Monday 16 December 2019

এক যে দেশে-

(c)Anindita Bhattacharya
৭৯৬৯৩৬০২ এর আজ আনন্দের শেষ নেই। আনন্দের ঢেউ গোটা মহল্লা জুড়েই। অবশেষে সেই বহু কাঙ্ক্ষিত ক্ষণ সমাসন্ন, সময় ঠিক মধ্যাহ্ন।  ভেসে এল মাননীয় দেশনেতার জলদগম্ভীর  কণ্ঠস্বর, “প্রিয় মিত্রগণ,অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গে জানাচ্ছি, আমাদের বহু শতকের মেহনত ফলপ্রসূ হয়েছে। জম্বুদ্বীপ আজ আবার জগৎসভায় শ্রেষ্ঠাসনে আসীন। দেশ থেকে অবশেষে আমরা নির্মূল করতে পেরেছি, “ধর্ম” নামক বিষাক্ত নেশার গুষ্ঠি। ধর্মনিরপেক্ষ নয়,আজ থেকে আমরা নির্ধর্ম রাষ্ট্র। উল্লাস প্রিয় মিত্রগণ!“। দেশনেতার অমৃত বাণী  থামার সাথে সাথেই গর্জে উঠল দেশ, যার বিস্তার গিরিরাজের কপোল থেকে মহাসিন্ধুরD কিণারা অবধি। “উল্লাস”। নিছক উল্লাসে মেতে উঠল সমগ্র রাষ্ট্র।
ধর্ম নামক অসুখকে নির্মূল করতে অনেক যাতনা সয়েছে জম্বুদ্বীপ। ঝরেছে অনেক রক্ত। ৭৯৬৯৩৬০২ শুনেছে তার মায়ের মুখে,মায়ের প্রপিতামহের প্রপিতামহের সময় নাকি সমগ্র জম্বুদ্বীপে ছড়িয়ে পড়েছিল ভয়াবহ গৃহযুদ্ধ R।নির্বিচারে মারা পড়ছিল ছাপোষা মানুষ।
ধর্মের নেশায় বুঁদ ছিল সমগ্র রাষ্ট্র। তারপর এলেন তিনি।ইতিহাস যাঁকে চেনে ১ হিসেবে। অতি সাধারণ দেখতে ওণাকে, নাতি দীর্ঘ উচ্চতা, পাতলা হয়ে আসা চুলের মাঝে মাঝে চাকাচাকা চকচকে টাক,চোখে গোল ফ্রেমের চশমা, যার একটি ডাঁটি আবার ভাঙা, গৃহযুদ্ধের অভিঘাতে ভেঙেছিল, উনি সারাননি। সুতো দিয়ে বেঁধে পড়তেন। উনিই প্রথম ডাক ছিলেন, পরিত্যাগ করুন ধর্ম নামক বিষাক্ত  নেশা। তখন নাকি ধর্মানুসারে নাম হত মানুষের। উনি ত্যাগ করেন ওণার নামK। নামের বদলে ধারণ করেন সংখ্যা।বংশানুক্রমিক  ধর্মস্থানে খোলেন দাতব্য চিকিৎসালয় আর বিদ্যাচর্চার কেন্দ্র।
২ ওণার প্রথম অনুগামী। তারপর ৩-৪-৫-। নামের বদলে বাড়তে থাকে সংখ্যা। লুপ্ত হতে থাকে দেবস্থান আর ধর্মালয়।  আর আজ? আজ দেশ জোড়া শুধুই সংখ্যা। প্রায় এক শতাব্দীর অধিক পরিত্যক্ত পড়ে আছে সমস্ত উপাসনালয়। জ্বলেনি সাঁঝবাতি। ভেসে আসেনি প্রার্থনার মোহক সুর, যা রক্ত পিপাসু করে তুলত মানুষকে। দেবস্থানগুলির অনেক কটাই বর্তমানে সংগ্রহালয়। এমনই একটি সংগ্রহালয় দেখতে যাবে আজ ৭৯৬৯৩৬০২। মায়ের মুখে শুনেছে প্রায় এক শতাব্দী জুড়ে কয়েক লক্ষ মানুষের রক্ত খেয়েছে এই দেবালয়। গড়েছে এক পক্ষ,ভেঙেছে অপর। আবার তৈরি হয়েছে নতুন পক্ষ, আবার চলেছে ভাঙা-গড়ার খেলা। মাটির নীচে পরতে পরতে লুকিয়ে আছে এমন ভাঙা গড়ার গপ্প। আজ দেখবে ৭৯৬৯৩৬০২। আর ভাববে কতখানি নির্বোধ ছিল ওর পূর্বপুরুষ তথা পূর্বমহিলাগণ।

Saturday 14 December 2019

মধ্যমেধার মধ্যবিত্তের রোজনামচা-১৪ই ডিসেম্বর,২০১৯

আমার তেত্রিশ কোটি দেবতার মধ্যে, মহঃ রফি একজন। আজ্ঞে হ্যাঁঁ, “আভি না যাও ছোড়কর, কে দিল আভি ভরা নেহি-”। এই পেলব অমৃতস্বরূপ স্বর স্বয়ং ঈশ্বর ছাড়া আর কার হতে পারে বলুন দিকি? কিশোরের সাথে খুনসুটি চলতে পারে, জমতে পারে হাল্কা ফুল্কা প্রেমও। মুকেশজীর সাথে গভীর সম্পৃক্ত প্রেম। কিন্তু রফি সাব? উনি এই তুচ্ছ সাধারণ মেয়েটার ধরা ছোঁয়ার বাইরে। যাঁর পদতলে করজোড়ে বসে মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে থাকতে মন চায়। যাঁর আত্মভোলা হাসিতে নত হয়ে যায় মম গর্বিত শির।
পকেটহীন হলুদ পাঞ্জাবি পরা, খালিপা এক বাংলাদেশী যুবার হাত ধরে, নীল শাড়ি পরে মিশে যেতে চাই জনসমুদ্রে। কদমফুল যাঁর ভীষণ প্রিয়। হস্তচুম্বন করতে চাই তাঁর স্রষ্টার। শরদ্বিন্দু বন্দোপাধ্যায়ের পর এত গভীর ভাবে কোন লেখকের অনুরাগিনী হইনি। আর সেই হেঁপো বুড়ো মিশির আলি, কি যে বলি তাঁকে নিয়ে? ভাগ করে নিয়েছি প্রিয় বান্ধবীদের সাথে। সবকটা তাঁর প্রেমে দিওয়ানা-
আর সেই সদ্য বিপত্নীক বৃদ্ধ, অবসর নেবার দিন যিনি বলেছিলেন, “ও আমার আরেকটা মেয়ে-”। আমার দুই বাপ ছাড়া এত ভালো আমায় কে বেসেছে? তিনিও তো ধর্মে মুসলমান। রোজা রাখতেন না বলে কত পিছনে লেগেছি, “আপনি ভুলভাল মুসলমান নজরুল সাহেব-”।  কান ধরে কবিতা পড়াতেন যিনি। কবিতার প্রতি যতটা ভালোবাসা,সবটুকুই তাঁর থেকে পাওয়া। আজও তাঁর তিরিশ সেকেণ্ডের হড়বড়ে ফোনে আদ্র হয়ে ওঠে উত্তেজিত শুষ্ক মন আর মাথা।

  সংবিধানের প্রস্তাবনা তো সেদিনের শিশু। ধর্মনিরপেক্ষতা আমার রক্তে। ক্রোমোজোমে। প্রপিতামহ ছিলেন চার্বাকপন্থী। ঋণং কৃত্বা ঘৃতং পিবেৎ।  লুকিয়ে অস্ত্র আনতে কালাপানি পেরিয়ে একঘরে হয়েছিলেন ঠাকুরদা। ইয়ে আজাদী ঝুটা হ্যায় বলেছিলেন ছোটদাদু। জেলখাটা নকশাল আমার বাবা। উদারমনা শ্বশুর-শাশুড়ী। ঘোরতর আস্তিক বটে,তবে আমার মতই উদার আমার ঠাকুর। এক স্যালুটেই খুশি। অতি ভক্তিতে কুঁচকে যায় তাঁর/তাঁদের ভ্রু।
বিশ্বাস করুন, এসব কথা আপনাদের শোনাচ্ছি না। শোনাচ্ছি নিজেকে। এহেন আমারও আজন্মলালিত সংস্কার, বিশ্বাস তথা মূল্যবোধের গোড়া নড়ে গেছে কালকে তথা আজকের নোংরামিতে। “নোংরামি”। আজ্ঞে হ্যাঁ, কান্নিককে(Spade) কান্নিক বলাই শ্রেয়। এটা প্রতিবাদ বা পোতিবাদ নয়, এটা সহজ সরল নোংরামি। সুদূর মুর্শিদাবাদ থেকে কানের কাছের উলুবেড়িয়া অবধি কেঁপে উঠল যে নোংরামিতে, তাজ্জব ব্যাপার আমাদের গোয়েন্দা সংস্থা গুলো ঘুণাক্ষরেও টের পেল না এতখানি সংঘবদ্ধ  প্রতিরোধের? আর আমাদের মূখ্য সংবাদপত্র কি লিখছেন, “- আইনের প্রতিবাদে সরব বাংলা”!  মাইরি সত্যি? শুধু সরব? তাহলে অরাজকতা তথা গুণ্ডামির সংজ্ঞাটা অনুগ্রহ করে জানাবেন দাদা/দিদি?
বাতানুকূল ঘরে, অনাগত শীতের অপেক্ষায় ওম্ পোহাতে পোহাতে ওমন কথা লেখা যায় বৈকি।ফেবুতে তপ্ত কুড়মুড়ে স্টেটাস্ লেখা যায়,“বেশ করেছে ভাঙচুর করেছে---। ওদের অস্তিত্ব বিপন্ন। এখন কি ভেবে ভেবে ডেমোক্রেটিক পথে ঝামেলা করবে---”।
আর আমার যে বন্ধু কাল সকালে চেন্নাই মেল ধরবে? সুস্থ ভাবে বাড়ি পৌঁছবে তো সে? বা যে লক্ষ্মীমন্ত বান্ধবীটির বর চাকরী করেন অশান্ত এলাকারই একটি স্কুলে? বিগত দাঙ্গায় বাইক ফেলে হামাগুড়ি দিয়ে ধানখেতের মধ্যে দিয়ে পালিয়ে এসেছিলেন, তাও টলেনি যাঁর ধর্মনিরপেক্ষতার প্রতি আস্থা। আগামী পরশু থেকে নিয়মিত দপ্তরে যেতে পারবেন তো তিনি? ভগ্নীসমা যে আধিকারিককে কাল রাতে ধমকাচ্ছিলাম, “গুলি মারো বড় সাহেবকে।স্টেশন লিভের নিকুচি করেছে, আগে বাড়ি ফেরো-”, স্বাভাবিক ভাবে কোয়ার্টারে ফিরতে পারবে তো সে? আর ঐ আধিকারিকের স্ত্রী আর কন্যা, আজ থেকে বছর নয় দশ আগে ঐ জায়গাতে তো আমিই ছিলাম-।
নড়ে গেছে যাবতীয় বিশ্বাস আর সংহতির ভিত। ভুলে গেছি পিঁয়াজের দাম বা না পাওয়া ডিএর বেদনা। পড়েও দেখিনি বিহারে নিগৃহিত তথা নিহত বছর দশেকের শিশু কন্যার খবর, শুধু ঘিরে ধরেছে অপরিসীম আতঙ্ক।

Wednesday 11 December 2019

অনির ডাইরি ১০ডিসেম্বর ২০১৯


গতকাল মাসির জন্মদিন ছিল। মাসির আবার জন্মদিন। ভূতের আবার জন্মবার। আর পাঁচজন মাসির জীবনচরিতের মতই তুত্তুরীর মাসিরও জীবন পাক খেয়েছে একই পাকদণ্ডী বরাবর, যার গতিমুখ  বড়ই উচ্চাবচ।
শৈশবে উদ্দাম মজা, ঝপাং করে ঝাঁপিয়ে পড়ে ডুব সাঁতারে জোড়া পুকুর এপাড়ওপাড়। মশারি দিয়ে বর্ষাকালে চুনো মাছ ধরা। জোড়া বিনুনী দুলিয়ে ইস্কুল যাওয়া। পথেই আলাপ তাঁর সাথে, যাঁকে কোন এককালে তুত্তুরী ডাকত মেসো। তারপর আর কি? গন্ধর্ব থুড়ি পালিয়ে গিয়ে বিয়ে। মাসির তখন সপ্তম শ্রেণী, মাসির সদ্য শাড়ি।
তারপর বড়দিদি,বড়দাদা এবং ছোটদিদি।সংসারের হামানদিস্তার বাড়ি খেয়ে ভালোবাসা পালাল জানলা গলে। শুরু হল সংগ্রাম। জীবন সংগ্রাম। বাড়ি বসে আচার-নাড়ু-পাটালি বানানো। ধূপ বানানো। চানাচুর বানানো।শায়া-ব্লাউজ বানানো।  চেষ্টা তো করেছে মাসি অনেকই। হয়তো করেছিলেন মেসোও। আমরা তো এক পক্ষের গপ্প শুনি কেবল।
কোথায় যেন চাকরী পেয়েছিল মেসো, ছোট চাকরী,তবে সরকারী তো বটে। শুধু যেতে হত বহু দূর। মেসোর মা ছাড়েননি তাঁর আদরের দুলালকে। কেঁদে কেটে কাটিয়ে দিয়েছিলেন নাম। জীবনে কখনই আর ঘুরে দাঁড়াতে পারেননি মেসো। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছিল সংসার, বাধ সাধল মেসোর বাবার হঠাৎ অসুস্থতা। ঘটি বাটি বেচেও বাঁচানো গেল না তাঁকে।  কাজের ধান্ধায় স্থানীয় নার্সিংহোমে আয়ার কাজ সেই তখন থেকে-। আজও জনৈক স্বর্গীয় ডাক্তারের নাম করার সময় কপালে হাত ঠেকান মাসি। হাতে ধরে কাজ শিখিয়েছিলেন যে ডাক্তারবাবু।

তুত্তুরী তখন ছ দিন বয়স। সোমবারে জন্মেছে বটে,রবিবারের আগে ছাড়েননি বুড়ো ডাক্তারবাবু। মা প্রচুর কান্নাকাটি  জুড়েছিল, বাড়ি যাবে বলে। ততোধিক ধমকেছিলেন ডাক্তারবাবু। অবশেষে রবিবার ভোরে বাড়ি ফেরা। উফ্ কি বৃষ্টি, ধুয়ে যাচ্ছে হাওড়া শহর। ঠাম্মাদাদুর কোলে চেপে হাওড়ার বাড়িতে ঢুকল তুত্তুরী। চকাস্(বড় মাসি), টুলটুল দাদা(বড় মেসো), বড় দাদু, আতুপাতু(বড় দিদা), দিদি(পিসি দিদা), দাদু,মামমাম(দিদা), ছোট দাদু, বড় মামা,বড় মামি সবাই মিলে সে কি টানাটানি। এ বলে আমায় দে। ও বলে আমায়। কত কি যে পেল তুত্তুরী, রূপোর টাকাই তো কতগুলো। আর বেশ কিছু পাঁচশ হাজারের নোট। যার দুটি এই সেদিন বের হল, মামমামের লক্ষ্মীর ঝাঁপি থেকে। দাদুর কি চিৎকার, কি বকল মামমামকে। ওগুলো নাকি পচা টাকা। টয়লেট পেপার সমতুল।
যাই হোক সবার আদরের মাঝে, ঐ বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে কে যেন এল। এসেই স্নান করে, ডেটল জলে কাচা জামাকাপড় পরে কোলে নিল তুত্তুরীকে। তাকিয়ে দেখল তুত্তুরী, ও মা!মাসি তো।

সেই থেকে বিগত নয় বছরে তু্ত্তুরীর জীবনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ মাসি। যখনই তুত্তুরী কোন দুষ্টুমি করে, কারো সাথে কথা বলে না বা মিশতে চায় না। লোকে তো দুটো কথাই বলে, “ইশ্ মা কোন শিক্ষা দেয়নি! ইশ্ আয়ার কাছে মানুষ!” তাতে তুত্তুরীর ঘন্টা। তোমাদের কাছে আয়া হতে পারে,তুত্তুরীর পরিবার তো অসম্পূর্ণ মাসি ছাড়া।
কে তু্ত্তুরীর অপরিসীম বকবক মন দিয়ে শোনে?কে পড়ে শোনায় উপেন্দ্রকিশোর বা অবন ঠাকুর? কে তুত্তুরী দুর্ব্যবহার করে ক্ষমা চাইলেই এক কথায় মার্জনা করে দেয়? কে মায়ের চোখ বাঁচিয়ে এখনও ইউনিফর্ম বা জুতো পরিয়ে দেয়? মাখতে দেয় পমেটম? বানিয়ে দেয় মনের মত টিফিন? স্কুলে কারো সাথে তু্ত্তুরী ঝগড়া করলে কে বাড়ি এসে তার গুষ্ঠির মুণ্ডপাত করে? মাসিই তো।

মেসো যখন ঝপ করে পাড়ি দিল অন্য জগতে, কে সাদা শাড়ি পরতে দেয়নি মাসিকে? মাসি নিরামিষ খেলে কে রাগ দেখায় আজও? কে ধ্বংস করবে বলে স্মার্ট ফোন কিনেছে মাসি? কার অনুরোধে, বাড়ির শাড়ি ছেড়ে সুন্দর শাড়ি এবং টুপি পরে তৈরী হয়ে গেল মাসি কেক কাটতে? তুত্তুরীই তো। এত জটিল সম্পর্কের মধ্যে ঢুকে আমাদের কাজ নেই ভাই, মোদ্দা কথা হ্যাপি বার্থ ডে মাসি। এমনই থাকুক তোমার সম্পর্ক, আদরে আর অধিকারে মাখা।

Saturday 30 November 2019

অনির ডাইরি, ৩০শে নভেম্বর, ২০১৯


হৈমন্তী এক অলস দুপুর। দেড়শ বছরের বুড়ো বাড়িটায় বিরাজ করা অখণ্ড নিস্তব্ধতা ভেদ করে ভেসে আসছে, কার যেন কচি গলার মিঠে সুর। “সুও রানির বড় আদর। সুওরানি সাতমহল বাড়িতে থাকেন। সাতশ দাসী তার সেবা করে-”।অবন ঠাকুরের গল্প শোনার ঝোঁকে পশ্চিমের নিম গাছের ঝাঁকড়া ঝাঁকড়া সবুজ পাতার ফাঁক গলে উকিঝুঁকি মারে মাঝবয়সী সূর্যটা।পাশের কাঁঠাল গাছের ডাল থেকে চিৎকার করে উঠল বায়স দম্পতি,-‘তাপ্পর, তুত্তুরী?তাপ্পর?”
“আর দুওরানি-বড়োরানি,তাঁর বড় অনাদর,বড় অযত্ন। রাজা বিষনয়নে দেখেন। ” হৈমন্তী রোদে আড়ামোড়া ভাঙল পোষা মেনি বেড়াল। পুবে সদগোপদের ছাতের ওপর উড়ে বেড়ানো নিতাইয়ের এক ঝাঁক পায়রার দিকে অলস লোলুপ দৃষ্টিতে তাকিয়ে, বিকট হাই তুলে বলল,“কেন তুত্তুরী?কেন?” দখিনমুখো লাল সিমেন্টের রোয়াকে ফেলে রাখা পুরোনো ইনভার্টারের বাক্সের ওপর তখন জমিয়ে বসেছে তুত্তুরীর গল্পের আসর। মূল শ্রোতার বয়স মধ্য আশি অতিক্রান্ত।সম্পর্কে তো দাদুর দিদি। তবে তুত্তুরীর মা এমনকি তুত্তুরীও ডাকে দিদি বলেই। তিনপ্রজন্ম ধরে চাটুজ্জে বাড়ির বাচ্ছারা শৈশব থেকেই, “দিদিকে বলো”তে অভ্যস্ত।গল্প শুনবে? দিদিকে বলো। বল/বাঁশি বা বেলুন চাই? দিদিকে বলো।  ফুচকা/ চকলেট খাবে? দিদিকে বলো। ঠাকুর দেখতে যাবে?দিদিকে বলো। মা কেলি- থুড়ি ঠেঙিয়েছে? দিদিকে বলো।
এহেন দিদি আপাততঃ হাতের প্লাস্টারটি নিয়ে কিঞ্চিৎ  বিপর্যস্ত। বোঝা বইতে অভ্যস্ত দিদি। বোঝা হতে নয়। আর বিগত একমাস ধরে রান্না-ঘরের কাজ-দোকানবাজার দূরস্থান,স্নানটাও করিয়ে দেয় তুত্তুরীর মামমাম(দিদা)। বেঁধে দেয় চুলও। বাকিটা বড়মামি একাই সামলে দেয় দশভূজা হয়ে। হুঁ হুঁ বাওয়া চাটুজ্জে বাড়ির বড় গিন্নী বলে কতা-।
এত যত্ন,এত আদর- হাতের প্লাস্টার ভর্তি তুত্তুরী,বু্ল্লুদাদা,মা-মামাদের এত মেসেজ-“সেরে ওঠ দিদি। আমরা তোমায় ভীষণ ভালোবাসি দিদি-”। তাও দিদির মন খারাপ। একে এই পরমুখাপেক্ষীতা তারওপর কিঙ্কর আর শঙ্করের বদমাইশি। একজন ডেজিগনেটেড ঝাড়ুদার,অন্যজন মেথর। দিদি এতদিন নিজে দাঁড়িয়ে সাফ করাত সবকিছু। একটা শুকনো পাতা-একটা গজানো আগাছাও নজর এড়াত না দিদির। আর এখন? আশ মিটিয়ে ফাঁকি মারছে দুটোতে। কিঙ্কর তো তাও আসে,একটু আধটু নর্দমা সাফ করে,তারপর গপ্প জোড়ে দাদুর সাথে। চা খায়। তারপর “পর্ণাম পিসিমা” বলে ভাগল বা। আর শঙ্কর?তিনি তো লাটসাহেব। এমাসে একদিনও এলেন না? অথচ মাসশেষে কেমন কাঁচুমাচু মুখ করে দাদুর মাথায় হাত বুলিয়ে মাহিনাটা নিয়ে গেল। দিদিকে দেখে গোটা দুয়েক আগাছা উপড়েছে কেবল। ভাবতে ভাবতে অন্যমনস্ক হয়ে পড়ে দিদি। কচি কচি একজোড়া হাত জড়িয়ে ধরে দিদির গলা, “দেখো না দিদি, বাঁদরটা এসে গেছে। এবার কপাল ফিরবে সুওরানির।” চটক ভাঙে দিদির, “কি বদ রাজারে। খালি সুও সুও করেই অস্থির-। ” বারন্দায় ভিজে কাপড় মেলে বড়মামি। ছ্যাঁক করে ডালে সম্বরা দেয় মামমাম। ভুরভুরে সৌরভে মথিত হয়ে ওঠে একতলার দালান। একরাশ সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে সোহাগী  গলায় চায়ের আব্দার করে দাদু।আর এক অব্যক্ত সুখানুভূতিতে ছলছলিয়ে ওঠে তুত্তুরীর মায়ের হৃদয় পেয়ালা।

Tuesday 26 November 2019

অনির ডাইরি ২৬শে নভেম্বর,২০১৯

“ম্যাডাম, আপনি আমায় বকবেন বলেছেন?” হ্যাঁ বলে তো ছিলাম। চিৎকার করেই বলেছিলাম, বকব, নালিশ ঠুকব, নিজে হাতে ফাইল নিয়ে গিয়ে গোবিন্দপুরে পাঠাব। ভালোবাসি বলে যা ইচ্ছে তাই করবে না কি? আমার সঙ্গে পেঁয়াজি? ওরকম তো কতই বলি। যখন রাগ হয়, তখন নাকি জ্ঞান থাকে না। উঁহু সেয়ানা রাগ বাবা। যেটা বললে বেশী আহত হবে সেটাই বলি। প্রীতি প্রথমে ফোঁ ফোঁ করে, তারপর হাউমাউ করে কান্না জোড়ে। ধীমান ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেলে। শুভজিৎ চোখ মোছে। সোমনাথের মাথা ধড় থেকে নেমে মাটিতে মিশে যায়। “সে কি সোমনাথ তুমি কাঁদছ না? তারমানে তুমি আমাকে অতটাও ভালোবাসো না-। ” মুস্কিল হচ্ছে রাগটা আমার কেমন যেন ক্ষুদ্র এবং ব্যাঁকা। খানিকপরে অনেক চেষ্টা করেও মনে করতে পারি না। শুধু মনে থাকে- এরা আমার দ্বিতীয় পরিবার। আমার তুত্তুরীর থেকেও বেশী সময় এরা আমায় ঘিরে থাকে। এদের ভালোবাসা এবং ঠ্যাঙানোর যুগপৎ অধিকার আমার আছে। আর সে অধিকার কোন চেয়ার আমায় দেয়নি। দিয়েছে এরাই।

দৃশ্যপট-২
মণ্ডপের বাইরে হ্যাণ্ডবিল বিলি করছিলেন বয়স্ক ভদ্রলোক। বিদ্যুৎ চিৎকার করে উঠল,“এই দেখুন ম্যাডাম- আমাদের বেনিফিশিয়ারি।আমি নিজে এর বই করে দিয়েছি। ” তাই নাকি? তা কি করেন দাদা? নার্ভাস হয়ে বললেন- মুন্সিপালিটিতে চাকরী করি আইজ্ঞা। সর্বনাশ। চাকরী করে? এমন লোক ঢুকিয়েছ? বিদ্যুৎ তুমি দেখছি আমার চাকরীটা আর রাখলে না। “না। না ম্যাম। ক্যাজুয়াল। পিএফ,ইএসআই নেই ওণার।” না হলে কেনই বা এতটা উজিয়ে ভিন্ন শহরে এসে হ্যান্ডবিল বিলি করছেন? তাও বটে। তা দাঁড়ান তো দাদা, একটা ছবি তুলি- আপনার আর আপনার এজেন্টের। কই লিফলেট গুলো কই? লিফলেটের গুচ্ছ ততোক্ষণে লুকিয়েছে ওণার পশ্চাৎদেশে। গোলাপী হয়ে বেগুনী বর্ণ হয়ে পড়ছেন প্রৌঢ়। কুঁতিয়ে কুঁতিয়ে বললেন “ডাক্তার বাবুর লিফলেট আইজ্ঞা-।” বুঝলাম ডঃ লোধ মার্কা কেস-। বিদ্যুৎটা যে কি করে না। আমরা কাটলুম দাদা। আপনি শান্তিতে বিলি করুন-।

দৃশ্যপট-৩
“আমার ছেলেটাকে ফিরিয়ে দিন ম্যাডাম”। বক্তা এক মধ্য ত্রিশের দীর্ঘাঙ্গী মহিলা। উস্কোখুস্কো চুল। উদভ্রান্ত  দৃষ্টি। “ছেলেটা আমার বড্ড ছোট। আট বছর মাত্র। ” যাঃ বাবা। আমরা ছেলেধরা কবে হলাম? চাইল্ডলেবার ইন্সপেকশনের গল্প কি? মহিলা কেঁদেই যাচ্ছেন। “কুড়ি পঁচিশ দিন হয়ে গেল। আর পারছি না যে। আমারই দোষ। আমি কেন ওকে মারলাম-।  না মারলে তো ও বাড়ি ছেড়ে যেত না”। মহিলার হৃদয়বিদারক কান্না ক্রমেই সংক্রামিত হচ্ছে আমারও মধ্যে।
বিবাহবিচ্ছিন্না মহিলা একাই থাকেন দুই সন্তান সহ। অকপটে স্বীকার করলেন কনিষ্ঠটি ওণার স্বামীর নয়। “আমি নষ্ট মেয়ে নই ম্যাডাম। ” দিনে সরকারী ঠিকে কাজ করেন। ডিউটি শেষে তিন বাড়ি রান্না করেন। রাতে মারোয়াড়ি গদির খাতা লেখেন। ছেলে দুটি অবৈতনিক বিদ্যালয়ে পড়ে। ছোটটি বড় চঞ্চল। পড়াশোনায় মন নেই। স্কুল থেকে আসা নালিশের জেরেই ঠ্যাঙানি খেয়েছে খুদেটা।
মায়ের চেয়ে মাসির দরদ বেশী- সেই মাসিই শিশুটিকে মায়ের ঠ্যাঙানি থেকে বাঁচিয়ে নিয়ে চলে যায় সে যাত্রা। বড় মাসি। পনেরো দিন মা-ছেলের দেখা হয়নি। দেখা করতে দেয়নি মাসি। বড় ছেলেটিকে পাঠিয়ে খবর যোগাড়ের চেষ্টা করেছেন মহিলা। জবাবে বেড়েছে দুই বোনে অশান্তি। পনেরো দিনের মাথায় থানা থেকে খবর এসেছে, সরকারী হোমে আছে ছেলেটি। মা অত্যাচার করে। তাই কেড়ে নেওয়া হয়েছে মায়ের বুক থেকে।
কিছুই বুঝতে পারছি না। আপনার দিদি? তিনি ওকে বাঁচিয়ে নিয়ে গেলেন হোমে দেবার জন্য। এ কেমন ভালোবাসা? মহিলার গুমরে গুমরে কান্নায় ভারি ঘরের আবহ।খবর পেয়েই ছুটেছিলেন মা।  হোমে ভালো নেই শিশুটি। মায়ের জন্য খুব মনখারাপ। গোটা গায়ে র ্যাশ। পিঠে ঘা।ছবি তুলে দৌড়ে এসেছে মা। বীজবীজে গোটায় ভরা অণ্ডকোষের ছবি দেখে আঁতকে উঠলাম। করাত দুঃস্বপ্ন দেখব জানি না। গিয়েছিলেন কোর্টে। “মুহুরী দাদা” পাঠিয়েছেন আমার ঘরে।
আমি কি করব? বলতে গিয়েও পারলাম না। সত্যমিথ্যা জানি না। তবে আমিও মা। আরেক মায়ের বেদনা ত্বক-পেশী-অস্থিমজ্জা ভেদ করে এফোঁড়ওফোঁড় করে দিচ্ছে আমাকে। কোনটা ঠিক,কোনটা অধিকার বহির্ভূত জানি না। জানি শুধু কিছু করতে হবে।
যাঁর নির্দেশনামায় ছেলেটি হোমে গেছে, তাঁর মুখ চেনা বটে,দিন কতক আগে কোন একটা মিটিং এ মুখোমুখি হয়েছিলাম বটে,তবে প্রতিপক্ষ স্বরূপ। আজ গায়ে পড়ে ফোন করলে কি ভাবতে পারেন,না ভেবেই ফোন করে বসলাম। কিছু করুন প্লিজ। নাহলে এবার আমিও কাঁদতে বসব মাইরি। পদ- দপ্তর- সরকার-বেসরকার সব ছাপিয়ে আমরা মানুষ। আবার অনুভব করলাম সেদিন। আশ্বস্ত হলাম। উনি দেখছেন। উনি দেখবেন। মাকে দিতে হবে একটি হলফনামা, যে তিনি সুস্থ এবং সন্তানের ভারবহনে সক্ষম। ফোন রেখে বললাম, কালই যান। ছেলেকে ফেরৎ পেয়ে জানিয়ে যাবেন কিন্তু।  উনি বিহ্বল হয়ে হাতদুটো জড়িয়ে ধরলেন। চলে যাচ্ছেন যখন ধাতস্থ হয়ে, হঠাৎ প্রশ্ন করলাম, আপনার দিদি এমন কেন করলেন, জানেন? আর পনেরো দিনের মধ্যে আপনিই বা জোর করে কেড়ে আনেননি কেন আপনার ছেলে? জবাব পেলাম- “ছেলেটা তো আমার জামাইবাবুরই। নষ্ট করিনি।”
সেদিন মা কালীর দিব্যি করে গিয়েছিলেন,ছেলে পেলেই দেখা করে যাবেন। আশায় আশায় দিনগুণি আমি। আজ এক পক্ষ অতিক্রান্ত-। জীবন বড়ই বিচিত্র। মা কালীও কথা রাখেন না।

Friday 8 November 2019

নিভাননীর ভাইফোঁটা-

©Anindita Bhattacharya
শোভাবাজারের সান্যাল বাড়িতে আজ দারুণ হইচই। আজ ভাইফোঁটা কি না। বিভিন্ন প্রান্ত  সব ভাইবোনেরা সবৎসা এসে জড়ো হয়েছে। ইশিতার মা-মাসিরা মামাদের ফোঁটা দেবে, আর ইশিতা আর তার তুতো বোনেরা মামাতো মাসতুতো দাদা এবং ভাইদের ফোঁটা দেবে। বিশাল ভোগের লোহার কড়াইএ খাসির মাংস চাপিয়ে উদাত্ত স্বরে গান ধরেছে ছোট মামা। ছোট মামা মায়ের নিজের ভাই নয়, কেমন যেন দূর সম্পর্কের ভাই, সেই সম্পর্কটা যে কি আজ আর কারো মনে নেই। জায়গায় জায়গায় বিভিন্ন বয়সীদের জটলা, হাহা হিহির দাপটে কাঁপছে পাড়া। শুধু ইশিতার মনটা ভালো নেই। আজকের দিনে একজনের জন্য বড় কষ্ট হয় ইশিতার, তিনি হলেন ইশিতার আদরের ঠাম্মা নিভাননী দেবী। এমনিতে নিভাননী দেবীর ছেলে এবং মেয়ের ঘর মিলিয়ে গোট পাঁচেক  নাতিনাতনী,তবে তাদের মধ্যে ইশিতা বরাবরই ঠাম্মার ন্যাওটা। জ্ঞান হওয়া ইস্তক ইশিতা দেখে আসছে ঠাম্মা ভাইফোঁটার দিন দেওয়ালে ফোঁটা দেয়। “দেওয়ালে কেন ফোঁটা দাও গো ঠাম্মা?” ইশিতা অবাক হয়ে প্রশ্ন করত, ঠাম্মা মাথায় ছোট্ট খাট্টৌ কিন্ত ব্যক্তিত্ব অতীব প্রখর, সবাই ভয় করত, আজও করে। নিভাননী দেবী কেজো সুরে বলত,“ভাইয়ের মঙ্গলকামনায়।” “তাহলে ভাইয়ের কপালে দাও না কেন?”এ প্রশ্নের জবাবে ঠাম্মা হিমশীতল গলায় বলত,“যাও। তৈরি হয়ে নাও। মায়ের সাথে শোভাবাজার যাবে তো। ” এরপর কোন প্রশ্ন করার সাহস হত না ইশিতার।
বড় হবার সাথে সাথে কথা প্রসঙ্গে জানতে পারে,মধ্য হাওড়ার অত্যন্ত অভিজাত তথা বনেদী মুখুজ্জে পরিবারের সন্তান নিভাননী। নিভাননীর পিতা সে যুগের রিপন কলেজ যা বর্তমানে সুরেন্দ্র নাথ কলেজ নামে খ্যাত, তার দর্শনের অধ্যাপক ছিলেন। এছাড়াও নরমপন্থী কংগ্রেসে স্থানীয় নেতাও ছিলেন মুখুজ্জে মশাই। তাঁর একমাত্র কন্যা নিভাননী। ঠাম্মার মা কাদম্বরী দেবী,আহিড়িটোলার শিকদার বাড়ির মেয়ে ছিলেন। সে যুগে সেনেট হলে বসে পরীক্ষা দিয়ে, লর্ড কার্জনের হাত  পরীক্ষা পাশের সার্টিফিকেট পেয়েছিলেন কাদম্বরী দেবী। ইশিতার মনে আছে কাদম্বরী দেবীকে। ও তখন খুব ছোট,বাড়ির সামনের বাগানে তিন খুড়তুতো জেঠতুতো ভাইবোন হুল্লোড়  করছে,আচমকা একটা রিক্সা এসে থামল,ওদের বিশাল সেগুন কাঠের বিবর্ণ সদর দরজার সামনে। রিক্সার পাদানিতে এক খুনখুনে বুড়ি কোনমতে উবু হয়ে বসা। অস্থিচর্মসার,এক মাথা উস্কোখুস্কো সাদা চুল একটা গুটলী খোঁপায় জড়ানো। পরনের সাদা শাড়ি বিবর্ণ। দু চোখে সব হারানো হাহাকার। ভাড়া দেবার সামর্থ্যও নেই। ইশিতারা খবর দেওয়ায় ঠাম্মা ছুটতে ছুটতে এসে ভাড়া দিল। ছোট কাকু পাঁজাকোলা করে নিয়ে গেল ভিতরে।ঠাম্মাকে জড়িয়ে হাউহাউ কান্না,“নিভা,আমায় তোর বাড়িতে থাকতে দে। ও বাড়িতে আমায় কেউ দেখে না। ”  হাঁটতে পারতেন না কাদম্বরী দেবী, ওদের সাবেকী বাড়ি, বাথরুমকে ওরা বলত কলতলা।  পিছন ঘষে ঘষে কলতলায় যেত ইশি আর ওর ভাইবোনেদের বুড়োমা। বেশী দিন বাঁচেননি। তাঁরই মুখে ঠাম্মার ছোটবেলার গল্প শোনা। ওরা হাঁ করে শুনত, চকমিলানো বাড়ি, চৌহদ্দির মধ্যে দু দুটো পুকুর, বিশাল বাগান, পিয়ানোর দালানের গল্প। বুড়োমা ছাড়া ঠাম্মার বাপের বাড়ির কাউকে কোনদিন দেখেনি ওরা। ও বাড়িতে ঠাম্মার বাপের বাড়ির নামও কেউ উচ্চারণ করত না। অথচ পিসি জেঠু বাবা সব মামার বাড়িতেই মানুষ। মামার বাড়ির প্রতি এক অদ্ভুত রোমান্টিক আকর্ষণ ছিল এবং আছে বাবা আর তার ভাইবোনেদের। অনেক বড় হয়ে ইশিতা ওর বাবাকে একবার জিজ্ঞাসা করেছিল,“তোমাদের মামার বাড়ির ব্যাপারটা কি?” তখন ইশিতার বয়স ত্রিশের চৌকাটে,বিয়ের আগে শেষ বারের মত হিমালয়ের কোলে এক অনামা শৈলশহরে বেড়াতে গেছে তিনজনে। শেষ নভেম্বরের হিমালয় যেন কাঁচের মত স্বচ্ছ। অস্বচ্ছ শুধু মায়ের চোখের দৃষ্টি। প্রাণপুতুলী বিয়ে হয়ে পরের ঘরে চলে যাবে,এই ভেবে অহরহ চোখের জল ফেলছে মা। অথচ ত্রিশ হতে চলল, আমার মেয়ের কি আর বিয়ে হবে না,এই ভেবে কিছুদিন আগেও মানসিক রোগীতে পরিণত হতে বসেছিল মা। মা অমনি, অনেকটা পাহাড়ের মতই বিশাল সাদাসিধে মায়ের মন। তবে এই রোদ ঝলমল তো এই প্রগাঢ় কুয়াশা। বাবা সে তুলনায় অনেক শক্ত,অনেক নির্লিপ্ত। সহনশীল অনেক বেশী। ঠাম্মার ছেলে কি না। বুক ফাটে তাও মুখ ফোটে না বাবার। শুধু বেড়ে যায় সিগারেটের সংখ্যা।
অন্যদিন হলে বাবা নির্ঘাত বলত,“মহান মাওসেতুং বলে গেছেন,‘ডিটাচ ফ্রম দা পাস্ট। রেকন দা প্রেজেন্ট। ’ অতীত ঘেঁটে লাভ কি?” কিন্তু সেইদিনটা ছিল অন্যরকম। হাঁটতে হাঁটতে বাপ মেয়েতে অনেক দূর চলে এসেছিল। শুধুমাত্র পাইন জাতীয় গাছের পাতায় হাওয়ার শরশরানি ছাড়া আর কোন শব্দ ছিল না। মাথার ওপর রূপার থালার মত ঝকমকে দিনমণি। দূরে বরফে ঢাকা জানা অজানা অসংখ্য পর্বত চূড়া। পথের ধারে কবেকার এক কংক্রীটের বেঞ্চ প্রায় ভেঙে লোহার শিক বেরিয়ে গেছে, বাবা বলল,“আয় বসি। ”
জ্বলন্ত সিগারেটের মত ধীরে ধীরে পুড়তে থাকল এতদিন ধরে গড়ে তোলা আবেগের বাঁধ। গগন মুখুজ্জে মশাইয়ের ছিল তিন ছেলেমেয়ে, স্যাণ্ডো,মেন্তু আর ছেলু। এই মেন্তুই শ্রীমতী নিভাননী। বাবার একমাত্র আদরের দুলালী। গায়ের রঙ ছিল বেশ কালো।তবে পিতৃমুখী মেয়ে। বলে না,পিতৃমুখী মেয়েরা সুখী হয়? তখনও দেশ পরাধীন, নয় দশ বছরের হলেই মেয়েদের বিয়ের যুগ্যি মনে করা হত। কিন্তু মেন্তুর আর সম্বন্ধ জোটে না। এত ধনীর দুলালী,এমন অভিজাত পরিবার, এমন পাথরে কোঁদা নাক-চোখ-মুখশ্রী,সমস্যা শুধু উচ্চতা আর গাত্রবর্ণ। মাথায় বেশ ছোট্ট খাট্টো ছিল নিভাননী,বাপের মতই। তেরো বছর বয়সে হঠাৎই একদিন বিয়ের সম্বন্ধ এল। বাবু শ্যামাচরণ চাটুজ্জ্যেও ছিলেন নরম পন্থী কংগ্রেসের ছোটখাট নেতা।উঠতি ধনী।  পেশায় ব্যবসাদার ব্যবসা বেশ ফুলে ফেঁপে উঠেছে। তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র শ্রীমান গৌরিমোহন গিয়ে ভিড়েছিল বিপ্লবীদের দলে। ছোকরাকে রিপন কলেজ  রাস্টিকেট করা হয় সরকার বিরোধীদের সাথে ঘনিষ্ট যোগাযোগের অপরাধে। শ্যামাচরণ বাবু তাকে নিয়ে গিয়ে ভর্তি করিয়ে এলেন সুদূর মেদিনীপুর কলেজে। হরি হরি!সে ছেলে সেখান গিয়ে আরো বখে গেল।প্রায় এক দশক আগে দেশদ্রোহীতার অপরাধে পুলিশের গুলিতে নিহত বাবু  যতীন্দ্রনাথ মুখার্জীর সশস্ত্র বিপ্লবের আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি আর্মস স্মাগল করার জন্য উত্তরপূর্ব ভারতের সীমানা টপকে রওণা দিলেন ব্রহ্মদেশ। মনিপুরে তখন ইংরেজ শাসন ছিল বেশ ঢিলেঢালা। তবে যতটা সহজে পার পাবে ভেবেছিল ছোকরা ব্যাপারটা অত সহজ হল না। কয়েক জন বাঙালী নব্য যুবকের ঐ অঞ্চলে বিচরণের খবর গিয়ে পৌঁছল সরকার বাহাদুরের কানে। ফলে ধরা পড়ল গৌরিমোহন এবং তার সাঙ্গোপাঙ্গো। স্থান হল মান্দালয় জেলে। খবর এল বাবু শ্যামাদাসের কাছে,দুহাজার টাকার ব্যক্তিগত বণ্ডে যদি পারেন ছেলেকে ছাড়িয়ে আনুন। কালক্ষেপ না করে রওণা দিলেন বাবু শ্যামাদাস। তারজন্য পেরোতে হল কালাপানি। হতে হল একঘরে। জেদী শ্যামাদাস বাবু সদম্ভে  ঘোষণা করলেন,“এমন সমাজের মুকে আমি হেগে দি। ”
লোক পাঠালেন গগন মুখুজ্জের কাছে, “ তোমার মত, পুঁথিগত শিক্ষার দীপ্তি আমার নেই। তবে আলোকজ্জ্বলতা আমার পরিবারেরও কিছু কম নয়। আমরা হলুম দেবানন্দপুরের চাটুজ্যে। ” গৌরিমোহনকে দেখতে ছিল অতীব সুদর্শন। ঝাড়া লম্বা,দুধে আলতা গায়ের রঙ, সাকারা মুখশ্রী। বয়সেও মেন্তু ওরফে নিভাননীর থেকে এমন কিছু বড় নয়। বয়স একুশ। ব্যাস ধুমধাম করে হয়ে গেল বিয়ে। যে যুগের বিখ্যাত গায়িকা কদমবালা,বায়োস্কোপের নায়িকা ফুলকুমারী এসেছিলেন নাকি ঠাকুমা আর দাদুর বাসরঘরে গান গাইতে। ফুলকুমারী দেবী? চোখ ছানাবড়া হয়ে গিয়েছিল ইশিতার। তাঁকে নিয়ে কত গল্প,কত সিনেমা দেখেছে ইশিতা।ফুলকুমারীর অল্প বয়সের অনেক সিনেমার প্রিন্ট নষ্ট হয়ে গেছে। প্রায় প্রৌঢ় বয়সে উনি যে সব সিনেমা করেছেন, তার সাদা কালো ঘষা প্রিন্টেই ওণার চোখ ধাঁধানো রূপ আর শক্তিশালী অভিনয় দেখে ফিদা বর্তমান আঁতেল বাঙালী সমাজ।
তো এহেন মেন্তু বিয়ে হয়ে এল ইশিতাদের পরিবারে।আসার আগে মেন্তু নামটা স্বহস্তে কবরে দিয়ে এলেন নিভাননী দেবী। বিয়ের পরও বেশ কয়েক বছর বেশ স্বচ্ছলতায় আর আরামে কাটে নিভাননীর। তারপর ঘনিয়ে আসে শনি। হঠাৎ মাত্র উনচল্লিশ বছর বয়সে পট করে মারা যান শ্যামাদাস বাবু। গৌরিমোহন তখন চব্বিশ। আচমকা পিতৃহারা হয়ে থিতু হবার আগেই শকুনের পালের মত হামলে পড়ল পাওনাদারের দল। সবার কাছেই নাকি ধার রেখে মারা গেছেন শ্যামাদাস বাবু। যারা প্রমাণ দিতে পারল তাদের অর্থ শোধ করে দেওয়া হল। বাকিরা দল বেঁধে গেল আদালতে। মামলায় মামলায় জেরবার হয়ে গেল গৌরিমোহন। বংশের বড় ছেলে বলে কথা। বিধবা মা, ছোট ভাইবোনেদের দায়িত্ব এসে পড়ল গৌরিমোহন আর নিভাননীর কচি ঘাড়ে। মেজভাইয়ের ব্যবসা সবে জমে উঠছিল আচমকা ভাগ হয়ে গেল দেশ।সাধের ফ্যাক্টরি পড়ল পূর্ব পাকিস্তানে।  মূলধন সহ সব জলে ফেলে কোন মতে প্রাণ নিয়ে সপরিবারে একবস্ত্রে পালিয়ে এল মেজদাদু। দেশভাগ যেন মেরুদণ্ডই ভেঙে দিল মেজদাদুর। এপাড়ে এসে  উদ্যমটাই হারিয়ে ফেললেন তিনি। ফলে স্ত্রী আর দুই কন্যা নিয়ে দাদার ঘাড়েই পড়ে রইলেন।সংসারে ছোটদাদুর কোনদিনই মন ছিল না। তিনি ভিড়লেন ইয়ে আজাদী ঝুটা হ্যায় আন্দোলনে। পরিণতি? পিটিয়ে মারল স্বাধীন দেশের পুলিশ আর শত্রুপক্ষ।গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মত গৌরিমোহনের তিন বোনও বিধবা হয়ে গণ্ডা গানেক বাচ্ছা নিয়ে, কপর্দকশূন্য হয়ে ফিরে এল বাপের বাড়ি। সংসার টানতে নাকের জলে চোখের জলে অবস্থা। এরই মধ্যে নিভাননীর বড় ভরসা ছিল তার বাপের বাড়ি। সংসারের চাপে যখন নিভাননী লুকিয়ে বেচছেন একের পর এক গয়না, নিভা আর গৌরিমোহনের সন্তানরা তখন পরম যতনে লালিত হচ্ছে দিদিমা-দাদু-মামা-মামিদের সংসারে।
নিভাননীর ভাইফোঁটা-২ ©Anindita Bhattacharya
বছর দশেক হতে চলল,বাবার সেই গল্প। যার সাক্ষী শুধু বাবা,ইশিতা আর গিরিরাজ স্বয়ং। টলটলে নীল আকাশের দিকে অনেকক্ষণ চুপ করে তাকিয়ে ছিল বাবা,তারপর ফস্ করে একটা সিগারেট ধরালো। এক মুখ ধোঁয়া ছেড়ে হতাশ গলায় বলল,“সেসব দিনের কথা ভাবলে মাঝে মাঝে রাতে ঘুম আসে না। দাদা দিদিরা মামার বাড়ির ন্যাওটা হলেও আমি বরবারই মায়ের আঁচলধরা ছেলে। সবাইকে লুকিয়ে আমার হাত দিয়ে একের পর এক গয়না পাঠাত মা স্যাকরার দোকানে বাঁধা দিতে। সুদ জমে জমে পাহাড় হত। একটা বাঁধা দেওয়া গয়নাও ছাড়িয়ে আনতে পারেনি বাবা। একটা নতুন গয়নাও গড়িয়ে দিতে পারেনি বাবা। মামা মামিরা কেউ খারাপ ছিল না। বরং বেশ ভালো ছিল। বড় মামা বেণীমাধব মুখুজ্জে ছিল অত্যন্ত রাশভারী। আর ছোট মামা সৌরেন মুখুজ্জে তেমনি ফিচেল। মাই ডিয়ার। ছোট মামা সে যুগে অ্যালোপ্যাথি ডাক্তার ছিল। বড় মামি ছিল ডাকসাইটে রূপসী। বড় মাইমার বাবা ছিলেন সে যুগের আইসিএস। কিলো দরে সোনার গয়না নিয়ে শ্বশুরবাড়ি এসেছিল বড়মাইমা। ভীষণ মিশুকে ছিল। মজলিসি যাকে বলে।সেদিক থেকে ছোট মাইমা ছিল অত্যন্ত শান্ত। চুপচাপ। ছোট মাইমা প্রবাসী বাঙালী জমিদারের মেয়ে ছিল জানিস। খাস বিলিতি আসবাবপত্র আর গয়নাগাটি ছিল ছোট মাইমার। রূপার বিলিতি বাসনই ছিল কত। কোন বড় অথিতি এলে ঐ বাসনে তাদের খেতে দেওয়া হত। সোনার সংসার ছিল আমার মামার বাড়ি। বড় মাইমা,ছোট মাইমা ইয়ে যাকে বলে বছর বিয়োনি ছিল। তবে দুজনেরই একটি করে সন্তান কেবল জীবিত ছিল। বড় মামার একটি মেয়ে ছিল,নাম শুনে হাসিস না। নাম ছিল শালিখ। আর ছোট মামার একটি পুত্র,নাম শ্যামল। শালিখদি আমাদের বড়দিদির প্রাণের সখী ছিল। এ গলায় জল ঢাললে ও গলায় যেত। দাদু স্বহস্তে একই দিনে দুজনের কন্যাদান করেছিলেন। বড়দির বিয়ের সব গয়না দাদুর দেওয়া। বিয়েও হয় মামারবাড়ি থেকে। এর বছর খানেকের মধ্যে যে কি হল।” “কি হল বাবা?”ইশিতা তন্ময় হয়ে শুনছিল এবার প্রশ্ন করল। বাবা সিগারেটের পোড়া টুকরোটা পা দিয়ে ঘষে নেভালো। “সে দিনের কথা আজও স্পষ্ট মনে পড়ে। আমি তখন কত?ছয় সাড়ে ছয় বছর। সেদিনটা ছিল রামরাজাতলার রামঠাকুর বিজয়া। কালিবাবুর বাজারের কাছেই ফ্রেন্ডস্ ইউনিয়ন লাইব্রেরীর ছাতে আসন পেতে বসেছে সব গণ্যমান্যরা বিজয়া দেখতে। দাদু হাঁটুর ওপর ধুতি তুলে বাবু হয়ে বসেছে। একপাশে আমি বসেছি আর একপাশে মেজদি। দাদু মাঝে মাঝে হাঁটুতে হাত বোলাচ্ছে,হঠাৎ মামার বাড়ির চাকর হরিয়া ছুটতে ছুটতে এসে খবর দিল,দাদুর ব্যাঙ্ক লালবাতি জ্বেলেছে। তখনও দেশ পরাধীন। তখনও রক্তক্ষয়ী দাঙ্গা শুরু হয়নি। ধিকি জ্বলছে আগুন পূর্ববঙ্গে। খবর ভেসে আসছে ইতিউতি। দাদা,ছোটকা এবং পাড়ার জোয়ান ছেলেরা রীতিমত ডনবৈঠক করছে,লাঠিখেলা প্রাকটিশ করছে। পাড়ার উঠতি মেয়েদেরও লড়াই শেখার তালিম দেওয়া হচ্ছে। বেতারে লুকিয়ে ভেসে আসছে এক অসীম সাহসী বাঙালি কায়স্থ সন্তানের বজ্রনির্ঘোষ। তিনি আসছেন। পরাধীনতার শৃঙ্খল চূর্ণ করতে। ওদিকে ইউরোপে পেশী ফোলাচ্ছে এক বেঁটে জার্মান। এতকিছুর মধ্যে দাদুর একলক্ষ টাকা নিয়ে লালবাতি জ্বেলে দিল দাদুর ব্যাঙ্ক। সে যুগে একলাখ। ভাব। এযুগে কতটাকা। এই ধাক্কাটা দাদুর সইল না। সান্নিপাতিক রোগে মারাই গেল দাদু। মারা যাবার আগে,মায়ের সামনে বড়মামা-ছোটমামা আর শ্যামলদার হাত ধরে দাদু বলে গিয়েছিল,পৈতৃক সম্পত্তি থেকে মাকে যেন বঞ্চিত না করা হয়।” “একলাখ টাকা জলে যাবার পরেও সম্পত্তি?” অবাক হয়ে বলেছিল ইশিতা। বাবা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেছিল,“হ্যাঁ। ভূসম্পত্তি। যার মধ্যে গোটা দুয়েক বাড়ি,জোড়াপুকুর, মন্দির সব মায়ের নামে কেনা ছিল। এছাড়াও দিদিমার সোনা আর জড়োয়ার গয়নাই ছিল কয়েক শ ভরি। ” বলো কি? ইশিতার মুখ আর বন্ধ হয় না।
বাবা মাথা নীচু করে বলল,“হুঁ। সম্পত্তিই যত নষ্টের মূল। দাদু মারা যেতে দিদিমার সধবা সাজ ঘুচিয়ে থান পরানোর কাজটা করেছিল দিদিমার দুই প্রিয় নাতনী। আমার বড়দি চপলা আর মামাতো দিদি শালিখ ওরফে রমলা। সধবা দিদিমার হাতে ছিল বারো মাস পরার দশগাছা শুধু সোনার চুড়ি,যার এক একটা একভরি করে। আর ছিল সাড়ে চার ভরি করে দুটো অমৃত পাকের বালা। দিদিমা হাত থেকে খুলে মেয়ের মেয়ে চপলার হাতে পরিয়ে দিয়েছিল দশভরির দশগাছা চুড়ি। আর ছেলের মেয়ের হাতে ন ভরির দুটো বালা। এই থেকেই সূত্রপাত। মাইমারা আড়ালে বলাবলি শুরু করল,‘দিদিমণি, মাকে এই অবস্থায়ও ফুসলে বেশ দশভরির চুড়ি হাতিয়ে নিল। ” দিদিমনি ওরফে মা।  কথাটা মায়ের কানেও গেল। মায়ের জীবনে কোনকিছুতে লোভ নেই। জীবনে হাতপেতে কারো থেকে কিছু চায়নি। একটার পর একটা গয়না,পিতলের কলসী বেচেছে তবুও কোনদিন দাদুকে বলেনি,পঞ্চাশটা টাকা দাও তো। বাবার আত্মসম্মানবোধ ছিল তীব্র। বাবার ঘোরতর আপত্তি ছিল বড়দি মেজদি বা আমার মামারবাড়িতে থাকায়। দাদু দিদিমা ছাড়ত না। এটা মামামামিদের অজ্ঞাত নয়। বরং দাদু বেঁচে থাকতে ওরাই বলত, ‘আহাঃ থাক না। শালিখ,শ্যামলের সাথে খেলে বড় হবে। এত বড় বাড়ি।’ আজ তাদের মুখে এই কথা শুনে মা স্তম্ভিত হয়ে গেল। পত্রপাঠ বড়দিকে ডেকে বলল,’চুড়ি ফেরৎ দে।’ ” “তারপর? বড়পিসিমা চুড়ি ফেরৎ দিল?” ইশিতা উদগ্রীব হয়ে জানতে চাইল। তীব্র বিরক্তিতে কুঁচকে যাওয়া মুখে বাবা বলল,“না। বড়দি নিজের বরের কথা ছাড়া কারো কথা শুনত না। জামাইবাবুটা এক নম্বরের চামার। কি আর বলব,নিজের দিদির নামে কিছু বললে, তো আকাশে থুতু ছোঁড়া হবে। ”ইশিতা এতদিনে বুঝল,কেন বড় পিসিমার প্রতি এত শীতল আচরণ ঠাম্মার। বড় পিসিমা আসে,অনাহূতের মত। বাড়ির বড় বউ হিসেবে বড় জেঠিমা প্রথাগত খাতির যত্ন করে, কিন্তু ঠাম্মা বাবা কাকা বা পিসিরা কেউ তেমন পাত্তা দেয় না। বড় পিসিমার পরিবার কেমন যেন অপাংক্তেয় ওদের পরিবারে।
বাবা বলেই চলেছে,“দাদু মারা যাবার পর চেনা মামারবাড়িটা  হঠাৎ কেমন যেন বদলে গেল। বড়মামা এবং বড়মামিমা গোটা বাড়ির কতৃত্ব তুলে নিল নিজের হাতে। মেজদি তখনও ওবাড়িতে থাকত। দিদিমার সাথে রাতে শুত।মেজদির তখন ক্লাশ সেভেন হবে,কত মানে বছর বারো,তেরো হবে, একদিন হঠাৎ স্কুল থেকে এবাড়ি চলে এল মেজদি। মাকে সাফ জানিয়ে দিল,ওবাড়িতে আর যাবেনা। নানা ছুঁতোনাতায় বড়মামা বড়মামি বড় কটু কথা শোনায়।বাবার সামর্থ্য নিয়ে খোঁটা দেয়। দিদিমা সব শুনেও শোনে না। ছোটমামিও কেমন যেন বদলে গেছে। তেমন কথা বলে না।শ্যামলদা ইঞ্জিনিয়ারিং পড়া নিয়ে ব্যস্ত। কেউ নেই যে মেজদির পাশে দাঁড়াবে। তীব্র অসহায়তা থেকেই পালিয়ে এসেছিল মেজদি। মা বুঝল সবই।  বাবাকে লজ্জায় সঙ্কোচে কিছু জানাতে পারল না মা। আমার খুব আনন্দ। মেজদি এবার থেকে আমাদের সাথে থাকবে। সন্ধ্যা বেলায় হাসপাতাল ফেরৎ ছোটমামা এসে হাজির,ছোটমামার উদাত্ত কণ্ঠস্বর,প্রাণখোলা হাসি,মেজদিকে বলত,বুড়ি। ‘চলরে বুড়ি মা। বুড়ো ছেলেটাকে এভাবে একা ফেলে কেউ পালিয়ে আসে।’ছোটমামাকে প্রচণ্ড ভালোবাসতাম সকলে। তাও মেজদি গাঁইগুই করতে লাগল। রাত একটু বাড়তেই গাড়ি করে দিদিমাকে নিয়ে সটান হাজির শ্যামলদা। ‘বুড়ি তোর কি কোন কাণ্ডজ্ঞান নেই?ঠাকমা কি কান্নাকাটি  করছে তোর জ্ন্য দেখ। ”দিদিমাও মেজদিকে জড়িয়ে সে কি কান্না। ফিরে গেল মেজদি। তবে বেশীদিনের জন্য না। অচীরেই জানা গেল ছোটমামার রাজরোগ ধরেছে।” মানে?টিবি? উৎকণ্ঠিত স্বরে প্রশ্ন করল ইশিতা। “নাঃ। ক্যান্সার।” অদ্ভুত দমচাপা কান্না গিলে বলল বাবা।নিভাননীর ভাইফোঁটা-৩ ©Anindita Bhattacharya
“ক্যান্সার?” ব্যথিত গলায় প্রশ্ন করেছিল সেদিনের ইশিতা। বাবা অনেকক্ষণ নীরব ছিল। নীল আকাশে ভেসে বেড়ানো দু এক টুকরো দুগ্ধফেননিভ মেঘের ভেলায় কি খুঁজছিল বাবা কে জানে? গলা ঝেড়ে সিগারেটে বেশ কয়েকটান মেরে বাবা বলেছিল,“ছোটমামা ডাক্তার ছিল। বেশ বড় ডাক্তার। এক্সরে নিয়ে কিছু কাজ করতে গিয়ে, অ্যাফেক্টেড হয়। লোকে বলে লেডের জামাটা ভিতরে ভিতরে ফেটে গিয়েছিল, খেয়াল করেনি। কি সুদর্শন ছিল ছোটমামা, টকটকে গৌরবর্ণ, উন্নত নাসা, সংসার ত্যাগী সন্ন্যাসীদের মত একজোড়া উদাস নির্মোহী চোখ, রবি ঠাকুরের মত একগাল দাড়িগোঁফ। ধপধপে সাদা ধুতি পাঞ্জাবি ছাড়া কিছু পরত না। আর কি রগুড়ে যে ছিল। সারাদিন এর পিছনে লাগছে,ওর পিছনে লাগছে। আর হো হো অট্টহাসি। দিদিমা উত্যক্ত হয়ে যেত। রেগে গিয়ে বলত,“মুকুজ্জে বাড়িতে একদণ্ড শান্তি পেলুম না। সারাদিন দেকো, কাক উড়ছে,চিল পড়ছে। ভালো লাগেনা বাপু ধেড়ে ছেলের ফাজলামি।” সেই লোক আচমকা শয্যাশায়ী হয়ে পড়ল। মুখ দিয়ে দমকে দমকে কাঁচা রক্ত। শ্যামলদা সদ্য ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করেছে। বিলেত যাবে সব ঠিকঠাক। এমন সময় ছোটমামা শয্যা নিল। বড়মামা তখন শাসকদলের এমএলএ। বিশাল নেতা। মধ্য হাওড়ার সব কলেজ-ইস্কুলের গভর্নিং বডির মেম্বার। গর্বে মাটিতে পা পড়ে না। মা-বাবা প্রায় রোজ দেখতে যেত ছোটমামাকে, তৎকালীন ডাক্তার বদ্যি যা করার সব করা হল। ছোটমামার স্যারেরা, অন্যান্য সহকর্মীরা শেষ পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে গেল। ফল হল অশ্বডিম্ব। বিলেত থেকে বিশাল দামী ইঞ্জেকশন আনানো হল, যার তখনকার দিনে মানে ষাটের দশকে মূল্য ছিল চল্লিশ হাজার টাকা। ছোটমামা একটার বেশী নিতে পারল না।”

আবার নীরবতা। বেশ কিছুক্ষণ পরে বাবা ফস্ করে একটা সিগারেট ধরালো। “ছোটমামার মৃত্যুর পর মামার বাড়িটা যেন কেমন বদলে গেল। যেন শ্মশানপুরি। শ্যামলদা বিলেত চলে গেল। ছোট মামিমা এমনিতেই শান্ত চুপচাপ স্বভাবের ছিল, আরো নিঝুম হয়ে গেল, আরো নিস্তেজ হয়ে পড়ল যেন। দিদিমাও কেমন যেন বোবা মেরে গেল।অত বড় বাড়ির একছত্র অধিশ্বরী বাড়ির এককোণে পড়ে থাকত। কেউ খোঁজ নিত না। বড়মামা বড়মামিমাই হয়ে দাঁড়ালো বাড়ির চালিকা শক্তি। পুরানো ঝি চাকরদের সকলকেই প্রায় তাড়িয়ে দেওয়া হল। ব্যয় সংকোচের নামে।বড়মামার আদরের দুলালী রমলাদি ওরফে শালিখ এসে জুটল সপরিবারে। তার বর এক নামী প্রাইভেট কোম্পানীতে চাকরী করত। পশ্চিমবঙ্গের তখন দুর্দিন সবে শুরু হচ্ছে,একদিকে পূর্ব পাকিস্তান থেকে আগত বিপুল জনস্রোত,দ্রুত জবরদখল হয়ে যাচ্ছে ফাঁকা পড়ে থাকা জমি, তারওপর বন্ধ হতে শুরু করেছে একের পর এক কারখানা। তো রমলাদির বরের কারখানাও লালবাতি জ্বাললো। দু-দুটো ছেলেমেয়ে নিয়ে রমলাদির সংসার আর চলে না। বড়মামা সাদরে নিয়ে এল নিজের বাড়িতে। জামাই হল শ্বশুরের রাজনৈতিক এজেন্ট কাম সেক্রেটারি। আর রমলাদিকে ঢুকিয়ে দিল একটা স্কুলে।
ছোট মাইমা খুব ভালোবাসত রমলাদিকে। রমলাদির বাচ্ছা গুলোকে পেয়ে যেন বেঁচে গেল ছোট মাইমা। ভালোই চলছিল সব। আমাদের পরিবারে যদিও দুর্দিনের ঘাটতি ছিল না। এসে গেল দামাল সত্তরের দশক। পেটে যাদের ভরপেট ভাত জোটে না,তারা ঝাঁপিয়ে পড়ল সমবন্টনের দাবীতে। ইতিমধ্যে শ্যামলদা এক মেম বিয়ে করে বসল। বড় মামা প্রথম চোটে খানিক চিল্লামিল্লি করল। তবে তিনি তখন নখদন্তহীন সিংহ।পার্টিতে কেউ পাত্তা দেয় না। রমলাদির বর একটা অপদার্থ। বেশ কয়েক জায়গায় চাকরীতে লাগালো,কিছুই পারল না। তো যা বলছিলাম,শ্যামলদা ফিরল বউ নিয়ে।মুকুজ্জে বাড়ির একমাত্র ছেলের বিয়ে বলে কথা,  বিশাল রিশেপসন এর আয়োজন করল বড়মামা। অন্তত হাজারজন নিমন্ত্রিত। বাবা মা মানে তোর ঠাকুমা দাদু সহাস্যে স্বাগত জানাচ্ছে অথিতি বর্গকে। বাবার পরনে ছিল ধুতি পাঞ্জাবি আর চাদর। আমাদের তখন যা অবস্থা, পাঞ্জাবিটা কিঞ্চিৎ বিবর্ণ ছিল একথা অনস্বীকার্য। বড়মামা হঠাৎ সবার সামনে বাবাকে ধরে কি অপমান। “আজকের দিনে একটা ভালো জামাকাপড় পরতে পারোনি।” বাবা ক্ষুব্ধ অপমানিত হয়ে সেদিন না খেয়েই চলে এসেছিল। মাও খুব দুঃখ পেয়েছিল। আমরা ভাইবোনেরা যদিও জানতাম এমনই হবে। তোর কাকা,জেঠু,আমি সবাই নামী নকশাল। আর বড়মামার পার্টির বদান্যে তখন লাল বরাহনগরের গঙ্গার জল। সর্বসমক্ষে আমাদের ঝেড়ে ফেলাই বড়মামার উদ্দেশ্য ছিল। শ্যামলদা যদিও বউ নিয়ে পরে আমাদের বাড়ি এসেছিল। মেম বউদি খুব ভালো ছিল। মা-বাবা সকলে খুব পছন্দ করত ওদের। শ্যামলদা আর বউদি যখন চলে যাচ্ছে,   হঠাৎ শ্যামলদা ইতঃস্তত করে মায়ের কাছে সম্পত্তি নিয়ে কিছু কথা তোলে। মা দুহাতে শ্যামলদার হাত চেপে ধরে বলে,“শ্যামল তুই আমার বাপের বংশের একমাত্র সলতে। আমার নামে বাবা যা কিছু রেখে গেছে সব তোর। তুই দানপত্র করে আনিস। আমি সই করে দেবো। ওবাড়ির আধলা ইঁটেরও ভাগ চাই না আমার।”
“তারপর?” প্রশ্ন করে ইশিতা। বাবা আড়ামোড়া ভেঙে বলে,“তোর প্রশ্নটা কি ছিল যেন?ঠাম্মা কেন দেওয়ালে ফোঁটা দেয়,তাই তো?” হ্যাঁ এটাই ইশিতার মনোগত প্রশ্ন ছিল,মুখে যদিও জানতে চেয়েছিল,“তোমাদের মামার বাড়ির গপ্পটা ঠিক কি?”
বাবা মিটমিট করে হেসে বলল,“ঠাকুমা যেত তো ফোঁটা দিতে। বড়মামার অত অভদ্রতার পরও মা যেত। নিজের হাতে গড়া নাড়ু,নিমকি আর পাড়ার মিষ্টির দোকান থেকে কেনা সবথেকে ভালো মিষ্টি নিয়ে। ব্যাপারটা হল,হঠাৎ দেখা গেল,মামার বাড়ির জমিবাড়ি,পুকুর সব প্লটপ্লট করে বিক্রি করে দেওয়া হচ্ছে। মায়ের কাছে খবর আসত। মা গা করত না। ইতিমধ্যে ছোট মামিমা মারা গেল। মারা গেল বাবাও। তোর পিসিদের বিয়ে থা হয়ে গেল। আমাদের সাধের আন্দোলন চৌপাট হয়ে গেল। পৈতে পুড়িয়ে ব্রহ্মচারী হয়ে আমরা সবাই সংসারে মন দিলাম। জেঠুর বিয়ে হল। নমঃনমঃ করে যদিও। দাদা দিদিরা জন্মালো। তোর মায়ের সাথে আমারও বিয়ে হয়,হয়। হঠাৎ একদিন সস্ত্রীক শ্যামলদা এসে হাজির। মায়ের আনন্দ সীমাহীন। আয়,বস,খেয়ে যা। খাতিরের কমতি রাখল না তোর ঠাম্মা। শ্যামলদার ইতিমধ্যে যমজ ছেলে হয়েছে। তাদের বয়সও তখন বছর দশেক। একটাকে সাহেবদের মত দেখতে আর একটাকে আমাদের মত। তাদের আনেনি যদিও। ছবি এনেছিল শুধু। শ্যামলদা মায়ের পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে বলল,“চললাম পিসিমা। এই শেষ দেখা। ” “বালাই ষাট” বলে উঠল মা। “একি অলক্ষুণে কথাবার্তা”। শ্যামলদা করুণ হেসে বলল,“কেউ কথা রাখেনি পিসিমা। তুমিও না। জমিবাড়ি সব রমলাদির নামে করে দিলে তুমিও? আজ নিজের দেশে ফিরে আমাদের কোথাও থাকার জায়গা নেই পিসিমা।”
(চলবে)