Thursday 21 June 2018

আমি আর ইয়াসিন


সবে তানিয়াদি ফোন করেছে,“কিরে, ফাঁকা আছিস?কথা বলা যাবে?” আর সবে আমি বলেছি,“হ্যাঁ। হ্যাঁ বলো। ঘর শুনশান। গড়ের মাঠ। ” ব্যাস্ ওমনি ধড়াম করে দরজা ঠেলে ঢুকল ধীমান,“ম্যাডাম। ম্যাডাম শিগ্গির আসুন। ইয়াসিনদা কেমন করছে। ” ইয়াসিন আমার ইন্সপেক্টর। বয়স সদ্য ত্রিশ পেরিয়েছে। বেশ হাসিখুশি  মিষ্টি দেখতে। অত্যন্ত বাধ্য।পরিশ্রমী ।  সবদিক দিয়ে যাকে বলে তুলনাহীন। শুধু একটাই সমস্যা। মাথায় যাকে বলে সলিড ছিট আছে।
দৌড়ে গিয়ে দেখি, ইয়াসিন টেবলের তলায় ঢুকে বসে আছে। দুহাতে চোখ ঢেকে একটাই কথা চিৎকার করে বারবার বলে যাচ্ছে,“ না। না। না। ” আমার অন্য তিন ইন্সপেক্টর রীতিমত ভয়ে জড়োসড়ো।কৌশিক হাঁটু মুড়ে বসে সভয়ে ডাকছে,“ইয়াসিন। এই ইয়াসিন বেরিয়ে আয়। ” সঞ্চিতার মুখ শুকিয়ে আমসি। কোনমতে বলল,“দেখুন না ম্যাডাম। কি রকম করছে। আপনার ঘর থেকে বেরিয়ে এল দিব্যি হাসিমুখে,তারপরই চিৎকার করতে করতে টেবিলের তলায় সেঁদিয়ে গেল। ” অরিন্দম বাবু বোধহয় টিফিন সারছিলেন। কাঁপা গলায় বললেন,“ম্যাডাম, এরকম কি আগে হয়েছে?ইয়ে মানে ডাক্তার ডাকবেন কি?”
ডাক্তার তো ডাকব। আগে ছেলেটাকে টেবিলের তলা থেকে বার তো করি- “ইয়াসিন কি হয়েছে?”উদ্বিগ্ন স্বরে জানত চাইলাম। ইয়াসিনের না-না-না থামল বটে কিছু জবাব পেলাম না। আবার শুরু হল কাঁপন আর চিৎকার। এতো মহাজ্বালা। বললাম,“বেরিয়ে আয় বাবা। কি হয়েছে?আমাদের খুলে বলো। শরীর খারাপ লাগছে?” ইয়াসিন যখন মুখ তুলল, দুই চোখে নির্ভেজাল আতঙ্ক। “ম্যাডাম। ম্যাডাম আবার দেখলাম তাকে-”।
“তাকে” অর্থাৎ এক ভয়ংকর  রোগা এবং কৃষ্ণকায় ব্যক্তি, যার দুই চোখ টকটকে লাল।পরণে চেক লুঙ্গি আর স্যাণ্ডো গেঞ্জি। গলায় আড়াআড়ি একটা বিশাল কাটা দাগ। মাঝেমাঝেই ইয়াসিন তাকে দেখতে পায়। সে আচমকা উদয় হয়, উদয় হবার সাথে সাথেই বাসি মড়ার চিমসে গন্ধে ভরে ওঠে চারদিক। ইয়াসিনের গা গুলিয়ে ওঠে। লোকটা একদৃষ্টিতে ইয়াসিনের দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ, তারপর পায়ে পায়ে এগিয়ে যায় অন্য কারো দিকে। তার পিছনে গিয়ে দাঁড়িয়ে ইয়াসিনের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ বার করে তার শুকিয়ে কালো হয়ে যাওয়া পচা জিভ। তারপর ঐ আড়াআড়ি কাটা বরাবর মাথাটা একদিকে হেলে যায়। তারপর আর তাকে দেখতে পায় না ইয়াসিন। শুধু যার পিছনে দাঁড়িয়ে কাটা মুণ্ডটা হেলে পড়ে, তার মেয়াদ নাকি ২৪টি ঘন্টা।
এই গল্প ইয়াসিন বহুবার আমায় শুনিয়েছে। তার আগে অবশ্য দিব্যি গেলে নিয়েছে,“কাউকে বলবেন না ম্যাডাম।” আমিও বলিনি। ইয়াসিন যখন সাত আট বছরের তার আব্বুর সাথে গিয়েছিল দাদীর বাপের বাড়ি। সেটা পূর্ব মেদিনীপুরের এক অজ গাঁ।বাবার মামার বাড়িতে দুটি ছোট ছোট মেয়ে ছিল, ডাক নাম অলি আর পলি। ইয়াসিনের সাথে খেলছিল ওরা। আচমকা এক তলার এক তালাবন্ধ ঘর থেকে বেরিয়ে এল এই ভয়াল লোকটা। অলির পিছনে দাঁড়ানো মাত্রই কাটা মাথাটা হেলে পড়ল। ঐ ভয়ংকর দৃশ্য দেখে আঁতকে উঠে অজ্ঞান হয়ে যায় ইয়াসিন। জ্ঞান হতে প্রবল কান্নাকাটি। শেষ পর্যন্ত ইয়াসিনকে নিয়ে ঐদিনই বাড়ি ফিরে আসে বাবা-মা। দিন কতক পর খবর আসে,ওরা চলে আসার পরদিনই জলে ডুবে মারা গেছে অলি।
এরপর বহুবার তার দেখা পেয়েছে। প্রাণাধিক বন্ধু আব্দুলের বাড়ির উঠোনে খাটিয়া পেতে ঘুমোতে শুয়েছিল দুই বন্ধু। মাঝরাতে পচা গন্ধে গা গুলিয়ে ওঠায় ঘুম ভেঙে যায় ইয়াসিনের। দেখে ঘুমন্ত আব্দুলের মাথার সামনে দাঁড়িয়ে সে। পরদিন কলেজের ইলেকশনের মারামারিতে জড়িয়ে বেঘোরে মারা যায় আব্দুল। তারপর ইয়াসিনের শক্তপোক্ত চাচা। দাদী। বাবা। এক অল্পবয়সী ভাইঝি, যার সাথে খুব ছোট বেলায় আশনাই ছিল ইয়াসিনের তার মৃত্যুও আগেভাগেই বুঝতে পেরেছিল ইয়াসিন। ভাইঝির মৃত্যুটা আমার জমানাতেই। বাচ্ছা হবার জন্য চুঁচুড়া সদর হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল মেয়েটি। অল্পক্ষণের জন্য ছুটি নিয়ে তাকে দেখতে গিয়ে কাঁদতে কাঁদতে ফেরে ইয়াসিন। আমাকে বলেছিল,“একি অভিশাপ ম্যাডাম?মাঝে মাঝে ইচ্ছা করে নিজের চোখ দুটো গেলে দি। তাহলে ঐ হতচ্ছাড়াকে তো আর দেখতে পাবো না। গিয়ে দেখি আমারই জন্য দাঁড়িয়ে ছিল হারামজাদা আসমার মাথার কাছে। মেয়েটা আর বাঁচবে না ম্যাডাম। কিই বা বয়স ওর?কলেজে পড়ার কথা-। ”সেদিন সান্ত্বনা দিয়েছিলাম,বিশ্বাস করিনি। ছেলেটা একটু ছিটেল কিন্তু বড় ভালো। বড় সাদাসিধে। আজ কি হল? হাত বাড়িয়ে টেবিলের তলায় ইয়াসিনকে ঠেলা দিয়ে কর্তৃসুলভ ভঙ্গীতে বললাম,“ইয়াসিন। বেরিয়ে এস। কি হয়েছে?” হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বলল ইয়াসিন,“ম্যাডাম। ম্যাডাম তাকে আবার দেখেছি। আপনার ঘরে ঢুকেছিলাম গাড়ির বিল সই করাতে। ঢুকেই গন্ধটা পেলাম। আপনি মাথা নীচু করে ফাইল করছিলেন, আর সে আমারই প্রতীক্ষায় আপনার পিছনে ঘাপটি মেরে ছিল। আমায় দেখা মাত্রই- ম্যাডাম--”।
©Anindita's blog ©Anindita Bhattacharya