Tuesday 27 December 2022

অনির ডাইরি ২২শে ডিসেম্বর, ২০২২

 

#কাঁথিরকিস্যা 


‘কাল কখন ফিরলেন ম্যাডাম?’ জানতে চাইলেন নূপুর বাবু। সদ্য সদ্য কাঁথির মহকুমা শাসকের সরকারী নিবাসের সীমানা ছেড়ে বেরিয়েছি আমরা।  গন্তব্য দীঘা বাইপাস। 

দীঘা বাইপাস থেকেই বাস ধরব আমি। বেদজ্যোতি তাই বলেছে। বেদজ্যোতি আমার ইন্সপেক্টর,স্থানীয় ছেলে এবং তমলুক- কাঁথি রুটের নিত্যযাত্রী। আপাতত আমার পথপ্রদর্শকও বটে। হতোদ্যম হয়ে পড়লে ওকে দেখে অনুপ্রেরণা পাই।  ও যদি পারে, আমি পারব না কেন?


এতদসত্ত্বেও সকাল থেকে কেন যে গরম হয়ে থাকে মাথা। ভোর বেলাতেই ধমকে দিই মেয়েটাকে সম্পূর্ণ অকারণে। নীরবে, নতমস্তকে মায়ের কটু কথা শুনে, স্কুলের রাস্তা ধরে তুত্তুরী। পলকে শতছিন্ন হয়ে যায় তুত্তুরীর মায়ের হৃদয়। মা হওয়া কি মুখের কথা!


একরাশ মনখারাপ নিয়েই রওণা দিই আপিসের পথে। সঙ্গী বলতে নূপুর বাবু।  গাড়ি চালাতে চালাতে নানা প্রশ্ন করেন ভদ্রলোক। অনেক মজার মজার কথাও বলেন। যেমন আগের দিনের বাসটা আমায় সেন্ট্রাল বাসস্ট্যান্ড যাবে বলেও, শেষ পর্যন্ত খড়্গপুর বাইপাসে নামিয়ে দিয়েছে শুনে উনি বললেন,‘ফের যদি এমনি বলে ম্যাডাম, আপনাকে কিছু করতে হবে না, আপনি শুধু বাসের নম্বরটা টুকে নিবেন।’ নম্বর টুকে যে কি করব ভগবান জানে। হাসি চেপে জানলার বাইরে তাকাই আমি। নূপুর বাবু এবার পড়েন, টোটোওয়ালাকে নিয়ে। কেন টোটোওয়ালা আমায় মহকুমা শাসকের করণ অবধি পৌঁছে দেয়নি? ‘লাইসেন্স নিয়েছে আর প্যাসেঞ্জার নিবেনি? বললেই হল? ফের যদি কেউ এমন করে, তাহলে আপনি ম্যাডাম, তাকে আটকে রেখে আমায় ফোন করবেন। আমি ছুট্টে চলে যাব-’।  


ধেড়ে গাড়িটা নিয়ে উনি ছুটে আসবেন আমার হয়ে টোটোওয়ালার সাথে ঝটাপটি করতে,ব্যাপারটা কল্পনা করে হাসি চাপা দায়। মন খারাপ জানলা গলে পালায়।  দূর থেকে দৃশ্যমান হয় দীঘা বাইপাস। চৌমাথায়  হর্ন বাজাচ্ছে একটা বাস। বাসের সামনে গিয়ে দাবাং স্টাইলে গাড়ি দাঁড় করালেন ভদ্রলোক। ‘ম্যাডামকে তুলে লাও তো। নিমতৌড়ি ডিএম আপিসে নাবিয়ে দেবে।’ 


বাসে উঠে গেলাম,বেদজ্যোতির সাথেও দেখা হয়ে গেল। নূপুর বাবু তখনও নীচে দাঁড়িয়ে, ‘তাহলে ম্যাডাম, সব ঠিক আছে তো? আপনি যদি রোজ এক টাইমে বেরোন, তাহলে সেরকম হলে আপনার জন্য একটা সিট বেঁধে রাখতে বলব।’ হাত নেড়ে ইশারায় বলি, এবার যান। রোজ একসময়ে বেরোন আমার অসাধ্য। কোনদিন পাঁচ মিনিট লেট করে ফেলি তো কোনদিন দশ মিনিট আগে হয়ে যায়। লেট হলে বাস পালায়। আর জলদি এলে বাস লেট করে। এযেন এক অলাতচক্র। 


বেদজ্যোতি যদিও আশ্বস্ত করে, ‘বাস অনেক পাবেন ম্যাডাম। একটু দাঁড়িয়ে গেলেই স্টেট বাসও পেয়ে যেতে পারেন। দারুণ আসে বাস গুলো।’ নূপুর বাবু আবার কিছুতেই স্টেট বাসে চাপানোর পক্ষপাতী নন। ‘সব জানলা খোলা, প্রচণ্ড হাওয়া ঢোকে। স্টেট বাস শীতকালে ভালো না। আপনাকে আমি ভালো এসি বাসে তুলে দিব। দেখবেন ভিতরে কেমন ওম পাবেন। উঠে ঘুমিয়ে পড়বেন, ওরা ঠিক ডেকে দেবে। আমি বলে দিব খন।’ 


ঘুমানো অবশ্য অত সহজ নয়। প্রথমদিন যে এসি বাসটিতে উঠেছিলাম, তাতে রমরম করে কি যেম একটা সিনেমা চলছিল। কোন দক্ষিণী ছবির হিন্দি ভাষান্তর। কোনটা নায়ক আর কোনটা যে খলনায়ক বোঝা দায়। কথায় কথায় ধুন্ধুমার। আর না হলে দক্ষিণী নাচগান আর বিটকেল প্রেম। তেমনি সব সংলাপ, যেমন, ‘ভাই রে ভাই,রক্কি ভাই’ বা ‘তু ব্যাড হ্যায়, তো ম্যাঁয় তেরা ড্যাড হ্যায়। সমঝা না!’ বা ‘তু গ্যাংস্টার হ্যায়, তো ম্যায় মনস্টার হ্যায়।’ ইত্যাদি প্রভৃতি। পুরো সিনেমাটাই কেমন যেন ধুলোয় মাখা ধুসর রঙের। দেখব না, দেখব না করেও বেশ খানিকটা দেখেই ফেললাম। পাশ থেকে বেদজ্যোতি বলল, ‘ম্যাডাম এই বাসে রোজ এই সিনেমাটাই চলে।কালও দেখতে পাবেন। এখন ঘুমিয়ে পড়ুন।’ 


সত্যিই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, ভালো করে ওড়না মুড়ি দিয়ে। ঘন্টা দেড়েক পর যখন ঘুম ভাঙল, বাস কোলাঘাট ব্রীজ পেরোচ্ছে। কি সর্বনাশ! আমরা তো পূব মেদিনীপুরের সীমানা ছাড়িয়ে হাওড়া জেলায় ঢুকে পড়ব গো। কেউ ডাকেও নি। টিকিটও তো কাটেনি।  কি জ্বালা।  


এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখি বেদজ্যোতিও ঘুমাচ্ছে। ঠেলে তুললাম ব্যাটাকে। দেউলটিতে নামতে হবে। তারপর উত্তমকুমারকে ডেকে নেওয়া ছাড়া গতি নেই। ঘুম চোখে জানলার বাইরে খানিক তাকিয়ে থেকে জড়ানো গলায় বেদজ্যোতি বলল,‘ম্যাডাম, এটা তো নরঘাট ব্রীজ। নীচে রূপনারায়ণ নয়, হলদি নদী। এখনও নন্দকুমারই আসেনি। আর একটু ঘুমিয়ে নিন।’ 


বারোটা থেকে মিটিং ডেকেছিলাম। আপিসে ঢুকে দেখি, ১১টা থেকেই লোকজন এসে বসে আছে। কটা দিন ছুটি নিয়েছিলাম নতুন করে সংসার গোছানো আর তুত্তুরীকে নতুন স্কুলে থিতু করানোর জন্য, পালিয়ে তো যাই নি। যাবার আগে ম্যারাথন মিটিং করে প্রায় মিটিয়ে এনেছিলাম সমস্যা গুলো। গুটি কয়েক সিদ্ধান্তে যদিও উপনীত হয়নি কেউই। বলেছিলাম ধৈর্য ধরতে। বলেছিলাম উভয়পক্ষকে সামনাসামনি বসে আরেকদফা আলোচনা করতে। যদি মিটে যায় বা যদি নাও মেটে আমাকে যেন জানায়, তেমন হলে ছুটির মধ্যেই চলে যাব একদিন, শুধু ওদের জন্য। 


বাবুরা আমার কথা খানিক শুনেছেন খানিক শোনেননি। ধৈর্য ধরেননি মোটেই। ঝটপট দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় বসে পড়েছেন। বসেও যখন কোন সমাধান সূত্র বেরোয়নি, সৃষ্টি হয়েছে উত্তেজনা। ঘটেছে কিছু অপ্রীতিকর ঘটনাবলী। নির্মূল হতে বসা রোগ ছড়িয়ে পড়েছে প্রতিটি অঙ্গ থেকে তন্ত্রে। 


ঝাড়া সাড়ে পাঁচ ঘন্টার মিটিং করে আবার পূর্বের জায়গায় ফিরতে ফিরতে রীতিমত কালঘাম ছুটে গেছে আমার। টিফিন করারও অবকাশ হয়নি কারো। বেলা আড়াইটে নাগাদ বলেছিলাম,সবাই চাইলে খেয়ে আসতে পারেন। কেউ রাজি হয়নি নড়তে। খাওয়া বলতে বার তিনেক জহরবাবুর হাতে বানানো আদা দেওয়া কালো চা। কোথা থেকে যে আদা জোগাড় করে এনেছে লোকটা ভগবান জানে। 


 শেষে তিনটে নাগাদ শুভাশিষকে বলতে বাধ্য হলাম, একটু ভালো দুধ চা আর বিস্কুট আনতে পাঠাও। একে খালি পেট তারওপর আমার বকুনি, মরে যাবে যে লোকগুলো। পাঁচটা দশ নাগাদ সবপক্ষ একসাথে করজোড়ে বলল,‘ছেড়ে দিন ম্যাডাম। মাথা ভোঁ ভোঁ করছে।’ 


সবকটাকে তাড়িয়ে টিফিন বাক্স খুলতে যাচ্ছি, জনা ছয়েক নেতা ঢুকে এসে অনুরোধ করল,‘ম্যাডাম, আজকের মিটিং এ কি হল, সেটা শ্রমিকদের যদি আপনি একটু বলে দেন তো খুব ভালো হয়। ’ বলাশোনার পাঠ যখন শেষমেষ মিটল রীতিমত গা গুলোচ্ছে। খাবারটা পচে গেল নাকি কে জানে। উত্তমকুমার বলল,‘ থাক ম্যাডাম আপনাকে আজ আর বাসে গিয়ে কাম নেই। আমি ছেড়ে আসি বরং।’ বেদজ্যোতিকেও সঙ্গে নিলাম আমরা, ওর বাড়ির কাছেই যাচ্ছি যখন। সঙ্গে নিলাম হক বাবুকেও। নন্দকুমার মোড়ে নামিয়ে দেব বলে। ঐ রাস্তাতেই যখন গাড়িটা যাবে, মুড়ির টিনের মত যতজনকে চেপেচুপে  নিয়ে যাওয়া যায়, তুলে নিই আমি। 


গাড়িতে বসে সবে টিফিন কৌটো খুলে মুখে এক গরাস দিয়েছি, উত্তমকুমার জানাল, গাড়ি আজ আর নড়বে না। কি হয়েছে ভগবান জানে,স্টার্টই নিচ্ছে না ব্যাটা। হক বাবু আর বেদজ্যোতিতে মিলে বেশ খানিকটা ঠেলল গাড়িটাকে, বনেট খুলে খুটখাট করল সবাই মিলে। গাড়ি আর নড়েই না।রাত বাড়ছে। এখন বাসে ভিড়ও হবে প্রচণ্ড। আর একটু আগে বেরোলে ভালো হত। আর সময় নষ্ট করা উচিৎ নয়। টিফিন বাক্স বন্ধ করে উঠে পড়লাম আমরা। কালেক্টরেটের গেট দিয়ে বেরোচ্ছি, একটি ছেলে একগাল হেসে বলল, ‘ম্যাডাম আজ হেঁটে যাচ্ছেন?’ ঘাড় নেড়ে বললাম, হ্যাঁ রে বাবা। দেখ না,  আজই গাড়িটা বিগড়েছে। 


নিমতৌড়ি বাসস্ট্যান্ড এখান থেকে হাঁটা পথে বেশ খানিকটা। পাশের হাইরোডে গিয়ে দাঁড়ালাম তিনজনে। তেমন আলো নেই এখানে। কে জানে হাত দেখালে বাস আদৌ দাঁড়ায় কি না। হক বাবু আর বেদজ্যোতি যদিও আশ্বস্ত করল,‘ বাসের বাবা ও দাঁড়ায়।’ একখানা বাস বেরিয়ে গেল পাশ দিয়ে,  উঠতেই যাচ্ছিলাম, বেদজ্যোতি আটকাল। ‘কেমন ভিড় দেখছেন ম্যাডাম। গোটা রাস্তা দাঁড়িয়ে যেতে হবে। একটু দাঁড়ান, পরে আরো বাস পাবেন।’ ঘড়ি দেখে হিসেব করলাম, বাড়ি পৌঁছাব কটায়। খেতে পাব কখন। সকালের ভাত খাবার পর সাড়ে আটঘন্টা কাটতে চলল। 


ব্যাগের মধ্যে ঝনঝনিয়ে উঠল মোবাইল, কিঞ্চিৎ  বিরক্ত হয়ে ব্যাগ থেকে ফোনটা বার করে দেখলাম, উত্তমকুমার। বাস পেয়েছি কিনা জানতেই ফোন করছে নির্ঘাত। অনুমাণ অকাট্য, ঠিক তাই বলল উত্তমকুমার,‘বাসে উঠে গেছেন? ’ বললাম না। অতঃপর উত্তমকুমার বললেন,‘উঠবেননি। উঠবেননি ম্যাডাম। আমি আসছি।’ হু হু করে হর্ন বাজাতে বাজাতে ছুটে এল উত্তমকুমারের গাড়ি। উঠে যে যার সিটে বসে, টিফিন বাক্স খুললাম আমি, আর হক বাবু শুধোলেন, ‘তোর গাড়ি চলল কি করে রে উত্তম।’ মহানায়কের স্টাইলে আমাদের উত্তমকুমার বলল,‘আপনারা ঠেলতে পারেননি তাই চলেনি। আমি পাঁচটা ড্রাইভার ডাকলাম, সবাই মিলে হেঁইও করে ঠেলল, ব্যাস অমনি-। স্টার্ট নিতেই আমি ম্যাডামকে ফোন করলাম। ভয় পাচ্ছিলাম, যদি আপনারা বাসে উঠে পড়েন।’ হকবাবু বললেন,‘আবার যদি বন্ধ হয়ে যায়, কি করবি?’ ফোঁৎ করে নিশ্বাস ফেলল উত্তমকুমার, ‘ এই যে স্টার্ট লিয়েছে, আর স্টার্টের বাবাও বন্ধ হবেনি। দেখে নিবেন।’ খোলা জানলা দিয়ে ছুটে আসছে শেষ ডিসেম্বরের সন্ধ্যের হিমেল হাওয়া, সকালে বানানো আলুকপি বিনের তরকারি এক চামচ মুখে দিয়ে প্রবল স্বস্তির শ্বাস নিলাম আমি। চালাও পানসি কাঁথি নগরী। এই তো জীবন কালি দা।

Tuesday 20 December 2022

অনির ডাইরি ২০শে ডিসেম্বর, ২০২২

 


দাঁড়িয়েই আছি, মিনিট দশেক হয়ে গেল। আমি অবশ্য একা নেই, আসেপাশে দাঁড়িয়ে আছেন আরো অনেকেই। দূর পাল্লার একেকটা বাস আসছে, অমনি ছুটে যাচ্ছে লোকজন। কোনটা এগরা যাচ্ছে তো কোনটা পটাশপুর, কোনটা বা নন্দীগ্রাম।  আমাকে ধরতে হবে দীঘার বাস। পাশেই দাঁড়িয়ে আছে উত্তমকুমার, বললাম,  চলে যাও। তাও গেল না। আজ দিনের আলো থাকতে থাকতেই বেরিয়েছি, প্রথমবার বাসে ফিরব। সকাল বেলা পাখি পড়া করে বুঝিয়েছে উত্তমকুমার,“অনেক বাস পাবেন ম্যাডাম। দু চারটে ছেড়ে দিবেননি। সিট আছে কিনা দেখে উঠবেন। নিমতৌড়িতে সিট না পেলেও নন্দকুমার মোড়ে পেয়েই যাবেন। কন্টাক্টরকে একটু বলে রাখবেননি।”  


বেশি জল খেতেও নিষেধ করেছে উত্তমকুমার। জল যদিও আমি বেশ কমই খাই। “বুঝে শুনে জল খাবেন ম্যাডাম। অনেকটা রাস্তা। একবার আমার যা হয়েছিল নি-”। পূর্ব মেদিনীপুর সত্যিই কেমন যেন লম্বাটে জেলা। তমলুক এবং কাঁথি যদিও একই জেলার দুইটি শহর, তাও খাতায় কলমে আমার বাসা থেকে আপিসের দূরত্ব প্রায় সত্তর কিলোমিটার ছুঁইছুঁই। 


ঘটাং করে একটা বড় বাস এসে দাঁড়াল। দরজা খুলে ব্রুস লির মত লাফিয়ে নামলেন এক চশমা পরা ভদ্রলোক, অতঃপর হাঁকতে লাগলেন কাঁথি, কাঁথি করে। উত্তমকুমারকে পিছনে ফেলে, হন্তদন্ত হয়ে এগিয়ে গিয়ে কিঞ্চিৎ  ভীতু স্বরে জানতে চাইলাম, ‘সেন্ট্রাল বাসস্ট্যান্ড?’ লোকটা পাত্তাও দিল না, তাচ্ছিল্যপূর্ণ ভাবে বলল,‘উঠুন, উঠুন।’ উঠেই পড়লাম, কপাল ঠুকে। সিট থাকলে বাঁচি। 


বেশ উঁচু আর লম্বা দূর পাল্লার বাস। একদিকে তিনজন আর একদিকে দুজন বসার ব্যবস্থা। আমার আগে যারা উঠেছিলেন, তারা পিছন দিকে এগিয়ে গেলেন। দূরপাল্লার বাসের পিছনে বসাটা কতটা বুদ্ধিমানের কাজ হবে বুঝলাম না, তাই সামনে থেকে গুটি কয়েক সিট পরেই যে সিট পেলাম, তাতেই বসে পড়লাম। দুই শুঁটকে চেহারার ভদ্রলোক এতক্ষণে হাত পা ছড়িয়ে বসে গপ্প করছিলেন, ‘দাদা’ বলে আমি গিয়ে দাঁড়াতে, ধারের ভদ্রলোক ভিতরে ঢুকে গেলেন। 


বাস ছাড়ল, ছাড়ার সাথে সাথেই রুদ্ধশ্বাস দৌড়। অধিকাংশ জানলারই কাঁচ বন্ধ, ফলে ভিতরটা একটু গুমোট। জানলার বাইরে ক্রমশঃ কমে আসছে আলো। সূর্য ডুবেছে কিছুক্ষণ পূর্বেই। অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলাম, চমকে উঠলাম কার যেন স্পর্শে। এক বিকলাঙ্গ ব্যক্তি উঠেছেন বাসে, সবার কাছে ভিক্ষা চাইছেন। বাস তো থামেনি এর মধ্যে, নির্ঘাত আগেই উঠে বসেছিলেন।  কয়েকবার মৃদু স্বরে দিদি/মা বলে ডেকেছেন বোধহয়, সাড়া না পেয়ে রড ধরে থাকা হাতটায় টোকা দিয়েছেন। বয়স কম না লোকটার, মসিকৃষ্ণ গাত্রবর্ণ। পিঠে মস্ত কুঁজ। এই শীতেও খালি গা, পরনে একটা ট্যানা। কারা কেন জিজ্ঞাসা করল,‘গরম জামা নেই?’ বিরক্ত হয়ে মাথা নেড়ে এগিয়ে যায় লোকটি। 


পাশের লোকটি হঠাৎ বলে ওঠে, ‘ গান্ধী বুড়ি’! বাইরে দিকে না তাকিয়েও বুঝতে পারি নন্দকুমার মোড় ঢুকছি। গোল চক্কর কেটে ডান দিকে বাঁকব আমরা। বাঁদিকে বাঁকলে তমলুক শহর আর সোজা চলে গেলে হলদিয়া। চৌমথার মোড়ে উন্নীত  নিশান কাঁধে দাঁড়িয়ে আছেন তমলুকের ঘরের মেয়ে। সঙ্গে তাঁর অনুগামী বৃন্দ। বাস গুলো এখানে বেশ কিছুক্ষণের জন্য দাঁড়ায়, আগেই বলে রেখেছে উত্তমকুমার। এর মধ্যে একবার ফোন করে খোঁজও নিয়ে নিয়েছে,‘ম্যাডাম সিট পেয়েছেন তো?’ ছোলা,বাদাম,মশলা মুড়ির ঝাঁকা নিয়ে হকাররা ওঠে। অনেকে নেমে গিয়ে চা খেয়ে আসেন, টুকটাক কেনাকাটা করে আনেন পথে খাবার জন্য। 


বেশি ক্ষণ দাঁড়াল না অবশ্যি বাসটা। চাকা গড়াল কাঁথি শহরের দিকে। টিকিট কাটতে এগিয়ে এলেন কন্ডাক্টর দাদা। জানতে চাইলাম, ‘সেন্ট্রাল বাসস্টান্ড কত?’ জবাব এল,‘সেন্ট্রাল বাসস্টান্ড তো যাবেনি। আপনাকে বাইপাসে নামতে হবে।’ কোন বাইপাস রে ভাই? এখানে তো গণ্ডা গণ্ডা বাইপাস। জবাব দিল বটে লোকটি, একে তো কাঁথির লোকের কথা বুঝতে সামান্য একটু সমস্যা হয় আমার তার ওপরে বাসের তীব্র গর্জন। লোকটি আশ্বস্ত করল,‘বেশী দূর নয়। আপনি হেঁটে চলে যাবেন।’ এদিকের লোকের ‘বেশি দূর নয়’ এই সংলাপটিকেও বড় ভয় পাই আমি। কতটা দূর যে ঠিক বেশি দূর এদের কাছে, বুঝতে আজও অপারগ আমি। 


একটু আগেই মেসেজ করেছিলাম শৌভিককে, ‘বাসে উঠেছি। সিট পেয়েছি।’ জবাবে একগাল হাসির ইমোজি পাঠিয়েছিল আমার বর। আবার মেসেজ পাঠালাম, ‘ ওরে, এখন বলছে, এটা সেন্ট্রাল বাস স্ট্যান্ড যায় না। কি যেন বাইপাসে নামাবে আমাকে।’ এবার ওদিক থেকে একটা কান্নার ইমোজি এল। রাগে দুঃখে আমারই চোখে জল আসছে তখন। কোন বাইপাসে নামাবে রে বাবা। বাড়ি পৌঁছাব তো ঠিকঠাক- 


নরঘাট ব্রিজ পেরিয়ে যায় গাড়ি, নীচে হলদি নদীতে তখন মিশছে সন্ধের আঁধার। পেরিয়ে যায় বাজে চণ্ডীপুর-চণ্ডীপুর-বাজকুল-হেড়িয়া। দরজার সামনের জোড়া সিটে বসা লোকটি নেমে যেতেই লটবহর সহ তার আসনটি দখল করে বসি আমি। কাতর স্বরে কন্ডাকটরকে মনে করিয়ে দিই, ভাই প্লিজ বোলো। আমি কিন্তু কিছুই চিনি না। তিনি আবার হেল্পারকে বলেন, ‘বৌদিটাকে মনে করে খড়্গপুর বাইপাসে নামিয়ে দিস তো।’ যাক এতক্ষণে বাইপাসটার নামটা অন্তত বুঝলাম। 


বাস ছুটে চলে রুদ্ধশ্বাসে মারিশদা-দুর্মুঠ-নাচিন্দা। কাঁথি বাইপাস বলে চিৎকার করে ওঠে হেল্পার ভদ্রলোক। তড়িঘড়ি উঠতে যাই আমি, পাশের অল্পবয়স্ক সহযাত্রীটি বলে ওঠে,‘দিদি আপনি পরেরটায় নামবেন।’ কৃতজ্ঞ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ভালো করে কান মাথা ঢেকে নিই। কি প্রচণ্ড হাওয়া ঢুকছে বাসে। ড্রাইভার আমি আর হেল্পার ছাড়া আর কেউ জেগে আছে বলেও মনে হচ্ছে না। প্রায় পৌনে দুই ঘন্টা হল বাসে উঠেছি। 


পরের চৌরাস্তায় যত্ন করেই নামিয়ে দেয় হেল্পারটি।  আঙুল দিয়ে দেখায় কোন রাস্তাটা ধরব আমি। ছুট্টে রাস্তা পেরিয়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ি আমি। রাত একটু ঘন হয়েছে। রাস্তাও বেশ ফাঁকা মহানগর বা শহরতলীর তুলনায়।কিছুই চিনি না। এবার কি করব? তাকে ফোন করব কি?পরক্ষণেই মত বদলাই, এভাবে নিজেকে তাচ্ছিল্য করা ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ। এই সামান্য কারণে তাকে বিব্রত করার মত অসহায়া অবলা অন্তত আমি নই। পাশের চায়ের দোকানের বৃদ্ধকে শুধাই, দাদা অমুক জায়গায় যাব। কি ভাবে যাব একটু বলুন না। 


গনগনে কয়লার উনুনে চায়ের কেটলি চাপাচ্ছিলেন ওণার বৃদ্ধা স্ত্রী, স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে বললেন,‘ঐ দেখো টোটো দাঁড়িয়ে আছে। ধরে চলে যাও।’ জানতে  চাই ভাড়া কত? হাবলা পেয়ে ঠকায় যদি। সে প্রশ্নেরও  জবাব দেন উনি। টোটোয় উঠি, গন্তব্য জানাই, টোটোওয়ালা জানায়, অত দূর যাবে না। কাছাকাছি একটা জায়গায় নামিয়ে দেবে। সেখান থেকে মহকুমা শাসকের করণ থুড়ি নিবাস খুব বেশি দূর না। 


রাতের কাঁথি শহরের বুক চিরে হাঁটতে থাকি আমি। দুদিকে আলোকমালায় সাজানো দোকানের সারি। কোথাও গরম পকোড়া ভাজছে তো কোথাও রসে টইটম্বুর জিলিপি। জামাকাপড়-গয়নাগাটি- বইপত্র-চশমার দোকানের সারির বুক চিরে অবশেষে যখন আপিস চত্বরে ঢুকছি, জনৈক টোটোওয়ালা জানতে চাইল, ‘যাবেন নাকি?’ কেমন রাগটা হয়! 


পরপর আপিসগুলোর অনেককটাই তখন অন্ধকারে ডুবেছে। শৌভিকের চেম্বারে যদিও আলো জ্বলছে। গাড়িও দাঁড়িয়ে আছে বাইরে। দেশোদ্ধার করছেন আমার বর বাবাজী। এর জন্য মহানগর ছেড়ে আসা একেবারে বেকার। একটুও ভালোবাসে না। দুটো সহানুভূতির কথা বলে না, কেবল ইমোজি পাঠায়।  আপদ 


বিড়বিড় করতে করতে খানিকটা এগিয়েই থমকে দাঁড়ালাম, আধো অন্ধকারে গা এলিয়ে বসে আছে দু-দুটো গাব্দা ষাঁড়। তাদের একজন সুপ্ত বটে অপরজন জুলজুল করে তাকিয়ে আছে আমারই দিকে। কোন মতে ইষ্টনাম জপতে জপতে তাদের পাশ কাটিয়ে বাংলোয় ঢুকলাম। ভেবেছিলাম সবাই আহাঃ আহাঃ করবে। উল্টে বাংলোর পাকশালা সামলায় যে ছেলেটি, সে বলল,‘মাত্র দুটো দেখতে পেলেন ম্যাডাম? ওখানে তো পনেরো বিশটা ষাঁড় থাকে। মাঝে মধ্যে কন্টাই বাজারে খেতে যায়। খেয়ে আবার পালিয়ে আসে।’ 


মা গো। আমি আর থাকব না এখানে। রোজ সন্ধ্যে বেলা এই ভাবে, ভোলে বাবা পার করে গা করতে আমি নাচার। আসুক আজ বুজুর বাবা। আগে ষাঁড় তাড়াবে তারপর অন্য কথা। ছেলেটি একগাল হেসে বলল,‘ ওরা কিচ্ছু বলে না ম্যাডাম। এই তো আমি বাজার করে ওর গায়ের পাশ দিয়ে নিয়ে এলুম, কিচ্ছু বলল না।’ দুধের কাপে চুমক দিয়ে নৈর্ব্যক্তিক ভাবে তুত্তুরী বলল, ‘বলবে না তো। সোজা উঠে গুঁতিয়ে দেবে।’ হে ভগবান সবাই আমার বিপক্ষে- আসুক আজ বুজুর বাপ।

অনির ডাইরি ১৮ই ডিসেম্বর, ২০২২

 

#কাঁথিরকিস্যা 


“একবার তো একটা মেয়ে সুইসাইডই করে ফেলল। রাত তখন আড়াইটা। সে কি ক্যাচাল ম্যাডাম।’ বক্তা  মহকুমা শাসকের বাহন চালক। 


মাস খানেক আগের কথা, তখনও শীত পড়েনি। সদ্য রঙ বদলেছে রোদ। বাতাসে লেগেছে সামান্য হিমেল স্পর্শ। যত্ন করে নতুন সাহেবকে শুঁটকি মাছ চাষ দেখাচ্ছিলেন ভদ্রলোক। মাছ ধরার পাশাপাশি, মাছ শুকানোও এই উপকূলীয় অর্থনীতির এক গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। অনভ্যস্ত শহুরে নাক হলে গন্ধটা বড় তীব্র লাগে। আগে জানলে সত্যিই আসতাম না। শৌভিক বলেছিল, পেটুয়াঘাট মৎস বন্দর দেখতে যাবে। বন্দর শুনে  হ্যাংলার মত লেজুড় হয়েছিলাম তুত্তুরী আর আমি। 


বন্দর দেখলাম, শৌলা আর জুনপুটে তারে ঝোলানো সারি সারি শুঁটকি মাছ দেখলাম। রঙবেরঙের ট্রলার দেখলাম। দেখেই অকুল দরিয়ায় ভেসে পড়তে ইচ্ছে করে। সাহস হয় না যদিও। বড় গন্ধ। বাঁধের ওপর দিয়ে পাকা রাস্তা চলে গেছে। পথের দুধারে দিগন্তপ্রসারী ফাঁকা মাঠ। মাঠ জুড়ে চলেছে মাছ শুকানোর কাজ। কোথাও খুঁটি পুঁতে, দড়ি টাঙিয়ে ঝোলানো রয়েছে সারি সারি বিভিন্ন প্রজাতির মাছ, কোথাও বা মাটিতে গর্ত করে পোঁতা, কোথাও বা সেই পুঁতে রাখা মাছকে তুলে ঝাড়াই-বাছাইয়ের কাজ চলছে। মাটি থেকে মাছ আলাদা করে জড় করা হচ্ছে স্তুপাকারে। মাছ শুকানোর কাজ মূলত বাড়ির মহিলারাই করছেন। হাত লাগিয়েছে সদ্য তারুণ্যে উপনীত হওয়া ফ্রক পরা মেয়ের দল ও। 


এদিকের মাটিটা বেশ বালি মেশানো। ড্রাইভার সাহেব বললেন কয়েক দশক পূর্বেও এই অঞ্চল ছিল সমুদ্র গর্ভে। রীতিমত ঢেউ খেলত। বাঁধের গায়ে আছড়ে পড়ত লবণাক্ত জলরাশি। এখন অবশ্য তিনি পিছিয়ে গেছেন বেশ অনেকটা। জোয়ারের সময় অবশ্য বেশ কিছুটা এগিয়ে আসেন আজও।  বাঁধের দুদিকে যত খানাখন্দ আছে, তাদের মধ্যে একদিকের জল মিষ্টি, অন্যদিকে লবণাক্ত। একদিকে প্রচুর সব্জি ফলেছে, অন্যদিকে পুকুর কেটে চলছে মাছ চাষের কাজ। প্রকৃতি হেথায় বড়ই উদার। সবকিছুই দিয়েছেন উজাড় করে। সবকিছুরই বড় প্রাচুর্য হেথা। ড্রাইভার সাহেব বললেন, ‘এদিকের লোককে মাছ কিনে খেতে হয় না স্যার।’ 


দেখতে দেখতে, শুনতে শুনতে, গ্রাম বাংলার রূপ- রস- গন্ধ- বর্ণে মোহিত হয়ে ফিরে চলেছি আমরা কাঁথি শহরের দিকে। একথা অনস্বীকার্য যে সমুদ্র দেখার সুপ্ত ইচ্ছে নিয়ে এসেছিলাম, ব্যর্থ মনোরথ হয়েই ফিরছি, তবে তাই নিয়ে তেমন ক্ষুন্নি বোধ নেই আমাদের। 


বেশ অনেক বছর ধরে কাঁথির মহকুমা শাসকের বাহন চালাচ্ছেন ভদ্রলোক। মহকুমাটাকে হাতের তালুর মত চেনেন। অনেক গল্প জানেন,বলতেও ভালোবাসেন। সাহেবের অনুমতি নিয়ে সামান্য ঘুরপথে নিয়ে চলেছেন আমাদের। উদ্দেশ্য হল মৎস দপ্তরের কি যেন একটা দীঘি দেখানো। সে দীঘি নাকি আয়তনে তেপান্তরের মাঠের সমান। কাকচক্ষুর মত টলটলে তার জল। অতি দক্ষ সাঁতারুও নাকি এপাড়- ওপাড় করতে হারিয়ে ফেলেন দম। চুনোপুঁটিদের পাশাপাশি রাঘববোয়ালরাও সেথা হাত-পা ছড়িয়ে সাঁতার কেটে বেড়ায়। শুধু ছিপ ফেলার অপেক্ষা। অবশ্য ছিপ ফেলতে সংশ্লিষ্ট দপ্তরের অনুমতি লাগে। 


গাড়ি চালাতে চালাতে বিভিন্ন সাহেব-মেমসাহেবদের সময় ঘটে যাওয়া না না ঘটন- অঘটনের গল্প শোনাচ্ছিলেন ভদ্রলোক। জনৈক সরকারী কর্মচারীর আত্মহত্যা তারই অঙ্গ। কোন এক নিশুতি রাতে গলায় দড়ি দেয় মেয়েটি। পাকেচক্রে কাঁথির তৎকালীন মহকুমা শাসক সে রাতেই কাঁথিতে উপস্থিত ছিলেন না। কি যেন দপ্তরী কাজে আটকে পড়েছিলেন দীঘায়। মধ্যরাত্রি অবধি দিব্যি জেগেই ছিলেন তিনি, ফোন সাইলেন্ট করে শুয়েছেন তার কয়েক ঘন্টার মধ্যেই এত বড় অঘটন ঘটায় মেয়েটি।


অকালে ঝরে যাওয়া এক অপরিচিতা কন্যার জন্য বেদনার্ত হয়ে ওঠে হৃদয়। আহা রে। না জানি, কত  যতনে লালনপালন করে বড় করে তুলেছিল বাবা মা। সেই সন্তান যদি এমন অবিবেচকের মত, নিজেকে শেষ করে দেয়, কিছু বলার থাকে না। উনিও সম্মতি জানান,‘ ঠিক বলেছেন ম্যাডাম।’ জানতে চাই, মেয়েটি কেন এমন করেছিল,কারণ জানা গেছে কি? কাজের চাপ নাকি মানসিক অবসাদ? জবাব আসে, ওসব তো ছিলই, সাথে অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছিল প্রেম। 


আবার গল্পে ফিরে যান ভদ্রলোক। বলতে থাকেন গভীর রাতে যখন আবিষ্কৃত হয় মেয়েটি অমন অঘটন ঘটিয়েছে, কতৃপক্ষ আতঙ্কিত হয়ে ফোন করে মহকুমা শাসককে। তখন রাত আড়াইটে। ওণার ফোন সাইলেন্ট ছিল, ফলে ফোন ধরতে কিঞ্চিৎ  বিলম্ব হয়। ইত্যবসরে মেয়েটিকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় এবং মৃত বলে ঘোষিত হয়। পরে যখন সাহেব/মেমসাহেব জানতে পারেন তিনি কিছুক্ষণের জন্য মানসিক ভাবে রীতিমত বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন। এমন নয় যে সেরাতে তিনি ফোন ধরলে মেয়েটি বেঁচে যেত, তবুও-।


 প্রাক্তন ওপরওয়ালা(ঈ) র প্রতি একরাশ মায়া মাখানো কণ্ঠে ঘাড় ঘুরিয়ে প্রশ্ন করেন ভদ্রলোক, ‘ আপনিই বলুন স্যার, এতে সাহেব/মেম সাহেবের কি দোষ?  রাত আড়াইটের সময় আপনাকে যদি কেউ ফোন করে, আপনি ধরবেন-’! 


দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে, “হ্যাঁ” বলে লম্বা ঘাড় নাড়ে শৌভিক। ‘ আমার ফোন সারা রাত খোলা থাকে, কখনও সাইলেন্ট থাকে না। খুব গুরুত্বপূর্ণ মিটিং এ না থাকলে আমি সব ফোন ধরি।’ থতমত খেয়ে গাড়ি চালানোয় মন দেন ভদ্রলোক। হাসি চাপি আমি, সত্যিই আমার বর ফোন ধরে ভাই। রাতবিরেতে , সময়- অসময়ে সবসময় ধরে। ধরতে পারে না কেবল যখন ইয়ে করতে যায়। কপালের এমন গেরো,যে ওই ঘরের চৌকাঠ ডিঙানো মাত্রই লাইন দিয়ে আসতে থাকে ফোন। ঘন্টি শুনে ছুট্টে এসে দরজার বাইরে থেকে চিল্লাই আমি বা তুত্তুরী, অমুকের ফোন/ তমুকের ফোন/ অজানা নম্বর থেকে আসা ফোন ইত্যাদি প্রভৃতি। 


এই অজানা নম্বর থেকে আসা ফোন গুলির মধ্যে আবার কেউ কেউ থাকেন, যাঁরা ফোনটি না ধরা পর্যন্ত করতেই থাকেন- একবার, দুবার, তিনবার। ওদিকে ফোন চিৎকার করে এদিকে আমি, ‘ওরে আমার বরটাকে ইয়েটা করতে দে বাপ।’ কতবার হয়েছে দাঁত মাজতে মাজতেও ফোন ধরেছে শৌভিক। এমনকি কুলি থুড়ি কুলকুচি করতে করতেও। বিগত বছর দেড়েকে আমাদের দাম্পত্য আলাপ তথা কলহও হয়েছে অমনি, থেমে থেমে, পূর্ণচ্ছেদ, কমা, কোলন, সেমি কোলন ইত্যাদি দিয়ে। ওটা যে কাজেরই অঙ্গ, সেটা বুঝে, মেনে নিয়েছি আমরা। অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি আমরা। 


এর মধ্যে শুধু একদিনই ফোন সাইলেন্ট রেখেছিল শৌভিক, যেদিন প্রযুক্তি গত কি যেন গড়বড় হয় আর লক্ষ্মীর ভাণ্ডার সংক্রান্ত একটা মেসেজের সাথে সাথে ওর মোবাইল নম্বরটা পৌঁছে যায় তমলুক মহকুমার ঘরে ঘরে, মা লক্ষ্মী দের মুঠোয় রাখা মুঠি ফোনে। পরিণতি সহজেই অনুমেয়।  মিনিটে মিনিটে আছড়ে পড়তে থাকে, ৩০/৪০ খানা ফোন প্রবাহ। একটা ফোন ধরে, ছাড়ার আগেই হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ছিল গুচ্ছ গুচ্ছ কল ওয়েটিং। সে এক রাত গেছে বটে। আক্ষরিক অর্থেই ছেড়ে দে মা (লক্ষ্মী), কেঁদে বাঁচি। 


তখন কি আর জানতাম যে বছর ঘোরার আগেই ঘটতে চলেছে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি । দিন তিন চার আগের কথা, কাক ডাকা ভোর থেকে বানের জলের মত আসতে শুরু করল ফোন। সেবার ফোনের ওপারে শুধু মা লক্ষ্মীরা ছিলেন, এবার অবশ্য কোন লিঙ্গবৈষম্য পরিলক্ষিত হল না। সবার একই প্রশ্ন, একই অনুরোধ " স্যার, অমুক প্রকল্পে নাম ওঠেনি। একটু আমার ব্যবস্থা করে দিন স্যার।"  যে প্রকল্পের জন্য ফোন,তা আদৌ মহকুমা শাসকের দপ্তর থেকে দেখা হয় না। প্রথম জনা পঞ্চাশকে সেটাই বলল শৌভিক। শান্ত ভাবে জানাল,কোন অফিসে যোগাযোগ করতে হবে। এমনকি এটা যে আপাতত কেবল পঞ্চায়েত এলাকায় হচ্ছে, পুরসভায় নয়,তাও বোঝালো কাউকে কাউকে। এই জেলা তথা মহকুমার লোকজন এমনিতে খুব বাধ্য,বললে অযথা তর্ক করে না। অবশ্য ব্যতিক্রম তো সর্বত্র বিদ্যমান। তেমনি এক ব্যক্তি বেশ বকেই দিলেন আমার বরটাকে। " আপনার অফিসে হবে না যখন, আপনার নম্বর দিয়েছেন কেন?"  


কোথায় নম্বর দিলাম রে বাবা,আকাশ থেকে পড়ে শৌভিক। ধীরে ধীরে ঝুলি থেকে বেরোন বাঘের মাসি। এক স্থানীয় সংবাদ পত্রের জনৈক সাংবাদিক মহাশয়, উক্ত প্রকল্পটি নিয়ে এক আগুনে প্রতিবন্ধ লিখেছেন। লিখতে লিখতে উদ্দীপনার বশে তিনি এই জেলার চার মহকুমা শাসকের ব্যক্তিগত নম্বরগুলিও টুকে দিয়েছেন। বিশদ জানতে ফোন করুন বা নালিশ জানান- এই ধরণের কোন শিরোণামে। 


পত্রিকাটি যেহেতু কাঁথিতেই প্রকাশিত হয়, স্থানীয় লোকজনই কেবল পড়েন ফলে নম্বরটা হাতে হাতে ছড়িয়ে পড়েছে আগুনের মত। পরিণতি অনুমেয়।আপদে বিপদে মানুষ অবশ্যই ফোন করবে, করেও, কিন্তু তাই বলে ওটা যে আদৌ কোন প্রকল্পের হেল্পলাইন নম্বর নয়, ওই সংক্রান্ত রিপোর্টে করো নম্বর ছাপতে হলে অন্তত তার মৌখিক অনুমতি টুকু নেওয়া দরকার, তথাকথিত সাংবাদিকদের থেকে এইটুকু নৈতিকতা কাঙ্ক্ষিত বটে, কে আর তার মর্যাদা দেয়। ভাগ্যে জনগণের স্মৃতিশক্তি  অত্যন্ত দুর্বল, আজকের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলি গুণোত্তর প্রগতিতে হারাতে থাকে তাদের তাৎপর্য, সেটাই আপাতত আমাদের ভরসা।

Thursday 15 December 2022

তুত্তুরী উবাচ ১৫ই ডিসেম্বর, ২০২২

 


👩🏻- বাবু ওঠ। সোয়া ছটা বাজছে। স্কুল যেতে হবে। 

👧🏻- (দু হাত জড়ো করে ছলছল চোখে) মা প্লিজ মা, আজ স্কুল যাব না। সারা রাত কানের ব্যথায় ঘুমাতে পারিনি। 

👩🏻- (উদ্বিগ্ন স্বরে) সে কি! আবার? ঠিক আছে, স্কুল যেতে হবে না, শুয়ে পড়। (মেয়ের গায়ে কম্বল চাপা দিতে দিতে, ছেলে ভোলানো স্বরে) বাবু জানিস তো, কাল আর্জেন্টিনা জিতেছে। 

👧🏻-(চোখের জল মুছে, মিনমিনে স্বরে) জানি। তিন-শূণ্যে। মড্রিচের জন্য আমার খুব মন খারাপ। 

👩🏻-(সন্দিগ্ধ স্বরে) তুই জানলি কি করে? খেলা তো রাত আড়াইটায় শেষ হয়েছে!

👧🏻-(ধরা পড়ে যাওয়া স্বরে) আসলে খুব কান ব্যথা করছিল তো, তাই মাসির ফোনটা নিয়ে দেখছিলাম চোখের ড্রপ কানে দেওয়া যায় কি না। গুগল বলল যায় না। (মাকে ভোলাতে, ছদ্ম উত্তেজনা দেখিয়ে) জানো মা, আর কি শিখলাম,  এমনকি নাকের ড্রপ ও কানে দেওয়া যায় না।

অনির ডাইরি ৯ই ডিসেম্বর, ২০২২

 


ভদ্রলোকের আজ জন্মদিন। যখন ভূমিষ্ঠ হয়েছিলেন, আক্ষরিক অর্থেই পৃথিবী কাঁপাচ্ছেন ওণার সমনামধারী জনৈক গুঁফো জার্মান সাহেব। অবিভক্ত ভারত। ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে আবেদন-নিবেদনের রাজনীতির উপর বীতশ্রদ্ধ হয়ে, সদ্য নতুন দল গঠন করেছে সুভাষ। ভারত ছাড়ো আন্দেলন থেকে নেতাজীর অন্তর্ধান, ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে থেকে দেশ ভাগ কিছুই তখনও লেখা হয়নি সময়ের খেরোর খাতায়। 


বিশ্বাসই হয় না, দেখতে দেখতে ৮৩টা বসন্ত পার করে ফেললেন ভদ্রলোক। সাক্ষী রইলেন কত না উত্থান-পতন, কুশীলব থেকে পট পরিবর্তনের। ভদ্রলোক নিজেও কম বর্ণময় চরিত্র নন। ওণাকে নিয়ে একটা-দুটো নয়, গল্প লেখা যায় ভুরি ভুরি। যেমন সপ্তম শ্রেণীর সেই দিনটা, স্কুলের বড় গেট থেকে বেরোনোর সাথে সাথে যেদিন আমাকে ছেঁকে ধরেছিল একদল সুহৃদ। সবার চোখে উৎকণ্ঠা, মুখে একটাই প্রশ্ন ‘ কি রে,কি হল?’ 


উদ্বিগ্ন হওয়াটাই স্বাভবিক, যা কেলো বাঁধিয়েছিলাম আমি। সেই সময় হাওড়া গার্লস কলেজে যারা BT পড়তেন, তাদের প্রাকটিক্যাল পড়ত আমাদের স্কুলে। সে এক দারুণ মজার ব্যাপার। রোজ, রোজ নতুন দিদিমণিরা আসতেন ক্লাস নিতে। কেউ বকতেন না, গল্প বলার ছলে সামান্য হাসি মস্করা মিশিয়ে পড়াতেন। সময় যে কোথা দিয়ে কেটে যেত। এই নবাগতা সুবেশা তরুণী শিক্ষিকাকুলের রীতিমত অনুরাগী হয়ে পড়তাম আমরা। 


কদাচিৎ আবার কেউ কেউ রাগী দিদিমণি সুলভ হাবভাবও দেখাতেন। ভাগ্যক্রমে তেমনি এক দিদিমণির সাথে সম্মুখ সমরে জড়িয়ে পড়েছিলাম আমি। ভূগোল পড়াতে এসে সামান্য ভুল তথ্য দিয়ে ফেলেছিলেন। হয়তো নার্ভাস হয়েই, কারণ ক্লাস চলাকালীনই চলত ওণাদের অ্যাসেসমেন্ট। ক্লাস রুমের পিছনের দরজা দিয়ে যখন তখন নিঃসাড়ে ঢুকে আসতেন ওণাদের শিক্ষক- শিক্ষিকারা। যদিও সেই সময় তেমন কেউ উপস্থিত ছিলেন না ক্লাসে। চিরকালের ডেঁপো আমি, দিদিমণির ভুল ধরতে পারার উত্তেজনা আর চাপতে না পেরে মুখ ফুটে বলেই বসলাম। সঙ্গত দিল আরো গুটি তিনেক সহপাঠী। 


ভুল স্বীকার করে নিলেই ল্যাটা চুকে যেত, অথবা আমাদের ধমকে বসিয়ে দিলেও ব্যাপারটা ওখানেই মিটে যেত। উনি সেসব কিছু না করে সটান নালিশ করে বসলেন ওণাদের হেডুর কাছে। তিনি আবার অনুযোগ জানালেন আমাদের বড়দির কাছে। সালিশি করতে পাঠানো হল বাংলার কমলকলিদি দিকে। উনি ক্লাস এসে হাই তুলে বললেন, ‘ এই BTর বিটি(বেটি)দের নিয়ে আর পারি না। কে কি বলেছিস বাবা, যা গিয়ে মার্জনা চেয়ে ধন্য কর।’ 


ছুটির ঘন্টা বাজার পর সেই মার্জনাই চাইতে গিয়েছিলাম চার ইয়ার মিলে, কমন রুমে।  অভিযোগকারিণী এতটাও বোধহয় আশা করেননি, ফলে মার্জনাভিক্ষা পর্ব তো বেশ নির্বিঘ্নেই সমাপন হল। বাইরে বেরিয়ে দেখি, ‘যেখানে বাঘের ভয়,সেখানেই’ ইয়ে , পিসির পরিবর্তে সেদিনই বাবা আনতে এসেছে। বাবার সামনেই বন্ধুদের ঐ প্রশ্নবাণ যে কি মারাত্মক আতঙ্ক জাগিয়েছিল, তা শুধু আমিই জানি। কোন মতে মাছি তাড়ানোর মত সবকটাকে কাটিয়ে বাবার হাত ধরে টানলাম, বাড়ি যাব। বড় রাস্তা পেরানো অবধি বাবা নীরবই ছিল, গলিতে ঢুকে ফস্ করে একটা সিগারেট ধরিয়ে, এক মুখ ধোঁয়া ছেড়ে জানতে চাইল,‘স্কুলে এক্জাক্টলি কি করেছিলি?’ 


বিস্তর ঢোঁক গিলে, হেঁচে-কেশে, ‘ব্রহ্মা-বিষ্ণু-কালী’ ইত্যাদি তেত্রিশ কোটি দেবদেবীকে স্মরণ করে বলেই ফেললাম সবিস্তারে। ভেবেছিলাম খুব বকবে, বকা তাও ভালো,  গৃহত্যাগ না করে বসে। একবার মায়ের কথায় খার খেয়ে, বাবার নেশা ছাড়াতে এক প্যাকেট সিগারেট কুচিয়ে নষ্ট করেছিলাম, যার জন্য করেছিলাম তিনি তো ধমকে আমার গুষ্টি উদ্ধার করেছিলেন, বাবা কিছু বলেনি, কেবল গৃহত্যাগের হুমকি দিয়ে আরেক প্যাকেট সিগারেট কিনতে বেরিয়ে গিয়েছিল। যখন ফিরেছিল, ততোক্ষণে কেঁদে গোটা বাড়ি মাথায় তুলেছি আমি। সেই থেকে বৃদ্ধের গৃহত্যাগের হুমকিকে বড় ভয় আমার। সেবার অপরাধ লঘু ছিল, ফিরে এসেছিল। এবার যে কি হবে। 


আমার যাবতীয় শঙ্কাকে হাওয়ায় উড়িয়ে দিল বাবা। হো হো করে হেসে উঠে বলল, ‘বেশ করেছিস। স্কুল - কলেজে অমন আমিও অনেক করিছি, বুঝলি-। শুনবি নাকি সে সব গল্প?’। 


ভদ্রলোক অমনিই। বেশ খানিকটা খামখেয়ালি, আর অনেকটা, ‘সৃষ্টিছাড়া-নিয়মহারা-হিসাবহীন।’ তা নাহলে কেউ কিশোরী কন্যার হাতে জ্বলন্ত সিগারেট ধরিয়ে বলে,‘টেনেই দেখ না, কেমন খেতে-’। দোষের মধ্যে আমি জানতে চেয়েছিলাম, যে সিগারেট খাওয়া নিয়ে নিত্য অশান্তি হয় এ বাড়িতে, সেটা খেতে কেমন? নির্ঘাত খুব সুস্বাদু। অতঃপর যা হয় আর কি, বাবাকে নকল করে ধোঁয়া টানা এবং প্রবল কাশি। কাশির দমক থামলে,মায়ের উদোম খিস্তির ঝড় শান্ত হলে জিজ্ঞাসা করেছিলাম,‘এটা কেন করলে?’ ফিচেল হেসে লোকটা বলেছিল,‘আমার মেয়ে, বড় হয়ে তো ফুঁকবিই। বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে গোল্লায় যাস না। খেতে ইচ্ছে হলে আমার থেকে চেয়ে খাস।’ 


বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে প্রথম ইয়ে খেয়েছিলাম যেদিন,সেদিনও একই কথা বলেছিল বাবা। তখন সদ্য চাকরী পেয়েছি। মনের মত চাকরী। খড়্গপুরে পোস্টিং। দীর্ঘ ট্রেন যাতায়াতের পথে গড়ে ওঠা কিছু বন্ধুর সাথে ছুটির পর, খড়্গপুর স্টেশনের কাছে এক পার্কে বসে, আক্ষরিক অর্থেই এক ছিপি করে খাওয়া আর কি। ডাক্তার কাকুর হোমিওপ্যাথি ওষুধের মত খেতে লেগেছিল মাইরি। তাও কি ভয়। এতটা রাস্তা একা ফিরব, বাকিরা নেমে যাবে মেচেদা থেকে দেউলটির মধ্যে। নবু পইপই করে সাবধান করে দিল,‘ আজ অন্তত হ্যাংলার মত ট্রেনে গজা বা পান্তুয়া উঠলে খাস না। পারলে জানলার ধারেও বসিস না। খোলা হাওয়ায় নেশা বাড়ে-।’ নেশা -টেশা কিছুই বুঝলাম না। দিব্য দাশনগর স্টেশনে নেমে,রিক্সাওয়ালার সাথে ব্যাপক দরাদরি করে গলির মুখে নামলাম। নবু বলেই দিয়েছিল, বাড়িতে ঢোকার আগে একটা পান খেতে। গন্ধ চাপার জন্য। পানের দোকানে গিয়ে দেখি, বাবাও এসেছে সিগারেট কিনতে। আমার বাড়ি ফেরার সময়, প্রায়ই কিছু না কিছু কেনার অছিলায় গলির মুখে চলে আসত বাবা। মিষ্টি পান আমি বরাবরি ভালোবাসি, তাতেও কোন অস্বাভাবিকতা নেই। পান কিনলাম, বাবা পয়সা দিল। পান গালে পুরে, সারাদিনের গল্প বলতে বলতে ফুরফুরে মনে বাড়ি ফিরছি, বাবা হঠাৎ বলল,‘পয়সা দিয়েছিলি?’ এ্যাঁ! কি? খেই হারিয়ে জানতে চাই আমি। দুই আঙুলের ফাঁকে জ্বলন্ত সিগারেট ধরে, বাতাসে স্বভাবসিদ্ধ আঁকিবুকি কাটতে কাটতে বাবা বলল ,‘ জীবনে আর যাই করিস, পরের পয়সায় নেশাটা করিস না। আর যদি খেতেই হয়, কি ব্রাণ্ড তোর বন্ধুরা খায়, জেনে বলিস, আমি কিনে এনে দেব। এতটা রাস্তা একা আসিস, পথে কি বিপদ আপদ হয়, তার থেকে বাড়িতে বসেই না হয়-’। 


একই কথা বলেছিল বাবা, যেদিন আমি কলেজ থেকে বাড়ি ফিরে অশান্তি করেছিলাম, আমার সব বন্ধুরা ইয়ে সিনেমা দেখে ফেলেছে, আমি কেন দেখিনি। রীতিমত হ্যাটা দেয় সবাই। ' গুড গার্ল ', ' আব্দেরে আলুভাতে ' বলে খেপায় সবাই। তখনও ইন্টারনেট আসেনি, লাল-নীল ছবির জন্য সিডিই ভরসা। মা তো গালি দিয়ে ভূত ভাগিয়ে দিয়েছিল, মুড়ো খ্যাংরা যে জোটেনি কপালে এই ঢের। আর বাবা বলেছিল, ‘দুয়েকটা সিনেমার নাম জেনে আসিস, আমি পার্লার থেকে সিডি এনে দেব, বাড়িতে বসে দেখে নিস।’ 


বাবা অমনিই, ঘোরতর বাস্তব হয়েও কেমন যেন ইচ্ছে পূরণের স্বপ্ন। শুভ জন্মদিন বাবা। খুব ভালো থাকো,সুস্থ থাকো। যেমনি আছো, তেমনি থাকো। Love you to the moon and back.

Sunday 4 December 2022

শৌভিক বাণী


শৌভিক বাণী ২৯শে ডিসেম্বর,২০২২


👨🏻- (রিলস্ দেখতে দেখতে, এক গাল হাসি নিয়ে) একটা ছেলেকে ভিডিও তুলতে বলেছে, ছেলেটা ক্যামেরাটা নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিয়েছে। 

👩🏻-(গেম থেকে মুখ তুলে) ওটা ২৫ বছর ধরে বাজারে চলছে। তুই আজ দেখলি। 

( অতঃপর কফির কাপে চুমুক দিতে গিয়ে) এ ম্যা গো! আমার কফিতে একটা পোকা পড়ে বসে আছে। 

👨🏻- (তির্যক স্বরে) তা পোকাটার কি দোষ? কফিটা এত ক্ষণ ধরে ফেলে রেখে দিয়েছিস ও ভেবেছে ওটা বোধহয় সুইমিং পুল। তাই গরম জলে সাঁতার কাটতে নেমেছে। 

👩🏻- 🫤

শৌভিক বাণী ২৭শে ডিসেম্বর,২০২২


👨🏻- পৌঁছতে এখন তিন ঘন্টা।  ঘুমিয়ে পড়। 

👩🏻-(হাই চেপে) আমার গাড়িতে ঘুম আসে না। 

👨🏻- একা থাকলে আমি তো দারুণ ঘুমাই। 

👩🏻-(সন্দিগ্ধ স্বরে) দোকায় কি প্রবলেম?

👨🏻-(দীর্ঘশ্বাস ফেলে) প্রবলেমটা সঙ্গে থাকে তো। 

👩🏻-😡

শৌভিক বাণী ১৮ই ডিসেম্বর, ২০২২


👨🏻-(খেলা শুরুর আগে, বিজ্ঞ স্বরে) দীনু কাকুকে বললাম, আজ ফ্রান্স জিতলে আমি খুব খুশি হব। 

👩🏻-সে কি? তুই তো চিরকালীন আর্জেন্টিনার সমর্থক রে। 

👨🏻-( উদ্দীপ্ত স্বরে) হ্যাঁ, কিন্তু ফ্রান্স হল বিপ্লবের আঁতুড় ঘর। উদার দেশ। বর্ণ বিদ্বেষ নেই। অনর্থক ইমিগ্রেশনের ঝামেলা নেই। কড়া বিধিনিষেধ নেই। কত জন কৃষ্ণাঙ্গ খেলোয়াড় আছে দেখছিস না। যুদ্ধটুদ্ধও তেমন পারে না-----_-। 


(খেলা শুরু হতেই) গোওওওওওল। 

👩🏻- আর্জেন্টিনা গোল করল তো। তো তুই খুশি হচ্ছিস কেন?

👨🏻-(বিরক্ত হয়ে)হব না?

👩🏻- তবে যে দীনু খুড়োকে পট্টি পড়ালি, যে ফাইনালে তুই ফ্রান্সকে সমর্থন করবি। 

👨🏻-( চোখ পাকিয়ে, দাঁত কিড়মিড় করে) মোটেও আমি তাই বলিনি। বলেছি ফ্রান্স জিতলেও এএএএ মানে ঠিইইইক আছেএএ।  

👩🏻- 🐻😡

শৌভিক বাণী, ৪ঠা ডিসেম্বর,২০২২

👨🏻- এত পড়ার চাপ দিচ্ছিস কেন(তুত্তুরীকে)?

👩🏻- চেপে পড়তে না বসালে, ও জীবনে পড়তে বসবে? পরীক্ষায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ফেল করবে যে। 

👨🏻- বসে বসেই ফেল করুক না। কি যায় আসে। 

👩🏻- 😡

 


শৌভিক বাণী ৯ই মে, ২০২২

👩🏻-আঁকশি কাকে বলে জানিস?

👨🏻-হুঁ যেটা দিয়ে আম পাড়া হয় তো?

👩🏻- হ্যাঁ। একটা লম্বা লাঠির ডগায়, আরেকটা ছোট লাটি ভি এর মত করে-

👨🏻-(মাঝপথে বিরক্ত হয়ে) জানি রে বাবা। 

👩🏻-(বিড়বিড় করে) না মানে বাঙালরা আবার আঁকসিকে ঠিক কি বলে, তা তো জানি না। তাই ভাবলাম 

👨🏻-(অত্যন্ত শীতল স্বরে) জানতাম না তো। শ্বশুর মশাইয়ের কাছে শেখা। সেই যে সেবার ওণার সাথে কামচাটকা গিয়েছিলাম, কৃষক বিদ্রোহ সংগঠিত করতে। 

👩🏻-( হাসি চেপে) কামচাটকায় কৃষক বিদ্রোহ-

👨🏻-হয়েছিল তো। আমার শ্বশুর মশাই সংগঠিত করেন। সেখানেই একজন কৃষক একটা আঁকসি নিয়ে এসেছিল অস্ত্র হিসেবে। শ্বশুরমশাই বোঝালেন,এটা শুধু অস্ত্র হিসেবেই ব্যবহার করা যায় না, এটা দিয়ে ফলও পাড়া যায়। এটা দিয়ে তোমরা আম আর খেজুর পেড়ে খেও। তারপরই তো ফল পাড়তে আঁকসির ব্যবহার শুরু হল। তার আগে তো ওটা দিয়ে চাষ করা হত। 

👩🏻- (হাসির দমকে, বিষম খেয়ে) সিরিয়াসলি, বিয়ের পর এত বছর হয়ে গেল, এবার আমার বুড়ো বাপটাকে একটু ছাড়। তোর শ্বশুর নিয়ে অবসেশনটা দিন দিন মাত্রা ছাড়া হয়ে যাচ্ছে মাইরি।


 শৌভিক বাণী ১১ই অক্টোবর, ২০২১

"We enjoy as a family, we suffer as a family."

শৌভিক বাণী- ২৫শে জুলাই, ২০২১

‘পরীক্ষা বছরে চারটে করে হয়, আর অলিম্পিক  চার বছরে একবার। ওকে(শ্রীমতী তুত্তুরী) শান্তিতে অলিম্পিক  দেখতে দে। অত পড়াশোনা করার দরকার নেই।’

অতঃপর আহ্লাদী কন্যাকে আর পায় কে?😡


শৌভিক বাণী- ৭ই ফেব্রুয়ারি ২০২১

"বিয়রকে বলা হয়, সফ্ট ড্রিংক ফর অ্যাডাল্টস্। এই ব্রীজার ব্যাপারটা নির্ঘাত বিয়র ফর কিডস।"

শৌভিক বাণী- ৫ই এপ্রিল ২০২০

“করোণা মাই কি জয়। আসছে বছর আবার হবে। ” 


শৌভিক বাণী ২২ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৮

“এবার মুখর করে দাও হে তোমার নীরব মোদী’রে”- শৌভিক বাণী অদ্য প্রাতে-




‘পরীক্ষা বছরে চারটে করে হয়, আর অলিম্পিক চার বছরে একবার। ওকে(শ্রীমতী তুত্তুরী) শান্তিতে অলিম্পিক দেখতে দে। অত পড়াশোনা করার দরকার নেই।’




অতঃপর আহ্লাদী কন্যাকে আর পায় কে?😡


তুত্তুরী উবাচ ১লা ডিসেম্বর, ২০২২

 


👩🏻- দুধের কাপ নিয়ে আর কতক্ষণ বসে থাকবি বাবু? পড়তে বসবি কটায়? রাত নটায়?

👧🏻- (ফোঁস দীর্ঘশ্বাস ফেলে, হতাশ হয়ে মাথা নাড়তে নাড়তে) এই জন্যই বলেছিলাম। আমি অনেক আগেই বুঝেছিলাম ব্যাপারটা। তুমিই মানতে চাও না। 

👩🏻-(ঘাবড়ে গিয়ে) কি?

👧🏻- আরে অলিম্পিক-ওয়ার্ল্ড কাপ চার বছরে একবার আসে, আর পরীক্ষা বছরে চার বার। কোনটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ তুমিই বলো।

Sunday 27 November 2022

অনির ডাইরি (তমলুক ছেড়ে কাঁথির পথে)

 

 

অনির ডাইরি ৯ই নভেম্বর, ২০২২

(পর্ব - ১)

এই তো সেদিন বদলি হয়ে এল শৌভিক। সোহাগী ফোনটা প্রথম করেছিল এষা। বাড়িতে সেদিন একাই ছিল শৌভিক। তুত্তুরীকে নিয়ে হাওড়া গিয়েছিলাম আমি। 


আমাদের এই ছুটকো-ছাটকা ঝটিকা সফর গুলো ভীষণ ভাবে উপভোগ করে শৌভিক। আমরা না থাকা মানেই নাকি অখণ্ড নির্জনতা, অপার শান্তি আর স্বাধীনতা। এই দিনগুলোয় নিজের হাতেই টুকটাক রান্না করে শৌভিক। সেদিনও তেমনি নৈশভোজের জন্য ম্যাগি আর ডিম সিদ্ধ বসাতে গিয়েছিল। এষার উচ্ছ্বাসের ধাক্কায় হাত থেকে ধড়াম করে প্যানটাই পড়ে গিয়েছিল মাটিতে। আর শৌভিক পড়েছিল রীতিমত আকাশ থেকে। 


বিস্মিত শৌভিকের ন্যাতানো প্রতিক্রিয়ায় চটে গিয়েছিল এষা। ‘ধুৎ দাদা, তুমি সত্যিই জানতে না। অর্ডার দেখোনি?’ এষার ফোনের মাঝেই ঝড়ের মত আসতে শুরু করেছিল শুভেচ্ছা বার্তা এবং শুভকামনামূলক ফোন। সমস্ত কিছু থেকে অনেক দূরে, আমি তখন গলা ফাটাচ্ছি বাবার বৈঠকখানায় চাটুজ্জেদের সান্ধ্যকালীন আড্ডায়। জম্পেশ করে মুড়ি মেখেছিল মা, মুড়ি শেষে চা চাপিয়েছি এমন সময় বরের ফোন। 


শৌভিকের প্রথম সম্ভাষণ আজও আমার কানে ভাসছে। ‘ কপাল পুড়েছে’।  খোলসা করে আর বলতে হয়নি। কিছু কিছু ক্ষেত্রে আমার ইনট্যুশন বেশ ধারালো। বেশ কিছুদিন ধরে এমনিই মনে হচ্ছিল, বলছিলামও বার বার,‘তুই বাপু বাঁচবি না। তোর কপালে এসডিও গিরি নাচছে।’ তবে সেটা যে এইভাবে সত্যি হয়ে যাবে তা স্বপ্নেও ভাবিনি। ঐ জন্যই ঠাকুমা বলত, কথা ক্ষণে পড়ে। মুখ খোলার সময় বুঝেশুনে বলতে হয়, কখন কি ঘটে যায়, কিচ্ছু বলা যায় না। 


৯ই জুলাই শুক্রবার জয়েন করতে গেল শৌভিক। একসাথেই বেরোলাম দোঁহে, যে যার আপিসের উদ্দেশ্যে। শৌভিকের ড্রাইভার, সিকিউরিটি উদগ্রীব হয়ে অপেক্ষা করছিল নতুন সাহেবের জন্য। উর্দি পরা, কোমরে বন্দুক গোঁজা নিরাপত্তা রক্ষী তড়িঘড়ি এগিয়ে এসে শৌভিকের হাত থেকে ব্যাগটা নিয়ে নিল। দরজা খুলে ধরল, ভ্যানিলা আইসক্রিম রঙা মস্ত জাইলো গাড়িটার। গাড়িতে যখন উঠে বসল শৌভিক, প্রবল গর্বের সঙ্গে সঙ্গে কেন যে টনটনিয়ে উঠছিল হৃদয় আর এত করকর করছিল দুটো চোখ। এবার তাহলে সত্যিই আলাদা হবার পালা, ভাবলেই ডাক ছেড়ে কাঁদতে ইচ্ছে করছিল। 


মার্চ মাস নাগাদ বিধাননগরে বদলির অর্ডার হয়েছিল আমার। মুভমেন্ট অর্ডার অর্থাৎ কবে কাকে চার্জ দিয়ে যাব সেই সংক্রান্ত অর্ডারের জন্য  দিন গুণছিলাম আমি। সেদিন মনে হল পলকে উল্টোপাল্টা হয়ে গেল চেনা অঙ্কটা। 


মহানগরের সদর দপ্তরে যেদিন সনির্বন্ধ অনরোধের ডালি নিয়ে গিয়ে হাজির হলাম, উর্ধ্বতন কতৃপক্ষ অত্যন্ত সহমর্মিতার সঙ্গেই জানতে চাইল কেন? তুত্তুরীর কি হবে? সোজা জবাব, স্কুল বদল হবে তুত্তুরীর। তারপর? যখন বদলি হয়ে যাবে যে কোন একজন তখন কি করবে? আবার স্কুল পাল্টাবে কি? স্নেহশীল দাদা,দিদি,বন্ধুরা বলল, হঠকারিতা নয়, একটু ভেবে সিদ্ধান্ত নাও। ও আসবে না হয় সপ্তাহান্তে,তোমরাও যাবে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে।


 মুস্কিল হল ব্যাপারটা ভাবতে যতটা সোজা,বাস্তব রূপায়ন ততোটাই জটিল। যাবতীয় ঝঞ্ঝাট- ঝামেলা, ঝড়- বৃষ্টি- তুফান দেখতাম বেছে বেছে সপ্তাহান্তেই এসে হাজির হত। আর ঐ ভাবে প্রতি সপ্তাহে তুত্তুরীর মাসিকে বাড়ি পাঠিয়ে, বাসন মাজার দিদিকে নিষেধ করে সব বন্ধ করে, তাল-ছন্দ মিলিয়ে আমাদের আসা যাওয়াটাও মোটেই সহজ ছিল না। অনেকেই করেন, বেশির ভাগ এমনি অফিসারদের সুগৃহিনীরাই তাই করেন। কিন্তু আমি যে মোটেই অত ভালো গিন্নি নই। অবুঝ হৃদয় যে কথাই শোনে না। পশ্চিম মেদিনীপুর ছেড়ে পুরুলিয়া গিয়েছিল যখন সুকন্যা, কি খিল্লিই না করেছিলাম আমি। বরকে ছেড়ে থাকতে পারে না বলে রীতিমত আওয়াজ দিতাম বেশ কিছুদিন।  অথচ যখন একই পরীক্ষায় বসতে হল আমায়, সু এর থেকেও খারাপ ফল করলাম আমি। একটা লোকের অনুপস্থিতিতে রাতারাতি যে কি বিবর্ণ, বিশ্রী হয়ে গিয়েছিল কল্লোলিনী তিলোত্তমা। 


২৭শে অক্টোবর যখন শেষ পর্যন্ত বদলির অর্ডারটা বেরোল, হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। কোজাগরী লক্ষ্মী পুজোর দিন,মেয়ে আর মেয়ের মাসীকে বগলদাবা করে, এতদিনের সংসার, সাধের গাছপালা ফেলে নির্দয়ের মত চলে এলাম পূব মেদিনীপুর। চারটে দেওয়াল আর একটা ছাতে বাড়ি হয় থোড়াই, বাড়ি বা সংসার গড়তে লাগে প্রিয়জন সাহচর্য। ব্যাপারটা বেশ ন্যাকা শোনালেও আমার মত অপদার্থ অলবড্ডেদের জন্য নির্মম সত্যি।


 নতুন করে গড়ে তুললাম আমরা আমাদের, ' লাল- নীল সংসার'। মহকুমা শাসকের মহা ফাঁকিবাজ ডেজিগনেটেড রাঁধুনীকে হাত ধরে রান্না শেখালাম তুত্তুরীর মাসি আর আমি। কি যে ভয়ানক রান্না করতেন তিনি। সব ডাল, সব তরকারি,সব মাছে যে কি করে একই স্বাদ আর গন্ধ আনতেন ভগবানই জানেন। 


প্রথম প্রথম ফেলে আসা, তালা বন্ধ বাড়িটার জন্য কাঁদত তুত্তুরী। মন খারাপ করত,ফেলে আসা স্কুল আর বন্ধুদের জন্য। ধীরে ধীরে ভালো লেগে গেল নিমতৌড়ির এই নিরালা প্রান্তর। বিরাট বিরাট কাঁচের জানলা, সক্কাল সক্কাল মোটা পর্দার ফাঁক গলে জবরদস্তি ঢুকে আসেন দিনমণি। আর আসে পাখির ঝাঁক। জানলার পর্দা সরালেই ঝাঁক বেঁধে উড়ে যায় মোটকু ধুসর বলের মত ছাতারে পাখিদের গুষ্টি। বারন্দার রেলিংএ, কাপড় শুকাতে দেবার তারে বসে নেচেই যায় মস্ত ল্যাজ ওয়ালা ঘোর কৃষ্ণাঙ্গী, চেরা ন্যাজ ফিঙে সুন্দরীদের দল। বাগানের ঘাসে নাক উঁচিয়ে চরে বেড়ায় ধপধপে সাদা বকের দল। গেটের বাইরের নারকেল গাছে বাসা বাঁধে গোলগোল চোখওয়ালা এক গুরুগম্ভীর প্যাঁচা। বৃষ্টি নামলে ডানা দিয়ে কি সুন্দর মাথা ঢেকে রাখে, দেখে তাজ্জব হয়ে যায় তুত্তুরী।  


বাংলোর সিকিউরিটি ছেলেগুলো কবে যেন কাকু হয়ে যায় তুত্তুরীর। রান্না করা, বাসন মাজা আর বাগানে কাজ করতে আসা দিদিরা হয়ে যায় মাসি।এমনকি তাদের ছেলেমেয়েদের সাথেও গভীর দোস্তি হয়ে যায় তুত্তুরীর। একসাথে হৈচৈ করে সরস্বতী পুজো হয় বাংলোয়। পুঁচকে গুলো সম্মিলিত ভাবে সাজায় মহকুমা শাসকের সরকারি নিবাসটাকে। পাকা হাতে নিপুণ, নিখুঁত আল্পনা দেয় সিকিউরিটি অমিত। অঞ্জলির দেবার সে কি লাইন আর ধুম সেদিন। 


ওদের থেকেই ধার করে সাইকেল চালাতে শেখে তুত্তুরী কিছুটা। অবসরে হরেক রকম গাছ চেনে তুত্তুরী। শাক চেনে। ফুল চেনে। পাখি চেনে কত যে। এছাড়াও সাপ চিনেছে বেশ কয়েকরকম, ব্যাঙ আর পোকার গুষ্টি চিনেছে এই তমলুকে এসেই না। 


       ব্যাঙ আর পোকা নিয়ে কত যে মজার মজার অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছে তুত্তুরী এখানে এসে। সেই যে সেদিন সান্ধ্যভ্রমণে বেরিয়ে ঢিল ভেবে একটা গাব্দা ব্যাঙের গায়ে শট্ মেরেছিলাম আমি, তাতে ব্যাঙটা বেপোট রেগে কটমট করে খানিকক্ষণ নাকি আমার দিকে তাকিয়েছিল। সেই প্রখর দৃষ্টির সামনে ভয়ে নাকি রীতিমত কুঁকড়ে গিয়েছিল তুত্তুরীর মারকুটে জননী। বেশ খানিক্ষণ তাকিয়ে থেকে, প্রবল ঘ্যাম নিয়ে, নাক উঁচু করে  থপথপ্ করতে করতে চলে গিয়েছিল ব্যাঙটা।  আজও সে গল্প করতে গিয়ে হেসে গড়িয়ে পড়ে তুত্তুরী। আর সেই যে সেবার, বাগানের দরজা বন্ধ হচ্ছে না দেখে প্রবল টানাটানি করেছিলাম আমি। ফলে দরজার ফাঁকে আটকে থাকা ব্যাঙটা জিভ বার করে অজ্ঞান হয়ে পড়ে ধড়াম করে। সেই দেখে কাঁদতে কাঁদতে নাকি  বিকট হট্টগোল জুড়ি আমি।  'কেন বাড়িতে চশমা পরি না গোওওও।' 'আমার জন্য ব্যাঙটা বেঘোরে মরে গেল গোওওও।' সেই দেখে শৌভিক কি ভাবে পেটে হাত দিয়ে অট্টহাস্য করতে করতে উল্টে পড়েই যাচ্ছিল,  হুবহু দেখিয়ে দেয় তুত্তুরী। 


দিন যায়, এপ্রিল মাসে নতুন স্কুলে ভর্তি হয় তুত্তুরী। প্রথম দিন কি যে বিকট ভয় বুকে চেপে স্কুলে গিয়েছিল মেয়েটা আমার। সব ভয় অমূলক প্রমাণ করে, কেউ bully করে না তুত্তুরীকে, কেউ উত্যক্ত বা বিরক্ত করে না। বরং খুব ভালো ভাবেই মিশেছিল সবাই। জনৈকা বান্ধবী শুধু দু একবার বলেছিল, ‘ঐ ব্যবসাটার নাম জানিস? ওটা কার জানিস? আমার দাদুর। আমরা কত বড়লোক জানিস? ফরেন ট্যুর করি আমরা। তুই কখনও বিদেশে গেছিস? যাসনি? বেড়াতে তো যাস বাকি? কোথায় যাস? মধ্য প্রদেশ? ওখানে দেখার কি আছে?  এই শীতে সুইজারল্যান্ড যাব আমরা।জানিস স্পেনে গিয়ে আমার বাবা স্প্যানিশ লিকর খেয়েছিল। তোর বাবা মদটদ খায়? খেতে বলবি। ক্ল্যাসি লাগবে।’ বাড়ি ফিরে হাসতে হাসতে বিষম খেয়েছিল তুত্তুরী। আজও বাড়িতে কোন পরিচিত অতিথি এলে, সর্বাগ্রে সেই গল্প শোনায় তুত্তুরী। 


মে মাসে প্রথম প্রাইভেট টিউটর রাখা হল তুত্তুরীর। নতুন ম্যাম এলেন, বেজায় ডিগ্রি ধারী। কিন্তু বয়সে ছুকরি। শৌভিক এবং আমি যগপৎ বলেও দিলাম, এসডিওর বাচ্ছা বলে আলাদা খাতির করার কোন দরকার নেই। প্রয়োজনে এমনকি অপ্রয়োজনেও হাত খুলে প্যাঁ- ইয়ে ঠ্যাঙাবেন। তুত্তুরীকেও বলা হল ম্যাম ব্ল্যাক বেল্ট ,সেটা যে সর্বৈব মিথ্যে বুঝতে তুত্তুরীর লেগেছিল দুটো দিন মাত্র। তারপর এমন দোস্তি হল দুজনের, যে উভয়ের হাহা-হিহি-হোহোর ঠ্যালায় বাংলো ভেঙে পড়ার খাপ। কে যে পড়ায় আর কে যে পড়ে বোঝা দায়। পড়াতে আসার সময় বাড়ি থেকে কুমড়ো ফুল, টাটকা শাক, গাছের পেয়ারা, তালের বড়া নিয়ে আসে দিদিমনি। যোগাড় করে আনেন পিরিয়ডিক টেবিলের ছক।  


বেশ জমিয়ে বসেছিলাম আমরা,  ভুলতেই বসেছিলাম আমরা ভূমিপুত্র বা কন্যা নই, আমরা হলাম পরিযায়ী পাখি। আজ এখানে, কাল না জানে কোথায়। আমাদের শিকড় ছড়াতে নেই। গত পরশু সন্ধ্যেয় যখন পুনরাবর্তিত হল ইতিহাস, ঠিক পৌনে সাতটা নাগাদ এসে হাজির হওয়া অর্ডার কড়া নেড়ে জানাল, বদলি হয়ে গেছে শৌভিক, ক্ষণিকের জন্য যেন বজ্রাহত হলাম আমরা। সেই একই রকম ভাবে আসতে লাগল শুভেচ্ছা বার্তা আর শুভকামনায় মোড়া ফোনগুলো। লাফাতে লাফাতে সোহাগী ফোন করল এষা, 'কি গো, তোমরা তো এবার রোজ দীঘা যাবে?' সেই একই রকম ন্যাতানো জবাব দিলাম আমরা। ঠিক একই রকম যুগপৎ হতাশ এবং ক্রুদ্ধ হল এষা। 


তিনজনেরই কমবেশি মনখারাপ,তবে তারই মধ্যে শ্রীমতী তুত্তুরীর মুখের দিকে তাকাতে পারছিলাম না দোঁহে। ‘আমাদের সত্যিই তমলুক ছেড়ে চলে যেতে হবে বাবা? আমি তো একটা সেশনও শেষ করতে পারলাম না মা? নতুন ব্লেজারটা পরতেও পারলাম না। আমার সাইন্স এক্সিবিশন এর কি হবে মা? স্কুল ম্যাগাজিনে আমার লেখাটা ছাপা হল কি না, সেটাও তো জানতে পারব না বাবা। ইত্যাদি, প্রভৃতি। ’ ভ্যাবাচাকা খেয়ে, বারবার বলেই যাচ্ছিল তুত্তুরী। সান্ত্বনা দেব কি, আমার নিজেরই বিশ্বাসই হচ্ছিল না যে। পাততাড়ি গোটানোর সময় সমাগত।  


 সরকারি চাকরির এই তো বিড়ম্বনা। মাতৃসুলভ কাতরতার সাথে শৌভিককে বলতে গিয়ে বেজায় ঝাড় খেলাম। ‘স্কুল পাল্টালে কিছু খারাপ হয় না। নজির তোর সামনেই আছে।’ সত্যিই তো, শ্বশুরমশাইয়ের চাকরির দৌলতে বহুবার এমন স্কুল পাল্টেছে শৌভিক। আর প্রতিবারেই মিড সেসনে। খারাপ তো কিছু মানুষ হয়নি বাপু। এটাও কিছু হয়েই যাবে নির্ঘাত। ‘আর না হলেই বা কি’ মেয়ের পিঠে হাত রেখে পাশ থেকে বলে শৌভিক, ‘ গরু চরালেই বা কার কি। শ্বশুরটা তো বলেইছে যে দুটো গরু কিনে দেবে। তাই চরাবে।' সবকথায় আমার বেচারী বাপকে না টানলে আমার বরের ঠিক পোষায় না।


ছদ্ম দাম্পত্য কলহে নিমজ্জিত হই আমরা, ঝুটো হাসি ঠাট্টা মশকরায় ডুবে যাই আমরা, মনখারাপী মনের ওপর পরে নিই নকল হাসির মুখোশ। সামলে নিই একে অপরকে। এই তো জীবন কালী দা। 


দেখতে দেখতে এসে পড়ে আজকের সন্ধ্যা। বিদায়বেলায় উপহার পাওয়া রাশি রাশি ফুলের সৌরভে মম করে ওঠে সরকারি নিবাসের চেনা বৈঠকখানা। জমে ওঠে উপহারের স্তুপ। মিষ্টির প্যাকেট। শৌভিক এর মোবাইল ভর্তি হয়ে যায় আবেগে মাখামাখি মেসেজে। সবকিছু যেন নীরবে, অথচ চিৎকার করে বলে, আর মাত্র কিছুটা সময়, তারপরই ছেড়ে যেতে হবে প্রিয় শহরটাকে।


 বিদায় সাধের তাম্রলিপ্ত নগরী, বড় ভালোবেসে ফেলেছিলাম তোমায়। খুব ভালো থেকো প্রিয় নগর আর তার অধিবাসীরা। অনেক অনেক সুখ স্মৃতি নিয়ে পরবর্তী গন্তব্যের দিকে চলেছি আমরা। সকলের জন্য রেখে গেলাম একরাশ শুভেচ্ছা আর শুভকামনা।

(চলবে)

 অনির ডাইরি ১৯ শে নভেম্বর, ২০২২

(পর্ব -২)

বেশ নরম, রেশমি একটা রোদ উঠেছে। বাতাসে হাল্কা হিমেল ভাব। তমলুকের থেকে এদিকে ঠাণ্ডাটা কেন জানি একটু বেশিই লাগে। কাঁথির মহকুমা শাসকের সরকারি নিবাসটা বেশ প্রাচীন। কথায় কথায় এরা বৃটিশ আমলের গল্প শোনায়। মহকুমা শাসকের বাংলো চেম্বারে টাঙানো বিশাল বিশাল দুটি বোর্ড জুড়ে, ১৯৪২ সাল থেকে পদাধিকারী  নানা রথী-মহারথীর নাম। সবার উপরে জ্বলজ্বল করছেন শ্রী এস সেন, আই সিএস। সময়কাল ১৮ই জুন, ১৯৪২ থেকে ২৩শে ডিসেম্বর,১৯৪৩। সত্যি মিথ্যে জানি না, জনশ্রুতি শুনি ইনিই সেই প্রবাদপ্রতিম সুকুমার সেন। স্বাধীন বাংলার প্রথম মুখ্যসচিব। ভারতের প্রথম নির্বাচন সংগঠিত হয় যাঁর তত্ত্বাবধানে। 


 তাঁর উত্তরসূরি শ্রী এম ভট্টাচার্য ছিলেন BCS, বেঙ্গল সিভিল সার্ভিসের অফিসার। বাংলা ভাগ হয়নি যে, পশ্চিমী তকমা লাগেনি আমাদের গায়ে। প্রথম IAS মহকুমা শাসক পায় কাঁথি ১৯৪৮ সালে। আর প্রথম WBCS (Exe) ঐ চেয়ারে বসেন ১৯৬১ সালে।   


চতুর্দিকে বাগান দিয়ে ঘেরা ছিমছাম একতলা বাংলো। বাগান মানে তমলুকের বাংলোর মত শৌখিন বাগান নয়, রীতিমত গা ছমছমে মহীরুহের সমাহার। ছতলা বাড়ির সমান লম্বা ইউক্যালিপটাস, নারকেল গাছ, আম গাছ, জাম গাছ, নিম, লিচু, তেঁতুল, শাল, জামরুল, বেল, কুল, পেয়ারা, সজনে ডাঁটা গাছ কি নেই সেই তালিকায়। এছাড়াও আছে দেবদারু আর ঝাউ গাছের সারি, দুখানা বিশাল কাজু বাদাম গাছ, তেজ পাতার গাছ,কারি পাতার গাছ, লবঙ্গ গাছ এমনকি দুটো শ্বেত চন্দনের গাছও। সামান্য খুঁটে দেখলাম, গন্ধ পেলাম না যদিও। 


এত গাছ থাকার জন্য পাখিদের আনাগোনা লেগেই থাকে। ভোর বেলা জানলা ঠকঠকায় কাঠঠোকরা, জানলার ফাঁক গলে ফুড়ুৎ করে ঢুকে আসে চড়াই দম্পতি। নিম গাছের কোটর থেকে মুখ বাড়ায় ডিমে তা দেওয়া মা টিয়া পাখি। বাগানে পেতে রাখা বেঞ্চে গিয়ে বসলে পায়ে সুড়সুড়ি দেয় হ্যাংলা কাঠবেড়ালির দল। আগের স্যার ম্যাডামরা নাকি বাসি রুটি, মুড়ি, বিস্কুট ইত্যাদি খেতে দিত। সেই লোভেই আমার কাছে এসেছিল, আমি যদিও কিছু না জেনে,  দলবেঁধে  পায়ে কামড়াতে এসেছে ভেবে ব্যাপক চিল্লিয়েছি। ফলশ্রুতিতে আপাতত হাতে বিস্কুট নিয়ে বসে আছি, আমাকে বয়কট করেছে কাঠবিড়ালির দল। তাদের জন্য ছড়ানো বিস্কুট খেয়ে যাচ্ছে একদল মোটু ছাতারে। 


সব মিলিয়ে ঝিম ধরানো পরিবেশ,নির্ভেজাল শান্তির প্রলেপ বুলিয়ে দেয় বিগত দশদিনের উত্তেজিত স্নায়ুর ওপর। বড় উৎকণ্ঠা আর উত্তেজনায় কেটেছে গত কয়েকটা দিন। সাত তারিখ সন্ধ্যেবেলায় যখন বিনা মেঘে বজ্রপাতের মত আছড়ে পড়েছিল অর্ডারটা, সাময়িক ভাবে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েছিলাম আমরা। মানছি বদলির চাকরী, অর্ডার বেরোলে যেতেই হবে, তাও একটু দম ফেলার সময় যদি পাওয়া যেত, বড় উপকার হত আর কি।


 আট তারিখটা গুরুনানকের জন্মদিন ছিল। কি যেন দপ্তরী কাজে মহানগরে আসার কথা শৌভিকের, মায়ের তুলে রাখা পেনশনটা ওর হাত দিয়েই পাঠিয়ে দিলাম। অজুহাত দিলাম সময় বড় কম,সংসার তুলে নিয়ে যেতে হবে, কত যে কাজ বাকি। আসল উদ্দেশ্য ছিল মায়ের একটু মনোবল বাড়ানো। মহানগর ছেড়ে আমাদের তমলুক চলে আসাটাই হজম হয়নি আমার মায়ের। ভুগতে শুরু করেছিল মানসিক অবসাদে। বিগত একবছর ধরে নিয়মিত বাড়ি যাওয়া আসা করে, প্রতিটি উৎসব অনুষ্ঠানে চাটুজ্জে বাড়ি গুলজার করে, কলকাতার মত তমলুকে বসে বাবার ইলেকট্রিক বিল, টাটা স্কাই, ফোন রিচার্জ করে, অনলাইন মাসকাবারি সওদা করে দিয়ে, পুজোর বাজার করে, সময়মত ডাক্তার দেখিয়ে এনে ইত্যাদি প্রভৃতিতে একটু মানসিক জোর পেয়েছিল মা। তাও পুরোপুরি ভয় মুক্তি হয়নি মায়ের, আমার স্কুলের বন্ধুদের পেলে আজও ডুকরে কেঁদে ওঠে, ‘পারলে আসিস। খোঁজখবর রাখিস। ও তো অনেক দূরে চলে গেছে’ ইত্যাদি, প্রভৃতি। আর এখন তো আরও একটু বেশি দূরে সরে যাবার পালা। ফোনের ওপারে মায়ের নীরব কাতর কণ্ঠ সোচ্চারে বলছিল, মোটেই ভালো ভাবে বদলির ব্যাপারটা নিতে পারেনি মা। ভাবছে আর হয়তো বাড়িই যেতে পারব না আমি/আমরা। এমতবস্থায় শৌভিকের পজিটিভ এনার্জি, ভালোবাসা মাখানো মিষ্টি ধমকের বড় দরকার ওদের।


 

নয় তারিখ, বুধবার চার্জ হ্যান্ডওভার করার পর গোছগাছে হাত দিলাম আমি।এই বাংলো এখন নতুন আধিকারিকের। তিনি যত উদারই হন না কেন, অনির্দিষ্ট কালের জন্য তাঁর সরকারি আবাস তো দখল করা যায় না। আর শৌভিকের পক্ষেও তমলুক থেকে কাঁথি নিত্য যাতায়াত করা বেশ চাপের। যত তাড়াতাড়ি পারা যায়, বোঁচকাবুঁচকি নিয়ে রওণা দিতে হবে নতুন বাসায়। শৌভিকের ইচ্ছে ছিল রবিবারের মধ্যেই পুরাণ বাসা ছেড়ে দেওয়া। বাধ সাধল তুত্তুরী। বাংলো ছাড়া মানে তো স্কুলও পরিত্যাগ করা। শিশু দিবসের আগে কিছুতেই পুরাণ স্কুল ছেড়ে যেতে রাজি হল না তুত্তুরী। 


তুত্তুরীর ভাষায়, কলকাতার স্কুলটা ছেড়ে আসতে তেমন দুঃখ হয়নি ওর। কারণ অতিমারির প্রকোপে দুবছর স্কুল বন্ধ ছিল, বন্ধুদের সাথে যোগাযোগের মাধ্যম বলতে ছিল হোয়াটস্অ্যাপ। তাও তো ছিল। শিক্ষককুলের সঙ্গে তো তাও ছিল না। কি যে অনলাইন ক্লাস হত, অর্ধেক দিন শুনতাম স্যারের ডেটা শেষ হয়ে গেছে। ম্যাম বলেছেন তোমরা পড়ে নাও ইত্যাদি প্রভৃতি। তাম্রলিপ্ত পাবলিক স্কুল, মফস্বলের সাদামাটা পুঁচকে স্কুল হতে পারে, কিন্তু আন্তরিকতা ছিল সীমাহীন। এখানে এসে যেমন ভালো বন্ধু পেয়েছিল তুত্তুরী, তার থেকেও ভালো পেয়েছিল শিক্ষক শিক্ষিকাদের। তাদের সাথে কত পরিকল্পনা করেছিল শিশুদিবস উদযাপনের, সে সব ফেলে কিছুতেই যাবে না তু্ত্তুরী।


 শৌভিকের বদলিতে আপাততঃ সবথেকে বেশি কষ্ট পাচ্ছে মেয়েটাই, তার জন্য এইটুকু তো করতেই হবে। নতুন আধিকারিকের কাছে কটা দিন সময় চেয়ে নেয় শৌভিক। দীর্ঘদিনের পরিচিত, ভ্রাতৃপ্রতিম আধিকারিক এক গলা জিভ কেটে বলে,‘কি বলছ দাদা। তোমার যতদিন ইচ্ছে, থাকো না।’ 


বাংলো না ছাড়লেও পলাশকে ছেড়ে দেয় শৌভিক। মহকুমা শাসকের নিজস্ব গাড়ি চালায় পলাশ, এতদিন সকাল সকাল তুত্তুরীকে স্কুলে পৌঁছে দেবার কাজটা স্বেচ্ছায় নিজেই করত পলাশ। ফেরৎ আনার দায়িত্ব ছিল আমার আর উত্তমকুমারের। আমি ব্যস্ত থাকলে মাসি আর উত্তমকুমার যেত।যেদিন আমি আর উত্তমকুমার উভয়েই ব্যস্ত থাকতাম, সেদিন পলাশই আনতে যেত। বকবক করতে করতে গাড়ি চালাত পলাশ, তুত্তুরীকে শহর চেনাত। এতদিন পলাশের আবোলতাবোল বকবকানিতে রেগে যেত তুত্তুরী, বুধবার সন্ধ্যেয় যখন আনুষ্ঠানিক ভাবে পলাশকে ছেড়ে দেওয়া হল, তার জন্যই কেঁদে ভাসাল তুত্তুরী। নতুন আধিকারিক এবং পলাশ উভয়েই বলেছিল, আর তো তিনটে দিন স্কুল যাবে মেয়েটা, এই কটা দিন না হয় পলাশই দিয়ে আসুক। শৌভিক রাজি হয়নি। অধিকার ছাড়তেও তো জানতে হয়। 


আমরা ছাড়তে চাইলেও কমলি ছাড়ে কই। পুরাণ আপিসের লোকজন পলাশ, নবেন্দু আব্দার করে, ‘আমরা গিয়ে সব প্যাকিং করে দেব স্যার।’ ভাগিয়ে দেয় শৌভিক। প্যাকিং করার মত আছেটাই বা কি? কটা তো জামাকাপড় আর বইখাতা। ও আমি দিব্য পেরে যাব। শুধু কটা প্যাকিং বক্স লাগবে। লোকজন স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে এসে দিয়ে যায় কার্ডবোর্ডের বাক্স, নারকেল দড়ি, টেপ। খোঁজ নিয়ে যায় বারবার, আর কিছু লাগবে কি? আর কোন সহায়তা লাগবে কি? লাগবে না বললে অখুশি হয়, দুঃখ পায়,তাও বেশ বুঝতে পারি আমরা। 


শ্বশুরমশাইয়ের চাকরি সূত্রে বীরভূম, মুর্শিদাবাদ, লবণহ্রদ ইত্যাদি মিলিয়ে সাকুল্যে চোদ্দ না পনেরো বার বাড়ি পাল্টেছিল শৌভিকের। বিয়ের আগে থেকে শুনে আসছি সেসব গল্প। শাশুড়ি মায়ের আসুরিক শক্তি আর কর্মতৎপরতার গল্প। শৌভিক বলত, আজও বলে, ‘মা একাই, একটা আর্মি ছিল।’ মুভার্স এণ্ড প্যাকার্স  মার্কা কারো হেল্প লাগত না। যাবতীয় প্যাকিং- আনপ্যাকিং সবকিছু একা হাতেই সামলেছেন উনি। শ্বশুরমশাই বা তাঁর লোকজন বড়জোর বাক্স গুলো গাড়িতে তুলে দিয়েছে বা নামিয়ে নিয়েছে। আর ওণার বাড়ি বদল মানে খাট-বিছানা- আলমারি- বাসনকোসন- টিভি-ফ্রিজ সবকিছু। 


তাঁর সবথেকে অযোগ্য পুত্রবধূ আমি। বিয়ের পর বার চারেক বাড়ি পাল্টেছে বটে, তবে সবকিছুই আগে থেকে সাজানো গোছানো ছিল। মামুলি কিছু জিনিস নিয়ে গেছি, দু একটা ব্যাগে ভরে ফিরে গেছি। এবারে কোথা থেকে যে এত জিনিস জমা হল বুঝতেই পারিনি। তুত্তুরীর মাসিকে নিয়ে চারজনের জামাকাপড়, জুতো, রাশি রাশি গল্পের বই, তুত্তুরীর পড়ার বই, খাতা, পুতুল, শৌভিকের ক্যামেরা, চার্জার, বুড়ো ল্যাপটপ,  ঝুটো গয়নাগাটি, প্রসাধন দ্রব্য, বিভিন্ন সময় উপহার পাওয়া ঘর সাজানোর সামগ্রী সব মিলিয়ে ১৬টা প্যাকিং বক্স উপচে গেল। এর বাইরেও বাড়িতে যতগুলো সুটকেস, হ্যান্ডব্যাগ ছিল, ভর্তি হয়ে গেল সেই কটাও। এরওপর ছিল গত বছরের না বিসর্জন দেওয়া সরস্বতী প্রতিমা, উপহার পাওয়া কাঁচের বাটিতে বসানো লাকি বাম্বু। নিত্য পুজো পাওয়া ঠাকুর, তাঁদের বাসনকোসন। পুজোর মাসে বেশ কটা দিন অনুপস্থিত ছিলাম বলে, মাসকাবারি তেমন ভাবে হয়নি। নভেম্বর মাসে তাই চাল,আটা, তেল, মশলা সবই বেশি বেশি নেওয়া হয়েছিল। সেই সব গুছিয়ে প্যাক করা কি চাট্টিখানি কথা। তারওপর ভাগাভাগির ঝামেলা, কিছু কৌটো মহকুমা শাসকের ছিল। কিছু আমরা বাড়ি থেকে এনেছিলাম। পরবর্তী কালে কফি, জ্যাম, বড় বিস্কুট ইত্যাদি কেনার জন্য কিছু কৌটো জমেছিল। কোনটা সরকারি ডাব্বা, আর কোনটা বেসরকারি তার হিসেব করতে বসে তুত্তুরীর মাসির আর আমার মাথার চুল ছেঁড়ার যোগাড়। শেষ পর্যন্ত একটা ডাব্বা নিয়ে সংশয় আর যায়ই না। উত্তরসূরিকে যেদিন বাংলোয় চা খেতে ডাকল, লজ্জার মাথা খেয়ে বলেই দিলাম আমি, ‘ভাই মনে হচ্ছে তোমার একটা কৌটো আমরা নিয়ে যাচ্ছি। বিস্কুটগুলোকে প্যাকেটে ভরে নিয়ে যেতে গেলে ভেঙে যাবে কি না।’ বেচারা এত অপ্রস্তুত বোধহয় জীবনেও হয়নি। 


একই সংশয় দেখা দিয়েছিল জামাকাপড় ঝোলানোর হ্যাঙার আর কাপড় শুকাতে দেবার ক্লিপ নিয়ে। শেষ পর্যন্ত অবশ্য শৌভিকের হস্তক্ষেপে প্রমাণ হয় ওগুলো সবই মহকুমা শাসকের সম্পত্তি।  


 একটা একটা করে বাক্সবোঝাই হয়, টেপ মারি আমরা, অতঃপর কালো মার্কার পেন দিয়ে লেখা হয় বাক্স নম্বর- আর ছোট করে কি আছে তাতে। তারপর সেই বক্সের একটা বড় তালিকা বানাই আমরা, গুছিয়ে লিখি কোন বক্সে কি ভরেছি। অতঃপর ভাগাভাগি করে দোতলা থেকে একতলায় নামাই তুত্তুরী আর আমি। মাসি দৌড়ে আসে, আহাঃ ও কেন, আমায় ডাকবে তো। সিকিউরিটি ছেলেগুলো দুঃখ পায়,  ঘড়ির কাঁটা কেবল টিক টিক করে জানায় একটু জলদি করো হে, আর তো মাত্র কয়েকটা ঘন্টা। এখনও বাকি কত যে কাজ। 

(চলবে)

অনির ডাইরি, ২৭শে নভেম্বর, ২০২২

(অন্তিম পর্ব)

কয়েকটা মুহূর্তের জন্য হৃদস্পন্দন স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল আমার বরের, যখন ৭ই নভেম্বরের সন্ধ্যেয় জনৈক শুভানুধ্যায়ী দাদা ফোন করে খবর দিয়েছিলেন,‘ তোর জায়গায় অমুকের অর্ডার হয়েছে।’  তমলুকের মহকুমা শাসকের বাংলো চেম্বারের সেদিন চলছিল কোন রুদ্ধদ্বার বৈঠক। উল্টো দিকে বসেছিল শৌভিকের অত্যন্ত স্নেহভাজন দুই অফিসার। দরজার বাইরে সদ্য নেমেছে সন্ধ্যা। অন্যান্য সন্ধ্যা গুলোর মতই খাবার টেবিলে এক কাপ দুধ নিয়ে বসে অনর্থক সময় নষ্ট করা তুত্তুরী বা পড়তে বসার জন্য নিরন্তর তাগাদা দেওয়া আমি, কেউ জানিই না ছোট্ট ঘরটার মধ্যে উল্টেপাল্টে যাচ্ছে সবকিছু। 


শৌভিকের কাঁথির অর্ডারটার গুরুত্ব প্রথমে কিছুক্ষণ উপলব্ধিই করতে পারেনি তুত্তুরী। অতঃপর সারা সন্ধ্যে একটাই কথা বলে গেছে,‘ আবার স্কুল বদলাতে হবে? আমি তো একটা সেশনও শেষ করতে পারলাম না এই স্কুলে।’ মোটামুটি চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে চার্জ দেওয়া-নেওয়া মিটিয়ে ফেলার পর শৌভিকের ইচ্ছে ছিল যত তাড়তাড়ি সম্ভব তাম্রলিপ্ত নগরী পরিত্যাগ করা। এখানেই বেঁকে বসে তুত্তুরী, শিশু দিবসের আগে কিছুতেই প্রিয় স্কুল ছাড়তে রাজি নয় সে। প্রতি মুহূর্তে ভিতরে ভিতরে ক্ষতবিক্ষত  হওয়া সন্তানের মুখের দিকে তাকিয়ে শৌভিকের পাষাণ হৃদয়  ও বোধহয় গলে ছিল কিছুটা। 


চারটি অতিরিক্ত দিন স্কুল করার অনুমতি দেওয়া হল তুত্তুরীকে। ৯ইনভেম্বর, বুধবার স্কুলে গিয়ে সবার আগে নিজের প্রিয় বান্ধবী রিমলিকে খবরটা দিল তুত্তুরী। রিমলির সাথে প্রথম দিকে অবশ্য তেমন ভাব ছিল না তুত্তুরীর। তুত্তুরীর ভাষায়,‘ একবার মিউজিক স্যার ক্লাশে এসে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, আগুনের পরশমণি গানটা কারা গাইতে পারবে। আমি আর রিমলি দুজনেই হাত তুলেছিলাম। স্যার দুজনকে একসাথে গাইতে বললেন, গাইলাম, গান শেষ হবার পর ও আমায় ডেকে বলল, ‘আমার পেটের বোতামটা খুলে গেছে, একটু লাগিয়ে দিতে পারবি?’ অবাক লেগেছিল জানো মা, আমি তো ক্লাসে নতুন, পুরাণ বন্ধুদের না বলে আমায় বলল কেন? তারপর খেয়াল করে দেখলাম, ওর পাশে কেউ বসে না। ও এসে একাই একটা বেঞ্চে বসে। দু-তিনদিন পর আমি একদিন ওকে জিজ্ঞাসা করলাম,‘তোর পাশে বসতে পারি?’ ও বলল,‘বস। বস।’ সেই যে আমরা একসাথে বসা শুরু করলাম, শেষ দিন অবধি একসাথেই বসেছি।’ 


গতকালও রিমলির গল্প বলতে বলতে ভেঙে এসেছিল তুত্তুরীর গলা। প্রথম দিকে তুত্তুরী আর রিমলির মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির চেষ্টা করেছিল কেউ, কেউ। রিমলির গাত্রবর্ণ, রিমলির মেদুল চেহারা, রিমলির অতিরিক্ত সিরিয়াস হাবভাব, তরল কথাবার্তায় অনীহা ইত্যাদি তুলে ধরে তুত্তুরীকে কুমন্ত্রণা দিয়েছিল,‘ওর পাশে বসিস না। আমাদের পাশে বসবি আয়।’ আর রিমলিকে বলা হয়েছিল, তুত্তুরী একে তো কলকাতা থেকে গেছে তারওপর বাবার বদলির চাকরি, ওর স্থায়িত্বই বা কদিন, ওর সাথে মেশা মানে সময় অপচয় করা। 


প্রতিটি কুমন্ত্রণা আরো কাছাকাছি  এনেছিল মেয়েদুটোকে। একসাথেই বসত ওরা। ভাগ করে খেত একে অপরের টিফিন। গল্প করত প্রিয় নায়কদের নিয়ে। কবে যেন কুমন্ত্রণা দেওয়া সহপাঠীগুলোও একে একে এসে বসতে শুরু করেছিল ওদের ঘিরে। প্রাথমিক নেতিবাচক মেঘলা আবহাওয়া কেটে গিয়ে উঠেছিল ঝলমলে বন্ধুত্বের রোদ। তুত্তুরীর বিদায় সংবাদ শুনে প্রাথমিক ভাবে সিঁড়িতেই বসে পড়েছিল রিমলি। ‘তুই চলে যাবি? সত্যি চলে যাবি? এত তাড়াতাড়ি?’ 


স্কুল প্রদর্শনীতে জীববিজ্ঞানের কি যেন মডেল বানানোর কথা ছিল দোঁহের। হাত ধরাধরি করে বলে এল বায়োলজি স্যারকে,‘ আমরা আর বানাতে পারব না।’ স্কুল ছুটির পর সিঁড়িতে ক্লাশ টিচারকে পাকড়াও করে জিজ্ঞাসা করে নিল তুত্তুরী,‘স্যার, সামনেই তো ইউনিট টেস্ট, এমন সময় আমায় টিসি দেবেন তো? নাহলে বাবা বলেছে, নতুন স্কুলে আমায় নেবে না।’ প্রিয় ছাত্রীর মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে তিনতলা থেকে নেমেছিলেন মাননীয় শিক্ষক মহাশয়। মনমরা মেয়েটাকে যুগিয়েছিলেন অপরিসীম সাহস। ইংরেজি বলার বাধ্যকতা ছেড়ে মাতৃভাষায় বুঝিয়েছিলেন‘ আরে মন খারাপ করছিস কেন? কাঁথি অনেক বড় শহর। অনেক বড় স্কুল পাবি ওখানে। আর যখন যাবি দেখবি, ঐ স্কুলের প্রিন্সিপাল স্যারের মনটা না পুরো সোনা দিয়ে তৈরি। নিখাদ সোনা। তারপর তো আমরা রইলামই। যেকোন দরকারে তোর পুরাণ স্যার ম্যাডামদের ফোন করবি।’ বুকে হাত দিয়ে বলতে পারি, মহানগরে বড় হওয়া তুত্তুরী, হাওড়ায় বড় হওয়া আমি কোনদিন এত সহৃদয় বার্তা পাইনি কোন শিক্ষক-শিক্ষিকার থেকে। 


পরবর্তী দুদিনের মধ্যে গোটা ক্লাশ জেনেই গেল। যাকে/ যাদের বেশ অপছন্দ করত তুত্তুরী, স্কুল থেকে যাবার আগে যাদের রূঢ় বা বিদ্রুপ মাখানো বিদায় সম্ভাষণ জানাবে ঠিক করেছিল, তারাও খবরটা শুনে এমন আবেগ বিহ্বল হয়ে পড়েছিল, একজন তো তুত্তুরীকে জড়িয়ে ভ্যাক করে কেঁদেই ফেলল। কিছুদিন আগে ঐ মেয়েটিই তুত্তুরীর কাছে জানতে চেয়েছিল, ক্লাসের ফার্স্ট বয়কে কি করে প্রপোজ করতে হয়। জবরদস্ত আইডিয়ার জন্য তুত্তুরী আবার কথাটা জানায় তার দাদুকে। কারণ তুত্তুরীর মতে যাবতীয় উৎকট আইডিয়া দাদুর থেকে ভালো কেউ দিতে পারে না। অব্যর্থ আইডিয়ার জন্য কটা দিন সময় চেয়েছিল দাদু, ভাগ্যে তারই মধ্যে শৌভিকের ট্রান্সফারটা হয়ে গেছে। নাহলে এই দাদু-নাতনীকে নিয়ে যে আমি কি করতাম ঠাকুর!


১৬ই নভেম্বর বুধবার সকালে যখন আমরা সত্যিসত্যিই তমলুক ছেড়ে রওণা দিলাম কাঁথির দিকে, অবিকল শিশুর গলা নকল করে বার বার একই কথা বলে যাচ্ছিল তুত্তুরী,‘ অ্যায়াম ছো ছ্যাড।’ বিষাদের চোটে জ্বরই এসে গেল মেয়েটার। বৃহস্পতিবারই নতুন স্কুলে ভর্তি হবার কথা ছিল,নতুন স্কুলের প্রিন্সিপাল স্যার আগেই জানিয়ে রেখেছিলেন, ঐ স্কুলে এখন ইউনিট টেস্ট শুরু হয়ে গেছে। ফলে কটা দিন লাইব্রেরিতে বসে থাকতে হবে তুত্তুরীকে। 


জ্বর অবশ্য নেমে গেল একদিনেই। পরদিন নতুন স্কুলে ভর্তি হতে গেল তুত্তুরী। প্রিন্সিপ্যাল স্যারের ঘরে বসে ফর্ম ফিলাপ করতে লাগল শৌভিক, আর তুত্তুরীকে নিয়ে গেল ইনচার্জ ম্যাডাম। মাপা হল ওজন, উচ্চতা ইত্যাদি। তারপর দু জন দিদিমণি ধরলেন কিছু প্রশ্নোত্তর। কি যে কাগের ঠ্যাং, বগের ঠ্যাং মার্কা উত্তর দিল তুত্তুরী, ভয়ে তো গলা দিয়ে আওয়াজই বেরোচ্ছিল না। শুধু নাক দিয়ে কি সব যেন ঝরছিল। ম্যামরা বকলেন তো নাই, উল্টে দুহাতে দুটো টফি নিয়ে ফেরৎ এল মেয়েটা। বেশ কিছুক্ষণ খোশ গল্প করলেন বড় স্যার। জানতে চাইলেন, পুরাণ স্কুলের জন্য মন খারাপ কি না? জানালেন মন খারাপ হলেই ওণার কাছে বা ভাইস প্রিন্সিপ্যাল স্যার বা ইনচার্জ ম্যাডামের কাছে গিয়ে মনোবেদনা উজাড় করে দিতে। বললেন,‘আমাদের ছাত্রছাত্রীদের থেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ আমাদের কাছে কেউ নই। নির্দ্বিধায় এসো আমার ঘরে। যত ব্যস্তই থাকি না কেন-’।  


 কিছুটা খুশি খুশি মনে ফিরে এল তুত্তুরী। সঙ্গে নিয়ে এল নতুন বই, খাতা। মাপ দেওয়া হল  নতুন পোশাকের। পুরাণ স্কুলের ব্লেজারটা আর পরতে পারবে না বলে খুব দুঃখ ছিল তুত্তুরীর, নতুন স্কুল থেকে অনুমতি দেওয়া হল, রঙটা যখন খুব কাছাকাছি, তখন ঐটাই পরুক তুত্তুরী। শুধু পুরাণ স্কুলের লোগোটা তুলে দিলেই চলবে। ছাত্রছাত্রীদের খুশিটাই বেশী জরুরী এই স্কুলে।  


নতুন স্কুলে, নতুন স্যার-ম্যাডামদের সাথে ধীরে ধীরে আলাপ হল। দুচারজন সহপাঠীর সাথেও আস্তে আস্তে ভাব হল। ইনচার্জ ম্যাডাম, ভাইস প্রিন্সিপাল, প্রিন্সিপ্যাল স্যার যার সাথেই দেখা হয়, প্রত্যেকে নিয়মিত খোঁজ নেন,‘কি পুরোযা, ভালো আছ তো? নতুন বন্ধু হল? কোন অসুবিধা হলেই আমাদের বলবে কিন্তু।’ শুধু তুত্তুরী নয়, প্রতিটি ছাত্রছাত্রীর সাথেই এমন ভাবেই কথা বলেন ওণারা। খোঁজ নেন সকলের। 


অন্যদের ইউনিট টেস্ট চলতে লাগল রুটিন মেনে, তাই বলে মন খারাপ করে একাকী লাইব্রেরিতে বসতে হল না মেয়েটাকে আমার। সবাই যখন পরীক্ষা দেয়, ক্লাশেই চুপ করে বসে থাকে মেয়েটা। জানলা দিয়ে আকাশ দেখে। মফস্বলের স্কুল,  স্কুলের উল্টো দিকে বিরাট ধান ক্ষেত। পেকে উঠেছে সোনায় ফসল। বড় বড় জানলা গলে হুহু করে ছুটে আসে হাওয়া। বাড়ি ফিরে গল্প শোনায় তুত্তুরী,‘জানো মা, অমুক সাবজেক্টের স্যার/ম্যাডাম আমাকেও প্রশ্নপত্র ধরিয়েই দিয়েছিলেন প্রায়। আমি হাত জোড় করে বললাম, স্যার আমি তো নতুন এসেছি। সিলেবাস জানা নেই।’ বলে একটু দম নেয় মেয়েটা, চোখ দুটো বড় বড় করে অপ্রয়োজনে, তারপর বলে,‘পাশের মেয়েটার পরীক্ষা শেষ হয়ে যাবার পর, বললাম, তোর প্রশ্নপত্রটা একবার দিবি? নিয়ে দেখি, সব চেনা। আমি সব পারতাম মা। সব পারতাম।’ বলতে বলতে চোখের কোণ চিকচিক করে ওঠে তুত্তুরীর।তুত্তুরীর মায়ের হৃদয় যেন এফোঁড়-ওফোঁড়  হয়ে যায় সাময়িক ভাবে। ক্ষণিকের জন্য কাঁথির মহকুমা শাসকের বাংলো চেম্বারে বিরাজ করে অখণ্ড নীরবতা। তারপরেই সামলে নেয় মা, জীবনের ঘাত প্রতিঘাত থেকে কতদিন বাঁচিয়ে রাখবে মেয়েকে, পাখির মাকেও তো একদিন বন্ধ করতে হয় ডানা। জোর করে উড়িয়ে দিতে হয় ছানাগুলোকে। উড়তে না শিখলে বাঁচবে কি করে? লড়তে না শিখলে টিকবে কি করে? আর ইতিহাস তো এটাই শেখায়, ‘যে টিকে গেছে, সেই জিতে গেছে।’

(শেষ)


Friday 28 October 2022

অনির ডাইরি ১৪ই অক্টোবর, ২০২২

 



পূর্ব মেদিনীপুর জেলার লোকজনের এই এক বৈশিষ্ট্য, যতক্ষণ না ফোন ধরছি, করতেই থাকে। ভীষণ টেনশনে আছি, প্রথম বার কেটে দিলাম, আবার করছে। টেনশনে হাবুডুবু খাচ্ছি বিগত আধেক ঘন্টা ধরে। তার মধ্যে আচ্ছা জ্বালা মাইরি।  


সেদিন পঞ্চমী, সময় মধ্যাহ্ন। কিয়ৎক্ষণ পূর্বেই আমার মা এবং আমার কন্যা যুগলে হাত ধরাধরি করে গেছেন পেনশন তুলতে। যাবার আগে সোহাগ করে ফরমাইশ করে গেছে মা, একটা ভালো কাপের সেট কিনে দিতে হবে। ভালো মানে দামী নয় কিন্তু, স্বচ্ছ টলটলে। এর আগেও অমন একটা সেট কিনে দিয়েছিলাম অ্যামাজন থেকে। ডেলিভারি পেয়ে গজগজ করছিল বাবা, ‘যত চিনে মাল।’ তা সেই চিনে মালকেও এক বছরের ওপর টিকিয়ে রেখেছে আমার মা। নিজে হাতে মেজে ধুয়ে ঝকঝকে করে রেখেছে। ইদানিং মায়ের মনে হয়েছে কাপগুলো আর ততোটা টলটলেও নেই বুঝি। হাল্কা ঘোলাটে হয়ে গেছে যেন। তাই আর কি-


পাক্কা দিশী কোম্পানির ভালো রিভিউ ওয়ালা কাপের সেট বাছাই করে পেমেন্ট করতে গিয়ে দেখি, ইন্টারনেট ব্যাঙ্কিং এর পাসওয়ার্ড ভুলে গেছি। সদ্য বদলে ছিলাম বটে। আন্দাজে যেটা মারলাম, সেটা ভুল। সতর্কীকরণ ভেসে উঠল ফোনের স্ক্রিনে, আর মাত্র দুটো সুযোগ দেবে। তারপর লক হয়ে যাবে গরীবের অ্যাকাউন্ট খানা। ওরে বাপরে, পুজোর মাসে খাব কি? 


অনেক ভেবে চিন্তে, স্থির চিত্ত হয়ে দ্বিতীয়বার পাসওয়ার্ড দিলাম, আবার ভুল। আর একটাই সুযোগ দেবে কেবল, উত্তেজনায় হৃদপিণ্ড গলার কাছে চলে এসেছে। তারই মধ্যে একের পর এক সিগারেট ধরিয়েই যাচ্ছে বাবা। বলি তোমার এত টেনশন কিসের? এক মুখ ধোঁয়া ছেড়ে বৃদ্ধ বলল,‘ তোমার গর্ভধারিণী। আবার কি? সেই কখন গেছে, একটা ফোন করে খোঁজ নাও দেখি।’ মা বেরিয়েছে বেশ কিছুক্ষণ হল সত্যি, তবে এত দুশ্চিন্তা করার কি আছে বুঝলাম না। সঙ্গে তো শ্রীমতী তুত্তুরী আছেনই। তাও পিতৃবাক্য অবজ্ঞা না করে ফোন করলাম, ওপাশ থেকে ভেসে এল তুত্তুরীর বিরক্ত স্বর,‘আঃ বারবার ফোন করছ কেন?’ কি জ্বালা, এই তো সবে করলাম। বলতে গিয়ে বুঝতে পারলাম, বাবা নির্ঘাত এর আগেও বার কয়েক লুকিয়ে ফোন করেছে, ধরেনি দেখে, এবার আমার কাঁধে বন্দুক রাখার ধান্ধা। 


শুনলাম একে তো পোস্টাফিসে মাত্রা ছাড়া ভিড়,তারওপর মা আবার ফর্ম ফিলআপ করতে কি সব গড়বড় করেছে। নতুন করে ফর্ম তুলে এবার পূরণ করছে স্বয়ং তুত্তুরী। তাই আর কি। ফোন রেখে দেবার আগে ফিসফিস করে জিজ্ঞাসা করলাম, ‘হ্যাঁ রে বাবু তুই আমার ইন্টারনেট ব্যাঙ্কিং এর পাসওয়ার্ডটা জানিস?’ হালুমবুড়ো না ভিকি কৌশল কিসব উল্টোপাল্টা বকল তুত্তুরী, যেগুলো কস্মিনকালেও  আমার পাসওয়ার্ড হতে পারে না। ফোন রেখে শ্রীমতী তুত্তুরীর বাবাকে ফোন করলাম, হ্যাঁ গো, তুমি কি জানো?


পুজোর ছুটি পড়ে গেছে, বউ বাচ্ছা বিদেয় নিয়েছে, তুত্তুরীর বাপ মনের আনন্দে বইপত্রের পাহাড় নিয়ে বসেছিল, হয়তো জড়িয়েও এসেছিল চোখের পাতা। এমন সময় আমার বেখাপ্পা প্রশ্নে অত্যন্ত বিব্রত হল বুঝতে পারলাম। তবে একটা ভালো বুদ্ধি দিল, ‘পাসওয়ার্ড চেঞ্জ করে  নে না।’ এতক্ষণ এই বুদ্ধিটা কেন মাথায় আসেনি? ফরগট পাসওয়ার্ড করে যখন পাসওয়ার্ড বদল করতে বসেছি, এমন সময় থেকে ফোন করতে শুরু করেছে লোকটা। এর আগেও গোটা দুয়েক মিসড্ কল আছে, তখন অন্য ফোনে ব্যস্ত ছিলাম আমি। 


প্রথম বার কেটে দিলাম। দ্বিতীয় বার যখন করল তখন মোক্ষম অবস্থায় আছি, এটিএম কার্ডের পাসওয়ার্ডটা সবে মেরেছি, আবার কাটলাম। তৃতীয় বার আর ধৈর্য রাখতে পারিনি, তিন সেকেণ্ডের জন্য ফোনটা ধরে খিঁচিয়েই দিলাম,‘বার বার করছেন কেন? ব্যস্ত আছি বলেই তো ধরতে পারছি না, নাকি? বুঝবেন তো। একটু পরে করুন।’ ওপাশ থেকে জনৈক পুরুষ কণ্ঠ মিনমিন করে, ‘হেলো ম্যাডাম-’ সবে বলতে শুরু করেছে, ফোনটা কেটে দিলাম। পুজোর মাস, অ্যাকাউন্ট বন্ধ হয়ে গেলে খাব কি? 


পাসওয়ার্ড বদলালাম, নতুন পাসওয়ার্ড দিয়ে অ্যাকাউন্টে ঢুকে ভির্মিও খেলাম। কি সব যেন টাকাপয়সা, কে যেন আমার অ্যাকাউন্ট থেকে কাদের সব পাঠিয়ে দিয়েছে। পুজোর মাস আমার চলবে কি করে? সেই নিয়ে একচোট হাঁউমাউ করলাম শৌভিকের কাছে। তারপর বুঝতে পারলাম, ওগুলো আমিই পাঠিয়েছি। সেই নিয়ে একচোট গালমন্দ খেলাম বরের কাছে। মা আর তুত্তুরী ফিরেও এল ঠাকুর দেখে, কিন্তু লোকটা আর ফোন করল না। সাধারণতঃ কারো সাথে ফোনে দুর্ব্যবহার করি না।মাঝে মাঝে পরিস্থিতিটাই এমন হয়ে যায়, কিছু করার থাকে না। খুব খারাপ লাগছিল মনটা। 


শ্রীমতী তুত্তুরী ব্যস্ত হয়ে পড়ল তার অভিজ্ঞতা ভাগ করে নিতে। কেমন ভাবে রিক্সাওয়ালার সাথে অবাস্তব দরদস্তুর করেছে আমার গর্ভধারিণী, কেমন ভাবে মামমাম (দিদা)এর হাত ধরে মোড়ের মাথায় নিয়ে গিয়ে টোটোয় তুলেছে তুত্তুরী। কেমন ভাবে ফেরার পথে রিক্সা পেলেও একটাও প্যাণ্ডেলে নামেনি মা। তুত্তুরী একাই নেমেছে আর ছবি তুলে এনেছে ইত্যাদি প্রভৃতি। ভালোবাসায় জবজবে পরিস্থিতিতেও মনটা খচখচ করছিল লোকটার জন্য। অচেনা নম্বর, এর আগে কখনও ফোন করেনি, ভাবলাম কপাল ঠুকে একবার ফোন করেইনি। তখন আমি মেজাজ দেখিয়েছিলাম, এবার না হয় উনি দেখাবেন। 


ভাবনাচিন্তার মধ্যেই ফোনটা এল। সেই অচেনা নম্বর। গলাটা যতদূর সম্ভব মোলায়েম অনুশোচনাপূর্ণ করে ফোনটা ধরলাম, ওদিকের পুরুষ কণ্ঠ চিল্লিয়ে বলল ‘হ্যালো ম্যাডাম, আপনি কি আজ আপিসে নেই?’ লে হালুয়া। ছুটির দিন আমি অফিসে থাকব কেন? গলাটা যথাসম্ভব ভদ্র করে জবাব দিলাম। উনি বললেন,‘ম্যাডাম আমরা যে আপনার জন্য ফুল, মিষ্টি এনেছিলুম গো। আপনার বাড়ি কোথায় বলেন, আমরা ওখানেই চলে যাব-’। 


সর্বনাশ, কোন পাগলের পাল্লায় পড়েছি! কোন মতে, ’কোন দরকার নেই। আপনারাই খেয়ে নিন’ বলে সে যাত্রা রেহাই পেলাম। তারপর কেটে গেছে অনেকগুলো দিন। ভুলেও গেছি ব্যাপারটা। আজ যখন হঠাৎ এণারা এসে হাজির ফুল আর মিষ্টি নিয়ে, তখন গিয়ে রহস্য উদ্ঘাটিত হল, আমাকে পুষ্পস্তবক প্রদানকারী ভদ্রলোকই তাহলে সেদিন ফোন করেছিলেন। 


তাহলে গল্পটা একটু আগে থেকেই বলি, এই ভদ্রলোক এবং তাঁর দুই সঙ্গিনী পেশায় সাফাইকর্মী। হঠাৎই একদিন এক পাতার একটা চিঠি নিয়ে একডজন নারী ও পুরুষ এসে হাজির হয়েছিলেন আমার কাছে। শুনলাম কোন এক নামজাদা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ওনারা সাফাই এর কাজ করেন। ওনাদের চিঠির বক্তব্য খুব সরল, দীর্ঘদিনের অপূর্ণ দাবীদাওয়া পূরণের ব্যবস্থা করতে হবে।  সেই দাবীর তালিকা পাঠিয়ে দিলাম ওনাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। দিন পাঁচেক কাটতে না কাটতে এণারা আবার এলেন আরও বর্ধিত দাবীতালিকা নিয়ে। কি যেন কারণে মাথা গরম ছিল, দিলাম উদোম ঝাড়। ইয়ার্কি নাকি? কত বার, কত দফা দাবী  জানাবে বাপু তোমরা। আর কতবার, কতগুলো চিঠি পাঠাব আমি? 


বকুনি খেয়েও গেল না লোকগুলো। কাচুমাচু মুখে কেউ বসে, কেউ দাঁড়িয়ে রইল। মাথা ঠাণ্ডা হতে জহর বাবুকে বললাম, আমার বকুনি তো খেয়েছে, এবার একটু আপনার চা খাওয়ান। বুঝিয়ে বললাম, চার্টার অব ডিমাণ্ড এমনি বারবার দেওয়া যায় না।বা বদল করা যায় না। ওরা কেউ রাগ করল না। জুলজুল করে তাকিয়ে রইল খানিকক্ষণ, তারপর হাত জোড় করে বলল, ‘ আপনি মাই বাপ। এর আগে এরকম কোন সাহেব মেমসাহেবের সাথে তো আমরা কথা বলিনি। তাই নিয়মকানুন মোরা কিছু জানি না। আমরা বড় আশা নিয়ে এইছি আপনার কাছে। আপনি মায়ের মতন-’।  


হাসব না কাঁদব বুঝতে পারলাম না। হেসেই ফেললাম। ওরাও একটু হাসল। সামান্য প্রশ্রয় পেতেই, জহর বাবুর হাকুচ কেলে চায়ের সাথে শুরু হল ওদের গল্প। 


কিছুই পায় না ওরা, সাবান,ডাস্টার,গ্লাভস্, কোদাল,বেলচা। কিচ্ছু না। কয়েকজন মেয়ে বলল, ‘হাতে করে নর্দমা সাফ করি দিদি।’ জনৈক ঘোর কৃষ্ণবর্ণ নাদুসনুদুস চেহারার ছেলে বলল, ‘ঘাস কাটার ছুরিকাঁচিও বাড়ি থেকে আনতে হয় আমাদের। কার্বলিক অ্যাসিডও দেয় না ম্যাডাম। সেদিন তো অমুক ভাইকে সাপে কেটে ছিল।’ যাকে কেটেছিল, তিনি হাত উড়িয়ে বললেন, ‘ওটা ঢোঁড়া ছিল। তবে বড় জব্বর কামড়ে ছিল বটে, টেনে ছাড়াতে পারছিলুম নি।’শুনে আঁতকে উঠলাম।


 বাপরেঃ। মেয়েরা সম্মিলিত ভাবে বলল,‘আমাদের গামবুটও দেয় না ম্যাডাম। কেবল ছেলেদের দেয়।’ এছাড়াও আরো দাবীদাওয়া ছিল বটে, বোনাস দিতে হবে,দীর্ঘ দিন কাজ করছে পিএফ, ইএসআই দিতে হবে, কাউকে বসানো যাবে না ইত্যাদি প্রভৃতি। 


দাবী তো ছিল, কিন্তু সব দাবীর ওপর জল ঢেলে দিল প্রতিষ্ঠান। এক লাইনের চিঠি পাঠিয়ে দায় ঝেড়ে ফেলল, ‘ওরা আমাদের কর্মচারী নয়।’ প্রশ্ন পাঠালাম, তাহলে কার লোক ওরা? কন্ট্রাক্টরের? সেই কন্ট্রাক্টরকে লাগিয়েছে কে? জবাব নেই। মিটিং ডাকি। কন্ট্রাক্টর আসে না। প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি আসেন বটে, তাকেই বুঝিয়ে বলি আমি। খুব বেশী তো কিছু চায় না। এগুলো তো ন্যূনতম দাবী। হাতে করে বাথরুম কি আমরা আমাদের বাড়িতে সাফ করি বলুন তো? আর আপনার আমার কপাল ভালো ওটা ঢোঁড়া সাপ ছিল। না হলে আপনার আমার দড়ি টানাটানিতে একটা পরিবার তো ভেসে যেত মশাই। আর এটা কি? ছেলেদের গামবুট দেবেন, মেয়েদের দেবেন না? কোথায় আপনারা লিঙ্গবৈষম্য বিরোধী পাঠ দেবেন তা নয় উল্টো পুরাণ? 


উনি সব শোনেন, গভীর সহমরমী হয়ে মাথা নাড়েন, অতঃপর ভালো করে চেপে নেন মুখের মাস্ক, হাতে স্প্রে করেন স্যানিটাইজার। দেখলাম বসার আগেও চেয়ারে স্প্রে করেই বসলেন। একে তো ল্যাবার দপ্তর তায় আবার সাফাইকর্মীদের নিয়ে মিটিং। 


দিন যায়। পরিস্থিতি বদল হয় না। খবর আসে কন্ট্রাক্টর কাজ ছেড়ে দিয়েছে। দৌড়ে আসে লোকগুলো, ‘ম্যাডাম ওরা আমাদের কাজ থেকে বসিয়ে দিয়েছে। খাব কি?’ জানতে চাই, লিখিত নির্দেশ দিয়েছে কি?জবাব আসে, নাঃ। বলি তাহলে আপনারা যেতে থাকুন। হাজিরা দিন নিয়মিত।  তারপর দেখি কি করতে পারি। সিসিটিভি ক্যামেরার সামনে জমায়েত হতে থাকে ওরা পর পর কয়েকটা দিন। ঐ প্রতিষ্ঠানেরই অন্য এক দল শ্রমিকের হাতে হাত মিলিয়ে, ‘কালো হাত ভেঙে দাও, গুঁড়িয়ে দাও’  মার্কা পোস্টার লিখতে থাকে ওরা। প্রতিষ্ঠানের ভাবমূর্তি ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে বলে এবার নালিশ আসে খোদ ম্যানেজমেন্টের কাছ থেকে। 


বড়সাহেবের নির্দেশ মত, ম্যানেজমেন্টকে আশ্বস্ত করি, আপনাদের পোস্টার আমি আধা দিনের মধ্যে খুলিয়ে দেব, আপনারা গরীবের দপ্তরে, আলোচনার টেবিলে তো আসুন। তেনারা রাজি হলে, এণাদের রাজি করাতে হয়,‘খুলে দাও বাবারা। বড় মুখ করে বলেছি।“ পোস্টার গায়েব হয়ে যায়। আলোচনা চলে। বড় প্রতিষ্ঠানের সম্মানীয় ডাইরেক্টর সাহেব খোদ আসেন এবার আলোচনার টেবিলে। সাথে আরোও কয়েকজন হোমরাচোমরা সাহেব। 


বেশ জমিয়ে একটা জ্বালাময়ী বক্তৃতা দিই আমি, কোভিডের বিরুদ্ধে যে লড়াই তাকে যদি তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ বলেন, তো সেই যুদ্ধ আমরা যাদের জন্য জিতেছি, তাদের মধ্যে যেমন ডাক্তার-স্বাস্থ্যকর্মী-পুলিশ-প্রশাসন-ব্যাঙ্ক কর্মচারীরা আছেন তেমনই আছেন এণারা। পর্দার পিছনে সাফাইকর্মীদের নিরলস লড়াইকে তো এই ভাবে মুছে ফেলা যাবে না। যারা আমাদের স্বাস্থ্যের এত খেয়াল রাখেন, তাদের ন্যূনতম খেয়াল রাখব না আমরা?   সাবান-গামছা-গামবুট- ব্লিচিং- অ্যাসিড তৎক্ষণাৎ পাস হয়ে যায়। বাতানুকূল চেম্বারেও ঘাম মোছেন ডাইরেক্টর সাহেব, ছিঃ ছিঃ এরা এতদিন এসব পেত না? ছুটকো দুশো পাঁচশ নয়, রীতিমত ৮.৩৩ শতাংশ হারে বোনাস দেবারও প্রতিশ্রুতি পাই আমরা। 


মহালয়ার দিন দুই পরে জনৈক ট্রেড ইউনিয়ন নেতা ফোন করে জানান, ‘ওরা বোনাস পেয়ে গেছে ম্যাডাম।’ উৎসবের মরশুমে মানুষগুলো কটা অতিরিক্ত টাকা পেয়েছে শুনে যে কি আনন্দ হয়েছিল কি বলব। হকের টাকা আদায় করে দেবার আনন্দই আলাদা। তবে সত্যিই ভাবিনি ওরা বোনাস পেয়ে ফুল মিষ্টি সহ সবাই মিলে আমার সাথে দেখা করতে আসবে। আজ শুনলাম, সবাই এসেছিল। পাক্কা বারো জন। অফিসের বাইরে তালা দেখে দীর্ঘক্ষণ প্রতীক্ষা করে, প্রবল দুরু দুরু বক্ষে আমায় ফোন করে। বার কয়েক বিজি পায়। তাতেও দমে না, পূর্ণ বিক্রমে আবার করে। কেটে দিই। আবার করে। এবার ধমকাই। ধমকে বলি ব্যস্ত আছি। তখন বারো মাথা এক হয়ে প্লান করে বোনাস তো পেয়েছে,সবার পকেটে টাকা আছে। স্টান্ড থেকে একটা গাড়ি ভাড়া করে ম্যাডামের বাড়িই চলে যাবে ওরা। যার পা কামড়ে ঝুলছিল ঢোড়া সাপটা,সে দৌড়য় গাড়ি খুঁজতে। কিন্তুু সব পরিকল্পনায় জল ঢেলে দিই আমি। 


আজ সেই গল্প বলতে বলতে খুব হাসছিল ওরা। হাসছিলাম আমিও। ওদের পরিকল্পনার দৌড় দেখে। তার সাথে সাথে কেন যে করকর করছিল চোখদুটো। পূর্ব মেদিনীপুর জেলার লোকজনের এই এক বৈশিষ্ট্য, যাই বলেন।


পুনশ্চ - লড়াই এখনও বেশ খানিকটা বাকি আছে। তাই মুখ গুলো একটু ঝাপসা করে দিলাম। আর ইয়ে কাপের সেটটাও শেষ পর্যন্ত আর কেনাই হয়নি 😞। ভুলেই গেছিলাম।



Tuesday 11 October 2022

অনির পুজোর ডাইরি, ২০২২

 বাবার ডাইরি থেকে ২৫ শে সেপ্টেম্বর, ২০২২

শুভ মহালয়া

(১ম কিস্তি)

১৯৭১ সাল। সে বছর মহালয়া পড়েছিল ১৮ই সেপ্টেম্বর। তার আগের রাত, অর্থাৎ ১৭ তারিখে হামলা হয় আমাদের বাড়ি। 

সেই সময় পশ্চিমবঙ্গে নকশাল আন্দোলন সর্বোচ্চ পর্যায় রয়েছে। সর্বত্রই অন্যান্য রাজনৈতিক দল আস্তে আস্তে পিছিয়ে যাচ্ছে। আর আরবান নকশালরা গড়ে তুলছে মুক্তাঞ্চল। গণ সমর্থনও পাচ্ছে ভুরি ভুরি। মূলতঃ গ্রামের দিকেই আন্দোলন ছিল অধিক সক্রিয়। শহর- নগরেও আস্তে আস্তে ছড়িয়ে পড়ছিল তার আগুন। স্কুল- কলেজ- বিশ্ববিদ্যালয়ের সেরা ছাত্ররা দল বেঁধে এগিয়ে আসছে, নিপাত্তা হয়ে যাচ্ছে শাসক দলের ছাত্র সংগঠন। শাসক দলও শুরু করেছে নিপীড়ন, নির্যাতন। 


এদিকে হাওড়া থেকে ডোমজুড়, তারপর সামান্য অংশ ছেড়ে ওদিকে আমতা পর্যন্ত তখন পুরোপুরি মুক্তাঞ্চল। সেটা আগস্ট মাস, শাসক দলের দুজন নেতা, নাম উহ্য থাকুক,হঠাৎ গোপনে আমার সাথে যোগাযোগ করল, ‘এখনও এখানে খুনোখুনি শুরু হয়নি, চেষ্টা করিস এখানে যেন ওসব না হয়।’ কথা হল, কোন পক্ষই হিংসার আশ্রয় নেবে না।  সিদ্ধান্ত জনগণের ওপর ছাড়া হবে, যারা গণ সমর্থন বেশী হবে, এলাকা তারই থাকবে।মিটে গেল যাবতীয় সমস্যা, আমিও আবার চেনা রুট দিয়ে আপিস যেতে শুরু করলাম। 


এর কিছুদিন পর,স্থানীয় এমপি তথা কংগ্রেসের বয়োজ্যেষ্ঠ নেতা স্বর্গীয় যুগল কিশোর মণ্ডল একদিন বাড়িতে এসে বাবার সঙ্গে দেখা করে বলল,‘ বড়দা আপনার মেজ ছেলেকে একবার আমার সাথে দেখা করতে বলুন। কিছু একটা চলছে তলায় তলায়-’। হাওড়া ময়দানে কল্পনা সিনেমার ওপরে একটা কংগ্রেসের পার্টি আপিস ছিল। চতুর্দিকে হিন্দিভাষী মেহনতি মানুষের বসবাস,আমার পক্ষেও বেশ নিরাপদ,সেফ জোন। কিন্তু আমি গেলাম না। 


এর কয়েকদিন পর আমাদের চাটুজ্জে বাড়ির বড় তরফের যে সবথেকে ছোট মেয়ে, তোরা বলিস খুকী পিসি আমরা বলতাম খুকনি। খুকনি প্রায় দিনই দুপুর বেলা আমাদের বাড়ি চলে আসত তোর পিসিদের সাথে আড্ডা দিতে। সে এসে তোর ঠাকুমাকে খবর দিল, অমুকবাবুর বাড়িতে গোপনে বিরাট পার্টি মিটিং চলছে। তাতে আমাদের ছোট পিসিমা, আর ছোটপিসিমার ছেলে তপনও আছে। খুকনি পিছনের জানলার আড়ি পেতে শুনেছে ওরা আমাদের বাড়িতে দল বেঁধে হামলার প্ল্যান করছে। মূল লক্ষ্য আমাকে আর অসিত(ছোটকাকু)কে মার্ডার করা। 


এর কিছুদিন পর আমার সোর্স মারফৎ খবর এল, আমাদের বাড়ির পূব দিকের খিড়কির দরজার উল্টোদিকের দোতলা বাড়ির বারন্দায় একটা ছেলে সবসময় বসে থাকে আর আমাদের বাড়ির দিকে নজর রাখে। তপন দুপুর বেলা প্রায়ই আসে তার কাছে আর দুজনে মিলে আমাদের বাড়ির দিকে আঙুল তুলে কিসব কথাবার্তা বলে ফিসফিস করে। খবর মোতাবেক একদিন নির্দিষ্ট সময়ে যেই খিড়কির দরজা খুলেছি দেখি তপন উল্টোদিকে দাঁড়িয়ে আমাদের বাড়ির দিকে তাকিয়ে একটা অচেনা ছেলের সাথে কথা বলছে। আমাকে দেখেই সুট্ করে ঢুকে গেল। 


খুকনি আর আমার সোর্সের খবর মিলে গেল। আমরা আভাস পেয়ে গেলাম যে শীঘ্রই আমাদের বাড়ি হামলা হতে চলেছে। আরোও খবর আসতে লাগল, আমাদের পিছন দিকে পবিত্রদের বাড়িতে বেশ কয়েকজন নতুন ভাড়াটে এসেছে। তাদের মধ্যে একজন দিদিমণি আছেন। তিনি কোন স্কুলে পড়ান, কখন বেরোন কেউ জানে না। কিন্তু তাঁর কাছে অনেক ছেলের আসাযাওয়া লেগেই থাকে। সবই অচেনা এবং ষণ্ডামার্কা  ছেলে। ভদ্রমহিলা পরে দমদম থেকে শাসক দলের এমপিও হন। নাম যাই হোক সবাই ডাকত বউদি বলে। এই বৌদির কথাই যুগল মণ্ডল আমায় বলতে চেয়েছিল। এই বৌদি প্রথমে নিজে ঢুকেছেন তারপর হার্মাদ বাহিনীকে ঢুকিয়েছেন একে একে। 


আমরা আন্দাজ করলাম, পুজোর মধ্যেই হামলা হবে। মহালয়ার আগের দিনই সব টাকাপয়সা যোগাড় করে, রেশন তুলে আমরা ঠিক করলাম গা ঢাকা দেব। রাতের অন্ধকারে বেরিয়ে সোজা হাওড়া স্টেশন। তারপর যা হোক একটা টিকিট কেটে রাত নটার দুন এক্সপ্রেসে চড়ে বসব। তারপর যা হয়- 


মহালয়ার আগের রাত, আমি আর অসিত খেতে বসেছি, হঠাৎ বৃদ্ধা প্রতিবেশিনী তারি পিসি ছুটে এসে মাকে খবর দিল,  “ তোমাদের বাড়ি থেকে আর বেরোনোর কোন রাস্তা নেই বৌদি। শাসক দলের কয়েক হাজার ছেলে সবদিক থেকে ঘিরে ফেলেছে বাড়িটাকে। সঙ্গে পুলিশ ও আছে।  আর আছে সিআরপি। তারি পিসি আমাদের বাড়ির পিছন দিকে একটা পোড়ো ঘর বানিয়ে থাকত, তারি পিসি তড়িঘড়ি বলল, ‘তোমাদের কাছে যদি কিছু থাকে আমায় দিয়ে দাও। আর্মস্ আর অ্যামুনিশন কিছু তো ছিলই। ভালোমতই ছিল। তারি পিসি সব নিয়ে গিয়ে তার ঘরে লুকিয়ে রাখল। কপালের এমন গেরো প্রথম হামলাটা ওরা করল তারিপিসির পোড়ো ঘরে- 

(চলবে?)

বাবার ডাইরি থেকে, ২৬ শে সেপ্টেম্বর, ২০২২


(কিস্তি -২)

শুভ প্রতিপদ 

তারি পিসির সাহস ছিল দুর্ধর্ষ। আমার ঠাকুমার (প্রপিতামহী) অন্যতম স্নেহের পাত্রী ছিল, বাবাকে(দাদু) দেবতার মত শ্রদ্ধা করত বৃদ্ধা, ডাকত ‘বড়দা’ বলে। বৃদ্ধা সেদিন ওদের সামনে বুক চিতিয়ে দাঁড়িয়ে বলেছিল, ‘দেখো বাবারা আমি গরীব গয়লানি। লোকের বাড়ি দুধ বেচে খাই। তোমাদের যা দেখার দেখো, যা খোঁজার খোঁজো, শুধু আমার ঘরটা নষ্ট করো না।’ কোথায় যে লুকিয়েছিল তারি পিসি জানি না,তবে ওরা কিছু খুঁজে পায়নি। ওরা চলে যেতেই তারি পিসি সেসব জিনিস পত্তর তাঁর লুকানো স্থান থেকে বের করে সোজা পাতকুয়ায় ফেলে দিয়েছিল।


এবার হামলা হল সামনে থেকে। পুলিশ,সিআরপি আর কয়েক হাজার হার্মাদ বাহিনী। বাড়িতে সবাই সন্ত্রস্ত। অসিতকে ছাতের সিঁড়িতে তুলে দিয়ে শিকল তুলে দেওয়া হল। বন্ধ সদর দরজার ওপার থেকে হুমকি আসতে লাগল, দরজা খুলতে হবে। বাড়ি সার্চ করবে ওরা। মজার কথা হল, পুলিশ কিন্তু সম্পূর্ণ নীরব ছিল, যাবতীয় আদেশ,নির্দেশ, হুমকি সবই আসছিল পার্টির ছেলেদের থেকে। আমরা বন্ধ দরজার এপার থেকে বলছিলাম, “ঠিক আছে। তবে এত জন নয়। দুচারজন আসুন।” এই সব কথাবার্তার মধ্যেই সাত আটজন ছেলে করল কি বাইরের বাগানে একটা মস্ত শালবল্লা পড়ে ছিল, সেটা তুলে এনে সেটা দিয়ে সদর দরজায় ঘা মারতে লাগল। 


দেড়শ বছরের বুড়ো সেগুন কাঠের দরজা, কতক্ষণ আর সেই অভিঘাত নিতে পারে। খুলে পড়ল একটা প্ল্যাঙ্ক আর সেই ফাঁক গলে ঢুকে দরজা খুলে দিল কেউ। এক পলকে গোটা উঠানটা হয়ে গেল জনসমুদ্র। ঢুকেই দাদার(জেঠু) গালে দুই চড়। বুড়ো, শারীরিক ভাবে অক্ষম রাজা কাকাকে(বাবার মেজকাকা) অশ্রাব্য গালিগালাজ। চোখের পলকে বৈঠকখানা, রান্নাঘর, ঠাকুরঘর, শোবারঘরগুলো তছনছ করে ফেলল ওরা। পুলিশ ঠুঁটো জগন্নাথ। আজও মনে আছে বৃদ্ধ রাজাকাকার ভয়ার্ত কণ্ঠস্বর,‘কি চাইছ, কি চাইছ কি তোমরা?’ বলতেই সপাটে চড়। 

 ততক্ষণে দোতলায় উঠে গেছে আরেকদল। দোতলার ঘর গুলোর অবস্থাও একতলার মতই হল।সমস্ত আলমারি,শোকেস, ঠাকুদার আমলের কর্পূরকাঠের সিন্দুক, তোরঙ্গ, খাট বিছানা ওলটপালট করেও কিছু পাওয়া গেল না। যে ছেলেগুলো ছিল, তাদের অনেকেই অসিতের(ছোটকাকু) বন্ধু, আগের দিন রাতেও একসাথে আড্ডা মেরেছে পাড়ার চায়ের দোকানে। 


ওরা যখন হতোদ্যম হয়ে সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসছে, আচমকা ভাবীর(জ্যাঠাইমা) দিকে চোখ পড়ল। হামলা হতে পারে জানার পর চুনু-লক্ষ্মীকে ( অবিবাহিতা ন এবং ছোট পিসি)  আগেই সরিয়ে দিয়েছিলাম আমরা। ভাবীকেও বলা হয়েছিল বাপের বাড়ি চলে যেতে। ভাবী বাড়ি ছেড়ে যেতে রাজি হয়নি। ওরা কুৎসিৎ কিছু গালমন্দ করে বলল, ‘নির্ঘাত এই মেয়েছেলেটা শাড়ির মধ্যে আর্মস্ লুকিয়ে রেখেছে। শাড়ি খুলে সার্চ করব।’


পুলিশ চুপ থাকলেও, ঠিক এই সময় গর্জে  উঠল সিআরপির জাঠ ড্রাইভারটা। তার কাঁধেও একটা ফায়ার আর্মস্ ছিল, আচমকা সেটা হাতে নিয়ে চিৎকার করে উঠল, ‘মেয়েদের গায়ে হাতে দিলেই আমি গুলি চালাব। জানানাকে সার্চ করতে হলে একজন জানানাকে ডেকে আনুন।’ পাশের বাড়ি থেকে একজন মহিলাকে ধরে আনা হল,সে মাঝের ঘরে ভাবীকে ঢুকিয়ে ভালো করে তল্লাশী নেবার পর জানাল,‘ নাঃ কিছু পাওয়া যায়নি।’


সাময়িক ভাবে হতোদ্যম হয়ে পড়ল ওরা। কয়েকজন বেরিয়েও গেল বাড়ি ছেড়ে। কয়েকজন আবার ভঙচুর করতে লাগল নিষ্ফল ক্রোধে। বাইরের ঘরে একটা সুন্দর জার্মান ঝাড় বাতি ছিল। বাবার(দাদু) ভীষণ পছন্দের জিনিস। মাঝেমাঝে বাবা বৈঠকখানার তক্তোপোষে শুয়ে এক দৃষ্টিতে ঐ ঝাড়বাতিটার দিকে তাকিয়ে থাকত। বিভৎস উল্লাসে সেটাকে গুঁড়ো গুঁড়ো করে দিল ওরা। ঠাকুরদার (প্রপিতামহ) যে দেওয়াল জোড়া পোর্টেটটা ছিল, সেটাকে আছড়ে আছড়ে ভেঙেও শান্তি হল না। শেষে বল্লম দিয়ে খোঁচাতে লাগল।


অসিত(ছোটকাকু) এতক্ষণ ছাতের সিঁড়িতে চুপচাপ বসে ছিল। হট্টোগোলের আওয়াজ কিঞ্চিৎ  স্তিমিত হয়ে পড়ায়, আস্তে আস্তে বেরিয়ে যেই দোতলার বারন্দা দিয়ে উঁকি মারতে গেছে অমনি ওদের নজরে পড়ে গেল। ‘ঐ তো অসিত। মার শালাকে-’ বলতে বলতে তৎক্ষণাৎ দোতলার দিকে দৌড়ল গোটা বিশেক ছেলে। তারপর অসিতকে প্রায় চ্যাং দোলা করে এনে ফেলল উঠোনে। 

এতক্ষণে পুলিশকে নড়তে দেখা গেল, ওসি ছিল গোপাল ভড়, সে বলল ‘অ্যারেস্ট করে নিয়ে চল।’ দুজন বাঙালী পুলিশ দুদিক থেকে আমার হাত চেপে ধরল, অসিতকে আর আমাকে নিয়ে চলল পুলিশ ভ্যানের দিকে। ভ্যানটা ইচ্ছে করেই দাঁড় করিয়েছিল যুগল মণ্ডলের বাড়ির সামনে অর্থাৎ আমাদের বাড়ি থেকে প্রায় ছয়-সাতশ মিটার দূরে। বাড়ি থেকে বেরিয়ে বাঁদিকের সরু গলিটা দিয়ে আমাদের যখন বড় রাস্তার দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, আমার হাত ধরে থাকা একজন বাঙালী পুলিশ হঠাৎ বলল,‘আপনার চশমাটা খুলে আমাকে দিন। আমি বুক পকেটে রাখছি। বুঝতেই তো পারছেন কি হতে চলেছে। চশমাটা ভেঙে কাঁচ চোখে ঢুকে যেতে পারে।’


 চশমা খুলে দেওয়াটা ভালো হল না মন্দ হল জানি না, কারণ আমার সামনের কিছুই আর আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম না। বড় রাস্তায় ওঠার সাথে সাথেই শুরু হল মার। চোখে ঝাপসা দেখার জন্য আমি বুঝতে না পারলেও অসিত পুলিশ ভ্যানটা দেখতে পেয়েছিল। মার খেতে খেতেই টেনে দৌড় মারল অসিত, সোজা গিয়ে উঠে বসে পড়ল পুলিশের জিপে, আর তারপর শুরু করল অসিতের পাল্টা গালাগাল। ‘দাঁড়া শালারা, মামার বাড়ি যাচ্ছি বটে,চিরদিন তো আর আটকে রাখতে পারবে না। ফিরে আসবই, আর ফিরে এসে তোদের সবকটাকে দেখে নেব।’ 


আমি পালাতে পারিনি, ফলে অঝোর কিল,চড়, ঘুঁষি,লাঠি, রডের বাড়ি পড়তে লাগল আমার ওপর।মার খেতে খেতে রক্তাক্ত অবস্থায় যখন লুটিয়ে পড়েছি, তখনও পুলিশ ভ্যানটা আরও দু- আড়াইশ মিটার দূরে। ওখানেই মেরে ফেলত আমায়,যদি না  একজন সিআরপি আচমকা পিছন থেকে আমায় তুলে কাঁধে ফেলে দৌড়ত পুলিশ ভ্যানের দিকে।


ব্যাঁটরা থানার লক আপে নিয়ে গিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিল আমাদের। অসিত দেওয়ালে ঠেস দিয়ে বসে ফুঁসতে লাগল। আমার আর বসার ক্ষমতা ছিল না। আমি নেতিয়ে পড়লাম। যে বাঙালী পুলিশটা আমার চোখ থেকে চশমাটা খুলে বুক পকেটে রেখেছিল, সে কখন যেন এসে আবার পরিয়ে দিয়ে গেল চশমাটা। চেতনা কখনও আসছিল, কখনও চলে যাচ্ছিল। তারই মধ্যে শুনতে পেলাম পার্টির দোর্দণ্ডপ্রতাপ নেতা শিবপ্রসাদ ঘোষ (নাম পরিবর্তিত) এসেছে আমাদের দেখতে। দাঁতে দাঁত চেপে ওসি গোপাল ভড়কে বলছে,‘একেবারে মেরে ফেলতে পারেননি?’ গোপাল ভড় মিনমিন করে বলছে, ‘ভ্যানটা তো অতদূরে রেখেছিলাম। হাঁটিয়ে তুলেছি। আপনার পার্টির ছেলেরা তার মধ্যে মেরে ফেলতে পারল না? ওরা না পারলে,পুলিশ কি করে সর্বসমক্ষে পিটিয়ে মারবে?’


সেই সময় থানার উল্টোদিকের দোতলা বাড়িতে শক্তি রায় বলে একটা ছেলে থাকত। শক্তি কলেজে স্টুডেন্ট ফেডারেশন করত বটে, পরে কংগ্রেস হয়ে যায়। তখন মাঝ রাত, কয়েকজন নকশাল ধরা পড়েছে শুনে শক্তি দেখতে এসেছিল থানায়, যে কারা ধরা পড়েছে। শক্তির সঙ্গেই এসেছিল পিযুষ গাঙ্গুলী বলে একটা ছেলে। পিযুষের বাবা ছিল আইবির মস্ত অফিসার। পিযুষের সৌজন্যেই শক্তির থানায় অবাধ প্রবেশ ছিল। পিযুষ আর শক্তিও সেদিন শিবপ্রসাদ রায় আর গোপাল ভড়ের গোপন বার্তালাপ শুনে ফেলে। তারপর ওরা চলে যেতে পিযুষই একজন লোক্যাল ডাক্তারকে তুলে আনে। তাঁরই চিকিৎসায় আর পিযুষের উদ্যোগে বলতে পারো সেদিন প্রাণ বেঁচেছিল আমাদের। যখন জ্ঞান ফিরল, তখন পূব আকাশে লেগেছে লালচে রঙের ছাপ,থানার বড় রেডিওটা থেকে ভেসে আসছে বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্রের জলদ গম্ভীর কণ্ঠস্বর, " আজি আশ্বিনের শারদ প্রাতে -"।

(শেষ)


অনির ডাইরি ২৮শে সেপ্টেম্বর, ২০২২



"তুই এলি কেন?" ভ্রু কুঁচকে জানতে চায় আমার বর। বেতন ঢোকার মেসেজটা পেয়ে বিকাল সাড়ে পাঁচটা নাগাদ এটিএম এ গিয়েছিলাম একবার, এটিএমটা শৌভিকের অফিসের পাশেই। এখানে ঐ একটিই স্টেট ব্যাঙ্কের এটিএম আছে। আমাদের অফিসের আসে পাশে বলতে বাজারের মধ্যে একটা টাটার কি যেন আছে, তাতে চার হাজার টাকা তুলতে দেয় কেবল, তাও কেঁদে ককিয়ে। ঐ কটা টাকায় হবে কি? কাল হয়ে শারদীয়া ছুটি পড়ছে, তুত্তুরীর মাসির পুজোর বেতন, বোনাস, তুত্তুরীর দিদিমণির ফিজ এগুলো তো দিতে হবে। কেন যে ব্যাটারা অ্যাকাউন্ট নম্বর দিতে চায় না।


 তমলুকে টাকা তোলাটা বেশ চাপের। নিমতৌড়ি থেকে ঠেঙিয়ে যেতে হয় নিমতলা। ব্যাঙ্ক ট্রান্সফার করে দিতে পারলে ল্যাটা চুকে যায়। বলাতে খিলখিল করে হাসছিল মাসি। আর তুত্তুরীর দিদিমণি পচুর ঢোঁক গিলে বলেছিল, ‘থাক না ম্যাডাম। পুজোর পরই দেবেন খন।’ আজব মেয়ে তো, তুমি পুজোর পর টাকা নিয়ে কি করবে বাপু? নিজে যে কটা দিন টিউশনি করেছি, কি হ্যাংলার মতই না তাকিয়ে থেকেছি ঐ কটা টাকার দিকে। বিশেষতঃ পুজোর মাসের টাকাটা তো পুরোটাই খরচ করতাম বাবা-মায়ের পোশাক কেনায়। নিজের উপার্জনে বাবা বা মাকে কিছুু কিনে দেবার আনন্দ যে কি পরম, যারা পারে তারাই জানে। খুব সস্তার কিছু কিনতাম হয়তো, তাই কি খুশি হয়ে যেত বাবা। মা মুখে কিছু বলত না বটে, ভালোলাগাটা টের পেতাম রাতে খেতে বসে। ছাপোষা রুটি- তরকারির পাশে সেদিন শোভা পেত গরম গরম একখানা ডিম ভাজা। 


এই দেখুন কথা হচ্ছিল শৌভিকের বিরক্তি নিয়ে, সেখান থেকে পৌঁছে গেলাম মায়ের হাতের ডিম ভাজায়। মাঝখান থেকে বেশ খানিকটা করকর করে উঠল চোখ। বয়স বাড়ছে মশাই। তো যাই হোক, এটিএমের পাশেই আমার বরের আপিস, ছুটির ঘন্টা তো বেজেই গেছে, তাই ভাবলাম যাই মাননীয় মহকুমা শাসককে বগলদাবা করে বাড়িই নিয়ে যাই বরং ফিরতি পথে। দুদিন ধরে জ্বরে কোঁ কোঁ করছিলেন ভদ্রলোক, আর ক্যালপল গিলছিলেন গপ্ গপ্ করে। আমার গুঁতোয় যে ডাক্তারবাবুকে ফোন করতে বাধ্য হয়েছিল, তিনিও ভুগছিলেন ঐ একই ব্যাধিতে। বললেন, এটা নাকি ‘কলকাতা ফিভার’। জেলার লোক কলকাতা গেলেই হচ্ছে। আমরাও গিয়েছিলাম বৈকি গত সপ্তাহান্তে। 


আজ জ্বর নামতেই আপিস গেছে, ডাক্তারবাবু এবং আমার আপত্তিকে কাঁচকলা দেখিয়ে। ‘আমার কাজ গুলো কি তুই গিয়ে করবি?’ তা বটে। গিয়ে দেখি তিনি এক গাদা জাতিগত শংসা পত্র সই করতে বসেছেন। এরপর এক পাহাড় ডাক দেখবেন। এক ঝলক তাকানো ছাড়া কোন ভাবান্তর পরিলক্ষিত হল না। বেশ খানিক চুপ করে বসে রইলাম। শৌভিক সই করছে আর নাক টানছে। গায়ে হাত দিয়ে দেখলাম, গা সামান্য উত্তপ্ত হলেও জ্বর নেই। 


পাশেই রাখা দুখানা বড় বড় মনিটর। এসডিও অফিসের ভিতরে,বাইরে, কোণে কোণে যতগুলি সিসিটিভি লাগানো আছে, সবকটার ফিড দেখা যাচ্ছে মনিটর দুটোয়। হ্যাংলার মত জিজ্ঞাসা করলাম, ‘আমি যে আসছি, দেখতে পেয়েছিলি?’ কেজো জবাব এল, ‘খেয়াল করিনি।’ একনাগাড়ে কাঁহাতক সিসিটিভি দেখা যায়, উঠে খানিক পায়চারি করলাম। অতঃপর ভাবলাম যুগলের একখান ছেল্ফি তুলি, বলা মাত্রই ভস্ম করে দিল শৌভিক। ‘না অফিস চেম্বারে কোন সেল্ফি তোলা যাবে না।’ খানিক থতমত খেয়ে গেলাম, এর আগেও তো তুলেছি, তখন অবশ্য সিসিটিভির দৌরাত্ম্য ছিল না। এখানেও কি সিসিটিভি লাগিয়েছে নাকি? উপযাচক হয়েই বললাম,‘চেম্বারে কিন্তু ভুলেও সিসিটিভি লাগাস না। নাক- কান চুলকালেও তখন চুলকাতে পারবি না। দাঁতও খোঁটা যাবে না। হেব্বি চাপ।’ 


‘উফঃ ভগবান’ বলে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে শৌভিক। জানায় চেম্বারে ওসব নেই। তাহলে? সেল্ফি তোলার সমস্যা কোথায়? কথা হয়তো আরও বাড়ত,দরজা খুলে মুখ বাড়াল নবেন্দু, ‘ম্যাডাম চা খাবেন?’ ভয়ে ভয়ে তাকালাম মহকুমা শাসকের দিকে,‘হ্যাঁ গো, চা খাবে?’ বেশ কয়েকবার নাক টেনে, শৌভিক বলল, ‘খাওয়া যেতে পারে।’ দুটো কাপে গরম জল আর গ্রীন টি ব্যাগ এসে হাজির হল। সাথে একটা করে সুগার কিউব। আর দুটো প্লেটে চারটে পুঁচকে পুঁচকে বিস্কুট। চিনিটা না মিশিয়ে চায়ের কাপে চুমুক দিলাম। একটা পুঁচকে বিস্কুট মুখে দিতেই গলে গেল। কি ভালো খেতে। 


শৌভিককে বললাম,‘হ্যাঁ গো, একটা সাদা খাম হবে?’ অন্যমনস্ক ভাবে জবাব এল,হতেই পারে, তবে ওণার কাছে নেই, সেকশন থেকে চাইতে হবে। অতঃপর চটক ভেঙে, নৈর্ব্যক্তিক স্বরে,‘কেন?’ বললাম, আমার ভাগের তিনটে বিস্কুট আর চিনির কিউবটা বাড়ি নিয়ে যাব। প্রায় লাফিয়ে উঠল শৌভিক, এতক্ষণের ঘ্যাম, ঘাম হয়ে ঝরে পড়ল। কাকুতি মেশানো আতঙ্কিত স্বরে অনুরোধ করল, ‘এই না। এসব করিস না। প্লিজ। কেমন। ল্যাবেঞ্চুষ কিনে দেব। ঐ বিস্কিটটাই তোকে কিনে দেব। কেমন।’ বেল বাজিয়ে নবেন্দুকে ডেকে জিজ্ঞাসাও করল, এই বিস্কুটটা কোন দোকান থেকে কেনা। ফেরার পথে সেটা পড়বে কি না। ইত্যাদি। প্রভৃতি। 


আমি ততোক্ষণে মহকুমা শাসকের প্রিন্টার হাঁটকাতে লেগেছি। খাম তো দেবে না, একটা সাফ কাগজ পেলে তাতেই নিয়ে নেব খন। নবেন্দু দেখি চায়ের কাপ প্লেট তুলতে লাগল। দৌড়ে গিয়ে নিজের বিস্কুটের প্লেটটা হাতে নিলাম। যেন এখুনি খাব, এমন ভান করে টুক করে তুলে নিলাম চিনির কিউবটাও। শৌভিক গাঢ় লাল থেকে বেগুনি হয়ে গেল। দুই চোখে কাতর মিনতি। 


ভালো কাগজ নেই একটাও, অগত্যা নিজের ব্যাগ থেকে একটা সাফ কাগজ বার করে পাকিয়ে নিলাম বিস্কুট আর চিনি। ‘কেন? কেন? কেন?’ বলতে থাকা শৌভিক কোনদিনও বুঝবে না, মায়েরা কেন এমন করে। মুখের খাবার কেন ছাঁদা বেঁধে নিয়ে যায় বাড়ি। যার জন্য চুরি করলাম,তিনি অবশ্যি মোটেই আমায় চোর বলেননি। শুধু বলেছেন, ‘আমায় খাইয়ে দেবে মা? আমি মেহেন্দি পরেছি কি না। দেখো মা, কেমন লাগছে।’ শুনতে শুনতে, দুটো চুরি করে আনা বিস্কুট খাওয়তে খাওয়াতে কেন যে হঠাৎ করকরিয়ে উঠল চোখ। 

শুভ তৃতীয়া🙏🏼।


অনির পুজোর ডাইরি, ২৯শে সেপ্টেম্বর, ২০২২

(আজ চতুর্থী) 



‘ম্যাডাম,দেরী হয়ে যাচ্ছে, লোকগুলো কিন্তু সকাল থেকে এসে বসে আছে।’ একসাথে তাড়া দিল সৌরভ আর যোসুয়া। পুজোর ছুটির আগে আজই শেষ কর্মদিবস। কোথাও ঢাক বাজছে না, তবুও কেন যে, মাথার মধ্যে অনর্গল গান গেয়ে চলেছেন সনৎ সিংহ, “ চণ্ডী তলায় ঢাকের আওয়াজ মিষ্টি মধুর!/জাগিনা, তাক্‌ তা ধিনা, তাক্‌ তা ধিনা/গুরু গুর গুরুর গুরুর তাক্‌ !‘ যার মানসিক অবস্থা পাঠশালার ঐ ছাত্র গুলোর মত, তাকে কিনা অবতীর্ণ হতে হবে ‘চশমাটি আঁটসাঁট’ গুরুমশাইয়ের চরিত্রে। 


আজ আমাদের বেনিফিট ডিসট্রিবিউশন প্রোগাম। বিশেষ কিছু না, গুটি কতক পেনশনের পিপিও, কয়েকটা সামাজিক মুক্তিকার্ড, কিছু ফাইনাল পেমেন্ট।তাও সবাইকে ডাকতে হলে সংখ্যটা চার পাঁচশ ছাড়িয়ে যাবে সহজেই, বেছে বেছে প্রতিটা ব্লক এবং পুরসভা থেকে দুই-তিনজন করে ডেকেছি আমরা। মূল অনুষ্ঠানটা সাড়ে বারোটা থেকে ছিল, ঝপ করে একজন ইন্সপেক্টরের অনলাইন ট্রেনিং পড়ে যাওয়ার জন্য এক ঘন্টা পিছিয়ে দিতে হয়েছে। সেই মর্মে জানানোও হয়েছিল, তাও সবাই বারোটার মধ্যেই এসে উপস্থিত হয়েছে। 


 বাতানুকূল চেম্বারে বসে বেনিফিট ছাড়তে একদম ভালো লাগে না আমার। তাই সুযোগ পেলেই ডেকেনি মানুষগুলোকে। শুনি তাদের সুখ দুঃখের কথা। চাকরী জীবনের শুরুতে জনৈক সিনিয়র দাদা বলেছিলেন, ‘মানুষের সরকারী দপ্তর গুলোর বিরুদ্ধে এত ক্ষোভ কারণ আমরা কিছু শুনতে চাই না। মানুষ সবসময় সুরাহা বা প্রতিকার চায় না। তারাও জানে তোর সীমাবদ্ধতা। শুধু শুনলেই দেখবি, অর্ধেক সমস্যা মিটে যাবে।’ 


সাধ্যমত চেষ্টা করি শোনার। শুধু শোনা নয়, আমার তো ওঁদের দেখতেও ভালো লাগে। চেম্বারের বাইরে পর্দা লাগানোর জন্য ঝোলাঝুলি করেছিল এই অফিসের সাপ্লায়ার, ‘এই বিল্ডিং এ সব অফিসারদের ঘরের সামনে পর্দা আছে। আপনিও লাগিয়ে নিন। উটকো পাবলিক ঢুকবে না।’ আমি লাগাইনি। পাবলিক কেন ঢুকবে না? পাবলিক সার্ভিস দেব বলেই তো বসে আছি। 


তো যাই হোক, এমনি গুটি কয়েক মানুষকে দেখা এবং তাদের কথা শোনার জন্য আজকের অনুষ্ঠান। কোলাঘাটের ইন্সপেক্টর সোহাগ করে যার নাম দিয়েছে, 'শারদ শ্রমাঙ্গনে'। বেনিফিট তুলে দেবার জন্য হোমরাচোমরা কেউ এ যাত্রা আসছে না বলে সামান্য দোনামোনা ছিল আমার টিমের মধ্যে। উড়িয়ে দিয়েছি আমি। আরে ভাই আমার চোখে তো তোমরাও সবাই হোমরাচোমরা। কাজ তো তোমরাই করো। ইন্সপেক্টররা- সিকেসিওরা- গ্রুপ সি/ ডিরা- এজেন্ট/ এসএলওরা থাকলেই হবে। আমরাই তো উপলক্ষ্য। আমরাই ভিআইপি। 


ছুটি পড়ার আগের দিন বলে সবাই ভেবেছিল লোকজন তেমন হবে না। হক বাবু মাথা গুণে জানিয়ে গেলেন একশ তেত্রিশ জন সমবেত হয়েছে আজ। 


 যাক সেজেগুজে আসা সার্থক। কালো ধনেখালি শাড়িটা সম্ভবতঃ চুঁচুড়া থেকে বদলির অর্ডার বেরোনোর পর উপহার দিয়েছিল ধনেখালির অমৃতা আর কৌশিক। আজ ভাঙব, কাল ভাঙব করে আর ভাঙাই হয়নি। বছর ঘুরে আজ ভেঙেছি। হুগলী এনসিএলপি ম্যানেজার ঝুমা শিখিয়েছিল, আগের দিন রাতে কুঁচি আঁচল ঠিক করে সামান্য ইস্ত্রি বুলিয়ে নিলেই আর তাঁতের শাড়ি নিয়ে চিন্তা করতে হয় না। সেই মোতাবেক গত রাতে শাড়িটা পরে, গোটা চারেক সেফটি পিন দিয়ে সাজিয়ে রেখেছিলাম কুঁচি আর আঁচল। আজ হাল্কা করে ইস্ত্রিও বুলিয়ে নিয়েছি সক্কাল সক্কাল। মুখ ব্যাদান করছিল বটে শৌভিক,পাত্তা দিইনি। আজকের দিনে ওসব দেখতেও নেই।


ডিএম সাহেবের মিটিং হল কানায় কানায় ভর্তি আজ। রোল কল করার মত করে তত্ত্বতালাশ করি আমি, চণ্ডীপুর এসেছে? আর কোলাঘাট? তমলুক পুরসভা? নাম ডাকার সাথে সাথেই একযোগে উঠে দাঁড়ায় ঐ ব্লক বা পুরসভা থেকে আগত আমাদের লোকজন আর অসংগঠিত শ্রমিকেরা। কোলাঘাটের দীপালীদিকে জব্বর বকেছিলাম আমি। তারপর বেশ কিছু মিটিং এ আসেননি উনি। প্রতিবারই আলদা করে ওণার খোঁজ নিতাম আমি। ইন্সপেক্টরের মুখে শুনতাম ওণার স্বামী খুব অসুস্থ। আজ দেখি হাজির হয়েছেন দীপালী দিও। আমার ওপর আর রাগ নেই তো, মাইকেই জানতে চাই আমি। দীপালি দি একগাল হেসে বলেন, ‘আপনি আমাদের যতটা ভালোবাসেন, আমরাও আপনাকে ততোটাই ভালোবাসি ম্যাডাম। বর অসুস্থ ছিল বলে আসতে পারিনি। এই দেখুন একটু সুস্থ হতেই এসেছি। বরকেও সঙ্গে করে এনেছি। আপনার সাথে আলাপ করাব বলে। ’ 


আবার বকব কিন্তু, হুমকি দিতে দিতে ময়নায় পৌঁছে যাই আমি। ‘ময়না? ময়না?’ হাঁকতে থাকি। সবাই এ ওর মুখ চায়। ময়নার ভারপ্রাপ্ত ইন্সপেক্টর ভাবুক হয়ে পড়ে, ময়না থেকে কেউ আসেনি দেখে। আজকের দিনে আবার কেউ মন খারাপ করে নাকি? সব মনখারাপ জানলা দিয়ে উড়িয়ে দিই আমি। ধুর, ময়না আসেনি তো কি? পুজোর ছুটির পর আপিস খুলতে দাও, আমরাই গিয়ে হাজির হব ময়নায়। অন্য ব্লক থেকে আসা লোকজন চিৎকার জোড়ে,‘ আমরাও যাব। আমাদের ও নিয়ে যাবেন ম্যাডাম।’ সম্মিলিত চিৎকার ছাপিয়ে ভেসে আসে পুরসভার সুতপার গলা। ‘স্যার/ম্যাডাম এই দেখুন মিনুদি এসেছেন ময়না থেকে।’ ‘বাসটা লেট করলনি’ বলতে বলতে একগাল হেসে মঞ্চের দিকে এগিয়ে আসেন মিনুদি, আমি বলি, তা হোক, তবুও বাপু আমরা ময়না যাবই।  


অনষ্ঠান এগোয়, সঞ্চালনার দায়িত্ব দারুণ ভাবে সামলায় কোলাঘাটের ইন্সপেক্টর সৌম্য। একেক জনের নাম ধরে ডাকে সৌম্য, জানায় তিনি কি পাচ্ছেন বা পেতে চলেছেন। গুড়গুড় করে এগিয়ে আসেন সেই শ্রমিক, আমি চিৎকার করি আমার টিমের কোন সদস্যের নাম ধরে, পিছন দিকে বসে জমিয়ে আড্ডা মারা শুভদীপ্ত,সৌমেন, শুভাশিসকে আড্ডা ফেলে উঠে আসতে হয় সার্টিফিকেট বা পিপিও তুলে দিতে। চায়ের হিসেব ফেলে এগিয়ে আসেন হক বাবু। তেমনি নাম পড়েছে সৌম্য, রোগা ছোট্টখাট্ট চেহারা, গলায় কণ্ঠি, চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা পরা এক ভদ্রমহিলা এগিয়ে এলেন স্টেজের দিকে। ওণার পেনশন ঢুকেছে প্রথম বার। আমাদের রবি বাবু ওণার হাতে তুলে দেবেন পিপিও। স্বভাববশতঃ বলে যাই আমি, ‘ যত্ন করে রাখবেন। অবশ্যই ল্যামিনেট করিয়ে নেবেন। আর প্রতি নভেম্বরে এসে লাইফ সার্টিফিকেট দিয়ে যাবেন।’ পিপিও পেয়েও, যান না ভদ্রমহিলা। নীচে থেকে আমার দিকে বাড়িয়ে দেন দুটো হাত। শিরা ওঠা রুগ্ন দুটো হাত চেপে ধরে আমার হাত, বিড়বিড় করে কি সব যেন বলতে থাকেন ভদ্রমহিলা। ওণার স্বামী ছুটে আসেন পিছন বেঞ্চ থেকে। ভদ্রমহিলা ততক্ষণে হাত বাড়িয়েছেন আমার মাথার দিকে। 


এতক্ষণে চিনতে পারলাম ওণাকে, এই আপিসের চার্জ নেবার পরপরই এসেছিলেন দোঁহে। ওণার পেনশনের আবেদন করার পর কেটে গেছে বেশ অনেকগুলি দিন। আশা ছেড়েই দিয়েছিলেন। তারপর কেউ বোধহয় বুদ্ধি দেয় আমার সঙ্গে এসে দেখা করার। তিনতলা সিঁড়ি ভেঙে এসে মুখচোখ ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছিল দুজনের। সব শুনে, শান্তনু আর তৎকালীন ইন্সপেক্টরের সাথে কথা বলে বুঝেছিলাম, ওণারা যতদিন বলছেন বা ভাবছেন ততোদিন পড়ে নেই, কিছু কাগজপত্র নিয়ে সমস্যা ছিল বটে, তাই হয়তো কয়েকবার হিয়ারিং এ ডেকেছিলেন ইন্সপেক্টর সাহেব। অতঃপর তিনি তাঁর কাজটা করে রেকমেণ্ডেশন সমেত জমা করেছেন আমাদের দপ্তরে। আমাদের দপ্তরে আরেক প্রস্থ ঝাড়াইবাছাই করে, আরোও গুটি পঞ্চাশ আবেদনের সঙ্গে তা অচীরেই পাঠানো হবে কলকাতা। সেই মত সব বলে, বুঝিয়ে দিয়েছিলাম। পেনশন পাবেনই এটা জোর দিয়ে বলার ক্ষমতা আমার নেই। বোর্ডের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত। তবে যদি পান, তো দেরী নিয়ে দুশ্চিন্তা করার কিছু নেই, নির্দিষ্ট দিন থেকেই পাবেন এবং পাইপয়সা সমেত পাবেন। 


আর একটা কাজ করেছিলাম, দুজনকে সঙ্গে করে নিয়ে গিয়ে লিফটে তুলে দিয়েছিলাম। বলেছিলাম আমার কাছে আর আসার দরকার নেই, আর যদি আসেনই তাহলে যেন অবশ্যই লিফটে চড়ে আসেন। সেটা ভোলেন নি ওণারা। অনষ্ঠান শেষেও অনেক আশির্বাদ করে গেলেন ভদ্রমহিলা। থুতনি ধরে চুমুও গেলেন বেশ কয়েকটা চকাস্ চকাস্ করে। গতকালই শারদ শ্রমাঙ্গনে নিয়ে কোন এক গ্রুপে জনৈক সহকর্মী প্রশ্ন করেছিল, ‘দিদি তুমি এইসব করছ অসংগঠিত শ্রমিকদের নিয়ে, আর আমাদের কি হাল। কেউ ভাবে আমাদের কথা?’ স্যাড ইমোজি ছাড়া কিছু দিতে পারিনি ছেলেটাকে। ভুল তো কিছু বলেনি, চাওয়া-পাওয়ার অঙ্কটা বড় জটিল, হাতে পেন্সিল থেকে যাবার সম্ভবনা প্রবল। হয়তো সবই ভুল, সবই অর্থহীন, তাই বলে অঙ্কটা না কষে ছেড়ে তো দিতে পারি না। দেখাই যাক না-। আমি বাপু ভয়ানক আশাবাদী। হয়তো মধ্যমেধার সেটাই বৈশিষ্ট্য।

অনির পুজোর ডাইরি, ২৯ শে সেপ্টেম্বর, ২০২২

পর্ব- ২ 

(আজ চতুর্থী) 


বিয়ের আগেই বলে রেখেছিলাম, পুজো মানেই আমার শহর। কন্যা সন্তানের জন্ম দিয়েছে বলেই, তাকে শ্বশুরবাড়ি পাঠিয়ে, উৎসবের দিনে ঘর অন্ধকার, মুখ কালো করে বসে থাকবে আমার বুড়ো বাপ-মা, তা হবে না বাপু। বরের সাথে তো সারা বছর কাটাই, গুচ্ছ গুচ্ছ ছবি তুলি, শৌভিক আর একটু নমনীয় হলে আরও বেশি তুলতাম, পুজোর কটা দিন অন্তত অর্ধেকটা না হয় নাই থাকলাম একসাথে। অঞ্জলি দিয়ে যেখানে বলবে,বাধ্য স্ত্রীর মত অনুগামিনী হব খন। 


 অঞ্জলি কিন্তু আমার পাড়ায়। আমাদের পাড়ার ঠাকুরকে ছাড়া অঞ্জলি অকল্পনীয়। ভাবতেই পারি না। আমি এবং তুত্তুরীও বলে, আমাদের ‘আসল মা’ তো তিনিই। প্রাণের স্পন্দন কেবল তাঁর বিভঙ্গেই টের পাই যে। নেহাৎ ছাপোষা প্যাণ্ডেল করত হাওড়া মিলনী। গলি জুড়ে নির্দিষ্ট দূরত্ব অন্তর ঝুলত কয়েকটা টিউবলাইট। চতুর্থীর ভোরে আসত ঠাকুর। তখনও পূব আকাশ থাকত ঘোর কৃষ্ণ, গলির মুখে এসে থামত ঠাকুর ভর্তি লরি, অতঃপর প্রবল শোরগোল করতে করতে প্রায় বাচ্ছাদের মত পাড়ার কাকু/জেঠু/দাদাদের কোলে চেপে মণ্ডপে যেত লক্ষ্মী-সরস্বতী-কেতো আর গণাই। মাকে চাগাতে দম বেরিয়ে যেত সবার। 


সাবেকীয়ানায় জবজবে ঠাকুর হত আমাদের। ঝুটো জরির ফুল বসানো টকটকে লাল বেনারসী পরা রণরঙ্গিণী মূর্তি অথচ স্নেহার্দ দুই চোখ, ওষ্ঠাধরে স্মিত হাসি। বাবরি চুল, লালচে চোখ, সবজে গায়ের রঙ,পেশী ফোলানো ইয়া ষণ্ডা মার্কা অসুর, আমরা বলতাম চোরা। পাটের কেশর লাগানো হলদে সিংহটাকে দেখে তো রীতিমত ভয়ই লাগত ছেলেবেলায়। সবুজ বেনারসিতে মা লক্ষ্মী , আর নীল বেনারসি পরিহিতা মা সরস্বতী। ঘিয়ে রঙের ধুতিতে কার্তিক আর গণু। সপ্তমীতে লাল পাড় কোরা সাদা শাড়িতে এসে হাজির হত কলা বউ। দুর্গা আর লক্ষ্মীর গায়ের রঙ কাঁচা সোনার মত। কেতো আর গণা একটু গোলাপী ঘেঁষা আর সরস্বতীর গায়ের রঙ হত ধপধপে সাদা। আজও চোখ বন্ধ করলেই দেখতে পাই সেই চিন্ময়ী মূর্তি। অঞ্জলির সময় কি জানি কি মন্ত্র পড়তেন বৃদ্ধ পুরোহিত, আমার মন্ত্র ছিল একটাই, ‘আই লাভ ইউ মা। প্লিজ আর কটা দিন থেকে যাও।’ মন্ত্রের ফাঁকে অনুযোগ করতাম, ‘মাঝে মাঝে তো আসতে পারো মা। বুড়ো বরের প্রতি কিসের এত সোহাগ বাপু?’ সেদিন আর নেই, আমাদের পাড়ার ক্লাবেও আজকাল লেগেছে থিমের হাওয়া। পাশের ক্লাবের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় আজকাল থিমের ঠাকুর হয় আমাদের। হয় থিমের প্যাণ্ডেল। গলি জুড়ে ঝিকিমিকি আলোর রোশনাই। শুধু আমারই যে কেন সেই আসল মায়ের জন্য মন কাঁদে কে জানে! 


আজ চতুর্থী। আজ হয়েই ছুটি পড়ছে, মানে মানে আজকে আপিসটা সেরেই বোঁচকাবুঁচকি আর মেয়ে বগলে পাড়ি দেব হাওড়ার উদ্দেশ্যে। 


গলির মুখে মস্ত সুটকেশ আর গোটা তিনেক পুঁচকে ব্যাগ নামাতে নামাতে আঁতকে ওঠে উত্তম কুমার, ‘ম্যাডাম চলুন আপনার বাড়ি পৌঁছে দিয়ে আসি। আপনারা পারবেননি।’ কে পারবে না? আমরা? তুমি বাড়ি যাও বাপু, আমাদের মা-মেয়েকে তুমি এখনও চিনতেই পারোনি। হিড়হিড় করে ভারী সুটকেসটা টানতে থাকি আমি, তুত্তুরী কাঁধে আর হাতে নেয় গুটি কতক ঝোলা। ভুরভুরে গন্ধওয়ালা মাধবীলতার ঝোপে ঢাকা দরজাটা খুলতে খুলতে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করি আমি, ‘মা, বাবা, দিদি(পিসি) আমরা এসে গেছি।’ 

 ব্যাগপত্তর নামিয়েই মাঠের ঠাকুর দেখতে দৌড়য় তুত্তুরী। বাবা বলে, ‘ থাকবি তো তিন, চারদিন। এত মাল কেউ আনে?’ মুখহাত ধুয়ে পোশাক বদলে মায়ের হাতের চা আর টিফিন খেতে খেতে জমে ওঠে পারিবারিক আড্ডা। ঠাকুর দেখে অখুশি নয় তুত্তুরী, শুধু বলে সিংহটাকে কুতুয়া বানিয়ে দিয়েছে নাকি। এক্কেরে কুট্টুস যেন। 


 গল্প গড়ায়, রাত বাড়ে। মা জানতে চায়, ‘আমার পেনশনটা তুই তুলে দিবি তো?’ মায়ের পেনশনের এটিএম কার্ডটা তো আনন্দের চোটে তমলুকেই ফেলে এসেছি আমি। এদের যাবতীয় ব্যাঙ্কের কাগজপত্র সবই আমার জিম্মায় থাকে। যদিও আমি জন্ম বাউণ্ডুলে, তবুও তেমনি নির্দেশ আমার বাপের। হুকুম মত টাকা তুলে বা ভরে দিই আমি। তাছাড়া আর উপায়ই বা কি, কিছুদিন আগে জনৈক ব্যক্তি পোস্ট অফিস থেকে বলছি বলে মাকে ফোন করে মায়ের পেনশন অ্যাকাউন্টের হালহদিশ জানতে চায়, মাও ওমনি গড়গড় করে তাকে সব তথ্য বলে দেয়। কার্ডের নম্বর, নামের বানান, সিভিভি ইত্যাদি। আশ্চর্যের কথা হল তারই দিন তিনেক আগে নতুন কার্ডটা পেয়েছিল মা। লোকটা এত গূঢ় খবর জানল কি করে, তা ওপরওয়ালাই জানেন।  


এত সহজে কার্য সিদ্ধি হওয়ায় সেই পোস্টাফিসের ভুয়ো বাবুর এত আনন্দ হয় যে এবার তিনি প্রশ্ন করেন, মায়ের অন্য কোন অ্যাকাউন্ট আছে কি না, সেই কার্ডের নম্বর কি, সিভিভি কি ইত্যাদি প্রভৃতি। এত প্রশ্নের জবাব দিতে না পেরে মা এবার ফোনটা দেয় বাবাকে। বাবা তাকে বলে, ‘ভাই কার্ড তো আমার মেয়ের কাছে।’ তিনি বলেন মেয়েকে ফোন করে কার্ডের ডিটেলস্ জানতে এবং জানাতে, তিনি অত্যন্ত বিজি মানুষ বটে, তবে বৃদ্ধের জন্য ততক্ষণ তিনি ফোন ধরে আমাদের উদ্ধার করতে প্রস্তুত। 


বাবাও সুবোধ বালকের মত আমায় ফোন করে নির্দেশ দেয়,‘ আমার এটিএম কার্ড গুলোর নম্বর গুলো একটু বলো তো। পোস্ট অফিস থেকে জানতে চাইছে।’ শনিবারের দুপুর, সদ্য নিজের হাতে রান্না করা লড়াই চিকেনের ঝোল আর ভাত খেয়ে একটা ক্ষুদ্র দিবানিদ্রা দেবার তোরজোড় করছিলাম শৌভিক আর আমি। ঢুলু ঢুলু মস্তিষ্কে যেন বাজ পড়ল, ‘পোস্ট অফিস কেন ফোন করে ব্যাঙ্কের কার্ড ডিটেলস্ চাইবে। ব্যাঙ্কেরই তো চাইবার এক্তিয়ার নেই রে বাবা। নির্ঘাত ফ্রড। এখুনি ঐ ফোনটা কাটো।’ কানে কম শোনে বলে বাবা বোধহয় স্পিকারে রেখেছিল ফোনদুটোই, আমি ব্যাপারটা ধরতে পারায় প্রবল ক্রোধান্বিত হয়ে পড়লেন বাবু মশাই,চিল চিৎকার জোড়েন ফোনের অন্য পাড় থেকে ‘আপনাদের সব টাকা কেটে নেবে ব্যাঙ্ক তখন বুঝবেন। দিনে ১২হাজার কাটবে তখন---’। কথাটা আর শেষ করতে পারেননি ভদ্রলোক কারণ তার আগেই আমার গলাবাজির চোটে ঐ ফোনটা কেটে দেয় বাবা। 


তবে এত কষ্ট করেও কোন টাকা তুলতে পারেনি লোকটা কারণ মা যে নতুন পাওয়া এটিএম কার্ডের বিশদ তথ্য দিয়েছিল, সেটিকে তখনও অ্যাক্টিভেট করিয়ে উঠতে পারিনি আমি। তো যাই হোক এই কারণে সব কার্ড আমার কাছে থাকে, প্রতিমাসেই মা আব্দার করে তার পেনশনটা তুলে দিতে হবে আর প্রতিবারই বাগড়া দেয় বাবা। ‘নাঃ মাসে একটা তো দিন, যাও না। গিয়ে তোলো। একটু শরীর চর্চাও তো হয়। দুটো লোকের সাথে দেখাও তো হয়। চারটে কথাও তো বলো, যেদিন পারবে না, সেদিন দেখা যাবে।’ মা প্রবল রাগ দেখাতে লাগল কার্ড না আনার জন্য আর বাবা আর তুত্তুরী মাকে চমকাতে লাগল। ‘যেতে তোমাকে হবেই মামমাম। আমি যাব তোমার সঙ্গে। তোমার হাত ধরে নিয়ে যাব কাল।’ রাগতে গিয়েও হেসে ফেলে মা, এই তো সেদিন হল মেয়েটা,এর মধ্যে এত বড় হয়ে গেল যে দিদিমাকে হাত ধরে পেনশন তুলতে নিয়ে যাবে-। বিগলিত হয়ে পড়ল মা, তারপর অবশ্য ঝুলি থেকে বেরোল বিড়াল।‘ যাতায়াতের পথে কয়েকটা ঠাকুরও দেখে নেব তোমাতে- আমাতে, বুঝলে মামমাম।’


অনির পুজোর ডাইরি, ৩০শে সেপ্টেম্বর, ২০২২

(আজ পঞ্চমী) 

পর্ব -১

জীবনের সরণি ধরে না জানি কতটা পথ পেরিয়ে এলাম, তবুও ঠাকুর দেখা নিয়ে আমার উন্মাদনা আজও অটুট। ঠাকুর দেখতে আজও আমার বড় ভালো লাগে। রাত জেগে, মেয়ের হাত ধরে, বন্ধুদের সাথে মহানগরের অলিগলিতে ঠাকুর দেখে বেরানোর মধ্যে কেন জানি না জীবনের সৌরভ পাই আমি। 


         জীবনের প্রথম ঠাকুর দেখা বলতে অবশ্যই ‘হাওড়া মিলনি।’ আমাদের পাড়ার ক্লাব। মহালয়ার দিন কয়েক আগে যখন মাঠে বাঁশ পড়ত, উদ্দাম উল্লাসে ফেটে পড়তে চাইত আমাদের কচি হৃদয়। সূয্যি মামা পাটে বসার উদ্যোগ নিলেই মাঠে সমবেত হত কচিকাচার দল। অতঃপর সে কি হুল্লোড়। কেউ শিম্পাঞ্জির মত প্যাণ্ডেলের বাঁশ ধরে ঝুলত, কেউ বা জুতো চপ্পল খুলে প্রতিমার জন্য নির্মিত মঞ্চে চড়ে জুড়ে দিত উদ্দাম নৃত্য। আবার কেউ বা অকারণেই নির্মিয়মান প্যাণ্ডেলটাকে ঘিরে গোল করে ঘুরত চরকির মত। 


            দেখতে দেখতে এসে পড়ত তৃতীয়ার রাত। রীতিমত যুদ্ধে যাবার মত দামামা বাজিয়ে ঠাকুর আনতে রওণা দিত পাড়ার মাতব্বর কাকু, জেঠু, দাদুর দল। চতুর্থীর ভোরে সবৎসা জননী এসে যখন পৌঁছাতেন তখনও পূব আকাশের মুখে থাকত অন্ধকারের অবগুণ্ঠন। তখনও জননী থাকতেন নিরস্ত্র এবং নিরাভরণ। চতুর্থীর রাত বাড়ার সাথে সাথে মায়ের মাথায় চাপত মুকুট, অঙ্গে নানা ভূষণ। পিছনে খাড়া করা হত ঝকমকে চালচিত্র। দশ হাতে ধরানো হত দশ রকম অস্ত্র। মা লক্ষ্মীর কাঁকে ঢুকত কুনকে বা ঝাঁপি, গণেশের হাতে সোনালী ঢাল ইত্যাদি। 


            পঞ্চমীর দিন ছুটি পড়ত আমাদের স্কুলে। বছরে এই রকম দু একটি দিনই মহানন্দে স্কুল যেতাম আমরা। একে তো সামনে লম্বা এক মাসের ছুটি, তারওপর ছুটি পড়ার দিন থাকত না ইউনিফর্ম পরার বাধ্যবাধকতা। রঙবেরঙের পোশাকে, শাড়িতে এক ঝাঁক উড়ন্ত প্রজাপতির মত হাজির হতাম আমরা। চেনা বন্ধুকেও মায়ের শাড়িতে কেমন যেন অন্যরকম অনুপমা লাগত সেদিন। একটু দামী শাড়ি, সামান্যতম প্রসাধনের ছোঁয়া লাগত দিদিমণিদেরও অঙ্গে। রাগীতম দিদিমণিও সেদিন থাকতেন খুশির মেজাজে। নাম ডাকতে এসে জুড়তেন খোশ গপ্প, তরল স্বরে প্রশ্ন করতেন, ‘কি রে, কটা জামা হল?’ 'কে বা আগে প্রাণ, করিবেক দান' এর মত ঝাঁপিয়ে পড়ে জবাব দিতাম আমরা। 


         কতগুলো যে জামা হত, হিসেব রাখা দুষ্কর ছিল। বাবা একাই দিত পাঁচটা। এর বাইরেও জেঠু দিত, কাকু দিত, দিদিভাই দিত। বড় মাসি দিত, সেজ মাসি দিত। ছোট মাসি প্রথম চোটে একটা বিশাল দামী জামা কিনে আনত অতঃপর মায়ের ধমক খেয়ে পাল্টে দুটো বা তিনটে জামা আনত। চাকরী পাওয়া ইস্তক জামা এবং জুতো কিনে দিত বড়দা। ছোটদা খুনসুটি করে বলত, ‘তোর চওড়া কপাল’। পঞ্চমীর সন্ধ্যেয় পিসির কাছে চুল বেঁধে, অপেক্ষাকৃত কম ঝলমলে জামাটা পরেই দৌড়তাম মাঠে। অতঃপর সে কি হুড়োহুড়ি। দুমদাম করে ক্যাপ ফাটাত দুষ্টু ছেলেগুলো।অন্য দিন ল্যাম্প পোস্টের টিমটিমে আলোয় প্রায়ান্ধকার থাকা গলিটা সেদিন ঝকমক করত টিউবলাইটের মালায়। লাউডস্পিকারে গান ধরতেন কিশোর কুমার, ‘আমা-আ-আর পূজার ফুল ভালোবাসা হয়ে গেছে, তুমি যেন ভুল বুঝ না-’।  


সন্ধ্যা গড়িয়ে নামত রাত। কোলে করে বাড়ি ফিরিয়ে নিয়ে যেত বাবা। ষষ্ঠীর ভোরে রওণা দেব আমরা, বাকি পুজোটুকু কাটবে দিদার বাড়িতে। স্বর্গীয় মাতামহ নিষ্পুত্রক ছিলেন বলে, মায়ের পিত্রালয়কে আমরা পাঁচ মাসতুতো ভাইবোন দিদার বাড়ি বলেই ডাকতাম। আজও ডাকি। উত্তরবঙ্গের সীমানা ঘেঁষা ছোট্ট একটা গাঁয়ে একাকী থাকত আমার দিদা। গাঁয়ের নাম রামনগর। বছর ভর দিন গুণত শারদোৎসবের জন্য। বছরে এই একটি বার সমবেত হত দিদার চার কন্যা, তিন জামাতা আর পাঁচ নাতিনাতনি। 


সেজ-ছোট মাসি নিয়মিত গেলেও, মা বছরে একবারই পিত্রালয়ে যেত। প্রথমদিকে তাই পাক্কা একমাসের ছুটি নিত মা। পঞ্চমীর রাতে ব্যাগ গোছানোর উন্মাদনাই ছিল আলাদা। আংটা লাগানো চামড়ার সুটকেসে ঠেসে ঢোকান হত জামাকাপড়। চেন টানা ঢাউস লাল লেদার ব্যাগে ঢুকত হরেক রকম কৌটোবাটা। দিদার নিঃসঙ্গ ভাঁড়ারে কি থাকে, কি থাকে না। তাই গুছিয়ে সব নিয়ে যেত মা আর বড়মাসি। বাবা নিত নতুন হ্যারিকেন, হ্যাজাক ইত্যাদি। আমার শৈশবের রামনগর ছিল নিষ্প্রদীপ। বিদ্যুত বাতি আসতে বাকি আরও এক দশক। গোছগাছ শেষ হলে টিফিন বানাতে যেত মা। তিন থাক অ্যালুনমিনিয়ামের কৌটো ভর্তি করে নেওয়া হত লুচি, আলুভাজা বা তরকারি আর পাড়ার দোকানের দানাদার। সাকুল্যে বার জন একসাথে যাব যে রামনগর, ঝলমলিয়ে উঠবে, কলকলিয়ে উঠবে দিদার দোতলা মাটির বাড়ি। 


পরদিন ভোরে বামাল সমেত আমরা যখন বেরোতাম সদ্য ঘুম ভেঙে আড়ামোড়া ভাঙতেন দিনমণি। পূব আকাশে যেন কেউ ছড়িয়ে দিত এক মুঠো কমলা- লাল আবির। গলির মুখ থেকেই হলুদ ট্যাক্সি ধরত বাবা। গন্তব্য শিয়ালদহ ইষ্টিশন। পুজোর মাসে অকারণ অর্থ ব্যয়ের জন্য গোঁসা করত মা, ‘ময়দান থেকে সাউথ বেঙ্গলের বাস ধরলেই তো হয়’। কিসব সোহাগী কথা বলে মান ভাঙাত বাবা। উড়ন্ত ট্যাক্সির খোলা জানালা দিয়ে অবাক চোখে ঘুম ভাঙা মহানগরকে প্রত্যক্ষ করতাম আমি। বুড়ি হলেও শহরটার একটা জেল্লা আছে যাই বলেন। সাধে কি, হতদরিদ্র হয়েও ইনি তিলোত্তমা। কলেজ স্ট্রিটের ক্রশিংয়ে গড়াগড়ি যেত পাহাড় প্রমাণ সবুজ ডাবের গুষ্টি। দেওয়ালে চিটানো মস্ত সিনেমার পোস্টার থেকে হাসি মুখে হাত নাড়ত মীণাক্ষী শেষাদ্রি, শ্রীদেবী,জয়া প্রদা, কিমি কাটকারের দল। 


শিয়ালদহ ইষ্টিশনে মোলাকাৎ হত মাসি, মেসোমশাই, দাদাদের সাথে। হুইসল্ দিতে দিতে প্ল্যাটফর্মে এসে ঢুকত লালগোলা এক্সপ্রেস। কুলিদের সাথে আগেই ব্যবস্থা করে রাখত বাবা। সুটকেস সমেত ছুটন্ত ট্রেনে লাফিয়ে উঠত কুলি, পিছন পিছন বাবা। তার পিছনে দাদারা। ট্রেন থামলে জানলার ধারে বসা নিয়ে ছোটদার সাথে এক প্রস্থ মুষ্টিযুদ্ধ হত আমার। কুঝিকঝিক করতে করতে দৌড়ত ট্রেন। মায়ের আনা লুচি, বড়মাসির বানিয়ে আনা খাবার পড়েই থাকত। হ্যাংলার মত ঝালমুড়ি, ডালমুট, গরম সিদ্ধ ডিম, কাঁচের বাক্স করে বিক্রি করতে আসা ছানার মিষ্টি খাবার বায়না জুড়তাম আমরা। রাণাঘাটে বদল হত ইঞ্জিন। ডিজেল ইঞ্জিনকে আলবিদা জানিয়ে এবার এসে জুড়ত কয়লার ইঞ্জিন। 


ধিকিধিকি করতে করতে ট্রেনটা যখন পলাশী স্টেশনে নামাত ততোক্ষণে গড়িয়ে গেছে বেলা। অতঃপর রিক্সায় চেপে পলাশীর আমবাগানের ভিতর দিয়ে রামনগর সুগারমিলকে ডাঁয়ে রেখে সোজা গঙ্গার ঘাট। হাতে টানা নৌকায় পেরোতে হত গঙ্গা। মাঝিদের কেউ মায়ের সহপাঠী ছিল, তো কেউ মাসিদের। খোশগল্প করতে করতে নদী পেরিয়ে ওপারে বিধান দাদু বা নারাণ ঘোষের দোকানে চা আর জিভে জল আনা ছানার রসগোল্লা খেয়ে আরও সোয়া কিলোমিটার হাঁটতে হত। রাস্তা প্রথমে খানিকটা পাকা। বাকিটা পুরো কাঁচা। আগের দিন বৃষ্টি হয়ে থাকলে কাদা মেখে ভূত হয়ে যেতাম সব। একবার তো বড়দার কিনে দেওয়া নতুন জুতো এমন কাদায় বসে গিয়েছিল যে হাত দিয়ে তাকে টেনে তুলতে হয়েছিল। তাও আমি পারিনি। তুলেছিল, গ্রাম তুতো এক মামা। গ্রামের ওটাই তো বৈশিষ্ট্য,সবাই সবার আপনজন। আবার পরিস্থিতি পাল্টে গেলে কেউ কারো না। 


      রামনগর গাঁয়ে তখন দুটোই পুজো হত। একটা পাশেই বাঁড়ুজ্জেদের বাড়িতে আর একটা শিবতলায়। একচালা মাটির ঠাকুর। যত উৎসব, উন্মাদনা সবই দিনের বেলা। রাত নামলেই অন্ধকারের চাদর জড়িয়ে নিত গ্রামটা। ঠিক তখনই জ্বলে উঠল দিদার বারন্দার হ্যাজাক। ঐ নিকষ অন্ধকারে সে কি রোশনাই। 


ষষ্ঠ শ্রেণীতে ওঠার পর আর ভালো লাগত না ছিমছাম গ্রামের পুজো। হ্যাজাকের আলোও যেন হারিয়ে ফেলেছিল রোশনাই। দাদারা একে একে যাওয়া ছেড়ে দিয়েছিল পুজোয়। জীবিকার টানে তুতো মামাদের অনেকেই নাম লিখিয়েছিল আর্মিতে। তুতো মাসিরা এমনকি তাদের বান্ধবীরাও বিয়ে করে পাড়ি দিয়েছিল অন্য মুলুক। ফলে রামনগরের পুজো হারিয়ে ফেলেছিল তার প্রাণ। মাসি,মেসোমশাইরা অবশ্য সবাই যেত। আর যেত বড়দা। বড় নাতি, দিদার প্রাণপুতুলী নয়নমণি ছিল যে। 


সপ্তম শ্রেণী থেকে আর পুজোয় রামনগর যাইনি আমরা। কিন্তু ইত্যবসরে হাওড়ার পুজোও কেমন যেন বদলে গিয়েছিল।পাড়ার মাঠে এতদিন যাদের সঙ্গে খেলে বড় হয়েছি, তারাও যেন হঠাৎ করে কেমন পাল্টে গেল। অনেকগুলি মেয়ের বিয়েই হয়ে গেল দেখতে দেখতে। অবশ্যই পালিয়ে গিয়ে। কেউ কেউ চলে গেল মহল্লা ছেড়ে। শিং ভেঙে নতুন প্রজাপতির দলে ঢুকতে পারলাম না আমি। ফলে ঠিকানা হল পূবের বারন্দা আর অন্ধকার ছাত। ঠাকুর দেখার সঙ্গী বলতে বাবা আর মা। সেখানেও বাঁধল গোল। রামনগর যাওয়া হবে না বলে আর ছুটি নিত না মা। ডাক বিভাগে কাউন্টার ডিউটি, ছুটি থাকত কেবল অষ্টমী আর দশমী। বাবার সপ্তমী থেকে ছুটি থাকত বটে, তবে পুজোয় বাবাকে পেতাম কোথায়। সকাল থেকেই বাবাকে পাকড়ে নিয়ে যেত বন্ধুদের দল। চলত অনন্ত আড্ডা। বাবার বাড়ি ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা গড়িয়ে নামত রাত। অফিস ফেরৎ রান্না সেরে সারাদিনের ক্লান্তিতে অবসন্ন হয়ে পড়ত মাও। খেতে বসে কান্না জুড়তাম আমি। পুজো এসেছে, ঠাকুর দেখব না? একমাত্র সন্তানের মুখ চেয়ে নৈশাহার সেরে প্রায় মাঝরাতে ঠাকুর দেখতে বেরোত বাবা মা। ঠাকুর দেখার পরিধি অবশ্য সীমাবদ্ধ থাকত মধ্য হাওড়ার মধ্যেই। বাবা মায়ের হাত ধরে ঠাকুর দেখতে বেরোনোর স্মৃতি আজও আমার শৈশবের প্রিয়তম স্মৃতিগুলোর অন্যতম। কটা ঠাকুরই বা দেখতাম আমরা, হাতে গুণে গোটা দশেক। সবশেষে একটা তিনশ মিলিলিটারের থামস্ আপ বা গোল্ডস্পট বা একটা কোয়ালিটির টুইনওয়ান কাপ আইসস্ক্রিম খেয়ে নাচতে নাচতে বাড়ি। দশম শ্রেণী অবধি এটাই ছিল আমাদের পুজোর রুটিন। বন্ধুদের সাথে প্রথম ঠাকুর দেখা একাদশ শ্রেণী থেকে- সে গল্প অন্য দিন হবে খন।  

(চলবে)