Friday 22 April 2022

অনির ডাইরি ২২শে এপ্রিল, ২০২২

 


#তাম্রলিপ্তকড়চা 

আমায় কেউ কোনদিন ইফতারে ডাকেনি। স্কুল, কলেজে না হয় কোন মুসলিম বন্ধু ছিল না, কর্মক্ষেত্রে তো ছিল। তাঁদের মধ্যে কয়েকজন নিয়ম করে রোজা রাখতেনও। রোজ গপ্প শোনাতেন, সের্গিতে কে, কি খেলেন। ‘বুঝলে অনিন্দিতা, বেশি কিছু না,সামান্য দুধভাত আর এক টুকরো ইলিশ মাছ।’ গল্প শোনাতেন,কার বাড়িতে কি রান্না হত, ভাগ করে নিতেন ঈদের বাজেট। ‘বুঝলেন ম্যাডাম, ফলের যা দাম, আপনার বৌদি বলছে, চল্লিশ হাজার শুধু ফলেই ধরে রাখো। বড় পরিবার তো আমাদের-’। ওদের কাছেই শিখেছিলাম কেউ রোজা রাখলে তার সামনে খেতে নেই। খেলে পাপ লাগে। তবে তিনি অনুমতি দিলে খাওয়া যায় বটে।


বলতে নেই, ঈদের পর অবশ্য সকলেই খাওয়াতেন, ঘি, দুধ আর চিনি দিয়ে মাখা ময়দার মিষ্টি মিষ্টি পরোটা আর চিকেন চাঁপ আর সেই বিখ্যাত সেমাই। নিউমার্কেটের স্পেশাল সেমাই, যার বেধ লজ্জা দেবে নাইলন সুতোকেও। ভালো ঘিয়ে ভাজা, সাথে প্রচুর কাজু এবং কিশমিস। সবই হতো, শুধু ইফতারটাই যা কোনদিন হত না। 


 আমাদের তমলুক আপিসের উডিসি হক বাবু যখন রোজা রাখা শুরু করলেন, আমরাও মুখিয়ে রইলাম, আসুক ঈদ, তারপরই আসবে সেমাই আর পরোটা। আমি যা বলি শুভাশিস আর শান্তনু বলে তার শতগুণ। রোজ দিন গুণি আমরা, কবে আসবে ঈদ। এমনি ভাবতে ভাবতেই একদিন মনে হল, হক বাবু আমাদের যবে খাওয়াবেন, খাওয়ান, তার আগে বোধহয় আমাদের একবার ওণাকে খাওয়ানো উচিৎ। হক বাবুকে বললাম,আমরা আপনাকে ইফতার পার্টি দিতে চাই, কিন্তু আমরা এ ব্যাপারে একেবারে অনভিজ্ঞ তথা অর্বাচীন। কি দিতে হয়, কি করতে হয় সেটা আপনাকেই বলে দিতে হবে। 


হক বাবু প্রথমে লজ্জায় লাল-বেগুনি হয়ে গেলেন বটে, পরে ধীরে ধীরে বললেন,‘ম্যাডাম, আমি তো ছটা না বাজলে খেতে পারব নি। আপনারা কেন অত দেরী অবধি থাকবেন।’ এ আবার কেমন কথা। আপনার জন্য একটা দিন আমরা দেরী করে বাড়ি ফিরতে পারব না? আপনি শুধু বলুন কি কি আনতে হবে? কি ভাবে সাজাতে হবে? হক বাবু লাজুক ভাবে জানান, ‘একটু আদা, একটু ভিজে ছোলা আর খেজুর এই আর কি।’ ব্যাস? হয়ে গেল? আর ফল? ফল দিতে হয় না? আর তেলে ভাজা? আর ঠাণ্ডা কিছু? ধুর হক বাবু, আপনি দেখছি কিছুই জানেন নি গো। আপনি ছাড়ুন। 


অতঃপর আমাদের হক বাবুর জন্য, আমরা  নিজেরা মাথা খাটিয়ে বানালাম ইফতার পার্টি। রাধামণি বাজার থেকে বেছে বেছে ফল কিনে আনল অরূপ, একটা পুঁচকে কৌটো করে আনা হল কুচানো আদা আর ভিজে ছোলা। নিচের ক্যান্টিন থেকে আনানো হল, টক দইয়ের সাথে কুচানো বাদাম আর মরিচ গুঁড়ো মেশানো ওদের সেই বিখ্যাত লস্যি, বিদ্যুৎ বেকারি থেকে আনা হল, সবুজ সবুজ পুদিনা দেওয়া আলুভাজা আর কাঠি কাবাব।আয়োজন হয়তো খুবই সামান্য, কিন্তু উৎসাহ, আন্তরিকতা আর ভালোলাগাটুকু ছিল একেবারে নিখাদ। 


সাড়ে পাঁচটার পর, যখন একে একে ঝাঁপ বন্ধ করছে নিমতৌড়ির অন্যান্য দপ্তর, আমাদের দরিদ্র শ্রম দপ্তরে তখন শুরু হয়েছে ইফতারের প্রস্তুতি। আপিসের পোশাক বদলে ধপধপে ফেজ টুপি, লুঙ্গি আর পাঞ্জাবিতে সেজে  নিয়েছেন হক বাবু। মেঝেতে বিছানো হয়েছে কার্পেট, নামাজ পড়তে বসার আগে হক বাবু বলে গেলেন, " ম্যাডাম আমার ভীষণ ভালো লাগছে। কোনদিন ভাবিও নি, যে আপিস আমাকে ইফতার দেবে।" আমি ভেবেছিলাম বটে, আপিসে একটা ছোট পুজো করিয়ে নেব, একেবারে নতুন বিল্ডিং, আর যা ঝঞ্ঝাটের দপ্তর আমাদের। নিত্য লেগে থাকে অশান্তি। অর্থাভাবে আর পূজারীর অভাবে করতে পারিনি। হক বাবুকে বললাম, আপনি যখন প্রার্থনা করবেন, একটু বলে দেবেন তো। ওপরওয়ালা তো একজনই। মাধ্যম যাই হোক না কেন। একটু দেখবেন আজ্ঞে। আর ইয়ে DA র জন্যও দুয়া চাইতে ভুলবেননি যেন।

Tuesday 19 April 2022

অনির নববর্ষের ডাইরি ২০২২

 অনির নববর্ষের ডাইরি, ১৩ই এপ্রিল, ২০২২


নগর কলিকাতার থেকে একদমই অন্যরকম জীবন হেথায়। অনেক সিধাসাদা, অনেক ঢিলেঢালা। ঘড়ির কাঁটা যেন সামান্য হলেও ধীরে নড়ে হেথায়। মহানগর ছেড়ে সুদূর তাম্রলিপ্ত নগরীর নিবাসী হবার সিদ্ধান্তটা ছিল নিছক আমার একার। শৌভিকের বরং ঘোর আপত্তিই ছিল। বাড়ির পাশের বিধাননগর পোস্টিং ছেড়ে কোন পাগলে যেচে পূব মিদনাপুর যায়?


নবোঢ়া হলেও কিঞ্চিৎ  বোধগম্য হত ব্যাপারটা, বিবাহিত জীবন কেটে গেছে একযুগেরও বেশি, তারপরেও একসাথে থাকার এত আদিখ্যেতা কিসের বাপু? দিব্যি তো ছিলাম, বর কাছে না থাকলেও, ফোন তুললেই সুইগি আর জ্যোমাটো তো থাকত। রাস্তা পেরোলেই ছিল হাবিব, রিক্সায় চাপলেই পৌঁছানো যেত তুত্তুরীর স্কুলে, মস্ত স্কুল। স্কুলের মধ্যে বুড়ো চার্চ। একটা অটো ধরলেই পৌঁছে যেতাম  সিটিসেন্টার। সুইমিং ক্লাব থেকে চব্বিশ ঘন্টা খোলা জিম সবই ছিল হাতের নাগালে। অবশ্য ওসব থেকেও যে আমার কোন পরিবর্তন ঘটেছিল, তা নিন্দুকেও বলবে না। তবুও তো ছিল। তুত্তুরীর দাঁতগুলোও তো অবশিষ্ট ছিল। যদি না আসতাম এই জেলায়, অক্ষতই থাকত হয়তো- 


এই জেলায় এসে কি শিখেছেন শ্রীমতী তুত্তুরী,শিখেছেন পাঁচফোড়নকে সোমরা বলে, শিখেছে কুমড়োকে বৈতাল বলতে, পেঁপে গাছকে পিপা বলতে। চিনেছেন ওলকপি, টমেটো, ঢ্যাঁড়স, ঝিঙে, কাঁচালঙ্কা,বেগুন, হলুদ,আদার মত হরেকরকম গাছ। চিনেছেন তথা আস্বাদ করেছেন নানা ধরণের শাক। ঘরোয়া পুঁই-পালং-কলমি ছাড়াও চেখেছে সুষনি শাক, গিমে শাক, হিংচে শাক। জেনেছে কচি পটল সুস্বাদু হলেও, পলতা বেশ তিতো হয়। আর পটল গাছের শিকড় তো মারাত্মক বিষ।  


শুধু যে গাছ চিনেছে তাই নয়,নিজের হাতে সব্জি তুলতেও শিখেছে তুত্তুরী। মাটি থেকে দুহাতে উপড়ে তুলে এনেছে ওলকপি। গাছের ডাল থেকে ছিড়তে শিখেছে কচি শসা বা টমেটো, রান্নাঘর থেকে ছুরি নিয়ে গিয়ে কাটতে শিখেছে লাউ,কুমড়ো আর পুঁই শাক। শাক তুলতে গিয়ে গুচ্ছের ব্যাঙ, ফড়িং এমনকি সাপও চিনেছে বটে গুটি কয়েক। তবে তেনারাই তো আমাদের ভয়ে অস্থির। 


 তুত্তুরীর হাতে তোলা বাগানের একরাশ সব্জি নিয়ে এক মাস পরে ফিরছি নিজের শহরে। গঙ্গা পাড়ের, ধূলিমলিন, পাঁচশ বছরের বুড়ি শহরটা আজও আমার প্রিয়তমা। ক্যালেণ্ডারে লাল দাগ দেখলেই ঘরে ফেরার জন্য হাঁকপাঁক করে চিরকেলে ঘরকুনো মনটা আমার। সাঁতরাগাছি স্টেশনের জ্যাম কাটিয়ে এগোনোর সাথে সাথেই চড়তে থাকে ঘরে ফেরার উত্তেজনার পারদ। এ যেন অকাল শারদীয়া। ঝলমলে রেস্তরাঁয় ঘেরা বেলেপোল থেকে বাঁদিকে বেঁকে, ৫২র চৌরাস্তায় খানিক থমকে, ইছাপুর জলট্যাঙ্কে অর্ধচন্দ্রাকারে ঘুরে গিয়ে সোজা কদমতলা বাজার। এই পড়ন্ত সন্ধ্যাতেও এক রাশ টাটকা সব্জি আর ফলের পসরা সাজিয়ে বসেছে বাজার। দেদার বিক্রি হচ্ছে মাছ আর মুর্গি। নগর কলিকাতার বাসিন্দাদের জন্য এ অতি সাধারণ দৃশ্য হলেও, সুদূর মেদিনিপুরের উত্তমকুমার প্রতিবার মুগ্ধ হয়ে যায়। যেমন মুগ্ধ হয়ে যাই আমি। এখানে এলেই কেন জানি না, ডঃ জেকিল এন্ড মিঃ হাইডের মত, আমার ঝড়ু বাজারু সত্ত্বা লাফিয়ে বেরিয়ে আসতে চায়।


 লাল-সবুজ-কমলা আনাজ আর ফলের পাশেই স্তূপাকারে বিক্রি হচ্ছেন বিভিন্ন সাইজের দুই সহোদর-সহোদরা, শ্রীমতী লক্ষ্মী আর সবার শ্রীমান গণেশ। নববর্ষ মানেই হাওড়া শহরে হালখাতার মরশুম যে।  


“কাল দয়া করে একটু সকাল সকাল উঠো”। যার উদ্দেশ্যে বলা, তিনি হাওড়া এলেই কেমন যেন প্যাঁচা হয়ে যান। এত গল্প যে কোথায় জমিয়ে রাখে মেয়েটা কে জানে। গভীর রাত পর্যন্ত একবার দাদুর সঙ্গে গল্প চলে, আরেকবার মাম্মাম(দিদার) সাথে। প্রতিবাদ করেও লাভ হয় না, অযথা দুটো কটু কথা শুনতে হয় মায়ের কাছে। মায়ের কটু কথা তাও হজম হয়, বাবার সেন্টুটা জাস্ট অসহ্য। কিন্তু এযাত্রা আমি নিরূপায়। এক গাদা কাজ নিয়ে এসেছি, কাল সকালে একবার বড় মাসির বাড়ি ঢুঁ মারব। কি জানি কেন দুই মাসির জন্য বেশ কিছু দিন ধরেই খুব মন খারাপ। বড় দ্রুত বুড়ো হয়ে যাচ্ছে সকলে। বিকালে মাকে নিয়ে ডাক্তার দেখাতে যাব, পরশু তারাদের নববর্ষের গেট্টু আছে, তরশু আবার ফিরে যাব তাম্রলিপ্ত নগরী, তার আগে একবার ঢুঁ মেরে যাব শ্বশুরালয়ে। এক ঢিলে মারা যায় যতগুলো পাখি, এই আর কি-


আমার ঝটিকা সফরের ব্যাখ্যান শুনতে শুনতে ক্লান্ত হয়ে পড়ে বাবা, “তাহলে আর আমাদের জন্য সময় কোথায় তোর?  এত কাজ নিয়ে আসিস কেন?” 


 

কোনমতে মুখ হাতটা ধুয়েই মায়ের ফ্রিজ থেকে ডাইনিং টেবল হয়ে সাবেকি মিটশেফের যাবতীয় কৌটোবাটা হাতড়াতে থাকি আমি। বাপের বাড়িতে ফিরলেই এত খিদে পায় কেন কে জানে? মস্ত স্টিলের টিফিন কৌটো ভর্তি লাল টুকটুকে তরমুজ জারিত হচ্ছে ফ্রিজে। এমনিতে তরমুজ আমার ঘোর অপছন্দের ফল, তাও এক টুকরো মুখে দিতেই জুড়িয়ে গেল প্রাণ। আমার অভিব্যক্তি পর্যবেক্ষণ করতে করতে হাজার ওয়াটের আলো জ্বলে ওঠে আমার বৃদ্ধের মুখে। তাও জানতে চায়, “ভালো লেগেছে? মাকে বললাম, কেটে অল্প চিনি মাখিয়ে ফ্রিজে রেখে দাও।“ তরমুজে চিনি বোধহয় একমাত্র আমাদের বাড়িতেই মাখানো হয়। ডাইনিং টেবিলের ওপর সাজিয়ে রাখা বাবার পছন্দের দোকানের গুটি কয়েক মিষ্টির প্যাকেট। আমার জন্য কালো জাম আর তুত্তুরীর জন্য ওর মনপসন্দ ছানার মুড়কি। এসব কে কিনে আনল বাবা? 


প্রশ্ন করে বিরাগ ভাজন হই। বৃদ্ধ নিজেই গিয়েছিল মেয়ে আর নাতনির জন্য তাদের প্রিয় মিষ্টান্ন ক্রয় করতে। সাথে দু হাঁড়ি পুরু সর ওয়ালা লাল দইও এনেছে, যাতে দইয়ের মাথা খাওয়া নিয়ে আমাতে আর তুত্তুরীতে হাতাহাতি না করতে পারি। বেশ গর্বের সঙ্গেই জানাল বৃদ্ধ। 


বিগত শারদীয়ায় এক কষাই মার্কা ডাক্তারের তত্ত্বাবধানে এক পক্ষকালেরও বেশি হাসপাতাল বাস করে তথা শুধু স্যালাইনের ওপর বেঁচে, কেবল চেহারা খানাই অস্থিচর্মসার হয়ে গিয়েছিল তাই না, শরীরের যাবতীয় পেশি বিশেষতঃ পায়ের জোরও হারিয়ে ফেলেছিল বৃদ্ধ। বাড়িতেই হাঁটতেই পারত না কতদিন, রাস্তায় বেরানো তো ছেড়েই দিন। সেখান থেকে নিজের পায়ে হেঁটে, গলির মোড় থেকে রিক্সা পাকড়াও করে সুদূর কদমতলা বাজার থেকে এত কিছু কিনে আনা তো স্বপ্নাতীত। কি করে পারলে বাবা? জবাব একটাই, অদম্য মনের জোর। আর তুত্তুরী আর আমার জন্য অপরিসীম ভালোবাসা। 


সামনে চায়ের কাপটা নামিয়ে নাতনির হাতে তোলা আনাজপাতি দেখতে বসে মা আর তুত্তুরী। তমলুকে এসে কত রকম গাছ চিনেছে সেই গল্পের ফাঁকে ফাঁকে ওঠে সাপ আর ব্যাঙের প্রসঙ্গও। একদিনে পর পর একজোড়া লাউডগা দেখেছে তুত্তুরী,সেই গল্প শুনতে শুনতে আঁতকে ওঠে মা। আমি যে কোন এক স্বর্ণালী সন্ধ্যেয় খালি চোখে কোলা ব্যাঙকে মাটির ঢেলা ভেবে শট মেরেছিলাম, এবং তাতে ব্যাঙটা অত্যন্ত ক্রোধান্বিত হয়ে কটমট করে আমার দিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে থেকে বিড়বিড় করতে করতে লাফিয়ে পালিয়েছিল সেই গল্প শুনতে শুনতে হাসিতে গড়িয়ে পড়ে তিনজন। 


বাসন্তী পুজোর ষষ্ঠীর দিন ফুল তুলতে গিয়ে ঠিক কিভাবে ভূপতিত হয়েছি আমি, সে দৃশ্যও অভিনীত হয় আমাদের চাটুজ্জে বাড়ির দালানে। কপালে আলু থেকে থেঁতলে যাওয়া ঠোঁট হয়ে গোড়ালি মচকানো অবধি কিছুই বাদ যায়নি যার জন্য, সেই পতনের গপ্প শুনে একমাত্র পিসি ছাড়া কারো মুখে আমার জন্য একফোঁটাও সমবেদনা দেখতে পাই না আমি। আমার পতনে কি চরম আমোদিত হয় সবাই। এরা কি সত্যিই আমার আপনজন? এদের জন্যই কি আমি হাওড়া এলাম? ধুত্তেরি। শাশুড়ি মা ঠিকই বলেন মাইরি, বেঁচে থেকে কোন লাভই নেই, যা দেখছি। 

(চলবে)


অনির নববর্ষের ডাইরি (পর্ব-২) ১৪ই এপ্রিল, ২০২২


কাঁচা ঘুম ভাঙানোয় এখনও বেদম চটে আছে তুত্তুরী, ‘কেন মা কেন? তুমি একা যাও না।’ একা যেতে পারলে কি আর যেতাম না, দোলের সময় তো একাই গিয়ে হাজির হয়েছিলাম বড় মাসির বাড়ি। ও বাবা, কেউ খুশি হয়নি, আমাকে দেখে, সবার মুখে একটাই প্রশ্ন,থুড়ি অনুযোগ,‘মেয়েটাকে আনলি না কেন?’ 


মায়ে-ঝিয়ে ধরাচূড়া পরে বেরোনোর আগে, কি মনে হল, একবার ফোন করেই নি। ‘হ্যালো বড়দা। তুমি কোথায়?’ প্রশ্ন করাটা ছিল নিছক বাতুলতা মাত্র,বড়দার কতৃত্বপূর্ণ কণ্ঠস্বরকে ছাপিয়ে ভেসে আসা চলন্ত ট্রেনের ঘটাং ঘটাং শব্দ সোচ্চারে জানাল, বড়দা আপাততঃ চূড়ান্ত ব্যস্ত কর্মক্ষেত্র সামলাতে। 


 আমরা পাঁচ ভাইবোন, মাসতুতো শব্দটা কখনওই প্রবেশাধিকার পায়নি আমাদের মধ্যে। চার দাদার একমাত্র  ‘ঢিপচালতি’ গোবরগণেশ, ল্যাদাড়ু বোন  আমি। 


চারজনের সঙ্গে চার রকমের সম্পর্ক, ছোটদার সঙ্গে বয়সের ব্যবধান যাই হোক না কেন, বরাবরই ছিল খুনসুটির সম্পর্ক। মা আর বড়মাসির রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে সামনাসামনি সংঘর্ষ(পড়ুন হাতাহাতি)হত আমাদের। অত্যন্ত বাজে ছেলে ছিল মাইরি, আমার হাড় জ্বালাতে কি সব উদ্ভট, উদ্ভট দাবীই না করত ছোটদা। যাকেই পছন্দ করতাম, যাকেই সমর্থন করতাম, ঠিক তার উল্টো বা পরম প্রতিদ্বন্দীকেই বেছে নিত ছোটদা। বাইশ গজের মহারণে আমি ইন্ডিয়ার সমর্থক, তো ছোটদা পাকিস্তানের। 


সেই সব আশি নব্বইয়ের আগুনে দিন। কল্পনা করুন, বাইশ গজের বিশ্বযুদ্ধে গোটা বাড়ি ইন্ডিয়া, ইন্ডিয়া করে চিল্লাচ্ছে, আর ছোটদা একা পাকিস্তান- পাকিস্তান করছে। কেন? না আমার হাড় জ্বালাতে।  সেসব দিনে ইন্ডিয়া হারতও বাপু। দুপক্ষের ম্যাচ মানেই গোহারান হেরে, মুখ কালো করা আমি আর ৩২ পাটি দেখিয়ে পেশি ফুলিয়ে ঘুরে বেড়ানো ছোটদা। 


 আরো ছোটবেলায়,যখন ভারত-পাক বোধ আসেনি বা ক্রিকেটের প্রতি কোন টান জন্মায়নি, আমার হাড় জ্বালাতে ছোটদা দাবী করত, সবাই মানে মা-বাবা-মাসি-মেসো-দিদা-দাদারা সবাই নাকি ছোটদাকেই বেশি ভালোবাসে, আমায় নয়। অতঃপর ষড়যন্ত্রের সুরে,‘ বিশ্বাস না হলে জিজ্ঞাসা করে দেখ-’।  আর আমিও অমনি হ্যাংলার মত জনে জনে প্রশ্ন করে বেড়াতাম আমি, ‘হ্যাঁ গো, তুমি কাকে বেশি ভালোবাসো।’ সবথেকে বেশি ঝগড়া করেছি বলে হয়তো সবথেকে বেশি মন খারাপও ছোটদার জন্যই করে। কিছুদিন ছাড়া ছাড়াই ফোন করে অকারণে খানিক হ্যাজাই। আজ আর কেউ কারো হাড় জ্বালাই না আমরা, বরং পরম মমতায় রোমন্থন করি সেসব গৃহযুদ্ধের অমূল্য স্মৃতি। কি ভালোই না ছিল সেইসব দিন, আরেকবার যদি ফিরে যাওয়া, ফিরে পাওয়া যেত- 


সেজদার অন্ধ ভক্ত, অনুরাগী ছিলাম আমি। সেজদার সবকিছুই ছিল ভয়ানক অন্যরকম।রীতিমত নায়কোচিত। নিজের হাতে বাজির মসলা তৈরি করে, ঘরেই রঙমশাল, হাউই আর তুবড়ি বানাত সেজদা। যে কোন ঘরোয়া গ্যাজেট ফটাফট খুলে সারিয়ে ফেলত সেজদা। বাড়ির ইলেকট্রিক লাইনের যাবতীয় সমস্যা একা হাতে সামলে দিত সেজদা। নিছক চ্যালেঞ্জের বশে, পাতি ডট পেন দিয়ে ইতিহাস বই থেকে খাতায় নামিয়ে আনত কখনও নেতাজী তো কখনও টিপু সুলতানকে। যা করত, তাতেই সবাইকে তাক লাগিয়ে দিত সেজদা। নিজস্ব কি সব যেন ভাষা আবিষ্কার করেছিল সেজদা, অনর্গল বকে যেত সেই ভাষাতে। হাঁ করে শুনতাম আমি। 


মেজদা ছিল এবং আছে আমার সবথেকে নরম,সবথেকে  আদরের জায়গা। আমার বইয়ের আলমারির অর্ধেক জুড়ে শুধু মেজদার দেওয়া উপহার। ফি বছর বইমেলা হলেই বস্তা ভরে বই কিনে আনত মেজদা, আমার জন্য। কলেজে ভর্তি হবার লাইনে সঙ্গী হত মেজদা। চাকরির পরীক্ষার ফর্ম ফিলাপের জন্য তাড়া তাড়া সার্টিফিকেট অ্যাটেস্টেড করে এনে দিত মেজদা। আমার দাদাদের মধ্যে প্রথম মেজদার সাথেই শৌভিকের আলাপ। সে কি কেলো।  ধর্মতলায় কি যেন কাজে গিয়েছিল মেজদা, পড়বি তো পড় হাত ধরাধারি করে মুখোমুখি দেখা। একটু আগে হলেও ঠেলে সরিয়ে দিতাম,ভিড়ে মিশে যেতে বলতাম তাকে, আর তো উপায় নেই। ভেবেছিলাম কান মুলে দেবে নির্ঘাত, বদলে কি মিষ্টি করে হেসে গল্প করেছিল মেজদা। হাতে একটা সদ্য কেনা জলের বোতল ছিল, ভালোবেসে সেটাই শৌভিককে গছিয়ে দিচ্ছিল মেজদা। শৌভিকও নেবে না,মেজদাও ছাড়বে না। “একটু জল খাও ভাই।” সেদিন বাসে তুলে দিতে দিতে, আমুদে স্বরে বলেছিল শৌভিক,‘শালাটা বেশ ভালো তো।’ ভালো তো হবেই, বোনকে যে  বড্ড ভালোবাসত, আজও বাসে। আমি যাকে ভালোবেসেছি, তাকে তো মেজদা ভালোবাসবেই। আজ মেজদার ভালোবাসার গল্প? সে অন্য দিন হবে খন। দাদা-বৌদির অনুমতিক্রমে, নাহলেই কপালে দুগুণ কানমলা। 


বাকি রইল বড়দা। আপাততঃ যিনি ঘোর ব্যস্ত আপন কর্মক্ষেত্রে।  বড়দা আমার শিক্ষাগুরু। সেই ষষ্ঠ শ্রেণী থেকে রীতিমত বেত হাতে পড়িয়েছে বড়দা। আজও যেকোন ভালো বা খারাপ খবর, বাবা,শ্বশুরমশাই আর শৌভিকের পরেই যাকে ফোন করে জানাই,সে আমার বড়দা। তাই নিয়ে মেজ,সেজ বা ছোটদার কোন নালিশ কোনদিন ছিল না,নেই ও। সবাই জানে বড়দার সঙ্গে আমার সম্পর্ক অন্য তারে বাঁধা।  পেশায় ইস্টার্ন রেলের গার্ড,ভয়ানক ব্যস্ত জীবন, ভয়ানক অনিয়মিত ডিউটি আওয়ার, তার ওপর বিশাল পরিবারের বড়কর্তা, দুই পুত্রকন্যার জনক, তাও যখনিই বিপদে পড়েছি, যখনই নিঃসঙ্গ বোধ করেছি দেখেছি ঘেমো হেলমেটটা হাতে নিয়ে বড়দা এসে হাজির। 


আজ সকালে বড়মাসির বাড়ি যাবার আগে, তাই অভ্যাস বশতঃই ফোন করলাম,‘ দাদা তুমি কোথায়?’বড়দা তখন ট্রেন চালাতে ব্যস্ত। কখন বাড়ি ফিরবে দাদা, জবাব এল রাত দশটায়। ‘কাল আসবি? তাহলে গল্প করা যেত। কতদিন কথা হয় না।’ দেখা হয়না সত্যিই,দেখা করতেই তো তৈরি আমি আর তুত্তুরী, কিন্তু কাল তো বন্ধুদের গেট্টু, বললামও সে কথা। অনুরোধের স্বরে দাদা বলল,‘সন্ধ্যা বেলা আয় অন্তত?দেখ না?’ চিরদিন তো নির্দেশ দিত দাদা, এটা পড়ে রাখবি, ওটা লিখে রাখবি, চিত্রহার দেখবি না,সুপারহিট মুকাবিলা দেখবি না। আজ তিনি অনুরোধ করলে হবে? কাল বিকাল মানে, কাল বিকালেই যাব আমি। তুমি থাকবে তো দাদা? আবার ভেসে আসে মনখারাপ করা সুর,‘ দেখছি বলে, যদি কালকের দিনটা অফ দেয়।’


বেলা আড়াইটে নাগাদ বেরোলাম,মাকে নিয়ে ডাক্তার দেখাতে। গিরিশ পার্কে বসেন উনি, আমাদের বাড়ি থেকে গিরিশ পার্কের দূরত্ব গুগল ম্যাপ বলে সাত কিলোমিটারও নয়। তাতে কি? যেতে পড়ে পোস্তা আর ফিরতে পড়ে মহাত্মা গান্ধী রোড আর বড়বাজার। তাই হাতে পাক্কা একঘন্টা হাতে নিয়েই বেরোই আমরা। আজ নববর্ষের আগের বিকেল, আজ যে কি আছে কপালে কে জানে। এই অজুহাতেই যেতে চাইছিল না মা। সেই জানুয়ারিতে দেখানোর কথা ছিল,পিছোতে পিছোতে এপ্রিল হয়েছে। এবার পিছোলে, পুজোর আগে হবে কি না সন্দেহ। হে মা পুঁটে কালি, জ্যামের হাত থেকে বাঁচাও মা। রোজ তো জ্যাম হয়ই, একদিন যদি না হয়, তো কি এমন মহাভারত অক্ষুন্ন হবে মা? 

অনির নববর্ষের ডাইরি (পর্ব-৩) ১৪ই এপ্রিল, ২০২২


‘আইসক্রিম খাবে মা?’বড়দিনের ছুটিতে চিড়িয়াখানা দেখতে আসা শিশুর মত, বিস্ফোরিত তথা উল্লসিত চোখে গাড়ির জানলা দিয়ে ছুটন্ত মহানগরকে পর্যবেক্ষণ করছিল মা। খসখসে হাত দুটো কোলের ওপর আলগোছে ফেলা। বাঁ হাতের মলিন হয়ে আসা নোয়াটা ছাড়া, দুহাতে দুটো কবেকার লাল সরু পলা আর গুটি কয়েক ঝুটো সোনার চুড়ি। ছোটমাসি এলেই কিনে আনে। আর দুবোনে ভাগ করে পরে। হাতে সোনার কিছু পরো না কেন মা, প্রশ্ন করলেই নির্বিকার মুখে জবাব দেয় মা, ‘চোরে নিয়ে নেবে।’ 


নিজের ছিটেফোঁটাও যত্ন করে না মা। যৌবনে সময় পায়নি, সামর্থ্যও ছিল খুবই সীমিত। সে যুগের চিন্তাধারাও অবশ্য ছিল ভিন্নতর। আজ চাইলেই অনেক কিছু কিনতে পারে মা, সময়ও অঢেল, তবুও বদলায়নি মা। তেল, ক্রিম, ময়শ্চারাইজার ইত্যাদি অনেক কিছু কিনে দিয়েও দেখেছি, কিছুই ব্যবহার করে না মা। সব কিছুতেই অনীহা, সবেতেই ঘোর ক্লান্তি এবং অলসতা। বাবা তুলনায় অনেক সতেজ,টগবগে। জীবনের রূপ,রস,গন্ধে মাতোয়ারা। 


এটা নিয়েই কথা হচ্ছিল মায়ের ডাক্তারের সাথে। শুধু আমার মা’ই যে এমন তা নয়, আমার সমসাময়িক, আমার পরিচিত শতকরা আশি ভাগ পরিবারের একই গল্প। মায়েরা কেন যে ভোগে এত বিষাদ আর অবসাদে কে জানে? একই রকম স্থবিরতা,নিঃসঙ্গতা, ক্লান্তি থাকা সত্ত্বেও বাবারা তো দিব্যি থাকে, ফুরফুরে-।  


প্রায় নয় বছরের সম্পর্ক আমাদের। ন বছর আগে যখন মাকে প্রথম দেখাতে এনেছিলাম, তখন ইনি বসতেন বাই পাসের ধারে এক পাঁচতারা হাসপাতালে। সোডিয়াম কমে যাওয়া জনিত সমস্যার জন্য সাময়িক ভাবে সবকিছু ভুলে গিয়েছিল মা। কেমন যেন কথা বলা পুতুলের মত নিষ্পাপ, সরল হয়ে গিয়েছিল মা। মায়ের রিপোর্ট দেখে সেদিন উনি বলেছিলেন, ওষুধ খেলে কিছুটা নিশ্চয়ই উন্নতি হবে, তবে সোডিয়ামের অভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বেশ কিছু মূল্যবান কোষ, ফলে স্বাভাবিকত্বের স্থায়িত্ব বেশি দিন নয়। 


পুতুলের মত হাসিমুখের মাকে নিয়ে সেদিন চোখের জল ফেলতে ফেলতে বাড়ি ফিরেছিলাম।তুখোড় মনের জোরওয়ালা আমার বাবাও যেন কেমন অসহায় কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েছিল। সাহস দিয়েছিল কেবল আমার বর।শৌভিক তখন মগরাহাটের বিডিও, আজও মনে আছে দূরাভাষে ভেসে আসা সেদিনের শৌভিক বাণী,‘আরেঃ উনি ডাক্তার হলেও ভগবান তো নয়। সম্ভবনার কথা বলেছেন কেবল। তুই এত ঘাবড়ে গেলে ওদের কে সামলাবে? আর তুই না আস্তিক?’


সত্যিই তো, আমি আস্তিক। আমি অবশ্য, অবশ্যই আস্তিক। মাথার ওপর কেউ আছেন, যিনি দুহাতে আগলে রেখেছেন আমায় আর আমার প্রিয়জনদের একথা আমি সর্বান্তঃকরণে বিশ্বাস করি। হয়তো তাঁরই ইচ্ছায় উত্তরোত্তর উন্নতি করেছে মা। ভুলে যাওয়া তো দূরাস্ত, হৃদয় খুঁড়ে বেদনা জাগাতে দিন দিন আরোও আরোও বেশি দক্ষ হয়ে উঠছে মা। কবে আমি বা বাবা কি গর্হিত অপরাধ করেছিলাম, মুখে মুখে কবে কি চোপা করেছি আমি বা তুত্তুরী সবকিছু ইদানিং ঠোঁটের আগায় থাকে আমার মায়ের। 


আজ তো ডাক্তার ম্যাডামও বললেন, ‘দিব্যি আছেন তো।  এমনিই থাকুন। খুব ভালো থাকুন।’ মাঝে মাঝেই আমার মনে হয়, ওণার দেওয়া ওষুধগুলো নয়, আসলে উনিই হলেন আমার মায়ের ওষুধ। কি ভাবে যে মায়ের যাবতীয় সমস্যা উনি মুখ না খুলতেই অনুধাবন করেন, চূড়ান্ত সফিস্টিকেশন থাকা সত্ত্বেও আমাদের নিতান্ত ছাপোষা জীবনের তুচ্ছাতিতু্চ্ছ ঘটনাবলীর সাথে একাত্ম হয়ে গিয়ে, ঐ ক্ষুদ্র পরিসরে নিজের অনুরূপ অভিজ্ঞতা ভাগ করে নেন আমি অবাক হয়ে দেখি। আগে শুধু শাড়িই পরতেন, এখন শুধুই পশ্চিমী পোশাক পরেন। তখনও নিরাভরণ থাকতেন, আজও তাই। তবে যখন শাড়ি পরতেন, তখন শাড়ির সঙ্গে মানানসই একটা ভারি সোনার ব্রোচ লাগাতেন। একবার বলেছিলেন,‘ব্রোচটা আশা করি কেউ ছিনতাই করে নিতে পারবে না।’ 


ডাক্তারখানা থেকে হাসি মুখে গাড়িতে উঠেই আইসক্রিম খাবার প্রস্তাবটা দিয়েছিলাম। জানলার বাইরে বছরের শেষ চৈতালী বিকেল ক্রমশঃ গড়াচ্ছে সন্ধ্যার দিকে। আগ্রহী বালিকার মত মাথা নাড়ল মা। ভাড়াটে গাড়ির ড্রাইভারকে বললাম,‘একটা আইসক্রিমের দোকান দেখে একটু দাঁড়াবে ভাই? মাকে কথা দিয়েছি, আইসক্রিম খাওয়াব।’ 


সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউ এর এক পুঁচকে দোকান থেকে তিনটি আইসক্রিম কিনে গাড়িতে উঠলাম। এতক্ষণ দাঁড়িয়েই ছিল গাড়িটা, পুলিশের ভয়ে এদিক, ওদিক তাকাচ্ছিল বাচ্ছা ড্রাইভার ছেলেটি। বললাম, ‘দাঁড়িয়ে খেয়ে নাও আগে। তারপর ছেড়ো। আশা করি পুলিশ কিছু বলবে না। আজ বছরের শেষ দিন।’ মোড়ক খুলে ড্রাইভার আর আমি বেশ কয়েক কামড় মেরেও ফেললাম, মা তখনও নিজেরটা হাতে নিয়ে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। ‘কি হল খাবে না?’ চকলেট ফ্লেভারটা আগে তেমন পছন্দ করত না মা। এদিকে আমি তো চকলেট ছাড়া খাইও না, আর খাওয়াই ও না। তবে কি বদলে এনে দেব? জবাবে মা বলল,‘তোর বাবারটা কই? আর তুত্তুরীর?’ এই না হলে মা। আমি যে কবে এমন মা হতে পারব। তবে আর যাই করি মানে যতই হ্যাংলার মত, তুত্তুরীকে ছাড়া ভালোমন্দ খেয়ে নিই না কেন, একটা কাজ আমি কখনও করি না। তা হল কন্যার সাথে মিথ্যাচার। যাই খাই, বাড়িতে পা রেখেই সটান জানিয়ে দিই এবং প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হই যে অচীরেই শ্রীমতী তুত্তুরীকে তা আমি খাওয়াব। 


এবারেও জানালাম। মায়ের হ্যাংলামিতে অভ্যস্ত তুত্তুরী, নির্বিকার ভাবে বলল, ‘ঠিক আছে। মামমাম(দিদা)কে খাইয়েছ, খুব ভালো করেছ।’ এমন মেয়েকে তো ভালোমন্দ কিছু খাওয়াতেই হয়, তার সাথে আমার বাপটাকেও। আর আমার পিসি, আর শ্রীমান বুল্লু কুমার। পিসি আমার অনেক কিছুই খায় না। মাংস তো জীবনেও স্পর্শ করেনি। মাছও খুব কম খায়। এমনকি মুর্গির ডিমেও পিসির অ্যালার্জি। তবে একটা জিনিস উপরোক্ত সবাই প্রচণ্ড ভালোবাসে, তা হল মোগলাই পরোটা।


 হাঁসের ডিমের মোগলাই পরোটা একটা দোকানই করে, ছোট্ট পুঁচকে দোকান। রাত নটায় বেরোলাম মোগলাই কিনতে। ‘কিন্তু কেন?’ ফোনের ওপার থেকে ভেসে এল শৌভিকের ধমক। টোটোয় উঠে সোহাগ করে ফোন করেছি যে। কোন মতে আমতা আমতা করে, করুণ সুরে বললাম, কাল নববর্ষ তো তাই।‘তাই বলে জাঙ্ক ফুড খেতে হবে কেন?’ এ প্রশ্নের জবাব কে দেবে আমার স্বাস্থ্য সচেতন গৃহস্বামীকে। রাত নটাতেই কেমন যেন নিঝুম পুরী হয়ে উঠেছে আমাদের পাড়াটা। ক্লাবের মাঠে আড্ডারত গুটি কয় চ্যাংড়া ছাড়া, সব কিছু শুনশান। এমনকি কুণ্ডলী পাকিয়ে পথের মাঝে ঘুমিয়ে পড়েছে পাড়ার সারমেয় কুল ও। মোড়ের মাথায় অবশ্যি কিঞ্চিৎ জন সমাগম পেলাম। তবে সব দুঃখ ভুলিয়ে দিল কদমতলা বাজার। এত লোক কি সত্যিই হাওড়া শহরে থাকে? তার থেকেও বড় প্রশ্ন হল, এত লোক কি কাল সত্যিই খাসির মাংস খাবে? মাংসের দোকানের সামনে যা ভিড়, দুজন সিভিক পুলিশ হিমশিম খেয়ে যাচ্ছে। জামাকাপড়, শাড়ির দোকানেও দম বন্ধ করা ভিড়।রাত বারোটা অবধি চলবে আজ বিকিকিনি। 


 মধ্য রাত্রি অবধি জমজমাট পারিবারিক আড্ডা মেরে সবে শুয়েছি, ভেসে এল মায়ের প্রশ্নবাণ, ‘হ্যাঁ রে, কাল তোর বন্ধুরা সব আসবে তো?’ হ্যাঁ তো।  কাল আমাদের গেট্টু তো। ‘তো কারা আসবে?’ জানি না তো। এখনও কিছু ঠিক হয়নি। 'কখন আসবে?'  সেটাও তো ঠিক বলতে পারছি না। দুপুর বেলা এটুকু জানি শুধু। ক্রমশঃ বিরক্তি চড়ছে মায়ের গলায়, ‘তা খাবি কি?’ ঢোক গিললাম, জবাব একই, এখনো কিছু ঠিক নেই। কি যে হবে কাল।চৈতালিকে একবার ফোন করব কি? ঘড়ি বলছে রাত সাড়ে বারো। গালাগাল দেবে নির্ঘাত, তবে মায়ের কাছে গাল খাবার থেকে, চৈ এর গালাগাল ঢের ভালো রে বাবা।

 

অনির নববর্ষের ডাইরি (পর্ব- ৪) 


যত দূর সম্ভব, উৎকণ্ঠা, হীনমন্যতা,সম্ভ্রম আর ভয় মিশিয়ে ডাকলাম,‘মা, ইয়ে মানে তোমাদের ঝ্যাঁটা আর ন্যাতা কোথায় থাকে গো? আর ফিনাইলটাও লাগত একটু।’এমনিতেই সকাল থেকে ক্ষেপে আছেন গর্ভধারিণী। আজ নববর্ষের পূণ্য প্রভাতে যেখানে সারা বাংলা কাক ভোরে ঘুম ভেঙে, পূণ্যস্নান সেরে, ঈশ্বর তথা গুরুজনদের নববর্ষের প্রণাম, লঘুজনদের স্নেহাশিস জানানোর পর্ব সেরে ফেলেছে, সেখানে অধম আমি ঘুম থেকেই উঠেছি বেলা নটায়। 


সত্যি বলছি মাইরি, এত বেলা হয়ে যাবে আমিও বুঝতে পারিনি।ভোর ৬টা ৩২এ ডেকেছিল বটে মা, দুদিনের জন্য বাপের বাড়ি এসেও কেন এত ভোরে উঠব, এই নিয়ে এক প্রস্থ অশান্তি করে আবার ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, মেয়েকে জড়িয়ে। অতঃপর আর কি? অতি কষ্টে যখন একটা চোখ খুলে ধড়মড় করে উঠে বসলাম, ঘড়ি বলছে নটা বেজে গেছে। জানলার বাইরে প্রবল বিক্রমে দেদীপ্যমান দিনমণি। পাশের বিছানা খালি, অর্থাৎ শ্রীমতী তুত্তুরী আগেই উঠে গেছেন বহুক্ষণ আগেই। 


চোরের মত গুটি গুটি গিয়ে ডাইনিং টেবিলে বসে দেখি, রিল তুলছেন আমার কন্যা। বেশ কিছুদিন ধরেই রিল বানানোর জন্য অনুরোধ উপরোধ করছে বটে তুত্তুরী, ওর সমস্ত বন্ধুরা নাকি বানাচ্ছে, আমি ঢেঁকি গিলিনি অবশ্য। তবে আমার বৃদ্ধ বাপ যে গিলেছে, বেশ বুঝতে পারলাম। অদূরে সোফায় পাশাপাশি বসে আছে আমার মা আর আমার মেয়ে। দরজায় দাঁড়িয়ে প্রসন্ন মুখে ধূমপান করছে বাবা। মায়ের মোবাইলটা কায়দা করে ধরে তুত্তুরী বলছে,‘হ্যালো বেব্বি!কাঁইসে হ্যায়?’ মায়ের বোধহয় বলার কথা,‘একদম মস্ত।’ গতকাল থেকে লুকিয়ে চুরিয়ে বহুবার ট্রেনিং দিয়েছে তুত্তুরী। রিল বানানোর ট্রেনিং। আজ আমি ঘুমোচ্ছি দেখে সুযোগ বুঝে তার চূড়ান্ত মঞ্চায়ন হচ্ছে। মা যদিও ফেল্লু ছাত্রীর মত কিছুই বলল না, আমার দিকে একপলক ক্রুর বঙ্কিম দৃষ্টিতে তাকিয়ে, তুত্তুরী থুড়ি তার ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে শুধু হাসল। দাঁতে দাঁত চিপে তুত্তুরী বলল,‘বলো মামমাম, ‘উ কৌন হ্যায়  বেবি?’ মা তাও কিছু বলল না। বিরক্তি চেপে নিজেই পার্টটা বলে তুত্তুরী,‘উ?’ বলে ইশারায় বাবার দিকে তাকিয়ে বলে,‘উ তো হামরি দাদু হ্যায়। আ রে মোটকাঃ, ইধার আ।’ বিগত শারদীয়ায় পক্ষকাল হাসপাতাল বাস করে ফিরে বাবার চেহারা হয়েছে হাড় জিরজিরে। বেল্ট দিয়েও আর কোমরে থাকতে চাইছে না প্যন্ট গুলো। সেই নিয়ে বাবার মনোযাতনার শেষ নেই। তবুও তিনি মোটকা সেজে, সিগারেট হাতে থপথপ করতে করতে এলেন। বাকি টুকু বলার জন্য তৈরিও হল তুত্তুরী, কিন্তু সবকিছুতে জল ঢেলে উঠে পড়ল আমার মা জননী। ‘তোমরাই করো ওসব রিল মিল। আমার কি অত সময় আছে? সব লাটসাহেবেরা একে একে ঘুম থেকে উঠছেন, তাদের চা দিতে হবে তো।’  


চা, প্রাতঃরাশ খেয়ে, লক্ষ্মীমেয়ের মত স্নানার্চনা সেরে গুরুজনদের হাতে কলমে এবং ফোনে প্রণামও সেরে ফেললাম। তাও একফোঁটা প্রসন্নতা ফুটল না মাইরি মায়ের চোখে মুখে। এমনিতেই মা খচে আছে, তার ওপর আবার আজ আমাদের গেট্টু। তাও এই বাড়িতেই। 


 নিয়মিত অথবা অনিয়মিতই সই যাঁরা এই অধমের ডাইরি পড়েন, তারা সকলেই জানেন আশা করি যে আমাদের স্কুলের নাম ছিল তারাসুন্দরী বালিকা বিদ্যাভবন। আমাদের বেড়ে ওঠার দশক গুলিতে হাওড়া জেলার অন্যতম সেরা তথা নিঃসন্দেহে মেয়েদের সেরা স্কুল ছিল আমাদের বিদ্যালয়। তারাসুন্দরীর প্রাক্তণী হিসেবে আজও আমরা নিজেদের, ‘তারা’ বলে পরিচয় দিতে অত্যন্ত শ্লাঘা বোধ করি। স্কুল ছেড়েছি দুদশকেরও বেশি হতে চলল, তবুও ঢিলে হয়নি বাঁধন। আজও চৈতালীর ভাষায় আমরা ’বেঁধে বেঁধে থাকি, বেঁধে বেঁধে রাখি’ একে অপরকে। ঘর-বাইরের হাজারো সমস্যা, জটিলতা সামলে, পেশাদারী আর গার্হস্থ্য জীবনের সাম্য বজায় রেখে, কন্যা-সহধর্মিনী-মাতার  নাম ভূমিকায় পাল্লা দিয়ে অভিনয় করেও আমরা সময় চুরি করে রাখি একে অপরের জন্য।সবাই হয়তো পারি না,সবসময় হয়তো পারি না, তবুও চেষ্টা করি সরস্বতী পুজোর দিন হলুদ শাড়ি পরে বুড়ো স্কুলটায় গিয়ে হাজির হতে, চেষ্টা করি দোল পূর্ণিমার রাতে পূর্ণ চন্দ্রকে সাক্ষী রেখে সম্মিলিত ভাবে ভাঙের গ্লাসে চুমুক দিতে, চেষ্টা করি লালসাদা শাড়ি আর মাথায় সুগন্ধী জুঁই-বেলির মালা নিয়ে বাংলা নববর্ষকে বরণ করতে, সারা রাত জেগে পুজোর কলকাতায় টহল দিতে, কালি পুজোর সন্ধ্যেয় একসাথে ছানাপোনা নিয়ে বাজি পোড়াতে ইত্যাদি প্রভৃতি। 


এবারের বর্ষবরণটা পুরো ঘেঁটে গেছে শুধু আমার জন্য। প্রিয়জনদের অসুস্থতার জন্য বার বার পিছিয়ে গেছে মিলিত হবার দিনটা। শেষ পর্যন্ত যদিও আমি এসে পৌঁছেছি আমার প্রিয় শহরে, কিন্তু বাকিরা পারবে কি? সেটা জানতেই গতকাল মধ্য রাতে ফোন করেছিলাম চৈতালীকে। রাত সাড়ে বারোটায় কাউকে ফোন করে সোহাগ করতে গেলে যে রকম প্রিয় সম্ভাষণ প্রত্যাশিত, তাই পেয়েছি। সেসব সুশীল সমাজে লেখার অযোগ্য।


যদিও এতদসত্ত্বেও চৈ শুধু আমারই জন্য অত রাতে কনফারেন্স কলে ধরে ছিল প্রায় সব্বাইকে। ফলাফল খুব একটা আশাপ্রদ হয়নি। কয়েকজন রূপসী যথারীতি নিদ্রামগ্ন হয়ে ফোনই তোলেননি।  বাকিদের নানা পূর্ব পরিকল্পনা, পূর্ব নির্ধারিত হয়ে আছে। কারো বা তরল দাস্ত হচ্ছে, কেউ বা গিয়ে বসে আছেন গ্রামের বাড়ি। এমনকি আমি দিন দুয়েকের জন্য হাওড়া গেলেও যে শতেক ব্যস্ততার জাল কাটিয়ে প্রতিবার ছুটে আসে, সেই অন্তু ওরফে অন্তরাও বলল, ‘শোন না, বছরের প্রথম দিন তো, বরের সাথে না খেয়ে গেলে কি হয় বল! তবে আমি যাব। যাব বলেছি যখন, যাবই। একটু বেলা হবে এই যা।’ অন্তরার খুব তাড়াতাড়ি মানে বেলা আড়াইটে/তিনটে। বেলা হবে মানে, নির্ঘাত সন্ধ্যে বেলায় এসে হাজির হবেন তিনি। 


মোদ্দা কথা হল, আজ আমাদের গেট্টু আছে বটে, তবে কারা আসবে জানি না। কখন আসবে তাও জানি না। এমনকি, কি খাওয়া হবে সে ব্যাপারেও সম্পূর্ন অন্ধকারে আমি। বেশ কয়েকবার জানতে চেয়েছে মা, রহস্য করে এড়িয়ে গেছি। সত্যি কথাটা বললে যে কি হবে-। এখন মধ্যাহ্ন, চৈ মেসেজ করেছে দেখলাম, বেলা আড়াইটে নাগাদ আসবে। মানে তার আগে পারবে না। সঞ্চিতাকে পান আনতে বললাম,তিনি  লিখেছেন, পান আনতে অপারগ। পানের পরিবর্তে মাংস চলবে কি? কারণ তিনি শুধু আমাদের জন্যই রেঁধে আনছেন ,সুতরাং আর কিছু না থাকলেও সঞ্চিতার মাংস থুড়ি  করা মাংসটুকু অন্তত জুটবে। তুত্তুরী আর বুল্লুবাবুকে দিয়ে এক বোতল সাদা আর এক বোতল কালো কোল্ড ড্রিংকস ও আনিয়ে রেখেছি। শীতল পানীয়ের ক্ষেত্রে বড্ড বর্ণ বিদ্বেষী ব্যাটারা। কেউ সাদা ছাড়া খান না, তো কেউ কৃষ্ণের(বর্ণ) অনুরক্ত। 


বেলা সাড়ে বারোটা, সবে খাটের তলায় ঢুকেছি ঝাঁট দিতে, নীচে থেকে আমার বাপ আর আমার কন্যার যুগপৎ চিৎকার,‘ ফোন এসেছেএএএএ।’ বৃদ্ধ-বৃদ্ধার সরলতার সুযোগ যে যেমন ভাবে পারে নেয়। মায়ের কাজের দিদি নাকি প্রত্যহ দোতলা ঝাঁট দেয় আর সপ্তাহে দুদিন মোছে। এতদসত্ত্বেও আমার এই অপটু হাতেই বেরিয়েছে কয়েক কিলো ধুলো। শোবার ঘরের মেঝে জুড়ে বিভিন্ন আঙ্গিকে শ্রীমতী তুত্তুরীর পায়ের ছাপ। তিনি বিগত দুদিন স্নান সেরে ভিজে গা এবং পায়ে কোথায় কি বিভঙ্গে দাঁড়িয়েছিলেন এক ঝলক দেখলেই বোঝা যায়। তড়িঘড়ি বেরোতে গিয়ে মাথা ঠুকলাম খাটে, ফোনটাও গেল কেটে। মাঝখান থেকে ফোন দিতে আসা  শ্রীমতী তুত্তুরী আমার মাকে গিয়ে লাগলেন,‘মামমাম, মা তোমার একটা পেলমেট ভেঙে ফেলেছে।’ সত্যি বলছি ধর্মাবতার, মোট্টেই আমি ভাঙিনি। আমি তো সবকটা জানলার পর্দা কেবল সরাতে গিয়েছিলাম। তিনি স্বেচ্ছায় সটান ভেঙে আমার মাথায় পড়েছেন।


মায়ের রোষ কষায়িত নয়নের সামনে দিয়ে মাথা নীচু করে গিয়ে ফোনটা নিলাম। বাবা যদিও বলছে, ‘ভেঙেছিস বেশ করেছিস। বাপের পর্দাই তো ভাঙলি। ও ঠিক আছে।’সাধে তুত্তুরীকে বলি, আমার বাপটার কোন তুলনা নেই। রুণা ফোন করেছিল। ‘শোন না তোদের বাড়ির দরজাটা ঠিক চিনতে পারছি না।’ মানে! রুণা আসছে নাকি? কত বছর বাদে? সেই বোধহয় শেষ ১৯৯৭সালে আমাদের বাড়ি এসেছিল রুণা। তড়িঘড়ি পায়ে জুতো গলিয়ে, ‘তুই দাঁড়া, আমি তোকে নিয়ে আসছি’, বলে রোয়াকে বেরিয়ে দেখি ঠিক আমাদের দরজার সামনেই দাঁড়িয়ে চোখ গোলগোল করে তাকিয়ে আছে রুণা। ‘দ্যাখ ভুলিনি তো?’ সত্যিই ভোলেনি মেয়েটা। পঁচিশ বছর পরে, যার মধ্যে বিশ বছর এই জেলার বাইরে থেকেও ঠিক চিনতে পেরেছে আমাদের বাড়িটা। স্কুলের বন্ধুত্ব গুলো বোধহয় এমনিই হয়, মূল্যবান মদের মত। যত পুরাণ ততো দামী। 


দেখে আশ্বস্ত হলাম যে রুণাও শাড়ি পরেনি। যা চিড়বিড়ে গা জ্বালানো গরম আজ হাওড়ায়। সঞ্চিতা যদিও ভয়ানক সুন্দর একখান শাড়ি পরে হাজির হল। রোয়াকে বসে রকবাজি মার্কা গসিপ, প্রচুর ছবি তোলার ফাঁকে মা একবার জিজ্ঞাসা করল বটে, ‘তা তোরা খাবি কি?’ শুধু মাংস আর কোল্ড ড্রিঙ্কস? তাও দোতলায় গিয়ে?মায়ের দুচোখে চূড়ান্ত অবিশ্বাস। তড়িঘড়ি বলি, না না আরোও কিছু তো নির্ঘাত খাব। শ্রীমতী তুত্তুরী, বুল্লু বাবু, রুনার মেয়েও তো খাবে। আমরা অধঃপতিত বটে, তবে এতটাও নয়। রাইস বা নুডলস কিছু নির্ঘাত অর্ডার দেওয়া হয়েছে। তা অর্ডারটা দিল কে? কেন চৈতলী। নির্ঘাত অর্ডার দিয়েছে চৈ। হ্যাঁ রে চৈ খাবার কখন আসবে রে?  আকাশ থেকে পড়ে চৈতালী, ‘ধ্যার ব্যাটা। আমি আবার খাবার অর্ডার দিলাম কখন? তোকে বললাম না, আমি পুজোয় বসেছি।’ 


 শেষ পর্যন্ত খাবার এসে পৌঁছেছিল বেলা তিনটায়, আর অন্তু সন্ধ্যা ছটায়। একরাশ ভুলে ভরা বছরের প্রথম দিনের সূর্য ডুবতে ডুবতে কি জানি কি বার্তা দিয়ে গেল, হয়তো বলে গেল, চিরদিন কাহারো সমান নাহি যায়, তবে যে কটা দিন এমন ভাবে যায়, যাক না- মন্দ কি? (শেষ)

Tuesday 12 April 2022

তুত্তুরী উবাচ ১২ই এপ্রিল,২০২২

 


👧🏻-(তারস্বরে) বাবা! বাবা! শিগ্গির এসো। হনুমানটা🐒 এখেনে গুহ্য ছেড়ে যাচ্ছে!

👩🏻🧔🏻-(ঘোরতর আপিস টাইম, শ্রীমতী তুত্তুরীর নাক দিয়ে গঙ্গা যমুনা ঝড়ছে বলে আজ তাঁকে স্কুল থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। যুগলে তৈরি হচ্ছিলাম যে যার দপ্তরের জন্য। কন্যার চিৎকার শুনে পড়িমরি করে দৌড়ে গেলাম।) কই? কোথায়?

👧🏻-ঐ তো। এ ম্যা গো। 

গিয়ে দেখি, তিনি ততোক্ষণে যা ছাড়বার ছেড়ে পগার পার। তবে তা মোটেই গুহ্য নয় এটুকু বলতে পারি। 🙊

Sunday 10 April 2022

অনির ডাইরি, ৩১শে মার্চ, ২০২২

 

পট্টনায়ক কাকুকে বললাম, ‘আপনাকে তো মিউজিয়ামে সংরক্ষণ করতে হয়।’ মহানগরের বুকের ওপর তখন নামছে বাসন্তী সন্ধ্যা। নিউটাউন যাবার রাস্তার ধারে, এক সস্তা চায়ের দোকানের সামনে পেতে রাখা জীর্ণ কাঠের বেঞ্চিতে বসে চা খাচ্ছি আমরা। পট্টনায়ক কাকু আর আমি। দুজনেই ভয়ানক ‘চাতাল’। চা’টা এই মুহূর্তে আমার কাছে শুধু চা নয়, খাদ্যও বটে। আপিস টাইমের ভাত খেয়ে, অর্ধেক আপিস করে বেরিয়েছি তমলুক ছেড়ে। দিন দুয়েক ধরে এটাই আমার নৈমিত্তিক রুটিন। আগের দিন টি জাংশানের কফি খেয়েছিলাম দুজনে, পছন্দ হয়নি পট্টনায়ক কাকুর, তাই আজ ওণার মনপসন্দ মাটির ভাঁড়ে জিভ পোড়ানো চা, সাথে দুটো কড়কড়ে সুজির বিস্কুট। সামনের ব্রিজ থেকে ঝুঁকে পড়া কি যেন এক অচেনা লতার পাতার ফাঁকে লুকোচুরি খেলা সূর্যের দিকে তাকিয়ে, তপ্ত মাটির ভাঁড়ে একটা লম্বা চুমুক মেরে ভ্রু কুঁচকে বাজখাঁই গলায় জানতে চাইলেন, পট্টনায়ক কাকু, ‘কেন?’ 


‘কেন’ আবার কি? এমন মানুষ আজকালকার দিনে খুঁজে পাওয়া যায় নাকি? ভদ্রলোক পেশায় ছিলেন ডিভিসির ইঞ্জিনিয়ার আর সম্পর্কে আমাদের প্রতিবেশী। একমাত্র সন্তান সাবলম্বী হয়ে যেতেই দুম করে একদিন চাকরিটা ছেড়ে দেন পট্টনায়ক কাকু। আজকাল মর্নিং ওয়াক করেন হনহনিয়ে, বাজারওয়ালার সাথে সামান্য দরাদরির পর জমিয়ে করেন খোশগল্প, বাজার নিয়ে ফেরার পথে চায়ের দোকানের ঠেকে আরেক প্রস্থ আড্ডা মেরে বাড়ি ফিরে কম্পুটার নিয়ে বসেন জনসেবায়। আবাসনে যত নিঃসহায় বৃদ্ধ-বৃদ্ধা আছেন, যাদের কৃতি সন্তানেরা কেউ বিদেশে কেউ বা ভিনরাজ্যের গর্বিত নিবাসী, তাঁদের যাবতীয় ট্যাক্স-ইলেকট্রিক বিল-ফোন-টাটাস্কাই রিচার্জ করে দেন। এমনকি ডিসকাউন্টে ওষুধপত্রও আনিয়ে দেন বিভিন্ন ওয়েবসাইট থেকে। সন্ধ্যে বেলা কাকিমার সঙ্গে বেরোন একদফা রোমান্টিক ওয়াকে। আবাসনের সামনের চায়ের দোকান থেকে মাটির ভাঁড়ে চা খেতে খেতে সারেন প্রেমালাপ, এটা অবশ্যি আমিই বলি কেবল। ওণারা বলেন, ওগুলো নাকি মধ্যবিত্তের তেল-নুন-লকড়ির গল্প। দিনের শেষে পট্টনায়ক কাকু ঢুঁ মারেন আমার শ্বশুর তথা ওণার ভটচায সাহেবের কাছে। বিভিন্ন বিষয়ে তাত্ত্বিক আলোচনা সেরে, এক কাপ চা বা ক্ষেত্র বিশেষে এক পেয়ালা ইয়েতে তুফান তুলে শুভরাত্রি। 


৭ই মার্চ কাক ভোরে যখন আচমকা নেতিয়ে পড়লেন শাশুড়ি মা, আমাদের ঘুম ভাঙানোর আগে, প্রথম ফোনটা শ্বশুরমশাই করেছিলেন পট্টনায়ককাকুকে। আমরা ছিলাম দুই নম্বরে। তমলুক থেকে যখন ছুটতে ছুটতে গিয়ে আমরা পৌঁছালাম,দেখি বৃদ্ধ শ্বশুরমশাইকে হাত ধরে হাসপাতাল থেকে বাইরে নিয়ে আসছেন পট্টনায়ক কাকু। শাশুড়িমাকে ততক্ষণে এমারজেন্সি থেকে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে ICU। প্রিয়তমা স্ত্রীর আচমকা অসুস্থতায় যৎপরনাস্তি ঘাবড়ে গেছেন বৃদ্ধ। আমাদের অবর্তমানে তাঁকে সাহস তথা বুদ্ধি দিয়ে, হেল্থস্কিম, আধারকার্ড ইত্যাদি যাবতীয় কাগজপত্র গুছিয়ে, অ্যাম্বুলেন্স ডেকে হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিলেন ঐ পট্টনায়ক কাকুই। এমন মানুষকে যদি না মিউজিয়ামে রাখা হয়, রাখা হবে কাকে?


গল্প তো এখানে শেষ না। শুরু বলতেই পারেন। বৃদ্ধার হিমোগ্লোবিন নেমেছিল ২.৯ এ। সে যাত্রা তাঁকে মোটামুটি সুস্থ করে বাড়ি এনে, ২৪ঘন্টার দেখাশোনার লোক রেখে, পরিস্থিতি কিছুটা সামলে দিন দশেক পর, আমরা গেলাম সিমলিপাল। একদিনের সিএল আর আরেকদিনের স্টেশন লিভের অনুমতি সম্বল করে। জঙ্গলে ঢোকার আগে উভয়ের এক জোড়া বৃদ্ধ-বৃদ্ধাকে পইপই করে বলে গেলাম আমরা, মাত্র ৪৮টি ঘন্টা পরিষেবা সীমার বাইরে থাকব আমরা। সবাই যেন খুব সাবধানে থাকে এই সময়টা। তারপর তো আমরা আসছিই। 

পথশ্রমের ক্লান্তি, জঙ্গুলে গা ছমছমে নির্জনতা, ক্যাম্পের বাইরে লেপার্ড আসার গল্প, সুস্বাদু দিশী মুরগির ঝোল কিছুতেই আমার ঘুমটা জমল না সিমলিপালে। প্রথম রাতে স্বপ্ন দেখলাম, খুব খারাপ অর্থনৈতিক অবস্থায় পড়েছি আমরা। বাবা অবসর নিয়েছে, মায়ের রিটায়ারমেন্ট সামনেই, সংসার চলবে না। আমায় একটা ৬০৩৬টাকার চাকরি জোগাড় করতেই হবে। সকালে স্বপন বৃত্তান্ত শুনে শৌভিকের সেকি হাসি। ৬০৩৬ই কেন? কারণ ওটাই যে ছিল আমার প্রথম বেতন। রাইটার্সে লোয়ার ডিভিশন ক্লার্ক হয়ে ঢুকে পাওয়া প্রথম মাইনে। কড়কড়ে নতুন টাকায়। 


দ্বিতীয় রাতে স্বপ্ন দেখলাম, পলেস্তারা খসে পড়ছে আমাদের বাড়ির, যত্রতত্র গজিয়ে ওঠা আগাছা গুলো রূপান্তরিত হয়েছে মহীরুহে। ইঁট বার করা সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠতে গিয়ে আটকে গেছে আমার পা। নীচে থেকে বেদম চিৎকার করছে বাবা,মা আর পিসি আমায় উঠতেই হবে দোতলায়। কিন্তু পারছি না। ঘুম ভেঙেও কাটছিল না আতঙ্ক। রবিবার মধ্যাহ্নে জঙ্গল ছেড়ে বেরিয়ে টাওয়ার পেতেই যে যার বাড়িতে ফোন লাগালাম আমরা। ফোন পেয়ে বাবার সে কি উল্লাস,‘হ্যালো! আমরা খুউব ভালো আছি-’। ফোন ছাড়াও দিব্যি শোনা যেত। মা যদিও মিনমিনে স্বরে বলল,‘আর যাস না।’ নিশ্চিন্ত হয়ে ফোন রেখে দেখি পাশে শুকনো মুখে বসে আছে শৌভিক। 


কি হল? জবাব এল শ্বশুরমশাইয়ের ফোন বন্ধ আর ল্যান্ড ফোন বেজে গেল। বৃদ্ধ আবার ফোন বন্ধ রেখেছে কেন? কি জ্বালা। চার্জে বসাতে ভুলে গেছে নির্ঘাত। দীর্ঘশ্বাস ফেলে শৌভিক বলল,‘একটু পরে দেখছি।’ আমার তর সইলে তো। আবার করলাম। আবারও। তিনবারের বার ল্যান্ডফোনটা তুললেন শাশুড়ি মা। শৌভিক কেড়েই নিল প্রায় ফোনটা, অতঃপর,‘বাবার ফোনটা বন্ধ কেন? সে কি গো, বাবা হাসপাতালে?’


শ্বাসকষ্ট জনিত কারণে হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছে শ্বশুরমশাইকে। আর কে নিয়ে গেছেন বলুন তো? অবশ্যই পট্টনায়ক কাকু। অর্থবর্ষের শেষে আপিস ফেলে মহানগরে এসে থাকা অসম্ভব, তাই যাতায়াতই ভরসা। বড়সাহেবের অনুমতি নিয়ে দেড়টায় তমলুক ছেড়ে বেরিয়েছি আমি, ডাক্তার আসবে তিনটে নাগাদ। আগে আউটডোর পেশেন্ট দেখে তারপর কথা বলবেন ইনডোর পেশেন্টের বাড়ির লোকের সাথে। সাড়ে তিনটের মধ্যে পৌঁছালেই হল। আমাদের উত্তমকুমার যেভাবে গাড়ি চালায়, আরেকটু আগেই পৌঁছে যাব আমি। সে কথা ফোনে জানালামও পট্টনায়ক কাকুকে, উনি বললেন,‘ তাড়া কি? আস্তে সুস্থে এস। আমি তো যাবই।’ 


ডাক্তারের সাথে কথা হবার পরও বেশ খানিকক্ষণ বসতে হয়, ভিজিটং আওয়ারে বৃদ্ধকে দেখে, তাঁর অসুস্থ প্রিয়াকে তাঁর কুশল সংবাদ দিয়ে বাড়ি ফিরব। সেই ফাঁকেই আগের দিন কফি খেয়েছিলাম আমরা। আজ চায়ের পালা। চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতেই খোশগল্প হচ্ছিল। পট্টনায়ক কাকুকে বললাম, ওণার মত মানুষকে মিউজিয়ামে সংরক্ষণ করা উচিত। উনি উল্টে আমায় বললেন, কেন?‘ এটাই কি স্বাভাবিক নয়?’ মানুষ তো মানুষেরই জন্য। প্রতিবেশী হয়ে প্রতিবেশীর দুর্দিনে এইটুকু করব না? মাথা নেড়ে বললাম,। ‘স্বাভাবিকই তো। ঘোরতর স্বাভাবিক। তবে ছিল। সেই শরৎচন্দ্রের ইন্দ্রনাথ বা লালুর জমানায়। আজ এমন একটা লোক আপনি আমায় খুঁজে দেখান তো মশাই? আপনাকে সত্যিই জাদুঘরে নিয়ে গিয়ে সংরক্ষণ করা উচিত।

Friday 8 April 2022

অনির সিমলিপালের ডাইরি ২৫-২ ৭শে মার্চ, ২০২২

 অনির সিমলিপালের ডাইরি ২৫শে মার্চ, ২০২২

(প্রথম পর্ব) 


পরিকল্পনা তো ছিল ভোর রাতে বের হবার। তমলুক থেকে বাংড়িপোশি, বাংড়িপোশি থেকে যোশিপুর। যোশিপুরে পৌঁছে করাতে হবে জঙ্গলে প্রবেশের পারমিট। তুলতে হবে গাইড নিহার বাবুকে, অতঃপর শুরু হবে আমাদের দুদিনের বনবাস। যতদূর শুনেছি সিমলিপাল অরণ্যে প্রবেশের মূখ্য প্রবেশদ্বার দুটি, পিঠাবাটা (নাকি পিথাবাটা) গেট আর যোশীপুরের রামতীর্থ গেট। বারিপদার কাছে পিঠাবাটা গেটটিই অধিক জনপ্রিয়, তুলনায় কাছাকছিও। অধিকাংশ পর্যটক ও পথেই প্রবেশ এবং প্রস্থান করেন। আমাদের ট্যুর প্লানার ওরফে তমলুকের মহকুমা বিপর্যয় মোকাবিলা আধিকারিক আগেই নাকচ করে দিয়েছেন সেই প্ল্যান। আমরা বাংড়িপোশি হয়ে যোশিপুর দিয়ে ঢুকব এবং পিঠাবাটা দিয়ে বেরোব। 


আমাদের ট্যুর প্ল্যানার প্রথমেই সচেতন করে দিয়েছেন, ‘দমবন্ধ-করা জঙ্গল দেখতে পাবেন, কিন্তু জন্তুজানোয়ার দেখতে পাবার কোন প্রতিশ্রুতি বা দাবী আমি করব না।’ বিভিন্ন ট্যুরিস্ট ব্লগেও দেখলাম অনেকেই বেশ ক্ষুব্ধ, নামেই টাইগার রিজার্ভ অথচ বাঘ দেখতে পাওয়া লটারি জেতার থেকেও দুষ্কর।স্মরণাতীত কালে কেউ দেখেছে বলেও দাবী করেনি। আমরা বাঘ দেখতে চাইছিও না, আমরা শুধু দুদণ্ড একটু প্রাণ ভরে শ্বাস নিতে চাইছি। পড়ে দেখলাম অধিকাংশ পর্যটকই ঝটিকা সফরে গেছেন, ভোর ভোর পিঠাবাটা দিয়ে প্রবেশ করে সারাদিন ঘুরে, সন্ধ্যা নামার মুখে বেরিয়ে এসেছেন।আমাদের ট্যুর প্ল্যানার জানালেন,‘ওভাবে সিমলিপালকে চিনতে বা অনুভব করতে পারবেন না স্যার। সিমলিপাল বড় লাজুক, জঙ্গলে না থাকলে,এ জঙ্গল আপনার সামনে স্বমহিমায় কখনই ধরা দেবে না।’ 


উদ্দীপিত হয়ে,এক নয় দুরাতের জন্য জঙ্গলে থাকবার মনোবাসনা নিয়ে চলেছি আমরা। জঙ্গলের বাইরে লুলুং নদীর ধারে গড়ে ওঠা শৌখিন তথা গলা কাটা প্রমোদ কুটির নয়, আমরা থাকব গভীর জঙ্গলের মধ্যে বন দপ্তরের নিজস্ব নেচার ক্যাম্পে। অনলাইন বুক করাতে গেলেই পাবেন সতর্কবাণী, জঙ্গলের মধ্যে তিনটি জিনিস থেকে আপনাকে থাকতে হবে সম্পূর্ণ বঞ্চিত- প্রথমতঃ ওখানে কোন ইলেকট্রিসিটি নেই। যা আলো বা পাখা চলবে সবই জ্বলবে সৌর বিদ্যুতে। ফলে বাতানুকূল যন্ত্রের আরাম মশাই ভুলেই যান। 


দ্বিতীয়তঃ ওখানে নেই কোন টেলিফোনের টাওয়ার। ফলে অন্তর্জাল তো ছাড়ুন মামুলী ফোনও করতে পারবেন না। জঙ্গলে পা রাখার সাথে সাথেই আধুনিক সভ্যতা তথা নাগরিক জীবন থেকে সম্পূৰ্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবেন আপনি। মানসিক ভাবে প্রস্তুত হয়েই আসুন।


তৃতীয়তঃ ওখানে নেই কোন পিচ রাস্তা। গাড়ি যাবার জন্য লাল মোরামের রাস্তাই বরাদ্দ কেবল। তাতে গাড়ি নাচবেই, সেই নাচটুকু হজম করতেই হবে আপনার পিঠ এবং কোমরকে। বাড়ির গাড়ি নিয়ে আপনি যেতেই পারেন, তবে নীচু গাড়ি হলে কিন্তু মিলবেনি জঙ্গলে প্রবেশের ছাড়পত্র।মাটি থেকে অন্তত ১৮০ সেন্টিমিটার ক্লিয়ারেন্স লাগবে গাড়ির। 


এসব জানা ইস্তক শৌভিক আমাকে ক্ষেপাচ্ছে, ‘কি করে থাকবি রে, তিন তিনটে দিন? কি হবে তোর ফেসবুক, হোয়াটস্অ্যাপ, ইন্স্টাগ্রাম আর নেটফ্লিক্সের? এসব ছেড়ে তুই বাঁচবি তো?’ সমস্যা সেটা নয়, সমস্যা হল আমাদের দু জোড়া বৃদ্ধ-বৃদ্ধা।আর সবার ওপরে আমার ৮৬ বছরের পিসি। পাক্কা আড়াই তিনদিন সমস্ত যোগাযোগ রহিত থাকাটা এনাদের কারোরই তেমন মনঃপূত হয়নি বেশ বুঝতে পারছিলাম। 

যাই হোক, ভোর চারটে নাকি পাঁচটা করতে করতে শেষ পর্যন্ত আমরা বেরিয়েছি সাড়ে ছটায়। পূর্ব মেদিনীপুরের সীমানা ছাড়িয়ে ডেবরা হয়ে পশ্চিম মেদিনীপুরে ঢুকে, খড়্গপুর শহরকে সামান্য স্পর্শ করে চৌরঙ্গী দিয়ে গোল করে ঘুরে লোধাশুলি আর ক্ষেমাশুলির শালের জঙ্গলের পাশ কাটিয়ে, বহরাগোড়া হয়ে উড়িষ্যায় প্রবেশ করে যখন বাংড়িপোশিতে পৌঁছালাম তখন সময় পৌনে নয়। দু একটা ছোট অংশ বাদে মোটামুটি মখমলী হাইরোড। সাধারণতঃ পর্যটকেরা ফেরার পথে বাংড়িপোশি হয়ে ফেরেন, কিন্তু আমাদের ট্যুর প্লানার বলেছেন, বাংড়িপোশি থেকে যোশিপুরের রাস্তাটা নাকি বেশ চড়াই এবং ভয়ানক সুন্দর। পথের দৈর্ঘ্য গুগল দেখায় সোয়া দু ঘন্টা আর যোশিপুরে আমাদের জন্য প্রতীক্ষারত গাইড নীহার বাবু বলেন এক ঘন্টা। শেষ পর্যন্ত নীহার বাবুকেই যথার্থ প্রমাণ করে সাড়ে দশটার মধ্যেই যোশিপুর পৌঁছে যাই আমরা। 


বাংড়িপোশি থেকে যোশিপুর যাবার পথটা সত্যিই নয়ন জুড়িয়ে দেয়। আচমকাই পথের বাঁকে মাথা তুলে দাঁড়ায় বেঁটে বেঁটে ক্ষয়িষ্ণু পাহাড়ের দল আর তাদের পাদদেশ বরাবর অগুনতি শিমূলে পলাশে যেন হোলি খেলেছে কেউ। প্রকৃতির থেকে বড় চিত্রকর বুঝি কেউ নেই, কত যে অগুনতি রঙ পথের দুধারে। গাইড সাহেব বললেন, শিমূল থেকেই নাকি সিমলিপাল নামটার উৎপত্তি। যদিও শীতেই সবথেকে বেশি পর্যটক আসে এদিকে, তবে শিমলিপালকে দেখা তথা অনুভব করার সেরা সময় নাকি বসন্তকাল বিশেষতঃ মার্চ-এপ্রিল। শীতে জঙ্গল কেবলি সবুজ, এখন তা না না বর্ণের সমাহার। হরেকরকম গাছ চেনাতে চেনাতে নিয়ে চললেন নীহার বাবু, কমলা পলাশ, লাল শিমুল, গোলাপী কাঞ্চন তো আগেই চিনতাম, টকটকে লাল কুসুম গাছ এই প্রথম দেখলাম। জানলার কাঁচ নামিয়ে দিতেই ছুটে আসছে জঙ্গলের গন্ধবাহী দামাল হাওয়া। কোথাও তা মহুয়া ফুলের গন্ধে মাতাল কোথাও বা বকুল বা ইউক্যালিপটাস বা নাম না জানা গাছের গন্ধে বন্ধ হয়ে আসে দম। 


গাড়ি থামিয়ে পথ থেকে এক গোছা মহুয়া ফুল তুলে নিয়ে এলেন গাইড বাবু। জলে ধুয়ে বললেন, খেয়ে দেখেন না। তুত্তুরী একটা খেল, আমি দুটো। শৌভিক আর ড্রাইভার সাহেব তো ছুঁলেনই না। কি অসম্ভব মিষ্টি ফুল। খেতে অনেকটা কচি তালশাঁসের মত। হাল্কা একটা কষাটে ভাব আছে বটেক, তবে তা মুখে লাগে না। তুত্তুরী ফিসফিস করে জানতে চাইল,‘মা তোমার নেশা হয়েছে?’ সমস্বরে হেসে উঠলাম আমরা। 


এই সামান্য দুটো ফুল চিবিয়ে কারো নেশা হয় না।পাকা মহুয়া ফল থেকে কিভাবে তৈয়ার হয় নেশার জিনিস বিশদে বোঝালেন গাইড দাদা। বললেন এছাড়াও মহুয়ার তেল হয়। আগে তা রান্নাতেও ব্যবহৃত হত। মহুয়া ফুল এবং ফল যদিও বেশ সুমিষ্ট, তেলটা কিন্তু বেশ তিতকুটে হয়। তবে গরম তেলে সামান্য নুন ফেলে দিলেই কেটে যায় তার তিক্ত ভাব। তবে আজকাল আর কেউ তেমন খায় না। মূলতঃ প্রদীপ জ্বালাতে আর নানা ওষুধ,প্রসাধনী ইত্যাদি প্রস্তুতিতেই যা লাগে। জানালেন আগে গরীর মানুষ এই ঝরে যাওয়া মহুয়া ফুল তুলে শুকিয়ে রেখে দিত। ঘোর বর্ষায় যখন মিলত না কোন খাবার, ঐ গুলিকে জলে ফুটিয়ে কাত্থ বানিয়ে তার সাথে পাকা তেঁতুলের কাত্থ মিশিয়ে ফুটিয়ে খেত।উনিও খেয়েছেন শৈশবের দিনগুলিতে, জানালেন সে নাকি পুরো অমৃত। আজকাল সরকারের হাজার একটা প্রকল্পের সৌজন্যে তেমন গরিব নাকি কেউ নেই। শুনেও সুখ।





সিমলিপালে যদি আসেন এবং থাকার মনস্থ করেন, সর্বাগ্রে মাথায় রাখবেন এটা গহীন জঙ্গল। মধ্যে মধ্যে জনবসতি বলতে কয়েকটা আদিবাসী গাঁ আছে বটে, তবে দোকানপাট কিছুই নেই। তাই ব্যাগ তথা গাড়ি ভর্তি করে নিয়ে আসবেন শুকনো খাবারদাবার আর জল।যে গেট দিয়েই প্রবেশ করুন না কেন, ঢোকার আগে অবশ্যই ভর্তি করে নেবেন গাড়ির তেলের ট্যাঙ্ক। গাইড সাহেব বললেন সিমলিপালের আয়তন প্রায় নয়শ বর্গকিলোমিটার। এর মধ্যে কিছুটা পর্যটনের জন্য নির্দিষ্ট থাকলেও বাকিটা শুধুই বন্যপ্রাণীদের চারণ ভূমি। সিমলিপালের সবটুকুই প্রাকৃতিক, এখানে কোন কৃত্রিম বা মনুষ্য নির্মিত ব্যাপার পাবেন না। সিমলিপাল হল রিজার্ভ ফরেস্ট, এখানকার কোন কিছুই অন্যত্র স্থানান্তর করা যায় না। বা অন্যস্থান থেকে কোন জীবজন্তু এনে এখানে ছাড়া হয় না। ওণার ভাষায়,‘যা সিমলিপালে জন্মাবে, তা এখানেই বড় হবে এবং এখানেই মারা যাবে।’ আন্দামান বা আমাদের সুন্দরবনের মত। এই জঙ্গলের সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র তথা নিজস্ব ইকো সিস্টেম আছে। 

আমরা থাকব বড়েহিপানি নেচার ক্যাম্পে। যোশীপুর থেকে সেটা প্রায় ষাট কিলোমিটার। জঙ্গলে প্রবেশের সাথে সাথেই ঝুপ করে পড়ে গেল সব ফোনের সব টাওয়ার। গাইড দাদা বললেন, ‘ফ্লাইট মোডে করে লিন। জঙ্গল থিকে না বেরোতে পারলি, টাওয়ার আসবে না।’ জানতে চাইলাম, ফোনে চার্জ দেওয়া যাবে তো? হেসে জানালেন তা যাবে বটে। লাল মেঠো আঁকাবাঁকা পথ, একপাশে ঘন জঙ্গল আর পথের অন্য ধার দিয়ে বয়ে যাচ্ছে তিরতিরে খৈরি নদী। এই জঙ্গলের বুক চিরে নাকি বেরিয়েছে সাত-সাতটা নদী। খৈরি, বুড়িবালাম (এরা বলে বুঢ়াবলঙ্গ), ভণ্ডন, খড়কাই, দেও,সঞ্জু আর সালন্দী। এগুলো ছাড়াও আছে আরো সাত আটটা ছোট নদী। যার অন্যতম হল পলপলা বা লুলুং। 

এত অপরিসর খৈরি নদীর খাত, মধ্যে মধ্যে পড়ে আছে বড় বড় পাথর। বর্ষা নামলেই নির্ঘাত দুকুল ছাপিয়ে যায় নদী? শুনলাম তা যায় বটে, তবে তার স্থায়িত্ব বড়ই স্বল্প। অচীরেই নেমে যায় জল, তবে আজ সিমলিপালে জল বাড়লে পরশু ভাসে বালেশ্বর বা কটক। নদীর ডানদিকে গভীর জঙ্গল, তথা কোর এরিয়া। বাঘের সাকিন। ওখানে সাধারণ মানুষের পদার্পণ কঠোর ভাবে নিষিদ্ধ। এতদসত্ত্বেও যদি কেউ যায় বা গবাদি পশুকে চরতে পাঠায় এবং বাঘের পেটে যায় তাহলে সরকার দেয় না কোন ক্ষতিপূরণ। জানতে চাইলাম বাঘ কি সত্যিই আছে? উত্তর পেলাম আছে তো বটেই। সদ্য শেষ জানুয়ারীতে হয়েছে বাঘসুমারি। আমাদের গাইডদাদাও নাকি তখন তাতে অংশগ্রহণ করেছিল। খুঁজে খুঁজে বস্তাবন্দী করে পাঠাতে হয়েছিল বাঘের পুরিষ। ফলাফল এখনও জানায়নি বনদপ্তর, তবে বড় ছোট মিলিয়ে প্রায় শতখানেক বাঘ আছে বলেই ওণার ধারণা। আসার আগে পড়েছিলাম ৯৯টা বাঘ ছিল আগের সুমারিতে। তাহলে তেমন বাড়েনি বাঘের সংখ্যা? 

গাইড দাদা হতাশ সুরে জানালেন,বাড়ছে বটে আবার মারাও পড়ছে। বাঘের দাঁত, বাঘের চামড়ার লোভে মাঝেমাঝেই চোরাগোপ্তা হামলা হয় দক্ষিণ রায়ের তুতো বংশধরদের ওপর। কিছুদিন আগেই নাকি দুটো বাঘকে মেরে কারা যেন ছাল ছাড়িয়ে তাদের মাংস রান্না করে খেয়েছে। ধরা পড়ার পর, তা জাতীয় খবর হয়। আজব লাগে শুনে, এতদিন জানতাম বাঘ মানুষের মাংস খায়,মানুষও যে বাঘ খেতে পারে তা কল্পনাতীত হলেও সত্যি। শুধু কি তাই, জঙ্গলে আগুনও লাগায় মানুষ। পথে যেতে যেতে আমরা নিজের চোখে দেখলাম দূরের পাহাড়ের মাথা থেকে পাকিয়ে পাকিয়ে উঠছে ধোঁয়া। শৌভিক জানতে চাইল কারা লাগায় এ আগুন? কেনই বা লাগায়?শুনলাম ফাজলামি করতেই আগুন লাগায় মানুষ। এত বড় জঙ্গল, জঙ্গল ভর্তি শুকনো পাতা।কে কোথায় একটা জ্বলন্ত বিড়ি ছুঁড়ে ফেলল, কি একটা দেশলাই কাঠি ছুঁড়ে মারল তার হদিশ পেতে পেতেই পুড়ে যায় অনেকটা জঙ্গল। আগুন নেভানোর জন্য আইন সংশোধন করে কঠোর শাস্তির বিধান এনেছে বনদপ্তর, গড়েছে অগুনতি অগ্নি নির্বাপক টিম, যাদের কেউ খাস সরকারি কর্মচারী, কেউ বা নিছক কন্ট্রাক্টে কাজ করে। খবর পেলেই তারা দৌড়ায় অগ্নিনির্বাপক যন্ত্র নিয়ে। তবে আশার কথা একটাই যে এই সব আগুনে বড় গাছের কোন ক্ষতি হয় না। বড়জোর এক দেড় ফুটের গাছ অবধি ক্ষতির শিকার হয়। তবে তাই বা কেন হবে? 

পথে পড়া প্রথম চেক পোস্টে আগুন লাগার খবর জানিয়ে, আমরা চললাম 'মহাবৃক্ষ শাল' এর সাথে আলাপিত হতে। যদিও গোটা সিমলিপাল জুড়েই শালের আধিক্য, তবে তাদের মধ্যে সবথেকে কুলীন তথা খ্যাত হলেন মহাবৃক্ষ শাল। তাঁর কাণ্ডের বেড়ই ১৬ ফুটের বেশি, উচ্চতাতেও তেমনি,বয়স হয়েছে সাড়ে তিনশ বছরেরও বেশি। ব্রিটিশ ভারতে রেল লাইন পাতার সৌজন্যে যখন শহীদ হচ্ছে একের পর এক শাল গাছ, দিন ঘনিয়ে এল মহাবৃক্ষেরও। সে তো তখন ছিল এক মামুলি উঠতি শাল গাছ। জনা দুয়েক কুলি এসে চালাল কুঠার।জনশ্রুতি হল চালানোর সাথে সাথেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে একজন আর অপরজন পাগলের মত ছুটে পালায় কুলি বস্তিতে। কিন্তু বাঁচে না সেও। রাত পোহানোর আগেই শেষ নিঃশ্বাস ফেলে সে। তারপর থেকে আর কেউ স্পর্শ করার সাহস পায়নি এই শাল গাছটিকে। গোটা সিমলিপালের সবথেকে বুড়া গাছ হয়ে আজও মেঘেদের সাথে লুকোচুরি খেলেন তিনি। স্থানীয় লোকজন এসে দিয়ে যায় শ্রদ্ধার্ঘ্য।




বড়েইপানি নেচারক্যাম্প যাবার আগে আমরা গুড়গুড়িয়ার পাইন জঙ্গল আর অর্কিডারিয়াম ঘুরে এলাম। গুড়গুড়িয়াতেও একটা নেচার ক্যাম্প আছে। আগে এখানে হাতির সওয়ারি হত, কিন্তু ২০১৯সাল নাগাদ সাতকোশিয়ায় একটা দুর্ঘটনা ঘটে, যেখানে পোষা হাতি খেপে গিয়ে তার মাহুতকেই তুলে আছাড় মারে, তারপর থেকে বনদপ্তর হাতির সওয়ারি বন্ধ রেখেছে। সিমলিপাল প্রায় শতেক রকমের অর্কিডের নিবাস। মার্চ-এপ্রিলই হল ফুলের মরশুম। এখনও ফুল আসেনি বটে আর কিছুদিনের মধ্যেই অর্কিডে ভরে যাবে গুড়গুড়িয়ার জঙ্গল। একবার ফুল ফুটলে নাকি মাস খানেক থাকে সেই ফুল। 

গুড়গুড়িয়া থেকে বেরিয়ে আমরা যখন বড়িয়াপানি নেচার ক্যাম্পে পৌঁছালাম তখন বাজে বেলা দুটো প্রায়। চা-ব্রেকফাস্ট-লাঞ্চ-বিকালের চা-তেলেভাজা-রাতের ডিনার সবকিছুই ধরা আছে ক্যাম্প বুকিং এর সাথে। যাঁরা ডে ট্রিপে আসেন তাদের অবশ্য প্রবেশের সময় লাঞ্চের কথা জানিয়ে আসতে হয় চেক পোস্টে। ওয়াকিটকি বা রেডিওয় খবর এলে রান্না করে রাখে এরা। তবে ডে ট্রিপারদের জন্য খাবার ব্যবস্থা মূল প্রাঙ্গনের বাইরে।

বিশাল এলাকা জুড়ে নেচার ক্যাম্প। লাল মোরামের রাস্তার দুধারে শাল আর কুসুম গাছের জঙ্গল। আছে আম- কাঁঠালও। এই মরসুমে কুসুমগাছের পাতার রঙ সিঁদুরে লাল। উঁচু গাছগুলোর মাথা জুড়ে এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত চলে গেছে ঝুলন্ত ব্রিজ। ছোট ছোট লাল রঙের কটেজ। বাতানুকূল নয় বটে তাও কটেজের ভিতর গুলো প্রচণ্ড ঠাণ্ডা। ওরা বলল, রাতে নাকি আরো ঠাণ্ডা পড়ে। কম্বল গায়ে দিতে হয়। 

আগে এই বড়েইপানি নেচারক্যাম্পটা ছিল একেবারে বড়েইপানি ঝর্ণার সামনাসামনি। কিন্তু এখন পিছিয়ে এসেছে প্রায় তিন কিলোমিটার। আদিবাসী গ্রামের মধ্যে গড়ে উঠেছে নতুন নেচারক্যাম্প। সৌজন্য মাওবাদী হামলা। বড়েইপানিতে কটেজে আগুন লাগানো হয়েছিল, আর চাহালাতে তো রাতে হামলা করে চরম লুটপাট চালিয়ে পর্যটকদের বিবস্ত্র করে রেখে গিয়েছিলেন তেনারা। তারপর দীর্ঘদিন বন্ধ ছিল যাবতীয় নেচারক্যাম্প। পরে উড়িষ্যা সরকার তথা বনদপ্তর সিদ্ধান্ত নেয় যে নতুন নেচারক্যাম্প গুলো গড়া হবে গাঁ তথা জনবসতির মধ্যে। 

এই সুবিশাল জঙ্গল নাকি আদতে ছিল ময়ূরভঞ্জের রাজাদের শিকারভূমি। বৃটিশ আমলে যখন শুরু হল রেললাইন পাতা, সাথে সাথে কাটা পড়তে লাগল সিমলিপালের শালের জঙ্গলও। লাইনের কাঠের স্লিপারের জন্য শালের থেকে মজবুত গাছ আর কিই বা হতে পারে। তখন শাল গাছ কাটা, চেরা, লোড করা তথা রাজার সাথে শিকারে যাওয়া এবং অন্যান্য বিলাসব্যসনের জন্য বেশ কিছু প্রজাকে এখানে বাস করার সুযোগ করে দেওয়া হয়। রাজার থেকে পাট্টা পেয়েই এণারা এখানে বসবাস করেন। তবে বর্তমানে নাকি বন দপ্তর অফার দিয়েছে, যাঁরা জঙ্গল ছেড়ে যেতে রাজি হবে, তাদের প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনার বাড়ি আর পরিবারের পুরুষ সদস্যকে দশ লক্ষটাকা এককালীন ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে। সাথে অন্যান্য সরকারী প্রকল্পের সুযোগসুবিধার ক্ষেত্রেও মিলবে অগ্রাধিকার। আজই নাকি ১৭টি এমন পরিবার ছেড়ে যাচ্ছে সিমলিপাল অরণ্য ভূমি। 

মুখ হাত ধুয়ে বেশ খানিক পায়ে হেঁটে খাবার ঘরে গিয়ে বসলাম। খাবার বলতে সাদা প্লাস্টিকের খোপ কাটা থালায় এল মোটা চালের ভাত, গুঁড়ো বড়ি ভাজা, পেঁয়াজ লঙ্কা দিয়ে বেগুন পোড়া মাখা, মোটা মোটা করে আলুভাজা, দই-বেগুন যা অনেকটা রায়তার মত খেতে,ডুমো ডুমো করে কাটা পেঁয়াজ, প্রচণ্ড মিষ্টি গাজর আর পাকা কিন্তু সরস শশার স্যালাড, পনির-সোয়াবিন-আলু-পটল-বেগুন দিয়ে একটা পাঁচমিশেলি তরকারি, ডিমের ঝোল আর ডাল। খিদের মুখে সবই যেন অমৃত। তবে রান্না বড়ই তেল মশলা বিবর্জিত এমনকি নুনও বেশ কম। তাও অতুলনীয়। খেয়ে উঠে রেস্ট। গাইড দাদা বললেন, পাঁচটা নাগাদ বেরাব। চাহালা যাব। চাহালা হল কোর এরিয়া। যেখানে জন্তুজানোয়ার দেখতে পাবার সম্ভবনা প্রবল। তবে সন্ধ্যা ছটার পর আর ঢুকতে দেয় না। এখান থেকে বড় জোর আধঘন্টা। আমরা সাড়ে পাঁচটা নাগাদ বেরোলেই আরামসে পৌঁছে যাব। ততোক্ষণ অন্ধকার শীতল ঘরে পরম সুখের ভাত ঘুমই সই।

সিমলিপাল অরণ্য পর্যটনের অন্যতম তথা সেরা আকর্ষণ হল সন্ধ্যার চাহালা। চাহালা হল জঙ্গলের কোর এরিয়া। সামান্য ভুল লিখলাম, সিমলিপালে অনেকগুলি কোর এরিয়া আছে বটে, তার মধ্যে পর্যটকদের প্রবেশ কেবল চাহালা অবধিই সীমাবদ্ধ। বড়েয়াপানি নেচার ক্যাম্প থেকে চাহালা পৌঁছাতে লাগে চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ মিনিট। প্রথম চোটে পড়বে আদিবাসী গাঁ, দূরে ঢেউ খেলানো পাহাড়ের পটভূমিকায় নিকানো তকতকে আদিবাসী গৃহকোণ,গবাদি পশু যেমন গরু, ছাগল, ভেড়া, মুর্গি ইত্যাদি আর ঝকঝকে রমণী আর হাসিখুশি শিশুর দল, যারা গাড়ি দেখলেই হাত নাড়ায় আর ছুটে আসে। 

গরুর লোভে নাকি এখানে প্রায়ই হামলা করে লেপার্ড। কয়েকমাসের মধ্যেই নাকি আট দশটা গরু মেরেছে, এরা বলে ছোট বাঘ। দিন কয়েক আগে নাকি রাতের বেলা নেচার ক্যাম্পের পিছনেও চলে এসেছিল ছোট বাঘ। এরা অবশ্য অকুতোভয়। বলল, ‘ছোটা বাঘ তো মানুষ মারলি না। দুটো ছোটখাটো জীবজন্তু একলা পেলি মারে। তাই আজকাল সাত আটটা গরুকে একসাথে চরতে পাঠায় স্থানীয় আদিবাসীরা। 'এমন বদমাশ ছোট বাঘ গুলা যে গরু মারলি, কিন্তু গরু খাইলি না। মেরে ফেলি রেখে চলে যায়।’

আদিবাসী গাঁ ছাড়িয়ে ক্রমেই গাঢ় হয় জঙ্গল, কমতে থাকে সূর্যের দীপ্তি। দুধারে শালের ঘন জঙ্গল, তাতেই টর্চ মারতে থাকে গাইড দাদা, বলেন, সন্ধ্যা না নামলে বেরোয় না জন্তুর দল। ড্রাইভারকে বলেন খুব আস্তে চালাও, দশ কি বিশের বেশি স্পিড তুলো না। প্রথমেই চোখে পড়ল একদল কালো মুখো হনুমান। লাল মুখো পুঁচকে ফিচেল বাঁদর অনেক দেখেছি, এই প্রথম কালো মুখ হনুমান চোখে পড়ল। তবে সে গুলো মোটেই আমাদের দেখে ভয় পেল না বা পালিয়ে গেল না। কেবল পুঁচকে গুলোকে কোলে নিয়ে মা গুলোই যা 'দৌড়ে পালাইলি'। আরো এগোতেই একপাল লাজুক হরিণ, শিং তথা পেশিওয়ালা দলনেতার অনুগামী। দলনেতা যাও বা খানিক বুক ফুলিয়ে উঁকি ঝুঁকি মারল, তাঁর অনুগামীরা তো গিয়ে লুকালো গাছের আড়ালে। একটু এগোতেই রাস্তা পেরোচ্ছিল গোটা দুয়েক নীল বন মোরগ, আমাদের গাড়ি দেখে, সে কি 'পড়ি কি মরি' করে দৌড়। 




ক্রমেই কমে আসছে দিনের আলো। একটা জায়গায় এসে গাড়িটা দাঁড়িয়ে পড়ল। লেখা আছে বৃন্দাবন গেট। সামনেই একটা চেকপোস্ট, গাইড দাদা বললেন ওটা কোর এরিয়া ছেড়ে বারিপদার দিকে বেরোনোর পথ। আমাদের ডানদিকে বাঁকতে হবে। আর বললেন,' দুমিনিট দাঁড়িয়ে যান, হাতির পটি পড়ে আছে। মনে হচ্ছে কাছাকাছি হাতি এসেছে।' গাইড আর ড্রাইভার নেমে বৃন্দাবন চেকপোস্টের গার্ডের সাথে কথা বলতে গেল। গার্ড বলতে একটা পুঁচকে ছেলে তাও আমাদের মেদিনীপুরের।একগাল হেসে এগিয়ে এসে আলাপ করল ছেলেটি। বয়স সদ্য বিশের কোটায়। কি কম ও হতে পারে। দাঁতনে বাড়ি। বলল, হাতি তো এসেছে। ভোর পাঁচটার সময় বৃন্দাবনগেটে এসেছিল। ওর ধারণা রাতে আবার আসবে। বৃন্দাবনে একটা পুঁচকে জলাশয় আছে, যার মাটিতে নুন ছড়িয়ে রাখে বনদপ্তর। সেই নুনের লোভেই আসে হাতি বা অন্য বন্য জন্তু। বাইসনও আসে, তবে বেশ অনেকটা রাত করে, যখন সব গাড়ি বেরিয়ে গিয়ে নিঝুম হয়ে আসে জঙ্গল। হাতি এলে ওয়াকিটকিতে খবর দেবার অনুরোধ জানিয়ে চাহালার পথ ধরলাম আমরা। 

চাহালাতেও একটা ক্ষুদ্র জলাশয় আছে, বিশাল মাঠের মাঝে, জঙ্গলের ধার ঘেঁষে। তার মাটিতেও ছড়ানো হয় নুন। মাঠের এক কোণে রাজার বাংলো, যেখানে স্মরণাতীত কালে শিকার করতে আসতের রাজামশাই। এখন অবশ্য বনদপ্তরের উচ্চপদস্থ আধিকারিক বা সরকারের গণ্যমান্য অতিথি ভিন্ন কেউ থাকতে পারে না। মাঠের একদিক কাঁটা তার দিয়ে ঘেরা, সেখান থেকেই পশুপাখি পর্যবেক্ষণ করেন পর্যটকরা। একটা তেতলা লোহার ওয়াচটাওয়ারও আছে। 

কাঁটাতারের এপাশ থেকে টর্চ মারল গাইড দাদা, ওপারে জলাশয়কে ঘিরে থিকথিক করছে হরিণের পাল। অন্ধকারে আলো পড়লে জোনাকির মত জ্বলে তাদের চোখ। বেশ খানিকক্ষণ থেকে অন্ধকার আর টর্চের আলোয় ছবি তোলার বৃথা চেষ্টা করে বোর হয়ে গেলাম আমরা। একে একে বিদায় নিল অন্য পর্যটকরাও, রয়ে গেলাম শুধু আমরা। শৌভিক তাড়া দিল, ‘চলুন ফিরে যাই’। গাইড দাদা অত্যন্ত লজ্জা লজ্জা করে বললেন, 'একটু অপেক্ষা করে যান দাদা। রাত যত গাঢ় হবে, জঙ্গল যত শুনশান হবে, ততো বেরিয়ে আসবে জংলি জানোয়ারের দল। অন্য গাড়ি গুলাকে চলে যেতে দিন না।'

বনদপ্তরের জনৈক কর্মচারীকে পটিয়ে, চিনি, বিটনুন, মরিচ গুঁড়ো, আর লেবুর রস দিয়ে দুর্ধর্ষ কালো চা বানিয়ে খাওয়ালেন গাইড দাদা। ওই গা ছমছম অন্ধকারে, বাঁধানো কাঁঠাল গাছের তলায় বসে জংলি জন্তুর অপেক্ষা করতে লাগলাম আমরা। মাঝে মাঝে টর্চ জ্বালাই আর বিরক্ত হয়ে মাথা তুলে তাকায় হরিণের পাল। রাত সাড়ে সাতটা নাগাদ দৌড়ে এলেন গাইড দাদা, ওনার অনুরোধ মোতাবেক ওয়াকিটকিতে খবর পাঠিয়েছে বৃন্দাবন গেট, ' হাতি এসেছে। একটা নয়, দুটো নয়, চার চারটে। সাথে একটা বাচ্ছা(হাতি) ও আছে।'

বৃন্দাবন গেটে আমরা যখন পৌছালি, রাত তখন আটটা। মনে হচ্ছে যেন নিশুতি মধ্য রাত্রি। যাবার পথে গাইড দাদা বুঝিয়ে দিলেন, পথে যদি কোন হাতি পড়ে, আলো নেভাবেন না, স্টার্ট বন্ধ করবেন না, হর্ন দেবেন না এবং কথা বলবেন না। একদম চুপচাপ থাকবেন, হাতি চলে যাবে। নড়েছেন কি, বিপদ। পথে যাই হোক তেনাদের সাথে মোলাকাত না হলেও বৃন্দাবন গেটে হল। আলো নিভিয়ে কোন মতে অন্ধকারে চোখ সইয়ে আমরা দূতলা ওয়াচ টাওয়ারে যখন উঠলাম এবং গার্ড ছেলেটি তার পরিপক্ক হাতে টর্চ জ্বালালো, সমানেই কাঁটাতারের ওপারে, ক্ষুদ্র জলাশয়ের ধারে একপাল হাতি। 

আলো জ্বলে, নিভে, ফাঁকে ফাঁকে ছেলেটি গপ্প শোনায়, নুন চাটতে এসেছে হাতির পাল। বাচ্ছা হাতিটা লেপ্টে আছে মায়ের পেটের কাছে। আমরা দেখলাম প্রথম চোটে দাঁত দিয়ে লবনাক্ত মাটির চোকলা তুলল দাঁতাল দলপতি। তারপর সবাই মিলে পা দিয়ে তাকে থেঁতলে গুঁড়া করল, তারপর শুঁড়ে করে সেই ঝুরঝুরে মাটি মুখে পুরল হাতির দল। সে এক অনবদ্য দৃশ্য।

আরো কি দেখতাম জানি না, এমন সময় এসে উদয় হলেন আরো একদল পর্যটক, সঙ্গে গুটি কয়েক বাচ্ছা। ' এলিফ্যান্ট' দেখে তাদের কি পুলক।তা সোচ্চারে জানানোও হল, গার্ড ছেলেটির নিষেধ সত্ত্বেও বার বার আলো জ্বালানো হল ছবি তোলার উদ্দেশ্যে, পরিণাম এই হল যে সচেতন হয়ে গেল হাতির পাল। প্রথম চোটে আমাদের ভয় দেখাতে করা হল, পায়ের ধুপধাপ আওয়াজ, তারপর ফোঁস ফোঁস করে নিশ্বাস ফেলা, তারপর বৃংহন, সবশেষে মড়মড়িয়ে শাল গাছের ডাল ভাঙা। হল্লাবাজ পর্যটকের দল তো ভয়ে পগার পর, নিকষ আধারে অপেক্ষারত আমাদের গাইড দাদা বললেন,' এবার চলে চলুন, ওরা লুকিয়ে পড়বে এখুনি। সঙ্গে বাচ্ছা আছে না। বেশি দূর যেতে পারলি না। পথেও মিলতে পারে দেখা।' 

গোটা পথ আমরা অন্ধকার জঙ্গলে টর্চের আলো ফেলতে ফেলতে এলাম। যদি মেলে কোন বন্য জীবের দেখা। মিলল বটে, এক পাল হরিণ, হাতি আর মিলল না। কোর এরিয়া ছেড়ে আমরা যখন বেরিয়ে আসছি, পথে পড়ল গোটা তিনেক গরু।এত রাতে গরু দেখে বিকট খুশি হয়ে গেল তুত্তুরী, গাইড দাদা আবার বলতে লাগল, ‘এখানে বাঘে খেলে কোন ক্ষতিপূরণ পাবে না গ্রামবাসীরা। তবে এগুলা তো ষাঁড় বটে, ইত্যাদি প্রভৃতি।’ এমন সময় চিৎকার করে উঠল শৌভিক, 'ওটা কি, ওটা কি? বড়সড় কুকুরের থেকে একটু বড় একটা জীব, প্রায় বাঘের মত মোটা লেজ-'। ভালো করে ঠাওর করার আগেই হাওয়া। গাইড দাদা গম্ভীর ভাবে বললেন, 'ছোট বাঘ আজ্ঞে।। গরুর লোভে এইয়েছিল মনে হচ্ছে।'




নিষুতি রাতের নিকষ জঙ্গলকে পিছনকে ফেলে আমরা যখন বড়েইপানিতে ফিরে এলাম, ঘড়ি বলছে সবে রাত সাড়ে আটটা। আজ আমরা ছাড়া এত বড় নেচারক্যাম্পে রয়েছে কেবল একটাই পরিবার। সৌর বিদ্যুতে জ্বলা মিটমিটে আলোয় গোটা নেচারক্যাম্পটা যেমন যেন ভুতুড়ে রূপ নিয়েছে। এরা ভীষণ অতিথি বৎসল,এত রাতে আমরা আশা না করলেও, ওরা ঠিক দিয়ে গেল তিনকাপ জিভ পোড়ানো সর ফেলা মোটা দুধের চা আর তিন প্লেট পেঁয়াজের পকোড়া। ডিনারে গরম গরম হাতে গড়া রুটি, ফুটন্ত দিশি মোরগের ঝোল আর মোটামোটা আলু ভাজা। 


যাত্রার ধকল, রাতের জঙ্গলের কুহকিনী উত্তেজনা আর উদর ভরা সুখাদ্যে মেখে হিমেল জঙ্গুলে রাতটা যে কখন ঝুপ করে কেটে গেল। দরজার কড়া নাড়ার শব্দে যখন অতি কষ্টে খুললাম চোখের ভারি পাতা, ঘড়ি বলল সবে সকাল সাড়ে ছয়। মোটা দুধের চা আর বিস্কুট দিতে আসা ছেলেটা লাজুক আদিবাসী সুরে জানতে চাইল, ‘ব্রেকফাস্ট মে কেয়া খায়েঙ্গে-’। আমাদের 'যা খুশি'র জবাবে, সকাল নটা নাগাদ পাতে এসে পড়ল খড়মড়ে করে ভাজা বিশাল বিশাল আটার তেকোনা পরোটা, চার কুচি আলু, ষোলটা মটর আর এক বাটি জল দিয়ে বানানো জিভে জল আসা ঘুঘনি, আচার, অমলেট আর উপমা। উপমাটা বড় উত্তম বানায় এরা। সুজির সাথে নানা সব্জি আর সিমাই মিশিয়ে বেশ নোনতা-মিষ্টি একটা রগরগে ব্যাপার। পেট ভরলেও মন ভরে না। 


সাড়ে নটা নাগাদ আবার জঙ্গলে বেরোলাম আমরা। সিমলিপালের মূখ্য ট্যুরিষ্ট আকর্ষণ হল তার তিনটি ঝর্ণা- উচ্চতা অনুসারে উস্কি, জোরান্ডা আর বড়েইপানি। তিনটেতেই জল থাকে বছর ভর। এদের মধ্যে সবচেয়ে পুঁচকে হচ্ছে উস্কি। জলপ্রপাতের খুব কাছ পর্যন্ত গাড়ি যায়, গাড়ি থেকে নেমে স্বল্প দূরত্ব সরু পাহাড়ি পথে হেঁটে গেলেই আপনি উস্কির সামনে এসে পৌঁছাবেন। চাইলে আপনি স্নানও করতে পারেন। উস্কির জল গিয়ে মিশেছে ভণ্ডন নদীতে। 


সিমলিপালের সবথেকে উঁচু জলপ্রপাতটির নাম বড়েইপানি। বুড়া বলঙ্গ নদীর এই জলপ্রপাতটির জল দুধাপে নেমেছে। সব মিলিয়ে মোট উচ্চতা ১৩০৯ ফুট বা ৩৯৯মিটার। এটি ভারতের দ্বিতীয় উচ্চতম আর উড়িষ্যার উচ্চতম জলপ্রপাত, গভীর জঙ্গলের মধ্যে অবস্থিত বড়েইপানি জলপ্রপাতকে আপনাকে দূরের পাহাড়ের মাথা থেকেই দেখতে হবে, তাও কোর এরিয়ার মধ্যে তিন কিলোমিটার ঢুকে এসে। আগে এখানে থাকার অনুমতি ছিল পর্যটকদের, তবে মাওবাদী হামলার পর, সব বন্ধ। ফাঁকা, পুড়িয়ে দেওয়া কটেজগুলিতে বাঁদর আর হনুমানের বাস। 


সারা দিন জঙ্গলের মধ্যে উদ্দেশ্যহীন ভাবে কখনও পায়ে হেঁটে, কখনও বা সাইকেল চালিয়ে ঘুরে বেড়িয়ে, নেচারক্যাম্পের ঝুলন্ত ব্রিজ আর দড়ির সেতুতে বেশ কয়েকবার পারাপার করে, ক্লান্ত হয়ে ভরপেট দ্বিপ্রাহরিক আহার এবং হাল্কা বিশ্রাম সেরে আমরা আবার যখন চাহলার জন্য বেরোলাম তখন ঘড়িতে বাজে সাড়ে পাঁচ। কমতে থাকা দিনের আলো, বাড়তে থাকা রহস্যময়তা, গাছের ডালে ডালে ফিসফিস করা ভয়ানক মিষ্টি, রঙচঙে রাক্ষুসে কাঠবিড়ালী (জায়েন্ট স্কুইরেল), চিন্তিত হনুমান আর ফিচেল বাঁদরের দল। ল্যাজ গুটিয়ে ছুট্টে পালানো বনমুরগি, কান খাড়া চেনা হরিণের দল সবই ভীষণ পরিচিত। নতুন আলাপ বলতে রাস্তা পেরিয়ে যাওয়া বার্কিং ডিয়ার, এরা বলে বনছাগল। মোটেই ক্যামেরা ফ্রেন্ডলি নয় ব্যাটারা। 


সন্ধ্যে সাড়ে ছটার পর টর্চের আলোয় দেখা হরিণের দল। রাতের বেলা জোনাকির মত জ্বলে ওদের চোখ। আলো ফেললেও কেমন যেন ভেবলে গিয়ে খানিক তাকিয়ে থাকে, তারপর আবার মন দেয় নুন চাটতে। রাত বাড়তে আসে হাতির দল। তারা অবশ্য চোখে টর্চ মারলে মোটেই খুশি হয় না। বরং বেশ বিরক্ত হয়। হুঙ্কার ছাড়ে। গাইড দাদা বলে, ‘বেশি বিরক্ত করলি ওরা কিন্তু গাছ তুলে ছুঁড়ে দেবে।‘ যাদের উদ্দেশ্য বলা তাঁরা কর্ণপাতও করে না। প্রায় ১৭/১৮ জন মধ্য ৩০থেকে ৫০ এর মহিলার দল, ওয়াকিটকিতে ছড়িয়ে পড়া হাতির খবর শুনে তাদের গাইড তাদের চাহালায় নিয়ে এসেছেন। তাদের উল্লাস দেখে কে!


আধো অন্ধকারে ওয়াচটাওয়ার ছেড়ে বেশ খানিকটা পিছিয়ে এসে একটা মস্ত কাঁঠাল গাছের তলায় বসলাম আমরা। গাইড দাদা ফরেস্টেরই এক কর্মচারীকে ধরে চা বানালেন, জিভ পোড়ানো কালো চা, তাতে প্রচুর মরিচ গুঁড়ো আর সামান্য বিটনুনের তড়কায় পুরো অমৃত। দিদিমণিদের হর্ষ চায়ের উত্তাপে কিছুটা জুড়াল বটে, তার ওপর ছিল হাতি সংক্রান্ত নানা গল্প। যেমন হাতির স্মৃতিশক্তি নাকি ভয়ানক প্রখর। হাতি নাকি দারুণ গন্ধ পায়। কোন রাস্তা দিয়ে একবার গেলে, হাতি সে রাস্তা ভোলে না। কোন মানুষ হাতির ক্ষতি করলে,হাতি নাকি ঠিক তাকে খুঁজে বার করে শাস্তি দেয়। শাস্তি বলতে শুঁড়ে করে গাছ তুলে ছুঁড়ে মারা। গাছ যদি খুব শক্ত হয়, মাটি ছাড়তে না চায়, হাতিরা করে কি নিকটবর্তী জলাশয় থেকে শুঁড়ে করে জল এনে মাটি ভিজিয়ে চেষ্টা করে গাছটাকে ওপড়াতে। নুন খাবার ভয়ানক লোভ হাতির। নুন খাবার তাড়নায় মাটিতে গর্ত করে ফেলে। আর হাতি ভালোবাসে মহুয়া খেতে। আদিবাসী গাঁয়ে কোথাও যদি মহুয়া তৈরি হয়, গন্ধে গন্ধে পৌঁছে যায় হ্যাংলা হাতির দল আর দেওয়াল ফুটো করে, শুঁড় ডুবিয়ে শুষে নেয় মহুয়া। তারপর মাতাল হয়ে টহল দিয়ে বেরায় বনে বনে। 


গাইড দাদা বলল, মাতাল হলেও তাল জ্ঞান নষ্ট হয় না হাতির। কিছুদিন আগে এমনি এক মাতাল হাতি বেশ কিছু শস্য নষ্ট করছিল, তখন হাতি তাড়াতে জনা কয়েক স্থানীয় যুবক বিভিন্ন গাছের ওপর উঠে তীর চালাতে থাকে। তার মধ্যে একটা তীর সত্যিই হাতির লেগে যায়, সামান্য রক্তপাতও হয়। ব্যাস, কিভাবে যে হাতিটা বোঝে কার তীরে আহত হয়েছে সে, কে জানে। কিন্তু পাগলের মত দৌড়ে যায় সেই গাছটার দিকে, তারপর ধাক্কা মারতে থাকে বারবার। বিশাল মহীরুহ ছিল বলে ঐ ধাক্কাও সয়ে যায়। তখন হাতি করে কি দাঁত দিয়ে গাছটাকে এফোঁড়-ওফোঁড় করতে থাকে। ছেলেটা তো ভয়েই আধমরা, সবাই দূর থেকে বলে, ‘হাতি যা পারে করুক, তুই নামিস না। নামলে ও তোকে জিন্দা ছাড়লি না।‘ তারপর সন্ধ্যা নামতে নামতে হাতির মাথা বোধহয় ঠান্ডা হল বা নেশা কাটল, তখন সে আবার জঙ্গলে ঢুকে গেল। 


হাতির গল্প শুনে, হাতি দেখে, রাতের জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে পাগলের মত টর্চ মেরে লেপার্ড খুঁজতে গুঁজতে আমরা যখন বড়েইপানি নেচার ক্যাম্পে পৌঁছালাম তখন রাত নটা। আজ মেঘলা ছিল বলে সোলার ব্যাটারি বসে গেছে। কটেজ গুলো ছাড়া বাকি সবকিছু ঘুট্ঘুটে অন্ধকারে নিমজ্জিত। অনেকরাতে উঠল মরা চাঁদ, জেনারেটরের আলোয় কোন মতে ডিনার সেরে ফাঁকা চত্বরে যখন পায়চারি করছি,মনে হল আজই শেষ রাত। কাল থেকে আবার আমাদের ঘিরে থাকবে ইঁট আর কনক্রিটের জঙ্গল। কাল অপরাহ্নের মধ্যেই আবার সভ্যতায় ফিরে যাব আমরা। এসে পড়বে ফোনের টাওয়ার। ঢুকবে গুচ্ছের নোটিফিকেশন, মেসেজ আর মেল। সেটা একই সাথে কাম্য আবার অকাম্যও বটে।





নিয়ম মত, ঠিক সকাল সাড়ে ছটায় জিভ কড়া নেড়ে এসে হাজির হল জিভ পুড়ানো সর সমেত মোটা দুধের চা। অত সকলেও ঝকঝকে রোদে ভেসে যাচ্ছে চরাচর। হরেক রকম গাছের, হরেক রঙা পাতায় লুকোচুরি খেলা রোদ তৈরি করছে বিচিত্র রামধনু। আগের দিনের মতই,স্নানাদি সেরে, ঠিক নটায় আটার পরোটা, জলজলে ঘুঘনি, গরম অমলেট আর মিষ্টি উপমা দিয়ে প্রাতরাশ সেরে আমরা বেরিয়ে পড়লাম বড়েইপানি নেচার ক্যাম্প থেকে। আজ বিকালে আর ফিরে আসব না আমরা। 


 গন্তব্য বাড়ি, পথে পড়বে জোরাণ্ডা জলপ্রপাত। জোরাণ্ডা দেখে আমরা বারিপদা হয়ে ফিরে আসব তাম্রলিপ্ত নগরী। যদিও বড়েইপানি থেকে বারিপদা যাবার পথেই পড়ে জোরাণ্ডা, তবে বেশ অনেকটা ভিতরে। পৌঁছানোর পথ যথারীতি নয়নাভিরাম, কোথাও ঘন জঙ্গল, কোথাও বা ফাঁকা উপত্যকা। উপত্যকা ঘিরে ছোট ছোট আদিবাসী গাঁ। ছোট আশ্রম। কোথাও স্কুল ইউনিফর্ম পরে স্কুল যাচ্ছে কচিকাচার দল। উদ্দাম হাত নাড়াচ্ছে চলন্ত গাড়ির উদ্দেশ্যে, কোথাও বা সাইকেলে মস্ত একটা গাছের গুঁড়ি চাপিয়ে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে চার পাঁচ জন পুঁচকে ছানা সিমলিপাল মোটেই একঘেঁয়ে নয় যাই বলুন। 


জোরাণ্ডা সিমলিপালের সবথেকে জনপ্রিয় ট্যুরিস্ট স্পট। যেহেতু বারিপদা বা লুলুং থেকে মাত্র দু আড়াইঘন্টা তাই প্রচুর ডে ট্যুরিস্ট আসেন। তারওপর আমাদের মত লোকজন তো আছেই, যাঁরা জঙ্গলেই রাত্রিবাস করেছেন। তাই জোরাণ্ডায় একটু সকাল সকাল যাওয়াই মঙ্গল। মোটামুটি এগারোটার মধ্যেই জোরাণ্ডা পৌঁছালাম আমরা। তখনও বেশ ফাঁকা। উঁচু পাহাড়ের ওপর থেকে সিঙ্গল ড্রপ ওয়াটার ফল, অনেকটা মেঘালয়ের নওকালিকাই এর মত। তবে নওকালিকাই জলপ্রপাতের নীচের পুলটা যেমন টলটলে নীল, এটা তেমন নয়। সাদা বা ঘোলাটে মনে হবে। জোরাণ্ডা জলপ্রপাতকে ঘিরে গহীন জঙ্গল, আগে এখানেও একটা নেচার ক্যাম্প ছিল, মাওবাদী হামলার পর বন্ধ হয়ে যায়। 


জোরাণ্ডা থেকে পিথাবাটা গেট আসতে সময় লাগে আরো ঘন্টা দু আড়াই। এদিকে জঙ্গল যেন আরো ঘন, পাহাড় ও অনেক বেশি খাড়া। জন্তুজানোয়ার তেমন না মিললেও ময়ূর মেলে ভুরিভুরি। যত ঢলে পড়ে সূর্যি মামা, ততো বাড়ে ময়ূরদের আনাগোনা। আর কত যে বিচিত্র ফুল ফুটে থাকে এই পথে, খোলা জানলা দিয়ে হুড়মুড় করে ফুলেল সুবাস বয়ে আনে দুষ্টু বাতাস। 


পিথাবাটা গেট দিয়ে বেরিয়ে আসার পর গাইড দাদা বললেন,‘ দাদা লুলুং দেখবেন নাকি?’ পিথাবাটা থেকে আনুমানিক তিন কিলোমিটার। লুলুং নদীর ধারে গড়ে উঠেছে গোটা দুই বিলাসবহুল রিজর্ট। জঙ্গল দেখে বেরোলে বড় আলুনি লাগে সবকিছু। তবুও গেলাম আমরা,সরু পাথুরে খাত ওয়ালা প্রায় শুকিয়ে আসা নদী। একটুও ভালো লাগল না। গাইডদাদা হেসে বললেন,‘ভালো লাগলি না তো? আমি জানতাম। তবে অনেকে এসে এখেনেই থাকে কি না। আপনি সিমলিপাল দেখে যখন কলকাতায় যাবেন, লোকজন বলবে, লুলুং দেখোনি? তাহলে তো কিছুই দেখোনি। লুলুংটাই তো আসল। আমি বাঙালিদের জানি, তাই বললি, একবার দেখে লিন দাদা।’




(শেষ)

Friday 1 April 2022

তুত্তুরী উবাচ ১লা এপ্রিল, ২০২২

 


👧🏻- মা জানো তো,আমি আজ গুগল অ্যাসিস্টান্টকে জিজ্ঞেস করেছিলাম,‘তোর সিক্রেট কি রে?’ ও বলল,' আমি কক্ষনো স্নান করি না। তোর মতই দুর্গন্ধ কালু।’( প্রসঙ্গতঃ যারা জানেন না, তাদের অবগতির জন্য জানাই, দুর্গন্ধ কালু 🐕হল, কি যেন একটা কার্টুনের অন্যতম চরিত্র। যাঁর গা দিয়ে ভয়ানক বোঁটকা গন্ধ বেরোয়, এবং তিনি প্রায় শুধু বগল তুলেই, প্রতিদ্বন্দ্বীদের ঘায়েল করে দেন।)


👩🏻-ভাগ!


👧🏻- হ্যাঁ গো মা, সত্যি। আমি প্রশ্ন করলাম।,‘হোয়াটস্ ইয়োর ডার্ক সিক্রেট।’ ও বলল,‘মেনি। ফর এক্সামপল্ আই ডু নট বেদ্।’


👩🏻- (কেজো সুরে) ও চান করুক বা না করুক, তোমায় যে করতেই হবে মা। 


👧🏻-(বেজার মুখে চানঘরের দরজা অবধি পৌঁছে, আচমকা ঘুরে গিয়ে, উৎসাহী সুরে) মা তুমি সেদিন বলছিলে না, ব্যাঙ্কের পাসওয়ার্ড ভুলে গেছ, আমি একটা ভালো পাসওয়ার্ড ভেবেছি তোমার জন্য, যেটা তুমি ভুলতেই পারবে না। কি বলো তো? পাসওয়ার্ড দাও,‘মিঠুনদা, নাচুন না।’🕺🏻🕺🏻