Friday 17 March 2023

অনির ডাইরি ৪ঠা মার্চ, ২০২৩

 

#অনিরডাইরি 

বালি ব্রিজ টপকালাম কত দিন বাদে, ব্রিজের নিচে কুচকুচে কালো মা গঙ্গা আর বাঁহাতে ঝকঝকে আলোকোজ্জ্বল মা দক্ষিণেশ্বরী। মা কালী আবার মা গঙ্গার সতীন,একসাথে দুজনকে প্রণাম করা উচিত নয় বোধহয়। এতদিন বাদে দেখা, আশা করি আজ ওরা কেউ কিছু মনে করবে না।


 বেলঘড়িয়া এক্সপ্রেসওয়ে। রাস্তার দু'ধারে যত চায়ের দোকান ছিল সব ভেঙে দেওয়া হয়েছিল কিছুকাল আগে। প্লাস্টিক টাঙিয়ে তারাই আবার ফিরে এসেছে। উজ্জ্বল বাল্বের আলো হাত বাড়িয়ে ডাকে, "ও দিদি, আসুন না। কতদিন বাদে এলেন কলকাতায়।এক কাপ চা তো খেয়ে যান অন্তত। ঘন দুধে, এলাচ থেঁতো করে, একটু বেশি চিনি আর চা দিয়ে ফুটিয়ে, মাটির ভাঁড়ে মুখ পোড়ানো অনবদ্য দিশি চা। পছন্দ নয় বুঝি? তাহলে না হয় আপনার জন্য বিলিতি চাই বানিয়ে দেব। কষকষে করে ফোটানো গরম জলে দার্জিলিং চায়ের পাতা ভিজিয়ে আপনার জন্য তৈরি করে দেবো, সুগন্ধ কালো চা। তাতে থাকবে ব্যাস এক চিমটে চিনি। আমাদের বিস্কুট গুলো দেখেছেন?  এই যে কাঁচের বয়াম ভর্তি বিস্কুট,  এগুলো কি আপনাকে ডাকছে না ? দেখুন কি না নেই, মুচমুচে লেড়ো বিস্কুট আছে, প্রজাপতি বিস্কুট আছে, ক্রিম রোল আছে, সুজির হরেক রকম বিস্কুট, যাদের আপনারা কুকিজ বলে কেনেন অনেক দামি মল থেকে, সব আছে। আছে চেরি আর চাল কুমড়ার মিঠাই ছড়ানো সস্তা বেকারির কেক।  বলুন তো কোনটা ছেড়ে কোনটা খাবেন? ও দিদিইইইইইইইইই আসুন নাআআআআআ।"


এয়ারপোর্ট। আড়াই নম্বরের গেট দিয়ে ঢুকতেই একযোগে মেসেজ পাঠালো ওলা এবং উবের। " ও দিদি আসব নাকি? প্রাইম, ম্যাক্স, মিনি, মাইক্রো কি লাগবে বলুন না যা বলবেন তাই নিয়ে এসে হাজির হব। হ্যাঁ, আমাদের ড্রাইভার গুলো একটু ছ্যাঁচড়া বটে, আমাদের নির্ধারিত ভাড়ায় কিছুতেই যেতে চাইবে না ব্যাটারা, বলবে অ্যাপ বন্ধ করে দিন, বলবে ক্যাশ টাকায় ভাড়া না দিলে কিছুতেই নিয়ে যাব না, হাজার বললেও এসি চালাবে না। উল্টে আপনাকে ওয়ান স্টার দেবে। আপনি নালিশ করবেন, আপনি ফেসবুকে লিখবেন, আপনি টুইটারে নালিশ করবেন। কিচ্ছু করবো না আমরা। জাস্ট কিচ্ছু করব না। বড়জোর একটা, " সরি ম্যাডাম, এই তো আমরা ড্রাইভারের মুণ্ডুচ্ছেদ‌ করলাম বলে- " মার্কা একটা গুরুত্বহীন মেসেজ পাবেন।  তাও কেবল টুইটারে। ওখানকার লোকজন একটু বেশিই গালাগাল দেয় কিনা। 


ওসব ছাড়ুন বরং। কতদিন বাদে ফিরলেন এই বুড়ি শহরে, কোথাও যাবেন না নাকি…? হাওড়ায় বুড়ো বাপ মায়ের কাছে অন্তত চলুন। নাকি অন্য কোথাও ঘুরে দেখতে চান? রাতের মহানগর কেমন লাগে? নামমাত্র পয়সায় রাতের মহানগর দেখাবো আপনাকে, তাও এঁকেবেঁকে, অলিগলি দিয়ে। নামমাত্র ভাড়ায়, শুধু ঘেমো হেলমেটটা একটু পরতে হবে। পিছন থেকে বলল রেপিডো।


ভিআইপি রোড। নিয়নের আলোয় পিচ্ছিল রাজপথ, পিছন পিছন তাড়া করেছে সুইগী আর zomato। ও ম্যাডাম কি খাবেন বলুন না। বিরিয়ানি খাবেন, বিরিয়ানি? কোথা থেকে খাবেন একবার বলুন শুধু, আমিনিয়া চলবে? আর্সলান? সিরাজ? রহমানিয়া? বিরিয়ানি বাই কিলো? কাবুলিওয়ালা? নাকি ইন্ডিয়া?

আরেকজন বলল, মোগলাই ছাড়ুন। বড় বেশি তেল আর মসলা, ওভার রেটেড বুঝলেন তো। আপনি তো ইয়ে আবার একটু মানে, স্বাস্থ্যবতী কিনা, চাইনিজ খান বরং।  উচ্চ মানের নুডুলস খাওয়াব দিদি। গ্রেভি চান যদি, গ্রেভি। না হলে হাক্কা।  কতদিন ভালো চাউমিন খাননি ভাবুন। মিক্সড চাউমিন খাবেন? গোটা গোটা প্রণ, মাশরুম, মাখনে ভাজা ওমলেটের কুচি, মাখন-গোলমরিচ দিয়ে সটেড চিকেন আর কুচি কুচি পর্ক।  ওঃ  আপনি তো আবার শুয়োরের মাংসটাংস খান না। ফিস উইথ রেড ওয়াইন নিন সাথে একদম জমে যাবে।


অপরজন পূর্ণ উদ্যমে ঝাঁপিয়ে পড়ল, বিদেশী জিনিসপত্র ছাড়ুন তো? এতদিন বাদে নিজের শহরে ফিরেছেন নিজের দেশি খাবার খান। বিরিয়ানি ছাড়াও অনেক কিছু আছে মোগলাইএ। বিভিন্ন রকম নান আছে। আর কাবাবের কথা ভুলে গেলে? তোমার প্রিয় কাবাব। এককালে তো ফ্যান্টাসাইজ করতে কাবাবের নামে। শোন, ওসব চিনে খাবার খাওয়ার থেকে সাহেবী খাবার খাও বরং। চিজে লটপট পিজ্জা, পাস্তা, স্প্যাগেটি খাও না, আমরা এনে দেবো তো। 


ফ্ল্যাটের তালা খুলছি আরবান  ক্লাপ বলল,  আজ তুমি বড় ক্লান্ত না? কাল আসি তাহলে? বড় নোংরা হয়েছে তোমার ফ্ল্যাট খান বাপু। বাথরুমে গিয়ে দেখো, কোণায় কোণায় ঝুল, জমা জলের লালচে দাগ। রান্না ঘরে ঢুকে দেখ না, দেখবে কেমন তেলচিটে পড়েছে। সব পরিষ্কার করে দেব। তোমার কোন চিন্তা নেই। এই শোনো না নিজের দিকে কতদিন তাকাও না বলতো, ফাটা গোড়ালি টা দেখেছো আর হাতের নখগুলো? কি কুচ্ছিত রকমের কিউটিকল জমেছে। এত কালোই বা হয়ে গেলে কি করে? বলছি কি একটা ফুল বডি স্পা করে নাও বরং। সাথে একটা দুরন্ত ফেসিয়াল। কোথাও যেতে হবে না তোমায়, আমরাই আসবো বরং। ফোল্ডিং বেড আনব,  ডিস্পোজেবল পোষাক আনব। তোমার শোবার ঘরে, তোমার বাতানুকূল যন্ত্রের শীতল হওয়ায়, দুর্দান্ত মালিশ করে দেবে আমাদের মেয়েরা। রিলাক্স করার জন্য, জ্বালানো হবে তোমার মনের মত সুগন্ধী, পপৌড়ি বা সেজ। নিদেনপক্ষে চন্দন। সামান্য একটু বেশি খরচা হবে, যদি চকলেট রাপ লাগিয়ে নাও, তাহলে দেখবে কি রকম ঝিলিক মারবে তোমার চামড়া।”


পাত্তা না দিয়ে ফ্ল্যাটের দরজা বন্ধ করলাম। কতদিন বাদে এলাম। প্রায় দুই মাসেরও পর। শেষ এসেছিলাম বড়দিনের ছুটিতে। বেশ অনেকদিন হয়ে গেল মহানগর ত্যাগ করার। আজকাল সেই টানটা আর অনুভূত হয় না।  উল্টে খুঁত গুলোই বেশি চোখে পড়ে। কথায় কথায় তাচ্ছিল্য করি শহরটাকে। তিনশ তেত্রিশ বছরের বুড়ির আর দেবারই বা কি আছে নতুন করে?নেহাৎ দুই প্রাণের বন্ধু এই মুহূর্তে মহানগরে পোস্টেড,নাহলে আরো বাড়ত খিস্তির তীব্রতা। কিন্তু একটা ব্যাপার প্রতিবারই অনুভব করি,কিছু তো আছে বুড়ির মধ্যে। সাধে তিলোত্তমা বলে না লোকে।বুড়ি বেশ কুহকিনী। সীমানা স্পর্শ করলেই, কেমন যেন আপন করে নেয় বুড়ি। ফিসফিস করে বলতে থাকে মান ভাঙ্গানো আদরের কথা। যাবতীয় ক্ষতে যেন মলম লাগিয়ে দেয় বুড়ি। যত্ত খিস্তিখেউর,রাগ, বিরক্তি, অভিমান সব যেন কেমন গলে গলে যায়। বিরাগটা যে কখন অনুরাগ হয়ে, মাখো মাখো প্রেমে পরিণত হয়ে যায় নিজেই বুঝতে পারি না। দূষিত বিষ বাতাসকেও একটু বেশি ভরে নিই ফুসফুসে। ঘুমিয়ে পড়ি বুড়ির বুকে মাথা রেখে, ময়লা আঁচল খানা জড়িয়ে। কাল সকালে উঠে সেই তো আবার ফিরে যেতে হবে। যতই চেপে ধরি না কেন,কাল সকালে ঠিক হাত ছাড়িয়ে নেবে বুড়ি। আবার ফিরে যেতে হবে পাতানো শহরে। নাককান মূলে ভাব জমাতে হবে আবার। এই তো জীবন কালি দা।

No comments:

Post a Comment