Sunday 15 September 2019

অনির ডাইরি ১৫ই সেপ্টেম্বর, ২০১৯


“আবছায়া জানলার কাঁচ”
আকাশের রঙ ফলসা। আর রাস্তার রঙ আয়না। দুপাশের নয়ানজুলিতে মুখ দেখছে ফলসা রঙা আকাশ। নয়ানজুলি টপকালেই ধানক্ষেত। সেথায় জমে থাকা  জলের ওপর মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে গাঢ় সবুজ রঙা ধানের চারা। যেন কার্পেটের মত বিছিয়ে দেওয়া দামি সবুজ মুর্শিদাবাদ সিল্ক। মহীরুহদের জটলায় আজ অখণ্ড নিস্তব্ধতা। বুড়ো গাছগুলো কেমন যেন ভিজে জড়সড়।
এই তো আমার ভূস্বর্গ। শুধু সামনের ট্রাকটা যদি আমাদের পথ ছেড়ে দিত। এমন গদাইলস্করি চালে চলছে, গতি বেগ মেরেকেটে ৪০ হবে। হর্ন বাজিয়ে বাজিয়ে হাত ব্যথা করে ফেলল সুশান্ত। অন্য গাড়িগুলিকে দিব্যি রাস্তা ছেড়ে দিলেও, আমাদের প্রতি কিসের যে আক্রোশ কে জানে? যেদিক দিয়েই গলে বেরোনোর চেষ্টা করছি, সেদিকেই পথ আটকে দাঁড়াচ্ছে ট্রাকটা। মুষিককে নিয়ে কি এমন খেলাই খেলে মার্জার? 
ইথারে আবছা ভেসে আসছে একযুগ আগের কোন বিস্মৃতপ্রায় বন্ধুর গলা, “ রাস্তা ছাড়ছিল না জানিস। কবার আপার-ডিপার মেরেছিলাম। রাস্তা তো দিল। ছাড়িয়ে এগোতে যাব টুক করে ঠেকিয়ে তুলে দিল উল্টো দিকের লেনে। উল্টো দিক থেকে ঠিক সেই মুহূর্তেই আসছিল আরেকটা ট্রাক-। ”
বলতে গেলাম, সুশান্ত ট্রাক হল হাইওয়ের রাজা। ওকে বিরক্ত করো না। আচমকা পাশ দিল ট্রাকটা। সজোরে বেরোতে গিয়ে ধরাশায়ী কয়েকটা কমলা রঙা ট্রাফিক কোণ। অন্তিম কোনটির সামনেই ভীত সন্ত্রস্ত কটি হাবাগোবা মুখ- মুখ ছাপিয়ে নোটিশ-“মেন এট ওয়ার্ক”।

“তারারাও নাকি অভিমানী হয়-”
রাগ হচ্ছে, খুব রাগ হচ্ছে। কেন পাত্তা দিচ্ছে না বিউটি ম্যাম? আজ নিয়ে তিন তিনটে দিন, এই  তো আমার পাশ দিয়ে জলপরীর মত মসৃণ ভাবে সাঁতরে চলে গেল, চিৎকার করল না তো, “কি হল? পা কই? পা চলছে না কেন? এইটুকু যেতে এতগুলো হাত লাগছে কেন?”
কতবার বলেছিলাম, আমি তো সাঁতার জানি। শহরের অন্যতম উঠতি প্রজাপতি ক্লাবে শিখেছিলাম তো। সে অনেকবছর হল, হাজার দুয়েক টাকায় ১৫টা ক্লাশে ফ্রি স্টাইল, ব্যাক স্ট্রোক সব শিখিয়ে দিয়েছিল। তাই নিয়েই কি উল্লাস। লঞ্চ পেরোবার সময়, বার বার সাবধান করা সত্ত্বেও লাইফ জ্যাকেট নিতাম না। কি হবে? আমি তো সাঁতার জানি।

শেখার দরকার তো তুত্তুরীর। টুকটুকে লাল মনোকিনি  পরে যে বিগত আড়াই তিন মাসে শুধু খলবল করতে শিখেছে। তাকে কেউ কিছু বলে না। শুধু মাঝে মাঝে গণেশ স্যার চিৎকার করে,“থামিস না। থামিস না। জল কাউকে থামার অবকাশ দেয় না। ”

দিব্যি সাঁতার কাটতাম আড়াআড়ি এপাড়-ওপাড়। বিউটি ম্যামই তো টেনে নিয়ে গেল গভীর জলে। ৫০মিটার? আমি কি পারব? ঐ প্রান্তে গভীরতা বোধহয় ১০মিটার। জলের রঙ বিমর্ষ কালো। বড় বেশী শীতল ঐ জল। বড় গুরুগম্ভীর। বড় নিথর। কেউ যায় না। গোটা কয়েক মুস্কো সাঁতারু ছাড়া। মাঝে মাঝে দল বেঁধে বাচ্ছাগুলোকে নিয়ে যায় স্যারেরা। বড় মেয়েরা তেমন কেউই যায় না। অবশ্য তারা আর সাঁতার কাটে কোথায়। কতজন যে ছিল বিউটি ম্যামের শিক্ষানবিশ, সব ঝরে গেছে একে একে। 
১৫মিটারের মাথায় আড়াআড়িভাবে বাঁধা থাকে নাইলনের দড়ি। সেখানে থেকেই ডুব জল।  যখন প্রতিযোগিতা বা পরীক্ষা হয়, খুলে দেওয়া হয় দড়ি। জেলা, রাজ্যস্তরীয় সাঁতারু তৈরি করে লালকুঠি নেতাজী সংঘ। ট্রেনাররা শেখাতে ব্যাকুল, শিখতেই যে চায়না কেহ।

প্রজাপতি ক্লাবের শৌখিন সুইমিং পুলে শিখে আসা সাঁতারকে রীতিমত তাচ্ছিল্য করে এরা। “আমি তো সাঁতার জানি”র আত্মবিশ্বাসকে দুমড়ে মুচড়ে গুঁড়িয়ে দিয়েছে। পুরানো স্মৃতি মুছে ফেলে, নতুন করে লিখতে বাধ্য হয়েছি স্মৃতির শ্লেট।

প্রথম প্রথম বড় কষ্ট হত, দমে পারতাম না। ৫০মিটার টানা, মনে হত অসম্ভব। অথচ বিউটি ম্যাম পরশুদিন ২৪টা ল্যাপ টেনেছেন। গতকাল ৩৬টা। আজকের লক্ষ্য ৫০।

বাতাস- এক চিলতে বাতাসের জন্য হাঁকুপাকু করে হৃদপিণ্ড। দেওয়াল ধরে প্রবল হাঁপানি। দৌড়ে আসতেন বাপি দা, উনি হেড ট্রেনার। জলে নামেন না, পাড় বরাবর বাঘের মত পায়চারি করেন। কি বাজখাঁই গলা বাপরে বাপ। ছাত্রছাত্রীদের সামনেই ট্রেনারদের ধমকান। থলথলে লোক বা বাচ্ছা দেখলেই, ছড়ি হাতে ব্যায়াম করান। মহিলাদের অবশ্য সাতখুন মাপ।
“ডুব দিন। কি হল?” বাপিদার গলার আওয়াজে চমকে সত্যিই ডুবে যাই। “ফুঁ গুলো জলের ভিতরে ছাড়ুন। ডুব দিন”।  দেওয়াল ধরে ফুঃ ফুঃ করে শ্বাস ছাড়ছিলাম, ঠিক খেয়াল করেছিলেন বাপি দা।

বিউটি ম্যাম বলতেন, পরীক্ষা নেবে বাপিদা। একটু বেগড়বাই করলেই আউট। তখন ঝাড় খাবে আমার দিদিমণি।
তাও কি হয়? কেমন ৫০মিটার সাঁতারই বিউটি ম্যাম? আপনি তো ইদানিং জলেই নামতেন না। আমার পাশ দিয়ে হেঁটে হেঁটে যেতেন। উল্টোদিক থেকে আসা মুস্কো সাঁতারুর সাথে ধাক্কাধাক্কি হবার সম্ভবনা দেখলে তখন ঝপাং করে ঝাঁপিয়ে পড়তেন।

কেমন ডাইভ দিতে শেখালেন আপনি? প্রথমে বসে ঝপাং করে ঝাঁপিয়ে পড়া, ক্রমে ক্রমে দাঁড়িয়ে। সত্যি বলছি বিউটি ম্যাম, প্রথম দিকে খুব লাগত। মনে হত গালে সাঁটিয়ে চড় মারছে জল। তবে মজাও হত খুব। ওয়ান-টু-থ্রি রেডি? ঝপাং করে ঝাঁপিয়ে পড়তাম দিদিমণি আর ছাত্রী। লাল টুকটুক তুত্তুরী হাঁ করে দেখত। প্রথম বার ডাইভ দেবার সময় মনে হয়েছিল, সর্বনাশ, শ্যালো হ্যালের কেস হবে না তো? আমি জলে, আর জল গ্যালারিতে? আপনাকে বলেছিলাম।  শুনে আপনার  কি হাসি। মনে আছে?

আর জলে সাইক্লিং শেখানো? কতবার যে আপনি বলতেন,“পা তোলো। লাথি মারো। ” তাও আবার তেরচা করে। শুধু লাথি আর চড় মেরে নিজেকে উল্লম্ব ভাবে ভাসিয়ে রাখা বেশ চ্যালেঞ্জিং যাই বলুন। বললাম নর্মাল সাইক্লিং করি? বাপিদার কি কিছুই নজর এড়ায় না?“ এই দেখুন, দুই হাঁটুর ওপর ভর দিয়ে শরীরটাকে নীচু করুন। করুন। এবার পাটাকে পেটের কাছে টেনে এনে লাথি মারুন। অ্যায়। এই ভাবে। ” লোকটাকে কে বোঝাবে, ডাঙায় ওটা আমিও করতে পারি। কিন্তু জলে করা এত সহজ?

বারবার ডুবে যেতাম। তাও আপনি ছাড়েননি। নখ দিয়ে আমার নীলচে কস্ট্যুমের প্রান্ত ধরে থাকতেন, আর বলতেন,“করো। এইতো ধরে আছি ডুববে না। ”
এতভালো দিদিমণি আমার, বয়সে হয়তো আমার বয়সী বা একটু ছোট বা বড়ই হবে, তবুও দিদিমণি তো।
সেই দিদিমণি আমার শুনলাম লাইফ সেভার হবে। জলে ডুবতে বসা মানুষের কুঁকড়ে যাওয়া ফুসফুসে ভরে দেবে টাটকা মুক্ত বাতাস। জলের নীচে মাথা ডুবিয়ে দম ধরে রাখা প্রাকটিশ করছিল বিউটি ম্যাম। বাপিদা একটা চেয়ার টেনে বসলেন। কাকে যেন বলছেন,“ডুবুরিরা তো অক্সিজেন নিয়ে নামে। এদের ওসব লাগে না। এরা এমনি একদমে জেটির তলায় এফোঁড় ওফোঁড় করে দেবে। ”
কে যেন জানতে চাইল, জেটির তলা কেন? বাপিদা আবেগহীন স্বরে বললেন,“লাশগুলো তো জেটির তলায়ই আটকে থাকে। যখনই কেউ ডুবে যায়, আগে আসেপাশে যত জেটি আছে, তাদের তলাগুলো খোঁজা হয় তন্নতন্ন করে-। ”

“কাঁচামিটে ছোঁয়া দিয়ে মাপি মন-
ছোট কাগজের ভিড়ে ছাপি মন”
জলের ভিতর দিয়ে ভেসে এল টুকরো টুকরো ছবি, জানুয়ারী মাস। মেলার শেষ দিন। স্টলে স্টলে উপচে পড়া ভিড়। খুশির আমেজ মাখিয়ে ডুবছে কমলাটে সূর্য। দুটি ছেলে ছুটে এল,“ম্যাডাম, আমাদের স্টলেও একটু আসতে বলুন না। কেউ আসছে না। ” কোন স্টল? শুনলাম সিভিস ডিফেন্স। 
তোমাদের স্টল তো ফাঁকা ছিল। সকাল থেকে কোথায় ছিলে হে বাপু? “ঐ যে ম্যাডাম, গিয়েছিলুম। দুটি ছেলেমেয়ে ডুবে গিয়েছিল তো। তাদের খুঁজতে। ” পেয়েছো? “হ্যাঁ ম্যাডাম পেয়েছি। ছেলেটাকে শ্রীরামপুরের ঘাটে। জেটির তলায় আটকে গিয়েছিল। মাছে খানিক খুবলে খেয়ে নিয়েছে। ” কেঁপে উঠে জানতে চাইলাম, আর মেয়েটাকে? জবাব পেয়েছিলাম, মেয়েটাকে মাছে খায়নি। আর প্রশ্ন করার সাহস হয়নি।
বেল বাজছে। এবার শুরু হবে দৈনন্দিন কর্মযজ্ঞ। কারো স্কুল, তো কারো চাকরগিরি। জমতে থাকা ধুসর অভিমানকে নেতাজী সংঘের ঘোলাটে নীল জলে ভাসিয়ে দিয়ে উঠে পড়লাম। অল দা বেস্ট বিউটি ম্যাম। খুব ভালো করে পরীক্ষা দেবেন-। 

Tuesday 3 September 2019

অনির ডাইরি ২২শে মে, ২০১৯

মা, হওয়া কি মুখের কথা? না বাপু, মোটেই মুখের কথা নয়। যেমন ধরুন, কি কুক্ষণে,যে তুত্তুরীকে বলেছিলাম, হৃদপিণ্ডের যে প্রচলিত প্রতীক, তা আসলে মানুষের পশ্চাৎদেশের উল্টানো প্রতিবিম্ব। মানে আমরা যাদের ভালোবাসি, শুধু তাদেরই নয়, ঘোরতর অপছন্দের পাত্র/পাত্রীকেও আমরা প্রয়োজন বিশেষে “হার্ট” পাঠাতে পারি। ফলশ্রুতি? আমার গোটা গায়ে, গোটা পাঁচেক বিভিন্ন বর্ণের হৃদপিণ্ডর ছবি জ্বলজ্বল করছে। অপরাধ? তুত্তুরীকে পর্যায়ক্রমে বকা, পড়তে বসতে বলা এবং গর্হিততম অপরাধ হল, তুত্তুরীর ভাগের তিনটি চকোলেট সাবাড় করে দেওয়া।
এখন আপনি বলতেই পারেন, এসব অসভ্য কথা, নিজের শিশুকন্যাকে শেখানোর কি দরকার ছিল বাপু? ওতো ছেলেমানুষ, তুমি বলবে, আর ও শিখলেই দোষ? কারণটা, ঐ যে বললাম মা হওয়া কি মুখের কথা? মোবাইল খোলার উপায় নেই মাইরি। যাই দেখতে বসি, যাকেই মেসেজ করতে বসি, যেই ফোন করুক, তিনি নিঃশব্দ চরণে পিছনে এসে দাঁড়াবেন। “কে ফোন করেছে?” “কি বলল?” “তুমি ঐ কথা বললে কেন?” “তুমি হাসলে কেন?” হরি হে মাধব, চান করব না গা ধোব! শৌভিককে এসব প্রশ্ন করে, বিশেষ সুবিধা হয় না, সদ্য জন্মানো বেড়াল বা কুকুরছানার মত ঘাড় ধরে, ঘর থেকে বার করে দেয়। মা হয়ে তো আর, অগত্যা-। তেমনি কোন ইংরাজি সিরিয়াল দেখার সময়, তিনি আমার ঘাড়ের ওপর দিয়ে হামলে পড়ে ছিলেন। তলার সাবটাইটেল দেখে খানিকটা বুঝেছিলেন, বাকিটা অবশ্য এই অধমই-।
আরো যে কত রকমের প্রশ্নাবলীর সম্মুখীন হতে হয়, “ছেলে হয়ে, ছেলেকে চুমু খাচ্ছে কেন?” “ছেলেতে- ছেলেতে বিয়ে হয় নাকি?” “ জন যে স্যামকে বিয়ে করল, ওদের বেবি হলে, কে বাবা হবে, আর কে মা?” “যেমন সারোগেট মাদার হয়, তেমনি সারোগেট ফাদার হয়?” “মা হলে তো উম্ব ভাড়া দেয়, সারোগেট বাবারা কি ভাড়া দেয়?”  “পেনি বিয়ের সময় অত মোটা হয়ে গেল কি করে? কি বললে? বেবি হবে? ওর তো এখনও বিয়েই হয়নি। বিয়ে না হলে, কারো বেবি হয়?” “ হয়?” “তাহলে তুমি খামোকা বাবাকে বিয়ে করতে গেলে কেন?”
শুধু কি তাই? তুত্তুরীর জ্বালায় ঘনঘন মোবাইলের পিন বদল করতে হয় আমাদের। ঈশ্বরের দিব্যি, আমাদের মোবাইলে কোন উল্টোপাল্টা জিনিসপত্র পাবেন না। বন্ধুবান্ধবদের পাঠানো ইল্লি মার্কা ইয়ে আমরা পারতপক্ষে ডাউনলোডই করি না। করলেও, একে অপরকে পাঠিয়েই ডিলিট। তবু ঘনঘন বদলাতে হয় কোড। উপায় কি? বছর চার পাঁচ আগের, কোন এক মধ্য রাতে, যখন শৌভিক এবং আমি গভীর নিদ্রামগ্ন, তুত্তুরীর কোন অজ্ঞাত কারণে নিদ্রাভঙ্গ হয়, এবং আমাদের সম্পূর্ণ অজ্ঞাতে জনৈক বড় সাহেবকে তুত্তুরী মেসেজ পাঠায়, “ইলেকট্রিক শক”।সাথে ২৫খানা ইমোজি। তখনও হোয়াটস অ্যাপে মেসেজ ডিলিট করা যেত না, নেহাত তিনি অত্যন্ত সহৃদয় ব্যক্তি, ঈশ্বর তাঁর মঙ্গল করুন। কিন্তু এই টেনশন নিয়ে বাঁচা যায়? আমরা নতুন কোড দি, আর মোবাইলের ওপর আঙুলের নাড়াচাড়া দেখে তুত্তুরী বুঝে যায়, নতুন কোড কি-।
মা হওয়া মোটেই মুখের কথা না, যেমন ধরুন, আপনি একদিক থেকে ঘরদোর সাফ করবেন, অন্যদিক থেকে অবিশ্বাস্য দ্রুততার সঙ্গে তাকে পুনরায় পূতিগন্ধময় করে তুলবে তুত্তুরী। সত্যি বলছি, জুতো রাখার র‍্যাক থেকে ওয়াশিং মেসিনের মাথা পর্যন্ত থরে থরে সাজানো, তুত্তুরীর বই, খাতা, খেলনা এবং পুতুল। দাঁড়ান, দাঁড়ান, গোটা পুতুল ভাবলেন নাকি? না মশাই। কোথাও পুতুলের মুণ্ডু পাবেন, কোথাও ধড়। কোথাও কিছুই পাবেন না, এক দু পাটি চপ্পল পাবেন কেবল।  আর পাবেন, ক্লাশ শেষে স্কুলের মাটি থেকে কুড়িয়ে নিয়ে আসা গুচ্ছ-গুচ্ছ, গুড়ি-গুড়ি পেন্সিল এবং রাবার। সবকটিই ব্যবহারের সম্পূর্ণ অযোগ্য, তবুও, ঐ গুলির প্রতি তুত্তুরীর যে কি অপরিসীম মায়া। এছাড়াও পাবেন, আমার বাতিল করে দেওয়া বিবর্ণ ঝুটো গয়নাগাটি এবং কয়েকশ পেস্তার খোলা। ক্র্যাফট বানাবে তুত্তুরী, তাই যত্ন করে জমিয়ে রেখেছে। মাঝে মাঝেই গোনাগাঁথা করে দেখে, কিছু হারায়নি তো? আরও পাবেন শেষ হয়ে যাওয়া কয়েক ডজন স্কেচ পেন, যে গুলি, সময় বিশেষে দেওয়ালে ঘষে দেখা হয়,রঙ সত্যিই শুকিয়ে গেছে কি না। নতুন কোন শব্দ শিখলেও আগে তা দেওয়ালে লেখে তুত্তুরী। মাঝে মাঝে পুরানো পড়াও কি সুন্দর দেওয়ালে লিখে অভ্যাস করে। ঐ জিনিসটাই খাতায় লিখতে বলুন, দেখি-। কি বাজে লোক মশাই আপনি। অখাদ্য। ঠিক তুত্তুরীর মায়ের মত। শুধু পড়া নয়, মাঝে মাঝে ছবিও আঁকে তুত্তুরী। অবশ্যই দেওয়ালে। ভালো না হলে আবার ইরেজার দিয়ে মুছেও দেয়, অবশ্য।সেসব ছবি দেখে মাঝে মাঝে আমাদের হার্ট অ্যাটাক হবার উপক্রম হয় যদিও।
আরো অনেক কিছু করে তুত্তুরী, যেমন বোতল-বাটি- ঘটি- গ্লাসে করে ডিপ ফ্রিজে বরফ জমায় তুত্তুরী। অবশ্যই মায়ের অসাক্ষাতে। মামমামকে (দিদা) গায়ের জোর দেখাতে, ভিডিও কল করে, আসবাব পত্র ধরে পর্যায়ক্রমে টানাটানি এবং ঠেলাঠেলি করে তুত্তুরী। গ্লুকন ডি জলে গুলে, আইসক্রিম বানায় তুত্তুরী। ফুল ফুটতে দেরী হলে, গাছ গুলোকে প্রবল ধমকায় তুত্তুরী এবং সর্বোপরি ড্রয়ারের কোন কোণে অনাদরে পড়ে থাকা বাতিল মোবাইল ফোনে চার্জ দিয়ে সেটাতে আবোলতাবোল ভিডিও তোলে তুত্তুরী-

Monday 2 September 2019

চাটুজ্জেদের গল্প- 2

“হেলো বাবা! কি করছ-। ” আদুরে বেড়ালের গলায় এই প্রশ্ন গুলো যখন করলাম, ঘড়িতে রাত পৌনে দশ। সারাদিন মেঘলা আর জোলো হাওয়ার পর সদ্য শুরু হয়েছে রঙীন ঝিরিঝিরি বৃষ্টি। সদ্য শেষ হওয়া নৈশ আহারে স্বপাক, তীব্র ঘি গন্ধী সুবাসি আতপের সাথে সৌরভী সোনা মুগের  খিচুড়ির যুগলবন্দি, সঙ্গতে পোস্ত মাখামাখি চাকা চাকা আলুভাজা এবং বেশী বেশী কাঁচালঙ্কা তথা পেঁয়াজ দিয়ে ভাজা ওমলেট। এই অনুপম যুগলবন্দির গপ্প শোনাতেই ফোন করা, নাহলে নৈশাহারের পর আমার বাবা তথা আমার ফোনের স্বত্ব বদলে যায়। স্বত্বাধিকারিনী আপাততঃ কি যেন একটা টিভি প্রোগামে মশশুল। সেই ফাঁকেই দাদু চুরি-
“ হ্যাঁ বলওওও। ” উচ্ছ্বসিত হলে চাটুজ্জেদের গলার জোর বেড়ে যায়, একই রকম আদুরে জবাব হলেও বিনা ফোনেই দিব্যি শোনা যায়। পরের প্রশ্নটা আমার বর বিড়বিড় করে প্রম্প্ট করে দিল,“কি করছ বাআবাআ?” সাধারণতঃ তাই বলি কিনা।
“কি আর করব? এই সবে বাড়ি ফিরলাম। ” মানে? এই বৃষ্টি বৃষ্টি রাত দশটায় কোথা থেকে ফিরল? নির্ঘাত রশদ সংগ্রহে বেরিয়েছিল। পরশু না তরশুই খুড়তুতো ভাই নালিশ করেছে,“ এই দেখ, এত রাতে, ছাতা মাথায় মেজজেঠু সেই অন্নপূর্ণার কাছে গেছে সিগারেট কিনতে।”
এই বুড়ো লোকটাকে শোধরানো আমার বাপেরও কম্ম না। বলতে গেলাম অনেককিছুই, তার আগে আসামীকে জেরা করার মত করে, গলার সব আবেগ ঝেড়ে ফেলে প্রশ্ন করলাম,“এত রাতে কেন বেরিয়েছিলে?” প্রত্যাশিত বিরক্তি তথা ধরা পড়ে যাওয়ার তিক্ততা গলায় জবাব ভেসে এল, “এত রাতে কি আর বেরিয়েছিলাম? বেরিয়েছিলাম সেই পৌনে ছটায়? কারণটা তোমার গর্ভধারিনীকেই জিজ্ঞাসা করো। তোমার মা আর তোমার মেয়ে একসাথে হলেই এই সব উটকো সমস্যা তৈরি হয় কি না। ” আমার মেয়ে? খামোকা আমার মেয়েকে ধরে টানাটানি কেন রে বাবা, সে তো দিব্যি বসে বসে তার বাপের টিভির রিমোটটা ধ্বংস করছে।
তবে কথাটা মিথ্যে নয়, তুত্তুরী, মামমাম এবং মামমামের ফোন এই তিনের কম্বোকে আমরা সবাই ডরাই। বাড়িতে কোন ফোনে হাত দেবার অনুমতি তথা সুযোগ পায় না বলেই হয়তো মামমামের ফোনের প্রতি তুত্তুরীর এমন ধর্ষকাম আকর্ষণ বা আক্রোশ ও বলতে পারেন। ফোনওয়ালির প্রত্যক্ষ প্রশয়ে ফোনের ওপর না না ধ্বংসাত্মক পরীক্ষা নিরীক্ষা চলে, আগে তুত্তুরী করে, তারপর মামমামকে প্রাকটিশ করায়। পরিণতি আমার বৃদ্ধ বাপের নিছক হয়রানি। গেল বার সিম লক হয়েছিল আর এবারে ফোনের চার্জারের প্রান্তটি ভেঙে আটকে গেছে ফোনের ভিতর। আর এসবই হয় বাবার সুখের দিবানিদ্রার সময়।
বাবার ভাষায়,“ তখনও সন্ধে নামেনি, তোমার মা আমার কাঁচাঘুম ভাঙিয়ে বলল, ‘ওগো দেখো কি করে ফেলেছি। ’” যাঃ।  তারপর? “তারপর আর কি? নিয়ে গেলাম শুভর দোকানে। ” পাড়ার শুভর ফোন রিচার্জের দোকানের নিত্য খরিদ্দার আমরা। ফোনে টাকা ভরানো ছাড়াও শুভকে নিয়মিত বা বলা যায় নিয়ম করে জ্বালাতন বা আব্দার করা হয়, “শুভ আমার ফোনে কি সব আপডেট বলছে,কি করব রে?” “ শুভ এই কাগজে লেখা নম্বরে কি করে হোয়াট্সঅ্যাপ করব রে?” শুভ আমাদের সোনার চাঁদ। পাড়াতুতো জেঠু-জেঠিমাকে যতদূর পারা যায় সাহায্য করে। কিন্তু এবার প্রশ্নটাই যে সিলেবাসের বাইরে-।
তারপর? এক চুমুক মায়ের বানানো চিনি ছাড়া চা আর লোকাল বেকারির বিস্কুটে এক কামড় মেরে বাবা আবার শুরু করল,“ তারপর আর কি? ফোনটা নিয়ে গেলাম পাওয়ার হাউস। ঈশার দোকানে। ” প্রসঙ্গতঃ যাদের হাওড়ার টপোগ্রাফি সম্পর্কে বিন্দুমাত্র ধারণা নেই, তাদের বলি, আমাদের বাড়ি থেকে বড় রাস্তা চার মিনিটের হাঁটা পথ। তারপর দশ টাকার টোটো ভাড়া দিয়ে পৌঁছাতে হয় কদমতলা পাওয়ার হাউস। যেখানে দেশপ্রাণ শাসমল রোড় বেঁকে গেছে তিনটুকরো হয়ে। সংযোগ স্থলে একটি বুড়ো বটের ছায়ায় দাঁড়িয়ে আছেন শ্বেতশুভ্র ডঃ বিধান রায়, না জানি কোন স্মরণাতীত কাল থেকে। তাঁর পিছনেই গাছের তলায় একটি গুড়গুড়ে শনি ঠাকুরের মন্দির। তো কথা হল ঈশা হল গিয়ে মোবাইলের এক্সপার্ট সার্জন। দর খুব বেশী। তার কাছে বৃদ্ধের কষ্টার্জিত অর্থে কেনা তথা স্ত্রীকে উপহার দেওয়া সামান্য সামস্যাং জে সিক্স ফোন নিছক ফেলনা। বাবাও তাই বলল,“প্রথমেই হাঁকিয়ে দিল। রেখে যান। দিন দুয়েক পর খোঁজ নেবেন। ” কেন? “ কেন আর? বলল কারিগরেরা সব ঈদের ছুটিতে দেশে গেছে।” ঈদ? সে তো অনেকদিনের কথা। “হ্যাঁ। শুনতেই চায় না। শেষে ডাম্পিকে ফোন করলাম। ” ডাম্পি আমার খুড়তুতো ভাই। তার মোবাইলের কালেকশন অসামান্য। তাকে ঈশা মুসা সবাই খাতির করে। “ডাম্পি বলে দিল,‘এই সারিয়ে দে। মানার ফোন।’“ মানা  অর্থাৎ মেজো জেঠি, অর্থাৎ আমার মা।

বাবা আবার শুরু করেছে, “তখন বলল, সারিয়ে দেব। দুঘন্টা লাগবে। ” দুঘন্টা? “হ্যাঁ। আবার ফিরে আসব? আবার যেতে হবে? তাই দুঘন্টা বিধান রায়ের মুর্তির তলায় বসে রইলাম। ” সে কি গো বাবা? এই ঝড়জলের রাতে তুমি দুঘন্টা বটতলায় বসে রইলে?
আরেক চুমুক চা খেয়ে বাবা বলল,“হ্যাঁ। আরো অনেক লোক বসেছিল। আমিও রইলাম। ঘড়ি পরিনি। সময়ও বুঝতে পারি না। আজকাল কেউ ঘড়ি পরে না বোধহয়? বৃষ্টিবাদলায় লোকজনও কম, যে কয়জন বুড়ো লোক ঘড়ি পরেছিল তাদের থেকেই সময় জেনে জেনে আন্দাজে পৌনে নটা নাগাদ গিয়ে হাজির হলাম। খানিখক্ষণ দাঁড় করিয়ে রেখে ফেরৎ দিল বটে, বলল আটশ টাকা। ” আট শ? “হ্যাঁ। সারাতে পাঁচশ। আর চটজলদি করে দেবার জন্য তিনশ টাকা।” বাপরেঃ। ডাম্পিকে ফোন করলে না কেন? “ধ্যাৎঃ।” টাকা ছিল? “হ্যাঁ।  তবে সব খুচরো টাকা দিয়ে দেবার পর আর টোটো ভাড়া ছিল না। হাঁটুর যা অবস্থা, হেঁটেও ফিরতে পারব না। ধরলাম একটা টোটো। গলির মুখে নেমে দেখি বিপিন বাবুর দোকানটা খোলা। বললাম আমাকে দশটা টাকা দিন। টোটো ভাড়া দেব। ” বিপিন বাবুর আইসক্রীম চকলেটের দোকান। তুত্তুরীর কল্যাণে বাবার সাথে ওণার প্রবল ভাব। যাক শান্তি। কাল গিয়ে শোধ করলেই চলবে। “পাগল নাকি?কাল করলেই কালে ধরবে। কাল মানে যম। বললাম, আমার কাছে পাঁচশ টাকা আছে। আপনি আমাকে একটা পঞ্চাশ টাকার চকলেট দিন। আর দশটাকা কেটে, বাকিটা ফেরৎ দিন। উনি তো কিছুতেই নেবেন না। বললেন,‘ বাড়ি
যান। চকলেটও নিয়ে যান। কাল দিয়ে যাবেন এখন।’ ”
তারপর?“তারপর চকলেট, ফোন আর খুচরো নিয়ে বাড়ি ফিরলাম। ” “বাবা। তুমি মাকে কত ভালোবাসো গো। প্রায় যুদ্ধ জয় করে ফিরলে। মা কি বলল?” ঠক করে চায়ের কাপ নামিয়ে বাবা বলল,“তোমার মা? তোমার মা রণং দেহী মূর্তিতে অপেক্ষা করছিলেন। এত দেরি কেন হল? নিশ্চয় তুমি রাস্তায় দাঁড়িয়ে আড্ডা মারছিলে। আর এখন গুলগল্প জুড়েছো। কি করে বোঝাই বলতো? আজকাল কেউ দাঁড়িয়ে গল্প করতেই চায় না। বেশ কয়েকজন বুড়ো লোক বসেছিল এপাশ ওপাশে, তারা সব উদাস হয়ে তাকিয়ে ছিল এদিকওদিক। কারো গল্প করার ইচ্ছে নেই। সবাই বিমর্ষ। কারো মনে আনন্দ নেই। ধুত্তোর।কথা বলার চেষ্টা করেও সফল হইনি। তোমার মা বুঝলে তো। এখনও গজগজ করছে।চকলেটটা দিলাম, তাও কোন লাভ হল না।”
“সাদাকালো এই জঞ্জালে ভরা মিথ্যে কথার শহরে” বুড়োবুড়ির প্রাগৈতিহাসিক প্রেমের হাতে গরম তপ্ততা মেখে, এক অদ্ভুত ভাললাগার গোলাপী রেশ মেখে ঘুমিয়ে পড়লাম।