Thursday 14 July 2022

অনির ডাইরি ১০ই জুলাই, ২০২২

 

#তাম্রলিপ্তকড়চা 



শুধু একবার ধুয়োটা তুলতে হত। যে কোন উৎসব, তা সে যে কোন ধর্ম বা সম্প্রদায়েরই হোক না কেন, পালন করতে সদা প্রস্তুত থাকত টিম চুঁচুড়া। আমার টিম চুঁচুড়া। এই ধরণের যাবতীয় বিদঘুটে পরিকল্পনার সুপ্ত বীজ, উপ্ত হত অবশ্যি এই অধমের উর্বর মস্তিষ্কে। আমি ধুয়ো তোলার পর, সেইসব ভুলে ভরা অবাস্তব পরিকল্পনাকে কেটে ছেঁটে বাস্তব রূপ দেবার দায়িত্ব নিত কৌশিক আর সঞ্চিতা। দুটোই ছিল ভয়ানক বাস্তববাদী। ওদের শিলমোহর পড়লে তারপর আসত ফাণ্ডের প্রশ্ন। এই নিয়ে মস্তিষ্ক প্রক্ষালনের দায়িত্ব ছিল সিকেসিও শুভজিতের। সবশেষে জানানো হত এসএলওদের। 'অমুক দিবসে, বৈকাল অমুক ঘটিকায় অনুগ্রহ করিয়া সমবেত হইয়া ধন্য করিবেন আঞ্চলিক শ্রম দপ্তর চুঁচুড়াকে।' 


সবাই কখনই আসতে পারত না, গুটি কয়েক লোকজনই আসত, বারবার ঘুরিয়ে ফিরিয়ে। পুরসভার বিদ্যুত, রেশমা আর চন্দ্রা, মগরার সংগ্রাম, মাম্পি,প্রিয়াঙ্কা আর পুজা, পোলবার রমেশ, প্রদীপ,সমীর, দেবী দি, মিঠুদি, কুমকুমদি, বাঁশবেড়িয়ার মহুয়াদি,নূপুর দি, ধনিয়াখালি থেকে অমৃতা, কৌশিক, পাণ্ডুয়া থেকে শান্তনু, আশিষ আর অভিষেক এবং বলাগড়ের শ্যামল। 


পুঁচকে আপিস, এত লোককে বসতে দেবার মত জায়গাও থাকত না, তাতেও দমত না লোকজন। নিজেদের আপিস মনে করে চলেই আসত। শ্যামল বলত,‘মন্দির’। কোর্ট বন্ধ হবার পর, 'সূর্য যখন অস্তে পড়ে ঢুলি- ', বুড়ো কালেক্টরেট জুড়ে ছড়িয়ে পড়া ছুটির মেজাজ, ব্যাগ গোছাত অন্যান্য দপ্তরের কর্মচারীবৃন্দ, পিছনের বারন্দাটা তখন গমগম করত, শুধুই আমাদের জন্য। 


SLOদের একটু দেরী করে জানানোর কারণ হল, রমেশ, মাম্পি এবং প্রিয়াঙ্কার কানে খবরটা একবার ঢুকলে, আর পরিকল্পনা বাতিলের সুযোগ থাকত না। রমেশের আনাগোণা বেশী ছিল বলে, আভাস পেয়েই যেত। আমরা চুপচাপ থাকলেও নানা অছিলায় ঐ প্রসঙ্গটাই তুলত, আশানুরূপ জবাব না পেলে শুকনো মুখে এসে বসত আমার উল্টো দিকের চেয়ারে, ‘ম্যাডাম, এবারে কি রথে জিলিপি পাঁপড় হবে না?’ 


রথের জিলিপি পাঁপড়, সে তো সবাই বাড়িতে খাই, কিন্তু আপিসে গোল হয়ে বসে ভাগ করে খাবার কি যে আনন্দ, তা কেবল বুঝত আমার টিম চুঁচুড়া। আপিসটাও তো একটা পরিবারই ছিল আমাদের, ভালোবাসা, রাগ অভিমান, ঝগড়া, চোখের জলে মাখামাখি একটা বৃহত্তর পরিবার।


যাই হোক, দিনক্ষণ ঠিক হয়ে যাবার পরই গঠিত হত অনেকগুলি কমিটি। যেমন আপিস সাফাই এবং সাজানো কমিটি। এতে থাকত প্রীতি, প্রিয়াঙ্কা, প্রদীপ আর আমাদের সুইপার তথা মালি তথা ষাটোর্ধ্ব এ্যাংগ্রি ইয়ং ম্যান অজিত দা। এক দফা সাফাই অভিযানের পর আসত রমেশ এবং কেঁচে গণ্ডুষ করত এতক্ষণের সাফাই অভিযান। বারন্দার গাছগুলোকে কাটছাঁট করে মেকাপ করাত মাম্পি। পড়ন্ত বিকেলের কনে দেখা আলোয়,  অন্য সময়ের অগোছাল সরকারী অফিসটাকে সেইদিন গুলোতে যেন চেনাই যেত না।


 খাবার কমিটিতে থাকত সোমনাথ,রমেশ আর ধীমান। মেনু সোমনাথ আর ধীমানের। প্রথমেই বলে দেওয়া হত, ‘বাপু হে এই অনুষ্ঠানে কিন্তু খাসি হবে না।’ 'অঃ খাসি হবে না', শুনেই ঝুলে যেত ধীমানের মুখ। আর সোমনাথ ডুব দিত গভীর চিন্তাসমুদ্রে। শেষ পর্যন্ত যা মেনু হত,সেটা ফেলতে হত কৌশিক সঞ্চিতা আর অরুণ বাবুর সামনে। খেয়ে পেটখারাপ করবে কি না বা অসুখবিসুখ বাঁধবে কি না এই নিয়ে চর্চার পর, অবশেষে পড়ত শিলমোহর। 


এরপর ধীমান আর রমেশ একচোট হাতাহাতি করত কোথা থেকে আনা হবে। ধারে নগদে যারা দেয়, তাদের খাবার তেমন পছন্দ হয় না এদের। রথের জিলিপিপাঁপড় অবশ্যি ধারে কেনার দরকার হত না, ওটা আমি খাওয়াতাম। পাঁপড়টা কিনে এনে প্রদীপ চা ওয়ালাকে দেওয়া হত,  ভালো তেলে মুচমুচে করে ভেজে দেবার জন্য। অতঃপর নির্দিষ্ট সময়ে একই সঙ্গে এসে হাজির হত জিলিপি আর পাঁপড়। আমার ঘরের পাখা, বাতানুকূল যন্ত্র সবকিছু বন্ধ করে কাগজের থালায় ঢালা হত স্তুপীকৃত জিলিপি আর পাঁপড়। হাতে হাতে চলে আসত আপিসের সব চেয়ার। বসে পড়ত যে যার বাঁধা জায়গায়। আমার ডানপাশের তোয়ালে ঢাকা চেয়ারটা নির্দিষ্ট থাকত চন্দননগরের বড়সাহেব তথা বড়দির জন্য। সবার মাথা হওয়া সত্ত্বেও শত অনুরোধেও ওণারা বসতেন না আমার চেয়ারে। টেবিলের সামনের চেয়ারগুলোয় বাঁ দিক থেকে বসত চঞ্চল, অরুণ বাবু, দর্প, সঞ্চিতা, কৌশিক আর নির্মল। পিছনের চেয়ারের একদম বাঁহাত থেকে বসত ধীমান,সোমনাথ,শুভজিৎ,প্রীতি ইত্যাদিরা। বিদ্যুতের জীবনেও বসার জায়গা হত না, ও বেচারী হাসি মুখে দাঁড়িয়ে থাকত দরজার কাছে। সবার আগে ছবি তুলত রমেশ, অতঃপর,‘টুট পড়ো’। 


এক বছরের মধ্যেই বদলে গেছে চিত্রটা। পুরাণ মুখগুলোর জায়গা দখল করেছে নতুন মুখের দল। কুশীলব বদলে গেছে বটে চরিত্রগুলো বদলায়নি। বদলায়নি চিত্রনাট্য ও। এখানেও ধুয়ো তুলি আমি। সেটা নিয়ে গভীর চিন্তাভাবনা করে আরএলও ইন্সপেক্টর সৌরভ আর পুরসভার ইন্সপেক্টর বেদজ্যোতি। অফিসে জিলিপি, পাঁপড় ব্যাপারটা কতটা বাস্তবসম্মত। অতঃপর ফাণ্ডের জন্য ফাইল যায় সিকেসিও শুভাশিষের কাছে। এবার ব্যাগড়া দিই আমি, আর ফাইল চালাচালির দরকার নেই বাপিরা। তুচ্ছ জিলিপি পাঁপড় স্পনসর্ করাটা আমার দায়িত্ব। আপিস সাজানো গোছানোর দায়িত্ব নেয় চঞ্চল,শুভাশিস আর উত্তম। বস্তাবন্দী হয়ে আবর্জনারা গুদামজাত হয়, সদ্য কেনা কন্টিনজেন্সি মালপত্র ভাগ করে পৌঁছে দেওয়া হয় ব্লকের শ্রমিক কল্যাণ সহায়তা কেন্দ্রগুলিতে। 


খাবার কমিটি হয় হক বাবু, শান্তনু আর অরূপকে নিয়ে। সরু জিলিপি না মোটা জিলিপি এই নিয়ে চলে দ্বন্দ্ব। ব্যক্তিগত ভাবে আমি রসে টইটুম্বুর মোটা বাঙালি জিলিপি ভালোবাসি। এদের অধিকাংশই সরু মুচমুচে জিলিপির পক্ষপাতী। পাঁপড় নিয়েও চলে বিস্তর অঙ্ক কষা। পাঁপড় কিনে এনে কাকে দিয়ে ভাজানো হবে? কারোর তেলের ওপরেই ভরসা করতে পারেন না হক বাবু। আমাদের চঞ্চল আবার দীক্ষা নিয়েছে, আঁশ খায় না। আপিসে যাবতীয় খাওয়াদাওয়ার সময় চঞ্চল শুকনো মুখে মুড়ি চিবোয়। কাজেই ভালো দোকান থেকে কিনতে হবে। 


অবশেষে অনেক গবেষণা করে, ডিমারীর রথের মেলা থেকে অর্ধ সুপ্ত জিলিপিওয়িলির ঘুম ভাঙিয়ে জিলিপি পাঁপড় ভাজিয়ে, চেখে কিনে আনে অরূপ, আশিষ আর উত্তম। চুঁচুড়ার মতই গাদাগাদি করে আমার চেম্বারে জড় হয় সবাই। আপিসের শেষ চেয়ারটাকে ঢুকিয়েও সবার জায়গা হয় না, জহর বাবু শেষে একটা টুল টেনে এনে বসেন। পাখা বাতানুকূল যন্ত্র বন্ধ করে দরদর করে ঘামি আমরা। জিলিপি আর আসে না। কই রে ভাই? ঠোঙাগুলো দেখিয়ে কোথায় গেল আশিষ আর অরূপ। বলতে না বলতেই কাঁসার থালায় সুন্দর করে সাজানো গুটি কয়েক বাটিতে করে চলে আসে জিলিপির দল।বুঝতে পারি,এদের সুন্দর করে পরিবেশনের তাগিদেই দেরী হচ্ছে। দূর দূর,অত সাজাতে হবে নি, দুটো থালায় উপুড় করে ঢেলে ফেল সবকিছু। ভাগ করে খাই সবাই। 


অ্যাসিড, গ্যাস,বদহজম নিপাত যাক, এমনি সৌহার্দ্যপূর্ণ মিষ্টিমধুর থাকুক আমাদের তাম্রলিপ্ত আঞ্চলিক শ্রম দপ্তর। সকলকে রথ এবং উল্টোরথের বিলম্বিত শুভেচ্ছা। জিলিপির রসের মত মধুর আর পাঁপড়ের মত মুচমুচে কাটুক আপনাদেরও দিনগুলি।

অনির ডাইরি ৮ই জুলাই, ২০২২

 

আমার আর তুত্তুরীর কাছে, হাওড়া হল উৎসবনগরী। পাঁচশ বছরের বুড়ি শহরটায় পা দিলেই কেবল হইচই আর আড্ডা। চাটুজ্জে বাড়ির বৈঠকখানাটা যেন গমগম করে আমাদের উপস্থিতিতে।  রাত যত গভীর হয়, ততোই চড়া হয় আড্ডার মেজাজ। তিন প্রজন্ম মিলে আড্ডাবাজদের সংখ্যা নেহাৎ কম না,  পিসি আর বাবা দুভাইবোন, অয়ন- অনিন্দ্য- অনিন্দিতা আমরা তিন খুড়তুতো- জেঠতুতো ভাইবোন, শ্রীমান বুল্লু কুমার আর শ্রীমতী তুত্তুরী দুই মামাতো-পিসতুতো ভাইবোন, মা আর চৈতি, চাটুজ্জে বাড়ির দুই প্রজন্মের দুই কুলবধূ সব মিলিয়ে বাবার ভাষায়, ‘এক কম কুরু বংশের ১/১০ অংশ।’  


খানা পিনা ছাড়া কি আর আড্ডা জমে, খানা বলতে জমিয়ে মাখা মুড়ি, কাপের পর কাপ চা ছাড়াও কখনও আসর মাতায় কদমতলা়র ফ্রেন্ডস কেবিনের জিভে জল আনা মোগলাই পরোটা, কখনও বা বেদুইনের রোল, কিছুক্ষণ রেস্তোরাঁর চাউমিন আর চিলিচিকেন, কখনও বা সর্দারজির ধাবা থেকে আনা ডিম তড়কা আর রুমালি রুটি। আর পিনা বলতে জিরের গন্ধওয়ালা নিরামিষ পানীয় বিশেষ। অন্য পানভোজনের আলোচনা চলে বটে পুরোদমে, আজগুবি পরিকল্পনাও হয় বিস্তর, যেমন ধরুন আমি যোগাড় করব গাঁজা, অয়ন যোগাড় করবে কল্কে আর গাঁজা সাজার দায়িত্ব নেবে বাবা। বেশি না সবার জন্য এক ছিলিম ব্যাস্।  মাইরি বলছি এ পরিকল্পনা আমরা বোধহয় তুত্তুরীর বছর পাঁচেক বয়স থেকে করে আসছি। আগে নেশার গল্পগাছা হলে প্রচণ্ড ক্রুদ্ধ হত মা, আজকাল আমাদের দৌড় বুঝে আর কিছু বলে না। প্রসঙ্গতঃ ইদানিং আমরা সবাই মিলে শ্রীমান অনিন্দ্যর পিছনে পড়ি মহুয়া খাবার জন্য। ব্যাটা কোথায় যেন দেখে এসেছে সিলড্ মহুয়া মাত্র কুড়ি টাকা লিটার। প্রাপ্তবয়স্ক গুলোকে ওটা খেতে এবং খাওয়াতেই হবে মাইরি। 


আকাশকুসুম নেশার পরিকল্পনা চলে, বাবা-পিসি এবং আমাদের শৈশবের স্মৃতিচারণ চলে, চাটুজ্জে বাড়ি আর মুখুজ্জে বাড়ি অর্থাৎ বাবাদের মামার বাড়িতে ঘটে যাওয়া নানা গা ছমছমে ভৌতিক গল্পের চর্বিতচর্বন চলে, অতীতের না না রসাল গল্প হয় আর হয় গানবাজনা। কয়েক হাজার বার বলা ও শোনা গল্প গুলো যখন সাময়িক ভাবে পুরাণ হয়ে যায়, হঠাৎই খালি গলায় গান ধরে অয়ন। 


অনেক তৈলমর্দন করলে টুকটাক গান গায় বুল্লু বাবু, মামির সঙ্গে ডুয়েট গায় তুত্তুরী। মায়ের দর বরাবরই বেশি, মধ্যরাত্রি সমাগত হলে তবে তাঁর গান গাইতে ইচ্ছে টিচ্ছে করে। ‘মন মোর মেঘের সঙ্গী’ হয়ে তুত্তুরীর হাত ধরে নাচে চৈতি। এমনকি আসুরিক গলায় গান গাই আমিও, বাড়ির মধ্যেই তো। 


নাচার পালা হলে, মা আর পিসির হাত ধরে টানি। হাত তুলে মারের ভঙ্গি করে মা।  পিসি কিন্তু কোমরে আঁচল জড়িয়ে রেডি, ‘ইনি-বিনি-টাপা-টিনি’। খানিক নেচে হাঁপিয়ে যায় পিসি, রিমোটে গান পজ করে অনিন্দ্য। ৮৭ বছর বয়সে ভাইপো ভাইঝি নাতি নাতনীদের সাথে নাচার ক্ষমতা কজন বাঙালি মহিলার থাকে মশাই। আমার পিসি সত্যিই অসামান্যা। 


চাগিয়ে বড় স্পিকারটাকে দোতলা থেকে নামিয়ে আনে অনিন্দ্য। ভাগের গান বাজে, একেক জনের মর্জি মত এক একটা গান। কেউ যেন বঞ্চিত না হয়।  এমনিই করে থাকি আমরা। এটাই আমাদের পার্টি।


 মায়ের প্রিয় মাধুরী চট্টোপাধ্যায়ের মধু ঢালা কণ্ঠ গেয়ে ওঠে, ‘ ঐ যে সবুজ বন বিথীকায়, দূর দিগন্তেরও সীমানায়-’। বাবার শাম্মি কাপুরের ওষ্ঠ হেলনের আড়াল থেকে সঙ্গত করেন মহঃ রফি সাহেব, ‘ও দিল লেনে ওয়ালোঁ দিল দেনা শিখখো জী।’ 


আমার জন্য মুকেশ জী গান ধরেন, ‘ওঃ মেহবুবা, তেরে দিল কে পাশ হি হ্যায় মেরি মঞ্জিল এ মকসুব-’। রেশ মেলায় না, দুই খুদের দাপটে মঞ্চে নেমে পড়ে শ্রেয়া ঘোষাল, জুবিন নাটিয়াল আর অরিজিৎ সিং।


 পিসির পালা আসে, অনিন্দ্য ফাজালামি মারা উদাত্ত কণ্ঠে জানতে চায়, ‘দিদি, ও দিদি, কি গান শুনবে গো তুমি?’ বাবার দিদিকে যে আমরা প্রজন্মের পর প্রজন্ম দিদি বলে ডাকি, তা আশা করি জানেন সকলেই।  লাজুক হেসে অনেক ভেবে চিন্তে জবাব দেয় দিদি,‘তুই সেই যে গানটা শোনাতিস না-’। লক্ষ্য আমি।  কোন গানটা? ‘ঐ যে রে, যাও পাখি বলো তারে, সে যেন ভোলেনা মোরে-’। নতুন চাকরি পেয়ে কেনা প্রথম ল্যাপটপে কবে যেন শুনিয়েছিলাম গানটা, কোন বাংলাদেশী শিল্পীর কণ্ঠে। শৈশবের গান শুনতে শুনতে ভিজে উঠেছিল পিসির চোখ, সে অনেক অনেক কাল আগের কথা। তখনও আমি অনুঢ়া, শ্রীমতী তুত্তুরী জন্মাতে আরো বছর আড়াই তিন। আর বু্ল্লু বাবু তো সদ্যোজাত। 


‘ কি গান বাছলে গো দিদি-’ বলতে বলতে ইউটিউব স্ক্রল করতে থাকে অনিন্দ্য। রাত বাড়ে, বাকিরা ব্যস্ত হয়ে পড়ে খুচরো খুনসুটিতে, সিগারেট ফুঁকতে যায় বাবা, দাম্পত্য কলহে লিপ্ত হয় মা, সবার জন্য খাবার গরম করতে যায় চৈতি, ঢাকের সাথে টেমটেমির মত বড় মামীকে অনুসরণ করে তুত্তুরী।  


সবকিছু থেকে নির্লিপ্ত, ঘোলাটে চোখে ছাতের কড়িকাঠের দিকে তাকিয়ে থাকে পিসি। পাশে গিয়ে বসতেই এক গাল হাসে। মা আর ছোট কাকিমা দুজনেই কর্মরতা ছিলেন বলে আমরা তিন ভাইবোনই ঠাকুমা আর পিসির কাছে মানুষ। ওদের চোখে আমরা তিনজনই সমান হলেও  আমার সঙ্গে পিসির সম্পর্কটা বরাবরই একটু অন্য মাত্রা পায়। পাবে নাই বা কেন, সেই নার্সারি থেকে দশম শ্রেণী পর্যন্ত পিসির হাত ধরেই তো স্কুলে গেছি আমি। ছুটির সময় পিসির ছাতার তলায় সেঁদিয়ে বাড়ি ফিরেছি। ব্যাঁটরা পাবলিক লাইব্রেরিই বলুন বা তারাসন্দরী বালিকা বিদ্যাভবন, স্কুল পাল্টেছে, পাল্টায়নি পিসির আর আমার সমীকরণ। শুনলে হয়তো হাসবেন, প্রথম কলেজের দিনেও বাজার যাবার অছিলায় গেট পর্যন্ত ছেড়ে এসেছিল পিসি। আমার আইনানুগ বিবাহের সাক্ষী হয়েছিল পিসি আর অগ্নিসাক্ষী করে বিয়ের বেলায় দিনভর অভুক্ত থেকে সম্প্রদান করেছিল পিসি। সম্প্রদান করতে করতে সে কি কান্না পিসির। পাশে একটা চেয়ারে লাঠি হাতে রাজার মত বসেছিলেন আমার জেঠামশাই, কান্না যে কি ছোঁয়াছে হয় সেদিন দেখেছিলাম। পিসিকে দেখে প্রয় শিশুর মত ফুলে ফুলে কাঁদতে লেগেছিল জেঠুও। সে কি বিড়ম্বনা। 


পিসির পাশে বসে, শিরা ওঠা খসখসে হাতটা নিজের হাতে নিয়ে বললাম, ‘আমার সাথে তমলুক যাবে দিদি?’ নিভন্ত দুই চোখ পলকে জ্বলে ওঠে দপ্ করে। ‘তমলুক? সে তো অনেএএক দূর।’ বলি, আমাদের উত্তমকুমারের তুফান মেল আছে তো। দেড়শো বছরের বুড়ো বাড়ি আর বাড়ির সদস্যদের জন্য চিন্তিত হয়ে পড়ে পিসি। ‘ আমি না থাকলে কি হবে?’


 সত্যিই তো, ঠাকুমা চলে যাওয়া ইস্তক এই বুড়ো বাড়িটার প্রতিটি কোণে যে নজরদারি চলায়, সে আমার পিসিই তো। কে কখন বেরোচ্ছে, কে কখন ঢুকছে, কোন দরজায় ছিটকিনি লাগানো হয়নি,।  কোন জানলার পাল্লা ভালোমত লাগছে না, কোথায় কাপড় শুকাতে দিয়ে বেমালুম ভুলেছে মা বা চৈতি,  সব খেয়াল রাখে পিসি। ঈশ্বরের কৃপায় কোন ব্যধি নেই আমার পিসি থুড়ি দিদির। ইদানিং কানে একটু কম শুনছে, আর হাঁটুর ব্যথাটাও অল্প বেড়েছে। তাই নিয়েই দিনরাত কাজ করে চলে পিসি। অপ্রয়োজনে চার বার ঝাঁট দেয় গোটা বাড়ি। এঁটো বাসন পড়ে থাকতে দেখলেই দৌড়ে গিয়ে মেজে দেয়। অয়ন সেদিন বিরক্ত হয়ে বলছিল,‘বয়স্ক লোকজনকে কোথায় বলতে হয়, অত বসে থেকো না। একটু নড়াচড়া করো। আর আমাদের দিদিকে দেখ, একে হাত জোড় করে বলি তুমি একটু সুস্থির হয়ে বসো, অত কাজ করতে হবে না। তাও শোনে না।’ 


তমলুক ভ্রমণের কথা শুনে পিসির চোখে হাজার ওয়াটের আলো জ্বলে উঠেও নিভে গেল। ‘আমি কি পারব?’ 


সবাই মিলে,সমস্বরে বললাম, পারবে না মানে? অয়ন বলল,‘ তবে দিদি, দোহাই যে শাড়ি গুলো বাড়িতে পরো,সেগুলো নিয়ে যেও না। আর প্রেশারের ওষুধটা অবশ্যই নিও। আর চশমাটাও। নাঃ থাক, দাঁড়াও আমিই গুছিয়ে দেব তোমার ব্যাগটা।’  


বাচ্ছা আর বয়স্কদের খাইয়ে আমাদের খেতে বসতে বসতে রাত সাড়ে বারোটা। পিসি তখনও দোদুল্যমান। হয়তো মানসিক সমর্থন পেতেই বলল, ‘অনেকদিন তো এ বাড়ি ছেড়ে কোথাও যাইও নি বল-’। ঠিক কাকে উদ্দেশ্য করা বলা কেউ বুঝল না, অয়ন বলল, ‘ আরে দিদি মন খারাপ করছ কেন? আজ রাতে ফুরফুরে মন নিয়ে ঘুমিয়ে পড়ো, কাল উত্তম কুমার আসবে তোমায় নিয়ে যেতে।’ ‘অ্যাঁ উত্তম কুমার? সে আবার কি?’ ভেবলে গিয়ে প্রশ্ন করে পিসি। হেসে কুটোপুটি খেতে খেতে অয়ন বলে, ‘কেন ওর ড্রাইভারের নাম যে উত্তমকুমার তুমি জানো না।’ অতঃপর ‘ তিন ভাইপো ভাইঝি আর দুই নাতি নাতনীর সম্মিলিত চিৎকার, ‘ভদ্দর ঘর কি লড়কি ভাগি ডেরাইভার কে সাথ-’। রাত একটা অবধি 'ছোঃ ছোঃ ছোঃ কেয়া শরম কি বাত' চলল আমাদের। প্রায় জোর করেই মজলিস ভঙ্গ করল মা। পরদিন সকাল আটটায় রওনা  দিতে হবে যে আমাদের। 


স্কুল ছুটি থাকার সৌজন্যে দাদু-মাম্মাম(দিদা) আর দাদা (বুল্লুবাবু)কে ছেড়ে নড়ল না তুত্তুরী। মাত্র দুটো দিনের তো ব্যাপার। কাল বাদ পরশুই ফিরে আসতে হবে আমাদের, পিসিকে যত্নপূর্বক পৌঁছে দিতে হবে তাঁর ভাইপোদের জিম্মায়। ব্যাগ সমেত পিসিকে গাড়ি অবধি ছাড়তে এল তুত্তুরী আর তার বড় মামা। যত্ন করে চামড়ার নরম ব্যাগে পিসির জামাকাপড় গুছিয়ে দিয়েছে অয়ন। চেনের খাপে রেখেছে টাকার ব্যাগ, প্রেশারের ওষুধ। সুন্দর করে চুল বেঁধে এমনকি নেল পলিশও পরিয়ে দিয়েছে দিদিকে। উত্তমকুমারের গাড়ির জানলা দিয়ে ছুটে আসা উদ্দাম হাওয়া অবশ্য পিসির যতনে বাঁধা চুলগুলিকে এলোমেলো করে দিচ্ছে। অবাক দৃষ্টিতে দুপাশে ছুটে চলা মানুষ, গাড়ি আর বাড়ি দেখছে পিসি। বাগনানের কাছে অসময়ের রুগ্ন দামোদর দেখে হতবাক হয়ে যায় পিসি। এই নাকি বাংলার দুঃখ? কোলাঘাটে রূপনরায়ণের বিস্তৃত রূপ দেখে অধিকতর হতবাক হয়ে পড়ে পিসি। দূরে রেল ব্রিজের ওপর দিয়ে উল্টোদিকে ছুটে চলা ট্রেন দেখে নিজের শৈশবে ফিরে যায় পিসি। উত্তমকুমার ওদিকে বলেই যায়,‘ আপনাকে আজ বিকালে বর্গভীমা মন্দির দেখতে নিয়ে যাব পিসিমা। কাল দীঘা যাবেন নাকি?’ বয়সজনিত শ্রবণশক্তি হ্রাস আর হাওয়ার দাপটে ভালো বুঝতেও পারে না পিসি। হাসে শুধু কান এঁটো করে।কানের গোড়ায় মুখ নিয়ে গিয়ে ফিসফিস করে  শুধাই আমি,‘দিদি তোমার ভালো লাগছে তো?’ শীর্ণ হাতে আমার হাতটা চেপে ধরে বলে পিসি,‘ভীষণ ভালো লাগছে। ভাগ্যে তুই বললি আর ওরা জোর করে পাঠাল। এবার দেখ না, মাঝে মাঝেই জ্বালাব তোকে। বলব,তমলুক নিয়ে চ-’। জীবন বড় অনিশ্চিত,কে জানে কি লুকিয়ে আছে কালের গর্ভে, সম্বল বলতে শুধু এই অমৃত মুহূর্তটুকুই তো। 



অনির ডাইরি ১লা জুলাই, ২০২২

 


এক বছর! মাত্র একটা বছরের মধ্যে আমূল বদলে গেল সবকিছু। বেশ তো গতানুগতিক ছন্দে চলছিল জীবন। বদলির অর্ডার তো বেরিয়েছিল আমার, চুঁচুড়া থেকে বিধাননগর। কারা যেন পরিহাসের ছলে মৃদু অনুযোগও করছিল তাই নিয়ে, ‘তোমায় তো পাড়ায় পোস্টিং দিল গো-।’ 


সেই মত, ক্যাশবুক গুলো শেষ করে, এক তাড়া গ্রাচুইটির কেসের অর্ডার লিখে, মহানগরে প্রবেশের জন্য প্রস্তুত ছিলাম আমি। এবার মুভমেন্ট অর্ডারটা বেরিয়ে গেলেই হয়। আমরা যারা বাইরে থেকে মহানগরে ঢুকতাম,রোজই কথাবার্তা - মেসেজ চালাচালি হত, বেরোল? মুভমেন্ট অর্ডার কি বেরোল? করোণা ভীতি ঝেড়ে ফেলে ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হচ্ছিল জীবন। গত বছর ১লা জুলাই ছিল বৃহস্পতিবার। শুক্রবার দিনটা ছুটি নিলে, টানা চারদিন ছুটি। সুযোগের সদ্ব্যবহার করে ব্যাগপত্তর গুছিয়ে তুত্তুরী সহ রওণা দিয়েছিলাম হাওড়া। 


দোসরা জুলাই, সন্ধ্যে বেলা, উদ্দাম আড্ডা বসেছে বাবার একতলার বৈঠকখানায়। এমন শোরগোল করছি আমরা, যে  ঠাকুমা থাকলে নির্ঘাত বলত, আমাদের চিৎকারের  ঠেলায়, ‘বাড়িতে কাক উড়ছে, চিল পড়ছে।’ হবে নাই বা কেন? আড্ডাবাজদের সংখ্যা কি কম? বাবারা দুই ভাইবোন, আমরা তিন খুড়তুতো জেঠতুতো ভাইবোন, তুত্তুরীরা তুই মামাতো পিসতুতো ভাইবোন, সর্বোপরি দুই কুলবধূ, মা আর চৈতি। 


আড্ডার ফাঁকে শৌভিকের ফোন। দুই ভাই কি সব ফাজিল মন্তব্যও করল তার জন্য। হট্টোগোল থেকে দূরে সরে গিয়ে, ফোনটা কানে ধরতেই, ওপাশ থেকে শৌভিকের চূড়ান্ত আবেগবিহীন কেজো কণ্ঠস্বর। ‘কপাল পুড়েছে-’। মানে? মানেটা শৌভিক বলার আগেই আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল,‘ এসডিও অর্ডার বেরিয়েছে?’ এটাকেই বোধহয় মহিলাদের ইনট্যুশন বলে। আমি বলি ভাইবস্। বেশ কিছুদিন ধরেই টের পাচ্ছিলাম, বলছিলামও শৌভিককে, ‘তুই বাপু বাঁচবি না। এসডিও তোকে হতেই হবে-।’ 


এরপরের প্রশ্ন অবধারিত ভাবেই, কোথায় হল? জবাব এল তমলুক। এরপরের প্রশ্ন, জানলি কি করে? জবাব এল ‘এষা।’ প্রশ্নটা না করলেও পারতাম, কারণ ততোক্ষণে আমার ফোনে এষার কল ওয়েটিং আসা শুরু হয়ে গেছে। কি প্রবল উৎসাহ নিয়ে খবরটা শুনিয়েছিল এষা, সেই উত্তাপের সিকি ভাগও ফেরৎ দিতে পারিনি আমরা। সেটা নিয়ে মৃদু অনুযোগও করল পাগলি মেয়েটা। ‘দেখ না দিদি, দাদা বলছে,দাদা নাকি জানত না। তা তোমরা আমাদের পার্টি দিচ্ছ কবে-’। জানতাম না তো কেউই, কবে যে ফাইল উঠল, কবে যে সই হল, ধুৎ জীবন কেন যে এত অঘটনঘটনপটিয়ী। 


অতঃপর খবর দেওয়া আর অভিনন্দন গ্রহণ করার পালা। গভীর রাতে,নিদ্রিত তুত্তুরী আর তন্দ্রাচ্ছন্নভাব মায়ের পাশে শুয়ে ফিসফিসে বার্তালাপ। ‘ কত লোক আমাদের অর্ডার বেরোনোর খবর রাখে রে-’, দাড়ি চুলকাতে চুলকাতে বলে শৌভিক। এমন দিনে একসাথে না থাকতে পারার অস্বস্তিতে ভুগছি দুজনেই। শৌভিক জানায়, কে যেন ওকে অভিনন্দন জানিয়ে ফোন করে বলেছে, অমুক মন্ত্রী সম্পর্কে তার মামা আর তমুক অফিসার পিসেমশাই হয়। খামোখা চমকে যে লোকজনের কি লাভ হয়। তবে উভয়ের বন্ধুবান্ধবরাই খুব উচ্ছ্বসিত। অর্জুন তো শ্রীমান কুট্টুসের ছবি সম্বলিত একটা কার্ডই বানিয়ে পাঠিয়েছে, ‘কি আনন্দ, মামা এসডিও হয়েছে, ভৌ উউউ’। খুশি আমার চুঁচুড়ার সহকর্মীরাও। খুশির লহর কেবল অনুপস্থিত উভয়ের পরিবারে। কারোরই বাবা-মা যেন খুশি নয়। তমলুক চলে যাবে শৌভিক। প্রতি সপ্তাহে ফিরতেও পারবে না, এটা যেন কিছুতেই হজম হচ্ছে না কারো। শ্বশুরমশাই তো যেন কাকে বলেই ফেলেছেন,‘জ্যেষ্ঠ পুত্রের বাইরে চলে যাওয়ায়, আমি বেশ বিপন্ন বোধ করছি।’ 


অন্যায় তো কিছু বলেননি, শৌভিকের চলে যাওয়ার সম্ভবনাতেই বিপন্ন বোধ করছি আমি। বড় পরিশ্রমী আমার বর। সকালে বিছানা ঝাড়া থেকে দোকানবাজার, জামাকাপড় কাচা (অবশ্যই মেসিনে), বাথরুম(মেঝেটা, ইয়েটা অবশ্য আমার জিম্মেদারি ) পরিষ্কার কতকাজ যে দায়িত্ব নিয়ে করে সংসারে, সেটা ভাবতে বসে পাগল পাগল লাগে। গোটা বাড়ির চালিকা শক্তি তো ওই। সবথেকে বড় কথা, কলকাতা উত্তরের নির্বাচনী দপ্তরে পোস্টিং হওয়ার দরুন আমার পরে বেরোয় এবং আমার আগে বাড়িতে ঢোকে শৌভিক। মেয়েটাও যে বড্ড বাপ সোহাগী।  


বললাম, আমিও তমলুকে বদলি হয়ে যাই বরং। প্রায় মারমূর্তি ধরল শৌভিক। কি দরকার? কোন পাগলে নিরাপদ নির্ঝঞ্ঝাট বিধাননগর ছেড়ে স্বেচ্ছায় ঝঞ্ঝাট চূড়ামণি পূব মেদিনীপুরে যায়? দেখতে দেখতে এসে গেল দিনটা।  ৯ই জুলাই, শুক্রবার একসাথেই বাড়ি থেকে বেরোলাম দুজনে। গ্রীলের গেট ধরে দাঁড়িয়ে থাকা তুত্তুরীর মুখে চোখে একটাই অনুনয়,‘ আজই ফিরে এসো কিন্তু বাবা।’ কিভাবে যেন আগেপিছেই রাখা ছিল দুজনের গাড়ি। শৌভিকের ক্রিম কালারের জাইলো। সিকিউরিটি মনোরঞ্জন বাবু নেমে স্যালুট করলেন, হাত থেকে ব্যাগটা নিতে গেলেন। ছেড়ে দিল দুজনের গাড়ি। নিবেদিতা সেতু পর্যন্ত বার বার ঘাড় ঘুরিয়ে দেখছিলাম একে অপরকে। তারপর দিল্লী রোড ধরলাম আমরা আর শৌভিকের গাড়ি রওনা দিল বোম্বে রোড বরাবর। 


সেদিন রাতে অবশ্যি ফিরে এসেছিল শৌভিক। শনি-রবি আর রথ নিয়ে পরপর তিনদিন ছুটি। সেই সপ্তাহান্তটা শুধু গল্প করেই কাটিয়ে দিলাম আমরা। মুগ্ধ হয়ে গল্প শোনাচ্ছিল শৌভিক, ‘এত সুন্দর কালেক্টরেট কোথাও দেখিনি। সবকিছু নতুন আর ঝকঝকে। আর ডিএম সাহেবের চেম্বারটা যা বানিয়েছে, উফঃ-’।  জানতে চাইলাম, এসডিওর বাংলো নেই? নিজের প্রসঙ্গে হাই তোলে শৌভিক, কেজো সুরে জানায়, ‘একটা হয়েছে শুনছি, নিমতৌড়ির ওখানে। কে যাবে? ওটা তো ভুষুণ্ডির মাঠ।’ জানায় ওর আপিসের পিছনের আবাসনে একটা ফ্ল্যাটেই আপাততঃ মহকুমা শাসকের নিবাস। শৌভিকও ওখানেই থাকতে চায়। ঘোরতর রকম শহরের মধ্যে, দোকান বাজার, তমলুক স্টেশন সবকিছু পা বাড়ালেই। মহকুমা শাসকের গৃহস্থালির ভারপ্রাপ্ত  লোকজনও খুব একটা ঐ ধাপধাড়া গোবিন্দপুরে যেতে উৎসুক নয়।


দেখতে দেখতে এসে গেল ১২ই জুলাই। কাল পাকাপাকি ভাবে তমলুক রওণা দেবে শৌভিক। তবে সে তো কালকের কথা, আজ যে রথ। ওপরের লফট থেকে নামানো হয় ভাইবোন সমেত জগু বাবুকে। নামানো হয়, খবরের কাগজের মোড়া তাঁর তিনতলা রথ।

বেলা বাড়ে, তুত্তুরীকে ছুটি দেয় না গোঁড়া ক্যাথলিক স্কুল। পড়ার ঘরে ল্যাপটপ চালিয়ে ঘাড় গোঁজ করে পড়তে বসে তুত্তুরী। ব্যাগ গোছাতে বসে শৌভিক। ব্যাগ গোছাতে গিয়ে আবিষ্কৃত হয়, টুকটাক কত কিছু কেনা বাকি। পোশাক পরিচ্ছদেরও যা হাল। পাকাপাকি ভাবে থাকতে হলে গোটা কয়েক জামাকাপড় কেনা বাধ্যতামূলক।  চটজলদি বেরোনোর তোড়জোর করি আমরা। তুত্তুরীর ক্লাশ শেষ হবার আগেই ফিরে আসব, মাত্র ঘন্টা খানেকের ব্যাপার। স্নানাহার ফিরে এসেই না হয়- 


ঠিক এগারোটা পয়ত্রিশে বাবার ফোন, আজও ভাসছে কথা গুলো ইথার তরঙ্গে, ‘তুমি কি ব্যস্ত আছ, আসতে পারবে? মা যেন কেমন-’।  ঠিক এই ভয়টাই পাই আমি সবসময়। ঠিক এই কথাগুলোই দুঃস্বপ্নে শুনি আমি, অসময়ে বাড়ি থেকে ফোন এলেই ধড়াস করে ওঠে বুক। যদিও প্রতিবারই প্রমাণ হয়, অকারণ আশঙ্কা করি আমি, আর যেদিন সত্যিই হয়, সেদিন কেন যে বাজে না কোন বিপদঘন্টি।


অনির ডাইরি ২৮ শে জুন, ২০২২


 

#তাম্রলিপ্তকড়চা 


অন্যান্য বারের তুলনায় এবারের দুয়ারে সরকার নিয়ে আমাদের উত্তাপ ছিল বেশ কম, তার অন্যতম কারণ অবশ্যি প্রকৃতি। মে মাসের তীব্র দাবদাহে পুড়ে যাচ্ছিল যেন চরাচর। এমন যে হবে তাতো জানাই ছিল, অন্যান্য কন্টিনজেন্সির সাথে তাই ওআরএসের প্যাকেটও দিয়েছিলাম আমরা। ক্যাম্প প্রতি তিনটে করে। যেদিন যে ক্যাম্পেই গেছি, সর্বাগ্রে জিজ্ঞাসা করেছি, ওআরএস খাচ্ছো তো? আগে প্রাণে বাঁচো, তারপর কাজ।


 বলেই দিয়েছিলাম, পারফর্ম করার ইঁদুর দৌড়ে আমরা, নেই এবার।  যেটুকু পারবে,সেটুকুই করবে, শুধু নিছক গতানুগতিক ভাবে করো না। কাজে যেন একটা প্রাণ থাকে, থাকুক না একটু চনমনে ভাব তবেই না কাজ করে আনন্দ। কাজ যা করবে, ছবি তুলবে তার চারগুণ।  আর কেউ দেখুক না দেখুক, আমি দেখব। আর কোথাও শেয়ার হোক বা না হোক আমি করব। করেওছি, ফেসবুক, হোয়াটসঅ্যাপ থেকে জেলাশাসক মহোদয়ের জেলা গ্রুপ, এমন কি লেবার কমিশনার সাহেবের রাজ্যের গ্রুপ, সর্বত্র। সগর্বে জানিয়েছি,অমুখ পেশার অমুক চন্দ্র অমুক বা শ্রীমতী তমুক কে পরিষেবা দিতে পেরে আমরা যৎপরনাস্তি গর্বিত। 


ছবি তোলা নিয়েও যে হয়েছে কত রগড়। বাচ্ছা কোলে মিষ্টি কোন মায়ের ছবি দেখে যেই বললাম দারুণ তো, অমনি শুধু মহিলার ছবিতে ভরে উঠল আমাদের গ্রুপ। সেদিন আমাদের শান্তনু হাসতে হাসতে বলছিল,‘ম্যাডাম আপনাকে খুশি করার জন্য তো লোকজন পারলে ছবি তুলতে পরের বাচ্ছা উঠিয়ে আনে।’ কি সর্বনাশ! ওসব করিস না বাবা। 


যদিও বলেছিলাম তেমন চাপ নেবার দরকার নেই, কোন টার্গেট দিচ্ছি না, যা পারো করো। ঝামেলা বাঁধাল চণ্ডীপুর। ব্যাটারা শুরু থেকেই এমন চালিয়ে খেলতে লাগল, রোদ গরম উপেক্ষা করেই হুহু করে উঠতে লাগল ডিএস। শহীদ মাতঙ্গিনী গতবারেও প্রচুর ডিএস ফেলেছিল, তড়িঘড়ি মাঠে নেমে পড়ল তারাও। সে কি প্রতিদ্বন্দ্বিতা দুপক্ষের। বিগত দুয়ারে সরকারে খুব খারাপ ফল করেছিল তমলুক পুরসভা। নতুন ইন্সপেক্টর বেদজ্যোতি সদ্য বদলি হয়ে এসেছিল আমাদের কাছে, আসতে না আসতেই তার ঘাড়ে চেপেছিল কোলাঘাট ব্লকের অতিরিক্ত দায়িত্ব। সব মিলিয়ে ঘেঁটে ঘ হয়েছিল পৌরসভার কাজ। রোজ বকতাম ব্যাটাদের। ব্লকের মত কাজ কখনই পুরসভা তুলতে পারে না। তাই বলে সামান্য নড়াচড়াও করবে না তোমরা? কোলাঘাট, তমলুক বা পাঁশকুড়া ব্লক কি এমন অপরাধ করেছে, যে তোমাদের দায়িত্ব ওদের ঘাড়ে করে বইতে হবে? 


আমার জিভের খোঁচায় নাকি বেদজ্যোতির ঘাড় থেকে কোলাঘাট নামার সৌজন্যে কি না জানি না, এবার প্রথম ক্যাম্প থেকেই ছুটতে শুরু করেছিল তমলুক পুরসভার ঘোড়া। মাঝে তো এমন দাঁড়াল, কয়েকটা ব্লকের থেকেও বেশি ডিএস পড়ে গেল পুরসভায়।  টুকটাক ডিএস পড়ছিল ময়নাতে, পাঁশকুড়া ব্লক বরাবরই আমাদের নাইটওয়াচম্যান। মেরে রান করে না বটে ব্যাটারা তবে ধরে রাখে উইকেট। পরিচ্ছন্ন ছোট্ট ইনিংস খেলে আউট হয়ে গেল তমলুক ব্লক। গতবারে তৃতীয় হয়েছিল ব্যাটারা। এবারে যে কিছু হবে না সেটা বেশ বুঝলাম আমরা। ধীরে ধীরে রান বাড়াচ্ছিল ময়না। প্রথম চোটে উদ্দাম দৌড়ে ক্রমশঃ বেদম হয়ে পিছু হটছিল চণ্ডীপুর।


 গতবারের চ্যাম্পিয়ন কোলাঘাটের বোধহয় ব্যাড প্যাচ চলছিল, কিছুতেই রান উঠছিল না। ক্যাম্পে গিয়ে সেটা বলেও এলাম, ঝাঁকিয়ে এলাম খানিক। ওঠো বাবারা। একটু নড়।  একটু অন্তত রান করার চেষ্টা করো। কোলাঘাট খালি বলে, ‘দেখছেননি অন্যান্য ব্লকে দিনে দুটো করে ক্যাম্প ম্যাডাম। আমাদের একটা। আপনি গড়ে হিসেব করুন।’ বয়ে গেছে গড়ে হিসেব করতে। আমি শুধু ফলাফল দেখব। কাজের চিন্তা তোমরা কর গা। 


সবার অলক্ষ্যে কখন যে নন্দকুমার মাঠে নেমেছে,বাকি রথী মহারথীরা খেয়ালই করেনি। খেয়াল করেছি কি আমিও? ব্যাটারা নেমেই যখন দমাদ্দুম ব্যাট চালিয়ে চার ছয় বাগাতে থাকল, তখন সবার খেয়াল হল, রাস্তায় হাতি নেমেছে। ৬তারিখ মধ্যরাত্রে যখন বন্ধ হয়ে গেল সার্ভিস ডেলিভারি, ততোক্ষণে সব রথী মহারথীদের বহু পিছনে ফেলে তমলুক মহকুমায় প্রথম স্থান অধিকার করেছে নন্দকুমার। দ্বিতীয় আর তৃতীয় কে হয়েছে তা অবশ্যি জানাই নি আমরা। থাকুক না একটু সাসপেন্স। ছটফট করুক না লোকজন,বেশি না, সামান্য একটু। মাত্র কটা দিন।


আজ সেই সাসপেন্সের পরিসমাপ্তি হল। প্রথম যে নন্দকুমার তা তো সবাই জানতই মোটামুটি। দ্বিতীয় স্থানে আমরা সবাই ভেবেছিলাম ময়না থাকবে বুঝি। শেষ মুহূর্তের স্কোর শিট মেলাতে গিয়ে দেখা গেল কি ভাবে যেন সেকেণ্ড পোজিশনটা দখল করে বসেছে কোলাঘাট। খরগোশ আর কচ্ছপের গপ্পের কচ্ছপের মত একদিকে নালিশ করে গেছে, দিনে একটা ক্যাম্প, নেট নেই, ডিএস ফেলতে দিচ্ছে নি, ভালো খেতে দিচ্ছেনি, কেবল ভাত আর বাঁধাকপি খাইয়েছে অমুক পঞ্চায়েত ইত্যাদি প্রভৃতি। অন্যদিকে তেমনি এগিয়েই গেছে ব্যাটারা, কখনও এলোপাথাড়ি ব্যাট চালিয়ে, কখনও সিঙ্গলস্ নিয়ে। ময়নার দৌড় এবারের মত এসে থেমেছে তৃতীয় স্থানে। তা হোক, সেটাই অনেক। ভুলে যাবেননি ময়না আমার সবথেকে দূরের ব্লক। দীর্ঘদিন ধরে ময়নায় কোন ইন্সপেক্টর নেই। কোন সিকেসিও নেই। নন্দকুমারের ইন্সপেক্টর রঞ্জিৎ রাণা আপাততঃ অতিরিক্ত দায়িত্বে আছে।


যাই বলুন আজ আমাদের রঞ্জিত রাণারই দিন। দুটো ব্লক থুড়ি এলডব্লুএফসির চার্জে আছে, যার একটা প্রথম আর একটা তৃতীয়। খোদ বড় সাহেবের হাত থেকে ট্রফি দেওয়া হল রঞ্জিতকে। এরপর না খাওয়ালে চলে মাইরি? ভুল বুঝলেন, আমরা খাওয়াব না, ফাস্ট বয় খাওয়াবে আমাদের।  যাই হোক বড়সাহেবের কাছে আমাদের কৃতজ্ঞতার শেষ নেই, চূড়ান্ত ব্যস্ততার মাঝেও স্যার বেশ অনেকটা সময় আজ কাটালেন আমাদের সাথে।  আমাদের সবার সাথে। স্যারের জন্যই বাজেট ভাঁড়ে মা ভবাণী হওয়া সত্ত্বেও সান্ত্বনা পুরষ্কার চালু করেছিলাম আমরা। এবারের সান্ত্বনা পুরষ্কার ছিল গাছ। ফলের গাছ। সৌজন্য আমার চুঁচুড়া পোস্টিং কালে হাড় জ্বালানো জনৈক ছোকরা উকিল। ব্যাটা বলেছিল, ‘পাখি গুলো আর বেশী দিন বাঁচবে না ম্যাডাম। না খেতে পেয়ে মরে যাবে সব। পাখিদের বাঁচাতে হলে ফলের গাছ লাগাতে হবে বুঝলেন-।’ যত পাগল কি আমার কপালেই জোটে। তা সেই পাগলের নির্দেশ শিরোধার্য করেই পেয়ারা, জামরুল আর লেবু গাছ দিলাম আমরা সান্ত্বনা পুরষ্কার হিসেবে। আর একটু সবুজ হোক না ধরা, আরো কিছুদিন বেশি বাঁচুক না পাখিগুলো। বাকি রইল কাজ, ও তো আমার আগেও হত, আমার পরেও হবে। থেকে যাবে শুধু একরাশ ভালোলাগার অনুভূতি।

অনির ডাইরি ৫ই জুন, ২০২২

 


আমার বাবার মতে আয়োজন ছিল যৎসামান্য। বেশি করে কাজু কিশমিশ দিয়ে মিষ্টি মিষ্টি ঘি গন্ধী সাদামাটা বাঙালী বাসন্তী পোলাও, তেলতেলে ঝাল ঝাল কষা মাংস, কাজু বাটা আর কসুরি মেথি দিয়ে পনীর, কালো জিরে ফোড়ন দিয়ে শুধু মাত্র টমেটো কোরা আর জিরে গুঁড়ো-লঙ্কা গুঁড়ো মিশিয়ে ফ্রিজের কাতলার পেটির লাল লাল ঝাল, পাতি টমেটো খেজুর আমসত্ত্বের চাটনি, আমাদের কদমতলা বাজারের দেশপ্রিয়র চাপ চাপ লাল দই আর পায়েস। জামাই ষষ্ঠীতে মায়ের জামাইয়ের সামনে এইটুকুই রেঁধে, বেড়ে দিতে সক্ষম হয়েছিলাম। আমার বর সোনামুখ করে খেয়ে নিয়েছিল বটে, ব্যাপারটা একদমই পছন্দ হয়নি আমার বাবার। 


বিগত দুর্গোৎসবের সময় ভুল চিকিৎসায় প্রায় এক পক্ষ কাল হাসপাতাল বাস তথা কেবল স্যালাইন সেবনের ফলে বাবার স্বাস্থ্য ইদানিং বড়ই ভেঙে পড়েছে। পাড়ার দোকানে যেতেই হাপিয়ে পড়ে বাবা। হারিয়ে ফেলে পায়ের জোর। ফলতঃ বড় দুশ্চিন্তা ছিল মায়ের, কি ভাবে সম্পন্ন হবে এবছরের জামাইষষ্ঠীর বিধি। এখনও কানে ভাসছে মায়ের আকুতি, “ ৫ তারিখে তো জামাইষষ্ঠী, রবিবার পড়েছে, শৌভিক আসতে পারবে তো?”


 অন্যদিন আপিসে ঢুকেই ফোন করি, সেদিন বেশ বেলা হয়েছে ফোন করতে। রমরমিয়ে চলছে দুয়ারে সরকার। গমগমিয়ে ঘুরছি আমি আর উত্তমকুমার, আজ অমুক ব্লকের এই পঞ্চায়েত তো কাল তমুক পুরসভার এত নম্বর ওয়ার্ড। বেশ কিছু ফাইল জমেছিল,ভেবেছিলাম সই সাবুদ করে সাড়ে বারোটা নাগাদ দুয়ারে সরকারের ক্যাম্পে বেরোব। গুটি কয়েক দর্শনার্থীও বসেছিলেন, নানা দাবিদাওয়া আর নালিশ নিয়ে। হাতের কাজ সেরে যখন বাড়িতে ফোনটা করতে পারলাম, শুনলাম গভীর দিবানিদ্রায় আচ্ছন্ন আমার বাপ। 


বাবার অবসর জীবনের সবথেকে প্রিয় অংশ হল এই অসময়ের দিবানিদ্রাটুকু। বেলা সাড়ে দশটা নাগাদ প্রাতঃরাশ সেরে, গোটা দুই সিগারেট আর এককাপ চিনি ছাড়া হাকুচ তেতো চা খেয়ে মায়ের সাথে জম্পেশ করে একচোট কোন্দল সেরে, পাখা চালিয়ে, জানলার পর্দা টেনে বা না টেনে, খাটে বা সোফায় ছোট্ট করে একটা ঘুম দিয়ে নেয় বাবা। ঘুম ভেঙে আবার চা, সিগারেট,আরেক প্রস্থ দাম্পত্য মতানৈক্য সেরে  স্নানাহারের দিকে পা বাড়ায় বৃদ্ধ দম্পতি। এটাই মোটামুটি চাটুজ্জে বাড়ির মেজ তরফের নৈমিত্তিক রুটিন। 


বাবার অনুপস্থিতিতে নিছক কেজো বার্তালাপ হয় মায়ের সঙ্গে। বাবার মত মজার মজার কথা বলতে থোড়াই পারে মা। বাবার মত মেরুদণ্ড সোজা করে নিজের মত প্রকাশ করতে বা ক্ষেত্র বিশেষে গলার শির ফুলিয়ে ঝগড়া করতেও পারে না মা। পারতপক্ষে পরচর্চা বা পরনিন্দা  করে না মা,কারো সমালোচনা করেও না, শুনতেও ভালোবাসে না মা। কারণ আমার জননী মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেন যে সমালোচনার ফল সাধারণতঃ  খারাপই হয়। সময় বড় নির্মম, আজ আপনি যাঁর তীব্র সমালোচনা করবেন, কাল সময় আপনাকে হাঁটতে বাধ্য করবে তার জুতো পায়ে, তারই হেঁটে যাওয়া পথ ধরে। তো যাই হোক, এরপর বলুন দিকি এহেন মহিলার সাথে রসাল তথা দীর্ঘ বার্তালাপ কি আদৌ সম্ভব?


মায়ের সাথে শুধু কেজো কথা হয়, যথা তুত্তুরী স্কুল গেছে কি না, ঠিকঠাক পড়াশোনা করছে কি না, শৌভিক অফিস গেছে কিনা বা তার শরীর কেমন আছে ইত্যাদি প্রভৃতি। মা প্রায় রোজ জানতে চায়, কি খেয়ে অফিসে এসেছি,টিফিনে কি খাব, ঠিকঠাক জল খাচ্ছি কি না। মা বলে, ‘রোজ একটা করে ফল খাস’। আমি যথারীতি কোনদিনই খাই না। আজও তার ব্যতিক্রম হল না। উপরি হিসেবে যুক্ত হয়েছে কেবল জামাইষষ্ঠীর কথাটা। 


রবিবার ৫ই জুন জামাইষষ্ঠীর কথাটা আগেই বলেছিল মা,সেই মোতাবেক জিজ্ঞাসাও করেছিলাম শৌভিককে। আজ মাকেও জানিয়েই দিলাম, শুধু শৌভিকই নয়, আমরা তিনজনেই যাব। ভিডিও কলে আসন্ন জামাই বরণের উল্লাস ছাপিয়ে মায়ের চোখেমুখে ছড়িয়ে পড়ে এক অচেনা বিষণ্ণতা। সুরাঁধুনী হিসেবে এককালে বেশ খ্যাতি ছিল মায়ের। এমনকি প্রবল রাশভারি তথা ব্যক্তিত্বময়ী আমার ঠাকুমাও তা স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছিলেন। রাঁধতে ভালোও বাসত বটে মা। সকালে এক দফা রান্না করে, বাবার, আমার, নিজের টিফিন গুছিয়ে আপিস যেত। এমনকি স্কুল বা কলেজ থেকে ফিরে কি খাব তাও সুন্দর করে সাজিয়ে চুপড়ি চাপা দিয়ে জলে বসিয়ে রেখে যেত মা। সন্ধ্যে বেলা আপিস থেকে ফিরে, চা খেয়ে ছোট্ট করে একটু ঘুমিয়ে নিয়ে আবার রাতের রান্না করতে বসত। জীবনেও এক তরকারি ভাত বা শুধু মাছের ঝোল ভাত খাওয়ায়নি মা। মাত্র এক দেড় ঘন্টার মধ্যে তেঁতো থেকে অম্বল কত কি যে রেঁধে ফেলতেন ভদ্রমহিলা তার ইয়ত্তা থাকত না। 


মধ্য সত্তরের কাছাকাছি পৌঁছে সেই মা আজ দুপদ রাঁধতে থতমত খায়। যত বলি শৌভিক মোটেই আমাদের মত ভোজন বিলাসী নয়। শাশুড়ি মা তাঁর পুত্রদের বড় সুশিক্ষা দিয়ে গঠন করেছেন। শৌভিক তাই সব খায়। একপদ-দুপদ-দশপদের কোন বেয়াড়া আব্দার কোনদিন করে না। এবেলার রান্না ওবেলা ছাড়ুন, আজকের রান্না ফ্রিজে রেখে কাল গরম করে দিলেও সোনামুখ করে খেয়ে নেয়। এমনকি বাসি রুটিও যদি সামান্য ভেজে বা গরম করে দেওয়া হয় তাও লক্ষ্মী ছেলের মত খেয়ে নেবে। বরং পদের সংখ্যা বেশি হলেই কিঞ্চিৎ  নার্ভাস হয়ে পড়ে আমার সোয়ামী। মাকে তা কইলামও, তাও মায়ের ভয় কাটে না। বিরক্তি চেপে বললাম, খাবার কিনে নিলেই তো হয়?


সুইগি জ্যোমাটোর ওপর বিন্দুমাত্র ভরসা নেই মায়ের। একবার বাবার জন্মদিনে অর্ডার করা খাবার না ডেলিভারি দিয়েই ফিরে গিয়েছিল সুইগির ডেলিভারি বয়। একটা ফোনও করেনি। তুত্তুরী আর বুল্লু বাবু পাশের মাঠে খেলছিল, ওরা দৌড়ে গিয়ে বলেওছিল,‘ কাকু ওটা আমাদের অর্ডার, আমাদের বাড়ি ঐ দিকে।’ তাও পাত্তা দেয়নি ছেলেটা। উল্টে সুইগি একটা মোটা টাকা ফাইন চাপিয়েছিল আমার ওপর, কেন ওদের খাবার অর্ডার দিয়েও নিইনি বলে-। সেযাত্রা টুইটারে পচুর হল্লা করে ফাইন মুকুব করেছিলাম বটে,তবে খাবার কিনতে আমাকে বেরোতে হয়েছিল টোটো চেপে। অনলাইন কোন কিছুকেই ভরসা করে না মা। 


 রান্না বাড়িতে করতে হলে বাজারও তো লাগবে সমানুপাতিক হারে। বাবার যা শারীরিক অবস্থা। সমস্যার কথা শুনতে শুনতে কখনও যে মুখ ফসকে বলে ফেলেছি, ‘এতই যখন সমস্যা তখন এবছর জামাইষষ্ঠীটা না করলেই তো হয়।’ বলেই প্রমাদ গুণলাম, মায়ের মুখে ঘনিয়ে এল শ্রাবণের কৃষ্ণ বাদল। তড়িঘড়ি ফোন রেখে তো দিলাম, কিন্তু মনের মধ্যে কি যেন বারবার ফুটতে লাগল। 


আজ আমরা কোলাঘাট ব্লক আর পাঁশকুড়া পুরসভায় ক্যাম্প  দেখতে যাব। যখন গাড়ির চাকা গড়াতে লাগল, তখনও বেশ রোদ, অচীরেই ঘনিয়ে এল মনখারাপী মেঘ এবং উপুর্যান্তে বৃষ্টি। গাড়িটাকে ঘিরে যেন জলের পর্দা, পর্দার আড়াল থেকে ভয়ে ভয়ে ফোন করলাম মাকে, ফোনটা ধরলেও জবাব দিল না মা, ফ্যাঁচফ্যাঁচে কান্নার শব্দ আসতে লাগল শুধু একটানা। অনেক কষ্টে,অনেক অনুনয় বিনয়, উত্তম কুমারের উপস্থিতি অগ্রাহ্য করে সহস্রবার মার্জনা ভিক্ষার পর মুখ খুলল মা,‘আমার সমস্যা, আমার অসহায়তার কথা, তোকে না বললে কাকে বলব?’ 


সত্যিই তো। আমার আশি পেরোনো বাপ আর মধ্য সত্তরের জননী, তাদের সমস্যার কথা অকপটে আমাকে না বললে আর বলবে কাকে? মাকে আশ্বস্ত করলাম, দাঁড়াও, তোমায় কোন চিন্তা করতে হবে না। জামাইষষ্ঠীর দুদিন আগেই বাড়ি ফিরব আমি আর তুত্তুরী। অতঃপর দোকান-বাজার, রান্না মায় উভয়পক্ষের উপহার কেনা সব আমার দায়িত্ব। মা শুধু বসে বসে হুকুম করবে আর মাঝে মাঝে একটু চা যদি, অনুগ্রহ করে- মায়ের মত চা, আর কেন জানি না কেউ বানাতেই শিখল না। এমনকি আমিও না। 


শেষ পর্যন্ত অবশ্য দোকানবাজারের অনেকটাই  তুত্তুরীকে সঙ্গে নিয়ে বাবাই করেছিল। কুটনো কোটা, মশলাবাটা ইত্যাদিতে সাহায্য করেছিল মায়ের আয়া দিদি, লক্ষ্মী।  হ্যাঁ খুন্তি আমি নাড়িয়েছি বটে, বাবার অগোচরে বার চারেক শ্রীমতী তুত্তুরী আর বুল্লু বাবুকে দোকানও পাঠিয়েছি  টুকটাক জিনিসপত্র, যেমন ইয়ে পোলাও রাঁধতে গিয়ে কম পড়া গোবিন্দভোগ চাল আনতে। ষষ্ঠী বলে স্বয়ং আঁশ বা এঁটো কোন খাদ্য চেখে দেখতে পারছিলাম না, সে কাজেও যথোপযুক্ত  সহায়তা করেছে তুত্তুরী আর বুল্লু বাবু। সে যাই বলুন না কেন, খুন্তী তো আমিই চালিয়েছি নাকি? এখন এত কিছুর পর যদি শৌভিককে প্রদেয় আশির্বাদী টাকাটা ঝেঁপেই থাকি, তেমন কোন অন্যায় করেছি কি? দুবেলা পর্যায়ক্রমে জ্ঞান এবং খোঁটা দেবার মত কোন গর্হিত কাজ করিছি কিনা বলুন তো? সেটা আমার বাপ, মা এবং তাদের জামাইকে কে বোঝায় বলুন দিকি?