোকে ছেড়ে বাঁচব না বাপ। বুড়ি মাটাকে ছেড়ে যাসনে। নাহলে আমাকেও নে চল বাপ-।”

“সেই যে গেলি গোপাল, বুড়ি মা টার একটা সংবাদও নিলি না? আমার শরীরের ভিতর তোকে পালন করিনি, এই কি আমার অপরাধ? নাকি আমি সামান্যা নারী, শরীরে রাজরক্ত নেই, এই আমার অপরাধ?” 

গলার কাছে দলা পাকানো অসহ্য বেদনা, দু চোখে অঝোর ধারাপাত নিয়ে দ্রুত আলিঙ্গন করতে গেলেন কেশব, “মাতা-”। কিন্তু কোথায় মাতা? কেউ নেই সামনে, যতদূর দৃষ্টি যায়, নির্জন বনানী। পাখি গুলিও বুঝি ভুলেছে কুজন। “মাতাঃ” চিৎকার করে উঠলেন কেশব, না,না,না আর হারাবেন না মাতাকে, মাতা বহুবার বলেছেন, কিন্তু কেশব কখনও বলে উঠতে পারেনি, আজ বলবেই, “বড় ভালোবাসি মাতা তোমায়, সেদিনও বাসতাম। আজও বাসি। আমৃত্যু তোমার গোপাল শুধু তোমাকেই  ভালোবাসবে। জীবন বড় দ্রুত দৌড়েছিল মাতা, ইচ্ছা আর কর্তব্যবোধে বেঁধেছিল তীব্র লড়াই, তোমার গোপাল, কর্তব্যকে অবহেলা করতে পারেনি মাতা। তুমিই তো শিক্ষা দিয়েছিলে মাতা। গোপাল কোনদিন তোমায় ভোলেনি, এক দন্ডের জন্যও না। দেবী দেবকীকে শ্রদ্ধা করলেও, কখনও ভালবাসতে পারিনি মা, তোকে ছেড়ে কাউকে ভালবাসতে পারিনি মা।” কিন্তু মাতা কোথায়? নিশ্চয় এদিক ওদিকেই কোথাও আছেন মাতা, লুকিয়ে পড়েছেন কোন বৃক্ষের আবডালে, এভাবে এই নির্জন বনানীর মাঝে কখনও গোপালকে ছেড়ে যেতে পারেন না মাতা। উঠে দাঁড়াতে গেলেন কেশব, খুঁজে বার করতেই হবে মাতাকে। কিন্তু কোমর থেকে নীচের অংশে কোন সাড় নেই যে, আবার উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করলেন কেশব, আবার ব্যর্থ হলেন। এভাবে মাতাকে হারাতে পারেন না কেশব, বড় দুখিনী মাতা, তাঁকে খুঁজে বার করতেই হবে, জানাতেই হবে কেশবের মনের কথা। রুক্ষ বালি-কাঁকরের ওপর দিয়ে ঘষটে এগিয়ে যাবার চেষ্টা করলেন কেশব- চিৎকার করে উঠলেন মাতাঃ-।

“কাকে খুঁজছ, বনমালী? দেবী যশোদাকে?” রিনরিনে এ নারী কণ্ঠ, বড় চেনা, দমবন্ধ হয়ে এল কেশবের, অসহ্য বেদনায় ফেটে পড়তে চাইল বুঝি হৃদপিণ্ড। অজান্তে বন্ধ হয়ে এল দুই আঁখি। একি স্বপ্ন? না সত্যি? যদি স্বপ্নও হয়, এ স্বপ্ন যেন কখনও না ভাঙে। রমণী বলে উঠল, “তুমি চলে যাবার পর, বেশী দিন বাঁচতে হয়নি মাতা যশোদাকে। তোমার জন্য কেঁদে কেঁদে অকালেই হারিয়ে ফেলেছিলেন দৃষ্টিশক্তি, তারপর একদিন সকলের অজান্তে চলে গেলেন, শুনেছি মৃত্যুর পূর্ব মুহূর্তেও তোমাকে খুঁজে ছিলেন দেবী যশোদা।” তারপর দীর্ঘ নীরবতা। নীরবতাও এমন বাঙময় হয়, ইতিপূর্বে জানতেন না কেশব। ইচ্ছে করছে শিশুদের মত ডুকরে ডুকরে কাঁদতে। ইচ্ছে করছে, দৌড়ে আলিঙ্গনবদ্ধ করতে প্রিয়তম নারীকে, কেশবের প্রথম প্রেম, রাধারানী!


পর্ব- ৩

সাহস হচ্ছে না নয়ন মেলার, তীব্র আতঙ্ক গ্রাস করছে,যদি জননীর মত হারিয়ে যান রাধারানীও। মুদ্রিত নয়নেও অনুভব করছেন, সামনেই হাঁটু মুড়ে বসে আছে রাধারানী, ঠিক যেমন করে  বসত, বৃন্দাবনের মধুর দিনগুলিতে। রাধারানীর তপ্ত নিশ্বাস স্পর্শ করছে, কেশবের চিবুক। আনমনে কিছু ভাবছে রাধারানী। অভিমান হলে এমনই করত, কয়েক মুহূর্ত না কি কয়েক যুগ কেটে গেল, জানেন না কেশব, কথার পর জমছে কথা, কিন্তু বলতে পারছেন না বনমালী, দুষ্ঠ শুষ্ক জিহবা যেন ষড়যন্ত্র করেছে ওষ্ঠ আর অধরের সাথে, আর বলবেনই বা কি? মার্জনা চাইবেন? এতগুলি বৎসর পার করে? বলতে পারবেন কি কেশব, যে রাধারানীর প্রতি তাঁর সেই দুর্দম-দুর্মর প্রেম আজও অটুট। কেশবের হৃদয়ের গভীর-গোপন প্রকোষ্ঠে বাস করেন শুধুই রাধারানী। প্রিয়তমা মহিষীদের সপ্রেম সাহচর্য, অর্জুন তথা সখী কৃষ্ণার উষ্ণ বন্ধুত্ব, অনুগত মুগ্ধ স্তাবকদের স্তুতি কিছুই ততটা গভীর ভাবে স্পর্শ করতে পারে না কেশবকে, যে ভাবে ছুঁয়ে থাকেন রাধারানী। দেবী রুক্ষ্মিণী ছাড়া কেউ জানে না,  কেউ অনুভব করেনি, কেশবের হৃদয়ের গোপন ব্যথা। বললে কি বিশ্বাস করবেন রাধারানী? 

“একটিবারও তাকালে না, একটি প্রিয়সম্বোধন পর্যন্ত করলে না, শৈশবের সখীকে?  ব্রজবাসীদের মত তুমিও তাহলে মুখ ফিরিয়ে নিলে বনমালী? আচ্ছা আমরা দুজনেই তো একই দোষে দুষ্ঠ বনমালী, তাহলে যে সমাজ তোমার অর্চনা করে, তারাই কেন আমায় কলঙ্কিনী বলে সম্বোধন করে বনমালী? আমার দেহে রাজরক্ত নেই বলে? আমি মূর্খ গোপিনী বলে? নাকি আমি নারী বলে? তুমি তো চলে গেলে বনমালী রাজরথে চড়ে মথুরা, একটি বার ফিরেও তাকালে না, অভাগীর দিকে, তোমার অবর্তমানে আরও কয়েকজন এসেছিল রাধারানীর নাগর হতে-।” আর সইতে পারলেন না কেশব, দুহাতে কান চেপে ধরলেন কেশব, রাধারানীর মধু ঝরা কণ্ঠ যেন তপ্ত শলাকার মত, প্রবেশ করতে লাগল কর্ণকুহরে।

“ওমা, কানে হাত দিলে কেন গো? তাই তো হয়, অভিসারিকা, পরপুরুষ অনুগামিনী নারী মানেই তো বহুভোগ্যা। সমাজ তো তাই মনে করে বনমালী, প্রথম কিছুদিন তোমার ভয়ে তারা সাহস পায়নি, তারপর লুকিয়ে আসতে লাগল প্রস্তাব। যে সখীরা এককালে তোমার প্রেম সম্ভাষণ বহন করে আনত, তাদের হাতেই আসতে লাগল, কামুক পুরুষদের অভিসারের প্রস্তাব। জানো আর্যাবর্ত্য থেকেও ছুটে এসেছিল জনা কয়েক রাজপুরুষ, ‘কে সেই রমণী, যার প্রেমে পড়েছিলেন স্বয়ং কেশব’। তাঁরা আসত অন্য উদ্দেশ্য নিয়ে, আর আমি ছুটে যেতাম তোমার সংবাদ পাবার আশায়। নির্বোধ মূর্খ রাধারানী। সতী লক্ষ্মী গোপিনীরা পরামর্শ দিয়েছিল, দড়ি-কলসি নিয়ে যমুনার কালো জলে ঝাঁপিয়ে পড়তে, সে চেষ্টাও করেছিলাম জানো, পারিনি বনমালী। কেবলই মনে হত, আমি চলে যাবার পর, যদি তুমি আসো, তাহলে কি হবে? মাতা যশোদাও তো নেই, আমিও যদি না থাকি, বড় দুঃখ পাবে আমার বনমালী। দেবী রুক্ষ্মিণীর সাথে তোমার বিবাহের সুসংবাদ পেয়েছিলাম, বহুদিন পর, সংবাদ পেয়েছিলাম, দেবী কৃষ্ণার সাথে তোমার সখ্যেরও। দুষ্ঠ দুঃশাসন যখন পরিপূর্ণ সভাগৃহে বিবস্ত্র করতে উদ্যত হয়েছিল, দেবী কৃষ্ণাকে, কি ভাবে নিজের উত্তরীয় জড়িয়ে তাঁর সম্মান রক্ষা করেছিলে তুমি বনমালী, চারণ কবিদের গানে গানে শুনেছিলাম সে গল্পও। গর্ব হয়েছিল খুব। এভাবেই বেঁচে ছিল রাধারানী জানো। তোমার কথায়, তোমার গানে। আর তারপর, তারপর একদিন বন্ধ হয়ে গেল সব গল্প, শুনলাম, তুমি সপরিবারে মথুরা ছেড়ে চলে গেছ, বহু বহু দূর দ্বারকা। দপ করে নিভে গেল সব আলো, যমুনার কালো শীতল জল, ডেকেছিল সেদিন-। যেতে গিয়েও পারেনি রাধারানী, যদি ফিরে আসে বনমালী-, কি মূর্খ, কি মূর্খ ছিলাম বল। হতভাগিনী মূর্খ রাধারানী।”

আর পারলেন না কেশব, দুহাত বাড়িয়ে আলিঙ্গনাবদ্ধ করতে গেলেন প্রিয়তমা রাধারানীকে, অসীম শূন্যতা ছাড়া কিছুই ধরতে পারলেন না কেশব, খিলখিল করে হেসে উঠল কেউ, হতভম্ব হয়ে নয়ন উন্মোচন করে দেখেন সামনেই বসে আছে এক বালিকা, কতই বা বয়স হবে, সদ্য বসতে শিখেছে হয়তো। এই গভীর অরণ্যে এই শিশুটি কোথা থেকে এল, কর্তব্যপরায়ণ কেশবের কপালে পড়ল গভীর খাঁজ। বালিকাটি অবশ্য দিব্যি খুশির মেজাজে আছে, খিলখিল করে হেসেই চলেছে। মানসিক বেদনাকে সংযত করে, কেশব প্রশ্ন করলেন, “তুমি কে কন্যা? এই অরণ্যে কি করে এলে মাতা?” 

“ কন্যা, বালিকা, মাতা- এসব কি বলছ কেশব? আমরা তো সমবয়সী। একই সাথে জন্মেছিলাম দোঁহে। কেন তুমি জানো না?” স্পষ্ট উচ্চারণে বলে উঠল শিশুকন্যা।  


পর্ব-৪

মস্তিকের কোষে কোষে নামছে অসীম ধোঁয়াশা। তীব্র মনোবেদনায় ফেটে পড়তে চাইছে হৃদয়। এ হৃদয় তো কোন দুর্বল পুরুষের হৃদয় নয়। তাহলে? কণ্ঠমূলে এমন অসীম বেদনা কেন? কেন ঝাপসা দুই আঁখি। দুই চোখে তার সীমাহীন কৌতুক নিয়ে নীরবে তাকিয়ে আছে সম্মুখস্থ শিশুকন্যা,  না জানি কত শত-সহস্র বৎসর ধরে। বড় সুমিষ্ট মুখখানি। তপ্তকাঞ্চনবর্ণা নন, তবে গৌরবর্ণা, ইতঃস্ততঃ বিক্ষিপ্ত ঢেউ খেলানো ঘোরকৃষ্ণবর্ণ কেশগুচ্ছ। বড় চেনা এই মুখ। বিশেষতঃ ঐ ভ্রুকুটি খুবই পরিচিত, খুব আপন, কারো সাথে যেন বড় বেশী মিল-। প্রায় মুছতে বসা স্মৃতির পাতায়, কোথায় যেন লুকিয়ে আছে মেয়েটি। “কন্যা, তোমার মাতা-পিতা কোথায়? এই গভীর বনানীর মাঝে, কে ছেড়ে গেছে তোমায়?”

“তুমি আমায় চিনতে পারছ না কেশব?” খিলখিল করে হেসে উঠল রহস্যময়ী বালিকা। তারপর পিছন দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে হাঁক পাড়ল, “মাতা, পিতা”। সুবিশাল মহীরূহের পিছন থেকে যাঁরা বেরিয়ে এলেন, তাঁদের দেখে মুহূর্তের জন্য বন্ধ হয়ে গেল কেশবের হৃদপিণ্ড। 

সস্নেহে শিশুকে কোলে তুলে নিলেন মাতা যশোদা, স্নেহচুম্বনে ভরিয়ে দিলেন শিশুর লালচে ওষ্ঠাধর। এই যশোদা নেহাতই তরুণী, পাশে হাস্যমুখে যিনি দণ্ডায়মান তাঁর সমস্ত মনোযোগ শিশুকন্যার উপর,ফিরেও তাকালেন না সাধের গোপালের দিকে। বরাবরই কিছুটা দূরত্ব রেখেই মিশেছেন নন্দলাল। মাতা যশোদার মত অনাবিল ছিল না ওণার স্নেহ। নিষ্ঠা, কর্তব্যপরায়নতার অভাব না থাকলেও, কোথায় যেন মিশে ছিল সম্ভ্রম মেশানো দূরত্ব। অন্যান্য পিতাদের মত কখনই শাসন করেননি নন্দলাল। কখনই চোখে রাখেননি চোখ, সামনাসামানি হলেও নত করে রাখতেন মস্তক। নির্বাক হয়ে পূরণ করতেন কেশবের তুচ্ছাতিতুচ্ছ চাহিদা। এমনকি মাতা যশোদা শাসন করলেও, আপত্তি জানাতেন নন্দলাল। কারণটা বুঝতে কেটে গিয়েছিল অনেকগুলি বছর- 


 নীলাভ হলাহলের মত, তীব্র ঈর্ষার বিষ ছড়িয়ে পড়ল শোকস্তব্ধ কেশবের শিরাউপশিরায়। নন্দলালে ঔরসে যশোদার গর্ভে জন্মগ্রহণ করেননি, এটা তাঁর দুর্ভাগ্য। তাই বলে অন্য ভাগীদার মেনে নেবেন না কেশব। যে যাই বলুক,তিনি,  তিনিই এনাদের একমাত্র সন্তান। এনাদের যাবতীয় স্নেহ-মায়া- ভালোবাসার একচ্ছত্র উত্তরাধিকারী।  

এই কন্যা কে? কোথায় ছিল এতকাল?  “মাতা- পিতা” বলে হেঁকে উঠলেন কেশব। তাঁর অার্ত কন্ঠ হাহাকারের মত ঘুরে ফিরে বেড়াতে লাগল সমগ্র বনানী জুড়ে। 

“তুমি আমায় চিনতে পারছ তো কেশব? একই সাথে জন্ম আমাদের, যমুনার এপারে-ওপারে। প্রসববেদনায় কাতর মাতা সাময়িক ভাবে হারিয়ে ছিলেন সংজ্ঞা। তাঁর ক্রোড় থেকে ছিনিয়ে নেওয়া হয় আমায়। বড় ভীরু ছিল আমার পিতা। আদর্শ প্রজা। বড় বিশ্বাস, বড় ভক্তি করতেন তোমার পিতাকে। তোমার পিতা আশ্বাস দিয়েছিলেন, কটা দিনের ব্যাপার মাত্র। সিংহাসনের ওপর যেহেতু নারীর অধিকার স্বীকৃত নয়, তাই কন্যাসন্তানকে কখনই দাবীদার হিসেবে দেখবেন না যুবরাজ কংস। সবই আপ্তবাক্য ছিল হে কেশব। সবই আপ্তবাক্য ছিল। পিতা বুঝেও আপত্তি করার সৎসাহস জোটাতে পারেননি।  যুবরাজ কংস, বিকৃত মস্তিষ্ক হলেও নির্বোধ ছিলেন না। আরে এতো সোজা হিসেব কেশব, ধরো আমি সিংহাসন দাবী না করতে পারলেও, কাল আমার হবু স্বামী তো করবেই, অথবা পরশু আমার প্রথম পুত্র? তবুও স্তোকবাক্য দিয়ে আমায় নিয়ে যাওয়া হয়,তোমাদের প্রাসাদে। তোমার জননী, দেবী দেবকী, তোমার শোকে মূহ্যমানা।  ক্ষণিকের জন্যও আমায় জড়িয়ে ধরেননি বক্ষে। একটি বারের জন্যও ওষ্ঠে ধরেননি অমৃতধারা।  ক্ষুধার্ত, প্রবল বর্ষণে, সিক্ত আমি থরথর করে কাঁপছিলাম, দুই নিদ্রাতুর আঁখি খুঁজে বেড়াচ্ছি মাতাকে। আমার স্নেহময়ী জন্মদাত্রী। কোথায় তিনি? ডুগরে কেঁদে উঠলাম আমি, “মাতা- মাতা- মাতা। ”ছাপোষা গোপালকের শিশুকন্যার আর্তনাদ ধ্বনিত হল তোমাদের প্রাসাদ জুড়ে। ঘোষিত হল যুবরাজ কংসের আগমনবার্তা। পলকে আমায় বক্ষে ধারণ করলেন তোমার জননী। তাঁর হৃদয়জুড়ে শুধুই তুমি কেশব। তোমার মঙ্গলাকাঙ্খায় থরথর তাঁর হৃদয়। কি নিপুণ অভিনয়টাই না করলেন তিনি। যুবরাজ কংস যখন চেপে ধরলেন আমার ক্ষুদ্র শ্বাসনালী,নীল বর্ণ ধারণ করল আমার মুখমণ্ডল কেমন আছাড়িপিছাড়ি কান্নাটাই না কাঁদলেন তিনি। মুখ ফিরিয়ে নিলেন তোমার পিতাও। এমন তো কতই হয়। রাজার দুলালের প্রাণ বাঁচাতে নাহয় ঝরলই খানিক রক্ত। দীন গোপালকের কন্যার প্রাণের আর কি মূল্য আছে? অন্তিম মুহূর্তেও আমার জননীকেই খুঁজেছিলাম আমি কেশব-”।  


আর সইতে পারলেন না কেশব, আগাছা ভরা অরণ্যের মাটিতে ঠুকতে থাকলেন মস্তক। “ক্ষমা। দেবী ক্ষমা। নিজের প্রাণ দিয়েও যদি ফিরিয়ে দিতে পারতাম তোমার জীবন- । ” “একি কেশব, তুমি কাঁদছ?” রাজ্ঞী রুক্ষিণীর পেলব স্পর্শে ঝটিতি ভেঙে গেল নিদ্রা। চোখ খুললেন কেশব, পূব আকাশে ছড়িয়ে পড়ছে হাল্কা লালিমা, বাতায়ন পথে ভেসে আসছে আরামদায়ক পুষ্প সুরভিত জোলো সামুদ্রিক বাতাস। মাথার উপর স্বচ্ছ দুগ্ধফেননিভ চন্দ্রাতপ। আপন দারুপালঙ্কে শায়িত আছেন কেশব। সুগন্ধী মিশ্রিত ঘিয়ের প্রদীপ প্রায় নিভু নিভু। আধো অন্ধকারেও ভাস্বর রাজ্ঞী রুক্ষিণীর অনুপম রূপ। উদ্বিগ্না রাঞ্জী পুনরায় প্রশ্ন করলেন, “কেশব? কাঁদছ কেন কি হয়েছে?” জবাব দিতে পারলেন না কেশব, নীরবে আলিঙ্গনাবদ্ধ  করলেন প্রিয় মহিষীকে, তারপর তাঁর কর্ণকুহরে ফিসফিস করে বললেন, “ক্ষমা। দেবী ক্ষমা। ” বাতায়নের ওপারে ঘোর অন্ধকার আকাশের বুকে তখন আঁকিবুকি কাটছে ঊষার লালিমা। ফুটে উঠছে একরাশ চেনা মুখ, যাদের চেনেন শুধু কেশব আর চেনে প্রকৃতি। বেদনার্ত প্রতিটি মুখ, ভ্রুকুটিতে লুকানো একরাশ অভিমান, আর হৃদয়ে শুধুই প্রেম। কৃষ্ণ প্রেমে ভাস্বর প্রতিটি চরিত্রের ওষ্ঠাধরে একটিই প্রার্থনা। ভালো থেকো কেশব। শুভ জন্মদিন।

Monday 10 August 2020

অনির ডাইরি ৯ই অগস্ট,২০২০

 তুমি বললে, “চলো যাবে?” একপায়ে খাড়া আমি। বড় দিশেহারা সময়, বড় দমবন্ধ-করা পরিস্থিতি। মোবাইলের ওপারে বড় দ্রুত পাল্টে যাচ্ছে মূল্যবোধ। বড় পুরু হয়ে উঠছে ত্বক, ভোঁতা হয়ে আসছে অনুভূতির দল। কোন অনাম্নী অঙ্গনা যেন কোথায় ঢেলেছে বিষ, কোন হতভাগ্য চলচ্চিত্রাভিনেত্রীর জন্য নাকি কলঙ্কিত আজি সমগ্র বঙ্গনারী সমাজ। ফুঁসে উঠছে বঙ্গ পুং আর নারীর দল। ঝড়ে উড়ছে শুকনো পাতা। ব্যক্তিগত ভাবে এসব কুবাক্যে খুব একটা প্রভাবিত হই না যদিও, জনরোষ দেখে  প্রাথমিক ভাবে মনে হল, বেচারী নির্ঘাত কোন বঙ্গতনয়ার চোখে হারিয়েছে প্রিয়তম পুরুষ। অথবা কোন বঙ্গপুঙ্গব ভেঙে খানখান করেছে মেয়েটার হৃদয়। আগুন জ্বললে ধোঁয়া তো উঠবেই। তবুও উত্তপ্ত জনপোস্টে প্রলোভিত হয়ে, চুপিচুপি দেখে এলাম আমিও, অনাম্নী অঙ্গনার সাধের দেওয়াল জোড়া বিশেষ কোন রাজনৈতিক মতাদর্শের ছড়াছড়ি। মনে হল ভারি অঙ্কের মানহানির মামলা ঢুকে দিলেই তো ল্যাটা চুকে যায়, এনারা অর্থের মূল্য আমাদের থেকে ঢের বেশী বোঝেন। বলেও দেখলাম জনাকয়েক মিডিয়া ফাটানো নরনারীকে। পরিণাম কি না জানি না, আজকাল আর খুঁজে পাচ্ছিনা আসল পোস্টটা। বাজারে স্ক্রিনশটের ছড়াছড়ি থাকলেও, ওণার দেওয়ালের আসল পোস্টটা গেল কোথায়? তোমাকে শোনালাম আমার ষড়যন্ত্র তত্ত্ব, তুমি বললে, “হুঁ।” 

এয়ারপোর্টের এক নম্বর গেট দিয়ে ঢুকে, আড়াই নম্বর দিয়ে গলে গাড়ি উঠল যশোর রোডে। রোজই তো যাই এই রাস্তা ধরে, তবুও এমন ঝকঝক করে না তো। আকাশটা যেন ধুয়ে মুছে তকতকে, ইতিউতি লুকোচুরি খেলছে পেঁজা তুলোর মত মেঘের দল। এই আধা লকডাউনে বেশ ফাঁকা বেলঘড়িয়া এক্সপ্রেস ওয়ে। দুপাশে সারি সারি চায়ের দোকান। এদের চা বেশ সুস্বাদু। পাশাপাশি কাঁচের বয়ামে রাখা হরেক রকম বিস্কুট। সস্তা ক্রীম রোল। গোল গোল নকল মতিচুরের লাড্ডু। রাস্তায় পেতে রাখা কাঠের বেঞ্চে বসে, মাটির ভাঁড়ে আগুন গরম দুধ চা আর প্রজাপতি বিস্কুট- পাশের রাজপথ দিয়ে আলোকগতিতে ছুটবে জীবন। জানতে চাইলাম খাবে? নিরুত্তর রইলে তুমি, দুচোখে ঝলসে উঠল কি জানি কি অনুভূতি । রাজপথের ধারে বসতি গড়েছে একদল বাঞ্জারা, দেদার পড়ে আছে, রামধনুরঙ হাতে গড়া ঘরসাজানোর সরঞ্জাম। দুদণ্ড জিরোই এথা, নারাজ তুমি। 

অন্যদিন নিবেদিতা সেতু ধরে ঝটিতি পেরিয়ে যাই নদী, আপিস যাবার পথে দুদণ্ড দাঁড়ায় বাপি, জানলার কাঁচের ওপারে ভেসে ওঠে দক্ষিণেশ্বরীর মন্দিরের সুদৃশ্য চূড়া। এপারে, মোবাইলের স্ক্রিনে ভেসে ওঠে মায়ের ব্যগ্র মুখখানি। দুহাত কপালে ঠেকায় মা, জ্বলন্ত সিগারেট হাতে পিছনে এসে দাঁড়ায় বাবা। সেই মাঝ মার্চ থেকে গৃহবন্দী বৃদ্ধ-বৃদ্ধা। এভাবেই হোক না মানসভ্রমণ। আজ বিবেকানন্দ সেতু ধরলে তুমি। দক্ষিণেশ্বর ইস্টিশনের পাশ দিয়ে, দূরে স্কাইওয়াক দেখতে দেখতে সাঁ করে বেঁকে গেল গাড়ি। দূর থেকে ইস্টিশনটা মায়ের মন্দির বলে ভ্রম হয় জানো,  প্রণামও করেন অনেকে। মা তো সর্বত্র বিরাজমানা, সমস্যা কোথায়? 

হ্যাঁ গো, তোমার মনে পড়ে? এই বালি ব্রীজের ওপরেই একবার খারাপ হয়ে গিয়েছিল গাড়ি। সুদূর খড়্গপুর থেকে, প্রায় সংসার গুটিয়ে গাড়ি ভাড়া করে ফিরছিলাম আমরা। তুত্তুরীর আগমনে তখন বাকি কেবল এক পক্ষ। আমায় বাড়ি পৌঁছে দিয়ে, পরদিনই  ভোর ৭টা ১০এর খড়্গপুর লোকালে ফিরে যাবে তুমি। বনেট খুলে খুটখাট করছিল ড্রাইভার, আর আমরা মোহিত হয়ে দেখছিলাম ডুবন্ত লাল বলের মত সূর্যটাকে। গঙ্গার পানিতে মাখামাখি সোহাগী আবির। সেই আবির ছড়িয়ে গেল মন্দিরের খাঁজে খাঁজে। কিছু কিছু মুহূর্ত বুঝি মোছে না হৃদয় হতে-  এবারও তুমি নিরুত্তর। হয়তো মৌখিকভাবে প্রশ্নটাই করিনি আমি। কিছু কিছু প্রশ্ন নিরুচ্চারিত থাকাই শ্রেয়। বাতাসে মিশে থাকে তার উত্তর। 

গ্রাণ্ড ট্রাঙ্ক রোড ধরেছি আমরা। বালি ছাড়িয়ে উত্তরপাড়া। সরু রাজপথের একদিকে চকচকে নব্য-প্রাচীন অট্টালিকা সমূহ, অপর পারে চিকচিকে গঙ্গা। ইতিহাস শোনাও তুমি, অবিভক্ত বাংলার প্রথম পৌরসভার গপ্প। স্থানীয় জমিদার, বাবু জয়কৃষ্ণ মুকুজ্জের উদ্যোগে ১৬৭ বছর আগে প্রতিষ্ঠিত হয় উত্তরপাড়া-কোতরং পৌরসভা। ১৮৫১ সালেই কোম্পানীর কাছে আবেদন করেছিলেন বাবু জয়কৃষ্ণ। হোক না ক্ষুদ্রিকা, তবুও প্রিয় নগরে গড়ে উঠুক পৌরসভা। সে আবেদন নাকচ হলেও দমেননি বাবু জয়কৃষ্ণ আর তাঁর সঙ্গীসাথীরা। অবশেষে দুবছর পর মেলে অনুমোদন। পৌরসভার গাত্রে খোদিত সন-তারিখ সেই শুভক্ষণের।  ১৮৫৩ সালের ১৪ই এপ্রিল। পৌরভবনের গাত্রে শোভা পায় আরো এক মহামানবের স্থিরচিত্র। বাবু সুভাষ চন্দ্র বোস। সন ১৯৩৮। তৎকালীন পৌরসভার আমন্ত্রনে পদধূলিধন্য করেছিলেন এই পৌরভবন। কৌচে আসীন হবু নেতাজী, পরিবৃত গুণমুগ্ধ ভক্তবৃন্দ দ্বারা। ধুতি-চাদর পরিহিত বিগলিত হাসিমুখ একদল বাঙালী, যারা গঠন করেছিলেন তৎকালীন বোর্ড।  

ইতিহাসের সঙ্গে আমাদের জন্মপ্রেম, ইতিহাসের অলিগলিতে ঘুরে বেড়াই আমরা। গাড়ি ছুটে চলে রাজপথ ধরে, সচেতন ভাবে আমরা এড়িয়ে যাই কেন্দ্র-রাজ্য-রাজনীতি-লকডাউন জাতীয় শব্দাবলী। এই সব শব্দ কর্ণকুহরে প্রবেশ করলেই ঝাঁপিয়ে পড়বেন অশোকবাবু। উনি অত্যন্ত রাজনৈতিক ভাবে সচেতন ব্যক্তি। আণ্ডারপাসে বড় বড় গর্ত এইটুকু বলার অপরাধে প্রায় আধঘন্টা ধরে যাবতীয় দপ্তরের মুণ্ডপাত করলেন উনি। অনলাইন ক্লাস নেওয়া নিয়ে হল আরেক দফা মুণ্ডপাত।  মানুষটি সাধাসিধে বটে, তবে স্বভাবে ঘোরতর তর্কবাগীশ বাঙালী।

ধাড়সা বাসস্ট্যাণ্ডের উল্টোদিকে আহমেদ সাহেবের চেম্বার। ওণার ওপর বড় ভরসা শ্বশুর মশাইয়ের। কি যেন নার্ভ শুকিয়ে আসছে ওণার, পরিণামে পায়ের পাতায় ধরে অসহ্য জ্বলন। কলকাতার নামীদামী ডাক্তারকুল বলেই দিয়েছে, “এ ব্যামোর কোন ওষুধ নেই।” প্রাণঘাতী তো নয়, শুধু জ্বলুনী টুকুই যা সইতে হবে। আহমেদ সাহেবের ওষুধে কম থাকে জ্বালা। বৃদ্ধ নিজেই আসছিল, ওষুধ আনতে। কোন মতে ধরে বেঁধে আটকানো গেছে তাঁকে। একফালি বারন্দায় পাশাপাশি বসে আছি আমরা, সহৃদয় ডাক্তারবাবু ভিতরে গেছেন ওষুধ আনতে। ঘড়ি বলে সাড়ে বারো। পাশের পুকুরে ঝিলিক মারে মধ্যগগনের যুবক তপন। গুনগুন করে গান গাইছি আমি, তুমি বললে, “হাওড়া যাবে?”

অশোকবাবু বললেন, “বাড়ি যাবেন না এজ্ঞে?” বাড়িই তো। তিন দশক কাটানো বাড়ি। আমার শহর। বেলুড় মঠের পাশ কাটিয়ে, লিলুয়া আইনক্স ছাড়িয়ে গাড়ি ঢোকে ঘুষুড়িতে। জানো, এখানেই কোথায় যেন বেশ কয়েকটা অনুপম পোড়া মাটির মন্দির আছে।বলেছিলাম না তোমাকে, কার সাথে যেন দেখতে এসেছিল সঞ্চিতা। সে অনেককাল আগের কথা। ছবি দেখে নেশা ধরেছিল। যতবার বলেছি তোমাদের, অট্টহাস্য করেছ তোমরা। ঘিঞ্জি বাজার এলাকা। সেখানে মন্দির বিরল নয় বটে, তবে দৃষ্টিনন্দন টেরাকোটার মন্দির? পথ দেখায়নি সঞ্চিতাও। স্বপ্নময় দেউল বোধহয় স্বপ্নেই দেখা। গাড়ি ঢোকে শালকে। একমনে বলে যাও তুমি, এখানেই কোথায় যেন ছিল মায়া সিনেমা। তোমার মা-মাসিদের একমাত্র বিনোদনস্থল। মাসিদের সাথে আশা ও ভালোবাসা দেখতে গিয়েছিল ছোট্ট তুতাই। প্রসেনজিৎ আর দীপিকা। পাডুকোন নয়, চিকলিয়া। আগে বাঁদিকে বাঁধাঘাট লঞ্চঘাট। কতবার কলকাতা থেকে লঞ্চ পেরিয়ে এপাড়ে এসেছেন তোমার বাবা-মা। ডানে হরগঞ্জ বাজার। ঐ বাজারেরই শাড়িজামা পরে বড় হয়ে উঠেছেন ওণারা। এদিকে গেলেই মায়ের স্কুল, ঊষাঙ্গিনী বালিকা বিদ্যালয়। ওদিকে বাবাদের  শালকিয়া অ্যাংলো-স্যানস্ক্রীট হাইস্কুল। এই তো তোমাদের বাড়ির গলি। কেউ থাকে না আর এখানে। ভাবুক হয়ে পড় তুমি। খুঁজতে থাকো, গলির মুখের চা-লস্যির দোকানটা। খোঁজ সেই রোয়াকগুলো, যেখানে বসত ফুলকাকা থেকে ছোটেকাকাদের আড্ডা। সেই আড্ডাবাজ ছেলেগুলো যে কোথায় হারিয়ে গেল। পৌনে দুটোর রোদে খটখটে শুকনো মরা গলি। উদাস হয়ে পড় তুমি, আর একটু চেপে ধরি তোমার নরম হাতের পাঞ্জা, একসাথে আরেকবার খুঁজতে থাকি, লুকানো শিকড়বাকড় গুলো। খালি চোখে ধরা যায় না, কিন্তু তবুও তারা থেকে যায়। থেকে যায় আমাদের সমগ্র সত্ত্বা জুড়ে। খুঁজলেই পাবো জানি। হয়তঃ পেয়ে যাব আমার হারানো ভাঙা দেউলগুলোও- জীবন বড় বিচিত্র, কিছুই হারায় না।  লুকিয়ে থাকে আলোআঁধারীর নক্সার মাঝে।

Saturday 8 August 2020

অনির ডাইরি ৮ই আগস্ট, ২০২০


তুত্তুরী বলল, “তোমার বাড়ি যাব। ডাকাতী করতে। ” পাপাই (নামটা না হয় পাল্টেই দিলাম) একগাল হেসে বলল, “কিন্তু তুত্তুরী মা, আমার বাড়িতে তো কুকুর আছে-”। “ বুঝলে না তো, তোমার কুতুয়াটাকেই তো চুরি করতে যাব।” কুতুয়া অর্থাৎ শ্রীমান (নাকি শ্রীমতী) শ্যাডো তখন ব্যস্ত পাশের বিল্ডিং এর গেটের ফাঁকে পুঁচকে নাকটা গলাতে। কুচকুচে কালো একরাশ উমনোঝুমনো লোমে  ইদানিং ধরেছে গাঢ় কফি রঙের ছোপ। তাই নিয়ে পাপাই আর ওর বউয়ের আফশোসের অন্ত নেই। আমাদের বাড়ির পাশেই কোথায় যেন মোজাম্মেল সাহেবের চেম্বার। পাপাইয়ের চোখে উনি ঈশ্বর। পেশায় কুতুয়াদের সার্জন, উনিই ছোট থেকে বাঁচিয়ে রেখেছেন শ্যাডোকে। শ্যাডোর আসল মালকিন পেশায় ছিল বারগার্ল। প্রতিসন্ধ্যায় হাইরোডের ধারে কোন বারে নাচতে যেত মেয়েটি। একলা ফ্ল্যাটে গলায় দড়ি বেঁধে রেখে যেত মাত্র কয়েকদিন (নাকি মাসখানেকের) বয়সের শ্যাডোকে। শখ করে কিনে তো ছিল, পোষার ক্ষমতা ছিল না। আর পুষবেই বা কখন? সারারাত মেহনত করে, কাক না ডাকা প্রভাতে ফ্ল্যাটে ফিরে ক্লান্তিতে ভেঙে পড়া দেহে ঘুমিয়ে পড়ত মেয়েটি। ঘুম ভাঙতে ভাঙতে বেলা গড়িয়ে যেত মধ্যাহ্ন। তারমধ্যেই যতটা পারত দেখভাল করত- অসুস্থ হয়ে পড়ছিল শ্যাডো, তখন অবশ্য শ্যাডো নামটা হয়নি। এরই মধ্যে কোন একটা ছুটির দিনে পাপাই আর ওর বউকে নিমন্ত্রণ করেছিল শ্যাডোর পুরাতন মালকিন। পাপাইয়ের ছোটবেলার বান্ধবী।ততোদিনে শ্যাডোর লোম ঝরেছে, গা ভর্তি ঘা। তবুও ঐ অবস্থাতেও পাপাইয়ের বউকে দেখে, তার কোলে উঠে পড়েছিল শ্যাডো। ঘেয়ো শ্যাডোকে কোলে নিয়েই সোনালী বলেছিল, “একে আর ফেরৎ দেবো না কিন্তু। ” পরে বহুবার বলেছে পাপাই, “জানেন তো ম্যাডাম, সোনালী বলেছে বলে, পুরো দাম দিয়ে কিনে নিয়েছিলাম ওকে। দেখেছেন তো, কেমনি কুচকুচে কালো রঙ, অন্ধকারে দেখাই যায় না। তাই ওর নাম রেখেছিলাম শ্যাডো।  ” 

কিনে তো নিল, কিন্তু শ্যাডো যে বড় অসুস্থ। তখনই মোজাম্মেল সাহেবের কাছে আসা। ওণার ওষুধ ছাড়া খায়ই না শ্যাডো। মুস্কিল হল এই লকডাউনে আর বসছেন না ডঃ মোজাম্মেল। ফলতঃ চুঁচুড়ারই কোথা থেকে যেন নৈমিত্তিক কি একটা ইঞ্জেকশন দেওয়া হয়েছে শ্যাডোকে। পাপাই বলে, “কি ব্যথা হয়েছিল ওর দুই পায়ে ম্যাডাম। দুরাত নাড়াতে পারেনি।” তারপর থেকেই নাকি, শ্যাডোর পশ্চাৎদেশের কালো রঙের রোমগুলো খয়েরী হতে বসেছে। শ্যাডো বাবুর অবশ্য কোন হেলদোল নেই তাতে। তিনি দিব্যি আছেন। সারা দিন ঘুমান। সারা রাত জাগেন।  মাঝেমাঝে আমার গাড়িতে উঠে আমায় বাড়িতে ছাড়তে আসেন। উদ্দেশ্য তুত্তুরী দিদির সাথে মোলাকাৎ। তুত্তুরী দিদিও আবাসনের সামনে দাঁড়িয়ে থাকে উদগ্র প্রতীক্ষা নিয়ে। শ্যাডোকে পেলেই সটান কোলে। ওমনি কুচকুচে নখ দিয়ে খুরখুর করে আঁচড়ে দেয় শ্যাডো। তাতে যে লাগে তা নয়, তবে বেদম হাসি পায়। ওমনি গদাম করে ছেড়ে দেয় তুত্তুরী। ঠিক সময় মত ক্যাচ লুফে নেয় সোনালী। নইলে চোট লাগতে পারে না,ছোট্ট বেবিটার। 

বেবিই তো। নিজে খেতেও পারে না, এমন ঢ্যাঁড়শ বেবি। সোনালী স্বহস্তে চটকে মুখে পুরে দেয়, তবে তিনি চিবোন। বড় বেশী আরাম প্রিয় বেবি, সোনালী বলে, “জানেন ম্যাডাম, খানিক দৌড়োদৌড়ি করেই উনি ক্লান্ত হয়ে পড়েন, তখন আমাদের বাসন মাজার জায়গায় যে জলের গামলাটা রাখা থাকে, তার মধ্যে পেট ডুবিয়ে বসে থাকেন উনি। তারপর পেট জুড়োলে, ঐ ভিজে গায়ে গোটা বাড়ি, দালান ঘুরে বেড়ায় আর গা ঝাড়া দিয়ে জল ঝাড়ে। আমি যেই রেগে গিয়ে বলি, এক চড় মারব, অমনি সটান খাটের তলায় ঢুকে বসে থাকে। ততোক্ষণ বেরোয় না, যতক্ষণ  না ওর বাবা আসছে। ” 

এহেন পাপাই-সোনালী আর শ্যাডোর সাদা-কালো-সোনালী দুনিয়ায় কিছুদিন আগে ঢুকেছিল এক অন্য ভাগীদার। কোথা থেকে যেন এক অসুস্থ কুতুয়াকে ধরে এনেছিল পাপাই। জাতে ল্যাব্রাডর। কিন্তু অনাথ। প্রথম মালিকের বাড়িতে ঠাঁই হয়নি। দ্বিতীয় যার কাছে থাকত, সে বছর খানেক শুধু বিরিয়ানি খাইয়েছে। নিজেও খেয়েছে, কুতুয়াকেও খাইয়েছে। ফলতঃ রীতিমত হাড় জিরজিরে চেহারা হয়েছিল কুতুয়াটার। প্রসাবে বেরোচ্ছিল লাল রক্ত। কালেক্টরেটের ড্রাইভারদের মুখে শুনে, আমাকে বাড়ি পৌঁছে ফেরার পথে সটান সেই বাড়ি গিয়ে হাজির নয় পাপাই। তারা তো এককথায় রাজি কুতুয়া হস্তান্তরে। ঘাড় থেকে নামাতে পারলেই বাঁচে। পাপাই বলে, “এমন লক্ষ্মী কুকুর ম্যাডাম, গলার দড়িটা ধরে টানলাম, চুপচাপ আমার পিছু পিছু চলে এসে টোটোয় উঠে পড়ল।” বাড়ি পৌঁছতে, শ্যাডোর চিৎকার দেখে কে? কে এলো রে ভাগীদার। 

নতুন অতিথির নাম রাখা হল জন্টি। তার জন্য ডাব আনা হল। শ্যাডো শুধু দুধভাত বা জল দিয়ে চটকানো রুটি বা ডিম সিদ্ধ খেয়েও কাটিয়ে দিতে পারে দিনের পর দিন। এর জন্য নিয়মিত রান্না করতে হত। অফিস ফেরৎ দুটুকরো হলেও মাছ কিনে আনতে হত পাপাইকে, ভেজে শুধু সিদ্ধ ভাতের সঙ্গে মিশিয়ে দিলে, “কি সুন্দর তৃপ্তি করে খেয়ে নেয় ম্যাডাম, দেখলেও চোখে জল আসে।” খাওয়া বা শ্যাডোর হিংসুটে ধমকধামকের থেকেও বড়, বলা যায় সবথেকে সমস্যা হত জন্টি যখন বড়কাজটা করে ফেলত। সোনালী বলে, “শ্যাডোর তো সব আমিই করি বলুন। ওর ধাতও বুঝি।  কিন্তু জন্টি যখন করেছিল আমি কাঁদতে শুরু করেছিলাম। কি গন্ধ!”  পাপাই আরো ভালো করে বুঝিয়ে দেয়, “ছোট বাচ্ছার গু আর বড় মানুষের পাইখানা যেমন। বুঝলেন কি না-”। 

ইত্যবসরে সংসারেও ঘনায় নানা অশান্তি। শাশুড়ী এবং মাসি শাশুড়ীর হাতে দুদফা মার খায় সোনালী। প্রথম বার শুধু কয়োকগাছা কেশ উৎপাটনেই সীমাবদ্ধ থাকে ব্যাপারটা। দ্বিতীয় দফায় মেরে ফাটিয়ে দেয় মাথা। হাসপাতাল থেকে যখন ভীত আতঙ্কিত স্বামী-স্ত্রী আমায় ফোন করে, বলি তৎক্ষণাৎ থানায় যেতে। ধারণা ছিল, থানায় গেলেই, বধূ নির্যাতনের নালিশ দাখিল করলেই, সবাই ঠাণ্ডা হয়ে যায়। বাস্তবে দেখলাম, আমিই ভুল ছিলাম। কোন ব্যবস্থা তো নেওয়া হলই না। উল্টে থানার জনৈক বাবু সোনালীকে বলল, “এত ভিড়ের মধ্যে এসব কথা আলোচনা করা যায় না। আমি তো একাই থাকি, আমার কোয়ার্টারে চলে আসুন বরং।” শুনে ওর থেকেও বেশী অসহায় বোধ করেছিলাম আমি। কি করি? কি ভাবে বাঁচাই মেয়েটাকে। সদ্য গেছে আমফান। জেলা প্রশাসন চরম ব্যস্ত ত্রাণের কাজে। ওদিকে নৈমিত্তিক অত্যাচার আর অশান্তি  বেড়েই চলে বাড়িতে। যোগাযোগ করি পরিচিতি নামক এনজিওর সাথে। ওরা এই ধরণের নির্যাতিত মেয়েদের পাশে দাঁড়ায়। কর্ণধার শ্রীমতী অঞ্চিতা ঘটকের সাথে যোগাযোগ চন্দননগরের বড় সাহেবের মাধ্যমে। প্রথম যখন ফোন করি, অঞ্চিতাদি ওয়েবইনারে ব্যস্ত ছিলেন। বাইরে ঘোর লকডাউন, তারই মধ্যে আমার চেম্বারে বসে হাপুস নয়নে কেঁদে যাচ্ছে মেয়েটা। থানার বাবুর কণ্ঠ স্পিকার ফোনের দৌলতে সারা আপিস শুনেছে। ওয়েবইনার মিটতেই  অঞ্চিতাদির ফোন, প্রথম প্রশ্নটাই ছিল, ‘বরটা কি বলছে?’ জানালাম বরটা নিজেও ভোম্বল হয়ে বসে আছে আমার ঘরে। নেহাত কাঁদলেই সবকটাকে দূর করে দেব বলে ভয় দেখিয়েছি তাই-। অঞ্চিতাদির কথা শুনে বুঝলাম, এই ধরণের বধূ নির্যাতনের কেসে যদি বরের সমর্থন থাকে, তাহলে অর্ধেকটা যুদ্ধ জেতাই হয়ে গেছে। বাকিটার জন্য নিয়োগ করা হল,ওণাদেরই এক সদস্যকে। লকডাউন, ট্রেন চলছে না, ফলে সশররীরে হয়তো আসতে পারেনি, তবুও বলতে বাধ্য যে,শুভ্রা নামক মেয়েটি, নিয়মিত শুধু সোনালী আর পাপাইয়ের সাথে যোগাযোগ রেখেছে তাই নয়, বাড়িয়ে গেছে ওদের মনোবল। নিজে কথা বলেছে থানায়। ওর নির্দেশমত চিঠির পর চিঠি নিয়ে গিয়ে বসে থেকেছে সোনালী। 

এই টালমাটাল অবস্থায় একদিন পাপাই বলল, “জন্টিকে কাউকে দিয়ে দেব ম্যাডাম। এইভাবে হয় না। এত মনমেজাজ খারাপ আমাদের। অধিকাংশ দিন রান্নাই হয় না। অন্তত মাস দুয়েকের জন্য হলেও দিয়ে দেব। ” বাড়িতে এসে জানালাম, ‘ভাবছি আমিই নিয়ে আসব ধেড়ে কুতুয়াটাকে-”। তুত্তুরী লাফাতে লাগল ধেইধেই। “জন্মদিনে কুতুয়া পাব।” মাসিও গররাজি হল। দুইটা মাসের তো ব্যাপার। শৌভিক একেবারে অনড়। “আমি জানি, এই বাড়িতে কেউ এলে সব দায় আমারই হবে। তোরা তো মা-মেয়ে,কুতুয়ার পটি দেখেই অজ্ঞান হয়ে যাবি। তারপর তাকে ফেলবে কে? আর সকালবেলা কুতুয়াটাকে নিয়ে যখন হাঁটতে বা ইয়ে করাতে নিয়ে যেতে হবে, আবাসনের নেড়িগুলো তেড়ে আসবে? তোরা মা-মেয়ে হা-হা করে কুতুয়া ফেলে ছুটে পালিয়ে আসবি। আমার সব দেখা আছে। আমি নেই। কুতুয়া আনলে আমি গৃতত্যাগী হব। ”কথাগুলো যে খুব ভুল, তা জোর গলায় বলতে পারলাম না। তারওপর তখনও জানি না, সপ্তাহখানেকের মধ্যেই অতিমারিতে আক্রান্ত হতে চলেছি আমরা মা আর মেয়ে। 

আপাততঃ একটা ভালো বাড়িতে ঠাঁই হয়েছে জন্টির। থানার বাবুকে টাইট দেওয়া গেছে। অন্য বাবু অত্যন্ত সহৃদয়তার সাথে নিয়েছেন সোনালীর কেস। কড়কে দিয়েছেন শাশুড়ী এবং তার বোন- বোনপো- বোনঝিকে। আদালত খুললে কেসও উঠবে। পরের সন্তানকে মেরে মাথা ফাটিয়ে দেওয়া বা চারজন মিলে একটি মেয়েকে মারধর করা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। শুভ্রা তথা পরিচিতি এখনও নিয়মিত যোগাযোগ রেখে চলেছে।

 জন্টি আপাততঃ খুব ভালো আছে।  আর ফিরছে না। একথা অনস্বীকার্য যে জন্টি বিদেয় হতে সবথেকে খুশি শ্যাডো। একলা রাজকুমার(ঈ)। মানসিক ভারমুক্ত সোনালী আজকাল আমায় বারবার বলে, “জন্টিকে নেননি, খুব ভালো করেছেন ম্যাডাম। নিলেও ছোট কুতুয়া নেবেন, কেমন? বড় কুতুয়ার পটি- ম্যাগো। ওয়াক থুঃ। ” শুনতে শুনতে ঘরের একজনের কথা মনে পড়ে যায়, সাধে কি বলে গরীবের কথা, বাসি হলে-

Sunday 2 August 2020

একরাশ যাচ্ছেতাই ইচ্ছেডানা-


এমনিতে যে নিজের আকৃতি বা প্রকৃতি নিয়ে অভাববোধ তো দূরের কথা, বরং আয়নার ওপারের  মেয়েটাকে নিয়ে বেশ গর্ববোধ করি। দেমাকী, মাটিতে পা পড়ে না ইত্যাদিও বলতে পারেন। তীব্র বিবাহপ্রীতি ছাড়াও, এই ব্যাপারটা “জব উই মেট”এর গীতের সঙ্গে আমার দারুণ মেলে, ঐ যে, কি বলে না, আমি হলাম, নিজের সবথেকে ফেভারিট-। 
এইটুকু তো জীবন, জগত বা তার অধিবাসীদের নিয়ে  মাথা ঘামাই কখন? দাড়িবুড়ো এক্কেবারে মনের কথাই বলে গেছেন, “আমার চোখে তো সকলই শোভন, সকলই নবীন, সকলই বিমল-”। পারিবারিক দিক থেকেও এ ব্যাপারে রীতিমত সৌভাগ্যশালিনী বলতে পারেন, অাশৈশব যখনই কেউ বর্ধিত ওজন নিয়ে সুচিন্তিত বিশেষজ্ঞ মতামত পেশ করেছে,সপাটে ব্যাট চালিয়ে স্টেডিয়ামের পার করে দিয়েছে বাবা। বাবার মতে, আমার দৈহিক ব্যাস, বাবার ব্যাঙ্কব্যালেন্সের পরিচায়ক। আরেঃ হোক না খণ্ডহর, তবুও তো কড়িবরগা ওয়ালা বাড়ির মেয়ে আমি, মানছি তালপুকুর, ঘটি ডোবে না, কিন্তু সুখের দিনে তো ডুবত রে ভাই। ঘটি-কলসী সবই ঢুবত। সেই বাড়ির মেয়েকে দেখে বোঝা যাবে না? অস্বীকার করব না, চাটুজ্জে থেকে ভট্টচায বাড়িতে এসেও, কখনও বদলায়নি ঘরোয়া পরিস্থিতি।

তবুও, যতই প্রিয়পুরুষদের ঢাল-তরোয়াল থাকুক, ফাঁকফোকর পেলেই হিতোপদেশ জুটেছে শুভাকাঙ্ক্ষীদের থেকে। যদি ফেটে যাই, আহাঃ ওণাদের চিন্তা কি কম? আর পাঁচটা স্থূলকায় ছেলে/মেয়ের মতই, সেই কোন শৈশব থেকেই তৈরী হয়েছে মানসিক দূরত্ব, গড়ে উঠেছে জন্মশত্রুতা ঘি-মাখন জাতীয় সুস্বাদু স্নেহপদার্থের সাথে। সবই যে ফ্যাটে লটপট, ঘোর নিষিদ্ধ। ঘুষের মাল,গোপন রোগ বা লুকানো প্রেমের মত গভীর আকর্ষণ থাকলেও,প্রকাশ্যে আস্বাদ নেওয়ার সৎসাহস মোটেই ছিল না।  শুধু দেখবি আর জ্বলবি টাইপ ব্যাপার আর কি। গরম ভাতে এক চামচ গাওয়া ঘি, বা টোস্টের ওপর পুরু নোনতা মাখনের প্রলেপ দিলেই, মনের মধ্যে যেন ঝপাঝপ সার্চ লাইটের মত জ্বলে উঠত জোড়া জোড়া চোখ। ঘুরিয়েফিরিয়ে একই কথা বলে যেত আমার মন, - “ না।  না এবং না। একদম না।”  অথবা “ “ফেটে যাব বোধহয়” অথবা “হার্টের ব্যামো হবে নির্ঘাত। অকালে টেঁসে যাই যদি, স্যালাড খাই বরং।” 
স্যালাড-ডায়েটিং এগুলো শুনতে বেশ সোজা-সরল, আদতে কিন্তু ব্যাপারগুলো ভয়ানক রকম জটিল। দুদিন-তিনদিন একসপ্তাহ চলেই যায়- শশা, টমেটো, পেঁয়াজের ভরসায়, তারপরই জিভে পড়তে থাকে চড়া। মুষড়ে পড়ে হৃদয়, সেই সমস্ত তুচ্ছাতিতুচ্ছ খাবারের জন্য, যা এই সমাজ ছাপ্পা মেরে নিষেধ করে ভারী চেহারার অধিকারীদের জন্য। সচেতন- অচেতন- অবচেতনে বড় বেশী বঞ্চিত বোধ হয় নিজেকে। ঈশ্, স্বাস্থ্য সম্পর্কে উদ্বিগ্ন না হয়েই যদি বিনা অপরাধবোধে খাওয়া যেত ঘি আর মাখন অথবা যা ভালোবাসি তাই। মাস দুয়েক আগেও, এটাই ছিল দিবাস্বপ্ন-

এই সময় কোন এক ওয়েলনেস গ্রুপে প্রথম ভার্চুয়াল পরিচয় ডঃ বার্গের সাথে। ডঃ এরিক বার্গ।  নামী ভিডিওব্লগার এবং পুষ্টিবিশেষজ্ঞ। ওণার বিভিন্ন ভিডিওতে পোস্ট করা মন্তব্যাবলী পড়লে ওণাকে মসীহা বলেও ভ্রম হতে পারে-
ডঃ বার্গ বললেন, কে বলেছে ফ্যাট বর্জনীয়। ফ্যাট শুধু রসনার পক্ষেই অমৃতসম নয়, আমাদের শরীরের জন্য অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পৌষ্টিক উপাদান। ফ্যাট খেলেই ক্লগড্ আর্টারিজ বা হৃদরোগ হবেই, এটা কিন্তু ঠিক নয়। বরং ফ্যাটে আছে জরুরী পোষণ। আরে মশাই, ফ্যাটই যদি না খান, তাহলে ফ্যাটে দ্রব ভিটামিন যেমন A,D,K কি করে আত্তিকরণ করবে আপনার দেহ? আর যতই ক্যালসিয়াম খান, ভিটামিন D যদি আপনার দেহে সংশ্লেষিত না হয়, তাহলে ঐ ক্যালসিয়ামকে কাজে লাগাবেন কি করে?
শুধু তাই না, আমাদের মস্তিষ্কেরও মূল উপাদান ফ্যাট। স্নায়ুতন্তুকে ঘিরে রয়েছে যে আস্তরণ, যার পোশাকী নাম মায়োলিন শিদ্ তারও মূল উপাদান ফ্যাট। ফার্টিলিটি, স্মরণশক্তি,কগনিটিভ সেন্স, স্ট্রেস  ইত্যাদি নিয়ন্ত্রণ করে যেসব গুরুত্বপূর্ণ হর্মোনসমূহ, তাদের অনেকগুলিই সংশ্লেষিত হয় ফ্যাটের উপস্থিতিতে। বাইরের আঘাত থেকে আপনাকে রক্ষা করার জন্য, ত্বকের নীচে যে কুশন তাও ফ্যাট দিয়েই তৈরী। ফ্যাট বাড়ায় অনাক্রম্যতা অর্থাৎ ইমিউনিটি।
আমাদের জন্য ফ্যাট এত জরুরী বলেই, শরীর যত্ন করে জমিয়ে রাখে ফ্যাট। তাই ফ্যাট কমানো ব্যাপারটা হল প্রকৃতিবিরদ্ধ, যাকে বলে, অ্যান্টি- সারভাইভাল। যত আপনি ফ্যাট কমাতে কমাবেন ক্যালোরি, যত কড়া হবে আপনার ডায়েটিং, ততোই আতঙ্কিত হয়ে উঠবে আপনার দেহ। আরও, আরও বেশী করে আঁকড়ে ধরবে শরীরের সমস্ত ফ্যাট। আপনি যেমন শুরু করবেন ডায়েটিং, শরীরও তেমনি পাল্লা দিয়ে কমাতে থাকবে বিপাক অর্থাৎ মেটাবলিজমের হার। যত কঠোর ডায়েট, ততোই কম মেটাবলিজম। যত  দীর্ঘ ডায়েট,ততোই ধীমে মেটাবলিজম। যা খাবেন সবটুকুই তখন সঞ্চয় করে রাখবে শরীর। উপরন্তু আরও বেশী খাবার জন্য তাড়না দিতে থাকবে আপনাকে। পরিণাম- বেড়ে যাবে খিদে আর লোভ। কষ্ট করতেই থাকবেন, কেষ্ট থাকবে অধরাই। আর কষ্ট করা ছেড়ে দিলেই, আবার দ্বিগুণ গতিতে যথা পূর্বম্। তাই আত্মবঞ্চনা ছাড়ুন। ক্যালরি মেপে খাবেন না। খান পেট ভরিয়ে, মন ভরিয়ে। যাতে প্রোটিন-ফ্যাট এবং কার্বোহাইড্রেট তিনটিই সুষম ভাবে প্রবেশ করতে পারে আপনার পাচনতন্ত্রে। শরীরের সাথে গড়ে তুলুন সৌহার্দ্য।
ডঃ বার্গের মতে, দেহে মেদ জমার জন্য মূল কালপ্রিট হল যে হর্মোন, তার নাম ইনস্যুলিন। দেহে ফ্যাট সঞ্চিত হয় ইনস্যুলিনের নির্দেশে, আবার ফ্যাট বার্নিংএও বাধা দেয় ইনস্যুলিন। মোদ্দা কথা ইনস্যুলিনের উপস্থিতিতে ফ্যাট কমানো, অলীক কল্পনা মাত্র।
যতবার খাবেন, রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করতে ততোবারই ক্ষরিত হবে ইনসুলিন। ঐযে দিনে ছবার/আটবার খাওয়া- ঐ গপ্প ভুলে যান। খাবেন, শুধু মাত্র খিদে পেলে তবেই।  ব্রেকফাস্ট-লাঞ্চ আর ডিনারে যদি সীমাবদ্ধ রাখতে পারেন ভোজনবিলাস,  আপনাকে ঠেকায় কে?
আর একটা কথা, কার্বোহাইড্রেট জাতীয় খাবার বাড়িয়ে দেয় ইনস্যুলিনের ক্ষরণ। তাই কার্বস কমিয়ে বাড়ান প্রোটিন আর ফ্যাট। ঘিটা খান, ভাতটা কমান। মাখন বা মেয়োনিজটা খান, পাউরুটিটা ছেড়েই দেখুন না। আর যাই খান, ফুল ফ্যাট ভার্সানটাই খান, ফ্যাট ফ্রি বা লোফ্যাট কিছু জিভে দেবেন না প্লিজ।

মাসখানেক ধরে ওণার কথা মত খাবারে ফিরিয়ে এনেছি ফ্যাট।  মাখন, ঘি, চীজ,মেয়োনিজ, ডিমের কুসুম সবই খাচ্ছি। আমি বিশেষজ্ঞ নই, শুধু মাত্র নিজের অভিজ্ঞতাটুকু ভাগ করে নিতে পারি মাত্র, কারণ পর্দার আড়ালে আমার মত দোদুল্যমানতার- দুষ্টচক্রের শিকার আরও অনেকেই। যাঁরা মনকে কোতল করে, সমাজের কথা শুনে হালদুরস্ত থাকার চেষ্টা করেন, আর আত্মবঞ্চনায় ভোগেন- তাঁদের বলি আমি ভালো আছি। ওজন কমেছে বলে দাবী করব না, তবে বাড়েনি। গা-হাতপায়ে লুকানো নানা ব্যথাবেদনারা গা ঢাকা দিয়েছে বেশ কিছুদিন হল। মাঝরাতে আর ডাক পাঠায় না রেফ্রিজারেটরে লুকানো চকলেট। মোটামুটি খুশিখুশিই থাকি, সদ্য করোনা থেকে উঠেছি, তবুও পরিশ্রম করতে ক্লান্তি লাগে না। মুখে ক্রীম/ময়েশ্চারাইজার না মাখলেও তেলতেল চকচকে থাকে মুখটা। হয়তো সবই মনের ভুল, তবে চোখে পড়ার মত উন্নতি হয়েছে হাতের নখগুলির, কিছুকাল আগেই এতই নরম হয়ে পড়েছিল, যে সামান্য চাপেই মুটমুটিয়ে ভেঙে যেত সবাই। বহুবার ক্যালসিয়ামের ওষুধ দিয়েছেন ডাক্তারবাবু, যতদিন খেয়েছি, ইতরবিশেষ উন্নতি হয়েছে হয়তো। তারপরই আবার ধরেছে ফাটল। আজকাল আর সেই সমস্যা নেই। কারণটা বুঝতে লাগল এতদিন।
এই আর কি, ভালো থাকুন। সুস্থ থাকুন। আনন্দে বাঁচুন।