Sunday, 26 March 2023

অনির ডাইরি ৯ই মার্চ, ২০২৩

 

#অনিরডাইরি #তাম্রলিপ্তকড়চা #happywomensday 


প্রতিবছর মার্চ মাসে একটা মোটা টাকার অ্যালটমেন্ট ঢুকত। সাথে সাথে আসতো নির্দেশ নামা, আসন্ন নারী দিবস উপলক্ষে, সংগঠিত এবং অসংগঠিত ক্ষেত্রের মহিলা শ্রমিকদের নিয়ে করতে হবে দুদিনের কর্মশালা। তড়িঘড়ি চুঁচুড়া পুরসভার বাতানুকূল হলটা বুক করে ফেলতাম আমরা। কথা বলতাম নারী-স্বশক্তিকরণ (women empowerment) নিয়ে কাজ করছে এমন বিশেষজ্ঞ, আইনজীবী, এনজিও এবং সরকারি আধিকারিকদের সাথে।


সেশন নিতে ডাকতাম, আমার পরিচিত এমন নারীদের, যাঁরা আমার চোখে প্রকৃতই সবলা। সবাই যে আসতে পারতো তা নয়, আবার অনেকেই চলে আসতো। যেমন এষা বা দেবশ্রী দি। একবার তো DLSA এর তৎকালীন সেক্রেটারি সাহেবের সৌজন্যে, ডিস্ট্রিক্ট জাজ স্বয়ং এসে হাজির আমাদের ক্ষুদ্র অনুষ্ঠানে। কথা বললেন, কথা শুনলেন, প্রয়োজনীয় আইনি পরামর্শ দিলেন মেয়েদের। ভাঙা ঘরে সেদিন আমাদের চাঁদের আলো।


এই জেলায় আসা ইস্তক আর আসে না ওই টাকাটা। কি জানি কেন বিমুখ হয়েছে দপ্তর, অধমের প্রতি। উচ্চতম আধিকারিক থেকে করণিক কার কাছে না অনুরোধ জানায়নি। তাও ভেজেনি চিঁড়ে।


 Women empowerment আমার প্যাশন বলতে পারেন। নিজেকে আমি সেই গুটিকয় empowered women দের মধ্যে ধরি, যাদের ভূমিষ্ঠ হবার পূর্বে তাদের পিতা-মাতার যদি পুত্রাকাঙ্ক্ষা থেকেও থাকে, নবজাতিকার মুখদর্শনের সাথে সাথেই তা দূরীভূত হয়েছিল চিরতরে। শৈশবে বা কৈশোরে আমরা কোনদিন সুস্পষ্ট ভাবে লিঙ্গ বৈষম্যের শিকার হয়নি। গোটা ডিমই বলুন বা মাছের পেটি বা খাসির মেটে বা নতুন জামা সবকিছুই পরিবারের পুরুষ সদস্যদের সমান সমান পেয়ে এসেছি। যতদিন পড়তে চেয়েছি, যা নিয়ে পড়তে চেয়েছি অনুমতি এবং উৎসাহ পেয়েছি। বিয়ের জন্য অযথা জোরাজুরি করেনি কেউ। পড়তে গিয়ে যত রাতেই বাড়ি ফিরি না কেন, কোনদিন ঘটেনি কোন অবাঞ্ছিত ঘটনা। চাকরির ফর্ম তোলা থেকে ইন্টারভিউ অব্দি, মহিলা বলে পড়তে হয়নি কোন বিরূপ মনোভাবাপন্ন ব্যক্তির সামনাসামনি। আমাকে কেউ কোনোদিন ঠারেঠোরেও বলেনি যে মহিলা বলে এই পদের আমি অযোগ্য বা অনুপযুক্ত। গ্লাস সিলিং এর সম্মুখীন হতে হয়নি। পুরুষ সহকর্মীদের সাথে নিজেকে প্রমাণ করার সমান সুযোগ পেয়েছি আমি। সমতালে বেড়েছে বেতন। প্রেমে প্রত্যাখ্যাত হয়ে এসিড নিয়ে ধাওয়া করেনি কেউ। চাকুরীরতা বলে বিয়ে করতে অসম্মত হয়নি কেউ। বিয়ের পরেও কেউ বলেনি চাকরি ছাড়তে। গার্হস্থ হিংসার শিকার হতে হয়নি। কন্যা সন্তানের জন্ম দেবার পর শুনতে হয়নি কোন কটু মন্তব্য। মেটারনিটি লিভ পেয়েছি। চাইল্ড কেয়ার লিভ পাই। আমি তো সমাজের ভাগ্যবান অংশ। আক্ষরিক অর্থেই the creamy layer। 


কিন্তু সবাই যে এত ভাগ্যবান হয় না। 'হে মোর দুর্ভাগা দেশ'- এ, কন্যা ভ্রূণহত্যা, লিঙ্গবৈষম্য, অশিক্ষা, স্কুল ছুট, বাল্যবিবাহ, গার্হস্থহিংসা (domestic violence), যৌন নির্যাতন ইত্যাদি প্রভৃতি যে আজও আছে। এখনও সমাজের একটা গরিষ্ঠাংশ প্রতি মুহূর্তে যুঝে চলেছে এই দৈত্যগুলির সঙ্গে। সবথেকে বড় কথা হল, এণারা অনেকেই এগুলিকে ভবিতব্য  বলে মেনে নিচ্ছেন। জন্ম থেকেই ধরে নিচ্ছেন নারী মাত্রই অবলা। অবরবর্গীয় মানুষ,বা মনুষ্যপদবাচ্যই নয়। তারা জানতেও পারছেন না, মানতেও পারছেন না যে নিছক জন্ম দিলে বা লালন পালন করলে বা ভাত কাপড়ের দায়িত্ব নিলেই গায়ে হাত তোলার অধিকার জন্মায় না কারো। শুধু গায়ে হাত তোলাটাই গার্হস্থ্য হিংসা নয়। মৌখিক এবং মানসিক নির্যাতন যেমন সবার সামনে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করা, উপহাসের পাত্র বানানো ইত্যাদি ও গার্হস্থ্য হিংসারই অঙ্গ। যেখানে প্রতিমুহূর্তে মেয়েটিকে মনে করানো হয় যে তার অস্তিত্ব একেবারেই তুচ্ছ, একান্তই নিষ্প্রয়োজন। 


এই সমস্ত পিছিয়ে পড়া মেয়েদের একটু স্পেশাল ফিল করানো, একটু সচেতনতা বৃদ্ধি, এইটাই তো হল নারী দিবসের উদ্দেশ্য। কোথা থেকে কোথায় এসেছি আমরা। এইতো সেদিন সম্পত্তির অধিকার ছিল না মেয়েদের, ছিল না মতদানের অধিকার। এমনকি শিক্ষার অধিকারও ছিল না। সেখান থেকে অনেক লড়াই করে আমরা এসেছি তো এতটাদূর। দিল্লি এখনো অনেক দূর হয়তো, তবে রাস্তাটা তো বোঝা যাচ্ছে। আর রাস্তা না থাকলেই বা কি, রাস্তা বানাতে হবে তো!


 জানি দুদিন বা একদিনের ওয়ার্কশপে কোন পরিবর্তনই হয়তো আনতে পারব না। ব্যাপারটা সিন্ধুতে বিন্দু সম। তাই বলে কি চেষ্টা করব না। ফান্ডে রাহু লেগেছে বটে, তবুও ঠিক করলাম যে, সীমিত সামর্থের মধ্যেই ওয়ার্কশপ আমরা করব।  ডিএম সাহেবের মিটিং হল বুক করতে লাগে না কোন টাকা পয়সা। মিটিং হলেই রয়েছে প্রজেক্টর। ল্যাপটপ তো আমাদের অরূপেরই আছে। চা বিস্কুট বা সামান্য দুটি মাছ ভাতের ব্যবস্থা ধারেনগদে হয়ে যাবে ডিএম অফিসের ক্যান্টিনে। রইল এবার কারা অংশগ্রহণ করবে আর কারা ক্লাস নেবে? আমাদের মহিলা এসএলও এবং কালেক্টিং এজেন্টদেরই ডাকা হল শেষ পর্যন্ত। প্রতিদিন অগুনতি মানুষের সাথে কাজ করেন এনারা। যাদের মধ্যে মহিলার সংখ্যাই বেশি। সামান্য শিখিয়ে পড়িয়ে নিলেই আমার মেয়েরা অনুঘটকের কাজ করতে পারে। এদের মাধ্যমেও ছড়িয়ে পড়তে পারে সামান্য সচেতনতা। 


ট্রেনার হিসেবে ডাকলাম আমার এক প্রিয় দিদি আর এক বন্ধুকে। বন্ধুবর শেষ পর্যন্ত এসে উঠতে পারেনি বটে, কিন্তু তানিয়া দি এসেছিল। জানতাম, এই মহিলার মাথায় আমার মতোই নারী স্বশক্তিকরনের পোকা গিজগিজ করছে। তাই না হাওড়া শিবপুর থেকে ঠেঙিয়ে তমলুক এলো আমার মেয়েদের ডোমেস্টিক ভায়োলেন্স অ্যাক্ট এবং সেক্সুয়াল হারাসমেন্ট অফ উইমেন অ্যাট ওয়ার্ক প্লেসেস পড়াতে। মালদায় পোস্টিং ভদ্রমহিলার। সেখান থেকে কয়েক দিনের ছুটিতে বাড়ি এসেছে, ছেলের পরীক্ষা বলে। তার মধ্যে থেকেও একটা বেলা, একটা দিন শুধু আমাদের জন্য খরচ করাটা আমার কাছে মোটেই ছোট কথা নয়। সেটা বললাম ও দিদিকে। 


আর বললাম যে, টাকা পয়সা সেভাবে কিছু দিতে পারবো না। হাল বহুত খারাপ। উল্টে দিদি আমায় মুখ ঝামটা দিল, "তোর সঙ্গে কি আমার টাকা পয়সার সম্পর্ক, অ্যাঁ? রাখ তোর টাকা তোর পকেটে।" সাধে কি বলেছি, ভদ্রমহিলার মাথায় পোকা গিজগিজ করছে। সাধে কি ভদ্রমহিলার সাথে আমার এত প্রেম। দুজনেই হাওড়ার মেয়ে যে। রতনে রতন চেনে মশাই।

No comments:

Post a Comment