Thursday 30 April 2015

একটি ঘেঁটে যাওয়া গল্প




মার্চ মাস। প্রচণ্ড কাজের চাপ। হঠাৎ মুঠো ফোনটির প্রবল চিৎকার। তাকিয়ে দেখি রাতুল। এই কর্পোরেট দুনিয়ার লোকজন আমাদের কি ভাবে কে জানে? সরকারি কর্মচারী মানেই যেন অফিসে সংবাদ প্ত্র পড়ে বা গসিপ করে। রাতে ফোন করলে কি মহাভারত অশুদ্ধ হত কে জানে?
        বেজার গলায় বললাম, “খুব চাপ। যা বলার খুব তাড়াতাড়ি বলে ফেল।” বিদ্রুপ এবং শ্লেষ এর প্রত্যাশা ছিল। আমাকে নিরাশ করে, অদ্ভুত হেরে যাওয়া গলায় রাতুল বলল, “ জানি তুই ব্যস্ত। অসময়ে বিরক্ত করার জন্য দুঃখিত। কিন্তু থাকতে পারলাম না রে। এই মাত্র আমার জীবনের চরম সর্বনাশটা ঘটে গেল।
        “মানে?” ধড়াস করে উঠলো বুক। তবে কি কাকু – কাকিমার কিছু হয়ে গেল? রাতুল ওদের একমাত্র আদরের নাড়ুগোপাল। দিদি বিয়ে করে দুবাই চলে যাবার পর থেকে ওদের জগত রাতুলকে কেন্দ্র করেই আবর্তিত হয়। নাকি অরো? রাতুলের এক মাত্র পুত্র। পুরো দেব শিশু। হে ঈশ্বর অরোর যেন কিছু না হয়। “রাতুল!  হতচ্ছাড়া  চুপ করে আছিস কেন? বল? কি হল?”
        রাতুল হতাশ গলায় বলল, “আই আম গেটিং ডিভোর্সড্।” “মানে? কি প্রলাপ বকছিস? অফিস টাইমে গাঁজা খেয়েছিস নাকি?” আড় চোখে ক্যালেন্ডারটা দেখে নিলাম, না এপ্রিল এখনো পড়েনি। এটা আমার বা রাতুলের জন্ম বা বিয়ের দিন ও নয় যে সারপ্রাইজ দেবে, তবে কি????” উত্তেজনায় চিৎকার করে উঠলাম, “বল না শালা। দর বাড়াচ্ছিস কেন?” রাতুল কি কান্না চাপছে? নাহ আমারই মনের ভুল, নাকি???রাতুল, থেমে থেমে বলল, “আমি কলেজ স্কোয়ারে। প্রিয়াঙ্কা ডেকেছিল। বলল এই প্রেসিডেন্সী থেকেই শুরু হয়েছিল, তাই এখানেই শেষ হয়ে যাক সবকিছু।”
        “প্রিয়াঙ্কা ডেকেছিল মানে?” প্রিয়াঙ্কা রাতুলের স্ত্রী। বহরমপুরের মেয়ে। ওরা অবাঙালি। প্রেসিডেন্সীতে রাতুলের সহপাঠিনী ছিল। সেখান থেকেই প্রেম। পরের বছর রাতুল ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে ব্যাঙ্গালোর চলে গেলেও ওদের সম্পর্কটা টিকেই যায়ঠিক যেমন আমাদের বন্ধুত্ব। রাতুল, সাদিক, রাফিয়া, দ্বৈপায়ন, শ্রেয়সী আর আমি অনি। সেই পাঁচ বছর বয়স থেকে আমরা একে অপরের ঘনিষ্টতম বন্ধু। সময় ও আমাদের মধ্যে ঢুকতে সাহস পায়নি।
        প্রিয়াঙ্কা কলেজে পড়ায়। ওর কলেজ বহরমপুর থেকে বেশ খানিকটা দূরে। তাই ও অরোকে নিয়ে নিজের বাবা-মার কাছে থাকে। লম্বা ছুটি পড়লে ওরা কলকাতায় আসে। না হলে রাতুল যায়। কর্পোরেট চাকরি মানেই চাকরগিরি তাই প্রতি সপ্তাহান্তে না পারলেও সুযোগ পেলেই কেটে পড়ে। প্রিয়াঙ্কার ওকে ডেকে পাঠানো ব্যাপারটা আমার বোধগম্য হল না। প্রিয়াঙ্কা কলকাতায় এলে তো রাতুলদের সল্টলেকের বাড়িতেই উঠবে, তা হলে? রাতুল বলল, “ও সকালের ট্রেনে এসেছে, রাতের ট্রেনে ফিরে যাবে।” বুঝলাম জল অনেক দূর গড়িয়েছে। রাতুল কি রকম ভেবলে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, “সাদিককে ফোনে পাচ্ছি না। আমি এখন কি করব?”
        সাদিক কোথায়? সেই ভূ-মধ্যসাগরে। জাহাজে চাকরি করে সাদিক। বছরে ন মাসই বাইরে। ফেসবুক আর হোয়াটস্ এ্যাপের কল্যাণে অবশ্য সাদিক সর্বদাই আমাদের সাথী। চিরকাল রাতুলের রক্ষাকর্তা সাদিক। আমাদের মধ্যে সবথেকে রগচটা, সবথেকে ডাকাবুকো। রাফিয়ার মত শান্ত বুদ্ধিমতী মেয়ে যে কি করে সাদিকের প্রেমে পড়েছিল কে জানে? যাই হোক বিয়ে করে সুখেই আছে দুটোতে।
        মাথা কাজ করছিল না। বললাম, “রাতুল ওখানেই থাক। আমি আসছি।” সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে সাদিক বাদে একে একে সবাইকে ফোন করলাম। কেউ কিছু বুঝতে পারছি না। দ্বৈপ্য অর্থাৎ দ্বৈপায়ন আর রাফিয়া বলল এক্ষুনি আসছে। শ্রেয়ার মিটিং চলছে, ৪টের আগে পৌছতে পারবে না। রাতুলকে নিয়ে আমরা সবাই কফি হাউসে গিয়ে বসেছিসেই কফি হাউস রাতুল-প্রিয়াঙ্কা, সাদিক-রাফিয়া, সৌর-আমি না জানি কত সফল প্রেমের সাক্ষী। রাতুলকে দেখে মায়া লাগছিল, উদ্ভ্রান্তের মত তাকাচ্ছে, অপ্রকৃ্তিস্থের মত কথা বলছে। যা বুঝলাম, প্রিয়াঙ্কা আজ সকালে ওকে ডেকে বলেছে, “সব শেষ। তোমার সাথে আমার পোষাচ্ছে না।” “পোষাচ্ছে না মানে?” রাফিয়া আর আমি সমস্বরে চিৎকার করে উঠলাম। শ্রেয়া কঠোর স্বরে বলল, “রাতুল! সত্যি কথা বল। কি বাঁধিয়েছিস?” রাতুলের সুন্দরী নারী দেখলেই ছোঁকছোঁক করার অভ্যেস সুবিদিত।প্রিয়াঙ্কারও তা অজানা নয়। তবে এ নিয়ে কখন ও কোন বিরোধ বা দাম্পত্য কলহের কথা শুনিনি। রাতুল কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল, “বিশ্বাস কর, আমি কিছু জানি না।”
        সাদিক অনলাইন হয়েই হোয়াটস্ এ্যাপ কাঁপাতে লাগল। রাতুলকে বলল, এখুনি বহরমপুর গিয়ে হত্যে দিয়ে পড়ে থাকতে। প্রয়োজন হলে প্রিয়াঙ্কার পায়ে ধরে মানাতে। প্রিয়াঙ্কার বাবার সাথে বহরমপুরের এক দোর্দণ্ডপ্রতাপ ব্যাক্তির দহরমমহরম আছে। প্রণয় পর্বে উনি এক বার রাতুলকে হুমকি দিয়েছিলেন, যে বহরমপুরে পা দিলেই গায়েব করে দেবেন। সেই ভয়ে কি না জানি না, রাতুল না না অজুহাত দেখাতে লাগল। বিরক্ত হয়ে শেষে দ্বৈপ্য বলল, “ আমি যাব। তোকে একা যেতে হবে নাকাল সকালেই চল।
পরের দিন, বিকাল বেলায়, দ্বৈপ্যর ফোন। কনফারেন্সে রাফিয়া, শ্রেয়া আর আমি তিন জনেই কানেক্ট হলাম। রাতুল, হাপুস নয়নে কেঁদে যাচ্ছে। দ্বৈপ্যর মত শান্ত ছেলে, যার মুখে কোনদিন অসংস্কৃত শব্দ শুনিনি,অসম্ভব উত্তেজিত হয়ে ষাঁড়ের মত চিৎকার করছে আর অনর্গল খিস্তি খেউর করে চলেছে। প্রিয়াঙ্কার বাবা নাকি দরজা খুলে রাতুলকে দেখেই গালমন্দ শুরু করেন। ছোট্ট অরো পাপা- পাপা বলে ছুটে আসছিল, প্রিয়াঙ্কার মা তাকে নড়া ধরে হিড়হিড় করে টেনে হিঁচড়ে ভিতরে নিয়ে যান। অরোর প্রবল কান্না, রাতুল- দ্বৈপ্যর অনুনয়- বিনয় কিছুতেই ওদের মন গলেনি। প্রিয়াঙ্কা ঘর থেকেই বের হয়নি। এমনকি রাতুল স্ত্রী পুত্রের জন্য যে উপহার নিয়ে গিয়েছিল, তাও ওনারা গ্রহণ করেননি। দ্বৈপ্য করজোড়ে অনুরোধ করে যাতে মাত্র পাঁচ মিনিটের জন্য রাতুলকে প্রিয়াঙ্কা আর অরোর সাথে দেখা করতে দেওয়া হয়, জবাবে মুখের ওপর দরজা বন্ধ করে দেন ভদ্রলোক।
        রাতুল হাউহাউ করে কাঁদছিল। পরিণত বয়স্ক কোন পুরুষকে কোনদিন কাঁদতে শুনিনি। হৃদয়বিদারক সে অনুভূতি ভাষায় অপ্রকাশ্য। “কি নরম ও। গায়ে কি সুন্দর গন্ধ জানিস? কি ছোট্ট লাল জিভ, ঠোঁট দুটো কি নালঝোল মাখা ভেজা ভেজা, জানিস? চুমু খেতে গেলেই চেটে দেয়। দু হাত দিয়ে গলা জড়িয়ে ধরে তোতা পাখির মত ডাকত, ‘পাআআপাআআ’। একবার ছুঁতে দিল না জানিস?” রাফিয়া আর আমিও কাঁদতে লাগলাম।
এ নিয়ে কোন সন্দেহের অবকাশ নেই যে একটা শিশুর মাকে যতটা প্রয়োজন, বাবাকে ঠিক ততটা নয়, কিন্তু বাবা তো বাবাই, বাবার স্থান পূরণ করা অস্মভব। সৌর আর তুলতুলির টান কি আমি অনুভব করতে পারি না।
পরিস্থিতি আরও জটিল হল, যখন আদরের খোকার আসন্ন বিবাহ-বিচ্ছেদ রোধ করার জন্য, রাতুলের বৃদ্ধ বাবা-মা কাউকে কিচ্ছু  না জানিয়ে গিয়ে হাজির হলেন প্রিয়াঙ্কাদের বাড়ি। কি হয়েছিল, সঠিক জানি না তবে প্রিয়াঙ্কাদের বাড়ি থেকে বুড়ো-বুড়ি কাঁদতে কাঁদতে বেরিয়ে আসেন এবং বৃদ্ধ উপবীত তুলে শাপ-শাপান্ত করতে থাকেন। বৃদ্ধা জ্ঞান হারান। হয়তো ধকল আর মানসিক টানাপড়েন এর জের, তবে প্রিয়াঙ্কা রাতুলকে ফোন করে যাতা বলে। ওদের প্রতিবেশীদের চোখে হেয় প্রতিপন্ন করার জন্যই নাকি এই নাটক রচনা করা হয়েছে।  অবাঙালী পুত্রবধূকে যে ওনারা মুক্ত মনে গ্রহণ করেননি এটাও সত্যি।
        যাইহোক সাদিকের চিৎকার আরও বেড়ে গেল। লাশ ফেলে দেবে। ওর সাথে নাকি কোন গুণ্ডার জিগরী দোস্তি। রাতুল ও নাচছে, তবে লাশ ফেলতে হবে না। শুধু হারামি শ্বশুরটাকে আচ্ছা করে কেলাতে হবে। প্রমাদ গুনলাম। এই পরিকল্পনার অংশীদার জানতে পারলে আমার বিবাহ-বিচ্ছেদ আসন্ন। রাফিয়া ফুঁৎকারে উড়িয়ে দিল, “ধুর! ধুর! সাদিকের দৌড় কতদূর জানিস না? ঐ পচা খাল অবধি। কম লোককে জবাই করে খালের জলে ভাসিয়েছে ভুলে গেলি?” সত্যি সাদিক পায়ে পা দিয়ে লোকের সাথে ঝগড়া করত এবং ঐ হুমকিই দিত বটে।
সাদিক একাই দাপাদাপি করতে লাগল। রাতুল বেপাত্তা। ফোন পরিসীমার বাইরে, অফিস যায় না। বাড়িতে ফোন করাতে কাকিমা এমন কান্নাকাটি জুড়ে ছিলেন, যে ভয়ে আমরা আর সাহস পাই না।  শ্রেয়া একদিন সাহস করে, প্রিয়াঙ্কাকে ফোন করেছিলতিন বার প্রিয়াঙ্কা ধরেনি, চতুর্থ বারে ফোন তোলে এবং অভিযোগের ঝুড়ি উপুর করে দেয়- রাতুল একটা অপদার্থ (এ ব্যাপারে অবশ্য আমরা একমত), মাতৃ- স্তন্যপানকারী বালক (ঠিক), প্রিয়াঙ্কা আর অরোকে সময় দেয় না ( হতে পারে, কাজের চাপ, তায় রাতুলটা বিশ্বকুঁড়ে) প্রিয়াঙ্কা আর অরোর কোন দায়িত্ব নেয় না ইত্যাদি ইত্যাদি। এত সব স্বামী- স্ত্রীর ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। ডিভোর্স কি এই সব কারণে হয়?  যাইহোক শ্রেয়ার ওর সাথে কথা বলে দৃঢ় ধারনা হয়েছে, যে রাতুলটা বিছানায় একেবারেই ঢ্যাঁড়শ। যৌন অতৃপ্তিজনিত ক্ষোভ জমতে জমতেই আজ এই বিস্ফোরন। শ্রেয়া অবশ্য পৃথিবীর সব সমস্যার মূলেই এই এক্তি জাগতিক কারণ দেখতে পায়। হতেই পারে, তবে সহমত হতে পারলাম না। রাফিয়া বলল, “কি বোকা মেয়ে রে? স্বচ্ছন্দে রাতুলের অগোচরে চুটিয়ে প্রেম করতে পারত। রাতুল যা গামবাট, জানতেও পারত না। আর পারলেই বা কি? কিছু বলত না। এরকম হামেশাই হয়। বিবাহ বহির্ভূত প্রেম। এই কারণে বিবাহ বিচ্ছেদ?” সত্যি কথা বলতে কি, প্রিয়াঙ্কার ওপর আমাদের কোন অসূয়া নেই। শুধু রাতুলটাকে আত্মপক্ষ সমর্থনের একটা সুযোগ দিল না, এই যা আফসোস। বেচারা জানেই না কোন অপরাধে ফাঁসি হচ্ছে।
        রাতুল ফিরে এল। কামাক্ষ্যা গিয়েছিল। রাতুল আর পুজো? কবে পুষ্পাঞ্জলি দিতে শিখল?  বিদ্রুপ গায়ে না মেখে রাতুল ঘোষণা করল, ও খুব শীঘ্রি তিরুপতি যাচ্ছে। সাদিকের রক্তচাপ বেড়ে গেল, আর ওর গালি-গালাজের ঠেলায় আমাদের। রাতুল নির্বিকার। ওর কোন সহকর্মী নাকি তারাপীঠের এক মহাতান্ত্রিককে চেনে, তাঁর বশীকরণ মোক্ষম। এক মন্ত্রে প্রিয়াঙ্কা অরোকে নিয়ে সুড়সুড় করে ফিরে আসবে রাতুলের কাছে, পূর্বস্মৃতিও লোপ পাবে। অমাবস্যার দিন রাতুল চলল তারাপীঠ মহাশ্মশান। আমাদের অনুনয়-বিনয়, সাদিকের খিস্তি, দ্বৈপ্য- শ্রেয়ার যুক্তি কিছু কাজে এল না। বাবাজী নাকি কথা বলেন না। ওনার চ্যালা মহারাজ গুরুর নির্দেশ ব্যাখ্যা করে যা বললেন, তা হল,  মেয়েটা ভাল। কিন্তু বাপটা রাম ঢ্যামনা। কানে ফুস মন্তর দিয়েছে। পরিস্থিতি খুব জটিল। যজ্ঞ করা আশু প্রয়োজন, না হলে বিবাহ-বিচ্ছেদ তো হবেই এমনকি রাজদ্বার দর্শন ও হতে পারে। খরচ মাত্র দেড় লক্ষ টাকা। রাতুল পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়।
        মাস দুয়েক নির্বিঘ্নে কাটে। আমাদের সবার অনুরোধে রাতুল সাহস সঞ্চয় করে আর এক বার প্রিয়াঙ্কার সাথে দেখা করতে যায় বহরমপুর, সাথে প্রচুর উপহার, স্ত্রী, পুত্র এমন কি শ্বশুর- শাশুড়ি, শালীর জন্যও। দুরুদুরু বুকে অপেক্ষা করতে থাকি আমরা। রাতে রাতুলের কোন ফোন আসল না। ভাবলাম নির্ঘাত সব ঠিক হয়ে গেছে। মান-অভিমানে ব্যস্ত তাই খবর দেবার হুঁশ নেই বাবুর।
        পরদিন সকাল নটা নাগাদ রাতুলের ফোন, জয়গুরু বলে ফোন ধরলাম। ফোন ধরতেই রাতুলের অসহায় কণ্ঠস্বর, “চলে গেল যে? কে করি?” “অ্যাঁ? মানে? কে চলে গেল? কোথায় তুই?” রাতুল ঢোঁক গিলে বলল, “প্রিয়াঙ্কা রে। আমার সামনে দিয়ে একটা লোকের সাথে কথা বলতে বলতে চলে গেল। তার বাইকে চেপে।” রাতুল অসংলগ্ন ভাবে যা বলল, তার সারমর্ম হচ্ছে, রাতে রাতুল আর যায়নি। একটা হোটেলে রাত কাটিয়ে সকাল বেলায় প্রিয়াঙ্কাদের গলির মোড়ে থলে ভর্তি উপহার নিয়ে হাজির হয়, প্রিয়াঙ্কাকে রাস্তায় ধরবে বলে, যাতে  শ্বশুর মশাই ঝামেলা বাঁধাতে না পারে, কিন্তু সব থেকে বড় উপহারটা প্রিয়াঙ্কাই ওকে দিয়ে যায় আজ।
        বিশ্বাস হয়নি। বন্ধু হতে পারে, সহকর্মী হতে পারে, আত্মীয় বা প্রতিবেশী হলেও আশ্চর্য হব না। হয়ত ঐ দিকেই যাচ্ছিল। হতেও তো পারে। রাতুল ফিরে আসে। সাদিক খোঁজ নিয়ে জানায়, আমার সন্দেহ অমূলক। ওরা পরস্পর প্রেমাষ্পদ এবং সম্ভবত বাগদত্ত। প্রিয়াঙ্কার এই বিয়েটা ভাঙলেই ওরা বিয়ে করতে চলেছে।
        অনেক গুলো মাস কেটে গেল। মা দুর্গা এসে চলেও গেলেন। রাতুলের ব্যাপারটা নিয়ে আমরা আর কথা বলি না। সবাই ভয়াবহ ব্যস্ত যে যার জীবনে। আমাদের বন্ধনও অটুট। সাদিক দেশে ফিরে ভালো আইনজ্ঞের সন্ধানে ব্যাপ্ত। রাতুল রাফিয়াকে আর আমাকে মাঝেমাঝেই ফোন করে জিজ্ঞেস করে, আমাদের ছানাগুলো কি করছে। অরোর বয়সে ওরা কি কি করত। খারাপ লাগে। কিন্তু বাস্তব বড়ই নির্মম।
        আজ বহুদিন বাদে রাতুল আমার অফিসে এল।আমাদের শ্রম কমিশনারেটের ভাঙা বাড়ি, খারাপ লিফট, অপরিচ্ছন্ন করিডোর, পচা চেম্বার, ঠাণ্ডা না করতে পারা বাতানুকূল সব নিয়ে আগের মত তামাশা করতে লাগল। আরও জ্বালাত, যদি না সাদিক ফোন করে ডেকে নিত। প্রিয়াঙ্কা নোটিশ দিয়েছে, তাই নিয়েই আইনজ্ঞের সাথে পরামর্শ করবে। দুজনের সম্মতিতেই ডিভোর্স হচ্ছে। রাতুল প্রিয়াঙ্কার আনা কোন অভিযোগ খন্ডন করার চেষ্টাও করেনি। উকিল বাবুর ইচ্ছে ছিল লম্বা টানার, রাতুল শান্তি চায়। শুধু অরোকে নিয়ে হাল্কা বাগবিতণ্ডা হতে পারে।
        খুব স্বাভাবিক স্বরে কথা বলছিল রাতুল, হাসছিল হা হা করে। কতদিন বাদে। আমার তো খুশি হবার কথা। তাও এত বিষণ্ণ লাগছে কেন? এত দিনের সম্পর্ক, বন্ধুত্ব হয়তো বা ভালবাসা ও ভেঙে যাচ্ছে তাই কি? “চলি রে” বলে ও উঠে পড়ল। রাতুলকে সিঁড়ি অবধি এগিয়ে দিয়ে এলাম। রাতুল নেমে যাচ্ছে, আমার কানে বেজেই চলেছে, ““কি নরম ও জানিস......। গায়ে কি সুন্দর গন্ধ জানিস......? কি ছোট্ট লাল জিভ, ভেজা ঠোঁট, চুমু খেতে গেলেই চেটে দেয় জানিস......। দু হাত দিয়ে গলা জড়িয়ে ধরে তোতা পাখির মত ডাকে………”

Thursday 9 April 2015

ভাল থেকো চয়ন



মন ভাল নেই। কিচ্ছু ভাল লাগছে না চয়নের। অফিসের সিঁড়ির ল্যান্ডিং এ দাঁড়িয়ে এক টা সিগারেট ধরালো। বুক ভরে পড়ন্ত বিকালের ঠাণ্ডা হাওয়া টানলো, তাও যেন চাপটা কাটছে না।
সিঁড়ির দেওয়ালের না না দেব-দেবীর ছবি, যাতে এই ঝকঝকে দেওয়াল কেউ থুথু ফেলে নোংরা না করে। ঐ হাসি মুখের অভয় দেওয়া ছবি গুলোর দিকে তাকিয়ে রাগ আরও বেড়ে গেল। কেন? এত লোক থাকতে কেন চয়নের সাথেই এত অন্যায় করলেন ভগবান। দম বন্ধ হয়ে আসছে, মাথা ছিড়ে যাচ্ছে যন্ত্রণায়।
চয়নিকা মধ্য তিরিশ, অবিবাহিত, মাঝারি উচ্চতা, ছোটো করে কাটা চুল, পরনে ডেনিম আর কুর্তা, সেক্টর ফাইভের এক নামি বেসরকারি সংস্থায় মোটামুটি ভাল পদে কর্মরতা। মাইনে পত্র খারাপ পায় না। আপন বলতে দুই বোন আর এক কাকা। দুই বোনেরই বিয়ে হয়ে গেছে। কাকা এক চূড়ান্ত বাউন্ডুলে লোক। তবু এই কাকাই চয়নের একমাত্র অবলম্বন।
দুই বোনেরই শ্বশুর বাড়ির লোকজন অত্যুৎসাহী চয়নের বিয়ের ব্যাপারে, কৌতুহল পাড়াপড়শির ও কিছু কম না। সবার ওপর অফিস কলিগেরা তো আছেই। সবার প্রশ্ন একটাই চয়ন কেন বিয়ে করছে না? আর কবে করবে? চয়ন সব সময় কাকাকেই শিখণ্ডী খাড়া করে, দুঃখ দুঃখ মুখ করে বলে, “ আমি তো বিয়ে করে চলে যাব, কাকাকে দেখবে কে?”।
খুড়ো মশাই অতি ধুরন্ধর। অন্য লোক হলে, নির্ঘাত বলত, “আমার জন্য কেন নিজের জীবন বরবাদ করছিস? আমার ঠিক চলে যাবে।” কিন্তু কাকা কিছুই বলে না। শুধু মিটিমিটি হাসে। চয়ন প্রচুর খোঁটা দেয়, মাঝে মাঝে মুখঝামটাও মারে। কিন্তু কাকা যেন সর্বংসহ। কাকার উপস্থিতি আর ভালবাসাই চয়নের বেঁচে থাকার রসদ।
কষ্ট হয় চয়নের, ভীষণ কষ্ট হয়। ভয় করে। ভুলে থাকার চেষ্টা করে। ভুলেও যায়। মেতে ওঠে জীবনের রঙে। সাধ্যাতীত পরিশ্রম করে। দশ জনের কাজ একা করার চেষ্টা করে, ক্লান্তির শেষ সীমানায় টেনে নিয়ে যেতে চায় নিজেকে। যাতে করে, রাত্রে বিছানায় গা দিলেই অতল ঘুমে তলিয়ে যেতে পারে। রাতকে চয়নের বড় ভয়। কিন্তু চয়নের দেহ এক্ষেত্রেও বিশ্বাসঘাতকতা করে।
দেহ-মনের এই দ্বৈরথে আজ বড় ক্লান্ত, নিঃস্ব, রিক্ত চয়ন। যখন শিশু ছিল, অবোধ ছিল তখনই ভাল ছিল। জীবনের এক মাত্র সুখের সময়। নারীত্বের লক্ষন যেমন যেমন প্রকাশ পেতে লাগলো, আতঙ্কে ভুগতে লাগলো চয়ন।স্কুলে ওর প্রিয় বান্ধবী ছিল তিস্তা। কতদিন ওরা হাত ধরাধরি করে ঘুরেছে। মেয়েদের স্কুলে বাচ্ছারা তাই করে। আদপে দৃষ্টিকটু না। কিন্তু আঙ্গুলে আঙ্গুলে যে এত কথা হতে পারে, প্রতিটা স্পর্শ যে এত বাঙময় হয় আগে তো বুঝত না চয়ন। তিস্তার আলিঙ্গন এত মোহময় আগে কখনও লাগেনি। কথায় কথায় তিস্তার ওকে জড়িয়ে ধরা, সে শিহরণ আজো চাইলেই অনুভব করতে পারে চয়ন। তিস্তার সাথে ওর শারীরিক নৈকট্য বোধহয় শালীনতার সীমা স্পর্শ করব করব করছিল, মৃদু গুঞ্জন কানে আসতেই চয়ন নিজেকে সরিয়ে নেয়। সবথেকে বেদনাদায়ক ছিল তিস্তার আচরণ,ও কোনদিনই কিছু বোঝেনি। চয়ন শুধুমাত্র ওর প্রিয় বান্ধবী ছিল। আজো যেমন আছে।
তিস্তার পর দোলা। দোলনচাঁপা। কথায় কথায় বলত, “চয়ন, তোকে আমি বড্ড ভালবাসি রে।” চয়ন, ঘরপোড়া গরু, বলতো, “ভাগ শালা।” কিন্তু দোলার সেই স্ফুরিত অধর, ব্যথা-বিদুর চোখ, তাড়িত করতো বিশ্বাস করতে। আজকাল তো লোকে ধন্যবাদ না বলেও “আই লাভ ইউ” বলে। কি করে বিশ্বাস করতো চয়ন? চয়নও  অবশ্য কোনদিন বলে উঠতে পারেনি। ক্ষুব্ধ দোলা বলতো, “দেখিস, যে দিন আমি থাকব না, সেদিন তুই বুঝবি।”
আজ দোলা কোথায়? দিব্যি মায়ের চাপে বিয়ের পিঁড়িতে উঠেছে। কি যেন বলছিল বিয়ের আগে, “ মন থেকে সাড়া পাচ্ছি না। বিয়ে না করলে দাদার বিয়ে হচ্ছে না।” ইত্যাদি ইত্যাদি। ও রকম সবাই বলে। দোলার বিয়েতে কি খাটাই না খেটেছে চয়ন, দোলা এক বার তাকায়নি পর্যন্ত। ঘাড় শক্ত করে মুখ ঘুরিয়ে বসে ছিল। অন্য বন্ধুদের সাথে দিব্যি মিষ্টি হেঁসে কথা বলেছে, চয়ন ওর হাত ধরে অভিনন্দন জানাতে গিয়েছিল, ঝটকা মেরে সরিয়ে দিয়েছে। কিসের এত ক্ষোভ ওর? বিয়ের পর দোলার একটা ফোন ধরেছে? আছে অথচ নেই। ফেসবুক থেকে জানতে পারে ওরা কোথায় বেড়াতে গেছে, চয়ন অনাহুতের মত কমেন্ট, ইনবক্স মেসেজ করে, দোলা নিরুত্তর। প্রতি পদে অত্যন্ত তাচ্ছিল্যের সাথে বুঝিয়ে দেয় দোলা ওর পরোয়া করে না। ঞ্জানতঃ চয়ন কারো মনে কোনদিন কষ্ট দেয়নি, অথচ দোলা যেন ওর হৃদপিণ্ডটাই ফুটো করে দিয়েছে। কাঁদতে পারে না, এটাই ওর সবথেকে বড় দুর্বলতা।
ফেসবুকে লোকে সমকামীদের নিয়ে কত কিছু লেখে, প্রচণ্ড রাগ হয় চয়নের, “ শালারা আয়, আমার জুতোয় পা গলিয়ে দেখ। যত ভণ্ডের দল। কটা গল্প, উপন্যাস লেখা হয় চয়নদের নিয়ে? একটা সিনেমা ওঠে? আর যা তোলা হয়, টা দেখে ওর হাসি পায়। ওর এক সুন্দরী সহকর্মী তার পুরুষ বন্ধুর দেওয়ালে একবার লিখেছিল, “উফ! ভাল ছেলে পাওয়া এত কষ্টকর জানলে আমি লেসবিয়ান হতাম।” সাঁটিয়ে একটা চড় কসাতে ইচ্ছে করছিল চয়নের। আজ যেমন অফিসে দীপক আর রণিত, দুই মেয়েবাজ গল্প করছিল, “ও সব সমকাম-টাম কিস্যু না। ছেলে গুলোকে চাবকানো উচিত, আর মেয়েদের জন্য তো আমরা আছিই।” আজ আর সহ্য করতে পারলো না চয়ন, বাথরুমের নিভৃতে উগরে দিল নিজের সমস্ত ক্ষোভ। বহুদিন বাদে কাঁদল চয়ন, ঝরঝর করে ঝরে পড়তে লাগলো সব ব্যথা – বেদনা, নিস্ফল আক্রোশ, অক্ষম রাগ। তীব্র ধিৎকারে ভরে ওঠে ওর মন, প্রতিবাদ না করতে পারার অক্ষমতার গ্লানিতে নিজেকে কৃমিকীটের অধম বলে মনে হয়।  
ইএম বাইপাসের এক নামি বেসরকারি হাসপাতালের ওপিডিতে মাথা নীচু করে বসে আছে চয়নিকা। অনেক দ্বিধা-দ্বন্দ্ব কাটিয়ে আজ এখানে এসেছে ও। শেষ চেষ্টা, জীবনের স্বাভাবিক ছন্দে ফেরার। ওর ডাক আসতে দরজা ঠেলে ঠাণ্ডা ঘরে ঢুকল চয়ন, ডাঃ ইশারায় ওকে বসতে বললেন। ডাঃ সুতপা সেন, মনোবীদ, প্রায় পঞ্চাশ, উজ্জ্বল শ্যাম বর্ণ, দোহারা চেহারা, হেনা করা লালচে চুল, রিমলেস চশমার আড়ালে এক জোড়া সহমর্মী চোখ, কালো দামি সুতির শাড়িতে সোনার ব্রোচ আটকানো দেখে মায়ের কথা মনে পড়ে গেল চয়নের। ডাক্তার উৎসুক চোখে ওর দিকে তাকিয়ে আছেন, হঠাৎ ওর মনে হল, এখানে আসাটা খুব ভুল হয়ে গেছে। কি চায় ও? কেন এল? কি বলবে ডাক্তারকে? অস্ফুটে নিজেকে অশ্রাব্য গালি দিতে লাগল চয়ন। মাথা নীচু করে ফোনটা নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করতে লাগল, এক, দুই, তিন মিনিট কাটছে না ঘণ্টা? ডাঃ ও কিছু বলছে না কেন? নাঃ আর বসা যায় না। “দুঃখিত, আপনার মূল্যবান সময় নষ্ট করার জন্য। চলি” উঠে দাঁড়িয়ে বলল চয়ন। ডাঃ এর ভ্রূ দ্বয় সামান্য কোঁচকাল, খর হল চোখের দৃষ্টি। পরিষ্কার বাংলা এবং ইংরাজি উচ্চারনে কেটে কেটে বললেন, “ মাঝে মাঝে দু এক জন অপোগণ্ড আসে তাদের কিশোর পুত্রকন্যা কে নিয়ে, আমি তাদের ঘাড় ধরে বার করে দি। আমি ডাক্তার চয়নিকা, ভগবান নই।”
অনেক কথা হল, তর্ক- বিতর্ক, খেলা, বিনোদন, রাজনীতি নিয়ে খোলাখুলি আলোচনা, হল না শুধু চয়নকে নিয়ে কোনো কথা। বহুদিন বাদে হাল্কা লাগছিল, আরও বসতে ইচ্ছে করছিল, ডাঃ সেন ও উঠতে বলছিলেন না। তবু উঠল ও। আরও পেশেন্ট অপেক্ষা করছে।  আসার সময় সুতপাদি বললেন, “ভালো থেকো চয়ন।” মাথা নেড়ে বেরিয়ে এল, ও।
হাল্কা লাগছিল। লিফটের লাইনে না দাঁড়িয়ে সিঁড়ি ধরল। পুরো দেওয়ালটাই স্বচ্ছ কাঁচের, বাইরে ঝকঝকে সোনা রোদ, নীল আকাশে পেঁজা তুলোর মত মেঘের নকশা সোচ্চারে ঘোষণা করছে মা আসছেন। মনটা আরও খুশিতে ভরে উঠল চয়নের। খুব ইচ্ছা করছিল একটা সিগারেট ধরাতে, নিদেন পক্ষে একটা বিড়ি হলেও চলবে, জোর করে নিজের অবুঝ মনকে শান্ত করে নীচে নেমে এল। দেরি হয়ে যাচ্ছে, অফিসে বলা আছে যদিও। একতলার ঝাঁ চকচকে ক্যাফেটেরিয়াটা দেখে আর লোভ সামলাতে পারলো না, চয়ন। “ধুত্তোর, নিকুচি করেছে” বলে এক কাপ কফি আর বানানা ওয়ালনাট ব্রেড নিয়ে আরাম করে জানলার ধারে বসল।
সত্যি শরৎ কালের যাদু আছে, আকাশপাতাল ভাবতে ভাবতে কফিতে চুমুক দিচ্ছিল চয়নিকা, হঠাৎ বুক পকেটে মুঠো ফোনটা সজোরে কাঁপতে লাগল। এক পলকে বাস্তবে ফিরিয়ে আনল ওকে, নির্ঘাত অফিস। মুখটা মুহূর্তের জন্য তেতো হয়ে গেল। ধরবেই না আজ ও, যত পারে কাঁপুক। কিন্তু কম্পনের কি রকমফের আছে? তা না হলে এ কম্পন কেন এভাবে চয়নের শিরা-উপশিরায় ছড়িয়ে পড়ছে? স্থির থাকতে দিচ্ছে না ওকে, হঠাৎ এক জুয়া খেললতে ইচ্ছে করল চয়নের, চোখ বুজে আন্দাজে ফোনটা বার করে, কানে দিয়ে, বিপক্ষকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই ও বলে উঠল, “ দোলা, আমি ভাল আছি রে।”
image courtesy Google