Sunday, 26 March 2023

অনির ডাইরি ২৩ শে মার্চ, ২০২৩

 

#অনিরডাইরি 


জীবনে দুঃখের কি আর শেষ আছে বাপু। শুনতে আপনার দুঃখ বিলাস মনে হবে হয়তো, কিন্তু বিশ্বাস করুন, আমার সবথেকে বড় এবং চিরকালীন দুঃখ হল ভোরবেলা ঘুম থেকে ওঠা। রাতের বেলা যত তাড়াতাড়িই শুয়ে পড়ি না কেন, হতভাগা ঘুম কিছুতে আসতে চায় না। মাথার মধ্যে গজগজ করে, না জানি কত কিছুই। মস্তিষ্ককে বেশ দু চার ঘা বেত্রাঘাত পূর্বক, মাত্রাতিরিক্ত সাধ্য সাধনা করে ডেকে আনতে হয় নিদ্রাদেবীকে। রাত্রিবাস করার পর, তাঁরই এমন সোহাগ উথলে ওঠে অধমের প্রতি, যে তিনি আর আমার ঘাড় থেকে নামতেই চান না।


দুঃখ হয়, খুব দুঃখ হয়, জাস্ট কান্না পায় অফিস টাইমে অফিস বেরোতে। বিশেষতঃ যখন ভোরের রোদ ঝলমলে আকাশটা আচমকাই ভার করে ফেলে মুখ। কে জানে কার ওপর অভিমানে ছলছলিয়ে ওঠে তার আঁখি। চৈতালি বৃষ্টিতে যখন কাকস্নান করে, জানলার বাইরের ইউক্যালিপটাস আর আকাশমনি গাছ গুলো, ভিজে চুপচুপে হয়ে যায় ঝগড়ুটে ছাতারে আর মেহনতী কাঠঠোকরার পাল, তখন কেবলই মনে হয়, "এমন দিনে তারে বলা যায়"।  চন্দ্রবিন্দুর জুজু গানের সুরে বলতেই তো পারি,  "মার্জনা করবেন স্যার, আজ আর আসছি না।" 


বেইমান আকাশ, অভিমান ভুলে খিলখিলিয়ে ওঠে একটু পরেই, ঝলমলিয়ে ওঠেন সূর্যি দেব। পরমেশ্বরের কাছে ঝুড়ি ঝুড়ি অভিযোগ আর হ্যাংলার মত প্রার্থনা করতে করতে আপিস বেরোই আমি। হে ভগবান, আজ একটা ভালো বাস পাইয়ে দিও কিন্তু। বাসে উঠেই যেন একখান সিট পাই। দীর্ঘ দুই, পৌনে দুই ঘন্টার বাস যাত্রা দাঁড়িয়ে করতে আমি অসমর্থ। ‘সিট হয়ে যাবে, উঠে আসুন না’ মার্কা গুলগল্পে বিশ্বাস করতে আমি নারাজ। দূরপাল্লার বাসে, পরের স্টপে সিট হয়ে যাবে মানে খুব কম করেও পনেরো-বিশ মিনিটের গল্প। 


শুধু কি তাই, হে ভগবান ভাড়া যেন ঠিকঠাক নেয় প্রভু। দীঘা অভিমুখী বা ফিরতি পর্যটকদের ওপর নির্ভর করে প্রাত্যহিক ভাড়া। কলকাতার লোক নাই, তো ভাড়া পঞ্চাশ/ষাট। তিনটে সিট বুক করে, জড়াজড়ি করে অর্ধ শায়িত হয়ে মহানগর ফিরতি কপোতকপোতী দর্শনের মতলব হল আমাদের সিটও নেই আর আমাদের ভাড়াও বেড়ে একশ। দাঁড়ান আরো আছে, হে ভগবান তোমার পায়ে পড়ি আমাকে বাদশা, টনি কক্কর এণ্ড পার্টির হাত থেকে বাঁচিও। 


দূর পাল্লার এসি বাস হলে যেমন সিনেমা চলে, নন এসি বাস হলে তেমনি বাজে গান। যেমন তাদের সুর, তেমনি কথা। গতকালের গান গুলো এখনও আমার কানে ভাসছে- ‘শি ডোন্ট নো, শি ডোন্ট নো-’, ‘ইউ ডার্টি, ডার্টি গাল, তু প্যার করে ইয়া ধোঁকা’, ‘থ্রি সিক্সটি পে কমর ঘুমা-’ ইত্যাদি। শুধু গানে রক্ষে নেই, একদম সামনের ছোট টিভিতে কারা আবার নাচেও। চোখ জুড়ানো লোকেশনে, মূল্যবান ছেঁড়াখোঁড়া পোশাক, হাতে বিদেশী ইয়ের বোতল নিয়ে একদল নারীপুরুষের সে কি উদ্দাম নাচ। ভয়ে চশমা খুলে বসে থাকি আমি। হতে পারে ঐ নাচগানের সৌজন্যেই, ঘুম আসে না রাতে। 


কি ভাবলেন, দুঃখ বা প্রার্থনা শেষ? দাঁড়ান মশাই, আরো আছে। হে ভগবান, বাসটা যেন ঠিকঠাক যায় প্রভু। আপদ বাস একই সময় ছেড়ে কোনদিন পুচ্ছ তুলে দৌড়ে চলে আসে তো কোনদিন তার গেঁটে বাত হয়। হয় এসে দেখি, সবে জহর বাবুর সঙ্গে ঝগড়া লাগিয়েছে সুইপার মাসি। এক প্রস্থ ঝগড়ার পর, ডাস্টবিন খালি করবে মাসি, তারপর ঝাঁট পড়বে, তারপর মোছা। 'তুমি আজ এত সকালে কেন' বলে হুংকার ছাড়ে মাসি। নয় তো দেখি, সব কাজ সেরে, জহর বাবুর এন্ড পার্টির সঙ্গে বেশ খানিকক্ষণ খোশ গল্প করে, বস্তা বগলে বাড়ি ফিরছে মাসি। ফেরার পথে আমাকে আওয়াজ দিয়ে যায় " এই যে, তোমার আজ এত দেরি কেন?"


এর পরেও থাকে নানা খুচখাচ দুঃখ এবং আব্দার, যেমন হে ভগবান যাওয়া এবং আসাটা যেন নির্বিঘ্নে হয়। এ পথে, পথ দুর্ঘটনা আকছার ঘটে। পথ অবরোধও নৈমিত্তিক ঘটনা। অবরোধ হল তো হল, অন্যান্য সহযাত্রীদের তেমন  তাপোত্তাপ থাকে না দেখি। অনেকেই নেমে পড়েন বাস থেকে, ঘুরে বেড়ান এদিক ওদিক। তত্ত্বতালাশ করেন, অবরোধ কেন হল, অবরোধ করা কতটা ন্যায়সঙ্গত ইত্যাদি প্রভৃতি। এসি বাস হলে, বন্ধ করে দেয় বাতানুকূল যন্ত্র। ফাঁকা হয়ে যায় সমগ্র বাস। এক আমিই বসে থাকি বোকার মতন, আর ভাবতে থাকি, হে ভগবান আজ সকালে কার মুখ দেখেছিলাম প্রথমে। নির্ঘাত আমার নিজেরই হবে। 


খোঁজ নিতে থাকি, অবরোধ কেউ তুলছে কি? পুলিশ এল কি? মহকুমা শাসককে ফোনটা করেই ফেলব নাকি? পুলিশ অবশ্য আসে, অবরোধ উঠেও যায়, বাস ছেড়েও দেয়, তখনও ওঠে না কয়েকজন যাত্রী। ‘হ্যাঁগো, কই গো’ বলে ফোন করে তাদের পরিবার পরিজন। কণ্ডাক্টর আর ড্রাইভার মিলে চর্চা জোড়ে, নির্ঘাত চরতে গেছে, ব্যাটাকে ফেলেই চলে চল। হাউমাউ জোড়েন মহিলারা, ‘ বাস ছেড়ে দিবে? ছেড়ে দিবে মানে কি?বলতেছি তো, লোকটা পাইখানা গেছে। তা লোকের পাইখানা পাবেনি-’। যিনি অপকর্ম করতে গিয়েছিলেন, এমন ভাবে বেল্ট আটকাতে আটকাতে বাসে ওঠেন, যেন বাসটা ওণার শ্বশুরমশাই যৌতুক দিয়েছিলেন। বউ প্রশ্ন করে, ‘ঠিকঠাক ধুইছ?’ মাথা চুলকানোর অছিলায় কানে আঙুল দিই আমি, মনে মনে বলি,হে ভগবান, সকাল সকাল এত দুঃখ কেন দিচ্ছ প্রভু, তুলে নাও প্রভু। 


কেউ কাউকে তোলে না, বরং আরো জোরে, আরো রসালো সুরে জমে ওঠে দাম্পত্যালাপ, ‘তোমায় কখন থেকে বলতেছি, বাস দাঁড়াইছে,এই তালে হেগে আসো। তা নয়, বসে বসে পা💨ছ।' বাতানুকূল যন্ত্র বন্ধ করে দেবার সাথে সাথেই, এসি বাসগুলো কেন যে এমন পূতিগন্ধময় এবং জনশূণ্য হয়ে ওঠে বেশ অনুধাবন করতে পারি। অন্যান্য সহযাত্রীদের মত কেন যে বাস থেকে নেমে গেলাম না ভেবে মুচড়ে ওঠে হৃদয়। রাগ হয়, সাথে সাথে আসে দুঃখ, এখন আপনি এটাকে দুঃখু বিলাস ভাববেন না কি ভাববেন সেটা আপনার ব্যাপার। তবে বুঝলেন কি না,  বিগ বি ঠিকই বলে গেছেন," ইয়ে জিনা ভি কোই জিনা হ্যায় লাল্লু "।

No comments:

Post a Comment