Tuesday 27 December 2022

অনির ডাইরি ২২শে ডিসেম্বর, ২০২২

 

#কাঁথিরকিস্যা 


‘কাল কখন ফিরলেন ম্যাডাম?’ জানতে চাইলেন নূপুর বাবু। সদ্য সদ্য কাঁথির মহকুমা শাসকের সরকারী নিবাসের সীমানা ছেড়ে বেরিয়েছি আমরা।  গন্তব্য দীঘা বাইপাস। 

দীঘা বাইপাস থেকেই বাস ধরব আমি। বেদজ্যোতি তাই বলেছে। বেদজ্যোতি আমার ইন্সপেক্টর,স্থানীয় ছেলে এবং তমলুক- কাঁথি রুটের নিত্যযাত্রী। আপাতত আমার পথপ্রদর্শকও বটে। হতোদ্যম হয়ে পড়লে ওকে দেখে অনুপ্রেরণা পাই।  ও যদি পারে, আমি পারব না কেন?


এতদসত্ত্বেও সকাল থেকে কেন যে গরম হয়ে থাকে মাথা। ভোর বেলাতেই ধমকে দিই মেয়েটাকে সম্পূর্ণ অকারণে। নীরবে, নতমস্তকে মায়ের কটু কথা শুনে, স্কুলের রাস্তা ধরে তুত্তুরী। পলকে শতছিন্ন হয়ে যায় তুত্তুরীর মায়ের হৃদয়। মা হওয়া কি মুখের কথা!


একরাশ মনখারাপ নিয়েই রওণা দিই আপিসের পথে। সঙ্গী বলতে নূপুর বাবু।  গাড়ি চালাতে চালাতে নানা প্রশ্ন করেন ভদ্রলোক। অনেক মজার মজার কথাও বলেন। যেমন আগের দিনের বাসটা আমায় সেন্ট্রাল বাসস্ট্যান্ড যাবে বলেও, শেষ পর্যন্ত খড়্গপুর বাইপাসে নামিয়ে দিয়েছে শুনে উনি বললেন,‘ফের যদি এমনি বলে ম্যাডাম, আপনাকে কিছু করতে হবে না, আপনি শুধু বাসের নম্বরটা টুকে নিবেন।’ নম্বর টুকে যে কি করব ভগবান জানে। হাসি চেপে জানলার বাইরে তাকাই আমি। নূপুর বাবু এবার পড়েন, টোটোওয়ালাকে নিয়ে। কেন টোটোওয়ালা আমায় মহকুমা শাসকের করণ অবধি পৌঁছে দেয়নি? ‘লাইসেন্স নিয়েছে আর প্যাসেঞ্জার নিবেনি? বললেই হল? ফের যদি কেউ এমন করে, তাহলে আপনি ম্যাডাম, তাকে আটকে রেখে আমায় ফোন করবেন। আমি ছুট্টে চলে যাব-’।  


ধেড়ে গাড়িটা নিয়ে উনি ছুটে আসবেন আমার হয়ে টোটোওয়ালার সাথে ঝটাপটি করতে,ব্যাপারটা কল্পনা করে হাসি চাপা দায়। মন খারাপ জানলা গলে পালায়।  দূর থেকে দৃশ্যমান হয় দীঘা বাইপাস। চৌমাথায়  হর্ন বাজাচ্ছে একটা বাস। বাসের সামনে গিয়ে দাবাং স্টাইলে গাড়ি দাঁড় করালেন ভদ্রলোক। ‘ম্যাডামকে তুলে লাও তো। নিমতৌড়ি ডিএম আপিসে নাবিয়ে দেবে।’ 


বাসে উঠে গেলাম,বেদজ্যোতির সাথেও দেখা হয়ে গেল। নূপুর বাবু তখনও নীচে দাঁড়িয়ে, ‘তাহলে ম্যাডাম, সব ঠিক আছে তো? আপনি যদি রোজ এক টাইমে বেরোন, তাহলে সেরকম হলে আপনার জন্য একটা সিট বেঁধে রাখতে বলব।’ হাত নেড়ে ইশারায় বলি, এবার যান। রোজ একসময়ে বেরোন আমার অসাধ্য। কোনদিন পাঁচ মিনিট লেট করে ফেলি তো কোনদিন দশ মিনিট আগে হয়ে যায়। লেট হলে বাস পালায়। আর জলদি এলে বাস লেট করে। এযেন এক অলাতচক্র। 


বেদজ্যোতি যদিও আশ্বস্ত করে, ‘বাস অনেক পাবেন ম্যাডাম। একটু দাঁড়িয়ে গেলেই স্টেট বাসও পেয়ে যেতে পারেন। দারুণ আসে বাস গুলো।’ নূপুর বাবু আবার কিছুতেই স্টেট বাসে চাপানোর পক্ষপাতী নন। ‘সব জানলা খোলা, প্রচণ্ড হাওয়া ঢোকে। স্টেট বাস শীতকালে ভালো না। আপনাকে আমি ভালো এসি বাসে তুলে দিব। দেখবেন ভিতরে কেমন ওম পাবেন। উঠে ঘুমিয়ে পড়বেন, ওরা ঠিক ডেকে দেবে। আমি বলে দিব খন।’ 


ঘুমানো অবশ্য অত সহজ নয়। প্রথমদিন যে এসি বাসটিতে উঠেছিলাম, তাতে রমরম করে কি যেম একটা সিনেমা চলছিল। কোন দক্ষিণী ছবির হিন্দি ভাষান্তর। কোনটা নায়ক আর কোনটা যে খলনায়ক বোঝা দায়। কথায় কথায় ধুন্ধুমার। আর না হলে দক্ষিণী নাচগান আর বিটকেল প্রেম। তেমনি সব সংলাপ, যেমন, ‘ভাই রে ভাই,রক্কি ভাই’ বা ‘তু ব্যাড হ্যায়, তো ম্যাঁয় তেরা ড্যাড হ্যায়। সমঝা না!’ বা ‘তু গ্যাংস্টার হ্যায়, তো ম্যায় মনস্টার হ্যায়।’ ইত্যাদি প্রভৃতি। পুরো সিনেমাটাই কেমন যেন ধুলোয় মাখা ধুসর রঙের। দেখব না, দেখব না করেও বেশ খানিকটা দেখেই ফেললাম। পাশ থেকে বেদজ্যোতি বলল, ‘ম্যাডাম এই বাসে রোজ এই সিনেমাটাই চলে।কালও দেখতে পাবেন। এখন ঘুমিয়ে পড়ুন।’ 


সত্যিই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, ভালো করে ওড়না মুড়ি দিয়ে। ঘন্টা দেড়েক পর যখন ঘুম ভাঙল, বাস কোলাঘাট ব্রীজ পেরোচ্ছে। কি সর্বনাশ! আমরা তো পূব মেদিনীপুরের সীমানা ছাড়িয়ে হাওড়া জেলায় ঢুকে পড়ব গো। কেউ ডাকেও নি। টিকিটও তো কাটেনি।  কি জ্বালা।  


এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখি বেদজ্যোতিও ঘুমাচ্ছে। ঠেলে তুললাম ব্যাটাকে। দেউলটিতে নামতে হবে। তারপর উত্তমকুমারকে ডেকে নেওয়া ছাড়া গতি নেই। ঘুম চোখে জানলার বাইরে খানিক তাকিয়ে থেকে জড়ানো গলায় বেদজ্যোতি বলল,‘ম্যাডাম, এটা তো নরঘাট ব্রীজ। নীচে রূপনারায়ণ নয়, হলদি নদী। এখনও নন্দকুমারই আসেনি। আর একটু ঘুমিয়ে নিন।’ 


বারোটা থেকে মিটিং ডেকেছিলাম। আপিসে ঢুকে দেখি, ১১টা থেকেই লোকজন এসে বসে আছে। কটা দিন ছুটি নিয়েছিলাম নতুন করে সংসার গোছানো আর তুত্তুরীকে নতুন স্কুলে থিতু করানোর জন্য, পালিয়ে তো যাই নি। যাবার আগে ম্যারাথন মিটিং করে প্রায় মিটিয়ে এনেছিলাম সমস্যা গুলো। গুটি কয়েক সিদ্ধান্তে যদিও উপনীত হয়নি কেউই। বলেছিলাম ধৈর্য ধরতে। বলেছিলাম উভয়পক্ষকে সামনাসামনি বসে আরেকদফা আলোচনা করতে। যদি মিটে যায় বা যদি নাও মেটে আমাকে যেন জানায়, তেমন হলে ছুটির মধ্যেই চলে যাব একদিন, শুধু ওদের জন্য। 


বাবুরা আমার কথা খানিক শুনেছেন খানিক শোনেননি। ধৈর্য ধরেননি মোটেই। ঝটপট দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় বসে পড়েছেন। বসেও যখন কোন সমাধান সূত্র বেরোয়নি, সৃষ্টি হয়েছে উত্তেজনা। ঘটেছে কিছু অপ্রীতিকর ঘটনাবলী। নির্মূল হতে বসা রোগ ছড়িয়ে পড়েছে প্রতিটি অঙ্গ থেকে তন্ত্রে। 


ঝাড়া সাড়ে পাঁচ ঘন্টার মিটিং করে আবার পূর্বের জায়গায় ফিরতে ফিরতে রীতিমত কালঘাম ছুটে গেছে আমার। টিফিন করারও অবকাশ হয়নি কারো। বেলা আড়াইটে নাগাদ বলেছিলাম,সবাই চাইলে খেয়ে আসতে পারেন। কেউ রাজি হয়নি নড়তে। খাওয়া বলতে বার তিনেক জহরবাবুর হাতে বানানো আদা দেওয়া কালো চা। কোথা থেকে যে আদা জোগাড় করে এনেছে লোকটা ভগবান জানে। 


 শেষে তিনটে নাগাদ শুভাশিষকে বলতে বাধ্য হলাম, একটু ভালো দুধ চা আর বিস্কুট আনতে পাঠাও। একে খালি পেট তারওপর আমার বকুনি, মরে যাবে যে লোকগুলো। পাঁচটা দশ নাগাদ সবপক্ষ একসাথে করজোড়ে বলল,‘ছেড়ে দিন ম্যাডাম। মাথা ভোঁ ভোঁ করছে।’ 


সবকটাকে তাড়িয়ে টিফিন বাক্স খুলতে যাচ্ছি, জনা ছয়েক নেতা ঢুকে এসে অনুরোধ করল,‘ম্যাডাম, আজকের মিটিং এ কি হল, সেটা শ্রমিকদের যদি আপনি একটু বলে দেন তো খুব ভালো হয়। ’ বলাশোনার পাঠ যখন শেষমেষ মিটল রীতিমত গা গুলোচ্ছে। খাবারটা পচে গেল নাকি কে জানে। উত্তমকুমার বলল,‘ থাক ম্যাডাম আপনাকে আজ আর বাসে গিয়ে কাম নেই। আমি ছেড়ে আসি বরং।’ বেদজ্যোতিকেও সঙ্গে নিলাম আমরা, ওর বাড়ির কাছেই যাচ্ছি যখন। সঙ্গে নিলাম হক বাবুকেও। নন্দকুমার মোড়ে নামিয়ে দেব বলে। ঐ রাস্তাতেই যখন গাড়িটা যাবে, মুড়ির টিনের মত যতজনকে চেপেচুপে  নিয়ে যাওয়া যায়, তুলে নিই আমি। 


গাড়িতে বসে সবে টিফিন কৌটো খুলে মুখে এক গরাস দিয়েছি, উত্তমকুমার জানাল, গাড়ি আজ আর নড়বে না। কি হয়েছে ভগবান জানে,স্টার্টই নিচ্ছে না ব্যাটা। হক বাবু আর বেদজ্যোতিতে মিলে বেশ খানিকটা ঠেলল গাড়িটাকে, বনেট খুলে খুটখাট করল সবাই মিলে। গাড়ি আর নড়েই না।রাত বাড়ছে। এখন বাসে ভিড়ও হবে প্রচণ্ড। আর একটু আগে বেরোলে ভালো হত। আর সময় নষ্ট করা উচিৎ নয়। টিফিন বাক্স বন্ধ করে উঠে পড়লাম আমরা। কালেক্টরেটের গেট দিয়ে বেরোচ্ছি, একটি ছেলে একগাল হেসে বলল, ‘ম্যাডাম আজ হেঁটে যাচ্ছেন?’ ঘাড় নেড়ে বললাম, হ্যাঁ রে বাবা। দেখ না,  আজই গাড়িটা বিগড়েছে। 


নিমতৌড়ি বাসস্ট্যান্ড এখান থেকে হাঁটা পথে বেশ খানিকটা। পাশের হাইরোডে গিয়ে দাঁড়ালাম তিনজনে। তেমন আলো নেই এখানে। কে জানে হাত দেখালে বাস আদৌ দাঁড়ায় কি না। হক বাবু আর বেদজ্যোতি যদিও আশ্বস্ত করল,‘ বাসের বাবা ও দাঁড়ায়।’ একখানা বাস বেরিয়ে গেল পাশ দিয়ে,  উঠতেই যাচ্ছিলাম, বেদজ্যোতি আটকাল। ‘কেমন ভিড় দেখছেন ম্যাডাম। গোটা রাস্তা দাঁড়িয়ে যেতে হবে। একটু দাঁড়ান, পরে আরো বাস পাবেন।’ ঘড়ি দেখে হিসেব করলাম, বাড়ি পৌঁছাব কটায়। খেতে পাব কখন। সকালের ভাত খাবার পর সাড়ে আটঘন্টা কাটতে চলল। 


ব্যাগের মধ্যে ঝনঝনিয়ে উঠল মোবাইল, কিঞ্চিৎ  বিরক্ত হয়ে ব্যাগ থেকে ফোনটা বার করে দেখলাম, উত্তমকুমার। বাস পেয়েছি কিনা জানতেই ফোন করছে নির্ঘাত। অনুমাণ অকাট্য, ঠিক তাই বলল উত্তমকুমার,‘বাসে উঠে গেছেন? ’ বললাম না। অতঃপর উত্তমকুমার বললেন,‘উঠবেননি। উঠবেননি ম্যাডাম। আমি আসছি।’ হু হু করে হর্ন বাজাতে বাজাতে ছুটে এল উত্তমকুমারের গাড়ি। উঠে যে যার সিটে বসে, টিফিন বাক্স খুললাম আমি, আর হক বাবু শুধোলেন, ‘তোর গাড়ি চলল কি করে রে উত্তম।’ মহানায়কের স্টাইলে আমাদের উত্তমকুমার বলল,‘আপনারা ঠেলতে পারেননি তাই চলেনি। আমি পাঁচটা ড্রাইভার ডাকলাম, সবাই মিলে হেঁইও করে ঠেলল, ব্যাস অমনি-। স্টার্ট নিতেই আমি ম্যাডামকে ফোন করলাম। ভয় পাচ্ছিলাম, যদি আপনারা বাসে উঠে পড়েন।’ হকবাবু বললেন,‘আবার যদি বন্ধ হয়ে যায়, কি করবি?’ ফোঁৎ করে নিশ্বাস ফেলল উত্তমকুমার, ‘ এই যে স্টার্ট লিয়েছে, আর স্টার্টের বাবাও বন্ধ হবেনি। দেখে নিবেন।’ খোলা জানলা দিয়ে ছুটে আসছে শেষ ডিসেম্বরের সন্ধ্যের হিমেল হাওয়া, সকালে বানানো আলুকপি বিনের তরকারি এক চামচ মুখে দিয়ে প্রবল স্বস্তির শ্বাস নিলাম আমি। চালাও পানসি কাঁথি নগরী। এই তো জীবন কালি দা।

Tuesday 20 December 2022

অনির ডাইরি ২০শে ডিসেম্বর, ২০২২

 


দাঁড়িয়েই আছি, মিনিট দশেক হয়ে গেল। আমি অবশ্য একা নেই, আসেপাশে দাঁড়িয়ে আছেন আরো অনেকেই। দূর পাল্লার একেকটা বাস আসছে, অমনি ছুটে যাচ্ছে লোকজন। কোনটা এগরা যাচ্ছে তো কোনটা পটাশপুর, কোনটা বা নন্দীগ্রাম।  আমাকে ধরতে হবে দীঘার বাস। পাশেই দাঁড়িয়ে আছে উত্তমকুমার, বললাম,  চলে যাও। তাও গেল না। আজ দিনের আলো থাকতে থাকতেই বেরিয়েছি, প্রথমবার বাসে ফিরব। সকাল বেলা পাখি পড়া করে বুঝিয়েছে উত্তমকুমার,“অনেক বাস পাবেন ম্যাডাম। দু চারটে ছেড়ে দিবেননি। সিট আছে কিনা দেখে উঠবেন। নিমতৌড়িতে সিট না পেলেও নন্দকুমার মোড়ে পেয়েই যাবেন। কন্টাক্টরকে একটু বলে রাখবেননি।”  


বেশি জল খেতেও নিষেধ করেছে উত্তমকুমার। জল যদিও আমি বেশ কমই খাই। “বুঝে শুনে জল খাবেন ম্যাডাম। অনেকটা রাস্তা। একবার আমার যা হয়েছিল নি-”। পূর্ব মেদিনীপুর সত্যিই কেমন যেন লম্বাটে জেলা। তমলুক এবং কাঁথি যদিও একই জেলার দুইটি শহর, তাও খাতায় কলমে আমার বাসা থেকে আপিসের দূরত্ব প্রায় সত্তর কিলোমিটার ছুঁইছুঁই। 


ঘটাং করে একটা বড় বাস এসে দাঁড়াল। দরজা খুলে ব্রুস লির মত লাফিয়ে নামলেন এক চশমা পরা ভদ্রলোক, অতঃপর হাঁকতে লাগলেন কাঁথি, কাঁথি করে। উত্তমকুমারকে পিছনে ফেলে, হন্তদন্ত হয়ে এগিয়ে গিয়ে কিঞ্চিৎ  ভীতু স্বরে জানতে চাইলাম, ‘সেন্ট্রাল বাসস্ট্যান্ড?’ লোকটা পাত্তাও দিল না, তাচ্ছিল্যপূর্ণ ভাবে বলল,‘উঠুন, উঠুন।’ উঠেই পড়লাম, কপাল ঠুকে। সিট থাকলে বাঁচি। 


বেশ উঁচু আর লম্বা দূর পাল্লার বাস। একদিকে তিনজন আর একদিকে দুজন বসার ব্যবস্থা। আমার আগে যারা উঠেছিলেন, তারা পিছন দিকে এগিয়ে গেলেন। দূরপাল্লার বাসের পিছনে বসাটা কতটা বুদ্ধিমানের কাজ হবে বুঝলাম না, তাই সামনে থেকে গুটি কয়েক সিট পরেই যে সিট পেলাম, তাতেই বসে পড়লাম। দুই শুঁটকে চেহারার ভদ্রলোক এতক্ষণে হাত পা ছড়িয়ে বসে গপ্প করছিলেন, ‘দাদা’ বলে আমি গিয়ে দাঁড়াতে, ধারের ভদ্রলোক ভিতরে ঢুকে গেলেন। 


বাস ছাড়ল, ছাড়ার সাথে সাথেই রুদ্ধশ্বাস দৌড়। অধিকাংশ জানলারই কাঁচ বন্ধ, ফলে ভিতরটা একটু গুমোট। জানলার বাইরে ক্রমশঃ কমে আসছে আলো। সূর্য ডুবেছে কিছুক্ষণ পূর্বেই। অন্যমনস্ক হয়ে পড়েছিলাম, চমকে উঠলাম কার যেন স্পর্শে। এক বিকলাঙ্গ ব্যক্তি উঠেছেন বাসে, সবার কাছে ভিক্ষা চাইছেন। বাস তো থামেনি এর মধ্যে, নির্ঘাত আগেই উঠে বসেছিলেন।  কয়েকবার মৃদু স্বরে দিদি/মা বলে ডেকেছেন বোধহয়, সাড়া না পেয়ে রড ধরে থাকা হাতটায় টোকা দিয়েছেন। বয়স কম না লোকটার, মসিকৃষ্ণ গাত্রবর্ণ। পিঠে মস্ত কুঁজ। এই শীতেও খালি গা, পরনে একটা ট্যানা। কারা কেন জিজ্ঞাসা করল,‘গরম জামা নেই?’ বিরক্ত হয়ে মাথা নেড়ে এগিয়ে যায় লোকটি। 


পাশের লোকটি হঠাৎ বলে ওঠে, ‘ গান্ধী বুড়ি’! বাইরে দিকে না তাকিয়েও বুঝতে পারি নন্দকুমার মোড় ঢুকছি। গোল চক্কর কেটে ডান দিকে বাঁকব আমরা। বাঁদিকে বাঁকলে তমলুক শহর আর সোজা চলে গেলে হলদিয়া। চৌমথার মোড়ে উন্নীত  নিশান কাঁধে দাঁড়িয়ে আছেন তমলুকের ঘরের মেয়ে। সঙ্গে তাঁর অনুগামী বৃন্দ। বাস গুলো এখানে বেশ কিছুক্ষণের জন্য দাঁড়ায়, আগেই বলে রেখেছে উত্তমকুমার। এর মধ্যে একবার ফোন করে খোঁজও নিয়ে নিয়েছে,‘ম্যাডাম সিট পেয়েছেন তো?’ ছোলা,বাদাম,মশলা মুড়ির ঝাঁকা নিয়ে হকাররা ওঠে। অনেকে নেমে গিয়ে চা খেয়ে আসেন, টুকটাক কেনাকাটা করে আনেন পথে খাবার জন্য। 


বেশি ক্ষণ দাঁড়াল না অবশ্যি বাসটা। চাকা গড়াল কাঁথি শহরের দিকে। টিকিট কাটতে এগিয়ে এলেন কন্ডাক্টর দাদা। জানতে চাইলাম, ‘সেন্ট্রাল বাসস্টান্ড কত?’ জবাব এল,‘সেন্ট্রাল বাসস্টান্ড তো যাবেনি। আপনাকে বাইপাসে নামতে হবে।’ কোন বাইপাস রে ভাই? এখানে তো গণ্ডা গণ্ডা বাইপাস। জবাব দিল বটে লোকটি, একে তো কাঁথির লোকের কথা বুঝতে সামান্য একটু সমস্যা হয় আমার তার ওপরে বাসের তীব্র গর্জন। লোকটি আশ্বস্ত করল,‘বেশী দূর নয়। আপনি হেঁটে চলে যাবেন।’ এদিকের লোকের ‘বেশি দূর নয়’ এই সংলাপটিকেও বড় ভয় পাই আমি। কতটা দূর যে ঠিক বেশি দূর এদের কাছে, বুঝতে আজও অপারগ আমি। 


একটু আগেই মেসেজ করেছিলাম শৌভিককে, ‘বাসে উঠেছি। সিট পেয়েছি।’ জবাবে একগাল হাসির ইমোজি পাঠিয়েছিল আমার বর। আবার মেসেজ পাঠালাম, ‘ ওরে, এখন বলছে, এটা সেন্ট্রাল বাস স্ট্যান্ড যায় না। কি যেন বাইপাসে নামাবে আমাকে।’ এবার ওদিক থেকে একটা কান্নার ইমোজি এল। রাগে দুঃখে আমারই চোখে জল আসছে তখন। কোন বাইপাসে নামাবে রে বাবা। বাড়ি পৌঁছাব তো ঠিকঠাক- 


নরঘাট ব্রিজ পেরিয়ে যায় গাড়ি, নীচে হলদি নদীতে তখন মিশছে সন্ধের আঁধার। পেরিয়ে যায় বাজে চণ্ডীপুর-চণ্ডীপুর-বাজকুল-হেড়িয়া। দরজার সামনের জোড়া সিটে বসা লোকটি নেমে যেতেই লটবহর সহ তার আসনটি দখল করে বসি আমি। কাতর স্বরে কন্ডাকটরকে মনে করিয়ে দিই, ভাই প্লিজ বোলো। আমি কিন্তু কিছুই চিনি না। তিনি আবার হেল্পারকে বলেন, ‘বৌদিটাকে মনে করে খড়্গপুর বাইপাসে নামিয়ে দিস তো।’ যাক এতক্ষণে বাইপাসটার নামটা অন্তত বুঝলাম। 


বাস ছুটে চলে রুদ্ধশ্বাসে মারিশদা-দুর্মুঠ-নাচিন্দা। কাঁথি বাইপাস বলে চিৎকার করে ওঠে হেল্পার ভদ্রলোক। তড়িঘড়ি উঠতে যাই আমি, পাশের অল্পবয়স্ক সহযাত্রীটি বলে ওঠে,‘দিদি আপনি পরেরটায় নামবেন।’ কৃতজ্ঞ দৃষ্টিতে তাকিয়ে ভালো করে কান মাথা ঢেকে নিই। কি প্রচণ্ড হাওয়া ঢুকছে বাসে। ড্রাইভার আমি আর হেল্পার ছাড়া আর কেউ জেগে আছে বলেও মনে হচ্ছে না। প্রায় পৌনে দুই ঘন্টা হল বাসে উঠেছি। 


পরের চৌরাস্তায় যত্ন করেই নামিয়ে দেয় হেল্পারটি।  আঙুল দিয়ে দেখায় কোন রাস্তাটা ধরব আমি। ছুট্টে রাস্তা পেরিয়ে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ি আমি। রাত একটু ঘন হয়েছে। রাস্তাও বেশ ফাঁকা মহানগর বা শহরতলীর তুলনায়।কিছুই চিনি না। এবার কি করব? তাকে ফোন করব কি?পরক্ষণেই মত বদলাই, এভাবে নিজেকে তাচ্ছিল্য করা ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ। এই সামান্য কারণে তাকে বিব্রত করার মত অসহায়া অবলা অন্তত আমি নই। পাশের চায়ের দোকানের বৃদ্ধকে শুধাই, দাদা অমুক জায়গায় যাব। কি ভাবে যাব একটু বলুন না। 


গনগনে কয়লার উনুনে চায়ের কেটলি চাপাচ্ছিলেন ওণার বৃদ্ধা স্ত্রী, স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে বললেন,‘ঐ দেখো টোটো দাঁড়িয়ে আছে। ধরে চলে যাও।’ জানতে  চাই ভাড়া কত? হাবলা পেয়ে ঠকায় যদি। সে প্রশ্নেরও  জবাব দেন উনি। টোটোয় উঠি, গন্তব্য জানাই, টোটোওয়ালা জানায়, অত দূর যাবে না। কাছাকাছি একটা জায়গায় নামিয়ে দেবে। সেখান থেকে মহকুমা শাসকের করণ থুড়ি নিবাস খুব বেশি দূর না। 


রাতের কাঁথি শহরের বুক চিরে হাঁটতে থাকি আমি। দুদিকে আলোকমালায় সাজানো দোকানের সারি। কোথাও গরম পকোড়া ভাজছে তো কোথাও রসে টইটম্বুর জিলিপি। জামাকাপড়-গয়নাগাটি- বইপত্র-চশমার দোকানের সারির বুক চিরে অবশেষে যখন আপিস চত্বরে ঢুকছি, জনৈক টোটোওয়ালা জানতে চাইল, ‘যাবেন নাকি?’ কেমন রাগটা হয়! 


পরপর আপিসগুলোর অনেককটাই তখন অন্ধকারে ডুবেছে। শৌভিকের চেম্বারে যদিও আলো জ্বলছে। গাড়িও দাঁড়িয়ে আছে বাইরে। দেশোদ্ধার করছেন আমার বর বাবাজী। এর জন্য মহানগর ছেড়ে আসা একেবারে বেকার। একটুও ভালোবাসে না। দুটো সহানুভূতির কথা বলে না, কেবল ইমোজি পাঠায়।  আপদ 


বিড়বিড় করতে করতে খানিকটা এগিয়েই থমকে দাঁড়ালাম, আধো অন্ধকারে গা এলিয়ে বসে আছে দু-দুটো গাব্দা ষাঁড়। তাদের একজন সুপ্ত বটে অপরজন জুলজুল করে তাকিয়ে আছে আমারই দিকে। কোন মতে ইষ্টনাম জপতে জপতে তাদের পাশ কাটিয়ে বাংলোয় ঢুকলাম। ভেবেছিলাম সবাই আহাঃ আহাঃ করবে। উল্টে বাংলোর পাকশালা সামলায় যে ছেলেটি, সে বলল,‘মাত্র দুটো দেখতে পেলেন ম্যাডাম? ওখানে তো পনেরো বিশটা ষাঁড় থাকে। মাঝে মধ্যে কন্টাই বাজারে খেতে যায়। খেয়ে আবার পালিয়ে আসে।’ 


মা গো। আমি আর থাকব না এখানে। রোজ সন্ধ্যে বেলা এই ভাবে, ভোলে বাবা পার করে গা করতে আমি নাচার। আসুক আজ বুজুর বাবা। আগে ষাঁড় তাড়াবে তারপর অন্য কথা। ছেলেটি একগাল হেসে বলল,‘ ওরা কিচ্ছু বলে না ম্যাডাম। এই তো আমি বাজার করে ওর গায়ের পাশ দিয়ে নিয়ে এলুম, কিচ্ছু বলল না।’ দুধের কাপে চুমক দিয়ে নৈর্ব্যক্তিক ভাবে তুত্তুরী বলল, ‘বলবে না তো। সোজা উঠে গুঁতিয়ে দেবে।’ হে ভগবান সবাই আমার বিপক্ষে- আসুক আজ বুজুর বাপ।

অনির ডাইরি ১৮ই ডিসেম্বর, ২০২২

 

#কাঁথিরকিস্যা 


“একবার তো একটা মেয়ে সুইসাইডই করে ফেলল। রাত তখন আড়াইটা। সে কি ক্যাচাল ম্যাডাম।’ বক্তা  মহকুমা শাসকের বাহন চালক। 


মাস খানেক আগের কথা, তখনও শীত পড়েনি। সদ্য রঙ বদলেছে রোদ। বাতাসে লেগেছে সামান্য হিমেল স্পর্শ। যত্ন করে নতুন সাহেবকে শুঁটকি মাছ চাষ দেখাচ্ছিলেন ভদ্রলোক। মাছ ধরার পাশাপাশি, মাছ শুকানোও এই উপকূলীয় অর্থনীতির এক গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। অনভ্যস্ত শহুরে নাক হলে গন্ধটা বড় তীব্র লাগে। আগে জানলে সত্যিই আসতাম না। শৌভিক বলেছিল, পেটুয়াঘাট মৎস বন্দর দেখতে যাবে। বন্দর শুনে  হ্যাংলার মত লেজুড় হয়েছিলাম তুত্তুরী আর আমি। 


বন্দর দেখলাম, শৌলা আর জুনপুটে তারে ঝোলানো সারি সারি শুঁটকি মাছ দেখলাম। রঙবেরঙের ট্রলার দেখলাম। দেখেই অকুল দরিয়ায় ভেসে পড়তে ইচ্ছে করে। সাহস হয় না যদিও। বড় গন্ধ। বাঁধের ওপর দিয়ে পাকা রাস্তা চলে গেছে। পথের দুধারে দিগন্তপ্রসারী ফাঁকা মাঠ। মাঠ জুড়ে চলেছে মাছ শুকানোর কাজ। কোথাও খুঁটি পুঁতে, দড়ি টাঙিয়ে ঝোলানো রয়েছে সারি সারি বিভিন্ন প্রজাতির মাছ, কোথাও বা মাটিতে গর্ত করে পোঁতা, কোথাও বা সেই পুঁতে রাখা মাছকে তুলে ঝাড়াই-বাছাইয়ের কাজ চলছে। মাটি থেকে মাছ আলাদা করে জড় করা হচ্ছে স্তুপাকারে। মাছ শুকানোর কাজ মূলত বাড়ির মহিলারাই করছেন। হাত লাগিয়েছে সদ্য তারুণ্যে উপনীত হওয়া ফ্রক পরা মেয়ের দল ও। 


এদিকের মাটিটা বেশ বালি মেশানো। ড্রাইভার সাহেব বললেন কয়েক দশক পূর্বেও এই অঞ্চল ছিল সমুদ্র গর্ভে। রীতিমত ঢেউ খেলত। বাঁধের গায়ে আছড়ে পড়ত লবণাক্ত জলরাশি। এখন অবশ্য তিনি পিছিয়ে গেছেন বেশ অনেকটা। জোয়ারের সময় অবশ্য বেশ কিছুটা এগিয়ে আসেন আজও।  বাঁধের দুদিকে যত খানাখন্দ আছে, তাদের মধ্যে একদিকের জল মিষ্টি, অন্যদিকে লবণাক্ত। একদিকে প্রচুর সব্জি ফলেছে, অন্যদিকে পুকুর কেটে চলছে মাছ চাষের কাজ। প্রকৃতি হেথায় বড়ই উদার। সবকিছুই দিয়েছেন উজাড় করে। সবকিছুরই বড় প্রাচুর্য হেথা। ড্রাইভার সাহেব বললেন, ‘এদিকের লোককে মাছ কিনে খেতে হয় না স্যার।’ 


দেখতে দেখতে, শুনতে শুনতে, গ্রাম বাংলার রূপ- রস- গন্ধ- বর্ণে মোহিত হয়ে ফিরে চলেছি আমরা কাঁথি শহরের দিকে। একথা অনস্বীকার্য যে সমুদ্র দেখার সুপ্ত ইচ্ছে নিয়ে এসেছিলাম, ব্যর্থ মনোরথ হয়েই ফিরছি, তবে তাই নিয়ে তেমন ক্ষুন্নি বোধ নেই আমাদের। 


বেশ অনেক বছর ধরে কাঁথির মহকুমা শাসকের বাহন চালাচ্ছেন ভদ্রলোক। মহকুমাটাকে হাতের তালুর মত চেনেন। অনেক গল্প জানেন,বলতেও ভালোবাসেন। সাহেবের অনুমতি নিয়ে সামান্য ঘুরপথে নিয়ে চলেছেন আমাদের। উদ্দেশ্য হল মৎস দপ্তরের কি যেন একটা দীঘি দেখানো। সে দীঘি নাকি আয়তনে তেপান্তরের মাঠের সমান। কাকচক্ষুর মত টলটলে তার জল। অতি দক্ষ সাঁতারুও নাকি এপাড়- ওপাড় করতে হারিয়ে ফেলেন দম। চুনোপুঁটিদের পাশাপাশি রাঘববোয়ালরাও সেথা হাত-পা ছড়িয়ে সাঁতার কেটে বেড়ায়। শুধু ছিপ ফেলার অপেক্ষা। অবশ্য ছিপ ফেলতে সংশ্লিষ্ট দপ্তরের অনুমতি লাগে। 


গাড়ি চালাতে চালাতে বিভিন্ন সাহেব-মেমসাহেবদের সময় ঘটে যাওয়া না না ঘটন- অঘটনের গল্প শোনাচ্ছিলেন ভদ্রলোক। জনৈক সরকারী কর্মচারীর আত্মহত্যা তারই অঙ্গ। কোন এক নিশুতি রাতে গলায় দড়ি দেয় মেয়েটি। পাকেচক্রে কাঁথির তৎকালীন মহকুমা শাসক সে রাতেই কাঁথিতে উপস্থিত ছিলেন না। কি যেন দপ্তরী কাজে আটকে পড়েছিলেন দীঘায়। মধ্যরাত্রি অবধি দিব্যি জেগেই ছিলেন তিনি, ফোন সাইলেন্ট করে শুয়েছেন তার কয়েক ঘন্টার মধ্যেই এত বড় অঘটন ঘটায় মেয়েটি।


অকালে ঝরে যাওয়া এক অপরিচিতা কন্যার জন্য বেদনার্ত হয়ে ওঠে হৃদয়। আহা রে। না জানি, কত  যতনে লালনপালন করে বড় করে তুলেছিল বাবা মা। সেই সন্তান যদি এমন অবিবেচকের মত, নিজেকে শেষ করে দেয়, কিছু বলার থাকে না। উনিও সম্মতি জানান,‘ ঠিক বলেছেন ম্যাডাম।’ জানতে চাই, মেয়েটি কেন এমন করেছিল,কারণ জানা গেছে কি? কাজের চাপ নাকি মানসিক অবসাদ? জবাব আসে, ওসব তো ছিলই, সাথে অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছিল প্রেম। 


আবার গল্পে ফিরে যান ভদ্রলোক। বলতে থাকেন গভীর রাতে যখন আবিষ্কৃত হয় মেয়েটি অমন অঘটন ঘটিয়েছে, কতৃপক্ষ আতঙ্কিত হয়ে ফোন করে মহকুমা শাসককে। তখন রাত আড়াইটে। ওণার ফোন সাইলেন্ট ছিল, ফলে ফোন ধরতে কিঞ্চিৎ  বিলম্ব হয়। ইত্যবসরে মেয়েটিকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় এবং মৃত বলে ঘোষিত হয়। পরে যখন সাহেব/মেমসাহেব জানতে পারেন তিনি কিছুক্ষণের জন্য মানসিক ভাবে রীতিমত বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন। এমন নয় যে সেরাতে তিনি ফোন ধরলে মেয়েটি বেঁচে যেত, তবুও-।


 প্রাক্তন ওপরওয়ালা(ঈ) র প্রতি একরাশ মায়া মাখানো কণ্ঠে ঘাড় ঘুরিয়ে প্রশ্ন করেন ভদ্রলোক, ‘ আপনিই বলুন স্যার, এতে সাহেব/মেম সাহেবের কি দোষ?  রাত আড়াইটের সময় আপনাকে যদি কেউ ফোন করে, আপনি ধরবেন-’! 


দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে, “হ্যাঁ” বলে লম্বা ঘাড় নাড়ে শৌভিক। ‘ আমার ফোন সারা রাত খোলা থাকে, কখনও সাইলেন্ট থাকে না। খুব গুরুত্বপূর্ণ মিটিং এ না থাকলে আমি সব ফোন ধরি।’ থতমত খেয়ে গাড়ি চালানোয় মন দেন ভদ্রলোক। হাসি চাপি আমি, সত্যিই আমার বর ফোন ধরে ভাই। রাতবিরেতে , সময়- অসময়ে সবসময় ধরে। ধরতে পারে না কেবল যখন ইয়ে করতে যায়। কপালের এমন গেরো,যে ওই ঘরের চৌকাঠ ডিঙানো মাত্রই লাইন দিয়ে আসতে থাকে ফোন। ঘন্টি শুনে ছুট্টে এসে দরজার বাইরে থেকে চিল্লাই আমি বা তুত্তুরী, অমুকের ফোন/ তমুকের ফোন/ অজানা নম্বর থেকে আসা ফোন ইত্যাদি প্রভৃতি। 


এই অজানা নম্বর থেকে আসা ফোন গুলির মধ্যে আবার কেউ কেউ থাকেন, যাঁরা ফোনটি না ধরা পর্যন্ত করতেই থাকেন- একবার, দুবার, তিনবার। ওদিকে ফোন চিৎকার করে এদিকে আমি, ‘ওরে আমার বরটাকে ইয়েটা করতে দে বাপ।’ কতবার হয়েছে দাঁত মাজতে মাজতেও ফোন ধরেছে শৌভিক। এমনকি কুলি থুড়ি কুলকুচি করতে করতেও। বিগত বছর দেড়েকে আমাদের দাম্পত্য আলাপ তথা কলহও হয়েছে অমনি, থেমে থেমে, পূর্ণচ্ছেদ, কমা, কোলন, সেমি কোলন ইত্যাদি দিয়ে। ওটা যে কাজেরই অঙ্গ, সেটা বুঝে, মেনে নিয়েছি আমরা। অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি আমরা। 


এর মধ্যে শুধু একদিনই ফোন সাইলেন্ট রেখেছিল শৌভিক, যেদিন প্রযুক্তি গত কি যেন গড়বড় হয় আর লক্ষ্মীর ভাণ্ডার সংক্রান্ত একটা মেসেজের সাথে সাথে ওর মোবাইল নম্বরটা পৌঁছে যায় তমলুক মহকুমার ঘরে ঘরে, মা লক্ষ্মী দের মুঠোয় রাখা মুঠি ফোনে। পরিণতি সহজেই অনুমেয়।  মিনিটে মিনিটে আছড়ে পড়তে থাকে, ৩০/৪০ খানা ফোন প্রবাহ। একটা ফোন ধরে, ছাড়ার আগেই হুড়মুড় করে ঢুকে পড়ছিল গুচ্ছ গুচ্ছ কল ওয়েটিং। সে এক রাত গেছে বটে। আক্ষরিক অর্থেই ছেড়ে দে মা (লক্ষ্মী), কেঁদে বাঁচি। 


তখন কি আর জানতাম যে বছর ঘোরার আগেই ঘটতে চলেছে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি । দিন তিন চার আগের কথা, কাক ডাকা ভোর থেকে বানের জলের মত আসতে শুরু করল ফোন। সেবার ফোনের ওপারে শুধু মা লক্ষ্মীরা ছিলেন, এবার অবশ্য কোন লিঙ্গবৈষম্য পরিলক্ষিত হল না। সবার একই প্রশ্ন, একই অনুরোধ " স্যার, অমুক প্রকল্পে নাম ওঠেনি। একটু আমার ব্যবস্থা করে দিন স্যার।"  যে প্রকল্পের জন্য ফোন,তা আদৌ মহকুমা শাসকের দপ্তর থেকে দেখা হয় না। প্রথম জনা পঞ্চাশকে সেটাই বলল শৌভিক। শান্ত ভাবে জানাল,কোন অফিসে যোগাযোগ করতে হবে। এমনকি এটা যে আপাতত কেবল পঞ্চায়েত এলাকায় হচ্ছে, পুরসভায় নয়,তাও বোঝালো কাউকে কাউকে। এই জেলা তথা মহকুমার লোকজন এমনিতে খুব বাধ্য,বললে অযথা তর্ক করে না। অবশ্য ব্যতিক্রম তো সর্বত্র বিদ্যমান। তেমনি এক ব্যক্তি বেশ বকেই দিলেন আমার বরটাকে। " আপনার অফিসে হবে না যখন, আপনার নম্বর দিয়েছেন কেন?"  


কোথায় নম্বর দিলাম রে বাবা,আকাশ থেকে পড়ে শৌভিক। ধীরে ধীরে ঝুলি থেকে বেরোন বাঘের মাসি। এক স্থানীয় সংবাদ পত্রের জনৈক সাংবাদিক মহাশয়, উক্ত প্রকল্পটি নিয়ে এক আগুনে প্রতিবন্ধ লিখেছেন। লিখতে লিখতে উদ্দীপনার বশে তিনি এই জেলার চার মহকুমা শাসকের ব্যক্তিগত নম্বরগুলিও টুকে দিয়েছেন। বিশদ জানতে ফোন করুন বা নালিশ জানান- এই ধরণের কোন শিরোণামে। 


পত্রিকাটি যেহেতু কাঁথিতেই প্রকাশিত হয়, স্থানীয় লোকজনই কেবল পড়েন ফলে নম্বরটা হাতে হাতে ছড়িয়ে পড়েছে আগুনের মত। পরিণতি অনুমেয়।আপদে বিপদে মানুষ অবশ্যই ফোন করবে, করেও, কিন্তু তাই বলে ওটা যে আদৌ কোন প্রকল্পের হেল্পলাইন নম্বর নয়, ওই সংক্রান্ত রিপোর্টে করো নম্বর ছাপতে হলে অন্তত তার মৌখিক অনুমতি টুকু নেওয়া দরকার, তথাকথিত সাংবাদিকদের থেকে এইটুকু নৈতিকতা কাঙ্ক্ষিত বটে, কে আর তার মর্যাদা দেয়। ভাগ্যে জনগণের স্মৃতিশক্তি  অত্যন্ত দুর্বল, আজকের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলি গুণোত্তর প্রগতিতে হারাতে থাকে তাদের তাৎপর্য, সেটাই আপাতত আমাদের ভরসা।

Thursday 15 December 2022

তুত্তুরী উবাচ ১৫ই ডিসেম্বর, ২০২২

 


👩🏻- বাবু ওঠ। সোয়া ছটা বাজছে। স্কুল যেতে হবে। 

👧🏻- (দু হাত জড়ো করে ছলছল চোখে) মা প্লিজ মা, আজ স্কুল যাব না। সারা রাত কানের ব্যথায় ঘুমাতে পারিনি। 

👩🏻- (উদ্বিগ্ন স্বরে) সে কি! আবার? ঠিক আছে, স্কুল যেতে হবে না, শুয়ে পড়। (মেয়ের গায়ে কম্বল চাপা দিতে দিতে, ছেলে ভোলানো স্বরে) বাবু জানিস তো, কাল আর্জেন্টিনা জিতেছে। 

👧🏻-(চোখের জল মুছে, মিনমিনে স্বরে) জানি। তিন-শূণ্যে। মড্রিচের জন্য আমার খুব মন খারাপ। 

👩🏻-(সন্দিগ্ধ স্বরে) তুই জানলি কি করে? খেলা তো রাত আড়াইটায় শেষ হয়েছে!

👧🏻-(ধরা পড়ে যাওয়া স্বরে) আসলে খুব কান ব্যথা করছিল তো, তাই মাসির ফোনটা নিয়ে দেখছিলাম চোখের ড্রপ কানে দেওয়া যায় কি না। গুগল বলল যায় না। (মাকে ভোলাতে, ছদ্ম উত্তেজনা দেখিয়ে) জানো মা, আর কি শিখলাম,  এমনকি নাকের ড্রপ ও কানে দেওয়া যায় না।

অনির ডাইরি ৯ই ডিসেম্বর, ২০২২

 


ভদ্রলোকের আজ জন্মদিন। যখন ভূমিষ্ঠ হয়েছিলেন, আক্ষরিক অর্থেই পৃথিবী কাঁপাচ্ছেন ওণার সমনামধারী জনৈক গুঁফো জার্মান সাহেব। অবিভক্ত ভারত। ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে আবেদন-নিবেদনের রাজনীতির উপর বীতশ্রদ্ধ হয়ে, সদ্য নতুন দল গঠন করেছে সুভাষ। ভারত ছাড়ো আন্দেলন থেকে নেতাজীর অন্তর্ধান, ডাইরেক্ট অ্যাকশন ডে থেকে দেশ ভাগ কিছুই তখনও লেখা হয়নি সময়ের খেরোর খাতায়। 


বিশ্বাসই হয় না, দেখতে দেখতে ৮৩টা বসন্ত পার করে ফেললেন ভদ্রলোক। সাক্ষী রইলেন কত না উত্থান-পতন, কুশীলব থেকে পট পরিবর্তনের। ভদ্রলোক নিজেও কম বর্ণময় চরিত্র নন। ওণাকে নিয়ে একটা-দুটো নয়, গল্প লেখা যায় ভুরি ভুরি। যেমন সপ্তম শ্রেণীর সেই দিনটা, স্কুলের বড় গেট থেকে বেরোনোর সাথে সাথে যেদিন আমাকে ছেঁকে ধরেছিল একদল সুহৃদ। সবার চোখে উৎকণ্ঠা, মুখে একটাই প্রশ্ন ‘ কি রে,কি হল?’ 


উদ্বিগ্ন হওয়াটাই স্বাভবিক, যা কেলো বাঁধিয়েছিলাম আমি। সেই সময় হাওড়া গার্লস কলেজে যারা BT পড়তেন, তাদের প্রাকটিক্যাল পড়ত আমাদের স্কুলে। সে এক দারুণ মজার ব্যাপার। রোজ, রোজ নতুন দিদিমণিরা আসতেন ক্লাস নিতে। কেউ বকতেন না, গল্প বলার ছলে সামান্য হাসি মস্করা মিশিয়ে পড়াতেন। সময় যে কোথা দিয়ে কেটে যেত। এই নবাগতা সুবেশা তরুণী শিক্ষিকাকুলের রীতিমত অনুরাগী হয়ে পড়তাম আমরা। 


কদাচিৎ আবার কেউ কেউ রাগী দিদিমণি সুলভ হাবভাবও দেখাতেন। ভাগ্যক্রমে তেমনি এক দিদিমণির সাথে সম্মুখ সমরে জড়িয়ে পড়েছিলাম আমি। ভূগোল পড়াতে এসে সামান্য ভুল তথ্য দিয়ে ফেলেছিলেন। হয়তো নার্ভাস হয়েই, কারণ ক্লাস চলাকালীনই চলত ওণাদের অ্যাসেসমেন্ট। ক্লাস রুমের পিছনের দরজা দিয়ে যখন তখন নিঃসাড়ে ঢুকে আসতেন ওণাদের শিক্ষক- শিক্ষিকারা। যদিও সেই সময় তেমন কেউ উপস্থিত ছিলেন না ক্লাসে। চিরকালের ডেঁপো আমি, দিদিমণির ভুল ধরতে পারার উত্তেজনা আর চাপতে না পেরে মুখ ফুটে বলেই বসলাম। সঙ্গত দিল আরো গুটি তিনেক সহপাঠী। 


ভুল স্বীকার করে নিলেই ল্যাটা চুকে যেত, অথবা আমাদের ধমকে বসিয়ে দিলেও ব্যাপারটা ওখানেই মিটে যেত। উনি সেসব কিছু না করে সটান নালিশ করে বসলেন ওণাদের হেডুর কাছে। তিনি আবার অনুযোগ জানালেন আমাদের বড়দির কাছে। সালিশি করতে পাঠানো হল বাংলার কমলকলিদি দিকে। উনি ক্লাস এসে হাই তুলে বললেন, ‘ এই BTর বিটি(বেটি)দের নিয়ে আর পারি না। কে কি বলেছিস বাবা, যা গিয়ে মার্জনা চেয়ে ধন্য কর।’ 


ছুটির ঘন্টা বাজার পর সেই মার্জনাই চাইতে গিয়েছিলাম চার ইয়ার মিলে, কমন রুমে।  অভিযোগকারিণী এতটাও বোধহয় আশা করেননি, ফলে মার্জনাভিক্ষা পর্ব তো বেশ নির্বিঘ্নেই সমাপন হল। বাইরে বেরিয়ে দেখি, ‘যেখানে বাঘের ভয়,সেখানেই’ ইয়ে , পিসির পরিবর্তে সেদিনই বাবা আনতে এসেছে। বাবার সামনেই বন্ধুদের ঐ প্রশ্নবাণ যে কি মারাত্মক আতঙ্ক জাগিয়েছিল, তা শুধু আমিই জানি। কোন মতে মাছি তাড়ানোর মত সবকটাকে কাটিয়ে বাবার হাত ধরে টানলাম, বাড়ি যাব। বড় রাস্তা পেরানো অবধি বাবা নীরবই ছিল, গলিতে ঢুকে ফস্ করে একটা সিগারেট ধরিয়ে, এক মুখ ধোঁয়া ছেড়ে জানতে চাইল,‘স্কুলে এক্জাক্টলি কি করেছিলি?’ 


বিস্তর ঢোঁক গিলে, হেঁচে-কেশে, ‘ব্রহ্মা-বিষ্ণু-কালী’ ইত্যাদি তেত্রিশ কোটি দেবদেবীকে স্মরণ করে বলেই ফেললাম সবিস্তারে। ভেবেছিলাম খুব বকবে, বকা তাও ভালো,  গৃহত্যাগ না করে বসে। একবার মায়ের কথায় খার খেয়ে, বাবার নেশা ছাড়াতে এক প্যাকেট সিগারেট কুচিয়ে নষ্ট করেছিলাম, যার জন্য করেছিলাম তিনি তো ধমকে আমার গুষ্টি উদ্ধার করেছিলেন, বাবা কিছু বলেনি, কেবল গৃহত্যাগের হুমকি দিয়ে আরেক প্যাকেট সিগারেট কিনতে বেরিয়ে গিয়েছিল। যখন ফিরেছিল, ততোক্ষণে কেঁদে গোটা বাড়ি মাথায় তুলেছি আমি। সেই থেকে বৃদ্ধের গৃহত্যাগের হুমকিকে বড় ভয় আমার। সেবার অপরাধ লঘু ছিল, ফিরে এসেছিল। এবার যে কি হবে। 


আমার যাবতীয় শঙ্কাকে হাওয়ায় উড়িয়ে দিল বাবা। হো হো করে হেসে উঠে বলল, ‘বেশ করেছিস। স্কুল - কলেজে অমন আমিও অনেক করিছি, বুঝলি-। শুনবি নাকি সে সব গল্প?’। 


ভদ্রলোক অমনিই। বেশ খানিকটা খামখেয়ালি, আর অনেকটা, ‘সৃষ্টিছাড়া-নিয়মহারা-হিসাবহীন।’ তা নাহলে কেউ কিশোরী কন্যার হাতে জ্বলন্ত সিগারেট ধরিয়ে বলে,‘টেনেই দেখ না, কেমন খেতে-’। দোষের মধ্যে আমি জানতে চেয়েছিলাম, যে সিগারেট খাওয়া নিয়ে নিত্য অশান্তি হয় এ বাড়িতে, সেটা খেতে কেমন? নির্ঘাত খুব সুস্বাদু। অতঃপর যা হয় আর কি, বাবাকে নকল করে ধোঁয়া টানা এবং প্রবল কাশি। কাশির দমক থামলে,মায়ের উদোম খিস্তির ঝড় শান্ত হলে জিজ্ঞাসা করেছিলাম,‘এটা কেন করলে?’ ফিচেল হেসে লোকটা বলেছিল,‘আমার মেয়ে, বড় হয়ে তো ফুঁকবিই। বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে গোল্লায় যাস না। খেতে ইচ্ছে হলে আমার থেকে চেয়ে খাস।’ 


বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে প্রথম ইয়ে খেয়েছিলাম যেদিন,সেদিনও একই কথা বলেছিল বাবা। তখন সদ্য চাকরী পেয়েছি। মনের মত চাকরী। খড়্গপুরে পোস্টিং। দীর্ঘ ট্রেন যাতায়াতের পথে গড়ে ওঠা কিছু বন্ধুর সাথে ছুটির পর, খড়্গপুর স্টেশনের কাছে এক পার্কে বসে, আক্ষরিক অর্থেই এক ছিপি করে খাওয়া আর কি। ডাক্তার কাকুর হোমিওপ্যাথি ওষুধের মত খেতে লেগেছিল মাইরি। তাও কি ভয়। এতটা রাস্তা একা ফিরব, বাকিরা নেমে যাবে মেচেদা থেকে দেউলটির মধ্যে। নবু পইপই করে সাবধান করে দিল,‘ আজ অন্তত হ্যাংলার মত ট্রেনে গজা বা পান্তুয়া উঠলে খাস না। পারলে জানলার ধারেও বসিস না। খোলা হাওয়ায় নেশা বাড়ে-।’ নেশা -টেশা কিছুই বুঝলাম না। দিব্য দাশনগর স্টেশনে নেমে,রিক্সাওয়ালার সাথে ব্যাপক দরাদরি করে গলির মুখে নামলাম। নবু বলেই দিয়েছিল, বাড়িতে ঢোকার আগে একটা পান খেতে। গন্ধ চাপার জন্য। পানের দোকানে গিয়ে দেখি, বাবাও এসেছে সিগারেট কিনতে। আমার বাড়ি ফেরার সময়, প্রায়ই কিছু না কিছু কেনার অছিলায় গলির মুখে চলে আসত বাবা। মিষ্টি পান আমি বরাবরি ভালোবাসি, তাতেও কোন অস্বাভাবিকতা নেই। পান কিনলাম, বাবা পয়সা দিল। পান গালে পুরে, সারাদিনের গল্প বলতে বলতে ফুরফুরে মনে বাড়ি ফিরছি, বাবা হঠাৎ বলল,‘পয়সা দিয়েছিলি?’ এ্যাঁ! কি? খেই হারিয়ে জানতে চাই আমি। দুই আঙুলের ফাঁকে জ্বলন্ত সিগারেট ধরে, বাতাসে স্বভাবসিদ্ধ আঁকিবুকি কাটতে কাটতে বাবা বলল ,‘ জীবনে আর যাই করিস, পরের পয়সায় নেশাটা করিস না। আর যদি খেতেই হয়, কি ব্রাণ্ড তোর বন্ধুরা খায়, জেনে বলিস, আমি কিনে এনে দেব। এতটা রাস্তা একা আসিস, পথে কি বিপদ আপদ হয়, তার থেকে বাড়িতে বসেই না হয়-’। 


একই কথা বলেছিল বাবা, যেদিন আমি কলেজ থেকে বাড়ি ফিরে অশান্তি করেছিলাম, আমার সব বন্ধুরা ইয়ে সিনেমা দেখে ফেলেছে, আমি কেন দেখিনি। রীতিমত হ্যাটা দেয় সবাই। ' গুড গার্ল ', ' আব্দেরে আলুভাতে ' বলে খেপায় সবাই। তখনও ইন্টারনেট আসেনি, লাল-নীল ছবির জন্য সিডিই ভরসা। মা তো গালি দিয়ে ভূত ভাগিয়ে দিয়েছিল, মুড়ো খ্যাংরা যে জোটেনি কপালে এই ঢের। আর বাবা বলেছিল, ‘দুয়েকটা সিনেমার নাম জেনে আসিস, আমি পার্লার থেকে সিডি এনে দেব, বাড়িতে বসে দেখে নিস।’ 


বাবা অমনিই, ঘোরতর বাস্তব হয়েও কেমন যেন ইচ্ছে পূরণের স্বপ্ন। শুভ জন্মদিন বাবা। খুব ভালো থাকো,সুস্থ থাকো। যেমনি আছো, তেমনি থাকো। Love you to the moon and back.

Sunday 4 December 2022

শৌভিক বাণী


শৌভিক বাণী ২৯শে ডিসেম্বর,২০২২


👨🏻- (রিলস্ দেখতে দেখতে, এক গাল হাসি নিয়ে) একটা ছেলেকে ভিডিও তুলতে বলেছে, ছেলেটা ক্যামেরাটা নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিয়েছে। 

👩🏻-(গেম থেকে মুখ তুলে) ওটা ২৫ বছর ধরে বাজারে চলছে। তুই আজ দেখলি। 

( অতঃপর কফির কাপে চুমুক দিতে গিয়ে) এ ম্যা গো! আমার কফিতে একটা পোকা পড়ে বসে আছে। 

👨🏻- (তির্যক স্বরে) তা পোকাটার কি দোষ? কফিটা এত ক্ষণ ধরে ফেলে রেখে দিয়েছিস ও ভেবেছে ওটা বোধহয় সুইমিং পুল। তাই গরম জলে সাঁতার কাটতে নেমেছে। 

👩🏻- 🫤

শৌভিক বাণী ২৭শে ডিসেম্বর,২০২২


👨🏻- পৌঁছতে এখন তিন ঘন্টা।  ঘুমিয়ে পড়। 

👩🏻-(হাই চেপে) আমার গাড়িতে ঘুম আসে না। 

👨🏻- একা থাকলে আমি তো দারুণ ঘুমাই। 

👩🏻-(সন্দিগ্ধ স্বরে) দোকায় কি প্রবলেম?

👨🏻-(দীর্ঘশ্বাস ফেলে) প্রবলেমটা সঙ্গে থাকে তো। 

👩🏻-😡

শৌভিক বাণী ১৮ই ডিসেম্বর, ২০২২


👨🏻-(খেলা শুরুর আগে, বিজ্ঞ স্বরে) দীনু কাকুকে বললাম, আজ ফ্রান্স জিতলে আমি খুব খুশি হব। 

👩🏻-সে কি? তুই তো চিরকালীন আর্জেন্টিনার সমর্থক রে। 

👨🏻-( উদ্দীপ্ত স্বরে) হ্যাঁ, কিন্তু ফ্রান্স হল বিপ্লবের আঁতুড় ঘর। উদার দেশ। বর্ণ বিদ্বেষ নেই। অনর্থক ইমিগ্রেশনের ঝামেলা নেই। কড়া বিধিনিষেধ নেই। কত জন কৃষ্ণাঙ্গ খেলোয়াড় আছে দেখছিস না। যুদ্ধটুদ্ধও তেমন পারে না-----_-। 


(খেলা শুরু হতেই) গোওওওওওল। 

👩🏻- আর্জেন্টিনা গোল করল তো। তো তুই খুশি হচ্ছিস কেন?

👨🏻-(বিরক্ত হয়ে)হব না?

👩🏻- তবে যে দীনু খুড়োকে পট্টি পড়ালি, যে ফাইনালে তুই ফ্রান্সকে সমর্থন করবি। 

👨🏻-( চোখ পাকিয়ে, দাঁত কিড়মিড় করে) মোটেও আমি তাই বলিনি। বলেছি ফ্রান্স জিতলেও এএএএ মানে ঠিইইইক আছেএএ।  

👩🏻- 🐻😡

শৌভিক বাণী, ৪ঠা ডিসেম্বর,২০২২

👨🏻- এত পড়ার চাপ দিচ্ছিস কেন(তুত্তুরীকে)?

👩🏻- চেপে পড়তে না বসালে, ও জীবনে পড়তে বসবে? পরীক্ষায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে ফেল করবে যে। 

👨🏻- বসে বসেই ফেল করুক না। কি যায় আসে। 

👩🏻- 😡

 


শৌভিক বাণী ৯ই মে, ২০২২

👩🏻-আঁকশি কাকে বলে জানিস?

👨🏻-হুঁ যেটা দিয়ে আম পাড়া হয় তো?

👩🏻- হ্যাঁ। একটা লম্বা লাঠির ডগায়, আরেকটা ছোট লাটি ভি এর মত করে-

👨🏻-(মাঝপথে বিরক্ত হয়ে) জানি রে বাবা। 

👩🏻-(বিড়বিড় করে) না মানে বাঙালরা আবার আঁকসিকে ঠিক কি বলে, তা তো জানি না। তাই ভাবলাম 

👨🏻-(অত্যন্ত শীতল স্বরে) জানতাম না তো। শ্বশুর মশাইয়ের কাছে শেখা। সেই যে সেবার ওণার সাথে কামচাটকা গিয়েছিলাম, কৃষক বিদ্রোহ সংগঠিত করতে। 

👩🏻-( হাসি চেপে) কামচাটকায় কৃষক বিদ্রোহ-

👨🏻-হয়েছিল তো। আমার শ্বশুর মশাই সংগঠিত করেন। সেখানেই একজন কৃষক একটা আঁকসি নিয়ে এসেছিল অস্ত্র হিসেবে। শ্বশুরমশাই বোঝালেন,এটা শুধু অস্ত্র হিসেবেই ব্যবহার করা যায় না, এটা দিয়ে ফলও পাড়া যায়। এটা দিয়ে তোমরা আম আর খেজুর পেড়ে খেও। তারপরই তো ফল পাড়তে আঁকসির ব্যবহার শুরু হল। তার আগে তো ওটা দিয়ে চাষ করা হত। 

👩🏻- (হাসির দমকে, বিষম খেয়ে) সিরিয়াসলি, বিয়ের পর এত বছর হয়ে গেল, এবার আমার বুড়ো বাপটাকে একটু ছাড়। তোর শ্বশুর নিয়ে অবসেশনটা দিন দিন মাত্রা ছাড়া হয়ে যাচ্ছে মাইরি।


 শৌভিক বাণী ১১ই অক্টোবর, ২০২১

"We enjoy as a family, we suffer as a family."

শৌভিক বাণী- ২৫শে জুলাই, ২০২১

‘পরীক্ষা বছরে চারটে করে হয়, আর অলিম্পিক  চার বছরে একবার। ওকে(শ্রীমতী তুত্তুরী) শান্তিতে অলিম্পিক  দেখতে দে। অত পড়াশোনা করার দরকার নেই।’

অতঃপর আহ্লাদী কন্যাকে আর পায় কে?😡


শৌভিক বাণী- ৭ই ফেব্রুয়ারি ২০২১

"বিয়রকে বলা হয়, সফ্ট ড্রিংক ফর অ্যাডাল্টস্। এই ব্রীজার ব্যাপারটা নির্ঘাত বিয়র ফর কিডস।"

শৌভিক বাণী- ৫ই এপ্রিল ২০২০

“করোণা মাই কি জয়। আসছে বছর আবার হবে। ” 


শৌভিক বাণী ২২ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১৮

“এবার মুখর করে দাও হে তোমার নীরব মোদী’রে”- শৌভিক বাণী অদ্য প্রাতে-




‘পরীক্ষা বছরে চারটে করে হয়, আর অলিম্পিক চার বছরে একবার। ওকে(শ্রীমতী তুত্তুরী) শান্তিতে অলিম্পিক দেখতে দে। অত পড়াশোনা করার দরকার নেই।’




অতঃপর আহ্লাদী কন্যাকে আর পায় কে?😡


তুত্তুরী উবাচ ১লা ডিসেম্বর, ২০২২

 


👩🏻- দুধের কাপ নিয়ে আর কতক্ষণ বসে থাকবি বাবু? পড়তে বসবি কটায়? রাত নটায়?

👧🏻- (ফোঁস দীর্ঘশ্বাস ফেলে, হতাশ হয়ে মাথা নাড়তে নাড়তে) এই জন্যই বলেছিলাম। আমি অনেক আগেই বুঝেছিলাম ব্যাপারটা। তুমিই মানতে চাও না। 

👩🏻-(ঘাবড়ে গিয়ে) কি?

👧🏻- আরে অলিম্পিক-ওয়ার্ল্ড কাপ চার বছরে একবার আসে, আর পরীক্ষা বছরে চার বার। কোনটা বেশি গুরুত্বপূর্ণ তুমিই বলো।