Saturday 6 March 2021

অনির ডাইরি মার্চ, ২০২১


অনির ডাইরি ৩০শে মার্চ, ২০২১


পাঁচশ বছরেরও বেশী পুরাণ শহরটায় যখন ঢুকলাম, তন্বী সন্ধ্যা ততোক্ষণে পা বাড়িয়েছে গভীর রাতের পানে। কাঁধে মাথা রেখে গভীর নিদ্রায় আচ্ছন্ন তুত্তুরী। দোলে ফিরে আসছি নিজের শহরে, প্রতিবারই শহরে প্রবেশের সাথে সাথে উদ্দাম আনন্দের পাশাপাশি এক অজানা আশঙ্কায় মৃদু কেঁপে ওঠে হৃদয়, কতদিন, আর ঠিক কতদিন বাঁধা থাকবে এই গাঁটছড়া? এমনি সজীব থাকবে সম্পর্কের শেকড়বাকড় গুলো? প্রতিটি পল অনুপলে কেমন যেন একটু একটু করে বুড়িয়ে যাচ্ছে, চেনা মানুষগুলো। একটু একটু করে মুছে যাচ্ছে সোনালী অতীত, আলগা হয়ে আসছে আশৈশব লালিত বাঁধন। 


কোণা এক্সপ্রেস ওয়ে বরাবর ছুটে আসা গাড়িটা আচমকা বেলেপোল থেকে ধরে নিল বাঁদিকের সরণি। তু্ত্তুরীর মুখ আর মাথা আবৃত পুরু আবিরে। গাড়ি ছোটে, পেরিয়ে যায় ৫২র চৌরাস্তা,পেরিয়ে যায় পুরাণ ইছাপুর রোড, ইছাপুর জলট্যাঙ্কের কাছে ক্ষুদিরামের মূর্তিকে ডানহাতে রেখে কদমতলা বাজারের দিকে বেঁকে যাই আমরা। পথে গমগমে ভিড় কিছুক্ষণ রেস্তোরাঁয়, এই অঞ্চলে কত যে রেস্তোরাঁ  খুলল আর বন্ধ হল, কিছুক্ষণের জনপ্রিয়তায় ভাঁটা পড়েনি তিলমাত্র। খাবার যে অনবদ্য তা নয়, তবে সুস্বাদু এবং বেশ সস্তা। কতবার যে আমি,চৈ, সঞ্চিতা আর দেবারতি এখানে নৈশাহার সেরে, রাত এগারোটা নাগাদ হাঁটতে হাঁটতে বাড়ি ফিরেছি। কি নিরাপদ ছিল আমাদের জনপদটা, হয়তো এখনও তাই আছে, তবে আমরা একটু বেশীই বেপরোয়া ছিলামও বটে। অন্তত মায়ের তাই অভিমত, হোটেলওয়ালারা, এবার ওঠ মামণি, তালা মারব মার্কা কিছু বলে ঠেলে না তুললে আমরা  উঠতাম থোড়াই? বকেই যেতাম, কি যে এত কথা জমে থাকত আমাদের। তবে মাঝেমধ্যেই এসে ঢুঁ মারতেন রবি ঠাকুর। দেবা থাকবে আর দাড়ি বুড়ো থাকবে না? 


পাওয়ার হাউসের মোড় থেকে ডানদিকে বেঁকে বাবাকে ফোন করলাম, একটু আসতে পারবে কি। টুকটুক করে জমেছে অনেকগুলো প্যাকেট। মাত্র চারবেলার জন্য পিত্রালয়ে আসাটাও যে কি ঝঞ্ঝাট, ব্যাগ ভর্তি করার আগে খালি করতে হয় ঠাণ্ডা আলমারি। এই করতে গিয়ে আবিষ্কৃত হয়, তিন টুকরো মাছ,বেশ খানিকটা ফুলকপি, শুঁটকো মটরশুঁটি, গুচ্ছ খানেক পটল, আধখানা ঢেপসা বেগুন, গুটি কয় উচ্ছে, একছড়া নিমপাতা, এক প্যাকেট বিনস্, গুটি চারেক পাতিলেবু, গাদাগাদা টমেটো আর শশা। এতকিছু থাকা সত্ত্বেও প্রতি সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে দেখি মাসির চিন্তান্বিত বদন, ‘রাতে যে কি তরকারি করি? সব্জি তো কিছুই নেই।’ গোটা সব্জিপাতি শাশুড়ী মাকে গছিয়ে, আধকাটা  ফুলকপি আর শুঁটকো মটরশুঁটি দিয়ে খিচুড়ি আর পটলের বড়া করে খেয়ে এবং খাইয়ে তথা টিফিন দিয়ে বেরিয়েছি। আর এককৌটো ভর্তি খিচুড়ি ঠাণ্ডা আলমারিতে না তুলে ডাইনিং টেবিলে ফেলে রেখেই চলে এসেছি। অতখানি গোবিন্দভোগ চাল আর সোনামুগের ডালের খিচুড়ি, তারওপর ছড়ানো হয়েছে অপরিমিত গব্য ঘৃত, কেন যে তুলে এলাম না? গৃহকর্তা বাড়ি ফিরবেন রাত দশটা নাগাদ, এই পচা গরমে ততোক্ষণে কি আর তা অবশিষ্ট থাকবে? যত বলছি, বাড়ি ফিরে ফেলে দিও, শৌভিক ততোবারই ভয় দেখাচ্ছে, ওটাই খাবে। তবে আজ রাতে নয়, ইতিমধ্যেই দুবার খিচুড়ি খাওয়া হয়ে গেছে। ওটা কাল সকালে খেয়ে আপিস যাবেন বাবু। সাধে কি তুত্তুরী মাঝেমাঝেই, “ঠাম্মার ছেলে বাবা” বলে আদর করে? শৌভিক যথার্থই অতসী দেবীর পুত্র। না শাশুড়ি মা একদানা খাদ্য নষ্ট করেন, না তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র।  


গলির মুখে এসে থামল গাড়ি। দুহাতে চারটে ব্যাগ নিয়ে আমরা দাঁড়িয়ে আছি, বাবার জন্য। বৃদ্ধ বলেছে, ‘বুড়ো হয়ে গেছি কিনা, অত তাড়াতাড়ি তো আর হাঁটতে পারি না, তোমরা কিন্তু দাঁড়াবে। চলে আসবে না। ’ আমার হাতে আর তুত্তুরীর পিঠের ব্যাগ ছাড়াও রয়েছে গোটা চারেক প্লাস্টিকের ব্যাগ। কাগজের ঠোঙার বদলে যখন সদ্য আসতে শুরু করল এই ব্যাগগুলো, আমরা বলতাম চিকচিকে। আজকাল আর কেউ বলে না বোধহয়। স্বকীয়তা ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছে শহরটার। আসল জেল্লা খুইয়ে, কেমনি যেন গিল্টিকরা ফ্যাশনদুরস্ত হয়ে উঠছে আমার শহর। 


বৃদ্ধের হাঁটুর যা অবস্থা, পাঁপড় ভাজার মত মচমচ করে, জোর কমেছে ফুসফুসেরও। আজকাল দু কিলো মালও বইতে পারে না বাবা। রিক্সায় বসে থেকে রিক্সাওয়ালাকে পাঠায় মাল সমেত বাড়ি, হয়তো কমেছে ক্ষয়েছে অনেককিছুই, তবে তিলমাত্র টসকায়নি মনের জোর আর বিক্রম। বুড়ো হলেও রীতিমত রয়াল বেঙ্গল হয়ে ঘুরে বেড়ায় বাবা। গলার শির ফুলিয়ে ঝগড়া করে মায়ের সাথে, সেই জন্যই ডেকে আনা, তুত্তুরীর যা অবস্থা, এইমেয়েকে শ্যাম্পু করাতেই হবে, আর এতরাতে মেয়েকে স্নান তথা শ্যাম্পু করাতে হবে বললেই পত্রপাঠ বিদায় করে দিতে পারে মা। ভুল বললাম, তুত্তুরীকে কেড়ে নিয়ে আমায় বিতাড়নই করবে মা। এই বৃদ্ধের সক্রিয় সমর্থন তাই আমার বড় প্রয়োজন। এত তাড়াতাড়ি তাড়িয়ে দিলে হবে? এখনও তো বাকি কতকিছু, দোলের আগের রাতে পোড়াতে হবে ন্যাড়া, রাত বারোটায় করতে হবে ফিস্টি, দোলের দিনের উদ্দাম রঙ খেলা আর রাতে আমাদের ভাঙ পার্টি। উৎসব থেকে উৎসবেই তো বেঁচে থাকি আমি, যতটা না ভালো থাকি আর তারথেকেও ভালো রাখি আসেপাশের মানুষগুলোকে। এবারেও হবে, সব হবে, আগে তো বৃদ্ধার প্রকোপ থেকে বাঁচি।



অনির ডাইরি ২৯শে মার্চ, ২০২১


মায়ের রান্নাঘরের জানলার বাইরে পূর্ণ মহিমায় বিকশিত দোল পূর্ণিমার চাঁদ। কি যেন বলেছিল চৈতালী, সবথেকে বড়,সবথেকে মাদক মাখানো চাঁদ ওঠে এই বসন্তপূর্ণিমার রাতে। সিদ্ধির নেশায় হাল্কা আচ্ছন্ন তখন আমাদের মন আর মাথা। নিঝুম বসন্তপূর্ণিমার রাতে চৈতালীদের বাড়ির গলি বেয়ে রাজপথের দিকে হাঁটছিলাম আমরা তিনজনা, চৈ, অন্তু আর আমি। গলির প্রতিটি বাঁকে ধাক্কা খাচ্ছিলাম পূর্ণ চন্দ্রের সাথে, পাল্লা দিয়ে চড়ছিল ঝিমঝিমানি। প্রতিটি পদক্ষেপে, মনে হচ্ছিল, কি অসম্ভব সুখী আমরা, এই পুতিগন্ধময় অবহেলার কুলি টাউনেও প্রকৃতি উজাড় করে দিয়েছে তার রূপের ডালি, শুধু, শুধু আমাদেরই জন্য। শিরায় শিরায় ছড়িয়ে পড়ছিল অসীম,অপরিসীম সুখ- 


এই তো গত পরশুই এসে হাজির হয়েছিলাম অর্ধ সহস্রাব্দী পেরোনো বুড়ো শহরটায়। প্রগাঢ় সন্ধ্যা তখন পা বাড়িয়েছে পূর্ণ রাতের দিকে।  নামানো কাঁচের বাইরে থেকে ছুটে আসা দামাল বাসন্তী হাওয়ায় মাখামাখি ফাগের সুবাস। কোথা থেকে যেন ভেসে আসছে মৃদু কাঁসরঘন্টার ধ্বনি। কাঁধে মাথা রেখে অকাতরে ঘুমাচ্ছে তুত্তুরী। বড় পরিশ্রান্ত বেচারী,সেই কোন সকালে আপিস টাইমে দুটো নাকেমুখে গুঁজে আপিসে ছুটেছিল মেয়েটা। আপিসটা অবশ্য আমার, তবুও-। 


কি ভূতভূতে করে রঙ মেখেছে মেয়েটা। মাথা,গাল, গলা গাঢ় লাল গোলাপী বেগুনী আবিরে মাখামাখি। অবশ্য যত না মেখেছে, মাখিয়েছে তার পাঁচ গুণ। বলাগড়ের শ্যামলের কালো চুল আর সাদা পাঞ্জাবি লাল-সবুজ মাখামাখি, সৌজন্য আমার, ঝুমার এবং মাম্পির দুহিতা। আমাদের থেকে ঢের সকালে বাড়ি থেকে বেরিয়েছিল ছেলেটা, দুধসাদা পাঞ্জাবি পরে, সাথে ব্যাগ ভর্তি করে এনেছিল ঘরে ভাজা মুড়ি, বাগানের নারকেল, ঝুরি ভাজা, চিনে বাদাম এমনকি একটা ছোট্ট প্লাস্টিকে মুড়ে খানিক ঘানি ভাঙা সর্ষের তেল। আপিসে এসে মুড়ি মাখবে বলে। এমনি করে ছেলেটা, শ্যামল আসা মানেই জম্পেশ করে মুড়ি মাখা। শুধু মুড়ি মাখার জন্যই একটা বড় স্টিলের গামলা কিনে আপিসে রেখে গেছে শ্যামল। পথে কোন দোকান থেকে কিনে এনেছিল রসগোল্লা আর পান্তুয়া। আর এনেছিল ফুল। পলাশের বায়না জুড়েছিল মেয়েরা। পলাশ পায়নি বলে, রাজ্যের হলুদ, লাল ফুল ব্যাগ ভর্তি করে এনেছিল ছেলেটা। যার মধ্যে খানিক হলুদ ফুল আর একখান শুঁটকো গোলাপ তুত্তুরীর মাথায় আটকে দিয়েছিল প্রিয়াঙ্কা। দশ কেজি লাল আবির আনবে বলেও ভয় দেখাচ্ছিল শ্যামল কয়েকদিন ধরে, সেটা যা হোক বলে কয়ে নিরস্ত করা গেছে।


 আমার সাতটা শ্রমিক কল্যাণ কেন্দ্রের প্রতিটি থেকে আসা এজেন্ট আর এসএলওদের বলা হয়েছিল একটা আলাদা রঙের আবির আনতে। যার যা মন চায়, নিয়ে আসুক সেই রঙ। বলাগড় বেছেছিল লাল, সেই হেতু লাল আবির। 


শুধু শ্যামল নয়, সবাইকেই কমবেশী রঙ মাখিয়েছে তুত্তুরী, মায়ের আপিস বলে,একটু বেশীই গুণ্ডামি করে মেয়েটা। আমার অসাক্ষাতে মৃদু শাসনও করে টুকটাক লোকজনকে। এবারের বসন্তোৎসবের জন্য রীতিমত দিন গুণছিল মেয়েটা।  এত আগ্রহের দুটি কারণ, প্রথমতঃ মায়ের নতুন ম্যাডামকে দেখবে আর দ্বিতীয় সিকনি আর লস্যি খাবে। নতুন ম্যাডামকে মা কেন যে, ‘দিদি,তুমি’ বলে সম্বোধন করে এটা নিয়ে অসীম কৌতুহল তুত্তুরীর। আগের উপরওয়ালাদের তুত্তুরী মামা এবং তুমি বললেও, মা তো,‘স্যার, আপনি’ বলেই সম্বোধন করত বরাবর। প্রশ্ন করলে মা বলে, ম্যাডামের সাথে পরিচিতি তো আজ নয়, প্রায় একযুগ আগে। উনিই বলেছেন, রাতারাতি সম্বোধন বদল করার কোন প্রয়োজন নেই।  


মঠ ফুটকড়াইয়ের পাশাপাশি সিকনি অর্থাৎ সিন্নির প্রস্তাবটা ছিল আদতে আমারই, পরে লস্যিটা জুড়েছে ঝুমার আব্দারে। বর্মন সাহেব খানিক ঘেঁটে গিয়ে প্রশ্ন তুলেছিলেন, ‘সিন্নি হবে মানে? আপিসে সত্যনারায়ণ করবেন?’ না না, পুজো আচ্ছা নয়, শুধু সিকনি থুড়ি সিন্নি মাখা। কে মাখবে সিকনি, ইয়ে মানে সিন্নি? কেন মগরার প্রিয়াঙ্কা আছে না। সবেতেই ঝাঁপিয়ে পড়ে প্রিয়াঙ্কা। রমেশ আর প্রিয়াঙ্কাকে নিয়ে মোটামুটি যুদ্ধ জেতা যায়, এদের অপরিসীম উৎসাহ আর উদ্দীপনা মাঝে মাঝে আমাকেও লজ্জায় ফেলে। শেষ পর্যন্ত অবশ্য লস্যি বানিয়েই ক্ষান্ত হল প্রিয়াঙ্কা। সিন্নি মাখা মোটেই সেদিনের ছুকরির কাম না। তারজন্য দরকার পাকা গৃহিণী। 


লস্যিটা অবশ্য বড় দরদ দিয়ে বানিয়েছিল মেয়েটা। বাড়ি থেকে বয়ে আনা স্টিলের হাঁড়িতে কোন খাটাল থেকে কিনে আনা মোষের দুধের দইয়ের সাথে মাদার ডেয়ারির দই মিশিয়ে সামান্য চিনি আর নুন দিয়ে ডাল ঘুটনি দিয়ে অনেকক্ষণ ধরে ঘটঘট করে যে বস্তটি তৈরী হল,সেটা এক্কেরে অমৃত। প্রিয়াঙ্কা অবশ্য তাতে লেবুর রস, বিট লবণ আর জলজিরা মেশাবে বলে উঠে পড়ে লেগেছিল, শেষ পর্যন্ত বড় ম্যাডামের হস্তক্ষেপে তাকে নিরস্ত করা গেল। 


সিকনি থুড়ি সিন্নি মাখল আমাদের বাঁশবেড়িয়ায় এজেন্ট নূপুরদি। পেশায় নূপুরদি অঙ্গনওয়াড়ি কর্মী।   আরও দুই অঙ্গওয়াড়ি দিদি, আমাদের পোলবার দেবী দি আর মিঠুদির সক্রিয় সহযোগিতায় সিন্নিটা দাঁড়ালো পুরো অমৃত। ওপর থেকে পাকা গৃহিণীরা আলতো হাতে ছড়িয়ে দিল কুচানো আপেল, বেদানার দানা আর ভাঙা কাজু। কাগজের বাটিতে ঘন ক্ষীরের মত সিন্নি মাখা, হাতে তুলে দেবার সময়, মিঠুদি লাজুক হেসে বললেন, ‘আপনি আমাদের মনে রেখেছেন ম্যাডাম, এতেই আমরা খুশি। ’ 


 আবিরে মাখামাখি আমারও মুখ আর মাখা। হাল্কা ঝেড়েছি বটে, তবুও টুপটাপ করে ঝরে পড়ছে রঙীন ফাগ, রাঙিয়ে দিয়ে যাচ্ছে সাধের কাঁচা হলুদ রঙা তাঁত। ওণার বিগলিত মিষ্টি হাসিটা দেখতে দেখতে সামান্য ব্যথা করে উঠল গলার কাছটা, চুঁচুড়ায় এটা আমার এবং তুত্তুরীর শেষ বসন্তোৎসব। পেশাগত ভাবে পরিযায়ী পাখি আমরা, কবেই ঘোষিত হয়েছে বদলীর হুকুমনামা। কার্যকর হয়নি শুধুমাত্র নির্বাচনী নির্ঘন্ট হেতু। সময় হয়ে আসছে, অনেকদিন তো হল এবার গুটাতে হবে পাততাড়ি। না হয় চলেই যাব, রেখে যাব অগুনতি সুখস্মৃতি আর নিয়ে যাব অনেক অনেকটা ভালোবাসা।


অনির ডাইরি ১৪ই মার্চ,২০২১


অচেনা কলরবে চমকে উঠলাম আমরা। সচকিত হয়ে তাকিয়ে দেখি গটগট করে হেঁটে যাচ্ছেন এক প্রৌঢ়, পরণে গোলাপী টি শার্ট আর নীল ট্রাউজার। পিছন পিছন রীতিমত ভিখারিনীর মত দৌড়াচ্ছেন প্রৌঢ়া, কণ্ঠে কাতর কাকুতি মিনতি, ‘ওগো যেও না। ওগো যেও না। ওগো একটু দাঁড়াও-’। হতভম্বের মত তাকিয়ে ছিলাম শ্বশুরমশাই আর আমি। সময় সকাল নটা। আজকের আবহাওয়াটা বেশ মনোরম, নরম সোনালী আদুরে একটা রোদ ক্রমেই ছায়া মেলছে ধুলিমলিন মহানগরের ওপর। গরম তেমন নেই, বরং একটা বেশ মনোরম ঠাণ্ডা হাওয়ার ঘুর্ণি মাঝে মাঝেই পাক দিয়ে উঠছে শহরটার বুক জুড়ে। ‘এমন বসন্ত দিনে, বাড়ি ফিরি মাংস কিনে’ না করে লং ড্রাইভে যেতে পারলে সবথেকে ভালো হত। ড্রাইভেই অবশ্য বেরিয়েছি আমরা, গন্তব্য শহরের এক প্রসিদ্ধ নার্সিংহোম।  


কি যেন একটা স্ক্যান করতে বলেছে ডাক্তার। তাতে সময় লাগবে ঘন্টা পাঁচেক। ভোর ভোরই বেরিয়ে এসেছি আমরা, রাস্তা পেরিয়ে কোণাকুণি দুচার পা হাঁটলেই হাসপাতাল থুড়ি নার্সিংহোম, কিন্তু ঐ টুকু পথও হেঁটে অতিক্রম করা দুঃসাধ্য শ্বশুরমশাইয়ের পক্ষে। বিগত কয়েকদিনের ঘুষঘুষে জ্বর,শ্বাসকষ্ট আর হাই ডোজের অ্যান্টিবায়োটিকের সম্মিলিত দৌরাত্ম্যে বেশ কাহিল বৃদ্ধ। গাড়ি থেকে নেমে, হাসপাতালের সামনের কেয়ারি করা বাঁধানো বাগানে বসে আছি দুজনে। শ্বশুরমশাইয়ের হাতে ফ্রুট জুসের বোতল, তাতে মেশানো আছে ওষুধ। একঘন্টা ধরে ঢুকঢুক করে খেতে হবে সবটা। তারপরও বসে থাকতে হবে পাক্কা একটি ঘন্টা, তারপর নিয়ে যাওয়া হবে স্ক্যান করতে। হাতকাটা সোয়েটার,মাথায় উলের টুপি পরে এসেছিলেন বাবা, এখন আবার গায়ে জড়িয়েছেন একটা খাদির মোটা চাদর। বাগান থেকে উঠে আসা বাসন্তী হাওয়ায় কিঞ্চিৎ  নাজেহাল বৃদ্ধ, আমি খুলে বসেছি একখান বই, সবকিছুই চলছিল বেশ জম্পেশ আচমকা এই হট্টোগোল। 


গোলাপী টি শার্ট এখন মুখের মাস্ক খুলে প্রবল চিৎকার করছেন প্রৌঢ়ার ওপর। রাস্তার ফুটপাতে দাঁড়িয়ে জমে উঠেছে রীতিমত নাটক। ফুটপাথের লাগোয়া স্বল্প উঁচু পাঁচিলের এপাশে, সুদৃশ্য বাগানে বসে বই বন্ধ করে হাঁ করে তাকিয়ে আছি আমি। কি ব্যাপার জানি না, তবে বাজে লাগছে খুব। এমন কি ব্যাপার হল যে এইভাবে নিজের স্ত্রীকে জনসমক্ষে অপমান করছে লোকটা। পাশ থেকে শ্বশুরমশাইও বললেন, ‘ছিঃ। কি সব মানুষ। ’ ভিড় জমে গেছে দম্পতিকে ঘিরে। ফুটপাথ বরাবর একটু এগিয়ে দৃষ্টির আড়ালে চলে গেছেন ওণারা,কিন্তু কানে এখনও আসছে উত্তপ্ত বাদানুবাদ। আর কতক্ষণ ঝগড়া করবে এরা? একটা লোকের মাথা ঠাণ্ডা হতে কত সময় লাগে? 

ভদ্রমহিলার জন্য মনের মধ্যে পাক খেয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে এক অদ্ভূত খারাপ লাগা। কেমন ভিখারিনীর মত কাকুতি-মিনতি করছিলেন উনি। হয়তো ডাক্তার দেখাতে এনেছিলেন স্বামীকে, এই হাসপাতালটা এমনি মন্দ না, তবে মাঝেমাঝে বড় ঝোলায়। শৌভিকের মত ঠাণ্ডা মাথার ছেলে বা উমার মত শান্ত মেয়েও একাধিকবার রেগে গেছে এদের ওপর। বাড়ির কাছে আর সবরকম টেস্ট হয় এই যা সুবিধা। 


হট্টোগোল ক্রমশঃ বাড়ছে। যারা ভিড় জমিয়েছিল দম্পতিকে ঘিরে, বুঝলাম সবাই একই পরিবারের সদস্য। এখন এক প্রৌঢ়া প্রচুর চিৎকার করছেন, বাগানের গেটের সামনে এসে। এক সিকিওরিটি আর একমহিলা গ্রুপ ডি স্টাফকে হাতপা নেড়ে ভয় দেখাচ্ছেন, ‘তোমাদের আমি দেখে নেবো। দেখ আমি কি করি-’। ট্রেনড স্টাফ এদের,রোজই চারটে লোক অমন ভয় দেখায়, তাই বোধহয় ভাবলেশহীন মুখে নিজের কাজ করে যাচ্ছে দুজনে। খুব ইচ্ছে করছে মহিলা স্টাফটাকে জিজ্ঞাসা করি, ‘ব্যাপারখানা কি?’ পারছি না শুধু পাশে বসে থাকা চাদর জড়ানো বৃদ্ধের জন্য। এমনিতে থিরথির করে কাঁপছেন, তবুও যা বিক্রম, যদি ধমকে দেন-


শৌচাগারে যেতে নিষেধ করছিল ওরা, শরীরে ফ্লুইডটা থাকলে নাকি রিডিং ভালো আসে। হেসে ফেললাম, সত্তরোর্ধ্বো কোন পুরুষকে এতটা জল খাইয়ে ওমন চেপে বসে থাকতে বলছে- এদের বুকের পাটা আছে বলতে হবে। অবশেষে রাজি হয়েছে ওরা, ‘একবার যাবেন কেমন-’। একবারই গেছেন শ্বশুরমশাই, শৌচাগার অদূরেই। দৃষ্টির অগোচর হতেই মহিলা স্টাফটাকে পাকড়াও করলাম, জানতে চাইলাম কেসটা কি? গোলাপী টিশার্টকে দেখা যাচ্ছে না বটে, তবে উত্তেজিত কথা বার্তা এখনও চলছে। বেশ অস্থির লাগছে এদের ঝগড়াঝাটির চোটে। এমন দিনে এত কলহ কেউ করে? 

আচমকা আবার বিরাট হট্টগোল লেগে গেল। উত্তর না দিয়েই দৌড়ল মহিলা স্টাফটি। হাসপাতালের মূল গেট থেকেও ছুটে গেল অনেকে। টেনে অানল চাকা লাগানো বিছানা। কি ব্যাপার হল, ব্যাগপত্র সামলে উঁকিঝুঁকি মারতে পাঁচিলের কাছে গিয়ে দেখি কাকুতি-মিনতি করা প্রৌঢ়া অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছেন ফুটপাথে। আজব ব্যাপার হাতদুটো তখনও খাড়া হয়ে উঠে আছে ওপরে- ।  


‘কোলাপস্ করে গেছে-’ অসহায় কিঞ্চিৎ  ভীত কণ্ঠে এইকথা গুলো শুনে দেখি কখন পিছনে এসে দাঁড়িয়েছেন বাবা। মুখেচোখে অপরিচিতার প্রতি টলটলে সহানুভূতি। প্রৌঢ়ার আত্মীয়স্বজন যা ঝগড়ুটে, কি আবার বলে বসে, তাই মুখ ঘুরিয়ে জানতে চাইলাম, ‘আপনার হয়েছে?’ জবাব পেলাম টয়লেটটাই খুঁজে পাননি বৃদ্ধ। 


সিকিউরিটি এক কথায় নিয়ে যেতে রাজি হল, তার সাথে শৌচাগারে যেতে যেতে বাবা বললেন ,‘এদের ব্যাপারখানা কি? কিছু জানতে পারলে-’। আর কোন চিন্তা নেই। পুরাণ মেয়েটিও আবার ফিরে এসেছে তার স্টেশনে, তাকে পাকড়াও করলাম, ব্যাপারখানা কি? মেয়েটি কেজো বিরক্তি উগরে বলল, ‘আরে ঐ যে ভদ্রমহিলা সেন্সলেস হয়ে পড়লেন না, ওণার স্বামীর একটা অপারেশন হয়েছে আজ সকালে। অপারেশনের পর বেডেও দেওয়া হয়েছে। দুজনকে দেখতে যেতে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। তাতেই এদের রাগ। এরা  সবাই দেখতে যাবে-। নিষেধ করা হয়েছে বলে এত কাণ্ড। ঐ যে মহিলা আমাকে শাসাচ্ছিল ওটা পিসি। অর্থাৎ ঐ বউটার ননদ। কি লাভ হল বলুন তো? একজন এমনিতেই অসুস্থ ছিল, এখন আরেকজনও বেঁহুশ- ’ 


তাজ্জব হয়ে গেলাম শুনে। এত সামান্য ব্যাপার নিয়ে এত অসভ্যতা? আরে কেউ হাসপাতালে ভর্তি হলে দল বেঁধে দেখতে যাওয়াটা চাটুজ্জে আর ঘোষ বাড়ি অর্থাৎ আমার বাপের বাড়ি আর দিদার বাড়ির ট্রাডিশন। তুত্তুরী জন্মের সময় হাসপাতালের ওয়েটিং রুমে শৌভিক ছাড়াও উপস্থিত ছিল আরো এগারোজন। শ্বশুরবাড়ির দিকেও যখনই শ্বশুরমশাইয়ের কোন অপারেশন হয়েছে ছুটে এসেছেন সেজো জেঠু,মণিকাকা, ছোট পিসেমশাই এমনকি নীচের ফ্ল্যাটের পট্টনায়ক কাকুও। আজই তো বাবা বলছিলেন, ‘ছুটির দিন। তুমি বাড়ি থাকো। আমি বরং পট্টনায়ককে নিয়ে চলে যাব-’।  মোদ্দা কথা, এতজন জমায়েত হন বটে, তবে হাসপাতালের নিয়ম তো কেউ ভাঙেন না। আর ও কেন দেখতে গেল, আমি কেন সুযোগ পেলাম না এই নিয়ে এমন অসভ্যতাও কাউকে কোনদিন করতে দেখিনি। এই কোভিডের বাজারে সর্বত্র ১জন করে ভিজিটর অ্যালাও করে, এরা তো তাও দুজন করেছে। 


বেলা বাড়ছে, শ্বশুরমশাইকে ভিতরে নিয়ে গেল ওরা। দরজার কাছ থেকে সোয়েটার, টুপি আর চশমাটা নিয়ে আবার বাগানে ফিরে এসেছি আমি। অজ্ঞান হয়ে পড়া মহিলার বাড়ির ঝগড়ুটে লোকজন এখন এসে জমায়েত হয়েছে বাইরের বাগানে। পিসি এখনও চেঁচিয়ে যাচ্ছে। ফোনে কাকে যেন পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে লাগাচ্ছে সব। পাশের অল্প বয়সী মেয়েটি বলতে গেল ‘একটু আস্তে’। তাকে কুৎসিত ভাবে ধমকালেন-।  


কানে হেড ফোন গুঁজলাম, স্টারট্রেকই বাঁচাতে পারে এই তিক্ত পারিবারিক দ্বৈরথ থেকে। কপাল মন্দ, স্কান ঘরের পুরুষ নার্সটি বেরিয়ে এসে জানতে চাইল, ২০১৪ সালে বাবার যে কোলনে অপারেশন হয়েছিল তার কাগজপত্র কিছু এনেছি কিনা। দস্তাবেজ তো সব বৃদ্ধ গুছিয়ে এনেছেন, কি কি আনতে হয় ভালো জানিও না। উমাই এগুলো ভালো পারে,  ভালো জানে। তবুও সব ঘেঁটে দেখতে লাগলাম। যদি এনে থাকা হয়- । কানের গোড়ায় এবার হল্লা জুড়েছে সকালের গোলাপী টি শার্ট পরা লোকটি। যার পিছনে ভিখারীর মত দৌড়েছিলেন সেন্স হারানো মহিলা। লোকটি পাকড়াও করেছে অজ্ঞান হয়ে পড়া মহিলার মেয়েকে, তারস্বরে প্রশ্ন করছেন, ‘আমার কি আসার কথা ছিল? না না আগে বলো আমার কি আসার কথা ছিল? তবুও আমি এসেছি-’। এমন দাক্ষিণ্য করার ঢঙে বললেন যে মনে হচ্ছিল উঠে ঘুরে দুটো জবাব দিই, এসে তো ধন্য করে দিয়েছেন মশাই। আপনি এসেছেন বলেই ভদ্রমহিলা এখন হাসপাতালে শুয়ে ধুঁকছেন। সবকথা তো আর বলা যায় না। আর এণার যা বিক্রম-।  


নার্স ভাইকে জানালাম, অপারেশনের কাগজপত্তর কিছু আনা হয়নি। কি হবে এখন? লোকটি দেখছি বলে উধাও হয়ে গেল-। পাশের নাটক এখন পুরোদমে চলছে, জনৈক চামচামত লোক গোলাপী টিশার্টকে তৈলমর্দন করে বলছে, ‘ঠিকই তো। তোমার তো আসার কথাই না। আমি তো অবাক হয়ে গেছি।’ অজ্ঞান মহিলার ভোম্বলমার্কা ছেলেটি কিছু বলতে গেল সবিনয়ে, গোলাপী টি শার্ট তাকে ধাক্কা মেরে সরিয়ে দিল,তারপর মেয়েটিকে বলল, ‘শুনে রাখো, তোমার মা আর তোমার এই ভাই তোমার বাবাকে মৃত্যুর শেষ সীমায় নিয়ে চলে এসেছে-’। মেয়েটি হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে করজোড়ে কিছু বলল,ছেলেটি গিয়ে লোকটির পায়ে পড়ল, ‘ অন্যায় হয়ে গেলে মাপ করে দাও। কিন্তু তুমি যেও না। বিশ্বাস করো আমি মাকেও দেখতে নিয়ে যাইনি। জানতাম মা বাবাকে ঐ অবস্থায় দেখলেই কাঁদবে-’। বাঘের মত ঝাঁপিয়ে পড়ল গোলাপী টি শার্ট, তাহলে ঐ লোকটা দেখতে গেল কি করে? আমি দেখতে পেলাম না, ও গেল কেন-’। জবাবে কি বলল ছেলেটি জানি না, দেহবিভঙ্গে বুঝতেই পারলাম বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করছে-। মেয়েটি কাঁদছে, যাদের বাবা মা দুজনেই আপাততঃ হাসপাতালে ভর্তি তাদের সাথে চরম খারাপ ব্যবহার করেও গোলাপী টিশার্টের মধ্যে ছিটেফোঁটা অনুতাপের চিহ্ন নেই।ক্ষ্যামা দিয়ে পুনরায় স্টারট্রেকে ডুব দিলাম।  এত অসভ্যতা বরদাস্ত হয় নাকি? ছেলেমেয়ে দুটি কাকুতি-মিনতি করে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে বেশ বুঝলাম। এই নাটকের শীঘ্রই যবনিকা পাত হবে হয়তো। তবে আর দেখার ইচ্ছা আমার নেই।  মনে মনে ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানালাম, বাপরেঃ ভাগ্যিস এমন আত্মীয়স্বজন আমাদের কেউ নেই। ঐ যে রাষ্ট্রভাষায় বলে না, এমন বন্ধু থাকলে আর শত্রুর কি প্রয়োজন-।


 

অনির ডাইরি ৯ই মার্চ, ২০২১


সিনেমা দেখার ভয়ানক নেশা ছিল পিসির। দোসর ছিল জ্যাঠাইমা। জ্যাঠাইমার বাপের বাড়িও যেহেতু একই মহল্লায়, পাড়ার ছেলেদের দিয়ে গোপনে খবর আনাত জ্যাঠাইমা, কোথায় কি সিনেমা এল। নবরূপমে কি এলো? আর শ্রীরূপায়? শ্যামাশ্রীতে বুঝি বাংলা বই চলছে, পার্বতীতে বাবা তারকনাথ। পুষ্পশ্রী সিনেমা হলের পাশেই গোরস্তান, নাইট শোয় নাকি আম দর্শকের পাশে বসে সিনেমা দেখেন তাঁরাও। বঙ্গবাসীতে আবার অবাঙালী লোকজন বেশী যায়, 'ভদ্দর ঘর কি লেড়কি'রা গেলে আর আস্ত রাখবে ঠাকুমা? তবুও যেত জ্যাঠাইমা আর পিসি। অনিল ধাওয়ানের কি ভয়ানক ভক্ত ছিল দুজনে। ছোট থেকে শুনে আসছি অনিল ধাওয়ান আর রাধা সালুজার সিনেমা মানেই নীল না হলেও আকাশী তো বটেই। আর জুলি? ছিঃ ছিঃ ওসব সিনেমা নিয়ে আমাদের সামনে কথাও বলা যায় না। আমার জন্মের পর, দেখাশোনার দায়িত্ব যখন স্বেচ্ছায় ঘাড় পেতে নিলো ঠাকুমা আর পিসি, সিনেমা দেখতে যাওয়ার ওপর লাগল প্রতিবন্ধ। 


সীমিত সামর্থেও মাসি রাখতে চেয়েছিল মা। রেখেও ছিল কাকে যেন। ঘুমন্ত আমায় ফেলে সে পাঁচিল ধার গিয়ে পাড়ার মাঠে ছেলেদের বল পেটানো দেখছিল নাকি। পরিণতি সহজেই অনুমেয়। মায়ের আপিসে নিয়ে যাবার চেষ্টাও করেছিল মা, ঠাকুমা তখন ঘুরিয়ে দিয়েছিল , তাঁর শাশুড়ীর ডায়লগ,‘সারাদিন বাচ্ছা আপিসে পড়ে থাকবে? বাচ্ছা কি বাপের বাড়ি থেকে এনেছো? ও বাচ্ছা আমার-’। আজও ঠাকুমার সম্বন্ধে বলতে গিয়ে কপালে হাত ঠেকায় মা। ঐ ভাবে বলেছিল হয়তো, তবে ক্ষণিকের তরেও কোনদিন দায়িত্ব এড়িয়ে যায়নি ঠাকুমা। 


ঠাকুমার নির্দেশ মত, প্রায় বুকে করে মানুষ করেছে পিসি। যৌথ সংসারের যাবতীয় দায়িত্ব,রান্না ইত্যাদি সামলেও খেয়াল রেখেছে আমার। আমার জন্য বেশ কিছুদিন বন্ধ হয়ে যায় পিসির সিনেমা দেখা। তারপর যখন হাঁটতে শিখলাম, ঠাকুমার অসাক্ষাতে আমাকে ট্যাঁকে নিয়েই নবরূপমে সিনেমা দেখতে গিয়েছিল পিসি। একটা পুঁটলিতে সামান্য ন্যাকড়া চোপড়া আর খিদে পেলে খাবার জন্য কাঁচের বোতলে দুধ এই নিয়ে পিসি গেল সিনেমা দেখতে। গিয়ে দেখে সুপার ফ্লপ সিনেমা। দুপুরের শো পুরো ফাঁকা। একা পিসি আর দোসর আমি আর অদূরে হলের ঝাড়ুদারনি। তাই সই, কোল থেকে নামিয়ে দিল পিসি- হাতে ধরিয়ে দিল দুধের বোতল আর গোটা সিনেমাটা নাকি আমি অন্ধকারে প্রতিটা সিটে হাত বুলিয়েই কাটিয়ে দিলাম। সমস্যা হল ক্লাইম্যাক্সে, হিরো যেই ঘুঁষি চালাল ঢিস্যুম,অমনি আমি ঘুমিয়ে কাদা।ঈশ্বরের দয়ায় চিরকালই হৃষ্টপুষ্ট, পুঁটলি সমেত, ঘুমন্ত ভারী আমাকে কি ভাবে যে পিসি সেদিন বাড়ি এনেছিল এ গল্প প্রতিবার গিয়েই শুনতে হয়। যেমন শুনতে হয়, সরগম দেখতে গিয়ে সোনার দুল হারিয়ে এসেছিল পিসি। সৌজন্য সেদিনের আমি। শুনতে হয় কি যেন এ মার্কা হিন্দি সিনেমা দেখতে গিয়ে, দিদিভাই থাকায় জ্যাঠাইমা আর পিসিকে আটকে দিয়েছিল পুলিশ। দিদিভাইয়ের বয়স তখন তুত্তুরীর বয়সী, ছিলও তুত্তুরীর মত বোকচন্দর। পুলিশকে বলেছিল,‘না গো পুলিশ কাকু, আমার অনেক বয়স-১৭/১৮/১৯/২০ বছর।’ জবাবে পুলিশ  কাকু বলেছিল নাকি, ‘চুপ কর ডেঁপো মেয়ে-’। ডেঁপো মেয়েটার অবশ্যি তাতে কিচ্ছু যেতো আসত না, তিন চার বছর বয়স থেকে বাবা আর ছোটকাকুর সাথে নকশালদের মিটিংএ গিয়ে বসত দিদিভাই। মিটিং শেষে, উঠোনে জমায়েত বাড়ির লোকেদের অবিকল বয়ঃজ্যেষ্ঠ বক্তাদের নকল করে শোনাত মিটিং এর গল্প- ‘তারপর সন্তোষ দা বলল----। জবাবে বনবেহারী দা বলল----। তখন মেজোকাকু বলল----’। সন্তোষ দা আর বনবেহারী দা ছিলেন ডাকসাইটে নকশাল নেতা আর মেজোকাকু আমার বাবা। বাড়িতে যেবার পুলিশের রেড হল, খালি গায়ে একটা চাড্ডি পরে, বাঁশের কঞ্চির ডগায় একটা লাল জাঙিয়া টাঙিয়ে পুলিশের নাকের ডগায় ঘুরছিল দিদিভাই- তবে সে তো অন্য গল্প। 


বয়স বাড়ার প্রধান লক্ষণই বোধহয় স্মৃতিমেদুরতা। কোথা থেকে কোথায় চলে যায় মানসিক তরঙ্গ। বয়স বাড়ে, সময় টপকে নামে এক প্রজন্ম থেকে অন্যে। বদলে যায় কতকিছুই, সমাজ, দেশ, পরিপ্রেক্ষিত, মানসিকতা- বদলায় না শুধু ভালোবাসা। বয়স আর ওজন যতই বাড়ুক, পিসির ভালোবাসা আজও অবিকৃত, নির্ভেজাল,১০০শতাংশ খাঁটি এবং ভয়ানক ভয়ানক দুর্লভ।


অনির ডাইরি ৪ঠা মার্চ, ২০২১

'আমি তোমার কথা বলব কাকে'-


এটা তিলীদের বাড়ি, ওটা সদগোপদের, কড়ুরীদের বাড়ি, সোনার বেনেদের বাড়ি, গয়লাদের বাড়ি, এটা গোপালে বস্তি আর ঐটা বনমালী বস্তি- এই ভাবেই পরিচিত ছিল বাড়িগুলো। পুরোনো পাড়া আমাদের, সববাড়িই নিদেন পক্ষে শতেক বছরের বুড়ো। পাড়া জুড়ে ঘুরে বেড়াত নরম গরম হাওয়া। নকী পিসির বাবা, লাঠি ঠুকঠুক করে হেঁটে বেড়ানো বুড়ো বনমালী ঢ্যাংকে বলা হত বস্তির রাজা। আমরা জানতাম সোনার বেনেদের বাড়ির মেয়েরা অপরূপ সুন্দর হয়, কাঁচা হলুদ রঙা ত্বক, মা দুর্গার মত মুখশ্রী আর গোলগাল গড়ন। ওদের বাড়িতে সোনা নাকি কিলো দরে থাকে- আমরা অবশ্য বাড়ি গুলোকে চিনতাম অন্য নামে, এটা রক্ষেদার বাড়ি, ওটা মৌরি আর তন্দ্রাদিদের। কড়ুরীদের ছিল যমজ বাড়ি, জোড়া বাড়ির উঠোনে ঘুরে বেড়াত বিশাল হোঁৎকা ডোবারম্যান। হাল্কা বিস্কুট রঙা কুকুরটা দৈর্ঘ্যে প্রস্থে ছিল একখানা বাছুরের সমান, শুধু ল্যাজের জায়গায় ছিল ছোট্ট একটা কুণ্ডুলী। বিশাল গেটের ফাঁক দিয়ে নাকটা গলিয়ে যমদূতের মত রাস্তা দেখত সে, পাড়ার নেড়িরা দল বেঁধে যেত ঝাড়ি মারতে। এতজন তপ্ত অনুরাগিনীর রঙ ঢঙ নখরায় বিন্দুমাত্র প্রভাবিত হত বলে মনে হয় না। কেমন যেন তাচ্ছিল্য ভরা উদাস চোখে তাকিয়ে তাকত - 


সেসব দিনকাল ছিল সন্ধ্যে নামলেই আমতেল দিয়ে মুড়িমাখার, দিনকাল হলুদ বাল্বের আলো আর সাদাকালো টেলেরামা টিভির। বুধবারে চিত্রহার আর বৃহস্পতিবারে চিত্রমালার। দিনকাল ছিল জ্যাঠাইমার উনুনের ধোঁয়া আর ভোর ভোর আকাশবাণীর অমৃত সুরের। দিনকাল ছিল গরম কালে কালবোশেখী আর তার ছিঁড়ে যাবার-। সদ্যস্বাক্ষর আমায় পড়াতে এলেন তিলিদের বাড়ির বউ, আমার দিদিমণি। বনেদী বাড়ির বউ, শুনেছি ওণার শ্বশুরমশাইয়ের ছিল বিশাল মুদিখানার দোকান। শ্বশুরের উপার্জন দেখেই বিয়ে দেওয়া হয়েছিল দিদিমণির। ব্যাঁটরা পাবলিক লাইব্রেরির গণ্ডি ছাড়িয়ে, একরাশ বন্ধু হারিয়ে, কান্নাকাটি করে জ্বর বাঁধিয়ে সদ্য ভর্তি হয়েছি তারাসুন্দরী বালিকা বিদ্যাভবনে।  এতদিন মা’ই পড়াত। আপিস ফেরৎ উত্তমমধ্যম সহকারে খানিক পড়ানোর পর মিলত ছুটি। তখন সামান্য সময়ের জন্য অনুমতি মিলত মাকে পড়ানোর। সেই যে সেদিন, ঈশ্বরচন্দ্রের চিত্রখচিত চটি বর্ণপরিচয়ের উ শেষ করিয়েছে মা। এবার মায়ের পালা ঊ পড়ার। মা পড়ল, ‘ভ য়ে ঊ ত, ভূত’। বাবা গো! সটান মায়ের কোলে আমি। পশ্চিমের জানালার ওপারে অন্ধকার ঝাঁকড়া পেয়ারাগাছে পা দুলিয়ে ছিলিম টানা বেহ্মদত্যির সে কি হাসি- 


দিদিমণি কোনদিন গায়ে হাত তোলেননি। অথচ তখন ছাত্র ঠ্যাঙানো ছিল শিক্ষক শিক্ষিকাদের গণতান্ত্রিক অধিকার। বাবামায়েরাই বলত, ‘বেশটি করে ঠ্যাঙাবেন তো মাস্টারমশাই/দিদিমণি। জলবিছুটি দিয়ে দেবেন এক্কেবারে।’ দিদিমণির ওসব ছিল না, বকতেন প্রচুর, পড়াতে পড়াতে মায়ের সাথে জুড়ে দিতেন সুখদুঃখের গল্প। বাল্বের আলো ঠিকরে আসত ওণার হাতের তুবড়ে যাওয়া সোনার আংটি থেকে, যার ওপরে মিনাকারিতে লেখা ছিল ,‘পুষ্পরাণী’। হাজার অভাবেও গয়না বেচেননি দিদিমণি। এটাই নাকি তিলী বাড়ির বৈশিষ্ঠ্য। অভুক্ত থাকলেও বাস্তু আর সোনা বেচেন না ওণারা। এতো বুঝতাম না,তবে প্রত্যেক সপ্তাহে একবার জানতে চাইতাম কি কি গয়না আছে ওণার- 


শরৎচন্দ্রের লেখার অসম্ভব অনুরক্ত ছিলেন। ওণার মুখে শুনে শুনে অর্ধেক গল্প, চরিত্রের নাম মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল ক্লাশ থ্রি ফোরেই। মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল সাদাকালো যুগের অগণিত বাংলা সিনেমার ডায়লগ আর ঘটনাবলী। সে সব ছবির বোধহয় আর প্রিন্টও অবশিষ্ট নেই আজ। 


বয়স বাড়ার প্রধান লক্ষণই বোধহয় স্মৃতিমেদুরতা। বর্তমান চরম সুখে জবজবে থাকলেও মন ঘুড়ি হয়ে যায় অতীতের চিলেকোঠার জানলা গলে, উড়ে যায় ‘চৈত্রের রৌদ্রের উদ্দাম উল্লাসে’। মেয়েকে দেখাতে বসা ঝাপসা যমালয়ে জীবন্ত মানুষের ডিজিটাল প্রিন্টের আড়াল থেকে বকে যায় কবেই মুছে যাওয়া জীবনের সাদাকালো কোন অধ্যায়। চন্দনগন্ধী ধূপের সুবাসে গুলে যায় কয়েকদশক আগে সদ্য বনেদী বাড়ির চৌকাঠ ডিঙানো এক অভাবী অথচ আত্মাভিমানী গৃহবধূর কাতর অনুরোধ, ওণার বর ধূপকাঠি বাঁধতেন, যদি দু এক প্যাকেট কেনে কেউ।  ধুতি পাঞ্জাবি পরিহিত ঈষৎ নুব্জ দাদামণি স্বয়ং আসতেন ধূপের গোছা নিয়ে- একটু বেশী করে জ্বালানো ধূপের সুবাসে ম ম করত বাড়িটা সকাল- বিকেল।


নাঃ তুত্তুরীর এখনও কোন দিদিমণি নেই, এখনও মায়ের কোলে বসে ‘ভ য়ে ঊ ত’ পড়ার স্তরেই আছে তুত্তুরী। অগোছালো আপিস- সংসার, কিছুই ঠিকমত সামলে উঠতে পারি না, পারি না ভালো পড়াতে, তবে ভালো লাগে ভীষণ। মেয়ের সাথে নতুন করে শিখতে- নতুন করে পা ফেলতে- কবে শিখেছিলাম সব, মনে হয় যেন বিগতজন্মের কথা। নাম বদলে ফেললেও দিব্যি চিনতে পারি, সেই মান্ধাতার যুগে শেখা লসাগু আর গসাগু। নতুন করে শিখি বায়ুতে তিনভাগ নাইট্রোজেন আর একভাগ অক্সিজেন। সেই যে সেবার বড়দার সঙ্গে হাতেকলমে পরীক্ষা করতে গিয়ে ফাটিয়ে ছিলাম মায়ের কাঁচের গ্লাস। আবার ভাঙি নতুন করে, সঙ্গে এবার নতুন দোসর। মা হবার এটাই তো সুবিধে- নতুন করে ফিরে পাওয়া যায় ফেলে আসা সাদাকালো জীবনটাকে। প্রিয় অতীত, তোমায় আমি হারাইনি, আমার ভবিষ্যেতর মধ্যেই লুকিয়ে থাকো তুমি, ফিরে ফিরে আসো প্রতিটা বাঁকে, আরোও অনেক অনেক ভালোবাসা নিয়ে-  জুগিয়ে যাও বেঁচে থাকার রশদ।