Monday 28 February 2022

অনির ডাইরি ১৯শে ফেব্রুয়ারি, ২০২২

 



#তাম্রলিপ্তকড়চা 


ভীম দেখবেন নাকি দাদা দিদিরা? চলুন, চলুন আজ আপনাদের ভীম দেখিয়ে আনি। এই তমলুক শহরের সবথেকে বড় ভীম। ব্যবত্তার ভীম।  

যবে থেকে ই জেলায় বসতি স্থাপন করেছি, ব্যবত্তার ভীম বাবাজীর প্রশস্তি শুনে আসছি। কে না করেছে ব্যবত্তা নিবাসী মধ্যম পাণ্ডবের জয়গান, বাংলোতে ঘাস ছিঁড়তে আসা মাসির দল, বাংলোর সিকিউরিটির দায়িত্বে থাকা ছেলে দুটি, রান্নার দিদি এবং তার কন্যা, বাসন মাজার দিদি এবং তার ছানাপোনা, শৌভিকের ড্রাইভার, আমার ড্রাইভার সবার মুখে এক কথা, ‘ভীম তো ভীম, ব্যবত্তার ভীম।’ 


ভীম নয়তো রাজা বিশেষ। ভয়ানক জাগ্রত ব্যবত্তার ভীম সেন। মাঘী পূর্ণিমার আগে যে একাদশী, যার পোশাকী নাম ভীম একাদশী, সেই দিনই অভিষিক্ত হন ভীম সেন, আর সেইদিন কম করে হলেও লাখ পাঁচেক মানুষ সমবেত হন ভীম সেনের দরবারে। ভীম সেনের গলায় ঝোলে টাকার মালা আর থাকে বাতাসার মালা। যার এক একটি বাতাসা হাতের পাঞ্জা এমনকি বড় থালার মাপেরও  থাকে। সবই মানত পূরণের পরিণাম। যার যেমন সামর্থ মানত করে লোকজন। কেউ বাতাসা তো কেউ পুঁচকে ভীম। মাথার মুকুট, কানপাশা, রূপা/ সোনার চোখ এমনকি গদাও মানত করে মানুষ। সোনা-রূপা- কাঁসা-পিতলের গদা, যার যেমন সামর্থ। 


শৌভিকের ড্রাইভার তো প্রথম দিনেই আমাদের নিয়ে যেতে ব্যগ্র ছিল, ব্যগ্র ছিল তুত্তুরী আর তার মাসিও। লাখ পাঁচেক দর্শনার্থীর ভয়ে পিছ পা ছিলাম আমি খোদ। হাল ছাড়েনি পলাশ, প্রতিদিনই শৌভিককে নিয়ে আপিস যাবার সময় বলে যেত, ফিরে এসে আমাদের লিয়ে যাবে। এও বলে যেত, মন্দির অবধি গাড়ি যাবেনি। সরু রাস্তা। খানিকটা হাঁটতে হবে, নাহলে টোটো যায় অবশ্য। এক সপ্তাহের বেশীই থাকেন ব্যবত্তার ভীম, বসে জমজমাট মেলা, কিন্তু নানা কারণে যাওয়া আর  ওঠে না। 


ভেবেছিলাম এ যাত্রা বোধহয় আর হলনি। সেদিন ব্যবত্তাতেই গিয়েছিলাম দুয়ারে সরকারের ক্যাম্প দেখতে। ব্যবত্তা পুর্ব এবং ব্যবত্তা পশ্চিম হল নন্দকুমার ব্লকের দুটি পঞ্চায়েত। ভাগ্যক্রমে একই দিনে ক্যাম্প পড়েছে দুটি পঞ্চায়েতে। ব্যবত্তা পশ্চিমের ক্যাম্পেই প্রথম গেলাম। যাবার সময় সঙ্গে করে নিয়ে গেলাম সুপ্ত বাসনা, যদি দেখা হয় তাঁর সাথে। মুখ ফসকে বলে ফেলতেই আঁতকে উঠল  আমাদের উত্তমকুমার, ‘ঐ দেখেন ম্যাডাম, কি ভিড়।’ সত্যিই সারি বেঁধে এগিয়ে চলেছে বিভিন্ন বয়সী নারী পুরুষদের দল।  


তাহলে বোধহয় আর হল না। ক্যাম্প দর্শন সেরে আপিস ফিরতে যাচ্ছি, ইন্সপেক্টর সাহেব বললেন, ‘ব্যবত্তা পূর্বে যাবেন নি ম্যাডাম? ঐ তো রাস্তার ও পাড়ে।’ পাশ থেকে আমাদের এসএলও শিবু বলল,‘আর ভীম দেখবেননি ম্যাডাম? এত কাছে এলেন-।’ বললাম আমি তো যেতেই পারি রে বাপ, কিন্তু আমাদের উত্তমকুমার যা ভয় দেখাচ্ছে, আর সত্যিই রাস্তা বেশ সরু এবং বেশ ভিড়। শাহরুখ খানের ‘ম্যায় হুঁ না’ র ঢঙে শিবু আশ্বস্ত করল,‘ চলুন। চলুন আমিও যাচ্ছি। আমি গেলে সবাই রাস্তা ছেড়ে দেবে।’ 


শিবুর চাপাচাপিতে গাড়ির চাকা তো ঘুরল ব্যবত্তার ভীমের মন্দিরের পানে, তবে এগোল না বটে। যেমনি সরু রাস্তা, তেমনি দর্শনার্থীদের ভিড়। তার ওপর ভিড় দুয়ারে সরকার থেকে ফিরতি জনগণ। গাড়ির কাঁচ তোলা, বাইরে বেশ ঠান্ডা, তাও দরদর করে ঘামছে উত্তম। পাড়ার বউদি,মাসিমারা হাতপা নেড়ে আমাদের গুষ্টি উদ্ধার করছে, চুনোপুঁটি গুলো মহানন্দে বনেটে তবলা বাজাচ্ছে এবং শিবু গাড়ি থেকে নেমে চিল্লাচ্ছে। অন্তত মিনিট পনেরো এই নাটকের পর, বাহুবলীর শিব লিঙ্গ তোলার মত, রাস্তার ধারে দাঁড় করিয়ে রাখা গুটি কয়েক সাইকেলকে শিবু যখন তুলে পাশের ধানক্ষেতে নিক্ষেপ করল, পলকে একটু ফাঁকা হল বুঝি রাস্তা। 


তারপর! তারপর আর কি, আমরা ঝাঁ করে পৌঁছে গেলাম মেলার মাঠে। গাড়ি থেকে নামলাম, শিবুকে অনুসরণ করে মন্দিরে ঢুকলাম, আশ মিটিয়ে ভীমের ছবি তুললাম। শিবুর ‘হেড ম্যাডাম’ শুনে কতৃপক্ষ কয়েকজন বেশ খাতির করে সবকিছু দেখাল। গল্প শোনাল যে এ বছর কম করে লাখ তেরো টাকার মালা ঝুলেছে ভীমের গলে আর জমা পড়েছে শ পাঁচেক পুঁচকে ভীম। পুজো শেষ হলে, বিসর্জন যাবে এই পাঁচশত পুঁচকে ছোঁড়া ভীম। ধুয়ে ফেলা হবে বড় ভীমের গায়ের মাটিও। তবে কাঠামোটা থেকেই যাবে। শিবুর বড় দিদিমণির জন্য দুপ্যাকেট খাস পুজোর ফুল আর জাম্বো বাতাসার মালাও দিয়েছিল কতৃপক্ষ, যার একটি গোটা প্যাকেটই আমি ধরিয়ে এসেছি ইন্সপেক্টর সাহেবকে। আর বকেছি খুব। আজব ছেলে মাইরি তুমি, আমি না হয়  হাওড়ার মেয়ে, তুমি তো খাস এই জেলার ছেলে। এদ্দিনেও ভীম দেখোনি! ভাগ্যে আমি এলাম। শুধু কাজ করলে হবে?  


 দ্বিতীয় প্যাকেটটা উত্তম, আমি, বাংলোর সিকিউরিটি অমিত, এমনকি শ্রীমতী তুত্তুরীর সৌজন্যে বাংলোর পিঁপড়ে গুলো মিলে ভাগ করেও শেষ করতে পারিনি। কে যেন শিখিয়েছিল মা, নাকি ঠাকুমা, প্রসাদ যত ভাগ করে খাবে, ততো বাড়বে তার প্রসাদগুণ, শ্রীমতী তুত্তুরী তাকে আক্ষরিক অর্থেই গ্রহণ করেছে আর কি।

Tuesday 22 February 2022

অনির ডাইরি ১৮ই ফেব্রুয়ারি, ২০২০ #তাম্রলিপ্তকড়চা

 



শুনলাম ছেলেটা কোল্ড ড্রিঙ্কস্ খেতে ভীষণ ভালোবাসে। ভালোবাসে চিকেন-মটন বা ভালো মাছের মুখরোচক পদ সমূহ। দুচক্ষে দেখতে পারে না কেবল দুধ আর ডাল-ভাত- নৈমিত্তিক তরিতরকারি। সকাল বিকেল ছেলেকে খাওয়াতে জিভ বেরিয়ে যায় মায়ের। মুখে ভাত নিয়ে চুপ করে বসে মোবাইল ঘাঁটে,মোবাইল কেড়ে নিলে তিড়িং বিড়িং করে নেচে বেড়ায়, মুখ ভর্তি মাখা ভাত নিয়ে। গলায় আটকে যাবার ভয়ে কাঁটা হয়ে থাকে মা-ঠাকুমা-দাদু। 

আমি অসময়ের অতিথি, এসেছিলাম দুয়ারে সরকারে, ছেলেটার বাবার নিমন্ত্রণে একটি বারের জন্য এসেছি তাঁকে দেখতে। যাঁর দর্শনের অভিলাষ এসে এসেছি, তিনি অবশ্যি আমায় পাত্তাই দিলেন না। জবরদস্তি তাঁকে আমার পাশে এনে বসানো হয়েছে বটে, তিনি মগ্ন মুঠো ফোনে। বাড়ির আদরের কচি, এই জেলা শিশুদের ঐ নামেই সম্বোধন করে। ছেলেটির নাকের ডগা দিয়ে আমার সামনে এক প্লেট মিষ্টি আর এক গ্লাস ঠাণ্ডা পানীয় রাখা হল। আমিও খাব না, ছেলেটির মা ঠাম্মাও ছাড়বে না। উভয় পক্ষের দর কষাকষির ফাঁকে তিনি দৌড়ে এলেন খপ করে আমার পানীয়ের গ্লাসে একটা আঙুল ডুবিয়ে সটান চুষে নিলেন আঙুলটা। পরের বার ডোবানোর তাল করেছিলেন বটে, কিন্তু তার আগেই খপ করে নড়া ধরে টেনে নিয়ে গেল মা। ঠাকুমা-দাদু-বাবা-কাকা লজ্জায় লাল। আর আমি তো হেসেই খুন। 


ওকে না দেওয়া হলে আমিও খাব না। আমার এবং কচির যুগপৎ জেদের কাছে পরাস্ত হয়ে একটা স্টিলের পুঁচকে গ্লাসে অল্প একটু কোল্ড ড্রিঙ্ক ঢেলে দেয় ওর মা। পিছনের জানলা দিয়ে কে যেন জানতে চায়, ‘গোলাপ গুলা কি তুমি ছিঁড়তেছ কচি?’ কচি ততোক্ষণে হারিয়ে গেছে মুঠো ফোনের দুনিয়ায়। স্নেহান্ধ ঠাকুমা বলল, ‘না না। ও ছিঁড়েনি।’ তুলনায় অনেক বাস্তববাদী মা, জানাল পুঁচকেটা ঐ দিকে ঘুরঘুর করছিল বটে, ছিঁড়েছে কি না সে জানে না। তাকিয়ে দেখলাম অপূর্ব সুন্দর সুন্দর গোলাপ ফুটে আছে।  দেখে আমারই লোভ লাগল আর ও তো বাস্তবিকই কচি।  


যাদের গোলাপ ছিঁড়েছে, তারা দেখলাম খুব একটা কিছু বলল না, বার দুয়েক মজা করে শূন্যে ঘুঁষি দেখিয়েই ক্ষান্ত দিল। যাকে দেখাল সে গ্রাহ্যই করল না, করলে বিপদ ছিল। ছেলেটির বাবা হেসে কইল,‘ওনারা সব আমাদেরই জ্ঞাতি ম্যাডাম। আমার দাদুরা চার/পাঁচ ভাই। সবাই ওকে(কচিকে) খুব ভালোবাসে। ওকে আমরা বকলে/মারার ভয় দেখালে ওণারা এসে ঝগড়া করেননি। ছেলেটা যখন হাসপাতালে ছিল, ওদের সবার নাওয়া-খাওয়া বন্ধ হয়ে গেছিল।’


আঁতকে উঠলাম, এইটুকু ছেলে হাসপাতালে কেন ভর্তি হয়েছিল? ছেলেটির বাবা বলল, ‘আর বলবেননি ম্যাডাম, একবার তো আমাদের চোখের সামনেই ধপাস করে পড়ে গেল। আমরা খেতে বসিছি, ওর খাওয়া হয়ে গেছে ও নেচে বেড়াইছে। ঠাকুরের সামনে জলছড়া দিয়েছিল মা,তাইতে পা হড়কে এমন পড়ল-। তখুনি কিছু বোঝা গেলনি, আমরা তো তাড়াতাড়ি মাথায় বরফ-টরফ দিলাম। তখন কিছু বোঝা গেলনি বটে, রাতে দেখি মাথা ফুলে ঢোল। আর ছেলেও কেমন ঝিমিয়ে পড়তেছে। কোন মতে রাতটা কাটিয়েই ছেলেকে নিয়ে দৌড়লাম তমলুক সদর হাসপাতালে। যে ডাক্তার পাব, তাকেই দেখাব। তো যে ডাক্তার পেলাম, তিনি বললেন বাবুর মাথার পিছনে রক্ত বেরিয়ে জমে গেছে। অপারেশন করে সিরিন(সিরিঞ্জ)ফুটিয়ে বার করতে হবে। বারো হাজার টাকায় রফাও হল আমার সাথে। তারপর আমার কি মনে হল, আমি ছেলেকে লিয়ে পাল্যে আসলাম। এইটুকুন ছেলের মাথায় অপারেশন করবে কি বলুন ম্যাডাম।’ 


কি বলি আমি,শুনেই তো হাত পা ঠাণ্ডা হয়ে আসছে। তবে সে যাত্রা জনৈক অন্য ডাক্তারবাবুর ওষুধে বিনা অপারেশনেই সুস্থ হয়ে ফেরে কচি এবং তার মা-ঠাকুমার বয়ানানুসারে দৌরাত্ম্যও বেড়ে যায় কয়েকগুণ। ছেলেটির বাবা বলে,‘ওর থিকেও সাংঘাতিক কি হয়ছিল জানেন নি ম্যাডাম?বাড়িতে কি যেন একটা কাজ চলতেছিল, সবাই তাতেই ব্যস্ত। সেই ফাঁকে ও করছে কি, বড় লোহার মুড়ির টিনের মধ্যে মাথা খানা গলাই দিছে।’ আঁতকে উঠি আমি। বাবা গো, কি ডানপিটে হোঁদল-কুৎকুতে ছেলে বাপু তুই কচি। 


ওর বাবা বলে,‘শুনেননি ম্যাডাম, মাথাটা বার করতে গিয়ে তলার ঠোঁটের ভিতর দিকটা কেটে গেল ছেলেটার। সে কি রক্ত!বন্ধই হয় না। আমি ছেলে কোলে দৌড়লাম তমলুক হাসপাতাল। ডাক্তারবাবু দেখে ভিতরে তিনটে সিলাই করদিলেন। ছেলে সমেত বউকে আমি ওদের মামার ঘরে রেখে এলাম। বাড়িতে থাকলে তো বউকে সংসারের কাজও করতে হয় টুকটাক, তাই আর কি। বাকি দিনটা ঠিকই কাটল, রাত আড়াইটে নাগাদ বউয়ের ফোন,বাবু ঘুমোচ্ছে আর রক্তে ভেসে যাচ্ছে ওর বালিশ।’


‘ সে যে কি রাত কেটেছে ম্যাডাম আপনি জানেননি। আমি বউকে বললাম,রাতটা যাহোক করে কাটাও কাল সকাল হলেই যাচ্ছি। ভোর পাঁচটার সময় বেরোলাম, সাড়ে ছটার মধ্যে ছেলেকে নেয়ে হাসপাতাল। আমাদের বাইরে বসিয়ে রেখে ছেলেকে ওটিতে ঢুকাল। ভিতর থেকে তারস্বরে কাঁদছে বাবু আর বাইরে আমরা দুজন।’ শুনতে শুনতে কখন ভিজে গেছে আমার দুচোখ। 


‘পঁয়তাল্লিশ মিনিট পর, পুরাণো সেলাই কেটে নতুন করে সেলাই করে ছাড়ল বাবুকে ম্যাডাম। সে রক্ত আর বন্ধ হয় না। পাগলের মত ছেলেকে নিয়ে ছুটিছি আমরা এ ডাক্তার থিকে সে ডাক্তার।’ শুনতে শুনতে কেমন যেন সন্দেহ হল, এ ব্যধি আমার চেনা। জানতে চাইলাম বাচ্ছাটার কি রক্তের কোন বিশেষ বৈশিষ্ট্য  আছে? জবাব এল, জবাব প্রত্যাশিত, হিমোফিলিয়ায় আক্রান্ত শিশুটি। রক্তের এক বিশেষ ধরণের ব্যধি,যেখানে জমাট বাঁধতে চায় না রক্ত। জানতে চাইলাম এমন জটিল জেনেটিক ব্যধি শিশুটি পেল কি করে, জবাব পেলাম নীলরতন সরকার মেডিকেল  কলেজের বোর্ড কিসব বিশদ পরীক্ষা নিরীক্ষার পর জানিয়েছে যে শিশুটির মাতৃকুলে কারো ছিল এই অসুখটি। পরবর্তী বেশ কয়েকটি প্রজন্মকে ছেড়ে কচির ঘাড়ে চেপেছেন তিনি। 


হিমোফিলিয়া এমনিতে তেমন ঘাতক নয়, শুধু রক্তক্ষরণ যত দূর সম্ভব এড়িয়ে গেলেই মঙ্গল। আজকাল চিকিৎসা ব্যবস্থাও অনেক উন্নত হয়ে গেছে, আমাদের শৈশবে দেখা একমাত্র হিমোফিলিয়া আক্রান্ত পাড়া তুতো দাদুটি তো আশি পার করেছিলেন হাসতে হাসতে। শুধু যখনই রাস্তায় বেরোতেন দেখতাম আপাদমস্তক ঢেকে বেরোতেন। ঘোর গ্রীষ্মেও পায়ে থাকত মোজা। যাতে কোন পেরেক না ফুটে যায়। সেই কথাটাই বললাম শিশুটির পিতামাতাকে। চার বছরের কচির জনকজননী তাতে কতটা আশ্বস্ত হল জানি না। শুধু বলল,‘ তাই আশির্বাদ করেননি ম্যাডাম।’ প্রাণ ভরে আশির্বাদ করে এলাম শ্রীমান কচিকে, খুব ভালো থাক, চুটিয়ে দস্যিবৃত্তি কর, শুধু একটু সাবধানে থাকিস বাবা।

অনির ডাইরি ১৭ই ফেব্রুয়ারি, ২০২২ #তাম্রলিপ্তকড়চা

 



একটা গরম সিঙারা, একটা নিমকি, একটা মোতিচুরের লাড্ডু, দুটো সন্দেশ আর এক বড় কাঁচের গ্লাস ভর্তি মাজা। আমাকে নাকি খেতেই হবে। ঘড়ি বলছে সাড়ে বারোটা, বাইরে রূপোর থালার মত চকচকে চোখ ধাঁধানো রোদ। বাড়ির ভেতরটা অবশ্যি খুব ঠাণ্ডা। আজ দুয়ারে সরকারের দ্বিতীয় দিন।কোলাঘাট হয়ে এসেছিলাম শহীদ মাতঙ্গিণী ব্লকে।প্রতিদিন প্রতিটা ব্লকে দুটো করে ক্যাম্প হচ্ছে, বিভিন্ন পঞ্চায়েতে। মাতঙ্গিণী ব্লকের দ্বিতীয় ক্যাম্পটা যে স্কুলে পড়েছে, আমাদের উত্তম কুমার নাকি ঐ স্কুলেরই ছাত্র।

স্কুল থেকে বেরোতেই উত্তম ঘোষণা করল, ‘বাড়ি চলুন ম্যাডাম।’ এই ঘোরতর মধ্যাহ্নে কোন গেরস্তর বাড়ি গিয়ে তাঁদের বিব্রত করতে আমি মোটেই ইচ্ছুক নই, কিন্তু গাড়ির স্টিয়ারিং কি আর আমার হাতে। গ্রামের মধ্যে খালের ধারে, গাড়ি দাঁড়াল। বাকি পথটুকু পদব্রজে যেতে হবে বলে সংকুচিত বোধ করছিল উত্তম, বাকি পথ বলতে একটা না দুটো বাড়ি। সব বাড়ির সামনে ছোটখাট সব্জি বাগান, ধরে আছে থোকা থোকা কাঁচা টমেটো। ফুলের গাছও প্রচুর। হরেক রকম গোলাপ গাছের টবে শোভা পাচ্ছে এত্ত বড় বড় হরেক রঙের গোলাপ।

দরজার কড়া নাড়তেই শোনা গেল কচি গলার প্রবল উত্তেজিত কণ্ঠস্বর। ‘বাবা এসেছে, বাবা এসেছে।’ অচীরেই বুঝলাম, বাবার থেকেও বড় কথা, ‘ফোন এসেছে। ফোন এসেছে।’ বক্তার বয়স মাত্র চার, প্রায়শই তাঁর গপ্প শোনায় তার বাবা। বলে,‘উরি বাপরে ম্যাডাম, কি দুষ্টু, কি দুষ্টু। কারো বাড়িতে লিয়ে যাই না আমরা ওকে, বাচ্ছা মানুষ, কি টানবে, কি ফেলবে। দরকার নেই বাপ, বড় হোক আগে।’ আমি এও জানি, এহেন দস্যু রত্নাকর জব্দ শুধু ফোনের কাছে। ফোন দিয়ে দিলেই, পশ্চিম সীমান্তে নেমে আসে অখণ্ড শান্তি। প্রত্যক্ষ করলামও তাই। অসময়ে বাবা বাড়ি ফেরার প্রাথমিক উত্তেজনা টুকু কাটতেই তিনি একটা চেয়ার দখল করে বসে গেছেন ফোন ঘাঁটতে। 

উত্তমের মা এত আনন্দিত আমাকে পেয়ে, যে কিছুতেই জুতো খুলতে দেবেন না। ওণাদের নিকানো চকচকে লাল সিমেন্টের দালানে জুতো পরেই ঢুকতে হল আমায়। খোলার চেষ্টা করেছিলাম ধর্মাবতার কিন্তু পর্যায়ক্রমে উত্তমকুমার এবং তাঁর পিতামাতার যুগপৎ তথা সম্মিলিত আপত্তিতে আবার বকলেস লাগিয়ে নিলাম।

উত্তমের মুখে শুনেছিলাম, ওদের একফালি জমিতে সম্বৎসরের ধান চাষ করেন ওর বাবা। আর সেই ধান সিদ্ধ করা থেকে বাকি সব কাজ করেন ওর মা আর বউ। বউটি বাচ্ছা মেয়ে, তার ওপর চার বছরের দুর্ধর্ষ ছানার জননী, সে যতটা পারে শাশুড়ীর সঙ্গে হাত লাগায়, তবে মূল কাজটা ওর মা’ই করেন। সে কথা বলেই প্রমাদ গুনলাম, উত্তমের মা আমাকে পাকড়াও করে নিয়ে গেল দোতলায়। এবারেও প্রবল আপত্তি ছিল জুতো খোলায়, আমি আর গ্রাহ্য করতে পারিনি।

লাল চকচকে সিমেন্টের সিঁড়ি, সিঁড়ি দিয়ে উঠে দোতলায় লাল সিমেন্টের দালান। উত্তমের মা আমাকে জবরদস্তি প্রতিটা ঘরে নিয়ে গিয়ে দেখাল, কোন ঘরে সপরিবারে উত্তম থাকে, কোন ঘরটা ওর ভাইয়ের। উনি বললেন,‘বড় কচি আর ছোট কচি।’এই জেলায় শিশুদের কচি বলে সম্বোধন করা হয়। তুত্তুরীকে যেমন বাংলোয় কাজে আসা মাসিরা কচি বলে ডাকে। ঘরদোর অগোছাল বলে বারংবার দুঃখ করছিলেন ভদ্রমহিলা, আশ্বস্ত করলাম,এ আমার কাছে নতুন কিছু নয়। আমি স্বয়ং চূড়ান্ত অগোছাল এবং অলবড্ডে প্রকৃতির। তুত্তুরী তো আরেক কাটি সরেস।

ঝাড়াই ধানের বস্তার পাহাড় দেখলাম। উত্তম এবং তার জননী জানালো এটা অর্ধেক কেবল। বাকি ইতিমধ্যেই উদরস্থ হয়েছে। উত্তমের মা খুশি হয়ে বললেন,‘দাঁড়াও এবার ধান উঠুক, আপনাকে পাঠায়ে দিব।’ নীচের বাগানে চটের বস্তায় ধান শুকাচ্ছে, দেখতে নিয়ে গিয়ে জানালেন, ‘এই গুলা দিয়ে মুড়ি ভাজা হবে। তাই সিদ্ধ করে নুনাইছে।’ নুনাইছে মানে বুঝতে না পেরে জানতে চাইলাম। আমার ধারণা ছিল ভাতের আর মুড়ির চাল আলাদা গোত্রের হয়, উত্তমের মা আর বউ তো হেসেই খুন। বউটি বুঝিয়ে দিল, একই চাল দিয়ে সব হয়, তবে সিদ্ধ করার ধরণ আলাদা হয়। আর নুনাইছে মানে নুন মাখানো হয়েছে। নুন মাখিয়ে রোদে শুকানোকেই নুনাইছে বলে।

অতঃপর উত্তমের মায়ের সঙ্গে ওদের ঠাকুর ঘর দেখে, বললাম এবার উঠি। বলার সাথে সাথেই সমানে এনে রাখা হল, এত্ত কিছু। খেতেই হবে, না খেলে গেরস্থের অকল্যাণ হবে। সবই তো বুঝলাম, কিন্তু আমিও তো সাড়ে দশটায় ভাত খেয়েই বেরিয়েছি দিদি। সে কথা কে শোনে। ভদ্রমহিলা এবং তাঁর লক্ষ্মীমন্ত পুত্রবধূ একসাথে বললেন,‘আমরা মানুষ খুব ভালোবাসি, যখন ইচ্ছে আসবেন। ঘরের চালের ভাত আর ভাজা মুড়ি সবসময় পাবেন।’ এগুলো না বললেও বুঝতেই পারছিলাম এণারা কতটা অতিথি বৎসল। তবুও এত খাবার উদরস্থ করা অসম্ভব। মার্জনা চেয়ে শুধু সিঙারাটা তুলে নিলাম। হাঁ হাঁ করে উঠল উত্তমের মা,‘লাড্ডুটা আমার গোপালের প্রসাদ। ওটা খেতেই হবে। নাহলে খুব বকব। আর শোনো এই সন্দেশ দুটোও তুমি খুব খেতে পারবে, দেখো না। আর ঐ নিমকিটাও-’। 

হাসব না কাঁদব বুঝলাম না। পলকের আলাপে আমায় এত ভালোবেসে ফেলেছেন যে প্রথম আলাপের ‘ম্যাডাম আপনি’র সম্ভ্রম কখন যেন বাতাসে মিশে গেছে। এত ভালোবাসায় আমি আপ্লুত, কিন্তু তাহলেও এত খেতে পারব না দিদি। অনেক অনুনয় বিনয় করে ছুটি তো পেলাম, কথা দিয়ে আসতে হল, অচীরেই আবার যেতে হবে এবং এবার ভাত খেতেই হবে। ভাত না খাওয়ালে কি আর অতিথিকে যথোচিত আপ্যায়ন করা হয়? কারা যেন বলে, এপার বাংলার মানুষ অতিথি আপ্যায়ন জানে না, প্লিজ একবার মেদিনীপুরে আসুন দিকি।

পুনশ্চঃ-ছবিতে উত্তমকুমারদের গাঁয়ের ভীম। উত্তম বলে ভীষণ জাগ্রত। ভীম একাদশীর দিন থেকে নাকি দিন সাতেক এর মেলাও বসে ।

Saturday 19 February 2022

অনির ডাইরি ১৬ই ফেব্রুয়ারি, ২০২২ #তাম্রলিপ্তকড়চা

 



দুয়ারে সরকারে আমি আর কি করি। কিছুই করি না, শুধু পটের বিবির মত সেজেগুজে যাই, ক্যাম্পের দরজার বাইরে থেকে বরকর্তার মত অভ্যর্থনা করে নিয়ে যায় আমার ইন্সপেক্টর/ সিকেসিও বা ক্ষেত্র বিশেষে এসএলও। জনসমুদ্রের মাঝখান দিয়ে ভাসতে ভাসতে আমাদের দপ্তরের টেবিলে গিয়ে পৌঁছাই, দেখামাত্র কাজ ফেলে উঠে দাঁড়ায় বাকিরা। আমিও হেব্বি মাতব্বরী করে জিজ্ঞাসা করি, কটা ডিএস পড়ল? আর কটা পড়তে পারে ইত্যাদি। ইন্সপেক্টর সাহেব কাচুমাচু মুখে বলে, ‘আরও পড়ত, দুয়ারে সরকারটা যদি জানুয়ারীতেই হত। পিছিয়ে গিয়েই মুস্কিল হয়েছে। এরা আগে ভাগেই সব পাশবই রিনিউ করিয়ে বসে আছে।’ 


অতঃপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে, ছবি তুলে, দুটো শুভেচ্ছা বার্তা দিয়ে আমি বেরিয়ে পড়ি পরের গন্তব্যের উদ্দেশ্যে। গ্রামের ছোট্ট নিম্নবুনিয়াদী বিদ্যালয়ে সেন্টারে পড়েছে, আসতে জিভ বেরিয়ে গেছে আমাদের। সরু ঢালাই রাস্তা দিয়ে কোনমতে গাড়ি নিয়ে এসেছে আমাদের উত্তমকুমার। এসে থেকে জনে জনে শুধিয়ে বেড়াচ্ছে, বের হবার অন্য কোন রাস্তা আছে কি না, ঐ রাস্তায় আবার গাড়ি ঢোকাতে হলেই চিত্তির। 


ক্যাম্প থেকে বেরিয়ে দেখি, গাছের ছায়ায় ঝিমোচ্ছে আমাদের নিঃসঙ্গ গাড়িটা, উত্তমকুমার বেপাত্তা। আমার কোন হেলদোল নেই, ইন্সপেক্টর সাহেব ক্রমেই হয়ে উঠছে অধৈর্য। আমাকে বিদায় করার কি উদগ্র বাসনা মাইরি। তিনবার ফোন করে ফেলল, এর মধ্যে। একটি বারও বাজল না ফোনটা। বাজবে কি করে, প্রথমতঃ উত্তমকুমার তাঁর মহার্ঘ ফোনটি গাড়িতে রেখেই বেরিয়েছেন আর দ্বিতীয়তঃ এই প্রত্যন্ত অঞ্চলে কারো ফোনে কোন টাওয়ার নেই। মাঝে মাঝে চপলার মত ঝিলিক মারছে দুটি টাওয়ারের দাঁড়ি। তাতে ফোন যায়ও না আর আসেও না।


গাড়ির দরজা খোলাই ছিল, উঠে বার কয়েক হর্ন বাজাতে না বাজাতেই উদয় হলেন উত্তমকুমার। জানতাম, গাড়ি খোলা রেখে গেছে তো হর্নের আওয়াজে ছুটে আসবেই। আসতে না আসতেই চড়াও হল ইন্সপেক্টর সাহেব, ‘ম্যাডমকে একা ফেলে কোথায় গিয়েছিলে?’ রাস্তা দেখতে গিয়েছিল উত্তম। কোন দিশা পায়নি, আবার সেই সরু ঢালাই রাস্তা, আবার সেই নড়বড়ে সেতু-। এবারের গন্তব্য রাণীহাটি প্রাইমারি স্কুল। বললাম, ওখানকার ইন্সপেক্টরকে একবার ফোন করি, উত্তমকুমার শুনলে তো। ‘আপনি বসুন না, আমি ঠিক চলে যাব।’


 হাইরোডে এসে উঠলাম আমরা, আবার বললাম, একবার ফোন করি রে বাপ। নাঃ উত্তমকুমার সব চেনে। যখন বলবে  তখন ফোন করতে হবে। যদি বলে, তবেই গুগল ম্যাপ অন করতে হবে লতুবা নয়। ফাঁকা হাইওয়ে, দুদিকে ঘন সবুজ ধান জমি, দেখলে চোখ জুড়িয়ে যায়। ‘ঐ ধান ক্ষেতে আপনি যেতে পারবেননি ম্যাডাম,’ বলল উত্তম। কচি ধানগাছের পাতা নাকি ব্লেড-ছুরির মত ধারালো হয়। উত্তমদের আছে একফালি জমি, সেখানে ওর বাবা ধান বোয়। ‘বাবাই সব করে ম্যাডাম, আমরা ঐ ধান মাড়াইতে যাই। গেলে কি ব্যথা হয় ম্যাডাম গায়ে, জানেন নি। ইদিকে আর ধান জমি পাবেননি, জমি থাকলেই সব ঝিল হয়ে যায়। আমাদেরও কত বলেতেছে লোকে,টাকা লিয়ে এইছে। বাবা রাজি হয়নি। একটা জল জমি আছে, মানে নীচু জমি বুজলেননি, ঐ তে বছরের ধানটা হয়ে যায় ম্যাডাম। সারা বচ্ছর আমাদের ভাত আর মুড়ির ব্যবস্থা টুকুন হই যায়।’ 


ধান চাষ সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করতে করতে যেখানে এসে থামলাম জনমানবশূন্য। ‘এবার ইন্সপেক্টর সাহেবকে ফোন করুন’-হুকুম করে উত্তম। করে কি বলব?তেপান্তরের মাঠে এনে ছেড়ে দিয়েছে উত্তমকুমার, তুমি এসে উদ্ধার করো? কোথায় আছি জিজ্ঞাসা করলে কি বলব রে বাপ? যাই হোক তাও করলাম, ইন্সপেক্টর সাহেবও তেমনি, বলল,‘এগিয়ে আসুন।’ কোনদিকে এগোব, সামনে না পিছনে? এতো দিকশূণ্যপুর। বিস্তারিত কথাবার্তা এবং অতিকষ্টে হদিস পাওয়া এক সাইকেল আরোহীকে পাকড়াও করে আমরা বুঝলাম আমরা সম্পূর্ণ  উল্টোদিকে এগোচ্ছিলাম। আমাদের যেতে হবে প্রতাপপুরের মোড়। তা আরো কিলোমিটার পাঁচ দশেক তো হবেই। 


গাড়ি ঘুরিয়ে পুনরায় আমরা ফিরে গেলাম ধান চাষের বিশদ ব্যাখ্যায়। চাষ শেষে ধান যখন বস্তায় উঠছে, গাড়ি এসে প্রতাপপুরের মোড়ে এসে দাঁড়াল।  উত্তম বলল,‘ভীম দেখবেননি ম্যাডাম?’ ভীম অর্থাৎ মধ্যম পাণ্ডব হলেন এই জেলার অন্যতম আরাধ্য দেবতা। ভীম একাদশীর দিন শুধু যে বড় করে ভীম পুজো হয় তাই নয়, মেলাও বসে বিভিন্ন এলাকায়। আত্মীয় কুটুম্বরাও আসে। উত্তমকুমারদের বাড়িতেই নাকি গিজগিজ করছে কুটুম্বদের দল। 


প্রসাদগুণ অনুসারে সবথেকে জাগ্রত হল নন্দকুমার ব্লকের অন্তর্গত ব্যবত্তার ভীম,তারপর আসে তমলুক ব্লকের নিমতৌড়ির ভীম,শহীদ মাতঙ্গিনী ব্লকে উত্তমদের গ্রামের ভীম ইত্যাদি। ইনি অবশ্য অমন জমকালো বা কুলীন ভীম নন। এণাকে কেন্দ্র করে বসেনি কোন মেলা, তবুও ভীম তো রে বাবা। আমার দেখা প্রথম ভীম। হোক না বাজারের ভিতর একচালা পাকা মণ্ডপে দাঁড়িয়ে থাকা নিঃসঙ্গ ভীম। ভদ্রলোককে কিন্তু হেব্বি মিষ্টি দেখতে যাই বলেন। আমার দেখা প্রথম ভীম বলে কথা-

অনির ডাইরি ১৫ই ফেব্রুয়ারি, ২০২২ #তাম্রলিপ্তকড়চা

 


সকালের চায়ের কাপ হাতে আলোচনা করছিলাম দোঁহে, কে কবে কোথায় যাব। দুজনে এক সঙ্গে একই ক্যাম্পে না গিয়ে পৌঁছাই, সে বড় লজ্জার ব্যাপার হবে বটেক। ‘দুয়ারে সরকার আবার হবে নাকি?’ একরাশ বিস্ময় নিয়ে জানতে চায় তুত্তুরী। যুগলে ঘাড় নাড়ি, হবে মানে, আজ থেকে তো শুরু। অতঃপর অনুযোগের সুরে, ‘তুমি তো আমায় জানাওনি মা?’ এবার বিস্মিত হবার পালা আমার। খামোখা তোকে জানাব কেন রে বাপ, এতো নৈমিত্তিক অফিসের কাজ। কটা দিন একটু দৌড়ঝাঁপ বেশী হবে এই যা। ‘আমার বাবা-মা যে আগামী কটা দিন আমাকে মোটেই পাত্তা দেবে না, এটা আমায় জানতে হবে তো-’। ক্ষুব্ধ স্বরে জানায় কন্যা। কত কিছুর জন্যই যে মায়েরা অপরাধী হয়। 


বেলা এগারোটা নাগাদ বেরোলাম। ঠিক করেছিলাম আজ পাঁশকুড়া ব্লক, পাঁশকুড়া পৌরসভা আর শহীদ মাতঙ্গিণী ব্লকে যাব। আপিস গ্রুপে ফুটে ওঠা প্রথম ছবিটা এল তমলুক ব্লক থেকে। অন্ধকার এবং বেশ ঝাপসা ছবি। এরা ভয়ানক বাধ্য এবং কর্মঠ। শেখার ইচ্ছেও প্রবল কিন্তু ছবি তুলতে একদম পারে না। চায়ও না হয়তো। টিম চুঁচুড়ার দুয়ারে সরকারের ছবি ভিডিও গুলো ফেসবুক হোটাস্অ্যাপ থেকে নামিয়ে এদের দেখিয়েছি, কেমন তুলতে হয় ছবি, কেমন করে করতে হয় এডিট তাও শেখে না ব্যাটারা। এদের সেলফি তোলারও ইচ্ছে নেই, মাঝে মাঝে সত্যিই দুঃখ হয়, এ আমি কোথায় এলাম। 


যাই হোক, যত কালোই ছবি হোক, তিন সেট ফিল্টার মারলে একটু ধলা হয়েই যাবে। তবে ফার্স্ট বয় তো বটে। গোটা তাম্রলিপ্ত টিমের মধ্যে সর্বপ্রথম এরাই কাউন্টার খুলে বসেছে এবং ছবি পাঠিয়েছে। পাঁশকুড়া যাবার পথেই পড়বে বোধহয় জায়গাটা, ঠিক করলাম ওদের ওখান থেকে ঘুরেই যাই নাহয়।  ইন্সপেক্টরকে ফোনে বললাম, ‘তুমি ফার্স্ট বয় কিনা, তাই তোমার ক্যাম্পেই সবার আগে যাব।’ খুশি হল কিনা বুঝতে পারলাম না, উল্টে জানতে চাইল, ‘আমি ফার্স্ট হলাম কি করে-’। 


অত কথা বলতে পারব না বাপ, বল যাব কি করে? আমতা আমতা করে ফোনটা ধরিয়ে দিল স্থানীয় এসএলওকে। সত্যিই ইন্সপেক্টরের পক্ষে প্রত্যন্ত গ্রামের স্কুলের লোকেশন বলে বোঝানো সম্ভব নয়। স্থানীয় ভদ্রলোক অবশ্য ভালোই বোঝালেন, আর গুগলও দেখলাম চেনে জায়গাটাকে। আমাদের উত্তম কুমারকে বললাম, ‘বুঝেছ তো। তাহলে তুমি চালাও আমি একটু বাড়িতে ফোন করেনি।’ হাইরোড দিয়ে হুহু করে দৌড়চ্ছে গাড়ি, পাল্লা দিয়ে ঝগড়া করছে বাবা। যত বলি, কটা দিন আমাদের কাছে এসে থাকতে, পৈতৃক ভিটে ছেড়ে, কিছুতেই আমার কাছে আসবে না বৃদ্ধ। কি জেদ বাপরে। তেমনি গলার জোর। ঘুরিয়ে আমি একটু গলার জোর দেখালেই শুরু করে দেয় সেন্টু দেওয়া। সঙ্গতে থাকেন আমার গর্ভধারিণী। ‘লোকটা তোকে এত ভালোবাসে আর তুই কিনা তাকেই মেজাজ দেখাচ্ছিস, ইত্যাদি প্রভৃতি।’ যেন আমি তো লোকটাকে ভালোই বাসি না। 


যে যা পারে করুক, বিরক্ত হয়ে ফোনটা কেটে দেখি গুগলের দেখানো রাস্তা ছেড়ে আমরা অন্য বাঁকে ঢুকে বসে আছি। আমাদের উত্তম কুমারকে নাকি স্থানীয় এসএলও এই রাস্তাই বলেছে। গুগল ঠিক নয়,এসএলওই ঠিক। তাই সই। কিন্তু সে কি রাস্তা রে ভাই, বড় জোর টোটো গলতে পারে, গাড়ির পক্ষে বড়ই সংকীর্ণ। গোটা রাস্তা আমার মুণ্ডপাত করতে করতে গেল উত্তম,‘এত ভেতরে আর কোন ক্যাম্পে যাবেননি ম্যাডাম। অমুক স্যার তো গেতেননি। তমুক স্যার তো গেতেননি।’ অপরাধীর মত মুখ করে বসে আছি আমি, আর উত্তম কুমার বকেই চলেছে,‘এখানকার মানুষ গুলোকে দেখুন, রাস্তার উপ্রে বাড়ি বানিয়েছে, বাড়ির সামনে গজাল পুঁতছে, যাতে গাড়ির চাকা ওর আঙনায় না উঠে পড়ে। দেখছেননি ম্যাডাম। অয় দেখুন বাড়ির সামনে কেমনি কাঠের ঢাঁই রেখেছে, অয় দেখুন ইঁটের পাঁজা রেখেছে গাড়িটা আমি চাপব কেমনে বলুন। এখন উল্টো দিক থিকে কোন গাড়ি না আসলেই বাঁচি। ’ 


যেখানে বাঘের ভয়, সেখানেই সন্ধ্যা হয়, বাঁক নিলাম আর সামনে দাঁড়িয়ে একখান টোটো। টোটো ভর্তি গ্যাস সিলিণ্ডার। এই যাঃ এবার কি হবে? হর্ন বাজিয়েই যায়, বাজিয়েই যায় উত্তম। টোটোওয়ালা বেপাত্তা। গাড়িকে ঘিরে ভিড় জমায় আসেপাশের বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসা গুড়গুড়েদের দল। রগড় আরো কত জমত কে জানে, এমন সময় দৌড়ে এল বর্ষীয়ান  টোটোওয়ালা এবং অসীম দক্ষতার সঙ্গে টোটোটাকে একটা বাড়ির একফালি উঠোনে ঢুকিয়ে দিল। টোটোকে টাটা করে একটু এগিয়েছি হঠাৎ করে সামনে এসে দাঁড়ালেন ইনি, উত্তম আর আমি যুগপৎ হাঁ হয়ে গেলাম,এমন অজ গাঁয়ে, এমন ঘিঞ্জি পরিবেশে এত ভালো, এমন সুউচ্চ মন্দির টো বানাইল কে? যানজট খানিক হল বটে, উত্তম কুমার আরেক চোট গজগজও করল, তাও নেমেই পড়লাম, এমন মন্দিরের একটা ছবি না তুললে হয়?

অনির ডাইরি ১লা -৫ই ফেব্রুয়ারি ২০২২

 অনির ডাইরি ১লা ফেব্রুয়ারি ২০২২



কেউ জমিয়ে রাখেন স্ট্যাম্প তো কেউ সংগ্রহ করেন কয়েন। কেউ বা জমান ’ভারি ভারি সিল্কের শাড়ি আর মোটা মোটা সোনার গয়না’। আর আমি জমাই অভিজ্ঞতা আর স্মৃতি। হরেক রঙের, হরেক স্বাদের অভিজ্ঞতা আর তার স্মৃতি। 


সরস্বতী পুজো এলেই মনে পড়ে যায়, এই তো সেদিন কোলে করে বাড়ি নিয়ে এসেছিলাম তুত্তুরীর বুজু সরস্বতীকে। চুঁচুড়ার রবীন্দ্রনগর মার্কেট জুড়ে তখন খুদে থেকে প্রমান সাইজের সরস্বতীদের মেলা। তাদের মধ্যে লুকিয়ে বসেছিল আমাদের বুজুটা। কিন্তু তানিয়াদির চোখ এড়ানো কি অতই সহজ রে বাবা! ঠিক খুঁজে বার করে দরদস্তুর করে, রমেশকে দিয়ে গাড়িতে তুলিয়ে দিল তাকে। পুঁচকে ছাঁচের ঠাকুর, বড় মিষ্টি মুখটা আর গা ভর্তি অভ্রর চিকিমিকি। 


কোলে করে বুুজু সরস্বতীকে গাড়িতে তোলার সময় পইপই করে সচেতন করল রমেশ, ‘একে সাবধানে কোলে নিয়ে বসবেন ম্যাডাম। পড়ে না যায়।’ বুজু সরস্বতী কিনা, বড় ছটফটে ও। গাড়ি যায়, গাড়ি যায়, আচমকা কোথা থেকে যে এক লক্কড় মার্কা বাইকওলা গাড়ির সামনে এসে উদয় হল, ঘচাং করে ব্রেক কষল আমাদের সুশান্ত। যাকে আমি বিগত কয়েক মাস ধরে প্রশান্ত বলে ডেকে আসছি, এবং সেও বিনা আপত্তিতে “হ্যাঁ ম্যাডাম” বলে সাড়া দিয়ে আসছে। কৃতঘ্ন বাইকওলা প্রাণ বাঁচানোর জন্য ধন্যবাদ দূরে থাকুক, চারটি গালাগাল দিয়ে পগার পার। সুশান্ত সম্প্রদায়গত ভাবে ছিল সাঁওতাল,এবং জাতবৈশিষ্ট্য বজায় রেখে নিখাদ সরল এবং সাদাসিধে। এই যদি আমাদের পুরানো ড্রাইভার রাজীব বা বিপ্লব হত, বাইকওলার কপালে সেদিন দুঃখ ছিল। 


যাক বাইকওলা তো পগারপার, সুশান্ত এবং আমি হতভম্ব আর বুজু সরস্বতীর সুউচ্চ চালচিত্র, ঠিক চায়ে ডোবাতে যাওয়া মারি বিস্কুটের মত দুখণ্ড। কি হবে এবার? ভাঙা ঠাকুরে কি পুজো হয়?

 গাড়ি তখন নিবেদিতা সেতুতে। একবার ভাবলাম দিই গঙ্গায় ভাসিয়ে। বাড়ির পাশের বাজার থেকে কিনে নেব খন একটা। শ আড়াই টাকা জলে গেল, এই যা দুঃখের। ভাবলাম বটে, কিন্তু ফেলতে পারলাম না। কেমন কোল ঘেঁষে বসে আছে দেখ, যেন একটা ছোট্ট মানুষ। মায়ের ওমে খুঁজছে নিরাপত্তার আশ্বাস। কি করি? 


আমার থেকেও বেশি মন খারাপ সুশান্তর,“কি হবে ম্যাডাম? আমার গাড়িতে ভেঙে গেল ঠাকুরটা?ইশ্। ” বেচারার কষ্ট দেখে ফোন করলাম আমার বুড়োকে, বৃদ্ধ যদিও নাস্তিক, তবে কন্যার জন্য, রামকৃষ্ণ দেবের ভাষায়, “ দুগ্ধ এবং তামাক” উভয়ই সেবনে সক্ষম। মায়ের হাতে বাননো এক কাপ গরম চায়ে, পরম তৃপ্তির চুমুক মেরে বাবা বলল, “ধুর!ধুর! ফেলে দিবি কেন? মনে নেই, রাণী রাসমনিকে কি বলেছিলেন রামকৃষ্ণদেব? পরিবারের কারো হাত-পা ভাঙলে তাকে ফেলে দিবি? ফেভিকুইক দিয়ে জুড়ে দে না। ”

সুশান্তর যেন ধড়ে প্রাণ এল,“গাড়িতে একটা ফেভিকুইক আছে ম্যাডাম। কিনেছিলুম। আপনি নিন।” তাই করলাম। কি গন্ধ বাপস্। চোখে জল এল। কিন্তু বুজু সরস্বতীর চালচিত্র তো জুড়ল না বাপু। সুশান্ত কাতর স্বরে বলল,“ম্যাডাম, ওকে কোলে নিয়ে বসুন। শুকনো মাটি তো তাই হুহু করে আঠা টেনে নিচ্ছে। আপনাদের বাড়িতে মাটি নেই ম্যাডাম? একটু এঁটেল মাটি ডেলা করে জুড়ে দিলেই আটকে যাবে। ” শহুরে আবাসনে বিশাল বাগান, প্রচুর গাছ, কিন্তু মাটি কোথায় পাই?

সুশান্তর বিশ্বাস হয় না। ম্যাডামের বাড়ি মাটি নেই? শেষে বলে “আপনি দুঃখ করবেন না ম্যাডাম, একটা দোকান দেখে দাঁড়াব, আর একটা ফেভি কুইক কিনে দেখা যাক না?” বেলঘড়িয়া এক্সপ্রেস ওয়েতে কোথায় ফেভি কুইক পাবি বাবা? খানিক গিয়ে ঘচাং করে গাড়ি দাঁড়িয়ে গেল। সামনে একটা মার্বেলের মূর্তির দোকান,“একটু বলে দেখব ম্যাডাম? যদি ওরা জুড়ে দেয়?” কাল বাদে পরশু সরস্বতী পুজো, অনেকে তিথিগত ভাবে কালই করবে, এখন কার দায় পড়েছে, সুশান্তর ম্যাডামের মেয়ের বুজু সরস্বতীর চালচিত্র জুড়তে বসবে। ছেলেটা শুনলে তো?


কি বলল, কি শুনল কে জানে, ফিরে এসে বলল, “দিন ম্যাডাম, ওরা দেখতে চাইছে।” কোলে করে নবজাতকের মত বুজু সরস্বতীকে নিয়ে গেল হাইওয়ের পাশের ঢালে। কালো প্লাস্টিক টাঙানো দোকানে থরে থরে দাঁড়িয়ে আছেন নানা দেবদেবী- মহাপুরুষের দল। সময় আর কাটে না। বেলঘড়িয়ার নচ্ছার মশার দল বার কয়েক আক্রমণ করে হাফ লিটার রক্ত শুষে নিল। তারপর দেখি সুশান্ত আসছে, কোলে বুজু সরস্বতী।পিছন পিছন দোকানের মালিকও উঠে এসেছে। “মার্বেলের গুঁড়ো দিয়ে জুড়ে দিয়েছি দিদি। চিন্তা নেই। ” দেখলাম রঙও করে দিয়েছেন ওণারা।  সুশান্ত বলল,“ম্যাডাম ওরা কিছু চায়নি, কিন্তু ২০-৩০টা টাকা দেবেন?” মাত্র ২০/৩০? ২০০/৩০০ হলেও দিতে রাজি ছিলাম। দিতে গেলাম-কিছুতেই নেবে না। কে বলে ভালো মানুষ নেই? শেষে সুশান্ত করজোড়ে বলল,“নিন না দাদা,ম্যাডাম ভালোবেসে দিচ্ছেন, চা খাবেন খন। নাহলে ম্যাডাম দুঃখু পাবে। ”


এত ঘটা করে যিনি সুদূর চুঁচুড়া থেকে দমদম বিমানবন্দরে অবতরণ করেছিলেন এবং বাসস্ট্যাণ্ড থেকে যাকে নবজাতকের মত কোলে করে সিঁড়ি ভেঙে চার তলায় তুলেছিল শৌভিক, সেই বুজু সরস্বতীকে আর সাহস করে তাম্রলিপ্তে আনতে পারিনি আমি। যা দস্যি মেয়ে, কে জানে আবার যদি ভেঙে বসে চালচিত্র বা আঙুল। সেই কথাই বলছিলাম গাড়িতে বসে, এবারে বোধহয় আর পুজো পাবে না বুজুটা।  


সেদিন রবিবার। মাসে একবার বাড়ি ফেরে আমার বর। শুক্রবার রাতে ফিরে মহানগরে প্রবেশ করে, রাতে হাটারির চাইনিজ, দিনে আর্সেলানের বিরিয়ানি আশ মিটিয়ে খেয়ে আবার রবিবার সন্ধ্যায় তাম্রলিপ্তের পথ ধরি আমরা। সেদিনটাও রবিবারই ছিল। রাত তখন আটটা। সদ্য এক পশলা বৃষ্টিতে ভিজে বোম্বে রোড দিয়ে হুহু করে দৌড়চ্ছে শৌভিকের সাদা গাড়ি। গাড়ি চালাতে চালাতে আমাদের কথা শুনছিল মহকুমা শাসকের বাহনচালক পলাশ। হঠাৎ বলে উঠল, ‘এখেনেই পুজো করুন না ম্যাডাম। সব হয়ে যাবে। ঠাকুরটা আমি বলে দেব-।’ 


দিন তিনেক বাদে, ঘোরতর আপিস টাইমে পলাশের ফোন, ‘ম্যাডাম পুজো করবেন তো?তাহলে বামুন ঠাকুরকে বলে দিই।  কারণ এর পর দেরী কললে আর বামুন পাবেননি।’ ঠাকুর মশাই দিয়ে আবার কবে পূজিত হয় আমাদের বুজু সরস্বতী? ও তো আমিই বসি পাঁচালি খুলে, পিছনে করজোড়ে বসে তুত্তুরী আর আমাদের উমারাণী। অং-বং-চং মন্ত্র পড়ি আমি। তারপর বলি পুষ্পাঞ্জলি দেবে তো। দুটোতেই মাথা নাড়ে একসাথে। অতঃপর ‘সরস্বতী মহাভাগে বিদ্যে কমলো লোচনে-’। এই তো হয়। আমার পাঁচালিটা অবশ্যি বাড়িতেই রয়ে গেছে। সাতপাঁচ ভাবতে ব্যস্ত ছিলাম, ফোনের ওপারে অধৈর্য হয়ে ওঠে পলাশ,‘ ম্যাডাম তাহলে ঠাকুর মশাইকে বলে দিই? আমাদেরই স্টাফ, খুব বেশী দক্ষিণা লাগবেনি। আর ঢাকিকেও বলে দিই ম্যাডাম? আমাদের অফিসেরই ঢাকী, স্যারের বাড়ির পুজোয় ও বাজাবে বুলছে-।’ সরস্বতী পুজোয় ঢাক! হাসব না কাঁদব বুঝে উঠতে না উঠতেই কেটে গেল ফোন-


অনির ডাইরি ২রা ফেব্রুয়ারি, ২০২২


‘হ্যাঁ গো দিদি তোমাদের বাড়িতে সরস্বতী পুজো হয়?’ যাঁদের উদ্দেশ্যে বলা, তাঁদের একজন ছোট হাত কোদাল দিয়ে বাগানের মাটি কোপাচ্ছিলেন, অপরজন ব্যস্ত ছিলেন চুপড়ি করে ঘাস তুলতে। দুজনেই খুব কথা বলতে ভালোবাসেন, ভালোবাসি তুত্তরী আর আমিও। তাই সক্কাল সক্কাল দিদিরা কাজে এলেই আমরা মা মেয়ে গুটিগুটি এসে দাঁড়াই, দু চারটে কুশল সংবাদ বিনিময় হয়। দিদি বা মাসিরা গল্প শোনান আর কোন কোন বড় সাহেবের বাংলোর বাগান ওনাদের হাতে তৈরি। কেমন সুন্দর ফুল ফোটে সেথা, কত কত সব্জি ফলে সেথা। 


'এই এত্ত বড় বড় গেঁদা, দেখেন মেডাম। সব আমাদের হাতে তৈরি। ও বাড়ির মেডাম তো সকাল বিকেল ছবি ছারতেছেন। তারপর কত্ত কমলি(কলমি) হইছে, মেথি হইছে। ফুল কপি, বাঁধা কপি, গাজর, পালং শাক,নঙ্কা, টমেটো-’। হতভাগ্য আমরা।  আমাদের বাগানে মহকুমা শাসকের আদরের বাহনচালক কেবল ওলকপি লাগিয়েছিলেন। যেদিকে তাকাই ওল কপি মাইরি। ফুল ও কিছু লাগানো হয়েছে বটে, তবে পাশাপাশি বাংলো গুলোর তুলনায় তাদের শোভা নেহাৎই দীন। অন্য সাহেব,মেমসাহেবদের বাংলোয় গেলে তুত্তুরী আর আমি হ্যাংলার মত ফুল দেখে বেড়াই। 


মাসিরা সদ্য কাজে আসছে কয়েকদিন। এসেই অমুক সাহেবের বাগান আর তমুক মেমসাহেবের গল্প জোড়াতে প্রথম দিকে খুব রেগে যেত তুত্তুরী। এখন আর রাগে না। বরং মাসিদের সঙ্গে গপ্প করবে বলে বসে থাকে। গাঁ ঘরের হরেক রকম খবর দেয় মাসিরা, যার অনেকটাই তুত্তুরীর কাছে রূপকথা। সেদিন যেমন বাড়ি থেকে এক ঝুড়ি কুমড়ো ফুল দিয়ে গেছে মাসিরা,তুত্তুরী ভাজা খাবে বলে।  


 আরেকদিন যেমন ভীম পুজোর গল্প শোনাচ্ছিল মাসিরা। এই জেলায় ভীম অত্যন্ত জাগ্রত দেবতা।ভীম একাদশীর দিন বিশাল আড়ম্বর সহ পূজিত হন মধ্যম পাণ্ডব। ‘ম্যালা লোকে মানত করে মেডাম। আমার ব্যাটাকে তো মানসিক করেই পেয়েছি।’ বলছিলেন প্রৌড়া। এদের পুত্রাকাঙ্খা বড় প্রবল। শ্রীমতী তুত্তুরী যে একলা একেশ্বরী, এটা কিছুতেই এদের গলা দিয়ে নামে না।


 অপেক্ষাকৃতা নবীনা যিনি, তিনি বলছিলেন,‘আমার দুই মেয়ের পর ব্যাটা হয় মেডাম। আমরা তো গরীব মানুষ, আমার বর,শাশুড়ী সবাই না করে দেছিল ব্যাটা নিতে। ডাক্তারবাবুর থেকে ওষুধ ও এনে দেছিল। কেবল আমার এক বুড়ি দিদি শাশুড়ী কইলেন, তোর এত ব্যাটার শখ, তুই লে। এখনই লিস না। বাড়িতে অশান্তি হবে। দুয়েক বছর বাদ, ওষুধ খাবা বন্ধ করে দিবি নি। সে আমার কি দুঃখ মেডাম। পরের ব্যাটা দেখি, আর চোখের জল ফেলি। তারপর খুড়িমাই( উপস্থিত প্রৌঢ়া) কইল, তুই ভীমের কাছে মানত কর কেনে। তাই কল্লাম। মোর কাছে তো ট্যাকাপয়সা কিছু ছেল না। তখন তো এ সব কাম করতুমনি। তাই ঠাকুরকে কয়েছিলাম, ব্যাটা হলে,তোমায় মাখা দিয়ে পুজো দুব। তাই দিয়ে এলুম।’ 


তুত্তুরী আর আমার শহুরে কান বোঝে না মাখাটা কি বস্তু। খুড়িমা বুঝিয়ে দেয়, ‘সন্দেশ গো মেডাম। তুমরা সন্দেশ বলো, আমরা বলি মাখা।’ তা তুমি কি মানত করেছিলে তো দিদি, জানতে চাই আমি। উত্তর পাই খুড়িমা ভীমকে, ভীম মানত করেছিল। মানে? একসাথে বলে উঠি আমরা মা আর মেয়ে। খুড়িমা বুঝিয়ে দেয়, বড় ভীমকে, ছোটা ভীম মানত করেছিলেন তিনি। খুড়িমা বলেন, ‘আমরা গরীব মানুষ মেডাম, তাই ছোট ভীমকে শুধু জবা ফুল চেনোনি, ঐ ফুলের মালা পরিয়ে দিয়ে গেছলাম। কত লোকে কত টাকার মালা পরায় তুমি জানোনি।’ নাঃ আমি সত্যিই জানি না বটে।  


মাসিদের ব্যাটা প্রেমে, প্রথমদিকে খুব আহত হত তুত্তুরী। কিন্তু রাতারাতি যে মাসিদের লিঙ্গ বৈষম্য বা নারী পুরুষের সমানাধিকার সম্পর্কে সচেতন করা যাবে না, সেটা এখন বুঝে গেছে। মাসিরা মাসিদের ভাবে থাকে, আমরা আমাদের। তাতে আমাদের সখ্য হতে কোন সমস্যা হয়নি। 


 আর তিনরাত পোহালেই সরস্বতী পুজো। এখনও কিছুই হয়নি আমাদের। শৌভিকের আদরের বাহনচালক পলাশ অবশ্য আমাদের সকাল বিকেল আশ্বস্ত করছে, ‘কুন চিন্তা নেই ম্যাডাম। ঠাকুর আমি বলে গেইছি। তুত্তুরীকে লিয়ে আনতে যাব। বড় ঠাকুর লিব ম্যাডাম। অরুণের ঠাকুর। খুব নাম। ও ছাঁচে ঠাকুর বানায় না ম্যাডাম। হাতে গড়ে। আপনি শুধু দেখবেন-। ’ আমি অরুণকে চিনি না, সেটা হয়তো আমারই অজ্ঞতা বটে। আমি এখনো এই শহরের কিছুই চিনে উঠতে পারিনি।


 পলাশ চায়ও না, আমি চিনি। আমি দোকান যাব বললেই, পলাশ দৌড়ে আসে,‘ দাঁড়ান না ম্যাডাম, স্যারকে একবার আপিসে ছেড়ে দিয়ে, আমি নিজে যাব। একটুও সময় পাচ্ছি নে।’ সময় আমার বরই পাচ্ছে না,তো পলাশ। সেটা নিয়ে আমার কোন নালিশ নেই। মুস্কিল হচ্ছে ফুল থেকে ফল, মিষ্টি, দশকর্মা কোনকিছুই পলাশ আগে ভাগে আনতে ইচ্ছুক নয়। সবকিছুই সে টাটকা লিয়ে পালিয়ে আসবে। অর্ধেক জিনিস কিনবেও না। যেমন-‘কলাগাছ আমি বাড়ি থেকে কেটে লিয়ে আসব। পান-সুপুরি তো আমার বাড়িতেই আছে ম্যাডাম। ওটা পুজোর দিন সকালে আনব। গোমূত্র-গোময়? ও তো আমার বাড়িতেই গরু আছে ম্যাডাম। সক্কাল সক্কাল লিয়ে পালিয়ে আসব।' ইত্যাদি এবং প্রভৃতি। 


  এই আন্তরিকতা, স্যারের প্রতি এত ভালোবাসা প্রশংসার ঊর্ধ্বে, কিন্তু মুস্কিল হল আমাদের বাড়ির পুজো, অথচ আমার এই মুহূর্তে করার কিছুই নেই। উত্তেজনার পারদকে নামাতেই গল্প করতে এসেছিলাম মাসিদের সঙ্গে। কথায় কথায় জানতে চাইলাম, ওদের বাড়িতেও পুজো হবে কি না। জবাবে লাজুক ভাবে হেসে, মাথায় ঘোমটাটা ভালো করে টেনে, উবু হয়ে বসে দোঁহে বললেন,  ‘না মেডাম। আমরা তো গরীব মানুষ। আমাদের বাড়ি পুজো হয় না।’ আমাদের বাড়ি হবে, তোমরা এসো, কেমন। বড়জন বলল, আচ্ছা।  আর ছোটজন বলল,‘ম্যাডাম আমার ব্যাটাকে লিয়ে আসব? ব্যাটাটা রোজ বলে, ও মা তুমি কুথা কাজে যাও? আমায় লিয়ে যাও নি কেন?’ এত কষ্ট করে পাওয়া ব্যাটা, তাকে না আনলে হয়? তাই বললাম, এসো। সাথে বেটি গুলোকেও নিয়ে এসো বটে, ওরা মোটেই ফেলনা নয়। 

অনির ডাইরি ৪ঠা ফেব্রুয়ারি, ২০২২


কে বলবে রাত পোহালেই বসন্ত পঞ্চমী, জানলার বাইরে ভরা শ্রাবণের কালো আকাশ, অঝোর ধারাপাত আর মাতাল ঝোড়ো বাতাস। তুত্তুরীর মুখেও পাল্লা দিয়ে জমছে ঘন বাদল। আগামী কাল পুজো, অথচ এখনও আসেনি ঠাকুর। আসেনি পুজোর ফুল, ফল, মিষ্টি বা দশকর্মার সামগ্রী। আসেনি জলচৌকি বা পুজোর বাসনকোসন। 


অথচ গতকালই আপিস টাইমে ঠাকুর  আনতে যাবার কথা ছিল তুত্তরী আর তার মাসির। সেই মোতাবেক প্রস্তুতও হয়েছিল দোঁহে, মোক্ষম মুহূর্তে শৌভিকের বাহনচালক পলাশ এসে সংবাদ দিল,  ঠাকুর নাকি তখনও কাপড়ই পরেননি। কি ঠাকুর রে তুই মা, পরশু তোর পুজো বলে কথা আর তুই এখনও রেডি হতে পারলিনি? 


যাই হোক সে তো গতকালের কথা, আজ তো তাঁকে আসতেই হবে। পলাশ বলেই গেছে, ‘সকাল সকাল তৈরি থেকো বুকু বাবু, তোমায় লিয়ে ঠাকুর আনতে যাব।’ পলাশ জানেই না বুকু বাবুর আসল নাম শ্রীমতী তুত্তুরী এবং তাঁকে অন্য নামে ডাকলে তিনি ভয়ানক অখুশি হন। পলাশ অবশ্য নির্দোষ, যা শুনেছে তাই শিখেছে। তুত্তুরীর বাবা যে কিছু বলেই ডাকে না, আর মা যখন যা মুখে আসে সবার সামনে তাই বলেই ডাকে- বুকু, বুকাই, বকবক, বুকলু,বাকলা, বুল্টু, বাল্টু, বালটি এমনকি বক রাক্ষসএবং বকাসুর। 


সাড়ে নটা নাগাদ, পলাশ কাকুর সঙ্গে তুত্তুরী আর তার মাসি বেরিয়েছে ঠাকুর আনতে, ঘড়ির কাঁটা মধ্যাহ্নের ঘর স্পর্শ করতে চলল, এখনও তাদের পাত্তা নেই। বাইরে ক্রমশঃ বাড়ছে বৃষ্টির বেগ, বৃষ্টি মাথায় নিয়েই আপিস বেরোল শৌভিক। আর কদিন বাদেই পৌরসভা নির্বাচন, গমগন করে  চলছে নমিনেশন পক্রিয়া। যাবার আগে অবশ্য প্রতিশ্রুতি দিয়ে গেল, জলদি ফেরার খুব চেষ্টা করবে আর আগামী কালকের দিনটা বরাদ্দ রাখবে শুধু আমাদের জন্য।


ভিজতে ভিজতেই গৃহে প্রবেশ করে আমাদের সরস্বতী। গাড়ি থেকে তাকে কোলে করে নামিয়ে সযতনে টুলের ওপর বসায় সিকিউরিটির দায়িত্বে থাকা অমিত। পুজো নিয়ে যতটা উৎসাহী তুত্তরী আর আমি, ততোটাই অমিত আর পলাশ। পলাশ  সগর্ভে বলে, ‘দেখতেছেন ম্যাডাম, কেমন সোন্দর ঠাকুর।  এ হল আমাদের অরুণের ঠাকুর। ছাঁচের কাজ ওর কাছে পাবেননি, সব হাতে গড়া।‘ 


ঠাকুর তো হল, এবার সাজানোর পালা। বেলা তিনটে নাগাদ টিপটিপে বৃষ্টি মাথায় নিয়ে এসে হাজির হয় পার্বতী আর তার ছানাপোনারা। পার্বতী মহকুমা শাসকের পাকশালা সামলায়। তার দুই পুত্রকন্যার সাথে তুত্তুরীর বড়ই সদ্ভাব। সদ্ভাব রেবতীর ছেলেমেয়েদের সঙ্গেও। রেবতী বাংলোর ঝাড়ন পোঁচন এবং বাসন মাজার কাজটা করে। সম্পর্কে পার্বতী আর রেবতী সহোদরা। ওরা নাকি পাঁচ বোন, রেবতী মেজো আর পার্বতী ‘সেনো’। প্রথমবার শুনে, আমিও বুঝিনি সেনো বা স্যানো মানে কি? পার্বতী দুহিতা মিষ্টি, খুব মিষ্টি মিষ্টি করে বুঝিয়েছিল আমায়, বড়,মেজ, সেজর পর যে জন্মায়, তাকে এই জিলায় বলে স্যানো। ঠিক যেমন হাওড়ায় বলে, ‘ন’। 


পুজো শৌভিকের সরকারি নিবাসে হলেও পুজো আসলে পার্বতী, রেবতী এবং আমার পাঁচ ছানা অর্থাৎ লাবণী,মিষ্টি, সূর্য, জগদীশ এবং তুত্তুরীর। রীতিমত পুজো স্পেশাল মিটিং করে তা ওদের ভালো করে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে। কি কি লাগবে বলো, যোগাড়ের দায়িত্ব আমার।  ওদের দাবী মোতাবেক আমাদের আপিসের শান্তনু কিনে এনে দিয়েছে রঙ বেরঙের মার্বেল পেপার, ডবল সাইড টেপ, আল্পনা দেবার রঙ, তুলি, রাংতার ঝাড় এবং অন্যান্য সাজানোর উপকরণ আর রঙবেরঙের পতাকা। গতকাল রাত জেগে শিকলির কাগজ কেটেই রেখেছে তুত্তুরীর মাসি। এবার শুধু ঝটপট করে শিকলি, এরা বলে শেকল বানাতে হবে। আর ঘর সাজাতে হবে। 


মেয়েগুলো বসে যায় শিকলি আর ফুল বানাতে। সাথে সাথে জমে ওঠে কাল সকাল বিকেল কে কি পরবে তার গল্প। ছেলেগুলোর ওসব সাজুগুজুতে উৎসাহ নেই, তারা হাত লাগায় সোফা,সেন্টার টেবিল ইত্যাদি সরিয়ে ঠাকুর বসার জায়গা করাতে। শৌভিকের সদ্য কাচা চাদর দিয়ে ঠাকুরের পিছনের চালচিত্র বানানো হয়। আপিস ফেরৎ যা দেখে যুগপৎ ভ্রু কোঁচকায় এবং ঠোঁট ফোলায় আমার বর। সাহস করে বলতে পারি না, এটা দু নম্বর চাদর বটে, প্রথমটা জানলায় ঝোলানোর পর বাতিল করেছে বাচ্ছাদের দল। 


 ভালো কাঁচিটা কার দখলে থাকবে এই নিয়ে এক প্রস্থ হাতাহাতির উপক্রম হয়, দমকা হাওয়ায় খুলে যায়, উড়ে যায়, ছিঁড়ে যায় বাইরের দরজায় এবং বারন্দার টাঙানো কাগজের শিকলি। হাওয়ার দমকে খসে পড়ে ঘরের ভিতরে সাজানো কাগজ আর রাংতার ডেকরেশন। হতোদ্যম হয়ে রাত আটটা নাগাদ বাড়ি চলে যায় ছেলেমেয়েদের দল। কালও যদি এমন বৃষ্টি হয়, কি হবে কে জানে। অমিত কেবল আশাবাদী, 'না ম্যাডাম, দেখবেন কাল সকালে সব ঠিক হয়ে যাবে। যা খুলে যাচ্ছে যাক, আমি সক্কাল সক্কাল উঠে, সব লাগিয়ে দেব।' 


 সাড়ে আটটা নাগাদ ফল, দশকর্মা, হোমকুণ্ড, বাসনকোসন এবং ঠাকুর বসানোর জলচৌকি নিয়ে হাজির হয় পলাশ আর নবেন্দু। ফুল, পান-সুপারি, কলাগাছ, গোমূত্র, গোময় নাকি কাল সকালে আসবে। আর আসবে মিষ্টি, একদম টাটকা-টাটকা। রাত নটায় নতুন করে ঝাঁট দেওয়া মোছা হয় ঠাকুর বসার ঘর, আলপনা দিতে বসি আমি। প্রথমে জলচৌকিতে আল্পনা আঁকা হয়, তারপর মঙ্গলঘট বসানোর জায়গায়। 


রাত দশটা নাগাদ খাওয়াদাওয়ার পাট চুকলে, চৌকাঠে আল্পনা দিতে বসি আমি। সবে রাত দশটা, মহানগরে কলির সন্ধ্যা, অথচ এখানে মনে হচ্ছে যেন নিঝুম রাত। ব্যাঙ আর ঝিঁঝির ডাকে কান পাতা দায়। কি সুন্দর আল্পনা দিত ঠাকুমা। ভিজে চালকে শিলে বেটে, এক চিলতে ছেঁড়া ন্যাকড়া দিয়ে ফুটিয়ে তুলত অনুপম নক্সা। কি না থাকত তাতে, ফুল, লতাপাতা, ধানের ছড়া আর সবার শেষে লক্ষ্মীর পায়ের ছাপ। তখন তো ইউটিউব ছিল না, কোথা থেকে যে ভেবে ভেবে নক্সা বার করত ঠাকুমা কে জানে। বাইরের জোলো ঠাণ্ডা হাওয়ায় রীতিমত কাঁপন ধরে যাচ্ছে, তারই মধ্যে ইউটিউব খুলে আল্পনা দিচ্ছি আমি আর পিছন থেকে বিশেষজ্ঞ মতামত দিচ্ছেন শ্রীমতী তুত্তুরী। আমার অন্যমনস্কতার সুযোগে মাসির সাজের বাক্স ঘেঁটে বেরিয়েছে কবে কার জমে যাওয়া মেরুন নেলপালিশের শিশি। তাই নিয়ে বিস্তর কসরৎ করছে দোঁহে, তিনবার বললাম, আমারটা পরো, কান করে না কেউ। আমারই পরা হয়নি অবশ্য, আর কখন পরব কে জানে!


সিকিউরিটির ঘর পায়ে পায়ে এগিয়ে এসে, রেলিং এ ভর দিয়ে দাঁড়ায় অমিত, তারপর মোবাইলে একটা ছবি আমায় দেখিয়ে, অত্যন্ত কুণ্ঠা ভরে  বলে,‘ ম্যাডাম আমায় যদি সুযোগ দেন, হুবহু এইটা এঁকে দেব-।বেশীক্ষণ লাগবেও না।  মানে আপনার তো আরও অনেক কাজ আছে।’ আমি অনুমতি দেবার কে, এটা তো ওদের সবার পুজো, যার যা ইচ্ছে হয়, যা প্রাণ চায় করুক। শুধু আনন্দে থাকুক সব্বাই, আমি তো শুধু এটাই চাই।

আরো কয়েকজনকে নিমন্ত্রণ করলাম বটে, সন্ধ্যে বেলা শৌভিক বাড়ি ফিরতেই ঘোষণা করলাম, পুজোর অন্য কোন কাজ আমায় করতে দেওয়া হচ্ছে না বটে, তবে একটা কাজ আমি করেছি। কটা লোককে নিমন্ত্রণ করেছি বটে। শৌভিক শুধাল কাদের? বললাম সিকিউরিটি ছেলে দুটোকে, ছানাপোনা সমেত ঘাস ছেঁড়া মাসিদের, রান্নার দিদি, বাসন মাজার দিদি আর তাদের ছানা এবং পোনাদের। অনুমতি করলে ওদের বরদেরও বলতে পারি। খামোখা বরের জন্য আর রান্না করবে কেন ওরা? এবার পলাশের পালা। পলাশ তুমিও এসো কেমন? তবে একা নয়, সপরিবারে কিন্তু।

 

Monday 7 February 2022

অনির ডাইরি ২৪ শে জানুয়ারি, ২০২২

 


কি ভীষণ মিস করছিলাম আমার পুরাণ টিমকে। কি বড় উৎসব হত আজকের দিনটায়। সকাল থেকে নির্বিকার মুখে ঘুরে বেড়াত সবাই, যেন ভাজা মাছটা উল্টে খেতে জানেই না কেউ। কিন্তু আমার হ্যাংলা মন টের পেত ঠিকই, যে কিছু একটা ঘোঁট পাকাচ্ছে ব্যাটারা।  ঠিক বেলা একটা-দেড়টা নাগাদ সদলবলে ঢুকে আসত সবাই। আমার ঠিক ডান পাশে রাখা সবুজ তোয়ালে ঢাকা কাঠের চেয়ারটায় বসতে বসতে তাড়া লাগাতেন বর্মন সাহেব, ‘এই রমেশ, কৌশিক, ধীমান জলদি এসো সব।’ 

টেবিলের উল্টোদিকে আমার ঠিক সামনের চেয়ার গুলো বরাদ্দ থাকত আমার ইন্সপেক্টরদের জন্য। ডানদিকেরটায় বসত নির্মল। মাঝে সঞ্চিতা আর কৌশিক। বাঁদিকে অরুণ বাবু। একটু পিছিয়ে রাখা একটা চেয়ারে আরাম করে হেলে বসত চঞ্চল। দেওয়ালে সাঁটানো চেয়ার গুলোতে ঘড়ির কাঁটার দিকে বসত সোমনাথ, ধীমান, প্রীতি, ঝুমা, মাম্পি, প্রিয়াঙ্কা, সমীর, প্রদীপ, শ্যামল, শুভজিৎ আর তার পাশে দর্প। দরজার কাছের চেয়ারে এসে বসত রেশমা আর চন্দ্রা। বিদ্যুৎ জীবনেও বসত না। আর বসত না রমেশ। সব কিছুর তদারকি যে ও করত। কেক কিনে আনা,আমার ড্রয়ার হাঁটকে মোমবাতি থুড়ি রঙ মশাল খোঁজা, বর্মন সাহেবের কাছ থেকে লাইটার চাওয়া এবং রঙ মশাল ধরানো। প্রতিবারই ভয় পেতাম আমি, দিল আমার টেবিল বা গোটা কয়েক ফাইল পুড়িয়ে। 


ছুরি ধরার সাথে সাথেই মোবাইল ক্যামেরা নিয়ে রেডি হয়ে যেত রমেশ আর সোমনাথ। ‘হ্যাপি বাড্ডে টু ইউ’ একসাথে শুরু তো করত সবকটা। শেষ পর্যন্ত গাইত কেবল দুজন এএলসি সুখেন বর্মন আর সিকেসিও সোমনাথ হাঁসদা। কাটতে শুরু করার পর ধীমান আলমারি খুলে বার করত এক দিস্তা কাগজের প্লেট।  অতঃপর মাথা পিছু হিসেব করে বাকি কেকটা কেটে বিতরণ করত রমেশ।বাদ যেত না তুত্তুরীও। ওর জন্য বড় একটা টুকরো কেটে, একটা কৌটো করে সরিয়ে রাখত রমেশ। তার আগে মিটে যেত উপহার প্রদান পর্ব। কত কি যে পেতাম। আরএলও চুঁচুড়া থেকে দিত, রমেশ একটা দিত, ঝুমা দিত, প্রিয়াঙ্কা দিত, প্রদীপ তাদের খেতের ঝাঁকা ভর্তি টাটকা সব্জি দিত, লাজুক বিদ্যুত লুকিয়ে মস্ত ক্যাডবেরি অরিও রেখে যেত ড্রয়ারে আর মাম্পি দিত গাছ। পাগলী মেয়েটার জন্য গাছে গাছে ভরে উঠত আমার ফ্ল্যাটের ছোট্ট ব্যালকনি বাগিচা। 


ঠিক বেলা দেড়টা নাগাদ ফোন করল সঞ্চিতা, ‘হ্যাপি বাড্ডে ম্যাডাম। যদিও বিলেটেড। কাল আর ফোন করিনি, জানতাম আপনি ভীষণ ব্যস্ত থাকবেন।’ ফোন কেড়ে কথা বলল কৌশিকও। পুরাণ দিন, সোনালী দিনের গল্প হল খানিকক্ষণ। সঞ্চিতা বলল, ওরা আমায় মিস করছে, আমি বললাম আমি ওদের মিস করছি। কে বেশী মিস করছে এই নিয়ে চাপানউতোর অন্তে যখন ফোন রাখলাম, তখনও জানি না কি চলছে আমার নতুন আপিসে। দিব্যি গম্ভীর মুখে লোকজন ঢুকছে, বেরোচ্ছে। পাঁচ কেজি বেনিফিট নিয়ে এসে চেক করাল শান্তনু আর জসূয়া। গুগল শিট আপডেট করলাম। কি সব রিপোর্টে কি যেন গরমিল পাওয়া গেছে তাই নিয়ে খুব এক চোট চেঁচামিচি করলাম। কলকাতায় ফোন করে দুবার সুকন্যা আর দুবার শ্যামাপ্রসাদের কাছে ঘ্যানঘ্যান করলাম। 


তিনটে নাগাদ খেতে গেলাম। তুত্তুরীর সঙ্গে রুটি আর ওলকপির ঘ্যাঁট খেয়ে সাড়ে তিনটেয় আবার আপিসে ঢুকলাম। কি অসম্ভব মনোযোগ দিয়ে কাজ করছে লোকজন, জহর বাবু এসে চা দিয়ে গেলেন। ঘড়ি বলল, চারটে বাজে হে, জানলার বাইরে আড়ামোড়া ভেঙে পাটে চললেন সূর্যদেব, হঠাৎ দেখি প্রকাণ্ড একখান কেক এসে বসল আমার সামনে। হুড়মুড় করে ঢুকল শেখর বাবু, জসূয়া, রাজীব, শুভাশিস, শান্তনু, সৌমেন, হকবাবু, আশিস, রবি বাবু, অরূপ, জহর বাবু আর যেন কারা, কারা। ‘হ্যাপি বাড্ডে ম্যাডাম।’ 


জাঁদরেল, রাগী, খাণ্ডারনি আধিকারিক হঠাৎ করে হয়ে গেল লাজুক ষোড়শী কিশোরী। আরে ভাই তোমরা জানলে কি করে? কোথা থেকে যেন খসে গেল যাবতীয় ঝুটো সফিস্টিকেশন, বোকার মত বলে বসলাম, ‘ভীষণ ভীষণ মিস করছিলাম আমার পুরাণ টিমকে। সবে তো মাস দুয়েক হল এখানে এসেছি,  তার মধ্যেই তোমাদের এত উষ্ণতা, এত ভালোবাসা কয়েক মুহূর্ত আগেও ছিল কল্পনাতীত। মনেই হচ্ছে না চুঁচুড়া ছেড়ে এসেছি।’ 


শান্তনুর তোলা কেক কাটার ভিডিও খানি রাতে শৌভিককে দেখাচ্ছিলাম, ‘দ্যাখ মাত্র দুমাসেই এরা আমায় কত ভালোবেসে ফেলেছে।’ দেখতে দেখতে এল আমার অমোঘ বাণী, 'মনেই হচ্ছে না চুঁচুড়া ছেড়ে এসেছি'। প্রবল ধমক খেলাম, মাননীয় মহকুমা শাসকের কাছে। ‘এরকম করে কেউ বলে? এরা কি ভাববে? এরা এত কিছু করল, তাও সেই চুঁচুড়া-’। কি করি, কি ভাবে বোঝাই, তাম্রলিপ্ত আমার বর্তমান ঠিকই, অতীতটা যে মাখামাখি চুঁচুড়ার সাথে। এত দ্রুত ওদের ভুলে যাই কি করে? আমার মন কি এতই ছোট যে একদলকে জায়গা দিতে সরে যেতে হবে আরেক দলকে। তার থেকে দুদলই থাকুক না বাপু, চুঁচুড়াও থাকুক আর তাম্রলিপ্তও থাকুক। যে যেখানেই থাকুক, শুধু খুব ভালো থাকুক, আমার অতীত ও বর্তমান সমস্ত টিম মেম্বারদের জন্য জন্মদিনে এটাই আমার ঐকান্তিক প্রার্থনা।

প্যার সে পুকারল না-

 



দরজা ঠেলে প্রবেশ করলেন তিনি, সামান্য ভারাক্রান্ত চিত্তে। সেখানকার রাণী ছিলেন তিনি,চাইলে কত কিছুই করতে পারতেন সামান্য অঙ্গুলি হেলনে। করেননি অবশ্য, বরাবর থেকেছেন মাটির কাছাকাছি। একবার কেবল অনুযোগ করেছিলেন, এক ব্যাটা উঠতি ফ্লাইওভারের জন্য বন্ধ হতে বসেছিল ওণার ছোট্ট ফ্ল্যাটের আলোবাতাস। অনুরোধ করেছিলেন যদি একটু দেখা হয় ব্যাপারটা। ভাবতেও পারেননি যে শুধু ওণার জন্যই সম্পূর্ণ নক্সা বদলে যাবে উড়াল পুলের। ঘুরে যাবে অভিমুখ।  অগণিত মানুষের অপরিসীম স্তাবকতায়, ভালোবাসায়, প্রেমে, শ্রদ্ধায় পুরোপুরি সম্পৃক্ত, নুব্জ তিনি। 


কিন্তু এযে অন্য জগৎ। সম্পূর্ণ অজানা অচেনা জগৎ। বড় ভয় লাগছে তার, লাগছে ভয়ানক বিষণ্ণ। আচমকা এক ফচকে ছোঁড়ার কণ্ঠস্বরে চমকে উঠলেন তিনি, ‘এই তো লতা দিদি এসে গেছে-’। বড় চেনা গলা ছোঁড়ার। জন্ম ফাজিল ছোঁড়া। প্রথম দেখাতেই ভয় পাইয়ে দিয়েছিল, স্টেশন থেকে স্টুডিও অবধি এমন ভাবে পিছু নিয়েছিল, তিনি ভেবেছিলেন কোন পাতি রোড সাইড রোমিও বোধহয়। দু চার ঘা খেয়েই যেত ছোকরা, যদি না কেউ বলত যে খোদ দাদামণি ওর দাদা। শুধু কি সেবার, সুযোগ পেলেই মজা করত ছোকরা। সেই ১৯৮৭তে শেষ দেখা। কিন্তু ওভাবে ছোকরাকে দেখতে চায়নি তার লতা দিদি। বড় অকালে হারিয়ে গিয়েছিল ছোকরা। ভাবতে ভাবতে আনন্দে না খুশিতে কে জানে ছলছলিয়ে ওঠে সাম্রাজ্ঞীর দুই আঁখি। 


পাশ থেকে আরেক পরিচিত কণ্ঠ, বাঙালি টানে বলে ওঠে,‘ কিঁউ দিদি ঠিক হ্যায় না? আশা ক্যায়সি হ্যায়?’ ঠোঁটের কোণে হাল্কা হাসির রেখা ফুটে ওঠে তাঁর। মনে পড়ে যায় সেই সব সাদাকালো দিনের কথা। কিশোর-রাহুল তো হল, তিন মূর্তির আরেক মূর্তি কই? ভাবতে না ভাবতেই তাঁর দেখা পেলেন। পরিচিত ঠেট হায়দ্রাবাদী টানে বলে উঠল মেহমুদ, ‘হাম কালে হ্যায় তো কেয়া হুয়া, দিদি আবসে ইয়ে ‘কুঁয়ারা বাপ’ আপকে ‘পডোসন’।’ খিলখিল করে বাচ্ছা মেয়ের মত হেসে উঠলেন তিনি। 


আদরের দিদির সঙ্গ ছাড়লই না তিন মূর্তি। ধীরে ধীরে দেখা হল, নৌশাদ জীর সাথে, এগিয়ে এসে স্বাগত জানালেন মদনমোহন জী। শঙ্কর জয়কিষণকে এক সাথে দেখে হাঁপ ছেড়ে বাঁচলেন তিনি। বড় ঝামেলা পাকিয়েছিল মাঝে দোঁহে। ভাগ্যে রফি সাব ছিলেন। দুটোই ধরে বসিয়ে আলোচনা এমনকি বকাবকিও কম করেননি। ভাবতে না ভাবতেই হাসিমুখে এগিয়ে এলেন দেবতুল্য মানুষটি। বড় অল্প বয়সে এ দুনিয়ায় পাড়ি দিয়েছিলেন ভদ্রলোক। পরিশীলিত বিনম্র কণ্ঠে জানতে চাইলেন কেমন আছেন তিনি। আশ্বস্ত করলেন, ‘কড়া নিগরানি’তে রেখেছেন এস-জে জুটিকে। কোন বেয়াদবি আর বরদাস্ত করা হবে না এপাড়ে। এখানে তো সবাই রাজা। 


‘সরস্বতী বিসর্জনের দিনই ব্যাটারা তোমাকে হারিয়ে ফেলল লতা? এ বহুত বুরা হুয়া। অব চলো চলো আমরা সবাই অপেক্ষা করছি, এ শুধু গানের দিন,  আর আজ সেই গান হবে শুধু তোমার।’ চূড়ান্ত কতৃত্ব নিয়ে ঘোষণা করলেন শচীন কর্তা। ঠিক ঠিক মাথা নেড়ে সঙ্গত করলেন মান্না দে। লজ্জিত তাঁর দুই বিনম্র আঁখি খোঁজে এদিক ওদিক কাকে যেন। ঐ তো নূরজাহান জী, রাজকুমারী জী, গীতা আর গুরু দত্ত জী, মধুবালা জী, সুরাইয়া জী।  আছেন ইউসুফ সাব থুড়ি দিলীপ সাব। দেবানন্দ জী। মনোজ কুমার, রাজ কুমার, রাজেন্দ্র কুমার জী। পৃথ্বী রাজ কাপুর সাবকে ঘিরে বসে থাকা রাজ-শাম্মি-শশী কাপুর দের তিন ভাই এর সাথে পুঁচকে ঋষি। সবাই করজোড়ে নমস্কার জানাল। নার্গিস-সুনীল দত্ত ও আছেন দেখলেন, আছেন মীনা কুমারী, কামাল আমরোহী সাবও। ট্রাজেডি কুইনের চোখে হেথায় নেই কোন দুঃখ, আছে শুধু অপরিসীম শান্তির দীপ্তি। হেসে  ইশারায় বোঝালেন ‘চলতে-চলতে’টা গেও কিন্তু। 


এত এত পরিচিত মানুষকে দেখে খুশি তিনি, তবুও উদ্বেল হৃদয় যেন কার জন্য? তিনি কই? তাঁর কাছে কি খবর পৌঁছায় নি, নাকি অধমার সাথে এসে দুটো কুশল বিনিময়েও তাঁর কুণ্ঠা? অথবা অনীহা। গলার কাছটা ব্যথা ব্যথা করছে তাঁর। জ্বালা করছে চোখ দুটো। মঞ্চে অসহিষ্ণু পঞ্চম শুরু করে দিয়েছে ধুমধাম বাদ্য। লক্ষ্মীকান্ত জী নীচে থেকে বলে উঠলেন, ‘ইয়ে সুর নেহি হ্যায় পঞ্চম, ইয়ে শোর হ্যায়।’ গা করল না পঞ্চম, বাজানোর আনন্দে বাজিয়েই চলেছে,রাজেশ খান্না জী আরো উস্কে দিচ্ছেন আহাঃ আহাঃ করে। বাজনার তালে তালে কিশোর ডেকেই চলেছে,‘দিদি, ও দিদি। এবার তো এসো-’। মহা ফাজিল ছোঁড়া। গায়ে কাপড়টা ভালো করে জড়িয়ে, পায়ে পায়ে স্টেজে উঠলেন তিনি। চাঁদের হাটে পলকে নেমে এল অসীম স্তব্ধতা। © Anindita Bhattacharya 


গলা ঝাড়লেন তিনি, দম নিলেন, বুকটা সামান্য ব্যথা করে উঠল। নিজেকে সংযত করে চোখ বন্ধ করে গাইতে যাবেন, এমন সময় কর্ণ কুহরে মধু ঢালল কার যেন মধুর সুরেলা কণ্ঠ, ‘ইয়াদ কিয়া দিল নে কাঁহা হো তুম, ঝুমতি বাহার হ্যায় কাঁহা হো তুম-’। কয়েক মুহূর্তের জন্য থমকে গেল কি সাম্রাজ্ঞীর হৃদস্পন্দন? শাড়ির খুঁটে কি মুছলেন দু ফোঁটা আনন্দের অশ্রু? অপার দৃষ্টিতে তাকালেন পাশে এসে দাঁড়ানো ধপধপে সাদা ধুতি-পাঞ্জাবি পরিহিত সৌম্যদর্শন বাঙালী যুবকের দিকে। কালো ফ্রেমের চশমার ওপারে দুই অতলান্ত গভীর চোখে যাঁর খেলছে শরতের রোদ। ইশারায় বললেন, ‘গাইয়ে লতাজী।’ বলতে হত না, লতাজীর সুর তন্ত্রী এই মুহূর্তে বোধহয় তাঁরও বশে নেই, ‘প্যার সে পুকারলো জাঁহা হো তুম। প্যার সে পুকারল যাঁহা হো তুম।’


পুনশ্চঃ চাইলে শেয়ার করতেই পারেন, দয়া করে কপি পেস্ট করবেন না। চিত্র সৌজন্য ফেসবুক।