Sunday 26 March 2023

অনির ডায়েরি ২৫শে মার্চ, ২০২৩

 

#অনিরডাইরি #কাঁথিরকিস্যা 


শনিবারের সন্ধ্যা, জোর করে পড়তে বসেছি তুত্তুরী আর আমি। কে যে কাকে পড়াচ্ছে, বোঝা দায় যদিও। শৌভিক এখনও বাড়ি ফেরেনি। তমলুকে মিটিং ছিল। মিটিং এর মাঝে, ঘন্টায় ঘন্টায় তো আর ফোন করে জ্বালাতে পারি না, তাই মহকুমা শাসকের ড্রাইভার নূপুর বাবুকে ফোন করেছিলাম, "স্যার বেরিয়েছেন" কি না জানতে। তিনিও ধরেননি, পরে জানতে পারলাম, ধরবেন কি করে, তিনি তো ফোনটা বাংলোতেই ফেলে গেছেন।


ব্যক্তিগত নিরাপত্তা রক্ষী ছেলেটির নম্বর নেব নেব করেও আর নেওয়া হয়নি। ফলে whatsapp ই ভরসা। অফিশিয়াল নম্বরে আবার, ' বেরিয়েছ ' বা ' ওগো ফেরার সময় এক কিলো চিনি আর আড়াইশো পেঁয়াজ এনো তো' মার্কা বার্তা পাঠালে,  খেপে ব্যোম হয়ে যায় শৌভিক। ব্যক্তিগত নম্বরে যে পাঠাব, সেটা আবার দিনে বার চারেকের বেশি দেখেন না তিনি। "বেরোলি? তুই এলে কফি খাবো " মেসেজটা বিগত দুই ঘন্টায় বার দুয়েক করে ফেলেছি। জবাব আসেনি। ভাবছি কি করব, ফোন করব কি না, এমন সময় বাংলোর নিরাপত্তা রক্ষী ভদ্রলোক এসে এক গাল হেসে, বার পাঁচেক মাথা চুলকে আর হাত কচলে বললেন, " ম্যাডাম এক ভদ্রলোক এসেছেন। বলছেন, উনি আগে এখানে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন। স্যারের সাথে কি দরকার-"। 


কেজো সুরে জানালাম, স্যার তো নেই। কখন ফিরবে জানিনা। উনি হাত কচলে বললেন, ' আজ্ঞে ম্যাডাম, বলছিলাম- উনি বললেন, উনি আপনার সঙ্গে দুই মিনিট কথা বলতে চান।' কি সাংঘাতিক!  এই শনিবার ভর সন্ধ্যায়, কোথাকার কে অজানা লোক, আমার সাথে কথা বলতে বাংলোয় চলে এসেছে? তমলুকে থাকতে এই এক জ্বালা ছিল, রাজ্যের লোক প্রথম প্রথম আমায় এসে ধরত, "আপনি একবার বললেই এসডিও সাহেব করে দিবেন/ ছেড়ে দিবেন।" কিছুতেই বোঝাতে পারতাম না যে, ওভাবে হয় না। সহবাস করলেও, পেশাগত ভাবে দুজন দুটো আলাদা জগতের বাসিন্দা।


আমার অফিসের ব্যাপারে যেমন আমি শৌভিককে নাক গলাতে দিই না। তেমনি ওর অফিসেরও কোন কিছু আমি জানতে চাই না। অফিসটাকে আমরা বাংলোর বাইরেই রাখতে সচ্ছন্দ বোধ করি। তাই বলে কি দপ্তরী কেচ্ছা করি না আমরা? কোন সমস্যা হলে, একে অপরের মতামত চাইনা আমরা?  অবশ্যই চাই। কিন্তু ওইটুকুই। বরের কাজে মাতব্বরি করা আমার দুচক্ষের বিষ। ফেসবুকে ডায়েরি লেখা ছাড়া, এমনকি অপরিচিত বা অর্ধপরিচিত লোকজনের কাছে নিজেদের পেশাগত পরিচয় দিতেও স্বচ্ছন্দ বোধ করি না আমি। আমি অনিন্দিতা আর ও শৌভিক এই পরিচয়টুকুই তো যথেষ্ট।


সন্দিগ্ধ স্বরে জানতে চাইলাম, 'আপনি ওনাকে চেনেন?' উনি দুদিকে ঘাড় নাড়লেন। সন্ধ্যেবেলা পাকশালা সামলায় যে ছেলেটি, সেও জানালো, চেনা তো দূর, নামই শোনেনি কোনদিন। তাহলে?  বললাম, বলুন স্যার এলে আসতে। না হলে সোমবার অফিস টাইমে স্যারের সাথে যোগাযোগ করতে।


ওরা দুজনে তাই বলতে গেল, আমি ফোন করলাম শৌভিককে। ঘড়িতে রাত পৌনে আটটা, এতক্ষণে যদি মিটিং নাও ভেঙ্গে থাকে একটা ফোনতো করা/ধরাই যায়। ফোন করতেই শৌভিক বললো, " এই বেরোলাম। ফোন করতেই যাচ্ছিলাম।"  জানালাম নূতন অতিথির কথা। ব্যাপারটা বেশ ভয়ের যাই বলেন, আমার বরটা তো বিশেষ সুবিধের নয়। বরং বেশ ট্যাড়া। এদিক ওদিক তাকায় না, সোজা ব্যাটে খেলে। শত্রুও বেশ কিছু বানিয়েছে। কারা যেন হুমকি-টুমকি ও দিয়েছে, কত বড় এসডিও হয়েছে দেখে নেবে। সে সব গল্প শৌভিক ফুৎকারে উড়িয়ে দিলেও, আমার অত দুঃসাহস নেই। 


ভেবেছিলাম উপহাস করবে বুঝি, শৌভিক হাসল না। ক্লান্ত স্বরে বলল, ' ভদ্রলোক বোধ হয় রিটায়ার্ড আইএএস অফিসার। হলদিয়ার এসডিও ছিলেন বোধহয়। আমার কাছেও এসেছিলেন। খুব গুছিয়ে কিছু বলতে পারছিলেন না, কথাবার্তা বেশ অসংলগ্ন মনে হয়েছিল স্বল্প পরিসরে। ভয় করলে দেখা করতে হবে না।' 


অবসরপ্রাপ্ত আমলা মানে তো, আমার শ্বশুরমশাইয়ের বর্তমান আর আমাদের ভবিষ্যৎ। কেমন লাগবে যদি ওনাকে এমনি করে বাংলোর বাইরে থেকে ভাগিয়ে দেয় বর্তমান কোন আমলার গৃহিনী। ফোনটা রেখে বাগানে বেরিয়ে দেখি গেটের কাছে কার সাথে যেন কথা বলছেন সিকিউরিটি। জিজ্ঞাসা করলাম ভদ্রলোক চলে গেছেন নাকি? জবাব দিলেন," না ম্যাডাম। স্যারের হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরটা চাইছেন।" দৌড়ে গেলাম গেটের কাছে,  এক বয়স্ক ভদ্রলোক দাঁড়িয়ে আছেন। পরনে ইস্ত্রি বিহীন ফুলহাতা শার্ট আর প্যান্ট। এক মাথা অবিন্যস্ত কাঁচা পাকা চুল। থতমত খাওয়া হাবভাব।


করজোড়ে নমস্কার জানিয়ে বললাম, " মার্জনা করবেন স্যার। আসলে আমি ঠিক আপনাকে চিনতে পারিনি। এসডিও সাহেব বললেন আপনি আগেও এসেছিলেন। ভিতরে আসুন প্লিজ।"


 উনি বললেন, ' আপনি আমার মেয়ের মতন। আমার মেয়েও আপনার বয়সীই হবে বুঝলেন। একটু নম্বরটা যদি-।' বললাম, নম্বর বলছি সেভ করে নিন। উনি নার্ভাস হয়ে সব পকেট হাতড়ে, মোবাইল ফোন খুঁজে না পেয়ে, বললেন, " আমি চোখে তেমন দেখতে পাই না বুঝলেন তো। একটু যদি কাগজে -'। 


ভিতরে এনে বসালাম, পাকশালার ছেলেটিকে বললাম, এক কাপ ভালো করে চা করে আনুন তো। সে উল্টে একটা মিষ্টির প্যাকেট এগিয়ে দিয়ে বললে, " স্যার এনেছেন।" কি দরকার ছিল বলতে গিয়েও গিলে ফেললাম। ওই প্রজন্মকে বোঝা আমাদের সাধ্যাতীত। ভদ্রলোক নার্ভাস ভাবে হেসে, হালকা জড়ানো স্বরে বললেন, " আমার সুগার আছে তো, তাই সুগার ফ্রী মিষ্টি এনেছি।"


ডায়েরির পাতা ছিড়ে বড় বড় করে মহকুমা শাসকের নম্বরটা লিখে দিলাম। উনি গুরুত্বহীন ভাবে, ভাঁজ করে, পকেটে পুরে গল্প করতে লাগলেন। বললেন ওনার বয়স ৭৯ বছর। উনি কাঁথির ভূমিপুত্র। সংস্কৃতের ছাত্র। সংস্কৃতে কাব্যতীর্থ। ওনার স্ত্রীও সংস্কৃতে এমএ এবং তিনিও কাব্যতীর্থ। স্ত্রী বিগত সাত বছর ধরে পক্ষাঘাতগ্রস্ত। বিছানাটাই তার ঘরবাড়ি। শোনালেন, " রান্নার লোক আছে। সে মাসে ১০ হাজার টাকা বেতন নেয়। স্ত্রীর দেখাশোনা করার জন্য, আয়া আছে। সে নেয় মাসে ১৫ হাজার। যে জামাকাপড় কাচে, সে নেয় ২০০০ টাকা। এছাড়াও  বাজার- মাছ যা লাগে, ফোন করে বললেই দিয়ে যায়।" বললেন, "চোখে তেমন দেখতে পাই না তো, তাই একটা টোটো রেখেছি। তাকে ফোন করে বললে, সেই এদিক ওদিক নিয়ে যায়।"


পক্ষাঘাতের অংশটুকু বাদ দিলে বাকি ওই বয়সী সব দম্পতিদের একই গল্প। জানতে চাইলাম সন্তানাদির কথা। বললেন একটি কন্যা সন্তান। তিনি কোন নামী স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা। জামাতাও পেশায় শিক্ষক। বললেন মেয়ে আগে ওঁদের সাথেই থাকত। বর্তমানে কর্মসূত্রে এই জেলারই অন্য শহরের বাসিন্দা।


এই জেলার জনৈক নামী নেতার নাম করে বললেন, ও আমার সম্বন্ধী। বুঝতে না পেরে প্রশ্ন করলাম, উনি আপনার শ্যালিকাকে বিবাহ করেছেন? ভদ্রলোক হেসে কইলেন, " নানা আমি ওর বোনকে বিয়ে করিছি।"বললেন, " জানেন ও  আমার সম্বন্ধী বলে, আমাকে হলদিয়া থেকে সরিয়ে দেয় তৎকালীন সরকার। অফিসে ভাঙচুরও করে অমুক-"। ভাঙচুর যিনি করেছিলেন, তিনি এককালে দুই মেদিনীপুরের ত্রাস ছিলেন। বর্তমানে অবশ্য সবটুকুই অতীত বা ভূত।


ভদ্রলোকের কথাবার্তা বেশ অসংলগ্ন। হুট করে কোথা থেকে কোথায় চলে যাচ্ছেন বোঝা দায়। এই আসানসোলে বিডিওগিরি করছেন, তো এই গেলেন ডায়মন্ড হারবারে। অনেক বড় বড় অফিসারের নাম করলেন, যাদের সঙ্গে উনি এককালে কাজ করেছেন। কাউকেই তেমন চিনতে পারলাম না, একজন ছাড়া। ভদ্রলোক এককালে লেবার কমিশনার ছিলেন। আমরা যখন চাকরিতে ঢুকি, উনি তখন আমাদের দপ্তরের মুখ্য সচীব। একজনকে অন্তত চিনতে পারার সাথে সাথেই, এনার মুখে জ্বলে উঠল হাজার ওয়াটের আলো।


বললেন আসানসোলে থাকতে থাকতেই দুষ্কৃতিদের ছোঁড়া বোমার স্প্লিন্টার লেগে ক্ষতিগ্রস্ত হয় চোখ।  "এখন তো আরোই কম দেখি, তোমাকে সরি আপনাকে যেমন একদম ঝাপসা দেখছি। শুধু অবয়বটাই যা, বুঝতে পারছি। অনেক ডাক্তার দেখিয়েছি জানো/জানেন, ঠিক হয়নি। উত্তরোত্তর বিগড়েছে।" 


কথা ঘোরাতে প্রশ্ন করলাম হলদিয়ার এসডিও থেকে কোথায় গেলেন? উত্তর দিলেন, " আর বলবেন না। সেই কুচবিহার এডিএম অর্ডার হল। আমি যাইনি। পরিবারকে ফেলে অতদূর যাবার মতন অবস্থা তখন ছিল না। তখন দিল কলকাতায়, কম্পালসারি ওয়েটিং এ। রাইটার্স বিল্ডিংয়ে এমন একটা ঘর দিল, যেখানে একটা পাখা পর্যন্ত ছিল না। এদিকে হাজিরা নিয়ে কি কড়াকড়ি। একটা মেস বাড়িতে থাকতাম আরো বেশ কয়েকজনের সঙ্গে। সে এক অভিজ্ঞতা- " 


মেস বাড়ির অভিজ্ঞতার মাঝখানে, ফোন করলো শৌভিক, জানতে চাইলো কি অবস্থা?  বললাম চায়ে পে চর্চা করছি আমরা। শৌভিক ভুল বুঝেছিল, উনি আইএএস ছিলেন না বটে, তবে উনি রাজ্য সিভিল সার্ভিসে আমার শ্বশুরমশাইয়ের ব্যাচমেট। ১৯৭৮ এর স্পেশাল ব্যাচ এতটাই বড় ছিল, যে আমার শ্বশুরমশাইয়ের নাম করতে গিয়েও আর করলাম না।  এই মুহূর্তে এনার স্মৃতিশক্তি বা মনোযোগ কোনটাই তেমন প্রবল নয়। দু একটি কথা বলতে গিয়ে দেখলাম, ইনি শোনার থেকে শোনানোতে বেশি উৎসাহী। এটাই হয়তো বয়স বাড়ার লক্ষণ। নিজের মধ্যেও এই লক্ষণের পূর্বাভাস পাই আজকাল। সাগ্রহে শুনতে লাগলাম ওনার গল্প।


রাইটার্স থেকে অবশ্য আবার এডিএম হয়ে ফেরত আসেন তমলুক। তখনও অবিভক্ত মেদিনীপুর। ২০০৪ সালে ভদ্রলোক অবসর নিতে নিতে, এসে পৌঁছায় শৌভিক। দেখলাম ভদ্রলোক যাকে না পেয়ে, তার সহধর্মিনীর সাথে দেখা করতে উদগ্রীব ছিলেন, গল্পের ঝোঁকে বিস্মিত হয়েছেন তার সাথে সাক্ষাতের কারণ। এমন কি শৌভিকের সঙ্গে বেশ কিছুক্ষণ গল্প করার পরেও, মনে পড়ল না। ভদ্রলোক এমন ভাবে মাথা চুলকাচ্ছিলেন, মায়া লাগছিল রীতিমত। শৌভিক বলল, " বাড়ি ফিরবেন তো? আমার গাড়িটা তো ফিরছেই, আপনাকে নামিয়ে দিয়ে যাবে।" 


ভদ্রলোক উঠে দাঁড়ালেন, একটা নোংরা রুমাল বার করে মুখটা মুছলেন, তারপর লাজুকভাবে এক গাল হেসে বললেন, " বাড়ি না ক্লাবে যাব। বাড়িতে বিড়ি সিগারেট ফুঁকতে দেয় না বউ। অশান্তি করে শুয়ে শুয়েই। তাই ক্লাবে যাই, বিড়ি না ফুঁকলে আবার পেট সাফ হয় না কিনা।" আসি, তাহলে,  বলে অনুমতি দিলেন ভদ্রলোক। আমরাও বললাম সাবধানে যাবেন। ভালো থাকবেন।  দুটো সিঁড়ি ভেঙে নামতেই যে হারে থরথর করে কাঁপছিলেন ভদ্রলোক, এ বুড়া কিভাবে যে রাতের বেলা একা বাড়ি ফিরবে কে জানে? ফোনটাও তো সঙ্গে করে আনেন নি। ওই ব্যাচের সিভিল সার্ভেন্টদের পেনশন কত, আমাদের থেকে ভালো কেউ জানে না। ভদ্রলোক আবার শ্বশুরমশাইয়ের বছর পাঁচেক আগেই অবসর নিয়েছিলেন। ফলে কি পান সহজেই অনুমেয়। পেনশনারদের তো আর ইনক্রিমেন্ট হয় না, DA টুকুই ভরসা। সে প্রসঙ্গে আর মুখ না খোলাই ভালো। ওষুধ,পথ্য, ডাক্তার, আয়া, বাজারদর কেউ তো আর বয়স দেখে রেয়াত করে না। ফলে কমাতেই হয় জীবনধারণের মান। 


সময় কাউকেই রেয়াত করে না, আজ আপনি যতই দোর্দণ্ডপ্রতাপ হোন না কেন, হাতে মুণ্ড কাটুন না কেন, কালকে আপনার গল্পটাও আর পাঁচজনের মতোই হবে। তাও যে কেন ভুলে যাই আমরা, মত্ত হয়ে পড়ি অর্থ, পদ আর শক্তির আস্ফালনে। ভুলে যাই, কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না শেষ কালে। শেষ অঙ্কে সবাই সমান।

অনির ডায়েরী ২৪ শে মার্চ ,২০২৩

 

#অনিরডাইরি #কাঁথিরকিস্যা 

"আমার নতুন PT ড্রেস লাগবে, বাবা," কোন একদিন বলেছিল তুত্তুরী। তখন সদ্য শেষ হয়েছে বার্ষিক পরীক্ষা, স্কুল বন্ধ। শৌভিক উড়িয়েই দিল দাবিটা, "আগে পাশ কর, নতুন ক্লাসে ওঠ, তবে না পিটি ড্রেস।"


মেনে নিল, বেশ কিছুদিন নির্বাক রইল তুত্তুরী। কাউকে আর কিছু বলল না, তারপর এল সেই দিন, পরীক্ষার ফলাফল ঘোষিত হলো এবং আমাদের যাবতীয় আশঙ্কা সমূলে বিনষ্ট করে দেখা গেল, সসম্মানেই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন শ্রীমতী তুত্তুরী।  অতঃপর তিনি পুনরায় দাবি তুললেন, " মা, এবার আমায় পিটি ড্রেস কিনে দাও।"


এবার আমার জবাব দেবার পালা। বললাম, " আগে স্কুল খুলুক গিয়ে দেখ কি বলে, তবে না-। গিয়ে হয়তো দেখলি, যে পিটি ড্রেস আবার বদলে গেছে। অথবা একদমই বদলায়নি, গত ক্লাসেরটাই আবার পরতে বলছে। তাই না, হতে পারে তো-"।


স্কুল খুলল কোন এক বৃহস্পতিবার এবং যেখানে বাঘের ভয়, সেখানেই ঘনিয়ে এলো সন্ধ্যা। নতুন রুটিন অনুযায়ী দেখা গেল, শুক্রবারই PT ক্লাশ পড়েছে। অফিস থেকে ফিরে দেখি মেয়ের মুখে জমেছে বাদল। ড্রেস ওই একই আছে এবং সবাই তা পরেছিল। "সবাই আমাকে দেখে হাসছিল। বলল তোর ড্রেস কই?  সবাই সালোয়ার পরে কি সুন্দর দৌড়াদৌড়ি করল, আর আমায় স্কার্ট পরে ওদের পিছন পিছন ছুটতে হলো"- স্ফুরিত অধরে, জানালেন শ্রীমতী তুত্তুরী।


তাজ্জব হয়ে জানতে চাইলাম, তা তুই খামোকা স্কার্ট পরলি কেন? আগের বছরের পিটি ড্রেস দুটো তো নতুনই আছে। যাঁরা জানেন না তাঁদের অবগতির জন্য বলি, বিগত বৎসরে দুবার স্কুল বদল হয়েছে শ্রীমতী তুত্তুরীর। একবার এপ্রিল মাসে মহানগর থেকে তাম্রলিপ্ত‌। আর একবার মধ্য নভেম্বরে তাম্রলিপ্ত থেকে কাঁথি। তাম্রলিপ্ত স্কুলেরটা পরতে বলছি না, কিন্তু এই স্কুলেরটা তো পরতেই পারতিস।


বাবাও সম্মতি দিল পাশ থেকে,'এক্কেবারে ভোম্বল।' শ্রীমতী তুত্তুরী চোখ বড় বড় করে বললেন, "এই না না। একদম নয়, হয় নতুন পিটি ড্রেস নয়তো নরমাল স্কুল ইউনিফর্ম, না হলে ঢুকতেই দেবে না-'।  অতঃপর বাবার কানে সুড়সুড়ি দিতে দিতে, গদগদ কণ্ঠে কইলেন, " বা-আ-বা-আ, PT ড্রেস কিনে দাও না, বাবা।" সুড়সুড়ির আমেজে চোখ বন্ধ করে, ইশারায় মাথাটা দেখিয়ে, ওখানে বিলি কাটতে বলে, বাবা বললেন, " হ্যাঁ, দেবো তো। মা কিনে দেবে।"


ছাই ফেলতে ভাঙ্গা কুলো আমি, সোমবার কাক ভোরে মেয়েকে স্কুলে ছাড়তে গিয়ে, স্কুলের উল্টোদিকের সদা হাস্যময়ী সেলাই মাসিকে বলে এলাম, " ও দিদি, মেয়ের পিটি ড্রেস লাগবে যে। আসছে শুক্রবারের মধ্যে দিতে পারবেন? না হলে আবার স্কুল কামাই করতে হবে মেয়েকে।"  মাসি এক গাল হেসে বাড়ি পাঠালেন।


প্রতিশ্রুতি মোতাবেক বুধবারের মধ্যেই নূপুর বাবু (মহকুমা শাসকের ড্রাইভার) গিয়ে নিয়ে এলেন নতুন জামা। বিলটা দেখেই বুঝলাম, যে কেন বাবা বলেছিল, ওটা মা দেবে। যাই হোক, ভাবলাম পকেটে আগুন লাগলো বটে, ঝামেলাটা অন্তত মিটলো। হরি হরি! বাড়ি ঢুকতেই লাফাতে লাফাতে এগিয়ে এলেন শ্রীমতী তুত্তুরী, " মা তোমার হলুদ ওড়না আছে?"


ঋণাত্মক জবাব পেয়ে ঘাবড়ে গেলেন তিনি। ভীত সন্ত্রস্ত স্বরে জানতে চাইলেন, "তাহলে  কি হবে মা? ওড়না ছাড়া তো ঢুকতে দেবে না। তুমি আমায় একটা হলুদ ওড়না কিনে দাও-"। ভাবলাম বলি, ওটা বাবা দেবে। বললাম না কারণ জানি, বিস্তর ফাইল চালাচালির পরেও ওটা আমারই ঘাড়ে চাপাবে শৌভিক। অতি কষ্টে ও ব্যাটাকে ওড়না এবং হলুদ রং যদিও বা বোঝাতে পারি, দোকানের  হাল হকিকৎ বোঝাতে আমার জান বেরিয়ে যাবে। 


সত্যি কথা বলতে কি, কোন দোকানে পাওয়া যায়, এই শহরে, তা তো আমি নিজেই জানিনা। ভাগ্যে বন্ধুদের থেকে দোকানের নামটা জেনে এসেছিল তুত্তুরী।  কাঁথি শহরের জমজমাট বাজারের মধ্যে,বেশ নামী এবং বড় দোকান। আসন্ন চৈত্র সেলের বিস্তর ভিড় আর টোটোওয়ালাদের সাথে রীতিমতো মল্লযুদ্ধ করে, বিগত বছরের PT ইউনিফর্ম (হাউস) রং মিলিয়ে যখন কিনে নিয়ে এলাম হলুদ ওড়না, আক্ষরিক অর্থেই শ্রীমতী তুত্তুরীর তখন খুশির সীমা নাই। কেবল বাবাকে বা মাসিকে দেখিয়ে স্বাদ মিটলো না, উল্লাসের চোটে হাওড়ায় ফোন করে দাদু দিদাকেও সবিস্তারে শোনালো সব গল্প।


আজ সকালেও প্রত্যক্ষ করলাম তার অপরিসীম আনন্দ। সময়ের বেশ খানিক আগে উঠে পড়ে,  তৈরি হয়ে নিয়েছেন একা একাই। সুপ্ত বাপকে ঠেলে তুলে আহ্লাদী হয়ে দেখালেন, "  বাবা, বাবা। দেখো বাবা আমায় নতুন PT ড্রেস।" বাপ মেয়েতে যখন এই নিয়ে খুনসুটি আর আহ্লাদ করছে, আমার মনে পড়ছিল প্রায় এক যুগ আগে, এক বৃদ্ধের উপদেশ-। 


তখন তুত্তুরী আড়াই বা তিন মাসের ছোট্ট বেবি। কন্যা সমেত আমি তখনও পিত্রালয়ে বসবাস করি। সপ্তাহান্তে শ্বশুরমশাই স্বয়ং এসেছেন পুত্রবধূ আর নাতনিকে বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে যাবার জন্য। শৌভিক তখন খড়গপুর ২ নম্বর ব্লকের বিডি ও। বাড়ি ফিরছে সেও। দীর্ঘদিন বাদে একত্রিত হতে চলেছে গোটা ভট্টাচার্য পরিবার। গিরিশ পার্ক ফ্লাইওভার তখনও কিছু গর্ত আর লোহার ছড়ের সমষ্টি। তাও প্রবল ট্রাফিক জ্যামে অচল গণেশ টকিজের মোড়। জানলা দিয়ে বাইরের বড় বড় বিজ্ঞাপনের হোর্ডিং দেখছিলাম আমি, দাদুর কোলে অকাতরে ঘুমাচ্ছে সেদিনের ছোট্ট তুত্তুরী ।বেবি পাউডারে প্রায় সাদা, কপালে কাজলের ধ্যাবড়া টিপ।


নিদ্রিত নাতনির পায়ের আঙুল টেনেটেনে খেলা করছিলেন শ্বশুরমশাই।আচমকা বললেন, " তোমায় একটা কথা বলব, দুঃখ পেয়ো না। এ যা চাইবে সঙ্গে সঙ্গে দেবে না।" অতঃপর একটু থেমে, একটু হেসে বললেন, "সামান্য হলেও অভাব বোধ থাকাটা বড্ড দরকার। না হলে ভালো মানুষ হওয়া যায় না।"


বৃদ্ধের নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে মানি আমরা।  মুখ খুলতেই কক্ষনো কিছু পেয়ে যায় না শ্রীমতী তুত্তুরী। মাসকাবার কাকে বলে তাও জানে এবং বোঝে তুত্তুরী। কোন জিনিস চেয়ে ফেলেও, দাম দেখে পিছিয়ে যায় তুত্তুরী। আশার বাইরে সামান্য কিছু পেয়ে গেলে এত্ত, এত্ত খুশি হয় তুত্তুরী। সময় বড় নির্দয়। বাবার শেখানো নেতির নেতিকরণ তত্ত্ব অনুসারে, আজ যা স্বাভাবিক, কাল তাই অস্বাভাবিক। আজ যা সাদা, কাল তাই ঘোর মসীবর্ণ। সময়ের অমোঘ নিয়মে বদলে যাবেন হয়তো ইনিও, না বদলে যাওয়াটাই অস্বাভাবিক। আজকের সবটুকুই থেকে যাবে স্মৃতিতে। তবুও এই সান্তনা টুকু তো থেকে যাবে, যে আমরা চেষ্টা করেছিলাম।

অনির ডাইরি ২৩ শে মার্চ, ২০২৩

 

#অনিরডাইরি 


জীবনে দুঃখের কি আর শেষ আছে বাপু। শুনতে আপনার দুঃখ বিলাস মনে হবে হয়তো, কিন্তু বিশ্বাস করুন, আমার সবথেকে বড় এবং চিরকালীন দুঃখ হল ভোরবেলা ঘুম থেকে ওঠা। রাতের বেলা যত তাড়াতাড়িই শুয়ে পড়ি না কেন, হতভাগা ঘুম কিছুতে আসতে চায় না। মাথার মধ্যে গজগজ করে, না জানি কত কিছুই। মস্তিষ্ককে বেশ দু চার ঘা বেত্রাঘাত পূর্বক, মাত্রাতিরিক্ত সাধ্য সাধনা করে ডেকে আনতে হয় নিদ্রাদেবীকে। রাত্রিবাস করার পর, তাঁরই এমন সোহাগ উথলে ওঠে অধমের প্রতি, যে তিনি আর আমার ঘাড় থেকে নামতেই চান না।


দুঃখ হয়, খুব দুঃখ হয়, জাস্ট কান্না পায় অফিস টাইমে অফিস বেরোতে। বিশেষতঃ যখন ভোরের রোদ ঝলমলে আকাশটা আচমকাই ভার করে ফেলে মুখ। কে জানে কার ওপর অভিমানে ছলছলিয়ে ওঠে তার আঁখি। চৈতালি বৃষ্টিতে যখন কাকস্নান করে, জানলার বাইরের ইউক্যালিপটাস আর আকাশমনি গাছ গুলো, ভিজে চুপচুপে হয়ে যায় ঝগড়ুটে ছাতারে আর মেহনতী কাঠঠোকরার পাল, তখন কেবলই মনে হয়, "এমন দিনে তারে বলা যায়"।  চন্দ্রবিন্দুর জুজু গানের সুরে বলতেই তো পারি,  "মার্জনা করবেন স্যার, আজ আর আসছি না।" 


বেইমান আকাশ, অভিমান ভুলে খিলখিলিয়ে ওঠে একটু পরেই, ঝলমলিয়ে ওঠেন সূর্যি দেব। পরমেশ্বরের কাছে ঝুড়ি ঝুড়ি অভিযোগ আর হ্যাংলার মত প্রার্থনা করতে করতে আপিস বেরোই আমি। হে ভগবান, আজ একটা ভালো বাস পাইয়ে দিও কিন্তু। বাসে উঠেই যেন একখান সিট পাই। দীর্ঘ দুই, পৌনে দুই ঘন্টার বাস যাত্রা দাঁড়িয়ে করতে আমি অসমর্থ। ‘সিট হয়ে যাবে, উঠে আসুন না’ মার্কা গুলগল্পে বিশ্বাস করতে আমি নারাজ। দূরপাল্লার বাসে, পরের স্টপে সিট হয়ে যাবে মানে খুব কম করেও পনেরো-বিশ মিনিটের গল্প। 


শুধু কি তাই, হে ভগবান ভাড়া যেন ঠিকঠাক নেয় প্রভু। দীঘা অভিমুখী বা ফিরতি পর্যটকদের ওপর নির্ভর করে প্রাত্যহিক ভাড়া। কলকাতার লোক নাই, তো ভাড়া পঞ্চাশ/ষাট। তিনটে সিট বুক করে, জড়াজড়ি করে অর্ধ শায়িত হয়ে মহানগর ফিরতি কপোতকপোতী দর্শনের মতলব হল আমাদের সিটও নেই আর আমাদের ভাড়াও বেড়ে একশ। দাঁড়ান আরো আছে, হে ভগবান তোমার পায়ে পড়ি আমাকে বাদশা, টনি কক্কর এণ্ড পার্টির হাত থেকে বাঁচিও। 


দূর পাল্লার এসি বাস হলে যেমন সিনেমা চলে, নন এসি বাস হলে তেমনি বাজে গান। যেমন তাদের সুর, তেমনি কথা। গতকালের গান গুলো এখনও আমার কানে ভাসছে- ‘শি ডোন্ট নো, শি ডোন্ট নো-’, ‘ইউ ডার্টি, ডার্টি গাল, তু প্যার করে ইয়া ধোঁকা’, ‘থ্রি সিক্সটি পে কমর ঘুমা-’ ইত্যাদি। শুধু গানে রক্ষে নেই, একদম সামনের ছোট টিভিতে কারা আবার নাচেও। চোখ জুড়ানো লোকেশনে, মূল্যবান ছেঁড়াখোঁড়া পোশাক, হাতে বিদেশী ইয়ের বোতল নিয়ে একদল নারীপুরুষের সে কি উদ্দাম নাচ। ভয়ে চশমা খুলে বসে থাকি আমি। হতে পারে ঐ নাচগানের সৌজন্যেই, ঘুম আসে না রাতে। 


কি ভাবলেন, দুঃখ বা প্রার্থনা শেষ? দাঁড়ান মশাই, আরো আছে। হে ভগবান, বাসটা যেন ঠিকঠাক যায় প্রভু। আপদ বাস একই সময় ছেড়ে কোনদিন পুচ্ছ তুলে দৌড়ে চলে আসে তো কোনদিন তার গেঁটে বাত হয়। হয় এসে দেখি, সবে জহর বাবুর সঙ্গে ঝগড়া লাগিয়েছে সুইপার মাসি। এক প্রস্থ ঝগড়ার পর, ডাস্টবিন খালি করবে মাসি, তারপর ঝাঁট পড়বে, তারপর মোছা। 'তুমি আজ এত সকালে কেন' বলে হুংকার ছাড়ে মাসি। নয় তো দেখি, সব কাজ সেরে, জহর বাবুর এন্ড পার্টির সঙ্গে বেশ খানিকক্ষণ খোশ গল্প করে, বস্তা বগলে বাড়ি ফিরছে মাসি। ফেরার পথে আমাকে আওয়াজ দিয়ে যায় " এই যে, তোমার আজ এত দেরি কেন?"


এর পরেও থাকে নানা খুচখাচ দুঃখ এবং আব্দার, যেমন হে ভগবান যাওয়া এবং আসাটা যেন নির্বিঘ্নে হয়। এ পথে, পথ দুর্ঘটনা আকছার ঘটে। পথ অবরোধও নৈমিত্তিক ঘটনা। অবরোধ হল তো হল, অন্যান্য সহযাত্রীদের তেমন  তাপোত্তাপ থাকে না দেখি। অনেকেই নেমে পড়েন বাস থেকে, ঘুরে বেড়ান এদিক ওদিক। তত্ত্বতালাশ করেন, অবরোধ কেন হল, অবরোধ করা কতটা ন্যায়সঙ্গত ইত্যাদি প্রভৃতি। এসি বাস হলে, বন্ধ করে দেয় বাতানুকূল যন্ত্র। ফাঁকা হয়ে যায় সমগ্র বাস। এক আমিই বসে থাকি বোকার মতন, আর ভাবতে থাকি, হে ভগবান আজ সকালে কার মুখ দেখেছিলাম প্রথমে। নির্ঘাত আমার নিজেরই হবে। 


খোঁজ নিতে থাকি, অবরোধ কেউ তুলছে কি? পুলিশ এল কি? মহকুমা শাসককে ফোনটা করেই ফেলব নাকি? পুলিশ অবশ্য আসে, অবরোধ উঠেও যায়, বাস ছেড়েও দেয়, তখনও ওঠে না কয়েকজন যাত্রী। ‘হ্যাঁগো, কই গো’ বলে ফোন করে তাদের পরিবার পরিজন। কণ্ডাক্টর আর ড্রাইভার মিলে চর্চা জোড়ে, নির্ঘাত চরতে গেছে, ব্যাটাকে ফেলেই চলে চল। হাউমাউ জোড়েন মহিলারা, ‘ বাস ছেড়ে দিবে? ছেড়ে দিবে মানে কি?বলতেছি তো, লোকটা পাইখানা গেছে। তা লোকের পাইখানা পাবেনি-’। যিনি অপকর্ম করতে গিয়েছিলেন, এমন ভাবে বেল্ট আটকাতে আটকাতে বাসে ওঠেন, যেন বাসটা ওণার শ্বশুরমশাই যৌতুক দিয়েছিলেন। বউ প্রশ্ন করে, ‘ঠিকঠাক ধুইছ?’ মাথা চুলকানোর অছিলায় কানে আঙুল দিই আমি, মনে মনে বলি,হে ভগবান, সকাল সকাল এত দুঃখ কেন দিচ্ছ প্রভু, তুলে নাও প্রভু। 


কেউ কাউকে তোলে না, বরং আরো জোরে, আরো রসালো সুরে জমে ওঠে দাম্পত্যালাপ, ‘তোমায় কখন থেকে বলতেছি, বাস দাঁড়াইছে,এই তালে হেগে আসো। তা নয়, বসে বসে পা💨ছ।' বাতানুকূল যন্ত্র বন্ধ করে দেবার সাথে সাথেই, এসি বাসগুলো কেন যে এমন পূতিগন্ধময় এবং জনশূণ্য হয়ে ওঠে বেশ অনুধাবন করতে পারি। অন্যান্য সহযাত্রীদের মত কেন যে বাস থেকে নেমে গেলাম না ভেবে মুচড়ে ওঠে হৃদয়। রাগ হয়, সাথে সাথে আসে দুঃখ, এখন আপনি এটাকে দুঃখু বিলাস ভাববেন না কি ভাববেন সেটা আপনার ব্যাপার। তবে বুঝলেন কি না,  বিগ বি ঠিকই বলে গেছেন," ইয়ে জিনা ভি কোই জিনা হ্যায় লাল্লু "।

অনির ডাইরি ১৮ই মার্চ, ২০২৩

 


#অনিরডাইরি #কাঁথিরকিস্যা 

"পাঁউসির কাছে একটা অনাথ আশ্রমে বসন্ত উৎসবের নিমন্ত্রণ আছে, যাবি?"কোন এক রবিবারে সকালে সাগ্রহে জানতে চাইল শৌভিক। দোল কেটেছে বেশ কয়েকদিন হল, জানলার বাইরে উদ্দাম উল্লাসে গান ধরেছে কোকিলের গুষ্টি। গরম কফির কাপটাকে দুই হাতে সোহাগী আলিঙ্গন পূর্বক, সেই কলতানই শুনছিলাম মন দিয়ে‌।

জবাব দিতে কিঞ্চিৎ বিলম্ব হওয়ায় আবার বলল শৌভিক,"যাবি? পাশেই একটা রিজর্ট আছে 'মনচাষা' বলে, ওটাও ঘুরে নেব আর ফেরার পথে তোদের মন্দারমনি থেকেও ঘুরিয়ে আনব। লাল কাঁকড়া বিচ, যাবি?" 


কয়েক বছর আগে হলেও, সপ্তাহান্তের ছুটির দিনে কোথাও যেতে বললে বিকট মুখব্যাদান করতাম আমি। ছুটির দুপুরে ফুল স্পিডে পাখা চালিয়ে, আপাদমস্তক চাদর মুড়ি দিয়ে ঘুমানো ছিল আমার কাছে স্বর্গসুখ। সাধের দিবানিদ্রা ফেলে কোথাও নড়তে রাজি হতাম না তেমন। ইদানিং বয়স বেড়েছে, প্রতিটা মুহূর্তে অনুভব করি, হাতে কমে আসছে সময়। ব্যস্ততাটাকেও ততো খারাপ  লাগেনা আজকাল আর। 


জলখাবার খেয়ে, আমরা যখন রওনা দিলাম মধ্য গগনে উঠবার তোরজোড় সম্পন্ন করে ফেলেছেন সূর্যদেব। কাঁথি থেকে খুব একটা দূরে নয়, কুড়ি-একুশ কিলোমিটারের মতো হবে। মহকুমা শাসকের ড্রাইভার নূপুর বাবু স্টিয়ারিং ধরলে তো, মিনিট কুড়ি -পঁচিশেই পৌঁছে যাব আমরা। গল্প শোনাতে শোনাতে নিয়ে গেলেন নূপুর বাবু, আগেকার স্যার ম্যাডামরা নাকি প্রায়ই যেতেন, এই আশ্রমে। দূর দূর থেকে বহু লোক আজও আসেন এই আশ্রমটি দেখতে। বেশ অনেকবার বললেন, "খুব ভালো লাগবে ম্যাডাম।"


বাংলায় "অন্ত্যোদয় অনাথ আশ্রম" লেখা বোর্ড টাঙ্গানো গেটের ভেতর দিয়ে যখন ঢুকলাম, একনজরে বুঝতে পারলাম না, এটা অনাথ আশ্রম না কোন রিজর্ট! সর্বত্র পরিচ্ছন্নতা আর যত্নের ছাপ, থোকায় থোকায় ফুটে আছে কেয়ারি করা মরশুমি ফুলের দল। একটা শেডের তলায় দাঁড় করানো আছে, অনেকগুলি ছোট বড় গাড়ি। নূপুর বাবু বললেন, "ওই দেখুন কত মানুষ এসেছে। এনারা প্রচুর অনুদান পান স্যার।"


হলুদ গোল গলা গেঞ্জি আর সাদা সুতির পাজামা পরিহিত এক ভদ্রলোক দৌড়ে এলেন। এক মাথা অবিন্যস্ত কাঁচা পাকা চুল, খালি পা, মুখে এক গাল হাসি। করজোড়ে শৌভিককে অভ্যর্থনা জানিয়ে, সাদরে নিয়ে গেলেন আশ্রমের ভিতরে। বিশাল এলাকা জুড়ে আশ্রম। বেশ অনেকটা রাস্তা হাঁটলাম আমরা। একদিকে মস্তপুকুর আর অন্যদিকে বড় বড় বিল্ডিং আর বাগান।


খোলা মাঠে ত্রিপল টাঙিয়ে বানানো হয়েছে ছাউনি। ছাউনির নিচে সারি সারি চেয়ারপাতা। সামনে সিমেন্টের তৈরি পাকা মঞ্চ। সেখানে নাচছে অধিবাসী মেয়েরা। এগোতে এগোতে দাঁড়িয়ে পড়ে শৌভিক দেখালো, আকাশে ড্রোন উড়িয়ে ছবি এবং ভিডিও তোলা হচ্ছে। মঞ্চের পিছনে লাগানো আছে মস্ত এলইডি স্ক্রিন। পর্দায় ফুটে উঠছে ছবি এবং ভিডিও। সবকিছুই বেশ হাইটেক এখানে। কোথাও তাচ্ছিল্য বা অবহেলা বা দীনতার কোন ছাপ নেই। 

একদম সামনের তিনটি চেয়ার বরাদ্দ হল আমাদের জন্য। অধিবাসী এক শিশু কোথা থেকে এক চুবড়ি পাঁপড় ভাজা নিয়ে এসে হাজির হল। উপস্থিত অভ্যাগতদের চা আর পাঁপড় ভাজা দিয়েই খাতির করা হচ্ছে এখানে। কুলোয় করে তিন রঙা আবির নিয়ে এসে হাজির হলো তিন সুসজ্জিতা আশ্রম বালিকা। মোদের তিনজনের গালে লাগল নতুন করে আবিরের ছোঁয়া। বাঁদিকের লম্বা মাটির দাওয়ায় পেতে রাখা কাঠের টেবিল এবং বেঞ্চে বসে বসে পা দোলাচ্ছে কয়েকটি বালিকা। প্রত্যেকেই বেশ সুন্দর সাজুগুজু করেছে, বুঝতে পারলাম এদের অনুষ্ঠান এখনও বাকি।


যে প্রৌঢ় ভদ্রলোক আমাদের অভ্যর্থনা জানিয়ে নিয়ে এসেছেন, দেখলাম তিনি মঞ্চে উঠে গিয়ে সঞ্চালিকার কানে কানে কিছু বলে এলেন। অতঃপর সঞ্চালিকার সুললিত আহ্বানে মঞ্চে উঠতে হলো তিনজনাকে। সদ্য বাবার পুরাণ ক্যামেরাটার দখল পেয়েছে তুত্তুরী, গলা থেকে ক্যামেরা নামাচ্ছে না মোটে। গলায় ক্যামেরা ঝুলিয়ে এসেছে এখানেও, তুলছিলও কিছু ছবি, আচমকা মঞ্চে ডাক পেয়ে, অত্যন্ত অপ্রস্তুত হয়ে, ভোম্বলের মতোই স্টেজে উঠল। গৌরবার্থে বহুবচনের মতই মহকুমা শাসকের সাথে সাথে বরণ করে নেওয়া হলো আমাদেরও। মনোজ্ঞ অথচ সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখতে হলো শৌভিককে। তারপর আমরা আবার নেমে গিয়ে দর্শকের আসন গ্রহণ করলাম।


খালি গলায় অসম্ভব সুন্দর গান শোনালো এক আশ্রম বালিকা। তারপর আবার নাচের পালা, নাচ সাঙ্গ হলে আবার গান। দাড়ি বুড়ো যে কতগুলো বসন্তের গান লিখে গেছেন তার ইয়ত্তা নেই। আজও যেকোনো বসন্ত উৎসবের প্রাণপুরুষ কেবল তিনিই। সঞ্চালিকা ঘোষণা করলেন এবার দশ মিনিটের নৃত্যনাট্যের পালা।  ফিসফিস করে বলল শৌভিক, "বোর লাগলে উঠে পড়তে পারি। দীঘাও যাওয়া যায়।"  যায় তো বটে, কিন্তু একটুও বোর হচ্ছি না যে। কি ভালো গান গাইছে, কি সুন্দর নাচছে ছেলেমেয়েগুলো। কি উৎসাহ সবকটার। কি মিষ্টি লাগছে বাচ্ছাগুলোকে। ফিসফিস করে জানতে চাইলাম, " এত সুন্দর বাচ্ছাগুলোকে, কে অনাথ আশ্রমে রেখে গেল গো।"


নৃত্যনাট্য শেষে, অনুষ্ঠানে সাময়িক বিরতি ঘোষণা করে, সঞ্চালিকা যিনি আবার কর্মসূত্রে পাঁশকুড়া পুরসভার কর্মীও, মঞ্চে ডেকে নিলেন এই অনাথ আশ্রমের প্রধান কর্ণধার তথা প্রাণপুরুষ শ্রী বলরাম করণকে। হলুদ গোল গলা গেঞ্জি আর সাদা পাজামা পরিহিত যে প্রৌঢ় ভদ্রলোক আমাদের অভ্যর্থনা জানিয়ে এনেছিলেন, বুঝলাম উনিই হলেন বলরাম বাবু।


করজোড়ে সকলকে নমস্কার জানিয়ে তিনি শুরু করলেন অন্ত্যোদয় অনাথ আশ্রমের গল্প। স্ত্রী আর তিন মেয়ে ময়না-চায়না আর মণিকে সঙ্গী করে একার চেষ্টায় এই আশ্রমটি গড়ে তোলেন নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি। তখন আবাসিকের সংখ্যা ছিল হাতে গোনা। সামর্থ ছিল নগন্য। একটি মাত্র ঘর সম্বল। মেদিনীপুরের ভূমিপুত্র কিনা, তাই জেদ অদম্য। পিছু হটেননি বলরাম বাবু। গ্রামের বাড়ি বাড়ি গিয়ে, দিয়ে এসেছেন একটি করে মাটির হাঁড়ি। ওণার ভাষায়, মা লক্ষীরভান্ডার। আর অনুরোধ করেছেন বাড়ির মা বউদের, " মাগো, তোমরা যখন তোমাদের ছেলেমেয়ের জন্য ভাত বসাবে, তখন আমার অনাথ শিশু গুলোর কথাও একটু ভেবো। একমুঠো চাল ওদের জন্য ফেলে দিও এই হাঁড়িতে। মাসের শেষে এসে, সেই হাঁড়ির চাল নিয়ে যাব আমি। তাই দিয়েই ভরবে আমার বাচ্ছাগুলোর পেট।" 


এই ভাবেই লড়েছেন কিন্তু পিছু হটেননি। বন্ধ হয়নি আশ্রম। আনন্দবাজার পত্রিকার স্থানীয় প্রতিবেদক শ্রী সুব্রত গুহ, যখন জানতে পারেন বলরামবাবু আর ওনার এই লক্ষ্মীর ভান্ডারের গল্প, তখন উনি এই নিয়ে একটি লম্বা প্রতিবেদন লেখেন। আনন্দবাজার পত্রিকার প্রথম পাতায়, ২০০৪ সালে আট কলম জুড়ে ছাপা হয় সেই প্রতিবেদন। তারপরে আর পিছু ফিরে তাকাতে হয়নি বলরাম বাবুকে। বর্তমানে এই আশ্রমে ৫০ জন বালক এবং ৫০ জন বালিকা থাকে। পাশেই আর একটি আশ্রম গড়ে তুলেছেন বলরাম বাবু। যেখানেই থাকেন আরো ৬৫ জন মেয়ে ও শিশু।


বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত, সাংবাদিক সুব্রত বাবু স্বয়ং উপস্থিত ছিলেন এই অনুষ্ঠানে। তাঁকে মঞ্চে ডেকে নিলেন বলরাম বাবু। ডেকে নিলেন উপস্থিত অন্যান্য মান্যগণ্য ব্যক্তিদের। দীর্ঘদিন এই আশ্রমের সঙ্গে যুক্ত এঁরা সকলেই। শুধু যে নগদ অর্থে সাহায্য করেছেন বা করে চলেছেন তাই নয়, এমনও মানুষ আছেন যিনি ছেড়ে দিয়েছেন কলকাতায় তাঁর ব্যক্তিগত দোতলা বাড়ি। সেখানে খোলা হয়েছে আশ্রমের একটি টেম্পোরারি অফিস। আশ্রমের কোন শিশু অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে ওখানে রেখে ডাক্তার দেখানো হয়। যে সমস্ত আবাসিক বালক বা  বালিকা প্রাপ্তবয়স্ক হয়ে গেছে, তারা ওখানে থেকেই পড়াশোনা করে। যেমন বর্তমানে নার্সিং পড়ছে বেশ কয়েকজন মেয়ে।


গল্প শোনাচ্ছিলেন জনৈক দম্পতি, এই আশ্রমের সঙ্গে ওনাদের ১৯ বছরের সম্পর্ক। ভদ্রমহিলা বলছিলেন," প্রথম যখন আসি সেটা ২০০৪ সাল। খবরের কাগজ পড়ে বলরামের সাথে ফোনে যোগাযোগ করি। সেটা মোবাইলের যুগ নয়। আমি শুধু বলেছিলাম, আমরা পাঁশকুড়া স্টেশনে দাঁড়াবো, আর আমি লাল পাড় সাদা শাড়ি পরে থাকবো।" আজও তাই পরে আছেন ভদ্রমহিলা। ওণার স্বামী একটু আগে বলছিলেন, তাঁর বয়স ৮০। বর্তমানে বিদেশে বসবাস করেন। কখনও সিঙ্গাপুর, তো কখনো আমেরিকা। দুই পুত্রই বিদেশে সুপ্রতিষ্ঠিত। জ্যেষ্ঠ পুত্র গুগলে মস্ত অফিসার। অনুষ্ঠান শেষে শৌভিককে গল্প শোনাচ্ছিলেন, Google Pay তে যত ট্রানজাকশন হয়, তার জন্য উনি রয়ালটি পান। কারণ ওটা ওনার জ্যেষ্ঠ পুত্রেরই ডিজাইন। 


বলছিলেন ১৯ বছর ধরে এই আশ্রমের সঙ্গে জড়িত, মায়া পড়ে গেছে এই আশ্রম আর এর প্রতিটি আবাসিকের ওপর। যেখানেই থাকুন প্রতিবছর এই অনুষ্ঠানে ছুটে আসেন। দুঃখ করছিলেন, "আর কতদিন আসতে পারব জানিনা। বয়স ৮০ হল, তবে এটুকু আশ্বাস নিয়ে যেতে পারব পরপারে, যে আমার পরেও আমার ছেলেরা পাশে থাকবে, এই বাচ্ছা গুলোর।"


বেশ অনেকক্ষণ বসলাম আমরা, আরো কিছুক্ষণ বসতে পারলে ভালো হতো কিন্তু বলরাম বাবু ধরে নিয়ে গেলেন আশ্রম দেখতে, বিশাল এলাকা জুড়ে আশ্রম। অনাথ আশ্রম চালানো ছাড়াও আরো অনেক কিছু করেন ওনারা। গণবিবাহ দেন, বিনামূল্যে ছানি অপারেশন শিবির করেন ইত্যাদি প্রভৃতি। সবশেষে ধরে নিয়ে গেলেন পাশের আশ্রমে, এটি একটি বিশেষ আশ্রম এখানে থাকে বিশেষ ধরনের শিশু যারা যৌন নির্যাতনের শিকার বা যারা ১৮ বছরের কম বয়সে পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করেছে। বিনা অনুমতিতে এই আশ্রমে প্রবেশ করা নিষিদ্ধ চতুর্দিকে নিরাপত্তার কড়াকড়ি, সিসিটিভি ক্যামেরার ছড়াছড়ি।  শৌভিক সাবধান করে দিল তুত্তুরীকে, "গলা থেকে ক্যামেরা খুলে,গাড়িতে রেখে যা। এখানে কোনরকম ছবি তোলা যাবে না।"


তালা লাগানো মস্ত লোহার গেটের ভিতরে চকচকে নিকানো উঠোন, উঠোনে তুলসী মঞ্চ। উঠোনকে ঘিরে দুদিকে দুটো দোতলা বাড়ি। যার একতলায় রয়েছে অফিস। অফিসে টাঙানো রয়েছে আশ্রমিকদের খাদ্য তালিকা, কখন কি ক্লাস আছে, কে পড়াতে আসবেন ইত্যাদি। দেখলাম লেখাপড়া ছাড়াও নাচ,গান,সেলাই, পাটের কাজ এবং অন্যান্য হাতের কাজ শেখানো হয়। কে, কখন এইসব স্পেশাল ক্লাস নিতে আসবেন, ঝোলানো আছে তারও তালিকা। 


বেরিয়ে আসছি, দোনা মোনা করে একটা প্রশ্ন করেই ফেললাম, বাচ্ছাগুলো এই ট্রমা কাটায় কি করে? বিশেষ আশ্রমের দেখাশোনা করেন যে ম্যাডাম, উনি বললেন কাউন্সিলর আসেন। কাউন্সেলিং হয় নিয়মিত। জানতে চাইলাম, ভোলা যায়? কেউ ভোলে? উনি হাসলেন কেবল। প্রশ্নটাই বড় বোকাবোকা যে। কিছু প্রশ্নের উত্তর না জানাই বোধহয় ভালো। মিশুক না বাস্তবে কিছুটা কল্পনার রং। যেখানে ভালো থাকবে প্রতিটা শিশু, যেখানে মুছে যাবে সমস্ত কুৎসিত দাগ।


ছবি সৌজন্য - শ্রীমতী তুত্তুরী

অনির ডায়েরি ১৫ ই মার্চ, ২০২৩

 

#অনিরডাইরি #তাম্রলিপ্তকড়চা 


মোবাইলের ঘড়ি বলছে সোয়া আটটা বাজতে এখনো বাকি কয়েকটা মিনিট, গাড়িতে উঠে বসলাম। আমি না বেরোলে কেউ যে আসর ছেড়ে নড়বেনা, বেশ বুঝতে পারছি। আজ আমাদের চণ্ডীপুরের ইন্সপেক্টর সাহেবের বৌভাত। শান্তনু, সন্দীপ আর মনীষ আমার তিন নবীন ইন্সপেক্টর। ব্যাটাদের চাকরি জীবনের বছর ঘুরে গেছে,অথচ এখনও ঘোঁছেনি "বেবি ইন্সপেক্টরের" তকমা। 

এহেন আমার তিন "বেবি"র মধ্যে শান্তনুরই প্রথম আইবুড়ো নাম ঘুঁচলো। বিয়ের কথাবার্তা শুরু হওয়া ইস্তক, যেভাবে সকলে শান্তনুর পিছনে লেগেছিল, আমার বদ্ধমূল ধারণা ছিল এমন উৎতপেতে লোকজনকে জীবনের শুভতম দিবসে মোটেই নিমন্ত্রণ জানাবে না শান্তনু। সকল দুশ্চিন্তার অবসান ঘটিয়ে, শেষ পর্যন্ত অবশ্য নিমন্ত্রণ জানিয়েছিল শান্তনু এবং তাও চূড়ান্ত সরলতা, এক রাশ উষ্ণতা এবং আন্তরিকতার সঙ্গে।


নিমন্ত্রিত হলে নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে হবে এটাই আমার বাবার শিক্ষা। অতিমারি এসে সব চেনা ছক উল্টেপাল্টে দিল তাই, নতুবা কেউ আমার বাবাকে নিমন্ত্রণ করবে আর বাবা যাবে না, এমন ঘটনা আক্ষরিক অর্থেই কোটিকে গুটিক। উপরোধে ঢেঁকি গিলে, এমন কত যে নিমন্ত্রণ বাবা রক্ষা করেছে, যেখানে না গেলেই বোধহয় ভালো হতো। যেখানে কেউ বলেনি,'আসুন', কেউ বলেনি,'খেতে চলুন' বা 'ভালো করে খাবেন।' নীরব অবজ্ঞা উপলব্ধি করে, নীরবেই উপহার প্রদান পূর্বক অভুক্ত অবস্থায় গৃহে প্রত্যাবর্তন করেছে বাবা, কিন্তু গেছে।


শুধু যে নিজে গেছে তাই নয় যেতে বাধ্য করেছে মাকে এবং আমাকে। তাচ্ছিল্যে, অবজ্ঞায়, অভদ্রতায় জ্বলে গেছে গা, ভরে উঠেছে চোখ, তাও হাসির মুখোশ পরে দাঁড়াতে হয়েছে সর্বজন সমক্ষে। বৃদ্ধের আমি এতটাই অনুরাগিনী, যে কখনই বৃদ্ধের বিরুদ্ধাচরণ করার ইচ্ছা বা সাহস হয়নি। আজও হয় না। অবশ্য আমার স্ট্রাইক রেট বাবার মত অত নিখুঁত ও নয়। স্বভাবতঃ কুঁড়ে হওয়ায়, না যেতে পারা নিমন্ত্রণ বাড়ির সংখ্যাও আমার খুব কম কিছু নয়।


আজও কোন বিয়ে বাড়ির ছবি লাগালে, ঠোঁট ফোলায় রমেশ, দুঃখ পায় প্রিয়াঙ্কা। চুঁচুড়া ছেড়ে আসার সময় কথা দিয়ে এসেছিলাম যে, পৃথিবী উল্টে গেলেও ওদের বিয়েতে আমি আসবোই। কথা দিয়েছিলাম তমলুক ব্লকের এসএলও জয়ন্ত বাবুকেও, অবশ্যই হাজির হব ওনার কন্যার শুভবিবাহে। দুখানা কার্ড দিয়ে নিমন্ত্রণ করেছিলেন জয়ন্ত বাবু, একটা শুধু আমাকে সপরিবারে আর একটা দিয়ে পুরো অফিসকে। 


দিনটা সম্ভবত ছিল রবিবার। প্রস্তুত ছিলাম আমি আর তুত্তুরী। কার্যক্ষেত্রে দেখা গেল কেবল আমরা ছাড়া, অন্য সকলেরই সেদিন অন্য কোন না কোন নিমন্ত্রণ বা ব্যস্ততা আছে। সদ্য বদলি হয়ে এসেছি তাম্রলিপ্ত নগরী, এমতবস্থায় একাকী, অচেনা পরিবেশে, নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে যাবার মতন সৎ সাহস সেদিন জোটাতে পারিনি। বাতিল করতে বাধ্য হয়েছিলাম পরিকল্পনা। সবথেকে খারাপ লেগেছিল, যখন কন্যার বিবাহের শত ব্যস্ততার মধ্যেও ফোন করেছিলেন জয়ন্ত বাবু, "ম্যাডাম আসছেন তো? ম্যাডাম কত দূরে আছেন?"  ঠিক যেমন ফোন করেছিল চুঁচুড়া থেকে রমেশ।


পরের দিন আপিসে এসে খুব বকেছিলাম সবকটাকে। কিসের এত গেঁতোমি তোমাদের বাপু? মানছি দূরের লোকেরা ছুটির দিন পরিবার ফেলে আসতে বিপন্ন বোধ করে, কাছাকাছি যারা থাকো তারা গেলে না কেন? সবাই চুপ, শেষে চঞ্চল বলল,' আসলে ম্যাডাম‌ কুন্তল স্যার সবাইকে গাড়ি করে নিয়ে যেত তো-'। কুন্তল আমার পূর্বসূরী এবং ব্যাচমেট এবং সুহৃদ। আজও এদের নয়নমণি। কুন্তলের সাথে নিমন্ত্রণ বাড়ি না যাবার কি সম্পর্ক বুঝলাম না। চঞ্চল বলল,' তার আগে তো, সাহেব ম্যাডামরা সবাই গাড়ি করে চলে যেতেন। স্টাফেরা যে যার মত বাসে করে যেত। একবারই গাড়ি দিয়েছিলেন অমুক আধিকারিক, সবাই খুব আনন্দ করে গিয়েছিল সেবার খেতে, ওমা হঠাৎ তাঁর মনে হল, যে তিনি হলদিয়া যাবেন। ভয়ের চোটে উত্তম তো না খেয়েই উঠে পড়ল।'


কবেকার কথা, তাও উত্তমকে বললাম, 'খেয়ে উঠবে তো? না খেয়ে হলদিয়া নিয়ে যেতে বলেনি তো কেউ।' উত্তম কপালে হাত ঠেকিয়ে বলল, ' আপনি জানেননি, উনি পাঁচবার খাবার জায়গায় চলে গেছেন আমায় ডাকতে, শেষে পাতে জল ঢেলে উঠে পড়লুম। যা ভয় পেতুম ম্যাডাম ওনাকে, ওনার ভয়ে বাথরুম পর্যন্ত যেতুমনি, চেপে বসে থাকতুম গাড়িতে। একবার বাথরুম গেছি চাবিটা গাড়িতে লাগানো ছিল, মোবাইলটাও গাড়িতেই রাখা ছিল। দু মিনিট পর ফিরে এসে দেখি, গাড়ি নাই। আমার তো মাথায় হাত, আশেপাশের অন্য সরকারি গাড়ির ড্রাইভাররা বলল, 'তোর বস্, তোর গাড়ি লিয়ে চলে গেছে।' ফোনটাও গাড়িতে রয়ে গেছে, ফোন করতেও পারতেছি নে। পকেটে যা পয়সা ছিল তাই দিয়ে বাসে করে অফিসে এসে দেখি, তিনি তুলকালাম বাঁধিয়েছেন। অমিয় দাকে (গাড়ির মালিক) বলতেছেন, 'হয় উত্তম থাকবে, নয় তোমার গাড়ি থাকবে।' উত্তমকুমারকে অবশ্য, দূর করে দেবার হুমকি, আমিও দিই। প্রতি তিন দিনে একবার তো বটেই। ভাগ্যে গাড়ি চালাতে পারি না- 


 যাইহোক প্রসঙ্গ থেকে সরে আসছি বুঝতে পেরে আবার জিজ্ঞাসা করলাম, তোমরা গেলে না কেন? ইতস্তত করে চঞ্চল বলল,' সেবার যা অভিজ্ঞতা হয়েছিল। তখন এত অটো টোটো ছিল না, ওই রোদে দুপুর বেলা সবাইকে হেঁটে অফিস ফিরতে হয়েছিল।' বুঝতে পারলাম আগেকার তিক্ত অভিজ্ঞতার জন্যই, ওরা সিঁদুরে মেঘ দেখে ভয় পাচ্ছে। আশ্বস্ত করে বললাম, কুন্তল স্যার জিন্দাবাদ। আর আমার ফেলে আসা অফিসের লোকজনকে একবার জিজ্ঞাসা করে দেখো,  চুঁচুড়ায় কেমন মুড়ি টিনের মত ঠেসে ঠেসে সবাইকে গাড়িতে তোলা হত। এখানেও তাই হবে। আধিকারিক বা অফিস বদলে গেলেও বদলাবে না নিয়ম।


নিমন্ত্রণ এলে তারপর থেকে মোটামুটি হাজিরা দেয় অধিকাংশই। আজই যেমন সব মিলিয়ে আমরা ১৬ জন এসেছি। কোলাঘাটের ইন্সপেক্টর সৌম্যর উপর ভার ছিল, কারা কারা যাবে তাদের নামের লিস্ট বানানো। তালিকা শেষ পর্যন্ত যা লম্বা হলো, বেদজ্যোতি-শুভাশিস-নন্দনের মত গুটিকয়েক যদি নানা কারণে যেতে অপারগ না হতো, তাহলে বোধহয় একটা মিনিবাস ভাড়া করতে হত, চাঁদা তুলে।


ঠিক ছিল, ঠিক চারটের সময় কাঁথি থেকে রওনা দেব আমি। পাঁচটা নাগাদ হক বাবুকে তোলা হবে নন্দকুমার থেকে। নিমতৌড়ি থেকে উঠবে সৌরভ আর CKCO শান্তনু। উপহার সমেত উঠবে শুভদীপ্ত। মেছেদা থেকে উঠবে সুরজিৎ, কোলাঘাট থেকে রঞ্জিৎ, দেউলটি থেকে সৌম্য, বাগনান থেকে রবিবাবু এবং সন্দীপ। সঞ্জয় আর মনীশ আসবে ট্রেনে। উলুবেরিয়া স্টেশন থেকে ওদের তুলে নেব আমরা। কাটায় কাটায় ছটায় পৌছবো আমরা নব দম্পতিকে আশিস এবং শুভেচ্ছা জানিয়ে প্রথম ব্যাচে খেয়ে ঠিক রাত আটটায় বেরিয়ে পড়ব আমরা।

সেই মতো শনিবার দুপুরে এক ফোঁটাও না ঘুমিয়ে পৌনে চারটের মধ্যে সেজেগুজে তৈরি হয়ে গেলাম আমি। সপরিবারে নিমন্ত্রণ ছিল, শৌভিক আর তুত্তুরী রাজি হলো না এই অবেলায় উলুবেরিয়া যেতে, তাঁরা নাকি যুগলে পাখির ছবি তুলতে যাবেন। সব হলো স্টার্ট নিল না কেবল গাড়িটা। টেনশনে আধ কিলো ঘেমে গেল উত্তম কুমার। বাংলোর সিকিউরিটি ছেলেটি এবং উত্তমে মিলে বিস্তর ঠেলাঠেলিও করল তাও নড়লো না গাড়ি। বিরস বদনে মেসেজ করলাম অফিস গ্রুপে, ভাই সব তোমরা যে যেমন পারো, যেভাবে পারো চলে যাও। মনে হয় না আমি যেতে পারবো।


ভেবেছিলাম এই নিমন্ত্রণ বাড়িটাও বুঝি সংযুক্ত হতে চলেছে অপারগতার তালিকায়। পাঁচটা বেজে গেলে হয়তো সত্যি সত্যি আর যেতামও না। বাঁচিয়ে দিল কাঁথি বাজারের বুড়ো মেকানিক, আসতে একটু দেরি করেছিলেন বটে তবে মাত্র তিন মিনিটে কি যে মৃতসঞ্জীবনী সুধা পান করালেন গাড়িটাকে। গাড়ি একদম রকেট হয়ে দৌড়লো। নির্ধারিত সময়ের মিনিট পঁয়তাল্লিশেকের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম আমরা।


মেনু কি হতে চলেছে আগেই জেনে নিয়েছিলাম আমরা, যদিও কিছুই আর মনে ছিল না সেদিন। তবে জানতাম এবং মনেও ছিল যে টকটকে লাল লেহেঙ্গা পড়বে নববধূ। লেহেঙ্গার ছবিও দেখিয়েছিল শান্তনু। ছেলেটা এতই ভালোমানুষ গোবলু, যে কে সাজাতে আসবে, কখন সাজাতে আসবে এবং সাজানোর খরচ কত সেসব গল্পও শুনিয়ে ছিল আমাদের। ফলে সুসজ্জিতা নববধূর মঞ্চে অবতীর্ণ হতে, যে বেশ খানিকটা সময় লাগবে, এ ব্যাপারে আমরা ইতিমধ্যেই অবহিত ছিলাম। 


নববধূর আসতে বিলম্ব হলেও ফুচকাওয়ালার যে আসতে বিলম্ব হবে না, এ ব্যাপারে আমরা নিশ্চিত ছিলাম। অবিলম্বে লাইন পড়ে গেল ফুচকাওয়ালার সামনে। একদল কটকটে ঝাল ফুচকা চায়, তো একদল ঝাল বিহীন শুকনো ফুচকা। ফুচকার পাশেই ঢেলে রাখা গরম গরম পনির কাঠি কাবাব। তার পাশে জ্বলন্ত চিকেন মোমো। তার পাশেই কফি। ফুচকার টক জলে পেট টইটুম্বুর, এমতবস্থায় কিছুতেই কফি খাব না আমরা, শান্তনুর মামা বাবুও ছাড়বেন না।  বড় ভালো বানিয়েও ছিল বটে কফিটা। পেট পুরে স্টার্টার সাঁটিয়ে, নববধূর ফাঁকা সিংহাসনে বসে ছবি তুলে, সেলফি কর্নারে গ্রুপি তুলতে সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়লেও আমার চোখ ঠিক ঘড়ির ওপর। এতগুলোকে তাড়িয়ে এনেছি যেমন, সালামত ভাবে বাড়ি পৌঁছানোর দায়িত্বও তেমনি আমারই। লজ্জার মাথা খেয়ে শান্তনুর মামাকে শেষ পর্যন্ত আমিই গিয়ে বললাম, রান্না কি সম্পন্ন? তাহলে আমাদের যদি একটু বসিয়ে দেন।


প্রথম ব্যাচে খেতে বসার সবথেকে বড় সুবিধা হল কোন কিছুই ঠান্ডা পাবেন না আপনি। জিভ জ্বালানো ফিস পাঞ্জাবি, আঙুল পোড়ানো মুগমোহন, কিমা মোটর, পোলাও, ভেটকি মাছের পাতুরি, খাসির মাংস, কষা চিকেন, মাছ, পনির ইত্যাদি যখন আসতে শুরু করল পরপর তখন বড় দুঃখ হচ্ছিল জানেন, কেন যে অতগুলো ফুচকা খেলাম। তেঁতুল জল আর এক্সপ্রেসো কফির আভ্যন্তরীণ বিবাদে, বাদ দিতে হলো অনেক কিছুই। তবে সন্দেশটা আর শেষ পর্যন্ত প্রাণে ধরে ছাড়তে পারলাম না। আমাদের হাওড়া জেলার বাগনান-উলুবেরিয়া অঞ্চল এমনিতেই মিষ্টির জন্য সুপ্রসিদ্ধ। এই অসময়েও সন্দেশটা থেকে ভুরভুর করে নলেন গুড়ের সুবাস ছাড়ছিল। প্রতি কামড়ে জিহবা আর তালুতে মিশছিল খাটি ছানার সোহাগ।


শান্তনুদের বাড়ির আতিথেয়তা অসম্ভব উষ্ণ। কতবার, কতজন, কতরকম ভাবে যে বলে গেল, ভালো করে খাবেন, যা ইচ্ছে খাবেন, যতবার ইচ্ছে চেয়ে খাবেন। আমার ছোট কাকুর ভাষায় নির্লজ্জের মত খাবেন অর্থাৎ লজ্জা করে খাবেন না, ইত্যাদি প্রভৃতি । বর বেশে এক ঘর অভ্যাগত দের সামনে অন্তত গোটা পাঁচেক বার তো আমায় প্রণাম করার চেষ্টাই করে ফেলল শান্তনু। পদাধিকার বলে উপরওয়ালা বটে, তাই বলে গুরু ঠাকুর তো নই, আরেকবার প্রণাম করতে এলেই ঠ্যাঙাবো, এই ভয় দেখিয়ে নিরস্ত করলাম শেষ পর্যন্ত। পাশ থেকে সন্দীপ ফুট কাটল, "ম্যাডাম সাথে সাথে শোকজ টাও করে দিন।" যেন অনাবশ্যক শোকজ করাটাই আমার কাজ। ওটাকেও দু চার ঘা দিলে মন্দ হত না, যা বুঝলাম।


আটটায় বের হব ভেবেছিলাম মাত্র পনেরো মিনিটের মধ্যে গুটিয়ে ফেলতে পেরেছি ব্যাপারটা। তার জন্য তারিফও করলো হক বাবু আর উত্তম। 'এই আপনি তাড়া দিলেন, তাই সব কটা নড়ল।' সেটা দূর থেকেও বুঝতে পারছিলাম বেশ, নতুবা যে হারে নতুন বরকে গোল করে ঘিরে ধরে মন্ত্রণা দিচ্ছিল সব কটা, এত বুদ্ধি আমাদের শান্তনু মাথায় রাখতে পারলে বাঁচি। কিছু রাখবে, কিছু হয়তো মিশে যাবে অপ্রয়োজনীয় স্মৃতির ভিড়ে। সব মিলিয়ে খুব খুব ভালো থাকবে আমাদের শান্তনু আর তার মৌলি, এটাই আপাতত টিম তাম্রলিপ্তর প্রতিটি উপস্থিত এবং অনুপস্থিত সদস্যর একমাত্র কামনা। ভালো থেকো নব দম্পতি। অনেক অনেক ভালোবাসা আর আশীর্বাদ রইল তোমাদের জন্য।

অনির ডাইরি ১০ই মার্চ, ২০২৩

 


#অনিরডাইরি #তাম্রলিপ্তকড়চা 

মাসি দীর্ঘদিন ধরে আমাদের অফিস ঝাড়পোচ করে আসছে। অফিস স্থানান্তরিত হয়েছে, বদলে গেছে ইন্সপেক্টর থেকে আধিকারিক সকলে। জগদীশ গুপ্ত সাহেব তো মারাও গেছেন। চাকরি ছেড়ে দিয়েছে কত সিকেসিও। নতুন জয়েন করেছে আবার। মাসি শুধু রয়ে গেছে  ধ্রুবক হয়ে। মাসির আসল নাম পুতুল দাস। এককালে চা বিক্রি করতেন, তখন আপিস সাফাই করত অন্য মাসী। সে মাসি গত হলে, ঐ কাজটাও চাপে এই মাসির ঘাড়ে। 


আমি আসার পর মাসির সামান্য চাপ বেড়েছে। মেঝে কতটা সাফ হল, কোথায় ঝুল জমল,ডাস্টবিন কতদিন পর খালি করা হল - পুরুষ আধিকারিকরা এসব দেখে থোড়াই। দুচারদিন ডুব মারলেও কেউ কিছু বলত না। মাসির ভাষায় সবকটা “সাক্ষাৎ ভগবান ছেল”। আমি একাই অসুর। আমি আসার পর হাজিরা খাতা বানানো হয়েছে মাসিরও। অফিসে ঢুকে ঝ্যাঁটা ন্যাতায় হাত দেবার আগেই,সামনে খাতা খুলে ধরেন হক বাবু। নিত্য আমার আর হক বাবুর মুণ্ডপাত করতে করতে সই করতে হয় মাসিকে। লম্বা ছুটি নিলে দিতে হয় একজন প্রতিস্থাপক। ঝাড়পোঁচ করতে হয় একটু ধৈর্য্য ধরে।টেবিলে আঙ্গুল দিয়ে যাতে নাম না লেখা যায়। ঘর মোছার আগে পাল্টাতে হয় জল। কাদাগোলা মেঝে আমার দুচক্ষের বিষ। খালি করতে হয় ডাস্টবিনও। অফিসে ঢুকতেই পচা গন্ধওয়ালা ডাস্টবিন আমার দুচক্ষের বিষ। ইত্যাদি প্রভৃতি। 


এতদসত্ত্বেও মাসি নীবর থাকে, কারণ আপাততঃ মাসির মজুরীটা মাসেমাসেই দিতে পারি আমরা। আগে ঐটি পেতে কালঘাম ছুটত মাসীর। এখন অ্যালটমেন্ট এলেই সর্বাগ্রে আলাদা করে রাখা হয় মাসীর সম্বৎসরের মজুরীর টাকা। পুজোর বোনাসের ব্যবস্থা করা গেছে সময়মত। মাঝেমাঝেই, "মজুরী বাড়াও নাহলে আর আসবুনি" বলে হুমকি দেয় বটে মাসি, ওগুলো নির্বিষ আস্ফালন আমরাও বুঝি। কিন্তু বসন্তোৎসবের পরের দিন মাসির যে রূপ দেখলাম, তা মোটেই ইয়ে মানে শান্ত নয়। হোলির পরের দিন আপিসে ঢুকে দেখি, হক বাবু, জহর বাবু এবং অরূপ সিঁটিয়ে আছে। আলমারি হাঁটকে ছেঁড়া ন্যাকড়া আর পুরাণ ডাস্টার বার করছেন জহর বাবু। মাসি একাই সব্যসাচী। নেহাৎ মজুরীর বিলে আমিই সই করি, তাই আমার ভাগ্যে অমৃত বচন তেমন না জুটলেও, চোখ গোলগোল করে, মনে মনে ব্যাপক ভর্ৎসনা করল মাসি। বেদম হেসে মাসির ধ্যান না ভাঙালে, ভম্মই হয়ে যেতাম নির্ঘাত। 


যত চটছিল মাসি,ততো বাড়ছিল আমার হাসির দমক। যত হাসছিলাম আমি, ততো চটছিল মাসি। শেষ পর্যন্ত অবশ্য হার মেনে নিলাম আমিই। সরি মাসি বলে বেশ খাণিক আদরও করে দিলাম, তাও গলল না বৃদ্ধা। তাও নমনীয় হল না দৃষ্টি। শুধু বলল,‘ মা, মা গো। মা জননী। তোমায় প্রণাম।” 🤕


ছবি - অরূপ এবং বেদজ্যোতি। দুদিন ধরে একই রকম ক্ষেপে আছে মাসি।😔

অনির ডাইরি ৯ই মার্চ, ২০২৩

 

#অনিরডাইরি #তাম্রলিপ্তকড়চা #happywomensday 


প্রতিবছর মার্চ মাসে একটা মোটা টাকার অ্যালটমেন্ট ঢুকত। সাথে সাথে আসতো নির্দেশ নামা, আসন্ন নারী দিবস উপলক্ষে, সংগঠিত এবং অসংগঠিত ক্ষেত্রের মহিলা শ্রমিকদের নিয়ে করতে হবে দুদিনের কর্মশালা। তড়িঘড়ি চুঁচুড়া পুরসভার বাতানুকূল হলটা বুক করে ফেলতাম আমরা। কথা বলতাম নারী-স্বশক্তিকরণ (women empowerment) নিয়ে কাজ করছে এমন বিশেষজ্ঞ, আইনজীবী, এনজিও এবং সরকারি আধিকারিকদের সাথে।


সেশন নিতে ডাকতাম, আমার পরিচিত এমন নারীদের, যাঁরা আমার চোখে প্রকৃতই সবলা। সবাই যে আসতে পারতো তা নয়, আবার অনেকেই চলে আসতো। যেমন এষা বা দেবশ্রী দি। একবার তো DLSA এর তৎকালীন সেক্রেটারি সাহেবের সৌজন্যে, ডিস্ট্রিক্ট জাজ স্বয়ং এসে হাজির আমাদের ক্ষুদ্র অনুষ্ঠানে। কথা বললেন, কথা শুনলেন, প্রয়োজনীয় আইনি পরামর্শ দিলেন মেয়েদের। ভাঙা ঘরে সেদিন আমাদের চাঁদের আলো।


এই জেলায় আসা ইস্তক আর আসে না ওই টাকাটা। কি জানি কেন বিমুখ হয়েছে দপ্তর, অধমের প্রতি। উচ্চতম আধিকারিক থেকে করণিক কার কাছে না অনুরোধ জানায়নি। তাও ভেজেনি চিঁড়ে।


 Women empowerment আমার প্যাশন বলতে পারেন। নিজেকে আমি সেই গুটিকয় empowered women দের মধ্যে ধরি, যাদের ভূমিষ্ঠ হবার পূর্বে তাদের পিতা-মাতার যদি পুত্রাকাঙ্ক্ষা থেকেও থাকে, নবজাতিকার মুখদর্শনের সাথে সাথেই তা দূরীভূত হয়েছিল চিরতরে। শৈশবে বা কৈশোরে আমরা কোনদিন সুস্পষ্ট ভাবে লিঙ্গ বৈষম্যের শিকার হয়নি। গোটা ডিমই বলুন বা মাছের পেটি বা খাসির মেটে বা নতুন জামা সবকিছুই পরিবারের পুরুষ সদস্যদের সমান সমান পেয়ে এসেছি। যতদিন পড়তে চেয়েছি, যা নিয়ে পড়তে চেয়েছি অনুমতি এবং উৎসাহ পেয়েছি। বিয়ের জন্য অযথা জোরাজুরি করেনি কেউ। পড়তে গিয়ে যত রাতেই বাড়ি ফিরি না কেন, কোনদিন ঘটেনি কোন অবাঞ্ছিত ঘটনা। চাকরির ফর্ম তোলা থেকে ইন্টারভিউ অব্দি, মহিলা বলে পড়তে হয়নি কোন বিরূপ মনোভাবাপন্ন ব্যক্তির সামনাসামনি। আমাকে কেউ কোনোদিন ঠারেঠোরেও বলেনি যে মহিলা বলে এই পদের আমি অযোগ্য বা অনুপযুক্ত। গ্লাস সিলিং এর সম্মুখীন হতে হয়নি। পুরুষ সহকর্মীদের সাথে নিজেকে প্রমাণ করার সমান সুযোগ পেয়েছি আমি। সমতালে বেড়েছে বেতন। প্রেমে প্রত্যাখ্যাত হয়ে এসিড নিয়ে ধাওয়া করেনি কেউ। চাকুরীরতা বলে বিয়ে করতে অসম্মত হয়নি কেউ। বিয়ের পরেও কেউ বলেনি চাকরি ছাড়তে। গার্হস্থ হিংসার শিকার হতে হয়নি। কন্যা সন্তানের জন্ম দেবার পর শুনতে হয়নি কোন কটু মন্তব্য। মেটারনিটি লিভ পেয়েছি। চাইল্ড কেয়ার লিভ পাই। আমি তো সমাজের ভাগ্যবান অংশ। আক্ষরিক অর্থেই the creamy layer। 


কিন্তু সবাই যে এত ভাগ্যবান হয় না। 'হে মোর দুর্ভাগা দেশ'- এ, কন্যা ভ্রূণহত্যা, লিঙ্গবৈষম্য, অশিক্ষা, স্কুল ছুট, বাল্যবিবাহ, গার্হস্থহিংসা (domestic violence), যৌন নির্যাতন ইত্যাদি প্রভৃতি যে আজও আছে। এখনও সমাজের একটা গরিষ্ঠাংশ প্রতি মুহূর্তে যুঝে চলেছে এই দৈত্যগুলির সঙ্গে। সবথেকে বড় কথা হল, এণারা অনেকেই এগুলিকে ভবিতব্য  বলে মেনে নিচ্ছেন। জন্ম থেকেই ধরে নিচ্ছেন নারী মাত্রই অবলা। অবরবর্গীয় মানুষ,বা মনুষ্যপদবাচ্যই নয়। তারা জানতেও পারছেন না, মানতেও পারছেন না যে নিছক জন্ম দিলে বা লালন পালন করলে বা ভাত কাপড়ের দায়িত্ব নিলেই গায়ে হাত তোলার অধিকার জন্মায় না কারো। শুধু গায়ে হাত তোলাটাই গার্হস্থ্য হিংসা নয়। মৌখিক এবং মানসিক নির্যাতন যেমন সবার সামনে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করা, উপহাসের পাত্র বানানো ইত্যাদি ও গার্হস্থ্য হিংসারই অঙ্গ। যেখানে প্রতিমুহূর্তে মেয়েটিকে মনে করানো হয় যে তার অস্তিত্ব একেবারেই তুচ্ছ, একান্তই নিষ্প্রয়োজন। 


এই সমস্ত পিছিয়ে পড়া মেয়েদের একটু স্পেশাল ফিল করানো, একটু সচেতনতা বৃদ্ধি, এইটাই তো হল নারী দিবসের উদ্দেশ্য। কোথা থেকে কোথায় এসেছি আমরা। এইতো সেদিন সম্পত্তির অধিকার ছিল না মেয়েদের, ছিল না মতদানের অধিকার। এমনকি শিক্ষার অধিকারও ছিল না। সেখান থেকে অনেক লড়াই করে আমরা এসেছি তো এতটাদূর। দিল্লি এখনো অনেক দূর হয়তো, তবে রাস্তাটা তো বোঝা যাচ্ছে। আর রাস্তা না থাকলেই বা কি, রাস্তা বানাতে হবে তো!


 জানি দুদিন বা একদিনের ওয়ার্কশপে কোন পরিবর্তনই হয়তো আনতে পারব না। ব্যাপারটা সিন্ধুতে বিন্দু সম। তাই বলে কি চেষ্টা করব না। ফান্ডে রাহু লেগেছে বটে, তবুও ঠিক করলাম যে, সীমিত সামর্থের মধ্যেই ওয়ার্কশপ আমরা করব।  ডিএম সাহেবের মিটিং হল বুক করতে লাগে না কোন টাকা পয়সা। মিটিং হলেই রয়েছে প্রজেক্টর। ল্যাপটপ তো আমাদের অরূপেরই আছে। চা বিস্কুট বা সামান্য দুটি মাছ ভাতের ব্যবস্থা ধারেনগদে হয়ে যাবে ডিএম অফিসের ক্যান্টিনে। রইল এবার কারা অংশগ্রহণ করবে আর কারা ক্লাস নেবে? আমাদের মহিলা এসএলও এবং কালেক্টিং এজেন্টদেরই ডাকা হল শেষ পর্যন্ত। প্রতিদিন অগুনতি মানুষের সাথে কাজ করেন এনারা। যাদের মধ্যে মহিলার সংখ্যাই বেশি। সামান্য শিখিয়ে পড়িয়ে নিলেই আমার মেয়েরা অনুঘটকের কাজ করতে পারে। এদের মাধ্যমেও ছড়িয়ে পড়তে পারে সামান্য সচেতনতা। 


ট্রেনার হিসেবে ডাকলাম আমার এক প্রিয় দিদি আর এক বন্ধুকে। বন্ধুবর শেষ পর্যন্ত এসে উঠতে পারেনি বটে, কিন্তু তানিয়া দি এসেছিল। জানতাম, এই মহিলার মাথায় আমার মতোই নারী স্বশক্তিকরনের পোকা গিজগিজ করছে। তাই না হাওড়া শিবপুর থেকে ঠেঙিয়ে তমলুক এলো আমার মেয়েদের ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স অ্যাক্ট এবং সেক্সুয়াল হারাসমেন্ট অফ উইমেন অ্যাট ওয়ার্ক প্লেসেস পড়াতে। মালদায় পোস্টিং ভদ্রমহিলার। সেখান থেকে কয়েক দিনের ছুটিতে বাড়ি এসেছে, ছেলের পরীক্ষা বলে। তার মধ্যে থেকেও একটা বেলা, একটা দিন শুধু আমাদের জন্য খরচ করাটা আমার কাছে মোটেই ছোট কথা নয়। সেটা বললাম ও দিদিকে। 


আর বললাম যে, টাকা পয়সা সেভাবে কিছু দিতে পারবো না। হাল বহুত খারাপ। উল্টে দিদি আমায় মুখ ঝামটা দিল, "তোর সঙ্গে কি আমার টাকা পয়সার সম্পর্ক, অ্যাঁ? রাখ তোর টাকা তোর পকেটে।" সাধে কি বলেছি, ভদ্রমহিলার মাথায় পোকা গিজগিজ করছে। সাধে কি ভদ্রমহিলার সাথে আমার এত প্রেম। দুজনেই হাওড়ার মেয়ে যে। রতনে রতন চেনে মশাই।

অনির ডাইরি ৭ই মার্চ ২০২৩

 


 আজ মায়ের জন্মদিন।  কাগজে কলমে কিন্তু আজ না, জানুয়ারী মাসের তিরিশ তারিখে মায়ের জন্মদিন। এরকম কেন? প্রশ্ন করলেই মা বলে,“ভূতের আবার জম্মবার। ” ভূত অর্থাৎ অদৃশ্য কোন জীব, হ্যাঁ তাই তো থেকেছে মা বরাবর, অদৃশ্য,আত্মগোপনকারী, পিছনের সারিতে মুখ লুকিয়ে বসা আনস্মার্ট চাকচিক্যহীন প্রাণী। যাদের কেউ হিসেবে ধরে না। যারা স্বপ্নেও আশা করেন না, ঝকমকে লাইমলাইট কখনও এসে পড়বে তাঁদেরও ওপর। অথচ তাঁদের জীবন নিয়েই রচিত হয় আধুনিক রূপকথা। 


আপাতদৃষ্টিতে মায়ের গল্পের শুরুতে নতুনত্ব তেমন কিছুই নেই, সদ্য বিভক্ত- দাঙ্গা বিধ্বস্ত স্বাধীন ভারতবর্ষে জন্মানো, ৫০-৬০এর দশকে বড় হওয়া আর পাঁচটা মেয়ের মতই একই গতানুগতিক ছন্দে বাঁধা শৈশব। সুদূর মুর্শিদাবাদে দুকূল ছাপানো ভাগীরথীর তীরে, ঘন সবুজ ধান-পাট-মুসুরি খেত আর ঐতিহাসিক আমবাগানে ঘেরা গণ্ডগ্রাম রামনগর। 


সেখানে ঘোষেদের বিশাল যৌথ পরিবার, পরিবারের মাথা, মায়ের ঠাকুমা হরিমতী দেবী ছিলেন বড়ই জাঁদরেল। দাদু এবং দিদা, হরিমতী দেবীর আতঙ্কে থরহরি কম্প। দাদু থাকতেন কলকাতার মেসে। সপ্তাহান্তে ট্রাঙ্ক হাতে পাড়ি দিতেন দেশে। বাড়ি যখন ঢুকতেন তখন আমবাগানের মাথার ওপর জ্বলজ্বল করত রামনগরের চাঁদ। ঝিঁঝি পোকাদের কলতানে দূর থেকে সানন্দে যোগদান করত শৃগালের দল। সেই শুনে খ্যাঁকখ্যাঁক করে উঠত স্থানীয় সারমেয় কুল। অকুল আঁধারে টেমটেমির আলো জ্বেলে বসে ঢুলত অভুক্ত দিদা। মেয়েরা কখন ঘুমিয়ে কাদা।দাদুর বড় দুঃখ হত। কেন জেগে থাকে না মেয়েরা? কি করে জাগিয়ে রাখা যায় চার কন্যাকে?


 দাদু অঙ্কে ছিলেন মাত্রাতিরিক্ত দক্ষ, দশ ক্লাশের পরীক্ষায় পাওয়া শংসা পত্র, যত্ন করে রেখেছিল দিদা অনেকদিন। জীবনের অঙ্কে অবশ্য দাদু ছিল বরাবর কাঁচা। না হলে,৬০এর দশকে নিছক মায়ের(হরিমতী দেবী) শখ মেটাতে কেউ কষ্টার্জিত অর্থ ব্যয় করে বানায় দোতলা মাটির কেল্লা? 

তো যাই হোক বড় দুঃখ দাদুর, মানসিক অঙ্ক করেই চলেন, কি করে জাগিয়ে রাখা যায়, মেয়েদের?শেষে দিদার কাছে আব্দার  করলেন, যেদিন উনি আসবেন, সেদিন কিছু যেন স্পেশাল রান্না করে দিদা, গভীর রাতে ক্লান্ত দেহে এমন বেঢপ আব্দার শুনে মুখ ঝামটাতেন আমার সাধাসিধে নিরীহ দিদা। মধ্যবিত্তের আবার ইসপেশাল কি হয়? রোজই তো থোড়-বড়ি-খাড়া। হোক না তবুও কিছু-। দাদু বলতেন,“আমি যেদিন আসব, তুমি বরং শুধু সেদিনই ডাল রেঁধো। তাহলে মেয়েরা ভাববে, আজ বাবা আসবে, আজ ডাল হবে!” বলেছিলাম না,বড় সরল,  জীবনের অঙ্কে বড় কাঁচা ছিলেন দাদু। 


মায়ের ভয়ে কোনদিন বউ মেয়েদের কোথাও ঘুরতে নিয়ে যাননি। বড় বেড়ানোর শখ ছিল দিদার। মাথায় ছোট্ট খাট্টো দিদা আর তালগাছের মত ঢ্যাঙা দাদুর ভাঙা ঘরে চাঁদের আলো। হঠাৎ একদিন সাহস করে পুরীর টিকিট কেটেই ফেললেন দাদু। ভয়ে ভয়ে সপ্তাহান্তে বাড়ি ফিরে হরিমতী দেবীকে বললেন,“শীলু খুব বায়না করছিল। ঐ টাকা জমিয়েছিল। ” শীলু অর্থৎ শিউলি অর্থাৎ আমার মা। বয়স— বছর বারো। সেই বোধহয় প্রথম এবং শেষ বার দাদুর মিথ্যা বলা। অতঃপর? হাওড়া ইস্টিশন থেকে কু ঝিকঝিক-দৌড়াল স্বপ্নের রেল। শ্রীক্ষেত্রে পদার্পণ করলেন সবৎসা সদানন্দ এবং সুনীতি রাণী ঘোষ। প্রথম সমুদ্র দেখা। প্রথম বাঁধন ছেঁড়া খুশি ভাসিয়ে নিয়ে গেল মা-মাসিদের শৈশব। 


স্থায়ী হল কোথায়? টুক্ করে একদিন চলে গেলেন দাদু। একটা ছোট্ট স্ট্রোক বদলে দিল জীবন। মা তখন নবম শ্রেণী, মায়ের সদ্য শাড়ি।  

 বড় মাসির বাড়িতে একটা বাঁধানো সাদাকালো ছবি ছিল,ফুলে ঢাকা দাদুর শরীর ঘিরে দাঁড়িয়ে-বসে দিদা আর তার চার মেয়ে আর একমাত্র জামাই,আমার বড় মেসোমশাই। সকলের চোখে অসীম শূণ্যতা আর অসহায়তা।থমথম করছে শোক। ব্যতিক্রম শুধু ছোট মাসি। আহাঃ বড়ই ছোট ছিল গো। দিদার কোল থেকে নামতে চাইত না। তখন ঐ ধরণের ছবি তোলার রেওয়াজ ছিল। 


সাদা থান পরা দিদাকে দেখে, জনৈক আত্মীয় নাকি বলছিলেন,“তোমায় খারাপ লাগছে না, বুঝলে। ” হাউহাউ করে কেঁদে উঠেছিল সেদিন কিশোরী মা আর মাসিরা। সদ্য সাদা শাড়িপরা মা, যে কোন সন্তানের কাছে বিভীষিকা। এই চূড়ান্ত অসময়ে কি বলছে এরা? সমাজ এত নিষ্ঠুর? 

চোখ মুছে আমার স্বল্প শিক্ষিত, সাড়ে চারফুটের দিদা তার পিতৃহারা মেয়েদের বলেছিল,“একদম কাঁদবি না। আজ থেকে আমিই তোদের মা- আমিই বাবা। আমি যতদিন না মরছি, কেউ কাঁদবি না। ” 


বিমুখ-লোলুপ-পলায়নপর আত্মীয়গোষ্ঠীর ভিড়ে একা প্রহ্লাদ ছিলেন আমার বড় মেশোমশাই স্বর্গীয় অজিত সিংহ। জন্মসূত্রে বিদ্যাসাগরের দেশ ঘাটালের অধিবাসী। স্বভাবেও অনেকটা একই। বাহ্যিক আবেগ ছিটেফোঁটাও ছিল না,ছিল শুধু অটল কর্তব্যপরায়ণতা। অন্তরে, স্নেহের কাঙাল ছিলেন “মেশোই”।  এই নামেই ডাকতাম। আরএমএস এর ছাপোষা বেতনে হাওড়া শহরে বাসা ভাড়া করে পরিবার পালন করতে দম বেরিয়ে যেত- তবু পিছপা হননি দায়িত্ব নিতে। মেশোই এর নির্দেশে একাকী পলাশী স্টেশন থেকে লালগোলা এক্সপ্রেসে হাওড়া পাড়ি দিল সেদিন কিশোরী মা। শিয়ালদায় প্রতীক্ষারত মেশোই, মায়ের ভাষায় দু নম্বর বাবা। সত্যজিৎ রায় বা মৃণাল সেনের সাদাকালো ছবির মত, কয়লার ইঞ্জিনে টানা ট্রেন একরাশ ধোঁয়া উড়িয়ে পৌঁছাল মহানগরে। মেশোই বলল,“এসেছিস! চা খাবি?” “হ্যাঁ জামাইবাবু। ” মাটির খুড়িতে চা খেতে খেতে মেশোই বলল,“চাটা পুড়ে গেছে বল? কেমন যেন পোড়া পোড়া গন্ধ। ” আবার মাথা নাড়ল মা,“হ্যাঁ জামাইবাবু। আপনাকে ঠকিয়েছে। পোড়া চা। ” ঠকাস্ করে পড়ল গাঁট্টা,“ভজহরি! এটাকে বলে কফি। বুঝেছিস। ”মেশোইয়ের প্রিয় শব্দ ভজহরি। সকলেই ভজহরি। যেমন আমি বলি অপদার্থ। 


এরপর শুরু হল আসল জীবন সংগ্রাম। অন্নচিন্তা চমৎকারা। মা এবং তার বোনেদের জীবন চরিত নিয়ে তিনখানা উপন্যাস লেখা যায়। একজোড়া শাড়ি আর এক জোড়া চপ্পল নিয়ে যুদ্ধ জয় করেছে আমার দিদার মেয়েরা। উপার্জনের জন্য মধ্য হাওড়া থেকে হাঁটতে হাঁটতে বড় বাজার গেছে টিউশ্যনি করতে, শিখেছে হিন্দি টাইপ। পাঁচ দশ পয়সার বিনিময়ে পোস্ট অফিসের বাইরে বসে খাম পোস্টকার্ড- মানি অর্ডার লিখেছে তবু হাল ছাড়েনি সদানন্দ ঘোষের মেয়েরা। এক্সট্রা ডিপার্টমেন্টাল হয়ে পোস্ট অফিসে ঢুকে নিরন্তর পড়াশোনা আর পরীক্ষা দিয়ে নিজস্ব শিক্ষাগত যোগ্যতার সেরা পদে উঠে সসম্মানে অবসর নিয়েছে মা। তাও আজ বারো বছর হয়ে গেল। পেয়েছে অগণিত মানুষের ভালোবাসা। যৌথ চাটুজ্জে পরিবারের মেজ বউ হয়ে, কোমর বেঁধে সামলেছে যাবতীয় দায়দায়িত্ব কর্তব্য। 

কি অমানুষিক পরিশ্রম করত মা, ভোর পাঁচটা থেকে রাত এগারোটা সাড়ে এগারোটা অবধি ছুটেই যেত মা। 

শরীর ভাঙছিল অনেকদিন ধরেই। অম্বল- গরহজম-থাইরয়েড-প্রেশার- হাড় ক্ষয়ে যাওয়ার ব্যামোর পাশাপাশি, ২০১৩ সালে যুক্ত হল লো সোডিয়াম আর অ্যাকিউট ডিপ্রেশন। বেশ কটাদিন হাসপাতালে কাটিয়ে যখন বাড়ি ফিরল মা, ততোদিনে  ভুলে গেছে সবকিছু, চিনতে পারছিল না সেই পাঁচদিন বয়স থেকে বুকে করে মানুষ করা প্রাণাধিকা তুত্তুরীকে, তখনও মা ভোলেনি, মায়ের গায়ের রঙ কালো। মা ভোলেনি, কালো মেয়ে মানেই অসুন্দর, ভোলেনি গাঁয়ের মেয়ে মানেই আনস্মার্ট আর গাঁইয়া, ভোলেনি চাকরী করা মেয়ে মানেই গৃহকর্মে ঢ্যাঁড়শ। 


  কিছু কিছু ক্ষত বোধহয় এমন গভীর হয়, যা কখনও সারে না। সেদিনের দামী হাসপাতালের নামী মানসিক রোগবিশেষজ্ঞ বলেছিলেন,“ব্রেনের কিছু সেল শুকিয়ে আসছে। ওষুধে আপাতঃ  সারলেও ধীরে ধীরে বাড়বে এই  ভুলে যাবার প্রবণতা। ধীরে ধীরে আক্রমণ করবে অ্যালঝাইমার্স। ভুলে যাবেন সবকিছুই। ” 

ডাক্তারের ভবিষ্যৎ বাণীকে ভুল প্রমাণ করে আজ দশ বছর বাদেও দিব্যি আছে মা। হ্যাঁ ভুলে যায় খুবই, আমরা কাছাকাছি থাকি না বলে ভোগে চূড়ান্ত নিরাপত্তাহীনতায়। 


এই নিরাপত্তাহীনতার জন্যই ২০২১ সালে মস্ত বড় বিপদ বাঁধিয়েছিল মা, ঈশ্বরের অশেষ আশীর্বাদ যে সেই বিপদ থেকে মাকে আমি বার করে আনতে পেরেছি। বাকি জীবনটুকুও যাতে মাকে ভালো রাখতে পারি, এটাই আপাতত ঈশ্বরের কাছে আমার একমাত্র প্রার্থনা। প্রতিটা সফল পুরুষের পিছনে যেমন থাকেন একজন অবগুণ্ঠনবতী, তেমনি প্রতিটি নারীর সফল হয়ে ওঠার পিছনেও থাকে একাধিক পুরুষের অবদান। মায়ের জীবনের প্রথম পুরুষ, আমার স্বর্গীয় বড় মেসোমশাই। দ্বিতীয় পুরুষ আমার বাবা, তৃতীয় পুরুষ, যেন আমি হয়ে উঠতে পারি।

অনির দোলের ডায়েরি ৬ই মার্চ, ২০২৩

 

#কাঁথিরকিস্যা #অনিরডাইরি 


প্রতিবছর ন্যাড়াপোড়াটা আমাদের দোলের এক অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। আর ন্যাড়াপোড়া মানেই হাওড়া। আমার বেড়ে ওঠার শহর। যে শহর দিয়েছে আমায় শৌভিক। যে শহরে প্রথম ঘুম ভেঙেছে আমার তুত্তুরীর।দূষিত হলেও, ঘিঞ্জি হলেও, আমার প্রাণের শহর। 


দোলের ছুটি পড়ার আগের শেষ কর্ম দিবসে, এক আঁচল রঙ খেলে, ঠিক সন্ধ্যের নামার মুখে সকন্যা হাওড়ায় গিয়ে হাজির হতাম আমি। বৈঠকখানার বড় কাঠের দরজাটা খুলে, উন্মুখ হয়ে আমাদের প্রতীক্ষায় থাকত বাবা আর মা।


ঢুকেই আগে হাঁকতাম, ' মা চা করো।' তারপর কোন মতে, কাঁধের ব্যাগটা নামিয়ে, আবিরে ফাগে জবরজং শাড়িটা বদলে, আমরা লেগে পড়তাম ন্যাড়াপোড়ার জোগাড় করতে। ওই স্বল্প আলোতেই, দুটো ঝাঁটা নিয়ে, পূব আর পশ্চিমের বাগান ঝাঁটিয়ে যত শুকনো পাতা জোগাড় করত তুত্তুরি আর বুল্লু বাবু। অনেক সময় প্রতিবেশীদের বাগান থেকেও চুরি করে আনতো, ঝরে পড়া শুকনো নারকেল পাতা। চোখের সামনে দিয়ে, ঝরা পাতা নিয়ে যেত চোরেরা, দাঁত বার করে হাসত গেরস্ত। আজব পাড়া মাইরি আমাদের। আজব শহর মাইরি, আমাদের হাওড়া।


 অতঃপর, পশ্চিমে দিকে,  বাবার এক ফালি ছোট্ট বাগানে, মরে যাওয়া বেলগাছের একপাশে, স্তূপাকারে জমা করা হতো সেই সব শুকনো পাতা। তার ওপরে ফেলা হতো যত অপ্রয়োজনীয় কাগজ, পুরানো খাতা, দস্তাবেজ, ফেললু জিনিসপত্র। আর তারপর? তারপরের সময়টা ছিল শুধুই প্রতীক্ষার।


থেকে থেকে আমার দুই খুড়তুতো ভাই, অয়ন আর অনিন্দ্যর মোবাইল নম্বরে ফোন করতো তুত্তুরী। "ও বড় মামা। ও ছোট মামা। বলি কখন আসবে তোমরা? জলদি এসো প্লিজ। নাহলে যে আমরা চাঁচড় পোড়াতেই পারছি না।"  সেই যে সেবার অয়ন গিয়েছিল বাঁকুড়া। কথা ছিল বিকাল বিকাল পৌঁছে যাবে বাড়ি। ট্রেন লেট করে, ঢুকতে ঢুকতে গড়িয়ে গেল রাত দশটা, রাত দশটা অবধি আমরা সপরিবারে গালে হাত দিয়ে অপেক্ষা করে গেছি, কখন আসবে অয়ন, তবে পুড়বে শ্রীমান বা শ্রীমতী ন্যাড়া।


ন্যাড়াপোড়ার সময় হলে, একত্রিত হত বাড়ির প্রতিটি সদস্য। বাবা,মা,পিসি,অয়ন,চৈতি,অনিন্দ্য বুল্লু বাবু, তুত্তুরী এবং আমি। বেচারা ন্যাড়া, দোল পূর্ণিমার আগের রাতে, হালকা বাতাসে অল্প একটু শরশর্ শব্দ করা ছাড়া,  মোটামুটি নীরবেই দাঁড়িয়ে থাকত। খবরের কাগজ গোল করে পাকিয়ে, আস্তিন গুটিয়ে তার গায়ে আগুন লাগাতো শ্রীমান অয়ন। দেশলাই বা লাইটার সরবরাও করত আমার বাপ। ধীরে ধীরে একটু একটু করে জ্বলতো ন্যাড়া, তুত্তুরী আর বুল্লুবাবুকে সটান পাঁচিলের ওপরে তুলে দিত অনিন্দ্য, আর সপরিবারে আমরা জুড়তাম প্রবল হল্লা। 


আমরা হাওড়াবাসীরা বলতাম

" আজ আমাদের ন্যাড়া পোড়া, কাল আমাদের দোল। 

পূর্ণিমাতে চাঁদ উঠেছে, বল হরি বোল।" 


আর আমার মুর্শিদাবাদী মা বলতো, 

" আজ আমাদের নেড়া পোড়া, কাল আমাদের দোল।

পূর্ণিমাতে চাঁদ উঠেছে, পাড়ায় গন্ডগোল।"


হাওড়া আর মুর্শিদাবাদের উদ্দাম ঝগড়ায় রেফারির হত আমার বাবা। আমাদের সম্মিলিত চিৎকার ছাপিয়ে শোনা যেত বাবার উল্লাসী আওয়াজ, " লে পচা----"। এক চোট থমকে, অট্টহাসিতে ফেটে পড়ত সকলে। মুখে আঁচল চাপা দিয়ে হাসতো পিসি, " তোর যত উল্টোপাল্টা কথাবার্তা কেবল হিটলার।"


ইদানিং কানে আর তেমন কিছুই শুনতে পায় না পিসি। একদম কানের কাছে মুখ নিয়ে বললে তবে হয়তো বুঝতে পারে। বাবারও ফুসফুসের সে যোশ আর নেই। স্বাস্থ্যটা ভালো যাচ্ছে না মায়ের ও। এবারে দোলে হাওড়া যায়নি আমরাও। 


আসলে মনটাই ভেঙ্গে গেছে। এইতো সেদিন দেখা হল মেসোমশাইয়ের সঙ্গে। সম্পর্কে আমার ভাই বউ, চৈতীর বাবা। বুল্লু বাবুর পৈতেতে এসেছিলেন সপত্নিক। ছিলেন বেশ কয়েকটা দিন। বুল্লু বাবুর পৈতের যাবতীয় আচার তো আমরা মাসিমাকে অনুসরণ করেই পালন করলাম। উনি যে ভাবে বললেন,উনি যা বললেন, উনি যখন বললেন। বাড়ি ফিরে যাবার কয়েকদিনের মধ্যেই যে এইভাবে একবেলার জ্বরে যে চলে যাবেন ভদ্রলোক আমরা কেউই ভাবতে পারিনি। বিনা মেঘে বজ্রপাত একেই বলে বুঝি। 


এমতবস্থায় শ্রীমতি তুত্তুরীর,মন ভালো রাখার জন্যই ন্যাড়া পোড়ার কথাটা তুলেছিলাম। বাগানে প্রচুর শুকনো পাতা তো পড়েই থাকে, তাদের কয়েকটাকে একত্রিত করে আগুন ধরিয়ে দিলেই তো ল্যাটা চুকে গেল। ন্যাড়াও পুড়ল, নটে গাছটিও মুড়াল। সমস্যা বাধালেন মহকুমা শাসক স্বয়ং। ওনার অনুমতি ছাড়া, ওনার লোকজন কি আর আমার কথা শুনবে? সকাল থেকে লিটার-লিটার, গ্যালন-গ্যালন তৈল মর্দনের পর অবশেষে সন্ধ্যে সাতটার সময় গররাজি হলেন তিনি। মেয়েটার মুখের দিকে তাকিয়ে, সাধ্যাতীত করলেন আমাদের রঞ্জিত বাবু আর তুত্তুরীর মাসি।এত ভালো ভাবে, এত উপাচার সহযোগে কোনদিন পোড়েনি আমাদের ন্যাড়া। পুড়ল বটে, আনন্দও হল খুব।কিন্তু কোথায় যেন রয়ে গেল খানিকটা বিষন্নতা আর অনেকটা অসম্পূর্ণতা। পরিবার ছাড়া কি আর উৎসব জমে? 

যাই হোক, সকলকে দোল পূর্ণিমার অগ্রিম শুভেচ্ছা এবং অভিনন্দন জানাই। ভালো কাটুক আপনাদের দোল। রঙিন হোক আগামী প্রতিটি দিন, প্রতিটি ক্ষণ।

Friday 17 March 2023

অনির ডাইরি ৪ঠা মার্চ, ২০২৩

 

#অনিরডাইরি 

বালি ব্রিজ টপকালাম কত দিন বাদে, ব্রিজের নিচে কুচকুচে কালো মা গঙ্গা আর বাঁহাতে ঝকঝকে আলোকোজ্জ্বল মা দক্ষিণেশ্বরী। মা কালী আবার মা গঙ্গার সতীন,একসাথে দুজনকে প্রণাম করা উচিত নয় বোধহয়। এতদিন বাদে দেখা, আশা করি আজ ওরা কেউ কিছু মনে করবে না।


 বেলঘড়িয়া এক্সপ্রেসওয়ে। রাস্তার দু'ধারে যত চায়ের দোকান ছিল সব ভেঙে দেওয়া হয়েছিল কিছুকাল আগে। প্লাস্টিক টাঙিয়ে তারাই আবার ফিরে এসেছে। উজ্জ্বল বাল্বের আলো হাত বাড়িয়ে ডাকে, "ও দিদি, আসুন না। কতদিন বাদে এলেন কলকাতায়।এক কাপ চা তো খেয়ে যান অন্তত। ঘন দুধে, এলাচ থেঁতো করে, একটু বেশি চিনি আর চা দিয়ে ফুটিয়ে, মাটির ভাঁড়ে মুখ পোড়ানো অনবদ্য দিশি চা। পছন্দ নয় বুঝি? তাহলে না হয় আপনার জন্য বিলিতি চাই বানিয়ে দেব। কষকষে করে ফোটানো গরম জলে দার্জিলিং চায়ের পাতা ভিজিয়ে আপনার জন্য তৈরি করে দেবো, সুগন্ধ কালো চা। তাতে থাকবে ব্যাস এক চিমটে চিনি। আমাদের বিস্কুট গুলো দেখেছেন?  এই যে কাঁচের বয়াম ভর্তি বিস্কুট,  এগুলো কি আপনাকে ডাকছে না ? দেখুন কি না নেই, মুচমুচে লেড়ো বিস্কুট আছে, প্রজাপতি বিস্কুট আছে, ক্রিম রোল আছে, সুজির হরেক রকম বিস্কুট, যাদের আপনারা কুকিজ বলে কেনেন অনেক দামি মল থেকে, সব আছে। আছে চেরি আর চাল কুমড়ার মিঠাই ছড়ানো সস্তা বেকারির কেক।  বলুন তো কোনটা ছেড়ে কোনটা খাবেন? ও দিদিইইইইইইইইই আসুন নাআআআআআ।"


এয়ারপোর্ট। আড়াই নম্বরের গেট দিয়ে ঢুকতেই একযোগে মেসেজ পাঠালো ওলা এবং উবের। " ও দিদি আসব নাকি? প্রাইম, ম্যাক্স, মিনি, মাইক্রো কি লাগবে বলুন না যা বলবেন তাই নিয়ে এসে হাজির হব। হ্যাঁ, আমাদের ড্রাইভার গুলো একটু ছ্যাঁচড়া বটে, আমাদের নির্ধারিত ভাড়ায় কিছুতেই যেতে চাইবে না ব্যাটারা, বলবে অ্যাপ বন্ধ করে দিন, বলবে ক্যাশ টাকায় ভাড়া না দিলে কিছুতেই নিয়ে যাব না, হাজার বললেও এসি চালাবে না। উল্টে আপনাকে ওয়ান স্টার দেবে। আপনি নালিশ করবেন, আপনি ফেসবুকে লিখবেন, আপনি টুইটারে নালিশ করবেন। কিচ্ছু করবো না আমরা। জাস্ট কিচ্ছু করব না। বড়জোর একটা, " সরি ম্যাডাম, এই তো আমরা ড্রাইভারের মুণ্ডুচ্ছেদ‌ করলাম বলে- " মার্কা একটা গুরুত্বহীন মেসেজ পাবেন।  তাও কেবল টুইটারে। ওখানকার লোকজন একটু বেশিই গালাগাল দেয় কিনা। 


ওসব ছাড়ুন বরং। কতদিন বাদে ফিরলেন এই বুড়ি শহরে, কোথাও যাবেন না নাকি…? হাওড়ায় বুড়ো বাপ মায়ের কাছে অন্তত চলুন। নাকি অন্য কোথাও ঘুরে দেখতে চান? রাতের মহানগর কেমন লাগে? নামমাত্র পয়সায় রাতের মহানগর দেখাবো আপনাকে, তাও এঁকেবেঁকে, অলিগলি দিয়ে। নামমাত্র ভাড়ায়, শুধু ঘেমো হেলমেটটা একটু পরতে হবে। পিছন থেকে বলল রেপিডো।


ভিআইপি রোড। নিয়নের আলোয় পিচ্ছিল রাজপথ, পিছন পিছন তাড়া করেছে সুইগী আর zomato। ও ম্যাডাম কি খাবেন বলুন না। বিরিয়ানি খাবেন, বিরিয়ানি? কোথা থেকে খাবেন একবার বলুন শুধু, আমিনিয়া চলবে? আর্সলান? সিরাজ? রহমানিয়া? বিরিয়ানি বাই কিলো? কাবুলিওয়ালা? নাকি ইন্ডিয়া?

আরেকজন বলল, মোগলাই ছাড়ুন। বড় বেশি তেল আর মসলা, ওভার রেটেড বুঝলেন তো। আপনি তো ইয়ে আবার একটু মানে, স্বাস্থ্যবতী কিনা, চাইনিজ খান বরং।  উচ্চ মানের নুডুলস খাওয়াব দিদি। গ্রেভি চান যদি, গ্রেভি। না হলে হাক্কা।  কতদিন ভালো চাউমিন খাননি ভাবুন। মিক্সড চাউমিন খাবেন? গোটা গোটা প্রণ, মাশরুম, মাখনে ভাজা ওমলেটের কুচি, মাখন-গোলমরিচ দিয়ে সটেড চিকেন আর কুচি কুচি পর্ক।  ওঃ  আপনি তো আবার শুয়োরের মাংসটাংস খান না। ফিস উইথ রেড ওয়াইন নিন সাথে একদম জমে যাবে।


অপরজন পূর্ণ উদ্যমে ঝাঁপিয়ে পড়ল, বিদেশী জিনিসপত্র ছাড়ুন তো? এতদিন বাদে নিজের শহরে ফিরেছেন নিজের দেশি খাবার খান। বিরিয়ানি ছাড়াও অনেক কিছু আছে মোগলাইএ। বিভিন্ন রকম নান আছে। আর কাবাবের কথা ভুলে গেলে? তোমার প্রিয় কাবাব। এককালে তো ফ্যান্টাসাইজ করতে কাবাবের নামে। শোন, ওসব চিনে খাবার খাওয়ার থেকে সাহেবী খাবার খাও বরং। চিজে লটপট পিজ্জা, পাস্তা, স্প্যাগেটি খাও না, আমরা এনে দেবো তো। 


ফ্ল্যাটের তালা খুলছি আরবান  ক্লাপ বলল,  আজ তুমি বড় ক্লান্ত না? কাল আসি তাহলে? বড় নোংরা হয়েছে তোমার ফ্ল্যাট খান বাপু। বাথরুমে গিয়ে দেখো, কোণায় কোণায় ঝুল, জমা জলের লালচে দাগ। রান্না ঘরে ঢুকে দেখ না, দেখবে কেমন তেলচিটে পড়েছে। সব পরিষ্কার করে দেব। তোমার কোন চিন্তা নেই। এই শোনো না নিজের দিকে কতদিন তাকাও না বলতো, ফাটা গোড়ালি টা দেখেছো আর হাতের নখগুলো? কি কুচ্ছিত রকমের কিউটিকল জমেছে। এত কালোই বা হয়ে গেলে কি করে? বলছি কি একটা ফুল বডি স্পা করে নাও বরং। সাথে একটা দুরন্ত ফেসিয়াল। কোথাও যেতে হবে না তোমায়, আমরাই আসবো বরং। ফোল্ডিং বেড আনব,  ডিস্পোজেবল পোষাক আনব। তোমার শোবার ঘরে, তোমার বাতানুকূল যন্ত্রের শীতল হওয়ায়, দুর্দান্ত মালিশ করে দেবে আমাদের মেয়েরা। রিলাক্স করার জন্য, জ্বালানো হবে তোমার মনের মত সুগন্ধী, পপৌড়ি বা সেজ। নিদেনপক্ষে চন্দন। সামান্য একটু বেশি খরচা হবে, যদি চকলেট রাপ লাগিয়ে নাও, তাহলে দেখবে কি রকম ঝিলিক মারবে তোমার চামড়া।”


পাত্তা না দিয়ে ফ্ল্যাটের দরজা বন্ধ করলাম। কতদিন বাদে এলাম। প্রায় দুই মাসেরও পর। শেষ এসেছিলাম বড়দিনের ছুটিতে। বেশ অনেকদিন হয়ে গেল মহানগর ত্যাগ করার। আজকাল সেই টানটা আর অনুভূত হয় না।  উল্টে খুঁত গুলোই বেশি চোখে পড়ে। কথায় কথায় তাচ্ছিল্য করি শহরটাকে। তিনশ তেত্রিশ বছরের বুড়ির আর দেবারই বা কি আছে নতুন করে?নেহাৎ দুই প্রাণের বন্ধু এই মুহূর্তে মহানগরে পোস্টেড,নাহলে আরো বাড়ত খিস্তির তীব্রতা। কিন্তু একটা ব্যাপার প্রতিবারই অনুভব করি,কিছু তো আছে বুড়ির মধ্যে। সাধে তিলোত্তমা বলে না লোকে।বুড়ি বেশ কুহকিনী। সীমানা স্পর্শ করলেই, কেমন যেন আপন করে নেয় বুড়ি। ফিসফিস করে বলতে থাকে মান ভাঙ্গানো আদরের কথা। যাবতীয় ক্ষতে যেন মলম লাগিয়ে দেয় বুড়ি। যত্ত খিস্তিখেউর,রাগ, বিরক্তি, অভিমান সব যেন কেমন গলে গলে যায়। বিরাগটা যে কখন অনুরাগ হয়ে, মাখো মাখো প্রেমে পরিণত হয়ে যায় নিজেই বুঝতে পারি না। দূষিত বিষ বাতাসকেও একটু বেশি ভরে নিই ফুসফুসে। ঘুমিয়ে পড়ি বুড়ির বুকে মাথা রেখে, ময়লা আঁচল খানা জড়িয়ে। কাল সকালে উঠে সেই তো আবার ফিরে যেতে হবে। যতই চেপে ধরি না কেন,কাল সকালে ঠিক হাত ছাড়িয়ে নেবে বুড়ি। আবার ফিরে যেতে হবে পাতানো শহরে। নাককান মূলে ভাব জমাতে হবে আবার। এই তো জীবন কালি দা।

অনির ডাইরি ২রা মার্চ,২০২৩

 

#অনিরডাইরি #তাম্রলিপ্তকড়চা 

 মোবাইলে যে টাওয়ার নেই খেয়ালই করিনি। দিব্য শান্তিতে কাজ করছিলাম। মাঝে হাত-পা ছাড়াতে, সেকশনে গিয়ে খানিক খোশগল্প ও করে এলাম সবার সাথে। আমাদের চঞ্চল বৈষ্ণব ধর্মে দীক্ষিত। তিনবেলা আহ্নিক করে। টিকি রাখে। কপালে তিলক কাটে। আজকের তিলকটা বড়ই নিখুঁত কেটেছে। কিভাবে এমন সুন্দর তিলক কাটা যায়,সেই সংক্রান্ত খাণিক জ্ঞান আহরণও করে এলাম। তিলক নাকি শুধু মাথায় কাটলেই হয় না। শরীরের বারো জায়গায় কাটতে হয়। প্রতিটা তিলক শ্রীকৃষ্ণের বিভিন্ন রূপের নামে কাটা হয়। সাথে সাথে পড়তে হয় সংস্কৃত মন্ত্র।  যাতে বলা থাকে শরীরের কোন অংশের তিলক কোন রূপের উদ্দেশ্যে অঙ্কিত। 


শরীরের কোথায় কোথায় তিলক কাটা হয়, ব্যাপারটা বেশ অস্বস্তিকর। আমিও শুনব না। চঞ্চলও ছাড়বে না। “শুনুন না ম্যাডাম। শুনলে পূণ্যি হয়। কপালের তিলক কেশবের নামে। কণ্ঠে শ্রী গোবিন্দ। হৃদমাঝে থাকেন শ্রীমাধব। উদরের এক পার্শ্বে শ্রীবিষ্ণু, অন্যদিকে বামনাবতার। মধ্যে নারায়ণ। এক বাহুতে ত্রিবিক্রম আর মধুসূদন আর অপর বাহুতে হৃষিকেশ আর শ্রীধর। পিঠে থাকেন পদ্মনাভ। কোমরে দামোদর। আর মস্তকে বাসুদেব।” বললাম তেরো হল তো। উৎসাহ পেয়ে গুছিয়ে বলে চঞ্চল,‘ না বারোটাই কাটি। কাটার পর যে টুকু মাটি হাতে লেগে থাকে,সেটা মাথায় মুছেনি বাসুদেবের নামে।’ জানতে চাই কাটো কি দিয়ে? জবাব পাই, ছাঁচ আছে। আবার প্রশ্ন করি, কাটো কি দিয়ে, চন্দন কি? চঞ্চল মাথা নাড়ে গম্ভীর ভাবে। ‘না ম্যাডাম। এটা হল দ্বারকার মাটি। যাতে মিশে আছেন আমাদের প্রভু। কেউ কেউ বৃন্দাবনের মাটি দিয়েও কাটে। সেটা কালো হয়। এটা মঠ ভেদে, আচার ও ভিন্ন হয়।’ 


বেশ ভালো লাগছিল শুনতে। জিজ্ঞাসা করি, মাটিটা পায় কোথা থেকে? উত্তর পাই মায়াপুর থেকে কিনে আনে। ‘বেশি দাম না। একশ টাকা কেজি। একবার কিনলে অনেক দিন চলে যায়। ’ মায়াপুরের কোন মঠে দীক্ষা নিয়েছে চঞ্চল। ইসকন্ নয়। 


বৈষ্ণব ধর্ম নেবার ফলে কি কি পরিবর্তন এসেছে, সে গল্পও শোনাল চঞ্চল। আমিষ ছেড়ে দেবার সাথে সাথে কমেছে তমঃ এবং রজ গুণ। সিগারেট ছেড়েছে। চায়ের নেশা ছিল তাও ছেড়েছে। গল্প আরো গড়াত, যদি না  বড় সাহেব মেসেজ পাঠাতেন, “তোমাকে ফোনে পাচ্ছি না কেন?’ কি সর্বনাশ ভালো করে তাকিয়ে দেখি কখন যে মোবাইলের সবকটা টাওয়ার পড়ে গেছে খেয়ালই করিনি। মোবাইলটা রিস্টার্ট দিলাম আর জহর বাবুকে বললাম এক কাপ চা খাওয়াতে। 


জহর বাবু কোন এককালে আমাদের নাইটগার্ড ছিলেন। অবসর নিয়েছেন বছর ঘুরে গেল। কিন্তু তাও নিত্য অফিস আসেন। অবসর নিয়ে বাড়িতে থাকা বোধহয় এই সব লোকের পোষায় না। সোয়া নটায় অফিসে ঢোকেন। ঝাড়পোঁচ নিয়ে সুইপার মাসির সাথে এক চোট ঝামেলা করেন। তারপর শুরু করেন চা করতে। চায়ের লোভে কত যে বন্ধু আসে জহর বাবুর। আমি গরহাজির বা অন্যমনস্ক থাকলেই  আমাদের ভিজিটর চেয়ার দখল করে তাঁরা বসে পড়েন চা খাবেন বলে। চা খেয়ে চলে গেলেও হয়, তা নয় এরপর শুরু হয় মজলিশি গল্প। ফলে কাকতাড়ুয়ার মত আমাকে চেম্বারের দরজা খুলে মুণ্ডু দেখাতেই হয়। এক ঝাঁকি দর্শনেই সব সাফ। ট্রেড ইউনিয়নের লোকেদের সাথেও ওণার হেব্বি ভাব। ডেপুটেশন দিতে এলেও তাদের বসিয়ে চা খাওয়ান, রসিয়ে সুখদুখ, ভূতভগবানের গল্প করেন জহর বাবু। ফলে আমার ঘরে যখন তাঁরা ঢোকেন, বিক্ষোভের বারুদ ততোক্ষণে ভিজে ন্যাতা। 


এ হেন জহর বাবুর চায়ের কোয়ালিটি নিয়ে কোন কথা হবে না। আমার অধিকাংশ ইন্সপেক্টর সাহেব ও চা ছোঁয়ও না। ঐ চা বর্জন করার বদবুদ্ধি আমাকেও দেয়। নেহাৎ আমি খানদানী চা-তাল। জলে চা মোটামুটি একবার দেন জহরবাবু। বাকিটা ঐ চা পাতাতেই চলে। জলটা বারবার পড়ে নতুন নতুন করে। চিনি থাকলে ভালো, নাহলে কোথা থেকে হরির লুঠের বাতাসা যোগাড় করে চায়ে ফেলে দেন জহরবাবু। চড়াম্ চড়াম্ গুড় বাতাসাও থাকে অনেক সময় চায়ে। থাকে কদমা বা বীরখণ্ডিও। সে যে কি ভয়ানক মিষ্টি, বাপরে। 


মিষ্টি ছাড়াই দিতে বলি আমি। বেশী বেলা হলে অনেক সময় বলি, জহরবাবু এটা চা? না আপনার হাত মোছাটা ফুটিয়ে দিয়েছেন। রাগ করে না বুড়ো। শুধু মাঝেসাঝে বেপোট চিৎকার করে, ‘জয় গৌরনিতাই’ বলে। ‘ইয়া আল্লাহ’ বলেও চিৎকার করেন অনেক সময়। বেলা তিনটে বাজলেই, আমার অগোচরে মোবাইলে সজোরে হয় কালিকীর্তন নয়তো হরিনাম চালান। সাথে নিজেও গলা মেলান। আমি বেরোলেই, সব চুপ।  আসেপাশের দপ্তরের লোকজন নিমন্ত্রণ করে নিয়ে গিয়ে ওণার গান শোনে। 


তো যাই হোক, কাগজের কাপে চা দিয়ে গেলেন জহর বাবু। এক চুমুক দিতেই মনে হল চায়ে জোয়ান দিয়েছেন আজ। এ আবার কি নবতম সংযোজন রে বাপু। এমনিতেই চাটার কোন স্বাদ গন্ধ নাই,  নিছক লালচে গরম জলের মত সোয়াদ। তারওপর জোয়ানগন্ধী। ডেকে জানতে চাইলাম, চায়ে জোয়ান দেবার দুর্বুদ্ধিটা কে দিল মশাই আপনাক? জহরবাবু আকাশ থেকে পড়লেন। ‘জোয়ান, আজ্ঞে?’ বললাম জী আজ্ঞে। উনি সাফাই দিলেন, ব্যাগে চাও ছিল,পুজোর বেলপাতাও ছিল। চায়ে নির্ঘাত পুজোর বেলপাতা মিশে গেছে। বেলপাতায় এমন জোয়ানের গন্ধ বেরোয়, বাপের জন্মে শুনিনি বাপু। বললাম, আরেকবার ভালো করে চা বানিয়ে আনুন দেখি। বেলপাতা -চাপাতাটা তার আগে সটান ময়লার বালতিতে ফেলুন। 


আবার চা এল। আবার জোয়ানের গন্ধ। এবার বোধহয় একটা জোয়ানও পড়ল মুখে। জহর বাবুর এক কথা। চায়ে পুজোর বেলপাতা মিশেছে। হতে পারে। আর একটা জিনিস ও হতে পারে,যেটা আমার পুরসভার ইন্সপেক্টর বেদজ্যোতি বলেছিল কিছুদিন আগে, ‘জহরবাবু পান চিবোন তো। হয়তো সেই চিবানো পানই খানিক চায়ে পড়ে গেছে ম্যাডাম।’ আবার ডেকে জিজ্ঞাসা করলাম, জহরবাবু আপনার পান কোথায়? একগাল হেসে বললেন, ‘পান আজ্ঞে?পান তো পকেটে?’ জিজ্ঞাসা করতে গেলাম, পানে জোয়ান দিয়ে খান না। করলাম না। কিছু প্রশ্নের উত্তর অজ্ঞাত থাকাই শ্রেয়। আপদ বেদজ্যোতি, যত কুচিন্তা ঢোকায় আমার মাথায়। থেকে থেকে চা-পানের পিক আর জোয়ান এই ঘুরতে লাগল সারাটা দিন মাথায়। জহরবাবু যতদিন না মাস্ক পরে চা বানাচ্ছেন, আমি আর চা খাচ্ছি না এই অফিসে।

অনির ডাইরি ১লা মার্চ, ২০২৩

 

#অনিরডাইরি #কাঁথিরকিস্যা 


শ্রীমতী তুত্তুরী আমাদের দ্বাদশী কন্যা এবং পড়াশোনায় অষ্টরম্ভা। আমরা দুজনেই সরকারী নৌকর। দুজনেরই বদলীর চাকরি, বদলীর চক্করে মহানগর ছেড়েছি আমরা।  বার তিনেক স্কুল বদল হয়েছে তুত্তুরীর। শেষ বদল হয়েছে বিগত নভেম্বরে। তাম্রলিপ্ত পাবলিক স্কুল থেকে কাঁথি। তো এহেন তুত্তুরীর বর্তমান স্কুল থেকে যখন মেসেজটা ঢুকল, যে আসছে রবিবার ওনারা বার্ষিক পরীক্ষার ফলাফল ঘোষণা করবেন, আমাদের মস্তকে আক্ষরিক অর্থেই বজ্রাঘাত হল। যার কৃতকর্মের ফলাফল ঘোষণা হতে চলেছে, তিনি তো হাওড়া।  মহানন্দে মাতুলালয়ে অধিবাস করছেন।  রবিবার দিনই তাকে কাঁথি ফেরত আনতে যাব দোঁহে। 


আমার বর ক্ষণিক ভেবে বলল, “নূপুরকে পাঠিয়ে দেবো বরং।’ নূপুরবাবু দীর্ঘদিনের সরকারী বাহন চালক।  ওনাকে এই শহরের এবং আসেপাশের পঞ্চায়েত এলাকার সবাই একডাকে চেনে। উনিও সবাইকে চেনেন। ভদ্রলোক স্বভাবেও বেশ ডাকাবুকো। অনেকটা ‘দাবাং’য়ের পাণ্ডেজীর মত। ফলে উনি গেলে রেজাল্ট ঠিক নিয়েই ফিরতে পারবেন। 


নিরস্ত করলাম আমিই। লোকটা এত ভক্তি শ্রদ্ধা করে আমার বরকে, তুত্তুরী রেজাল্ট দেখিয়ে সেই ভয়-ভক্তি বিনাশ করাটা কি ভালো হবে? শ্রীমতী তুত্তুরীর রেজাল্ট তো আমি আজ থেকে আনছি না। রীতিমতো হাঁড়ি-বালতি-ছালা নিয়ে যেতে হয়। এমন ঝুড়িঝুড়ি নম্বর পায় আমার দুলালী।


ও আমিই যাবো খন রেজাল্ট আনতে, এবারও।  বরকে বললাম,একটু স্কুলে কথা বলে দেখ সোমবার দেবে কিনা। দেখা গেল স্কুল তো রাজি, বেবারে রেজাল্ট দিতে, গররাজি শ্রীমতী তুত্তুরী।  বাড়ি ফিরে যখন শুনলেন, আমি তাঁর রেজাল্ট আনতে যাব তৎক্ষণাৎ পড়ে গেলেন বাপের পায়ে। 


 “ বাবা, প্লিজ মাকে যেতে দিও না বাবা। ওই মহিলা কি রকম মারকুটে জানো তো। আমাকে আর আস্ত রাখবে না"  শুধু কাকুতিমিনতি নয়, রীতিমত উৎকোচের প্রলোভন ও দেখানো হল, " আমি তোমাকে আমেজ করে দেবো বাবা।” আমেজ বলতে, ভোলানাথ হয়ে চোখ বন্ধ করে বসবেন একজন, আর অপরজন মনের সুখে তার মাথার চুল টানবে, পিঠে সুড়সুড়ি দেবে, কান মূলে দেবে। তাতে নাকি আমার বরের ব্যাপক আমেজ হয়। কান মূললে কারো কোনদিন আমেজ হতে পারে, মা না হলে জানতেই পারতাম না। 


বাপমেয়ের যোগসাজশে শেষ পর্যন্ত আমাকে আর এ যাত্রা রেজাল্ট আনতে যেতে হল না। আমাকে বলা হল, " তুমি অফিস যাও বরং।" মাঝখান থেকে টানাপোড়েনে বেশ খানিক দেরী হয়ে গেল অফিস যেতে। আমার আপিস তমলুকে। যাতায়াতের জন্য দীঘা- কলকাতা বাসই আমার ভরসা। এমনিতে কলকাতা থেকে দীঘা যাবার হাজারে হাজারে বাস, দীঘা থেকে কলকাতা আসার বাসের সংখ্যা ও খুব কম নয়, কিন্তু অফিস টাইম পেরিয়ে গেলেই এই বাসগুলোর আর টিকি দেখা যায় না। যেহেতু আজকে বেরোতে দেরি হয়েছে, কপালে দুঃখ আছে বেশ বুঝলাম। 


অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে রইলাম আমি আর নূপুর বাবু। প্রত্যহ আমাকে বাসে তুলে দেবার দায়িত্বটা উনি আগ বাড়িয়ে ঘাড়ে নিয়েছেন। উনি তো পারলে আমাকে আমার অফিসেই ছেড়ে আসেন, নেহাৎ সাহেবের রক্তচক্ষুর ভয়ে আপাততঃ দীঘা বাইপাস অবধিই আমাকে সঙ্গ দেন। 


দাবাংয়ের চুলবুল পাণ্ডের মত,রীতিমত মাঝ রাস্তায় বাস থামিয়ে আমায় তুলে দেন এবং যাতে সিট পাই সেটাও বলে দেন ড্রাইভার/কণ্ডাক্টরকে। কিন্তু আজ চুলবুলও ফেল। দীর্ঘক্ষণ অপেক্ষা করার পর যে বাসটি এল, কণ্ডাক্টর হাত তুলে দিল, সিট নেই বলে। এতটা রাস্তা প্রায় সত্তর/পঁচাত্তর কিলোমিটার, দুটো ব্যাগ নিয়ে বাসে  দাঁড়িয়ে যেতে আমি অপারগ। অগত্যা বাস ছেড়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। সেটাও নাপসন্দ নূপুর বাবুর। সতেরো বার বললেন, ‘গাড়িতে বসুন ম্যাডাম। সাহেবের বউ দাঁড়িয়ে থাকলে ভালো লাগে নাকি।’ 


বড্ড রোদ। তাই বিনা বাক্যব্যয়ে গাড়িতে তো উঠলাম, মনটা কেমন যেন খুঁতখুঁত করতে লাগল। নির্ঘাত সিট ছিল। এখানে না থাকলেও সেন্ট্রাল বাসস্ট্যান্ডে বা খড়্গপুর বাইপাসে নির্ঘাত খালি হত। এই নূপুর বাবুর জন্যই আমায় তোলেনি। সবাইকে আমার বৈবাহিক পরিচয় বলার যে কি দরকার।পরিচয় জানতে পারলে আর উল্টোপাল্টা ভাড়া চাইতে পারবে না। নির্ঘাত তাই তোলেনি। 


এই রুটের এই এক দস্তুর। কোন বাঁধা ভাড়া নেই। স্থানীয়দের থেকে ৫০ নেবে তো আমার থেকে ৬০। তা নিক। কোন-কোনদিন, কোন-কোন বাস তো ১০০টাকাও চায় এবং নেয়। আমাকে দেখেই বোঝে, এ স্থানীয় অধিবাসী নয়, অমনি যাতাঃ ভাড়া চায়।  যতক্ষণ না স্থানীয়দের মত কোমর বেঁধে ঝগড়া করছি, ‘কাল ৬০ নিলে আজ ১০০ কেন দেব’, ভাড়া বাড়তেই থাকে।


দাঁড়িয়ে থুড়ি বসে আছি মিনিট পাঁচ সাতেক, আচমকা নূপুর বাবু ডেকে বললেন,‘ম্যাডাম আসুন।’ একটা সাদা স্করপিও দাঁড়িয়ে আছে, তার দরজা খুলে ধরে বললেন,‘উঠে পড়ুন। ম্যাডাম। আমার চেনা গাড়ি। এই ঠিক করে পৌঁছে দিবি কিন্তু।’ ভেবলে গিয়ে উঠেও পড়লাম, কিছু বোঝার আগেই, ড্রাইভার কিঞ্চিৎ গ্যাঁগো করে, গাড়ি ছেড়ে দিল। সামনের সিটে মস্ত ব্যাগ নিয়ে একটা লোক বসে আছে। ভাবলাম ওণারই গাড়ি হয়তো। ভ্যাবলার মত বললাম,‘ দেখুন আমি কিন্তু কিছুই জানি না। আপনি কি আদৌ নিমতৌড়ি যাচ্ছেন?’ আমার আপিস নিমতৌড়িতে। সামনের লোকটা আর ড্রাইভার উভয়ে একসাথে জানালেন, ওণারা বাগনান যাবেন। পথে আমার যেখানে প্রয়োজন, নামতে পারি। তবে রাজপথেই নামতে হবে, গলিঘুঁজিতে গাড়ি ঢুকবে না। 


সেন্ট্রাল বাসস্ট্যান্ডে গাড়িটা থামতেই, এক দঙ্গল লোক হুড়মুড় করে উঠে পড়ল। এতক্ষণে বুঝলাম এটা শাটল্ খাটছে। চারজন বড় এবং একটি বাচ্ছা গাদাগাদি করে বসলাম মাঝের সিটে। পিছনেও চারজন। একটি অল্পবয়সী ছেলে কিঞ্চিৎ  আপত্তি করছিল, ড্রাইভার বলল, ‘একটু এডজাস্ করে নে ভাই। নাচিন্দায় ওণারা নেমে যাবেন, তোকে ভালো সিট দুব।’ পিছনের লোকেদের সুবিধার্থে নামিয়ে দেওয়া হল সব কাঁচ। খোলা হাইরোড ধরে হুহু করে ছুটছে গাড়ি, হাওয়ার দাপটে দম বন্ধ হয়ে আসে।পথে কিছু মানুষ উঠল। কিছু নামল। 


আজকাল আর শাড়ি পরে অফিস যেতে পারি না। যে সালোয়ার গুলো পরি, সেগুলো আমার মায়ের ভাষায়," ফেলে দিলেও, কেউ কুড়িয়ে নেবে না।" বেতনপত্রের আপাততঃ যা হাল, ভাবলাম এই বেলা মিন্ত্রা খুলে দেখি সস্তা গণ্ডায় যদি কিছু মেলে। জামা দেখছি, পার্শ্ববর্তিনী আচমকা বললেন, ‘এটা বেশ ভালো তো। ’ চমকে তাকিয়ে দেখি উনিও আমার মুঠো ফোনের দিকেই তাকিয়ে আছেন। ভদ্রমহিলা কৃশকায়, পরণে সস্তার সিন্থেটিক শাড়ি। অবিন্যস্ত কেশদাম,তেল প্যাটপ্যাটে মুখচোখ। কি বলব,বুঝতে পারলাম না। বোকার মত হাসলাম। হাসলেন উনিও লাজুক ভাবে, তারপর বললেন, ‘কিছু মনে করবেন নি। আমার আসলে কুর্তির দোকান আছে তো। তাই আপনার ফোনের দিকে চোখটা চলে গেল।’ 


সামান্য হেসে ফোনটা বন্ধ করে দিলাম। ভদ্রমহিলা গল্প বলার মুডে আছেন,আমার সাথে খোশ গপ্প জুড়লেন। জানতে পারলাম ওণারা মেলায় মেলায় ঘুরে কুর্তি-নাইটি বিক্রি করেন। তবে মিন্ত্রায় যেমন দেখছিলাম ওমন ফ্যান্সি কিছু না। পাইকারি দরে কিনে, মেলায় বিক্রি করেন। এই মুহূর্তে নন্দীগ্রামের শিবরাত্রির মেলায় দোকান দিয়েছেন। ওণার গৃহকর্তা ওখানেই আছেন এখন। সামনেই এদিকে হোলির মেলা বসবে, ভদ্রমহিলা সেখানেই গিয়েছিলেন স্টলের ব্যবস্থা করতে। কথা হয়ে গেছে, পাঁচ হাজার টাকা চেয়েছে মেলা কমিটি। ভদ্রমহিলা আবার নন্দীগ্রাম ফিরে যাচ্ছেন। 


বললেন বাড়ি নন্দকুমার। জানতে চাইলাম রাতে কখন ফিরবেন মেলা  সেরে? বললেন, রাতে আর ফিরবেন না।  রাত বারোটা অবধি দোকান খোলা থাকে। তারপর সব বন্ধ করে রান্না চাপাবেন। খেয়ে দেয়ে কর্তা গিন্নী ঐ স্টলেই শুয়ে পড়বেন। চমকে উঠলাম শুনে। তাই নাকি? বললেন "হ্যাঁ। এমন কত করি আমরা। পুরো সংসারটাই উঠিয়ে নিয়ে ঘুরি। খুব কষ্ট হয় জানেন। দুটো পয়সার জন্য করি। বিক্রিটা যদি ভালো হয়, তাহলেও ভালো। না হলে খুব কষ্ট হয়। যে কোন মেলায় স্টল দিতে নিদেনপক্ষে হাজার পাঁচেক টাকা তো দিতেই হয়। কুর্তি পিছু কত আর লাভ থাকে। দশ- কুড়ি-তিরিশ টাকা। খুব জোর পঞ্চাশ।"  জানতে চাই,এবারে বিক্রি কেমন হয়েছে? জানতে চাই স্নানাদি কোথায় সারেন। কপালে হাত ঠেকিয়ে জবাব দেন, ঈশ্বরের কৃপায় বিক্রি মন্দ হয়নি। জানান মেলাতে শৌচালয়ের বন্দোবস্ত করেছে মেলা কমিটি। ওখানেই -। 


চণ্ডীপুর এসে যায়। ' আসছি ' বলে নেমে যান ভদ্রমহিলা। ওঠেন সাদা পাঞ্জাবি আর নীল লুঙ্গি পরা এক প্রৌঢ়। জানতে চান,‘নন্দকুমার যাবি ভাই?’ ড্রাইভার জবাব দেয়, ঐ পথেই তো যাচ্ছি। গাড়ির চাকা গড়ায়। জুৎ করে বসেন ভদ্রলোক। জিজ্ঞাসা করেন,‘তুই ঠিক কোথায় যাচ্ছিস বল তো ভাই?’ ড্রাইভার বলে,‘তার্-কেশ্বর যাব চাচা। ঠিক তার্-কেশ্বর নয়, হরিপাল অবধি যাব।’ প্রৌঢ় বলে,‘ আমায় নে যাবি? কত নিবি?’ আমি আর ড্রাইভার একসাথে প্রৌঢ়ের দিকে তাকাই, আপনার দরকার নন্দকুমার,আপনি খামোখা হরিপাল যাবেন কেন?প্রৌঢ় বলে, ‘ওটাই আমার স্বভাব। আমি খালি গাড়ি পেলেই উঠে পড়ি। আমার কোন গন্তব্য থাকে না। গাড়ি যেখানে নিয়ে যায়, চলে যাই। যেখানে ছেড়ে দেয়, বাড়ির পথ ধরি। পথে যা পাই , তাই খাই। রাস্তার কলের পানিতে তৃষ্ণা নিবারণ করি।’ 


মনে হল যেন বুড়ো হিমু বা নীললোহিতের সাথে দেখা হল বুঝি। এমন মানুষ এই হিসেবী, মামলাবাজ জেলায় থাকতে পারে কল্পনাতীত। ভদ্রলোক আরোও কিছু অভিজ্ঞতার গল্প শোনাতে ইচ্ছুক ছিলেন, আমার গন্তব্য এসে যাওয়ায় নেমে পড়লাম। ড্রাইভার কিছুতেই পয়সা নেবে না। নূপুর বাবু নাকি নিষেধ করেছেন। এই লোকটাকে নিয়ে আর পারি না। সামনের লোকটা প্রায় আমার সঙ্গেই উঠেছিল, সে ৭০টাকা দিল দেখে, আমিও তাই সিটে রেখে নেমে এলাম। নিলে নে, না হলে হাওয়ায় উড়িয়ে দে। ড্রাইভার তখনও বলে চলেছে,‘আমায় খুব বকবে ম্যাডাম।’ 


 এখান থেকে আমার আপিস হেঁটে দুমিনিট। আপিসে ঢুকেছি, শ্রীমতী তুত্তুরীর ফোন,‘মা আমি পাশ করে গেছি।’ বিশ্বাসই হল না প্রথম চোটে। কি বলছিস রে বাবু? বিগত নভেম্বরের মাঝামাঝি ভর্তি হয়েছে নতুন স্কুলে। সবার সাথে ভাব জমাতে না জমাতেই এসে পড়েছে ফাইনাল পরীক্ষা। পরীক্ষা চলাকালীনই অসুস্থ হয়ে পড়েন শ্বশুরমশাই। সেই টানাপোড়েনের মধ্যে কিছুই দেখতে পারিনি আমি। বরের কথা তো ছেড়েই দিলাম।


 নিজেই পড়েছে, নিজেই পরীক্ষা দিয়েছে মেয়েটা আমার। দিনান্তে বাড়ি ফিরে আমি কেবল জানতে চেয়েছি, ‘কেমন হয়েছে পরীক্ষা। ভদ্রলোকের এক কথার মত, রোজই "হুঁ, ভালো" বলেছে তুত্তুরী। সত্যিই ভালো বলে বিশ্বাস করিনি যদিও। তুত্তুরী নিজেও করেনি। সন্দেহ প্রকাশ করলেই বলত," রাইট টু এডুকেশন অ্যাক্টো হ্যায় না মমি। তুম চিন্তা মাৎ করো। পাশ করা দেগা।"  রেজাল্ট বেরানের দুদিন আগে বর যখন বলল, ‘ওটা সরকারি স্কুলের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য রে মর্কট। এখানে ফেল মানে ফেলই।’ আমাদের মা মেয়ের হৃৎকম্প হয়েছিল। কি হবে, আমার মেয়েটা নতুন ক্লাশে আদৌ উঠবে তো?


 আজ যখন সোচ্ছারে বলছিল তুত্তুরী,‘আমি পাশ করে গেছি মমি। তোমার সাবজেক্ট গুলোতে সব এ আর এ প্লাস পেয়েছি। কেবল বাবার ইংরেজি সাহিত্যটা ভালো হয়নি। বি পেয়েছি। আর ড্রয়িংয়ে বি পেয়েছি।’ সেটাই স্বাভাবিক। চাকরগিরি করার চক্করে, নিজের সাবজেক্ট হওয়া সত্ত্বেও ইংরেজি সাহিত্য ছিটেফোঁটাও দেখেনি তুত্তুরীর বাপ। আর আমার আর শৌভিকের কন্যা আঁকায় ডি পেলেই ধন্য হয়ে যাই আমরা। সেখানে বি তো লটারি পাওয়ার সামিল। বিরাট কোন প্রত্যাশা তো নেই জীবনের কাছে, এমনি করেই যাক না দিনগুলো। এমনিই থাকুক আমার তুত্তুরী মাটির কাছাকাছি। বাকি হিসেব সময় হলে ঠিক মিলেই যাবে।

Wednesday 1 March 2023

অনির (বুল্লুবাবুর উপনয়নের) ডাইরি, ২২শে ফেব্রুয়ারি, ২০২৩

 

পর্ব - ১



আমরা বলতাম, ‘ছিরি।’ আসল নাম যদিও শ্রী। অন্নপ্রাশন থেকে উপনয়ন, এমনকি বাড়ির বড় সড় পুজো- যাবতীয় শুভকাজের অন্যতম উপকরণ এই শ্রী। শ্রী বানাত বটে আমার জ্যাঠইমা, স্বর্গীয়া শ্রীমতী কল্পনা চট্টোপাধ্যায়। শুধু চাটুজ্জে বাড়ি নয়, যাবতীয় আত্মীয়- অনাত্মীয়, পাড়া প্রতিবেশী সকলের কাছ থেকে রীতিমত শ্রী বানানোর বরাত পেত জ্যাঠাইমা। যার বাড়িতে যা শুভকাজ পড়ত, এসে একবার হাঁক পাড়ত শুধু, ‘ডলি দি’। কল্পনা নামটা বোধহয় খোদ জ্যাঠাইমারও আর মনে ছিল না। 


  মূলতঃ চালের গুঁড়ি বা গুঁড়ো দিয়েই তৈরি হয় শ্রী। এখন বারোমাস সহজলভ্য হলেও, তখন পৌষ মাস ছাড়া বাজারে মিলত না চালের গুঁড়ি। ফলে ভোর ভোর চাল ভেজাত জ্যাঠাইমা। জেঠু ছিল সুগার পেশেন্ট। সেই ১৯৮২ সাল থেকে রক্তে মাত্রা ছাড়া শর্করা নিয়ে চলত জেঠু, চড়া ডোজের ওষুধের পাশাপাশি, খাওয়া-দাওয়ার ছিল হাজার খানেক ধরাকাট। বাতে প্রায় পঙ্গু হলেও জেঠুর তত্ত্বাবধানে এতটুকু খুঁত রাখত না জ্যাঠাইমা। নিজে বাজার করে আনা থেকে, পঞ্চব্যঞ্জন রান্না, সুন্দর করে কাঁসার থালা বাটি গ্লাসে সাজিয়ে পরিবেশন,  সবটুকু করত একাহাতে। তারওপর ছিল জেঠুর মিনিটে মিনিটে চায়ের ফরমাইশ। ব্যাঁটরার চাটুজ্জেরা জন্ম -চা-তাল। চায়ের সাথে মেজাজ অনুযায়ী ছোলা- বাদাম ভাজা বা নোনতা বিস্কুট সব কিছু সাজিয়ে মুখের কাছে ধরে, সব সামলে উঠতে উঠতে, সূর্যি মামা আসর গুটিয়ে রওণা দিত পশ্চিমে। আকাশে লাগত রঙের ছোঁয়া। বাতাস মুখরিত হত কুলায় ফিরতে উন্মুখ পাখিদের কলতানে। তখন নিরালায় ঠাকুর ঘরে বসে শ্রী গড়াতে হাত লাগাত জ্যাঠাইমা। 


কাঁসা বা স্টিলের কাঁসির(প্লেট) ওপর নিপুন হাতের কাজে ফুটে উঠত অনবদ্য সব নকশা। মূল কাঠামোটা একই হত, একটা দেউলের মত উঁচু চাউলের মণ্ড, তার গায়ে লাল-লীল-সবজে নক্সা। লাল হত সিঁদুর দিয়ে,নীল বা লীল রঙ আসত রবিন ব্লু দিয়ে। গুঁড়ো হলুদ ধরাত হলদে রঙ। সবুজ কি দিয়ে করত মনে নেই। সম্ভবতঃ কোন গাছের পাতা বেটে। সব হলে ওপর থেকে অকাতরে সর্ষের তেল ঢালত জ্যাঠাইমা। শ্রী নাকি সর্ষের তেলে চুবিয়ে এবং ডুবিয়ে রাখতে হয়। 


যবে থেকে বুল্লু বাবুর পৈতে থুড়ি উপনয়নের প্রস্তুতি শুরু হয়েছে,কত শত সহস্র বার যে জ্যাঠাইমার নাম উঠেছে। শুধু শ্রী গড়া নয়, চাটুজ্জে বাড়ির যাবতীয় নিয়মকানুন যার মগজে তালাবন্ধ ছিল সে ছিল আমার জ্যাঠাইমা। মা আছে, পিসি আছে কিন্তু  নিয়মকানুনের কিছুই ওদের অধিগত নয়। থাকবে কেন? জ্যাঠাইমা জীবিত থাকতে কোনদিন জানার প্রয়োজন পড়েছে নাকি? প্রথম শুভকাজ, জ্যাঠাইমা ছাড়া। যে যা প্রশ্ন করছে, আমরা শুধু ভাবছি। ভাবছি জ্যাঠাইমা থাকলে কি বলত। 


ভাবতে ভাবতে এসে পড়ল শুভ দিনটা। কাক না ডাকা ভোরের দধি মঙ্গল থেকে সাড়ে নটার গায়ে হলুদ। পর পর হয়েও গেল সবকিছু। এবার বরণের পালা, মাসিমা অর্থাৎ চৈতির মা অর্থাৎ বুল্লু বাবুর দিদিমা আমায় বললেন, ‘শ্রী টা তুমি নাও’। শ্রী? শ্রী গড়েছে নাকি কেউ? তাকিয়ে দেখি অবিকল জ্যাঠাইমার মতই গড়া হয়েছে শ্রীটা। কে গড়ল রে? পাশ থেকে চৈতি বলল,‘ আমার মা খানিক গড়েছিল, বাকিটা ওর বাবা মানে তোমার ভাই (শ্রী অয়ন কুমার চট্টোপাধ্যায় ) গড়েছে।’ ভরে উঠল হৃদয়, জ্যাঠাইমা না থেকেও রয়ে গেছে। এইভাবেই তো থেকে যায় আমাদের পূর্বসুরীরা,আমাদের মধ্যে দিয়ে। থেকে যায় তাদের শিক্ষা- সংস্কৃতি, আশির্বাদ। নাঃ কিছুই হারায় না মশাই। কোথাও না কোথাও থেকে যায় সবটুকুই।


পর্ব - ২ 



#অনিরডাইরি #কাঁথিরকিস্যা 


আইবুড়ো ভাত বেশ কয়েকজনকে খাওয়ালেও, অপৈতে ভাত ইতিপূর্বে কখনও কাউকে খাওয়াইনি। সত্যি কথা বলতে কি, এমন যে কিছু আছে তাই তো জানতাম না। আমার মাতৃকুল কায়স্থ, ফলে ওদিকে কারো উপনয়নের গল্প ছিল না। আর পিতৃকুলে যে সব ভাইদের উপনয়ন হয়েছে তা এমন মান্ধাতার আমলে হয়েছে যে কেবল ন্যাড়ামুণ্ডি হওয়া ছাড়া কোন স্মৃতিই তেমন নেই আর। 


কিছুদিন আগে জনৈকা বন্ধুপুত্রের উপনয়নের ছবি দেখতে গিয়ে প্রথম জানতে পারি অপৈতেভাতের কথা। তখনও বুল্লু বাবুর উপনয়ন জল্পনা-কল্পনার স্তরে। কথা প্রসঙ্গে অপৈতেভাতের কথাটা তুলেছিলাম, ব্যাপারটা কি এবং কেন ইত্যাদি। বুল্লুবাবুর জননী ওরফে আমার ভ্রাতৃবধু চৈতি বুঝিয়ে বলল,‘ ও দিদিভাই, পৈতে হলে তো এক বছর আঁশ খাওয়া নিষেধ। মাছ-মাংস- ডিম- পেঁয়াজ কিছুই খেতে নেই। তাই আর কি, সবাই অগ্রিম ডেকে পেট পুরে খাইয়ে দেয়।’ 


 বুল্লুকুমার কি আদৌ এক বৎসর নিরামিষাশী হয়ে থাকতে পারবে? একথা ভাই ভূতেও বিশ্বাস করবে না। তা নাই করুক, আচার বিধি নাই মানতে পারুক, আমি ওকে খাওয়াবই, অপৈতেভাত। সেই মত যবে থেকে দিন স্থির হয়েছে, আমি পর্যায়ক্রমে সবার পিছনে পড়ে থেকেছি। ওরে আয় রে, হবু ব্রহ্মচারীকে একটু পেট পুরে খাওয়াই। 


দেখতে দেখতে,যাচ্ছি- যাব করতে করতে দিন গড়ায়। ২২ তারিখে উপবীত ধারণ করবেন শ্রীমান বুল্লু। ১০ই ফেব্রুয়ারি দুপুর বেলা ফোন করে অয়ন, বুল্লু বাবুর পিতৃদেব। ‘শোন না তোকে নেমন্তন্ন করতে যাব ভাবছি। এই রবিবার।’ শুনে লাফিয়ে উঠি আমি। আয় ভাই,আয়। নেমন্তন্ন না করলেও চলবে, ব্যাটাকে অপৈতেভাতটা খাওয়াই। কিভাবে আসবি, কি ভাবে যাবি এই সব কথায় কথায় জানতে পারলাম, অয়ন ভাবে এখনও বুঝি আমরা তাম্রলিপ্ত নগরীর নিবাসী। ‘কেন? দাশনগর থেকে ট্রেন ধরব। মেচেদায় নামব। না হলে বেলেপোল থেকে ফাঁকা বাস ধরে নেব, নিমতৌড়িতে নেমে পড়ব।’ বলি তারপর? অকুতোভয় অয়ন বলেই চলে, “তারপর আর কি? ওখান থেকে তো তোদের বাংলো হাঁটা পথ।”


হাসি চেপে বলি, একদম হাঁটা পথ। গুগলে বলছে বেশি না তেরো ঘন্টা হাঁটলেই কেল্লা ফতে। “অ্যাঁ?” আঁতকে ওঠে অয়ন। “তোরা এখন কোথায় থাকিস রে?” হোক কাঁথি, তাও বদলায় না পরিকল্পনা। ভোরের তাম্রলিপ্ত এক্সপ্রেস ধরে এসে হাজির হয় সবাই। রাতের কাণ্ডারী ধরে ফিরে যায়। “নিরাপদে বাড়ি পৌঁছেছি রে“ মেসেজটা যখন এসে পৌঁছায় তখন মধ্য রাতি পেরিয়ে গেছে। 


ওদের ওপর ব্যাপারটা অকথ্য নির্যাতন হলেও আমাদের যে কি আনন্দে কেটে যায় দিনটা। মনের মত করে বাগানের ফুল তুলে এনে সাজিয়ে দিই বুল্লু বাবুর থালাবাটি। চৈতি আবার দৌড়ে গিয়ে তুলে আনে আরোও কিছু ফুল। একই রকম ভাবে খেতে দেওয়া হয় শ্রীমতী তুত্তুরীকেও। সকাল থেকে যিনি মুখ ভার করে ঘুরছিলেন আর থেকে থেকে নালিশ করছিলেন, ‘কেন? কেন? শুধু দাদা কেন? কেবল ছেলেদেরই কেন? মেয়েদের কেন পৈতে হয় না?” নালিশ শুনতে শুনতে বিরক্ত হতে হতে মনে পড়ে যাচ্ছিল কয়েক দশক পূর্বে এমনিই এক হিংসুটে মেয়ের কথা। যার পিঠোপিঠি খুড়তুতো ভাইদের যখন পৈতে থুড়ি উপনয়ন হচ্ছিল এমনিই তীব্র ঈর্ষার জ্বালায় জ্বলছিল মেয়েটা। এমনি ভাবেই নালিশ করে বেড়াচ্ছিল তার বাবার পিছন পিছন। আর তার বাবা বলছিল,‘ মেয়েদের যদিও উপনয়ন হয় না, তা না হোক। তোর আমি পৈতে দেবো। ন্যাড়া হবি তো? ভেবে দেখ-”। বুঝতেই পারছেন আশা করি মেয়েটা কে? আর তার রাম-ফাজিল বাপটাই বা কে। চিত্রনাট্য একই থাকে মশাই, সময়ের সাথে সাথে শুধু বদলে যায় কুশীলব। এই যা।




পর্ব - ৩


রাত সাড়ে চারটে। দধিমঙ্গল হবে বুল্লু বাবুর। একদম বিয়ের মতই, সূর্যোদয়ের আগে পেট পুরে দই,চিঁড়ে,সন্দেশ মেখে খেয়ে নিতে হবে। এরপর খেতে পাবে সেই বিকালে, যজ্ঞাদি মিটলে, দণ্ডীঘরে ঢুকে। তাও ডাল-ভাত-মাছ নয়। চরু। চরু জিনিসটা কি, ঠাকুমা বলত বটে, এখন আর বিশদে মনে নেই। পায়েসের মত কিছু একটা। 


এত ভোরে বুল্লু আদৌ উঠতে পারবে কি না, তাই নিয়ে রীতিমত দুশ্চিন্তায় ছিলাম আমরা। আমি স্বয়ং উঠতে পারব কি না, ভয় ছিল তা নিয়েও। গতকাল কাঁথি ছেড়ে যখন বেরিয়েছি তখনও নটা বাজেনি।হাওড়া ঢুকতে ঢুকতে ঘড়ির কাঁটা গড়িয়ে গেছে পৌনে ছয়ের ঘর। খুব ইচ্ছে ছিল সকাল সকাল আসার। কিন্তু সাম্প্রতিক সরকারী নির্দেশনামার পরিপ্রেক্ষিতে ছুটি তো দূর, অর্ধদিবস ছুটিও অসম্ভব ছিল। তাও বড় সাহেবকে অনুরোধ করে একটু আগে বেরিয়ে এসেছি। সন্ধ্যে থেকে আনন্দনাড়ু ভাজার কথা-


আমাদের যাবতীয় শুভ অনুষ্ঠানের আগের দিন চালের গুঁড়ো, সাদা তিল, নারকেল কোরা, আর আখের গুড় দিয়ে একটা নাড়ু ভাজা হয়। আমরা বলি আনন্দনাড়ু।আমার বিয়ের আনন্দনাড়ু ভেজেছিল আমার জ্যাঠাইমা আর বড় মাসি মিলে। নিমন্ত্রণ করতে এসে বুল্লুর বাপ অর্থাৎ অয়ন অনুরোধ করেছিল এসে নাড়ু ভাজায় হাত লাগাতে। এই নাড়ু সবাই ভাজতে পারে না। যাদের পরিবারে এই নিয়ম আছে, কেবল তারাই নাকি হাত লাগাতে পারবে। নিকটাত্মীয় কারোরই তেমন নেই, যাদের আছে তাদের সবাইকে অনুরোধ করা হয়েছে। অয়ন সাগ্রহে আমার কাছে জানতে চাইল, ‘তোদের আছে তো?’ 


আমাদের অর্থাৎ ভটচায বাড়ির? কখনও তো দেখিনি বা শুনিনি। কাকে শুধাই? আমার বরের মতই আমার শ্বশুরমশাই জন্ম নাস্তিক। শাশুড়ীমাতাও তেমন নিয়ম জানেন না। ফলে আমি বেশীর ভাগ ক্ষেত্রে আজও চাটুজ্জে বাড়ির নিয়মই অনুসরণ করি। বিস্তর ভাবনা চিন্তা করে, শেষ পর্যন্ত ফোন করলাম ছোট খুড় শ্বশুরকে। শৌভিকের ছোটকাকার থেকেই আমি জেনেছিলাম আমাদের গোত্র কি। এটাও নির্ঘাত উনিই বলতে পারবে। ভদ্রলোককে ওণার ভ্রাতুষ্পুত্ররা মোমো বলে সম্বোধন করে, আমিও তাই বলেই ডাকি। প্রশ্ন করলাম, ‘হ্যাঁ গো মোমো, আমাদের আনন্দনাড়ু আছে?’ প্রথমে তো বললেন না। তারপর খানিক ভেবে বললেন, এটা কি সেই চালের গুঁড়ি আর তিল দিয়ে বানায়? আমি উৎসাহিত হয়ে বললাম, হ্যাঁ,হ্যাঁ। ওটাই। ওটাই। আছে কি আমাদের কুলে? মোমো খানিক মাথা চুল্কে বলল,‘হত তো আগে। তবে ওকে আনন্দনাড়ু বলে কি না জানি না। দাঁড়া তোর কাকিমার সাথে কথা বল।’ ছোট খুড়ি শাশুড়ি মাতা অভয় দিলেন, ‘হ্যাঁ। হ্যাঁ। আমাদের আছে। আমাদেরও আনন্দনাড়ুই বলে। তুই নির্ভয়ে ভাজগে যা।’ 


নিয়ম যতই থাকুক, সরকারী চাকরবৃত্তি করলে কি আর ওসব হয়। ভাগ্যে চৈতির(বুল্লুর মা) মেজ পিসি এসেছিলেন,ওণাতে আর আমার মায়ে মিলে যখন কড়ায় নাড়ু ছাঁকতে শুরু করেছেন তখন গিয়ে পৌঁছালাম আমি। নাঃ কেউ কথা রাখে না, এমনকি আমি নিজেও না। 


পুনশ্চ - ধুতিটা কিন্তু বুল্লু বাবু নিজেই পরেছে। ঘুম চোখে এত অল্প বয়সে, এত ভালো করে ধুতি পরতে আমি আজ অবধি কাউকে দেখিনি। ❤️❤️


অনির (বুল্লুবাবুর উপনয়নের) ডাইরি, ২২শে ফেব্রুয়ারি, ২০২৩

পর্ব - ৪


ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। তুত্তুরীকে বলে শুয়েছিলাম, মাত্র পনেরো মিনিট শোব। যদি ঘুমিয়ে পড়ি, সোয়া ছটা বাজলে ডেকে দিস তো। তুত্তুরী ডেকেছে, তার ওপর ভরসা না করে সেট করে রাখা মোবাইলের অ্যালার্ম তো বেজে গেছে,আমি শুনতে পাইনি। নিথর হয়ে ঘুমিয়েছি কে জানে কতক্ষণ। শীত বিদায় নেবার সাথে সাথেই যেন বহুগুণ বেড়ে গেছে পথশ্রমের ক্লান্তি। পথশ্রমে কেন যে ক্যালোরি পোড়ে না ভগবান জানে। এত লম্বা লম্বা দূরত্ব গ্যাঁট হয়ে বসে পাড়ি দিই, তাও একটুও কমি না মাইরি। উত্তর-মধ্য-অন্ধ্র যাবতীয় প্রদেশের আয়তন ক্রমবর্ধমান। 


সাতটা নাগাদ কোন মতে নিজেকে চাগিয়ে তুললাম সুপ্তির অতল খাদ থেকে। ঘর ফাঁকা। পাশ থেকে মোবাইলটি হাতিয়ে কখন সটকে পড়েছেন শ্রীমতী তুত্তুরী। বাইরে থেকে ভেসে আসছে শানাইয়ের মধুর আওয়াজ। সদর দরজার মাথার ওপর ঝলসাচ্ছে ঝর্ণা আলোর রোশনাই। স্বর্গীয় ছোটকাকুর বসার ঘর, রান্নাঘর থেকে ভেসে আসছে নারীকণ্ঠের কলকাকলি। গোটা বাড়িটার গায়ে আজ লেগেছে উৎসবের ফাগ। সদ্য ভাজা আনন্দ নাড়ুর সৌরভে মম করছে চারিধার। চৈতির মেজোপিসির সঙ্গে সই পাতিয়েছে আমার মা। কি খোশগপ্পই যে করছে দুই জনে, সবাইকে ছাপিয়ে শোনা যাচ্ছে দুই বৃদ্ধার কলতান। অবশ্য বৃদ্ধা বললে পিসিমা হয়তো লাঠির বাড়ি আমাকে দিতেও পারেন দুয়েক ঘা। 


এও যেন এক রূপকথা। বুল্লু বাবুর উপনয়নের আনন্দনাড়ু ভাজছে তার মেজ জেঠঠাকুমা আর মেজো পিসিদিদা। আজকালকার দিনে কটা ছেলে/মেয়ের এমন সৌভাগ্য হয়। এত কিছু ভেবে আরোও ঘুম পেয়ে গেল যেন, কোন মতে টলতে টলতে বাবাকে গিয়ে বললাম,‘ যা যা করার কাল করব কেমন? আরেকটু ঘুমাই, কেমন বাবা?’ 


যা যা করা বলতে, বেশ অনেককিছুই করার আছে, যেমন ধরুন মায়ের ব্লাউজ কেনা। শাড়ির সঙ্গে ম্যাচ করে মায়ের ব্লাউজ কেনার কাজটা বোধহয় আমি নবম বা দশম শ্রেণী থেকে করে আসছি। হাওড়া ময়দানের যাকে বলে ওয়ার্ল্ড ফেমাস ইন হাওড়া দি বসাক ব্রাদার্স ছাড়া অন্য কোন দোকানের ব্লাউজ মায়ের কোনদিন পছন্দ হয়নি। উৎসবে অনুষ্ঠানে বসাকে খুনোখুনি করার মত ভিড় হয়, তাও আমায় যেতে হত এবং হয় মায়ের শাড়ি বগলে। শুধু যে মারামারি করে কিনে আনব আর মিটে যাবে তা কিন্তু নয়। রঙমিলান্তি একটা বড় চাপের ব্যাপার। নীল মানে এমন নয়, অমন নীল। সবুজ পানে হলুদ নয় ইত্যাদি প্রভৃতি। ধরুন ঐ পরীক্ষাতেও আমি পাশ করে গেলাম, তারপর মা নাক সিঁটকাবে, ‘কাপড়টা কি? রুবিয়া? ভয়েল? অরবিন্দ মিল?’ ধরুন এটার জবাবও আমি দিতে পারলাম। এরপরের প্রশ্ন, ‘এঃ হাতাটা কত বড়/ছোটরে। এ চলবে না পাল্টে নিয়ে আয়।’ শুধু কি হাতা? ‘পিটটা এত কাটা কেন? এটা কি প্রিয়াঙ্কা চোপড়ার ড্রেস?’ মায়ের পৃথিবীতে এই একজনই আছেন যিনি খোলামেলা পোশাক পরেন। অন্য কারো নামধাম আমার মায়ের কোন কালে মনে পড়ে না। সবকিছুতেই এটা তো প্রিয়াঙ্কা চোপড়ার ড্রেস বলে নাক সিঁটকায় মা। আবার যদি পিঠ ঢাকা ব্লাউজ আনি তো, শুনতে হয়,‘এটা কি এনেছিস?এটা পরে তো আমার গরমে ঘামাচি বেরিয়ে গেল।’ আরোও আছে, হুক গুলো এত বাজে ভাবে বসানো কেন? সেলাই করেছে দেখ যেন মানুষ সেলাই করেছে ইত্যাদি প্রভৃতি। 


দীর্ঘ দিন ধরে এই কাজ করছি তাও আজ পর্যন্ত একটাও মায়ের মনোমত ব্লাউজ আনতে পারিনি। যবে থেকে পৈতের দিনস্থির হয়েছে রোজ ফোনে একটাই কথা বলে যাচ্ছে মা, ‘আমায় একটা ব্লাউজ কিনে দিস তো। পৈতের দিন পরব।’ বসাক ব্রাদার্স খোলে বেলা বারোটার পর। ফলে কাল সকালে বেরিয়ে কিনে আনতে আনতে আর মায়ের পরা হবে না। দুচোখে পাঁচ কেজির বাটখারা চাপানো, কিন্তু হৃদয়ে যে কাঁটা ফুটছে। মেয়েটাও কাল শাড়ি পরবে। ওর আপাততঃ একটাই ব্লাউজ। ও মহানন্দে তাই পরতে রাজি হয়ে গেছে যদিও। কিন্তু আমি মা হয়ে সেটা কেমনে হতে দিই। 


সাড়ে সাতটার সময় শেষে থাকতে না পেরে, গুগল করে ফোন নম্বর বার করে, ফোন করেই ফেললাম বসাক ব্রাদার্সে। চেনা কণ্ঠ বলল, আটটায় বন্ধ হয়ে যাবে। ঊর্দ্ধশ্বাসে পোশাক বদলে দৌড়ালাম। দৌড়ানোর আগে বাবার হাত থেকে ছিনিয়ে নিলাম ভিক্ষা দেবার সরঞ্জামের তালিকা। হবু ব্রহ্মচারীকে ভিক্ষা দেবে মা। এই ভিক্ষার থালা এবং উপকরণ নিয়েও কয়েকদিন ধরে দাম্পত্য যুদ্ধ চলছে আমাদের গৃহে। বাবা চায় কাঁসার থালা। মায়ের মত স্টিল। কাজে আসবে। কাঁসা আজকাল কেউ ব্যবহার করে নাকি? 


প্রথম রাউন্ডে অবশ্য বাবা জিতেছে। কাঁথি থেকে বড় কাঁসার থালা কিনে বাবু অভিজ্ঞান চট্টোপাধ্যায়ের নাম এবং উপনয়নের দিনটির বাংলা তারিখ লিখিয়ে দিয়ে গেছি আমি আগেই। সে কি কেলেংকারি। কার্ডটা না নিয়েই দোকানে চলে গেছিলাম আমি। অত্যন্ত আত্মবিশ্বাসের সাথে বলেছি লিখে দিন মাঘ, ১৪২৯। বাংলা সাল নির্ণয় আমার বরাবরই নিখুঁত কিন্তু তারিখ সম্পর্কে কোন ধারণাই থাকে না। দোকানদারই বললেন, ‘ম্যাডাম তারিখটা ফোন করে জেনে নিন না। তারিখ সমেত লিখি, ভালো লাগবে।’ ফোন করে জানতেও চাইলাম বুল্লুর বাপের কাছে। সে তখনও অফিসের কাজে ব্যস্ত। বলল,‘বাড়ি গিয়ে তোকে রাতে জানাচ্ছি।’ অত রাত অবধি কাঁথির দোকান খোলা থাকবে নাকি? দোকানদারই শেষে কোথা থেকে ছেঁড়া বাংলা ক্যালেণ্ডার যোগাড় করে লিখে দিল ৯ই ফাল্গুন,১৪২৯। 


যাই হোক,থালার যুদ্ধে বাবা জিতলেও,ভিক্ষা সামগ্রীর যুদ্ধে মাই জিতেছে শেষ পর্যন্ত। বাবা যদিও সহজে হার মানেনি। রীতিমত পুরোহিত মহাশয়কে ফোন করে জেনে, একগাল মাছি হওয়া সত্ত্বেও টুকে রেখেছে কি কি আনতে হবে। ব্লাউজ পর্ব সফল ভাবে মিটিয়ে গেলাম কদমতলা বাজারে। সেখানে তখন বিশাল ভীড়। পত্নীসহ বিসর্জনে চলেছেন ভোলেবাবা। উদ্দাম ঢাক ঢোল বাজাচ্ছে ভূতপ্রেতের দল। বাতাসে ফুরফুরে গাঁজার সৌরভ। পাশকাটিয়ে যাওয়া দুষ্কর।


 কোনমতে চাল, ফল,মিষ্টি, হরিতকী, পৈতে ইত্যাদি বগলে যখন টোটোয় উঠলাম, ঘড়ির কাঁটা নটা ছুঁইছুঁই। আমার উল্টোদিকে আমারই মত কেউ বসে আছে, তারও মুখেচোখে সারাদিনের পরিশ্রম আর শ্রান্তির কালিমা। সহমরমি দুই জোড়া ঢুলুঢুল চোখ একে অপরের ওপর পড়তেই ঝলমলিয়ে উঠল যেন শহরটা। আরে এতো আমাদের অদিতি। দুইজনেই ‘তারাসুন্দরী’, দীর্ঘদিনের সহপাঠী। 


আমাদের বিদ্যালয়ে পদবীর প্রথম অক্ষর ধরে বিভাগ নির্ধারিত হত। যেমন আদক থেকে দাসেরা ক বিভাগ। আবার মণ্ডল,মুখার্জী, নন্দীরা গ বিভাগ।আমি চাটুজ্জে তাই আমার সেকশন ছিল এ আর অদিতি লাহা ছিল বলে সম্ভবতঃ বি। জীবন বড় নির্মম, স্কুলের নিরাপদ পরিমণ্ডল ছেড়ে বেরিয়ে আসার পর সময়ের অভিঘাতে ক-খ-গ-ঘ সব মিলেমিশে একাকার। গোটা রাস্তা স্কুলের মেয়েদের মতই কলকল করতে করতে এলাম আমরা। একে অপরকে শোনালাম, “-- কী রকম ভাবে বেঁচে আছি, তুই এসে দেখে যা।” নিজেরাই তাজ্জব হয়ে গেলাম, আমরা কি সত্যিই এতটাও সবলা ছিলাম! শৈশবে বুঝিনি তো। বুঝলেই বা কি হত? অন্যরকম হত কি জীবনটা? লেখা হত অন্য কোন গপ্প? নাঃ মশাই, এই বেশ ভালো আছি। 


ঝাউতলায় নেমে গেল অদিতি, ‘তোর ভাড়াটা দিয়ে গেলাম,তুই আবার দিতে যাস না। আর একদিন মিট করি চল -’ বলে। আবার খানিক ঝিমিয়ে পড়ল যেন বুড়ো শহরটা। গোটা পাঁচেক ব্যাগ বগলে লটরপটর করতে করতে বাড়ি পৌঁছে দেখি বুল্লুর বাপ বসে আছে আমারই প্রতীক্ষায়। সুসংবাদ দিলেন। কাল সকাল চারটের সময় উঠতে হবে। সূর্যোদয়ের পূর্বে বুল্লুবাবুকে দধিমঙ্গলে বসতে হবে। প্রয়োজন তিনজন এয়োস্ত্রীর। বুল্লুর মা-দিদিমা ছাড়া অপর ভাগ্যবতী আমি। যৎপরনাস্তি পুলকিত হয়েও খেয়াল হল, এই রে পট্টবস্ত্র পরতে হবে তো।সাকুল্যে এনেছি তিন সেট জামাকাপড়। একটা পরে এসেছি এবং বাজার গেছি। অন্যটা পরে রাতে ঘুমাব আর তৃতীয়টা কাল অনষ্ঠান বাড়িতে পরব। অপারগতা জানিয়ে বললাম,‘মাকে নিয়ে যা না।’ সিঁড়ি ভাঙার নামে ককিয়ে উঠল মা। আর অয়নও নস্যাৎ করে বলল,‘মানার (আমার মা এবং অয়নের জেঠিমা) একটা শাড়ি পরে নিবি। আমি তোকে চারটের সময় ফোন করব।’ 


অয়নের ফোনের ভরসায় না থেকে ভাগ্যে মোবাইলে অ্যালার্ম দিয়েছিলাম। আমি উঠলাম, মায়ের কাচা শাড়ি পরলাম, মুখ ধুলাম,মাথায় গঙ্গা জল ছিটালাম, বাইরে রোয়াকের আলো জ্বালালাম,তালা খুললাম,মোবাইলে ফেসবুকও দেখে ফেললাম প্রায় মিনিট বিশেক কেউ ডাকে না। শেষে বিরক্ত হয়ে আমিই ফোন করতে গেলাম, ওরা আদৌ উঠেছে কি না জানতে। এদিকে চারটে সাঁইত্রিশ বাজে। ফোন করতে গিয়ে দেখি আমার ফোনটাই চমকে বসে আছে। ফোন যাচ্ছে না অর্থাৎ আসছেও না। সাহস করে দরজা খুলে উঠোনে যখন নেমেই পড়লাম উল্টোদিকের বারন্দা থেকে অয়ন বলল,‘তুই উঠেছিস? আমি তো ভাবছি মেজ জেঠু উঠে আলো জ্বেলে সিগারেট খাচ্ছে বুঝি।’ বোঝ কাণ্ড। আমায় যে কেন কেউ সিরিয়াসলি নেয় না। শাশুড়ি মাতা যথার্থই বলেন, "বেঁচে থেকে আর লাভ নেই।"


অনির (বুল্লুবাবুর উপনয়নের) ডাইরি, ২২শে ফেব্রুয়ারি, ২০২৩

পর্ব - ৫



পেশাদার চিত্রগ্রাহিকা বলেছিলেন, "গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানটা বাইরে করুন না।প্লিজ।" চৈতি বলল, " কেন?সব যোগাড় তো এই ঘরেই করা হয়েছে।" মেয়েটি বলল, " আসলে বাইরে তুললে প্রেক্ষাপটটা বেশ ভালো আসত। এখানে 🫤।" চৈতি কখনও গলা তুলে কথা বলে না। হুকুম করে না। তবে সেই মুহূর্তে চৈতির কণ্ঠ স্বরে ফুটে উঠল, এক অদ্ভুত ঋজুতা। " না এখানেই তুলুন। পিছনে এই ছবি দুটো যেন থাকে।" যাঁরা চেনেন না তাঁদের উদ্দেশ্যে বলি ছবি দুটি হল আমার স্বর্গীয় ছোট কাকু এবং কাকিমা অর্থাৎ অসিত কুমার চট্টোপাধ্যায় এবং কণিকা চট্টোপাধ্যায়ের। চৈতির শ্বশুর শাশুড়ি এবং বুল্লু বাবুর পিতামহ এবং পিতামহী। দুজনেই নেই আজ বেশ অনেক গুলো বছর।


অনির (বুল্লুবাবুর উপনয়নের) ডাইরি, ২২শে ফেব্রুয়ারি, ২০২৩

পর্ব - ৫


আমার জননী এবং আমার কন্যা। দুজনকেই সাজানোর কৃতিত্ব এই অধমের। দ্বিতীয় জন সানন্দে সাজুগুজু করে নিলেও,প্রথম জনকে সাজাতে হয়ে গেছে একখানা ছোট্টখাট্টো কুরুক্ষেত্র। আমার মায়ের বক্তব্য হল,‘সাজবি তো তোরা। আমি বুড়ো মানুষ, খামোখা আমায় নিয়ে টানাটানি কেন?’ বললেই হল? কমলি কি অত সহজে ছাড়ে? আর এক্ষেত্রে কমলি তো আর সংখ্যায় একটা নয়। 


বিগত সপ্তাহান্তে, শ্রীমতী তুত্তুরীকে হাওড়া ছাড়তে গেছি, সদর দরজার বাইরে থেকে শুনতে পাচ্ছি মায়ের রাগত কণ্ঠস্বর। মায়ের নিষেধ সত্ত্বেও আমার তিরাশি পেরোনো বাপ গিয়ে পাড়ার দোকান থেকে কিনে এনেছে চুলের রঙ। বুড়ি মেজ জেঠিকে রোয়াকে বসিয়ে মিষ্টি মিষ্টি কথায় ভুলিয়ে তাই লাগিয়ে দিচ্ছে আমার খুড়তুতো ভাই অয়ন। মা দিব্যি রোদে বসে মাথায় কলপ থুড়ি রঙ করছে এবং চাটুজ্জে গুষ্ঠির মুণ্ডপাত করছে। দেখে মন ভরে গেল। প্রতিনিয়ত ভাগ্যের কাছে কতই না অভিযোগ করে মা হাঁটুর ব্যথা, অবসাদ, আমার বাড়ি থেকে বহুদূরে পোস্টিং, বাবার মাত্রাতিরিক্ত সিগারেট খাওয়া, খকখকে কাশি ইত্যাদি প্রভৃতি। যা নেই তার শোকে মা যে কেন দেখতে পায় না, আদতে মা কত ধনী। মায়ের সম্পদ নিক্তিতে মাপা যায় না, এই যা। 


চুল তো হল, এবার পোশাকের পালা। কিছুতেই ভালো শাড়ি পরবে না মা। এমন একখান শাড়ি পরল যেটা ২০১৩ সালে আমিই এনে দিয়েছিলাম আগ্রা থেকে। বাঁশ না কলার খোসা কি দিয়ে যেন তৈরি শাড়িটা। ১৪০ না ১৫০ টাকা দাম নিয়েছিল যেন। একেবারে ন্যাতা এবং জ্যালজেলে শাড়ি। উৎসব বাড়িতে অন্য সবার ঝকমকে পোশাকের পাশে আমার মা প্রায় অদৃশ্য। অতঃপর রীতিমত খণ্ডযুদ্ধ, শ্রীমতী তুত্তুরীর গ্যালন খানেক অশ্রুপাতের পর নমনীয় হল মা। ভালো শাড়ি পরবে বটে, তবে তা যেন ভারি না হয়। হলহলে সিল্কের না হয়। চকরাবকরা না হয়। ইত্যাদি,প্রভৃতি। ভদ্রমহিলার নক্সা কি কম। 


অনেক ভেবে চিন্তে জ্যাঠাইমার দেওয়া এই শাড়িটা বার করলাম। আইবুড়ো ভাত খাইয়েছিল জ্যাঠাইমা এই শাড়িটা দিয়ে। শাড়িটা আমার ভয়ানক,ভয়ানক পছন্দ ছিল। মহানগরে পোস্টেড থাকাকালীন যতবার মাননীয়ার প্রোগ্রাম হয়েছে আর আমার স্টেজ ডিউটি পড়েছে, এই শাড়িটাই পরে গেছাি আমি। বারবার। লাগাতার। কে বলবে শাড়িটার বয়স ১৪ বছরেরও বেশী। 


আর শ্রীমতী তুত্তুরীর শাড়িটার বয়স কত বলুন তো? পাক্কা ২৪বছর। দাদার বিয়েতে পাওয়া। জীবনে প্রথম বার ননদ হিসেবে কিছু পেয়েছিলাম। দাদা বৌদির ফুলশয্যার তত্ত্বে নিজের নাম দেখতে পাওয়া, সে যে কি আনন্দ, ভাষায় অপ্রকাশ্য। বউদির বাপের বাড়ি থেকে পাঠানো উপহার,তাই কেবল বৌদির অনুমতি নিয়েই ট্রেটা তুলে নিয়েছিলাম। তখনও আমি অপ্রাপ্তবয়স্ক। আরো অনেকের অনুমতি নেওয়া উচিৎ মাথাতেও আসেনি। ছোট থেকে জানি,চার দাদার একমাত্র বোন আমি। গুরুজনরা যে ভিন্ন মত পোষণ করেন, তা বোঝার মত পরিপক্কতা আমার ছিল না। ওনারা যদি একবারও বলতেন, আমি নিতাম ও না। সবটাই ছিল এক নাবালিকা তরুণীর নিছক আনন্দ।      


যাঁরা সমালোচনা, পরচর্চা করেন,তাঁরা তো বেশ রসিয়ে আলোচনা করেন, যাদের নিয়ে করেন,ব্যাপারটা তাদের কাছে যে কতটা বেদনার তা বোঝেন না। আর কখনও কারো বিয়ের পর কিছুতে হাত দিইনি। আমার নাম লেখা ট্রে হলেও না। বৌদিরা ডেকে, ভালোবেসে হাতে তুলে দিয়েছে, মেজ বৌদি তো ট্রে বগলে চলেই এসেছে আমাদের বাড়ি। তাও হাত বাড়িয়ে নিতে কেঁপেছে হাত। আবার না কেউ কিছু বলে বসে। আবার না মাকে শুনতে হয়, 'মেয়েকে কোন শিক্ষা দিসনি।' এমনও হয়েছে,ট্রে খুলে আসে পাশে উপস্থিত সকলের মধ্যে ভাগ বাটোয়ারা করে দিয়েছি বডি স্প্রে,পাউডার, আয়না, চিরুনি ইত্যাদি। তাও মোছেনি দাগ। তাও ভরেনি ক্ষত। এমনও ভাবতাম যে, যেদিন বেকারত্ব ঘুচবে, বেতন পেয়ে সব কিছু দুটো করে কিনে প্যাক করে ফেরত দিয়ে আসব। যেদিন সত্যিই রাইটার্স বিল্ডিং এর কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রিজ এ অবর বর্গীয় সহায়কের চাকরিটা পেলাম, প্রথম বেতন হাতে এল, ৬০৩৬ টাকা। ততোদিনে কেটে গেছে সাত বছর। বেড়েছে পরিপক্কতা। সেদিন মনে হল, যদি সত্যিই ফেরত দি, তাহলে সেদিন যারা সমালোচনা করেছিলেন তাদের আদৌ কিছু যায় আসবে না। অপমানিত হবে আমার বৌদি আর তার পিতামাতা। তাঁরা তো একদিনের জন্যও কিছু বলেননি। তাঁরা তো বরং বারবার ভালোবেসে জানতে চেয়েছেন, আমার কেমন লেগেছে শাড়িটা। কতটা পছন্দ হয়েছে তত্ত্ব ইত্যাদি। 


 ভীষণ পছন্দ হলেও, অভিমান করেই বহুদিন পরিনি শাড়িটা। তোলা ছিল আলমারির কোণে, নরম কাপড় মুড়ে। ভুলেই গিয়েছিলাম শাড়িটার কথা।দাদার উপনয়নে শাড়ি পরার অনুমতি পেয়ে আহ্লাদিত শ্রীমতী তুত্তুরীই খুঁজে বার করেছিলেন শাড়ি খানা। ভেবেছিলাম পাটে পাটে ফেঁসে গেছে বুঝি। মেয়েকে পরাতে গিয়ে দেখলাম আজও নতুন আছে শাড়িটা। নাহ্ এ তো সুন্দর শাড়িটার ওপর অভিমান করাটা আমার মস্ত ভুল হয়েছে। শাড়ি গুলো তো নিছক শাড়ি নয়, প্রতিটা শাড়ি আসলে একেকটা ইমোশন। প্রতিটা শাড়িই আসলে একটা উপন্যাস।